মরুস্বর্গ – ২

০২.

মরু-হায়েনাটার গায়ে ভোরবেলার সূর্যের আলো এসে যখন লাগল, সে তখন অরণ্যের দিকে চলে গেল। কূপ থেকে উঠে এল রিবিকা। সূর্যদেব আটনের দিকে জলভরা দুই চোখ মেলে চাইলে সে। আমারনার বণিক নমরুর স্তোত্রোচ্চারণ মনে পড়ছিল তার।

‘দুনিয়ার সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা তুমি,
যা কিছুর অস্তিত্ব চোখে পড়ে এবং পড়ে না,
সমস্তই একা তুমি সৃষ্টি করেছ;
তোমার চোখের ভিতর থেকে যাবৎ মানুষ
বেরিয়ে এসেছে। তোমার মুখ থেকে
দেবতাগণ অস্তিত্ব লাভ করেছেন;
দেবতাদের মধ্যে তুমিই রাজা ॥”

[মিশরীয় প্রাচীন কবিতা]

মহাপৃথিবীর আকাশে তুমি কোথাও সামাশ, কোথাও-বা তুমি আটন অথবা আমন। তুমিই আমেন। ঈশ্বর। অথচ তোমার এই আকাশ অবধিহারা–সবখানে তুমি রয়েছ। রিবিকা বিড়বিড় করে বলল–নারীর কতটুকু লজ্জা পাওয়া উচিত হে দেবতা! মরুপথ দিয়ে রথ এবং অশ্ব পূর্বে পশ্চিমে ছোটাছুটি করছে–কখনও-বা নেমে আসছে উত্তরের পর্বতগাত্র বেয়ে। কারা এরা? কাউকে আমি চিনি না। কে শত্র কে মিত্র আমি জানি না। শুধু জানি আমার লজ্জায় পৃথিবী লজ্জা পায় না–পৃথিবী মানে ওই আকাশ, ওই পাহাড়, সমুদ্র, লাল দরিয়া, নীল নদী, আকাশচুম্বী পিরামিড, অথবা আলোকোজ্জ্বল নিনিভে নগরী, বাবিলের স্বর্গের সিঁড়ি, কেউ লজ্জিত হয় না–ম্লান হয় না দেবতা সামাশ। হা আমীন, হা আমীন, যুদ্ধশেষে যে জেতে, যুদ্ধের পাওনা এই নারী তার হয়। আমি কারো নই, আমার মূল্য মাত্র তিনটি পশুলোমের সমান।

আমারনার সূর্যমন্দিরে আমি ছিলাম সকাউৎসর্গীকৃত নারী। হা দেবতা, তুমিই আমার বর। তামুজদেব নয়, তুমি। দেবদাসী রিবিকাকে কে তোমার দাসী করেছিল মনে আছে? একজন সম্পত্তিশালী পুরুত! নমরু নামেমাত্র বণিক–আসলে সে ভূপতি। ঘরে অনেকগুলি বউ। আমি ছিলাম তোমার ভোগ্যা–হে দেবতা! অথচ তোমার নামমাত্র। মন্দিরে রেখে নমরুই আমাকে ভোগ করত। মানুষ দেবতার নামে যা দেয়, তা আসলে নিজেরই জন্য দখলে রাখে। দেবতার ছুতা না দিলে ক্রীতদাসী হালাল হয় না–অধিকারেও থাকে না। নারী ‘তাহলীল’ হয় আমনদেবের মন্দিরে, শুদ্ধ হয়। আক্কাদের এটো মাল দেবতাকে দিয়ে শুদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল নমরু।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম আলো-ঝরানো সূর্যের দিকে ফের চোখ তুলল রিবিকা। মরুপথ অশ্বের ক্ষুরের উৎক্ষিপ্ত ধূলায় একটা সমাচ্ছন্ন মেঘের মত পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। তারই আড়াল ধরে অরণ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে রিবিকা। তার আর চলবার শক্তি নাই। অথচ তার থেমে পড়ার মত কোন ছায়া সে দেখতে পাচ্ছে না। এইভাবে একলা পথ হেঁটেছিলেন মহাপিতা আব্রাহাম।

চন্দ্রকলাকৃতি ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব দিকের অসুর জাতি অতীতে পুনঃ পুনঃ যে বীভৎস আক্রমণ করে মিশর থেকে ইহুদের পূর্বযুগের মোসির উম্মতদের টেনে এনে তাদের নগরগুলিতে বন্দী করেছিল–সে এক ভয়াবহ আতঙ্কের ইতিহাস; আজও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। অসুররা কতবার যে মিশর আক্রমণ করেছে তার সঠিক হিসেব করা হয়নি। এরা পার্বত্য হিত্তীয়দের মতই। দুর্ধর্ষ। মিশরও কম যায়নি। প্রতি-আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু মোসির মত ইহুদও শান্তি চান। তাঁর অভিযাত্রা অবশিষ্টদের নিয়ে, যারা অসুরদের হাতে এখনও বন্দী এবং যারা আজও মিশরের ক্রীতদাস মাত্র। মোসির অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পন্ন করতে চান। তিনিও আব্রাহামের মত দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত থেকে অর্ধগোলাকৃতি পথে দক্ষিণ-পশ্চিম কিনারা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন।

এই পথে কাঠের তৈরি তেতলা সাঁজোয়া গাড়ি গেছে। বন্দীদের বহন করে নিয়ে গেছে অসুররা। নিনিভে নগরীর দিকে চলে গেছে সৈন্যবাহিনী, রথ আর পদাতিক। অশ্ববাহিনীর পদচিহ্ন পড়েছে পথে। এই দৃশ্য কত পুরনো, যুগযুগান্তর একই দৃশ্যের অবতারণা করছে নগরনির্মাতা মানুষ–কেন করছে। কিছুই বোঝা যায় না।

রিবিকা পথের দিকে চেয়ে আঁতকে উঠল। তার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেল।

সারি সারি খুঁটা পোঁতা–মানুষের মুণ্ডুহীন ধড় এবং কোথাও শুধুমাত্র গুচ্ছবাঁধা ছিন্ন মুণ্ড ঝুলছে। রক্ত টুপিয়ে পড়ছে বালির উপর লাশ পচে গলে পড়ছে, মরুশকুন আর শৃগাল খুঁটিগুলিকে ঘিরে গোল বৃত্ত রচনা করেছে, রিবিকা শৃগালগুলিকে হায়েনা ভেবে শিউরে ওঠে। পশুদের জিহ্বা লাল আর রক্তমাখা। শকুনের চঞ্চতে মানুষের হাড় আর পচা মাংস ধরা। সবই যেন মরুপথের চিরন্তন। দৃশ্য। এ-দৃশ্য কিন্তু রিবিকা এই প্রথম দেখল। অসুররা চিরদিন এভাবেই পথ অলংকৃত করে মৃতদেহ সাজিয়ে। অধিকাংশই পুরুষদেহ। আক্রান্ত জাতির পুরুষ। ধ্বংস করা একটা যুদ্ধনীতি। পুরুষকে শেকল পরিয়ে সাঁজোয়ায় তোলা বীরত্বের নমুনা। বন্দী করে কৃষিজমিতে চাষে জোড়া, পাথর কাটার কাজে নিয়োগ করা সবই যুদ্ধের উদ্দেশ্য। সুন্দরী মেয়েদের পুরুষহীন করা এবং ধর্ষণ করা এক ধরনের বিক্রম। মেয়েরাও শ্রমিক হয় দ্রাক্ষাক্ষেত্রগুলিতে।

