স্বাধীন – কি মধুমাখা কথা! স্বাধীন জীবন কি আনন্দময়! স্বাধীন দেশ আরামের স্থান! স্বাধীন ভাবের কথাগুলি কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলে হৃদয়ের সূক্ষ্ম শিরা পর্যন্ত আনন্দোচ্ছ্বাসে স্ফীত হইয়া উঠে এবং অন্তরে বিবিধ ভাবের উদয় হয়। হয় মহাহর্ষে মন নাচিতে থাকে, না হয় মহাদুঃখে অন্তর ফাটিয়া যায়। স্বাধীন মন, স্বাধীন জীবন, পরাধীন স্বীকার করিতে যেরূপ কষ্ট বোধ করে, আবার অন্যকে অধীনতা স্বীকার করাইতে পারিলে ঐ অন্তরেই অসীম আনন্দ অনুভব হয়। এক পক্ষের দুঃখ, অপর পক্ষের সুখ।
এজিদ্ স্বরাজ্যে স্বাধীন। সকলেই তাহার আদেশের অধীন! জয়নালকে হাসি-রহস্যচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “তুই কি করিবি?” জয়নালের মুখে তাহার উত্তরও শুনিয়াছে। ক্রমে বশে আনিয়া, ক্রমে শান্তভাব ধরাইয়া, কার্যসিদ্ধির উপায় না করিলে এইক্ষণে কিছুই হইবে না। জয়নালকে প্রাণে মারিয়া, মদিনার সিংহাসনে বসিলে কোন লাভ নাই। জয়নাল নিয়মিতরূপে মদিনার কর দামেস্কে যোগাইলে দামেস্ক সিংহাসনের সহস্র প্রকারে গৌরব। কিন্তু সিংহ-শাবককে বশে আনা সহজ কথা নহে। কিছুদিন চেষ্টা করিয়া দেখা কর্তব্য। প্রথমেই নিরাশ হইয়া হোসেন-বংশ একেবারে বিনাশ করিলে বাহাদুরি কি? এই সকল আশার কুহকে পড়িয়া এজিদ্ বন্দিগণ প্রতি সুব্যবস্থার অনুমতি করিয়াছিল।
জয়নাল কিসে বশ্যতা স্বীকার করে, কিসে প্রভু বলিয়া মান্য করে, কি উপায় করিলে নির্বিঘ্নে মদিনা রাজ্য করতলস্থ হয়, অধীন দাসত্বকলঙ্করেখা জয়নালের সুপ্রশস্ত ললাটে অক্ষয়রূপে অঙ্কিত হয়, এজিদ্ এই সকল মহাচিন্তার ভার নিজ মস্তকে লইয়াও কৃতকার্য হইতে পারে নাই। বিনা যুদ্ধে মদিনার সম্রাট্ হওয়া সহজ কথা নহে! এজিদের মস্তক কেন-লোকমান আফ্লাতুন প্রভৃতি মহা মহা চিন্তাশীল মহজ্জনের মস্তিষ্কও এ চিন্তায় ঘুরিয়া যায়। কিন্তু এজিদের এমনই দৃঢ়বিশ্বাস যে, মারওয়ান চেষ্টা করিলে অবশ্যই ইহার কোন এক প্রকারের সদুপায় বাহির করিবে। মনের ব্যগ্রতায় দামেস্কের বহুলোকের প্রতি তাহার চক্ষু পড়িল, কিন্তু মারওয়ান ভিন্ন ইহার স্থির সিদ্ধান্ত করার উপযুক্ত পাত্র মানবচক্ষে কাহাকেও দেখিতে পাইল না।
মারওয়ান উপস্থিত হইলে, এজিদ্ ঐ সকল গুপ্ত বিষয়ের স্থির সিদ্ধান্ত করিতে কহিলেই মারওয়ান একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “আগামী জুম্মাবারে (শুক্রবারে) জয়নাল দ্বারা মহারাজ নামে খোৎবা পাঠ করাইব। এক্ষণে সমগ্র প্রদেশে হোসেনের নামে খোৎবা হইতেছে। কারণ হোসেনের পর এ পর্যন্ত মদিনায় রাজা কেহ হয় নাই। জয়নাল যদি আপন পিতার নাম পরিত্যাগ করিয়া মহারাজের নামে খোৎবা পাঠ করে, তবেই কার্যসিদ্ধি-তবেই দামেস্কের জয়-তবেই বিনা যুদ্ধে মদিনা করতলে। যাঁহার নামে খোৎবা, তিনিই মক্কা-মদিনার রাজা। এখনই রাজ্যমধ্যে ঘোষণা করিয়া দিতেছি যে, আগামী জুম্মাবারে, শেষ ইমাম জয়নাল আবেদীন,-দামেস্ক-সম্রাট্ মহারাজাধিরাজ এজিদ্ নামদার নামে খোৎবা পাঠ করিবেন। নগরের যাবতীয় ঈশ্বরভক্ত লোককেই উপাসনা-মন্দিরে খোৎবা শুনিতে উপস্থিত হইতে হইবে। যিনি রাজ আজ্ঞা অবহেলা করিবেন, তৎক্ষণাৎ তাঁহার শিরচ্ছেদ করা যাইবে।”
এজিদ্ মহা তুষ্ট হইয়া মারওয়ানকে যথোপযুক্ত পুরস্কৃত করিল। মুহূর্তমধ্যে রাজঘোষণা দামেস্ক নগরের ঘরে ঘরে প্রকাশ হইল। ঘোষণার মর্মে অনেকেই সুখী হইল, আবার অনেকে মাথায় হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। তাহাদের হৃদয়ে বিষম আঘাত লাগিল। প্রকাশ্যে কোন কথা বলিবার সাধ্য নাই-রাজদ্রোহী সাব্যস্ত হইয়া প্রাণ যায়। গোপনে গোপনে বলিতে লাগিল, “এতদিন পরে নূরনবী মোহাম্মদের প্রচারিত ধর্মে কলঙ্করেখা পতিত হইল! হায় হায়! কি মর্মভেদী ঘোষণা! হায় হায়! ইসলাম ধর্মের এত অবমাননা! কাফেরের নামে খোৎবা। বিধর্মী নারকী ঈশ্বরদ্রোহীর নামে খোৎবা। হা ইসলাম ধর্ম! দুরন্ত জালেমের হস্তে পড়িয়া তোমার এই দুর্দশা! হায় হায়! পুণ্যভূমি মদিনার সিংহাসন যাঁহার আসন, সেই শেষ ইমাম জয়নাল আবেদীন, কাফেরের নামে খোৎবা পড়িবে? সে খোৎবা শুনিবে কে? সে উপাসনাগৃহে যাইবে কে? আমরা অধীন প্রজা, না যাইয়া নিস্তার নাই। জগদীশ! আমাদের কর্ণ বধির কর, চক্ষুর জ্যোতি হরণ কর, চলচ্ছক্তি রহিত কর।”
মোহাম্মদীয়গণ নানা প্রকারে অনুতাপ করিতে লাগিলেন। এজিদ্ পক্ষীয় বিধর্মীরা দর্প করিয়া বলিতে লাগিল, “মোহাম্মদ বংশের বংশমর্যাদার চিরগৌরব এখন কোথায় রহিল? ধন্য মন্ত্রী মারওয়ান!”
এ সকল সংবাদ বন্দিরা এখন পর্যন্ত জানিতে পারে নাই! এজিদ্ মনে করিয়াছে, উহাদের জীবন আমার হস্তে,-মুহূর্তে প্রাণ রাখিতে পারি, মুহূর্তে বিনাশ করিতে পারি। জুম্মার দিন জয়নালকে ধরিয়া আনিয়া মস্জিদে পাঠাইয়া দিব। যদি আমার নামে খোৎবা পড়িতে অস্বীকার করে, রাজাজ্ঞা অমান্য করার অপরাধে তখনই উহার প্রাণবিনাশ করিব।
জুম্মাবার উপস্থিত; নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই মোহাম্মদীয়গণ প্রাণের ভয়ে উপাসনা-মন্দিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জয়নাল আবেদীনের নিকটে যাইয়া মারওয়ান বলিল, “আজ তোমাকে মস্জিদে খোৎবা পড়িতে হইবে।”
জয়নাল বলিলেন, “আমি প্রস্তুত আছি। ইমামদিগের কার্যই উপাসনায় অগ্রবর্তী হওয়া, খোৎবা পাঠ, ধর্মের আলোচনা, শিষ্যদিগকে উপদেশ দান;-সুতরাং ঐ সকল আমার কর্তব্য কার্য। তুমি অপেক্ষা কর, আমি আমার মায়ের অনুমতি লইয়া আসিতেছি।”
“তোমার মা’র অনুমতি লইতেই যদি চলিলে, তবে আর একটি কথা শুনিয়া যাও।”
“কি কথা?”
“খোৎবা পড়িতে হইবে বটে, কিন্তু তোমার নামে পড়িতে পারিবে না।”
জয়নাল চক্ষু পাকল করিয়া বলিলেন, “কেন পারিব না?”
“কেন-র কোন উত্তর নাই,-রাজার আজ্ঞা।”
“ধর্মচর্চায় বিধর্মী রাজার আজ্ঞা কি? আমার ধর্মকর্ম আমি করিব, তাহাতে তোমাদের কথা কি? আমি যতদিন মদিনার সিংহাসনে না বসিব ততদিন পিতার নামেই খোৎবা পাঠ করিব: এই তো রাজার আজ্ঞা। তুমি কোন্ রাজার কথা বল?”
“তুমি নিতান্তই অবোধ, কিছুই বুঝিতেছ না। তোমার মার নিকট বলিলে তিনি সকলই বুঝিতে পারিবেন।”
“আমি অবোধ না হইলে তোমাদের বন্দিখানায় কেন আসিব? আর কী কথা আছে বল। আমি মা’র নিকটে যাইতেছি।”
“যিনি দামেস্কের রাজা, তিনিই এক্ষণে মদিনার রাজা। মক্কা ও মদিনা একই রাজার রাজ্য হইয়াছে। এখন ভাব দেখি, কাহার নামে খোৎবা পড়া কর্তব্য?”
“আমি ও-প্রকারের কথা বুঝিতে পারি না। যাহা বলিবার হয়, স্পষ্টভাবে বল।”
“তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান নাই; কেবল থাকিবার মধ্যে আছে-রাগ আর নিজের অহঙ্কার। বাদশা এজিদের নামে খোৎবা পড়িতে হইবে।”
জয়নাল আবেদীন রোষে এবং দুঃখে সজলনয়নে বলিতে লাগিলেন, “কাফেরের নামে আমি খোৎবা পড়িব? এজিদ্ কোন্ দেশের রাজা? আর সে কোন্ রাজার পুত্র?”
মারওয়ান অতিব্যস্তে জয়নাল আবেদীনকে ধরিয়া সস্নেহে বলিতে লাগিল, “সাবধান! সাবধান!! ও-কথা মুখে আনিয়ো না। ও-কথা মুখে আনিলে নিশ্চয় তোমার মাথা কাটা যাইবে।”
“আমি মাথা কাটাইতে ভয় করি না। তুমি আমার নিকট হইতে চলিয়া যাও; আমি খোৎবা পড়িতে যাইব না।”
মারওয়ান মনে করিয়াছিল যে, জয়নালকে বলিবামাত্র সে খোৎবা পড়িতে আসিবে। কিন্তু তাহার কথা শুনিয়া অবাক্ হইল। এদিকেও উপাসনার সময় অতি নিকট। মারওয়ান মনে মনে বলিতে লাগিল, “এ সিংহশাবকের নিকট চাতুরী চলিবে না, বল প্রকাশ করিলেও কার্য উদ্ধার হইবে না। সালেমা বিবির নিকট যাইয়া বলি;-তিনি সর্বশ্রেষ্ঠা, বয়সেও প্রবীণা, অবশ্যই ভাল-মন্দ বিবেচনা করিয়া জয়নালকে সম্মত করাইয়া দিবেন। সকলেই এক বন্দিগৃহে।”
মারওয়ান সালেমা বিবির নিকট যাইয়া বলিল, “আপনাদের কপালের এমনই গুণ যে ভাল করিতে গেলেও মন্দ হইয়া যায়। আমার ইচ্ছা যে কোন প্রকারে এই বিপদ হইতে আপনারা উদ্ধার পান।”
সালেমা বিবি বলিলেন, “কি প্রকারে ভাল করিতে ইচ্ছা কর?”
“মহারাজ এজিদ্ নামদার আজ্ঞা করিয়াছেন যে, জয়নাল আবেদীনের দ্বারা আজিকার জুম্মার খোৎবা পড়াইয়া তাঁহাদিগকে কারামুক্ত করিয়া দাও।”
“ভাল কথা। জয়নাল কই? তাহাকে এ-কথা বলিয়াছ?”
“বলিয়াছি এবং তাহার উত্তর শুনিয়াছি!”
“সে কী উত্তর করিল? তার বুদ্ধি কী?”
“বুদ্ধি খুব আছে, ক্রোধও খুব আছে।”
“ক্রোধের কথা বলিয়ো না। বাপু! তাহারা ধর্মের দাস, ধর্মই তাহাদের জীবন; বোধ হয়, ধর্মসংক্রান্ত কোন কথা বলিয়া থাকিবে। ধর্মবিরোধী কথা তাহাদের কর্ণে প্রবেশ না করিলে কখনোই সে শরীরে ক্রোধের সঞ্চার হয় না।”
“মহারাজ আজ্ঞা করিয়াছেন, আজ হোসেনের নাম পরিবর্তন করিয়া মক্কা ও মদিনা এইক্ষণে যাঁহার করতলে, জয়নাল আবেদীন তাঁহারই নামে খোৎবা পাঠ করুন। আমি আজই তাঁহাদিগকে বন্দিগৃহ হইতে মুক্ত করিয়া মদিনায় পাঠাইয়া দিব। জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিয়া রাজত্ব করুন,-কিন্তু তাঁহাকে দামেস্করাজের অধীনে থাকিতে হইবে!”
“এ কী কথা! বন্দি হইয়া আসিয়াছি বলিয়াই কী সে ধর্মের প্রতি হস্তক্ষেপ করিবে? আমাদের প্রতি যে অত্যাচার করিতেছে তাহাকে যথার্থ ধার্মিক বলিয়া কিরূপে স্বীকার করিব? হজরত মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ্র প্রচারিত ধর্মে যে দীক্ষিত নহে, মদিনার সিংহাসনের যে অধীশ্বর নহে, তাহার নামে কী প্রকারে খোৎবা পাঠ হইতে পারে? তাও আবার পাঠ করিবে-জয়নাল আবেদীন! এ কী কথা!”
“আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, একটু শান্ত হউন! বন্দিভাবে থাকিয়া এতদূর বলা নিতান্ত অন্যায়। যাহা হউক, আমি বলি, যদি খোৎবাটা পড়িলেই মুক্তিলাভ হয়, তাহাতে হানি কী? জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিতে পারিলে কি আর তাঁহার উপর দামেস্করাজের কোন ক্ষমতা থাকিবে? তখন যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারিবেন, ইহাতে আর আপনাদের ক্ষতি কি?”
“ক্ষতি কিছুই নাই;-কিন্তু-”
“আর ‘কিন্তু’ কথা মুখে আনিবেন না, প্রাণ বাঁচাইবার জন্য অনেক-”
“জয়নালকে একবার ডাকিতে বল।”
জয়নাল আবেদীন আড়ালে থাকিয়া সকলই শুনিতেছিলেন, সালেমা বিবির কথার আভাসেই নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। মহারোষের চিহ্ন এবং ক্রোধের লক্ষণ দেখিয়া, সালেমা বিবি অনুমানেই অনেক বুঝিলেন। সস্নেহে জয়নালের কপোলদেশ চুম্বন করিয়া অতি নম্রভাবে বলিতে লাগিলেন, “এজিদের নামে খোৎবা পড়ায় দোষ কি? যদি ভগবান্ কখনো তোমার সুখসূর্যের মুখ দেখান, তোমার নামে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোক খোৎবা পাঠ করিবে। এখন মারওয়ানের কথা শুনিলে বোধ হয় ঈশ্বর ভালই করিবেন।”
জয়নাল বলিলেন, “আপনিও কী এজিদের নামে খোৎবা পড়িতে অনুমতি করেন?”
“আমি অনুমতি করি না; তবে ইহা বলিতে পারি যে, তোমার মুক্তির জন্য আমরা সকলে প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি। একদিন খোৎবা পড়িলেই যদি তুমি সপরিবারে বন্দিগৃহ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পার, মদিনার সিংহাসনে নির্বিবাদে বসিতে পার, তবে তাহাতে ক্ষতি কি ভাই? আরো কথা,-তুমি ইচ্ছা করিয়া এই কুকার্যে রত হইতেছ না। এ পাপ তোমাতে অর্পিবে না।”
সামান্য কারামুক্তি আর মদিনার রাজ্যলাভ জন্য আমি এজিদের নামে খোৎবা পড়িব? এ বন্দিগৃহ হইতে মুক্তির জন্য ভয় কী? শক্তি থাকিলেই মুক্তি হইবে। যদি কেহ রাজ্য কাড়িয়া লইয়া থাকে তাহার নিকট ভিক্ষা করিয়া রাজ্যগ্রহণ করা অপেক্ষা অস্ত্রে তাহার মস্তক নিপাত করাই আমার কথা।”
সালেমা বিবি জয়নালের মুখে শত শত চুম্বনপূর্বক আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ হউক! ঈশ্বর তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন।”
মারওয়ান বলিতে লাগিল, “আপনারা এরূপ গোলযোগ করিলে কোন কার্যই সিদ্ধ হইবে না। আর সময় নাই; যদি মদিনা যাইবার ইচ্ছা থাকে, এজিদের হস্ত হইতে পরিত্রাণের আশা থাকে, জয়নালকে খোৎবা পাঠ করিতে প্রেরণ করুন; ইহাতে সম্মত না হন, আমার অপরাধ নাই, আমি নাচার।”
সালেমা বিবি বলিলেন, “জয়নাল! তুমি ঈশ্বরের নাম করিয়া মস্জিদে যাও। তোমার ভাল হইবে।”
জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “আপনি যাইতে আজ্ঞা করিলেন?”
“হাঁ, আমি যাইতে আজ্ঞা করিলাম। তোমার কোন চিন্তা নাই। আরো একটি কথা বলিতেছি, শুন! শুনিয়া মনে মনে বিচার করিলেই ভাল-মন্দ বুঝিতে পারিবে। একদা তোমার পিতামহ হজরত আলী কাফেরদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে আম্বাজ নামে এক নগরে গমন করিয়াছিলেন। সেখানে যাইয়া শুনিলেন, এদেশ পুরুষাধিকারে নহে, একজন রাজ্ঞীর অধিকারভুক্ত। আরো আশ্চর্য কথা,-রাজ্ঞী এ পর্যন্ত বিবাহ করেন নাই; তাঁহার পণ এই, বাহুযুদ্ধে যে তাঁহাকে পরাস্ত করিবে, তাঁহাকেই পতিত্বে বরণ করিবেন, আর রাজ্ঞী জয়ী হইলে পরাজিত পক্ষকে আজীবন দাসত্ব স্বীকার করিয়া তাঁহার দাসভাবে থাকিতে হইবে। মহাবীর আলী স্ত্রীলোকের এই পণের কথা শুনিয়া যুদ্ধে প্রস্তুত হইলেন। বিবি হনুফাও কম ছিলেন না। আরবীয় যাবতীয় বীরকে তিনি জানিতেন। তাঁহারও মনে মনে ইচ্ছা ছিল যে, আলীকে পরাস্ত করিয়া একজন মহাবীর দাস লাভ করিবেন। ঘটনাক্রমে সুযোগ ও সময় উপস্থিত-দিন নির্ণয় হইল। রূপের গরিমায়-যৌবনের জ্বলন্ত প্রতিভায় বিবি হনুফা আরবের সুবিখ্যাত বীরকেও তুচ্ছজ্ঞানে সমরাঙ্গণে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু ঈশ্বরের মহিমায় যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া মোহাম্মদীয় ধর্ম গ্রহণপূর্বক মহাবীর আলীকে স্বামীত্বে বরণ করিলেন। হজরত আলী বিবি ফাতেমার ভয়ে এ কথা মদিনার কাহারো নিকট প্রকাশ করেন নাই। সময়ে বিবি হনুফার গর্ভে এক পুত্রসন্তান হয়। আলী সে সময়ে মহা চিন্তিত হইয়া কি করেন-কথাও গোপন থাকে না। বিবি ফাতেমার ভয়ও কম নহে। পুত্রকে গোপনে আনাইয়া একদা প্রভু মোহাম্মদের পদপ্রান্তে ফেলিয়া দিয়া জোড়হস্তে দণ্ডায়মান হইলেন। প্রভু মোহাম্মদ পুত্রটিকে ক্রোড়ে লইয়া মুখে চুমা দিয়া বলিলেন, “আমি সকলই জানি। আমি ইহার নাম, ইহার মাতার নামের সহিত এবং আমার নামের সহিত যোগ করিয়া রাখিলাম।” বিবি ফাতেমা দেখিলেন যে, একটি অপরিচিত সন্তানকে প্রভু ক্রোড়ে করিয়া বারবার মুখে চুমা দিতেছেন। বিবি ফাতেমা সন্তানের কথা জিজ্ঞাসা করায় প্রভু সমুদয় বৃত্তান্ত প্রকাশ করিলে, বিবি ফাতেমা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া পিতাকে এক প্রকার ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “আমার সপত্নীপুত্রকে আপনি স্নেহ করিতেছেন? আর কোন্ বিবেচনায় আপনার নামের সহিত যোগ করিয়া নাম রাখিলেন?”
প্রভু বলিলেন, “ফাতেমা, শান্ত হও! এই মোহাম্মদ হানিফা তোমার কি কি উপকার করিবে, শুন। যে সময়ে প্রিয় পুত্র হোসেন কারবালার মহাপ্রান্তরে এজিদের আজ্ঞায় সীমার হস্তে শহীদ হইবে, তৎকালে তোমার বংশে এক জয়নাল আবেদীন ভিন্ন পুরুষপক্ষে আর কেহ থাকিবে না; তোমার আত্মীয়-স্বজন ভগিনী পুত্রবধূরা এজিদের সৈন্যহস্তে কারবালা হইতে দামেস্কে বন্দিভাবে আসিবে। তাহাদের কষ্টের সীমা থাকিবে না। সেই কঠিন সময়ে এই মোহাম্মদ হানিফা যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে উদ্ধার করিবে, জয়নাল আবেদীনকে মদিনার সিংহাসনে বসাইবে।” বিবি ফাতেমা পিতৃমুখে এই সকল কথা শুনিয়া, মোহাম্মদ হানিফাকে আহ্লাদে ক্রোড়ে করিয়া হানিফার আপাদমস্তকে চুমা দিয়া আশীর্বাদপূর্বক বলিলেন, “প্রাণাধিক! তুমি আমার পুত্র, তুমি আমার হৃদয়ের ধন, মস্তকের মণি। আমার চুম্বিত স্থানে কোনরূপ অস্ত্র প্রবেশ করিবে না! তুমি সর্বদা সর্বজয়ী হইয়া জগতে মহাকীর্তি স্থাপন করিবে। আশীর্বাদ করি, তুমি দীর্ঘজীবী হও!” যে সময়ে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধের সূচনা হয়, সেই সময় আমি গোপনে একজন কাসেদকে মোহাম্মদ হানিফার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত বলিয়া পাঠাইয়াছি। মোহাম্মদ হানিফা শীঘ্রই দামেস্কে আসিয়া আমাদিগকে উদ্ধার করিবেন। এই তো শাস্ত্রের কথা। এখন সকলই ঈশ্বরের হাত। আরো একটি কথা,-হোসেন যুদ্ধকালে কি বলিয়া গিয়াছেন মনে হয়? তিনি বলিয়াছেন, “তোমরা ভাবিয়ো না, এমন একটি লোক আছে, যদি তাহার কর্ণে এই সকল ঘটনার অণুমাত্রও প্রবেশ করে, ইহার প্রতিশোধ সে অবশ্যই লইবে। সে কে? এই মোহাম্মদ হানিফা।”
জয়নাল আবেদীন এই পর্যন্ত শুনিয়া আর বিলম্ব করিলেন না। খোৎবা পাঠ করিবেন স্বীকার করিয়া উপাসনার সমুচিত পরিধেয় লইয়া বহির্গত হইলেন, মারওয়ান সঙ্গে সঙ্গে যাইতে লাগিল! নগরে হুলস্থূল পড়িয়াছে-আজ জয়নাল আবেদীন এজিদের নামে খোৎবা পাঠ করিবে। মারওয়ানের আনন্দের সীমা নাই। আজ এজিদের আশা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হইবে। জয়নাল উপাসনা-মন্দিরে প্রবেশ করিয়া উপাসনান্তর খোৎবা পাঠ আরম্ভ করিলেন। মোহাম্মদীয়গণের অন্তরে খোৎবার শব্দগুলি সুতীক্ষ্ণ ছুরিকার ন্যায় বিদ্ধ হইতে লাগিল। কোন্ মুখে জয়নাল আবেদীন মদিনার ইমামের নাম অর্থাৎ হোসেনের নামের স্থানে এজিদের নাম উচ্চারণ করিবেন? হায়! হায়! এ কী হইল? কিন্তু সময় উপস্থিত হইলে মদিনার সিংহাসনের যথার্থ উত্তরাধিকারী যিনি তাঁহারই নামে খোৎবা পাঠ হইল। খতিবের (খতিব-যে খোৎবা পাঠ করে।) মুখে কেহ এজিদের নাম শুনিল না। পূর্বেও যে নাম এখনো সেই হোসেনের নাম স্পষ্ট শুনিল।
মোহাম্মদীয়গণ মনের আবেগে আনন্দ-উল্লাসে জয় জয় করিয়া উঠিল। এজিদ্পক্ষ রোষে ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হইয়া জয়নাল আবেদীনকে নানা প্রকার কটুবাক্যে ভর্ৎসনা করিতে করিতে ভজনালয় হইতে বহির্গত হইল।
নিষ্কোষিত অসিহস্তে এজিদ্ ক্রোধে অধীর। কম্পিত কলেবরে কর্কশ স্বরে অসি ঝন্ঝনির সহিত রসনা সঞ্চালন করিয়া বলিল, “এখনই জয়নালের শিরচ্ছেদ করিব! এত চাতুরী আমার সঙ্গে?”
মারওয়ান বলিতে লাগিল, “বাদশা নামদার! আশা-সিন্ধু এখনো পার হই নাই। বহুদূরে আসিয়াছি বলিয়া ভরসা হইয়াছে,-অচিরেই তীরে উঠিব। কিন্তু মহারাজ! আজ যে একটা গোপনীয় কথা শুনিয়াছি তাহাতে জয়নাল আবেদীনের জীবন শেষ করিলে ইমামবংশ সমূলে বিনাশ হইবে না, বরং সমরানল সতেজে জ্বলিয়া উঠিবে। সে দুর্দান্ত প্রমত্ত রাবণকে মারওয়ান যতদিন কৌশলাঙ্কুশে হোসেনের দাদ উদ্ধার পর্যবেক্ষণ হইতে নিবারণ করিতে না পারিবে, ততদিন মারওয়ানের মনে শান্তি নাই, আপনার জীবনে আশা নাই।”
এজিদ্ মৃত্তিকায় তরবারি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, “সে কী কথা? হোসেনবংশে এখনো প্রমত্ত কুঞ্জরসম বীরশ্রেষ্ঠ বীর আছে? আমি তো আর কাহাকেও দেখিতে পাই না?”
মারওয়ান বলিল, “জয়নালকে নির্দিষ্ট বন্দিগৃহে প্রেরণ করিবার আদেশ হউক। আমি সে গুপ্ত কথা-নিগূঢ়তত্ত্ব এখনই বলিতেছি।”