সাতান্ন
ভোর হতে এখনও অন্তত একঘণ্টা।
শাংহাই শহর কেন্দ্রে পিপল্স্ স্কয়্যারের ফাঁকা প্লাযা পার হয়ে আঁধারে হাঁটছে আসিফ রেজা ও তার স্ত্রী তানিয়া। ওদের সঙ্গে রয়েছে মহিলা সাংবাদিক মেরিয়ান হিউবার্ট। সে বলল, ‘আগে এ জায়গাটা ছিল ঘোড়ার রেসের মাঠ। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি চাইল না জুয়া নিয়ে মাতামাতি করুক মানুষ। তখন তারা এখানে তৈরি করল এই পার্ক।’
‘অথচ এখন সেই জুয়াই খেলতে হচ্ছে,’ বলল আসিফ। ‘জীবন-জুয়া। বন্দি হলে বাকি জীবনেও জেল থেকে বেরোতে পারব না।’
পার্ক পার হয়ে সরকারী ভবনের কাছে পৌঁছুল ওরা। লোকে ওটাকে বলে শামুক বাড়ি। এর কারণ, একতলায় বেশ ক’টি দরজা থাকলেও কংক্রিটের ভাঁজ ও কাঁচের কারণে দেখা যায় না নিচের কয়েক তলা।
আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ, তাই দ্বিধা ঝেড়ে হেঁটে চলেছে আসিফ, তানিয়া ও মেরিয়ান। নির্দিষ্ট ভবনের গেটে গিয়ে থামল ওরা। নিজের ক্রেডেনশিয়াল বাইরের গার্ডকে দেখাল মেরিয়ান।
‘ভাল হতো না আমি একা গেলে?’ বলল আসিফ। ‘বন্দি হলে সেই সুযোগে পালাতে পারতে তোমরা দু’জন।’
মাথা নাড়ল তানিয়া। ‘মনে নেই, বিয়ের আগে দু’জন দু’জনকে কথা দিয়েছি, ঘটনা যাই ঘটুক, সবসময় পাশে থাকব আমরা?’
‘কিন্তু তোমার খারাপ কিছু হবে ভাবতে গেলে…’
‘আমরা ভালই থাকব,’ স্বামীকে থামিয়ে দিল তানিয়া। ‘তা ছাড়া, মেরিয়ানের ওই ভ্যানে ঘুমানোর চেয়ে জেলখানাও ভাল।’
সামনের গার্ড ছেড়ে দেয়ায় চেক পয়েন্টে গিয়ে থামল ওরা। এ জায়গা পাহারা দেয়া হয় চব্বিশ ঘণ্টা। ওদেরকে ঘিরে ফেলল কয়েকজন সশস্ত্র সৈনিক। পরীক্ষা করে দেখছে ওদের সঙ্গের জিনিসপত্র। কঠোর গলায় দলনেতা বলল, ‘ক্রেডেনশিয়াল?’
ওর নেটওঅর্কের আইডি বাড়িয়ে ব্যাখ্যা দিল মেরিয়ান, ‘এরা আমার নতুন প্রোডাকশন ক্রু। ওদেরকে…’
মহিলা সাংবাদিককে পাত্তা না দিয়ে কড়া চোখে আসিফ ও তানিয়াকে দেখল গার্ডদের দলনেতা। ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধায় পড়ল সে। চিনা ভাষায় চিৎকার করে কী যেন বলে হাতের ইশারা করল। জড় হলো আরও কয়েকজন গার্ড।
‘আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে জেনারেল ফং মিং-এর সঙ্গে দেখা করতে,’ ঘাবড়ে গিয়ে বলল আসিফ। ‘তাঁর জন্যে জরুরি কিছু জিনিস এনেছি।’
ওর কথা চাইনি ভাষায় অনুবাদ করল মেরিয়ান।
মাথা নাড়ল গার্ডদের দলনেতা। পকেট থেকে বের করল মোবাইল ফোন। তার সঙ্গীরা বের করেছে অস্ত্র। একজন পিস্তল তাক করল আসিফের হাঁটু লক্ষ্য করে।
ওদেরকে আসতে দাও,’ কণ্ঠস্বর এল ছায়ার ভেতর থেকে। সবার চোখ চলে গেল ওদিকে।
থমকে গেছে গার্ডরা।
বিশাল লবি থেকে বেরিয়ে এল সুদর্শন এক চিনা যুবক। পরনে ধূসর সুট। তাকে দেখে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল গার্ডরা।
‘তোমাদের সার্চ হয়ে গেলে এঁদেরকে নেব আমাদের অফিসে,’ বলল ধূসর সুট। ‘বডি সার্চ।’
‘কিন্তু, স্যর, এরা পলাতক অপরাধী,’ বলল গার্ডদের দলনেতা। ‘আমাদের লিস্টে আছে। দেশের শত্রু।’
কড়া চোখে তাকে দেখল যুবক। ‘আমি কিন্তু তোমাকে একটা নির্দেশ দিয়েছি।’
‘জী, স্যর।’
কী বলা হয়েছে, ইংরেজি করে আসিফ ও তানিয়াকে জানাল মেরিয়ান।
‘যাক্, মনে হচ্ছে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কথা রাখবে এই লোক,’ বলল আসিফ।
পরিষ্কার বাংলায় জবাব এল যুবকের, ‘অবস্যই!’
‘ক্যালকাটার বাংলা বলচে, গো,’ বলল তানিয়া।
ওদেরকে সার্চ করল গার্ডরা।
সরিয়ে নিল সব ইকুইপমেণ্ট।
মেরিয়ানের কাছ থেকে আসিফ ও তানিয়াকে আলাদা করে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। তুলে আনা হলো সপ্তমতলার এক অফিসে। এরই ভেতর পরস্পর পরিচিত হয়েছে চাইনি যুবক, আসিফ ও তানিয়া।
চমৎকারভাবে গুছিয়ে রাখা অফিসে বসতে বলে বিদায় নিল চাইনি যুবক।
‘এবার কী?’ স্ত্রীর দিকে তাকাল আসিফ।
‘অপেক্ষা,’ বলল তানিয়া। ‘আশা করি আমাদের কথা জেনেছেন জেনারেল ফং মিং।’
চুপ করে বসে থাকল ওরা। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে বিশাল পিকচার উইণ্ডো দিয়ে দূরে তাকাল আসিফ। নিচে ধূসর হয়ে উঠেছে প্লাযা। ভোর হচ্ছে।
আরও ক’মিনিট পর অফিসে ঢুকলেন বয়স্ক এক লোক। পরনে সবুজ রঙের পিপল্স লিবারেশন আর্মির ইউনিফর্ম। বুক ভরা মেডেল। মাথার ক্যাপের নিচ থেকে চেয়ে আছে তীক্ষ্ণ দুটো চোখ। জেনারেলের পর অফিসে ঢুকল সেই যুবক, হাতে আসিফদের ল্যাপটপ।
‘স্যর, এঁদের কথাই বলেছেন বিসিআই চিফ।’
মৃদু মাথা দোলালেন চাইনিয সিক্রেট সার্ভিস চিফ ফং মিং। আসিফ জানালার দিকে চেয়ে আছে দেখে বললেন, ‘খোলা যায় না এসব জানালা। পালাতে পারবেন না।’
‘পালাতে চাইলে এখানে আসতাম না,’ বলল আসিফ, ‘আপনিই তো ফু-চুঙের বস, জেনারেল ফং মিং?’
‘হ্যাঁ,’ বললেন জেনারেল, ‘ফু-চুঙের কাছে শুনলাম আপনারা আসিফ ও তানিয়া রেজা। কাজ করেন নুমার হয়ে। অনেকের ধারণা: আপনারা গুপ্তচর। এর কারণও আছে। বেআইনীভাবে পা রেখেছেন এ দেশে। হয়তো জানেন না, এ অপরাধের জন্যে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
কথা শুনে মুখ শুকিয়ে গেল আসিফের। ভেবেছিল বড়জোর জেল হবে। কিন্তু এই লোক বলছে মেরেও ফেলা হতে পারে!
‘আশা করি আপনাদের জেল-জরিমানা বা বিপদ হবে না, বললেন জেনারেল ফং মিং।
‘আমাদের ব্যাপারে সবই মিস্টার ফু-চুংকে জানিয়ে দিয়েছেন বিসিআই চিফ,’ বলল তানিয়া। ‘মিস্টার ফু-চুং আপনাকে কিছু জানাননি?
মৃদু হেসে যুবককে দেখালেন জেনারেল, বললেন, ‘ইনিই ফু-চুং। হ্যাঁ, জানিয়েছেন। তবুও আরেকবার বলুন কেন এসেছেন।’
লজ্জিত দৃষ্টিতে যুবককে দেখল তানিয়া।
‘সব শুনলে বিশ্বাস করবেন না,’ বলল আসিফ।
ভুরু কুঁচকে ওকে দেখলেন জেনারেল। ‘বিশ্বাস করব কী করব না, সেটা আমার ওপরই ছেড়ে দিন। নিন শুরু করুন।’
সংক্ষেপে বলতে লাগল আসিফ ও তানিয়া।।
টেবিলের কিনারায় বসে শুনছেন জেনারেল। কিছুক্ষণ পর আরও গম্ভীর হয়ে গেল তাঁর চেহারা।
‘আমরা বরং দেখাই কী ঘটছে,’ ফু-চুঙের হাতের ল্যাপটপ দেখাল আসিফ।
মাথা দোলালেন জেনারেল। ল্যাপটপ আসিফের হাতে দিল চাইনিয সিক্রেট সার্ভিসের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী কর্মকর্তা লিউ ফু-চুং।
কমপিউটার চালুর পর প্রতিটি বিষয় ব্যাখ্যা দিতে লাগল আসিফ ও তানিয়া। জেনারেলকে বলল, কীভাবে ওরা জানল উঠে আসছে সাগর-সমতল, কীভাবে পাঠাল পুব চিন সাগরের নিচে রোভ, কী দেখেছে পানির গভীরে। ঢিবি থেকে উঠে আসছে বিপুল পরিমাণের পানি।
ওরা আরও জানাল, ক্রমেই বাড়ছে রিংউডাইটের বুকে ফাটল। অল্পদিনেই তলিয়ে যাবে বহু দেশ। শেষে সাগরের উচ্চতা হবে শত শত ফুট। তারপর ছাড়িয়ে যাবে মাউন্ট এভারেস্টকেও।
চুপচাপ শুনছেন জেনারেল মিং। মাঝে মাঝে দেখছেন ফু- চুংকে। আসিফ ও তানিয়ার বক্তব্য শেষ হলে বললেন, ‘আমার সহকর্মীর কাছে শুনেছি আপনারা মাসুদ রানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বহুবার এ দেশের বিপদে সাহায্য করেছে সে। সুতরাং আপনাদের একটা কথাও অবিশ্বাস করব না। তবুও জানতে চাই, এক বছর আগে খনির কাজ বন্ধ করে দেয়ার পরেও কেন উঠে আসছে এত পানি?’
‘জবাব আমাদের কাছে নেই,’ স্বীকার করল আসিফ, ‘আপনাদের জিয়োলজিস্টরা হয়তো দিতে পারবেন এর ব্যাখ্যা। নানান টেস্ট ও এক্সপেরিমেন্ট শেষ না করে আমি নিজে কোনও মন্তব্য করব না।’
চুপ করে থাকলেন চাইনিয সিক্রেট সার্ভিস চিফ। তাঁর চেহারা দেখে তানিয়ার মনে হলো, কী যেন ভেবে বিব্রত বোধ করছেন জেনারেল।
‘জেনারেল, আমরা মিথ্যা বললে নিজেদের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিতাম?’ বলল তানিয়া। ‘আপনারা তো বছরের পর বছর আটকে রাখতে পারবেন আমাদেরকে। কিন্তু অন্তর থেকে বলতে পারি, আমরা গুপ্তচর নই। কারও কোনও গুটি নই। এসেছি জরুরি প্রশ্নের জবাব খুঁজে মানুষের উপকার করতে— সেই মানুষদের মধ্যে আপনারাও আছেন। আর তা করতে গিয়ে তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি এখন। হয়তো মারাই যাব। তবে চাই, মানুষ যেন জেনে নেয়, আসছে মহাপ্লাবন… সাক্ষাৎ মৃত্যু।
ও থেমে যাওয়ার পর থমথম করছে ঘরের পরিবেশ।
‘বিসিআই চিফের বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি আমরা,’ একটু পর বললেন জেনারেল মিং। ‘তবু আপনাদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিতে চাই। ভুললে চলবে না, এটা মহাচিন। একটাই রাজনৈতিক পার্টি। আমি বা ফু-চুং বড় কোনও ভুল করলে রক্ষা পাব না নিজেরাও। …এবার বলুন, কী ধরনের প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে?’
‘ভিডিয়ো তো দেখেছেন, সাগরের ওই ক্যানিয়নে রোভ নামালে পাবেন সব প্রমাণ,’ বলল আসিফ, ‘এ ছাড়া, দেখতে পারেন লো হুয়াং লিটনের ব্যক্তিগত ফাইল। ওখানে অনেক কিছুই থাকবে।’
চোখ সরু করলেন জেনারেল মিং। ‘লো হুয়াং লিটন? সেই মস্ত ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট?’
‘জী,’ বলল আসিফ, ‘আপনি একটু আগে সাগরের নিচে যে রোবটের হাত ও কাঁধ দেখলেন, ওগুলো তৈরি করেছে তারই কোম্পানি। এই একই লোক খুন করতে চেয়েছে আমাদেরকে জাপানে।’
জানালা দিয়ে দূরে তাকালেন জেনারেল।
কিছুক্ষণ পর বলল ফু-চুং, ‘হুয়াং এসবে জড়িত হলে, তাকে অনুমতি দিয়েছেন পার্টির ওপর মহলের কেউ।’
‘কতটা উঁচু পর্যায়ের লোক সে?’ বলল তানিয়া, ‘এমন কেউ যে যা খুশি করতে পারে কোটি কোটি মানুষের জীবন নিয়ে?’
চুপ করে রইলেন জেনারেল।
‘স্যর, আপনাদের কাজ চিনকে নিরাপদ রাখা, তাই না?’ মুখ খুলল আসিফ।
‘অবশ্যই!’ মাথা দোলালেন জেনারেল।
‘আপনাদের কাছে প্রমাণ আছে, চিনের পুব সাগরের নিচে মাইনিং হয়েছে,’ বলল আসিফ। ‘ওই ক্যানিয়নের তলার ফাটল থেকে উঠছে প্রতি ঘণ্টায় কোটি কোটি গ্যালন পানি। আরও জানেন, চওড়া হচ্ছে এসব ফাটল। কিছু দিন পর কিছুই গোপন থাকবে না। তার আগেই চেষ্টা করা উচিত বিপর্যয় ঠেকাবার। নইলে গোটা পৃথিবীর মানুষ অভিশাপ দেবে আপনাদেরকে।’
মাথা দোলালেন জেনারেল মিং। ‘সমস্যার মাত্রা আরেকটু খুলে বলুন।’
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল আসিফ, তারপর বলল, ‘চিনের সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা। হয় সমস্ত দোষের দায় নিজেদের ঘাড়ে নেবে মহাচিন সরকার, নয়তো এ দায় চাপবে ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট লো হুয়াং লিটনের কাঁধে। আমার ধারণা, তার কারণেই ঘনিয়ে এসেছে পৃথিবীর বুকে এই মহা বিপর্যয়। এসব করেছে ক্ষমতা ও আরও টাকার মালিক হওয়ার জন্যে।’
‘মহাচিনের বদলে দায় নেবে হুয়াং,’ বিড়বিড় করলেন জেনারেল।
‘সে দায়ী হলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অপেক্ষাকৃত সহজ,’ মন্তব্য করল ফু-চুং।
‘তাতে মুখ রক্ষা হবে চিনের,’ বলল তানিয়া। ‘সবাই জানবে ওই লোকের জন্যে ডুবে মরতে বসেছে কোটি কোটি মানুষ। এটা প্রমাণ হলে তার পেছন থেকে সরে যাবে চিন সরকার। কিন্তু যা করার করতে হবে দেরি না করে। হাতে বেশি সময় পাবেন না আপনারা।
টেবিল থেকে নেমে বললেন জেনারেল, ‘আপনারা এ ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাইরে থাকবে গার্ড। কোনও বিপদ হবে না। কেউ জানবে না আপনারা আছেন এ ভবনে।’ ফু- চুঙের দিকে ফিরলেন জেনারেল। হাতের ইশারায় দেখালেন দরজা। ‘আমার অফিসে অপেক্ষা করছি আমি। তুমি ওপরতলায় যাও। কথা বলে দেখো যেইন নিং-এর সঙ্গে। তবে বাধ্য না হলে গ্রেফতার করবে না।’
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন জেনারেল।
পিছু নিল চিনের দুর্ধর্ষ গুপ্তচর মাসুদ রানার প্রিয় বন্ধু লিউ ফু-চুং।
.
বিশাল ভবনের দশমতলায় এলিভেটর থামতেই করিডোরে বেরিয়ে এল লিউ ফু-চুং। সরাসরি করিডোরের শেষমাথার অফিসে পা রাখতেই পরের ঘরের দরজা আগলে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল দু’জন গার্ড। ফু-চুংকে দেখে আরেকটু আড়ষ্ট হয়েছে তারা। ভাল করেই জানে, এই লোক চিন সিক্রেট সার্ভিসের দ্বিতীয় ব্যক্তি।
‘ভেতরে যেইন নিং আছেন?’ দুই স্ট্রিপওয়ালা এক কর্পোরালের কাছে জানতে চাইল ফু-চুং।
‘জী, স্যর,’ বলল যুবক সৈনিক। ‘তবে তাঁকে বিরক্ত করতে মানা করে দিয়েছেন।’
‘জরুরি কাজে দেখা করব,’ বলল ফু-চুং।
‘কিন্তু, স্যর… তিনি…..
‘কাজটা জরুরি, দরজা ছেড়ে দাঁড়াও।’
নিচু পদের সৈনিকরা বড় সমস্যায় পড়ে ওপরমহলের দু’জন দুটো আলাদা নির্দেশ দিলে। যেইন নিং রাজনৈতিক নেতা হলেও মিলিটারিতে লিউ ফু-চুং-এর পদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের। সৈনিক মাত্রেই জানে ওই পদের মালিকের দাপট কতখানি। চুপচাপ দরজা ছেড়ে দিল দুই কর্পোরাল।
ঘরে ঢুকে যেইন নিংকে কাউচে বসে থাকতে দেখল ফু- চুং। বয়স্ক মানুষটা দেখছে জাপানি নেটওঅর্কের সকালের খবর।
মুখ তুলে তাকাল না যেইন নিং। ‘আমি কিন্তু বলেছি কেউ যেন বিরক্ত না করে আমাকে।’
‘গার্ডদের অন্য নির্দেশ দিয়েছি,’ নিচু গলায় বলল ফু-চুং।
বেশিরভাগ মানুষ ক্ষমতা পেলেই তা প্রয়োগ করে। তবে এমনি এমনি খামোকা প্রতিক্রিয়া দেখাবার লোক নয় নিং। মোলায়েম সুরে বলল, ‘আপাতত আমাকে বিরক্ত করবেন না, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। তবে ওই বাঙালি-আমেরিকান গুপ্তচরদেরকে ধরে থাকলে, সে কথা আলাদা।’
মিলিটারি এবং পুলিশে প্রবল প্রভাব আছে এ লোকের। আসিফ ও তার স্ত্রীকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে হাজার হাজার অফিসার ও তাদের লাখ লাখ অধীনস্থরা। কয়েক পা সামনে বাড়ল ফু-চুং। ‘জী, খুঁজে পাওয়া গেছে তাদেরকে। অদ্ভুত এক কাহিনী বলেছে তারা আমাদেরকে।’
এবার ওর প্রতি মন দিল নিং। ‘ওরা কোথায়? নিজ চোখে দেখতে চাই তাদেরকে।’
‘আপাতত সেটা সম্ভব হবে না,’ বলল ফু-চুং।
কথাটা শুনে ঝট্ করে উঠে দাঁড়াল প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা। রাগে বিকৃত হয়েছে চেহারা। ‘আপনি জানেন আমি কে? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বুদ্ধিমান অফিসার!’
মুহূর্তের জন্যে ফু-চুঙের মনে হলো, মস্তবড় ভুল করেছে ও। চেতিয়ে দিয়েছে দেশের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী লোকটাকে। ফলাফল হয়তো ভয়ানক। সাইবেরিয়ার কাছে বরফে ছাওয়া কোনও স্টেশনে পাঠানো হবে ওকে বাকি জীবনের জন্যে। পার্টির পেছনে বসে থাকলেও এর নির্দেশে চলে কোটি কোটি সদস্য। কিন্তু আগে কখনও কোনও কাজে পিছিয়ে যায়নি ফু- চুং। ঠিক করল, আজও নিজেকে ছোট করবে না। তা ছাড়া, ওর হাতে রয়েছে খেলার মত তাস। নরম সুরে বলল ও, ‘জাপানে কী করছে লো হুয়াং লিটন, স্যর? আমরা জানি সে যা করছে, আপনার নির্দেশেই করছে।’
‘এ কথা জিজ্ঞেস করেছেন বলে আপনাকে পাঠাতে পারি দেশের সবচেয়ে খারাপ জেলখানায়, তা কি জানেন?’
‘তবুও ওই প্রশ্নের জবাবটা চাই আপনার কাছে।’
প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। বহু বছর পর কেউ চ্যালেঞ্জ করেছে নিংকে। সামান্য বিস্মিত চোখে তাকাল সে। কয়েক মুহূর্ত পর টের পেল, পিছিয়ে যাবে না এই যুবক।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ছোট একটা টেবিলের পেছনে বসল যেইন নিং। সামনে পেতে রাখা খেলার বোর্ড। কাপ থেকে নিয়ে কালো একটা পাথর:বোর্ডে রাখল বৃদ্ধ।
‘হাত বেশি নাড়াবেন না, লাও-শি,’ বলল ফু-চুং।
‘আপনি কি আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন?’
‘লো হুয়াং জাপানে কী করছে, তার ওপর নির্ভর করে আপনাকে গ্রেফতার করব কি না,’ বলল ফু-চুং। কিছুক্ষণ আগে রানার কাছ থেকে ফোন পেয়েছে। জেনেছে, কী ঘটবে আজ জাপানে। দেরি করেনি এ বিষয়ে জেনারেলকে জানাতে। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে যেইন নিংকে বিরক্ত করবে না, নইলে বিপদ হবে। নিচু গলায় বলল ফু-চুং, ‘আরও একটা ব্যাপার এখানে জড়িত। আমরা জানতে চাই আপনারা কী করেছেন সরীসৃপের চোয়ালে।’
‘ও… তো দু’একটা ব্যাপার জেনেছেন আপনি।’ খেলার বোর্ডে মনোযোগ দিল নিং। চিন সিক্রেট সার্ভিসের সেরা এজেন্টের দিকে ঘুরেও তাকাল না। হাড্ডিসর্বস্ব তর্জনী তুলে দেখাল টিভি স্ক্রিন। ‘সংবাদ পাঠিকার দিকে নজর দিন, একটু পর নিজেই দেখবেন কী ঘটছে।’