মরুস্বর্গ – ৩

০৩.

সাদইদের দিকে চোখ মেলে চাইল রিবিকা। তার বুকের কাপড় সরে গেছে। লোকটি তার দিকে গভীর আগ্রহে চেয়ে আছে। হঠাৎ কী খেয়াল হওয়াতে সাদইদ রিবিকার বুকের কাপড় সাবধানে তুলে রিবিকাকে ঢেকে দেয়। রিবিকা পুরুষের এই আচরণ ভাবতে পারে না। নারী যখন সংজ্ঞাহীন, পুরুষ তখনও নারীকে গমন করে। মিশরে সমকামী পুরুষের অভাব ছিল না। পুরুষ এমনকি মৃতাকেও গমন করে। নারীর এসব সুযোগ নেই। দেবতা আমন নারীকে এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন। ফলে সে সুন্দর হয়েছে।

সাদইদ বলে উঠল–ভয় পেও না প্রজাপতি!… খুব নরম করে বলল, তা আহ্বানের সুরে। কেন যে এমন করে বলল, হৃদয়ের এই চিন্তার ব্যাখ্যা সাদইদের জানা ছিল না। ঠিক তখনই হৃদয়াবেগের প্রবল চাপে রিবিকা সভ্যতার সেই নারী যে লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ফেলল।

একটা কথা ভেবে রিবিকার কান্না থেমে যায়। অজ্ঞান অবস্থায়, দেবী ইস্তারের মত যখন সে পাতালে ভাসছিল, খুব একা, খুবই অসহায়, যখন সে তার পুরুষকে পাগলের মত অন্ধকার স্রোতে খুঁজছে, তখন এই সৈনিকটা তাকে গমন করেনি তো!

–কী হল? প্রশ্ন করল সাদইদ।

রিবিকা জবাব না দিয়ে উঠে বসে অন্ধকার স্রোতের কোন ক্ষীণ স্মৃতি শরীরে স্পষ্ট লেগে আছে কিনা মনে মনে বুঝে নিল। শরীর কাহিল, কিন্তু অজ্ঞানতার ক্রমাগত নিমজ্জন তাকে অসহায় করেছে, পীড়ন করেনি-বুঝতে পেরে ফের দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল । রিবিকা আপন বুকের দিকে কাপড়ের আড়ালে চক্ষু সঞ্চালিত করে টের পেল মৃত পতঙ্গ অক্ষত। তার কান্না আরো বেড়ে গেল।

সাদইদ বলল–নিনিভে নগরী তোমার চেয়ে সুন্দরী নিশ্চয়। মনে রেখো সেখানের সিংদুয়ারে বৃষমূর্তি আছে বৃষের মুখ মানুষের মত। স্কন্ধ বৃষ, চোখ মানুষের। সেই চোখে তোমার জন্য কোন কান্নার জল জমে নেই–তা আগুন জ্বালায়। বৃষবক্ষ যাকে বলি, তা নির্মম। ওঠো, আমার সঙ্গে তোমাকে যেতে হবে।

কথার শেষ অংশে গলা কঠোর করে তুলল সাদইদ।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে জুমা পাহাড়ের দিকে আবার চাইল সাদইদ।

বলল–তোমাকে মধু আর রুটি দিতে পারি। দেখে মনে হচ্ছে তুমি অনেক দিন কিছু খাওনি। চলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তোমাকে শিবিরে নিয়ে যাই।

রিবিকা ঘোড়ার পিঠে ফের উঠে বসেছিল। অত্যন্ত ম্লান গলায় বলল–খিদেয় ধোঁকাচ্ছি, দেহে বল নাই। এই অবস্থায় যা খুশি করতে পারো। তবে দোহাই, আমাকে শিবিরে দিও না। তোমার সৈনিকরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। হায়েনার হাত থেকে মসীহ আমায় রক্ষা করেছেন, একটা মেষশিশুর কাছ থেকে তুমি একজন প্রজাপতির বন্ধু, কিছুই কি শিখবে না?

–অ। তুমি দেখছি ভারী চালাক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীদের কাছে থেকে কতকিছুই শেখার আছে। হ্যাঁ, আমি একথা বিশ্বাস করি। আমার কাছে ব্যাপারগুলি খুবই স্পষ্ট। অবশ্য ক্ষুদ্র কেন, বৃহৎ প্রাণী যারা, তারাও আমাদের শেখায়। উট, অশ্ব, কুকুর। এরা কেউ ভগবান নয়। এরা লাঠিধারীদের মত ইশারাবাদীও নয়, ভণ্ডও নয়। কিছু মনে করো না। পিতা নোহ ছাড়া আমার কোন মসীহর উপর আস্থা নেই।

বলতে বলতে একটি দেবদারু গাছের ছায়ায় ফের দাঁড়িয়ে পড়ল সাদইদ।

বলল–এখানে একলা তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি নিচে নেমে এসো। আমার ভয় হচ্ছে, তোমাকে সৈনিকরা দেখলে কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না।

–দোহাই!

আর্তনাদ করে উঠল রিবিকা। বলল–আমি তোমার কবিতার তারিফ করি সারগন। পিতা নোহের সন্তান তুমি–আমায় বাঁচাও।

–আমি সারগন নই প্রজাপতি। আমাকে এত সম্মান দেখানোর কিছু নেই। আমি শুধু প্রজাপতি দু’টির’আচরণে মুগ্ধ আর অবাক হয়েছি। জানি মধুর। লোভেই তারা তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তারপর ঘটনাটা অন্যরকম। হয়েছে। ওরা বিভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সেটা খুব দুর্লভ ব্যাপার। ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না। হৃদয় উর্বর হলে, আমি এ নিয়ে দু ছত্র লিখতাম। পাথরের গায়ে কুঁদে রাখলে সেটা বাবিলের অনুশাসনলিপির চেয়ে মূল্যবান হত। ধন্যবাদ! তুমি আমার কবিতার তারিফ করেছ!

ধন্যবাদ জানিয়ে সাদইদ বলল–এবার তাহলে তোমাকে নামতে হয়।

রিবিকা বলল–আমার নামবার ক্ষমতা নেই সারগন। আমি আর পারছি না।…বলতে বলতে রিবিকার চোখ দুটি খিদেয় আর ক্লান্তিতে মুদে এল।

দুটি হাত অখের দিকে প্রসারিত করে সাদইদ বলল-তোমার সঙ্গে অদ্ভুত দু’টি প্রজাপতির সংযোগ ঘটেছে। যাই হোক, এই দৃশ্যের খাতিরে আমি তোমাকে খাদ্য আর পানীয় দেব। এবং চাইব না যে তোমাকে ধর্ষণ করে মেরে অসুরদের খুটায় টাঙিয়ে দিক সৈন্যরা। অসুর কে নয় বল? যুদ্ধ যতদিন আছে একটা রঙিন প্রজাপতির পক্ষধ্বনি কারো কানে যাবে না। আমি নিশ্চিত, প্রকৃত নোহের সন্তান ছাড়া এই ধুন শুনতে পায় না। আমি ঠিক যোগ্য নই। চুটকিলা গেয়ে যুদ্ধ থামানো যায় না। দরকারই বা কী! যুদ্ধ থামলে আমার জায়গা কোথায়! এসো! নেমে পড়ো।

গাছের ছায়ায় নামিয়ে রেখে সাদইদ অশ্বারোহণ করল, রিবিকার চোখে অদ্ভুত আকুতি ফুটে উঠল। খিদে আর তেষ্টায় সে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। মুহূর্ত কতক চলে যায়। দ্রুতই ফিরে আসে সাদইদ। দ্রাক্ষাকুঞ্জ থেকে মধু আর রুটি সংগ্রহ করে ফিরেছে। হত্যা করা মেষটাকে সৈনিকদের ভিতর ছুঁড়ে দিয়ে এসেছে।

রিবিকা যখন গোগ্রাসে খেতে শুরু করল, সুন্দর মায়া এসে সাদইদের চোখ দু’টিকে ঘিরে ছায়া ফেলে দাঁড়াল।

সাদইদ বলল–তোমার জন্য জল, মধু আর রুটি। শীতে আর গ্রীষ্মে উপযুক্ত পোশাক। যদি পর্যাপ্ত এইসব পাও, কী করবে তুমি? মিশরীয় অভিজাত নারীদের মত তুমিও কামকলার চর্চা করবে। তখন আমার মত যাযাবরের কবিতা ভাল লাগবে না। আমার কতরকম ভাবনা, কোনটারই মাথামুড়ো নেই। কখনও বলি প্রজাপতি, কখনও বলি যুদ্ধ। দিশেহারা একটা ভাব। যার দেশ নেই, গ্রাম কিংবা নিজস্ব নগরী নেই। অশ্ব আর অস্ত্রবিদ্যা কী কাজে লাগল! রাজা হিতেনের অনুগৃহীত। তোমাকে যে খেতে দিলাম–মাগনা নয়। রাজাকে তুষ্ট করলে…যাক গে!

খেতে খেতে রিবিকা থেমে পড়ে দু’চোখ সামান্য কুঞ্চিত করে সাদইদের মুখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করে। কেমন সন্দেহ হয়। মনে হয়, এই লোকটাও তাকে বিক্রি করে দেবে। পুরুষ মাত্রই বিক্রেতা এবং ক্রেতা। প্রত্যেকেই বণিক। তবে লোকটির ভাব খুব দুরূহ সন্দেহ নেই। নিজেকে সে দিশেহারা বলছে। নারীর শরীরে কাদা, বালি লাগে, তেমনি ফুলের পাপড়িও লেগে থাকে। সবই সমান। তুচ্ছ প্রজাপতি দেখে মুগ্ধ যে হয়, সে পাগল। লোকটা যখন প্রজাপতিকেও শিক্ষক বলে ঘোষণা করেছে, বোঝা যায়, পাগলামিটাও তবে আস্ত। আবীরুদ এইরকমই ছিল। প্রাসাদ ছেড়ে সে তাঁবুর তলে থাকতে চেয়েছিল।

ভাবতে ভাবতে আবার খেতে শুরু করল রিবিকা। খাওয়া শেষ হলে ঢকঢক করে জলপান করতে করতে থেমে পড়ল সে। বলল–হায় আমন! তোমাকে তো একবারও বললাম না! মাফ করো আমাকে। তোমারও তো খিদে পেয়েছিল!

ক্ষীণ হেসে সাদইদ বললবলেছিলাম না! খেতে পেলে আবার তোমার বাঁচতে ইচ্ছে করবে। ক্ষুধার্ত মেয়েকে বলাৎকার করা কাপুরুষতা। সমকামিতার চেয়ে নোংরা জিনিস। আমি যদি সারগন হতাম, আমার নাগরিক অনুশাসনে একথা লিখতাম। অবশ্য সারগনেরই মত আমার জন্মমুহূর্তেই মা আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। হয় আমি জারজ ছিলাম। কোন সৈনিক আমার পিতা ছিলেন, যার কোন উদ্দেশ ছিল নানতুবা মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। আমার মাকে তোমাদের ঈশ্বর হত্যা করেছিলেন। নইলে নবজাতক সাদইদ কেন ঝুড়িতে করে জলে ভেসে যাবে।

একটু থেমে সাদইদ বলল–একজন ভিস্তি–ভিস্তি বোঝো তো! দ্রাক্ষাকুঞ্জের মালি। তিনি কে? তিনি এক ক্রীতদাস। বস্তুত তিনিই আমার পিতা-আসল বাপটি কে জানিনে। এইরকম দিশেহারা নিরাশ্রয় জন্ম আমার। সারগনেরই মত। কিন্তু আমি সারগন নই। বারংবার একটা মিথ্যা কথা বলছ। কেন?

বলতে বলতে সাদইদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। আরো খানিক জল আশ্লেষে পান করে রিবিকা বলল–একজন দেবদাসীকে ক্ষমা কর! আমার কথার কি কোন দাম আছে!

সাদইদ রিবিকার স্বীকারোক্তি শুনে অবাক হয়। মুখে আর কোন কথা বলে না। ক্ষমা চেয়ে সুন্দরী রিবিকা ঘাড় নিচু করে অনেকক্ষণ বসে থাকল। তার অধোভঙ্গিমার মুখোনির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কবিপ্রাণ সাদইদের মনে হল, মেয়েটিকে সে কুমারী ভেবেছিল। একটি দেবদাসীকে চিনতে না পারা তার অক্ষমতা। মেয়েটির মাথার নীল ফিতেটিকে দেখে তার আশ্চর্য লাগছিল।

সাদইদ বলল-দেবদাসী না থাকলে আমাদের যুদ্ধ থেমে যেত। তোমরা। আছো বলেই আমরা আছি প্রজাপতি!

–তোমার একথার প্রতিবাদ করার সাহস একজন দেবদাসীর নেই। তুমি সৈনিক। মুখে যা আসে বলতে পারো। তবে একথা একজন বুড়োর মুখে ভাল শোনায়। আমি প্রজাপতি নই। আমার নাম রিবিকা। আমার মত মেয়েকে প্রজাপতি বলে ঠাট্টা না করলেই পারতে সারগন!

রিবিকার ঈষৎ অভিমানভরা কণ্ঠস্বর শুনে সাদইদ হা-হা করে হেসে ফেলে বলল–আবার সারগন!

রিবিকা আবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। বলল–অন্য কোন সৈনিক হলে এমন করে সারগন বলে ডাকলে খুশি হত! তুমি তেমন নও। তোমার নাম ধরে তো ডাকতে পারি না।

সাদইদ বলল–শোন আমনের বউ! তোমাদের মুখে তারিফ শুনতে সৈনিকরা ভালবাসে, কারণ তাতেও এক ধরনের নেশা হয়। মদের চেয়ে সে নেশা খর। একজন সৈন্যকে গেজিয়ে দিতে তোমরা ওস্তাদ। বিশেষত একজন ভাড়াটে সেপাই দেবদাসীর মুখে ছাড়া প্রশংসা কোথায় পাবে! আমি অধিনায়ক, কিন্তু কখনও কোন সেপাইয়ের প্রশংসা করিনি। কেন করব?

বলতে বলতে গাছের শেকড়ে বসে থাকা সাদইদ উঠে দাঁড়ায়। তারপর তার ফেনশুভ্র ঘোড়াটির কাছে সরে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে লাগাম আঁকড়ে ধরে। পরম মমতায় ঘোড়ার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে–তারিফ কখনওই করব না। এরা প্রত্যেকে সারগন হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কখনও ঐক্যবদ্ধ হয় না। লুঠের মাল নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। একজন সুন্দরী দেবদাসীর উপর অধিকার বলবৎ করতে সহযোদ্ধার বুকে চাকু বসায়। মন্দিরে গিয়ে কে আগে কার কাছে কোন্ সুন্দরীর কাছে যাবে তার প্রতিযোগিতা করে। কী বলব, এদের ঐক্য নেই। এরা কখনও কোন একটা সুন্দর নগর নির্মাণের কথা ভাবতে পারে না। ক্রীতদাস ছিল, চোরাপথে পালিয়ে এসেছে, মন খুব ছোট। বিচিত্র মুখের ভাষা। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই।

একটু থেমে সাদইদ বলল–আমি নিজে প্রচুর মেহনত করে ওদের জন্য একটা তাঁবুর মিশ্রভাষা তৈরি করেছি। তাঁবুতে থাকে, কথা চালাচালির একটা মাধ্যম তো লাগে। সেই ভাষা তো কতকগুলো নকশা হলেই চলে না। মুখে একটা নকশার বর্ণনা করতে অনেক সময় লাগে। লিপি তৈরি হয়েছে, ভাষাও সহজ হয়েছে। লিপি দরকার। আমি নকশা নয়, লিপিভিত্তিক একটা বর্ণমালা প্রস্তুত করেছি-বলতে পারো, এটা আমার কোন কৃতিত্বই নয়। ফিনিশীয়রা লিপির ভাষার উদগাতা। উগাতা বোঝো তো! এই ভাষা তৈরি একটা জাতির ক্ষমতা। কল্পনা করার ক্ষমতা। লিপি হল লিখিত রূপ। অঙ্কিত রূপ নয়। সেটি হওয়ার ফলে ভাষাগুলিকে মেশানো সহজ হয়েছে। সে কাজটা কঠিন নয়। তা, সেই কাজ করে আমি প্রমাণ করেছি, বাবিলের গল্পটা ঠিক নয়। মানুষ ভাষার। দূরত্ব ঘোচাতে পারে। তা সত্ত্বেও এরা সত্যকে চিনতে চায় না।

একনাগাড়ে কথা বলার পর দম নেবার জন্য দণ্ডভর থামে সাদইদ। ঘোড়ার কাছ থেকে দ্রুত সরে এসে জলের পাত্রটা রিবিকার হাত থেকে ছোঁ মেরে ঠোঁটে তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জল গেলে। তারপর সেটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে–চলল, ওঠা যাক। তুমি দেবদাসী, তোমার পক্ষে বোঝা কতটা সম্ভব আমি জানি না। ঈশ্বর যবহ বা ধরা যাক আকাশের দেবতারা মানুষের মধ্যে। ভাষাভেদ ঘটিয়েছেন। কারণ মানুষ জিগুরাত তৈরি করে। জিগুরাত বা স্বর্গ যাই বল, মানুষের হাতে গড়া। তাই না? তা আকাশের ঈশ্বর মনে করলেন, স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে তুলে মানুষ তেনাদের আক্রমণ করতে চাইছে, কী স্পর্ধা! ব্যস হয়ে গেল! অমনি তেনারা জিগুরাত ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হলেন না, মানুষকে আলাদা করে দিলেন। কীভাবে? না, ভাষা আলাদা হল। এক এক গোষ্ঠীর এক এক ভাষা। গল্পটার ছিরি আছে বলতে হবে! সরদার ইহুদ নিশ্চয়ই তোমাকে এই গল্পটা হাজারবার বলেছেন!

–হ্যাঁ! সলজ্জ মুখ তুলে মাথা নাড়ল রিবিকা।

সঙ্গে সঙ্গে সজোরে উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠল সাদইদ। পাগল ছাড়া এভাবে হাসে না। মনে হল, এই হাসি যেন আকাশের দেবতাদেরই বিদ্রূপ করছে।

ইসিতে তার স্বর ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল, হাসি না থামিয়েই সে কথা বলে যেতে লাগল আর কোন সোল্লাসে ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে উঠতে থাকল, বলল–তুমি মিশরী মেয়ে, তুমি বুঝবে! রাজা ফেরাউন তো নিজেই তিনভাগ দেবতা, একভাগ, মাত্র মানুষ। দেবতা আর মানুষে এই ভাগাভাগিটা হাস্যকর। হয় তুমি পুরোপুরি দেবতা হও, নতুবা পুরোটাই মানুষ হও। এমনকি তুমি। লাঠিধারীদের মত জাদুকরও হবে না। দেবতাদের স্বভাব সব সময় কুপিত থাকে। তারা যদি সত্যিই কোথাও থাকে, তবে তাদের বোঝা উচিত, মানুষ প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। মৃত্যুর পরও মানুষের একটা ছায়া থেকে যায়। যাক গে! আমার কথা তুমি বুঝবে না।

রিবিকা বলল–মানুষ ভাষা তৈরি করতে পারে একথা বিশ্বাস করা কঠিন সারগন! ভাষা ঈশ্বরের দান। মুখের ভিতর জিভ নেড়ে নেড়ে মানুষ শব্দ করতে পারে মাত্র, ভাষা তো অন্য জিনিস। ঈশ্বর না চাইলে মানুষ নতুন কোন ভাষা সৃষ্টি করতেই পারে না। তুমি ধ্বংস হবে সারগন! ঈশ্বরই ভাষাভেদ ঘটিয়েছেন। তুমি সৈনিকদের জন্য ভাষা তৈরি করলে কেন?

সাদইদ ম্লান হেসে বলল–জুমা পাহাড়ের ওদিকে আমরা এখন চলে যাব রিবিকা। পাহাড়ের নাম জুমা অথবা জুম । আমার ভাষার নাম জুমপাহাড়ী অরমিক ভাষা। এই ভাষা তোমাকেও শিখতে হবে। দেবদাসীরা, ওখানে গিয়ে দেখবে–জুমপাহাড়ীতে কথা বলছে। একটা অত্যন্ত নির্দোষ সহজ মিষ্টি ভাষা। ভয় নেই। আমি কোন দেবতাকে অপমান করার জন্য এই ভাষা তৈরি করিনি। বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে একটা মিশ্রভাষা গড়ে না নিয়ে উপায় ছিল না। চলো, যাওয়া যাক।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রিবিকা বলল–কোন অহংকার দেবতারা সহ্য করেন সারগন। নইলে সাত বছর মিশরে বৃষ্টিপাত নেই, জলোচ্ছ্বাস নেই–এমন কেন হবে! যারা ঘরে ঘরে নিস্তার-চিহ্ন, গুণচিহ্ন আঁকল, তারাই পুড়েছে। মহাত্মা ইহুদ, কোথায় রয়েছেন কেউ জানে না। আমি এই অরণ্যে বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করব। তোমার তৈরি ভাষায় কথা বলার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়। হায় দেবী! মাগো!

বলতে বলতে দু’হাতে চোখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল রিবিকা। সাদইদ পরম আশ্চর্য হল। কোন সৈনিক অথবা দেবদাসী কখনও এমন করেনি। সাদইদের কৃত্রিম ভাষায় কথা বলাতে তাদের কোনওই আপত্তি নেই। বিভিন্ন স্থান থেকে তারা এসেছে। তাদের নিজেদের গোষ্ঠীভাষা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সংযোগের ভাষা জুমপাহাড়ী। তারা বাধ্য এই কৃত্রিম মনুষ্য-উদ্ভাবিত ভাষায় কথা বলতে। কেন না সেখানে এমনও দু একজন রয়েছে, যারা ভাষাগত কারণেই একা হয়ে পড়ে। একটা লোক শুধু তার নিজের ভাষাটিই জানে, সে কী করবে!

ভাষার সমস্যা বিকট। একজন শ্বেতাঙ্গিনী মিশরী দেবদাসীর কাছে কনানী সেনা ভাষার কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গোলমাল বাধায়। আমারনার মেয়ে উর নগরীর প্রায় লুপ্ত ভাষা যখন একজন বলে, বুঝতে পারে না। ঈশ্বরের ভাষা না কি লুপ্ত হয় না। কিন্তু দামাস্কাসের কোন এক মরুজাতির এমন এক ভাষায় লোটা নামে একজন দুর্ধর্ষ সৈনিক আপন মনে কথা বলে যে, সাদইদ স্বয়ং হতবাক হয়ে শোনে বুঝতে পারে না। লোটার ভাষা জুমাপ্রদেশে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ভাষা। লোটা যদি কালই মরে যায়,জুমার চারপাশে সেই ভাষাটিও আর শোনা যাবে না। মরুভূমির জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রিতে চাঁদের দিকে চেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুবোধ্য ভাষায় সম্ভবত সে তার ভাগ্যকে অভিসম্পাত দেয়কী করুণ আর আদ্রব্যাকুল তার ভাষা! ভাষা দুর্বোধ্য, দুর্বোধ্যই নয়, অবোধ্য বলাই সঠিক, সে কাঁদে। মনে হয়, মানুষ নয়, অবলুপ্ত হওয়ার ভয়ে ভাষাটাই যেন কাঁদছে!

ভাষা দিয়ে ঈশ্বর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করলেন। নোটাকে দেখলে মর্মান্তিক ঘটনাটির সেই যে একমাত্র বিষণ্ণ সাক্ষী, সেকথা গুরুতর আঘাত হয়ে হৃদয়ে বাজতে থাকে। লোটার ভাষাই শুধু আলাদা এবং একলা নয়। তার পূজাবিধিও আলাদা। জুমাতে একমাত্র উট-উপাসক সে। ভাষা এবং পূজা যদি এত স্বতন্ত্র হয়–তার ভাগ্যে অপার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই বতায় না। অমিতসাহসী, বীর্যশালী এমন সৈনিক হয় না। সে মরে গেলে সাদইদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

সাদইদ সকরুণ চোখে রিবিকার দিকে চাইল। তারপর একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লোটাকে সবাই খাটো চোখে দেখে। কবে সেই বাবিলের জিগুরাত, দর্পিত স্বর্গ মাটিতে ভেঙে পড়ল, কোন সেই অতীতের কথা। কিন্তু ভাষার ভিতর রইল তার শাপলাগা স্মৃতি। ঈশ্বর যেখানে একবার নাক গলাবেন, যুগ যুগ ধরে তারই প্রহার চলতে থাকবে।

দেবদাসী নিশিমা খুব দাম্ভিক মেয়ে। দরজার বাইরে লোটাকে ঠেলে ফেলে দিলে, শালা উটমুখো, বেদে! ভাষার মা বাপ নেই। আমার ইয়ে-ধোয়া জল খাস রে সালেহর বাচ্চা! ওরে গামছাবালা সারগনের ছাঁ–লিয়ে যা, মড়াটাকে পিরামিডের খাঁচায় শুইয়ে দে আয়। ওরে গামছাবালা! ভাতারের শালীর পো, আয় দুদু খা আর গা মোছা আমার! পিদিম জ্বেলে দ্যাখ মড়াটা দুয়োর আগলে ভনভন করে যাচ্ছে রে! কী ভাষার ছিরি! উটের খুরো, উটন্যাজা! শালা আমায় চাট মেরেছে রে! ফেলে দে বালির উপর।

এই তীব্র অপমান কোন সৈনিকই হজম করতে পারে না! তার মজ্জা থেতলে গেছে যেন। শরীরে ভাষার বিষ ঢুকে গেছে। সে পলাতক সেনা। ঘর হারানো, শ্রীপুত্রকন্যাহারা এক দলিত ক্ৰী দাস। আরাবা মরুর কোন্ দিগন্তে তার ভাষাগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে। সে এ। এবং এ কারণে এত গোঁড়া যে, সে তার ভাষা এবং উট-উপাসনা কোনটি ছাড়তে রাজি নয়। সে সেই রাতে গামছাবালাদের দ্বারা প্রহৃত হয়ে সাইদের কাছে ছুটে এল। ইচ্ছে করলে সমস্ত মন্দির সে একাই রক্তাক্ত করে পিষে দিতে পারত। কিন্তু তাতে সমস্যা মিটত না। কামনাতাড়িত, নারীসঙ্গহারা, অপমানিত লোটা সাদইদের সামনে গুহার ভিতর নিজেকে একটি পাথরের উপর আছড়ে ফেলল।

নিকষ পাষাণের মত বলিষ্ঠ অন্ধকারসদৃশ ঘর্মাক্ত পিঠে আলো পড়েছে। এই ক্ষুদ্র পাহাড়টির অধীশ্বর সাদইদ। চর্বির মশালের আলো পাহাড়ের অভ্যন্তর উদ্ভাসিত করেছে আলো-ছায়ায়। পাহাড়টির একটি অংশ মন্দিরের মত করে কেটে কেটে বানানো হয়েছে সাদইদের গৃহ। পাহাড়ের চুড়োটা দূর থেকে দেখতে পিরামিডের মত স্পর্ধিত। পাহাড়কে ঘিরে তাঁবুর সংসার এবং কিছু কিছু ইটপাথরে তৈরি দেবদাসী মন্দির আর আছে দ্রাক্ষাকৃঞ্জ। এ অঞ্চল নগরও নয়, গ্রামও নয়।

তাঁবুতে পুরুষরা থাকে। মন্দিরে থাকে দেবদাসী। সৈনিকদের জন্য এ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা জরুরি নয়। রাজা হিতেন আসলে সৈন্যাবাস এবং দুর্গ। স্থাপনের জন্য সাদইদকে ওই পাহাড় এবং দ্রাক্ষাকুঞ্জ দান করেছেন। যে-কোন সময় কেড়ে নিতে পারেন। পলাতক সৈন্যরা তাঁবুর তলায় থাকে, মন্দিরে রাত্রিবাস করে। বস্তুত এদের কোন সংসার নেই। সাদইদ এদের জন্য কখনও কোন গ্রাম বা নগর নির্মাণ করতে পারবে না। এদের দিতে পারবে না সংসার করার সুখ। যদি কখনও নিনিভে নগরী ধ্বংস হয়, তখনই যুদ্ধ থামবে। সাদইদ মনে মনে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখে। সে এই সৈনিকদের আর দেবদাসীদের সঙ্গে করে কনান প্রদেশে একদিন ঢুকে যাবে।

তার প্রবর্তিত জুমপাহাড়ী ভাষা যুদ্ধকালীন ভাষা, ভয় হয় যুদ্ধ থামলে এই ভাষাটিরও মৃত্যু হবে। কিন্তু কানে ঢুকে যেতে পারলে ভাষাটি মরবে না। সৈনিদের মুখে এই ভাষা বাঁচবে, সৈনিকরা সংসার পেলে এবং দেবদাসীদের কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগ করতে পারলে জুমপাহাড়ী মানুষের ঐক্যের ভাষা হিসেবে টিকে যাবে। দেবদাসীর সন্তানরা সংখ্যায় কম নয়।

আলো এসে পড়ল পিঠের উপর। পাথরের উপর মুখ রেখে কুঁজো হয়ে পড়ে থাকা লোটা ফুঁপিয়ে উঠল। তার শরীর অপমানে থরথর করে কাঁপতে থাকল গমকে গমকে। এই বিচ্ছিন্ন মানুষটিকে যে কোথায় রাখবে সাদইদ,ভেবে পেল না। ধর্মে একা, ভাষায় একক। এই বিচ্ছিন্নতা কেন? লোটার কী ভবিষ্যৎ? মানুষের হৃদয়ে এর কোন আশ্রয় নেই কেন?

নোটার পিঠের ঘর্মাক্ত-পিছল আলো চকচক করছে। লোটা বলছে–আমার। কে আছে? বউ নেই, সন্তান নেই।

অস্পষ্টভাবে লোটার আর্তচাপা গোঙানির ভাষা বোঝার চেষ্টা করে সাদইদ। তার কেবলই মনে হয়, লোটা বলছে, কে আছে তার–তার বউ, তার সন্তান?

যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার কি কোন আক্রোশ পুঞ্জীভূত হয়েছে হৃদয়ে? হঠাৎ সাদইদের মনে হল, লোটা যেন বলছে–যুদ্ধই যখন জীবন, তবে যুদ্ধই আমার। নিয়তি, তিনি আমায় গ্রহণ করুন! কতকাল আমি নারী-সঙ্গ করিনি। মানুষ কি এভাবে বাঁচতে পারে? দেবদাসীর এত দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এই যুদ্ধ? আর আমি, আমার ধর্ম এবং ভাষাকে দেবদাসীর পায়ে উৎসর্গ করব? আমি ভুলে যাব আমার সর্বস্ব? আমি আমার স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছি, যে ধর্ম পালন করেছি, সব ত্যাগ করব একটি গণিকার কাছে? এমন পতিত অবস্থা কেন হল আমার?

সাদইদের কাছে লোটা এক সুতীব্র সমস্যা। লোটা তার কোন কিছুই ছাড়তে চায় না। জুমপাহাড়ী ভাষা সে মুখে উচ্চারণ করবে না। বোধহয় এই ভাষার অক্ষরগুলি নিয়ে তার আপত্তি আছে। কারণ অক্ষরগুলি ফিনিশীয় বর্ণমালা ছাড়া কিছু নয়, দু’একটি এদিক-ওদিকের মিশেল রয়েছে মাত্র। কিছু ইস্তারী চিহ্ন আর নকশা আছে, আছে মিশরীয় দু’একটি অপভ্রংশ। সব মিলিয়ে এ তার কাছে উৎকট মনে হয়েছে হয়ত। সে মনে করে তার নিজের ভাষা নিদোষ আর পবিত্র। দেবভাষা তার। সে কেন সেই ভাষা ত্যাগ করবে?

অতএব সীমাহারা নিঃসঙ্গতাই তার সঙ্গী! সবচেয়ে বড় সমস্যা তার ধর্ম। সৈন্যশিবিরে দেবতা আমন বা সামাশই যথেষ্ট অথবা দেবী ইস্তার কিংবা বালদেব। কারো মনে উঁকি দেয় ঈশ্বর যবহ। তারা মেষের মূর্তি কাছে রাখে। কিন্তু তাদের কেউ তেমন ঘৃণা করে না। কেবল নোটার বেলা যত বিপত্তি। সে

উটের বিগ্রহ সামনে রেখে বসে থাকে।

লোটার ধর্ম পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে, এই ভয়ে লোটা তীব্র এক বিষাদে রক্তাক্ত হয়েছে। তার একাকিত্ব যেন পিরামিডের চূড়ার মত অলৌকিক। লোটার জন্য দেবদাসী রিবিকা কি সুলভ্য হতে পারে না? নাকি এই নারীকে রাজা হিতেনের হারেমে উৎসর্গ করবে সাদই? হিতেনের হারেম সুন্দরীদের এক বিপুল সমাবেশ মাত্র। সেখানকার প্রহরীরা খোঁজা সম্প্রদায়। শোনা যায়, সেই হারেম সমকামী নারীতে পরিপূর্ণ। সমকামী নারীদের রতিমোচনের প্রদর্শনী রাজা হিতেনের প্রসিদ্ধ বিলাস। রাজা হিতেন কাম ও রতির দেবতা হবার বাসনা করেন। তিনি নাকি আপন শরীরে রতি আর কামকে একত্র ধারণ করার কথা ভাবেন।

একদিকে লোটা, অন্যদিকে হিতেনকার জন্য রিবিকাকে সাদইদ নির্বাচন করবে?

বেদনাপূর্ণ দৃষ্টিতে সাদইদ রিবিকাকে দেখতে থাকে। সাদইদের এই দৃষ্টিপাত, চোখের ভাষাবিভঙ্গ, চাহনির কারুণ্য কোন প্রকারেই উপলব্ধি করতে পারে না রিবিকা।

সাদইদ সহসা রিবিকাকে অশ্বপৃষ্ঠে তুলে নিয়ে কেমন এক ক্ষিপ্ত আক্রোশে দুবার বেগে মরুভূমির বুকে অশ্ব ছুটিয়ে দেয়। হতচকিত বিহ্বল হয়ে পড়ে রিবিকা। সাদইদ আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে–একটি প্রজাপতি জীবনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। কিছুতেই নয়। মহাপিতা নোহ, তুমি আমাকে এভাবে বিভ্রান্ত করছ কেন? আমি কোন বীজ অথবা কোন জীবকাররা সুরক্ষা জানি না। আমি ত্রাতা নই। জীবনের অর্থ এই মরুভূমির বুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। এখানে যুদ্ধ আর নারীর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছু নেই। সুন্দরী নিনিভে, তার আলো, রক্তে তোলপাড় করে। কেন এভাবে ছুটছি আমি? কোথায় চলেছি? আমার ফুলের আর আতরের বাজার। অথচ পশম সংগ্রহের সামর্থ্য নেই। কেন আমি স্বপ্ন দেখি তবে? কেন দেখি? মেয়েটি আমাকে সারগন বলেছে, অথচ আমি তো সামান্য ভাড়াটে সৈনিক। মরুভূমির লুটের রসদ জোগাড় করা আমার কাজ। আমার দৃষ্টি কেন তুচ্ছ রঙিন দু’টি পতঙ্গের উপর নিবদ্ধ হয়? কী আছে হৃদয়ের ভিতর? পিরামিডের চেয়ে, বাবিলের জিগুরাতের চেয়ে হৃদয় কি বিস্ময়কর?

তার দিয়ে ঘেরা এবং ইট দিয়ে কোমর পর্যন্ত খাড়া করা প্রাচীরের আড়ালে শবির। তারগুলি তেমন মিহি নয়, ধাতু ঘষে ঘষে সরু করা। অসুররা অনেক সময় শিবির আক্রমণ করে তাবৎ সৈন্যবাহিনী মুহূর্তে নিঃশেষ করে দেয়। বশেষত ভাড়াটে সৈনিকদের উপর অসুরদের ক্রোধ সীমাহীন। তাই গাছপালা ঘেরা, ইটের প্রাচীর এবং প্রাচীরের উপর ধাতুর মোটা তারের বেড়া, বস্তুত শিক দিয়ে বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে বানানো বেড়া–সহসা আক্রান্ত হলে সৈন্যরা পালিয়ে যাওয়ার কিছুটা সময় পায়। হৃদয়ের কথা ভাবতে ভাবতে শিবিরের দিকে মুহূর্তে চোখ চলে যায় সাইদের। অশ্ব তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ শিবিরে ঢুকে পড়ল।

গাছপালার ভিতর কতকগুলি তাঁবুর ছাউনি ছাড়া অন্য কোন গৃহ নেই। অশ নিয়ে প্রাচীরের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। অত্যন্ত ছোট একটি শিঙা, যা তার গলায় ঝোলে, সেটি ফুকে উঠল সে। সেই শব্দে একটি তাঁবু থেকে প্রথমে একজন, পরে অন্যান্য তাঁবু থেকে দু’একজন বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। শিঙার সুরের ভিতর কোন ব্যস্ততার সুর ছিল না, খুব শান্ত স্বরে ডাকা–তাই তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসা সৈনিকদের চোখে-মুখে তেমন কোন উদ্বেগের চিহ্নই দেখা যায় না।

সাদইদ রিবিকার সমস্ত মুখমণ্ডল এবং শরীর কাপড়খানির দ্বারা ঘোমটার মত করে তুলে ঢেকে দিয়ে বলল–তুমি চুপ করে থেকো, কথা বলবে না।

রিবিকা বুঝল, সাদইদ তাকে গোপন করতে চাইছে। তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবার পর কী মনে করে সাদইদ পথ থেকে এদিকেই ফের ছুটে এল । একটি তাঁবুর থেকে একজন মাত্র সৈনিকই তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জুম পাহাড়ের দিকে অশ্ব ধেয়ে যেতে গিয়ে ফিরে এসেছে সাদইদ। এখানে রয়েছে আটাশজন নব্য সৈনিক–এরা পালিয়ে এসেছে বিভিন্ন নগরী থেকে, দু’একজন জুটেছে মরুপথ থেকে। প্রত্যেকেই ছিল পদাতিক। এদের অশ্ব চালনার কোনওই অভিজ্ঞতা নেই।

সৈনিকটি কাছে এগিয়ে আসতেই সাদইদ বলল–একজনকে পথের উপর পাওয়া গেছে সমের মিঞা, তুমি সকলকে বলে দাও। আমি আহত এই বেচারিকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যাচ্ছি। এর চিকিৎসা দরকার। আমার ফিরতে কোন কারণে দেরি হলে লোটাকে পাঠিয়ে দেব। আর শোন, রাজা হিতেনের সঙ্গে দেখা করা জরুরি, আমি চলে যেতে পারি। অযথা কেউ যেন মরুযাত্রীদের আক্রমণ না করে। অসুররা মরুযাত্রীর বেশ ধরে যাচ্ছে, আসলে প্রত্যেকটা কাফেলাই এখন সন্দেহজনক–তারা মরুযাত্রী না-ও হতে পারে। সৈনিক হতে পারে। না বুঝে আক্রমণ করতে গিয়ে, ফল উল্টো হতে পারে। তোমরা নতুন, শিবির ধ্বংস করে চলে যাবে অসুররা। সাবধানে থাকবে।

সৈনিকটা মাথা নেড়ে সাদইদের কথায় সায় দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, সহসা সাদইদ বলে উঠল–মনে রেখো সমেরু, একজন সৈনিক আমার কাছে আমার এই সাদা ঘোড়াটার মতই দামী। অযথা কোন প্রাণের বাজে খরচ পিতা নোহ পছন্দ করেন না। রাজা হিতেনের কাছে একশ’টি সুন্দরী দেবদাসীর মূল্য যরকম, আমার কাছে ক্ষুদ্র একজন সৈন্য তারও চেয়ে শতগুণ মূল্যবান। আমি তোমাদের শপথ করে বলতে পারি, কখনও যদি একটি গ্রামও আমি অধিকার রুরি, তোমাদের মত সৈনিকদের আমি সেখানে সংসার গড়বার ব্যবস্থা করব।

সাদইদের কথায় পিছনে ফিরে দাঁড়িয়েছিল সমেরু। স্মিত হেসে বলল–প্রাণে বাঁচলে তবে তো সংসার! একখানা তাঁবু, দু’মুঠো খাদ্য আর আমার মা। আমি আর কিছুই চাই না মহামতি। একটা নদীর ধারে ছোট একখানা তাঁবু ফেলবার অধিকার আর মাকে ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখি। আপনি আমার জন্য তাই করুন। আমি কোন দেবদাসীর মন্দিরে যেতে চাই নে। মহাত্মা উঁহুদের ধর্মই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তিনি মানুষের পাপ আর পুণ্যের সীমানা নর্ধারণ করতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে, জুম পাহাড়ের ওদিকে তাঁকে কোথাও আমি দেখেছি। আমার বাঁচালতা ক্ষমা করবেন, আমি ছেলেমানুষ, মামার বিয়ে হয়নি, মা-ই আমার চোখে একমাত্র সবচেয়ে সার্থক নারী, আমি সেই মাকে হারিয়েছি, আমার আর চাইবার কিছু নেই।

কথা শেষ করেই সমেরু দ্রুত পায়ে তাঁবুর দিকে ছুটে গেল।

সমেরু নামে এই কিশোরটির মুখমণ্ডল অত্যন্ত নরম। হাত-পা সুন্দরী দেবদাসীদের মত অতিমাত্রায় কোমল। গোঁফের রেখা অবধি ঠিকমতন ওঠেনি। চোখ দুটি এত মায়াবী যে,মরূদ্যানের স্বচ্ছ জল যেন ভরে আছে বলে মনে হয়, শান্ত সেই চোখে স্থির তার হৃদয়, যেন ছায়ায় মোড়ানো একটি হ্রদ। সে তার মা ছাড়া অন্য কোন নারীর কথা চিন্তা করতে চায় না।

যুদ্ধেরও একটি অলিখিত, লিপিহীন পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে হয়েছে নাইদকে–কিন্তু সেই পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় আজ একটি অভূতপূর্ব তথ্য সন্নিবেশিত হল। মা-ই একমাত্র নারী। সমেরু জোরের সঙ্গে বলল, মহাত্মা ইহুদের ধর্মই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তিনি পাপ আর পুণ্যের সীমানা নির্ধারণ করেন। কথাটা শুনেই মনে হল, ছেলেটি এই বাক্যটি মুখস্থ করেছে। নারী সম্পর্কে তার বক্তব্যও অজি। মা ছাড়া আর যেন কোন নারীই হয় না। সে তার মাকে নিয়ে নদীর ধারের তাঁবুতে বাস করতে চায়। সে দেবদাসীর মন্দিরকে ভয় পায় বলে মনে চল। ভাবতে ভাবতে সাদইদের এক তীব্র কৌতূহল হতে থাকল।

অশটি মন্থর বেগে অগ্রসর হচ্ছিল। মাথার কাপড় নামিয়ে ফেলে রিবিকা বলল–আমি পারলাম না! হায় দেবী!

–কী পারলে না রিবিকা!

–ওই ছেলেটাকে মুখের পর্দা সরিয়ে কেন দেখলাম না! ও নিশ্চয়ই মহাত্মা ইহুদকে দেখেছে! আমি প্রশ্ন করতে পারতাম! তাছাড়া ওর মুখটা আমার চিনে রাখা উচিত ছিল। যে কিশোর মা ছাড়া কিছু জানে না, তাকে কেন আপনি নষ্ট করছেন সারগন! দোহাই! আপনি ওকে রক্ষা করুন!

রিবিকা আর্তস্বরে ককিয়ে উঠল। সাদইদ লক্ষ্য করছিল, প্রথমাবধি এই মেয়েটি তাকে ‘আপনি-তুমি’ করছে, যখন যা মুখে আসছে। কখনও তাকে ভাবছে সামান্য সৈনিক, কখনও ভাবছে মহামতি সারগন। মাথারও কিছু ‘বেগড়বাঁই’ আছে সন্দেহ নেই। সহসা একটা কিসের ঝোঁকে বেমক্কা সাদইদ ঈষৎ আক্রমণাত্মক ঢঙে পেশ করল–সমেরুকে তোমার পছন্দ হয়? ওকে তুমি চাও বুঝি? চোখে দেখলে তোমার শরীরে তেষ্টা পেত নিশ্চয়ই। ঠিক আছে, একদিন দেখা হবে অবশ্য।

–না! না! ভয়ে কেমন আর্ত চাপাস্বর ফুটে ওঠে রিবিকার গলায়।

–না কেন! ও-ও তো সৈন্যমাত্র। কেবল তুমি তোমার মন্দিরটা পরিচ্ছন্ন রাখবে। দ্যাখো, ও হল জোয়ান ছেলে, দেহে প্রচণ্ড জোর–ওকে সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে আমি তৈরি করব । ও যেভাবে মা মা করছে, সেটা পাগলামি! ওকে যদি আমি একটি মাত্র রূপের কথা বলি–যেমন ধরো, নারীর বুকের চন্দ্রোদয় সে দেখেনি, সেটা যদি বলি–কেমন হতে পারে! ভেবে দ্যাখো, দুটি প্রজাপতি তোমাকে অধিকার করেছিল! কেন করেছিল! পতঙ্গ নির্বোধ বটে, কিন্তু ফুল ছাড়া সে বসে না । পতঙ্গ মানে এই দুটি প্রজাপতির কথা আমি বলছি। তারা ফুল ছাড়া বসে না। অথচ তারা তোমায় অধিকার করেছিল। মা সুন্দর। কিন্তু এই দৃশ্যটা নিশ্চয়ই তার জানা নেই। বলা দরকার, জীবনে আরো কিছু আছে, জানতে হলে তোমার মত দেবদাসীর কাছেই যেতে হয়।

অশ্ব কিছুটা গতি বাড়িয়েছে। টিপে টিপে ঠোঁটের তলায় একটি একটি শব্দ উচ্চারণ করে চলেছিল সাদইদ। কথা না কি মন্ত্র বোঝা যায় না। লোকটা কবি সন্দেহ নেই। তবে ভয়ানক যোদ্ধা এবং গভীর চিন্তানায়কও বটে। তার অভিসন্ধিরও সীমা নেই।

সহসা সাদইদ বলে ফেলল–তোমার রূপের আড়ালে খুব উত্তেজক সুরা আছে আমনের বউ। সেটা ছেলেটাকে ধরাতে হবে। নইলে ছেলেটা ফের কোথাও ভেগে যেতে পারে।

শুনতে শুনতে সভয়ে শিউরে উঠল রিবিকা। সমেরু এক অদ্ভুত কিশোর নিশ্চয়। কণ্ঠস্বর পাখির মতন সুরেলা। তাকে সে দেখেনি। সারগন তাকে ঢেকে রেখেছিল। অবশ্যই তাকে নিয়ে এই অশ্বারোহী সৈনিকটির নানান মতলব মাথায় আসছে । পতঙ্গ-অধিকৃত নারী যদি সমেরুকে নষ্ট করবার জন্য ব্যবহৃত হয়–তবে এই সৈনিকটির কবিত্ব সর্বনাশা। এই লোকটি নিশ্চয়ই তার কবিত্বকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করে–একে বিশ্বাস করা পাপ। ভাবতে ভাবতে দম পায় না রিবিকা।

রিবিকা এইরূপ ভাবছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধের কতকগুলি নিজস্ব নীতি আছে। মানুষের জমি দখলের দাঙ্গাগুলি একরোখা ঘটনা, সেখানে কোন উচ্চাশা থাকে না। এ অবধি মানুষের মনে পাপ জন্মায় না। বাঁচার জন্য মানুষ হয় হানাদার। কিন্তু যুদ্ধ অন্য জিনিস। মানুষ যখন থেকে নগর গড়তে শিখল, তখন থেকে। হানাহানি মাত্রই যুদ্ধ নয় বোঝা গেল। গ্রাম এবং অন্য নগরীগুলিকে শুষে শুষে এনে একটি উপত্যকাকে সাজিয়ে ভোলা, যেন একটি শোভিত স্বপ্ন, তার খিলান, গম্বুজ, সিঁড়ি ও প্রাচীর-দম্ভ আর ঔদ্ধত্যের ভাস্কর্য, তিনতলা সাঁজোয়া গাড়িটি মানুষের শস্ত্র আর ক্রীতদাসে পূর্ণ হয়ে মরুপথ যখন অতিক্রম করে তখনই বোঝা যায় যুদ্ধ হল মানুষের সর্বাত্মক বিভীষিকা।

সামান্য একজন দেবদাসী নীল নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে কতদিন একথা ভেবেছে। আজ সে জীবনের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ভিতর প্রবেশ করছিল। জীবনে সে কখনও বা চকিতে অনুভব করার চেষ্টা করেছে যে নারীর বক্ষাকাশে এক নিবিড় চন্দ্রোদয় হয়, আবীরুদ তার কবিতায় একদা একথা বলেছিল, সে কথায় রোমাঞ্চ ছিল–কিন্তু প্রজাপতি যখন তাকে অধিকার করল, পৃথিবীর সকল মসীহ এবং আকাশের দেবতাদের সমূহ প্রার্থনা যেন তখন তারই জন্য। কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এ বিস্ময় শেষ হতে না হতেই সাদইদ তাকে বলেছে, তার রূপের আড়ালে রয়েছে মদ। এ সৌন্দর্য যুদ্ধেরই উদ্দীপনা মাত্র। বহুদর্শী এ জীবন তার। অভিজ্ঞতাও নানা-বিভঙ্গিত। আক্কাদের হাতের আঙুল ছিল মোটা, মেটে সাপের মত। সাদইদের আঙুল পুষ্পকলিকার ন্যায়, কিন্তু সে আঙুল নখরে। শাণিত একথা বিস্মৃত হলে চলে না।

সাদইদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–একজন এহেন কিশোরকে সৈন্যরা উত্ত্যক্ত করে। কী বলব তোমায় রিবিকা। মেয়েছেলে সস্তা হলেও, যুদ্ধের নিয়ম হল, সৈনিকের কাছে তাদের একটু আক্ৰা করে রাখতে হয়। যত দেবদাসী দরকার আমার মন্দিরে,ততটা সরবরাহ নেই। হিতেন বলেন, একটু কম করেই রাখো। ফলে হয়েছে কি, একটা মন্দিরেই দশজন সৈনিকের লাইন পড়ে যায়। ফের প্রধান সৈন্যদের আলাদা ব্যবস্থা-জনপ্রতি একজন দেবদাসী দিতে হয়। ভেবে দ্যাখো, কী অবস্থা! একখানা মন্দির, একজন দেবদাসী আর একজনই সেনাপতি। সমস্ত ব্যাপারেই অভাব তৈরি হয়। মেয়েছেলে সস্তা কিন্তু দেবদাসী আক্রা–এই কৃত্রিম অভাব বজায় না থাকলে যুদ্ধ থেমে যাবে। এর একটা কুফল হচ্ছে, সমেরুর মত কিশোরদের সৈন্যরা খোবলাবে। পুরুষ যখন পুরুষকে প্রেম নিবেদন করছে, জানবে সেটা সমকামী শিবির।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অশ্বের গতিবেগ আরো কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দিয়ে সাদইদ বলল–আমি সৈন্যদের শেখাই। না–কোন ধর্মপুরাণ পাঠ করতে শেখাই না। শেখাই শস্ত্র ক্ষেপণ করা। অশ্ব চালনা। অর্থের পিঠে চড়ে ছুটতে ছুটতে বশ ছুঁড়ে লক্ষ্য ভেদ করা। লক্ষ্য করেছি, সমেক দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকলে কোন কোন সেনা লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়। আমি আজ তিনদিন এই সবই করেছি। তোমাকে এসব কথা শোনাতে আমার ভালই লাগছে–কেননা তুমি মিশরী দেবদাসী।

.

আবার থামল সাদইদ। তারপর বলল–সমেরু সামনে থাকলে নষ্টমজ্জার সেপাই দৃষ্টি-বিভ্রান্ত হয়ে কাত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। তখন অন্যরা হো হো করে হাসে। এটাও এক ধরনের উদ্দীপনা এবং শিক্ষাও বটে। সমেরু সামনে থাকলেও লক্ষ্যভেদ করতে হবে–যাতে চাঁদমারী বিদ্ধ হয়। ভয় হচ্ছে সমেরুকে না সৈন্যরা নিজেদের ভিতর লুফালুফি করে মেরে ফেলে!

ফের অশ্বের গতি সামান্য পড়ে এল। এমনকি হঠাৎ থেমেই পড়ল সাদইদ। সমেরুর দুর্ভাগ্যের কথা রিবিকা বিমূঢ় হয়ে শুনছিল। এই বিবরণ বিশ্বাস করতে তার বুক কেঁপে যাচ্ছিল। সমেরু তবে শিবির ছেড়ে পালাতে চাইবে না কেন? যুদ্ধের এই নির্লজ্জতা ক্ষমাহীন। একজন রূপবান নিদোষ কিশোর-রিবিকা তাকে কল্পনার চোখে দেখতে থাকে। সৈন্যরা তাকে কামনা করে পরস্পরের মধ্যে কামড়াকামড়ি বাধিয়েছে–এ দৃশ্য রিবিকার কল্পনায় আসতে চায় না। সমেরু সামনে আছে বলে সৈন্যের বর্শা লক্ষ্যবিন্দু বিদ্ধ করতে পারছে না। ছেলেটা তবে কী করে বাঁচবে! মনে হল, সমেরু তার চেয়েও হতভাগ্য, যে তার মা ছাড়া অন্য কারুকে জানে না। কোন কিশোরের মনের এমন সরল স্বপ্নকে নষ্ট করছে মানুষ, এই অশ্বচালক কবি হয়েও কী করে সইছে এইসব! এ বান্দার পতন অনিবার্য! মনে পড়ল ইহুদ কতদিন সদোম আর ঘোমরা শহর দুটির ধ্বংসের কথা বলেছেন! লোট, লোটের বউ, জিব্রিল আর আব্রাহামের কাহিনী।

উক্ত নগর দু’টি সমকামিতায় ভরে গিয়েছিল। যবহ জিব্রিলকে নগর দু’টিকে ধ্বংস করার জন্য পাঠালেন। পিতা আব্রাহামের সঙ্গে সীনয় পাহাড়ে তাঁর বন্ধু ঈশ্বর যবহের কথা হত। যবহ বললেন,–ওহে আব্রাহাম, শোন আমার বাতাবাহক (পয়গম্বর)! আমার গায়েবী আওয়াজ শোন! অদৃশ্য বার্তা শোন! আমি নগর দুটি ধ্বংস করব! ওখানে আর কোন ভাল মানুষ অবশিষ্ট নেই।

আব্রাহম বললেন–না বন্ধু যবহ! আমার ঈশ্বর! আপনি একবার অন্তত পরীক্ষা করে দেখুন, সেখানে অন্তত ৫০ জন ভাল মানুষ পাওয়া যাবে। লোট আমার বন্ধু–সে অত্যন্ত ভাল লোক। আরো ভাল লোক আছে। আমি বিশ্বাস করি না সমস্ত মানুষ খারাপ হয়ে গিয়েছে।

জিব্রিল একদিন অতঃপর আব্রাহামকে সঙ্গে করে লোটের বাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করলেন। তখন নগরীর লোকেরা লোটের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা জিব্রিল এবং আব্রাহামকে সমকামী সন্দেহ করে–ভাবে এরা দুজন অপূর্ব মানুষ! লোট নগরবাসীদের বোঝাতে পারে না এই দুজন সমকামী নয়–এরা আলাদা। জিব্রিল খেপে গিয়ে নগরের লোকেদের অন্ধ করে দেন। লোট পরিবারকে খিড়কি পথে নিষ্ক্রান্ত করেন জিব্রিল। আব্রাহাম অতঃপর লোট এবং লোটের বউকে সঙ্গে করে পাহাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করেন।

জিব্রিল বলেন, তোমরা কেউ পিছনে ফিরে চাইবে না। শাপ লাগবে। পালাও। পালাও।

হঠাৎ তীব্র এক আওয়াজ হয় পিছনের দিকে। লোটের স্ত্রী ভুল করে পিছনে চেয়ে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নুনের অনড় মূর্তিতে পরিণত হন। সীনয় পাহাড়ের আগুন থেকে গন্ধক বৃষ্টি শুরু হয়। ঈশ্বর লোটের বউকে অবধি গ্রাস করেন। বউ পিছনে চেয়ে দেখে ভুল করেন–এত পাপগ্রস্ত নগরীর দিকে দৃকপাত করাও ভয়াবহ। ইহুদ বলেছেন, সমকামিতা কোন বিদ্যা নয়। কলাও নয়। পাপ। নগর নির্মাণ করা স্পর্ধা মাত্র।

রিবিকা ভাবল, ইহুদের প্রতিটি কথা সত্য। তিনি স্বয়ং সত্য। সমেরু তাকে দেখেছে।

–সমেরুর সঙ্গে আমার দেখা হবে বললে! ও নিশ্চয়ই মহাত্মার ঠিকানা জানে! জিজ্ঞাসা করে রিবিকা।

ঘোড়া থেমে পড়েছে। সামনের দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে সাদইদ। সদ্য হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে পথের উপর। একটি সুদীর্ঘ উদ্বাস্তু প্রবাহ উল্টো দিকে চলেছিল বলে মনে হচ্ছে। আসিরিয়ার দিক থেকে যাচ্ছিল সিদন টায়ার মাগিদ্য উপদ্বীপগুলির দিকে–সবই রাস্তায় খতম হয়ে গিয়েছে। এ প্রবাহ নতুনই শুরু হয়েছে। ক্রমশ নিনিভের পতন আসন্ন হয়ে উঠছে । নিনিভের উপর চারিদিকের আক্রমণ শুরু হয়েছে।

ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে সাদইদ। ঘোড়াটি রিবিকাকে পিঠে করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এমন দৃশ্য অশ্বটির কত চেনা। দেবদাসীকে যেভাবে মানুষ চারিদিক থেকে খোবলায়, রূপসী নগরীকেও সেই ধারা ঠুকরে চলে। যারা খতম হল, তারা সবাই ভাস্কর আর মিস্ত্রী। দুঃখ হয় এরাই নিনিভের নির্মাতা। যারা গড়ে তুলেছিল, তাদেরই আজ কোন আশ্রয় নেই। ওদের অস্ত্র হল নানা ধরনের চিকণ কাজের হাতিয়ার। থলেয় মুখ আঁটা অবস্থায় তাদেরই মৃতদেহের পাশে পড়ে রয়েছে।

সবাই মৃত। বোঝা যায় অসুররা মারেনি। সাদইদের মতই কোন ভাড়াটে দল মেরে গিয়েছে। এরা বেঁচে থাকলে আরো কত নগর নির্মাণ করতে পারত। হঠাৎ মৃত্যুস্তূপের ভিতর একটি শিশুর কান্না উচ্চকিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *