ভালোবাসি তোমাকেই – ৬

তামান্না তন্ময়দের বাসা থেকে ফিরে এসে কোনো খদ্দেরকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না, একথা খালা জানতে পেরে অকথ্য অত্যাচার শুরু করল। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে নিজ হাতে মোটা বেত দিয়ে নির্মমভাবে মেরে মেরে শাস্তি দিতে লাগল। মারের আঘাতে তামান্নার শরীরের অনেক জায়গা ফেটে রক্ত বেরিয়ে পড়ে। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মেঝেয় পড়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলে, খালাম্মা, রোজ রোজ এভাবে না মেরে একেবারে মেরে ফেলুন। নচেৎ বিষ খাইয়ে মেরে ফেলুন। তবু আমাকে দিয়ে ঐ পাপ কাজ করাতে পারবেন না। আমি আল্লাহর কাছে ঐ পাপ কাজ আর করব না বলে তওবা করেছি। জান দেব, তবু ঐ কাজ করব না।

খালা আরো মারতে মারতে বলে, যখন যৌবন জ্বালায় নাগরের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলি তখন পাপের কথা মনে ছিল না বুঝি? তোকে অনেক টাকা দিয়ে কিনেছি। মেরে ফেললে সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? যতদিন না তুই আমার কথা শুনবি ততদিন তোকে শাস্তি দিয়ে যাব। দেখব কতদিন সহ্য করতে পারিস।

প্রায় মাসাধিক কাল মার খেয়ে তামান্না শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। খালা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করল না। অন্যান্য মেয়েরা তাকে দেখাশোনা করে, ওষুধপত্র এনে দেয়। একটু ভালো হলে খালা আবার মারধর শুরু করে। এবারে অসুখে পড়তে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে ফিরে এলে খালা যখন বলল, এবার কথামত কাজ না করলে, এমন শাস্তি দেব, যা তুই চিন্তা করতেও পারবি না। হাসপাতালে রেখে তোর পিছনে অনেক টাকা খরচ হয়েছে।

তামান্না খালার পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি তো আমার কাছ থেকে টাকা রোজগারের জন্য ঐ কাজ করতে বলছেন, সেই রোজগার যদি আমি অন্য উপায়ে করে দিতে পারি, তা হলে তো আপনার কোনো আপত্তি নেই।

খালা বলল, বল কি উপায়ে তুই রোজগার করবি?

তামান্না বলল, আমি সেলাইয়ের কাজ জানি। আপনি একটা সেলাই মেশিন জোগাড় করে দিন। আমি এখানকার সকলের জামা কাপড় তৈরি করে রোজগার করব।

মার খেয়ে অসুখে ভুগে তামান্নার শরীর খুব ভেঙ্গে গেছে। তামান্নার কথা শুনে কেন জানি খালার একটু দয়া হল। বলল, তা যদি পারিস, তা হলে আপত্তি নেই।

কয়েকদিনের মধ্যে খালা একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে বলল, এই মেশিনের জন্য আলাদা মাসিক একশ টাকা ভাড়া দিতে হবে।

তামান্না তাতে রাজি হয়ে ঐখানকার সব মেয়েদেরকে বলে এল, তারা যেন তাদের জামাকাপড় তার কাছে বানায়।

তারপর থেকে সে সেলাইয়ের কাজ করে নিজের খরচ রেখে খালাকে সব টাকা দিয়ে দেয়। আর ঠিকমতো নামায রোযা করে দিন কাটাতে লাগল। হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে ফিরে আসার পরও তাকে ওষুধ খেতে হচ্ছে।

একদিন এক ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনে রিক্সায় উঠতে যাবে, এমন সময় তন্ময় গাড়িতে করে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তামান্নাকে দেখতে পেয়ে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে দ্রুত তার কাছে এসে বলল, তামান্না তুমি? সেদিন কোথায় চলে গিয়েছিলে? সেই থেকে তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি। তোমার শরীর এত শুকিয়ে গেছে কেন? নিশ্চয় কোনো কঠিন অসুখ হয়েছিল?

নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েরা সবাই না হলেও অনেকে বাইরে বেরোবার সময় বোরখা ব্যবহার করে। তামান্নাও একটা কাল বোরখা পরেছিল। কিন্তু তখন মুখে নেকাব ছিল না। তন্ময়কে দেখে ও তার কথা শুনে এক পলক তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি মুখের নেকাব ফেলে দিয়ে রিক্সায় উঠে রিক্সাওয়ালাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলল।

তন্ময় বলল, তামান্না, তুমি আমাকে চিন্তে পারলে না? আমি তোমার সাহেব। তারপর রিক্সাওয়ালাকে বলল, দাঁড়াও।

তামান্না রিক্সাওয়াকে বলল, তুমি থেমো না, জোরে চালাও।

রিক্সাওয়ালা জোরে চালিয়ে চলে যেতে লাগল।

তন্ময় রাস্তা পার হয়ে গাড়ির কাছে এসে গাড়িতে উঠে রিক্সাকে ফলো করে চলল।

নিষিদ্ধ পল্লীর গলির মুখে রিক্সা থামলে তামান্না ভাড়া দিয়ে দ্রুত গলির ভিতর ঢুকে পড়ল।

তন্ময়ও তাড়াতাড়ি গাড়িটা রাস্তার এক সাইডে রেখে দ্রুত তার পিছনে পিছনে যেতে যেতে বলল, তামান্না দাঁড়াও যেও না, আমার কথা শোন।

তামান্না কিন্তু দাঁড়াল না। দোতলায় নিজের রুমে এসে দরজা ভিড়িয়ে খিল দিয়ে দিল।

তন্ময় ততক্ষণে দরজার কাছে এসে গেল। দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল, তামান্না দরজা খোল কথা আছে।

তামান্না দরজা খুলল না।

আশপাশের মেয়েরা যে যার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা তন্ময়ের কান্ড দেখে খিল খিল করে হাসতে লাগল।

তন্ময় তামান্নাকে ধরার জন্য এমন অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, পারিপার্শ্বিকতার বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। বেশ কিছুক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকডাকি করে বিফল হয়ে যখন বাস্তবে ফিরে এল তখন আশপাশের মেয়েদের হাসির শব্দ শুনতে পেল। তাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, প্রত্যেক দরজার সামনে শুধু সায়া ও ব্রেসীয়ার পরা যুবতী মেয়েরা দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এবার তন্ময় বুঝতে পারল, কোথায় এসেছে। আরো বুঝতে পারল, তামান্না এদেরই একজন। তখন তার মাথায় কে যেন লাঠি দিয়ে ভীষণ জোরে আঘাত করল। এখান থেকে চলে যাওয়ার শক্তি তার রইল না। অবশ শরীরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আবার বাস্তব জ্ঞান হারাল।

একটা মেয়ে অঙ্গ ভঙ্গি করে এগিয়ে এসে তন্ময়ের একটা হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে বলল, এই যে সাহেব, ওকে তামান্না তামান্না করছেন কেন? ওর নাম তো তমসা। তমস। অনেক দিন থেকে এই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। সে জন্যে খালার মার খেয়ে খেয়ে হাসপাতালে ছিল। এখনও অসুখ সারেনি। ওর শরীরে মাংস বলতে কিছু নেই, শুধু হাড়। মার খেয়ে খেয়ে অসুখে ভুগে ওর রূপ যৌবন চলে গেছে। ওর থেকে আমার অনেক কিছু আছে, মন ভরিয়ে দেব। চলুন আমার ঘরে। এই বলে তন্ময়ের একটা হাত ধরে টানতে লাগল।

