মরুস্বর্গ – ৮

০৮.

দ্বিতীয় পর্ব

তারপর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে মধুদুগ্ধের দেশে। রিবিকার সঙ্গে সাদইদের দেখা হয়নি। সাদইদ তার জীবন শুরু করেছিল একটি বৃক্ষের মত। একটি ছোট গ্রামে নদীর তীরে ছোট কুটির বেঁধেছিল। চাষীর চোখে ছিল তার প্রতি ঘৃণা আর করুণা। পশুদল নিয়ে সে প্রবেশ করেছে, যাযাবর যেমন প্রবেশ করে। রাত্রির অন্ধকারে হানা দিয়েছিল যেন সে। চাষীরা তার পশুগুলি কেড়ে নিয়ে বলেছিল–যা ভাগ! এ লোক যুদ্ধ বাধাবার জন্য এসেছে নিশ্চয়। শোন ভাই, এখানে ওসব চলবে না।

মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চাষীদের সাদইদ বলল–পশুগুলি আমি তোমাদের জন্যই কষ্ট করে এনেছি। আমি যুদ্ধ-ফেরত একজন সাধারণ সৈনিক। চাষবাস জানিনে। এই সব গরু আমার কোনই কাজে লাগবে না। তোমরাই রাখো। তবে আমায় তাড়িয়ে দিও না। এ আমার বন্ধু হেরা। নিনিভের লোক। ওর বউ মড়কে মরেছে। শিশুপুত্র হারিয়ে গিয়েছে। বাচ্চাটিকে আমরা খুঁজছি। আমাদের আশ্রয় দাও। মহাত্মা ইহুদের কাছে আমাদের ছেলেটি রয়েছে, ওঁর এক মেয়ের কোলে আমরা তাকে দিয়েছি।

–কোন্ মেয়ে সেকথা বলবে তো! তাঁর কি মেয়ের শেষ আছে? অবিবাহিত ইহুদের চোখে মেয়ে মাত্রই হয় মা, নয় মেয়ে। অতএব সঠিক করে বলতে হবে কার বউ, কার কী, কোথায় থাকে–গ্রামের নাম–সবকিছু বলতে হবে! ইহুদ থাকেন পাহাড়ে–কোন্ পাহাড়ে তাও আমরা দেখিনি। কত শিশুই যে তাঁর দয়ায় বেঁচেছে! তিনি তো মহাপুরুষ! হলফ করে বলতে পারি ওই ছেলে নষ্ট হয়নি। মহাত্মা বহাল রাখেন, নষ্ট করেন না!

একজন মধ্যবয়স্ক চাষী গড়গড় করে বলে যেতে লাগল। একজন বৃদ্ধ তাকে সমর্থন করে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক! মড়কের মুখ থেকে তিনি রক্ষা করেন, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচান। রাজা হিতেনের অতবড় সৈন্যদল তাঁর লাঠির ইশারায় মাটিতে শুয়ে গিয়েছিল, আর ওঠেনি! রাজা মুখে রক্ত তুলে পথের ওপর পড়ে গেল। সেই যে পড়ল, আজও পড়ল, কালও পড়ল। বলি কি, ছেলে নিশ্চয় আছে, নষ্ট হয়নি।

মহীপাল নামে একজন সম্পন্ন কৃষকের গোয়ালে গরুগুলিকে লোকেরা বেঁধে দিল–ভেড়াগুলিকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর বলল–যাও, ঢুঁড়ে দ্যাখো!

এইভাবে মধুদুগ্ধের দেশ সাদইদ আর হেরাকে অভ্যর্থনা জানায়। হেরা ধৈর্য, রিয়ে বলে ওঠে–শিশুকে আমি আর পাব না সাদ!

–পাবে। নিশ্চয় পাবে। অতবড় একটা নগরের স্থপতি তুমি। একদিনে সই নগরী গড়ে ওঠেনি। তুমি কত ধৈর্যে সেই রূপ তোয়ের করেছ। আগে কিটু ঠাঁই দরকার। তারপর শিশুকে খুঁজব আমরা।

–ঠাঁই তুমি কোথাও পাবে না! তখন সেদিন রাগ করেছিলে, এখন দেখলে তা যাযাবর ভাড়াটে সৈনিকের কোথাও জায়গা নেই। মড়কের নগরী থেকে সেছি বলে এই একটা ভাঙা কুঁড়ের কাছে ফেলে রেখে ওরা দিব্যি চলে গেল! লো ফিরে যাই।

–কোথায় যাব! জীবনভর এই একটা দেশের স্বপ্ন দেখেছি হেরা! সন্যদের বলতাম যদি কখনও একটা গ্রামের অধিকার পাই… থাক সে কথা। এলাম তো যাযাবরের মত। অথচ এ আমার নিজের জন্মস্থান। কেউ আমায় চনে না। আবার আমি মরুভূমিতে ফিরে যাবো! সেই তাঁবুর জীবন, সেই উটের গাম ধরে পথ চলা।

–তাহলে ইহুদের শরণাপন্ন হও। তার ধর্ম গ্রহণ করো।

–অসম্ভব!

–কেন?

–ইহুদের ধর্ম মরুভূমির ধর্ম! মাটি ছাড়া মূর্তি হয় না। ভেবে দ্যাখো!

–হ্যাঁ! সেকথা ঠিক।

–বালি মুঠো করলে মূর্তি তো হবে না!

–না।

–মরুভূমি একঘেয়ে। ধূসর। যতদূর চাও কোন ছবি নেই।

–নেই বটে।

–ইহুদের ধর্মের ঈশ্বর পাহাড়ে থাকেন। তাঁর কোন রূপ নেই। আছে কবল আগুন-ঝরা দুটি চোখ। চোখ দু’টিও দেখা যায় না। কল্পনা করা যায় ত্র। রূপ মানে তো মাটি। মানে গ্রাম + ছবি। ঠিক তোমায় বোঝাতে রছিনে।

–বুঝতে কিছুটা পারা যে না যায়, তা নয়। তবে সেই ইহুদই জিতে গছেন। মূর্তিহীন ঈশ্বরই সব দখল করেছেন–এখন তুমি কী করবে!

–তবু রূপ যে খুব গুরুতর বিষয় হেরা! তা যে একটা প্রজাপতি!

–তোমার কথা আর বোঝা গেল না।

–আমিও ঠিক বুঝি না, বালিতে মূর্তি হয় না কেবল এটুকু তোমায় বলতে পারি। দ্যাখো, রূপ, আকৃতি, জ্যামিতি, একটা ছায়া–এসব আমার চাই। পরমায়ু যখন ফুরায় তখন একটা পিরামিড খাড়া হয়। পাহাড়ের গুহায় আঁক শিকার শিকারী–এ তো ছায়া। নিনিভের গায়ে আঁকা রাজা চলেছে মৃগয়ায়–রাজা থাকল কি গেল সেটা কথা নয়। ছায়াটাই আসল। রূপ তাছাড় কী? তুমি কেন আমার সঙ্গে এসেছ! নিনিভে নেই। কিন্তু তোমার হৃদয়ের ভিতর সেটা দেখতে পাও! পাও না?

–পাই।

–তবে? বল, এমন কেন হয়! আমি কেন দুটি প্রজাপতি আর লোটার করুণ মুখখানা ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনে। লোটা হিতেনকে বশবিদ্ধ করে মারে। এইজন্যই মারে যে,রাজা হিতেন তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে বধ করতে চেষ্টা করে। সেই সময় আকাশ ছেয়ে যায় ঈগল পাখিতে-পাখিরা মড়ব সংকেতকারী লাল ইঁদুর নখে ধরে উড়ে আসে, কারণ ইঁদুর তাদের খাদ্য। ভয়ে রাজা তার দলবল নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে–ছুটে চলেছে–এমন সময় লোট বশ ছোঁড়ে। এটা একটা অভিজ্ঞতা। তারপর লোটা পশুদল নিয়ে বালি ছেড়ে মাটির দিকে যাচ্ছিল। সে একটা ছবি হতে চাইছিল। আকাশে একটি যুদ্ধ চলছিল ঈগলে আর ইঁদুরে। নিচে ঘটছিল হিতেন আর লোটার যুদ্ধ। তাহলে বল, এখানে ইয়াহোর ইশারা কোথায় ছিল!

হেরা অনেকক্ষণ মুখ বুজে থেকে বলল–তোমার অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক কিন্তু কারো কাছে সেটা স্বাভাবিক না-ও হতে পারে। ক্রমাগত যুদ্ধ সমস্ত রূপ আকৃতি, ছবি, জ্যামিতি, তাঁবু, গৃহ সব–সমস্ত ভেঙে দেয়। তামাম কিছু অদৃশ করে দেয়। তাহলে অদৃশ্য একটা জগৎ আছে কোথাও। ইহুদ মনে করেন ইয়াহো সেই জগতে থাকেন। তোমাকেও ভেবে দেখতে হবে এসব কথা লোটা ছিল, লোটা নেই।

সাদইদ হেসে ফেলে বলল–এভাবে আমায় বোঝাতে পারবে না হেরা! য কিছু অদৃশ্য হয় তা মানুষ আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। সব ছবি । এবং তা আরো সুন্দর করে আনতে পারে। সব রূপ। সমস্ত।

–হ্যাঁ পারে! পারে বইকি!

বলতে বলতে দূরে কুটিরের আলোর দিকে চাইল হেরা। একটি বউ ছোট মশাল ধরিয়ে আলোর শিখার দিকে উপরে চোখ তুলে চেয়ে আছে। অন্যমনস্ক সুরে হেরা অতঃপর বলল–কিন্তু লোটা আর ফিরবে না!

–সে তো ইয়াহোর ইচ্ছে! সেই ইচ্ছেয় আমার আগ্রহ নেই। কারণ লোটাকে ফেরানোর ক্ষমতা আকাশের খোদারও নেই। রেগে যেও না স্থপতি! যা তিনি ফিরিয়ে দেন না নিয়ে ব্যাখ্যা চলতে পারে কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় অদৃশ্য জগৎটা অদৃশ্যই থেকে যায়–আলো পড়ে না সেখানে। সেই অন্ধকার আমি চাই না।

–রেগে তো তুমিই গেছ সাদইদ! তর্ক তুমিই করছ!

–তর্ক তো এক মুখে হয় না। যা আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি, সেই অদৃশ্য জগতের কথা তুললে! বরং একটি বীজ থেকে একটি গাছ কীভাবে উঠে আসছে, সেই পর্যবেক্ষণ অনেক সুন্দর। তোমার শিশুকে যেদিন নলখাগড়ার কাগজে তৈরি নৌকা, উপহার দিলাম–সেদিন সে হেসে উঠেছিল। আজও সেই হাসি দেখতে পাই। এর চেয়ে সুন্দর আর কী আছে! এই নৌকা আমার পিতা নোহ বানিয়েছিলেন। জীব এবং বীজের সুরক্ষার জন্য। আমি কাগজের নৌকা বানাতে বানাতে ভেবেছি আসল নৌকা জ্যামিতি মাত্র কাঠের বাহু ছোটবড় করে গাঁথা–এই বুদ্ধি নোহের ছিল।

হেরা বলল–কিন্তু এখন আমার সমস্ত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে সাদ। ভয়ংকর রাত। কড়িয়ে শীত পড়বে! বাঁচব তো? দাঁড়াবার মত মাটিও যে পাইনি!

একটু ভেবে হঠাৎ সাদইদ বলে উঠল–একটা উপায় হতে পারে হেরা! চলো ওই বউটার কাছে গিয়ে প্রার্থনা করি! যুদ্ধ নারীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষয় করে–কিন্তু চাষীর ঘর–দয়ামায়া থাকতে পারে! একখানা কাঁথা যদি দেয়, রাতটা তাহলে কোনরকমে কাটিয়ে দিতে পারব!

কাঁথা চাইতে গিয়ে আশ্চর্য ঘটনা হয়! বউটি ওদের দেখে স্তম্ভিত হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে মেঝেয় পড়ে থাকা কাঁথা জড়ানো এক বুড়িকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তোলে। বৃদ্ধা ঘুম জড়ানো চোখে সাদইদকে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়। এ যে সাদইদ! সারগন!

বোবা বুড়ি অদ্ভুত অব্যক্ত আহ্লাদে চাপা স্বর তোলে মুখে। বউ বুঝতে পারে লোক দুটি খারাপ নয়। বুড়ির চেনাজানা ঠাহর হচ্ছে। বুড়ি তার আঁচল খুলে কুমীরের প্রতীকগুলি দেখিয়ে অভিমানের সুরে জিভ ঠেলে ঠেলে একটা শব্দই কেবল বার করতে পারে বহু কষ্টে–লোটা! লোটা!

শিউরে ওঠে সাদইদ।

–তুমি চেন? প্রশ্ন করে হেরা!

অশ্রুরুদ্ধ স্বর চেপে বুড়ির মুখের কাছে মুখ নামিয়ে সাদইদ বলল–লোটা আসবে বুড়ি-মা! একদিন লোটা কি আসবে না! দ্যাখো, কেঁদো না!

কুমীর বুড়ি এ সংসারে কী করে এল? কপাল চাপড়াচ্ছে বোবা ভাষায় করাঘাত করতে করতে! মশালের আলো কাঁপছে! নদী থেকে বাতাস বহে আসছে! বাতাসে আঁশের গন্ধ! বোধহয় কোথাও মাছের জালও অন্ধকার উঠোনে টাঙানো আছে। নইলে গন্ধ এত স্পষ্ট হবে কেন! এ তবে চাষী পুরোপুরি নয়, জেলেও বটে। কুমীর সেই নদী অববাহিকার ত্রাস। দেবতা মাত্র।

কাঁথা ওরা পেল। ভাঙাকুটিরে ফিরে এল। সমস্ত রাত দাঁত কাঁপানো শীত। কাঁথা গায়ে দেওয়া দুটি সুন্দর বলিষ্ঠ গাভী সারারাত শীতে নাদলো আর প্রস্রাব করল ছড়ছড় শব্দে। একই ভাঙা কুটিরে বাঁধা থাকল দুজন মানুষ আর দুটি গরু।

ভোরের দৃশ্য আলাদা। বুড়ি ছুটে এল সাত সকালে। এসেই সে যেমন করে লোটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, ঠিক তেমনই ভালবাসায় সাদইদের গায়ে হাত বুলিয়ে চলল। সে যেন যুদ্ধের রক্ত মুছিয়ে দিচ্ছে। লোকে সবাই ভিড় করে এল। বুড়ির আহ্লাদ ধরে না। যুদ্ধের দ্বাত্মক রুদ্রতার আড়ালে বোবা এই বুড়ি পড়ে ছিল! এককোণে। যুদ্ধ তাকে কী করে যেন ধর্তব্যই ভাবেনি। অথচ সে ছিল। এই বউটি তার ছেলের বউ। তাদের সে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু তার থাকাটাই বিস্ময়কর!

হেরা বলল–তুমি বুড়িকে মিথ্যে কথা বললে কেন?

–বুড়ি শুনতে পায় না হেরা! ওর কাছে লোটার মৃত্যু নেই! আর এরকম একজন মানুষকে সবাই বিশ্বাস করে। ও না থাকলে জীবনটা শুরু করাই যেত না।

এইভাবে গ্রামে ঠাঁই পেল ওরা। কিন্তু শিশুর সন্ধান তারা পেল না। হেরা একদিন নির্জন দুপুরে ফুঁপিয়ে উঠল নদীর মৃদু কলোলিত স্রোতের দিকে চেয়ে। তার বুকের ভিতর রয়েছে অবলুপ্ত বিধ্বস্ত নগরীর স্মৃতি। সে প্রসিদ্ধ স্থপতি। কিন্তু আজ তার কোন কাজ নেই। গ্রামের কুঁড়েঘরে তাকে থাকতে হয়। অত্যন্ত নিম্নমানের পরিবেশ। স্যাঁতসেতে ঘর। কখনও বৃষ্টিতে মাটি ফুলে ওঠে জোঁকের মত। মরুভূমির তপ্ত হাওয়ায় সেই গৃহ হাহাকার করে কখনও বা। নদীর বন্যায় সেই কুটির তলিয়ে যায়। এখানকার চাষবাস অত্যন্ত পুরনো ধরনের। বীজ ছিটিয়ে তার উপর দিয়ে ছাগল ভেড়ার পাল দৌড় করানোর বুদ্ধিও জানে না–যাতে করে পশুর পায়ের দাপানিতে বীজ পুঁতে গিয়ে তোফা উদ্ভিদ দিতে পারে। কিছুই জানে না। এত খাদ্যাভাব এখানে। আকাশে মুখ তুলে হাহাকার করা আর রাতদিন ঢোল বাজিয়ে বালদেবের মন্দির মাত করা এদের কাজ। চারিদিক থেকে নানান জনপ্রবাহ এসে মিশেছে–কাউকে এরা খেদায় না। নানান দেশে পৌঁছনোর রাজপথগুলি এই দেশের বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে। রথ, অশ্ববাহী সেনা, পদাতিক ছুটাছুটি করেছে এই পথে। চাষী তা চেয়ে চেয়ে দেখেছে।

চোখের সামনে সৈন্যরা ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার খেলা খেলে চলে গেছে–চাষী মুখ বুজে থেকেছে। মিশরের দূতরা এসে লোভ দেখাতোযুদ্ধে চলো, প্রচুর উপহার দেব–মাতব্বর যদি হ্যাঁ করে মাথা নেড়ে দেয়,রাজা করে দেব। চাষী প্রলোভনে ভোলেনি। যুদ্ধ করা নয়, যুদ্ধ দেখা এদের রোমাঞ্চ। যুদ্ধ থামলে এরা বীরের গল্প ফাঁদে–আরে ভাই অমুক সারগনের কথা বোলো না–এমনি হাঁকলে ওই দেওদার তলায় দাঁড়িয়ে যে, লেডুর গর্ভবতী বউটা ছেলে বিইয়ে বসলে! লাও লেঠা!

বলেই বিবরণকতা মাড়ির দাঁত বার করে এমনি নিঃশব্দে হাসলে যে, সেই হাসিটা গাঁময় ছড়িয়ে গেল, যারা দেখেছে তারাও তো আকুল, হেসে অস্থির, যারা মাড়ির বর্ণনা শুনল তারাও নিরাকুল হাসিতে আকাট হয়ে রইল। তারপর দলে দলে শুঁটকি মাছের চাট দিয়ে আঙুর তাল খেজুরের চোলাই মেরে তামাম রাত দেবী ইস্তারের ভাসান শুনল। দেবী কী করে পাতালে যেতে যেতে ক্রমশ নগ্ন হয়ে যাচ্ছে, বস্ত্রহরণের সেই দৃশ্যে মেতে গেল গ্রাম। তখন নদীর জল ফেপে উঠে মরাই তলিয়ে মাটির গোলার তলা ফাঁক করে ডিহি ছুঁয়ে এসে ভাসান শ্রোতাদের পাছার কাপড় ভিজিয়ে দিলে। সবাই তখন চমকে লাফিয়ে উঠে বলল–ওরে বাপ। হায় দেবী–এ যে বান বটে গো!

এরা নদীতে বাঁধ দিতেও জানে না। নালা কেটে জলাশয় তৈরি জানে না। বান হলে পূজা দেয়। বজ্ৰ গজালে পূজা দেয়। মাটি শুকালে জিভ ফুড়ে একটা লগির সঙ্গে শেকল বেঁধে ঝোলে। বলে, লে মাতৃকা রক্ত খা! এ হল এদের দুর্ভিক্ষের শুখা মাটির মাদল বাজানো উৎসব। এই উৎসবে হঠাৎ জড়ো হওয়া কোন বহিরাগতকে দেখলেই হোতা ব্যক্তিটি শুধায়–মশাইয়ের যুদ্ধ জানা আছে নাকি! ভাড়াটে, না আসল! বহিরাগত মিটকি মিটকি হাসছে দেখে বললে–আচ্ছা নিবে নগরে একটা পাঁচিল ছিল শুনেছি। দেখতে কেমন ছিল মশাই! শুনেছি প্রস্থে আপনার কত গুণিতক কত হাত যেন পুরু। তা বেশ! শুনি সেই পাঁচিল নাকি ধ্বসে গেল তিনতলা সাঁজোয়ার ধাক্কায় । মিথ্যা বলব না। দু’ একখানা দেখেছি! এই রাস্তা ধরে গেছে…তিনতলা–সব চোলাই আর দেবদাসী ভর্তি হয়ে চলে গেল! দেখবেন, ঈষৎ রঙ লাগলে বলবেন, কথায় রঙ দেওয়া ঠিক নয়।

–না না। বলুন। বেশ বলছেন আপনি। পাঁচালী শুনেছি তো, তাও এত ভাল লাগে না।

উৎসাহিত দ্রাক্ষাবাগিচার মালী বলল–একথা শুনে ইহুদ বললেন, মেয়েলোক বাড়লে, দেবদাসী বাড়লে, বেশ্যা বাড়লে জানবে–এটা যুদ্ধের লক্ষণ! দ্যাখো আর নাই দ্যাখো, এটা যুদ্ধ। পুরুষ কমে যাচ্ছে, এটা যুদ্ধ! একথা মহাত্মার কাছে কোথায় শুনলাম শুনবেন! গত মাসে ওলাওঠা দেবীর থানে। না ভাই ঈষৎ ভুল হল। শুনলাম ভোমরাতলীর হাজারী থানে। ও গাঁয়ে কুমারী বলি হচ্ছে সেদিন। মহাত্মা এসে ঢাকের কাঠি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন কুমারী মেরে বৃষ্টি নামে না–ইয়াহোকে ডাকো! তা আমরা ইয়াহোকে ডাকি না এমন নয়। ডাকি। অবসর পেলে ডাকি! বাপঠাকুদ্দা কুমারী বলি দিয়েছে, চারটা দশটা বিয়ে করেছে–আমরাও করছি। পূজা করলে কি আর ইয়াহোকে ডাকা যায় না। খুব যায়। ধম্ম ঠাকুর জানে, এই দিগরে দশটা কুমারী বলি হলে হুড়মুড়িয়ে আকাশে মেঘ জমে যাবে। ফলে সবাই মহাত্মাকে মারতে তেড়ে গেল! ইহুদ আকাশে লাঠি উচিয়ে বললেন, আমি নোটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করেছি। আমি পারি! মেঘ জমবে। ওই দ্যাখ পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। আকাশের তলায় রুদ্র জিহ্বা নীল রঙ চাটছে। মেঘ জমবে। ইয়াহোকে ডাকো।

তারপর কী বলব ভাই, দুদিন যেতে না যেতেই আকাশ ফেড়ে ঢল নেমে গেল!

হেরা বলল–সবই শুনলাম। কিন্তু আমি নালা কেটে জল ধরে রাখার কথা বলছি। নিনিভের গ্রামগুলিতে এই প্রণালীর চাষাবাদ ছিল। জলকেও বাঁধা যায় মালী। পাথর ফেলে, তক্তা বসিয়ে বন্যা ঠেকানো যায়। এ তোমার ঢাকের কাঠির সঙ্গে হাতের লাঠির তজা নয়। সেটা শ্রম ঢালবার অন্য চেহারা। তা ওহে মালী, সেই কুমারী মেয়েটা তো বেঁচে আছে!

–আজ্ঞে আছে বইকি! যাবেন নাকি দেখতে! বাঁচার পর, মানে বলি তো হল না–সেই থেকে মেয়েটা বোবা হয়ে রয়েছে! দেখতে খুবই খাসা!

–আচ্ছা যাব! কোথায় থাকে!

–ওই আপনার উট-পাড়ায়!

–উট?

–আজ্ঞে!

ক্ষুব্ধ হেরা এই প্রথম কনানের মাটি খামচে তুলল হাতে। তৈরি করল একটি উটের মূর্তি। মরুভূমিতে পায়ে হেঁটে গিয়ে শুকিয়ে আনল। রঙ করল। সাদইদ ঘোড়া নিয়ে কোথায় চলে যায়, অনেক রাতে ফেরে না। উটের মূর্তি দেখে বলল–এটাও তো কাজ হেরা!

হেরা বলল–এটাই একমাত্র কাজ! এটা এক মূর্তিমান দেবতা। যে মেয়েটি বলি হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য উপহার। আমি ভাস্কর নই। কারিগর। অজস্র মূর্তি দিয়ে এই দেশকে ভরে দেব সাদইদ। ইট কাঠ পাথর মাটি–সকল বস্তুকে দেবতা করে না তুললে মূর্তিহীন ঈশ্বর ডরাই না। ইহুদ কোথায় আছে–দেখে নাও, এরপর আত্মপ্রকাশ করে কিনা! আমার শিশুকে আমিই বহাল রাখব, সে নয়! সে কে?…

সাদইদ বলল–আমার এখন কিছু মিস্ত্রী, কারিগর আর শিক্ষিত নালা প্রস্তুতকারক চাষীর দরকার। আমি বিধ্বস্ত নগরী থেকে তাদের তুলে আনতে চাই। বাড়তি ফসল–উদ্বৃত্ত ফসল না হলে তোমায় কাজ দেওয়া যাবে না। আমার চাই প্রচুর খাদ্য। পরিধান। পশম। আতর। সুম। ফুল। প্রচুর প্রজাপতি।

–আমার এই উট–এই যথেষ্ট এখন।

মালী এসে হেরাকে নিয়ে গেল কুমারী মেয়েটির কাছে। হেরা তাকে উট উপহার দিয়ে সম্ভোগ করল। মেয়েটি বাধা দিল না। সম্ভোগ শেষ হলে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে হেরা পাগলের মত ভাঙা ঘরটি ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে চলে এল পথে। মালী তাকে প্রচুর মদ খাইয়ে বলল–আপনি এবার কেঁদে হালকা হোন–আমরা জানি আপনার খুব কষ্ট ।

–কিছুই জানো না তুমি,আহাম্মক! আমাকে ঠকালে কেন? বলেই চড় মারতে গেল হেরা। পারল না। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। পড়ে রইল পথের উপর। মুখ ঘষড়াতে থাকল। বমি করল।

মালী বলল-শালা রসের নাগর। কুত্তা!

হেরা মদ খায়। মূর্তি তৈরি করে। দোকানপাটে সেই মূর্তি দিয়ে আসে। তার মন ভাল থাকে না। তার কষ্ট হয়, বুকের মধ্যে রয়েছে তার নিনিভে নগরী। তার পাগলামি কিন্তু সত্যিই ব্যর্থ হয় না। ইহুদ লক্ষ্য করেন, এইসব মূর্তি নিনিভের বাজারে পাওয়া যেত। দোকানপাটে সেই মূর্তি ছেয়ে গেছে। এই কারিগর কোথা থেকে এল! এ তো নাগরিক-বিদ্যার জিনিস!

লোক দিয়ে সাদইদকে ডেকে পাঠালেন ইহুদ–তোমার সঙ্গে কথা বলার তেমন কোন প্রবৃত্তি আমার নেই সাদইদ। তবু তোমায় ডেকে পাঠাতে হল!. বললেন ইহুদ।

সাদইদ বলল–আপনাকে আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি। আপনার সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়ার শেষ হয়নি। আমি কাজের লোক। ধর্ম আপনার জিনিস! কিন্তু সেই ধর্ম যেন সত্য কথা বলে আমি চাইব! লোটাকে আপনি মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়েছেন একথা সত্য নয়। লোটা বাঁচেনি।

–তাহলে তুমিই তাকে হত্যা করেছ।

কথার শুরুতেই পা থেকে বক্ষস্থল অবধি এবং দাঁড়া বরাবর একটা হিম স্রোত বহে গেল সাদইদের। উচ্চাসনে বসে দিব্যতা-মুগ্ধ চোখে কথা বলছেন শান্ত তীব্রখরে ইহুদ। সাদইদ বুঝতে পারল মূর্তিহীন ঈশ্বর তুচ্ছ নয়। তথাপি খানিক ইতস্তত করে সাদইদ বলল-লোটা মারা গিয়েছে, হত্যা তাকে কেউ করেনি। হেরা দেখেছে!

–হেরা তো একজন পাপী মানুষ সাদইদ। মূর্তি বানায়। তা সে বানাক। কিন্তু নাগরিক পাপ যেন কুমারী মেয়েকে না দংশায়। নিভাকে আমি বলির হাত থেকে বাঁচিয়েছি–তাকে সে উটের মূর্তি উপহার দিয়ে বলাৎকার করেছে। বোবা মেয়েকে ধর্ষণ করার শাস্তি কী হতে পারে বিধান দাও হিতেনের পোলা। কী হে ভিত্তি! নিভাকে ডেকে আনো! আমি সমস্ত আঙুল কর্তন করব না। খালি ডান হাতের বুড়া আঙুলটা কেটে দেব। নদীতে বাঁধ বাধলেই হয় না সাদইদ। বাঁধ বাঁধো চরিত্রে! অবশ্য তোমার আর আমার সত্যের ধারণা আলাদা। কিন্তু তোমার ধারণা অনুযায়ী হেরার মৃত্যুই অনিবার্য ছিল।

–এতবড় শাস্তি ওকে দেবেন না মহাত্মা ইহুদ!

–কেন দেব না?

সাদইদ কোন উত্তর দিতে পারল না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শিশু কোলে করে দাঁড়িয়ে ছিল রিবিকা,ইহুদের আসনের আড়ালে। লোটার মৃত্যুর কথা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার জানতে ইচ্ছে করছিল কোথায় কীভাবে লোটা মরেছে। তার চোখের সামনে বারবার লাফিয়ে উঠতে থাকল। দিগন্তাভিসারী এক কৃষ্ণ অষ। তার গলায় আজ আর কোন কান্না এল না। সে অপেক্ষা করেছে দিগন্তের দিকে চেয়ে। কেঁদেছে। কিন্তু কান্না এক সময় নিজেই থেমে গেছে।

আজ মাথা নিচু করে থাকা সাদইদকে দেখে তার অন্তর কেমন মুচড়ে উঠল। একজন সামান্য চাষীর পোশাক পরা এই কি সারগন! মহা অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ইহুদ সহসা কঠোর স্বরে বললেন–ঠিক আছে। দুটি শর্ত তোমায় পালন করতে হবে। প্রথমত হেরা আর মূর্তি বানাবে না। দ্বিতীয়ত নিভাকে সে বিবাহ করবে। যাও! ওহে কে আছে ওকে ওর শিশুকে দিয়ে দাও!

রিবিক এগিয়ে এল সামনে! সাদইদের বলতে ইচ্ছে করল–এই নারীকে আমি চাই মহাত্মা ইহুদ। এর সঙ্গে আমার পাপের সম্বন্ধ!

কিছুই কিন্তু বলতে পারল না সাদইদ। কেবল রিবিকার বিমর্ষ আর গভীর চোখ দুটির দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল–কেমন আছে প্রজাপতি!

রিবিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-জানি না সারগন!

–শোন সাদইদ। লোটাকে আমি বাঁচাইনি। ইয়াহো বাঁচিয়েছিলেন! তোমার কথাই ঠিক। লোটা যদি না ফেরে কখনও, তবু এই সত্য স্থির থাকবে!

বললেন ইহুদ।

রিবিকা বলল-যুদ্ধ থেমেছে। তবু যুদ্ধ থামেনি সারগন। ভয় পেও না!

কালো অষের পিঠে ওরা তিনজন। শিশু, নিভা আর সাদই। এ এক আশ্চর্য অশ্বারোহণ। চকিতে অন্য এক দৃশ্য ভেসে উঠল রিবিকার মনে। সাদা অশ্ব ছিল। সেটি। কিন্তু আজকের অশটি তো কৃষ্ণকায়। মুহূর্তে ম্লান হয়ে আসে চোখ।

ভয় পেও না। যুদ্ধ থামেনি সারগন! আজ সাদইদের মনে হল, লোটা নেই, তবু তার অশ্ব আছে যেমন, তেমনি যুদ্ধও ফুরোয়নি। একদিন যুদ্ধ থামবে মনে হলে জীবনে আর কিছু বুঝি নেই, মনে হত! আজ মনে হচ্ছে, সব আছে তার। কিছুই হারায়নি। শুধু একটি শব্দ–ভয় পেও না। এ কী বিষম শক্তিধর। কুমারী বলি হয় যে দেশে, দেবী থাকেন নাঙা, বাবা মেয়ে ধর্ষিত হয়–সেই। দেশের নারীকণ্ঠে এত জোর থাকে কী করে! যুদ্ধ সব রূপ ভাঙে, আকৃতি ভাঙে, স্বর্গ ধ্বংস করে, ঈগল ওড়ায় আকাশে, যোদ্ধা ঘুমিয়ে পড়ে পথে, আর জাগে না, মরুশকুনের চোখ টলটল করে, সমেরু ঝোলে ডালে, তাঁবু আওয়াজ করে। ফটফটসু বহে, দুর্ভিক্ষ হয়, বান ডাকে, শোকে স্তব্ধ হয় পৃথিবী–তারপরও নারী বলে, ভয় পেও না। সামান্য চাষীকে, অতি তুচ্ছ যাযাবরকে, ভাড়াটে ফেরতা সৈনিককে ডাকে সারগন! সেই এক কোমল নারী ডেকে ওঠে, যাকে দুটি অদ্ভুত বর্ণবহুল ডানা কাঁপানো প্রজাপতি ফুল ভেবে অধিকার করেছিল! এ কী বিস্ময় ব্যাকুল চন্দ্রকলার দেশ। এ মরুমর্ত অশেষ শোকেও গান গায়!

হঠাৎ কতকাল পর আকাশে চোখ তুলে চাইল সাদইদ। মনেই ছিল না, মাথার’পর আকাশ রয়েছে। সেখানে চাঁদ আর নক্ষত্ররাজি ওঠে। তার একদা পাহাড় ছিল, তথায় চাঁদ উঠত। রিবিকা সেই চাঁদের কথা বলেছিল। এই চাঁদ ওই পাহাড় ছেড়ে কোথাও যাবে না। এইরকম মনে হত! আজ আকাশ এমন করে সেজেছে কেন। চাঁদ তার চারপাশে নীল কস্তুরী আভায় জড়িয়েছে এক গোল পুরু বৃত্ত। যেমন নীল তেমনি সাদা। কী দারুণ ছবি! সমস্ত রাতেই চাঁদ একটি তারকা সঙ্গে করে উদিত হয়। সেই তারকাকে চাঁদ ছাড়ে না। আজ অজস্র তারকা চাঁদের চারপাশে ঘিরে বসেছে। চাঁদ যেন কথা বলছে, তারকারা ঝুঁকে পড়ে শুনছে–এইসব তারকা কোথায় ছিল। এভাবে চাঁদের চারিদিকে জুটল কী করে! চাঁদ যেন সভা বসিয়েছে আকাশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *