পারিবারিক বন্ধু মান্না দে

পারিবারিক বন্ধু মান্না দে

মান্না দে-র সঙ্গে আমার পরিচয় পারিবারিক সূত্রেই। আমার বাবা বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ধীরেন দাসের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র দে[১]-র পরিচয় ছিল। শুধু শিল্পী হিসেবেই নয়, উভয়ের সম্পর্ক ছিল পারিবারিক বন্ধুর মতো। বাবা প্রায়ই ওঁদের বাড়ি যেতেন। মাঝে মাঝে আমিও যেতাম বাবার সঙ্গে। তা ওই বাড়িতে গিয়ে মনে হয়েছিল গোটা বাড়িটাই যেন একটা সংগীতাশ্রম। সেখানে গল্পও হত সংগীত নিয়ে, ভাবনাচিন্তা হত সংগীত নিয়ে। সেখানেই মান্না দে-র সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, এবং তা হয়েছিল সংগীতের হাত ধরে, সংগীতকে কেন্দ্র করেই।

তারপর অবিশ্যি বহুদিন আর যোগাযোগ ছিল না। পরে যখন আমি অভিনয়জগতে পাকাপাকিভাবে চলে এসেছি, তখন শুনলাম আর এক মান্না দে-র কথা, বম্বের মান্না দে। মান্না দে কলকাতা ছেড়ে যে সময়ে বম্বে চলে গিয়েছিলেন, সে সময় রফি সাহেবের রমরমা বাজার। কিন্তু তার মধ্যেও মান্না দে বম্বের সংগীতজগতে নিজের স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছিলেন। আমরা বাঙালিরা, সেই বম্বের মান্না দে-কে পেয়েছিলাম। তারপর থেকে অনেক ছবিতেই আমি ওঁর গানে লিপ দিয়েছি, এবং আশ্চর্য হয়ে গেছি ওঁর গায়কির বৈচিত্র্য দেখে। বিশেষ একটা ঢং আছে মান্নাবাবুর গানের মধ্যে। যার ফলে অনেক গানের মধ্যে থেকে সহজেই চিনে নেওয়া যায় কোনটা ওঁর গান। এটা শুধুমাত্র গলার জন্য নয়, তাঁর গাইবার ভঙ্গি, উচ্চারণ সবকিছুর মধ্যেই একটা অসাধারণত্ব, একটা স্বকীয়তা আছে। বম্বে আর কলকাতা, এই দূরত্বটা আমাদের দু’জনের দেখাসাক্ষাতের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও ভালোলাগার দিকে থেকে কোনও সমস্যাই ছিল না। কলকাতায় বা ওখানে ওঁর সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে, ততবারই টের পেয়েছি যে উনি শিল্পী হিসেবে যতখানি বড়ো, একজন মানুষ হিসেবে ঠিক ততখানিই সুন্দর।

এ তো গেল ভালোলাগার কথা, এবার বলি ওঁর সম্পর্কে আমার অভিযোগের কথা। মান্না দে গান রেকর্ডিং করার আগে জেনে নিতেন কে লিপ দেবে গানে। যেই শুনতেন অনুপ, সঙ্গে সঙ্গে উনি একটা বিশেষ ভঙ্গিতে গাইতে শুরু করতেন। ওই বিশেষ ঢঙে গাওয়া গানে লিপ মেলাতে, আমার বেশ মেহনত করতে হত। লয় নিয়ে খেলা করতেন উনি। তাল ফেলতেন, লয় বাড়িয়ে-কমিয়ে একটা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় গাইতেন। আমি একবার ওঁকে হাসতে হাসতে বলেছিলাম যে, মান্নাবাবু, আমি যদি গান গানতাম তাহলে আপনাকে আর করে খেতে হত না। কিন্তু যখন জানিই না, তখন আপনি আমাকে এরকম বিপদে ফেলেন কেন? উনি বলেছিলেন, আমি আপনাকে জানি, আপনার পরিচয়টাও জানি, তাই ওরকম করি। আর আমি বিশ্বাস করি যে আপনি ওই গানের সঠিক চেহারা দিতে পারেন। মনে পড়ে ‘বাবুমশাই'[২] ছবির কথা। ওখানে আমার লিপে ওঁর একটা গান ছিল। গানটার মধ্যে আবার খানিকটা ঝগড়া ছিল। আমি খুব পরিশ্রম করে গানটাকে চিত্রায়িত করেছিলাম। ছবিটা দেখে উনি বলেছিলেন, বুঝলেন তো কেন আপনার লিপ থাকলে আমি নিশ্চিন্তে নিজের মতো করে গাই! ওঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা বছরখানেক আগে। তখন আমি ওঁকে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার আগ্রহের কথা বলেছিলাম। শুধু স্মৃতিচারণার সঙ্গে হবে কৃষ্ণচন্দ্রের গান। শুনে খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন আমাকে। বলেছিলেন, বেশ তো, করুন না। দারুণ কাজ হবে একটা। যদিও শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা আর হয়ে ওঠেনি। আজ মান্নাবাবুর সঙ্গীতজীবনের পঞ্চাশ বছর। আমি শুধু এইটুকুই প্রার্থনা করি, উনি যেন আমাদের আরও আনন্দ দিতে পারেন, নিজে যেন আনন্দে থাকেন শান্তিতে থাকেন।

টীকা :

১. ভারতীয় সংগীতে এক যুগের প্রতীক হলেন সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে (১৮৯৮-১৯৬২)। বাংলা-হিন্দি চলচ্চিত্রজগৎ, নাট্যজগৎ— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কণ্ঠশিল্পী তো বটেই, সংগীত পরিচালক হিসেবেও অসামান্যতার পর্যায়ে নিজেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম সংগীতব্যক্তিত্ব। সম্পর্কে ইনি মান্না দে-র ছোটোকাকা।

২. সলিল দত্ত পরিচালিত ‘বাবুমশাই’ ছবিটি মুক্তি পায় ১১ মার্চ ১৯৭৭। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন মান্না দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *