তুমি না সেনাপতি! ছি ছি সীমার! তুমি যে এক্ষণে এজিদের সেনাপতি! কী অভিমানে বীরবেশ পরিত্যাগ করিয়া ভিখারীর বেশ ধারণ করিয়াছ? উচ্চ পদ লাভ করিয়াও কী তোমার চির-নীচতা স্বভাব যায় নাই? ছি ছি! সেনাপতির এই কার্য? বল তো, আজ কোন্ কুসুম-কাননের প্রস্ফুটিত কমলগুচ্ছ সকল গোপনে হরণ করিতে ছদ্মবেশী হইলে? কী অভিপ্রায়ে অঙ্গে মলিন-বসন,-স্কন্ধে ভিক্ষার ঝুলি,-শিরে জীর্ণ আস্তরণ? এত কপটতা কার জন্য? তোমার অন্তরের কপাট তুমিই খুলিয়া দেখ, দেখ তো, বাহ্যিক বেশের সহিত তাহার কোন বর্ণের সম্মিলন আছে কি-না? মনের কথা মন খুলিয়া বল তো, তোমার পূর্বকথার সহিত কোন কথার সমতা আছে কি-না? ও-হস্তে আর অস্ত্র ধরিবে না-তাহাই কী সত্য? সেই অভিমানেই কী এই বেশ? আজ যুদ্ধে পরাস্ত হইয়াছ বলিয়াই কী সৈন্যাধ্যক্ষের পদ পরিত্যাগ করিয়া বিরাগী? কিন্তু সীমার একটি কথা! সূর্যদেব অস্তাচলে গমন করিয়া দশ দিনের মধ্যে আর জগতে আসিবেন না,-বহু পরিশ্রমের পর কিছু দিন বিশ্রাম করিবেন। বৎসরকাল আর বিধুর উদয় হইবে না, তাঁহার ক্রোড়স্থ মৃগশিশুটি হঠাৎ ক্রোড়স্খলিত হইয়া পড়িয়া মরিয়া গিয়াছে। সেই দুঃখে তিনি মহাকাতর! এ সকল অকথ্য, স্বভাবের বিপরীত কথাও বিশ্বাস করিতে পারি; কিন্তু সীমার! তোমার বাহ্যিক বৈরাগ্য ভাব দেখিয়া, অন্তরে বিরাগ, সংসারে ঘৃণা, ধর্মে আস্থা জন্মিয়াছে, ইহা কখনো বিশ্বাস করিতে পারি না। সূর্যদেব মধ্যগগনে-উত্তাপ প্রখর, তুমি একাকী কোথায় যাইতেছ? ওদিকে তোমার প্রয়োজন কী? ওরা যে তোমার শত্রু! শত্রুশিবিরের দিকে এ বেশে কেন?
সীমার অতি গম্ভীরভাবে যাইতেছে। শিবিরের দ্বারে উপস্থিত হইলেই প্রহরিগণ বলিল, “কোন প্রাণীর প্রবেশের অনুমতি নাই-তফাৎ!” সে দ্বার হইতে বিফলমনোরথ হইয়া অন্য দ্বারে উপস্থিত। সেখানেও ঐ কথা। তৃতীয় দ্বারে উপস্থিত হইলে, প্রহরিগণ কর্কশ বাক্যে বিশেষ অপমানের সহিত তাড়াইয়া দিল। নিরাশ হইয়া চতুর্থ দ্বারে উপস্থিত। সে দ্বারের প্রহরিগণ নানা প্রকার কথা তরঙ্গ উঠাইয়া আলাপে মন দিয়াছিল। সীমার ঈশ্বরের নাম করিয়া দণ্ডায়মান হইতেই প্রহরী তাড়াইয়া দিতে অগ্রসর হইল। কিন্তু কোন অধ্যক্ষ মহামতি বারণ করিলেন এবং বলিলেন, “ফকির কি চাহে জিজ্ঞাসা কর?” এ দ্বার তুর্কীদিগের তত্ত্বাবধানে। জিজ্ঞাসা করিলে সীমার ঈশ্বরের নাম করিয়া বলিল, “আমি সংসারত্যাগী ফকির। আমার কোন আশা নাই, কিছুই চাহি না! আপনারা কে-কোথা হইতে আসিয়াছেন, কোথা যাইবেন জানিতে বাসনা। আর অন্য কোনরূপ আশা আমার নাই।”
সৈন্যাধ্যক্ষ বলিলেন, “আপনি মহাধার্মিক। আশীর্বাদ করুন, আমরা যে উদ্দেশ্যে আসিয়াছি, তাহাতে কৃতকার্য হইয়া হাসিমুখে যেন স্বদেশে ফিরিয়া যাই, এই মাত্র বলিলাম। আর কোন কথা বলিব না, তবে আপনি অনুমানে যতদূর বুঝিতে পারেন।”
“আমি অনুমানে কি বুঝিব, আমি তো অন্তর্যামী নহি?”
“হজরত! কি করিব। প্রভুর আদেশ অগ্রে প্রতিপাল্য, ইহা আপনি জানেন।”
“তাহা জানি;-কিন্তু যাহারা কাপুরুষ, তাহারাই নিজ মন্তব্য প্রকাশে সঙ্কুচিত।”
“আপনি যাহা বলেন আমি বলিব না,-এ সম্বন্ধে আপনার কথার আর উত্তর করিব না, অন্য আলাপ করুন।”
“অন্য আলাপ কি করিব? ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্যে কেহ বাধা দিতে পারে না!”
“সে কথা সত্য, কিন্তু প্রভুর আজ্ঞা অবহেলা করাও মহাপাপ।”
“আমি কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিব মাত্র; ইচ্ছা হয় বলিবেন, ইচ্ছা না হয় বলিবেন না। আর আমি ইহাও বলি, যদি আমার দ্বারা আপনাদের কোন সাহায্য হয়-আমি প্রস্তুত আছি। পরোপকার করিতে করিতেই জীবন শেষ করিয়াছি। ঈশ্বরভক্ত মাত্রেরই আমি ভক্ত। সামান্য উপকার করিতে পারিলেও কিঞ্চিৎ সুখী হইব। পরোপকার,-পরকার্য করাই আমার স্বভাব এবং ধর্ম। মানবজীবনের উদ্দেশ্য কী? পরোপকারের ন্যায় পুণ্য আর কী আছে? ভাবিতে পারেন, আমি পথের ভিখারী-এক মুষ্টি অন্নের জন্য সর্বদা লালায়িত, কিন্তু সে ভাব অজ্ঞ লোকের হৃদয়ে উদর হওয়াই সম্ভব। আপনার ন্যায় মহান্ হৃদয়ে কি সে ভাবের আবির্ভাব হইতে পারে?”
“তবে আপনি কিছু বলিবেন, আমার দ্বারাও কিছু বলাইবেন।”
“আপনি কিছু বলুন আর না বলুন, আমিই দুই-একটি কথা বলিব।”
“বলুন, আপনার কি কথা?”
“এখানে বলিব না।”
“তবে কি গোপনে বলিবেন?”
“ইচ্ছা তো তাহাই। আমার মঙ্গলের জন্য আমি ভাবি না, চিন্তাও করি না। পরিহিতসাধনই আমার কর্তব্য কার্য, নিত্য নিয়মিত ব্রত।”
“আচ্ছা চলুন, আমিই আপনার সঙ্গে যাইতেছি।”
সৈন্যাধ্যক্ষ মহামতি যাইবার সময় সঙ্গীদিগকে সঙ্কেতে বলিয়া গেলেন, “আমার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়ো। আমরা ঐ বৃক্ষের আড়ালে কথাবার্তা কহিব! তোমরা আমাদের অদৃশ্যভাবে বিশেষ সতর্কে সজ্জিতভাবে দূরে থাকিবে।”
সৈন্যাধ্যক্ষ সীমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। পূর্বকথিত বৃক্ষের আড়ালে দণ্ডায়মান হইয়া কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন, কিন্তু কথাগুলি বড়ই মৃদুভাবে চলিল। অপরের শুনিবার ক্ষমতা রহিল না। হস্ত-চালনা, মুখভঙ্গি, মস্তক হেলন, হাঁ-না মোহাম্মদ হানিফ, এজিদ্; মহারাজ, অসংখ্য ধন, লাভের জন্য চাকুরী-আত্মীয় নয়,-ভ্রাতা নয়-লাভ কি? আপন লাভ-ইত্যাদি অনেক বাদানুবাদের পর, সৈন্যাধ্যক্ষ নীরব হইলেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, “বিশ্বাস কী?”
সীমার বলিলেন, “অগ্রে হস্তগত পরে ধৃত, শেষে শিবির ত্যাগ-আবার ত্যাগের পরেই পদ লাভ। আপনার কথাও শুনিলাম। আমার চিরব্রত হিত কথাও বলিলাম। এখন ভাবিয়া দেখুন, লাভালাভ কি?”
“তাহা তো বটে, কিন্তু শেষে একূল-ওকূল দু’কূল না যায়!”
“না-না, দুই কূল যাইবার কথা কি? সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। বিশ্বাস না হয় আমিই অগ্রে বিশ্বাস স্থাপন করি। সন্ধ্যার পর একটু ঘোর অন্ধকার হইলে আপনি এই নির্দিষ্ট স্থানে আসিবেন। যে কথা সেই কার্য, হস্তগত হইলেও কি মনের সন্দেহ দূর হইবে না?”
“সে তো বটে, সে কথা তো বটে; কিন্তু শেষে কী ঘটে বলিতে পারি না।”
“আর কি ঘটিবে? আপনারাই সকল, আপনারাই বাহুবল।”
“তা যাহা হউক, আপনি কৌশল করিয়া তো আমার মন পরীক্ষা করিতেছেন না?”
“যদি তাহাই বিবেচনা করেন, তবে আপনিই ঠকিলেন। আমি এখন আর কিছুই বলিব না। কেবল এইমাত্র বলিব যে, সন্ধ্যাদেবী ঘোমটা টানিয়া জগৎ অন্ধকার করিলেই আপনাকে যেন এখানে পাই। আমি বিদায় হইলাম-নমস্কার।”
“আপনি বিদায় হইলেন বটে, কিন্তু আমার মনে অশান্তির বীজ রোপন করিয়া গেলেন।”
সীমার ত্রস্তপদে আর এক পথে স্বসৈন্য-মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। সেনাপতি মহোদয়ও অতি মৃদুমৃদুভাবে পদ নিক্ষেপ করিতে করিতে শিবিরে আসিলেন। প্রহরীদ্বয়ও কিঞ্চিৎ পরে শিবিরে আসিল। ধিক্ রে তুর্কীয় সেনাপতি! ধিক্ রে অর্থ!!