ভালো অভিনেতা হতে গেলে
অভিনেতা হওয়ার জন্য প্রথমেই অভিনয় করবার প্রতি একটা স্বাভাবিক ঝোঁক তো থাকা দরকারই। কেউ কেউ যেমন নাওয়া-খাওয়া ভুলে ফুটবল খেলেন, অভিনয় করার জন্য সেই অদম্য তাড়না না থাকলে অভিনেতা হওয়া মুশকিল। বলতে পারেন, এই তাড়নাই হচ্ছে শিল্পী হবার অন্তর্নিহিত শক্তি। এই ব্যাপারটা কাজের মধ্যে থাকলে, তবেই তিনি অভিনেতা হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন।
সত্যি বলতে কী, অভিনয় শিল্পের প্রতি ভালোবাসা দেখানো শ্রদ্ধা ও প্যাশন ছাড়া অভিনেতা হওয়া যায় না।
পড়াশোনা করে বা কোনও ইনস্টিটিউটে অভিনয় শিক্ষার আগে প্রথমেই দুটো জায়গা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা যেতে পারে : (১) জীবন থেকে, (২) সিনেমা-নাটকে অভিনয় দেখে। অভিনেতা হবার জন্য জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করাটা বেশ জটিল ব্যাপার। অবশ্য যে-কোনো ক্ষেত্রেই। কেননা জীবন এতটাই বড়ো আর জটিল যে জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার জন্য চাই উদার, খোলামেলা মন, মেধা আর জীবনের প্রতি মমত্ববোধ। জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ মানে চারপাশের কিছু মানুষের অঙ্গভঙ্গি, কথা বলার ধরন ইত্যাদি নকল করা নয়।
একটু বুঝিয়ে বলি। অনেকে কমেডি চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে কিছু অদ্ভুতুড়ে ভঙ্গি, ক্যারিকেচার ইত্যাদি করে থাকেন। অনেক সময়ই ওগুলো দেখে আমাদের হাসি পায় না। যথার্থ কমেডি অভিনেতা তিনিই, যিনি জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত, ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে হাসির উপাদানটিকে বার করে আনতে পারেন। যেরকমভাবে প্রবল দুঃখের মুহূর্তের ভিতরেও লুকিয়ে থাকে কৌতুকের উপাদান। জীবন থেকে শিক্ষাগ্রহণ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি মানবচরিত্রের জটিল রহস্যের অনুসন্ধান। অভিনয় করতে এসে অভিনেতা হিসেবে যাঁরা নিজেদের সাধারণ মানুষের চেয়ে উচ্চশ্রেণির বলে ভাবেন, তাঁদের পক্ষে এই জীবন থেকে পাঠ নেওয়া সম্ভব নয়। জীবন থেকে পাঠ নেবার সঙ্গে-সঙ্গেই চলতে থাকবে অভিনয় দেখার ব্যাপারটা। প্রস্তুতিপর্বে বিশেষভাবেই গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দেখার ওপর আমি জোর দেব। সত্যি বলতে কী, ভালো অভিনয় দেখার অভ্যাস না থাকলে, ভালো অভিনেতা হওয়া অসম্ভব। এই অভিনয় দেখার মধ্য দিয়েই অভিনেতার কল্পনাশক্তির বিকাশ হতে পারে। কিন্তু একটা ব্যাপার, অভিনয় দেখার সময় ভেসে গেলে চলবে না। অনেকটা ছাত্রের মতো মনোভঙ্গি নিয়ে অভিনয় দেখতে হবে। এই জায়গাটা কেন এভাবে করল, ওখানে কেন তিনি দু-পা এগিয়ে গেলেন, একটি বিশেষ সংলাপ বলার সময় তার মুখভঙ্গি অমন হল কেন— সমস্ত কিছুর পেছনেই খুঁজতে হবে যুক্তি। নির্দিষ্ট একটি যুক্তি পরম্পরা ছাড়া কোনও চরিত্র নির্মাণই সম্ভব নয়।
ধরা যাক, কোনও একটি চরিত্র আপনি কল্পনা করে নিলেন। এবার সেই চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সে কী ধরনের ব্যবহার করতে পারে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতার ওপরই নির্ভর করে, একজন শিল্পী বড়ো মাপের কাজ করতে পারবেন কি পারবেন না। বিশ্লেষণী ক্ষমতা যিনি যত বাড়িয়ে তুলতে পারেন, তিনি তত বেশি সফল হন। লক্ষ করবেন, কোনও একটি ভাব কিন্তু পাঁচটা মানুষ একভাবে ব্যক্ত করেন না। তাঁদের জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাবপ্রকাশের চেহারাটাও বদলায়। তাই বিভিন্ন চরিত্র বিশ্লেষণ করে এই পার্থক্যগুলো বুঝতে হবে।
অভিনেতা হিসেবে প্রস্তুতি নেবার জন্য এই সাধারণ বা সার্বিক দিকটি ছাড়াও রয়েছে মেথড বা পদ্ধতির একটা দিক। যে-কারণে অভিনয়কে বলা হয় এক ধরনের বিজ্ঞান। একদিকে যেমন কতগুলো সূত্র মেনে আপনাকে এগোতে হবে, তেমনি দরকার নিয়ত গবেষণার মানসিকতা। প্রথম সূত্র হচ্ছে এলিমিনেশন বা বাদ দেওয়া। একটা ব্যাপার লক্ষ করবেন, মঞ্চের ওপর দাঁড়ালে অনেকের কিছু সমস্যা হয়। হাত দুটো সে কোথায় রাখবে। কীভাবে সে দাঁড়াবে। কোনদিকে তাকাবে। এইরকম আর কী। জনসমক্ষে নিজেকে নিয়ে এই যে অস্বস্তি তা বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। অভিনেতার কিন্তু এটা থাকলে চলবে না। এই অস্বস্তি, এই বাধাকে বাদ দিতেই হবে। একেই আমি বলছি এলিমিনেশন। স্বতঃস্ফূর্তি না থাকলে দর্শকদের সামনে বা ক্যামেরার সামনে চরিত্রকে উপস্থাপিত করাই অসম্ভব। এলিমিনেশনের একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে শারীরিক এক্সারসাইজ। এক্সারসাইজের মাধ্যমে শারীরিক বিভিন্ন বাধা দূর হয়ে যায়। আর একটা ব্যাপার তো জানেনই যে অভিনেতার একমাত্র সম্পদ হচ্ছে তাঁর শরীর। ফলত শারীরিক বাধাগুলি দূর হলে চরিত্র নির্মাণ অনেক সহজ হয়ে আসে। শরীর ফ্লেক্সিবল হলে দেখবেন কণ্ঠস্বরকেও নিজের খুশিমতো ব্যবহার করা যায়। তবে কণ্ঠস্বরের জন্যও আলাদাভাবে চর্চা চালাতে হবে। বস্তুতপক্ষে চর্চার মধ্যে দিয়ে শরীর ও কণ্ঠস্বরের মেলবন্ধন হলেই— অভিনেতার হাতে সাফল্যের একমাত্র অস্ত্রটি এসে যায়।
কণ্ঠস্বরের চর্চার জন্য বিশেষভাবেই আবৃত্তি ও নাটক পাঠ করতে হবে। আবৃত্তি করার সময় তো কবিতার ধ্বনি, গতি ইত্যাদির ওপর জোর পড়ে। তাই এই অনুশীলনের ফলে কণ্ঠস্বরের বিভিন্নমুখী প্রকাশের একটা বাড়তি সুযোগ পাওয়া যায়। এই সঙ্গে গান শিখতে পারলে তো খুবই ভালো।
ভালো অভিনেতা হওয়ার জন্য আর একটা ব্যাপার খুব দরকার। প্রয়োজনে নিজেকে আলাদা করে নেওয়া। অর্থাৎ যে অভিনয় করছে সেই ‘আমি’ থেকে একটা আলাদা ‘আমি’কে বার করে নেওয়া— যে বিচারক। এটা অভ্যাসের মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়। তবে একটা ব্যাপার জোর দিয়েই বলব, অভিনয় শিক্ষার এইসব অনুশীলন কিন্তু ঘরে বসে করলে খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে না। কেননা অভিনয়ও অনেকটা গুরুমুখী বিদ্যা। তাই বিশেষভাবেই কোনও নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিদিন কাজ করতে হবে। বাড়িতে বসে এগুলো করলে ক্ষমতার যথাযথ স্ফূরণটা হয় না।
ইদানীং অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রচুর সুযোগ বেড়েছে। বিশেষ করে টিভি সিরিয়ালগুলো তৈরি হবার পর থেকে। সহজ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যিনি অভিনয় করতে পারেন, তাঁর রোজগারের অভাব হয় না এটুকু বলতে পারি। সুযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সহজে কিস্তিমাতেরও একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এই প্রবণতা যাঁদের রয়েছে তাঁরা খুব বড়ো-কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু মাথার ঘাম ফেলে সত্যিকারের পরিশ্রম করলে তাঁকে কখনোই পিছন ফিরে তাকাতে হবে না।