ভালোবাসি তোমাকেই – ৪

রাত দশটার সময় তন্ময় মজাহার ও তামান্নাকে নিয়ে বাড়িতে এল। হোটেলে যাওয়ার সময় মাকে ও বাড়ির সবাইকে বলে গিয়েছিল, বিয়ে করে বৌ নিয়ে রাত দশটার মধ্যে ফিরবে। তাই তারা বৌকে অভ্যর্থনা করে ঘরে তোলার জন্য তৈরি ছিল। কাজের মেয়ে দু’জন বৌকে নিয়ে প্রথমে বেগম সাহেবের কাছে গিয়ে বলল, বৌমা, ইনি আপনার শাশুড়ী।

তামান্না ফিরোজা বেগমের পায়ে হাত ছুয়ে সালাম করল।

ফিরোজা বেগম চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দো’য়া করে তন্ময়কে বললেন, বৌমাকে উপরে নিয়ে যা।

তামান্না শাশুড়ীর পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, আপনার অসুখের কথা আমি শুনেছি। এখন উপরে যাব না; কিছুক্ষণ আপনার কাছে থাকি।

ফিরোজা বেগম আনন্দে আপ্লুত হয়ে চোখ মুছে বললেন, আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক মা। তোমার কথা শুনে খুব খুশী হয়েছি। আমার সেবা যত্ন করতে হয় করবে, এখন উপরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। তারপর জামা কাপড় পাল্টে না হয় আসবে। তন্ময়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, আমার কথা শুনতে পাস নি? যা বৌমাকে নিয়ে গিয়ে তুইও জামা কাপড় পাল্টে বিশ্রাম নিয়ে আসবি। রাত হয়েছে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে না?

তন্ময় তামান্নাকে উপরে নিজের রুমে নিয়ে এসে দেখল, বাসর শয্যা সাজান হয়েছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, এসব দেখে আপনি কিছু মনে করবেন না। ঐ যে দেখছেন দরজা, আপনি পাশের রুমে যান। ওখানে আপনার থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছি। কাজের মেয়েরা আমার হুকুম ছাড়া এ রুমে ঢুকে না। তারা কেউ কিছু জানতে পারবে না। ওটাতেও এটাচ বাথরুম আছে।

তামান্না পাশের রুমে গিয়ে দেখল, রুমটা খুব সুন্দর। বাথরুম খুলে দেখল, সেটাও খুব সুন্দর। গোসল করার দামী দামী সাবান, তেল, তোয়ালে সবকিছু রয়েছে। তামান্নার মনে হল, সাহেবরা অত্যন্ত ধনী। দীর্ঘ দু’তিন বছর অমানবিক পরিস্থিতিতে বাস করে এখানে এসে তার খুব ভালো লাগল। ভাবল, যে কটা দিন এখানে থাকবে, সে কটা দিন বেশ আরামেই কাটবে। ড্রেস চেঞ্জ করে মুখ হাত ধুয়ে খাটে বসে ভাগ্যের কথা চিন্তা করতে লাগল।

তন্ময়ও ড্রেস পাল্টে হাতমুখ ধুল। তারপর দরজায় মৃদু করাঘাত করে বলল, বেরিয়ে আসুন, নিচে খেতে যেতে হবে।

তামান্না রুমে ঢুকে দরজা এমনি আলগা করে ভিড়িয়ে দিয়েছিল, তন্ময়ের গলা পেয়ে এ ঘরে এল।

তাকে দেখে তন্ময় বলল, চলুন খেয়ে-দেয়ে মায়ের কাছে যাব। আর শুনুন, আমি মায়ের কাছে এবং বাসার সকলের কাছে আপনাকে তুমি করে বলব, মনে কিছু নেবেন না। অবশ্য অন্য সময় আপনি করেই বলব। আর আপনিও তাই করবেন।

তামান্না বলল, মনে করার কি আছে। বরং কথাটা বলে ভালই করেছেন। আমি একটা অনুরোধ করব রাখবেন?

বলুন, রাখবার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।

আপনি সব সময় আমাকে তুমি করেই বলবেন।

তন্ময় কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে এমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, যা দেখে তামান্না অনেক কিছু বুঝতে পারল। সেও নিজের সত্বা ভুলে একই রকমভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, কিছু বললেন না যে?

তন্ময় বলল, ঠিক আছে চেষ্টা করব।

খাওয়া-দাওয়ার পর দু’জনে রাত একটা পর্যন্ত মায়ের কাছে থেকে সেবা যত্ন করল।

ফিরোজা বেগমের বারবার তাগিদে তারা উপরে এল। তন্ময় তাকে পাশের রুমে যেতে বলে একটা বই নিয়ে বসে পড়তে লাগল। তামান্নাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, অনেক রাত হয়েছে, যান, এবার ঘুমিয়ে পড়ুন।

তামান্না বলল, আপনি ঘুমাবেন না?

ঘুমাবো, তবে একটু পরে। আমার ছোটবেলা থেকে অভ্যাস, খাওয়ার পর কিছুক্ষণ কিছু না কিছু পড়তে হবে। নচেৎ ঘুম আসবে না। পড়তে পড়তে যখন ঘুম পাবে তখন ঘুমিয়ে পড়ব। মায়ের অসুখের পর থেকে বই পড়েও ঘুম আসে না। তা ছাড়া মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে হয়। ঘুমই যখন আসে না তখন আর শুধু শুধু শুয়ে জেগে থাকার কোনো মানে হয়? তার চেয়ে বই পড়া অনেক ভালো।

তামান্না বলল, আপনি নিশ্চেন্তে ঘুমান; আমি বরং মায়ের কাছে যাচ্ছি।

মা আপনাকে থাকতে দিলে তো থাকবেন, আমাকেই কত রাগারাগি করে। দেখলেন না, আপনার সামনে আমাকে কত বকল?

আপনি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলবেন বলে স্বীকার করেছেন।

করেছি। অভ্যস্থ হতে সময় লাগবে। আপনি সরি, তোমাকেও আমি নই বলেছিলাম।

মনে আছে। অভ্যাস হতে আপনার যদি সময় লাগে, আমার বুঝি লাগবে না? তারপর জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে টেবিলের উপর রেখে চাপা দিয়ে বইটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে যথাস্থানে রেখে বলল, আজ থেকে মাকে দেখাশোনা করার সব দায়িত্ব নিলাম। আপনি ঘুমাবার চেষ্টা করুন। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে মাকে দেখে আসব।

তন্ময় কয়েক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে দেখে এই রকমই আশা করেছিলাম। তুমি যাও, আমি ঘুমাচ্ছি।

তামান্না নিজের রুমে এসে কিছুক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করল; কিন্তু দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই তন্ময়ের সুন্দর মুখটা ভেসে ওঠে। শেষে তন্ময়ের রুমের দেয়াল ঘড়িতে যখন রাত তিনটে বাজার ঘন্টা বাজল তখন উঠে নিচে আসার সময় দেখল, সে বিছানায় নেই। ভাবল, বাথরুমে গেছে, না নিচে মায়ের কাছে গেছে? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিচে এসে দেখল, মায়ের অনতি দূরে বসে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বই পড়ছে। আর মা ঘুমাচ্ছেন। কাছে এসে অনুচ্চস্বরে বলল, আমার কথা বুঝি আপনার বিশ্বাস হয়নি?

তন্ময় লজ্জা পেয়ে বলল, বিশ্বাস হবে না কেন? ঘুম আসছিল না তাই ….!

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তামান্না বলল, থাক, আর সাফাই গাইতে হবে না। রাত জাগলে যে শরীর খারাপ হয়, সে কথা বুঝি জানেন না?

জানব না কেন? তাই বলে মায়ের অসুখের সময় কি ঘুমান উচিত?

না তা উচিত না। এতদিন কেউ ছিল না, তাই না হয় জেগেছেন। এখন তো আমি আছি। যান, ঘুমাতে যান, আপনার কোনো কৈফিয়ত শুনব না।

রাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ হবে না?

আবার তর্ক করছেন? মেয়েদেরকে আল্লাহ সেবাযত্ন করার জন্য তৈরি করেছেন। রাত জাগলে তাদের কিছু হয় না।

ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু মা তোমাকে দেখলে তোমাকে ও আমাকে দু’জনকেই বকাবকি করবে।

বকুক। তাতে আমি কিছু মনে করব না। আপনি কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে চলে যান।

তন্ময় আর কোনো কথা না বলে ঘুমাতে চলে গেল। সে রাতে তামান্না সারারাত ফিরোজা বেগমের কাছে রইল।

ভোরে ফিরোজা বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যেতে দেখলেন, বৌ তার কাছে জেগে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলেন, কখন এলে বৌমা?

তামান্না মিথ্যে করে বলল, এই কিছুক্ষণ আগে এসেছি। একটু পরে কাজের মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে সেখানে এল।

ফিরোজা বেগম তাদেরকে বললেন, তোমরা তোমাদের কাজে যাও। তারপর তামান্নাকে বললেন, রান্নাঘরে যাও। চা হয়ে গেলে তন্ময়ের জন্যে নিয়ে যাবে। ওকে জাগিয়ে বেডটি দেবে। আর সাথে দু’তিন পিস বিস্কুট নিয়ে যেও। প্রথমে বিস্কুট খাইয়ে পানি খাওয়াবে, তারপর চা দেবে।

তামান্না চা বিস্কুট নিয়ে রুমে গিয়ে দেখল, তন্ময় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেগুলো টেবিলের একপাশে রেখে গ্লাসে পানি ঢালল। তারপর জাগাতে গিয়ে তার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবল, কি সুন্দর চেহারা! যে মেয়ে এ বাড়ির বৌ হয়ে আসবে, সে কত সৌভাগ্যবতী। তাকে নড়ে উঠতে দেখে বলল, এই যে শুনছেন, উঠুন, সকাল হয়ে গেছে। বেডটি খেয়ে নিন।

তন্ময়ের ঘুম খুব সজাগ। অল্প একটুতে ভেঙ্গে যায়। তামান্নার কথায় তার ঘুম ছুটে গেল। তামান্নাকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল, মা কেমন আছে?

ভালো। তারপর বলল, আপনার ব্রেডটি।

তন্ময় টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এসব জানলে কি করে?

মা বলেছেন। তন্ময়কে চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়াতে দেখে তামান্না বাধা দিয়ে বলল, তা হবে না। আগে বিস্কুক খেয়ে পানি খান, তারপর চা।

তন্ময় তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, মা দেখছি তোমাকে সবকিছু বলেছে। গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, টেবিলের নিচে চিলিমচি আছে দাও।

তামান্না চিলিমচি হাতে ধরে বলল, নিন কুলকুচি করে নিন।

তন্ময় কুলকুচি করে দুটো বিস্কুট খেয়ে পানি খেল। তারপর চা খেয়ে আবার ঘুমাবার সময় বলল, ঠিক আটটার সময় জাগাবে।

তামান্না কিছু না বলে কাপ পিরিচ নিয়ে নিচে নেমে এল। সে শিক্ষিতা ও দুটো পুরুষের সাথে কাটিয়েছে। তার উপর প্রায় দু’বছর নিষিদ্ধ পল্লীতে থেকে বিভিন্ন পুরুষের সংস্পর্শে এসে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। পরের দিন থেকে সে ফিরোজা বেগমের সেবাযত্ন করার সাথে সাথে ঠিক ঘরের বৌ-এর মতো সংসারের সবকিছু দেখাশোনা করতে লাগল। সেই সাথে তন্ময়ের সঙ্গেও এমন ব্যবহার করতে লাগল, সত্যি সত্যি সে যেন এ বাড়ির বৌ।

ফিরোজা বেগম বৌমা বলতে অজ্ঞান। তামান্নার প্রাণঢালা সেবাযত্নে তিনি যেমন দিন দিন সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন তেমনি তন্ময়ও তাকে ভীষণ ভালবেসে ফেলন।

ফিরোজা বেগমকে সুস্থ হয়ে উঠতে, তামান্নার মনে দুশ্চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করল। সারাদিন কাজে কর্মে তেমন ভাববার সময় পায় না। কিন্তু রাতে ঘুমাবার সময় মনের মধ্যে ভীষণ চিন্তার ঝড় উঠে। ফিরোজা বেগম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর কি হবে? তিনি কি যেতে দেবেন, না সাহেব তাকে যেতে দেবেন? এই চিন্তা ছাড়াও আরো একটা চিন্তায় সে অস্থির হয়ে পড়ল, ফিরোজা বেগম ভালো হয়ে যাওয়ার পর সাহেব তাকে বিয়ে করবে বলেছে। এ যে সর্বনাশের কথা। সাহেব যদি জানে আমি পতিতা, তখন কি হবে? এই সব চিন্তা করে সে অস্থির হয়ে উঠল।

দিন পনেরর মধ্যে ফিরোজা বেগম অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি তামান্নার ব্যবহারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। তার উপর তার রূপ তাকে আরো আকৃষ্ট করেছে। একদিন তামান্নার সামনে ছেলেকে বললেন, কিরে তুই না বলেছিলি, বৌ এলে সংসারে অশান্তি আসবে। কিন্তু এখন তো দেখছি, বৌমা এসে যা কিছু অশান্তি ছিল তা দূর হয়ে শান্তিতে ভরে গেছে। আমি তো সুস্থ হয়ে উঠছি, এবার একদিন তোর শ্বশুর শাশুড়ীকে নিয়ে আসবি। এতদিন হল মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, একদিনও তো তাদের মেয়েকে বা আমাকে দেখতে এল না। তারা কি আমার অসুখের কথা জানে না?

এরকম পরিস্থিতি যে একদিন আসবে, তা তন্ময় আগেই বুঝেছিল। তাই সেজন্য প্রস্তুত ছিল। বলল, ওর মা বাবা কেউ নেই। চাচা চাচির কাছে মানুষ হয়েছে। ওর চাচি খুব দজ্জাল মেয়ে। ওকে মোটেই দেখতে পারে না। অনেক জ্বালা যন্ত্রনা দিত। পরের মেয়েকে বিদায় করে শান্তি পেয়েছে। আর তারা মানুষও ভালো নয়। বিয়ের পর ওর চাচি আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, এরপর আমরা যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখি।

ছেলের কথা শুনে ফিরোজা বেগম তামান্নাকে কাছে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, এমন সোনার মতো মেয়ের গায়ে হাত তুলতে চাচির বাধে নি? তারপর তামান্নাকে বললেন, যাকগে, এবার আল্লাহপাকের ইচ্ছায় তুমি আমাদের বৌ হয়ে এসেছ। এতদিনে তিনি তোমার দুঃখ কষ্ট দূর করলেন। কুরআনে আল্লাহপাক বলিয়াছেন, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য্য সহকারে নামায আদায় কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সঙ্গে থাকেন।” [সূরা-বাকারা, ২য় পারা, ১৫৩ নং আয়াত] তিনি বিপদের সময় মানুষকে ধৈর্য্য ধরতে বলেছেন।

তামান্না রাত বারটা একটা পর্যন্ত ফিরোজা বেগমের কাছে থাকে। তিনি ঘুমাতে যাওয়ার কথা বললেও যায় না। বলে আপনি ঘুমিয়ে পড়লে যাব। সুস্থ হওয়ার পর বৌকে তিনি নামায পড়তে শিখিয়েছেন। এখন তামান্না নিয়মিত নামায পড়ে। ছোট বেলায় আমপারা পড়েছিল। এখন ফিরোজা বেগম কুরআন পড়াচ্ছেন। তার কাছে কুরআন হাদিসের কথা শুনে শুনে তামান্না ক্রমশঃ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে পূর্ব জীবনের অন্যায় কাজের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করে কেঁদে কেঁদে দোয়া চাইতে লাগল— “হে রাহমানুর রাহিম, আমার সমস্ত গোনাহ খাতা মাফ করে দাও। তুমি আমাকে ঐ পাপ জীবন থেকে রক্ষা কর। সৎভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ করে দাও। তুমি ছাড়া আমার কেউ সাহায্যকারী নেই। সেজন্যে তোমার কাছে সাহায্য চাই। তুমি সর্বশক্তিমান মহান প্রভু। তোমার সাহায্য ছাড়া কেউ হেদায়েত প্রাপ্ত হয় না। আমি তোমার কাছে হেদায়েত প্রার্থনা করছি, তুমি আমাকে হেদায়েত দান কর। আল্লাহ গো, আমি যে ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়েছি এবং এখানে এসে ফেরেস্তার মতো সাহেবের সাথে ও তার মায়ের সাথে অভিনয় করছি, সেজন্যে আমাকে ক্ষমা কর।”

এই সব বলে একদিন গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে কেঁদে কেঁদে দো’য়া করছিল, তার কান্নার শব্দে তন্ময়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল। আতঙ্কিত হয়ে উঠে বসে বুঝতে পারল, পাশের রুমে তামান্না কাঁদছে। খাট থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে আস্তে ঠেলা দিতে একটু ফাঁক হয়ে গেল। দেখল, তামান্না নামায পার্টিতে বসে ঐসব বলে দোয়া করছে। আস্তে করে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে ফিরে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করল, তামান্না ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে দোয়া করছিল কেন? তা হলে কি মজাহার ওকে ষড়যন্ত্রের মধ্যে এনেছে? ভেবে রাখল, তামান্নার কাছ থেকে ঘটনাটা জানতে হবে।

মোনাজাত শেষ করে তামান্না মজাহারের কথা ভাবতে লাগল। এতদিন এখানকার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তার কথা মনে পড়লেও ভাবত, মজাহার এখানে না এলেও অফিসে সাহেবের সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করে। সে খালাকে একমাসের কথা বলে এনেছে। আজ প্রায় বিশ দিন হয়ে গেল আসছে না। তা হলে সে কি শুধু টাকা কামাবার টোপ হিসেবে আমাকে ব্যবহার করল? এতবড় বিশ্বাসঘাতকের মতো কাজ কি সে করতে পারবে? ভেবে রাখল, কাল সকালে সাহেবকে তার কথা জিজ্ঞেস করবে। সাহেবের কথা মনে হতে ভাবল, লোকটার সঙ্গে এতদিন স্ত্রীর মতো অভিনয় করছি অথচ নির্জনে এত কাছে পেয়েও একবারের জন্যেও কামনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় নি। তার কি পুরুষত্ব বলতে কিছু নেই? না সে খুব চরিত্রবান? এই ক’বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝছে এই বয়সে পুরুষরা নারীসঙ্গ পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে থাকে। সাহেব ইচ্ছা করলে যেমন খুশী যতবার ইচ্ছা তাকে ভোগ করতে পারে। আর সেও তাতে বাধা দিত না। কারণ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, সে যেন অন্য কিছু বলতে চায়। এত সংযমী পুরুষও তা হলে আছে? আচ্ছা, সাহেব কি আমার আসল পরিচয় জানে? মনে হয় জানে না। জানলে বিয়ে করার কথা বলত না। সাহেব যে তাকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে, তা তার ব্যবহারে ও চোখের দৃষ্টিতে বোঝা যায়। হঠাৎ তার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, পোড়ামুখী, তুইও তো তাকে ভালবেসে ফেলেছিস। একজন বেশ্যা হয়ে ফেরেস্ত তুল্য সাহেবকে ভালবাসতে তোর বাধল না? তোর মরণ হওয়া উচিত। কথাটা চিন্তা করে তামান্না চমকে উঠল। আল্লাহকে জানাল, তুমি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য কর। নচেৎ মরণ ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই। এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন তন্ময় অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তামান্না সবকিছু এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, মজাহার ভাই কি আপনার সঙ্গে দেখা করে?

এই কথা শুনে তন্ময়ের গত রাতের মোনাজাতের কথা মনে পড়ল, একপলক তামান্নার মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, না। আমি মনে করেছিলাম, সে হয়তো মাঝে মাঝে এখানে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করে যায়। এখন বুঝতে পারলাম আসে নি। ঠিক আছে, আজ তাঁর খোঁজ নেব।

তামান্না আর কিছু বলল না।

অফিসে গিয়ে তন্ময় এজাজকে মজাহারের কথা জিজ্ঞেস করল।

এজাজ বলল, সেদিনের পর সে মাত্র একদিন আমার কাছে এসেছিল, আর আসে নি।

আপনি তার ঠিকানা জানেন?

ভার্সিটিতে পড়ার সময় হলে থাকত। এখন কোথায় থাকে জানি না। তার দেশের বাড়ির ঠিকানাও জানি না। আপনি যদি বলেন, তা হলে খোঁজ নিতে পারি ।

তাই নেবেন। দেখা হলে বলবেন, সে যেন আজকালের মধ্যে দেখা করে।

ঠিক আছে স্যার, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

ফিরে এসে এজাজ তন্ময়কে জানাল, সে কয়েকদিন হল চাকরি নিয়ে কাতার চলে গেছে।

তন্ময় কথাটা শুনে চমকে উঠল। সামলে নিয়ে বলল, তার সঙ্গে কথা ছিল, আমার মা সুস্থ হয়ে উঠলে আমি তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করব। তবে শর্ত ছিল, তার বোন আমার অসুস্থ মাকে সেবা যত্ন করে ভালো করে তুলবে এবং আমার মা ও আমি যদি তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হতে পারি, তা হলে এ বিয়ে হবে। তাতে রাজি হয়ে সে তার চাচাতো বোনকে আমাদের বাসায় দিয়ে যায়। আমার মা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং মেয়েটাকে আমাদের সকলের পছন্দ। আমি এখন তাকে বিয়ে করতে চাই। সে বলেছিল, তার চাচা নাকি ঢাকাতেই থাকেন। আপনি কি তাদের ঠিকানা জানেন?

এজাজ খুব অবাক হল। কারণ মজাহার পরে যখন বাকি টাকাটা নিতে এসেছিল তখন বলেছিল, “তোর সাহেব মেয়ে দেখে মুগ্ধ হয়ে কাজি অফিসে ঐদিনই বিয়ে করে ঘরে নিয়ে গেছে।” সাহেবের কথা শুনে বুঝতে পারল, সে সেদিন মিথ্যে বলেছে। বলল, তার চাচার ঠিকানা তো জানি না। এমন কি তার কোনো আত্মীয় ঢাকায় আছে কিনা তাও জানি না।

তন্ময় বলল, ঠিক আছে, আপনি এখন যান।

সেদিন তন্ময় বেশ রাত করে বাসায় ফিরল। খাওয়া-দাওয়ার পর নিজের রুমে এসে তামান্নার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

ফিরোজা বেগম ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তামান্না উপরে এসে দেখল, সাহেব বই পড়ছে। অফিস থেকে কোনোদিন দেরি করে তন্ময় বাসায় ফিরেনি। আজ দেরিতে ফিরতে দেখে এবং তার মুখে চিন্তার ছাপ দেখে তামান্না বুঝতে পেরেছিল, মজাহারের খোঁজ নিশ্চয়ই পায় নি। কথাটা ভেবে সেও খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তাই সাহেবকে বই পড়তে দেখেও কিছু না বলে নিজের রুমে চলে যাচ্ছিল!

তন্ময় বই পড়লেও তামান্না ঘরে ঢুকতে টের পেয়েছে। তাকে চলে যেতে দেখে বলল, শোন।

তামান্না সাহেবের ডাক শুনে একবার কেঁপে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তন্ময় বলল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? আর আজ আমাকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছিলে কেন? ঐ চেয়ারে বস, দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করব। তামান্না ধীর পদক্ষেপে এসে অনতিদূরে একটা চেয়ারে বসল।

তন্ময় বলল, মজাহার ভাইয়ের খোঁজ নিয়েছি। তিনি চাকরি নিয়ে কাতার চলে গেছেন। সেই প্রথম দিন তোমাকে যা বলেছিলাম, তা পূর্ণ হয়েছে। এবার বিয়ের কাজটা আমি সেরে ফেলতে চাই। মজাহার থাকলে এসব কথা তোমাকে বলতাম না। সে নেই, তাই বললাম। তোমার চাচার ঠিকানাটা বল, আমি নিজেই ওনার সঙ্গে দেখা করব। মা তোমাকে ছেলের বৌ হিসেবে পেয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছে। আর এই ক’দিনে তোমাকে যতটুকু জেনেছি, আমার মায়ের সন্তুষ্টির চেয়ে আমি অনেক বেশি ভালবেসে ফেলেছি।

তন্ময়ের কথা শুনে তামান্না একদিকে যেমন মজাহারের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জেনে তার প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মাল, অপরদিকে তেমনি সাহেবের ভালবাসার ও বিয়ে করার কথা শুনে খুব ঘাবড়ে গেল। সাহেব যে তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছে, তা সে অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল আর সেও যে সাহেবকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছে, তা সে নিজেই অনুভব করেছে। সেইজন্য নিজের পরিচয়ের কথা ভেবে সাহেবের কাছে নিজের দুর্বলতা কখনও প্রকাশ করেনি। সে একজন বেশ্যা, একথা সাহেব জেনে গেলে মনে প্রচন্ড আঘাত পাবে, সে কথাও জানে, তাই কি বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে মাথা নিচু করে ঘামতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ তাকে ঐভাবে থাকতে দেখে তন্ময় বলল, এতক্ষণ ধরে কি ভাবছ? চাচার ঠিকানা বলবে না?

তামান্নার তখন নিজের ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কথা চিন্তা করে কান্না পাচ্ছিল। কোনো রকমে সামলে নিয়ে নিজের রুমে যেতে যেতে বলল, কালকে বলব।

তন্ময় বলল, প্লীজ যেও না। তা না হয় কালকে বলবে। আর একটু বস, আরো দু’একটা কথা বলব।

তামান্না যেতে যেতেই বলল, কাল শুনব। আজ আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। এই কথা বলে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। তন্ময় পিছু পিছু এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, প্লীজ দরজা খোল, শরীর খারাপ বললে না? আমার কাছে অনেক রকম ঔষধ আছে। বল কি হয়েছে। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যার।

তামান্না দরজা না খুলে মিনতি সুরে বলল, তেমন কিছু হয় নি। ওসবের দরকার নেই। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না। তারপর বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগল।

তন্ময় আর কি করবে, ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করল, তামান্না আমার কথা শুনে বেসামাল হয়ে পড়ল কেন? সেই কথা ও মজাহারের কথা ভাবতে ভাবতে অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম এল না। ভোরের সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে তামান্না বেডটি নিয়ে এসে তন্ময়কে জাগাল।

তন্ময় উঠে তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক। গত রাতের ঘটনার প্রতিফলন তার চেহারার মধ্যে নেই। আগের মতো স্বচ্ছ, হাসি খুশী প্রাণবন্ত। চায়ে চুমুক দিয়ে একটু সরে বসে পাশে বসার ঈশারা করে বলল, দাঁড়িয়ে কেন বস!

তামান্না না বসে বলল, ঠিক আছে।

ঠিক আছে মানে? আমি বসতে বললাম, বসলে না? অথচ বলছো ঠিক আছে।

না মানে আমাকে এক্ষুনি মায়ের কাছে যেতে হবে। তাই ….

সে জন্য বুঝি আমার কথা শুনবে না?

তা কেন বলে একটু দূরত্ব রেখে খাটেই বসল।

চা খাওয়া শেষ করে কাপটা হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর রেখে বলল, আমাকে এড়িয়ে চলছ কেন?

এটা করা কি অন্যায় হচ্ছে?

তুমি তো দেখছি ভীষণ চালাক। প্রশ্নকারীকে প্রশ্নের মাধ্যমে উত্তর দিলে। আচ্ছা, এখানে আসার পর থেকে তুমি মাঝখানের দরজায় ছিটকিনি না দিয়ে ঘুমিয়েছ। তাতে তোমার কি মনে হয়নি, আমার দ্বারা তোমার কোনো ক্ষতি হতে পারে?

না হয় নি।

কেন?

আপনার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস। আপনার মতো লোক শুধু আমার কেন কারুরই ক্ষতি করতে পারেন না।

এ রকম বিশ্বাস জন্মাল কেমন করে?

তামান্না বেশ্যা জীবনের অভিজ্ঞাতায় হঠাৎ করে বলে ফেলল, আমরা পুরুষের চোখ মুখ দেখলেই বুঝতে পারি, সে কি ধরনের লোক।

আমরা বললে যে, সব মেয়েদের কি সেই ক্ষমতা থাকে?

তামান্না নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে বলল, সব মেয়েদের অবশ্য সেই ক্ষমতা নেই, কথা প্রসঙ্গে এমনি হঠাৎ করে বলে ফেলেছি। তবে অনেকের আছে।

আমাকে না হয় কোনো কারণে বিশ্বাস করেছ, কিন্তু ভালো লেগেছে কিনা বলবে?

বা রে, যাকে ভালোলাগে তাকেই তো বিশ্বাস করা যায়।

ভালোলাগা থেকে কিন্তু ভালবাসার উৎপত্তি। সে রকম কিছু হয়নি? আমার কিন্তু তোমার মতো দৃষ্টি ক্ষমতা না থাকলেও তোমাকে দেখার পর থেকে খুব ভালো লেগেছে। তারপর সেই ভালোলাগাটা গভীর ভালবাসার পরিণত হয়েছে।

তামান্না কথাটা আগের থেকে বুঝতে পেরেও এখন শুনে একটু চমকে উঠে মাথা নিচু করে নিল।

কি হল চমকে উঠে চুপ করে আছ কেন?

তামান্না সংযত হয়ে বলল, স্বীকার করছি, ভালোলাগা থেকে ভালবাসার উৎপত্তি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও হয়। ভালোলাগাটা বন্ধুত্ব পর্যন্ত এসে পুর্ণচ্ছেদ পড়ে যায়।

আমিও তোমার কথা স্বীকার করছি। তবে ভালোলাগাটা বন্ধুত্বে এসে তখনই পুর্নচ্ছেদ পড়ে যখন ভালবাসার পথে কোনো বাধা থাকে। আশা করি, তোমার সেরকম কিছু নেই। আর একটা কথা বোধ হয় তোমার জানা নেই, ভালবাসা কিন্তু কোনো বাধা মানে না। বাধার সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করাই ভালবাসার ধর্ম।

মানুষ যদি ধর্ম মেনে চলত, তা হলে সমাজের এত অবনতি হত না।

এটা অবশ্য ঠিক কথা বলেছ। আচ্ছা এবার বল, গতরাতে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছিলে কেন? আমার দ্বারা তোমার কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল বলে মনে হয়েছিল বুঝি?

না না, তা নয়। অন্য কারণ ছিল। কারণটা বলবে?

পরে বলব, এখন বলতে পারব না।

তা না হয় পরেই বলো; কিন্তু তোমার চাচার ঠিকানা আজ বলবে বলেছিলে। আর শরীর খারাপের কথাও বলেছিলে। কি হয়েছিল বল।

কিছু না বলে তামান্না চুপ করে রইল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে চিবুক ধরে বলল, তোমাকে মনে প্রাণে ভালবাসি। কয়েকদিনের মধ্যে বিয়ে করব; সে কথা তুমিও জেনেছ। সেই অধিকারে ঐ সব কথা বলে কি অন্যায় করেছি?

তন্ময় চিবুক ধরতে তামান্না থরথর করে কাঁপতে লাগল, আর তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমাকে স্পর্শ করবেন না, আমি অস্পৃশ্য। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। ।

তন্ময়ও খাট থেকে নেমে তার দুটো হাত ধরে বলল, কে বলেছে তুমি অস্পৃশ্য? আমার স্ত্রী মায়ের মনে কষ্ট দেবে বলে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন বিয়ে করব না। সেই জন্য কখনও কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখিনি। কিন্তু তোমাকে দেখে ও তোমার আচরণে আমার সেই ভুল ভেঙ্গে গেছে। তুমি নিজেকে কেন অস্পৃশ্য বলছ জানি না। আমি কিন্তু তোমাকে নিজের থেকে বেশি ভালবেসে ফেলেছি, এ কথা যেমন চন্দ্ৰ সূর্যের মতো সত্য তেমনি তোমাকে বিয়ে করব, একথাও ঐ রকম সত্য।

তামান্না হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমার পরিচয় জানলে একথা বলতেন না, তারপর দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল।

তন্ময় দরজায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, দরজা খোল তামান্না, আমার কথা শোন, আমি গোসল করে রেডী হচ্ছি, তুমিও হয়ে নাও। নাস্তা খেয়ে তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব।

তামান্না দরজা না খুলে বলল, আপনি নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে যান। আমার কিছু হয়নি।

তন্ময় আরো কয়েকবার অনুরোধ করে গোসল করে রেডী হওয়ার পরও তামান্না আসছে না দেখে দরজার কাছে গিয়ে বলল, ডাক্তারের কাছে না হয় নাই গেলে, তা বলে আমাকে নাস্তা খেতে দেবে না?

ততক্ষণে তামান্না চোখ মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে বসেছিল। তন্ময়ের কথা শুনে দরজা খুলে বলল, চল।

তন্ময় আর কিছু না বলে নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে গেল।

এরপর তন্ময় মায়ের সামনে ছাড়া তামান্নার সাথে কথা বন্ধ করে দিল। এভাবে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। এই ক’দিন সে তামান্নার কথাগুলো চিন্তা করেছে। কিন্তু কোনো সদউত্তর বের করতে পারে নি।

এদিকে তামান্না ফিরোজা বেগম ও বাসার সবার সঙ্গে এমন নিখুঁত অভিনয় করে চলল যে, তাদের মনোমালিন্যের কথা কাউকে জানতে দিল না। কিন্তু রাতে সে একফোটা ঘুমাতে পারল না। ফলে এই ক’দিনে তার চেহারার মধ্যে মলিনতা ফুটে উঠল।

উপরে কেউ কারো সঙ্গে কথা না বললেও তামান্না প্রতিদিন তাকে বেডটি দেয়। আজ দিতে এলে তন্ময় বলল, তোমার অভিনয় করার ক্ষমতা অদ্ভুত। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দিতে পারনি। এই ক’দিন যে তুমি ঘুমাতে পারনি তা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখ বসে যাচ্ছে, সেদিকে লক্ষ্য করেছ? আমি তোমার সঙ্গে কথা বলিনি বলে তুমিও বলনি কেন আজ বলতেই হবে। আর তোমার চাচার ঠিকানাই বা বলছ না কেন? তামান্না কিছু না বলে চলে যাচ্ছে দেখে পথ আগলে ভিজে গলায় বলল, আমাকে যন্ত্ৰনা দিয়ে তুমি বুঝি সুখ পাচ্ছ?

তামান্না এইসব কথার জবাবে কি বলবে ভেবে পেল না। মাথা নিচু করে চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করল।

তন্ময় তা বুঝতে পেরে বলল, তোমার কি হয়েছে বলছ না কেন? না বললে বুঝব কি করে?

এমন সময় দরজার পর্দার বাইরে থেকে একটা কাজের মেয়ের গলা পাওয়া গেল, বেগম সাহেব বৌমাকে ডাকছেন।

তামান্না হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আঁচলে চোখ মুখ মুছে বলল, যাই, মা ডাকছেন। কথা শেষ করে চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল।

বেলা নটার দিকে যখন তন্ময় অফিসে যাবে তখন তামান্নাকে বলল, প্লিজ তামান্না, তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাব।

তামান্না বলল, আপনি শুধু শুধু আমার জন্য চিন্তা করছেন। তখন বললাম না, আমার কিছু হয়নি?

আলবত হয়েছে। তুমি স্বীকার না করলেও চেহারার মধ্যে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আমি যদি তোমার প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার করে থাকি, তা হলে মাফ চাইছি। তবু তুমি আমার কাছে কোনো কিছু গোপন করো না। তোমাকে আমার ভালবাসার কসম দিয়ে বলছি, কি হয়েছে বল।

তামান্না কঠোরভাবে নিজেকে সংযত করে বলল, আচ্ছা আপনি কি? কতবার বললাম আমার কিছু হয়নি, আমি ডাক্তারের কাছে যাব না। আপনি অফিসে যান, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তন্ময় আর কিছু না বলে নিচে এসে মাকে বলল, ক’দিন থেকে তোমার বৌয়ের শরীর খারাপ। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলাম, যেতে চাইল না। আমি ডাঃ রহিম চাচাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ফিরোজা বেগম বরাবর নিচতলায় থাকেন। তন্ময় দোতলায় থাকে। অসুখ হওয়ার আগে তিনি ছেলের রুম নিজের হাতে গুছাতেন। অসুখ হওয়ার পর কাজের মেয়ে সেই কাজ করত। এখন তামান্না করে।

প্রতিদিন তন্ময় যখন অফিসে যাওয়ার জন্য নেমে আসে তখন তামান্নাও সঙ্গে থাকে। আজ তামান্না আসে নি। তন্ময় চলে যাওয়ার পর নিজের রুমে বসে বসে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে ভাবছিল, একমাস শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি। এদিকে সাহেব যে রকম চাপাচাপি করছে তার ফল কি দাঁড়াবে কি জানি।

ফিরোজা বেগমেরও ক’দিন থেকে বৌমাকে যেন একটু কেমন কেমন মনে হয়েছে। তবে অসুখ বিসুখ হয়েছে অতটা ভাবেন নি। আজ ছেলের সঙ্গে নামেনি দেখে ও তার শরীর খারাপের কথা শুনে বললেন, কই, শরীর খারাপ হলে আমি বুঝতে পারতাম না? তুই নিশ্চয় বৌমাকে কিছু বলেছিস।

তন্ময় বলল, না মা, আমি কিছু বলিনি। তার চোখ মুখ শুকনো দেখে আমি জিজ্ঞেস করতে বলল, শরীর খারাপ।

ফিরোজা বেগম বললেন, ঠিক আছে, তুই ডাঃ রহিম ভাইকে পাঠিয়ে দিয়ে অফিসে যা।

ডাঃ রহিম তন্ময়ের বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে এ বাড়ির ফিজিসিয়ান। তন্ময়ের বন্ধু মারা যাওয়ার পরও এবাড়ির সঙ্গে আগের মতো গাঢ় সম্পর্ক।

তন্ময় চলে যাওয়ার পর ফিরোজা বেগম উপরে এসে বৌমা বৌমা করে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলেন। ঘরে নেই দেখে ভাবলেন, বাথরুমে গেছে। একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

তামান্না এতক্ষণ পাশের রুমে নিজের ভাগ্যের কথা মনে করে কাঁদছিল। ফিরোজা বেগমের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে ফ্রেস হয়ে এঘরে এসে বলল, মা আপনি কষ্ট করে উপরে এলেন কেন? আমি তো এক্ষুনি আপনার কাছে যেতাম। তেমন দরকার থাকলে কাজের মেয়েকে দিয়ে ডেকে পাঠাতেন।

ফিরোজা বেগম এতক্ষণ ছেলের রুমের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, বৌমা এঘরে থাকে না। তার একটাও জামা কাপড় এঘরে নেই। চোখ মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে এলেও বৌমা যে এতক্ষণ কাঁদছিল, তা তিনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন। বৌমার কথার জবাব না দিয়ে উঠে পাশের রুমের দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে বুঝতে পারলেন, বৌমা এঘরে থাকে। নতুন বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী আলাদা ঘরে থাকে জেনে তিনি যেমন অবাক হলেন তেমনি ছেলে বৌয়ের মধ্যে অশান্তির আগুন প্রবেশ করেছে ভেবে আতঙ্কিত হলেন। ফিরে এসে তামান্নার একটা হাত ধরে খাটের কাছে এসে নিজেও বসলেন আর তাকেও পাশে বসালেন। তারপর বললেন, এসব কি দেখছি বৌমা?

তামান্না ধরা পড়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। কোনো কথা বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চোখের পানিতে বুখ ভাসাতে লাগল।

ফিরোজা বেগম তামান্নাকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, তন্ময় কি নিজেই এই ব্যবস্থা করেছে? কবে থেকে তুমি ওঘরে ঘুমাও।

তামান্না কি বলবে ভেবে না পেয়ে সেই অবস্থাতেই রইল।

ফিরোজা বেগম বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই মা, তুমি বল। আমি তোমাদের মা। মা হয়ে যদি তোমাদের অশান্তি দূর করার চেষ্টা না করি, তবে কে করবে? আর রোজ হাশরে আল্লাহর কাছে মুখ দেখাব কি করে? বল মা বল, চুপ করে থেক না। তোমরা আমার একমাত্র ছেলে বৌ। তোমরা যদি সুখী না হও, তা হলে কাদেরকে নিয়ে আমি সুখী হব?

তামান্না মেঝেয় বসে ফিরোজা বেগমের দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা আমাকে মাফ করবেন, আমি আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। এ ব্যাপারে আপনার ছেলের এতটুকু দোষ নেই। তার চরিত্র ফেরেস্ত ার মতো। তার মতো মানুষ বর্তমান দুনিয়ায় আছে কিনা জানি না। আর আপনার মতো মা পাওয়া যে কোনো মেয়ের সৌভাগ্য। তবু আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না। আপনি আমাকে মাফ করে দিন মা।

ফিরোজা বেগমের মাথায় যেন কিছুই ঢুকছে না। তামান্নাকে তুলে পাশে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কেঁদো না মা, কেঁদো না। তন্ময় আসুক তাকে না হয় জিজ্ঞেস করব। যাও, চোখ মুখ ধুয়ে কাপড়টা পাল্টে নিচে এস। ডাক্তার আসার সময় হয়ে গেছে, এবার এসে পড়বে। এই কথা বলে তিনি নিচে নেমে এলেন।

তামান্না নিচে নেমে আসার দশ মিনিট পর ডাঃ রহিম এসে হাজির হলেন। দু’দিন হল বিদেশ থেকে ফিরেছেন। ফিরে এসে ফিরোজা বেগমের কঠিন অসুখ হয়েছিল শুনে গতকাল দেখা করে গেছেন। তন্ময় বিয়ে করেছে জেনে খুশী হয়ে তামান্নাকে দোয়া করেছেন। আজ এসে শাশুড়ী ও বৌকে একসঙ্গে দেখে সালাম দিয়ে বললেন, বৌমার আবার কি হল?

ফিরোজা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, বৌমার ক’দিন থেকে শরীর খারাপ। একটু পরীক্ষা করে দেখুন। তারপর তামান্নাকে বললেন, যাও বৌমা আমার রুমে যাও, ডাক্তার ভাই পরীক্ষা করে দেখুক।

ডাঃ রহিম পরীক্ষা করে এসে বললেন, না, বৌমার কোনো ট্রাবল নেই। কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিন, ঘুরে আসুক। বাবা মাকে ছেড়ে এসেছে। সেই জন্যে একটু টেনসনে ভুগছে। কোনো ওষুধ পত্র লাগবে না। তারপর তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর ফিরোজা বেগম তামান্নাকে বললেন, তোমার তো বাবা মা নেই। চাচা চাচির জন্য মন কেমন করছে সে কথা বললেই পারতে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, বেয়াই সাহেবদের কি টেলিফোন আছে?

তামান্না বলল, জি না।

ফিরোজা বেগম বললেন, তন্ময় আসুক তোমাকে নিয়ে যেতে বলব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *