বায়ান্ন
আধুনিক এক ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল। খুলে নেয়া হয়েছে ওর বুট। ঘরের মেঝে চকচকে লোহা বা ইস্পাতের তৈরি। পায়ের স্পর্শে মনে হচ্ছে ওটা বরফের মত শীতল। ছাতে কিছু উজ্জ্বল বাতি। চোখ সইয়ে নিচ্ছে ও। কুঁচকে ফেলেছে ভুরু।
‘কী তোমার নাম?’ গোপন স্পিকারে এল প্রশ্ন।
কণ্ঠস্বর চিনল সোহেল। চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাবা সাবেলা। লো হুয়াং লিটনের ডানহাত। ঘরের চারপাশ দেখল ও। প্লাস্টিকের চার দেয়ালে ঝুলছে ওয়ান-ওয়ে সব আয়না।
‘নিজের নাম বলো, নইলে ক্ষতি হবে তোমার।’
প্রতিটি অ্যাংগেল থেকে রেকর্ড হচ্ছে, বুঝল সোহেল। ওয়ান-ওয়ে আয়নার ওদিকে ক্যামেরা। তোলা হচ্ছে থ্রি- ডিমেনশনাল মেযারমেন্ট, সঙ্গে চলছে ডিজিটাইযিং। রানার মতই তৈরি হবে ওর রোবট। কারণ পরিষ্কার। চিচিওয়া বলে ফেলেছে, ওর রোবট কাজ শেষ করলে ওদেরকে মেরে ফেলবে সে।
হেরে যেতে রাজি নয় সোহেল। ঠিক করেছে, নিজ ইচ্ছেয় স্বাভাবিক কথা বলবে না। প্রতিটি কথা ডিজিটাল করে রিমিক্স শেষে তৈরি হবে নতুন বাক্য। এমন কী শত্রুর সঙ্গে তর্ক করলে বা গালি দিলেও সেটা উপকারে আসবে তাদের।
‘নাম বলো!’ কড়া সুরে বলল সাবা সাবেলা।
কিছু না কিছু বলতে হবে। নাকি সুরে শুরু করল সোহেল, ‘আন্নে আঁরে ইতান কী যিঙ্গান, বাঁউ? আঁরে ডিনার খাওয়াইবেন নি? আফনের বাফে হুয়াং কইসিলো…’
চিফ ইঞ্জিনিয়ার বুঝে গেছে মস্করা চলছে তার সঙ্গে। সোহেল কথা শেষ করার আগেই এল প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক শক। থরথর করে কাঁপতে লাগল সারাশরীর। ব্যথা এতই তীব্র, তাল হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল সোহেল।
‘এর পরেরবার দ্বিগুণ সময় নিয়ে শক দেব,’ শান্ত গলায় জানাল সাবেলা। ‘এবার দেরি না করে উঠে নিজ নাম বলো।’
যতটা পারা যায় ধীরেসুস্থে উঠল সোহেল। বুঝে গেছে, তাড়া আছে এদের। কাজেই নষ্ট করতে হবে সময়।
এক সেকেণ্ড পর এল আরেকটা শক। শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে গেল ব্যথা। আড়ষ্ট হলো মাংসপেশি। নিজেকে সামলাতে গিয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে ফেলেছে সোহেল। পাকা তালের মত পড়ল মেঝেতে। শক কেটে যেতেই বড় করে শ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে, ঘুরে এসেছে নরক থেকে।
‘উঠে তোমার নাম বলো,’ জানাল ধৈর্যের প্রতিমূর্তি চিফ ইঞ্জিনিয়ার।
কুঁজো হয়ে উঠে দাঁড়াল সোহেল। ভাবছে, নে, শালা, এবার রেকর্ড কর কুঁজো আমাকে। মুখ তুলে কাটল ভয়ঙ্কর ভেঙচি। বাঁদরও ওটা দেখলে লজ্জায় মুখ ঢাকত— যা, শালা, কিছুই শিখলাম না সারাজীবনে!
ক্যামেরার দিকে ঘুরে সৌদি আরবের নর্তকীদের মত কোমর ও নিতম্ব দুলিয়ে নর্তন-কুর্দন শুরু করল সোহেল। সেইসঙ্গে বিকট, বেসুরো গলায় নামকরা বাঙালি পপ গায়ক আজম খানের গান: ‘আরে, আলালো-দুলাল… আলালো- দুলাল… তাদের বা…বা… হা…জি…চা…ন, চাঙ্খার পুলে প্যাডেল মেরে…
‘অ্যাই! অ্যাই, চোপ!’ কড়া ধমক দিল সাবেলা। ‘তোমার নাম বলো!’
গান ও নাচ থামিয়ে অভিমানে গাল ফোলাল সোহেল। ‘আঁরে, বাঁউ, আঁর নামডা দি কী কইরবা? ঠিআসে, আঁর নাম গিরিসের দা গেরেট ইস্কান্দার মিয়া!’ পরক্ষণে ঝেড়ে দিল বরিশালের খাস ভাষা: ‘ওরে মোর আল্লা, মোরে সেনো না, হামি অইলাম গিয়া করিম আলী খোন্দকার, তুমার আফন দুলাবাই!’
কথা শেষ হতে না হতেই এল শক। এবার আরও অনেক জোরালো। মেঝেতে পড়ে পানি থেকে তোলা মাছের মত ছটফট করতে লাগল সোহেল। আবছাভাবে ভাবছে, চাইলেও ওকে খুন করতে পারবে না এরা। আগে চাই নকল জিনিস!
পুরো বিশ সেকেণ্ড পর থামল শক। কাঁপছে সোহেলের প্রতিটা পেশি। কনকন করছে দাঁত থেকে শুরু করে পায়ের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত। হাড্ডি-মাংস গলে যাচ্ছে কি না আল্লা- মাবুদ জানে!
‘আমরা হিসাব কষে দেখেছি, কতটা সময় ধরে শক দিলে বড় ক্ষতি হবে না,’ চিবিয়ে চিবিয়ে জানাল সাবা সাবেলা। ‘চাইলে সারারাত এটা চালাতে পারো। ঠিক আছে, এবার উঠে দাঁড়াও। নাম বলবে, তারপর পড়বে দেয়ালে ফুটে ওঠা প্যারাগ্রাফ।’
দেয়ালে ফুটেছে কালো প্যারাগ্রাফ, আবছা দৃষ্টিতে দেখল সোহেল। ধীরে ধীরে উঠে বসল, যেন পরাজিত। বুঝতে চাইছে, কতক্ষণ নির্যাতন সহ্যের পর খুন হবে। ভাল করেই জানে, প্রাণ থাকতে তৈরি হতে দেবে না ওর রোবট।
.
দেয়ালে শক্ত করে পা রেখে, জং ভরা পাইপে দু’হাত রাখল রানা, নামতে লাগল অন্ধকার কূপে। মাত্র দশ ফুট নিচেই লোহার বৃত্তাকার ক্ল্যাম্প। ওটার জন্যে আর নামতে পারবে না ও।
তবে ক্ল্যাম্প ঢিলা হয়েছে গত ষাট বছরের প্রাকৃতিক অত্যাচারে। শেকল পরা দু’হাত সামনে-পেছনে নিয়ে বাধা উপড়ে নিতে চাইল রানা। দেড় মিনিট পর মট্ করে ভাঙল ক্ল্যাম্প।
হাতের শেকল ওটা পার করিয়ে নেমে চলল রানা। পরের ক্ল্যাম্প জং-এ ভরা, মুচমুচে। শেকল দিয়ে সামান্য চাপ দিতেই মট্ করে দু’টুকরো হলো জিনিসটা।
সাবধানে নামছে রানা। নিচের দিকে বাড়ছে পাইপের জং- এর পরিমাণ। ঘষা লাগতেই জং থেকে পড়ছে লালচে তুষারের মত কণা। জায়গায় জায়গায় পাইপের গায়ে ফাটল, সেখানে আটকা পড়ছে শেকল।
এত দীর্ঘ হয় না কোনও পাইপ। নিশ্চয়ই মাঝে আছে কানেক্টর। ওটা খুঁজছে রানা। অভিজ্ঞতা থেকে ভাল করেই জানে, আগে জং ধরবে সংযুক্ত করার অংশে। সবচেয়ে দুর্বল হবে ওই জায়গা।
ওপর থেকে ঝরঝর করে ঝরছে বৃষ্টির পানি। নিচে সাগরের পানি উঠে আসছে জোয়ারের কারণে। রানা আশা করছে, একটু পর পাবে পাইপের দুর্বল অংশ। দেখে হয়তো মনে হবে ওটা ঠিক আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেছে পচা গাছের কাণ্ডের মত।
কানেক্টর খুঁজছে রানা, হঠাৎ করেই ওর পা ঝুপ করে নামল পানিতে। পিছলে তলিয়ে গেল অন্ধকার কূপের জলে। খড়-খড় শব্দে পাইপ ঘষে নেমে চলেছে শেকল। আরও কয়েক ফুট যেতেই রানার আঙুলে লাগল পাইপের খসখসে এক অংশ। বুঝে গেল, পেয়ে গেছে ঠিক জায়গা। জং-এর এবড়োখেবড়ো অংশে শেকল বসিয়ে পরক্ষণে হ্যাঁচকা টান দিল রানা।
মড়াৎ শব্দে ভাঙল পাইপের নিচের অংশ। তাতে মুক্ত হলো না রানা। কাটল না বিপদ। পাইপে করাতের মত করে শেকল চালাল ও। খসে পড়ছে জং-ধরা লোহার টুকরো।
হঠাৎ করেই পাইপ ভেঙে বেরিয়ে এল শেকল।
ফুরিয়ে এসেছে দম, সাঁতরে উঠতে লাগল রানা।
কয়েক মুহূর্ত পর ভুস্ করে ভেসে উঠে বুক ভরে টেনে নিল বাতাস। তাকাল ওপরে। ওদিকের বৃত্তাকার জায়গা থেকে আসছে মৃদু আলো।
চল্লিশ ফুট ওপরে মুক্তি!
.
রেকর্ডিং বুথে সোহেলের ইন্টারোগেশন দেখছে হুয়াং লিটন, চেহারা গম্ভীর। মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে বিসিআই চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। বেশ ক’বার শক দেয়ার পরেও তার মুখ থেকে স্বাভাবিক কথা শুনতে পায়নি তারা। একবার অদ্ভুত এক গান গেয়েছে, অন্য দু’বার বিদঘুটে দুই ভাষায় কী যেন বলেছে। ওগুলো কোনও কাজেই আসবে না।
লোকটা পড়ে আছে স্তূপের মত। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। গাল বেয়ে নামছে দরদর করে ঘাম।
‘যথেষ্ট হয়েছে,’ বলল লো হুয়াং।
‘কিন্তু আমরা ভয়েসপ্রিণ্ট পাইনি,’ বলল সাবা সাবেলা। ‘কাজে লাগবে এমন কিছুই বলেনি। রোবটকে কী শেখাব!’
‘আপনাকে হারিয়ে দিয়েছে, বুঝতে পারছেন না?’ বলল লো হুয়াং।
বসকে দেখল সাবেলা।
‘ওই লোক জানে আমরা কী চাই,’ বলল বিলিয়নেয়ার। ‘তাই মরতেও রাজি, দেবে না ভয়েসপ্রিন্ট। আরও চাপ দিলে খুশি মনে মরবে।’
‘তা হলে আমাকে কী করতে বলেন, স্যর?’ বলল সাবেলা।
‘একে হিসাব থেকে বাদ রাখুন,’ বলল হুয়াং। ‘তৈরি করুন এর রোবট। ওটা হবে প্রায় বোবা। বাধ্য না হলে মুখ খুলবে না। যা বলার বলবে রানার রোবট। তার সঙ্গে দেখা গেছে সোহেল আহমেদকে, সেটাই দেখুক লোকে। তারপর গাড়িতে করে পালিয়ে যাবে ওরা।’
হতাশ হলেও বসের কথা মেনে নিল সাবেলা। ‘ঠিক আছে, স্যর। হয়তো কাজে লাগতে পারে, তাই ওর রোবটের মুখে দেব ব্রিটিশ উচ্চারণের ইংরেজি।’
‘যা করার তাড়াতাড়ি, বলল লো হুয়াং, ‘আমার পাইলটকে জানিয়ে দিন, একটু পর রওনা হব আমরা।’
.
চরম ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে সোহেল। ঘামছে কুলকুল করে। ভাবছে, একটু পর আবারও শক দেবে। প্রতিটা শক আরও বেশি সময় ধরে দিচ্ছে। প্রতিবার বাড়ছে ব্যথা। থরথর করে কাঁপছে শরীরের সমস্ত পেশি। মনে হচ্ছে, ভালুকের সঙ্গে কুস্তি করে মরার দশা ওর। এত শক্তি নেই যে উঠে দাঁড়াবে।
পেরিয়ে গেল পুরো এক মিনিট। শক দেয়া হলো না। নিজেকে একটু সামলে নিল সোহেল। ঠিক করেছে, ভুলেও উঠে বসবে না। কে জানে, ওর গান শুনে আর শক দিতে গিয়ে নিজেরাই শক্ড হয়ে গেছে এরা। মেনে নিয়েছে হার।
চুপ করে পড়ে থাকল সোহেল।
একটু পর খুলে গেল ঘরের দরজা। ভেতরে ঢুকল লো হুয়াঙের দু’লোক। সোহেলের দু’হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল তারা। তাদের ওপর ভার চাপিয়ে ঝুলে রইল সোহেল।
প্রথম লোকটা বলল, ‘শালার শরীরে আর কিছু নেই।’
ঘর থেকে ছেঁচড়ে সুড়ঙ্গে সোহেলকে আনল তারা। দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে অদ্ভুত প্রতিধ্বনি। কয়েক সেকেণ্ড পর সোহেল বুঝল, ওটা হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের গর্জন। দ্বীপ ছেড়ে যাচ্ছে হুয়াং লিটন। আগামীকাল ঘটিয়ে দেবে সর্বনাশ। অথচ, সুড়ঙ্গে বন্দি রানা আর হিমুরা। নিজে ও হারিয়ে ফেলেছে শক্তি। হেঁটে যাওয়াই কঠিন। হঠাৎ মনটা দমে গেল সোহেলের।
সুড়ঙ্গ ধরে ওকে ছেঁচড়ে নিয়ে চলল লোকদু’জন।
বাঁক নিয়ে এয়ার শাফটের কাছে পৌঁছুল ওরা।
তখনই আবছা আলোয় সোহেল বুঝল, দেয়ালের পাশের পাইপে এখন উবোন হিমুরা থাকলেও উধাও হয়েছে রানা!