কালীদা—এক শক্তিশালী অভিনেতা
আমাদের প্রথম পরিচয় ১৯৪৬ সালে গণনাট্য সংঘের প্ল্যাটফর্মে। বয়সের ফারাক সত্ত্বেও আমি, কালীদা ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলাম বলতে গেলে হরিহর আত্মা। কতদিন কাজের অবসরে কিংবা ছুটির বিকেলে দেশপ্রিয় পার্কে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। তাই কালীদার চলে যাওয়াটা আমার কাছে পরম বন্ধু বিয়োগ। ওঁর সঙ্গে প্রথম ছবি করি সত্যেন বসু পরিচালিত ‘বরযাত্রী'[১] আর মঞ্চে ‘স্বর্গ হতে বড়ো’ নাটকে। তারপর একই সঙ্গে চলচ্চিত্রে ও মঞ্চে একের পর এক অভিনয়। তারপর কালীদা বিশ্বরূপায়, আমি স্টারে। ‘বরযাত্রী’ ছবিতে তোতলা গণশার চরিত্রে অভিনয় করে অসাধারণ সাড়া জাগালেও কালীদা প্রকৃত মর্যাদার আসন পান ‘নীল আকাশের নীচে'[২] ছবিতে অভিনয় করে। আসলে মানুষটার মধ্যে মস্ত গুণ ছিল অভিনয় সচেতনাতা। কোন চরিত্রে ওঁকে ফিট করবে, সেটাই উনি খুঁটিয়ে দেখতেন। যদিও শেষের দিকে অনেক ছবিতেই ওঁর অভিনয় তেমন ছাপ রাখতে পারেনি। যেমন ‘বউমা'[৩] বলে একটা ছবিতে ভীষণ বাজে অভিনয় করেছিলেন অথচ ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে পোস্টমাস্টারের রোলে কী অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। দেখে তো আমার রীতিমতো হিংসা হয়েছিল। আইপিটিএ থেকে কর্মজীবন শুরু বলেই কালীদার রাজনৈতিক চেতনা ছিল গভীর। একটা সময় অভিনেতৃ সংঘের সহ-সভাপতিও হয়েছিলেন কালীদা।
ঘটনা তো কতই আছে, তবে সব থেকে বেশি মনে পড়ে ‘বরযাত্রী’ ছবি করার সময় একটা ঘটনার কথা। কালীদা ‘গণশা’, আমি ‘গোরাচাঁদ’, সত্য ‘কে গুপ্ত’ এবং ‘ত্রিলোচন’-এর ভূমিকায় হারাধন ব্যানার্জি। একটা সিন ছিল সব বন্ধু মিলে ছদ্মবেশে গণশার মেয়ে দেখতে যাওয়ার এবং একটা সময়ে ছদ্মবেশে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর গণশা ত্রিলোচনকে একটা চড় মারবে। বেশ কয়েকবার শটটি নিয়েও পরিচালক সত্যেনবাবুর ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। কালীদাসকে সত্যেনবাবু বললেন, চড়টা এমনভাবে মারবেন যেন প্রমিনেন্ট হয়। ব্যাস আর যায় কোথায়! শট নেওয়ার সময় গণশারূপী কালীদা ত্রিলোচনকে গালে ঝেড়ে এক চড় কষিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পরিচালকমশাই ‘ওকে’ বলে কালীদাকে তো পিঠ চাপড়ে দিলেন, এদিকে বেচারা হারাধন তো চড় খেয়ে রেগেমেগে অভিনয় করবে না বলে পাশের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে আমি হারাধনের কাছে গিয়ে দেখি ওর ফুলকো লুচির মতো গালে পাঁচ আঙুলের কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। কোনোরকমে আটকে রেখে সমবেদনার সুরে বললাম, কী আর হবে, যা হবার হয়ে গেছে। বলে কোনোরকমে ম্যানেজ করলাম। বিশ্বরূপায় কালীদা ও আমি ‘ঘর'[৪] নাটকেই শেষ অভিনয় করি। আমাদের দুজনের অভিনীত ‘ক্ষুধা'[৫] নাটকটিও ভালো হয়েছিল।
টীকা :
১. বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা মজাদার গল্প ‘বরযাত্রী’। ছয় বন্ধু গণশা (তোতলা), ঘোঁতনা, রাজেন, কে. গুপ্ত, ত্রিলোচন ও গোরাচাঁদের কাণ্ডকারখানায় ভরা এই গল্প নিয়ে জমজমাট ছবি তৈরি করেছিলেন পরিচালক সত্যেন বসু। ছবিটি মুক্তি পায় ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১। ‘গোরাচাঁদ’-এর চরিত্রে অভিনয় করেন অনুপকুমার। এছাড়া বাকি পাঁচ বন্ধুর চরিত্রে ছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায় (গণশা), অরুণ চৌধুরী (ঘোঁতনা), ভবেন পাল (রাজেন), সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (কে. গুপ্ত), হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় (ত্রিলোচন)।
২. ভারত-চীন মৈত্রীর উপর ভিত্তি করে মহাদেবী বর্মা কাহিনিনির্ভর মৃণাল সেন পরিচালিত হেমন্ত-বেলা প্রডাকশন্সের ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ ১৯৫৯ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায়। ছবিতে চীনা মানুষের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
৩. সুজিত গুহ পরিচালিত ‘বউমা’ ছবিটি মুক্তি পায় ১০ অক্টোবর ১৯৮৬। সংগীত পরিচালক ছিলেন কানু ঘোষ।
৪. নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে রাসবিহারী সরকারের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ‘ঘর’ নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ৪ মার্চ, ১৯৬৯ বিশ্বরূপা থিয়েটারে।
৫. বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত একটি বিখ্যাত নাটক ‘ক্ষুধা’।