জটায়ুর পালক
সেদিন খুব মন দিয়ে একটা বই পড়ছি, পায়ে কুট করে যেন পিঁপড়ে কামড়াল। পা আলগোছে নাড়া দিয়ে ফের বইয়ের পাতায় ডুবে রইলাম। ভারি জমাটি গোয়েন্দা কাহিনি। গোয়েন্দা অফিসারকে বেঁধে ডাকাতরা বস্তায় ভরছে। এক্ষুনি সমুদ্রে ফেলে দেবে। কী হয় কী হয় অবস্থা। উত্তেজনায় আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠেছে।
ফের কুটুস করে যেন পিঁপড়ের কামড়। এবার যেন গেঁয়ো পিঁপড়ে। বিরক্ত হয়ে থাপ্পড় মারতে গিয়ে দেখি, শ্রীমান ডন টেবিলের তলায় বসে এই কম্মটি করছে।
খপ করে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে তাকে বের করলুম। তারপর গর্জে বললুম,–তবে রে বাঁদর ছেলে! গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি!
ডন কাচুমাচু মুখে বলল,–অত যে ডাকলুম, তুমি তো শুনতেই পেলে না!
–তাই বলে তুই চিমটি কাটবি হতভাগা?
তোমার সঙ্গে যে আমার ভীষণ দরকার মামা! –ডন মুখে-চোখে কাকুতি মিনতি ফুটিয়ে বলল,–সত্যি বলছি, দারুণ দরকার!
ডনের দরকারে আমার সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। কারণ, তাহলে আর বইটি পড়াই হয়ে উঠবে না। পিঁপড়ের কামড় দিয়ে সবে তার জ্বালাতনের নমুনা শুরু। এরপর জানলা দিয়ে আস্ত ইটের টুকরো এসে পড়ারও চান্স আছে। যা বিচ্ছু ছেলে!
তাই বললুম, ঝটপট বলে ফেল তাহলে। দেরি কোরো না। দেখ না আমি এখন ব্যস্ত।
ডন তার পিঠের দিকের জামার ভেতর থেকে কী একটা টেনে বের করল। অবাক হয়ে দেখি, আন্দাজ ফুটখানেক লম্বা একটা সাদা-কালোয় চকরাবকরা পালক। জানলা দিয়ে উপচে আসা শেষবেলার রোদ্দুরে পালকটাতে ফিনফিনে সবুজ রঙও ঝিলমিলিয়ে উঠল একবার। ডন বলল, বলো তো মামা, এটা কোন পাখির পালক?
পালকটাও ওর হাত থেকে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললুম,–ঠিক বুঝতে পারছি না। সারস জাতীয় কোনও পাখির পালক হয়তো। এ তুই কোথায় পেলি রে?
ডন মুখ টিপে হাসল। বলতে পারলে না তো! মামা, তুমি রামায়ণের গল্প পড়োনি?
–রামায়ণের সঙ্গে এটার কী সম্পর্ক?
ডন ফিসফিস করে বলল, রাবণরাজা সীতাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন সেই যে একটা পাখি এসে রাবণরাজার মাথায় করে দিল আর মুকুট পড়ে গেল–তখন রাবণরাজা মারল তলোয়ারের কোপ। এক কোপে পাখিটার ডানা কেটে গেল। কী যেন নাম পাখিটার, বলো না মামা? পেটে আসছে, মুখে আসছে না…
হাসতে হাসতে বললুম,–হুঁ–জটায়ু পক্ষী।
টায়ুর পালক
–পক্ষী না মামা, পাখি!
–বেশ তাই হল।
স্বীকার করে নিলুম। নইলে কথা বাড়বে। ডনটা যা তবাজ–তো, তুই কি বলতে চাস, এটা সেই জটায়ুর পালক-মানে, রাবণের তলোয়ারের কোপে যেটা কাটা পড়েছিল?
ডন রহস্যের ভঙ্গি করে বলল,–ঠিক বলেছ। সেজন্যই তো তোমার কাছে এলাম।
–ঠিক আছে। এখন যাও, আমি ব্যস্ত!
ডন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ধুস! এখনও আমার দরকারটা বলাই হয়নি। তুমি জিগ্যেস করো পালকক্টা কোথায় পেলুম!
তারপর সে আমার জিগ্যেস করার আগেই বলতে শুরু করল, পালটা পেয়েছিল হারু-গয়লা–ওই যার খাটাল আছে শিবমন্দিরের পেছনে। কোথায় পেল জানো? তার একটা গরু বেজায় দুষ্টু। চরতে-চরতে নদীর ওপারে চলে গিয়েছিল। গরুটাকে খুঁজতে গিয়ে হারু পালকটা পেয়েছে।
–বুঝলুম। এবার এসো।
ডন গ্রাহ্য করল না। বলল,–এই পালটা যদি সুতো দিয়ে পিঠে বাঁধো মামা, তাহলে তুমি দিব্যি পাখির মতো উড়তে পারবে। দাও না মামা খানিকটা সুতো!
জানি, সুতো যেভাবে তোক জোগাড় করে দিতেই হবে। নইলে রেহাই পাব । কাজেই উঠতে হল। পাশের ঘরে ডনের দাদা শ্ৰীমান টমের ঘুড়ির লাটাই থেকে খানিকটা সুতো ছিঁড়ে আনতেই হল। টম এখন ক্রিকেট খেলতে গেছে। বাড়ি থাকলে কাজটা কঠিনই হতো।
ডন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, পালটা পিঠে বেঁধে দাও মামা। শক্ত করে বাঁধবে যেন। নইলে যদি খুলে যায়, পড়ে ছাতু হয়ে যাব।
কষে বেঁধে দিলুম ওর ডান কাঁধের কাছে পালকটা। তারপর ডন বলল,– এবার দেখ মামা, আমি উড়ে চললুম, রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…
সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তখন আমি ফের গোয়েন্দা কাহিনি পাতায় চোখ রাখলুম।…
ব্যাপারটা যে শেষ পর্যন্ত এতদূর গড়াবে ভাবতে পারিনি। সন্ধ্যার মুখে টম ফিরে এসে যেভাবেই হোক টের পেল যে, তার লাটাইয়ের সুতো ছেঁড়া হয়েছে। খুব লম্ফঝম্প করে সে ডনকে খুঁজে বেড়াল। আলমারির পেছন, টেবিলের তলা, এমনকী খাটের তলা খুঁজে ডনকে পিট্টি দেওয়ার তাল করল। কিন্তু কোথায় ডন দিদি চেঁচামেচি করেও ছেলেকে শান্ত করতে পারলেন না। শেষে ওদের বাবার নামে শাসালেন। জামাইবাবু মফস্বল শহরের উকিল। কোর্ট থেকে ফিরে কোন ক্লাবে যেন দাবা খেলতে যান। ফেরেন রাত নটার পরে।
বেগতিক দেখে বললুম, উম! তোর সুতো ইঁদুরে ছিঁড়েছে। বাড়িতে কত ইঁদুর দেখতে পাসনে? থাম কালই একডজন বেড়াল এনে রাখব।
টম শান্ত হয়ে পড়তে বসল। এবার আমিই ডনকে খুঁজতে থাকলুম। টমের ভয়েই ডন নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে আছে। বাড়ির চারধারে সবজি ও ফুলফলের বাগান। জ্যোৎস্না ফুটেছে। বাগানে গিয়ে চাপা গলায় ডাকলুম,–ডন! ও ডন! বেরিয়ে আয়। অল ক্লিয়ার! তোর ভয় নেই। চলে আয়!
কিন্তু কোনও সাড়া পেলুম না। তাহলে কি পাশের বাড়ি ওর বন্ধুদের কাছে আছে? গিয়ে দেখি, সেখানেও নেই! গেল কোথায় ও? কাছাকাছি আরও কয়েকটা বাড়ি খোঁজাখুঁজি করলুম। কোথাও নেই। এবার একটু ভয় পেয়ে গেলুম। বাড়ি ফেরার মুখে নিশ্চয় টমের চেঁচামেচি শুনে কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু কোথায়?
হঠাৎ মনে পড়ল নাদুবাবুর ছেলে ন্যাড়ার সঙ্গে ডনকে ঘুরে বেড়াতে দেখি। নিশ্চয় ন্যাড়ার কাছে আছে ও। নাদুবাবুর বাড়ি নদীর ধারে খেলার মাঠের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখি, ন্যাড়া তুষো মুখ করে পড়তে বসেছে। নাদুবাবু গম্ভীর গলায় ওকে মুখস্থ করাচ্ছেন, ক মূর্ধন্য ষয়ে টয়ে কষ্ট! জোরে-জোরে বল ক মূর্ধন্য ষয়ে… আমাকে দেখে মুখ নামিয়ে চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন,–কে হ্যাঁ?
–আমি জ্যাঠামশাই! ন্যাড়ার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
ন্যাড়ার সঙ্গে? খুব অবাক হয়ে নাদু সিঙ্গি অনেকটা হাঁ করে ফেললেন,–নেডুর সঙ্গে তোমার কী?
ঝটপট বললুম,–মানে ডনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই…
খাপ্পা হয়ে সিঙ্গিমশাই বললেন, বোলো না! ওই পাজি হতচ্ছাড়া ছেলেটার কথা আমায় বলতে এসো না?
–আজ্ঞে না জ্যাঠামশাই! আপনাকে বলতে আসিনি। ন্যাড়াকে জিগ্যেস করতে এসেছি।
–নেডু কিছু জানে না। দেখছ না এখনও পড়তে বসেছে? ওকে ডিসটার্ব কোরো না।
ন্যাড়া বইয়ের পাতায় চোখ রেখে পড়া মুখস্থ করার সুরে বলে দিল,-ডন জটায়ুর পালক পেয়েছে। ডন মাঠে উড়ে চলে গেল।
মাঠে! মানে খেলার মাঠে? –উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করলুম। কিন্তু ও নেড়! উড়ে চলে গেল কী বলছ?
নাদুবাবু গর্জে উঠলেন, হয়েছে, হয়েছে। আর কোনও কথা নয়। কাজ নেই কম্ম নেই, রোজ খালি ডন ডন ডন। ডন ডন ডন ডন! হুঁ! উড়ে যাবে না তো কি হেঁটে যাবে? ভাগ্নের পিঠে ডানা গজিয়েছে যে। এবার চাদে গিয়ে বসে থাকবে।
হনহন করে খেলার মাঠে চলে গেলুম। তারপর যত জোরে পারি গলা ছেড়ে ডাকলুম, ডন! ডন! আচমকা একটা গাধা বিকট চেঁচিয়ে সাড়া দিল। পিলে চমকানো ডাক। আকাশে টোল-খাওয়া চকচকে উঁদ যেন মজা পেয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। ঘাসে ভরা মাঠে জ্যোৎস্না ঝলমল করছিল। মাঠের শেষে নদীর ধারে পোড়া মন্দির ঘিরে একটা জঙ্গল। সেদিক থেকে ভেসে এল পেঁচার ক্রাও ক্রাও চেঁচানি। অমঙ্গলের ডাক! বুক কাঁপতে লাগল। ডনের কোনও বিপদ হয়নি তো?
এই রাতবিরেতে জঙ্গলটার দিকে পা বাড়াতে গা ছমছম করছিল। ভূত না থাকলেও ভূতের ভয়টা থাকে। কিন্তু ডন বেচারার জন্য তখন ভূতের সঙ্গে লড়াই করতেও তৈরি আছি। জঙ্গলের কাছাকাছি গিয়ে গলা ছেড়ে ফের ডাকলুম,–ডন! ডন!
এবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কান্না-জড়ানো গলায় কেউ চি-চি করে সাড়া দিল যেন। আরও খানিকটা এগিয়ে ডাকলুম,–ডন! তুই কোথায়?
মাথার ওপর থেকে করুণ সুরে ডন বলল,–এই যে এখানে মামা!
–সর্বনাশ! তুই গাছের ডালে কেন রে?
নামতে পারছিনে মামা! –ডন ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।
রেগেমেগে ভেংচি কেটে বললুম, নামতে পারছিনে মামা! হতভাগা ছেলে! গাছে উঠতে গেলি কেন? উঠলি যদি নামতেই পারলিনে কেন?
ডন কান্না থামিয়ে বলল, আমি কি গাছে চড়তে পারি? জটায়ু পাখির পালক আমায় উড়িয়ে এনেছে না?
হাসতে হাসতে বললুম,–উড়ে-উড়ে নামলিনে কেন তাহলে?
গাছের ডালে লেগে পালকটা ভেঙে গেল যে! –ডন আবার চিকুর ছেড়ে কেঁদে উঠল।
–কই লাফ দে। তোকে ধরে ফেলব।
–পারব না।
–চেষ্টা কর বাঁদর! রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…
ডন মরিয়া হয়ে লাফ দিল এবং তাকে ধরে ফেললুম। তারপর ছায়াঢাকা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ মাথায় এল, তাই ত! ডন গাছটাতে চড়তে পারল কেমন করে? চড়তে পারলে নামতে পারাটা কি কঠিন হতো? বরং চড়াটাই কঠিন, নামাটা সোজা।
আমার গা শিউরে উঠল। তাহলে কি সত্যি পালকটার কোনও আশ্চর্য ক্ষমতা আছে? মাঠে জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে বললুম,–দেখি পালকটা!
সত্যি পালকটা ভেঙে গেছে। পস্তানি হল, পালকটা না ভাঙলে একবার আমি নিজে পরখ করে দেখতুম। কিন্তু কী আর করা যাবে।
হাঁটতে-হাঁটতে বললুম, এ্যারে বোকা! গাছ থেকে যে নামতে পারছিলিনে, চেঁচিয়ে কাউকে ডাকলিনে কেন? বুদ্ধি করে আমি না এলে সারা রাত্তির তোকে গাছের ভালে থাকতে হতো।
ডন এবার ফিক করে হাসল,–জানো মামা, রামু-বোপা ওর গাধার পিঠে কাপড় চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেখে যেই ডেকেছি, ও রামুকাকা! আমায় নামিয়ে দেবে? অমনি রামু রাম-রাম বলতে বলতে গাধাটাকে ডাকিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল। আমি সন্ধ্যাবেলা গাছ থেকে ডেকেছি তো ভেবেছে ভূত! হি-হি-হি!
ডন খুব হাসতে লাগল। কথাটা কিন্তু ঠিক। ভাগ্যিস ডন আমার ভাগ্নে এবং তাকেই খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। নইলে অন্য কেউ ওই পোডড়া মন্দিরের জঙ্গল থেকে ডাকলে আমিও বেজায় ভয় পেতুম না কি?
ডনকে সুতোর ব্যাপারে টমের কথাটা বললুম। তখন ডন বলল, সুতোগুলো খুল দাও মামা। শিগগির!
সুতো খুলে ফেলে দিলুম। ভাঙা পালকটা হাতে নিয়ে ফের আমার গা শিরশির করতে থাকল। বললুম,–পালকটা তাহলে সত্যি জটায়ুর! হারুর কাছে কত দিয়ে কিনেছিলি রে?
ডন আবার ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। জ্যোৎস্নায় ওর সাদা সরু দাঁতগুলো ঝিমিক করছিল। বললুম, হাসছিস যে?
ডন জবাব দিল না। গুলতির মতো হঠাৎ বোঁও করে ছুটে গেল। অদ্ভুত ছেলে তো! এমন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পালকটার ওপর একটুও মায়া করল না দেখে অবাক লাগছিল।
কিন্তু হাসল কেন অমন করে? ভাঙা পালকটা পকেটে ভরে খুব ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে চললাম। হুঁ, ব্যাপারটা ভাববার মতো।…