মেয়েটার স্পর্শে ও আহ্বানে তন্ময়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘৃণায় ও লজ্জায় রি রি করে উঠল। হাতটা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে গাড়িতে উঠল। তারপর কিভাবে বাসায় ফিরে এল, তা সে নিজেই বুঝতে পারল না। বাসায় ফিরে বিছানায় পড়ে চোখের পানিতে বালিশ ভিজাতে লাগল। আর ভাবতে লাগল, তামান্না নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়ে, এ যে চিন্তা করতেই পারছে না। কিন্তু একটা শিক্ষিত মেয়ে, যার আচার ব্যবহার, কথা-বার্তায় ভদ্রবংশের পরিচয় পাওয়া যায়, সে কি করে ওখানে গেল? তাকে সেখানে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না।

কয়েকদিন ধরে তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারল না। কেবলই তার সেখানকার ঐ মেয়েটার কথা মনে পড়তে লাগল, “অনেক দিন থেকে তামান্না ঐ কাজ ছেড়ে দিয়েছে। সেজন্যে খালার হাতে মার খেয়ে খেয়ে অসুখে ভুগে ভুগে হাড্ডিসার হয়ে গেছে।” তা হলে বোঝা যাচ্ছে এখান থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে ঐ কাজ ছেড়ে দিয়েছে। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, তামান্নাকে বাঁচান দরকার। তাকে ওখান থেকে উদ্ধার করা উচিত। কিন্তু কিভাবে? আচ্ছা, একবার তার সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়? ভেবে ঠিক করল, একদিন গিয়ে তার আসল পরিচয় জানার চেষ্টা করবে। তারপর ভেবে চিন্তে যা করার করা যাবে।

তামান্নার কাছে যাই যাই করেও তন্ময় যেতে পারল না। সেখানকার পরিবেশের কথা মনে পড়লে সারা শরীর ঘিন ঘিন করে উঠে। তখন তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। আবার যখন মনে পড়ে, তার জন্যেই হয়তো সে ভালভাবে জীবন যাপন করার জন্য এতদিন ধরে খালার অত্যাচার সহ্য করছে তখন তার কাছে যাওয়ার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠে। শেষমেষ একদিন বিকেলে তামান্নার কাছে রওয়ানা দিল।

ঐদিন রাস্তায় তন্ময়কে দেখে তামান্নার মনের মধ্যে ঝড় বইতে শরু করে। তার মান সম্মানের দিকে খেয়াল করে তাকে না চেনার ভান করে চলে আসে। তারপর তন্ময় যখন তার ঘর পর্যন্ত এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকে তখন তার কলজে ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও ঐ একই কারণে দরজা খুলে নি বা একটা কথাও বলেনি। তাকে সেও গভীরভাবে ভালবেসে ফেললেও এবং তাকে ভালভাবে দেখতে চাইলেও মনকে কঠোরভাবে সংযত করে ঐ একই কারণে ফিরিয়ে দিয়েছে। তন্ময় চলে গেছে বুঝতে পেরে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।

সেদিন তামান্নার এক পরিচিত সাহেব এসেছিল তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, একথা খালা জানতে পেরে খুব মারধর করে বলেছিল, মাগী, তুই কি ভেবেছিস বলতো? তোর জানাশোনা সাহেবকে ফিরিয়ে দিলি? তার কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা বাগাতে পারলি না? শেষে বলেছে, আবার সেই সাহেব এলে যদি ফিরিয়ে দিস, তা হলে তোর একদিন কি আমার একদিন।

আজ যখন তন্ময় এল তখন তামান্না ঘরের দরজা এমনি ভিড়িয়ে রেখে একটা জামা সেলাই করছিল। তন্ময় রুমে ঢুকে আস্তে করে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে তামান্না বলে ডাকল।

তামান্না একমনে সেলাই করছিল বলে তন্ময়ের উপস্থিতি টের পায়নি। কেউ তার নাম ধরে ডাকতে তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না। তারপর সামলে নিয়ে বেশ রাগের সঙ্গে বলল, কেন এসেছেন? একটা বেশ্যার ঘরে ঢুকতে আপনার লজ্জা করল না? যান, চলে যান।

তামান্নার চেহারা দেখে ও তার কথা শুনে তন্ময়ের চোখে পানি এসে গেল। কিছু বলতে গিয়েও পারল না।

তাই দেখে তামান্না আরো রাগের সঙ্গে বলল, ছি ছি সাহেব, পুরুষের চোখে পানি শোভা পায় না। ওটা দুঃখী মেয়েদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। আপনি দেখছি মেয়েদের চেয়েও অধম। ভাবতেও অবাক লাগছে, আপনার মতো লোক একটা বেশ্যার ঘরে এসে চোখের পানি ফেলছেন। ধিক, শত ধিক আপনাকে।

তন্ময় চোখ মুছে সংযত হয়ে করুণ সুরে বলল, প্লীজ তামান্না চুপ কর।

তামান্না বলল, কাকে তামান্না বলে ডাকছেন? আমার নাম তমসা। তমসাই তামান্না সেজে কয়েকদিনের জন্য আপনাদের বাসায় গিয়েছিল অভিনয় করে টাকা রোজগার করতে। মাথা কুড়লেও সেই তামান্নাকে এখানে পাবেন না। সে অনেকদিন আগে মারা গেছে। চলে যান সাহেব চলে যান, আর কখনো আসবেন না।

তন্ময় ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। বলল, তামান্না মারা গেলেও আমার কাছে বেঁচে আছে। এখানে সে তমসা হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে সে চিরকাল তামান্নাই থাকবে। তারপর আবার বলল, মান ইজ্জৎ খুইয়ে কেন এসেছি, তা কি তুমি জান না তামান্না? তবু তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছ? একটু বসতেও বলবে না?

আবার তামান্না তামান্না বলছেন। বললাম না, সে মরে গেছে। আমি তমসা। আমার কাছে কেন এসেছেন? কে আপনাকে মান ইজ্জৎ খুইয়ে আসতে বলেছে? বারবার চলে যেতে বলছি তবু যাচ্ছেন না কেন? আপনার কি এতটুকু পিত্তি নেই?

এভাবে আমাকে তাড়িয়ে দিও না তামান্না।

তামান্না মুখে বিদ্রূপের হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার পরিচয় পাওয়ার পরও কি আমাকে ভালবাসেন? না করুণা দেখাতে এসেছেন?

হ্যাঁ তামান্না, এখনও তোমাকে আগের মতই ভালবাসি। করুণা করার জন্য এলে, সেইভাবে আসতাম ও চলে যেতাম। এতক্ষণ তোমার কথার বান সহ্য করতাম না।

বেশ তাই যদি হয়, তা হলে যারা এসে ভালবাসার কথা বলে ফূর্তি করে চয়ে যায়, তাদের মতো আপনিও টাকা ফেলে ফূর্তি করে চলে যান। যদিও আমি ঐ কাজ ছেড়ে দিয়েছি, তবু আপনাকে আমিও ভালবাসি বলে ফেরাব না।

তন্ময় আহতস্বরে বলল, একথা তুমি বলতে পারলে? ফূর্তি করার ইচ্ছা থাকলে আমার বাড়িতে আপনাকে নিয়ে ফূর্তি করতে পারতাম না? আমি আমার তামান্নার কাছে এসেছি, কারো সঙ্গে ফূর্তি বা ইতরামী করতে আসিনি।

তামান্না বুঝতে পারল, সাহেব তাকে এখনও আগরে মতো ভালবাসে। কোনো ভদ্র ঘরের ধনীর সন্তান গভীরভাবে ভাল না বাসলে একজন বেশ্যাকে ভালবাসার কথা জানাতে আসতে পারত না। তা ছাড়া সেও সাহেবকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবেসে ফেলেছে। তাই খালার শত অত্যাচার সহ্য করেও পাপ কাজ করতে রাজি হয়নি। কিন্তু একজন বেশ্যার ভালবাসাকে যেমন কেউ বিশ্বাস করবে না তেমনি সমাজও তাকে গ্রহণ করবে না। তাই এতক্ষণ তন্ময়কে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মনকে কঠোর ভাবে সংযত রেখে যা তা বলে তাড়াবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার কথা শুনে সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। ফুঁপিয়ে উঠে মুখে হাত চাপা দিয়ে শেষ চেষ্টা করল। বলল, আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না, আপনি এখান থেকে চলে যান সাহেব চলে যান। তারপর সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, চোকিতে বসে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।

তন্ময় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এগিয়ে এসে তার দুটো হাত ধরে মুখের উপর থেকে সরিয়ে বলল, তুমি একটু আগে বললে না, কান্না দুঃখী মেয়েদের বেঁচে থাকার সম্বল? কথাটা ঠিক। মেয়েরা কেঁদে কেঁদে মনের দুঃখ হালকা করে; কিন্তু পুরুষরা কি করবে বলে দিতে পার? শোন তামান্না, তুমি যেই হওনা কেন, তোমার পরিচয় যাই হোক না কেন? আমি তোমাকে যেমন আগে ভালবাসতাম, এখনও সেই রকম বাসি। আর চিরজীবন বেসে যাব। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।

এই কথা শুনে তামান্না আরো বেশি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। একটু পরে সামলে নিয়ে বলল, চুপ করুন সাহেব চুপ করুন, ভালবাসার কথা আর বলবেন না। এ জীবনে অনেকের কাছ থেকে ঐ কথা শুনে শুনে অনেক শিক্ষা হয়েছে, আর নয়।

এতকিছু বলার পরও তুমি অন্যের সঙ্গে আমাকে তুলনা করতে পারলে? একদিন বলেছিলে, আমাকে খুব বিশ্বাস কর। সেই বিশ্বাস হারাবার মতো কিছু করেছি কি?

আপনার প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছি কিনা বলব না। তবে একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারছি না। আপনি একজন পতিতাকে গ্রহণ করলেও সমাজ করবে না। এমনকি আপনার গর্ভধারিণী মাও করবেন না। তখন কি করবেন? ভালবাসা কথাটা সত্য হলেও সমাজে তার কোনো দাম নেই। অথচ সেই সমাজের ছেলেরা মেয়েদেরকে ভালবাসার কথা বলে কিছুদিন ভোগ করে এই পাপপুরীতে নিক্ষেপ করে যায়। আপনি ভদ্র ও ধনী ঘরের শিক্ষিত ছেলে। আপনার এরকম পাগলামী করা সাজে না। তারচেয়ে এক কাজ করুন, আপনাদের সমাজে হাজারো সুন্দরী- শিক্ষিতা মেয়ে আছে। তাদের একজনকে বিয়ে করে সুখী হওয়ার চেষ্টা করুন। সেটাই আমার কাম্য। আর তাতে আমিও অনেক সুখ পাব, শান্তি পাব।

তন্ময় বলল, তুমি খুব খাঁটি কথা বলেছ। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে সব জিনিসের ব্যতিক্রম আছে। আমি সেই ব্যতিক্রম। কারো কথা শুনব না। কারো বাধা মানব না। এমন কি তোমার জন্য যদি সব কিছু ত্যাগ করতে হয়, তবু আমার সংকল্প থেকে এক চুল পিছনে হঠব না।

তন্ময়ের কথা শুনতে শুনতে তামান্নার সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে, তাই বারবার তাকে চোখ মুছতে হচ্ছে। তবু বলল, তা হয় না সাহেব, তা হয় না। আপনার মাকে বাঁচাবার জন্য আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বেঁচে গেছেন। সেটাই আমার পরম পাওয়া। আমার জন্য তার মনে কষ্ট দেবেন না। একজন ঘৃণ্য পতিতার জন্য আপনি সবার কাছে ছোট হয়ে যাবেন, তা আমি সহ্য করতে পারব না, প্রাণের বিনিময়েও তা আমি পারব না। আপনার পায়ে ধরে বলছি সাহেব, আপনি ফিরে যান। আমার কথা আর কখনো মনে স্থান দেবেন না।

তন্ময় বলল, তোমাকে নিয়ে আমি এমন দেশে চলে যাব, যেখানে আমাদেরকে কেউ চিনবে না, জানবে না। তুমি শান্ত হও তামান্না, তুমি শান্ত হও।

কি করে শান্ত হব? যেখানে যাই না কেন, আমি আমার বিবেকের কাছে চিরকাল ছোট হয়ে থাকব। চিরকাল আমার অন্তরে অন্যায় বোধটা কাঁটা হয়ে গেঁথে থাকবে। না না, এ হয় না সাহেব, এ হয় না।

কেন হবে না? আমার ভালবাসা দিয়ে তোমার অন্তরের সেই কাঁটা তুলে দেব। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর তামান্না। আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দিও না।

আপনি এখন চলে যান, আমাকে ভাবতে সময় দিন।

যাব, তার আগে তোমাকে কথা দিতে হবে, আমার ভালবাসাকে তুমি বিশ্বাস কর। আমাকে ফাঁকি দিয়ে আত্মঘাতী হবে না।

আত্মঘাতী হলে অনেক আগেই হতাম। আর বিশ্বাসের কথা বলেছেন? বিশ্বাস আছে বলে আজও আত্মঘাতী হইনি।

ঠিক আছে, আজ যাচ্ছি, কাল আবার আসব। তারপর চলে যাওয়ার জন্য দরজা খুলে তন্ময় বেশ ভ্যাবাচাখা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রায় পনের বিশজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামলে নিয়ে বলল, আপনারা একটু সরে দাঁড়ান, আমাকে যেতে দিন।

তাদের মধ্যে ফরিদা নামের একটা সুন্দরী মেয়ে বলল, তার আগে তমসাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যান। নচেৎ খালা আজ ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। আমরা আপনাদের সব কথা শুনে বুঝতে পেরেছি, আপনার জন্য আজ ছ’মাস তমসা এই কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আর সেই কারণে প্রতিদিন সকাল বিকেল খালার চাবুক খেয়ে বেঁচে আছে। সেদিন আপনি এসেছিলেন; কিন্তু টাকা দিয়ে যাননি জেনে খালার অত্যাচার আরো বেড়ে গেছে।

ফরিদার কথা শুনে তামান্না বেরিয়ে এসে তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, তোরা সব সরে যা। তারপর তন্ময়কে বলল, আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, তাড়াতাড়ি চলে যান।

ফরিদা তন্ময়ের পথ আগলে বলল, আমি সাহেবকে যেতে দেব না। তোরা দু’জন দু’জনকে ভালবাসিস। তুই সাহেবের জন্য এতদিন খালার অত্যাচার সহ্য করেছিস, আর সাহেব টাকার বদলে তোকে সেই অত্যাচর থেকে রক্ষা করবে না কেন?

তামান্না বলল, ফরিদা তুই চুপ কর। খালার হাতে মার খেয়ে খেয়ে মরে গেলেও আমি শান্তিতে মরব। তবু সাহেবের কাছ থেকে টাকা নিতে পারব না।

তন্ময় প্যান্টের ব্যাক পকেট থেকে পার্স বের করে ফরিদার হাতে দিয়ে বলল, আপনি এটা ওকে দেবেন। তারপর মেয়েদেরকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে এসে গাড়িতে উঠল।

.

ফরিদার সঙ্গে তমসার খুব ভাব। সে ময়মনসিংহের মেয়ে। দরিদ্র মুনসুরের প্রথম সন্তান। ওরা পাঁচবোন দু’ভাই। ভাইয়েরা ছোট। গরীবের ঘরে মেয়ে হয়ে জন্মান যে কত বড় অভিশাপ, তা যারা ভুক্তভোগী তারাই জানে। দরিদ্র মুনসুর গতরে খেটে মেয়েদের মানুষ করলেও টাকার জন্য তাদের বিয়ে দিতে পারেনি। দেখতে দেখতে যখন তিন মেয়ের বিয়ের বয়স বেড়ে চলল তখন তাদের বাবা- মার দুশ্চিন্তার শেষ রইল না। ফরিদা সব ভাই বোনদের চেয়ে বেশি সুন্দরী। স্বাস্থ্যও ভালো। যৌবনে পা দেওয়ার সাথে সাথে তার সৌন্দর্য্য আরো ফুটে উঠল। মুনসুর মেয়ের দিকে তাকাতে পারে না। মেয়েদের বিয়ের চিন্তায় তার মনে শান্তি নেই। দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে গ্রামের বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোক ফরিদাকে নিকে করার জন্য প্রস্তাব দেয়। মুনসুর রাজি হতে পারেনি। যখন মুনসুর বেশ কিছুদিন অসুখে ভুগে মারা গেল তখন তাদের ঘরে কয়েকদিন খাবার জুটেনি। পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ফরিদা মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পাড়ার জামসেদ চাচার বাড়িতে কাজ নিল। জামসেদের অবস্থা ভালো। লোক হিসেবেও তেমন খারাপ না। তার তিন ছেলে তিন মেয়ে। মেয়েদের সব বিয়ে হয়ে গেছে। দু’ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। তাদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। তারা বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে সেখানে থাকে। ছোট কিরণ ঢাকায় ভাইয়েদের কাছে থেকে লেখাপড়া করে। জামসেদ শুধু স্ত্রীকে নিয়ে দেশে থাকে। তার ইচ্ছা কিরণ বি. এ. পাস করলে তার বিয়ে দিয়ে দেশে রাখবে। কারণ তার অনেক জমি জায়গা আছে। সে সব চাষবাস করার জন্য এবং সংসারের কাজ কর্মের জন্য ছেলে বৌ দরকার। ইদানিং জামসেদের স্ত্রী কিছুদিন থেকে অসুস্থ। সংসারের কাজের জন্য একটা মেয়ের খোঁজ করছিল। তাই বাপ মরা ফরিদা এসে যখন অভাবের কথা বলে কাজ করতে চাইল তখন রেখে দিল। ফরিদা সকালে এসে সারাদিন সংসারের সব কাজ কর্ম করে সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরে।

কিছুদিন পর জামসেদের ছোট ছেলে কিরণ বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে দেশের বাড়িতে এসে ফরিদাকে দেখে লোভ সামলাতে পারল না। শহরে কলেজে পড়া ছেলে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ডেপো হয়েছে। তবে ভাইয়েদের বা ভাবিদের তা টের পেতে দেয়নি। সামাদ নামে তার এক বন্ধু ছিল। যত রকমের খারাপ কাজের সে ছিল ওস্তাদ। তার পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে নিষিদ্ধ পল্লীতেও গেছে। বাড়িতে এসে ফরিদাকে দেখে তাকে ভোগ করার জন্য পাগল হয়ে উঠল। ফাঁক পেলেই তাকে বিয়ে করার কথা বলে এবং টাকা পয়সার প্রলোভন দেখিয়ে ঘাটে আনার চেষ্টা করতে লাগল।

ফরিদা গ্রামের সহজ সরল মেয়ে। কিরণের প্রস্তাবে ভয় পেয়ে প্রথম দিকে তাকে পাত্তা দেয়নি। টাকা পয়সাও নেয়নি। কিন্তু তারও তো যৌবনের একটা জ্বালা আছে। দিনের পর দিন কিরণের প্রলোভনে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে সময় বর্ষাকাল। সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর জামসেদ ও তার স্ত্রী বিশ্রাম নিচ্ছে। ফরিদা ঝুঁটো থালাবাসন, হাঁড়ি পাতিল ধুয়ে রান্না ঘরে রাখতে গেল।

কিরণ সকাল থেকে ভেবে রেখেছে, আজ যেমন করে হোক ফরিদাকে কাবু করতেই হবে। সে জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। খেয়ে উঠে এতক্ষণ ফরিদার দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। ফরিদা যখন থালাবাসন রান্না ঘরে রাখতে গেল তখন সে তার পিছন পিছন রান্নাঘরে এসে দরজা লাগিয়ে ছিটকিনি দিয়ে দিল। তারপর ফরিদার শত আপত্তি সত্ত্বেও জোরপূর্বক যা করার করল। সবশেষে যখন ফরিদা কাঁদতে লাগল তখন কিরণ তাকে আশ্বাস দেওয়ার জন্য বলল, কাঁদছ কেন? আমি তো তোমাকে বিয়ে করব। এরপর থেকে তাদের প্রায় দৈহিক মিলন হতে লাগল। ফলে দু’তিন মাসের মধ্যে ফরিদা প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ল।

প্রায় চার মাস পরে কিরণের পাসের খবর বেরোনোর পর জামসেদ ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্রী খোঁজ করতে লাগল।

ফরিদা সে কথা শুনে একদিন কিরণকে বলল, তোমার বাবা তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে দেখছে, তুমি তাকে কিছু বলছ না কেন?

কিরণ বলল সময় এলে বলব। মেয়ে দেখলেই কি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাকি? তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না।

ফরিদা বলল, আমার যে খুব ভয় করছে।

কিরণ বলল, কেন ভয় করছে কেন?

ফরিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার পেটে বাচ্চা এসেছে।

কিরণ শুনে ভয়ে চমকে উঠে বলল, কি বললে?

ফরিদা বলল, হ্যাঁ কিরণ ভাই, তিন মাস চলছে। কিন্তু তুমি চমকে উঠলে কেন?

কিরণ তখন চিন্তা করছে, সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন জানাজানি হয়ে গেলে কেলেংকারীর শেষ থাকবে না। কি করবে ভাবতে লাগল।

ফরিদা বলল, কিছু বলছ না কেন কিরণ ভাই? বললাম না, আমার খুব ভয় লাগছে।

কিরণ ততক্ষণে বুদ্ধি এঁটে ফেলেছে। বলল, ভয় তো একটু করবেই। আমারও তো করছে। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, যা হবার হয়েছে, এখন আর ভেবে কিছু লাভ নেই। কানের কাছে মুখ এনে বলল, জানাজানি হবার আগে শহরে গিয়ে খুব গোপনে কাজি অফিসে আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে। বাবা মাকে জানালে তারা যে রাজি হবে না, সে কথা তুমিও জান। বিয়ে করে ফিরে এসে জানালে তখন আর কিছু করতে পারবে না। তোমাকে যা বলব সেই মতো করবে কেমন?

ফরিদা শুনে আল্লাদে আটখানা হয়ে কিরণকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, তুমি ঠিক বলেছ। যা বলবে তাই করব।

কয়েকদিন পর কিরণ শহরে গিয়ে বন্ধু সামাদের সঙ্গে পরামর্শ করে এল। তারপর ফরিদাকে বিয়ের কথা বলে একদিন রাতে শহরে এনে সামাদের পরামর্শ মতো এই নিষিদ্ধ পল্লীর সর্দারণি খালার কাছে বিক্রি করে দিয়ে চলে আসে।

ফরিদা যখন কিরণের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারল তখন তার আর কিছু করার উপায় ছিল না। খালা এ্যাবরসন করিয়ে ফরিদার পেটের বাচ্চা নষ্ট করে দেহ ব্যবসায় লাগিয়েছে।

তামান্না আসার আগে ফরিদা এসেছে। প্রথম প্রথম যখন তামান্না দেহ ব্যবসাতে রাজি না হয়ে খালার হাতে মার খেত তখন ফরিদা নিজের অভিজ্ঞতায় খালাকে বাধা দিয়ে বলেছে, কয়েকদিন যাক সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর তামান্নাকে নিজের দূর্ভাগ্যের কাহিনী শুনিয়ে এই কাজে রাজি করিয়েছে। সেই থেকে দু’জনের মধ্যে খুব ভাব। অসুখে বিসুখে একে অন্যের সেবাযত্ন করে। ওষুধপত্র এনে দেয়। তন্ময়ের বাসায় এক মাস থাকার পর ফিরে এসে তামান্না যখন খদ্দের ঘরে ঢুকতে দিল না এবং সেজন্যে খালা অত্যাচার শুরু করল তখন ফরিদা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তামান্না তাদের দু’জনের ভালবাসার কথা বলেছিল। আরো বলেছিল, সে এই কাজ করবে না বলে আল্লাহপাকের কাছে তওবা করেছে। শুনে ফরিদা বলেছিল, বেশ্যাদের আবার আল্লাহ আছে নাকি? যদি থাকত, তা হলে আমরা বেশ্যা হলাম কেন? পাপ কি শুধু মেয়েরা একলা করি? ছেলেরা করেনি? পাপ করে যদি আমরা বেশ্যা হলাম, তা হলে ছেলেরা কি হল? তারাই তো আমাদেরকে এই পাপের পূরীতে নিয়ে এল। তাদের কিছু হয়নি কেন? এই বেশ্যাদের কাছে তো মেয়েরা আসে না, আসে পুরুষরা। তাতে তাদের পাপ হয়নি বুঝি? আল্লাহ শুধু মেয়েদের জন্যে পাপ-পূণ্যের আইন করেছে। তাই তাদের একটু কিছু ভুল ত্রুটি হলেই তারা পাপাচারিণী হয়ে যায়। আর পুরুষরা হাজারটা ভুল ত্রুটি করলেও তারা পাপাচার হয় না। তুই তো তওবা করে নামায পড়িস, রোযা করিস, কই, আল্লাহ তো তোকে এই পাপপূরী থেকে অথবা তোর উপর যে এত অত্যাচার চলছে, তা থেকে উদ্ধার করছে না কেন? তুই যাই বলিস না কেন, আমি জানি আল্লাহ যদি থেকে থাকে, তা শুধু পুরুষদের জন্য, মেয়েদের জন্য নয়।

তামান্না বলল, আগে তোর মতো আমিও তাই ভাবতাম। সাহেবের মায়ের কাছে যে ক’দিন ছিলাম, সেই সময় তার কাছে ধর্মের কিছু কথা শুনে আমার সেই ধারণা পাল্টে গেছে। তার কাছে শুনেছি, সমস্ত মখলুকাতের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ। তাঁর ঈশারাতে সব কিছু চলছে। তিনি সমস্ত মখলুককে একটা সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে পরিচালিত করছেন। সব মখলুক সেই নিয়ম মেনে চলছে। শুধু মানুষ ও জ্বীন ছাড়া। কারণ তিনি তাদেরকে ভালো ও মন্দ করার ক্ষমতা দান করে বিবেক বলে একটা জিনিস দান করে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, “তোমরা নিজেরা সৎপথে চল এবং অন্যকেও সেই পথে আহ্বান কর আর অসৎ পথে চল না। যদি তোমরা আমার নির্দেশ মেনে চল, তা হলে ইহকালে যেমন সুখ শান্তি পাবে, তেমনি পরকালে ইহকালের চেয়ে কোটি কোটি গুন বেশি অনন্তকাল সুখ শান্তিতে বাস করবে। আর যদি আমার নির্দেশ না মেনে নিজেদের ইচ্ছামত চল, তবে ইহকালে যেমন চরম অশান্তি ভোগ করবে, তেমনি পরকালে ইহকালের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি অশান্তি অনন্তকাল ভোগ করবে।” বিবেক মানুষ ও জ্বীনকে দিয়েছে বলে শুধু তাদেরই বিচার হবে। তিনি ন্যায় বিচারক। কারো প্রতি অবিচার করেন না। যদিও মানুষ তার সসীম জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহর বিচারকে মেনে নিতে পারে না। সব কিছু সুষ্ঠভাবে চলার জন্য যেমন আইন করে দিয়েছেন, তেমনি ভালো মন্দ কর্মফলের নির্দিষ্ট সময় ও বেঁধে দিয়েছেন। সেই সময়ের এক সেকেন্ড আগে পরে কিছুই হবে না। ন্যায় অন্যায় পুরুষ অথবা নারী যে কেউ করুক না কেন, তার ফলাফল প্রত্যেককে ভোগ করতেই হবে। নারী পুরুষের জন্য আলাদা কোন আইন নেই। সকলের জন্য একই আইন। আমার মনে হয়, পুরুষরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য মেয়েদেরকে আল্লাহ কতটা অধিকার দিয়েছেন তা শিক্ষা না দিয়ে শুধু পাপ- পূণ্যের আইন শিক্ষা দিয়ে তাদেরকে বাঁদি দাসি করে রাখতে চায়। তাই তারা আমাদেরকে ঐ সব শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। আর এক শ্রেণীর মেয়ে ও পুরুষ অর্থ কামাবার জন্য সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মেয়েদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাচ্ছে। এর চেয়ে বেশি আমি তোকে বোঝাতে পারব না।

আজ তন্ময় চলে যাওয়ার পর ফরিদা অন্যান্য মেয়েদেরকে চলে যেতে বলে তামান্নাকে নিয়ে তার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর তার হাতে পার্সটা দিয়ে বলল, গুণে দেখ কত টাকা আছে।

তামান্না সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আমার টাকা গোনার দরকার নেই। তুই গুণে দেখতে পারিস। আর টাকাগুলো তোর কাছে রেখে দে, তুই খালাকে দিবি।

ফরিদা গুণে দেখল দু’হাজার দুশো টাকা। তারপর টাকাগুলো পার্সে রেখে আবার তার হাতে দেয়ার সময় বলল, তোর কাছেই রাখ। আমার কাছে থাকলে খালা রেগে যাবে। আর শোন, সব টাকা খালাকে এক সঙ্গে দিবি না। পাঁচশ টাকা দিবি। বলবি এটা তার কাছে ছিল দিয়ে গেছে। সাহেব পরে যখন আসবে তখন বাকি টাকা থেকে দফায় দফায় দিবি। তুই তো বার বার তার কাছ থেকে টাকা নিবি না। এবার আমি যাই, খালা হয়তো সাহেবের আসার খবর এতক্ষণ শুনে ফেলেছে, এসে পড়তে পারে।

ফরিদার কথাই ঠিক। সে চলে যাওয়ার একটু পরে খালা এসে বলল, শুনলাম তোর প্রিয় নাগর সাহেব এসেছিল। তার কাছ থেকে কত আদায় করেছিস দে।

তামান্না ফরিদার কথা মতো পাঁচশ টাকা নিজের কাছে রেখে পার্সটা লুকিয়ে রেখেছিল। সেই টাকাটা দিয়ে বলল, তার কাছে এগুলো ছিল দিয়ে গেছে।

খালার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে মিলিয়ে গেল। ভারি গলায় বলল, সাহেবকে এত তাড়াতাড়ি বিদায় করলি কেন? এবার এলে খাতির করবি। নাস্তাপানি খাওয়াবি। আর ভালবাসা দেখিয়ে যত বেশি পারিস আদায় করবি। এই সব বলে চলে গেল।

.

তন্ময় ফেরার পথে চিন্তা করতে লাগল, কি করে তামান্নাকে ওখান থেকে বের করে আনবে। আরো চিন্তা করল, টাকার বিনিময়ে হয়তো বের করে আনতে পারবে। কিন্তু তাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এলে মা কি গ্রহণ করবে? আর সমাজেই বা কি করে মুখ দেখাবে? একজন পতিতা কি সমাজে উঠতে পারে? সেদিন বাসায় ফিরে সারা রাত ভেবে কিছু ঠিক করতে পারল না।

সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় ফিরোজা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কি হয়েছে বলতো? মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাসনি। কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছি, তুই আমাকে এড়িয়ে চলছিস। ব্যবসায় কোনো কিছু হয়েছে?

তন্ময় বলল, না মা ওসব কিছু নয়। আর তোমাকেই বা এড়িয়ে চলব কেন? তবে একটা ব্যাপারে খুব চিন্তায় আছি।

সেটা কি বলবি তো।

বললে তুমি মনে খুব ব্যথা পাবে।

মেয়েদের আল্লাহ সব রকমের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছেন।

তবু বলা ঠিক হবে না। আরো কয়েকদিন ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে দেখি, তারপর তোমাকে বলব।

তোর আর চিন্তা করার দরকার নেই। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তুই অনেক দিন থেকে চিন্তা করছিস। আজ তোকে বলতেই হবে।

তন্ময় মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, একদিন না একদিন যখন মাকে বলতেই হবে তখন এখনই বলাই উচিত। মাথা তুলে বলল, তামান্নার খোঁজ পেয়েছি। কিন্তু বলে থেমে গেল, কথাটা শেষ করতে পারল না।

কিরে থেমে গেলি কেন? তামান্নার খোঁজ পেয়েছিস ভালো কথা। সে এতদিন কোথায় ছিল না ছিল জিজ্ঞেস করিসনি?

করেছি। আমরা তার যে পরিচয় জানি, সেটা আসল নয়।

ফিরোজা বেগম ছেলের কথা শুনে মনে মনে চমক খেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তার আসল পরিচয় কি বল না?

তন্ময় ঢোক গিয়ে বলল, সে একজন পতিতা।

কি বললি বলে ফিরোজা বেগম দাঁড়িয়ে টলে পড়ে যাচ্ছিলেন।

তন্ময় তাড়াতাড়ি মাকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, মা তুমি শান্ত হও। মনে আঘাত পাবে বলে কথাটা বলতে চাইনি।

ফিরোজা বেগম ততক্ষণে একটু সামলে নিয়েছেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, সেই পতিতা মেয়েটাকে নিয়ে তুই তা হলে এতদিন চিন্তা করছিস? শোন, এখন থেকে তার কথা আর একদম মনে স্থান দিবি না। ভাবতেও ঘেন্না পাচ্ছে একটা পতিতা মেয়ে আমাকে সেবা করে সুস্থ করেছে। এর থেকে মরণ ভালো ছিল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, যতশিঘ্রী সম্ভব ভালো মেয়ে দেখে আমি তোর বিয়ে দেব। তোর আর কোনো আপত্তি শুনব না। কত কোটিপতি তোকে মেয়ে দেবে বলে হ্যাঁ করে রয়েছে।

তন্ময় মাকে খুশী করার জন্য বলল, সে যা হয় পরে করো, এখন তুমি কোনো রকম দুশ্চিন্তা করো না। তারপর সে অফিসে চলে গেল। অফিসে এসে মন স্থির করে কোনো কাজ করতে পারল না, শুধু তামান্নার কথা মনে পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে মায়ের কথাও মনে পড়তে লাগল। এক সময় বন্ধু মুশতাকিমের কথা মনে পড়তে তাকে ফোন করল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর বলল, তোর সঙ্গে খুব জরুরী কথা আছে, যা ফোনে বলা সম্ভব নয়। কখন আসব বল।

মুশতাকিম বলল, পাঁচটার দিকে আয়, একসঙ্গে আমার বাসায় যাব।

তন্ময় বলল, ঠিক আছে তাই আসছি। তারপর ফোন ছেড়ে দিল।

মুশতাকিম গোপিবাগে একটা ফ্লাটে ভাড়া থাকে। তন্ময়কে সঙ্গে করে বাসায় এসে কলিং বেল বাজাল। একটা দশ বার বছরের কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিতে ভিতরে ঢুকল।

মুশতাকিমের ফ্লাটটায় এটাচ বাথসহ দুটো বেডরুম, একটা কিচেন। দুটো বেডরুমের একটাকে ড্রইংরুম হিসেবে ব্যবহার করে। তন্ময়কে ড্রইংরুমে বসিয়ে মুশতাকিম পর্দা ঠেলে পাশের রুমে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এসে বসে বলল, এবার বল তোর কি জরুরী কথা।

ভাবি কি বাসায় নেই?

আছে। একটু পরে আসবে। তুই ততক্ষণ শুরু কর। সন্ধ্যের পর আমরা একটু বেরোব।

কোন প্রোগ্রাম আছে নাকি?

হ্যাঁ, শ্বশুরবাড়ি যাব। তুই শুরু করতো।

তা হলে আজ থাক, অন্য দিন বলব। একটা ব্যাপারে তোর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করব। তোদের দেরি হয়ে যাবে।

হোক দেরি তুই বল। বললাম না, সন্ধ্যের পর যাব। এখনও এক দেড় ঘণ্টা সময় হাতে আছে!

এমন সময় একটা ট্রেতে করে চা নাস্তা নিয়ে এসে মুশতাকিমের স্ত্রী পূরবী সালাম দিয়ে বলল, আরে তন্ময় ভাই যে, কেমন আছেন?

তন্ময় সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এই কাটছে আর কি। আপনার স্মৃতিশক্তি তো দারুণ, সেই কবে মাত্র একবার আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমাকে এবং আমার নাম ও ঠিক মনে রেখেছেন।

পূরবী বলল, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের স্মৃতিশক্তি একটু বেশি। তারপর চা নাস্তা পরিবেশন করে বলল, নিন, শুরু করুন।

দু’জনের জন্য সব কিছু দেখে তন্ময় পূরবীর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কই?

পূরবীর আগে মুশতাকিম বলল, তোর ভাবির খাবার ব্যাপারে কিছু বিধি নিষেধ আছে।

পূরবী একবার স্বামীর দিকে কটাক্ষ হেনে মুখে হাসি ফুটিয়ে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার বন্ধু ঠিক কথা বলেছে। আপনি শুরু করুন, আমি আসছি। কথা শেষ করে চলে গেল।

তন্ময় মুশতাকিমকে বলল, ভাবির খাওয়ার ব্যাপারে বিধি নিষেধের কথা যে বললি, সেটা কি বল দেখি।

মুশতাকিম বলল, পর পুরুষের সঙ্গে মেয়েদের খাওয়া ইসলামে নিষেধ।

তন্ময় খুব অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, হোয়াট?

আরে বস বস, অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।

তন্ময় বসে বলল, ইসলামে নিষেধ আছে কি না জানি না। কিন্তু তোর মতো একজন উচ্চশিক্ষিত ছেলের কাছ থেকে এটা আশা করিনি।

মানুষ তার জ্ঞানের দ্বারা বিচার করে যা কিছু আশা করে তা ঠিক নয়।

তা হলে কি দিয়ে বিচার করবে?

জ্ঞান দিয়ে তো অবশ্যই করবে। তবে সেই জ্ঞান সৃষ্টিকর্তার কুরআন ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের হাসিদের জ্ঞান হতে হবে। সেই জ্ঞান অর্জন করে সবকিছু বিবেচনা করে দেখবে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ। দুনিয়ার মানুষ তা না করে নিজের জ্ঞানের দ্বারা ভালো মন্দ বিচার করছে বলে মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে।

তোর কথা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। কুরআন হাদিসের জ্ঞান ছাড়া দুনিয়ার আর সমস্ত জ্ঞান কি তা হলে পরিত্যাজ্য, না অমূলক? না তার প্রয়োজন নেই?

তুই আমার কথা বুঝতে পারিসনি বলে তার উল্টো ব্যাখ্যা করছিস। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান মানুষের উপকারের জন্য। তাই বলে সব মানুষ সব জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। তাই বলেছিলাম, মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করবে, সেটা কুরআন হাদিসের জ্ঞানের কষ্টি পাথরে যাচাই করে দেখতে বলেছি। আর এটা করা প্রত্যেক মানুষের, বিশেষ করে প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। আমরা কুরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করিনি বলে যারা সেগুলো অর্জন করে মেনে চলে তাদেরকে গোঁড়া বা মৌলবাদি বলি। অবশ্য তাদেরও জ্ঞানের অনেক অপরিপক্কতা আছে। যার দরুন নিজেদের গোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের দেখতে পারে না। এসব কথা এখন থাক। পরে সময় করে মাঝে মাঝে আসিস, তখন আলোচনা করা যাবে। এখন যা বলতে এসেছিস বল।

তন্ময় ঘড়ি দেখে বলল, এত কম সময়ের মধ্যে বলা যাবে না। তা ছাড়া আমকেও এক জায়গায় যেতে হবে। আজ উঠি, কাল বরং আসব।

মুশতাকিম জানে তন্ময় এসেছে বলে পূরবী রেগে আছে। কারণ আজ তার বড় ভাইয়ের পাঁচ বছরের মেয়ে যুথীর বার্থ ডে। সন্ধ্যের আগে মার্কেট থেকে তার জন্য কিছু একটা প্রেজেন্টেসান কিনে তারপর সেখানে যাবে। তাই তনয়ের কথা শুনে বলল, বেশ কালকেই আসিস তা হলে।

তন্ময় বলল, ভাবিকে একটু ডাক বলে যাই।

পূরবী নাস্তা খেয়ে এসে এতক্ষণ দরজার পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথা শুনছিল, এবার ঘরে ঢুকল।

তন্ময় তার দিকে তাকিয়ে বলল, এসে আপনাদের অনেক ডিস্টার্ব করলাম। আজ আসি, কাল কিন্তু আবার আসব। আচ্ছা চলি আস্সালামু আলাইকুম

মুশতাকিম ওয়া আলাইকুম আস্সলাম বলে বলল, কাল তোর জন্য অপেক্ষা করব।

তোকে আর অপেক্ষা করতে হবে না, তার আগেই এসে পড়ব বলে তনুয় সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।

ওখান থেকে সোজা নবাবপুর রোডে এসে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে নিষিদ্ধ পল্লীর গলির ভিতর ঢুকে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেই ফরিদার সঙ্গে দেখা।

ফরিদা তামান্নার রুমের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে একটু চিন্তা করে বলল, ও দরজা বন্ধ করে মাগরিবের নামায পড়ছে। আসুন আমার সঙ্গে বলে তামান্নার দরজার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, একটু অপেক্ষা করুন। তারপর দরজার কড়া নেড়ে বলল, নামায পড়া হয়ে গেলে আমার সঙ্গে দেখা করবি। এই কথা বলে সে চলে গেল।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লজ্জায় তন্ময়ের মাথা কাটা যাচ্ছিল। পাশের কয়েকটা মেয়ে তখন বলাবলি করছে তামান্না আগে খুবসুরৎ ছিল ঠিক, কিন্তু এখন তো শুধু হাড় আর চামড়া। সাহেব যে ওর মধ্যে কি দেখেছে কি জানি। তার চেয়ে আমাদের অনেক কিছু আছে। আমরা সাহেবকে অনেক কিছু দিতে পারব। এরা সবাই জানে, সাহেব তামান্নাকে ভালবাসে। আর তামান্নাও সাহেবের জন্য খালার অত অত্যাচার সহ্য করেছে। তাই ঐ রকম কথা বলাবলি করলেও কেউ কাছে এসে হাত ধরে টানাটানি করল না। নচেৎ এতক্ষণ তন্ময়ের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ত।

আজ বিকেল থেকে তামান্না তন্ময়ের অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও তার এক মন বলে, এই পাপপুরীতে সাহেবের না আসাই উচিত, তবু পথ চেয়ে থাকতে থাকতে মাগরিবের আযান শুনে নামায পড়ছিল। ফরিদা যখন দরজায় শব্দ করে কথা বলল তখন সে নামায শেষ করে দু’চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে মোনাজাত করছিল- “হে গফুরুর রহিম, তোমার দয়ার কোনো শেষ নেই। জেনেছি, বান্দা যত কঠিন গোনাহর কাজ করুক না কেন, সে তওবা করে মাফ চাইলে মাফ করে দাও। কোনো এক জোহরা নাম্নী পতিতা তুষ্ণার্ত ও মুমূর্ষ কুকুরকে নিজের ওড়না কৃয়ার পানিতে ভিজিয়ে পানি পান করিয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সেজন্যে তুমি তাকে ক্ষমা করে হেদায়েত দান করেছিলে। তুমি অসীম দয়ালু। সেই দয়ার অসিলায় আমার তওবা কবুল করে আমাকেও হেদায়েতের পথ দেখিয়েছ। আমি ওয়াদা করছি, দেহে প্রাণ থাকতে এই পাপ কাজ আর করব না। তুমি আমাকে এই পাপপূরী থেকে উদ্ধার কর। তুমি ছাড়া আমার আর কোনো সাহায্যকারী নেই। আমি একমাস নফল রোযা রাখব। সাধ্যমতো গরিব মিসকীনকে সাহায্য করব।” এই পর্যন্ত দোয়া করার পর ফরিদার গলা পেয়ে মোনাজাত শেষ করে নামাযের পাটী তুলে রেখে দরজা খুলল।

তন্ময় রুমে ঢুকে বলল, তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ কর। এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে যা লজ্জা পাচ্ছিল।

দরজা লাগিয়ে তামান্না দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, তবু এখানে আসেন কেন?

তন্ময় বলল, কেন আসি তা তুমিও যেমন জান, তেমনি আমিও জানি। আজ আমাকে তোমার জীবন কাহিনী শোনাতে হবে।

তামান্না আরো কিছুক্ষণ কাঁদল তারপর চোখ মুখ মুছে বলল, কি হবে ঐ সব শুনে। আমাদের কাহিনীকে শুধু কাহিনী বলে মনে হবে, কেউ বিশ্বাস করবে না।

তন্ময় বলল, কেউ না বিশ্বাস করলেও আমি করব।

তামান্না একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সে এমন এক মর্মান্তিক কাহিনী, যা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার আগে আরো অনেকে জানতে চেয়েছে। বলেছিও, কিন্তু সত্য কাহিনী বলিনি। আপনি জানতে চাইবেন না। কারণ তাদের কাছে মিথ্যা বললেও আপনার কাছে মিথ্যা বা সত্য কোনোটাই বলতে পারব না। প্লীজ, সে সব কথা জানতে চাইবেন না।

তন্ময় বলল, জানি সে সব কথা বলতে তোমার খুব কষ্ট হবে, তবু শুনব। যাকে আমি জীবনসাথী করব বলে সংকল্প করেছি, ভবিষ্যতে কেউ তাকে মিথ্যে অপবাদ দিলে তার প্রতিবাদ করার জন্য সবকিছু জানা আমার একান্ত দরকার। প্লীজ, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।

তামান্না ছল ছল নয়নে বলল, সে সব কথা মনে পড়লে নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। তখন আমার খুব কষ্ট হয়।

তন্ময় বলল, সে কথা একটু আগে আমি তো বললাম। আমার জন্যে না হয় আর একবার কষ্ট পেলে।

তামান্না কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখের পানি মুছে পূর্বাপর সব ঘটনা বলে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগল।

তন্ময় বলল, কাঁদছ কেন? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতো, সেখানে কোনো ঘৃণা বা অন্য কিছু আছে কিনা। তামান্নাকে সেইভাবে থাকতে দেখে খুব মোলায়েম সুরে বলল, তামান্না তুমি কি ভাবছ, তোমার জীবন কাহিনী শুনে তোমাকে ঘৃণা করে ত্যাগ করব? যদি তা না ভেবে থাক, তা হলে আমার মুখের দিকে একবার তাকাও।

তামান্না ধীরে ধীরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, তন্ময়ের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ভাবল, সাহেব মানুষ না ফেরেস্তা? আমার সব কথা শোনার পরও এ কি দেখছে? সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না; সাহেব বলে তাকে জড়িয়ে ধরে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

তন্ময় জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ের স্পর্শ পেয়ে একবার কেঁপে উঠল। তারপর তাকে আলিঙ্গনবদ্ধ করে বলল, তোমার অনুশোচনার পানি তোমাকে নিশ্চয় পবিত্র করে দিয়েছে। তারপর তাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে বলল, এবার থেকে আমাকে তুমি করে বলবে, আর সাহেব নয়, তন্ময়।

এই কথা শুনে তামান্না আবার বেসামাল হয়ে পড়ল। বসে পড়ে তন্ময়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, মুর্খতাবশতঃ আবেগের বশবর্তি হয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি। সে জন্যে মাফ চাইছি। আপনাকে আপন করে পাওয়ার আমার এতটুকুও যোগ্যতা নেই। আপনাকে তুমি করে বলার এবং আপনার নাম ধরে ডাকার স্পর্দ্ধাও যেন কোনো সময়েই আমার না হয়। আপনি শুধু আমাকে এই পাপপুরী থেকে অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করুন। এই সেলাইয়ের কাজ করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তা হলে আমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে। আপনার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব। আল্লাহ আপনার ভালো করবেন।

তন্ময় তার হাত ধরে তুলে বলল, কে বলেছে তোমার যোগ্যতা নেই। দুনিয়াশুদ্ধ লোক বললেও আমি স্বীকার করব না। বরং তোমার যা আছে তা অন্য কোনো মেয়ের মধ্যে নেই। তোমাকে আমি এখান থেকে উদ্ধার করে কোথায় রাখব তা এখন বলব না। যখন নিয়ে যাব তখন নিজেই জানতে পারবে। আজ আসি। দু’এক দিনের মধ্যে আসব। পকেট থেকে কয়েকটা একশো টাকার নোট বের করে বলল, এগুলো খালাকে দিও।

তামান্না সেলাই মেশিনের বাক্স থেকে পার্সটা বের করে তাকে দেয়ার সময় বলল, আজ টাকা দেয়া লাগবে না। এটা নাও, এতে তোমার দরকারী কিছু কাগজ আছে।

তন্ময় পার্সটা নিয়ে বলল, টাকা নিচ্ছ না কেন? খালাকে দিতে হবে না?

তামান্না বলল, খালাকে দেয়ার মত টাকা আমার কাছে আছে।

তন্ময় শুনল না, পার্সটা নিয়ে টাকাগুলো জোর করে হাতে গুজে দিয়ে বেরিয়ে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *