এক ব্যতিক্রমী চরিত্র—রবি ঘোষ

এক ব্যতিক্রমী চরিত্র—রবি ঘোষ

রবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক— সে কী আজকের কথা! ঠিক মনে পড়ে না কবে কোথায় প্রথম দেখা বা আলাপ হয়েছিল রবির সঙ্গে। বয়সেও আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটোই হবে। একাধারে আমার ভাই, আমার বন্ধু। মানুষে মানুষে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক কখনো মধুর কখনো বা কিছুটা তিক্ত হয়ে পড়ে ঘটনাচক্রে; কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসার। সবটাই মধুর— কখনো কোনও একটুকু তিক্ততার কথা আমার মনে পড়ে না।

রবি ছিল একজন সত্যিকারের বড়ো মাপের মানুষ। ক্ষুদ্রতা, নীচতা, সংকীর্ণতা এ সবের অনেক ঊর্ধ্বে ছিল ও। পরনিন্দা, পরচর্চা ওর মুখে কেউ কোনোদিন শোনেনি। ওর রুচিটাই ছিল খুব উঁচু তারে বাঁধা। কাজের জগতের বাইরে রবির বন্ধুবান্ধব বা মেলামেশার পরিধি ছিল বেশ বড়ো। ওর থেকে হায়ার ইন্টেলেকটের মানুষদের সঙ্গে মিশতেই ও বেশি পছন্দ করত। অতুল্য ঘোষ, সুসাহিত্যিক কমল মজুমদার প্রভৃতি অনেকেই রবিকে খুব স্নেহ করতেন।

কাজের ব্যাপারে রবি ছিল অত্যন্ত সিরিয়াস। ওর নিষ্ঠা ছিল দেখার মতো। শিল্পী হিসেবে ও যে কত বড়ো ছিল সে আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। রবির অভিনয়ের মধ্যে সবচেয়ে লক্ষ্য করার যেটা— সে হল ওর স্বতঃস্ফূর্ততা— স্পনটেনিটি বা ক্যাজুঅ্যালিটি। যেমন পরিশ্রম করতে পারত, তেমনি আবার কাজের পর চুটিয়ে আড্ডা মারতে ওর জুড়ি ছিল না। সত্যিকারের আমুদে লোক ছিল রবি। এই আমুদে স্বভাবের জন্য ও ছিল সবার প্রিয়। কী শিল্পীরা, কী টেকনিশিয়ানরা— সবাই ওকে ভালোবাসতো। জনপ্রিয়তাই যদি একজন শিল্পীর মাপকাঠি হয় তবে বলতে হয়, ওর মতো জনপ্রিয় শিল্পী খুব কমই দেখা গেছে। রবির মৃত্যুর পর রবীন্দ্রসদনে এবং তারপর ওর শেষ যাত্রায় পথের দুধারে সব বয়সের সর্বস্তরের মানুষের যে ঢল নেমেছিল সে এক বিরল দৃশ্য। অনেকবার মনে হয়েছে একবারটি যদি ও চোখ মেলে চাইত তা হলে দেখতে পেত ওর জন্যে, শুধু ওরই জন্যে আজ কত মানুষের চোখে জল।

আজ রবি নেই। মনের মধ্যে ওকে নিয়ে শুধুই স্মৃতির ভিড়। বলতে গেলে হয়তো খেই হারিয়ে ফেলব। স্টুডিয়োতে একসঙ্গে কত কাজ, কত আড্ডা। মনে পড়ে, ওর গলফগ্রীনের ফ্ল্যাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডার কথা— তার মধ্যে অভিনয় সংক্রান্ত কথাবার্তাই হত বেশি। আমাদের কথা তো ফুরোয়নি, কিন্তু কেন যে হঠাৎ এমন করে সব কথা থামিয়ে দিয়ে রবি চলে গেল। ভাবতে গেলে শুধু একটা শূন্যতা নামে সারা বুক জুড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *