স্ত্রীলোকমাত্রেই বোর্কা ব্যবহার করিয়া যথেচ্ছ স্থানে বেড়াইতে পারে। ভারতের ন্যায় তথায় পাল্কি-বেহারা নাই। লক্ষপতি হউন, রাজললনাই হউন, ভদ্রমহিলাই হউন, বোর্কা ব্যবহারে যথেচ্ছভাবে ভ্রমণ করিয়া থাকেন। দূর দেশে যাইতে হইলে উষ্ট্রের বা অশ্বের আশ্রয় লইতে হয়।
মায়মুনার গৃহ বেশি দূর নহে। জায়েদা মায়মুনার গৃহে উপস্থিত হইয়া বোর্কা মোচনপূর্বক তাহার শয়নকে যাইয়া বসিলেন। মায়মুনাও নিকটে আসিয়া বসিল। আজ জায়েদা মনের কথা অকপটে ভাঙ্গিলেন। কথায় কথায়, কথার ছলনায়, কথায় ভর দিয়া, কথা কাটাইয়া, কথায় ফাঁক দিয়া, কথায় পোষকতা করিয়া, কথায় বিপতা করিয়া স্বপ বিপ, সকল দিকে যাইয়া আজ মায়মুনা জায়েদার মনের কথা পাইল। মায়মুনার মোহমন্ত্রে জায়েদা যেন উন্মাদিনী।
সপত্নীনাগিনীর বিষদন্তে যে অবলা একবার দংশিত হইয়াছে, তাহার মন ফিরিতে কতক্ষণ? চিরভালবাসা, চিরপ্রণয়ী পতির মমতা বিসর্জন করিতে তাহার দুঃখ কী? এক প্রাণ, এক আত্মা, স্বামীই সকল, এ কথা প্রায় স্ত্রীরই মনে আছে, স্ত্রীরই মনে থাকে, কিন্তু সপত্নীর নাম শুনিলেই মনের আগুন দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ ভাবে জ্বলিয়া উঠে। সে আগুন বাহির হইবার পথ পায় না বলিয়াই অন্তরস্থ ভালবাসা, প্রণয়, মায়া মমতা একেবারে পোড়াইয়া ছারখার করিয়া ফেলে।
মায়মুনার সমুদয় কথাতেই জায়েদা সম্মত হইলেন। মায়মুনা মহা সন্তুষ্ট হইয়া বলিতে লাগিল, “বোন্! এত দিনে যে বুঝিয়াছ, সেই ভাল, আর বিলম্ব নাই, কোন্ সময় কাহার অদৃষ্টে কি ঘটে, কে বলিতে পারে? যত বিলম্ব হইবে, ততই তোমার অমঙ্গলের ভাগ বেশি হইবে। যাহা করিতে বসিলে, তাহার উপর আর কথা কি আছে? শুভকার্যে আর বিলম্ব কেন? ধর, এই ঔষধ নেও।”
এই বলিয়া মায়মুনা শয্যার পার্শ্ব হইতে খর্জুরপত্র নির্মিত একটি ক্ষুদ্র পাত্র বাহির করিল। তন্মধ্য হইতে অতি ক্ষুত্র একটি কৌটা জায়েদার হস্তে দিয়া বলিল, “বোন্। খুব সাবধান! এই কোটাটি গোপনে লইয়া যাও, সুযোগমত ব্যবহার করিয়ো। মনস্কামনা পূর্ণ হইবে, জয়নাবের সুখতরী ডুবিবে, এই কৌটার গুণে তুমি সকলই পাইবে। যাহা মনে করিবে তাহাই হইবে।”
জায়েদা কহিলেন, “মায়মুনা! তোমার উপদেশেই আমি সকল মায়া পরিত্যাগ করিলাম। জয়নাবের সুখস্বপ্ন আজ ভাঙ্গিব, জয়নাবের অঙ্গের আভরণ আজ অঙ্গ হইতে খসাইব, সেই আশাতেই সকল স্বীকার করিলাম। আমার দশার দিকে ফিরিয়াও চাহিলাম না। জয়নাবের যে দশা ঘটিবে, আমারও সেই দশা। ইহা জানিয়াও কেবল সপত্নীর মনে কষ্ট দিতে স্বামী বধ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। দেখ বোন্! আমায় অকূল সাগরে ভাসাইও না। আমার সর্বনাশ করিতে আমিই তো দাঁড়াইলাম, তাহাতে দুঃখ নাই। জয়নাবের সর্বনাশ করিতে আমার সর্বনাশ! এখন সর্বমঙ্গল, ইহাও সর্বসুখ মনে করিতেছি। কিন্তু বোন্! তুমি আমাকে নিরাশ্রয় করিয়া বিষাদসমুদ্রে ভাসাইয়া দিয়ো না।”
ধীরে ধীরে কথাগুলি বলিয়া জায়েদা বিদায় হইলেন। মায়মুনাও গৃহকার্যে ব্যপৃত হইলেন। জায়েদা গৃহে আসিয়া কৌটা খুলিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার সর্বশরীর শিহরিয়া উঠিল, ভয়ে হস্ত কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু মায়মুনার উপদেশক্রমে সে ভয় বেশিক্ষণ রহিল না। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে সেই কৌটার বস্তু মিশাইবেন, ইহাই মায়মুনার উপদেশ। সে সময় আর কিছুই পাইলেন না, একটা পাত্রে কিঞ্চিৎ মধু ছিল, তাহাতেই সেই বস্তুর কিঞ্চিৎমাত্র মিশাইয়া রাখিলেন। কৌটাটিও অতি যত্নে সংগোপনে রাখিয়া দিলেন।
হজরত হাসান প্রতিদিনই একবার জায়েদার গৃহে আসিয়া দুই-এক দণ্ড নানাপ্রকার আলাপ করিতেন। কয়েক দিন আসিবার সময় পান নাই, সেই দিন মহাব্যস্তে জায়েদার ঘরে আসিয়া বসিলেন। জায়েদা পূর্বমত স্বামীর পদসেবা করিয়া জলযোগের আয়োজন করিতে লাগিলেন।
হাসান ভাবিয়াছিলেন, জায়েদার ঘরে কয়েক দিন যাই নাই, না জানি জায়েদা আজ কতই অভিমান করিয়া রহিয়াছে। কিন্তু ব্যবহারে তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিলেন। জায়েদা পূর্বাপেক্ষা শতগুণে সরলতা শিখিয়াছে, মানসের পূর্ণানন্দে পরিপূরিত রহিয়াছে। এই ভাব দেখিয়া হাসান আজ জায়েদার গৃহে বাস করিবেন, মনে মনে স্থির করিলেন। জায়েদাও নানাপ্রকার হাবভাব প্রদর্শনে স্বামীর মন হরণ করিয়া প্রাণ হরণ করিতে বসিলেন। ঈশ্বরভক্তই হউন, মহামহিম ধার্মিকপ্রবরই হউন, মহাবলশালী বীরপুরুষই হউন, কী মহাপ্রাজ্ঞ সুপণ্ডিতই হউন, স্ত্রীজাতির মায়াজাল ভেদ করা বড়ই কঠিন। নারীবুদ্ধির অন্ত পাওয়া সহজ নহে। জায়েদা এক পাত্রে মধু ও অন্য পাত্রে জল আনিয়া স্বামীর সম্মুখে রাখিলেন।
সকৌতুকে হাসান জিজ্ঞাসা করিলেন, “অসময়ে মধু?”
মায়াপূর্ণ আঁখিতে হাসানের দিকে একবার তাকাইয়া জায়েদা উত্তর করিলেন, “আপনার জন্য আজ আট দিন এই মধু সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছি। পান করিয়া দেখুন, খুব ভাল মধু।”
মধুর পেয়ালা হস্তে তুলিয়া হাসান বলিতে লাগিলেন, “আমার জন্য আট দিন যত্ন করিয়া রাখিয়াছ, ধন্য তোমার যত্ন ও মায়া! আমি এখনই খাইতেছি।” হাসান সহর্ষে এই কথা বলিয়া মধুপাত্র হস্তে তুলিয়া মধু পান করিলেন। মুহূর্ত মধ্যেই বিষের কার্য আরম্ভ হইল। শরীরের অবস্থার পরিবর্তন ও চিত্তের অস্থিরতাপ্রযুক্ত পিপাসার আধিক্য হইল। ক্রমে কণ্ঠ, তালু ও জিহ্বা শুষ্ক হইয়া আসিল, চক্ষু লৌহিতবর্ণ হইয়া শেষে দৃষ্টির ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। তিনি যেন চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। জায়েদাকে বলিলেন, “জায়েদা! এ কী হইল? এ কেমন মধু? এত জল পান করিলাম, পিপাসার শান্তি হইল না। ক্রমেই শরীর অবশ হইতেছে, পেটের মধ্যে কে যেন আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। ইহার কারণ কি? কিসে কি হইল?”
জায়েদা বায়ুব্যজনে প্রবৃত্ত হইলেন। মস্তকে শীতল জল ঢালিতে লাগিলেন, কিছুতেই হাসান সুস্থির হইলেন না। ক্রমেই শরীরের জ্বালা বর্ধিত হইতে লাগিল। বিষের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া সামান্য শয্যার উপর গড়াগড়ি দিতে লাগিলেন। পেটের বেদনা ক্রমশঃই বৃদ্ধি। হাসান অত্যন্ত কাতর হইয়া অবশেষে কাতরস্বরে জিজ্ঞাসা করিরেন, “জায়েদা! এ কিসের মধু? মধুতে এত আগুন? মধুর এমন জ্বালা! উঃ! আর সহ্য হয় না! আমার প্রাণ গেল! জায়েদা! উঃ! আর আমি সহ্য করিতে পারি না।”
জায়েদা যেন অবাক্; মুখে কথা নাই। অনেকক্ষণ পরে কেবল মাত্র এই কথা, “সকলই আমার কপালের দোষ। মধুতে এমন হইবে, তা কে জানে! দেখি দেখি, আমিও একটু খাইয়া দেখি।”
হাসান এই অবস্থাতেই নিষেধ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “জায়েদা! আমার কথা রাখ; ও মধু তুমি খাইয়ো না। আমার মাথা খাও, ও মধু মুখে দিয়ো না! ছুঁইয়ো না! জায়েদা! ও মধু নয়, কখনোই ও মধু নয়! তুমি-খোদার দোহাই, ও মধু তুমি ছুঁইয়ো না! আমি যে যাতনা ভোগ করিতেছি, তাহা আমিই জানি। জায়েদা ঈশ্বরের নাম কর।”
পত্নীকে এই কথা বলিয়া হাসান ঈশ্বরের নাম করিতে লাগিলেন। কাহাকেও সংবাদ দিলেন না, জায়েদার ঘরেই ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করিয়া রহিলেন। পবিত্র হৃদয়ে পবিত্র মুখেই দয়াময়ের পবিত্র নাম পুনঃপুনঃ উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। বিষের বিষম যাতনা নামের গুণে কতক পরিমাণে অল্প বোধ হইতে লাগিল। জায়েদা সমস্ত রাত্রি জাগিয়া সেবা-শুশ্রূষা করিলেন। প্রভাতী উপাসনার সময়ে অতি কষ্টে জায়েদার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া প্রভু মোহাম্মদের সমাধি-মন্দিরে গমন করিলেন। মন্দিরের সম্মুখস্থিত প্রাঙ্গণে উপবেশন করিয়া বিনীতভাবে ঈশ্বরের নিকট সকাতরে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন।
যাঁহার কৃপাবলে অনন্ত জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে, পর্বত সাগরে মিশিয়াছে, বিজন বন নগরে পরিণত হইয়াছে, জনপূর্ণ মহানগরী নিবিড় অরণ্য হইয়া যাইতেছে, সেই সর্বেশ্বরের অসাধ্য কি আছে? প্রভু মোহাম্মদের সমাধি-মন্দিরের পবিত্রতাগুণে, ঈশ্বরের মহিমায় হাসান আরোগ্য লাভ করিলেন। কিন্তু এই প্রথম বিষপান হইতে (মৃত্যু পর্যন্ত চল্লিশ দিন) প্রায় কোন না কোন প্রকারে শরীরের গ্লানি ছিল। এ কথা (প্রথম বিষপান ও আরোগ্য লাভ) অতি গোপনে রাখিলেন। কাহারো নিকটে প্রকাশ করিলেন না।
প্রণয়ী বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি শত্রু হইয়া দাঁড়ায়, তাহার হস্ত হইতে রক্ষা পাওয়া নিতান্ত কঠিন। চিরশত্রুর হস্ত হইতে অনেকেই রক্ষা পাইতে পারে, কিন্তু মিত্র যদি শত্রু হয়, তাহার হস্ত হইতে রা পাওয়ার আশা কিছুতেই থাকে না। বিশেষত স্ত্রীজাতি শত্রুতাসাধনে উত্তেজিত হইয়া উঠিলে, তাহা শেষ না করিয়া প্রাণ থাকিতে ক্ষান্ত হয় না। জায়েদা ক্ষান্ত হইবেন কেন? জায়েদার পশ্চাতে আরো লোক আছে। জায়েদা একটু নিরুৎসাহ হইলে, মায়মুনা নানাপ্রকারে উৎসাহিত করিয়া নূতন ভাবে উত্তেজিত করিত। একবার বিফল হইলে দ্বিতীয়বারে অবশ্যই সুফল ফলিবে, এ কথাও জায়েদার কর্ণে মধ্যে মধ্যে ফুৎকারের ন্যায় বাজিতে লাগিল।
মায়মুনা মনে মনে ভাবিয়াছিল, যাহা দিয়াছি তাহাতে আর রক্ষা নাই। একবার গলাধঃকরণ হইলেই কার্যসিদ্ধি হইবে। হাসান জায়েদার গৃহে আসিয়া বসিয়াছেন, মধুপানে আত্মবিকার উপস্থিত হইয়াছে, গোপনে সন্ধান লইয়া একেবারে নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া আছে, কোন্ সময়ে হাসানের পুরী হইতে ক্রন্দনধ্বনি শুনিবে, নিজেও কাঁদিতে কাঁদিতে যাইয়া পুরবাসিগণের সহিত হাসানের বিয়োগজনিত ক্রন্দনে যোগ দিবে এইরূপ আলোচনায় সারানিশা বসিয়া বসিয়া কাটাইল; প্রভাত হইয়া আসিল, তবুও ক্রন্দনশব্দ তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল না। দুই-এক পদ করিয়া জায়েদার গৃহ পর্যন্ত আসিল, জায়েদার মুখে সমুদয় ঘটনা শুনিয়া আশ্চর্যান্বিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “তবে উপায়?”
জায়েদা উত্তর করিল, “উপায় অনেক আছে। তুমি বাজার হইতে আমাকে কিছু মিষ্ট খেজুর আনিয়া দাও। এবারে দেখিয়ো কিছুতেই রক্ষা হইবে না!”
“খেজুরে কী হইবে?”
“মধুতে যাহা হইয়াছিল, তাহাই হইবে।”
“তিনি কী তোমার ঘরে আসিবেন?”
কেন আসিবে না?”
“যদি জানিয়া থাকেন-ঘুণাক্ষরে যদি টের পাইয়া থাকেন, তবে তোমার ঘরে আসা দূরে থাক্, তোমার মুখও দেখিবেন না।”
“বোন্! তুমি আমার বয়সে বড়, অনেক দেখিয়াছ, অনেক শুনিয়াও থাকিবে, কিন্তু তোমার ভ্রমও অনেক। স্ত্রীজাতির এমনি একটি মোহিনীশক্তি আছে যে, পুরুষের মন অতি কঠিন হইলেও সহজে নোয়াইতে পারে, ঘুরাইতে পারে, ফিরাইতেও পারে। তবে অন্যের প্রণয়ে মজিলে একটু কথা আছে বটে, কিন্তু হাতে পাইয়া নির্জনে বসাইতে পারিলে, কাছে ঘেঁষিয়া মোহন মন্ত্রগুলি ক্রমে ক্রমে আওড়াইতে পারিলে অবশ্যই কিছু-না-কিছু ফল ফলাইতে পারিবই পারিবে। এ যে না পারে সে নারী নহে। আর আমি তাঁহাকে বিষপান করাইব এ কথা তো তিনি জানেন না, কেহ তো তাঁহাকে সে কথা বলে নাই; তিনিও তো সর্বজ্ঞ নহেন যে, জয়নাবের ঘরে বসিয়া জায়েদার মনের খবর জানিতে পারিবেন। যে পথে দাঁড়াইয়াছি, আর ফিরিব না, যাহা করিতে হয়, আমিই করিব।”
মায়মুনা মনে মনে সন্তুষ্ট হইয়া মনে মনেই বলিল, “মানুষের মনের ভাব পরিবর্তন হইতে ক্ষণকালও বিলম্ব হয় না।” প্রকাশ্যে কহিল, “আমি খেজুর লইয়া শীঘ্রই আসিতেছি।” মায়মুনা বিদায় হইল। জায়েদা অবশিষ্ট মধু, যাহা পাত্রে ছিল, তাহা আনিয়া দেখিয়া দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, “যেমন মধু তেমনই আছে; ইহার চারি ভাগের এক ভাগও যদি উদরস্থ হইত, তাহা হইলে আজ এতক্ষণ জয়নাবের সুখতরী ডুবিয়া যাইত, সুখের বাসা ভাঙ্গিয়া একেবারে দুঃখের সাগরে ডুবিত, স্বামীসোহাগিনীর সাধ মিটিয়া যাইত! এই সুমধুর মধুতেই জায়েদার আশা পরিপূর্ণ হইত। প্রথমে যে ভাব হইয়াছিল, আর কিছুক্ষণ সেই ভাবে থাকিলে আজ জয়নাবের আর হাসিমুখ দেখিতাম না; আমারও অন্তর জ্বলিত না। এক বার, দুই বার, তিন বার, যত বার হয় চেষ্টা করিব; চেষ্টার অসাধ্য কী আছে?”
মায়মুনা খেজুর লইয়া উপস্থিত হইল। বলিল, “সাবধান! আর আমি বিলম্ব করিব না। যদি আবশ্যক হয়, সময় বুঝিয়া আমার বাটীতে যাইয়ো।” এই কথা বলিয়া মায়মুনা চলিয়া গেল। জায়েদা সেই খেজুরগুলি বাছিয়া বাছিয়া দুই ভাগ করিলেন। এক ভাগের প্রত্যেক খেজুরে এমন এক একটি চিহ্ন দিলেন যে তিনি ভিন্ন অন্য কাহারো চক্ষে তাহা পড়িবার সম্ভাবনা রহিল না। অবশিষ্ট অচিহ্নিত খেজুরগুলিতে সেই কৌটার সাংঘাতিক বিষ মিশ্রিত করিয়া, উভয় খেজুর একত্র করিয়া রাখিয়া দিলেন।
হাসান জয়নাবকে বলিয়াছিলেন যে, “গত রাত্রিতে জায়েদার গৃহে বাস করিব ইচ্ছা ছিল, দৈববশে এমনই একটি ঘটনা ঘটিল যে সমস্ত রাত্রি পেটের বেদনায়, শরীরের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। মুহূর্তকালের জন্যও সুস্থির হইতে পারি নাই। ভাবনায় চিন্তায় জায়েদা কোন কথাই মুখে আনিতে পারিল না। কেবলমাত্র বলিয়াছিল যে, ‘সকলই আমার কপাল!’ তা যাহাই হউক, আজিও আমি জায়েদার গৃহে যাইতেছি!”
জয়নাব বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া হাসানকে বিদায় দান করিলেন। জয়নাবের ইচ্ছা যে, কাহারো মনে দুঃখ না হয়, স্বামীধনে কেহই বঞ্চিত না হয়। সে ধনে সকলেই সমভাবে অধিকারিণী ও প্রত্যাশিনী।
হাসানের শরীর সম্যক্ প্রকারে সুস্থ হয় নাই; বিষের তেজ শরীর হইতে একেবারে যে নির্দোষভাবে অপসৃত হইয়াছে, তাহাও নহে। শরীরের গ্লানি ও দুর্বলতা এবং উদরের জড়তা এখনো অনেক আছে। এ সকল থাকা সত্ত্বেও তিনি জায়েদার গৃহে উপস্থিত হইয়া গত রাত্রির ঘটনা আলোচনা করিতে লাগিলেন। সেই মধুর কথাও জিজ্ঞাসা করিরেন। জায়েদা উত্তর করিলেন, “যে মধুতে এত যন্ত্রণা, এত কেশ; সেই মধু আমি আবার গৃহে রাখিব? পাত্রসমেত তাহা আমি তৎক্ষণাৎ দূর করিয়া ফেলিয়া দিয়াছি।”
জায়েদার ব্যবহারে হাসান যারপরনাই সন্তুষ্ট হইলেন। সুযোগ পাইয়া জায়েদা সেই খর্জুরের পাত্র ইমাম হাসানের সম্মুখে রাখিয়া, নিকটে বসিয়া খর্জুর ভণে অনুরোধ করিলেন। হাসান স্বভাবতঃই খর্জুর ভালবাসিতেন, কিন্তু গত রজনীতে মধুপান করিয়া যে কষ্ট পাইয়াছিলেন, তাহা মনে করিয়া একটু ইতস্তত করিতে লাগিলেন। চতুরা জায়েদা স্বামীর অগ্রেই চিহ্নিত খেজুরগুলি খাইতে আরম্ভ করিয়া দিলেন। দেখাদেখি, ইমাম হাসানও চিহ্নিত এবং অচিহ্নিত উভয়বিধ খেজুর একটি একটি করিয়া খাইতে আরম্ভ করিলেন। ঊর্ধ্ব সংখ্যা সাতটি উদরস্থ হইলেই বিষের কার্য আরম্ভ হইল। হাসান সন্দেহপ্রযুক্ত আর খাইলেন না, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অস্থির হইয়া পড়িলেন। আর বিলম্ব করিলেন না, কোন কথাও কহিলেন না; নিতান্ত দুঃখিতভাবে প্রাণের অনুজ হোসেনের গৃহাভিমুখে গমন করিলেন। এবারো কাহাকে কিছু বলিলেন না; কিছুণ ভ্রাতৃগৃহে অবস্থিতি করিলেন। নিদারুণ বিষের যন্ত্রণা ক্রমশ অসহ্য হইয়া উঠিল। পুনরায় তিনি প্রভু মোহাম্মদের ‘রওজা মোবারকে’ (পবিত্র সমাধিক্ষেত্রে) যাইয়া ঈশ্বরের নিকটে আরোগ্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। দয়াময় এবারেও হাসানকে আরোগ্য করিয়া প্রাণ রক্ষা করিলেন।
জায়েদার আচরণ হাসান কিছু বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তথাপি সে কথা মুখে আনিলেন না; কাহারো নিকট প্রকাশ করিলেন না। কিন্তু মনে মনে বড়ই দুঃখিত হইলেন। নির্জনে বসিয়া স্বগত বলিতে লাগিলেন, “স্ত্রী দুঃখের ভাগিনী, সুখের ভাগিনী। আর আমার স্ত্রী যাহা-ঈশ্বরই জানেন। আমি জ্ঞানপূর্বক জায়েদার কোন অনিষ্ট করি নাই, কোন প্রকারে কষ্টও দিই নাই। জয়নাবকে বিবাহ করিয়াছি বলিয়াই কী জায়েদা আমার প্রাণ লইতে সঙ্কল্প করিয়াছে? স্বহস্তে পতিবধে প্রবৃত্ত হইয়াছে? সপত্নীসম্বন্ধ তাহার নূতন নহে। হাসনেবানুও তো তাহার সপত্নী। যে জায়েদা আমার জন্য সর্বদা মহাব্যস্ত থাকিত, কিসে আমি সন্তুষ্ট থাকিব, তাহারই অনুসন্ধান করিত, আজ সেই জায়েদা আমার প্রাণবিনাশের জন্য বিষ হস্তে করিয়াছে! একথা আর কাহাকেও বলিব না! এ বাটীতেও আর থাকিব না। মায়াময় সংসার ঘৃণার্হ স্থান। নিশ্চয়ই জায়েদার মন অন্য কোন লোভে আক্রান্ত হইয়াছে। অবশ্যই জায়েদা কোন আশায় ভুলিয়াছে, কুহকে পড়িয়াছে। সপত্নীবাদে আমাকে বিষ দিবে কেন? এ বিষ জয়নাবকে দিলেই তো সম্ভবে। জয়নাবের প্রাণেই তাহার অনাদর হইতে পারে, আমার প্রাণে অনাদর হইলে তাহার আর সুখ কী? স্ত্রী হইয়া যখন স্বামীবধে অগ্রসর হইয়াছে, তখন আর আমার নিস্তার নাই। এ পুরীতে আর থাকিব না। স্ত্রী-পরিজনের মুখ আর দেখিব না, এই পুরীই আমার জীবন বিনাশের প্রধান যন্ত্র।-কিছুতেই এখানে থাকা উচিত নহে। বাহিরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়াও সহজ, কিন্তু ঘরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর! শত্রু দূরে থাকিলেও সর্বদা আতঙ্ক। কোন্ সময়ে কী ঘটে,-কোন্ সূত্রে, কোন্ সুযোগে, কী উপায়ে, কোন্ পথে, কাহার সাহায্যে, শত্রু আসিয়া কী কৌশলে শত্রুতা সাধন করে, এই ভাবনায় ও এই ভয়েই সর্বদা আকুল থাকিতে হয়। কিন্তু আমার ঘরেই শত্রু! আমার প্রাণই আমার শত্রু! নিজ দেহই আমার ঘাতক! নিজ হস্তই আমার বিনাশক! নিজ আত্মাই আর বিসর্জক। উঃ! কী নিদারুণ কথা! মুখে আনিতেও কষ্ট বোধ হয়! স্ত্রী-স্বামীতে দেহ ভিন্ন বটে, কিন্তু আমি তো আর কিছুই ভিন্ন দেখি না। স্বামী, স্ত্রী এক দেহ হইতে পারে না বলিয়াই ভিন্ন ভাবে থাকে, কিন্তু আত্মা এক, মন এক, মায়া মমতা এক, আশা এক, ভরসা এক, প্রাণ এক,-সকলই এক। কিন্তু কী দুঃখ! কী ভয়ানক কথা! হা অদৃষ্ট! সেই এক আত্মা এক প্রাণ স্ত্রী-তাহার হস্তেই স্বামীবিনাশের বিষ। কী পরিতাপ! সেই কোমল হস্ত স্বামীর জীবন-প্রদীপ নির্বাণের জন্য প্রসারিত! আর এস্থানে থাকিব না। বনে বনে পশুপীদের সহবাসে থাকাই ভাল। এ পুরীতে আর থাকিব না।”
এইরূপে দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া হাসান আপন প্রধান মিত্র আব্বাস ও কতিপয় এয়ার সমভিব্যাহারে মদিনার নিকটস্থ মুসাল নগরে গমন করিলেন। মুসালবাসীরা হজরত ইমাম হাসানের শুভাগমনে যারপরনাই আনন্দিত হইয়া অতি সমাদরে বিশেষ ভক্তি-উপহারে অভ্যর্থনা করিলেন, কিন্তু এখানে তাঁহার ভাগ্যে বেশি দিন বিশ্রাম ঘটিল না।