ঊনষাট
ভবনের পেছনের করিডোরে অপেক্ষা করছে জাপানি পুলিশ সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট উবোন হিমুরার নকল। ভাবনার সুযোগ নেই, তবে প্রসেসর ভালই জানে, গোলাগুলির পর একটু দূরের ওই দরজা বন্ধ করবে সিকিউরিটির লোক।
তার আগেই সে যাবে পার্কিং লটে। একইসময়ে পৌঁছবে অন্য দুই রোবট। গাড়ি তৈরি, দেরি হবে না এই এলাকা থেকে সরে যেতে।
আপাতত মানুষকে অনুকরণ করছে হিমুরার রোবট। পায়চারি বাদ দিয়ে পরখ করল দরজা খোলা কি না। অপটিকাল প্রসেসরে ধরা পড়ল, পেছন থেকে আসছে দুই পরিষ্কার কর্মী। পরনে একই ইউনিফর্ম। দ্বিতীয় প্রোগ্রামের মাধ্যমে রোবট বুঝল, এরা বিপজ্জনক নয়। তৃতীয় প্রোগ্রামের কল্যাণে ওদের দিকে চেয়ে হাসল সে, মৃদু বাউ করল।
একইসময়ে আরেক অ্যালগোরিদমের কারণে স্ক্যান করল লোকদু’জনের চেহারা। তখনই প্রসেসর বুঝল, মেমোরিতে আছে ওই দুই মুখ। তবুও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল না নকল হিমুরা। মাথার ক্যাপ এত নিচু করে রেখেছে লোকদুটো, পুরো নিশ্চিত হওয়া কঠিন।
তাদের তরফ থেকে হামলা হচ্ছে না জেনে, অটল প্রহরীর মত আগের জায়গায় থাকল রোবট। কাজ করছে মানুষ অনুকরণের প্রোগ্রাম। ওখানে লেখা আছে, ঠিক কতক্ষণ পর ফেলবে চোখের পাতা বা হাঁটতে হবে। এত প্রোগ্রাম চালাতে গিয়ে সামান্য ধীর হয়েছে হিমুরা-রোবট। একবার কর্মীদের দেখে নিয়ে তিন সেকেণ্ড পর চোখ সরিয়ে নিল সে। বাম কনুই ওপরে তুলে ডানহাতে খুলতে লাগল কবজির বোতাম।
রোবটের অপটিকাল সেন্সর সম্পূর্ণ মগ্ন বাম কবজির দিকে। সময় গুনছে সিপিইউ। ধারণা নেই কী হচ্ছে।
কিন্তু সবই ঘটছে প্রোগ্রামের অগোচরে।
সত্যিকারের মানুষকে নকল করে হাতা গুটিয়ে নিল রোবট। বড় করে দম ফেলে তাকাল দরজার মাঝের ছোট্ট জানালার দিকে। আর তখনই চোখা কিছুর গুঁতো খেয়ে ঝাঁকি খেল সেন্সরগুলো। ফুটো হয়েছে নিতম্বের প্যাডিং! কাজ করল আত্মরক্ষামূলক প্রোগ্রাম। ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াতে গেল নকল হিমুরা। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পিস্তলের দিকে। কিন্তু বাঁট ধরার আগেই থামল প্রতিটি প্রসেসর। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল রোবট।।
রাবারের গ্লাভ পরা হাতে ওটার নিতম্বের প্যাডিং থেকে পিন খুলল রানা। ওই পিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তামার তারের কয়েল। ওটা থেকে গেছে পুরো এক শ’ ফুট দূরে সরু বৈদ্যুতিক কর্ড। সেটার শেষমাথা ঢুকেছে সকেটে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সোহেল।
রোবটের পেছনে রানা পিন ফুটিয়ে দেয়ায় বাকি কাজ করেছে জাপানিস ইলেকট্রিকাল সিস্টেম। তৈরি হয়েছে সাইক্লিক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড।
ব্যথা পেয়ে চমকে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি রোবট। ছিল না আগুনের ফুলকি। জ্যাম ধরে যায়নি কোনও কলে। স্রেফ বিদ্যুৎ চলে যাওয়া কমপিউটারের মত শাট ডাউন করেছে ওটা। বিকল হয়েছে শক খেয়ে। বড় কোনও ক্ষতি হয়নি, তবে সিপিইউ থেকে মুছে গেছে সব প্রোগ্রাম।
ম্যানিকিনের মত দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। ওটার চোখের সামনে হাত তুলে দেখল রানা।
নড়নচড়ন নেই।
কর্ড গোটাতে গোটাতে প্রায় দৌড়ে এল সোহেল। ‘কী বুঝলি?’
‘মাথাটা খারাপ হলেও তুই জিনিয়াস,’ প্রশংসার সুরে বলল রানা। ‘কিন্তু আবারও যদি জেগে ওঠে? পিটিয়ে হাড্ডি গুঁড়ো করে দেবে দু’জনের।
‘যে বেমক্কা শক খেয়েছে, সিপিইউ চালু হলেও দরকারি প্রোগ্রামিং ফাইলের অভাবে এই হিমুরা এখন শিশু।’..
‘থামাতে হবে আরও দুটোকে,’ বলল রানা, ‘পেছনের যে স্ক্লসিটে এসব ইউনিফর্ম পেয়েছি, ওখানে নিয়ে চল এটাকে। হাতে এখনও অনেক কাজ।’
.
জাপানি প্রাইম মিনিস্টার তাঁর রেলগাড়ির সমান দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল লো হুয়াং লিটন।
এবার শুরু হবে সত্যিকারের খেলা।
এল বারোটি দামি কলম। ডেস্কে রাখা হবে একের পর এক ছয় কপি চুক্তিনামা। প্রতিটির কপি সইয়ের পর নেয়া হবে নতুন কলম।
পঞ্চম কপি সই হওয়ার পর চিনা দূতের হাত ফস্কে পড়ে গেল কলম। ঢুকে গেছে টেবিলের তলে। একইসঙ্গে ঝুঁকে কলম তুললেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী ও চিনা দূত।
হাসি-হাসি মুখে বললেন প্রধানমন্ত্রী, ‘একেই বলে সহযোগিতা।’
খুশি মনে হেসে ফেলল দর্শকরা।
পঞ্চম চুক্তিনামা সই হওয়ার পর টেবিলে দেয়া হলো ষষ্ঠ চুক্তিনামা।
থরথর করে কাঁপছে তার হাত, টের পেল লো হুয়াং। নিশ্চিত হতে ঝট্ করে তাকাল ভিড়ের দিকে। অনেক কাছে চলে এসেছে নকল রানা। ধাক্কা দিয়ে কয়েকজন সাংবাদিককে ঠেলে সরিয়ে পৌছে গেল মঞ্চের খুব কাছে। এবার ঝট্ করে বের করবে পিস্তল। কিন্তু গণ্ডগোল বেধে গেছে!
‘না! আয়-হায়!’ ফিসফিস করল হুয়াং। ‘না!’
চুক্তিনামার কাগজে কলম নামালেন প্রধানমন্ত্রী। ঝটকা দিয়ে সামনে বাড়ল নকল মাসুদ রানা। তার ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে এক ফোটোগ্রাফার। চিৎকার করে উঠল রোবট: ‘জাপান কখনও চিনের বন্ধু হবে না!’
পিস্তল তুলেই গুলি করল রোবট, কিন্তু ঠিক তখনই ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কেউ। সে সিকিউরিটির কেউ নয়। আসল মাসুদ রানা! পর পর চারটে গুলি করল রোবট। তবে নল নিচু হওয়ায় বুলেট বিঁধল মঞ্চের নিচের পাটাতনে। ভীষণ ভয়ে পালাতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ।
নিজ চোখকেও বিশ্বাস করতে পারল না হুয়াং। মুহূর্তের জন্যে বরফের মূর্তি হলো সে, পরক্ষণে ঘুরেই দৌড় দিল দরজার দিকে।
.
পেছন থেকে রোবটের পিঠে পিন গেঁথে দিয়েছে রানা। কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি ওটার। হাতের প্রচণ্ড এক ঝটকা দিয়ে রানাকে ছিটকে ফেলল নকল রানা।
পাখির পালকের মত কয়েক ফুট উড়ে কয়েকটা খালি চেয়ারের ওপর গিয়ে পড়ল রানা। ঘুরেই আবারও গুলি করল রোবট। কিন্তু ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে ফেলেছে তাঁর সিকিউরিটি ডিটেইলের সবাই। সরিয়ে নেয়া হচ্ছে তাঁকে। পর পর তিনটে গুলি ফেলে দিল সিক্রেট সার্ভিসের তিন এজেণ্টকে। চতুর্থজন পাল্টা গুলি করলেও পরের গুলি খেয়ে পড়ে গেল সে।
উঠে হাতের পিনের দিকে তাকাল রানা। ঠিক সময়ে বেঁকে বসেছে জিনিসটা। নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়ার সময় কারও পায়ে লেগে সকেট থেকে খুলে গেছে কর্ড।
একটা চেয়ার তুলে রোবটের পিঠে ভাঙল রানা।
ভারসাম্য হারাল মেশিনটা। তবে মাটিতে পড়ল না, ঘুরেই রানার পেটে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসাল। উড়ে গিয়ে এক ক্যামেরার ট্রাইপডের ওপর পড়ল রানা। সব ভেঙে হুড়মুড় করে নামল মেঝেতে।
আবারও ঘুরে গুলি করল রোবট। এবার প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল দিয়েছে সাধারণ কেউ। একপাশ থেকে তাঁকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে সে। নিজের দেহে নিয়েছে বুলেট।
রোবটের সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে না, ভাল করেই জানে রানা। উঠে কর্ডের প্লাগ খুঁজে নিল ও। কয়েক পা সরে প্লাগটা গুঁজে দিল এক টিভি ক্যামেরার আউটলেটে।
প্রধানমন্ত্রীর বুকে গুলি করবে বলে সামনে বাড়ছে রোবট। মঞ্চের দিকে দৌড়ে গেল রানা। পিন গেঁথে দিল রোবটের শিরদাঁড়ায়।
বেকায়দা ভঙ্গিতে থামল রোবট। কাজ করছে না সিপিইউ। ভারসাম্য হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল যন্ত্রমানব। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আবারও শক দিল রানা।
এদিকে বিশাল ঘরে ঢুকেছে পুলিশ ও প্যারামিলিটারি ইউনিট। রানাকে ঘিরে ফেলল কয়েকজন। রোবটের ওপর থেকে হ্যাঁচকা টানে তুলে দাঁড় করাল। ঘুরে চেয়ে থমকে গেল তারা। রানা আর মেঝের লোকটার চেহারা একই! জীবন্ত লোকটাই ঠেকিয়ে দিয়েছে হামলা, নইলে গুলি খেয়ে মরতেন প্রধানমন্ত্রী।
ব্যাখ্যা দেয়ার সময় রানার নেই। পিনের খোঁচা দিয়ে রোবটের ঘাড়ের ত্বক ছিঁড়ল ও। এক টানে চড়চড় করে তুলে নিল মেশিনের মুখের চামড়া। কাঁচের চোখ চেয়ে রইল ফাঁকা দৃষ্টিতে।
তবুও রানার ওপর থেকে সন্দেহ দূর হওয়ার কারণ নেই। কয়েকজন পুলিশ ঘিরে রেখেছে ওকে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল তাদের গাড়ির দিকে।
কিন্তু তখনই বলে উঠল কে যেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও!’
মুখ তুলে তাকাল রানা। এইমাত্র খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকেছেন পুলিশ সুপারইন্টেণ্ডেণ্ট হিমুরা। তাঁকে দেখে রানার মনে হলো কবর থেকে উঠেছে ফ্যাকাসে মুখের কোনও লাশ। পরনে এখন অফিশিয়াল পুলিশের জ্যাকেট।
‘এত মার খাওয়া চেহারা না দেখলে ভাবতাম আপনি ও রোবট,’ বলল রানা।
‘রোবট হলে এত ব্যথা থাকত না,’ বললেন অফিসার। মৃদু হাসল রানা। ‘আপনি কখন এলেন?’
‘এসেছি একটু দেরিতে।’ রানাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন হিমুরা। ওরা দু’জন উঠে পড়ল মঞ্চে। বিশাল ঘর থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে। হাজির হয়েছে প্যারামেডিকরা। সিকিউরিটি টিম আর সিভিলিয়ান মেয়েটাকে চিকিৎসা দিচ্ছে তারা।
মেয়েটার পাশে বসে নরম সুরে ডাকল রানা, ‘হিনা।’ প্রধানমন্ত্রীর সামনে ঝাঁপ দিয়ে পিঠে গুলি খেয়েছে বেচারি। বিড়বিড় করল, ‘আমি তো আগেই বলেছি, ভালই লড়তে পারি।
‘ফুটো হয়েছে ওর ফুসফুস,’ জানাল এক প্যারামেডিক। ‘বাঁচবে। দেরি না করে নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে।
‘দেরি করবেন না,’ তাড়া দিলেন হিমুরা।
তুলে দেয়া হলো হিনাকে স্ট্রেচারে। ক’জন মিলে নিয়ে গেল অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতে।
‘নিশ্চয়ই সাঁতরে আসেননি?’ জানতে চাইল রানা।
‘ভোরের পর এক জেলে-নৌকা পেয়ে ওটা নিয়ে সৈকতে এসেছি,’ বললেন হিমুরা, ‘থামিনি কোথাও। কিন্তু আইডি তো কেড়ে নিয়েছে, তাই পথে ব্যাখ্যা দিতে দিতে এত দেরি হয়ে গেল। মঞ্চের কাছে আসার আগেই শুনলাম গুলির আওয়াজ। দৌড় শুরু করলেও আমাকে পেছনে ফেলে দিল হিনা।’
‘সাহসের কাজ করেছে,’ বলল রানা। ‘কথা দিয়েছিল বাঁচাবে ডক্টর শিমেষুকে। সেটা পারেনি, কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেছে আমাকে বাঁচাতে। আর পরে প্রধানমন্ত্রীকে।’
‘সাহস আছে মেয়ের,’ বললেন হিমুরা।
মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘এবার ঠেকাতে হবে লো হুয়াং লিটনকে। কাজ শেষ হয়নি।’
‘হ্যাঁ, একবার চিনে ফিরলে আর কখনও তার টিকি দেখব না।’
‘ভাববেন না,’ বলল রানা, ‘ধরা পড়বে।’