ঘুঘুডাঙার ব্রহ্মদৈত্য
ভূতের স্বপ্ন তো সবাই দেখে! তাই বলে কি ভূত বিশ্বাস করতে হবে? এই হচ্ছে ভবভূতিবাবুর স্পষ্ট কথা। তিনি যৌবনে দুর্দান্ত শিকারি ছিলেন। বনে জঙ্গলে পোড়ো-বাংলোয় ঘুরেছেন। কোথায় ভূত?
তার বন্ধু গজপতি গোঁ ধরলেন,–আজকাল এই ভিড়-হল্লা-আলো আর যন্তরের ঠেলায় বেচারি ভূতেরা থাকবে কোথায়? তাই মানুষের স্বপ্নে গিয়ে আড্ডা নিয়েছে। গজপতি আরও বলেন, উপায়টা কী? মানুষের হাতে আজকাল কতরকম জব্বর অস্ত্রশস্ত্র। অ্যাটমবোমা, হাইড্রোজেন বোমা, নিউট্রন বোমা। তার ওপর কতরকম সাংঘাতিক ওষুধপত্র বেরিয়েছে। তাই ভূতেরা মানুষের স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গিয়ে নিরাপদে কাটাচ্ছে। স্বপ্নে মানুষ তো একেবারে অসহায় বুঝলে না?
ভবভূতি তা মানতে রাজি নন।
বলেন,–হ্যাঁ, একথা সত্যি, সুন্দরবন বাঘ প্রকল্পের মতো রামচন্দ্রপুর ভূত প্রকল্পের এক অদ্ভুত অভয়ারণ্যের স্বপ্নে ভ্রমণ করে এসেছি। কিন্তু স্বপ্ন ইজ স্বপ্ন। অর্থাৎ স্বপ্ন জিনিসটা জলজ্যান্ত মিথ্যে। যাকে পদ্যে বলে, আপন মনের মাধুরী।
মাধুরী?–বলে গজপতি চোখ কটমট করে তাকান। মাধুরী বলছ?
গজপতিকে অমন করে তাকাতে দেখে ভবভূতি বাকা হেসে বলেন, আলবাত মাধুরী।
গজপতি বলেন,–মাধুরীকে তুমি চেনো?
ভবভূতি অবাক, কী কথায় কী বলেন তার মানে?
–মাধুরী ছিলেন আমার পিসতুতো দিদি। তাঁর বিয়ে হয়েছিল ঘুঘুডাঙায়! জামাইবাবু ছিলেন রেলের গার্ড। অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তারপর
কিস্যু বুঝলাম না। ভবভূতি বাধা দিয়ে বলেন।
বিরক্ত গজপতি বলেন, কথা শেষ করতে দেবে তো? খালি তক্ক আর তক্ক। ঘুঘুডাঙা রেল ইয়ার্ডের ওদিকে এক একর জায়গায় একটা বাড়ি ছিল জামাইবাবুর। পৈতৃক বাড়ি। ওর মৃত্যুর পর সেই বিশাল বাড়িতে একা মাধুরীদিদি থাকতেন।
ভবভূতি খিকখিক করে বলেন আর থাকতেন তোমার জামাইবাবু, অর্থাৎ ভূত।
গজপতি রীতিমতো গর্জন করে বলেন, না ব্রহ্মদৈত্য।
ব্রহ্মদৈত্য! ভবভূতি তাজ্জব হয়ে যান।
–হ্যাঁ। উঠোনের কোনায় একটা বেলগাছ। সেই গাছ থেকে সে মাঝে-মাঝে রাতদুপুরে প্রায়ই উঠোনে পায়চারি করতে নামত। মাধুরীদি জেগে থাকলে বলতেন,–কী গো! গরম লাগছে বুঝি? ব্রহ্মদৈত্য বলত, না গো! আজ সন্ধেবেলা একটা ভোজ ছিল। খাওয়াটা বেজায় রকমের হয়ে গেছে। তাই হজম করার তালে আছি। তো তখন মাদুরীদিদি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হজমের গুলি দিতে ডাকছেন, নাও গো! টুক করে গিলে ফেলে এক গেলাস জল খেও। সব হজম হয়ে যাবে। ব্ৰহ্মদৈত্য মস্ত লম্বা কালো হাতখানা জানলা অবধি বাড়িয়ে দিত। হাতে কাড়ি কাড়ি লোম।
ভবভূতি আরও হেসে বলেন, তুমি দেখেছ?
না দেখেছি তো কি বানিয়ে বলছি? গজপতি গম্ভীরমুখে বলেন।-আমার বয়েস বারো-তেরো হবে। ক্লাস এইটে পড়ি। মাধুরীদির ছেলেপুলে ছিল না বলে আমাকে মাঝে-মাঝে নিয়ে যেতেন। খাটে শুয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে ওইসব কাণ্ডকারখানা দেখতুম। বলতুম,–ও কে দিদি, যাকে ইজমি গুলি দিলে? মাধুরীদি বলতেন, চুপ, চুপ। বলতে নেই।
ভবভূতি বলেন,–সে বাড়িটা এখনও নিশ্চয়ই আছে?
–হুঁ আছে। মাধুরীদি অবশ্য বেঁচে নেই।
–বাড়িতে কে থাকে এখন?
এবার গজপতি বাঁকা হেসে বলেন,–যাবে নাকি? বাড়িটা খালি পড়ে আছে। হানাবাড়ি হয়ে গেছে। কতবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হল কাগজে। সস্তায় বেচে দিতে চেয়েছিল মাধুরীদির বড় জায়ের ছেলে ত্রিলোচন। সে-ই এখন বাড়ির মালিক। কিন্তু বাড়ির বদনাম শুনে সবাই পিছিয়ে যায়। তাই বাড়িটা তেমনি খালি পড়ে আছে।
ভবভূতি বলেন, বাড়িটা আমি কিনব।
–বলো কী?
–হ্যাঁ। কিছুদিন থেকে আমি নিরিবিলি জায়গায় একটা বাড়ি খুঁজছি। ইচ্ছে আছে, সেখানে একা থাকব এবং কিছু এক্সপেরিমেন্ট করব।
–কীসের এক্সপেরিমেন্ট, শুনি।
ভবভূতি ফের নিজস্ব বাঁকা হাসিটা হেসে বলেন, নিশ্চয় ভূত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট নয়, কুকুর নিয়ে।
গজপতি প্রায় আকাশ থেকে পড়ার মতো বলেন, কুকুর নিয়ে মানে?
–তোমাকে বলিনি। কিছুদিন থেকে আমি কুকুর নিয়ে একটু-আধটু গবেষণা করছি। আমার গবেষণার বিষয় হচ্ছে, কুকুরের ভাষা। ওদের যে নিজস্ব ভাষা আছে, তাতে কোনও ভুল নেই, সেই ভাষা আমার শেখা চাই-ই।
গজপতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর বলেন, তা হঠাৎ এই আজগুবি ব্যাপারটা তোমার মাথায় চাপল কেন শুনি?
ভবভূতি গম্ভীরমুখে বলেন, তুমি তো সারাজীবন খালি আইনের প্রকাণ্ড কেতাব পড়েই কাটালে! আদালত আর জজসায়েব ছাড়া কি বোঝোও না।
কৌতূহলী গজপতি বলেন, আহা, বুঝিয়ে বলল না একটু!
–বললেও বুঝবে কী? তুমি তো ঋগ্বেদ পড়োনি। সরমা ছিলেন কুকুরদের মা। সরমার ছেলেমেয়েদের নাম তাই সারমেয়। দেবতাধিপতি ইন্দ্র সরমাকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন–
গজপতি বাধা দিয়ে বলেন, আহা হলটা কী তাতে?
ভবভূতি চটেমটে বলেন,–হল তোমার মাথা আর মুন্ডু! সে যুগে কুকুররাই দূতের কাজ করত বুঝতে পারছ না? তাদের যদি ভাষা না থাকবে তাহলে তাদের দৃত করা হল কেন? তাছাড়া ঋগ্বেদের আরেক জায়গায় আছে, একদল কুকুর কোরাস গাইছে। ভাষা না থাকলে
ফের গজপতি বাধা দিয়ে খিকখিক করে হেসে বলেন, এখন আমাদের পাড়ায় রাতদুপুরে কুকুরেরা কোরাস গায়। বাপস! সে কী কোরাস!
ভবভূতির এবার গর্জনের পালা, তুমি মূর্খ। শাস্ত্রজ্ঞানহীন নিতান্ত ইয়ে। নইলে মহাভারতে মহাপ্রস্থান পর্বে স্বর্গপথে যুধিষ্ঠিরের পেছন-পেছন কুকুর যাওয়ার কারণটাও তুমি বুঝতে! বলো তো, কেন কুকুর পেছন-পেছন যাচ্ছিল?
কুকুর এখনও পেছন-পেছন যায়। সেদিন আমি কিলোটাক পাঠার মাংস কিনে আনছি, একটা কুকুর পিছু ধরেছিল–গজপতি হাসতে-হাসতে বলেন, নিশ্চয় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাঁঠার মাংস ছিল। স্বর্গে তো জীবহত্যা নিষেধ। তাই মর্ত থেকে স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
ভবভূতির পক্ষে এটা অসহ্য। রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন তক্ষুনি। গজপতির পরে হুঁশ হল। তখন বেরিয়ে গিয়ে আদুরে স্বরে ডাকে,–ভবী! ভব! ও ভবা!
কোথায় ভবভূতি! তাঁর মান্ধাতার আমলের খনখনে বিলিতি গাড়ির লেজের ডগাটুকু মোড়ে একবারের জন্যে দেখতে পেলেন গজপতি।
খুব রেগেছে। তা রাগুক–গজপতি মনে-মনে বললেন। একটু পরে জল হয়ে যাবে। দুই বন্ধুর এমন রাগারাগি দৈনিক পাঁচ-সাতবার হয়। আবার মিল হতেও দেরি হয় না!
তবে অন্যবারে রাগ পড়তে ভবভূতির যতটা সময় লাগে, এবার লেগেছিল তারও কম।
এর এক নম্বর কারণ, গজপতির পিসতুতো দিদির সেই হানাবাড়ি কেনার ইচ্ছে।
দুই নম্বর কারণ, ভবভূতি ভূত বিশ্বাস করেন না। গজপতির কাছে প্রমাণ করতে চাইছিলেন, ভূত বলতে কি নেই। সুতরাং গজপতি মিথ্যুক।
তিন নম্বর কারণ, ভবভূতির কুকুর নিয়ে নিরিবিলি গবেষণা!
বাড়িটার মালিক ব্রিলোচন থাকে হাজারিবাগে। ভবভূতির তর সইছিল না। গজপতিকে বলে টেলিগ্রাম করিয়ে তাকে কলকাতায় আনালেন এবং রাতারাতি বাড়িটা কিনে ফেললেন! সস্তায় কিনলেন বলা যায়। ত্রিলোচন যা পেল, তাই লাভ। ঘুঘুডাঙা রেল ইয়ার্ডের ওদিকে কোন ভদ্রলোক গিয়ে বাস করতে চাইবেন? রেল ইয়ার্ডে হরদম ট্রেন, মালগাড়ি আর ইঞ্জিনের বিকট বাজখাই ভঁাচামেচি, তার ওপর ভূত ওরফে ব্রহ্মদৈত্যর গুজব। তবে হ্যাঁ, কারখানার জন্যে কেউ কিনতেও পারতেন। কিন্তু ত্রিলোচনের কাকিমা মাধুরীদেবী নাকি বলে গিয়েছিলেন, কলকারখানা হলে উনি অর্থাৎ ব্রহ্মদৈত্য-মশাই রিফিউজি হয়ে যাবেন। খবরদার বাবা তিলু, এই কম্মটি কোরো না! ওতে পাপ তো হবেই, তার ওপর উনি রেগে গিয়ে তোমাদের পিছনে লাগবেন।
তিলু বা ত্রিলোচন গজপতির মতো ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী। এছাড়া সে ছেলেপুলে নিয়ে ঘরসংসার করে। ব্রহ্মদৈত্য-মশাইয়ের চেহারার যা বর্ণনা শুনেছে সে, তাতে তার হাজারিবাগে ছোট্ট বাড়িটার ওপর তিনি গিয়ে একখানা পা রাখলেই পৌরাণিক গল্পের সেই তিনপেয়ে বামনাবতারের বলিরাজার মাথায় পা চাপানোর ব্যাপারটাই ঘটে যাবে। অর্থাৎ চিড়েচ্যাপটা যাকে বলে।
যাই হোক, বাড়ি তো কিনে ফেললেন ভবভূতি। খুব পছন্দসই বাড়ি। কতকটা সেকালের কুঠিবাড়ির গড়ন। একতলা এবং উঁচু ছাদ। সাত-আট পাশাপাশি ঘর আছে। তার সঙ্গেই স্নানঘর, রান্নাঘর ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। বাড়ির চারদিকে লম্বা-চওড়া প্রচুর জায়গা। গাছপালা আছে। ঝোঁপঝাড় গজিয়ে জঙ্গল হয়ে আছে। চারদিকের পাঁচিল যথেষ্ট উঁচু। একদিকে মস্ত গেট, অন্যদিকে খিড়কির দরজা। গেটের সামনে খোয়াঢাকা অনেককালের অব্যবহৃত রাস্তা আছে একফালি। সেটা গিয়ে মিশেছে রেল ইয়ার্ডের কাছে চওড়া রাস্তার সঙ্গে। সেইদিকে একটু এগোলে ঘুঘুডাঙা রেলস্টেশন।
বিশাল উঠোনর কোনায় পাঁচিল ঘেঁষে সেই প্রকাণ্ড বেলগাছটা দেখতে পেলেন ভবভূতি। আনন্দে নেচে উঠলেন।
না, ব্রহ্মদৈত্যের জন্যে নয়। গাছটা ইয়া মোটা, বেলে ভর্তি। ভবভূতি বেলের সরবত পেলে আর কিছু খেতে চান না। একগাল হেসে গজপতিকে বললেন,–গজু, প্রতিদিন বেলের সরবতের নেমন্তন্ন রইল। এলেই পাবে।
গজপতি মুখে হ্যাঁ বললেন বটে, কিন্তু মনে-মনে বললেন–
–মাথা খারাপ? বেলের সরবতের জন্যে রোজ ট্রেনে চেপে ব্রহ্মদৈত্যর আখড়ায় আসব? আমি তো ভবুর মতো পাগল নই। ওই বেলে হাত দিলে ব্ৰহ্মদৈত্য মশাই খড়মপেটা করবে না?
ভবভূতিকে গৃহস্থ করতে এসেছিলেন সেই প্রথমদিন। তারপর আর তিনি আসেননি। তবে দৈনিক একটা করে চিঠি লেখেন। লিখেই আশা করেন, এ চিঠির জবাব ভবভূতির বদলে তার রাঁধুনিকাম-চাকর নরহরিই লিখবে। বড় দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি কর্তাবাবু গতরাতে বেলতলায় পটল তুলেছেন। অর্থাৎ ব্রহ্মদৈত্য তাঁর ঘাড়টি মটকে দিয়েছে।
কিন্তু কোথায় কী? দিব্যি ভবভূতিরই জবাব আসে। নিজের হাতে লেখা। প্রিয় গজু, তুমি কি সম্প্রতি ন্যাড়া হইয়াছ? নতুবা আসিতেছ না কেন? প্রচুর বেল পাকিয়াছে। তোমার ব্রহ্মদৈত্য ভদ্রলোকটি বেজায় ভদ্র। তাঁহার সঙ্গে ভাব জমিয়াছে। তিনি ন্যাড়া বলিয়াই কদাচ বেলতলায় অবতরণ করেন না। মগডালে বসিয়া পাকা লে পাড়িয়া দেন। আমি লম্বা বাঁশের ডগায় বাঁধিয়া অ্যালুমিনিয়ামের জগভর্তি সরবত পাঠাই। তিনি সরবত পান করিয়া জগটি নামাইয়া দেন। হা–গতকাল লিখিতে ভুলিয়াছি, তিনি তোমার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন। বলিলেন, আহা! বালকটিকে দেখিলে বড় আনন্দ পাইতাম। …
এই চিঠি পেয়ে গজপতি রেগে লাল,–চালাকি? ঠাট্টা করা হয়েছে বালক বলে? আমার বয়স পঁয়ষট্টি হয়ে গেল। আমাকে বালক বলা হচ্ছে? আমার গাল টিপলে দুধ বেরোয়, না আমি এখনও দুধুভাতু খাই যে আমাকে বালক বলেছে?
একটু পরে রাগ পড়ে গেল। না, হয়তো ঠিকই লিখেছে। ব্রহ্মদৈত্য-মশাই আমাকে সেই ছেলেবয়সে দেখেছেন। তাই বালক বলাটা স্বাভাবিক। হয়তো সত্যি সত্যি ভবভূতি ওনার দর্শন পেয়েছে। এবং পেয়ে এতদিনে ভূতপ্রেতে বিশ্বাসও হয়েছে।
তাহলে ভয়ের কথা, ব্রহ্মদৈত্য এখনও মনে রেখেছেন গজপতিকে? ওরে বাবা, এ যে সাংঘাতিক কথা। আজই কালীঘাটে পুজো দিয়ে আসতে হবে। হে মা কালী, যেন বেলগাছিয়াবাসী কালো কুচকুচে, সর্বাঙ্গে লোমওয়ালা এবং খড়ম-পরা ভদ্রলোকটি আমাকে ভুলে যান। ওনার স্মৃতিভ্রংশ করিয়ে দাও মা!
না ভুললেই বিপদ। হয়তো ভবভূতিই তাকে প্ররোচিত করবেন গজপতির বাড়ি আসতে এবং তিনি নিছক স্নেহ-প্রদর্শনেই খড়ম পায়ে খটখট করে রাতদুপুরে হাজির হয়ে হেঁড়ে গলায় ডেকে বলবেন,–জু! কেমন আঁছিস বাবা?
গজপতি আঁতকে উঠে তক্ষুনি কালীঘাট ছোটেন—
ওদিকে ভবভূতি চমৎকার কাটাচ্ছেন ঘুঘুডাঙার বাড়িতে।
বাড়ির নাম দিয়েছেন–সরমা। ঋগ্বেদের সেই কুকুর জননী সরমা। তলায় ব্র্যাকেটে ইংরেজিতে লেখা আছে :
দি ডগ রিসার্চ সেন্টার।
পূর্ব দক্ষিণের একটা ঘরে থাকেন ভবভূতি। তার পাশের ঘরে নরহরি ঠাকুর। তার ওপাশে রান্নাঘর। উত্তর পশ্চিমের মস্ত ঘরে রেখেছে পাঁচটা অ্যালসেশিয়ান, দুটো গ্ৰেহাউন্ড, তিনটে টেরিয়ার, আর সাতটা দিশি কুত্ত। এই সাতটা দিশি কুত্তার মধ্যে দুটো বাঘা, দুটো খেকি আর বাকি তিনটে নেড়ি। রীতিমতো আন্তর্জাতিক বাহিনী।
কদিনের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার ডেকে এনে ওই ঘরটা সাউন্ড প্রুফ করে নিয়েছেন। তার ফলে যতই চাচামেচি করুক, বাইরে থেকে একটুও শোনা যাবে না।
মোট সতেরোটা কুকুরের জন্যে সতেরেটা কাঠের খাঁচাঘর আছে। সামনে লোহার গরাদ। চিড়িয়াখানায় যেমন বাঘের খাঁচা দেখা যায়, ঠিক তেমনি।
দেখাশোনা, খাওয়ানো, স্নান করানো–সবকিছুর ভার ভবভূতি নিজে নিয়েছেন। নরহরি কুকুর দেখলেই উল্টোদিকে দৌড়ায়। তাই পারতপক্ষে এ ঘরে ঢোকে না। ভবভূতি একটা প্রকাণ্ড নোটবইতে দুবেলা কুকুরগুলোর হাবভাব টুকে রাখনে। টেপ রেকর্ডারে টেপ চালিয়ে শোনেন! গম্ভীর মুখে ভাবনা-চিন্তা করেন। লেখেন। রীতিমতো গবেষণা কিনা!
বেশ চলছিল এই রকম। রাতে কুকুরশালায় টেপরেকর্ডার চালিয়ে রাখছিলেন এবং সকালে নিয়ে এসে বাজিয়ে শুনছিলেন। নোট করছিলেন কোনও বৈশিষ্ট্য আছে নাকি। জীবজন্তুর ভাষা শেখা তো সহজ কথা নয়। টেপের একটা জায়গা বারবার বাজিয়ে শুনে তবে না কিছু বোঝা যাবে!
হঠাৎ একদিন সকালে টেপ বাজিয়ে শুনতে-শুনতে ভবভূতি অবাক হলেন।
টেপে সতেরোটা কুকুরের নানান হাঁকডাক অন্যদিন যেমন শোনেন, তেমনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তারপর কী একটা ঘটল। আচমকা ওরা চুপ করে গেছে। কোনও ডাক নেই! না ঘড়ঘড়, গরগর, গাঁগো, খ্যাক খ্যাক, ঘেউঘেউ, কিংবা ভ্যাকভ্যাক। হঠাৎ বেড়ালের মতো যেন মিউ গোছের নরম ডাক ডেকেই সবাই থেমে গেছে। গেছে তো গেছেই।
তারপর একটা কেমন শনশন শব্দে হল। তারপর ঘট ঘটাং!
তারপর খট খট, খট খট, খট খট–
শব্দটা ক্রমে ক্ষীণ থেকে জোরালো হয়ে বাজতে থাকল টেপে। তারপর থেমে গেল। কীসের শব্দ হতে পারে?
তারপর চকচক চকাম-কাম-কুকুরগুলো খাওয়ার সময় যেমন শব্দ করে, সেইরকম! বেশ তালে-তালে শব্দগুলো বাজছে। ভোজের আসরে শেষপাতে চাটনির সময় চোখ বুজলে যেমন শোনা যায়। এ তো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার! কুকুরগুলোর তো এত রাতে কিছু খাওয়ার কথা নয়! খাবে যে, তা পাবেটা কোথায়?
অথচ শোনা যাচ্ছে, গত রাতে (হিসেব মতো তখন প্রায় বারোটা) ওরা খুব খাচ্ছে। খাচ্ছেটা কী? চাটনি? অসম্ভব। কুকুর তো চাটনি খায় না। চেটেপুটে খায় অবশ্য। কিন্তু চাটবেই বা কী? নিজের নিজের লেজ? মনে হয় না তা। ভবভূতি কুকুরের লেজ চেটে না দেখলেও জানেন, মোটেও সুস্বাদু নয়।
ভবভূতি টেপ বন্ধ করে কুকুরশালায় ঢুকলেন। তাঁকে দেখে কুকুরগুলো কিন্তু অদ্ভুত আচরণ শুরু করল! ঘণ্টাটাক আগে এ ঘরে ঢুকেছেন! খাইয়েছেন। টেপ রেকর্ডারটা তুলে নিয়ে গেছেন। তখন ওরা স্বাভাবিক ছিল। অথচ এখন ওঁকে দেখে প্রত্যেকটা কুকুর গরগর করে উঠেছে। কুকুরের ভাষা এতদিনে যতটা বুঝেছেন, ওদের এই শব্দে রীতিমতো রাগ আছে। সবচেয়ে বেশি আদরের অ্যালসেশিয়ানটার খাঁচার সামনে যেতেই সে দাঁত বের করে কামড়াতে এল। গ্রেউন্ড দুটো শরীর লম্বা করে গাঁ-গাঁ করতে থাকল।
তারপরই প্রত্যেকটি খাঁচায় প্রত্যেকটি কুকুর লাফালাফি জুড়ে দিল। যেন খাঁচা ভেঙে ফেলবে। তাকে পেলে যেন ওরা টুকরো-টুকরো করে খেয়ে ফেলবে। সে কী হিংস্র হাঁকরানি!
ভবভূতি বিলিতিগুলোকে ইংরিজিতে এবং দেশিগুলোকে বাংলায় তর্জন-গর্জন সহকারে ধমক লাগালেন। একটা লাঠি নিয়ে এসে খুব ঠোকাঠুকি করলেন খাঁচার সামনে। কিন্তু কেউ ভয় পেল না বরং আরও খেপে গেল। ভবভূতির কানে তালা ধরে যাচ্ছিল ওদের চ্যাঁচামেচিতে।
হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন কিছুক্ষণের জন্যে। এমন তো করে না ওরা। ব্যাপার কী?
অসহ্য লাগলে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। খুব রাগ হয়েছে। বেইমান নেমকহারাম! এত যত্ন করে রাখা হয়েছে। রোজ কাড়িকাড়ি দুধ, মাংস এইসব খাওয়ানো হচ্ছে। আর তার বদলে এই ব্যবহার!
রোস, আজ সারাদিন খাওয়া বন্ধ।
নিজের ঘরে ফিরে আবার টেপ বাজিয়ে রাতের রেকর্ড হওয়া শব্দগুলো শুনতে থাকলেন ভবভূতি। এই খট খট খট খট শব্দটা কীসের হতে পারে?
হঠাৎ চমকে উঠলেন। তাহলে কি ওটা খড়মের শব্দ? অর্থাৎ বেলগাছের ব্রহ্মদৈত্য?
তাহলে কি সত্যি ব্রহ্মদৈত্য বলে কিছু আছে? এবং সেই ব্রহ্মদৈত্যই কি কুকুরগুলোকে রাতে কিছু খাইয়ে বশ করে ফেলেছে এবং তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে?
অথচ সকালে যখন দুধ-পাঁউরুটি খাওয়াতে গেলেন, তখন ওরা শান্তভাবে ছিল। এর মানে কী?
ভবভূতির মনে হল, নেহাত খাবার লোভে তখন জন্তুগুলো তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেনি। নেমকহারাম লোভী স্বার্থপর।
ভবভূতি যত ভাবলেন ব্যাপারটা, বিচলিত বোধ করলেন। ঠিক আছে, আজ রাতে তিনি জেগে থেকে পাহারা দেবেন। নরহরিকে সঙ্গে নেবেন। এ রহস্যের ফর্দাফাই না করলেই চলে না।
নরহরিকে ডেকে সব খুলে বললে তার মুখ যেন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাকে ওই বেলগাছের ব্যাপারটা এতদিন বলেননি। এটাকে যে হানাবাড়ি বলত লোকে, তাও জানে না সে। কেমন করে জানবে? সে বাঁকুড়ার লোক। ভবভূতির জামাই তাকে শ্বশুরের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জামাই ওখানে রোডস দফতরের ইঞ্জিনিয়ার। শশুরমশায়ের নানান উদ্ভট বাতিকের কথা জানেন তিনি। কেমন লোক পছন্দ হবে তাও জানেন। ভবভূতির কোনও কথায় না করবে না এবং কোনও ব্যাপারে অবাক হবে না–এমন লোক চাই। সেদিক থেকে নরহরি উৎকৃষ্ট। সবেতেই মুণ্ডু কাত করে বলে, ইয়েস স্যার!
কর্তাবাবুর কথার বিরুদ্ধে অন্য কথা বলার জো নেই। সে মুখে সায় দিল। বরং জাঁক দেখিয়ে বলল,–বেহ্মদত্যির টিকি আর টাক দুই-ই কেড়ে নেব স্যার।
খুশি হয়ে ভবভূতি বললেন,–একখানা মোটা লাঠি জোগাড় করে রাখো। আর একটা বস্তায় পাটকেল রাখো। টিকি আর টাক কাড়তে গিয়ে মামলায় পড়বে হে! গবুউকিল তাক করে বসে আছে ওদিকে।
ওদিকে কুকুরগুলো উপোস করছে। করুক। ভবভূতি রাতের খাওয়া শেষ করে নরহরিকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি ওপাশের দরজায় বের হলেন। জ্যোৎস্না রাত। সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বেলগাছটার একটু তফাতে একটা জঙ্গল হয়ে যাওয়া জবাগাছের আড়ালে দুজনে ওৎ পেতে বসে রইলেন। সঙ্গে একটা বন্দুকও নিয়েছেন। লাঠি আর পাটকেলের বস্তাও আছে।
বসে আছেন তো আছেন। সব নিস্তব্ধ। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে পশ্চিমের রেলইয়ার্ড থেকে রেলগাড়ির শব্দ কিংবা হুইসেল শোনা যাচ্ছে। আবার সব চুপ। হেমন্তকাল। শিশিরে ঘাস-গাছপালা ভিজে জবজব করছে। হাল্কা কুয়াশা জমেছে গাছপালায়। কিছুক্ষণ পরে বেলগাছ থেকে একটা পেঁচা ডাকলাও! ক্রাও! ক্রাও!
তারপর মনে হল বেলগাছটায় হঠাৎ ঘূর্ণি হাওয়া এসেছে। শনশন করে ডালপালা নড়ছে। তারপরই ভবভূতি দেখতে পেলেন, ঠিক মগডালে কালে প্রকাণ্ড একটা মানুষের মতো কে উঠে দাঁড়াল এবং ঈদের দিকে তাকিয়ে যেন হাই তুলে বারতিনেক বুড়ো আঙুল ও তর্জনীর সাহায্যে তুড়ি দিল।
তারপর হেঁড়ে এবং চাপাগলায় সেই মূর্তিটা বলে উঠল, হরি হে দীনবন্ধু। পার করো হে ভবসিন্ধু।…তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো! জগদম্বা বলো মন হে! জগদম্বা বলো!
নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না ভবভূতি। তাঁর পিছনে বসে নরহরি ঠকঠক করে কাঁপছে। তাকে চিমটি কেটে সাবধান করে দিলেন এবার।
একটু পরে মূর্তিটা গাছের ডগা থেকে লাফ দিয়ে নামল। মাটি কেঁপে উঠল যেন। জ্যোৎস্নায় এলে স্পষ্ট দেখা গেল, তার পরনে কেঁচা করে পরা খাটো ধুতি, খালি গা, বুকে পৈতে রয়েছে। মাথার চুল ছোট করে কাটা। একটা প্রকাণ্ড টিকি আছে।
হ্যাঁ, খড়মের শব্দ হচ্ছে। খট খট খট খট! ভবভূতি দেখলেন, সে তাঁদের দিকেই এগিয়ে আসছে। শিউরে উঠলেন। কিন্তু তিনি এক সময়কার শিকারি মানুষ। এমনিভাবে বন্দুক হাতে কতবার গহন অরণ্যে বাঘের এলাকায় রাত কাটিয়েছেন। এ কিছু নতুন ব্যাপার নয় তার কাছে। দেখা যাক।
অবশ্য এবার বাঘ নয়, ব্রহ্মদৈত্য এই যা।
ব্রহ্মদৈত্যকে কাছে থেকে ভালো করে দেখবেন বলে চুপচাপ বসে আছেন ভবভূতি। নরহরির সাড়া নেই। চোখ বুজে ফেলেছে। নাকি ভিরমি গেল, ভবভূতির ঘুরে দেখার সময় নেই।
ব্ৰহ্মদৈত্য এসে ভবভূতির মাথার ওপর জবাগাছ থেকে টুপ করে একটা জবাফুল পেড়ে নিল। নিয়ে টিকিতে বোঁটাটা গিট দিয়ে বাঁধল। কী বোটকা গন্ধ। ভবভূতির অসহ্য লাগল। নাকে আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন। আর এতক্ষণে দেখলেন, ব্রহ্মদৈত্যের হাতে একটা হাঁড়ি রয়েছে। তারপর দেখলেন ব্রহ্মদৈত্য তাঁর কুকুরশালার দিকেই চলেছে। খড়মের শব্দ হচ্ছে খট খট খটাং! হাঁড়িতে কী থাকতে পারে? তাছাড়া ও ঘরে ঢুকবেই-বা কীভাবে? ভেবেই পেলেন না ভবভূতি।
কুকুরশালার বাইরে দরজার কাছে গিয়ে ব্রহ্মদৈত্য হেঁড়ে গলায় ফের বলে উঠল,–হরি হে দীনবন্ধু! পার করো হে ভবসিন্ধু।…তারা। তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো!… জগদম্বা বলো মন হে, জগদম্বা বলো!
তারপর যেন তিনবার তুড়ি দিল সে। অমনি অবাক কাণ্ড! দরজা খুলে গেল। তখন ব্রহ্মদৈত্য হাঁড়িটা উঁচু করে ধরে যেই ঢুকতে যাচ্ছে, ভবভূতি আর সহ্য করতে পারলেন না। গর্জে উঠলেন, খবরদার!
সঙ্গে সঙ্গে আকাশমুখো বন্দুক তুলে ছুড়লেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, নরহরি! ঠিল ছোড়ো! লাঠি চার্জ করো! এক হাতে ঢিল, অন্য হাত লাঠি।
ঘুরে দেখেন, কোথায় নরহরি? কেউ নেই পিছনে। পাটকেলের বস্তা আর লাঠিটা পড়ে আছে। রাগে ভবভূতি বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে এবং লাঠি ও বন্দুক বগলদাবা করে উঠে দাঁড়ালেন।
এই অবস্থায় দৌড়ে গিয়ে ফঁকায় দাঁড়ালেন। ওদিকে ব্রহ্মদৈত্য তখন দরজা থেকে কেটে পড়েছে। খড়ম পায়ে দৌড়ে আবার বেলগাছটার দিকে তাকে যেতে দেখলেন ভবভূতি।
একলাফে বেলগাছে উঠে পড়েছে ব্রহ্মদৈত্য।
ভবভূতি বস্তা নামিয়ে গাছের দিকে পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে গর্জাতে থাকলেন,–গেট ডাউন! গেট ডাউন রাস্কেল! নেমে এসো বলছি!
বস্তার পাটকেল শেষ হয়ে আসছে, এমন সময় গাছ থেকে ব্রহ্মদৈত্য করুণ স্বরে বলে উঠল, ভব! ভবী! ভবী! ভবু! আর ঢিল ছুড়ো না ভাই! মাইরি, মরে যাব!
ভবভূতি চমকে উঠলেন।
গলাটা এতক্ষণে চেনা মনে হচ্ছে। দৌড়ে গাছতলায় গিয়ে বললেন,–কে? কে তুমি?
আবার করুণস্বরে জবাব এল-আমি, আমি। উ হু হু হু! গেছিরে বাবা।
কে আমি? নেমে এসো বলছি! নইলে এবার লাঠিপেটা করব! বলে ভবভূতি সেই ইয়া মোটা লাঠিটা বাগিয়ে ধরল!
ব্রহ্মদৈত্য কান্নার সুরে বলল, নামতে পারছি না। তোমার ঢিল লেগে হাঁটুর বাতটা হঠাৎ চাগিয়ে উঠেছে! উঁহু হু হু!
এতক্ষণে ভবভূতির সংশয় ঘুচল। লাঠি ও বন্দুক মাটিতে রেখে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হো-হো, করে হেসে বললেন,-রোসো৷ হাত বাড়াও। ধরে নামাচ্ছি।
ব্রহ্মদৈত্য গুঁড়ির ওপরে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে দিল। ভবভূতি তার হাত ধরে সাবধানে নামতে সাহায্য করলেন।
নেমেই ব্রহ্মদৈত্য হাঁটুর ব্যথা ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, এই সেরেছে। হাঁড়িটা পড়ে আছে যে! সর্বনাশ! নির্ঘাৎ ব্যাটা এতক্ষণে অর্ধেক সাবাড় করেছে।
বলে সে কুকুরশালার দরজার দিকে দৌড়ল। ভবভূতিও তার সঙ্গে দৌড়েছেন।
গিয়ে দেখেন, ব্রহ্মদৈত্য নরহরির কাঁধ আঁকড়ে ধরেছেন, আর নরহরি হাঁড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। টানাটানিতে তাকে নাড়ানো যাচ্ছে না। ভবভূতি দেখেশুনে গম্ভীর হয়ে বললেন, রসগোল্লা নাকি?
–হ্যাঁ। পাক্কা তিন কিলো মাল। ব্যাটা সব সাবাড় করে ফেললে দেখছ না? এ যে আস্ত রাক্ষস!
বেশ করেছে। ভবভূতি রেগে বললেন।
ব্রহ্মদৈত্য বলল, ইয়ার্কি? ওর জন্যে এনেছিলুম নাকি?
ভবভূতি গর্জে উঠলেন,–তোমার নামে মামলা করব! তুমি আমার কুকুরগুলোকে রসগোল্লা খাইয়ে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছ। সকাল হতে দাও। দেখাচ্ছি মজা। সটান ঘুঘুডাঙা আদালতে গিয়ে তোমার নামে মামলা করব।
ব্ৰহ্মদৈত্য হাসল,–হুঁ! আমাকে মামলার ভয় দেখাচ্ছ। আমি চল্লিশ বছর ওকালতি করেছি জানো না বুঝি?
হ্যাঁ, তাও বটে। ভবভূতি ভড়কে গেলেন। বললেন,–তাই বলো, তো এই বুড়ো বয়সে কেলেঙ্কারি করতে তোমার লজ্জা হল না? ছিঃ!
কীসের লজ্জা? ব্ৰহ্মদৈত্য অর্থাৎ সাক্ষাৎ স্বয়ং গজপতি বাঁকা হেসে বললেন। তুমি যে ব্রহ্মদৈত্য মানে না। এবার মানলে তো?
ভবভূতি পাল্টা বাঁকা হেসে বললেন, , মানলুম। তবে যাও, এখন চান করে গায়ের কালো কালিগুলো ধুয়ে এসো। নইলে তোমায় বিছানায় শুতে দেব ভেবেছ? ছা-ছা!
নরহরি ঠাকুর হাঁড়ি শেষ করে এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন গো। টিউবেল থেকে জল টিপে দিই। চান করবেন। আমারও তেষ্টা পেয়েছে।…
এই ঘটনায় দুটো ফল হল। এক : নরহরি গোপনে গজপতির চক্রান্তে যোগ দিয়েছিল এবং কুকুরশালার চাবিও চুরি করে ওকে দিয়েছিল বলে তার এখানকার চাকরি গেল। সে অবশ্য গজপতির বাড়ি ফের চাকরি পেল। তাই কথা ছিল গজপতির সঙ্গে।
দুই : ভবভূতিকে কুকুরগুলোর জন্যে দৈনিক তিন কিলো করে রসগোল্লার ব্যবস্থা করতে হল। রসগোল্লার মজা ওরা পেয়ে গেছে। একদিন না পেলে ভবভূতির বিরুদ্ধে সেদিনের মতো প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখায়।
ভবভূতি নতুন লোক বহাল করেছেন। তার নাম কালীপদ। ডাক নাম কালো। বছর বিশ-বাইশ বয়সের এক ছোকরা। ভারি অমায়িক এবং বিশ্বাসী। তাকে কুকুরগুলো বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। এটা ভবভূতির বাড়তি লাভ বলা যায়।
আর গজপতির সঙ্গে সম্পর্ক? এবার চিড় খেয়েছে সত্যিসত্যি। গজপতির সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া হয়ে গেছে ভবভূতির। ব্ৰহ্মদৈত্য আছে তা প্রমাণের জন্যে যে এমন কাণ্ড করতে পারে, সে কি মানুষ? সে নিজেই ভূত। অতএব ভূতে-মানুষে কি বন্ধুত্ব হয়? কিংবা হয়ে গেলেও তা বেশিদিন টেকে?
ভবভূতি মন দিয়ে কুকুরের ভাষা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। গজপতিকে মন থেকে একেবারে মুছেই ফেলেন।
কিন্তু মাঝে-মাঝে হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা-বেলগাছে যদি গজপতির বদলে সে রাতে সত্যি সত্যি ব্রহ্মদৈত্যকেই দেখতে পেতেন, তাহলে কী ঘটত? একটু শিরশির করে শরীর। বিশেষ করে কোনও-কোনও রাতে লনে পায়চারি করতে করতে বেলগাছটার দিকে তাকালে যেন মনে হয় কেউ ওর মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাগে পেলেই ঘাড় মটকাবে। তখন ভবভূতি বন্দুকটা নিয়ে এসে খামোকা আকাশে একটা গুলি ছোড়েন। সেই আওয়াজে ভয় পেয়ে বেলগাছের পেঁচাটা চ্যাঁচিতে-চ্যাঁচিতে উড়ে পালায়।
ততদিনে কুকুরের ভাষা নিয়ে গবেষণায় অনেকটা এগিয়েছেন ভবভূতি। ইয়া মোটা লাল কাপড়ে বাঁধানো খেরোর খাতায় কুকুরের ডাকগুলো টুকেছেন এবং তার পাশে বাংলা অনুবাদও করে ফেলেছেন।
এমনকী ওদের সঙ্গে ইদানীং ওদের ভাষাতেই কথা বলার চেষ্টা করছেন।
অ্যালসেশিয়ানের খাঁচার সামনে গিয়ে বলেন,–গররর গঁঃ। অর্থাৎ কেমন আছো হে?
সে জবাব দেয়,–গর গরররর গা। ভালোই আছি। তবে খাঁচায় আটকে থাকাটা ভালো মনে হচ্ছে না।
ভবভূতি একটু হেসে বলেন,-ঘঃ ঘঃ। ঠিক আছে। শিগগির ছেড়ে দেব।
টেরিয়ার দুটো তাকে দেখে বলে–ঘেঃ ঘেঃ। ছেড়ে দাও না ব্রাদার!
ভবভূতি বললেন,–ঘঁঃ। সবুর, সবুর। দেব বইকী।
গ্ৰেহাউন্ড ভারি রাগী। বলে—খ্যাঁ খ্যাঁ খ্যাঁঃ খুঁঃ। ছেড়ে দাও, নয়তো ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
ভবভূতি বলেন,–ছু চুঃ। সোনা ছেলে, লক্ষ্মীছেলে। রাগ করে না।
দিশি কুকুর বাঘা, খেকি এবং নেড়ি তাঁকে দেখে চ্যাঁচিমেচি করে বলে, ভৌ ভৌ ভেউ ভু-উ-উ-উ। কেন আটকে রেখেছ। আমাদের কষ্ট হচ্ছে না বুঝি?
ভবভূতি জবাব দেন,–ঘেউ ঘেউ ঘেক ঘেক ঘুঃ? বেশি চেঁচিও না তো বাপু! সময় হলেই ছাড়ব।
নতুন রাঁধুনিকাম-চাকর কালীপদ ব্যাপার-স্যাপার দেখে হতভম্ব। আজকাল কর্তাবাবু আপনমনে ঘরের মধ্যে পায়চারি করেন আর কুকুরের মতো ডাকেন। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো?
সেদিন কালীপদ গেছে চা নিয়ে। ভবভূতি বই পড়তে-পড়তে বললেন,–গেঃ গেঃ! ঘেউ-উ-উ-উ!
কালীপদ হতভম্ব হয়ে বলেন, কী বলছেন স্যার?
ভবভূতি একটু হেসে বললেন,-তাইত! তুমি এ ভাষা জানো না বটে। শোন কালীপদ, আমি কুকুরের ভাষায় দিব্যি কথা বলতে পারি। একটা বই লিখব ভাবছি। ওটা পড়লে সবাই এ ভাষা শিখে নেবে। তা শোনো, তুমি বরং আমার কাছে রোজ এ ভাষাটা শিখতে থাকে। বেশি কথা খরচ করতে হবে না। একটুও ক্লান্ত হবে না কথা বলতে। কত সহজে একটা শব্দে অনেক বেশি কথা বলা যায় জানো?
কালীপদ ছেলেটি ভারি সরল। বলল, তাহলে আজই শেখাতে শুরু করুন স্যার।
ব্যাস, ভবভূতি ওকে নিয়ে পড়লেন। রোজ দু-ঘণ্টা করে মনোযোগী ছাত্রের মতো সে কর্তাবাবুর কাছে বসে কুকুরের ভাষা শেখে। রান্নাঘরে গিয়ে আপনমনে অভ্যাস করে। জিভ তালুতে ঠেকিয়ে কীভাবে কীভাবে ঘেউ করতে হয়, সহজেই রপ্ত করে নেয়। রান্নাঘর থেকে অনেক সময় তার সেই ঘেউ শোনা যায়। ভবভূতি তাঁর ঘর থেকে সাড়া দিয়ে বলেন,-ঘেউ ঘেউ ঘোঃ। বাঃ বহুত আচ্ছা। ঠিক হচ্ছে।
কিছুদিন পরে দেখা গেল, দুজনে আর মানুষের ভাষায় কথা বলছেন না। স্রেফ কুকুরের ভাষায় কথা চলছে।
কারণ ভাষাশিক্ষার তাই নিয়ম! যেমন কিনা ইংরাজি স্কুলে যারা পড়ে, তাদের সবসময় ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। তাছাড়া সেই যে একটা কথা আছে–যদি ইংরেজি শিখতে চাও, তাহলে ইংরেজিতে কথা বলো, ইংরেজিতে স্বপ্নও দেখো।
কুকুরের ভাষায় আজকাল দুজনে স্বপ্ন দেখতেও চেষ্টা করেন বইকী?
আর এই ভাষার নামও খুঁজে পেয়েছেন ভবভূতি। শ্বানভাষা। শ হল কিনা কুকুর। তাদের ভাষার নাম শান ভাষা।
যে গোয়ালা রোজ সরমা অর্থাৎ ভবভূতিবাবুর বাড়িতে দুধ দিতে যায়, সে অবাক হয়ে শোনে, ভবভূতি বলছেন,–ঘৌ ঘৌ ঘঃ?
কালীপদ জবাব দিচ্ছে,–ঘরররর ঘ্যাঃ।
–ভেঁক ভেঁক।
–ভেউ—উ–উ।
–গ্যাঃ গ গাও!
–গ্যাঁ–আঁ অ্যাঁ।
গোয়ালা কালীপদকে চুপিচুপি বলে,–ব্যাপারটা কী ভাই কালীপদ?
কালীপদ মুচকি হেসে বলে,–গরগরর! ঘেউ!
গোয়ালা বেচারা ঘাবড়ে যায়। বাইরে ব্যাপারটা রটায় সে। তাই সরমার গেটে কৌতূহলী লোকেরা ভিড় জমায়। বিরক্ত ভবভূতি তাড়া করে বলেন,–ঘরররর ঘেঁউ ঘেঁউ। ঘ্যাঁ।
লোকেরা ভাবে নির্ঘাৎ পাগল এই ভদ্রলোক। তারা হো-হো করে হাসে এবং ভেংচি কেটে কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে। তখন ভবভূতি বন্দুক বের করেন। তারা পালিয়ে যায়।
এই খবর গিয়েছিল গজপতির কাছে। শুনে গজপতি তো ভাবনায় পড়ে গেলেন। হাজার হলেও তার ছেলেবেলার বন্ধু ভবভূতি। বুড়ো বয়সে হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়াটা মোটেও কাজের কথা নয়।
বুদ্ধি খাঁটিয়ে একদিন গজপতি এক সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে নিয়ে ঘুঘুডাঙায় হাজির হলেন। ইনি কুকুর সম্পর্কেও জ্ঞানী। হন্ডুরাসে তিনবছর কুকুরবিদ্যা শিখে এসেছেন।
সরমার গেটে গিয়ে ডাকলেন,-ভব! ভবী! ভবী! আছে নাকি ভায়া?
ভবভূতি কিন্তু গজপতির জন্যে মনে-মনে ছটফট করছেন। আহা, কত কালের বন্ধুত্ব। তার ওপর এমন শান ভাষায় তাঁর কৃতিত্ব গজপতির কাছে জহির না করলে কি চলে?
গজপতির ওপর সব রাগ ভুলে হাসিমুখে গেটে গিয়ে সম্ভাষণ করলেন, গররর গরর।
গজপতি ডাক্তারবাবুকে চিমটি কেটে দিলেন। অর্থাৎ দেখছেন এবং শুনছেন তো? ডাক্তার মুচকি হেসে ফিসফিস করে বললেন,–এই রোগের নাম কুকুরামি। দেখেছি হন্ডুরাসে অনেকেরই আছে।
গজপতিকে গেট খুলে ভবভূতি ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন–গঁঃ গঁঃ। ডাক্তারবাবু জবাব দিলেন,–ঘঁ-গ-অ-অ। ঘ্যাঁ!
গজপতি অবাক। আরও অবাক হলেন ঘরে গিয়ে। ডাক্তার ভদ্রলোকও ভবভূতির মতো পাগল হয়ে গেলেন নাকি?
ভবভূতি আর ডাক্তার কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ গরগর করে যাচ্ছেন সমানে। সেই সময় কালীপদ চা নিয়ে এসে বলল,-ভৌ ভৌ ভঃ।
গজপতির এতক্ষণে রাগ হল। আর রাগের চোটে ভেংচি কেটে বলে উঠলেন,-ভৌ ভৌ ভ্যাও।
অমনি কালীপদ তার পায়ের ধুলো নিল। আর ভবভূতি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একগাল হেসে বলে উঠলেন,–ঘঁরররর গরররর গঁঃ।
এবার অসহ্য লাগল গজপতির। বললেন কী ব্যাপার বলো তো ভায়া ভব? তোমরা সবাই কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ করছ কেন?
ভবভূতি মুচকি হেসে তার খেরোর খাতাটি সামনে খুলে ধরলেন।
চোখ বুলিয়ে গজপতি সব টের পেলেন এতক্ষণে। একের পর এক পাতা উল্টে গোটাটা দেখে নিলেন। তারপর হাসিমুখে ভবভূতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘউউ! ঘঁ!
গজপতির সঙ্গে ভবভূতির আবার ভাব হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে গজপতি প্রায়ই সরমাতে বন্ধুর কাছে এক-এক বেলা কাটিয়ে যান এবং শান ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আর সেই কুকুর বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোকের নাম ডাঃ লম্বোদয় হোড়। সংক্ষেপে ডাঃ এল হাউর। তাঁকে মোটা মাইনেতে বহাল করেছেন ভবভূতি। কুকুরগুলোর মাথাধরা, কান কটকট, পেটফাঁপা চিকিৎসা করতেন ভবভূতি। এখন ডাঃ হাউর তা করেন। উনি হন্ডুরাসী পদ্ধতিতেই চিকিৎসাটা করেন। তারই পরামর্শে কুকুর বাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা খাঁচায় এতদিন বাস করে অভ্যস্ত হয়েছে। তাই বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে চায় না। খাঁচায় গিয়ে ঢোকে। বাইরে যতক্ষণ থাকে, চুপচাপ উদাস চোখে শুধু আকাশ দেখে আর হাই তোলে। এতে একটা দারুণ রকমের কাজ হয়েছে। লোকেরা এই বাড়িটা পাগলাগারদ ভেবে পাগল দেখবার জন্যে ইদানীং গেটের পাশে উঁকিঝুঁকি মারত। এখন বাড়ির ত্রিসীমানায় এলেই সতেরটা কুকুর নিজ-নিজ কণ্ঠস্বরে গর্জন করে ওঠে। আর গ্ৰেহাউন্ড কী সাংঘাতিক কুকুর, সবাই জানে।
আর কেউ বাড়ির আনাচে-কানাচে আসতে সাহস পায় না। বিকেলে দেখা যায় ভবভূতি আর ডাঃ হাউর সতেরোটা দেশি-বিদেশি কুকুর নিয়ে বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণে বেরিয়েছেন এবং কুকুরগুলোকে হা-ডু-ডু খেলা শেখাচ্ছেন। বিদেশি কুকুরগুলো দিব্যি হা-ডু-ডু হাঁকতে পারে। কিন্তু দিশি-বাঘা-নেড়ি-ঘেঁকিরা ওই ইংরিজি বলতেই পারে না। তারা দিশি ভাষাতেই বলে–চু কিট কিট কিট।…
সূর্য ডুবে যায় গাছপালার আড়ালে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা আসে। তখন ডাঃ হাউর কুকুরদের নিয়ে কুকুরশালায় ঢোকেন। আর ভবভূতি চুপচাপ পায়চারি করেন কতক্ষণ। চারদিকে নিঝুম। মনে কত কী আশা জেগে ওঠে। এবার নোবেল প্রাইজ ঠেকায় কে?
সেদিন সন্ধ্যায় ভবভূতি একা পায়চারি করছেন। মনে একটা নতুন ভাবনা গজিয়েছে। কুকুরগুলোকে রাষ্ট্রভাষা শেখালে কেমন হয়? অন্য ভাষার চাইতে ওটা খুব তাড়াতাড়ি শেখারই কথা। একটু রাগিয়ে দিয়ে শেখাতে শুরু করলেই ঝটপট শিখে নেবে। রাগ হলেই তো মুখ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বেরিয়ে যায়।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সেই বেলতলায় গেছেন ভবভূতি। হঠাৎ মাথার ওপরে ডালপালার আড়াল থেকে কে ভারী গলায় বলে উঠল,-ঘরররর ঘূ-উ।
চমকে উঠলেন ভবভূতি। কথাটার মানে, কী ভায়া? ঘুরে বেড়াচ্ছ নাকি।
অন্ধকারে ভবভূতি কাকেও দেখতে পেলেন না। বললেন,–সঁঃ : ঘেউ উ। কে হে তুমি? গাছে কী করছ?
জবাব এল, ঘ্যাঁ-আঁ-আঁক ঘরররর…
কী?—ভবভূতি খাপ্পা। বলছে কিনা, আমি যাই করি, তাতে তোমার কী হে! ভবভূতির বেলগাছে বসে ভবভূতিকেই চোখ রাঙাচ্ছে–তাও এই রাতবিরেতে? –তিনি রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠলেন মানুষের ভাষাতেই। এবং রাগ হলে বাঙালি ভদ্রলোক যা করেন, তাই করলেন অর্থাৎ গেট ডাউন। গেট ডাউন ইউ ব্লডি ফুল!
অমনি ধপ করে তার সামনে কে লাফিয়ে পড়ল। অন্ধকার গাঢ় হয়নি ততটা। আবছা দেখলেন, বেঁটেখাটো মোটাসোটা একটা লোক। খালি গা। পরনে খাটো ধুতি কেঁচা করে পরা। পায়ে যেন খড়মও আছে। গলায় পৈতেও ঝকমক করছে।
অবিকল সেই জ্যোৎস্নারাতে ব্রহ্মদৈত্যবেশী গজপতির মতো।
তাহলে আবার নির্ঘাৎ গজপতি রসিকতা করতে বেলগাছে চেপেছিলেন। এই ভেবে ভবভূতি হো-হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,-গজু, তুই মাইরি আস্ত ভূত!
ভূত!–বেলগাছের লোকটা ঘুসি তুলে বলল, তুমি ভূত! তোমার চোদ্দপুরুষ ভূত! আর গজু বলছ, সেই গজু-টজকে আমি চিনি না!
ভবভূতি বললেন,–দেখো গজু, বাড়াবাড়ি কোরো না। গায়ে জল ঢেলে দেব বলছি!
–কেন? জল ঢালবে কেন?
–তোমার গায়ের কালো পেন্ট ধুয়ে যাবে সেদিনকার মতো।
–সেদিনকার মতো? কী বলছ! আমি আজ এক বছর কাশী-গয়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম। সদ্য কাল সন্ধেবেলা ফিরেছি। ফিরেই তোমার কীর্তিকলাপ দেখছি।
ভবভূতি অবাক হয়ে গেছেন। বললেন, তুমি গজু নও?
বেঁটে মূর্তিটা জোরে বনবন করে লাটিমের মতো টিকিসমেত ঘুরপাক খেয়ে বলল,-না না না কভি নাহি!
–আলবাত গজপতি তুমি! চলো, আলোয় চলো! পরীক্ষা করে দেখব।
–আমার আলোয় যাওয়া বারণ আছে। যাব না। পরীক্ষা করে দেখতে হয়, এখানেই দেখো।
–ঠিক আছে। আগে এক বালতি জল আনি।
–সে কী! কেন, কেন?
–তোমার গায়ে কালো পেন্ট ধুতে হবে না? তখন তোমার ফর্সা রং বেরিয়ে পড়বে।
ভবভূতি পা বাড়াচ্ছিলেন, মূর্তিটা পিছু ডাকল,–শোনো, শোনো। বলছিলুম কী, জল না ঢাললে হয় না? বড্ড ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। মাইরি, শীতে জমে যাব। তুমি বরং কাছে এসে আমাকে টিপে দেখো! আমি তোমার গজু না টজু, সহজে বুঝতে পারবে।
ভবভূতি সটান গিয়ে ওর গোঁফ খামচে ধরলেন। মূর্তিটা চ্যাঁচিমেচি করে বলল, ওরে বাবা রে! গেছি রে! গেছি রে! ছাড়ো ছাড়ো! উঃ হু হু হু!
তাইতো! গজপতির তো গোঁফ নেই। সে রাতে নকল গোঁফ পরেছিলেন। কিন্তু এর গোঁফটা দেখা যাচ্ছে আসল। তার চেয়ে বড় কথা, আজ সকালে গজপতি এসেছিলেন। গোঁফ পরিষ্কার কামানো ছিল। সন্ধ্যার মধ্যে এমন পেল্লায় গোঁফ গজাতে পারে না তার। তাহলে এ গজপতি নয়, অন্য কেউ।
ভবভূতি গোঁফ ছেড়ে চুল ধরতে গেলেন। ধরা গেল না। ছোট-ছোট চুল যেন পেরেকের ডগার মতো। হাতে বিধতেই ভবভূতি হাত সরিয়ে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,–তাহলে তুমি কে শুনি?
মূর্তিটিও তাঁর মতো গম্ভীরগলায় জবাব দিল, আমার নাম বলা বারণ। তাছাড়া বললেই তুমি ভিরমি খাবে। কাজেই চেপে যাও।
–ইয়ার্কি? পুলিশে দেব তোমাকে। কেন তুমি আমার বাড়িতে ঢুকেছ?
–তোমার বাড়ি? তোমার বাড়িতে ঢুকলুম কোথায়? আমি তো গাছে ছিলুম।
–গাছটাও যে আমার।
–তোমার গাছ মানে? আজ তিনশো বছর এই গাছ আমার দখলে! আমি এই গাছে থেকে বুড়ো হয়ে গেলুম! আর তুমি বলছ আমার গাছ?
গাছে থাকো! এই বেলগাছে? রাগের মধ্যে ভবভূতি হেসে ফেললেন।
মূর্তিটি বলল, এতে হাসির কী আছে? যার যেখানে বাসা। তুমি মানুষ, তাই বাড়িতে থাকো। আমি ইয়ে, তাই বেলগাছে থাকি।
–ইয়ে মানে? তুমি কি ব্ৰহ্মদত্যি?
খবরদার নাম ধরে বলবে না! জানো না কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বললে রেগে যায়? ব্রহ্মদত্যিকে ব্রহ্মদত্যি বললে রাগ হবে–ভীষণ রাগ বলে সে দাঁত কিড়মিড় করে রাগটা দেখিয়ে দিল। টিকিটা কাঠির মতো সোজা দাঁড়িয়ে রইল।
ভবভূতি এবার একটু সংশয়ান্বিত হয়ে বললেন, তাহলে বলছ, তুমিই এই বেলগাছের ব্রহ্মদত্যি?
–আলবাত। আদি, আসল এবং অকৃত্রিম ব্ৰহ্মদত্যি। এতটুকু ভেজাল নেই।
–বিশ্বাস করি না। আজকাল সবকিছুতেই ভেজাল। –তাহলে প্রমাণ চাও?
–হুঁউ। চাই।
–বলো, কী প্রমাণ চাও?
–তুমি যদি আসল ব্ৰহ্মদত্যি, তাহলে…তাহলে…
কথায় বাধা পড়ল। গাড়িবারান্দা থেকে ডাঃ হাউরের গলা শোনা গেল, কার সঙ্গে কথা বলছেন ভবভূতিবাবু?
অমনি মূর্তিটা একলাফে গাছের ডালে উঠে পড়ল। ফিসফিস করে বলল, এই? ওকে বোলো না মাইরি! ডাক্তার-টাক্তার দেখলেই আমার বড্ড বুক কাপে। ওরা যে ইনজেকশান দেয়।
ভবভূতি হাসি চেপে ডঃ হাউরকে বললেন,–ও কিছু না। আপনি বরং কালীপদকে কড়া করে কফি বানাতে বলুন। ঠান্ডা পড়েছে বেশ।
তাহলে আর শিশিরে ঘুরবেন না। বলে ডাঃ হাউর ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভবভূতি বললেন, কই হে ব্রহ্মদত্যি-মশাই, নেমে এসো!
–ডাক্তার আর আসবে না তো?
–না, না। তুমি নেমে এসো। উনি ডাক্তারও বটেন, ডক্টর-ও বটেন! কাজেই ভয় নেই।
ব্ৰহ্মদত্যি নেমে এল আবার। তারপর বলল-যাকগে। যেজন্যে তোমায় দেখা দিয়েছি, বলি! এতক্ষণ খালি বাজে বকবক কথা হল। ভবভূতিভায়া, তোমায় বন্ধু বলেই মেনে নিয়েছি! তো কথাটা হচ্ছে আমায় খানভাষাটা শেখাবে?
–নিশ্চয় শেখাব। ইতিমধ্যে শুনে-শুনে তো তুমি কিছু শিখেই ফেলেছ।
–হুঁউ। ভেউ উউ গ র র র র।
–উঁহু। ভেউ-উ-উ-উ র র র র। জিভ তালুতে ঠেকিয়ে উচ্চারণ করো।
–ভেউ-উ-উ-উ র র র র র র…
পরদিন গজপতি এসেছেন বন্ধুসকাশে। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়াটা ভালোই হয়েছে। ভবভূতি ভাতঘুম দিচ্ছেন অভ্যাসমত। ডাঃ হাউরও পাশের ঘরে নাক ডাকছে। কালীপদর তো সবসময়ে ঢুলুনি। সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে নেয়। সে শ্বান ভাষায় নাক ডাকছে– র র র র গো!
গজপতির দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই। বেরিয়ে গিয়ে রোদে দাঁড়িয়েছেন। সবে শীত পড়েছে। বেশ আরাম লাগে।
হঠাৎ কানে এল, বেলগাছ থেকে কে সুর ধরে আওড়াচ্ছে :
গর র র মানে এসো এসো–
ভেউ মানে কে রে?
ঘেঁউ মানে খবরদার–
যাব নাকি তেড়ে?
খ্যাঁক মানে কামড়াব
ভ্যাঁক মানে যাঃ।
আঁউ মানে পেটে ব্যথা–
কিছু খাব না…
গজপতি পা টিপে টিপে এগোলেন। নিশ্চয়ই ভবভূতির কোনও ছাত্র খান ভাষায় পড়া মুখস্থ করছে। পরীক্ষার সময় ছাত্ররা নিরিবিলিতে এমনি করেই তো মুখস্থ করে। গজপতি বেলতলায় গিয়ে মুখ তুলে দেখলেন, ঘন ডাল ও পাতার আড়ালে কালো কুচকুচে একটি বেঁটেখাটো টিকিওয়ালা মূর্তি আপনমনে বসে পড়াশুনো করছে। গজপতি বললেন,–কে হে তুমি? গাছের ডালে বসে ও কী মুখস্থ করছ?
মূর্তিটা পাতা সরিয়ে গজপতিকে দেখেই ফিক করে হাসল। তারপর হনুমানের মতো সড়-সড় করে নেমে এসে বলল,–গজু না তুমি? সেই অ্যাটুকুন দেখেছি ওরে বাবা! কত বড় হয়েছ তুমি? কত বুড়ো হয়েছ। সেই যে তোমার দিদি রাতের বেলা জানালায় দাঁড়িয়ে পান চিবুতে-চিবুতে আমার সঙ্গে গল্পগুজব করত–আর তুমি বিছানায় শুনে টুক-টুক করে তাকিয়ে দেখতে। সে কি আজকের কথা? এসো গজু, তোমায় আদর করি। ওরে আমার গজু ছোনারে! তোমার চুল কেন পাক? ওরে গজু রে গজু রে!…।
গজপতি ততক্ষণে গেটের কাছে। গেট বন্ধ! তখন পাঁচিলে উঠে পড়লেন কোনওরকমে। তারপর লাফ দিলেন। তারপর পড়ি-কিমরি করে দৌড়! একদৌড়ে ঘুঘুডাঙা স্টেশনে। আর এ জীবনে ও বাড়িতে নয় বাপস!
ব্ৰহ্মদত্যি দুঃখিত মনে বেলগাছে উঠে আবার পড়ায় মন দিল।
গজপতি আর সত্যিই আসেন না ঘুঘুডাঙায় ভবভূতির সরমা ভবনে। ভবভূতি, ডাঃ হাউর আর কালীপদ, আর সতেরোটা কুকুর, আর বেলগাছের…ব্রহ্মদত্যিমশাই দিব্যি কাটাচ্ছে। কুকুরগুলো আজকাল মানুষের ভাষায় কথা বলতেও পারে নাকি। তোমরা কেউ ইচ্ছে করলেই ঘুঘুডাঙায় হাজির হতে পারে। তবে সাবধান, ব্রহ্মদত্যি মশায়ের জন্য সন্দেশ নিয়ে যেতে ভুলো না। নয়তো বেলগাছ থেকে শ্বানভাষায় গর্জন শুনবে,–ঘেঁউ গঁর র র র!…