কচি খেজুর রসের মত, নবীন সান্ধ্য রসের মত কৃষককন্যার গায়ের গন্ধ অসুরদের মুগ্ধ করে। যৌনতার এই মৌতাত তাদের সংগীতকে মাদকতায় পূর্ণ করেছে। মিশরীয়দের মত এরা ফুলের ঘ্রাণের উপমা প্রয়োগ করে না। ফোরাতের তীরেও একই ধরনের গান গাইত কিছু শ্রেণীর লোক। একটি খুঁটায় ঝোলানো নারীদেহ দেখে রিবিকার সেই গানের সুর মনে পড়ে। ভয়ে আর ত্রাসে সেই সুর পাখির ডানার মত মনের ভিতর ঝাঁপটায়-হৃদয়কে আঘাত করে।

রিবিকার দিকে পশুরা হিংস্র হলুদ চোখ মেলে তাকায়। রিবিকা ভয়ে অরণ্যের দিকে ছুটতে শুরু করে। ইহুদ কোথায় সে জানে না। খুটা পোঁতা পথ কতদূর গেছে সে জানে না। ইহুদকে সাঁজোয়ায় করে অসুররা তুলে নিয়ে গেছে কিনা তাও সে জানে না। ইহুদ চলেছিলেন পায়ে হেঁটে। তাঁর দল সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। রিবিকা হাঁটতে পারছিল না বলে দয়ালু ইহুদ তাকে উটের পিঠে চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর উটের পিঠে ছিল আরো কিছু রমণী–তারাও আর নেই। উটের সঙ্গে পায়ে হাঁটা লোকেরাও নিশ্চিহ্ন, নিশ্চয়ই। তারা খুঁটায় ঝুলছে অথবা বালির উপরে শুয়ে আছে, বেঁচে নেই। হতে পারে অসুররা নয়, হিত্তীয়রা মেরে ফেলেছে।

এমন অরণ্যও এই প্রথম দেখছে রিবিকা। সমুদ্রের ভেসে আসা স্বল্প মেঘ এই অরণ্য রচনা করেছে। ক্ষুদ্র অরণ্য। দূর থেকে সমুদ্রের তান ভেসে আসছে। বৃক্ষপত্রের মর্মরধ্বনিও বেজে চলেছে। দেবদারুগাছ, ঝাউ আর শালসেগুনের গাছ, তাল খেজুর বীথি আছে, পাশেই রয়েছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ। ফলবতী দ্রাক্ষা মৌমাছির পুঞ্জে গুঞ্জিত। একটি কৃষ্ণবর্ণ গাছের ছায়ায় আশ্রয় পায় রিবিকা। চারিদিক সৌরভে মুগ্ধ, আবিষ্ট। রক্তাক্ত নৃশংস মৃত মুণ্ডমালিকা-সজ্জিত পথ ছেড়ে এসেছে সে। রথ, অশ্ব, বর্শা, সাঁজোয়া, মরুকূপ, হায়েনা, শৃগাল শকুন–সেই ত্রাস এখানে নেই। দূরে রয়েছে মৌন সুদৃশ্য পাহাড়। অদ্ভুত স্তব্ধতা জমাট বেঁধে সৌরভ আর গুঞ্জনে ফুরিত করছে এক অপার সংগীত।

হঠাৎ রিবিকার চোখে পড়ল একটি বাচ্চা মেষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কালো কুঞ্চিত কেশ সারা গায়ে, কিন্তু ছোট ঘোট। মেষটির বয়স খুবই কম। মরুযাত্রীরা ফেলে চলে গেছে। মরুদস্যুরা ওকে নেয়নি। রিবিকার অত্যন্ত মায়া হল। সে ওকে ধরবার জন্য হাত বাড়াল–আ মসীহ! বলে দু’হাত সামনে প্রসারিত করল রিবিকা।

হাতের নাগাল থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাণীটি। মনে হল একে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে সে। এই প্রাণীই তার নগ্নতাকে আড়াল করতে পারে।

এক দেবদাসীকে ভালবেসেছিল এক মিশরীয় যুবক। নমরুর জোয়ান পুত্র আবীরুদ। আবীরুদ রোজ মন্দিরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। সূর্যমন্দিরের সামনের একটি গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকত সারা দুপুর। রাত্রে আসত চুপিচুপি। বলত–আমি তোমাকে দু হাত রাঙানোর প্রচুর মেহেদি পাতা দিতে পারি, ঠোঁট রাঙানোর জন্য দিতে পারি সুগন্ধি পাতা আর পা রাঙাবার প্রসাধন–সব দিতে পারি এবং দামাস্কাসের পাথরের মালা এবং আমাদের প্রসিদ্ধ আতর। আমার জন্য তুমি কি দুয়ার খুলবে না? আমি তোমার জন্য অশ্ব আর। সুর্মা প্রস্তুত রেখেছি। নীল নদীর উপর চাঁদ ঝুলে আছে–এসো আমরা সম্বন্ধ পাতাই। তুমি আমার বোন। এসো বিয়ে করি।

মুখে ছেলেটির এ ছাড়া কোন কথাই ছিল না। যেন মরু-দোয়েল। ক্রমাগত শিস দিয়েই চলেছে। মরু-চাতকের মতই ছিল আবীরুদের পিপাসা। পাখির সেই ডাকে মন খারাপ করত। পিরামিডের নিঃসঙ্গ চূড়াকে আর্তস্বরে প্রদক্ষিণ করত পাখিটি।

এই পাখিটিই যেন আবীরুদ। অথচ আবীরুদের সঙ্গে আপন বোন দীনার বিবাহ স্থির ছিল। ভূসম্পত্তি রক্ষা করতে হলে আপন বোনকে বিয়ে করাই বুদ্ধির কাজ। নমরু যখন জানতে পারল তার ছেলে তারই রক্ষিতা দেবদাসী রিবিকার। প্রেমে আসক্ত হতে চলেছে, তার হৃদয়ে পিরামিড ভেঙে পড়ল।

মিশরীয়রা উট পছন্দ করে না। কিন্তু অশ্বে তাদের অশেষ ভক্তি। কারণ যুদ্ধপ্রিয় হিত্তীয়রা অশ্বশিক্ষা জানে–অশ্ব সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং শক্তিশালী পশু। উট শ্লথগতি এবং বিকটদর্শন। একজন মিশরীয় যুবক যখন তার। প্রেয়সীকে অশ্বের কথা বলে, তখন সে তার আভিজাত্য আর আধুনিক মনের পরিচয় দেয়। রিবিকা ছিল উট-পূজকের রক্ষিতা এবং দেবী ইস্তারের মত দুর্ভাগা। ফলে তার সূর্যমন্দিরে আশ্রয় হয়েছিল। তার প্রতি একজন ভূপতি। সূর্যপুরোহিত আসক্ত হতে পারে, কিন্তু সে তার ছেলের সঙ্গে সেই ‘সদকা’ নারীর বিবাহ কস্মিনকালেও দিতে পারে না।

তথাপি একদিন রাত্রে আমারনার মন্দির থেকে রিবিকা আবীরুদের সঙ্গে ঐরাবত মন্দির (এলিফেনটাইন) দুর্গের এলাকায় অশ্বধাবিত হল। রাত্রির উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত নদী নীল। তারই কিনারা ধরে ছুটে চলল অশ্ব। বসন্তের দীপ্র হাওয়ায় রিবিকার মাথার চুল উল্লসিত আবেগে কম্পিত হল ছন্দে ছন্দে। সে আবীরুদকে পিছন থেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অশ্বের তীব্র বেগ সামাল দিচ্ছিল–এই তার অনিঃশেষ স্মৃতি, উষ্ণ আর উতল।

যখন মিশর আক্রান্ত হল, ইহুদের উম্মতরা নিস্তার-পর্ব পালন করল, নিশান-মাস এল–আগুন লাগল সিবিকাদের ঘরে ঘরে–আবীরুদ নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। একটি বর্শা এসে তাকে বিদ্ধ করে মাটিতে ফেলে দিল। সেই বর্শা ছুঁড়েছিল মিশরীয় বণিক পুরোহিত নমরু। অসুররা আবীরুদকে মারেনি। পিতার হাতে পুত্রের জীবননাশা হয়েছিল। নমরু থুৎকার দিয়ে বলেছিল–এ মাগী বেশ্যা। দেবতা আমন তোকে ঘৃণা করে। ইহুদ ছাড়া তোকে নেবার কেউ নেই।

আবীরুদের সঙ্গে খুব স্বল্প সময় রিবিকা একটি তাঁবুতে বাস করেছিল। এই জীবন যাপনের কোন মানে হয় না। আবীরুদ তাকে কোনদিনই ঘরে তুলতে পারত না। নমরু এই সম্পর্ক স্বীকার করবে কেন? মরু-যাযাবরের মত আবীরুদ তাঁবুতে দিন কাটাত-সঙ্গে সুন্দরী রিবিকা। এলিফেনটাইনের (ঐরাবত মন্দিরের) অধিবাসীরা তাদের সন্দেহের চোখে দেখত। এই জীবন কোনদিই মিশরের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পাবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। তবু সেই তাঁবুর জীবনে আকাশে মরু-চাতকের করুণ স্বর কখনও থামেনি।

লোকে আবীরুদকে ঠাট্টা করে বলত–অমন সুন্দর প্রাসাদ ছেড়ে ছেলেটা ওই পূর্বদেশী একটা ইস্তারীকে নিয়ে পড়ে আছে! দেবদাসীকে ঘরে তোলার সাধ্য তো নেই। আমনের বউকে গৃহ দিতে নেই, সে মন্দিরের সরকারী মাল । ছোঁড়াটা দু’দিন মধু লুটছে। আসলে ঘেন্নাপিত্ত থাকলে আমারনা থেকে পালিয়ে আসে-সঙ্গে একটা উটমুখী মেয়ে। হায়, একেই বলে ভ্যাগাবন্ডী! জীবনে হুতোশ লাগলে কে ঠেকায়!

ফেরাউনদের শবাধারলিপিতে খোদিত ছিল :

‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
কাউকে কষ্ট দিইনি। কখনও কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিইনি।’

মিশর রিবিকাকে কেবলই কাঁদিয়েছে। আবীরুদকে মেরেছে। চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে অশ্বারোহণের উদ্দাম চঞ্চল বেগবতী স্মৃতিই রিবিকার দহ্মানো জীবনকে আরো দন্ধেছে। জীবনের কোথাও সে আশ্বাস পায়নি জন্মাবধি। তার দেহে। খেজুর রসের নবীন স্বাদু ঘ্রাণ মিশরীয় আতরে মজ্জিত হয়েছে মাত্র–সেই সজ্জা, সেই রাতের গভীর উত্তেজক যাত্রা তাকে কাঁদায়।

ইহুদ তার পিঠে হাত রেখে মন্দ্রস্বরে বলেছিলেন–একটি মেষশাবক তোমায় পথ দেখাবে রিবিকা। সেই তোমার নিয়তি। কারণ মাসি সেই বাচ্চা মেযেদের ভালবাসতেন।

রিবিকা আবার ভেড়ার বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়াল। তার হাসি পাচ্ছিল স্বপ্নদর্শী ইহুদ অদ্ভুত কথা বলেন। তাঁর পয়গম্বরী রহস্যময়। তিনি স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা একটি পবিত্র দেশের কথা বলেন। মর্তের এক অমরাবতী সেই কনান। মধু আর দুধ বইছে তার মাটিতে, উপত্যকায় স্বর্ণশস্যে ম ম করছে হাওয়া।

এই সংগীতময় অরণ্যের মর্মর ব্যঞ্জিত সুঘ্রাত হাওয়া এসে রিবিকার নগ্ন ত্বকে স্পর্শ দিচ্ছিল। সমস্ত রাত্রির জাগরণের ক্লান্তি দু চোখে ঘুমের আবেশ এনে দিয়েছিল, সে আর চোখ তুলে চাইতে পারছিল না। তথাপি সে জোর করে দু চোখ প্রসারিত করল। ভেড়ার বাচ্চাটিকে ধরবার জন্য ছুটে গেল। বাচ্চাটি অরণ্যের ভিতর ছুটে যেতে লাগল।

রিবিকা অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেছিল। সে আর ভেড়াটিকে দেখতে পেল না। স্বপ্নদশী ইহুদের কথা কি সত্য? তাই যদি হবে তাহলে এই অরণ্যে পথ কোথায়? সে তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ অরণ্য আর যাই। হোক নিরাপদ নয়। মনে হচ্ছিল হিংস্র জন্তু রয়েছে, ডাকাতদল থাকতে পারে। যে-নারীর জীবনের দাম মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের ওজনের সমান–তাকে একটি মেষশাবক পথ দেখাবে কী করে? ইহুদ তাঁর ধর্মের প্রতীক মেষের কথা বলেছেন। মেষশিশু মানে সেই মসীহ, সীনয় পাহাড়ে যাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হয়েছিল। মুসা, মোসি, মসীহ।

হঠাৎ শিঙার আওয়াজ কানে এল রিবিকার। সে উৎকর্ণ হয়ে উঠল । আবোরা প্রবেশ করল ভিতরে। চোখে পড়ল তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি ভূমিক্ষেত্রে লোজন রয়েছে, তারা সৈনিকের পোশাক পরা এবং বিচিত্র রঙের বলিষ্ঠ অশ্ব চিৎকার করছে। রিবিকা ভয় পেয়ে পিছনে ফিরল এবং দ্রুত দৌড়তে লাগল। মেষশাবককে নিকটে আকর্ষণ করে। বস্ত্রখণ্ড তুলে নেয়। তার বুকে প্রজাপতির ডানা মৃদু স্পন্দনে যেরকম তার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন সেই ছন্দে স্পন্দিত। কিন্তু তবু সে এই জীবনকে বিশ্বাস করতে পারে না।

প্রজাপতি দুটি তার বুক থেকে উড়ে পালাবার ক্ষমতা রাখে না। ক্রমে মৃত্যুই স্বাভাবিক। মধুর লোভে যে এই দুটি প্রাণ এসেছিল তা সে বুঝতে পারে উপরে চোখ তুলে। বিরাট কালো মধুচক্র। যেন মেঘ। ক্ষুদ্র পিরামিড উল্টো করে। ঝোলানো, যেন ঝুলন্ত শিলা। টুপিয়ে পড়া মধু মৃত্যুসোমরস। কী বোকা রে তোরা! নারীর বুকের এই পুষ্পফুল্লতা মায়াবী, এ যে পুষ্পভ্রম মাত্র! যদি আক্কাদ। কখনও নারীর বুকে চন্দ্রোদয় দেখত অথবা পুষ্পকলিকার বিকাশ লক্ষ্য করবার প্রতিভা পেত! একজন মরুবণিক তা পারে না। তার তো মদ আর শুঁটকির কারবার। মরুর রঙ ধূসর। দামাস্কাস থেকে ফোরাতের তীরে বাসা বেঁধেছিল ঐশ্বর্যের লোভে কারবার ফলাবার জন্য। বোকা চাষীদের ঠকিয়ে মুনাফা করার জন্য। তার চোখে মেয়েমানুষ খরিদা সম্পত্তি, যুদ্ধে পরিত্যক্ত মাল। সে কখনও মিশরের শৃঙ্গার রসের কবিতা পড়েনি।

‘নারী তুমি মেষপশমের মত হালকা
তোমার দাম নেই, ওজন নেই–
তবু তোমাকে ফুলের বিনিময়ে খরিদ করা যায় না।
মরুশীতে উষ্ণপশম দিতে পারিনি প্রিয়া–
আতর আর সুর্মা তাই বৃথা গেছে। আমার তো
ফুলের বাজার–খদ্দের আসে না ।।’

ভূপতির ছেলে আবীরুদের মেজাজ আতর আর সুর্মার মেজাজ। কিন্তু প্রিয়ার জন্য শীতের পশম কেনার সামর্থ্যও তার ছিল না। তাঁবুর জীবনে পশুর লোম যোগাড় করা সমস্যা, কিন্তু সেই দুঃখকে সে সস্তা আতরে আর সুর্মায় এবং ফুলে ভরিয়ে তুলেছিল। অন্তত তার মুখের কবিতায় তার দারিদ্র্য আর বাদশাহীপনা। একাকার হয়ে যেত। বস্ত্রখণ্ড গায়ে জড়াতে জড়াতে সেই কবিতার সুর কানে ভেসে আসছিল স্মৃতির ধুনে। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল রিবিকা।

হঠাৎ তার চোখ চলে যায় সামনের দেবদারু গাছটির দিকে। আড়া থেকে একখানি পা বেরিয়ে এসেছে। সৈনিকের জুতা পরিহিত এই পা সে ‘মশরের মাটিতে দেখেছে। শরীরের তুলনায় এই পা সরু হয়, পাতা একটু বেশি লম্বা এবং ভারী, কিন্তু পাতার তুলনায় পায়ের উপর অংশ মিহি, অসুন্দর পা। এই পা মরুভূমিতে দ্রুত ছুটতে পারে। কিন্তু চোখ দুটি হয় ভেতরে ঈষৎ ঢোকানো, দয়ার্দ্র। সেই চোখ সুদূরাভিসারী। মুখ খুব সুন্দর এবং মায়াময়। ঠিক ঠাকুমার বিবরণ অনুযায়ী সারগনের পা। রাজচক্রবর্তী সারগন। বাদশা সারগন। মনে পড়ল, সারগন মরে, তবু সারগন মরে না।

লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ওর ক্ষুদ্র বর্শা। পিছনে একটা দীর্ঘদেহী। তুষারধবল অশ্ব। মনে হচ্ছে সাদা আগুন দাউদাউ করছে। লাগাম ধরা রয়েছে বাঁ হাতের আঙুলে। পিঠের দু’পাশে ঝুলন্ত রেকাব, পিঠে গদি আঁটা। অশ্বের মুখ ঈষৎ ফেনশুভ্র। লোকটি শৌখিন।

এ অশ্ব হিত্তীয় অশ্ব। লোকটির পা দুখানি দেখে বোঝা যায় মানুষটি অসুর নয়। কিন্তু মুহূর্তে আসুরিক ঘটনা ঘটে যায়। ক্ষুদ্র বর্শাটা নিক্ষিপ্ত হয় নিরীহ ভেড়াটির গায়ে এবং মায়াভরা শিশুমেষ মাটিতে গেঁথে গিয়ে পিছনের দু পা শূন্যে উঠে যায়, ছটফট করে, এত চকিতে ঘটে যে,ভেড়ার বাচ্চাটি মরবার আগে কাঁদবার সময় পায় না। তার হৃদক্রিয়া রুদ্ধ হয় নিমেষে। সে তাকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করে গেল, কিন্তু প্রাণ দিতে বাধ্য হল।

লোকটি বলল–আমি বিনিময়ে বিশ্বাসী। কাপড় দিয়েছি, ভেড়ার মাংস আমার। আশা করি দুঃখ পাওনি। অবশ্য এতটুকু মাংস কাকে দেব? আমার শিবিরে এখন আটাশজন সৈন্য কসরত করছে।

একটু থেমে লোকটি বলল–তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।

বলেই লোকটি বর্শায় গাঁথা মেষটিকে কাঁধে তুলল। তারপর রিবিকার খুব কাছে এসে দাঁড়াল-তোমাকে তাই বলে হত্যা করব ভেবো না। যারা তোমাকে এবং তোমার ভেড়াটিকে ছেড়ে গেছে, হয়. মরেছে, নতুবা পালিয়েছে, তাদের সরদার হয় সৎ পুরুত,নয় কপট মসীহ (নবী)। কারণ সৎ পুরুত ভীতু হয়, কপট মসীহ হয় কাপুরুষ। মসীহর হাতে লাঠি থাকে বটে, কিন্তু পথের বাঘ বা হায়েনা থোড়াও ডরায় না। যুদ্ধই জীবন-যুদ্ধ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। শিরোপা, পদাধিকার, সৌধ, একটি ছোট পাহাড়। সোনাদানা তো বটেই, খাদ্য পানীয় সুরা। এমনকী তোমার মত সুন্দরীদের। শৌর্য থাকলে পথের উপরই সব পড়ে থাকে। দেবতাদের ধন্যবাদ, এই জীবন যেন কখনও শেষ না হয়। ভাগ্যিস অসুররা মিশর আক্রমণ করেছিল! এসো!

বলে লোকটি ক্লিবিকার বুকের দিকে হাত বাড়াল। ঈষৎ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–তুমি আমার ভাষা বুঝতে পারছ না?

রিবিকা বলল–সব কথা পারিনি। তবে আমি অনেক ভাষা জানি। ভাষা বুঝে আমার লাভ নেই। আমাকে ছেড়ে দাও। আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমাকে ছোঁবে না। হাত সরাও।

সাদইদ বলল–খাওয়া-দাওয়ার পর তোমার ফের বাঁচতে ইচ্ছে করবে। একদণ্ড দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখেই তার বিশ্বাস স্থির হল যে ওরা দস্যুও হতে পারে, ফের দুর্ধর্ষ সৈনিকও বটে। এটা তাদের গোপন শিবির। অশ্ব এবং অস্ত্রচালনা, শিক্ষা করছে। এদের হাতে পড়লে তার আর নিস্তার নেই।

রিবিকা দিগভ্রান্তের মত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। তারপর এমন এক স্থানে এসে পড়ল যে,মনে হল এদিকে ওরা আর আসবে না। ওদের অশ্বধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না। ওদের দৃপ্ত গলার স্বরও অরণ্যের আড়ালে ঢাকা পড়েছে।

এবার রিবিকা আছাড় খেয়ে দেবদারুর তলায় পড়ে গেল দু চোখ শীতল ক্লাসের ছোঁয়ায় ক্লান্তিতে ক্ষুধায় বুজে এল। গাছে সুরেলা পাখি ডাকছিল। বাতাসে বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি উড়ছিল। কিছুই আর চেয়ে দেখতে পারছিল না রিবিকা। গাছের ডালে প্রকাণ্ড মধুচক্র ছিল–চক্রটি এত বড় যে, রিবিকা যদি দেখত হলে পুলকিত এবং ভীতও বোধকরি হতৃত্ব। তার নগ্ন বুকের উপত্যকায় মধুচক্র থেকে মধু টুপিয়ে পড়ল। স্তন ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে যেতে লাগল। সেই মধুর পতনে তার শরীর মৃদু মৃদু কেঁপে উঠছিল।

ঠিক এই সময় দুটি উজ্জ্বল রঙের, সেই রঙও অসাধারণ, প্রজাপতির জগতে এমন রঙদার ছবি খুব বিরল, সেরকম দুটি প্রজাপতি এল। এতবড় প্রজাপতিও সাধারণ নয়। মসীহ যদি এ প্রজাপতি পাঠিয়ে থাকেন, তবে এই নির্জন অরণ্যই সেকথা টের পেল। বুকের উপর, যেন দুটি রাঙা কুসুমের উপর বসছে এভাবে, সন্তর্পণে মধুলোভী প্রজাপতি, দুই সম তরঙ্গের প্রাণ চুপচাপ বসে পড়ল। প্রাচীন এ অরণ্য, বৃক্ষও নবীন নয়, বাতাস যে কবেকার সমুদ্রবিধৌত হয়ে আসছে কে জানে–এ নারী দেবী ইস্তারের মত দুঃখী আর বিষাদমথিত–এর মাথায় নীল ফিতে বাঁধা, যা নীল নদীর স্মৃতিবাসিত চিহ্নস্বরূপ, চোখ দুটি গভীর কালো পিরামিডের ছায়া ফেলেছে, যে সমস্ত রাত্রি মৃত্যুর সঙ্গে জলের হিংসা জাগিয়ে যুঝেছে, যে একদা উটের পিঠে কবরে মাথা রেখে পুরুষের দ্বারা যৌন-প্রহৃত হয়েছিল, যার আসক্তি নীল নদীর কিনারা ধরে ছুটে গিয়েছিল একদা নির্জন জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রিতে, যার বিবাহ হয়েছিল সূর্যদেব আমনের সঙ্গে, যার ঘর জ্বলে গিয়েছে ভস্মরূপে, মিশরীয়দের পুঞ্জীভূত ঘৃণা, পূর্বদেশের অবহেলা, কনানের ভাগ্যহত স্মৃতিই যার সম্বল, তাকে ফুলের মত সুন্দর দেখে দুটি কোমল বহুলরঙরঞ্জিত প্রজাপতি অধিকার করল–চন্দ্রকলাকৃতি ভূখণ্ডের ইতিহাসে এই তুচ্ছ দৃশ্যটি অবলোকন করেছিল যে, তার নাম সাদইদ। সে দেখেছিল নারীর নগ্নতাকে অলংকৃত করেছে দুটি ডানা-ছড়ানো রঙিন প্রজাপতি।

ভেড়ার বাচ্চাটি ঘুমন্ত রিবিকার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার হাঁটুর উপর মুখ বাড়িয়ে শোঁকে। ভেড়ার গরম নিঃশ্বাসে ঘুমন্ত রিবিকা চোখ মেলে। প্রথমে সে ভয় পায়, আর্তনাদ করতে গিয়ে ভেড়াটিকে দেখে থেমে যায়, পুলকিত হয়।

বলে—’আ মসীহ, তুমি এসেছো!’ মুখ দিয়ে কথা বার হতে না হতে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। ভেড়াটির পিঠে যত্ন করে ভাঁজ করা খুব মসৃণ কাপড়–সৈনিকের শরীরের বস্ত্রখণ্ড। শরীরে পেচিয়ে মসীহদের মত করে পরা যায়। ডান হাত উন্মুক্ত থাকবে, বাঁ কাঁধের উপর ফেলে দিলে পিঠে কোমর ছাড়িয়ে জানু অবধি ঝুলবে। সৈনিকরা কেউ কেউ বিশ্রামের সময় এই পোশাক পরে।

প্রথমে আহ্লাদিত হয়ে উঠলেও, রিবিকা ক্রমশ ভীত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার মুখ শুকিয়ে ওঠে। সে ভেড়াটির দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে সাহস পায় না। তার মনে হয় সে ফাঁদে পড়ে গিয়েছে। মেয়েরা আদিকাল থেকেই ভয় বা সংকোচ পাওয়ামাত্র চকিতে আপন বুকের দিকে তাকায়। যেদিন সে শরীরের উর্বভাগে কাপড় পরত না, সেদিনও সে চোখ আপন বুকের দিকে মেলেছে। মেয়েরা কখনওবা নরম পতঙ্গকেও ভয় পায়। হোক সে প্রজাপতি। যেন তার বুকে প্রাচীন আকাশের ইন্দ্রধুন ডানা মেলেছে। সূর্যদেবতা সামাশ আকাশে এই রঙ ছড়িয়ে দিতে পারেন। বৃষ্টির পর আকাশে তিনি ধনুকের সংকেত মেলে মানুষের জীবন-সংগ্রামের ছবি আঁকেন।

রিবিকা আপন স্তনযুগলের বর্ণপ্রলেপে ভয় পায়। আর্তস্বরে বলে ওঠে-মা গো!

মা আর দেবী ইস্তার এক্ষেত্রে একাকার। কোমল প্রজাপতি কিন্তু উড়ে পালাতে পারে না। মধুতে পাখা প্রলিপ্ত হয়েছে। দূর থেকে দেখলে সুশোভিত কাঁচুলির মত দৃশ্য হয়। এই প্রকৃতি শীতল, সালংকারা, বর্ণবিভাসিত। এই কি তবে মধুদুগ্ধের দেশসীমা! দৈবনির্দেশিত এই দৃশ্যে ভয় এবং আহাদ মিশে রিবিকাকে ক্রমে আশ্বস্ত করে! আবীরুদের হাতের আঙুলের চেয়ে কোমল এই ডানা আবীরুদের অঙ্গুরীয় বিভার মত রঞ্জিত। কী বিস্ময়! কী বিস্ময়!

রিবিকার কণ্ঠে আদরের ভেজা নরম স্বর নিরর্থক বেজে ওঠে। সে জানে না। এই দৃশ্যের কোন দর্শক আছে কিনা।

রিবিকার চোখে কৃতজ্ঞতার অরুণালোক খেলা করতে থাকে। তার গ্রীবায় প্রজাপতির রঙ লেগেছে; অস্তগামী সূর্যালোক যেমন নীল নদীতে ছায়া ফেলে মন্দিরগাত্রে ভেসে ওঠে, তেমনি এক ছবি। রিবিকা মনে করে জীবন অলীক নয়, রহস্যময় ঈশ্বরের দান–দেবী ইস্তার কাপড় না পেলেও মানুষ পায়। মসীহর সংকেতে ঘাসফড়িঙের বাঁচা, প্রজাপতির উড়ে আসা।

–এমন কেন হল? নিজের কাছেই এই প্রশ্নের বিস্ময় শেষ হয় না। সে বেশ! ছোঁব না। তুমি নিজে থেকেই ঘোড়ায় উঠে বসো। তুমি সুন্দরী না হলে, আমি সৈন্যশিবিরে ছেড়ে দিতাম। তাছাড়া সামান্য প্রজাপতি তোমার ইজ্জৎ রেখেছে, ক্ষুদ্র জীবেরা আমার শিক্ষক। আমি নরম প্রাণীদের ভালবাসি। আমার কথা তুমি বুঝবে না! আমি মসীহ (নবী) হলে এই কথাই তোমার আশ্চর্য লাগত। তোমার সরদারের নাম কী?

ঈষৎ বিস্ময়াপন্ন গলায় রিবিকা প্রায় অস্ফুটে বলল–ইহুদ। মহাত্মা ইহুদ।

সাদইদ ঘোড়র কাছে ফিরে এসে গদিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল–ও! সেটা একটা লাঠিধারী বটে! যাক গে! এখন যা বলছি শোন, আমার নষ্ট করার। মত সময় নেই। অসুররা যে-কোন সময় হামলা করতে পারে।

সহসা সাদইদের কাঁধে ধরা বর্শার বাঁটের দিকে চোখ পড়ে রিবিকার। বাঁটের কারুকৃতি অদ্ভুত। ডানামেলা প্রজাপতি কাঠে কোঁদা হয়েছে। শত দুঃখের মধ্যেও রিবিকার চোখে বিস্ময় ঝলসে ওঠে। লোকটি শৌখিন মাত্র নয়, কেমন যেন অন্যরকম। চোখ দুটি দয়াপূর্ণ এবং উদাসীন। গভীরও বটে। রিবিকা তথাপি রাগতস্বরে বলল–একজন সামান্য সৈনিকের কাছে দয়াই যথেষ্ট। মসীহর নামে ঠাট্টা করার স্পর্ধা তোমার মত নিষ্ঠুরের শোভা পায় বইকি। তুমি নিশ্চয়ই জানো লাঠি ঘোরালেই কেউ মোড়ল হয় না। তবে বর্শা ছুঁড়তে পারলেই ডাকাত হওয়া যায়।

তাই নাকি! সাদইদ তরুণীর মুখের দিকে সকৌতুকে চাইল। ক্ষণকাল চুপ। করে থেকে বলল–তুমি যে আমারনার দেবদাসীদের মত কথা বলছ দেখছি। তোমার পরিচয় জানতে পারি?

–তুমি দেবদাসীর ঘরে গেছ কখনও? পাল্টা প্রশ্ন করে রিবিকা।

–সে অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। দেবদাসীর চেয়ে সুন্দর মেয়ের আমার অভাব নেই।

–তবে আমায় ছেড়ে দাও। তোমার তো অনেক আছে।

–অনেক আছে বলেই তোমাকে আমার দরকার। যার আছে সেই তো রাখতে পারে!

–কিছুই থাকে না সেপাই। নানভী (নিনিভে) নগরীও ধ্বংস হবে! আর তোমার নরম ক্ষুদ্র প্রাণী শখের প্রজাপতিও বেঁচে নেই। আমার মত মেয়ের স্তনে মধু পড়লে তা বিষ হয়ে যায়, অত নরম প্রাণ কি বাঁচতে পারে! এই দ্যাখো … কিছুই থাকে না! যা দেখছ সব!

বলে অশ্বের কাছে এগিয়ে এসে রিবিকা গায়ের কাপড় দু হাতে সরিয়ে পিঠে মেলে দু হাত দু পাশে প্রসারিত করে দিলনাও দেখে নাও। আমি আমনের (সূর্যদেব) বউ, আমার তো কোন লজ্জা নেই! হায়েনাও আমাকে খেতে পারে না। সাত বছরের দুর্ভিক্ষেও আমি মরিনি। নাঙা মেয়ের চুলে নীল ফিতে বাঁধা–তাই দেখে কবিতা লিখবে এমন মানুষ নোহের সন্তানরা জন্ম দিতে পারে না। আর তোমার মত সৈনিক জীবনেও কাঁদতে জানে না। নাও, দ্যাখো, দ্যাখো!

সাদইদ যা গাছের আড়াল থেকে চুরি করে দেখছিল কিছুক্ষণ আগে, তা অতি নিকটে উদ্ভাসিত হতে দেখল। এমন রূপ সে কখনই দেখেনি। সে কোন প্রকার জাদু বিশ্বাস করে না। স্বপ্নদর্শীরা জলের উপর তেল ফেলে মানুষের ভাগ্য গণনা করে, পশুর মেটের আকৃতি, তেলের আকার দেখে ভাগ্য বলা তার কাছে হেঁয়ালি এবং অসত্য। কোন প্রকার নবীগিরি বা নবুয়তী সে পছন্দ করে না। কারুকে মাথার উপর লাঠি ঘোরাতে দেখলে পাগলা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়। সে যে-কোন প্রকারের গ্রাম্যতাকে ঘৃণা করে। দেবদাসীর প্রতি তার কণামাত্র আগ্রহ নেই। সে যুদ্ধের অর্জনকে সম্মানজনক ভাবে, নিনিভের ঐশ্বর্য আলো উদ্ভাসন তাকে লুব্ধ এবং ঈর্ষাতুর করে। তথাপি তার আজ মনে হল, এই। মেয়েটিকে সে পথে পেয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়নি এ তার ভাগ্য।

রিবিকার বুকের দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছিল না। তার কুসুকুলিকার মত রাঙা আঙুল স্তনের প্রলিপ্ত প্রজাপতির ডানাকে ছুঁয়ে তুলে ফেলে উড়িয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা করে–এই মুহূর্তে। এই মনোভাব কোন মসীহ বা ঈশ্বর জানতে পারে না। মানুষ সে অর্থে দেবতার চেয়ে দুর্গম।

রিবিকা সাদইদকে ভুল বুঝল। মনে হল, চোখে যতই দয়া থাক, এ নিশ্চয়ই এমন নির্জনতায় সম্ভোগ না করে ছাড়বে না। মসীহ যদি সহায় থাকেন, সম্ভোগের পর ছেড়ে দেবে। তখন সে মরুপথে কেঁদে বেড়াবে, তাই বেশ । তবু নিস্তার পাবে। মহাত্মা ইহুদকে সে কি পাবে না খুঁজে? সাদইদের গালে চড় মেরে বলল–অনেক দেখেছ, দেবদাসী দ্যাখোনি, না? কোন পুরুষের হৃদয়ে যুদ্ধের যুগে সত্য নেই সরদার। পুরুষ যে কখনও সত্য সৃষ্টি করেছে, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশে করেছে, তেমন দুএকজন ছাড়া আমার কে আছে? নাও, যা করবার করো। তুমি আমার মেষশিশুকে মেরেছ! প্রাণের উপর খুব মায়া তাই না, প্রজাপতির বন্ধু!

বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে সাদইদের পায়ের কাছে মাটির উপর বসে পড়ল রিবিকা। কান্নার চাপে তার বুক ভেঙে যেতে লাগল। শরীর কাঁপতে লাগল।

সাদইদ কিছুক্ষণ হতভম্বের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল রিবিকার। কান্নাভেজা দুহাত চোখের উপর থেকে সরিয়ে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদইদকে দেখল। তারপর গায়ের কাপড় সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

এবার সাদইদ খুশি হয়ে উঠল অকারণ। বলল–ওঠো! আমি লাগাম ধরে হেঁটে যাব।

রিবিকা প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব ঠিক শুনছে কিনা বুঝতে পারছিল না। হাসি মুখে খুব নরম করে সাদইদ বলল–উঠবে না? জিজ্ঞাসা করেই সে তার আঙুলে লেগে থাকা প্রজাপতির পাখার আসান লক্ষ্য করছিল। কিছুই থাকে না। একটি নগরী আঙুলের এই রেণুর মত শেষ হয়। তাই কি? কিন্তু আমি কখনই একথা মানতে পারি না। মনে মনে বলল সাদইদ।

রেকাবে পা রেখে বহুকষ্টে রিবিকা ঝুলে ঝুলে বেয়ে বেয়ে ঘোড়ার পিঠে। উঠল। সামনে লাগাম ধরে এগিয়ে চলল সাদইদ। অনেকক্ষণ দু’পক্ষই নীরব।

হঠাৎ সাদইদ মিশরীয় সেই কবিতা আউড়ে উঠল আপন মনে :

‘আমার ফুলের বাজার, তাই খদ্দের আসে না।
আমার নেই পশম, যা দিয়ে তোমায় রক্ষা করি,
ওহে প্রিয়া! মরুশীতে একটি বৃদ্ধ উট
আমার সঙ্গী! আতর আর সুর্মা কী হবে!
শুধু পশমের জন্য, আঙুর বাগিচার জন্য,
সবুজ উপত্যকার জন্য এ জীবন–আব্রাহাম!’

চমকে ওঠে রিবিকা! সে চুপিচুপি বুকের কাপড় সরিয়ে দেখে দুটি প্রজাপতিই স্পন্দনহীন। এ-স্থল ছুঁয়েছে ওই লোকটি!

কবিতার সুর সহসা সাদইদের গলায়।

সাদইদ বলল–তোমার এই ভেড়ার বাচ্চাটা যদি আমাদের শিবিরে না ঢুকে পড়ত, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হত না। ভেড়াটাকে দেখেই মনে হল, রাস্তায় নিশ্চয়ই কোন কাফেলা (মরুযাত্রীদল) যাচ্ছে। আমার সৈন্যরা যে যেমন পারল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেল ঘোড়া নিয়ে, মরুভূমির মধ্যে। আমি একা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আসছিলাম। তোমাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখে কী যে হল বলতে পারব না–কোলের বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলাম, ওর পিঠে চাপিয়ে দিলাম আমার ঘাড়ের কাপড়। ওকে এভাবে বর্শায় গেঁথে মারার আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না।

–তবে মারলে কেন? উদ্বেগের সঙ্গে বলল রিবিকা।

সাদইদ বলল–হিত্তীয় সৈনিকদের সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই। ওরা ক্ষ্যাপা কুত্তার মত মরুভূমি তোলপাড় করে যখন কিছুই পাবে না–জুমা পাহাড়ের ওদিকে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গিয়ে মদ খেয়ে দেবদাসীদের মন্দিরে পড়ে থাকবে দুদিন। যুদ্ধ যত ঘোরতর হয় দেবদাসীদের উপর ততই নির্যাতন বাড়ে। যুদ্ধের আধেক শক্তিই দেবদাসী। বিশেষ করে আমারনার মেয়েদের উপর বেশি লোভ।

–কেন?

–তারা সুন্দরী আর ওদের হাত-পা মোলায়েম। মিশর সুখী দেশ। চাষী ঘরে যারা মাঠে কাজ করে তারা গেঁয়ো হয় ঠিকই, হাত-পা শক্ত হয়, কিন্তু শহুরে দেবদাসীরা কামকলায় পটু আর লেখাপড়াও কিছুটা জানে, গান জানে। ওখানকার অভিজাতরা দেবদাসীদের যত্নে রাখে। একটা রাষ্ট্র কতটা ভাল তা বোঝার উপায় হচ্ছে দেবদাসী। যেখানে কবিতা-চৰ্চার চেয়ে কামকলার চর্চা বেশি হয়, জানবে সেটা ঐশ্বর্যশালী দেশ। কবিতা হল উটচালকের জিনিস, তারা তো চুটকিলা গায়, ঠুংরি জাতীয় গান করে।

–তুমি কী করো! সকৌতুকে জানতে চায় রিবিকা!

–আমি? বলে স্নান হেসে পিছনে ফিরে চাইল সাদইদ। তারপর সামনে চোখ মেলে চলতে চলতে বলল–আমি কী করি একটু পরেই বুঝতে পারবে। অকৃতজ্ঞতা হল যুদ্ধের শর্ত? তোমার ভেড়ার ওপর আমার কোনই কৃতজ্ঞতা ছিল না। থাকলে হত্যা করতাম না। আমি শিবিরে গিয়ে কোন কথাই বলব না, শুধু ভেড়াটা ছুঁড়ে দেব। একটা ভেড়া আর তোমার মত সুন্দরীকে পেলে ওরা চুড়ান্ত উৎসাহ পাবে। আমি ওদের পরিচালক। ওরা মরুভূমি ছুঁড়ে খালি হাতে ফিরেছে। ব্যর্থতার জ্বালায় জ্বলছে। আমি ওদের প্রশমিত করব। ওদের বোঝাতে হবে, রেগে উঠলেই হয় না, চোখ খুব তীক্ষ্ণ আর মাথাটা ঠাণ্ডাও। দরকার।

–তুমি আমাকেও ভেড়াটার সঙ্গে হত্যা করলে না কেন? অশ্বপৃষ্ঠে হাহাকার করে উঠল রিবিকা।

–মানুষ যে যুদ্ধে জেতে কেন জেতে, তলার ইতিহাস খুব কটু। একজন মহাপরিচালকের পক্ষে খারাপ দেখালেও তাকেও কতকগুলো ছোট কাজ করতে হয়। ভেড়া বওয়াটা নিশ্চয় খুব মর্যাদার কাজ নয়। তবু কেন বইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ।

–আমাকে ক্ষমা করুন। বলতে বলতে রিবিকার মাথা ঘুরে উঠল। সে ঘোড়ার গা খামচে ধরল।

সাদই বলে যেতে লাগল–তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে যে মন্দিরটা দেওয়া হবে, তা খুবই পরিচ্ছন্ন আর আধুনিক। সূর্যমন্দিরই পাবে তুমি । সূর্য যতদূর আলো ছড়ায় একজন সৈনিক আকাঙ্ক্ষা করে সে ততদূরই পৌঁছবে। কিন্তু সারগনও তা পারেননি। কিন্তু সূর্যের বর পেয়েছে দেবদাসী–সবখানে তার দেশ। মহাপিতা নোহের কাহিনী সবদেশে আছে, দেবদাসীর কাহিনীও মানুষের যুদ্ধের সঙ্গে জড়ানো–সর্বত্র আছে। মন্দিরে তোমাকে পাহারা দেবে সমর্থ একজন গামছাবালা। তোমার কাছে আসবে রাষ্ট্রনায়ক, মন্ত্রী। সত্যি বলতে কি তোমার জন্য মোতায়েন হবে গামছাবালা-এরা দালাল চরিত্র নয়। প্রহরী বলতে পারো। মিলনের আগে এবং পরে সেই গামছাবালা তোমার ও তেনার নানারকম সেবা করবে। লাঠিধারী যেমন পদবী, গামছাবালাও তাই।

শুনতে শুনতে রিবিকা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে খসে পড়ল। ক্ষুধায় এমনিতেই এত কাহিল ছিল যে, গা কাঁপছিল; তার কম্পিত হৃদয়ও আর চিন্তা করতে পারছিল না। পড়ে যাওয়ার শব্দে পিছনে ফিরে তাকাল সাদইদ। দেখল মেয়েটি মূৰ্ছা গিয়েছে। তার বুকের উপর থেকে কাপড় সম্পূর্ণ সরে গিয়েছে। একটি প্রজাপতিও আর জীবিত নেই। ভোরের এই অরণ্য আড়াল দেওয়া টুকরো টুকরো আকাশে প্রজাপতির রেণু মাখিয়েছে কে!

সে আপন মনে লজ্জা পেল, গামছাবালা যে পদবী সে যে দালাল নয়, একন নির্যাতিতার সামনে এসব এমন করে বিবৃত করা ঠিক হয়নি। মেয়েটিকে নিয়ে এখন সত্যিই সে কী করবে! মেয়েটি তো জানে না এই পুরুষটি আসলে কে–কী তার ভাগ্যের পরিচয়। গামছাবালা কথাটি কি আর সাধে সাধে মুখে আসে!

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। মহাপরিচালক কথাটাও কি কম পরিহাস্য! মর্যাদা! নিরীহ অসহায় নারীর কাছে মর্যাদার কথা! সামান্য একজন ভাড়াটে সৈনিক! যারা মিশর থেকে, আসিরীয় ভূখণ্ড থেকে, বাবিলন থেকে গুপ্তপথে, চোরাপথে পালিয়ে আসা সৈনিক, তারাই তার সহচর। একত্র দল গড়েছে–সেই দল ভাড়া খাটে, তারই পরিচালক সে। যুদ্ধ শেষ হলে কিংবা আসিরীয় নগরী নিনিভে ধ্বংস হলে তাদের আর কোনই দাম থাকবে না। যুদ্ধ থাক, কিন্তু নগরী যেন ধ্বংস না হয়। একটা বড় নগরী ধ্বংস হওয়ার পর কিছুকাল যুদ্ধ থেমে থাকে। বিজয়ী জাতি ভাড়াটে সেনাদের নিজের রাষ্ট্রে বন্দী করে আবার । স্বপ্নের পাহাড়, ক্ষুদ্র অরণ্য, মরূদ্যান, মন্দির, দেবদাসী–সব কেড়ে নেয়। যুদ্ধ থামলে আবার তাকে পার্বত্য নগরীর মধ্যে হিত্তীয় রাষ্ট্রের সৈন্যশিবিরে,নতুবা কোথাও ঠাঁই নিতে হবে।

অথচ কনান তার দেশ। মহামতি হিত্তীয় রাজা হিতেন তাকে এই যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার সময় খানিকটা স্বাধীনতা দিয়েছেন মাত্র। সে নিজের উদ্যোগে সৈন্যদল গড়েছে। তথাপি হিতেনের যুদ্ধবিদ্যা সাদইদের অধিগত হয়েছে হিতেনের বদান্যতায়–ফলে হিতেনের কাছে তার আনুগত্য প্রবল।

হিতেন সাদইদকে একটি ছোট পাহাড়, কিছু মন্দির এবং শিবির স্থাপনের জন্য এই সামান্য অরণ্য দিয়েছেন। এখানে ছোট একটি দ্রাক্ষাকুঞ্জ আর দুটি কূপ এবং ক্ষুদ্রাকৃতি মরূদ্যানের বিস্তার আছে। দ্রাক্ষাকুঞ্জের কাজ করে আহত সৈনিকরা–বিশ্রামের জন্য তাঁবু খাটায়। পাহাড় এখান থেকে পঞ্চাশযাট মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানেই রয়েছে নতুন মন্দিরগুলি। হিটাইটরা (হিত্তীয়) অশ্ব চালনাতেই কেবল পারঙ্গম, তাই নয়, এরা মাটির ইট, বালির তাপে শক্ত করে নিয়ে বাড়ি তৈরি করতেও পারে। সেই গৃহগুলি পাথর এবং ইটের প্রস্তুত। ঠিক সেইভাবেই তারা মন্দির গড়েছে।

এইসব মন্দিরগৃহ উপাসনার জন্য তৈরি নয়। সৈনিকরা এখানে দেবদাসীদের হাতে মদ্যপান এবং রাত্রিবাস করার জন্য আসে; আক্রান্ত জাতির সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে দেবদাসী করা হয়। তারা অধিকাংশই পুরুষহীন। তাদের পুরুষরা হয় যুদ্ধে নিহত, নতুবা জেল খাটছে অথবা পঙ্গু। যুদ্ধে ক্রমাগত পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে দেবদাসীদের সংখ্যা দিনে দিনে অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে।

একটি নগরীর শ্রীবৃদ্ধি মানে দেবদাসীর সংখ্যা-বৃদ্ধি। দেবতা সামাশের জয়জয়কার। নারীকে পুরুষহীন না করতে পারলে সৈনিকদের জন্য দেবদাসী সরবরাহ করা যাবে না। দেবদাসী না থাকলে সৈনিকরা যুদ্ধ করবে না। দেবদাসীর সংখ্যা বাড়লে মন্দিরের সংখ্যা বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে গামছবালার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। পরাধীন রাষ্ট্রের পুরুষদের জন্য গামছা কাঁধে করা চাকরি নির্দিষ্ট। হয় সে দ্রাক্ষার মদ বানাবে, নয় গামছা কাঁধে ফেলে টুলের উপর বসে থাকবে দেবদাসীর মন্দিরের দরজার কাছে। আবোবদনে এইধারা বসে থাকাই হল সভ্যতার চিহ্ন। যে দেবদাসীর সৌন্দর্য যত বেশি তার গামছাবালার চাকচিক্যও তত বেশি।

সংজ্ঞাহীন রিবিকার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে জীবনে এই প্রথম সাদইদের মনে হল, দেবদাসীদের পাড়ায় এই মেয়েটির খুব কদর হবে। কিন্তু এই মেয়েটিকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তুলতে সাদইদ বুকের মধ্যে কেমন একধারা কষ্ট অনুভব করছিল।

ঠিক সে জানে না, এই কষ্টটাই বা কিসের! এমন তো কখনও হয়নি। যার পুরুষ নেই, তার তো ঈশ্বর আছেন! গামছাবালা এবং পুরুত আছে। সর্বোপরি সৈনিকদের আদর-সম্ভাষণ তো রয়েছেই। সাদইদ কূপ থেকে মাথার টুপিতে করে জল বহে এনে রিবিকার মুখে প্রক্ষেপ করতে করতে ভাবল–আমি না হয় দেবদাসীর ঈশ্বরকে অথবা যে কোন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না–তা বলে আমনদেব সূর্য তো মিথ্যে হয় না। সে প্রতিদিন আকাশে আসে। ঈশ্বর যবহ পাহাড়ে বসে চোখ রাঙায়। দেবতার আশীর্বাদে একজন প্রথম শ্রেণীর দেবদাসী কত সমাদৃত হয়। নগর রাষ্ট্র ধ্বংস হয়, তেমন রূপসী দেবদাসী ধ্বংস হয় না। একটি নগর শেষ হলে আর-একটি নগর জেগে ওঠে। বিজয়ী রাষ্ট্র-পুরুষ সবচেয়ে সুন্দরীকে অশ্বে তুলে নিয়ে চলে যায়।

মেয়েটিকে বলতে হবে–সে যেন কোন সৈনিকের প্রেমে না পড়ে। তার নিজের দাম বোঝা উচিত। সৈনিক আজ আছে কাল নেই। আজ রাতে যে সৈনিক এই মেয়েটির পাশে শুয়ে রাত কাটালোকাল ভোরেই তার মৃত্যু হতে পারে। অসুররা যে কখন কার প্রাণ নেবে বলা তো যায় না। ভাড়াটে সৈনিকের দেশ নেই, রাষ্ট্র নেই, জীবনের স্থায়িত্ব নেই। তার চুক্তিরও কোন দাম নেই। আজ সে মিশরের পক্ষে, কালই সে অসুরদের তরফে। একটি ছোট পাহাড় দেখে একটি নগরীর কল্পনা করা কী বোকামি! সাদইদ তার পাহাড়টির দিকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একবার চাইল। তারপর আবার রিবিকার জলসিক্ত মৃদু কম্পিত মুখের রেখার দিকে চাইল। এই মেয়েটি তাকে প্রজাপতির বন্ধু বলে ঠাট্টা করেছে। অত্যন্ত উর্বর-মস্তিষ্ক না হলে, অমন বাক্য মুখে আসত না। যার রূপ প্রখর আর মিন্ধ এবং বুদ্ধি প্রখরতর,তাকে দেবী ভাবলে অন্যায় হয় না । দেবী যে আকাশে থাকে না, সাদইদের এ হল গভীর বিশ্বাস!

একজন দেবী কখনও এত স্পষ্ট নয়, যা প্রত্যক্ষ তাই সত্য। যা বোঝা যায়, তাই সত্য এবং সুন্দর। প্রজাপতি এই সুন্দরীকে অধিকার অকারণ করেনি। সাদইদ দেখল, রিবিকার চোখের পাতা ঘন-ঘন নড়ে উঠছে। সে চেতনা ফিরে পাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *