কী চমৎকার দৃশ্য! মহাবীর মোহাম্মদ হানিফা অশ্ব-বল্গা সজোরে টানিয়া অশ্ব-গতিরোধ করিয়াছেন। গ্রীবা বক্র, দৃষ্টি পশ্চাৎ-কারণ সৈন্যগণ কতদূরে তাহাই লক্ষ্য। অশ্ব সম্মুখস্থ পদদ্বয় কিঞ্চিৎ বক্রভাবে উত্তোলন করিয়া দণ্ডায়মান। একপার্শ্বে মদিনার কাসেদ। হানিফার চক্ষু জলে পরিপূর্ণ। দেখিতে দেখিতে অর্ধচন্দ্র এবং পূর্ণতারা সংযুক্ত নিশান হেলিয়া-দুলিয়া ক্রমেই নিকটবর্তী হইল। গাজী রহমান উপস্থিত প্রভুর সজল চক্ষু, মুখভাব মলিন, নিকটে অপরিচিত কাসেদ-বিষাদের স্পষ্ট লক্ষণ, নিশ্চয়ই বিপদ! মহাবিপদ! বুঝি হোসেন ইহজগতে নাই।
“গাজী রহমান! আপনার সিদ্ধান্ত নিশ্চিত! মোহাম্মদ হানিফা ভ্রাতৃহারা, জ্ঞাতিহারা হইয়া এইক্ষণে জ্ঞানহারা হইবার উপক্রম হইয়াছেন। রক্ষার উপায় দেখুন। ভ্রাতৃশোক মহাশোক!”
মোহাম্মদ হানিফা গদগদ-স্বরে বলিলেন, “গাজী রহমান, আর কারবালায় যাইতে হইল না, বিধির নির্বন্ধে, ভ্রাতৃবর হোসেন শত্রুহস্তে প্রাণ হারাইয়াছেন! ইমাম বংশ সমূলে বিনাশ হইয়াছে। পরিজনমধ্যে যাঁহারা বাঁচিয়া আছেন, তাঁহারাও দামেস্কনগরে এজিদ্ কারাগারে বন্দি। এইক্ষণ কী করি? আমার বিবেচনায় অগ্রে মদিনা যাইয়া প্রভু মোহাম্মদের রওজা পরিদর্শন করি? পরে অন্য বিবেচনা।”
আবদুর রহমান বলিলেন, “এ অবস্থায় মদিনাবাসীদিগের মত গ্রহণ করাও নিতান্ত আবশ্যক। রাজাবিহনে সেখানেও নানাপ্রকার বিভ্রাট উপস্থিত হইতে পারে। ইমাম বংশে কেহ নাই এ কথা যথার্থ হইল পুণ্যভূমি মদিনা যে এতদিন এজিদ্ পদভরে দলিত হয় নাই,-ইহারই-বা বিশ্বাস কি? তবে অনিশ্চিতে অন্য চিন্তা নিরর্থক! মদিনাভিমুখে যাওয়াই কর্তব্য।”
পুনরায় মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “যাহা ঘটিবার ঘটিয়াছে, ভবিষ্যতের লেখা খণ্ডন করিতে কাহারো সাধ্য নাই। মদিনাভিমুখে গমনই যখন স্থির হইল, তখন বিশ্রামের কথা যেন কাহারো অন্তরে আর উদয় না হয়! সৈন্যগণ সহ আমার পশ্চাৎগামী হও।”
দিবারাত্রি গমন। বিশ্রামের নাম কাহারো মুখে নাই। এই প্রকার কয়েক দিন অবিশ্রান্ত গমন করিলে দ্বিতীয় কাসেদের সহিত দেখা হইল। জাতীয় নিশান দেখিয়াই মোহাম্মদ হানিফা গমনে ক্ষান্ত দিলেন।
কাসেদ যথাবিধি অভিবাদন করিয়া জোড়করে বলিল,-“বাদশাহ নামদার। দাসের অপরাধ মার্জনা হউক। আমি মদিনার কাসেদ।”
মোহাম্মদ হানিফা বিশেষ আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সংবাদ কি?”
“পূর্বসংবাদ বাদশাহ নামদারের অবিদিত নাই। তৎপর যে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, আর আমি যাহা স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি,-বলিতেছি!”
“বাদশাহ নামদার! আপনার ভ্রাতৃবংশে পুরুষপক্ষে কেবলমাত্র এক জয়নাল আবেদীন জীবিত আছেন। তিনিও তাঁহার মাতা, ভগ্নী, পিতৃব্য পত্নী, দামেস্ক নগরে বন্দি। দিনান্তে এক টুকরা শুষ্ক রুটি, একপাত্র জল ভিন্ন আর কোন প্রকার খাদ্যের মুখ দেখিতে তাঁহাদের ভাগ্যে নাই। এজিদ্ এই সময় অগ্নিমূর্তি ধারণ করিয়া বসিয়াছে-সে কেবল আপনার সংবাদে আপনার প্রাণ বিনাশ করাই এক্ষণে তাহার প্রথম কার্য। ওত্বে অলীদকে লক্ষাধিক সৈন্যসহ সাজাইয়া মদিনার সীমায় পাঠাইয়া দিয়াছে। ওত্বে অলীদ মদিনা আক্রমণ না করিয়া আপনার প্রতীক্ষায় মদিনা-প্রবেশপথ রোধ করিয়া সর্বদা সতর্ক ও প্রস্তুতভাবে রহিয়াছে। অলীদ আপনার শিরচ্ছেদ করিয়া পরে মদিনার সিংহাসনে এজিদ্ পক্ষ হইতে বসিবে-ইহাই ঘোষণা করিয়াছে। এক্ষণে যাহা ভাল হয় করুন।”
মোহাম্মদ হানিফা এবার এক নূতন চিন্তায় নিপতিত হইলেন। সহজে মদিনা যাইবার আর সাধ্য নাই-প্রথমে যুদ্ধ-পরে প্রবেশ, তারপর মদিনাবাসিদিগের সহিত সাক্ষাৎ।
গাজী রহমান বলিলেন, “তবে যুদ্ধ অনিবার্য। যেখানে বাধা সেইখানেই সমর এত বিষম ব্যাপার। অলীদ চতুরতা করিয়া এমন কোন স্থানে যদি শিবির নির্মাণ করিয়া থাকে যে, সম্মুখে সুপ্রশস্ত সমতল ক্ষেত্র নাই, শিবির নির্মাণের উপযুক্ত স্থান নাই, জলের সুযোগ নাই, সৈন্যদিগের দৈনিক ক্রীড়া করিবার উপযুক্ত প্রাঙ্গণ নাই, তবে তো মহা বিপদ। অগ্রেই গুপ্তচর, চিত্রকর এবং কুঠারধারিগণকে ছদ্মবেশে প্রেরণ করিতে হইতেছে।”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “আমার মতি স্থির নাই যাহা ভাল বিবেচনা হয় করুন। তবে এইমাত্র কথা যে, বিপদে-সম্পদে, শোকে-দুঃখে সর্বদা সকল সময় যে ভগবান্-তাঁহারই নাম করিয়া চলিতে থাকুন। যাহা অদৃষ্টে আছে ঘটিবে। আর এখান হইতে আমার আর-আর বৈমাত্রেয় ভ্রাতৃগণ যাঁহারা যেখানে আছেন তাঁহাদিগকে ইমামের অবস্থা ইমাম-পরিবারের অবস্থা বিস্তারিতরূপে লিখিয়া কাসেদ পাঠাও। এ কথাও লিখিয়া দাও যে, পদাতিক, অশ্বারোহী, ধানুকী প্রভৃতি যত প্রকার যোধ যাহার অধীনে যত আছে, তাহাদের আহার সংগ্রহ করিয়া মদিনা প্রান্তরে আসিয়া আমার সহিত যোগদান করুন। ইরাক নগরে মস্হাব কাক্কা, আঞ্জাম নগরে ইব্রাহিম ওয়াদি, তোগান রাজ্যে অলিওয়াদের নিকটে সমুদয় বিবরণ লিখিয়া কাসেদ প্রেরণ কর। আর-আর মুসলমান রাজা যিনি যে প্রদেশে, যে নগরে রাজ্য বিস্তার করিয়া আছেন, তাঁহাদের নিকটও এই সকল সমাচার লিখিয়া কাসেদ প্রেরণ কর। শেষে এই কয়েকটি কথা লিখিয়ো যে, ভ্রাতৃগণ! যদি জাতীয় ধর্ম রক্ষার বাসনা থাকে, জগতে মোহাম্মদীয় ধর্মের স্থায়িত্ব রাখিতে ইচ্ছা থাকে, কাফেরের রক্তে ইমাম-অস্ত্র রঞ্জিত করিবার ইচ্ছা থাকে, আর প্রভু মোহাম্মদের প্রতি যদি অটল ভক্তি থাকে, তবে এই পত্রপ্রাপ্তিমাত্র আপন-আপন সৈন্যসহ মদিনা-প্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হও। প্রভু-পরিবারের প্রতি যে দৌরাত্ম্য হইতেছে, সে বিষয় আলোচনা করিয়া এখন কেহ দুঃখিত হইও না। এখন ধর্মরক্ষা, মদিনার সিংহাসন রক্ষা, এজিদের বধ, হোসেন-পরিজনের উদ্ধার, এই সকল কথাই যেন জপমালার মন্ত্র হয়।
এক্ষণে কেহ চক্ষের জল ফেলিয়ো না। কাঁদিবার দিনে সকলে একত্র হইয়া কাঁদিব। শুধু আমরা কয়েকজনেই যে কাঁদিব, তাহা নহে; জগৎ কাঁদিবে। এ জগৎ চিরদিন কাঁদিবে। স্বর্গীয় দূত ইসরাফিল জীবের জীবনলীলা শেষ করিতে যেদিন ঘোর রোলে শিঙ্গা বাজাইয়া জগৎ সংহার করিবেন, সেদিন পর্যন্ত জগৎ কাঁদিবে। দুঃখ করিবার দিন ধরা রহিল! এখন অস্ত্র ধরুন, শত্রু বিনাশ করুন, মোহাম্মদীয় দীন, ঐ শিঙ্গাবাদন দিন পর্যন্ত অক্ষয়রূপে স্থায়িত্বের উপায় বিধান কর। গাজী রহমান! এ সকল কথা লিখিতে কখনো ভুলিয়ো না।”
গাজী রহমান প্রভুর আদেশমত ‘শাহীনামা’ পত্র, যাহা যাহার নিকট উপযুক্ত, তখনই লিখিতে আরম্ভ করিলেন। সৈন্যগণ ক্রমে আসিয়া জুটিল। মন্ত্রীপ্রবর-রাজাদেশে সকল শ্রেণীর প্রধান প্রধান অধ্যক্ষগণকে সমস্ত বিবরণ জ্ঞাপন করাইলেন। নির্দিষ্ট স্থানে কাসেদ সকল প্রেরিত হইল। সকলে আবার গমনে অগ্রসর হইলেন। একদিন প্রেরিত গুপ্তচর ও সন্ধানী লোকদিগের সহিত দেখা হইল। সবিস্তার অবগত হইয়া পুনরায় যাইতে লাগিলেন। নির্দিষ্ট স্থান অতি নিকট; উৎসাহে গমনবেগ বৃদ্ধি করা হইল।