মরুস্বর্গ – ১

০১.

সমস্ত রাত্রি মরুভূমির আকাশে নিশান-মাসের চতুর্দশীর চাঁদটির দিকে চেয়ে ছিল সুন্দরী রিবিকা। নিশান-মাসটি যে মুক্তির মাস সেকথা স্বপ্নদশী ইহুদ বারবার বলেছিলেন। এই মাসে নিস্তার-পর্ব পালন করছিল তারা। অথচ তাদের একমাত্র আশ্রয় এলিফেনটাইন দুর্গটি জ্বালিয়ে দিলে মিশরীয়রা। হাতির দাঁতের কারুকাজ করা মন্দিরটি ধ্বংস করল। হায় দেবী ইস্তার তোমাতে আমাতে আর কোনই বিশেষ পার্থক্য নেই।

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ের তলার ভেজা বালি পাথর আর জল মুঠো করে চেপে ধরল রূপবতী রিবিকা। রিবিকার গায়ে কাপড় নেই। পরনের কাপড়খানিও মরুদসুর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। আকাশের নীল নদীর জলের মত উজ্জ্বল চাঁদ নগ্ন রূপসীকে দেখছে, কিন্তু নির্বাক। আকাশের ওই ক্রীতদাসী চন্দ্রমা কী বলবে তাকে? রূপ আছে কিন্তু নরদেবতা ফেরাউনের পিরামিডের আকাশ ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়ার সাধ্য নেই। যেন সে পিরামিডের চুড়োর সঙ্গে গাঁথা। নরদেবতা সপ্তম ফেরাউন তাকে আটকে রেখেছে। তার বন্দিত্ব আর রিবিকার বন্দিত্ব নীল নদীর আকাশের মত সীমাহীন অথচ তা যেন-বা একটি পিরামিডের চূড়ার চারপাশে বন্দী।

একটি হায়েনা এসে মরুকূপটির উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে রিবিকার হৃদয় কেঁপে উঠল। মানুষ নাকি হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে–একথাই বলেন নরোত্তম ইহুদ। সেকথা যদি সত্য হয়, তাহলে এখন সেই হৃদয় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলায় জল পাথর আর বালি ফের মুঠো ভরে আঁকড়ে ধরে বিনিদ্র রিবিকা। তারপর সে কূপটির তলা থেকে সেই ভেজা ভারী পাথর মিশ্রিত বালি উপরের দিকে ছুঁড়ে মারে। এই মরুকূপের ভিতর সে মরুদস্যুর হাত থেকে কোন প্রকারে প্রাণে বেঁচে আত্মগোপন করতে পেরেছে। উপরে দীর্ঘক্ষণ তাদের দলটির সঙ্গে দস্যুদলের লড়াই হয়েছিল সন্ধ্যার মুখে।

কেউ রক্ষা পায়নি। সকলকে হত্যা করেছে ডাকাতরা। কেবল সে লড়াই বাধার পর উটের পিঠ থেকে নেমে পালাতে শুরু করে। ঊর্ধ্বশ্বাসে মরুভূমির ভিতর দিকহারার মত ছুটতে শুরু করে। একজন ডাকাত তার পিছু পিছু তেড়ে এসে তার গায়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে দেয়। পরনের পোশাক ধরে টানাটানি করার সময় রিবিকা হতভাগ্য দেবী ইস্তারের নাম ধরে কঁকিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। দস্যুটি তাকে কিছুতেই ছাড়ত না-সহসা কোথা থেকে একটি বর্শা এসে কামোন্মত্ত ডাকাতটিকে পিছন থেকে বিদ্ধ করে। লোকটি রিবিকার পরনের পোশাক ছেড়ে মরুভূমির বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে যায়।

আবার পালাতে থাকে দেবী ইস্তারের মত নগ্ন এবং রূপসী রিবিকা। কতদূর সে ছুটে এসেছে বুঝতে পারে না। যেন নীল নদীর পশ্চিম তীরে সূর্যদেবতা সামাশ ডুবে যাচ্ছেন, মরুপথ অতিক্রম করতে করতে বুঝতে পারে মাত্র–অথচ কোথায় সেই নীল নদী পড়ে রইল পিছনে। তার শস্য রাঙানো দেহতীরের বসতি ভেঙে দিল মানবদেবতা ফেরাউন–যে কিনা দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা এবং মাত্র একাংশ মানুষ। ফেরাউনদের শবাধারলিপি সে পড়েছে। তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল, চিরকাল তারা লিখে আসছে :

‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
আমি কাউকে কখনও কষ্ট দিইনি,
আমি পশুদের কখনও আঘাত দিইনি।
আমি কাউকে কখনও মৃত্যুদণ্ড দিইনি ।।‘

মরুপথে দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে রিবিকা কতবার সেই শবাধারলিপি মনে মনে পাঠ করেছে আর দেবী ইস্তারের নাম ধরে কেঁদেছে।

বালির আঘাতে রিবিকার পা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, ফোস্কা পড়েছে। সে ছুটতে ছুটতে বালির ঢিবির পাশে পড়ে গিয়েছিল, শ্ৰমশ্রান্ত সে–তার হৃদয় আর চলছিল না। হৃদয় চিন্তা করতে পারছিল না। আস্কিলনের রাজকুমার ওয়িডিয়া হৃদয় দিয়ে চিন্তা করতেন। নরদেবতা ফেরাউন সেই হৃদয় দিয়েই চিন্তা করেছে। এমনকি পুণ্যশ্লোক ইহুদ অবধি হৃদয়ের সংকেতে কথা বলেন। কারণ এই সকল দিব্যজ্ঞানী মহাত্মাদের হৃদয় সত্যের পালক দিয়ে ওজন করেছেন ঈশ্বর–তাঁরা প্রত্যেকেই সত্যের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অথচ রিবিকা জানে না, পালকের মত হালকা আর কোমল তার হৃদয় ভেঙে পড়বে কিনা! তার হৃদয় আজ কোন্ সংকেত বহন করছে। সূর্যদেব সামাশ মরুভূমির বুকে অস্ত গিয়েছেন, চাঁদের বেগুনি আলো পড়েছে বালিতে, যা ক্রমে রূপার গলিত বিভায় উজ্জ্বল হবে, হৃদয় মাত্র এইটুকু চিন্তা করতে পারে।

কেমন এক আচ্ছন্নতার ভিতর, ক্লান্ত অবসাদের ভিতর রিবিকার সময় কেটেছে । চারিদিকে চাঁদের আলোর ঘোর। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হলে চোখ মেলে রিবিকা। চাঁদ কোন দেবী কিনা জানে না সে, তবে ক্রীতদাসী যে সন্দেহ নেই। ইহুদের হৃদয় কি তবে সত্য বলেনি? কোথায় মুক্তি! মরুভূমির বালিতেই রিবিকা মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছে।

ক্রীতদাসী চাঁদ জানে মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের বিনিময়ে রিবিকা দামাস্কাসের এক মরুবণিকের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। অথচ সুন্দরী কনান তার মাতৃভূমি। পবিত্র দেশ কনান। আব্রাহামের মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী স্বপ্নের দেশ, মহাপিত নোহের পিতৃভূমি। একজন বণিক, যার ছিল মদ আর লোমের ব্যবসা–রিবিকাকে তিনটি মেষের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়ে ফোরাত নদীর তীরভূমির দিকে চলে গিয়েছিল। সেই পূর্বদেশের দেবী ছিলেন ইস্তার। আকাশের দেবতা সূর্য,নাম তার সামাশ। অথচ সেই মেষপালক বণিকটি ক্ষুদে ব্যবসায়ী এবং চতুর–তাকে কন্যারূপে গ্রহণ করে, দাসীরূপে ব্যবহার করেছিল।

লোকটির নাম ছিল আক্কাদ। তার নবী ছিলেন সালেহ। সালেহ উটের নবী। পুণ্যশ্লোক ইহুদের মতই কি তিনিও মরু আরাবার নবী? নিশ্চয়ই তাই। ফোরাতের তীরে আক্কাদের ছিল ছোট একটি গোষ্ঠী।

সবচেয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আক্কাদীয় গোষ্ঠী। মাত্র গুটিকতক তাঁবুর তলে তারা বাস করত।

কিন্তু এসব ভেবে তো কোন লাভ নেই। আক্কাদ অবশ্য ইট দিয়ে গেঁথে জমরুদ পাথর গেড়ে একটি সুন্দর ইমারত গড়েছিল–তার ছিল সাদা সাদা উট আর উষ্ট্রী। আর ছিল নানা রঙের মেষ। মদের দোকান ছিল।

চাঁদের আলোয় হঠাৎ খেয়াল হল, ঠিক পায়ের কাছেই একটি অর্ধমৃত কূপ। নিচে নেমে বালি সরাতে পারলে জল পাওয়া যাবে। তৃষ্ণার পীড়নে বুক ফেটে যাচ্ছে। আর দেরি না করে রিবিকা গড়াতে গড়াতে কৃপের তলায় নেমে আসে। ক্লান্ত হাতে বালি সরাতে সরাতে মরু-দস্যুটির কামানো থুতনি আর ঝোলা গোঁফ মনে পড়ছিল। তাকে দেখাচ্ছিল আক্কাদের সাদা আর গায়ে হলুদ মুতমাথা গাধাটার মত বোকা। নিশ্চয়ই পাহাড়ী ডাকাত। একটা হিত্তীয় বাঁদর। একেবারে গোঁয়ার হাটুস। হিটাইট বা হিত্তীয় জাতিকে মনে মনে হাটুস বলে গালি পাড়তে পাড়তে বালি খুঁড়ে চলল রিবিকা। আঙুলে জলের ছোঁয়া লাগা-মাত্র সে শিউরে উঠল। যেন-বা ফেরাউনের দৈবী হৃদয় পালক আর ঐশ্বর্যময় জীবনের মত তাকে ছুঁয়েছে। উপরে চাঁদের আলোর হালকা হাওয়া বইছে। দূরের অরণ্যে কোথাও পাতাগুলি নড়ে উঠল। এই সময় মরুভূমির পশুরা বালির উপর খেলা করে। উপর থেকে হাওয়ার একটা গোলা বয়ে এসে কূপের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই বাতাসে পশুর গায়ের রমণ করা গন্ধ।

নিঃশ্বাস টেনে কেমন বিপন্ন হয় রিবিকা। জলপান করতে করতে ভাবে, ঈশ্বরের রমণকৃত সুঘ্রাত শ্বাস দিয়ে মানুষের জন্ম। এই জল, এই জ্যোৎস্না, এই বায়ু, উপরের বন্যঘ্রাণ, মাতাল মরুভূমি, রক্তঝরা মৃত্যুশীতল বালকা–অবধিহারা তার বিস্তার–অথচ সে এক ভাগ্যতাড়িত ক্রীতদাসী কিনা মুক্তির কথা ভাবছে–যে কিনা দেবী ইস্তারের মত নগ্নিকা। কী তুচ্ছ এই জীবন!

উপরে কৃপের কিনারে ভয়ংকর সেই লম্বাটে মৃত্যুবৎ জঘন্য-দর্শন মুখটা ঝুঁকে আসে। হিংস্র আর ধূর্ত মরু-হায়েনাটা কিছুতেই যাবার নয়। রিবিকা জলের ভিতর হাত নেড়ে খলবল শব্দ করে, খুব দ্রুত এবং সবেগে হাত নাড়ে। ক্রমাগত হাতের আন্দোলনে জলের চাপা অদ্ভুত শব্দে হায়েনাটা দূরে কান পাতে এবং মরুভূমির আকাশে তাকায়। জলের শব্দ থেমে যেতেই আবার ঝুঁকে আসে। রিবিকা অতর্কিতে পাথর মেশানো বালি ছুঁড়ে মারে। ভেজা দলা পাকানো বালি গিয়ে লাগে হায়েনার জ্বলন্ত চোখে। পশুটা অন্ধের মত চিৎকার করে ওঠে। হিংসার বিদ্যুৎ গলা থেকে খেঁকিয়ে বার হয়। গায়ে মোচড় মেরে পালিয়ে যায় পশুটা।

অতঃপর কুপের তলার জলে রিবিকার হাতে আন্দোলিত জল মাত্রই যে-শব্দ ওঠে, তাতেই ভয় পায় হায়েনাটা। সমস্ত রাত্রি এভাবে কূপটা জেগে থাকে। জল, মানুষ, চাঁদ আর হায়েনা ছাড়াও নাঙা দেবী ইস্তার জাগেন।

কাল ভোরে কী হবে, কোথায় যাবে রিবিকা কিছুই জানে না। সেকথা ভাববার মত মনের অবস্থাও তার নয়। সে কেবল এই রাতটুকু কোনভাবে পার করতে চায়।

নীল নদীর দক্ষিণ প্রান্তে এলিফেনটাইন (ঐরাবত দুর্গ)। দুর্গটি ধ্বংস হয়ে গেল। ইহুদের জনগোষ্ঠী নিরাশ্রয় হল। তার আগে পর পর সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস হল না। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্র পাঁচ ফুট নিচে দিয়ে জল বইলেই নীল নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ফসল জন্মানো যায় না। মাটি শুকিয়ে ওঠে। পর পর সাত বছরের খাদ্যাভাবে প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ইহুদের যাযাবর গোষ্ঠীর পশুরা মরেছে। মিশরে ইহুদের লোকবল অতি সামান্য। অথচ সামান্য এই জনগোষ্ঠীর জন্যই ইহুদের স্নেহ অসামান্য। তিনি চান পারস্য উপসাগরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে লোহিত সাগরের কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত হাজার মাইলের চন্দ্রকলাকৃতি অর্ধবৃত্তাকার ভূভাগের আধিপত্য। তাঁর ধর্মের বিস্তার। এবং তিনি আব্রাহামের বায়োগোষ্ঠীর একতা যাতে হয়, সেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে চান। তাঁর বারোটি গোষ্ঠী চন্দ্রকলাকৃতি ভূভাগে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের তিনি খুঁজছেন।

ইহুদ কবেই (ঐরাবত) এলিফেনটাইন ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। দুর্গের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা রিবিকাদের বস্তীগুলিকে তিনি এক পরম মমতাবশত ত্যাগ করে যাননি। তাঁর সংকল্প ছিল মোসির উল্লিখিত নিশান-মাস অর্থাৎ মুক্তির মাসেই যাত্রা করবেন কানের দিকে। ঠিক এই মাসেই মাত্র ৮০ জন উৎকৃষ্ট উম্মত পরিবার সঙ্গে করে মোসি এই মিশর ছেড়ে গিয়েছিলেন একদা অতীতে। কিন্তু একদিন (১২০০-৫২৫ খ্রিঃ-পূর্বাব্দের কোন এক সময়) ইতিহাসের চাকা অতীতবৃত্তে ঘুরে যেতে লাগল পিছনে, ঘুরেই গিয়েছে বলা যায়। মিশরীয়রা মোসির আগের যুগের মত বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদের ধর্মের লোকজনকে কিনে। এনে, জোর করে ধরে এনে ক্রীতদাস ব্যবস্থার নতুন করে পত্তন করেছে এই মিশরের বুকে। দক্ষিণ-পূর্বের অসুর জাতি মিশর আক্রমণ করেছে অতীতের মত।

অবশ্য মোসি তো মাত্র ৮০ জন উম্মত পরিবারকে কনানের দিকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পরে সেই টানে আরো কতজন বিভিন্ন স্থানে মুক্তি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খল বারবার পায়ে পরেছে তারা। কেবল একটুখানি মুক্তির স্বাদ তাদের রক্তে মিশেছিল সেই কবে। সেই স্বাদ আবার তারা ভুলে যেতে বসেছে। যাযাবর জাতি স্বাধীন চৈতন্যে ঘোর, ফের মাটির টানে তার রক্ত উষ্ণ হয়, ক্রীতদাসত্বে মজে। হানাদার হিসেবে তার বদনাম যত, মুক্তি-পিপাসু এবং ভূমিবশ্য হিসেবেও তার রক্তের গড়নের দাম আছে। ইহুদ এসব বলেন।

এলিফেনটাইন (ঐরাবত) কতবার ধ্বংস হয়েছে। দুর্গের মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছে ক্রীতদাসেরা। বিশেষত মেসোপটেমিয়ার আব্রাহামী দাসেরা চেয়েছে মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে সাজাতে এবং দুর্গের প্রাচীর খাড়া করতে। অতঃপর দেবী ইস্তারকে মন্দিরের সর্বোচ্চ ধাপে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা করেছে। তারা। এমনকি তারা মন্দিরের গায়ে খোদিত করেছে মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন অনুশাসনলিপি। মানবাধিকারের জ্বলন্ত উক্তি।

‘অত্যাচারী তার পাপের ভারা টানতে পারে না। তার স্পর্ধাচিহ্ন পিরামিডের চুড়ার মত আকাশম্পৰ্শী হলেও সে ডোবে।‘

এই লিপি হুবহু সুমেরীয় লিপির অনুকৃতি নয়। তার সঙ্গে আধুনিক মেজাজ এবং মিশরীয় উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। সেদিকে আঙুল তুলে ইহুদ বলেছেন–এই লিপি ইতিহাসজড়িত। কিন্তু মিশরের রাজা এতে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। প্রাচীন অনুশাসন অবিকৃত রাখাই বিধেয়। তোমরা এভাবে প্রকাশ্য উক্তির নকশা না আঁকলেই পারে। তাছাড়া দেবী ইস্তারকে এভাবে গহনা পরিয়ে জীবিত করার মানে নেই। এ দেবী নগ্ন ছিলেন। এসব কুসংস্কার।

ইহুদেরও দেবীর উপর রাগ। কিন্তু তিনি খুব বুদ্ধিমান। সব কথাই খুব নরম সুরে বলেন। তিনি জানেন পর পর সাত বছর দুর্ভিক্ষ হলে মানুষ কৃষির দেবী, উর্বরতার বিগ্রহ ইস্তারকেই ডাকবে। নগ্ন হলেও ডাকবে । ইহুদের বোঝা উচিত, কেন, কীভাবে দেবী নগ্ন হয়েছিলেন!

রিবিকার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। সে তখন জলের তলায় হাত চালিয়ে দিয়ে শব্দ করল। জলের শব্দে হায়েনাটা আবার সরে গেল। যেন মৃত্যুর ছায়া সরে গেল চকিতে।

তার মনের ভিতর জেগে উঠল তিনটি লোম-ছাঁটা ভেড়ার করুণ নেড়া ছবি। একজন কনানীয় চাষী রিবিকাকে বিক্রি করছে। মেষের লোম স্থূপীকৃত করেছে একজন যাযাবর মেষপালক বণিক। মদের কারবারী। লোকটির হাতে ধরা লোমকাটার যন্ত্র। খুরপি চকচক করছে। আক্কাদের গাধাগুলির পিঠে ছিল চামড়ার থলে ভর্তি মদ আর শুঁটকি মাছ। সেবছর মরুভূমির হাহাকার করা শীত ছিল কনানের গ্রামগুলিতে–সে যে কী ভয়ংকর দুর্দশা!

মরুভূমিতে শীত সব বছর সমান পড়ে না। এই শীতকে চাষীরা যমের চেয়ে ভয় পায়। মেষপালক যাযাবর আব্রাহামীদের সেকারণে রেয়াত করতে বাধ্য হয় তারা। যাযাবরী তাঁবুগুলির সঙ্গে সেই সময় সদ্ভাব হয়। ভেড়ার নোম আর যাযাবরীদের হাতে বোনা লোমের পোশাক চাষী তার শস্যের বিনিময়ে কেনে। ঘটনা এমনও রয়েছে যে,একটি গরিব চাষী পরিবার শুধুমাত্র নোম পাওয়ার জন্য যাযাবরীদের চাষের জমিতে বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। চাষবাস এবং অন্যান্য কাজের সুযোগ দিয়েছে। দ্রাক্ষাচাষ এবং মদ তৈরি শিখিয়েছে।

নগরের লোকেরা আব্রাহামীদের কেন যে বেদে বলে উপহাস করে? অমার্জিত অসভ্য বলে কটুক্তি করে? খুরপি-অলা আক্কাদের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বালিকা রিবিকার দুই চোখ ম্লান হয়ে আসছিল। দুই চোখ তার বারবার ভিজে উঠছিল। ঠাকমার মুখে রাজা সারগনের গল্প শুনেছে । তিনি ছিলেন রাজচক্রবর্তী। এই আক্কাদের পূর্বপুরুষ তিনি। ফোরাত আর হিদ্দেকল নদীর তীরে ছিল তাঁর রাজপ্রাসাদ ‘জিগুরাত’ সে এক স্বপ্নবেষ্টিত পৃথিবী। আজ আর নেই। কেন নেই, সে এক অভিশাপের কথা। সে কাহিনী শুনলে মন খারাপ করে।

মানুষ রাজত্ব গড়ে, ফের রাজত্ব হারায়। আব্রাহামীদের বদনাম ঘোচে না–এরা মরু আরাবার হানাদার গোষ্ঠী। এরা বেদে। এরা নিরন্ন। দিদিমা সুর করে বলতেন :

‘আব্রাহামী হানাদার মাথা নিচু করে না,
সারগন মরে তবু সারগন মরে না ॥
নলখাগড়ার ঝুড়িতে সারগন ভাসে রে;
পীচ-আঁটা ঢাকনার ঝুড়িতে–
জর্দন নদীতে, ফোরাতের কূলেতে,
ভিস্তির কোলেতে সারগন হাসে রে ॥
তার জাত আরাবার, কাঁচাখেকো হানাদার–
বেঁচে থাকে তাঁবুতে, ঘরবাড়ি জোটে না,
যখন সে মরে যায়, কাঁচা খায় হায়েনা ॥
কবর তো জোটে না, তিন হাত জমিটুকু
তাও সে পায় না, এমনই হাহাকার–
হানাদার হানাদার, জর্দন নদীতে ফোরাতের কূলেতে ॥’

কোথায় ফোরাত আর কোথায় জর্দন! সারগন কতদূর পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে সাম্রাজ্য গড়েছিল–সবই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। পরে তারই জাত মিশরের ফেরাউনের হাতে বন্দী হল। সবই কপাল! এই আহাদী আক্কাদ তাকে আজ পশুলোমের বিনিময়ে মদ আর শুঁটকি মাছের বিনিময়ে খরিদ করছে বালিকা সে, তার বাধা দেবার কোনই ক্ষমতা নেই। তাকে বেচে নানী এই চাষী পরিবার। মরুভূমির শীতের হাত থেকে বাঁচবে। একটি পারিবারিক উষ্ণতার বিনিময়ে রিবিকা মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী পবিত্র জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় ভেসে যাবে।

আক্কাদ লোম কাটতে কাটতে হাতের খুরপি থামিয়ে ঘাড় তুলে বলল–ফোরাতের পানি তো খাওনি বাছা! দেখবে কী মিঠে! ফোরাতের হাওয়া খুব ভাল। আমার বাড়ির নাম হাওয়ামহল। খালি বসন্তের হাওয়া বয়। মরুভূমির ঠাণ্ডা পোঁছয় না। খুব তাড়াতাড়ি তুমি যুবতী হতে পারবে।

–আমি যাব না ঠাকমা! আমি কি আক্কাদের ভেড়ার চেয়ে দেখতে খারাপ!

–না বাছা! কিছুতেই না! তুমি যে খুবই সুন্দরী মাগো!

–তবে এভাবে বেচে দিচ্ছ কেন?

–তোমার ভাগ্য মা! আক্কাদের তোমাকেই চোখে ধরল কিনা! এই দ্যাখো, উনি আমাকে একখানা কুর্তা দিয়েছেন। তোমার কাকাদের লোমের জোব্বা দিয়েছেন। তোমার কাকীদের গরম বসন দিয়েছেন। সবই তোমার জন্য মা! জমিতে ভাল ফসল হলে তাই বেচে একটা উট কিনে তোমায় আনতে যাবে তোমার ছোটকাকা। ততদিনে তুমি আর কতটুকু বড় হতে পারবে–যদি বৃষ্টির দেবতা চোখ তুলে চান–সামনের সন তুমি ফিরে আসবে।

–তুমি যে বল, পূর্বদেশে যারা গেছে, তারা আর ফেরেনি!

–তারা তো যুদ্ধে মরেছে। তাছাড়া মিশরের রাজা ধরে নিয়ে গেছে। বিহিস্তুনের ডাকাতেও মেরেছে ওদের। তা ফের কারুকে ভান হ্রদে পুঁতে দিয়েছে। তুমি যাবে নিনিভে নগরী পার হয়ে, ফোরাত কি হিদ্দেকলের ধারে–সেখানে উটকণ্ঠী নৌকা ভাসছে মা। ভয় পেও না। মহপিতা পুণ্যশ্লোক নোহ তোমার সঙ্গে রইলেন!

সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে পড়ছিল রিবিকার। আক্কাদ সেদিন তিনটি ভেড়ার লোম কেটে তূপীকৃত করেছিল, এবং রিবিকাকে পেয়ে লোমসুদ্ধ তিনটি ভেড়াই দিয়ে দিয়েছিল কনানীয় দরিদ্র পরিবারটিকে।

লোমছাড়ানো হতকরুণ একটি মেষ যেমন, রিবিকা নিজেও তাই–ভাগ্যের কথা মনে হলে, বারবার তার তিনটি ভেড়ার ছবি মনে পড়ে। আক্কাদ তাকে যত সস্তায় কিনেছিল তত কম দামে বেচেনি, চড়া দাম নিয়েছিল মিশরীয় এক বণিকের কাছে। আসলে আক্কাদ তাকে চড়া দরে বেচে দেবার জন্যই যে। কিনেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু কেনার সময় দেবী ইস্তারের নামে, কৃষিদেবতা। বালদেবের নামে দিব্যি গেলেছিল, সে রিবিকাকে কন্যার মত দেখবে এবং বেচে দেবে না। বলেছিল-উটের গা ছুঁয়ে কসম খাই মা!

মিশরীয় সেই বণিক পুরনো নগরী আমারনার লোক ছিল। লোকটি সূর্যদেবতা আটনের জন্য রচিত সূর্যস্তোত্র আওড়াত। এর নাম ছিল নমরু। মিশরের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু সম্প্রদায়ের লোক। সংখ্যালঘু আক্কাদ করত উটের পূজা। নমরু করত সূর্যস্তব। ভাবতে অবাক লাগে, এরা দুজনই এমন ধর্ম পালন করত, যার কোন মিলই নেই। সেদিক দিয়ে দেখলে আক্কাদ ছিল বিদ্রোহী আর কোণঠাসা, একটেরে লোক। ইহুদের আবার এই দুই ধর্মসম্প্রদায়ের উপর সহানুভূতি লক্ষ্য করা গেছে। রিবিকা যখন যেখানে থেকেছে সেই ধর্মই পালন করেছে। তবে দেবী ইস্তারের মত এত স্পষ্ট কেউই নয়, অন্তত রিবিকার তাই মনে হয়েছে। এই দেবী যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা (সেকালে সেখানে অন্ন বলতে যব গম ইত্যাদি বোঝাত), কোমল, ভীরু আর নগ্ন। নবান্নের দেবী। অন্নপূর্ণাই বল আর লক্ষ্মীই বল, এত অসহায় কেউ নয়, এত পূর্ণশ্রীও কেউ না।

টুকরো টুকরো ভাবে কত ছবিই না মনে পড়ে! পূর্বদেশের নবান্নের রাত, যে-রাতে আক্কাদ তাকে প্রথম সম্ভোগ করেছিল উটের পিঠে শুইয়ে । কন্যা হয়েছিল উপপত্নী। তখন রিবিকার বুকে কেবলই কুঁড়ি ফুটেছে। স্তনবৃন্তে মর্দন করা লোকটার মেটে সাপের মত আঙুল সিরসির করছিল; ঘৃণায় আর ভয় মেশানো কামার্ধ দেহে রিবিকা কেঁদেছিল–তার যোনি-প্রদেশ রক্তাক্ত করেছিল গর্দভ-লিঙ্গ পশুটা। সে বারংবার রিবিকাকে বুঝিয়েছিল, উটের পিটে যৌন আস্বাদন করলে পুণ্য হয়, এ জিনিস সুন্নৎ। নবী সালেহ তাতে খুশী হন।

উটের কুঁজটা নবী সালেহর কবর। এখানে তিনি শুয়ে আছেন। এই অনুমান পূর্বদেশগুলির সকলেই বিশ্বাস করত। কেন করবে না? সালেহ ছিলেন মরু আরাবার আমোরাইট বা আমেলেক জাতির লোক, আব্রাহামের বংশের মানু নোহের পুত্র সামেরের গোত্রভুক্ত, তথাপি উট-উপাসক। নিশ্চয়ই বারো গোষ্ঠীর এক গোষ্ঠী এরা। নবান্নের রাতে আক্কাদের লোকজন উটকে মাল্যে পুষ্পে সুর্মা তিলকে সাজাত, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দিত। এই রাতে তারাও দেবী ইস্তারের সামনে যৌনাচার করত। এই রাতে সমূহ গ্রাম নগরী সেজে উঠত। গ্রামে এবং নগরে সর্বত্র উৎসব চলত। চাষী জীবনে উটের প্রভাব তেমন ছিল না, কিন্তু যৌনাচারের রাতে কোন কোন চাষীপুত্র উটকে ব্যবহার করত তার আন্দোলিত পৃষ্ঠভূমিতে যৌনবিহারের জন্য।

দুটি ধর্ম–নির্দিষ্ট এই রাত্রিতে মিলিত হত। নবান্নের রাতেই আক্কাদ রিবিকাকে উটের পিঠে জোর করে তুলে নিয়েছিল। সেই সময় আক্কাদের চোখদুটি দপ দপ করে জ্বলছিল। আক্কাদের চোখে হীরা পর্বতের নীল সুমা। মোসি যে পর্বতে ঈশ্বর যবহের প্রত্যাদেশ পেয়েছিলেন, সীনয় উপদ্বীপের হীরা পর্বতটি, অতএব সীনয় পর্বতেরই সংলগ্ন অথবা সীনয়েরই অন্য নাম হেরোর বা হীরা। অথবা হীরা কোন গুহা মাত্র। যাইহোক, হীরার পবিত্র সুর্মা চাষীদের চোখেও সেই রাতে জ্বল জ্বল করছিল পশুচর্বির মশালের আলোয়। আলোর ফোয়ারা উঠছিল আকাশের দিকে। মিলনের এমন রাত পৃথিবীতে কমই আসে।

নবান্ন আর দোলের রাত একই রাত। আকাশে পূর্ণিমা। উদ্ভাসিত আলোয় প্লাবন বইছে চরাচরে। দেবী ইস্তার অলংকৃতা। ঢোল বাজছে বাতাসে। উট সুসজ্জিত। সবার পরনে বেগুনি রঙের পোশাক। মরুসরষের পাঁপড়ি আর বোঁটায় রাঙানো–বোঁটা বেগুনি, পাপড়ি হলুদ। রঙে ছোপানো হয় সেদ্ধ করার পর। রিবিকার গায়ে কাঁচুলি–দুই-তিনটি স্তরে পাতলা কাপড়ে ঢাকা বক্ষবন্ধনী)–আর কোন পোশাক নেই। মধ্যরাত্রিতে গায়ে সামান্য সুতো রাখাও নিষেধ। ধর্মের নিষেধ। দেবী ইস্তার ক্ষুণ্ণ হবেন। আক্কাদীয়রাও সেকথা বিশ্বাস করে। কাঁচুলি পরা বিদেশী নাগরিক প্রভাব । চাষীরা অনেকে কাঁচুলি পরলে ঠাট্টা এবং ঈষৎ কটুক্তি করত।

আক্কাদের মা তাড়া দিচ্ছিল–যাও বাছা! আক্কাদ উটের পিঠে অপেক্ষা করছে। বুকে ওইরকম লাগাম পরেছ, লজ্জা হয় না? এত শউরেপনা ভাল না!

কথাটার ইঙ্গিত বালিকা রিবিকা বুঝতে পারছিল না। ঢেলে সেই কখন কাঠি পড়ে গিয়েছে। দেবী ইস্তার শেষ রাতে পাতালে নামবেন। যমালয়ে প্রবেশ করবেন তিনি। যমের বাড়ি পাতালে,এই হল লোকবিশ্বাস। মাটি ও বৃষ্টির দেবতা তামুজদেব মাঠ থেকে হলুদ শস্য কেটে নেবার পর পাতালে চলে যান। যমালয়ে যাত্রা করেন। মাঠ শূন্য। একটি দানাও সেখানে পড়ে নেই। আকাশ মেঘহীন। মরুভূমির শীত সামান্য হালকা হয়েছে। দোল রাত্রি এসেছে। নবান্ন হয়েছে প্রথমে একবার। যখন ফসল উঠেছিল। এবার হচ্ছে দ্বিতীয়বার। এটাই বড় উৎসব। এই উৎসবটি হয় বীজ গমের পায়েস দিয়ে, দেবীকে খাইয়ে, তেভাগ দিয়ে, পাঠানো হয় তামুজদেবকে উদ্ধার করতে। তামুজদেব পাতাল থেকে ফিরে না এলে আকাশে মেঘ জমবে না। আঁর প্রিয়তমা দেবী ইস্তার ছাড়া তাঁকে বাঁচিয়ে তুলে যমালয় থেকে ফিরিয়ে আনার কেউ নেই। দেবীকে সাত সাতটি তোরণ অতিক্রম করে যমালয়ে পাতালে শেষ স্তরে পৌঁছতে হবে।

প্রত্যেকটি তোরণ অতিক্রম করার সময় দেবীর হাত থেকে তাঁর দৈবশক্তির প্রতীকগুলি একটি একটি করে কেড়ে নেওয়া হয়। প্রত্যেক তোরণে একটি করে প্রতীক তিনি হারিয়ে ফেলেন। সাতটি স্তরে পেঁচানো পোশাক, প্রত্যেকটি খণ্ড খুলে পড়ে প্রতিটি তোরণের কাছে। যম তাঁর বস্ত্রহরণ করেন। দেবীমূর্তির দিকে চেয়ে ছিল রিবিকা। বুকে তার কেবলই কুঁড়ি ধরেছে। বারবার সে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল।

পুরোহিত এবার চতুর্থ খণ্ড পোশাকটি খুলে ফেলছেন দেবীর গা থেকে। চতুর্থ প্রতীক একটি নৌকা, সেটি হাত থেকে নামিয়ে রাখলেন। এই সময় বিষয় শিঙা বেজে উঠল। মৃত্যুর স্বর যেন ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। রাঙা রাত্রি যে বিষাদে ভরে যায়, অন্তত রিবিকা বালিকা হলেও বুঝতে পারে। এই যে নৌকার, প্রতীক–এটা নোহের চিহ্ন। নৌকার পুচ্ছটাতে ফের উটের মুখ আর গলা। তা ছাড়া উটের বিগ্রহও আছে।

এই সময় খানিকটা গোলমাল বাধে। প্রতীক নামাতে গিয়ে পুরুত নাকি ভুল করেছেন। চতুর্থবার নামবে উটের চিহ্ন। ষষ্ঠবারে নামবে নৌকা এবং অবশেষে বৃষমূর্তি। বৃমূর্তি হল চাষীর চিহ্ন। দেবী ষষ্ঠ তোরণ পর্যন্ত মহাপিতা নোহের নৌকায় করে যেতে পারেন। সপ্তম তোরণে গিয়ে বৃষের পিঠ থেকে পড়ে যান। অতঃপর নগ্ন দেবী ভাসতে ভাসতে গিয়ে রানী এরেসকীগালের কাছে উপস্থিত হন। এই কাহিনী ইস্তার পুরাণে লিখিত আছে। পুরোহিত সেই পুরাণ পাঠ করে চলেছেন মন্ত্রস্বরে। বস্ত্রহরণ করছেন যম। এই অনুষ্ঠানে পুরাণ-পাঠ আবশ্যিক।

মণ্ডপের সামনে থেকে নড়তে এতটুকু ইচ্ছে নেই রিবিকার। অথচ আক্কাদের মা বারবার ডেকে পাঠাচ্ছে। কেন যে এভাবে ডাকছে এবং বারংবার আক্কাদ উঠের পিঠে ওঠাতে চাইছে বোঝা যায় না। উঠের পিঠে ওঠা মানে যে একজন কুমারীর পক্ষে খুব মারাত্মক, রিবিকা শুনেছে–কিন্তু দোলের এই রাত্রি তার কাছে কোনই আনন্দ বহন করে না। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ক্রমশ রিবিকার মনে হচ্ছিল, তার বিপদ হবে।

দেবী ইস্তারও কুমারী। তামুজদেব তাঁর প্রেমের উপাস্য পুরুষ। তাঁর সঙ্গে অবৈধ মিলনে আকাশে মেঘ জমে, মাটি উর্বর হয়। মাটির সঙ্গে চাষীর হলের সম্পর্ক, বলপ্রয়োগের সম্পর্ক। যে দেবী তামুজকে উদ্ধার করেন, তাঁরই যৌন-প্রহারে দেবী দুঃখ এবং আনন্দ পান। পুরাণের মস্বরে সেকথা আছে। দুঃখ আর আনন্দ মেশানো দোলরাত্রি বিষাদে আচ্ছন্ন হয় এই মুহূর্তে।

দেবীর তরফে আর্তস্বর পুরুতের গলায় ধ্বনিত হয় :

‘আমাকে ছেড়ে দাও, যাতে আমি যে-দেশে গিয়ে কেউ ফেরে না, সেখানে যেতে পারার সান্ত্বনা পাই, জানি সে দেশ বিষণ্ণতার, সে দেশ অন্ধকারের। (ইয়োব ১০ : ২০-২১)।

এই পূর্ণিমা রাতে বস্ত্রহৃতা দেবীর বিসর্জন। আর্তস্বরে সমস্ত গ্রাম আর আলোকোজ্জ্বল নগরীগুলি মথিত হচ্ছে। একই সঙ্গে চুড়ান্ত দুঃখ আর আনন্দ পাওয়ার অনুভূতি রিবিকার হয়নি। তার জীবনে অবৈধ কোন প্রেমও নেই। সে জানে আক্কাদের উটের কুঁজটা নবী সালেহের কবরভূমি। যে নবী মাটিতে ঠাঁই পাননি মৃত্যুর পর। সমগ্রজীবন মরু আরাবার পথে পথে, ফোরাতের তীরে তীরে। তাড়িত হয়ে ফিরেছেন। শুধু তৃষ্ণার জল দিয়েছে মরুবাহক উট। উটই ছিল তাঁর দেবতা। সালেহের জীবনও ইস্তারের মত। দুঃখের রূপ তো একই। অসহায় যে তার একই কষ্ট। দেবী প্রতীক হারিয়ে অন্ধকার পাতালে প্রবেশ করেন, সালেহ ঘুরে মরেন মরুভূমির উষর পথে পথে।

প্রতি বছরই দোলরাত্রির দেবী-অর্চনায় উটের প্রতীক নামানোর সময় পুরুতে পুরুতে গোলযোগ বাধে। পুরোহিতরা অবস্থাপন্ন এবং প্রচুর জমির দখলদার। তারা সালেহের উপাস্যদের পছন্দ করে না। এরা যেহেতু মরু আরাবার যাযাবর জাতি, হানাদার–তাই ঘৃণ্য। এদের বাস্তু নেই, নির্দিষ্ট কোন বাসভূমি নেই, এরা তাঁবুতে থাকে। জোর করে পূর্বদেশীয়দের শস্যভূমিতে ছাগল মেষ উট নিয়ে ঢুকে পড়ে–জবরদখল করে জমি। এই অতীতে বহুবার ঘটেছে। পরে এরা বাস্তু পেয়েছে কিন্তু কখনই নিজস্ব ভূখণ্ড পায়নি, জবরদখল করাই এদের নিয়তি। এদের ইতিহাস দীর্ঘ। এরা যখনই নিজস্ব বাসভূমির জন্য কোন এক স্থানে তাঁবু স্থাপন করেছে, গ্রাম ও নগরের মানুষরা ক্ষুব্ধ হয়েছে।

অথচ দিনে দিনে এরা চাষীজীবনের সঙ্গে খুব একটা দূরত্বও রাখতে চায়নি। বরং মিশে যেতে চেয়েছে। তাদের যাযাবরী অনেক প্রথাকানুন ত্যাগ করে, কোথাও বালদেব, কোথাও দেবী ইস্তারের উপাসনা শুরু করেছে। চাষবাস শিখে স্থিতু হয়েছে। শুধুমাত্র মাংসভুক এই শ্রেণীর মানুষ তাদের কাঁচাখেকো বদনাম ঘোচানোর জন্য চাষীদের ঘরে বৈবাহিক সম্বন্ধ গজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাষীরা আপন ঘরের গৌরীদান করতে হামেশা কুণ্ঠা প্রকাশ করে। বরং যাযাবর মেয়েদের ঘরে বউ করার পর চোর বলে খোটা দেয়। আসল বউ নয়, উপপত্নী।

রিবিকার মা ছিল কনানীয় পরিবারে দ্বিতীয় শ্রেণীর বউ। অর্থাৎ রক্ষিতার চেয়ে সামান্য উন্নত। উপপত্নী মাত্র। রিবিকার বাবা রূপে মুগ্ধ হয়ে পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁর থেকে মেয়েটিকে ঘরে তুলেছিল। পরে কালাজ্বরে বউটি মারা যায়। উপপত্নীর মেয়ে বলে বাতৃ আর জমিতে রিবিকার কোন আইনগত অধিকার ছিল না।

আক্কাদ ওকে পশুলোমর বিনিময়ে খরিদ করল। একজন যাযাবর বণিক চাইছে–পরিবার তেমন কোন আপত্তিই করল না। কেনই বা করবে!

রিবিকার মায়ের মুখের ভাষা ছিল অন্যধারা। পরিবারের পাঁচজন নাকি বুঝতেই পারত না। কে জানে কী ছিল–মাকে তো রিবিকার তেমন মনেই নেই। ভাষাভেদ মানুষকে বিভিন্ন করে, খাদ্যাভ্যাস আলাদা করে দেয়–সর্বোপরি ধর্ম কখনই এক হতে দেয় না। অথচ রিবিকার বাবা ছিল মহাপিতা নোহের বংশধর। নোহ কি যাযাবর ছিলেন না? নোহকে কেন যে সবাই চাষী মনে করে? চাষী বটে, জেলেও বটে, মিস্ত্রীও বটে। তিনি নৌকার কারিগর, চাষের উদগাতা, বীজ ও জীবের পালক। অথচ তিনিও মহাপুরুষ পুণ্যশ্লোক আব্রাহামেরই পূর্বপুরুষ।

তা সত্ত্বেও বিভেদ কম নয়। আব্রাহামীরা একদা যখন বাবিলনের পতনের পর ঈশ্বর যবহের অভিশাপে ভাষাভেদ হল বারোটি গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে গেল মরুনগরী আর গ্রামগুলি এবং মরুছাউনিগুলিতে, নোহ তাঁর নৌকায় সকল গোষ্ঠীর বীজ ও জীবকে স্থান দিয়েছিলেন-তিনি ভাষাভেদ গণ্য করেননি–যাযাবর কি চাষী, ভেদাভেদ করেননি।

রিবিকার বাবা যদি মাকে পত্নীরূপে বিবাহ করতেন, তাহলে বোধহয় রিবিকা এভাবে বিচ্ছিন্ন হত না। আক্কাদ মরুবণিক যাযাবর সালেহর কউম। ঠাকুমা একবার ভেবেও দেখলেন না কার হাতে পড়ছে মেয়েটি! যেখানে যাচ্ছে। সেখানকার অবস্থা কীরকম। তিনটি মেষ আর মেয়ে কি সমান? কনানীয়দের গণিতের ভাষা কি এই ধারা? মন্দিরের দেবীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকা আপন মনে ফুঁপিয়ে উঠল। চতুর্থ প্রস্থ কাপড় খণ্ড খুলে ফেলেছে। পুরোহিত।

উটের চিহ্ন নিয়ে বিবাদ। আসলে আক্কাদীয়দের কেউ চায় না। মন্দিরে উটের ঠাই দিতে গভীর কুঠা-পুরোহিতরা চরম অসন্তোষে প্রতি বছর দোলের রাতে বিবাদ বাধায়। তারা চায় আক্কাদীয়দের উচ্ছেদ করতে। কিন্তু আক্কাদ অনেক চাষী পরিবারের লোম, মদ আর শুঁটকি মাছ দাদন দিয়ে মাথা খরিদ করে রেখেছে। আক্কাদের এই উন্নতি পুরোহিতরা সহ্য করতে পারে না।

সালেহ মরুপথে ঘুরে মরেছেন। উটের মাংস আর তৃষ্ণার জল দিয়ে তাঁর বাহক মানুষের জীবন রক্ষা করেছে–তাঁর দলকে নিয়ে ঘুরেছেন তিনি উষর মরু, নীল বনানী, সবুজ উপত্যকার চন্দ্রকলাকৃতি পথে। তাঁর পূর্বপুরুষ আব্রাহামের মত তাঁরও চোখে ছিল একটি পবিত্র দেশের স্বপ্ন, মধুদুগ্ধপ্রবাহিনী দেশের মেঘমেদুর ছায়ায় তিনি আশ্রয় এবং সমাধির স্বপ্ন দেখেছিলেন।

সালেহ পাননি। উটের কুঁজই তাঁর সমাধিক্ষেত্র। মন্দিরের সামনে থেকে রিবিকাকে আক্কাদের ভগিনী এসে জোর করে হাত ধরে টানল। আক্কাদের উটের কাছে এনে রেখে গেল। ইস্তার পুরাণে উট-উপাস্যদের বিধর্মী এবং বিদেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে দেবী তাঁদেরও বাঁ হাতে গমশীর্ষ উপচার নেন। দেবী হতভাগ্যদের অমোচন করেন। অসভ্য জাতিরা সংযত থাকলে দেবী প্রসন্ন থাকেন। দেবী গমশীর্ষ চান–উট-উপাসক যেন নিজের জমি থেকে সেই ফসল উৎপাদন করে।

কিন্তু সালেহর যেখানে মরবার মত সাড়ে তিনহাত জমিই ছিল না–সেক্ষেত্রে তাঁর সংখ্যালঘু গোত্রটি জমি কোথায় পাবে–গমই বা ফলাবে কোথায়?

রিবিকাকে মন্দিরের চৌহদ্দির অনেক দূরে দাঁড়িয়ে দেবী ইস্তারের অর্চনা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছিল, এমন সময় আক্কাদ-ভগিনী সেবা তাকে টেনে নিয়ে এল।

বলল–ওভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পোশাক-খোয়ানো নাঙা দেবী নিজেই তো বাঁচে না, তোমায় কি রাখবে গা? নবী সালেহর আশ্রয়ই আসল। পাতালে গিয়ে ভাসেন যে-দেবী, ইজ্জৎ যার নিজেরই নেই, তা ফের গমের শীষ! কথায় বলে কিসে আর কিসে–তামা আর সীসে! কোথায় সালেহ আর কোথায় ইস্তার। এসো তেতা, দাদা সেই কখন থেকে সেজে বসে আছেন ভোলায়।

উটের পিঠে দোলা চাপানো হয়েছে। সেবা বলে ভোলা। ঠেলা দিয়ে সেবা রিবিকাকে উটের পিঠে তুলে দিতেই উটটা চলতে শুরু করল।

মৃত্যবৎ জঘন্য-দর্শন কুৎসিত লম্বা মুখাকৃতি হায়েনাটা ফের ফিরে এসেছে। কূপের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রিবিকাকে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে রিবিকা সতর্ক হয়। জলের তলায় সজোরে হাত এবং আঙুল নেড়ে জলকে সরব আর হিংস্র করে তোলে। জলের যেমন সুন্দর ধ্বনি আছে, ফোরাত আর হিদ্দেকলের নদীতে সুর আছে, আছে জর্দনে আর নীল নদীতে সংগীতের ধ্বনিমালা, পার্বত্য নদীগুলির গান আছে ঝিরিঝিরি, তেমনি সেই জলেই রয়েছে হিংসা। ভয়াবহ প্লাবনে সেই হিংসারই ছবি ভেসে ওঠে।

কূপের জল মায়াবী। রিবিকার প্রাণরক্ষা করেছে। ফের সেই জলকে হিংস্র করে তুলে তাই হয়েছে তার অস্ত্র। হিংসা দিয়ে হিংসা দমন করা একটা শিক্ষা বটে। কিন্তু একে দমন না বলে, বলা উচিত–হিংসা ঢাল এবং হিংসাই তরবারি। শুধু আত্মরক্ষার জন্য ইহুদের ঈশ্বর এই হিংসার পক্ষপাতী। কোমল আর মৃদু এই হিংসা আজকার এই জলের মত সত্য। একজন ক্রীতদাসের হিংসা এরকমই নরম আর মায়াবী হতে বাধ্য।

যবহের হিংসা কোমল আর মায়াবী। সীনয় পাহাড়ে তাঁর আত্মা রয়েছে। তিনি জ্বলে ওঠেন কিন্তু কখনও দাবানল ঘটান না। চোখে এই দৃশ্য দেখা যায়। হঠাৎ আকাশের তলা আর পাহাড়ের চূড়া রক্তিম হয়ে ওঠে। আগুন লাগে আকাশের গায়ে। অথচ আকাশ থেকে গন্ধক বৃষ্টি হয় না, মানুষ পুড়ে মরে না। যবহের পবিত্র চোখ থেকে আগুনের সংকেত বার হয়। যবহ পবিত্র নাম। মনে মনে তাঁকে ডাকতে হয়। তিনি বাবিলের স্বর্গ (জিগুরাত)-এর পতন হলে পিতা আব্রাহামকে ডেকে নিয়েছিলেন। মহাত্মা মোসিকে তিনি মিশর থেকে উদ্ধার করেন। যবহ এক রহস্যময় ঈশ্বর। তাঁর সংকেত আছে। জ্বলে ওঠা আছে, হিংসা আছে কোমল আর মৃদু। যবহ, কে? যবহ কেমন?

ইহুদ বলেন, তাঁকে দেখা যায় না। তিনি অদৃশ্য। তিনি সংকেতকারী। তাঁর উদ্দেশে নিশানমাসে ঢেরা-চিহ্ন আঁকতে হয় ঘরের দেওয়ালে। এই চিহকরণের ক্রিয়াপথ হল নিস্তার বা স্বস্তিকা। যারা চিহ্ন আঁকে তারা যবহের লোক। বান্দা। যবহের দাস কখনও ফেরাউনের দাস হতে পারে না। যবহ বলেন–আমি কে। এই প্রশ্ন করো না। আমি যা আমি তাই। আমার চিহ্ন যারা আঁকে তাদের আমি রক্ষা করি। বন্যা এবং খরার হাত থেকে নিস্তারীদের বাঁচাই। শিলা ও গন্ধক বৃষ্টি তাদের মাথার উপর হতে দিই না । উত্তরের পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলে তাদের হত্যা করি না। মরুভূমির তপ্ত হাওয়া ছড়িয়ে বালিঝড় দিয়ে ফসল এবং প্রাণ নষ্ট করি না। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত করি না আমার উপাস্যদের। মরুদস্যুর আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করি। আমি তোমাদের মুক্ত করি।

কিন্তু মহাপ্লাবনের কথা মনে আছে? আমি শুধুমাত্র নোহ এবং তার নিজের লোকেদের ত্রাণ করেছিলাম। কিস্তি (নৌকা) বানানোর বুদ্ধি আমি নোহকে দিয়েছিলাম। আমি বুদ্ধি এবং জ্ঞান দান করি। তোমার শত্রুদের জন্য বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, মরুলু, গন্ধক বৃষ্টি ঘটাই। ফেরাউনের ধ্বংসের জন্য এইসব দুর্যোগ সৃষ্টি করি। ভয় পেও না–কারণ নোহ ভয় পায়নি। নিস্তার-পর্বে ঢেরা-চিহ্ন আঁকো–আমাকে স্মরণ করো। তোমাদের গুণ-চিহ্নিত গৃহ আমি রক্ষা করব। আমি গন্ধক বৃষ্টির হাত থেকে আব্রাহামকে বাঁচিয়েছিলাম। বন্যার হাত থেকে নোহকে রক্ষা করেছি। আমি মোসিকে চূণ অবস্থায় তার মায়ের পেটে লালন করেছি। এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যে, ফেরাউন বুঝতে পারেনি মোসির মা গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার সমস্ত লক্ষণ আমি গোপন রেখেছিলাম। সেই স্ত্রীলোকের তলপেট এমনভাবে নির্মিত ছিল যে, মোসি যে রয়েছে তা বোঝার উপায় ছিল না। পেট ফোলেনি, স্বাভাবিক ছিল। নিয়মের এই বৈকল্য আমার ইচ্ছাধীন। নইলে সেই সময় ফেরাউনের নির্দেশ ছিল মোসির উম্মতদের যত স্ত্রীলোক গর্ভবতী হয়েছে, তাদের হত্যা করা হোক। আমি গোপন করতে পারি এবং প্রকাশ করতেও পারি। আমি ওই শিশুকে আগুনের ভিতর বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।

যখন ফেরাউনের সেপাই শিশুহত্যার জন্য প্রবেশ করল, আমি উনুনের ভিতর মোসিকে ঠেলে দিলাম। আগুন তখন নিবে গিয়েছিল। আমারই নির্দেশে আগুন নেবে এবং প্রজ্বলিত হয়। পাহাড়ে যে আগুন জ্বলে ওঠে–এ-সবই সেই সংকেত মাত্র। সেপাই সর্বত্র শিশু মোসিকে খুঁজেছে তন্নতন্ন করে, পায়নি। আমি তাকে উনুনের ভিতর রেখেছিলাম। উনুনে যে শিশু থাকতে পারে একথা শিশুর মা অবধি বিশ্বাস করেনি। কারণ আমিই তাকে গড়িয়ে দিই।

রিবিকা, তোমার মত সুন্দরী তন্বীকে আমিই কুপের ভিতর গড়িয়ে ফেলেছি, তোমাকে আমি কূপের অন্তরালে গোপন করেছি। জলকে হিংস্র করে তোলার বুদ্ধি আমিই তোমাকে দিয়েছি।

মোসি যখন তার দলবল নিয়ে লাল দরিয়া (লোহিত সাগর) পার হচ্ছেন তিনি তাঁর হাতের লাঠিকে ইশারা করেন, উত্তাল জলের উপর আঘাত করতেই জল দু’ভাগ হয়ে পথ সৃষ্টি হয়। সেই পথের উপর একখানা পাথর পড়ে ছিল, যবহ মোসিকে নির্দেশ করেন, আঘাত করো। মোসি তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে পাথরের উপর আঘাত করেন, পাথর দু’ভাগ হয়। যবহ মোসিকে এই লাঠি দান করেছেন। এই লাঠি দিয়ে তিনি মেষ চরান। মেষ যেমন লাঠির নির্দেশে একমুখে প্রবাহিত হয়, যবহ তাঁর উপাস্যদের সেইভাবে একত্রিত করেন, একাভিমুখী করেন।

ইহুদের হাতেও অনুরূপ একখানি লাঠি আছে। তিনি সেটি মাথার উপর ঘুরিয়ে বলেছিলেন–পাথর দু’ভাগ হলে দেখা গেল একটি ঘাস ফড়িং একটি ঘাস মুখে করে সমুদ্রের তলায় পাথরের ভিতর বেঁচে আছে। যবহ তাঁকে ঘাস যোগাচ্ছেন। এইভাবে তিনি গোপন করতে পারেন। রক্ষা করতে পারেন।

অথচ এলিফেনটাইনের ঢেরা-চিহ্নিত সমস্ত গৃহ এবং দুর্গটি মিশরীয়রা বেছে বেছে জ্বালিয়ে দিয়েছে। যবহ প্রেরিত মৃত্যুদূত ইহুদীদের রক্ষা করেনি। স্বপ্নদর্শী ইহুদ বলেছিলেন–সাত বছর দুর্ভিক্ষ হয়েছে, সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস। হল না–এ-সবই যবহের নির্দেশ–মিশরীয়রা দুর্বল হয়েছে এবার আমরা। কনানের দিকে চলে যেতে পারব। তাই সবাই চিহ্ন এঁকেছিল। নিস্তার পর্ব পালন করছিল। এই সময় অগ্নিসংযোগ করল মিশরীয়রা বাইরের শত্রু আক্রমণ করল ফের মিশরকে। লুঠ, হত্যা, ধর্ষণ চলতে লাগল। সবই কি যবহের নির্দেশ? আগুনের হাত থেকে মোসি বেঁচেছিলেন কিন্তু রিবিকাদের। কত প্রাণ চলে গেল! যবহ তাঁর বান্দাদের এমন শাস্তি দিলেন কেন?

রিবিকা কূপের তলায় আর্তনাদ করে উঠল–ঘাসফড়িঙের মুখে ঘাস জোগাও জানি, কিন্তু আমার বস্ত্র কেড়ে নাও। দেবী ইস্তার তো নাঙা থাকে। মহাত্মা ইহুদ!

যদি আমরা ঢেরা না আঁকতাম, আমাদের অনেকগুলি গৃহ বেঁচে যেত। চলার পথে মোসিকে যবহ যে লীলা প্রত্যক্ষ করালেন ওই পাথর দু’ভাগ করে, তার মহিমা যাই হোক, দেবী যে নগ্ন থাকে, এ তো মিথ্যা নয়। নগ্নতাই এখন বাস্তব, ধর্ষণের ফলে ছিন্ন রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ বাস্তব, দু’পা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়া বাস্তব, পথের উপর বিচ্ছিন্ন মস্তক, ওপড়ানো চোখ বাস্তব, উটের পিঠে চড়িয়ে বালিকাকে যৌনপ্রহারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলানো বাস্তব–মনে পড়ে। সবই মনে পড়ে। এবং উপরে প্রহরারত মৃত্যু অবাস্তব নয়।

আক্কাদ বলল–রিবিকা! আজ দোলের রাত! আমি যৌন-বিহারের জন্য পাঁচটি উট চাষার ছেলেদের ভাড়া দিয়েছি। উটের দোলনে রতিমোচন আনন্দদায়ক। একজন বুড়োলোকও এই রাতে বালিকাদের দিয়ে গা লেহন করায়। ওই দ্যাখো…

একটি চালার নিচে দৃশ্যটি দেখা গেল। এক বৃদ্ধকে দুটি নগ্ন নারী চাঁদের ছায়ায় লেহন করে চলেছে। সমস্ত বুক এবং যাবৎ অঙ্গ লালায় মথিত হচ্ছে। বুকের পাঁজর দ্রুত প্রকম্পিত হচ্ছে কামনাতাড়িত বাতাসে। শিঙা বেজে উঠল মন্দির চাতালে। বৃদ্ধের মুখ দিয়ে রক্ত উথলে এসে গলা ভিজে যাচ্ছে। বুড়োটি রোগগ্রস্ত। এই রোগ ছোঁয়াচে–অথচ দুটি তরুণী বধূ তাকে লেহন করছে। মৃত্যু এবং যৌনতা এত ঘনিষ্ঠ যে সহ্য হয় না। কাম এবং পুনর্জীবন তো ইস্তারের উপাসনা মাত্র। ফসলের জন্ম আর মৃত্যু আর জন্মই জীবন।

আঙুল তুলে দেখিয়ে আক্কাদ রিবিকাকে বলল–এসো! রিবিকা বলল–তুমি আমার পিতা। ক্ষমা করো!

আক্কাদ বলল–তুমি আমার কেনা। ক্রীত যা তাই হল দাসী। তোমাতে আমার অধিকার। পালক পিতা পালিতাকে এমনি কেনে না। কুঁজের এদিকে মাথা রাখো।

কবরের দিকে মাথা রেখে রিবিক মৃত্যু আর যৌনতার মাঝখানে ছটফট করে ক্রমাগত একটি অন্ধকার স্রোতে তলিয়ে যেতে লাগল। যেন ইস্তার চলেছেন পাতালে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *