ভালোবাসি তোমাকেই – ৭

পরের দিন অফিসে গিয়ে তন্ময় মুশতাকিমকে ফোন করে বলল, দুপুরে লাঞ্চের সময় তোর কাছে আসছি। কালকের কথাগুলো বলব।

মুশতাকিম বলল, ঠিক আছে আয়; সেইসাথে লাঞ্চও করা যাবে।

সময় মতো দু’বন্ধুতে একটা হোটেলে এল। মুশতাকিম বলল, কি খাবি অর্ডার দে।

তন্ময় মেনু দেখে বেয়ারাকে অর্ডার দিল।

বেয়ারা চলে যেতে মুশতাকিম বলল, নে, এবার যা বলার বলতে শুরু কর।

তন্ময় তামান্নার আগের ও বর্তমানের পরিচয় এবং তার সঙ্গে কি ভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠল, সবকিছু বলে বলল, তুই আমাকে পরামর্শ দে এখন কি করব।

তন্ময়ের কথা শুনে মুশতাকিম খুব অবাক হল। কি পরামর্শ দিবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।

কিরে কিছু বলছিস না কেন?

এসব ব্যাপারে তাড়াতাড়ি কিছু বলা যায় না, ভেবেচিন্তে বলব। তোকে দু’একটা প্রশ্ন করছি উত্তর দে। তোদের দু’জনের সম্পর্কের কথা শুনে বুঝলাম, ঐ মেয়েটার নাম কি যেন বললি?

তামান্না।

হ্যাঁ, তামান্নাকে প্রথম দেখে ও তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাকে ভালবেসে ফেলেছিলি। কিন্তু যখন তার আসল পরিচয় জানতে পারলি তখন তোর মনে ঘৃণা জন্মায় নি? আর তার কাছে বারবার যাচ্ছিস কেন?

তোর প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলব, পরিচয় জানতে পেরে ঘৃণা যে জন্মায়নি তা নয়। সেই সাথে মনে ভীষণ আঘাতও পেয়েছিলাম। সেইজন্যে তাকে ভুলে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কারণ তামান্নাকে প্রথম দেখে আমি খুব মুগ্ধ হই। তারপর বাড়িতে একমাস থাকার সময় মায়ের প্রতি তার অক্লান্ত সেবাযত্ন এবং আমার সাথে স্ত্রীর ভূমিকা, আমাকে আরো বেশি মুগ্ধ করে। মেয়েটা খুবই সুন্দরী। তার উপর তার আচার ব্যবহার দেখে আমার দৃঢ় ধারণা জন্মায়, একে বিয়ে করলে মা ও আমি সুখী হব। তখন আমি ওকে প্রচন্ড ভালবেসে ফেলি। আর তামান্নাও যে আমাকে ভালবেসে ফেলেছে তা বুঝতে পারি।

তোর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলব, ওকে এত বেশি ভালবেসে ফেলেছি যে, ওর পরিচয় পাওয়ার পরও নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে বারবার ছুটে যাই।

মুশতাকিম বলল, তুই তো বললি তামান্না এখনও নিষিদ্ধ পল্লীতে রয়েছে। সে কি এখনও পতিতাবৃত্তি করে?

তন্ময় বলল, না। আমাদের বাসায় থাকার সময় মা তাকে ধর্মের অনেক কথা শুনিয়েছিল। নামায শিখিয়ে নামায ধরিয়েছিল। ওখানে ফিরে গিয়ে এখনও নামায পড়ে রোযা রাখে। ঐ পেশাও ছেড়ে দিয়েছে। তার ফলে ওদের সর্দারনি খালার অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকদিন কঠিন অসুখে ভুগেছে। ভালো হওয়ার পর সেই খালার সাহায্যে সেলাই মেশিন জোগাড় করে সেলাইয়ের কাজ করে জীবন কাটাচ্ছে।

মুশতাকিম বলল, স্বীকার করলাম মেয়েটা তোকে ভালবেসে জীবনের ধারা পাল্টেছে। আর তুইও তাকে প্রচন্ড ভালবাসিস। কিন্তু জেনে রাখিস, প্রেম ভালবাসার সঙ্গে বাস্তব জীবনের আসমান জমিন তফাৎ। প্রেম ভালবাসা হল কিছুদিনের জন্য মনের আবেগ। আর বাস্তব জীবন হল দীর্ঘস্থায়ী ও খুব কঠিন এবং রূঢ়। তার উপর তামান্না যত ভালো মেয়ে হোক, একজন পতিতাকে সমাজ কোনোদিন গ্রহণ করবে না। তুই হয়তো বলবি, সমাজের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকলেও রাখবি না। কিন্তু যখন যৌবনের টান কমে যাবে তখন তুই নিজের কাছে নিজে অনেক ছোট হয়ে যাবি। ভাববি, একটা পতিতার জন্য জীবনভর সমাজে ঠাঁই পেলি না। তোদের বংশধররা যখন তাদের মায়ের আসল পরিচয় জানবে তখন তাদের মনের অবস্থা কি হবে ভেবে দেখেছিস? তারাও সমাজে কোনো দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। বেয়ারাকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে বলল, এবার খেতে খেতে প্রশ্নগুলোর উত্তর দে।

তন্ময় খেতে শুরু করে বলল, আমার উত্তর কিছুই নেই। শুধু এইটুকু বলতে পারি, তামান্নাকে ঐ পাপপূরী থেকে উদ্ধার করবই। আর এমনিতে তো মা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন বিয়ে করব না বলে ঠিক করেছিলাম। ওকে বিয়ে করতে না পারলে সারাজীবন বিয়েই করব না।

মুশতাকিম বলল, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোর মায়ের কথা চিন্তা করেছিস? তিনি যদি তোর বিয়ে অনত্র দিতে না পেরে চিন্তায় চিন্তায় আবার কঠিন অসুখে পড়ে যান তখন কি করবি?

তার আগে মাকে বোঝাতে চেষ্টা করব, যাতে করে তামান্নাকে গ্রহণ করে। যদি তাতে কৃতকার্য না হতে পারি, সে কথা ভেবে তোর কাছে পরামর্শ নিতে এলাম। আচ্ছা, সমাজের কথা না হয় বাদ দিলাম, ইসলামে কি এই বিয়ে জায়েজ হবে না?

হবে তবে শর্ত আছে। মেয়েটিকে বিয়ের আগে তওবা করিয়ে নিতে হবে।

তওবা সে অনেক আগেই করেছে। তারপর থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। গত রোযায় রোযাও রেখেছে। আর ঐ কাজ যে ছেড়ে দিয়েছে তা তো একটু আগেই বললাম।

তা হলে নিঃসন্দেহে এই বিয়ে জায়েজ।

ইসলামে যখন জায়েজ তখন মা রাজি হবে না কেন? আর সমাজই বা গ্রহণ করবে না কেন?

এই কেনর উত্তর খুব কঠিন বন্ধু। তুই নিজে না হয়ে অন্য যে কেউ একজন পতিতাকে বিয়ে করতে চাইলে তুইও রাজি হতিস না। আর সমাজ এমন একটা জিনিস ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না। যাক, সমাজের কথা বাদ দে, আমি তোকে তামান্নাকে বিয়ে করার পরামর্শ দিলাম। তবে তার আগে তোর মাকে রাজি করাতে চেষ্টা করবি।

সত্যি বলছিস?

হ্যাঁ, সত্যি বলছি।

কেন একটু বলবি?

দেখ, মানুষ মাত্র দোষত্রুটি করবে। সে কথা যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি জানেন। তাই তওবা ও ক্ষমা রেখেছেন। মানুষ দোষত্রুটি করার পর যদি আর করবে না বলে ওয়াদা করে নিজেকে সৎভাবে চালাবার চেষ্টা করে এবং আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চেয়ে সাহায্য চায়, তা হলে তাকে তিনি ক্ষমা করে দিয়ে সাহায্য করেন। আল্লাহপাক কুরআন মজিদে বর্ণনা করিয়াছেন, ‘হযতর মুহাম্মদ (সঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলিয়াছেন, আপনি বলিয়া দিন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করিয়াছ, তোমরা আল্লাহ তা’য়ালার রহমত হইতে নিরাশ হইও না; নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করিবেন। নিশ্চয় তিনি বড়ই ক্ষমাশীল দয়ালু। [সূরা জুমার, ২৪ পারা, আয়াত- ৫৩]

আর একটা কথা জেনে রাখ, যারা অন্যায় থেকে ন্যায়ের পথে ফিরে আসতে চায়, তাদেরকে যদি আমরা সাহায্য না করি, তা হলে কেয়ামতের দিন এ জন্য আল্লাহপাকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের ভেবে দেখা উচিত, পুরুষরা মদ খেয়ে, জুয়া খেলে, পতিতালয়ে গিয়ে, খুন, জখম, রাহাজানি করে যতই চরিত্রে অবনতি ঘটাক না কেন, সমাজ তাদেরকে নিয়ে সমালোচনা করলেও তাদেরকে সমাজচ্যুত করে না। অপর পক্ষে মেয়েদের সামান্যতম কিছু চরিত্রের অবনতি ঘটলে তাকে সমাজ গ্রহণ করে না।

পুরুষেরা বিয়ে করার সময় সতী নারী খুঁজে। কিন্তু সেই পুরুষদের কয়জনের চরিত্র ভাল, সে কথা কি কেউ ভেবে দেখেছে? এর কারণ কি জানিস, পুরুষরা শিক্ষা পেয়েছে, মেয়েরা তাদের থেকে সব দিক থেকে ছোট। আর তারা মেয়েদের চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। কথাটা বিশ্লেষণ করলে ইসলামিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে ঠিক নয় বলে ইসলাম নারী বা পুরুষ কাউকেই কোনো রকমের অন্যায় ও গর্হিত কাজ করার অনুমতি দেয়নি। যে সমস্ত অন্যায় ও গর্হিত কাজ মেয়েদের জন্য হারাম, সেইসব কাজগুলো পুরুষদের জন্যও হারাম। ইসলাম আরো বলেছে, “নারী পুরুষের অর্দ্ধেক আর পুরুষ নারীর অর্দ্ধেক।” আসলে মেয়েদেরকে আল্লাহপাক কতটা অধিকার দিয়েছে তা তারা জানে না। আর পুরুষরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদেরকে তা জানতে দেয় নি। এই জন্য আল্লাহ প্রত্যেক নারী পুরুষকে জ্ঞান অর্জন ফরয (অবশ্য কর্তব্য) করেছেন। আর সেই জ্ঞান বলতে আল্লাহ কি বুঝিয়েছেন, তা জানতে হলে অন্যান্য জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে কুরআন হাদিসের জ্ঞানও অর্জন করতে হবে। আসল ব্যাপার হল, যারা কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করছে তারা অন্যান্য জ্ঞান অর্জন এড়িয়ে চলছে। আবার যারা অন্যান্য জ্ঞান অর্জন করছে, তারা কুরআন হাদিসের জ্ঞান এড়িয়ে চলছে। এর ফলে এই দুই দলের মধ্যে অনেক মত পার্থক্য দেখা দিচ্ছে, বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হচ্ছে। যদি আমরা উভয় প্রকারের জ্ঞান অর্জন করতাম, তা হলে এত মতবাদ বা দলাদলির সৃষ্টি হত না। আর সমাজেরও এত অবক্ষয় হত না। এই পতিতালয়ের ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখ, সেখানে খারাপ মেয়েরা থাকে; সেকথা সবাই জানে। কিন্তু সেখানে যাচ্ছে কারা? নিশ্চয় পুরুষ? তা হলে পুরুষদের বিচার সমাজ করছে না কেন? সেইসব পুরুষদের মধ্যে অনেকে বিবাহিত, অবিবাহিত, ভালো মন্দ, ভদ্র-অভদ্র সব ধরনের রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে সমাজপতিরা শাস্তি দিচ্ছে না কেন? দেবে কি করে? সমাজপতিরা তো পুরুষ। তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য তা করতে পারছে না। তাদের মধ্যে অনেকে টাকা রোজগারের জন্য কত যে অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছে তার খোঁজ কে রাখে? পুরুষরাই তো গ্রাম-গঞ্জের গরিব মেয়েদেরকে চাকরি অথবা বিয়ের লোভ দেখিয়ে শহরে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে। অনেক মেয়ে আবার নকল প্রেমিকের হাতধরে ঘর ছাড়ে। তারপর নকল প্রেমিকের খপ্পরে পড়ে পতিতালয়ে আসতে বাধ্য হয়। একথা ধ্রুব সত্য যে, পুরুষরাই মেয়েদেরকে পতিতা বানানর জন্য শতকরা নব্বইভাগ দায়ী। তোর তামান্নার ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পেয়েছিস। এখন কোনো পতিতা যদি সেই পাপপূরী থেকে সমাজে এসে সৎ জীবন যাপন করতে চায়, তাতেও পুরুষরাই বেশি বাধা দিয়ে হৈ চৈ করবে। এ ব্যাপারে সরকার ও শিক্ষিত সমাজের লোকেরা যদি ঐসব জঘন্য মনোবৃত্তির লোকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিকারের চেষ্টা করে, তা হলে হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা হতে পারে। এই ব্যাপারে সব ধরণের শিক্ষিত ছেলেদের অগ্রনী ভূমিকা নেয়া উচিত।

তন্ময় বলল, তুই ঠিক কথা বলেছিস। এদিকটায় শিক্ষিত ও সমাজপতিদের এবং সরকারের উদাসীনতার ফলে দিন দিন পতিতাদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এবার চল ওঠা যাক। কথা বলতে বলতে অনেক আগে খাওয়া শেষ হয়েছিল। বেয়ারাকে ডেকে বিল মিটিয়ে তারা হোটেল থেকে বেরিয়ে এল।

সেদিন তন্ময় অফিস থেকে বাসায় ফিরে চিন্তা করতে লাগল, কি ভাবে তামান্নাকে বিয়ে করার কথাটা মাকে বলবে।

রাতে খাওয়ার সময় ফিরোজা বেগম ছেলেকে বললেন, কিরে, চুপচাপ রয়েছিস কেন? বিয়ের ব্যাপারে কিছু চিন্তা ভাবনা করেছিস? আমি কিন্তু ঘটক লাগিয়েছি।

তন্ময় বলল, এত তাড়াহুড়োর কি আছে।

ফিরোজা বেগম বললেন, তুই তো আজ পাঁচ বছর ধরে একই কথা বলে আসছিস। বিয়ের বয়স পার হয়ে গেলে বুঝি বিয়ে করবি?

তন্ময় হেসে উঠে বলল, বিয়ের বুঝি কোনো নির্দিষ্ট বয়স আছে? যে যখন খুশী বিয়ে করছে। নাবালক বয়স থেকে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বিয়ে হচ্ছে।

ফিরোজা বেগম বললেন, দেখ, আজেবাজে কথা বলবি না। প্রত্যেক জিনিসের একটা উপযুক্ত সময় থাকে, বিয়েরও আছে। সেই সময় পার হয়ে গেলে সংসার সুখের হয় না। তোর বিয়ের বয়স অনেক আগেই হয়েছে। আর সেটার সময় প্রায় শেষ হতে চলেছে। এখনও যদি বিয়ে না করিস, তা হলে সংসারে সুখ-শান্তি পাবি না। আর আমারও তো বৌ, নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার করার সাধ আহহ্লাদ আছে। এতদিন তোর অনেক টালবাহানা শুনেছি, আর নয়। ঘটক একটা ভালো মেয়ের সন্ধান এনেছে। কাল তোকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে যাব।

তন্ময় চিন্তা করল, এখনই মাকে তামান্নার কথাটা বলা দরকার। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সাহস সঞ্চয় করে বলল, বিয়ের ব্যাপারে আমাকে জোর করো না।

কেন? তোর উপর কি আমার জোর খাটাবার অধিকার নেই?

তা থাকবে না কেন? তবে জীবন সঙ্গিনীর ব্যাপারে অধিকার দেখান সব ক্ষেত্রে ভালো হয় না।

তা হলে সত্যি কি তুই চিরকুমার থাকবি?

সে কথা কোনোদিন বলেছি?

তা বলিস নি। কিন্তু তোর ব্যাপার স্যাপার দেখে তাই তো মনে হচ্ছে।

তোমার যাই মনে হোক না কেন, আমি আমার পছন্দ করা মেয়ে ছাড়া বিয়ে করব না।

সেটা তো খুব ভালো কথা। সেই জন্যে তোকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব। তোর পছন্দ হলে হবে নচেৎ অন্য মেয়ের চেষ্টা করব।

কোনো মেয়ে দেখার দরকার নেই। মেয়ে আমার পছন্দ করা আছে।

সে তো আরো ভালো কথা। তাদের বাসায় আমাকে নিয়ে চল। আমি তার মা বাবার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের ব্যবস্থা করি।

কিন্তু সে মেয়েকে তোমার পছন্দ হবে না।

আমার পছন্দ হবে না তুই কি করে বুঝলি? তুই যদি কানা, খোঁড়া বা অসুন্দর মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হবি বলে মনে করিস, তাতেও আমার আপত্তি নেই।

সে মেয়ে কানা, খোঁড়া বা অসুন্দর নয়। বরং অন্যান্য দশটা মেয়ের চেয়ে অনেক ভালো। তবে সে সমাজের বাইরের মেয়ে।

ফিরোজা বেগম ভাবলেন, তা হলে কি সেই বেশ্যা মেয়েটাকে ওর পছন্দ? তাকে কি এখনো ভুলতে পারেনি? গম্ভীর স্বরে বললেন, সমাজের বাইরের মেয়ে বলতে কি বলতে চাচ্ছিস খুলে বল।

খুলে বলার কি আছে, তুমি যা ভাবছ তাই। আমি তামান্নাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করব না।

ফিরোজা বেগম রাগে গর্জে উঠলেন, একটা বেশ্যা মেয়ের কথা বলতে তোর মুখে আটকাল না। তুই না শিক্ষিত ছেলে? তোর কাছ থেকে এরকম কথা আশা করিনি।

সেই জন্যে তোমাকে কথাটা বলতে চাইনি। তুমি জান কিনা জানি না, কেউ কিন্তু স্বেচ্ছায় পতিতালয়ে পতিতা হতে যায় না। বদ মানুষের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে সেখানে যায়। তামান্নার সব পরিচয় আমি নিয়েছি। সে উচ্চবংশের কলেজে পড়া মেয়ে। দৈব দুর্বিপাকে পড়ে পতিতালয়ে এসে পড়ে। সে জন্যে সে ভীষণ অনুতপ্ত। ঐ পাপপূরী থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমাদের এখানে এসে তোমার সহচার্য্যে তার মনের সেই ইচ্ছা আরো প্রবল হয়েছে। সব কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করে রোযা নামায করছে। আর সেই কারণে এখান থেকে যাওয়ার পর থেকে তাদের সর্দারনীর হাতে নির্মম অত্যাচার সহ্য করে চলেছে। একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে সবকিছু জেনে তাকে সেই পাপপূরী থেকে উদ্ধার করা কি আমার উচিত নয়? তোমার কাছেই শুনেছি, বান্দা যত বড় অন্যায় করুক না কেন, সে যদি তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, তা হলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। আর আমরা মানুষ হয়ে মানুষের অন্যায় ক্ষমা করতে পারব না কেন?

ফিরোজা বেগম বললেন, তোর কথা ঠিক। কিন্তু বাবা বেশ্যারা কোনোদিন ভালো হয় না। যে মেয়ে একবার চরিত্র হারায় সে কোনো দিন চরিত্রবতী হতে পারে না।

তুমি শুধু মেয়েদের কথা বলছ কেন? আর যে ছেলে চরিত্র হারায়, সে বুঝি চরিত্রবান হতে পারে? তুমি তো মেয়ে। আমি যে কথাটা বললাম চিন্তা করে দেখ। কেন ছেলেদের শত অন্যায় ক্ষমার চোখে দেখা হয়? অপরপক্ষে মেয়েদের এতটুকু অন্যায় ক্ষমা করা হয় না। এটা তোমাদের সভ্য সমাজের কি রীতি আমি বুঝি না। তাই আমি সেই রীতি মানব না। আর যদি তোমার কথা সত্যও হয়, তবু বলব, সব জিনিসের ব্যতিক্রম আছে। সব বেশ্যারা সমান হতে পারে না। তামান্না সেই ব্যতিক্রম।

তুই যাই বলিস না কেন, আমি তোর কথা মেনে নিতে পারছি না। আর সমাজও মানবে না। আমরা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না। সমাজ আমাদেরকে ত্যাগ করবে। তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি তোর মা হয়ে বলছি, একটা বেশ্যাকে বিয়ে করে কেউ কোনোদিন সুখী হতে পারে না। তুই ওকে ভুলে যা। মনে করবি তামান্না নামে যে মেয়েটার সঙ্গে তোর পরিচয় হয়েছিল, সে মরে গেছে।

মাগো, তাই যদি পারতাম, তা হলে বেঁচে যেতাম। তোমার মনে ব্যথা লাগবে বলে তার কথা কোনোদিন বলব না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তুমিই আমাকে বলতে বাধ্য করালে। সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। আর আমার শেষ কথাটা শুনে আরো মনে ব্যথা পাবে। তবু বলব। সেজন্যেও ক্ষমা চাইছি। আমি তামান্নাকে সারাজীবনেও ভুলতে পারব না। তারপর তন্ময় উঠে নিজের রুমে চলে গেল।

ফিরোজা বেগম ছেলের কথা শুনে মনে মনে খুব আঘাত পেলেন। তার একমাত্র আঁতড়ীছেড়া ধন একটা বেশ্যাকে ভালবেসেছে; তাকে ছাড়া অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে না, এটা তিনি ভাবতেই পারছেন না। এরপর তিনি খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। ছেলেকে আর বিয়ে করার কথা বলেন না।

তন্ময় বুঝতে পেরে মায়ের সঙ্গে যেচে যেচে কথা বলে।

এক সপ্তাহ হয়ে গেল তামান্নাকে নিয়ে চিন্তা করেও কিছু ঠিক করতে পারল না। একদিকে মা ও সমাজ, অন্যদিকে নিজে ও তামান্না। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে একদিন বিকেলে মুশতাকিমের কাছে গিয়ে বলল, আর পারছি না দোস্ত, কি করব তুই বল, এভাবে আর টিকতে পারছি না।

মুশতাকিম তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ও চেহারার মলিনতা দেখে বলল, কিরে, তোর অবস্থা এরকম কেন? মনে হচ্ছে মাকে রাজি করাতে পারিসনি?

বুঝতেই যখন পেরেছিস তখন আর কাটা ঘায়ে নুন ছিটাস না। তারপর মায়ের মতামতের কথা বলে জিজ্ঞেস করল, এখন আমার কি করণীয় বলতে পারিস?

আগে তুই কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস বল?

সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তোর কাছে আসব কেন?

তোর নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে তোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অত ভেঙ্গে পড়লে চলবে কেন।

তুই যদি আমার পরিস্থিতিতে পড়তিস, তা হলে বুঝতিস।

একদম যে বুঝি না তা নয়। আমার পরামর্শ নিতে হলে বলব, তামান্নাকে তুই ইমিডিয়েট বিয়ে করে ফেল। সেও নিশ্চয় তোর অবস্থা বুঝে। বিয়ের পরে তাকে নিয়ে দু’জনে মিলে মায়ের পা ধরে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চেয়ে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা কর। তাতে যদি বিফল হস, তা হলে তাকে একটা ভাড়া বাসায় রেখে তুই মাকে মানাবার চেষ্টা চালিয়ে যাবি। আমার যতদূর মনে হয়, প্রথমদিকে বৌকে ঘরে তুলতে রাজি না হলেও কিছুদিনের মধ্যে হয়ে যাবেন। আফটার অল তুই তো তার একমাত্র সন্তান। কতদিন আর রাগ করে থাকতে পারবেন।

কথাটা তুই মন্দ বলিসনি। এখন চলি, আজ একবার তামান্নার সাথে দেখা করব। এক সপ্তাহ দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম বলে তার কাছে যাই নি। আর শোন, বিয়ের সময় তোকে থাকতে হবে কিন্তু।

বেশ তো থাকব। আগে থেকে খবর দিস।

তাই দেব, এখন তা হলে আসি বলে তন্ময় সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে তামান্নার কাছে রওয়ানা দিল।

তামান্না এই ক’দিন চিন্তা করছে, তন্ময় আসছে না কেন? তার কোনো অসুখ হল না তো? না আমাকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েছে? সে যে তাকে খুব ভালবাসে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ভালবাসা কি মায়ের বাধার কাছে হেরে গেল? না অন্যদের মতো দু’দিনের জন্য ভালবেসে ছিল? আবার ভেবেছে তাকে কি অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা চলে? অন্যরা আমার রূপ যৌবনের আগুনে ফড়িংয়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে শত সুযোগ পেয়েও তার গায়ে একটু হাতও ছোঁয়াইনি। আজও সেলাই করতে করতে ঐসব কথা ভাবছিল। হঠাৎ তার চিন্তা হল, সে কি সত্যি সত্যি তাকে এই পাপপূরী থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে? সঙ্গে সঙ্গে তার বিবেক বলে উঠল, না না, এটা ঠিক হবে না। এতবড় স্বার্থপরের মতো তুই কাজ করিসনি। তোকে বিয়ে করলে সে নিজেও যেমন সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, তেমনি তোদের ছেলে মেয়েরাও পারবে না। সবাই তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলবে, এদের মা একজন বেশ্যা ছিল। তাদের সঙ্গে কোনো উচ্চবংশের ছেলে মেয়ের বিয়ে দেবে না। বরং এক কাজ করতে পারিস, এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর সে তোকে বিয়ে করতে চাইলেও কিছুতেই রাজি না হয়ে তুই যাতে সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে থাকতে পারিস, তার ব্যবস্থা করে দিতে বলবি। এমন সময় তন্ময়কে ঢুকতে দেখে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?

তন্ময় সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আজ হঠাৎ সালাম দিলে যে?

মন চাইল দিলাম। কেন সালাম দেয়া কি অন্যায়?

না তা নয়। আগে দাওনি তো তাই বললাম।

কেমন আছ বললে না যে? আমি তো মনে করেছিলাম তোমার কোন অসুখ বিসুখ করেছে। তোমার চেহারা দেখে কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।

তোমার অনুমান একদম মিথ্যে নয়। তবে শারীরিক কিছু না হলেও মানসিক হয়েছে। জান, এই ক’দিন তোমার অদর্শন যে কি বেদনা দিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।

তামান্না ছলছল নয়নে বলল, আর আমিও কিভাবে এই ক’দিন কাটিয়েছি, তা উপরের মালিক জানেন। কেন তুমি এই পাপী হতভাগীর জন্য এত কষ্ট পাও? কেন, কেন, কেন? কথা শেষ করে দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

তন্ময়ও ভিজে গলায় বলল, উত্তর জেনেও কেন বারবার জিজ্ঞেস কর। এতে যে আমি আরো বেশি কষ্ট পাই। আর কখনও জিজ্ঞেস করো না। তারপর তার হাত দুটো ধরে সরিয়ে দিয়ে বলল, কেঁদো না তামান্না কেঁদো না। তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারি না।

তামান্না আঁচলে চোখ মুখ মুছে তাকে বসতে বলে বলল, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি খুব ক্ষিধে পেয়েছে। একটু অপেক্ষা কর কিছু আনাবার ব্যবস্থা করি।

তন্ময় একটু চিন্তা করে বলল, ওসবের দরকার নেই। তুমি খালাকে একটু ডেকে নিয়ে এস; তার সঙ্গে কথা বলব।

তামান্না বলল, তা ডাকছি। তার আগে তোমার কিছু খাওয়া দরকার। তন্ময় কিছু বলছে না দেখে আবার বলল, তোমার টাকাতেই আনাব, তবু খাবে না? কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছতে লাগল।

তামান্নার অবস্থা দেখে তন্ময়ের মায়া হল। বলল, ঠিক আছে, আনাও।

তামান্না রুম থেকে বেরিয়ে ফরিদার হাতে টাকা দিয়ে বলল, কিছু ভালো নাস্তা ও ঠাণ্ডা পানিয় আনিয়ে দে। আমি খালাকে ডেকে নিয়ে আসি, সাহেব তার সঙ্গে কি কথা বলবে।

এখানে কিছু কম বয়সি ছেলে থাকে, তারা খদ্দেরদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে দেয়। ফরিদা তাদের একজনের দ্বারা কিনিয়ে এনে তামান্নার ঘরে পাঠিয়ে দিল।

ততক্ষণে তামান্না খালাকে ডেকে ফিরে এসেছে। খালা একটু পরে যাচ্ছি বলে তামান্নাকে বলেছে, তুই গিয়ে সাহেবকে ভালো করে খাতির কর।

তামান্না নাস্তা পরিবেশন করে তন্ময়কে খেতে বলল।

তন্ময়ের যদিও ক্ষিধে ও পিপাসা দুটোই লেগেছে, তবু এখানে খেতে ইচ্ছা করছিল না। তামান্নার বারবার অনুরোধে একপিস কেক ও ফান্টা খেল।

একটু পরে খালা এলে তন্ময় তামান্নাকে বাইরে যেতে বলল। তামান্না চলে যাওয়ার পর খালাকে বলল, জেনেছি আপনি এখানকার সকলের খালা। সেই সুবাদে আমিও আপনাকে খালা বলে জানি। খালা হল মায়ের বোন। মায়ের বোন মায়ের সমান। ছেলে হয়ে মায়ের কাছে আব্দার করছি, আমি তামান্নাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। এ ব্যাপারে মা হয়ে যা বলবেন, তা মেনে নেব। তবে যা কিছু হবে তা লেখাপড়ার মাধ্যমে হবে। যাতে করে ভবিষ্যতে আমরা বা আপনি বিপদে না পড়েন। আর একটা কথা নিশ্চয় জানেন, আমাদের মান সম্মান আছে। সেটা যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে মা হয়ে নিশ্চয় লক্ষ্য রাখবেন। আপনি হয়তো আমার ঠিকানা জানেন। তাই মায়ের কাছে কারো আব্দার করছি, ভবিষ্যতে ছেলের সংসারে যেন কোনো অশান্তির আগুন না জ্বলে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখবেন। সে জন্যে আপনি যা দাবি করবেন, ছেলে হয়ে সাধ্যমতো পূরণ করার চেষ্টা করব।

সাহেবের বাসা থেকে তামান্না ফিরে আসার পর তার উপর অত্যাচার করে খালা বুঝতে পেরেছিল, এই মেয়েকে দিয়ে আর দেহ ব্যবসা করানো যাবে না। তখন ভেবেছিল, একে বিদায় করে দেয়াই ভালো। তবে বিদায় করার আগে মোটা টাকা আদায় করে নিতে হবে। সেটা পূরণ হতে যাচ্ছে দেখে মনে মনে খুব খুশী হল। তা ছাড়া তন্ময়ের কথাবার্তায় ও তাকে দেখে তার প্রথম জীবনের কথা মনে পড়ল। তার প্রথম স্বামীর ঔরষে একটা ছেলে হয়েছিল। ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর ছিল। পাঁচ বছর বয়সে মারা যায়। তন্ময়কে দেখে সেই মরা ছেলের কথা মনে পড়ল। তাই তার মনটা তন্ময়ের প্রতি আরো নরম হল। বলল, তুমি বাবা যখন আমাকে মায়ের মতো মনে কর তখন কথা দিচ্ছি, মা হয়ে ছেলের দুশমনি করব না। তবে এই মেয়েকে পেতে আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তা ছাড়া আজ সাত আট মাস হতে চলল রোজগার করা ছেড়ে দিয়েছে। অসুখ বিসুখেও ওর পিছনে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। ওকে নিয়ে যেতে হলে বেশ কিছু টাকা দিয়ে যেতে হবে।

তন্ময় বলল, তা আমিও জানি। কত দিতে হবে বলুন। আপনি আগামী পরশু দশটার সময় কাউকে সাথে নিতে চাইলে তাকে ও তামান্নাকে নিয়ে জজকোর্টে আসবেন। সেখানে লেনদেনের পর কাগজে সই সাবুদ করে কাজি অফিসে বিয়ের কাজ সেরে তামান্নাকে নিয়ে যাব। তবে এমন দাবি করবেন না, যা পূরণ করা আপনার ছেলের পক্ষে অসাধ্য।

তন্ময় যত কথা বলছে খালার তত নিজের ছেলের কথা মনে পড়েছে। চেপে থাকতে না পেরে বলল, আমার একটা ছেলে ছিল। সে বেঁচে থাকলে আজ তোমার মতো হত। তোমাকে দেখে ও তোমার কথা শুনে বার বার তার কথা মনে পড়ছে। তোমার বদলে অন্য কেউ হলে অনেক টাকা দাবি করতাম। কিন্তু তোমাকে আমি কিছু বলব না। তোমার বিবেচনায় যা হয়, তাই দিও। তারপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।

তন্ময় বলল, তা হয় না খালা। আপনি বলতে না পারলেও আমি বলছি, একলাখ টাকা দেব। এই টাকার কথাটি কিন্তু আপনি কাউকে জানাবেন না। এমন কি তামান্নাকেও না। অবশ্য কাগজপত্রে থাকবে।

টাকার কথা শুনে খালা খুব খুশী হলেও দুঃখে মনটা ভরে গেল। ভাবল, এই টাকা যদি আগে পেত, তা হলে এমন ব্যবসা সে স্বামীকে করতে দিত না আর নিজেও করত না। স্বামী টাকার জন্য প্রথমে তাকে দিয়েই এই ব্যবসা শুরু করে। প্রথম দিকে সে রাজি হয়নি বলে স্বামীর হাতে কত নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছে। সেই কথা ভেবে এখন চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে কোনো রকমে বলল, তুমি যা দেবে তাতেই আমি খুশী। এই কথা বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

তামান্না এতক্ষণ বাইরে ফরিদার সঙ্গে কথা বলছিল। উল্টো দিকে মুখ করে ছিল বলে খালাকে চলে যেতে দেখেনি। ফরিদা দেখতে পেয়েছে। বলল, এবার তুই ঘরে যা, খালা চলে গেছে।

তামান্না ঘরে এসে দেখল, তন্ময় চুপচাপ বসে কি যেন ভাবছে। বলল, খালার সাথে কি কথা হল?

তন্ময় বলল, তোমাকে পরশু এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থার কথা বললাম।

খালা আপত্তি করে নি?

আপত্তি যে একদম করেনি তা নয়, আমি তার আপত্তির কারণ দূর করে দিয়েছি। যাক, সে ব্যাপারে তোমাকে পরে বলব। এখন যা বলছি শোন, পরশু সাড়ে নটার দিকে এখান থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি থেক। খালা তোমাকে নিয়ে কোর্টে যাবে। কোর্টে ম্যারেজ হওয়ার পর কাজি অফিসের কাজ সেরে তোমাকে নিয়ে আমি চলে যাব।

তামান্না ভেবেছিল, তন্ময় হয়তো তাকে প্রথমে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে কোথাও রাখবে। তারপর ভেবে চিন্তে বিয়ের ব্যবস্থা করবে। তা না করে পরশুই একেবারে বিয়ে করে নিয়ে যাবে শুনে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কোন কথা বলতে পারল না।

তন্ময় বলল, কিছু বলছ না যে? তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ না?

তামান্না নিজেকে সংযত রাখতে পারল না, তন্ময় বলে ডুকরে কেঁদে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমাকে অবিশ্বাস করার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। তাই তো এতবড় সুখবর শুনে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এতবড় সৌভাগ্য কি আমার হবে?

তন্ময় তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ভাগ্য যিনি গড়েছেন, তিনিই জানেন কতটা সৌভাগ্য তোমার হবে। এখন একটু সামলাবার চেষ্টা কর। তোমাকে কতটা সুখী করতে পারব জানি না। আমাদেরকে এখন অনেক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

তামান্না কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারব। শুধু তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হয়। তুমি সুখী মানুষ। বিপদে পড়লে অনেক দুঃখ কষ্ট আসে। সেই দুঃখ কষ্ট সহ্য করা তোমার পক্ষে খুব কষ্টকর হবে।

তন্ময় বলল, তুমি পাশে থাকলে শত শত দুঃখ কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব।

তামান্না বলল, আমি আমার প্রাণের বিনিময়েও তোমার দুঃখ কষ্ট দূর করার চেষ্টা করব।

তন্ময় বলল, তা জানি বলেই সামনে বিপদ জেনেও তোমাকে গ্রহণ করতে যাচ্ছি। এখন আসি। আজ ও কাল আমাকে অনেকগুলো কাজ করতে হবে।

এস বলে তামান্না কদমবুসি করে দাঁড়িয়ে বলল, আল্লাহ হাফেজ।

তন্ময়ও আল্লাহ হাফেজ বলে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

পরের দিন দুপুরে মুশতাকিমের কাছে গিয়ে সব কথা বলল।

মুশতাকিম বলল, আল্লাহ তোদের সহায় হোক। আচ্ছা, একটা কথা কি ভেবেছিস, তোর মা যদি তামান্নাকে ঘরে না তুলেন, তখন তাকে কোথায় রাখবি?

হ্যাঁ ভেবেছি, তাই আজ সকালে গ্রীণরোডে আমাদের বাড়ির একটা ফ্লাট খালি করেছি। মা যদি সে রকম কিছু করে, তা হলে ওকে সেখানে রাখব। তারপর মাকে রাজি করাবার চেষ্টা করব।

তা হলে তো দেখছি তুই সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছিস।

কিন্তু কি জানিস দোস্ত, খুব নার্ভাস ফিল করছি।

তাতো স্বাভাবিক। এতবড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছিস, নার্ভাস ফিল করবি না? আচ্ছা, তুই কি নামায পড়তে জানিস?

জানি।

তা হলে আজ থেকে তুই নামায পড়তে শুরু কর। মোনাজাতের সময় নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করে আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চেয়ে সাহায্য প্রার্থনা কর। দেখবি মনের মধ্যে যে নার্ভাস ফিল করছিস, তা দূর হয়ে গেছে। আর জীবনে কখনও ফরয নামায ও ফরয রোযা ত্যাগ করবি না। নামায পড়লেই বুঝতে পারবি, নামায পড়ে কত শান্তি পাওয়া যায়। তুই তো জানিস, আমি আগে ধর্মের কোনো কিছুই মেনে চলতাম না। বিয়ের পর তোর ভাবিকে নিয়ে যখন কি করব না করব ভেবে অস্থির হয়ে পড়লাম এবং অশান্তিতে দিন কাটতে লাগল তখন আমার এক মোল্লা বন্ধু আমার অশান্তির কারণ শুনে আমাকে নামায পড়ার কথা বলেছিল। প্রথমে তার কথা গ্রাহ্য করিনি। তার কয়েকদিন পর আমি দেশে যাই। আমার বাবা আমার অশান্তির কারণ জানত। সেও আমাকে একই কথা বলল। দেশ থেকে ফিরে এসে নামায পড়তে শুরু করলাম। নামায পড়ে যখন দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে নিজের দোষত্রুটি ক্ষমা চেয়ে তাঁর কাছে সাহায্য চাইলাম তখন সত্যি সত্যি মনের মধ্যে অনেক শান্তি অনুভব করলাম। নামাযের পর ভারাক্রান্ত মন অনেক হালকা হয়ে গেল। তুই সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলি, আমার পরিবর্তন হল কি করে? এখন তার কারণ নিশ্চয় বুঝতে পারলি। তারপর যত ধর্মীয় বই পড়তে লাগলাম তত আরো বেশি শান্তি পেতে লাগলাম। তোর ভাবি এতদিন আমর মতো ধর্মের প্রতি উদাসীন ছিল। আল্লাহপাকের অপার করুণায় সেও এখন ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ে নিজের অনেক ভুল সে বুঝতে পেরেছে। আমার থেকে আরো বড় প্রমাণ পাবি তোর তামান্নার কাছে। আমার যতদূর মনে হয়, তোর মায়ের কাছে নামায শিখে পড়ার পর থেকে তার পরিবর্তন হয়েছে। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস, নামাযের মধ্যে কি শান্তি আছে।

তন্ময় বলল, তুই বোধ হয় সত্য কথাই বলেছিস। তোর কথা মানার চেষ্টা করব। তারপর তার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বলল, কাল দশটার দিকে কোর্টে আসছিস তো?

মুশতাকিম বলল, ইনশাআল্লাহ আসব।

সেদিন তন্ময় সারাদিন ভালো করে খেতে পারল না। সব সময় টেনসন ফিল করতে লাগল। রাতেও যেমন খেতে পারল না তেমনি ঘুমাতেও পারল না। একদিকে তামান্নাকে বিয়ে করে বাসায় আনলে মা কি বলবে বা করবে, সে কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠল। কোনোটাকে সামাল দিতে না পেরে খুব আনইজি ফিল করতে লাগল। শত চেষ্টা করেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। হঠাৎ মুশতাকিমের নামায পড়বার কথা মনে পড়ল। কথাটা চিন্তা করে বাথরুম থেকে গোসল ও অযু করে এসে এশার নামায পড়ল। তারপর কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করল। যখন মোনাজাত শেষ করে উঠল তখন তার সত্যিই মনে হল, মনের সেই অস্থির ভাবটা আর নেই। মনটাও অনেক হালকা হয়ে গেছে। দু’চোখে ঘুম যেন জড়িয়ে আসছে। নামায পাটী গুটিয়ে রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরে ফজরের আযান শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে নামায পড়ে আজকের সব কাজ যেন ভালভাবে মিটে যায় সেই দোয়া করল।

সকালে নাস্তা খেয়ে বেরোবার সময় মাকে বলল, কয়েকদিন থেকে তুমি রাগ করে আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলনি। আমার বুঝি কষ্ট হয় না? তোমার কথা না শুনে অন্যায় করেছি, তাই কষ্ট দিচ্ছ দাও, কিন্তু আজ আমি একটা কাজে যাচ্ছি, রাগ করে থাকলেও দোয়া করো মা, আমি যেন কাজটা ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারি। তারপর এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বেরিয়ে গেল।

ফিরোজা বেগম তখন কিছু বললেন না বটে, কিন্তু ছেলে চলে যাওয়ার পর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোকে কামিয়াব করুক।”

সব কাজ ঠিকমতো মিটে যাওয়ার পর তন্ময় তামান্নাকে নিয়ে বাসায় এসে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, তোমার কথা রাখতে পারলাম না বলে ক্ষমা চাইছি। তামান্নাকে বিয়ে করে এলাম, আমাদেরকে দোয়া কর মা। তারপর দু’জনে একসঙ্গে পায়ে পাত দিয়ে সালাম করতে গেল।

ফিরোজ বেগম ছেলের স্পর্দ্ধা দেখে যেমন অবাক হলেন, তেমনি রেগে গেলেন। সালাম করতে এলে তামান্নাকে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়ে কর্কশস্বরে বললেন, তোরা আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। তোদের দিকে নজর দেয়াও পাপ। তারপর ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কে তোর মা? আমাকে আর কখনো মা বলে ডাকবি না। আমি তোকে পেটে ধরিনি। আমার যদি ছেলে হতিস, তা হলে একটা বেশ্যাকে নিয়ে ঘরে ঢুকতিস না। যে ছেলে পেটে ধরেছি সে তুই না। আমার পেটের ছেলে কখনও এমন জঘণ্য কাজ করতে পারে না।

তামান্না লাথি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। উঠে আবার শাশুড়ীর পা ধরতে যেতে ফিরোজা বেগম গর্জে উঠে বললেন, খবরদার, তুমি আমাকে ছুঁয়ো না। তুমি রাক্ষুসী, তুমি যাদু জান। আমার ছেলেকে যাদু করে করায়ত্ব করেছ। বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। আর কোনোদিন এমুখো হয়ো না। একটা বেশ্যা হয়ে এ বাড়িতে কোন সাহসে ঢুকেছ? আমার ছেলেকে সহজ সরল পেয়ে তাকে রূপ যৌবন দেখিয়ে গ্রাস করেছ। শীগগির বেরিয়ে যাও বলছি। নচেৎ বলে তিনি কাঁপতে কাঁপতে একটা সোফায় বসে পড়লেন।

তামান্না কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে যা খুশী বলে দোষারূপ করুন, তাতে আমি কিছু মনে করব না। আপনার ছেলে নির্দোষ, তাকে কিছু বলবেন না। আমাকে আপনার পায়ে ঠাঁই না দিতে পারেন; কিন্তু আপনার ছেলেকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলবেন না। আমি চলে যাচ্ছি, তবে তার আগে আপনার পবিত্র কদমে দু’একটা কথা বলে তারপর যাব। এক সময় আমি বেশ্যা ছিলাম ঠিক। কিন্তু আমাকে বেশ্যা বানাল কারা? আমিও একজন সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত ফ্যামিলির মেয়ে। ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ে বেশ্যা হয়েছিলাম। আপনার পবিত্র সহবাসে এসে আল্লাহপাক আমাকে হেদায়েত দিয়ে আজ পর্যন্ত হেফাজতে রেখেছে। ভালো লোকেরা যদি খারাপ লোকদের ভালো করার জন্য কাছে টেনে না নেই; তা হলে খারাপ লোকেরা ভালো হবে কি করে? পাহাড়ের চূড়া থেকে যদি কেউ কোনো পাথরকে নিচে ফেলে দেয়, তবে সেই পাথর আর কোনোদিন নিজে সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারে না। যদি কেউ দয়া করে সেই পাথরকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠিয়ে দেয়, তা হলেই তা সম্ভব। আমি আপনার দয়ায় আবার পূর্ব জীবনে উঠতে চেয়েছিলাম। আর আপনার ছেলে দয়া না করলে ঐ পাপপূরীতে চিরকাল জীবন কাটাতে হত। এখন আপনি দয়া করে পায়ে আশ্রয় দিন। এই কথা বলে আবার তার পা ধরতে গেল।

ফিরোজা বেগম তামান্নার কথা শুনে কিছুটা নরম হলেও রেগে রয়েছেন। তাই গরম মেজাজে বললেন, আমাকে ছুঁতে নিষেধ করলাম না। মনে করেছ নীতিকথা শুনিয়ে আমাকে ভুলাবে। তারপর তিনি উঠে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

তন্ময় মায়ের পিছনে আসতে আসতে বলল, যেওনা মা, দাঁড়াও, আমার কথা শোন। তারপর বন্ধ দরজায় করাঘাত করে বলতে লাগল, মাগো দরজা খোল। আমি তোমার ছেলে। তুমি অস্বীকার করতে পারবে, আমি তোমার গর্ভজাত সন্তান নই? অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাকুতি মিনতি করেও যখন ফিরোজা বেগম দরজা খুললেন না এবং কোনো কথাও বললেন না তখন তামান্নার হাত ধরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে অনুমান করে বাসা ঠিক করে রেখেছি। সেখানে তোমাকে রেখে মাকে মানাবার চেষ্টা করব।

তামান্না বাসায় পৌঁছান পর্যন্ত নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। বাসায় ঢুকে বসে পড়ে তন্ময়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আগে মাকে রাজি করিয়ে আমাদের বিয়েটা হওয়া উচিত ছিল। আমার জন্য তোমাকে মায়ের অনেক লাঞ্ছনা খেতে হল।

তন্ময় তাকে তুলে মাথায় ও কপালে চুমো খেয়ে আলিঙ্গনবদ্ধ করে বলল, তুমি এই কথা আর বলো না। আমি জীবনে কোনোদিন মায়ের কথার অবাধ্য হইনি। শুধু বিয়ের ব্যাপারটা ছাড়া। তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপার নিয়ে মায়ের সঙ্গে অনেকদিন থেকে মনোমালিন্য চলছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তা একদিন না একদিন অবসান হবে। তুমি শুধু আমার পাশে থেকে সাহায্য করবে। সেই আশা নিয়ে মায়ের অমতে তোমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করলাম।

তামান্না কাঁদতে কাঁদতে বলল, কিন্তু আমার কারণে মা তোমাকে বাড়ির চাকর চাকরানিদের সামনে যেভাবে অপমান করল, সেকথা ভেবে নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে।

তন্ময় তাকে আলিঙ্গনমুক্ত করে কয়েকটা আদর দিয়ে বলল, আমার জন্য তুমিও সবার সামনে কম লাঞ্ছনা ভোগ করনি। সে জন্যে আমিও যে নিজেকে অপরাধী মনে করছি। মায়ের কোনো দোষ সন্তানের ধরতে নেই। মা ছেলেকে শাসন করবে না তো কে করবে? আমরা দোষ করেছি, শাস্তি আমাদের পাওনা। ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। আজ আমাদের বিয়ের দিন। আজকের দিনের গুরুত্ব নিশ্চয় জান। কান্নাকাটি করে এমন শুভদিনটা মাটি করে দিও না। অনেক প্রতিবন্ধকের মধ্যে দিয়ে আল্লাহপাক তোমাকে পাইয়েছেন। আমার ভূবুক্ষ মন আজ তোমার কাছে অনেক কিছু আশা করে। কান্নাকাটি করে সেগুলো থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না।

তামান্না কান্না থামিয়ে চোখ মুখ মুছে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরে সারামুখে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে দিতে বলল, আমার সাধ্যমতো সেগুলো তোমাকে দেয়ার চেষ্টা করব। কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত করব না। কিন্তু কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।

অফকোর্স বলে তন্ময়ও তাকে বুকে চেপে ধরে তার সারামুখে আদরের প্রতিদান দিতে লাগল। এভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর একসময় তামান্না বলল, দুপুর হয়ে গেছে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না?

তন্ময় বলল, তোমাকে পেয়ে আমার ক্ষুৎপিপাসা মিটে গেছে। সে কথা খেয়াল ছিল না। তাই এখানে সে সবের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। চল, হোটেল থেকে খেয়ে আসি।

তামান্না আস্তে করে তার গাল টিপে দিয়ে বলল, বেশ তাই চল। ঐ দিন তন্ময় বাসা থেকে কোথাও গেল না। সারাদিন ও রাত তামান্নাকে নিয়ে কাটাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *