মরুস্বর্গ – ৯

০৯.

ফের সেই তাঁবুরই পৃথিবী। কনানে এসে তাঁবুরই তলে আশ্রয় পেয়েছিল। সৈনিক আর দেবদাসীরা। গৃহ পায়নি। সাদইদের ভাল লাগল, দেবদাসীর সঙ্গে অনেক সৈনিকের বিয়ে দিয়েছেন ইহুদ। তবে দেবদাসীর সংখ্যা বেশি ছিল না বলে অনেক সৈনিক অবিবাহিতই রয়েছে। সেই অবিবাহিতদের মধ্য থেকে কিছু সৈনিকের বিয়ে ইহুদ দিয়েছেন অনেক আগে আসা যাযাবর পরিবারে–যারা ইয়াহোর উপাসক। তবে সেইসব পূর্ববর্তী যাযাবর পরিবার যারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং এখনও যারা তাঁবুরই তলে রয়েছে। তাছাড়া কিছু উট-উপাসক পরিবার ইহুদকে সম্মান করে–তারা সৈনিকদের পাণিগ্রহণে আগ্রহী–কিন্তু লোটার ঘটনা সত্ত্বেও সৈনিকদের ভিতর কেমন একধারা নাক-উঁচু ভাব ।

দেবদাসী, বিয়ের পরও কি দেবদাসী? নইলে অনেক সৈনিকের মধ্যেই কেন এক গোপন চোরা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে! তারা কনানী চাষীর মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়তে চায়। দু’ একটি ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। প্রেম শুধু নয়, বিয়ে অবধি হয়েছে। তারা ভাগ্যবান। মেয়ের বাবা সেই জামাইকে গৃহ নির্মাণের জন্য এক টুকরো জমি দিয়েছে। খড়ের চাল আর মাটির দেওয়াল। তারপরই ঘটনা অন্যরকম হয়েছে। একটি বউ তাঁবুতে, অন্যটি, কম বয়েসী বউটি, রয়েছে কুটিরে। সৈনিকের হয়েছে দু’তরফ। ফলে দেবদাসীর এখন উপোসের কাল এসেছে। খেতে না পেয়ে শুকিয়ে থাকা। কেননা সৈনিক থাকে। কুটিরে–চাষবাসে ঢুকে গেছে। তাঁবু বাতাসে নিঃসঙ্গ ফটফট আওয়াজ করে চলে।

দেবদাসী থাকে একা। চাষীর ছেলেরা আসে। বিয়ে করতে নয়। ভোগ করতে। দু’এক কুনকে গম অথবা বাড়ি থেকে গোপনে নিয়ে আসা বউয়ের পুরনো কাপড়। দানধ্যান দেওয়া-থোয়ার এই হল বহর। এদিকে ঘরের বউটি ভারী মুখরা আর তিড়িঙ্গে–লাফিয়ে ছুটে এসে দেবদাসীর পরনের কাপড় ধরে টানলে—খোল্‌ মাগী কাপড়!

লজ্জায় তখন দেবদাসীর ধরিত্রী দ্বিধা হতে বাকি, মুখ লুকোবার মন্দির-কাণটি সে হারিয়েছে। কাপড় টানাটানির এই দৃশ্য দেখে সাদইদ স্তম্ভিত হয়ে যায়।

ইহুদের সামনে দেবদাসীর বিচার বসল। দেবদাসী বলল–লজ্জা ঢাকবার পরনের দু’প্রস্থ কাপড় দাদাবাবু দিয়েছিল! তারই খোঁটা এত! এই মারে তো সেই মারে! বলি কি এই সোনার অঙ্গে কুষ্ঠ হয় আমার। আমি পাপী! মহাত্মার সামনে বলছি, সামনে শীতে আমি আর বাঁচব না। জুম পাহাড় কী দোষ করেছিল শুনি–এখানে টেনে আনলে কেন? আমারও স্বামী ছিল, ঘর ছিল! তাঁবুর মিনসে কি মিনসে নাকি! কে দেয়, কে থোয়–দেখবার কে আছে! তাঁবুতে ফেলে রেখে চাষার ঘরে চলে গেল। আমি ধম্ম ধুয়ে খাব!

ইহুদ বললেন–সবুরে মেওয়া ফলে মা!

–হ্যাঁ খোবানী জন্মায়! কিন্তু গাছ তো পুঁতবেন!

–ইয়াহো ধর্মের উদ্ভিদ। তিনি তোমায় ছায়া দেবেন।

এই দৃশ্যের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। সাদইদ সরে চলে আসে। তাঁবুর এই পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে কত নির্মম ছবি চোখে পড়ে। সাদইদ দেখে এক নিঃসঙ্গ সৈনিককে–একা একটি পাথরের উপর বসে আছে। বয়স বেশি নয়। বেচারি মরুভূমির জাতক–যে কিনা উটের পিঠে প্রসবিত হয়েছিল। চাষী জীবনের সঙ্গে এর কখনওই কোন যোগাযোগ ঘটেনি। নাম দিনার। এ যেন সমেরু আর লোটার মিলিত প্রতিচ্ছায়া। বাপ-মাকে কোথায় হারিয়েছে। সে তার দেহ থেকে হিতেনের উল্কি মুছে ফেলেছে–সেই ক্ষতস্থানে চেয়ে ঘাড় গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে।

–একা বসে আছো?

–হ্যাঁ।

আর কোন কথা বলল না। দু’ধরনের সৈনিক। এক যারা চাষী ছিল। জমি থেকে উৎখাত হয়ে ক্রীতদাস হয়। দ্বিতীয় যারা মরুভূমি থেকে ক্রীতদাস হয়ে পিরামিডে কাজ করত। পরে সৈনিক হয়েছে। পদাতিক। যারা চাষী ছিল তারা চাষে ঢুকবার চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা পাথর বইত উটের পিঠে বা চাকাঅলা গাড়িতে, তারা চাষীদের চোখে ঘৃণ্য। এদের জন্য এই গ্রামে কোন কাজ নেই।

নতুন জামাতা হয়েছে যে সৈনিক, তার সঙ্গে শ্বশুরের সংলাপ কানে আসে।

–শ্যামাঘাস চেন বাপ? গম আর ঘাসে একাকার।

–চিনতে হবে!

–ওহ্! এখনও চিনতে হবে! কবে চাষবাস করতে মানিক!

এক ঝটকায় কানে এল কথা। শ্বশুর বলল–কত না জমি-জিরাত ছিল। মানিকের! খেজুরের বাগান! খোবানির চাষ। খেজুরের আঁটি যেন পিরামিডের পানা খাড়া হয়ে থাকত! গাইয়ের দুধে গোঁফ চুমরে যেত! আঁটি হত জ্বালানি আর দুধ হত ক্ষীর। একবার ফরাতের পলিতে আটকে গেল পাঁচখানা গাই, সেকি কাণ্ড! বাঁট ঠেকল কাদায়, দুধের ভারে থইথই! কাদায় গড়িয়ে পড়ে দুধ। কালো এটেল আর সাদা দুধ! সেই একটা জীবন ছিল বটে।

–আজ্ঞে!

–তবে মানিক আমার শ্যামাদাস চেনেন না!

–আজ্ঞে বিস্মরণ হয়েছে।

–তা তো হবেই, কতকালের কথা!

–আজ্ঞে!

–ওট্‌ শালা সেপাই! মিছে বলার আর জায়গা পেলে না। আরে যা যা, তাঁবুর ইস্তারীর কাছে যা! শরীরের কী ব্যাধি আছে, কে জানে ঘোড়াখোর! আমার মেয়েকে ভোগাভাগা দিয়ে এখন জমিতে দাগ বসাতে চাও! ওই যে কী বলে নাম, ইয়াহুদ, সেইটেই সব্বেনেশে! মহাত্মা বলে কথা!

এই অপমান হজম হয় না। তাঁবুতে অগত্যা জুমপাহাড়ীর স্ত্রীর কাছে ফেরে সেই লোক। কুটির থেকে নতুন কনে হামলায়। তাঁবুর বউ স্বামীকে পেয়ে বলে–সবুর আর কত করব সেপাই!

সেপাই ডাকটি শুনে মাথা গরম হয়ে যায়। দেবদাসীকে অকথ্য গাল দেয়। পিটিয়ে পাট পাট করে দেয় লোকটি।

দেবদাসী বিধবস্ত বাহু, পিঠ দেখিয়ে বলল–দেখুন সারগন! আপনি বলুন, মুক্তি কবে পাব? হে অদৃশ্য ঈশ্বর, তুমি কি দেখতে পাও না!

লোটার অশে ধাবিত সাদইদ আকাশে চোখ তুলল। আকাশে চাঁদের সভা বসেছে। তারকারা চাঁদের মুখপানে ঝুঁকে আছে। চাঁদ কথা বলছে, তারকারা শুনছে। একটা নীলাভ গোল বৃত্ত। কস্তুরী আভা জড়ানো যেন এক গোল তাঁবুর রাত। আজ প্রচুর বাঁচতে ইচ্ছে করে! কিন্তু বেদনা জাগে গম শিষ আর যব শিষের পার্থক্য বোঝে না বলে একজন সৈনিক যখন অপমানিত হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশুকে চুম্বন করল সাদইদ। তারপর বলল–ওহে নিভা! ভাল করে আঁকড়ে থাকো পিছনে। পড়ে যেও না!

হেরা তার শিশুকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। আরো আশ্চর্য নিভাকে দেখে। সাদইদের হাত দুখানি ধরে বললে–এমন কখনও হয় না সাদইদ! কখনওই হয় না। আমি আরো মূর্তি বানাব। পুরনো দেবদেবীদের অনেক ভাব আমার মাথায় এসেছে। এবার নববর্ষে মন্দিরে একেবারে মচ্ছব হবে। দেবদেবীদের অভিনয় করবে মানুষ। লিঙ্গপূজা হবে। কত কি হবে। নিনি আমার সঙ্গে থাকবে। ওর নাম কিন্তু নিভা নয় সাদইদ। ও নিনি। আমার স্বপ্ন।

–এ তোমার পাপের উপার্জন। এ তোমার দণ্ড হেরা। তুমি কখনওই আর মূর্তি বানাতে পারবে না। ইহুদের সঙ্গে শর্ত করে এসেছি। শিশু আর নারীর জন্য তোমায় শিল্পচর্চা ত্যাগ করতে হবে। যদি এই শর্ত অমান্য করো, তোমার আঙুল কর্তন করা হবে।

–অসম্ভব! এ হতে পারে না। হাস্যকর প্রস্তাব। মূর্তি না বানালে আমি খেতে পাব না। বাঁচতে পারব না। মাটি মানেই মূর্তি। মাটি তার রূপ চায়। পাথর তার রূপ চায়। পেত্তল তার রূপ চায়। সোনা চায় অপূর্ব রূপের কান্তি। নগর হল রূপের একটি উচ্চতা। নিনি আমার পাপের উপার্জন নয়। সে আমার অর্জন। একটা রূপের বদলে পেয়েছি। ও আমার বোবা দেবী, ওর সঙ্গে দেহ মিলনে কোন পাপ নেই আমার। আমায় বিরক্ত করো না! নিনিভা! ও নিনি! স্বপ্নের নগরী! হায়!

বলে শিশুকে কোলে করে নিনির হাত ধরে জ্যোৎস্নায় নেমে গেল হেরা। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। তারপর আশ্চর্য হয়ে হেসে ফেলল। হেরাই। পারে জীবনের একটা ভয়ানক সমস্যাকে মুহূর্তে মিটিয়ে ফেলতে।

এই হেরাই অতঃপর যোবা মেয়েটির মুখে ভাষা দিল। নিনি একদিন আশ্চর্য প্রশ্ন শুধালো-সবারই তো কিছু না কিছু রয়েছে। সারগনের কেউ নেই কেন?

হেরা সাদইদকে চোখের ইশারা করে বলল-এবার জবাব দাও!

সঙ্গে সঙ্গে সাদইদের চোখের সামনে ভেসে উঠল দিনারের মুখচ্ছবি। সে ঈষৎ হাসল। বলল–আমার অনেক আছে নিনিভা। তোমরা জানো না! তোমরা নতুন ঘর বাঁধলেনগর ধ্বংস হয়ে গেছে, তোমাদের দেখলে সেকথা মনেই হয় না! আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছ তোমরা ইহুদ ভেবেছিলেন তোমরা বিয়ের সময় তাঁর কাছে যাবে! এ তাঁর ব্যর্থতা!

হেরা বলল–তোমার কি মনে হয় না, যার যা ভাল লাগে সে সেই ধর্ম করবে! পূজাবিধি কতকালের অব্যেস! মূর্তি ছাড়া ধর্ম কী করে হবে! নগর কী করে হবে!

সাদইদ বলল–তোমার সেই এক কথা হেরা। নগর। নগরের সঙ্গে মূর্তির কী সম্বন্ধ!

–সম্বন্ধ আছে সাদইদ। ডানাঅলা বৃষ–নিনিভের ভাস্কর্য! মূর্তি ছাড়া তুমি তোমার শক্তি, সমৃদ্ধি, তোমার শৌর্য–কিছুই প্রকাশ করতে পারো না। মানুষ মূর্তিতে পরিণত না হলে দেবতা হতে পারে না। যেমন মিশরের ফেরাউন। মূর্তি যত বিশাল হবে মানুষও তত দেবতা হয়ে উঠবে। নতুবা দেহটা হবে সিংহের, মাথা হবে মানুষের–অন্তত তুমি তাই হও–আতঙ্কের জনক। তোমার পায়ের তলায় পিঁপড়ের সমান পড়ে থাকবে চাষা। একজন মুটে। একজন কারিগর। একজন ঘরামী।

–তাহলে বলছ, মূর্তিই সব?

–মূর্তিই সব সাদইদ। নগর মানে মূর্তি। বিশাল মূর্তি। বড় বড় রাস্তা। রাস্তার উপর মূর্তি। কোন উচ্চতার উপর মূর্তি। যাতে ভয় আর সম্ভ্রম হয়। উচ্চতা, কেবল উচ্চতা। ক্রমাগত উচ্চতার দিকে ওঠা। পিরামিড একটি সুউচ্চ আকৃতি–একটা জ্যামিতি ছাড়া কিছু নয়। এর কি কোন মানে নেই? নগর। বলতে কতকগুলি সুউচ্চ বিশাল আকৃতিকে বোঝায়। মিনারকে বোঝায়। সৌধ বোঝায়। স্তূপ। জিরাত। স্বর্গ! এইসব বোঝায়।

–কিন্তু স্বর্গ বোঝায় না হেরা!

দু’জনের উত্তেজিত তর্কে নিনিভা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা তার কখনওই ছিল না। বাচ্চাকে সে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছে সবেগে।

হেরা অবাক হয়ে বলল–স্বর্গ বোঝায় না?

সাদইদের গভীর জবাব–না।

একটু থেমে বলল–বোঝায় না। মধুদুগ্ধের দেশ এটি। সহিষ্ণু। সব ধর্ম এখানে থাকবে। কিন্তু মধু থাকে উচ্চে। মধুচক্র থাকে উপরে। কিন্তু তা টুপিয়ে পড়ে মাটিতে। গাভীর দুধ মাটিতেই ঝরে পড়তে চায়। উপরে থাকে এইজন্য। যে,তা মাটির উপর ঝরবে। উপরে থাকার নিয়মই হচ্ছে নিচে নামার উদ্দেশ্য। মধুদুগ্ধপ্ৰবাহিণী দেশ। মর্তের অমরাবতী। স্বর্গ উপর থেকে নিচে নামবে। তাড়া করে ওঠা নয়।

হেরা বিড়বিড় করে বলে–তাড়া করে ওঠা!

সাদইদ বলল–হ্যাঁ। একটা জ্যামিতির কথা তুমি প্রায়ই বল। তোমার সঙ্গে আমি একমত। তুমি ভাস্কর, স্থপতি, জ্যামিতি মানে যেমন ধরো তিনটে বাহু উপরে খাড়া হয়ে আকাশ ধরতে চায়। ত্রিভুজও তো একটি জ্যামিতি। কিন্তু সেটা আদৌতে কবর। হাত দিয়ে ছুঁতে না পারার ফলে পাথর সাজিয়ে সাজিয়ে বাহু বাড়ানো–এই আকৃতি সম্ভ্রম ঘটায়, কিন্তু একজন চাষীর দুঃখ বাড়িয়ে দেয়, পিঠ নুইয়ে দেয়। আমি বলছি, এভাবে তেড়ে ওঠাকে আমি সুন্দর বলি না। মধু টুপিয়ে মাটিতে পড়ছে, ফল মাটিতে পড়ছে, ফুলের ভারে ডাল নুইয়ে নামছে। হাওয়ায়। যত কিছু সুন্দর তা মাটির দিকে নামতে চায় কেন! সূর্যের আলো, চাঁদের আলো মাটির দিকে নেমে আসছে কেন? ইন্দ্রধনুটা নামতে পারছে না। বলে শান্ত জলের তলায় এসে ভাসছে। মেঘ নামছে বৃষ্টির হাত ধরে মাটিতে! তাহলে স্বর্গ কেন মাটিতে নামবে না! তোমার কী মনে হয়?

হেরা স্তব্ধ হয়ে চুপ করে গেল। নিনি অবাক হয়ে সাদইদের বুকের দিকে চাইল। ওখানে হৃদয় আছে। কিন্তু এতসব কথা হৃদয় চিন্তা করতে পারে । চিন্তার ধকলে এই মানুষটি মরে যাবে না তো! ফের হেরাও তর্ক বাধানোর জন্য। দম ধরেছে। দুটিই পাগল।

হেরা বললনগর না গড়লে তুমি কিছুতেই স্বর্গ গড়তে পারো না। মধু যে মাটিতে টুপিয়ে পড়বে তার জন্য মধুচক্র দরকার। উচ্চতা দরকার। বন্যা যাতে তোমাকে ঘিরে না ধরে। দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধ যেন তোমাকে তেড়ে না মারে। গ্রামগুলির দিকে যদি তুমি নজরদারি করতে চাও, তোমাকে উচ্চতার দিকে যেতেই হবে।

সাদইদ বলল–হ্যাঁ, গ্রামগুলির দিকে নজর রাখা। উপরের দিকে ওঠা এই জন্য যে, যেন আমি নিচের শেষ অবস্থাটা, একেবারে তলার স্তর দেখতে পাই। যেখানে লোটা মুখ গুজড়ে পড়ে রয়েছে!

হেরা চমকে উঠল। অবাক হয়ে সাদইদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সাদইদ অতঃপর ম্লান হেসে বলল–মূর্তি আমার চাই। লোটা মুখ খুঁজড়ে মরুভূমির বালিতে পড়ে আছে, তার কাছাকাছি ছড়িয়ে রয়েছে পশুগুলি-মরু আকাশ থেকে নেমে আসছে নখরঅলা ভয়ংকর কালো ঈগল। এই মূর্তিটা আমার চাই হেরা! একজন নিঃসঙ্গ পড়ে থাকা হাঁটু ভেঙে পড়া মানুষ–অথচ নির্দয় আকাশ, মরু ঈগল!

–ও হো হো! অমন করে বলল না সাদইদ–সহ্য হয় না!

ভয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে হেরা। নিনিভা নরম লাবণ্যময় শ্যামা-উজ্জ্বল মুখ ভয়ে বিস্ময়ে ভরিয়ে তোলে, দুচোখে তার টলটল করে কাঁচা শিশুগম চারার মত আলো। স্নিগ্ধ করুণ চির হরিতের মুগ্ধতা নিনিভাকে কখনও যেন ছেড়ে যাবে না মনে হয়।

–একজন মানুষ ভালবাসে কতকগুলি আকৃতি-নারী তার মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আকৃতি–স্বর্গ মানে চির বসন্তের আলোপগ্ন নারী আর নগ্ন শিশুর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। সেই আলোর মধ্যে নারী আর শিশুরা থাকে। হেরা! আমি আর কিছু চাই না!

–কিন্তু তোমার সেই নারী কোথায় সারগন!–নিনিভা শুধালো।

সেকথার জবাব না দিয়ে সাদইদ বলল-ইয়াহোর স্বর্গে শুধু নারী থাকে। পুরুষ আর নারীর অবিচ্ছিন্ন ক্লান্তিহীন মিলন। সেখানে শিশু নেই। স্বর্গের দেওয়ালে তুমি একেছ একটি স্রোত। গাভী আর বৃষের তুমুল প্রবাহ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে-দেবতা আমন আকাশে ডুবুডুবু, যাই যাই করছে। পশুর গলায় ঘণ্টা বাজছে। সেই একটা স্রোত চলেছে তো চলেইছে। ভেবে দ্যাখো হেরা! সেই দলটির মধ্যে তুমি একটা শিশু; সাদা ধপধপে বাছুর দাওনি! আমি তাহলে তোমাকে স্বর্গের সেই দেওয়ালটি ভেঙে ফেলতে বলব।

–তাহলে তোমার শিশু কোথায় সারগন!

সাদইদ সেই জবাব না দিয়ে বলল–ইয়াহোর স্বর্গ–ইহুদের বেহেশ্‌ত অসম্পূর্ণ হেরা! অথচ ইহুদের কিছু কল্পনা আমার মন্দ লাগে না। ওঁর ওপর ইয়াহো যখন ভর করেন, তখন বেচারি স্বর্গের বিবরণ দেন–যেন তিনি স্বর্গের সকল আকৃতি দেখতে পাচ্ছেন? সেই বর্ণনায় কখনও শুনিনি যে,তিনি দেখছেন #কটি উটের পিঠে একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে! আমার কথা হেরা তুমি বুঝবে না!

উটের পিঠে জন্ম, উটের পিঠেই মৃত্যু-একঘেয়ে ধূসর মরুপথ–তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে–উটকেই অতঃপর হত্যা করে জলের থলি টেনে বার করে তেষ্টা মেটানো-মরুভূমি এমন মানুষকেও বাঁচিয়ে রাখে। আর যেখানে মানুষ বৃক্ষের স্বভাব পায়–নদী পায়–উপত্যকা পায়–সেখানেও বৃষ্টির জন্য কুমারী বলি দিয়ে রক্তাক্ত নারীদেহ ফসলের মাঠে টেনে নিয়ে ফেরে। একটা কুমারী দেহ, জল্লাদ কেটে ফেলে দিলে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়–কার জমি কুমারীর রক্তের ছোঁয়া পাবে! ফসল ভাল হবে। যুদ্ধের পর নারীর সংখ্যা বাড়ে পুরুষের তুলনায়, কুমারী বলি থাকলে সেটা ফের সমতায় ফিরে আসে। এই কি জীবন?

মানুষ এভাবে কতকগুলি নিয়ম চালু করে। কুমারী বলি রদ করেছেন মহাত্মা ইহুল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য দেবদেবীর দেহমিলনের অভিনয় হয় নববর্ষে–সেটা এখনও রদ হয়নি। শুধু একটা লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে সমস্ত কাজ করতে হচ্ছে। হলে আকাশে মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে চিৎকার করে বলতে হচ্ছে, কুমারী বলি অতি দূর দূরান্তরের দেশের, মহুলা নদীর পারের ঘটনা—হাল আমলে এখানকার পুরুতরা চালু করেছিল–জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য তারা নানারকম পূজা চালু করছে–যার কখনও নামই শোনা যায়নি। আর একবার একটা জিনিস চালু হলে সহজে রদ করা যায় না। নতুন একটা নিনিভে-পূজাও চালু হয়েছে। মড়ক-পূজার নতুন নাম হয়েছে নিনিবে। মারীর দেবী নিনিবে।

অথচ হেরাকে ধন্যবাদ যে, সে তার স্ত্রীর নামই রেখে দিলে নিনিভা। তার সংস্কারে বাধলও না একটু। ভয়ও করল না! আতঙ্ককে ভালবাসার মধ্যে হেরা মজা পায়। লোটার কথায় তার দুচোখ ঢেকে ফেলার ভয় বোধহয় ভয় নয়–কান্না। এই ছবি তার হৃদয়ে ঢুকে গেল। সারাদিন, সারাজীবন হেরা ওই দৃশ্যটা ভুলবে না। ক্রমান্বয়ে সে ভাববে।

বছর চৌদ্দ বয়েস নিনিভার। বলির মুখ থেকে বেঁচেছে সে, তারপর বোবা হয়ে যায়। নিনিভা যদি বোবা না হত, তাহলে হয়ত হেরা তার কাছে ছুটে যেত না। হেরা এরকমই।

সাদা অশ্বটার পিঠে লাফিয়ে উঠল সাদইদ। প্রবল জ্যোৎস্নার ভিতর ছুটতে শুরু করল।

নদীর বাঁধটার কাছে এসে ঘোড়ার পিঠে শান্ত হয়ে দাঁড়াল সাদইদ। জল ফেঁপে উঠে খালে গিয়ে পড়ছে। মাটির উপর পলি জমলে মাটি উর্বর হয়–মেসোপটেমিয়া তার নদীর তীরে এই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল। সেখানকার চাষীদের দক্ষিণ এলাকা থেকে, মারীর বিভীষিকার কবল থেকে টেনে এনেছে সাদইদ–এখানকার লোকেরা ভয়ে শুকিয়ে কাটা হয়ে গিয়েছিল। নদীর এই দূরবর্তী এলাকায় তাদের ঘর বেঁধে দিয়েছে সাদইদ। এরা বাধ বেঁধেছে, খাল কেটেছে। এমন ফসলের রূপ কনান কখনও দেখেনি। শস্য পাবার সময় হয়ে এল। সেই গন্ধ নাকে এসে লাগছে।

জ্যোৎস্নায় চারিদিক নিথর। হঠাৎ দূরে মাঠের ভিতর মশালের আলো চোখে পড়ল। তারপর সমবেত বিচিত্র চিৎকার। ঘোড়া ছোেটালো সাদইদ। কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল কতকগুলি লোক মাঠের উপর দিয়ে কী যেন বস্তু দারুণ উল্লাসে মাতলামো করতে করতে টেনে নিয়ে চলেছে, চিল্কারে আকাশ ফাটিয়ে তুলছে। অষের পায়ের শব্দ শুনে লোকগুলি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর কে একজন চেঁচালো–সারগন! ওরে সারগনের ঘোড়া! চ! ফেলে দে! আর নিয়ে যেতে হবে না। অ্যাই! সর্বনাশ হল! পালা, পালা!

মাঠের উপর মশাল ফেলে দিয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালিয়ে গেল। অশ্বের পিঠ থেকে নেমে মাটিতে পড়ে থাকা জ্বলন্ত মশাল তুলে ঝুঁকে পড়ল সেই বস্তুটির উপর। সাদইদ দেখল–নিনিভা! কিন্তু তা কী করে সম্ভব! একটু আগেই তো সাদইদ নিনিভার সঙ্গে কথা বলে এসেছে। মুহূর্তে এ ঘটনা কী করে ঘটে! অবিকল নিনিভার মুখ।

সাদইদ অশ্ব ছুটিয়ে ফিরে আসে। এসে দেখতে পায় নিনিভা হেরার সঙ্গে কথা বলছে। অশ্ব থেকে নেমে এসে বলে-তোমার মত দেখতে এই গ্রামে আর কেউ আছে?

–হ্যাঁ। আমার বোন। দু’বছরের ছোট। আমার আরো পঁচটা বোন আছে। একজন দেখতে আমার মত। কেন?

–ও বলি হয়ে গিয়েছে নিনিভা। ইহুদের ভয়ে রাত্রে কেটেছে।

নিনিভা আর্তনাদ করল–জানতাম! বাবা বোনটাকে বাঁচতে দেবে না। মাঠে ফসল হচ্ছে না বলে বলির জন্য বাবার কাছে পুরুত আমাদের চাইত। হায় গোলাপী, শেষে তুই ..

বোনের নাম ধরে ডুকরাতে থাকল নিনিভা। অশ্ব ছুটিয়ে এসে মাঠের মধ্যে গোলাপীর বলি হওয়া মৃত গলা কাটা দেহ খুঁজে পেল না সাদইদ। হেরা কালো ঘোড়ায় চড়ে সাদইদের পিছু পিছু এসেছিল।

বলল–তোমার কি কষ্ট হচ্ছে সাদইদ? কতকগুলি নিয়ম তুমি বুঝতে চাও না কেন? তিনটে ভেড়ার বদলে হাটে একটা বালিকা খরিদ করা যায়। পশুবলি হলে নারী কেন বলি হবে না? তুমি একটা স্বাভাবিক ঘটনায় এত উত্তেজিত হও! তুমি কি ভাবছ, হাটে কেবল পশুই বিক্রি হবে, মানুষ বিক্রি হবে না? পশু আর মানুষে তফাত করাটা তোমার কবিত্ব হতে পারে, নিয়ম হতে পারে না।

–কিন্তু ইয়াহোর নিয়মটা তাহলে আমাকে বলবে! ইহুদ কেন এই নিয়ম রদ করতে চাইলেন? শোন বলি, মসীহ পশুদের চালনা করেন। চাষী পশুদের খেতে দেয়, বাঁচায়, চালিয়ে নিয়ে ফেরে। তাই মানুষ কখনও পশু হতে পারে না। চালকের বেঁচে থাকা দরকার। লোটার মৃত্যু তাই মেনে নেওয়া যায় না। সে পশুদের চালিত করেছিল। তুমি একটা অন্ধকার সময়ের কথা বলছ–এখন মানুষ হত্যা করা অন্যায়। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। যা আমার কবিতার সমর্থন পাবে না তাকে আমি উচ্ছেদ করতে চাই। কুমারীর রক্ত নয়, জমি উর্বর হয় পলিজলে।

–পলিজল!

–হ্যাঁ, পলিজল! এটা মাটির নিয়ম। সে উর্বর হওয়ার জন্য মানুষের রক্ত প্রত্যাশা করে না। সে চায় মাটিরই প্রলেপ। মাটি আপন নিয়মে কাজ করছে। জল তার আপন নিয়মে পলি বইছে। এই নিয়ম নিরন্তর চলছে। মানুষ এদিকে সে নিয়ম না জেনে নরবলি দিচ্ছে, কুমারীর দেহ কেটে ফেলছে। এদিকে মহাত্মা ইহুদ করলেন কি,মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে বললেন–লাঠিই শ্রেষ্ঠ! পশুকে শাসন করে। হেদিয়ে মরছেন তিনি। এ করে হয় না হেরা!

–হয়, তা কে বলেছে!

–আমি নিয়ম না জানতে পারি, তাই বলে কুমারী মেয়েটি অকারণ হত্যা হয়ে গেল, তারা মৃতদেহ হিঁচড়ে টানছে মাঠের উপর দিয়ে–হৃদয় যদি তোমার দুঃখ না পায়, তুমি কখনও জল, বৃক্ষ, মাটির কথা বুঝতেও পারবে না–স্বর্গও তৈরি হবে না তোমার হাতে। নোহ নিয়ম জানতেন। তাই কিস্তি তৈরি হল। তিনি জল এবং মাটির কাছেই থাকতে চেয়েছেন। জলের উপর ভাসছেন। কিনারা খুঁজছেন। যিনি নৌকা তৈরি করবেন, তার কিন্তু লাঠি ঘোরানোর সময় হবে না। কারণ নৌকায় তাকে তুলে রাখতে হবে সকল জীব এবং বীজের নমুনা। একটা কালো খর্ব হাবসী কন্যাও যেন আমার স্বর্গে আশ্রয় পায় হেরা! কখনও যেন নিনিভার আর্তনাদ আর শুনতে না হয়!

–কিন্তু নৌকায়, তো সবাই আশ্রয় পায়নি। যারা পাপী তারা ঠাই পায় না। তারা মরে! নোহ তাদেরই নিয়েছিলেন, যারা পুণ্য করেছিল। আমি ইহুদের বক্তৃতায় একথা গত কদিন আগে শুনে এসেছি। তিনি আমায় দেখে বললেন, ওহে কর্মকার–কী ব্যঙ্গ ভাবো–বললেন, আর কী সব বানাচ্ছো এখন বললাম–নোহর কিস্তি মহাত্মা! তা উনি শুধালেন–কার জন্য! কথাটা অত্যন্ত বাকা–একেবারে হৃদয়ে এসে বেঁধে! বললাম, তেমন বাছবিচার করিনি মসীহ! তা উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন–তবে এ নৌকা তোমার তলিয়ে যেতে বাধ্য হেরা! বাকি কথা তোমায় আর বলতে পারব না। সাদইদ!–চুপ করে গেল হেরা!

সাদইদ চেয়েছিল গমের ঝাড়ালো শিষগুলির দিকে। ভাবছিল মধু আর রুটি আর ডুমুর। খোবানী-খেজুর! মানুষ খাবে। মাটি এবার প্রচুর দিয়েছে। গমগাছের গোড়ায় জল জ্যোৎস্নালোকে চিকচিক করছে। সেই ঝিলিমিলি অসম্ভব সুন্দর! চেয়ে থাকলে নিশ্চয় পুণ্য হয়। হঠাৎ পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে সাদইদ বলল–লোটা তবে কী পাপ করেছিল হেরা! মরল নে?

হেরা বলল-লোটা তো মরেনি!

–মরেনি?–সাদইদ কাতর স্বরে এক তীব্র আর্তনাদ করে।

–না। ইহুদের উম্মতরা লোটার মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করে না। এই মিথ্যা প্রচারের জন্য তোমাকে ঘৃণা করে! পুণ্যবান লোটার কখনও মৃত্যু হতে পারে না। তারা বিশ্বাস করে লোটা একদিন ফিরে আসবে।

–অসম্ভব!

–সে তত তোমার আমার কাছে সাদইদ। ইহুদের উম্মতরা মনে করে, লোটা মরুভূমিতে রয়েছে। নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ফলে লোটার স্ত্রীর আর কখনও বিয়ে হবে না। রিবিকাকে আমি কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই সে নিনিভার মত বোবা। রিবিকা নিশ্চয়ই দেবীর মত সুন্দর। লোটা ছাড়া তাকে কেউ কখনও স্পর্শ করতে পারবে না। ভেবে দ্যাখো সাদইদ, সামনের ওই কালো ঘোড়াটা কী মিথ্যা হয়ে গেল!

–এসব কথা তোমার মুখে আমি আর শুনতে চাইনে হেরা! তুমি ফিরে যাও! আমার ফিরতে দেরি হবে।

–এখানে কী করবে এখন?

–লোটার জন্য অপেক্ষা করব!

–পাগল! তুমি কী পাগল হয়ে গেলে! যা তুমি বিশ্বাস কর না, তার জন্য কি অপেক্ষা করা যায়!

–একটি মেয়ে কী করে পারে!

–পারে না সাদইদ, পারে না!

 পারে, কে বলেছে তোমায়? পারা উচিত নয়।

–উচিত নয়? তবে সে রয়েছে কী করে?

–সে তো আমি বলতে পারব না।

–তবে তুমি কথা বলছ কেন হেরা! কেন বলছ কথা!

প্রায় চিৎকার করে ফেলল সাদইদ। আর্ত সে স্বর গলায় হাহাকার করে উঠল। হেরা নিচু সুরে বলল–নিনিভার বোন মরল এই রাতে। কেন মরল, এতদিন যা জানতাম তা ভুল! কিন্তু রিবিকা যে অপেক্ষা করে রয়েছে একথা ভুল নয় সাদইদ। ভুল হতে পারে না। লোটা ফিরে এসে যুদ্ধ করবে।

–যুদ্ধ!

–হ্যাঁ। ইহুদের সাম্রাজ্য গড়ে উঠবে সেদিন।

–কী বলছ তুমি?

–তুমি ইয়াহোর ধর্ম গ্রহণ করো সাদইদ! তুমি পাপী!

–এ পাপ কিসের হেরা!

–যুদ্ধের! লোটার অপমানের। লোটা ফিরে আসবে সেকথা বিশ্বাস না করার পাপ। তুমি তুচ্ছ একটা মানুষ সাদইদ। কাফের! পাপ করার অধিকার তোমার আছে।

হঠাৎ মনে হল, এ যেন হেরা নয়, ইহুদেরই কণ্ঠস্বর। কালো অশ্বটি মুহূর্তে মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। একা দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। ক্রমশ তার হৃদয়ে হেরার বলা কথাগুলি চেপে বসতে লাগল। তুমি একটা তুচ্ছ মানুষ। পাপ করার অধিকার তোমার আছে।

নিনিভার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল–সবার কত কিছু আছে। তোমার নেই কেন? তোমার শিশু! তোমার নারী!

–আমার আছে নিনি! আর্তস্বর ফুটে বার হয় সাদইদের কণ্ঠে । তারপর সাদইদ আকাশে চোখ তুলে বলে–আমার পাপ করার অধিকার আছে নিনি! নিশ্চয়ই আছে। দেবদাসী রুহা! তুমি শুনে রাখো, আমি পাপী! আমার কুড়িয়ে পাওয়া নারীতে আমার পাপেরই অধিকার মহাত্মা ইহুদ! এ নারী লোটার নয়।

এই নিথর, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রকৃতি সাদইদের কথায় বিচলিত হল না! কিছুক্ষণ বাদে একলা কালো ঘোড়াটা ফিরে এল। অনেকদিনই এরকম হয়, সাদইদ সাদা ঘোড়ায় চলেছে সম্মুখে, পিছনে ছুটে আসছে লোটার কৃষ্ণ অশ্ব। অকারণ কালো ঘোড়া অসহায়ের মত, অবাধ্যের মত দৌড়য়। তাকে ফেরানো যায় না।

কালো অশটিকে দেখে ভয়ে সাদইদ একটা বোবা আর্তনাদ করে কেঁদে ফেলে। সাদা ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে পড়ে। ছুটিয়ে দেয় ক্ষিপ্র বেগে। কালোটি তাকে অনুসরণ করে। সাদইদকে এক আশ্চর্য পাগলামি পেয়ে বসে। এই জ্যোৎস্নায় দেবদেবীর রমণকৃত সুঘ্রাণ হাওয়ায় ছড়ানো। পশুরা ঘুমাতে পারছে না। নদীর জলে সোনালী একটি সিংহী চকচক শব্দে জল পান করছে। জ্যোৎস্নার তীব্র দোলনে জল কাঁপছে সাদা ইস্পাতের ঢালের মত। সিংহীর নধর শরীরে কামনার কাপুনি। অশ্ব ছুটে যায়। রাত্রি বেড়েছে ঢের।

তাঁবুর পৃথিবী চোখে পড়ে। সাদা অশ্ব এসে থামে দিনারের তাবুর সামনে। কালো অশ্ব মুখ তুলে শূন্যে ভেসে বেড়ায় নিরুপায় অর্থহীন। দিনার বেরিয়ে আসে চুপচাপ।

সাদইদ বলে–তুমি কাল রাস্তা তৈরির কাজে নিয়োগ হলে দিনার। কাল আমার সঙ্গে দেখা করো। যাও রিবিকাকে ডেকে দাও।

দিনার প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব বুঝতে পারে না। কাজে সে নিয়োজিত হবে কোথায়? আর কেনই বা রিবিকাকে ডেকে দেবে? কাজ এবং ডেকে দেওয়ার মধ্যে সম্পর্ক কোথায়!

দিনার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্ত হয়ে সাদইদ বলল–শুনতে পাও না?

একটুখানি কেঁপে উঠল দিনার। তারপর জুমপাহাড়ী ভাষায় দিনার জবাব দিল–আপনার জিভ খসে পড়বে সারগন! কাকে ডাকতে বলছেন আপনি। উনি আমাদের মায়ের মত। সবার মা! আর আমাকে কাজের লোভ দেখাবেন না! আপনি তো ইয়াহোর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। যার কিনা হিতেন রাজার বিরুদ্ধে একটা কথা বলার সাহস নেই, সে বানাবে জিগুরাত! ওই কাজে আমাদের দয়া করে ডাকবেন না। থুঃ! কী ভাষায় কথা বলছি হায় ইয়াহো! যান চলে যান!

দিনার চলে গেল! কালো অশ্ব তীব্র আর্তনাদে আকাশে গলা তুলল। রিবিকার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, লোটা যেন এসেছেন! রিবিকা পাগলের মত বাইরে বেরিয়ে চলে আসে। সাদইদ ওকে হাত ধরে অশ্বে টেনে তুলে নেয়। তারপর অশ্ব আর থামে না। রিবিকার ঘোর কাটতে সময় লাগে না।

সাদইদ রিবিকার কানের কাছে মুখ রেখে বলে–বলেছিলে ভয় পেও না!

–আমায় ছেড়ে দাও সাদইদ!

–কেন তুমি বেরিয়ে এলে!

–আমার যে মনে হল, উনি এসেছেন!

–আমি সাদইদ রিবিকা! তোমার সারগন!

–অ। তুমি?

পাগলের মত কথা বলে রিবিকা। তারপর সাদইদের কোলে মূৰ্ছা যায়। অশ্ব কোথায় এসে পৌঁছয়, সাদইদ ছাড়া কেউ জানে না। এক আশ্চর্য উপত্যকায় উঠে এসেছে জ্যোৎআফেননিভ অশ্ব। স্বর্গের আলোয় জ্বলছে তার দেহ।

এমন সুন্দর উপত্যকা সাদইদের স্বপ্নের ভূমি। এ উচ্চস্থান ঝর্নার ধারায় সিক্ত, প্রকৃতিই নিজে সেজে রয়েছে, সমতল থেকে ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে পাহাড়ের গা অবধি প্রসারিত হয়েছে এ পাহাড়ে ইয়াহোর অগ্নিচক্ষু আকাশ রক্তাক্ত করে না। এখানে ঝর্নাটি বাতাসে যেন দেবদাসী রিবিকার মাথার নীল ফিতার মত ভাসছে, অনন্ত সুরে বইছে, ফেনাইত হচ্ছে স্ফটিক বুদ্বুদ, নীল আভা-মাখা স্রোতে মিশে আছে কিঞ্চিৎ গেরুয়া পলি। এখানে আপনা-আপনি জন্মেছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ, গাছপালাগুলি ঝুলিয়ে রেখেছে ফল ফুল মধুচক্র আর লতানো দোলনা। এখানে কখনও ভূমিকম্প হয় না। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে না ভয়ংকর পাগলা পাথর। এখানে গাছের ডালের দুবাহু তোলা ফাঁকে মুখ রেখে বসে থাকে পূর্ণিমা। লাল আলোর ঘোর আর ছায়া-মাখা চাঁদটি ফর্সা হয়ে ওঠে ক্রমশ। চাঁদটা একটা বিশাল মধুচক্রের ঝুলন্ত শিলার পাশে উঁকি দিয়ে ডালের দু’বাহুর উপর ধীরে ধীরে খাড়া হয়।

সেই ছায়া, সেই আলো, সেই শুভ্রতা রিবিকারসংজ্ঞাহারা মুখে এসে লাগে। চুলে এসে ঝর্নার বাতাস সুরের দোলা দিয়ে একটা তরঙ্গ উদ্বেলিত করে। রিবিকার বুকের কাপড় বাতাস যেন আকুল হয়ে অতি সন্তর্পণে খসিয়ে দিয়ে চলে যায়। পাথরে শায়িতা রিবিকা। চোখ মুদিত। হাত দুটির একটি মাথার দিকে এলিয়ে শ্লথ আবেশে পড়ে রয়েছে। অন্য হাতটি পাথর ছাড়িয়ে শূন্যে ঝুলে পড়েছে। নাভিমূলের একটি-দুটি রেখার নিচে কাপড় বিস্রস্ত। একটি পা পাথরের উপর সটান, অন্যটি পাথর গড়িয়ে ঝুলছে। রিবিকা কি পড়ে যাবে?

রিবিকার মাথার কাছে ঝর্না এঁকেবেঁকে চলেছে মেসোপটেমিয়ার খালের মত। যেন সুরই এঁকেবেঁকে গেছে। এই অবস্থায় আকাশের দেবতারা যেন চাঁদের মশাল তুলে রিবিকার মুখ দেখছে। দেবতারা এই রাতে মানবীর গর্ভসঞ্চার করে। তারপর তারা আর আকাশে ফিরে যেতে পারে না। তারা প্রজাপতি হয়ে পৃথিবীতে থেকে যায়।

হঠাৎ সাদইদের ভয় হয়, রিবিকা যদি আর না জেগে ওঠে? লোটার মতই যদি ঘুমিয়ে পড়ে? সাদইদ রিবিকার মাথায় হাত রাখে। রিবিকার দেহ নড়ে ওঠে।

চোখ দুটি পাপড়ির মত খুলে যায়। সভয়ে রিবিকা দ্রুত উঠে বসে। কাপড় তুলে বুকের কাছে জড়ো করে। সাদইদ রিবিকাকে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করার জন্য পাথরের উপর বসবার চেষ্টা করে। রিবিকা পাথর ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে–আমায় হেঁবে না সাদইদ।

–কেন রিবিকা!

–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে।

–লোটা নেই। ও মরে গেছে। লোটা আর ফিরবে না রিবিকা! এখানে কেউ নেই। চারিদিক নির্জন। দ্যাখো সেই চাঁদটা এখানেও এসেছে। এই উপত্যকা ছেড়ে চাঁদ আর কোথাও যাবে না। এখানেই আমাদের স্বর্গ মিবিকা!

–তা হয় না সাদইদ। চাঁদ যেমন মিথ্যা, স্বর্গও সত্য নয়। একমাত্র ইয়াহোর স্বৰ্গই সত্য সারগন। লোটা ফিরে আসবে। সমস্ত মরুভূমিতে সে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। মানুষ আজ জেনেছে, লোটা মরে না। সে মরেছে ভাবলে পাপ হয়। তার জন্য অপেক্ষা করলে মানুষের পরমায়ু বৃদ্ধি পায়। আমি আজও বেঁচে আছি কেন? বলে দাও, কেন বেঁচে আছি! তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। ও যে আমার জন্য খাদ্য আর বস্ত্র জোগাড় করতে গেছে সাদইদ।

–আমি তোমায় খাবার আর পোশাক দেব রিবিকা! তুমি তো আমারই ছিলে! মনে আছে জুম পাহাড়ের সেই রাত। সেই সকালবেলা! আমার এই লুঠ করা হাত দুটি দুর্বল নয় রিবিকা!

–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে সাদইদ! তুমি যদি এই নির্জন স্থানে আমার অসম্মান করো–পাপ হবে তোমার! লোটার পত্নীকে কেউ ছুঁতে পারে না। দেবতা পর্যন্ত তার ওপর কু দৃষ্টি ফেলতে পারে না। আমি চিরপবিত্র নারী! ছোবে না আমাকে। স্বর্গ একটা প্রতারণা। তুমি পাপী!

সাদইদ বিষঃ সুরে বলল–তোমার দেহ! আমি যদি প্রজাপতি হতে পারতাম, তুমি আমায় পাপের কথা তুলে এভাবে কষ্ট দিতে না! আমার কষ্টের কি কোন দাম নেই? আমি নোহের সন্তান। কবি আমি। মনে নেই? আমি তোমাকে একটি ফুলের বিনিময়ে খরিদ করতে পারি। পারি না? এই নাও রিবিকা। অন্তত তুমি আমায় ফুলের পাপড়ি দিয়ে স্পর্শ করতে দাও।

হাতে ধরা ফুলটি সাদইদ সামনে এগিয়ে ধরে। বলে–এই ফুল নিশিগন্ধা । সাদা এর কলিকা। এখানে মধু আর শিশির জমেছে রিবিকা। এই রাতে একটি উটের চোখের জল এভাবে ঝরে পড়ে।

–ওভাবে বলল না সাদইদ! আমি আশ্রয়চ্যুত হব । আমার কেউ নেই যে সারগন! এই মাটিতে আমার জন্ম। তিনটি ভেড়ার বদলে আমি এখান থেকে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলাম এক বণিকের হাতে। ঠাকুমা বলেছিল আমার কাকারা ফসল ভাল হলে উট নিয়ে যাবে আমায় ফিরিয়ে আনতে। সেই অপেক্ষা করছি কত বছর। ওরা যায়নি ফরাতের বস্তীতে। কেউ নেই। এখানে এলাম। কেউ আমায় চিনল না। দেবদাসীকে কেউ চিনতে চায় না। মনেও রাখে না। তুমি ভুলে যেও সাদইদ। এই স্বর্গ আমার জন্য নয়। স্বৰ্গ কি কখনও নেমে আসে?

–আসে না? তোমার এই দাঁড়িয়ে থাকা কি সত্য নয়? –সাদই অবাক হল, গলায় অদ্ভুত কাতরতা।

–এ অলীক! সাজোয়ার মৃতদেহের ভিতর আমার এই দেহ কি শুয়ে থাকতে পারে না? পারে, খুব পারে! মনে করো, আমি নেই। অদৃশ্য জগৎ আমায় ডেকে নিয়েছে! বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা।

এই সময় সাদইদের হাত থেকে নিশিগন্ধার কলিকা স্খলিত হয়ে রিবিকার পায়ের উপর পড়ে যায়। ফুলের স্পর্শে রিবিকার তামাম দেহ রোমাঞ্চিত হয়। মুহূর্তে তার দু’চোখ মুদে আসে। নাকের গোড়া স্ফীত হয়, বুকের ভিতর ঘন মদির খাস যেন ঢুকে যায়। ধীরে ধীরে নারীর দেহ কেঁপে ওঠে ঠোঁটের উপর ঘাম জমে।

সাদইদ রিবিকাকে স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে বসে পড়ে পায়ের কাছে। ফুলের দীর্ঘ কলিকা তুলে নিতে গিয়ে দুটি হাতের তালু প্রসারিত উপুড় করে পায়ের উপর চেপে ধরে। রিবিকা গলায় অদ্ভুত সুখ আর কাতরতার মিশ্র ধ্বনি উচ্চকিত করে। তারপর সে সাদইদের মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকে শরীরে চেপে ধরে।

এমন সময় কালো অশ্বের হ্রেষা তীব্র মন্থনে গলার শিরা ছিঁড়ে আকাশে দীর্ণ হয়। পাগলের মত ছুটে আসতে থাকে ঘোড়াটা। কী যে হয় ঘোড়া ফের ফিরে যায় নিচের দিকে। অশ্বের এত আর্তনাদ কখনও শোনা যায়নি।

সাদইদ রিবিকাকে পাথরের উপর শুইয়ে দেয়। জ্যোৎস্না আরো উজ্জ্বল হয়েছে। ডালের দু’বাহুর ফাঁকে ঝুলছে মধুচক্র, মৌমাছির জ্যোৎস্নার মাদকতায় অদ্ভুত নড়াচড়া। চকচক করছে কালো পুঞ্জীভূত দেহগুলি। সাদইদ ভাবল, মধু যেমন সঞ্চিত থাকে মধুচক্রে, এই স্বর্গস্থানে সঞ্চিত থাকবে খাদ্য, পানীয় আর পোশাক। দুর্ভিক্ষে, বন্যায়, অভাবে মানুষ এখানে আশ্রয় পাবে। বন্যার জল নেমে গেলে, বর্ষার জল মাটিতে পড়লে, শীত অথবা গ্রীষ্ম কমে গেলে মানুষ নিচে নামবে।

কিন্তু নোহের নৌকাকে যেমন সেদিন মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি, তার স্বর্গকেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এই রিবিকা স্বর্গ বিশ্বাস করে না। তাকে বোঝানো দরকার, স্বর্গ আকাশে থাকে এ ধারণামাত্র। সেই কল্পনা সত্য। কিন্তু এই মর্তে তার বিশ্ব মিথ্যা নয়। নারীর এই রূপ যেমন সত্য, স্বর্গও সত্য। স্বর্গ ছাড়া, হেরার ভাস্কর্য ছাড়া এ নারীর রূপ কোথাও বিম্বিত হতে পারে না।

অশ্ব আর্তনাদ করে উঠল। সাদইদ রিবিকাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলল। রিবিকা কেঁদে উঠল। দু হাত জড়ো করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল–হায় ইয়াহো। এ পাপীকে রক্ষা করো প্রভু!

কালো অশ্ব তীর এবং বর্শাবিদ্ধ হয়েছে। কে তাকে মারছে কেউ জানে না। অশ্ব ছুটে এসে পাগলের মত সাইদের গা ঘেঁষে আছাড় খেয়ে পড়ল, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে প্রাণপণে উঠে দাঁড়াল।

সাদইদ বলল–লোটা তুমি এ কী করলে? আমার পাপ তোমার সহ্য হল না!

অশ্ব কান পাতল বাতাসে। মরুভূমি তাকে ডাকল লোটার গলায়–সালেহ-ও-ও-ও, হায় পিতা-আ-আ-আ…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *