1 of 2

ভূত নয় অদ্ভুত

ভূত নয় অদ্ভুত

সেদিন বিকেলে আমার কুকুর জিমকে নিয়ে খেলার মাঠ ঘুরে ঝিলের ধারে ।যেতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। শুধু অদ্ভুত কেন, অসম্ভবই বলা উচিত। অথচ আমি চর্মচক্ষে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত কী আশ্চর্য! কী অবাক।

না, স্বপ্নও বলা যাবে না। কারণ আমি হেঁটে বেড়ানোর সময় ঘুমোব কেমন করে? এদিকে জিমও ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছে এবং আমার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত ঝিলের জলের ওপর মার্চের ভঙ্গিতে হাঁটতে-হাঁটতে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। মুখে মিটিমিটি হাসি! জয়ের হাসিই বটে। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, অসম্ভব! অসম্ভব!

বিজ্ঞানীপ্রবর ঝিলের জল থেকে কিনারার ঘাসে পা বাড়িয়ে বললেন,–বিজ্ঞান অসম্ভবকে সম্ভব করে। এটাই তার কাজ।

এতক্ষণে দৃষ্টি গেল ওঁর পায়ের দিকে। পায়ে গাবদাগোবদা কালো জুতো। বেটপ গড়নের এমন জুতো কোথাও দেখা যায় না। বললুম,–, বুঝতে পেরেছি। আপনার জুতোর ম্যাজিক।

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত হাসতে-হাসতে বললেন,–ম্যাজিক বলতেও পারেন। কারণ সব ম্যাজিকই কোনও না কোনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। তবে এই জুতোর সঙ্গে কিঞ্চিৎ ব্যালান্সের কসরতও জড়িত। সার্কাসে তারের ওপর হাঁটা নিশ্চয় দেখেছেন। সেইরকম আর কী! জুতো-জোড়া পরে জলে ব্যালান্স রেখে হাঁটা শিখতে আমার দিন সাতেক লেগেছে। আপনি চাইলে দিতে পারি।

ঝটপট বললুম, কী দরকার? জলে হাঁটার চাইতে মাটিতে হাঁটায় অনেক আরাম।

চন্দ্রকান্ত ঘাসে বসে পা থেকে কিম্ভুত গড়নের জুতদুটো খুলে ফেললেন। তারপর জিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, বরং ওর জন্য দু-জোড়া জল-জুতো তৈরি করে দেব। দেখবেন, একদিনেই জলের ওপর ছুটোছুটি করতে শিখে গেছে। কারণটা বুঝতে পারছেন তো? ওর শরীরটা আমার-আপনার চেয়ে অনেক হালকা।

জিমের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে তার চারটে ঠ্যাঙের জন্য দু-জোড়া জল-জুতো পেলে ধরাকে সরা জ্ঞান তো করবেই, আমাকেও আর পাত্তা দেবে না। সে জল-জুতো দুটো শুঁকতে পা বাড়ালে ধমক দিলুম। তখন সরে এল। ঠ্যাং মুড়ে করুণচোখে তাকিয়ে রইল বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের দিকে।

চন্দ্রকান্ত পাইপে তামাক ভরতে-ভরতে বললেন,–জিম আমার-আপনার বা যে-কোনও মানুষের চেয়ে জল-জুতো পরে হাঁটা অনেক আগে কেন শিখতে পারবে, তার কারণ আছে। মানুষ ছাড়া সব প্রাণীই জন্মের পর খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে শেখে। কিন্তু মানুষের দেরি লাগে। ওই যে বলে হাঁটি হাঁটি পা-পা!

বললুম, বুঝলুম। কিন্তু জলের ওপর হেঁটে লাভটা কী? জলের ওপর নৌকোয় চেপে যাওয়ার মতো আনন্দ পাওয়া যাবে কি? কিংবা ধরুন জলে ভাসা অর্থাৎ সাঁতার কাটারও একটা আনন্দ আছে। বিজ্ঞান যদি মানুষের জীবন থেকে এইসব আনন্দ কেড়ে নেয়, সেটা কি উচিত কাজ হবে?

বিজ্ঞানী পাইপে আগুন দিলেন। তারপর একরাশ ধোঁয়ার ভেতর বললেন, আবর্ণ ব্যাপারটা নিয়ে তর্ক করার মুড নেই। কারণ এখন আমি আনন্দের ভেতর বুঁদ হয়ে আছি। জলে হাঁটার যে কী আনন্দ, যে-মানুষ জলে হাঁটেনি, তাকে বোঝানো কঠিন।

একটু হেসে বললুম,–এরপর কবে দেখব, আপনি পাখির মতো সটান মাটি ছাড়া হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছেন!

চন্দ্রকান্ত বললেন, কী বলছেন মশাই! সে তো সায়েবদের দেশে কবে শুরু হয়ে গেছে। এমনকী, গ্লাইডারে ওই তো এখন সেকেলে ব্যাপার হয়ে গেছে। না, না। প্যারাশুটের কথা বলছি না। বেলুনের কথাও না। পিঠে রুকস্যাকের মতো চৌকো বোঁচকা বেঁধে সটান পাখির মতো ওড়াউড়ি। বোঁচকাটার ভেতর থাকে ঠাসা হাইড্রোজেন গ্যাস। ইচ্ছেমতো কন্ট্রোল করার অসুবিধে নেই।

পা বাড়িয়ে বললুম,–দরকার নেই মশাই! দিব্যি আছি। ঝুটঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী?

বিজ্ঞানী মন্তব্য করলেন, আপনি বড় সেকেলে।

ঝিলের ধারে হাঁটতে-হাঁটতে কিছুটা চলার পর ঘুরে দেখি, চন্দ্রকান্ত তাঁর জল জুতো বগলদাবা করে বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছেন। মন তেতো হয়ে গেল। বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা? জল, মাটি, আকাশ এসবের সঙ্গে মানুষের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে, তা দুমদাম ভেঙে ফেলা উচিত হচ্ছে কি? নামোটরগাড়ি, বিমান, জাহাজের ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু চন্দ্রকান্ত মাঝে-মাঝে যা-সব করছেন, তা অন্যরকম। একেবারেই আলাদা ধরনের। এই জল-জুতোর ব্যাপারটাই ধরা যাক। এটা যদি বাজারে চালু হয়ে যায়, আর নৌকো, জাহাজ, স্টিমার, লঞ্চ এসব জলযানের দরকার হবে না। কত শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। কত লোকের মুখের অন্ন যাবে। কোনও মানে হয়?…

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তকে তারপর থেকে এড়িয়ে চলাই উচিত মনে করেছিলুম। দূর থেকে ওঁকে দেখতে পেলে অন্য দিকে কেটে পড়ছিলুম। কিন্তু জিমের মতিগতি দেখে সন্দেহ জাগছিল। যখনই সে দূরে কোথাও ওই বিজ্ঞানী ভদ্রলোককে দেখতে পায় কেমন যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর কান টেনে দিয়ে বলি,–ওরে হতভাগা! বেশ তো চার ঠ্যাঙে নেচে কুঁদে বেড়াচ্ছিস। বেশি লোভ নয়। তুই যা, তাই থাক। তুই কি জল-মাকড়সা যে তরতর করে জলের ওপর দৌড়োদৗড়ি করবি?

জিম তবু বারবার মুখ ঘুরিয়ে চন্দ্রকান্তকে দেখতে থাকে।

একদিন খেলার মাঠে বসে আছি। জিম আমার বগলদাবা। ছেলেরা ফুটবল খেলছে। হঠাৎ ফুটবলটা জোরালো কিক খেয়ে ঝিলের জলের মধ্যিখানে গিয়ে পড়ল। খেলুড়েরা হইহই করে ঝিলের ধারে গেল। বলটা উদ্ধার না করলে খেলা বরবাদ। কেউ ঢিল ছুঁড়ে বলটাকে কাছে আনার চেষ্টা করতে থাকল। কেউ জাঙিয়া পরে জলের নামার জন্য তৈরি হল। এমন সময় ঝোঁপঝাড়ের ভেতর থেকে বিজ্ঞানীপ্রবরের আবির্ভাব ঘটল। ঝোঁপের ভেতর নিশ্চয় একটা কিছু করছিলেন। মনে হল, সেই গোপন কাজটা ফেলে আসায় একটু বিরক্তও হয়েছেন। বললেন, কী হল? এত হল্লা করছ কেন তোমরা? খেলা আর হল্লা এক জিনিস নয়, জানো না?

চন্দ্রকান্তকে সবাই খুব সমীহ করে চলে। তার একটা বড় কারণ, গত বছর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এশহরে এসে ওঁকে কী যেন একটা পদক-টদক দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন,–এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আমাদের দেশের গর্ব। জাতির গর্ব। যাই হোক, তারপর থেকে ভদ্রলোককে ছোট-বড় সব্বাই খাতির করে প্রচণ্ড খাতিরই বলতে হবে। এই ফুটবল-খেলুড়েদের বিদ্রূপনা আমার জানা আছে। তারা যে ইচ্ছে করেই কাদামাখা ফুটবল আমার দিকে পাঠায়, আমি কি বুঝি না? দেখলুম, চন্দ্ৰকান্তের সামনে সব্বাই নিরীহ কেঁচো বনে গেছে। একজন কঁচুমাচু মুখে বলল, জলে বল পড়েছে, স্যার!

শোনামাত্র চন্দ্রকান্ত ফিক করে হাসলেন, তাই বলো,–বলে সেই ঝোঁপটার ভেতর ঢুকে গেলেন। খেলুড়েরা হল্লা থামিয়ে ফের জলের দিকে ঘুরল! এরপর কী ঘটবে, একমাত্র আমারই জানা! চন্দ্রকান্তকে ফের দেখা গেল। জলের ওপর গটগট করে হেঁটে গিয়ে বলটি তুললেন এবং চমৎকার একটা কিকে সেটিকে মাঠে ফেরত পাঠালেন। ছেলেগুলো ব্যাপারটা দেখে প্রথমে বেজায় ভড়কে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের মন পড়ে আছে বলে। কাজেই বলটার দিকেই দৌড়ে গেল। আবার পুরোদমে খেলা চলতে থাকল। তখন বুঝলুম, চন্দ্ৰকান্তের অদ্ভুত সব কীর্তিকলাপ দেখে-দেখে সবাই এমনই অভ্যস্ত যে, এসব নিয়ে কেউ কথা ঘামাতে চায় না।

শুধু আমি বাদে। আমিই মাথা ঘামাই। চিন্তিত হই। মনে হয়, এত বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। পৃথিবীটাকে এত ঝটপট অন্যরকম করে ফেলা উচিত হচ্ছে না।

কিন্তু ঝোঁপের ভেতর কী করছেন চন্দ্রকান্ত? ঝোঁপগুলো মাঝে-মাঝে নড়ে উঠছে। খুব সন্দেহজনক ব্যাপার। জিমকে বগলদাবা করেই উঠে পড়লুম। ছাড়া পেলে জিম বিজ্ঞানীপ্রবরের ঠ্যাঙের তলায় গিয়ে ঢুকবেই, যা বুঝতে পারছি ওর মতিগতি দেখে এবং একবার ওঁর খপ্পরে পড়লে আর উদ্ধার করাই যাবে না। একটা বশীকরণ ক্যাপসুল খাইয়ে দিলেই হল–কিছু বলা যায় না।

উঁকি মেরেই অবাক। ঝোঁপের ভেতর রামু-ধোপা তার গাধাটাকে শুইয়ে ওপারে গাট মেরে বসে আছে। বেচারাকে নড়তে-চড়তে দিচ্ছে না। আর চন্দ্রকান্ত প্রাণীটার চার ঠ্যাঙে সেই জল-জুতো পরাচ্ছেন।

না হেসে পারা গেল না। আমার হাসি শুনে বিজ্ঞানী মুখ ফেরালেন। বললেন, এই যে! আসুন, আসুন।

ফাঁকা জায়গায় ঢুকে বললুম, ব্যাপারটা কী?

রামু একগাল হেসে বলল, খুবই সুবিধে হবে দাদাবাবু, বুঝলেন?

-সুবিধেটা কীসের?

–আজ্ঞে দাদাবাবু, ঝিলের মধ্যিখানে কত দাম গজিয়ে আছে। এবার থেকে মনের সুখে সেখানে গিয়েও চরতে পারবে।

চন্দ্রকান্ত জল-জুতো পরাতে-পরাতে বললেন,–সেদিন আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়নি। সেটা হল, মানুষের চেয়ে আর সব প্রাণী জন্মের পর দ্রুত হাঁটতে শেখে কেন? না–তাদের চারটে করে ঠ্যাঙ আছে। চার-ঠেঙেদের ব্যালান্স আর দু-ঠেঙেদের ব্যালান্সে তফাত আছে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ব্যাপারটা আশা করি জানেন?

চুপ করে থাকলুম। গাধাটার চতুর্থ পায়ে জল-জুতো ঢুকিয়ে স্কু আঁটতে-আঁটতে বিজ্ঞানী ফের বললেন,–বলবেন, পাখিরাও তত মানুষের মতো দু-ঠেঙে। কিন্তু পাখিদের হাড় কঁপা। তাই ওজন হালকা। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তাদের বাগে পায় না। যত সমস্যা খালি মানুষের।

বলে রামুকে উঠতে ইশারা করলেন। রামু তার গাধার ওপর থেকে সরে যেতেই গাধাটা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। অমনি চন্দ্রকান্ত তার দুটো কান ধরে ফেললেন। বললেন,-রামু, পেছন থেকে ঠেলে দাও। শিগগির!

রামু ঠেলতে শুরু করল। চন্দ্রকান্ত প্রাণীটাকে জলের ধারে নিয়ে গেলেন। এরপর রীতিমতো একটা লড়াই বেধে গেল। গাধাটা কিছুতেই জলে নামবে না। প্রচণ্ড আপত্তি তার গলা দিয়ে বিকট হয়ে বেরোল। গাধার ডাক কাছ থেকে শোনা। বাপস!

চন্দ্রকান্ত আমার উদ্দেশ্যে বললেন,–ও মশাই! হাঁ করে দেখেছেনটা কী? হাত লাগান! এমন একটা বৈপ্লবিক কাজে সহযোগিতা করবেন না? আসুন, আসুন।

অগত্যা জিমকে নামিয়ে দিয়ে গাধাটার পেছনে যেতে হল। কিন্তু গাধাটা পেছনের ঠ্যাং ছুড়ছে, ব্যাপারটা বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই সাবধানে পাশ থেকে বরং কাতুকুতু দেওয়াই উচিত মনে করলুম এবং তাতে কাজ হল। গাধাটা আমার কাতুকুতুর চোটে মরিয়া হয়ে ঝাঁপ দেওয়ার ভঙ্গিতে জলে নেমে গেল।

না–নেমে গেল বলা ভুল। হেঁটে গেল। হাঁটতে গিয়ে রীতিমতো দৌড়তে শুরু করল। বিজ্ঞানী চেঁচিয়ে উঠলেন, খাসা! অপূর্ব! তোফা!

রামু একগাল হাসির সঙ্গে চ্যাঁচিতে থাকল, সোজা চলে যা বাপ! ওই দ্যাখ, কত্ত দাম! মনের সুখে পেট পুরে খা!

গাধাটা আশ্চর্য, এতটুকু অবাক হল না–তুই ব্যাটা স্থলচর প্রাণী হয়েও যে জলে দিব্যি হেঁটে যেতে পারছিস, তাও লক্ষ করছিস না? মনে-মনে বললুম, এ-জন্যই লোকে বলে গাধা!

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত পাইপ ধরাচ্ছিলেন। ঠোঁটের কোণায় গর্বের হাসি। জিম একবার জলচর গাধাটার দিকে, একবার চন্দ্রান্তের দিকে তাকাচ্ছে। ওর দুচোখে লোভ চনমন করছে। পড়ন্ত বেলায় বিশাল ঝিলের জলে লালচে রোদ্দুর ঝলমল করছে। খেলার মাঠ থেকে খেলুড়েদের আবার একটা হুল্লোড় ভেসে এল। তারপর দেখলুম, ফুটবলটা আবার আকাশ বেয়ে এসে ধপাস করে ঝিলের মধ্যিখানে পড়ল।

হাসতে-হাসতে বললুম, যান আবার ফুটবল কুড়িয়ে দিন।

চন্দ্রকান্ত বললেন,–ভাববেন না। ওই দেখুন, বলটা যাচ্ছে গাধাটার কাছে। আশা করা যায়, গাধাটা ওটার একটা সদগতি করবে।

করলও বটে। বলটা ভাসতে-ভাসতে কাছে যাওয়া মাত্র দামখেকো গাধাটা নিশ্চয় বিরক্ত হয়েই পেছনের ঠ্যাং দিয়ে কিক করল। অমনি বলটা হাইকিকে ফের খেলার মাঠে। আশ্চর্য! এতে খেলুড়েরা অবাক হল না? আবার পুরোদমে খেলতে শুরু করল।

বিজ্ঞানী মৌজ করে পাইপ টানছিলেন। বললেন, কী মশাই? আপনার কুকুরের জন্য জল-জুতোর প্রস্তাব দিয়েছিলুম। কী সিদ্ধান্ত করলেন, বলুন?

বললুম, কী দরকার? জিম তো জলজ উদ্ভিদ খায় না রামুর গাধার মতো! কাজেই ব্যাপার অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু আমি খালি একটা কথা ভাবছি।

–বলুন কী ভাবছেন?

–ভাবছি, আজকাল মানুষ অবাক হতে ভুলে গেছে। এটা ঠিক নয়।

–কেন বলুন তো?

–মানুষ অবাক হতে ভুলে গেলে পৃথিবীটা হয়তো আর আনন্দময় ঠেকবে । সব একঘেয়ে হয়ে যাবে।

বিজ্ঞানী মুচকি হেসে বললেন,–সেদিন বলেছি, আনন্দ-টানন্দ নিয়ে তর্ক করার মুড আর আমার নেই। কারণ আমি ক্রমশ সদানন্দ হয়ে আছি। কিছু বুঝলেন?

–উঁহু।

–বুঝবেন। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন। আপনাকে আমি একজোড়া ডানা তৈরি করে দেব।

–বলেন কী।

–হুঁ। অসম্ভব সম্ভব হলে মানুষের মনে কী ভাব জাগে, সেটা আপনার টের পাওয়া দরকার। কারণ আমার ধারণা, আনন্দ বলতে ঠিক কী বোঝায়, আপনি জানেনই না!

এই সময় রামু বলে উঠল, আচ্ছা বাবুমশাই, আমার গাধাটা যদি ওখানে থেকেই যায় আর যদি বাড়ি না ফেরে?

চন্দ্রকান্ত চোখ কটমটিয়ে বললেন,–কেন এ কথা ভাবছ তুমি?

রামু চিন্তিত-মুখে বলল,-দেখুন না, দাম খাচ্ছে তো খাচ্ছে। ব্যাটাছেলের খেয়াল নেই, এখনই শুকুতে দেওয়া কাপড়-চোপড়ের বোঁচকা নিয়ে ওকে বাড়ি ফিরতে হবে।

চন্দ্রকান্ত বললেন,–ভেবো না। বরং আমার জল-জুতো জোড়া পরে জলে হাঁটার প্র্যাকটিস চালিয়ে যাও। নাও, পররা।

রামুকে জল-জুতো পরতে দেখে আমার কেন যেন রাগ হল। ভাবা যায়? রামু জল-জুতো পরে জলে হেঁটে তার গাধাটাকে খেদিয়ে আনবে! এ একটা বিদঘুঁটে অনাছিষ্টি ছাড়া কী? মুখ গোমড়া করে জিমকে তুলে নিয়ে কেটে পড়লুম।

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন, আর দিনতিনেক অপেক্ষা করুন। আপনার ডানা পেয়ে যাবেন।

দুদিন পরে বিকেলে অভ্যাসমতো জিমকে নিয়ে ঝিলের ধারে বেড়াতে গেছি। দেখি, রামু মুখ চুন করে জলের ধারে বসে আছে। বললুম, কী রামু, তোমার গাধার খবর কী?

রামু চোখ মুছে বলল, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে দাদাবাবু! গাধাটা ডুবে মরেছে।

চমকে উঠে বললুম,–সে কী! ওর পায়ে তো জল-জুতো ছিল।

থাকলে কী হবে? রামু ভাঙা গলায় বলল।কাঁটা-খোঁচা লেগে কখন ছাদা হয়ে গিয়েছিল। সক্কালে ঝিলের মাঝখানে গেছে, অমনি হ্যাঁদা দিয়ে জল ঢুকে ভড়ভড় করে ডুবে তলিয়ে গেল।

–তোমার তৌ জল-জুতো আছে। দৌড়ে গিয়ে ওকে–

বাধা দিয়ে রামু বলল, সাহস হল না দাদবাবু! যদি এতেও ছাদা হয়ে থাকে? তাছাড়া তেমন পেরাকটিসও তো হয়নি। কসরতের ব্যাপার!

খাপ্পা হয়ে বললুম,–চন্দ্রকান্তবাবুর কাছে তোমার খেসারত দাবি করা উচিত ছিল। গাধার দাম আর জরিমানা!

রামু ফোঁসফোঁস করে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,–গিয়েছিলুম তো। গিয়ে দেখি দরজায় তালা ঝুলছে।

হুঁ, বেগতিক দেখে কেটে পড়েছেন বিজ্ঞানী। কিন্তু এর একটা বিহিত করা উচিত। পাড়ার লোকেদের ডেকে একটা মিটিং করতে হবে। তারপর জেলাশাসকের কাছে চন্দ্ৰকান্তের নামে একটা দরখাস্ত। এই সব উদ্ভুট্টে কাণ্ড করে ভদ্রলোক এরপর আরও কত লোকের ক্ষতি করবেন কে জানে।

ফেরার সময় চন্দ্ৰকান্তের বাড়ির পাশ দিয়েই গেলুম। রামু ঠিকই দেখেছে। দরজায় প্রকাণ্ড তালা ঝুলছে। কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে গেছি হঠাৎ শনশন শব্দ। গাছপালা তোলপাড়। তারপর ওপর থেকে কী একটা ঝুপ করে পড়ল, একেবারে সামনাসামনি। দেখি, বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত। দু-বাহুতে দুটো ডানা–সত্যিই ডানা। প্রকাণ্ড ডানা। ফিক করে হেসে বললেন, কী? বলেছিলুম না আপনার জন্য একজোড়া ডানা তৈরি করে দেব। পাখি হয়ে ইচ্ছেমতো ওড়াউড়ি করে বুঝবেন, অসম্ভব সম্ভব হওয়ার আনন্দটা কতখানি!

বললুম,–দেখুন মশাই, এ সব উদ্ভুট্টে ব্যাপারে আমি নেই।

–সে কী! কেন বলুন তো?

–আপনি জানেন রামুর গাধাটা জলে ডুবে মারা পড়েছে?

–কী কাণ্ড। রামু তো বলেনি আমাকে।

–আপনার দেখা পেলে তো বলবে।

চন্দ্রকান্ত দুঃখিত মুখে বললেন, আপনার এই ডানার কাজে দুদিন ব্যস্ত ছিলুম। যাই হোক, গাধাটার তো ডুবে মরা উচিত ছিল না।

–উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন নয়। জল-জুতোয় হ্যাঁদা হয়েছিল!

চন্দ্রকান্ত একটু হাসলেন। বুঝেছি! নেহাত একটা দুর্ঘটনা। ঘঁাদার জন্য নৌকো ডোবে কি না বলুন আপনি? দোষ তো নৌকোর বা যে তৈরি করেছে নৌকো, তার নয়-মাঝির। মাঝির এসব ব্যাপারে নজর রাখা উচিত!

–ধুর মশাই! গাধা কেমন করে বুঝবে যে জল-জুতোয় ছ্যাঁদা হয়েছে?

–আহা! রামুর উচিত ছিল জলে হাঁটানোর সময় পরীক্ষা করে দেখা।

–রামু একজন নিরক্ষর লোক। সে কী করে ওসব যন্ত্রের ব্যাপার বুঝবে?

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত জিভে চুকচুক শব্দ তুলে বললেন, আহা রে, বেচারা! আপনি ঠিকই বলেছেন। রামুকে আমারই শিখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, জল-জুতো ছাদা হয়েছে কি না, কীভাবে পরীক্ষা করতে হয়! যাই হোক, ওকে বরং একটা গাধা কেনার টাকা দেবোখন। আসুন, আপনাকে ডানাদুটো পরিয়ে দিই।

ভড়কে গিয়ে বললুম, না মশাই, পাখি হয়ে দরকার নেই আমার।

চন্দ্রকান্ত হাসতে লাগলেন। বুঝেছি! ঘঁাদা-ঊ্যাদার ভয় হচ্ছে তো? আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে তবে না এতক্ষণ ওড়াউড়ি করে বেড়ালুম?

ভয় নেই। গ্যারান্টি রইল–আপনি আকাশ থেকে পড়বেন না।

চন্দ্রকান্ত ডানা খুলতে ব্যস্ত হলেন। আমি সেই ফাঁকে কেটে পড়লুম মানে, প্রায় দৌড়ে পালিয়ে বাঁচলুম।

কিন্তু সেটাই প্রকাণ্ড একটা ভুল হয়ে গেল। পালিয়ে-টালিয়ে আসার সময় মানুষের অবস্থা হয় চাচা, আপন প্রাণ বাঁচার মতো। জিমের কথা মনে ছিল না। ফলে জিম নিশ্চয় সুযোগটা নিল। কারণ বাড়ি ঢুকতে গিয়ে তার কথা যখন মনে পড়ল, দেখি সে নেই। সর্বনাশ!

চেঁচিয়ে ডাকলুম,–জিম! জিম! জিম! কিন্তু তার আর পাত্ত নেই।

হতভাগা বুদু যদি চন্দ্ৰকান্তের পাল্লায় পড়ে থাকে, নিশ্চয় তাকে জল-জুতো পরতে হবে এবং তারপর ঠিক রামুর গাধাটার মতোই…

ভাবতে গিয়ে বুক কেঁপে উঠল। তখন মরিয়া হয়ে চন্দ্ৰকান্তের বাড়ির দিকে ফের হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলুম।

চন্দ্রকাস্তের বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেখি, তেমনই তালা বন্ধ। যে-রাস্তায় একটু আগে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেখানেও সব শুনশান, ফঁকা। বুঝলুম, জিমকে নিয়ে বিজ্ঞানীপ্রবর গা-ঢাকা দিয়েছেন কোথাও। গুজব শুনেছি, চন্দ্ৰকান্তের একটা ল্যাবরেটরি আছে কোনও এক গোপন জায়গায়। সেখানেই নাকি যত উদ্ভুট্টে জিনিস আবিষ্কার করেন ভদ্রলোক। বাড়িটা নেহাত বসবাসের জন্য এবং নিতান্তই পৈতৃক। এ-বাড়িতে আমি যেমন, তেমনই অন্য কেউই কোনও ল্যাবরেটরি কস্মিনকালে দেখিনি। খুব ভাবনায় পড়ে গেলুম। জিমটা এত বুদ্ধ আর ন্যালা-ভোলা, সেটাই ভাবনার কারণ ।

কদিন ধরে বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের খোঁজে সারা শহর, মাঠ-ময়দান, বন-জঙ্গল, এমনকী এলাকার প্রায় সবটাই চষে বেড়িয়েছি। গোয়েন্দার মতো সূত্র খুঁজেছি। মেলেনি। আমাদের এই এলাকাটা অসমতল, এখানে-ওখানে ছোট-বড় টিলাও আছে। এমন একটা জায়গায় কাউকে খুঁজে বের করাও কঠিন। শেষে পুলিশে খবর দেওয়াই ঠিক করলুম।

থানায় যাব বলে তৈরি হচ্ছি সেই সময় রামু-ধোপা এল হাঁপাতে হাঁপাতে।–দাদাবাবু! শিগগির আসুন।

–কী হয়েছে, রামু?

রামু বলল, আমার গাধার অবস্থা দাদাবাবু! ঠিকঠাক গাধার অবস্থা।

বিরক্ত হয়ে বললুম,–ভ্যাট! কার গাধার অবস্থা বলবে তো?

–আজ্ঞে দাদাবাবু, আপনার কুকুরটার!

লাফিয়ে উঠলুম। –জিম? কোথায় জিম? ঝিলের জলে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

হুঁ, যা ভেবেছিলুম তাই। দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলুম রামুর সঙ্গে। খেলার মাঠ পেরিয়ে ঝিলের ধারে পৌঁছে দেখি, ঝিলের জলের মধ্যিখানে চন্দ্রকান্ত আর জিম লুকোচুরি খেলছে। জলজ দাম আর শোলাগাছের ভেতর একটি দু-ঠেঙে এবং একটি চার-ঠেঙে প্রাণী ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানী মাঝে-মাঝে শোলাঝোঁপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বলছেন, জিমি টু-কি!

তারপর দুজনে বরফে স্কেটিং খেলার মতো জলের ওপর স্কেটিং শুরু করল। চেঁচিয়ে উঠলুম,–জিম! জিম! এই হতভাগা!

চন্দ্রকান্ত থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। রোদ্দুরে তাঁর দাঁত চকচক করতে থাকল। তার মানে, হাসছেন। খাপ্পা হয়ে বললুম, আপনার নামে পুলিশ-কেস করব বলে দিচ্ছি।

চন্দ্রকান্ত স্কেটিং করে চলে এলেন কাছাকাছি। ভুরু কুঁচকে বললেন, কী করবেন বললেন যেন?

–পুলিশকে জানাব।

চন্দ্রকান্ত খি-খি করে হেসে বললেন,–তা জানাতে পারেন। তবে এও জানাবেন, এলাকার সব চোর-চোট্টাকে তাহলে আমি জল-জুতো আর ডানা তৈরি করে দেব। পুলিশ তখন তাদের আর পাকড়াও করতেই পারবে না! চোর যদি উভচর হয়, পুলিশের কী অবস্থা হবে, আশা করি, বুঝতেই পারছেন!

ওঁর কথায় কান না দিয়ে ফের ডাকতে থাকলুম,–জিম! জিম! এই নেমকহারাম হতচ্ছাড়া!

এতক্ষণে জিম আমাকে দেখতে পেল। কিন্তু এবার সে জলের ওপর দিয়ে দৌড়ে এল না। হঠাং জল-ছাড়া হয়ে পাখির মতো ডানা মেলে আকাশে উড়ল এবং আমার মাথার ওপর বারতিনেক চক্কর দিয়ে ঝুপ করে মাটিতে নামল। লেজ নাড়তে লাগল। অমনি খপ করে তাকে ধরে ফেললুম।

চন্দ্রকান্ত জল থেকে ডাঙায় উঠে জল-জুতো খুলতে-খুলতে বললেন, আপনার ডানাদুটো কিন্তু রাখা আছে সযত্নে। চাইলে এখনও দিতে পারি। আর যদি শেষপর্যন্ত না-ই নেন, রামুকেই দেব। এই রামু, যাসনে। কথা আছে শোন! ডানা পরে পাখি হবি?

রামু কী বুঝল সেই জানে। সে হন্তদন্ত হয়ে কেটে পড়ল। বিজ্ঞানী বাঁকা হেসে পাইপ বের করে বললেন, আশ্চর্য! মানুষের ভালো করতে গেলেই গাল খেতে হয় দেখছি। আপনার জিমকে উভচরে পরিণত করলুম–সেজন্য আপনি আমার প্রশংসা করবেন, তা নয়। উল্টে পুলিশের কথা বলে শাসাচ্ছেন!

জিমের চার ঠ্যাং থেকে চারটে জল-জুতো খুলে চন্দ্ৰকান্তের সামনে ছুঁড়ে ফেললুম। তারপর ওর দুই কাঁধ থেকে ডানার মতো জিনিস দুটো অনেক টানাটানি করে খুলে ফেললুম। জিম মুখ গোমড়া করে রইল। ডানাদুটোও ফেলে দিয়ে বললুম,

–আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি চন্দ্রকান্তবাবু, আর কখনও আমার কুকুর চুরি করবেন না। নিজে কুকুর পুষে যা ইচ্ছে করুন!

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত পাইপ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,–অগত্যা তাই করতে হবে। তবে ডানাদুটো

আমি পাখি নই, মানুষ। বলে চলে এলুম। তবে এ কথা ঠিকই, ডানাদুটো পরে একবার পাখির মতো ওড়াউড়ি করে দেখতে লোভ যে হচ্ছিল না, এমন নয়। ভয় শুধু একটাইযদি ছাদা থাকে? তাহলে রামুর গাধা-বেচারার মতো–বাপস! ভাবতেই শরীর ঠান্ডা হিম হয়ে যায়। ঝুটঝামেলায় কী দরকার? বেশ তো আছি দু ঠেঙে হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *