ভৌতিক বাদুড় বৃত্তান্ত
গুণধর বলল,-একটা কথা বলি দাদাবাবু! বাদুড়কে রাতবিরেতে কক্ষনো বাদুড় বলবেন না। বলবেন রাতপাখি।
অবাক হয়ে বললুম,–কেন বলল তো গুণধর?
গুণধর হাসল।–এ তো সোজা কথা দাদাবাবু। কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বললে রেগে যায়। সাপকে কেউ কি সাপ বলে। বলে, পোকা। বাঘকে বলে, বড়মিয়া। ভূতপ্রেতের নাম ধরে কি কেউ ডাকে? বলে–ওনারা। বাদুড় বড় অমঙ্গুলে জীব দাদাবাবু, কক্ষনও রাতবিরেতে ও নাম মুখে আনবেন না।
–আহা, বাদুড় অমঙ্গুলে কেন?
–প্রথম কথা হল, বাদুড়ের সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার। সবাই পা নিচে আর মাথা ওপরে করে দাঁড়ায়। বাদুড় দাঁড়ানো তো দূরের কথা, পা ওপরে মাথা নিচে করে উল্টো হয়ে ঝোলে। দ্বিতীয় কথা হল, বাদুড় উড়তে পারে। কিন্তু দেখুন, যারা ওড়ে তারা ডিম থেকে জন্মায়–অথচ বাদুড় ডিম থেকে জন্মায় না। তার চেয়ে বড় কথা, বাদুড় মায়ের স্তন থেকে দুধ খেয়ে বড় হয়। এসব সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড না দাদাবাবু?
কথা হচ্ছিল বাদুড় নিয়ে। কারণ কিছুদিন থেকে দেখছি, খেলার মাঠের ধারে পুরোনো শিবমন্দিরে দেয়াল ফাটিয়ে-ফাটিয়ে যে গাছটা উঠেছে, তার ডালে একটা বাদুড় ঝোলে। ছেলেরা সন্ধ্যার মুখে খেলা শেষ করে চলে গেলে মাঠটা যখন নিরিবিলি ভৌতিকবাদুড় বৃত্ত হয়ে ওঠে, তখন বাদুড়টা অদ্ভুত চিৎকার করে আমার দিকে ছুটে আসে এবং আমি সরে বসার আগেই চঁটি মেরে উড়ে যায়।
কদিন এই জ্বালাতন সহ্য করার পর আমাদের বাড়ির কাজের লোক গুণধরকে (আমরা ওকে চাকর বলি না–বলতে নেই।) ব্যাপারটা বললাম। বাদুড়টাকে তাড়াতেই হবে। এজন্য ওর সাহায্য দরকার। কিন্তু গুণধর এইসব কথা বলে আমাকে ভড়কে দিল। শেষে বলল, সন্ধেবেলা একা-দোকা নাইবা গেলেন ওখানে? রাতপাখিটা যখন আপনাকে পছন্দ করছে না তখন না যাওয়াই ভালো।
আমার জেদ চড়ে গেল মাথায়। দিনের বেলা বাদুড় চোখে দেখতে পায় না। সকালবেলা একটা ছোট্ট লাঠি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাড়িটা এই মফস্বল শহরের শেষ দিকটায়। খেলার মাঠ পেরিয়ে ভাঙা শিবমন্দিরের কাছে গিয়ে দেখি হতচ্ছাড়া বাদুড়টা ঝুলছে, লাঠিটা জোরে ছুঁড়ে মারলাম তার দিকে। অমনি বিকট চিৎকার করে নিচে পড়ে গেল। তখন মায়া হল বড্ডসামান্য একটা কারণে বেচারিকে মেরে ফেললুম?
বাদুড়টা মরেনি কিন্তু। ঘাসের ওপর চিত হয়ে চুপচাপ পড়ে রয়েছে। চকচকে লালচোখে তাকিয়ে আছে। দাঁত বের করা বেজির মতো মুখ। দেখে একটু ভড়কে গেলুম। বাদুড়টাকে বড় ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। ঠোঁটের একপাশে খানিকটা রক্তও জ্বলজ্বল করছিল। মুখে একটু জল দেব ভাবলুম। কিন্তু এমন হিংসে বিটকিলে মুখের দিকে তাকাতে দিনদুপুরেই গা ছমছম করছে যে। হঠাৎ সেই সময় মন্দিরের পাশ থেকে জটাজুটধারী এক সাধু বেরিয়ে এলেন। তারপর ব্যাপারটা দেখেই গর্জন করে বললেন,–আরে আরে দূরাচার পাপিষ্ঠ। তুই আমার বাহনকে বধ করেছিস? অভিশাপ লাগবে তোর। তুই উচ্ছন্নে যাবি।
আমি বেগতিক দেখে হন্তদন্ত হয়ে পালিয়ে এলুম মাঠ পেরিয়ে। আর পিছু ফিরে দেখার সাহস ছিল না।
সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে খেলার মাঠে আর গেলুম না। ওটা ছিল আমার প্রিয় বেড়ানোর জায়গা। কী জানি, যদি সেই রাগী সাধুর পাল্লায় পড়ি, অভিশাপের ভয়ে না হোক–খামোক একটা ঝগড়াঝাটি বেধে যেতেও পারে। প্রথম দর্শনে ভড়কে ছিলুম বটে। দ্বিতীয়বার আর ভড়কাব না।
অনেক রাতে কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শরৎকালে বড় মশার উপদ্রব। মশারির ভেতর শুয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল মশারির ছাদে একজোড়া লাল জ্বলজ্বলে চোখ আমাকে দেখছে তারপর মশারির ছাদটা নেমে এল কিছুটা। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছিল। লাল জ্বলন্ত ভাটার মতো দুটো চোখ আমার মুখ থেকে মাত্র দেড়ফুট ওপরে। ঝটপট বেডসুইচ টিপে দিতেই উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল। তারপর ঘরের ভেতর তুমুল ঝটপট শব্দ।
সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, ওটা সেই বাদুড়ই বটে। আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে গেল। ভয়জড়ানো গলায় ডাকলাম,–গুণধর। গুণধর! গুণধর!
গুণধরের সাড়া পেয়ে সাহস হল। মশারি থেকে মাথা বের করে দেখি কোণার দিকে বাদুড়টা চিত হয়ে রয়েছে। মশারি থেকে বেরিয়ে সাবধানে তার পাশ কাটিয়ে দরজা খুলে দিলুম। গুণধর বলল, কী হল দাদাবাবু? কু-স্বপ্ন দেখছিলেন বুঝি?
–না, না সেই বাদুড়! ওই দেখো, এবার আমার ঘরে এসে ঢুকেছে। গুণধর জিভ কেটে বলল, চুপ, রাতপাখি বলুন, রাতপাখি। সে উঁকি দিয়ে বাদুড়টাকে দেখে দু-পা পিছিয়ে গেল। তারপর আমাকে হাত ধরে টেনে বের করল ঘর থেকে। শেষে দরজা আটকে দিল।
এটা বাইরের ঘর। আমাদের কথাবার্তা শুনে বাড়ির লোকদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বড়দা, মেজদা, সেজদা এবং বউদিরা সদ্য ঘুমভাঙা মুখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারপর ঘরে বাদুড় ঢুকেছে শুনে সবাই হাসতে লাগলেন। বড়দা পরামর্শ দিলেন, চুপচাপ শুয়ে পড়গে যা। তারপর সবাই চলে গেলেন।
চলে তো গেলেন, আমরা এখন কী করি? গুণধর কঁপা গলায় বলল, আপনার ওপর ওর কেন নজর পড়ল কে জানে। এটা মোটেই ভালো ঠেকছে না।
বললাম,-এক কাজ করা যাক। একটা লাঠি আনন। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেছে ওর। নড়াচড়া করতে পারছে না। তুলে জানালা গলিয়ে ফেলে দেব।
গুণধর নিমরাজি হল। কিন্তু সাবধান দাদাবাবু। বলে সে একটা লাঠি এনে দিল।
দরজা খুলে কিন্তু আর বাদুড়টার পাত্তা পেলুম না। ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলুম টর্চ জ্বেলে–শোফা, টেবিল, আলমারির তলা বা পেছন দিক, ফ্যান, কোথাও নেই। গুণধর কিছুতেই ঘরে ঢুকল না। ওর ওপর রাগ করে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লুম। বেডসুইচ টিপে আলো নেভালুম বটে, কেমন একটা অস্বস্তি জেগে উঠেছিল। ঘুম এল না। বারবার মশারির ছাদে চোখ পড়ছিল। পাশে লাঠিটা রেখেছি। জ্বলন্ত চোখদুটো দেখলেই লাঠির গুতো মারব–যা থাকে বরাতে।
চুপচাপ শুয়ে আছি। কতক্ষণ পরে জানালার দিক থেকে চাপা শব্দ হল। মশারি থেকে নিঃশব্দে মুখ বের করে সেই জানালার দিকে টর্চের আলো জ্বেলে দিলুম।আঁতকে দেখলুম, জানালার রডের ফাঁকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে আছেন সেই জটাজুটধারী সাধুবাবা। তাঁর জটা আঁকড়ে কানের পাশে ঝুলছে সেই বীভৎস বাদুড়। সাধুবাবা হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এক সেকেন্ড মাত্র। তারপর টর্চ নিভে গেল, বোতামে আমার আঙুল অবশ হয়ে গিয়েছিল আসলে। ফের যখন বোতাম টিপলুম, দেখিসাধুবাবা নেই। জানালা ফাঁকা! ঝটপট বেরিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিলুম। বাকি জানলাগুলো বন্ধ ছিল।
বাকি রাত আর ঘুম হল না। এমন আতঙ্কের রাত কখনও আসেনি।
সকালে গুণধরকে চুপিচুপি সাধুবাবার কথাটা বলতেই হল। গুণধর আরও ভড়কে গিয়ে বারবার মাথা নেড়ে বলল, ভালো নয়–মোটে ভালো ঠেকছে না। কাজটা ভালো করেননি দাদাবাবু! বরং শিবের থানে গিয়ে ওনার কাছে ক্ষমা-ভিক্ষে করে নিন।
সেদিন দুপুরে আমার জ্বর এল কম্প দিয়ে। অফিস থেকে রিকশো করে বাড়ি চলে এলুম। ঋতু পরিবর্তনের ফলে জ্বরজ্বালা হতেই পারে। কিন্তু গুণধর সব ব্যাপার বাড়ির সবাইকে শুনিয়ে দিল–সে এবার আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল।
জ্বরের ঘোরে বারবার সেই কালো রঙের লালচোখো বাদুড়টাকে দেখে গো গোঁ করছিলুম। মা কান্নাকাটির চূড়ান্ত করলেন। বাড়িতে সবার মুখে আতঙ্কের ছাপ। দুদিন-দুরাত্রি ধরে জ্বরটা থাকল। কিন্তু আমার অবস্থা শোচনীয়। যখনই চোখ বুজি, বীভৎস বাদুড় কখনও সেই সাধুবাবাকে দেখতে পাই। স্বপ্নেও সাধুবাবার জটায় বাদুড়টা ঝুলিয়ে আমাকে অভিশাপ দেন। ঘুম ভেঙে দেখি, গলা শুকিয়ে গেছে। মা শিয়রে জেগে থাকেন। জল খাইয়ে দেন।
জ্বর ছাড়ার দিন শুনলাম, মা এবং বউদিরা গিয়ে শিবমন্দিরে সাধুবাবাকে খুঁজেছেন। তাঁর দেখা পাননি। অগত্যা মন্দিরে পুজো দিয়ে চলে এসেছেন। মন্দিরের ফাটলে গাছে ওঁরা বাদুড়টাকে দেখতে পাননি শুনে আশ্বস্ত হলাম। মা ভৎর্সনা করে বললেন, ছি! এমন বয়সেও ছেলেমানুষি গেল না খোকা! পাখপাখালি মারতে আছে? সেই ছেলেবেলায় মতো দুষ্টুমি এখনও ছাড়তে পারলি না?
আরও তিনটে দিন অসুস্থ হয়েই কাটল। কিন্তু এই কদিনে বাদুড়টা বা সাধুবাবার ভুতুড়ে উৎপাত আর ঘটল না।
গায়ে জোর এলে একদিন বিকেলে অনেকদিন পরে খেলার মাঠে গিয়ে বসলুম। এক সময় মাঠ নির্জন হয়ে গেল। সন্ধ্যায় ধূসর রঙে ঢেকে গেল চারদিক। একটু দূরে শহরের রাস্তার আলো জ্বলে উঠল। বাদুড়টা যদি উড়ে এসে আমাকে চাটি মারে, আজ প্রতিবাদ করব না। বাদুড়ের চাটি খেয়ে মারা পড়ে বলে শুনিনি। মারে তো মারুক না কয়েকটা ঠাটি! মশার উপদ্রব শুরু হল এতক্ষণে। শিশিরও জমছে। ফের জ্বরজ্বালা বাধানোর ভয়ে এক সময় উঠে পড়তে হল। আর সেই সময় মন্দিরের দিকে একটা চিৎকার শোনা গেল। সঙ্গে টর্চ ছিল। তক্ষুনি বোম টিপলুম। তারপর একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য চোখে পড়ল।
সেই সাধুবাবার গলা কামড়ে ধরে ঝুলছে বীভৎস বাদুড়টা আর সাধুবাবা তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। মুখে অদ্ভুত একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে।
আমার দৌড়ে যেতে-যেতে সাধুবাবা সশব্দ পড়ে স্থির হয়ে গেলেন। বাদুড়টা ডানা ঝটপট করে উড়ে অন্ধকার আকাশে মিলিয়ে গেল।
আমার ডাকাডাকিতে, খেলার মাঠের ওপাশের বস্তি থেকে লোকেরা আলো আর লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে এল।
কিন্তু আশ্চর্য, লোকগুলোকে দ্রুত ঘটনা বলার পর ঘুরে দেখি, সাধাবাবু নেই। চারপাশে খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে দেখা গেল না। তখন লোকগুলো হাসাহাসি করতে থাকল। একজন বলল, ওরে দাদাবাবু একলা বেড়াতে এসে ভয় পেয়েছেন!
ওরা চলে গেলে আমি ব্যাপারটা ভাবতে-ভাবতে বাড়ির দিকে চললাম। আগাগোড়া সবটাই আমার চোখের ভুল? বাদুড়ঘটিত ঘটনার এই উপসংহারটুকু আমি গুণধর বা বাড়ির কাউকে আর বললাম না।
তবে এতকাল পরে মনে হয়, আসলে ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভৌতিক। দৈবাৎ কীভাবে ভূতদের জীবনে ঢুকে পড়েছিলুম এবং তার ফলে কিছুটা ভুগতেও হয়েছিল। ভূতেরা সত্যি বড় অদ্ভুত।