একান্ন
কয়লা খনির সুড়ঙ্গে বন্দি রানা ও সোহেল। কাঁচা লোহার পুরনো মোটা পাইপে শেকল দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে ওদের দু’হাত। পাইপ নেমেছে পাশের কূপে। আবার ছাতের একটা গ্রেট পেরিয়ে চলে গেছে ওপরে।
মাঝে পাইপ, ধরা পড়া চোরের মত মুখোমুখি বসে আছে দু’জন। রানার বামেই গভীর কূপ। সত্যিকারের গাড্ডা যাকে বলে। লো হুয়াঙের লোক শেকলের তালা পরীক্ষা করার পর নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেছে ফ্যাসিলিটির দিকে।
‘খুবই খারাপ লেগেছে আমার, নিজের সঙ্গে লড়াই করে এভাবে হারলি তুই,’ মন্তব্য করল সোহেল।
‘আমারও ভাল লাগেনি,’ বলল রানা। ‘মানুষ পেল এক পয়েন্ট। রেসের সময়। আর রোবটও পেল: এক পয়েন্ট।’
‘পিন পয়েন্ট করে বল কীসের পয়েন্ট।’
‘না, কিছু না,’ বলল রানা। ‘স্কোর দেখছি।’
বন্ধুর হেঁয়ালি ভুলে চারপাশে চোখ বোলাল সোহেল। সুড়ঙ্গের ছাতে মিটমিট করছে ঘোলা এলইডি বাতি। ভালই দেখা যাচ্ছে তাতে। ‘আগেও বিপদে পড়েছি। তবে এবার কিছুই আসছে না মাথায়। লোকগুলো ধরে নিয়েছে, চাইলেও আমরা পালাতে পারব না।’
দেয়ালে দু’পা রেখে গায়ের জোরে পেছনে ছিটকে পড়তে চাইল রানা। ক’ইঞ্চি নড়ল পাইপ, তবে পাথরের দেয়াল থেকে খসে এল না। ‘বোধহয় প্রতি দশ ফুট পর পর রিভেট মারা।’
‘তো বাকি জীবনেও ছুটতে পারব না,’ বলল সোহেল। কথা ঠিক, মনে মনে স্বীকার করল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘শক্তি না খাটিয়েও ছুটে যাওয়া যায়।’
উঠে মাথার ওপরের গ্রেট দেখল। লোহার জালির মত জিনিসটা ময়লায় ভরা। টপটপ করে ওখান থেকে পড়ছে বৃষ্টির পানি। গ্রেটের কিনারা থেকে নেমেছে দেয়াল বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত।
‘বৃষ্টির পানি,’ বলল রানা। ‘এটা এয়ার শাফট। সোজা গেছে ওপরে।’
পাথুরে দেয়ালে ফাটল পেয়ে ওখানে পা রেখে ওপরে উঠছে ও। দেখবে খোলা যায় কি না গ্রেট। পাইপে আটকে রাখা হাতে টান দিয়ে কাত হলো। নিচে অন্ধকার কালো কূপ। কাঁধের গুঁতো দিল লোহার জালি তুলতে।
কাঁচা লোহার পুরু পাইপের মতই সামান্য নড়ল গ্রেট। ওপরে কিছু বাধা দিচ্ছে সরে যেতে। আবারও কাঁধের গুঁতো দিল রানা। কিন্তু সড়াৎ করে পিছলে গেল পা, বেকায়দাভাবে নেমে এল ও। পাইপ ঘষে শেকল নেমেছে বলে ছিলে গেছে দুই কবজি। তবে ওই শেকল না থাকলে সোজা গিয়ে নিচের কূপে গিয়ে পড়ত ও।
মন খারাপ করে ওর দিকে চেয়ে আছে সোহেল।
একটু পর আবারও কূপে উঁকি দিল রানা। আবছাভাবে দেখছে নিচের বিশ ফুট, তারপর সব অন্ধকার। লাথি মেরে ছোট একটা পাথর কূপে ফেলল ও। কান পাতল।
‘খটাং!
‘খট!
‘টিং!
‘ছপ্!’
‘নিচে পানি আছে,’ বলল রানা।
‘খনির নিচের অংশ তলিয়ে গেছে,’ বলল সোহেল।
মাথা দোলাল রানা। ‘বহু বছর হলো চালু হয় না পাম্প। সাগরের পানি ঢুকেছে। আমরা যদি আর কোনও উপায় না পাই, চেষ্টা করব নিচের সুড়ঙ্গ দিয়ে সাঁতরে বেরিয়ে যেতে।’
‘ভুলে গেলি লোহার পাইপে হাত আটকানো?
‘পাইপ ক্ষয়ে যাওয়ার কথা জং-এর জন্যে। বিশেষ করে নিচে যখন লোনা জল।’
নড়েচড়ে বসে কূপে উঁকি দিল সোহেল। আস্তে করে মাথা নাড়ল। ‘বুঝলি, নেমে যাওয়া ঠিক হবে না। ধর্, তুই নেমে গেলি পানিভরা খনির খাড়া শাফটে। পাইপ ভেঙে ছুটে গেলি। খুঁজে বের করলি আনুভূমিক সুড়ঙ্গ। সাঁতরে যাচ্ছিস অন্ধকারে। শেকলে আটকানো তোর দুই হাত। জানিস না সামনে কী আছে। হয়তো কিছুটা যাওয়ার পর বুঝলি, ধসে পড়েছে ছাত। বা জঞ্জালে আটকে গেছে সুড়ঙ্গ। …তখন পারবি ফিরতে?’
হতাশ না হয়ে বলল রানা, ‘বলব না যে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে শেষ ভরসা হয়তো ওই পথই।’
‘বাঁচার উপায় থাকবে না,’ বলল সোহেল। ‘প্রথম সুড়ঙ্গ পেরিয়ে হয়তো সামনে পড়ল খাড়া আরেক শাফট। শেকল পরা হাতে উঠে যেতে পারবি?’
‘যে এলিভেটরটা দেখেছি, সেরকম পেলে উঠে যেতে ঠেকাবে কে?’ হাল ছাড়ল না রানা। ‘জানি, যন্ত্রপাতি পুরনো আর বিকল। কিন্তু এলিভেটরের ফ্রেমওঅর্ক বেয়ে সহজেই উঠতে পারব। আগেও এই খনির ছাতে দেখেছি এয়ার শাফট।’
‘তোর প্ল্যানে অনেক বেশি ‘যদি’। শেষে পানি ভরা সুড়ঙ্গে দম আটকে মরব আমরা। লাশও পাবে না কেউ।’
‘তাও খারাপ না,’ বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে আমার লাশে রোবটের পোশাক চড়িয়ে আমাকে পচাতে পারবে না লো হুয়াং লিটন। বুঝতেই পারছিস, আগামীকাল যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হবে, সেটা হবে উনিশ শ চোদ্দ সালে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউকের হত্যার চেয়েও বেশি সমালোচিত।’
‘আশা করি ওটার কারণে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে না।’
‘যুদ্ধ তো আগেই লেগেছে,’ বলল রানা। ‘ওই লড়াই প্রভাব বিস্তারের। সঠিক জায়গায় টোকা দিচ্ছে লো হুয়াং লিটন। ভবিষ্যতে হয়তো শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে জাপান ও চিন। তেমন কিছু হলে তার প্রভাব থেকে বাদ পড়বে না বাংলাদেশও।’
‘সবই বুঝলাম,’ বলল সোহেল। ‘এবার আত্মহত্যার প্ল্যান বাদ দিয়ে এখান থেকে বেরোবার ভাল কোনও বুদ্ধি বের কর্।’
রানা জবাব দেয়ার আগেই দেখল সুড়ঙ্গ ধরে আসছে ফ্ল্যাশলাইট। দু’জন তারা। মেঝেতে ছেঁচড়ে আনছে অন্য আরেকজনকে।
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় রানা চিনল, জণ্ডিস রোগীর মত হলদে মুখের ওরে চিচিওয়াকে। অন্যজন লো হুয়াং লিটনের লোক। দু’হাত ধরে তৃতীয়জনকে টেনে আনছে তারা। মেঝেতে ছেঁচড়ে আসছে পা। কয়েক সেকেণ্ড পর রানা ও সোহেল বুঝল, ওই লোক পুলিশের সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট উবোন হিমুরা।
ধুপ্ করে রানা ও সোহেলের পাশে তাকে ফেলল দু’জন। শেকল দিয়ে দু’হাত আটকে দিল লোহার পাইপে। ওরে চিচিওয়ার পাশের লোকটা বোধহয় জেলার। পকেট থেকে চাবি নিয়ে খুলে দিল সোহেলের হাতের শেকলের তালা। ঘাড় ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল ওকে।
‘ব্রেকফাস্ট রেডি, না?’ শুকনো গলায় বলল সোহেল। মেন্যু অনুযায়ী সব দিচ্ছ তো?’
কষে ওর গালে চড় দিল চিচিওয়া। তাল হারিয়ে মেঝেতে পড়ল সোহেল। উঠে মুখোমুখি হবে, এমনসময় ওর পিঠে লাগল খুব শীতল কিছু। চিরে গেল ওয়েট সুট, চিরচির করে কাটল ত্বক। সোহেল বুঝল, পিঠে ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষুরের মত ধারালো কোনও তলোয়ারের ডগা।
‘লো হুয়াং বলেছে আপাতত যেন তোমাদেরকে খুন না করি,’ বলল প্রেতাত্মা। ‘তবে বেশি তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেলে বাধ্য হয়েই… বুঝতেই পারছ।’
তলোয়ারটা দেখছে রানা। আগে অন্য তলোয়ার ছিল লোকটার হাতে। ‘সাবধান, সোহেল, উঠবি না,’ সতর্ক করল ও। ‘নইলে পিঠে গেঁথে যাবে।’
‘বিশ্রাম নিচ্ছি,’ বলল সোহেল। পিঠ থেকে তলোয়ারের ডগা সরে যাওয়ায় হাত ও হাঁটুর ওপর ভর করে উঠে বসল ও। হিংস্র চেহারায় ওকে দেখছে প্রাক্তন ইয়াকুয়া খুনি।
‘কুত্তা-শালা-শুয়োর কোথাকার, তোর মাফ নেই!’ খসখসে গলায় বলল চিচিওয়া। ‘এক পা হাঁটতেও টনটনে ব্যথা আমার সারাশরীরে। শয়তান, তোর জন্যেই বারবার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। আর তারপর ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলে মনে হচ্ছে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাব। এসবই হয়েছে, কুত্তা, তোর দোষে! এজন্যে ভোগান্তি আছে তোর কপালে!’
‘দোষটা তো, বাপু, কমোডো ড্রাগনের,’ আপত্তির সুরে বলল সোহেল। ‘আমি তো ছিলাম নীরব দর্শক।’
‘তোরা মরবি ভয়ঙ্কর গাড়ি দুর্ঘটনায়,’ বলল প্রেতাতা। ‘পুড়িয়ে মারব আগুনে। তখন এত রসিকতা আসবে না পেটে। পুড়তে পুড়তে চেঁচাবি আর মরবি।’
সোহেলকে ছেঁচড়ে নিয়ে রওনা হলো ওরে চিচিওয়া আর লো হুয়াঙের লোক। পেছন থেকে চেয়ে রইল অসহায় রানা। ভাবছে, সুযোগটা কি নিতে পারবে সোহেল? খুনিটা ভুলে গেছে শেকল দিয়ে ওর হাত আটকে দিতে।
সোহেলকে নিয়ে লোকদু’জন চলে যাওয়ার পর উবোন হিমুরার দিকে ফিরল রানা। ‘সুপারইণ্টেণ্ডেণ্ট, কী অবস্থা আপনার?’
প্রচণ্ড ব্যথায় মুখ কুঁচকে ওকে দেখলেন হিমুরা। রানা দেখল, মারধর করেনি লোকটাকে। তবে হাতে ব্যাণ্ডেজ।
‘সাধুদেরকে মেরে ফেলেছে,’ বললেন হিমুরা, ‘বাঁচতে দেয়নি একজনকেও।’
‘ওরে চিচিওয়া?’
মাথা দোলালেন পুলিশ অফিসার। ‘তলোয়ার নিতে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম ফাঁদে ফেলেছি। কিন্তু… মেরে ফেলেছে আমার সঙ্গের অফিসারদেরকে। কেটে নিয়েছে আমার একহাতের প্রায় সব আঙুলের শেষ কড়া।’
মানুষটাকে জ্বরগ্রস্ত মনে হলো রানার।
মেঝের দিকে চেয়ে বললেন, ‘অনেক প্রশ্ন করেছে। কারণ বুঝলাম না। জবাব না দিলে বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে। বারবার। যখন পড়ে গেছি, একটু পর আবারও শুরু করেছে প্রশ্ন।’
‘কী ধরনের প্রশ্ন?’
‘নানাধরনের,’ বললেন হিমুরা, ‘বলল বই পড়ে শোনাতে। কথা বলতে হয়েছে কখনও রাগী স্বরে, আবার কখনও নিচু গলায়। মনে হয় ওটা কোনও ইন্টারোগেশনের খেলা।’
সোজা হয়ে বসল রানা। ‘ওরা আপনার কণ্ঠস্বর আর বাচন ভঙ্গি রেকর্ড করেছে।’
মুখ তুলে ওকে দেখলেন অফিসার। ‘কিন্তু কেন?’
‘যাতে তৈরি করতে পারে আপনার নকল। আমার নকলও তৈরি করেছে।’
‘কী করবে এসব দিয়ে?’
‘ওরা এমন রোবট তৈরি করেছে, যেগুলো দেখতে আমাদের মত, কথাও বলবে আমাদের মত। আপনার আইডি কেড়ে নিয়েছে না?’
‘সবই,’ বললেন হিমুরা, ‘এমন কী নিয়েছে আঙুলের ছাপ।’
কাজে ভুল নেই লো হুয়াঙের।
উবোন হিমুরার ফেডারেল পুলিশের আইডি আর আঙুলের ছাপ লাগবে অথেনটিফিকেশনের জন্যে। যাতে রোবট যেতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায়। তার সঙ্গে যাবে রানার রোবট।
‘এবার একইভাবে সোহেলের মুখ খোলাবে ওরা।’
চোখ বিস্ফারিত হলো হিমুরার। ‘জবাব না দিলে প্রচণ্ড নির্যাতন করে।’
তাতে সন্দেহ নেই রানার। আপাতত সাহায্য করতে পারবে না সোহেলকে। তবে এ কারণেই জরুরি মুক্ত হওয়া। ‘আপনি উঠে দাঁড়াতে পারবেন?’
চেষ্টা করেও মেঝেতে পড়ে গেলেন হিমুরা। ‘না, পারছি না। শরীরে শক্তি নেই।’
মানুষটাকে উঠিয়ে বসাল রানা। ‘বিশ্রাম নিন। শক্তি ফিরে পাবেন।’
বড় করে শ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইলেন উবোন হিমুরা। কূপে সাবধানে নামতে লাগল রানা। ‘কেউ এদিকে এলে আগে থেকে জানাবেন।’
‘কী করবেন আপনি?’ জানতে চাইলেন হিমুরা।
‘এমন এক ইঁদুর খুঁজব, যেটার লোহার দাঁত। তারপর ওটাকে দিয়ে কাটিয়ে নেব শেকল।’