ভারতে মুসলমান

ভারতে মুসলমান

বর্তমানের মধ্যে অতীতের প্রভাব

আমরা সচরাচর ভারতবর্ষের যে-সব ইতিহাস পড়ি, তাহার ভিতর এই জাতির প্রাণের সাড়া পাই না। এইসব স্কুলপাঠ্য পুস্তকে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও ইংরাজ অধিকার, এই চারিটি যুগ একেবারে ভিন্ন ভিন্ন কোঠায় আবদ্ধ করিয়া দেখান হয়,–যেন একটিকে সংহার করিয়া তাহার সমস্ত চিহ্ন লোপ করিয়া তবে তৎপরবর্তী যুগ বা জাতি ভারতবর্ষ দখল করিয়াছে, পূর্ব্ব ও পরের মধ্যে কোনই সম্বন্ধ নাই; আগেকার যুগের প্রভাব, আগেকার যুগের দান, যেন পরের যুগে চলিয়া আসে নাই, যেন এই ভারতীয় জাতি প্রত্যেক যুগের শেষে মরিয়া গিয়া আবার নূতন শিশু হইয়া জন্মিয়াছে।

কিন্তু এইরূপ মনে করা ভুল। ইতিহাসের প্রকৃত শিক্ষা ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। যুগে যুগে ভারতের সেই একটি প্রাণ, সেই একই জাতীয় বিশেষত্ব রাজা রাজড়ার, ধর্ম্ম ও ভাষার অসীম পরিবর্তনের মধ্য দিয়া সজীব থাকিয়া অগ্রসর হইয়াছে; বাহ্যবেশ বদলাইয়াছে বটে, কিন্তু মরে নাই, নিজ আত্মাকে হারায় নাই। সহস্র সহস্র বৎসরের শত শত রাজনৈতিক ও ধৰ্ম্মসম্বন্ধীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়া ভারতীয় জনসঙ্ঘের (nationalityর) প্রাণ ও ব্যক্তিত্ব কিরূপে জীবন্ত থাকিয়া বাড়িয়া চলিয়াছে, প্রত্যেক যুগ হইতে, প্রত্যেক রাজার জাতি হইতে ভারতীয় জাতি কিরূপে দেহ ও চিত্তের পুষ্টিলাভ করিয়াছে, ভারতবর্ষ কিরূপে সেই যুগের দানগুলি নিজস্ব করিয়া পূর্ব্ববর্ত্তী যুগের দানগুলির সহিত তাহার সামঞ্জস্য করিয়া লইয়াছে এবং ইহার ফলে যে ভারতীয় জাতি আমরা আজ চোখের সম্মুখে দেখিতেছি, তাহা বর্তমান অবস্থায় কেমনে উপনীত হইয়াছে, এই জনসঙ্ঘের চরিত্রের বিশেষত্ব ও গুণ, সভ্যতা ও চিন্তার সেই ক্রমবিকাশ পদে পদে দেখানই ইতিহাসের প্রকৃত কাজ।

প্রত্যেক মানুষের যেমন বাল্যকাল, যৌবন ও বার্দ্ধক্য ব্যাপিয়া একই দেহ,একই মন, একই আত্মা চলিয়া আসিয়াছে, সে যে যে বয়সে যাহা খাইয়াছে, করিয়াছে, ভাবিয়াছে তাহার সমষ্টি, যে যে দেশে বাস করিয়াছে তাহার জলবায়ুর ফলাফল তাহার দেহে এখন প্ৰকাশ পাইতেছে–তেমনি হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও ব্রিটিশ যুগে ভারতে যাহা ঘটিয়াছিল, যে চিন্তা, যে সভ্যতা প্রবাহিত হইয়াছিল, তাহা একেবারে লোপ পায় নাই, তাহার শ্রেষ্ঠ অংশগুলির সমবেত ফল বর্তমান ভারতের জাতীয় চরিত্রে ও চিন্তায় রহিয়া গিয়াছে। অর্থাৎ কোন একজন মানুষ যেমন জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সেই একই ব্যক্তিবিশেষ থাকে, সেইরূপ ভারতবাসী লোক-সমষ্টিরও একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব আছে; প্রাচীনতম জ্ঞাত আর্য্যযুগ হইতে তাহা ধারাবাহিকরূপে নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে চলিয়া আসিয়াছে; এবং তাহার শেষ ফল এখনকার আমরা।

স্মরণাতীত যুগ হইতে সময়ের স্রোতে ভাসিয়া কত ভিন্ন ভিন্ন জাতি ভারতবর্ষে আসিয়া বসতি করিয়াছে। তাহাদের আদিম যে-সব পার্থক্য ও বিশেষত্ব ছিল, ক্রমে ক্রমে ভারতের জলবায়ু রোদ বৃষ্টি ভাত রুটির প্রভাবে তাহা লোপ পাইয়া তাহারা সকলেই এক ভারতীয় ছাপ লইয়াছে। আর্য হিন্দুই বলুন, আরব সৈয়দই বলুন, আর খ্রিস্টান পর্তুগীজই বলুন, যে-সব লোক ভারতে স্থায়ী বসতি করিয়াছে, মুষ্টিমেয় পারসী জাতি বাদে তাহারা সকলেই নিজ নিজ আদি দেশের রক্তের বিশুদ্ধতা হারাইয়াছে, প্রকৃতপ্রস্তাবে মিশ্র ভারতীয় জাতি হইয়াছে। নানা দেশ, নানা জাতি হইতে ভারতে আগত এই জনসঙ্ঘের উপর এই দেশের প্রভাবে যে এক ভারতীয় ছাপ পড়িয়াছে, তাহারা যে কাৰ্য্যতঃ এখানে থাকিয়া এক বিশেষ জাতি, এক বিশেষ সভ্যতার স্রষ্টা ও অংশীদার হইয়াছে– নিজ নিজ পূৰ্ব্বতন বিদেশীত্ব হারাইয়াছে– তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। যে রীড্লী সাহেব ভারতের রাষ্ট্রীয় একতা অসম্ভব মনে করিতেন, তিনিও বলিয়াছেন– “বিদেশী ভ্রমণকারী ভারতবর্ষে আসিয়া নানা প্রদেশে নানা জাতির মধ্যে আকৃতিতে, সমাজনীতিতে, ভাষায়, ধর্ম্মে আচার-ব্যবহারে বিবিধ পার্থক্য দেখেন বটে, কিন্তু তিনি লক্ষ্য না করিয়া থাকিতে পারেন না যে, “হিমালয় হইতে কুমারিকা পর্য্যন্ত সমস্ত দেশ ব্যাপিয়া তলে তলে একটা অনির্বচনীয় জীবনের একতা (uniformity of life) আছে। প্রকৃতই একটা সর্ব্ব-ভারতীয় চরিত্র, একটা সর্ব্ব-ভারতীয় ব্যক্তিত্ব আছে, তাহার অংশগুলি বিশ্লেষণ করিয়া দেখান সম্ভব নহে।” এই “সাধারণ সর্ব্ব-ভারতীয় বিশেষত্ব” আবহমানকাল হইতে গঠিত হইয়া আসিয়াছে, যুগে যুগে অল্পবিস্তর বাহ্যবেশ বদলাইয়াছে, আজও বদলাইতেছে, কিন্তু কখনও একেবারে নষ্ট হয় নাই।

চারি যুগে চারি জাতির দান

আজিকার ভারতবাসীদের এই সম্মিলিত ব্যক্তিত্ব প্রধানতঃ চারিটি জাতির দান লইয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে, তাঁহারাই প্রকৃত যুগ-কর্তা, ভারত-ভাগ্যবিধাতা; তাঁহাদেরই প্রভাব ঔষধের মধ্যেকার ধাতুপদার্থের মত আজ পর্য্যন্ত আমাদের রক্তে প্রবাহিত হইতেছে। তাঁহারা (১) বৈদিক আর্য্যগণ, (২) বৌদ্ধগণ, (৩) মুসলমান ও (৪) ইংরাজ। ইঁহাদিগের প্রত্যেকেই এই দেশে একটি নূতন জিনিস একটি নূতন ধরনের শক্তি প্রবেশ করাইয়া দিয়াছেন, তাহা পুরাতনের সহিত মিশ্রিত হইয়া পুরাতন ভারতকে পরিবর্তিত করিয়াছে এবং নিজেও পরবর্তী যুগে পরিবর্তিত আকারে রহিয়া গিয়াছে। কোন যুগের কোন জাতির কোন ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠ দানই ভারত হারায় নাই– এগুলি আজিকার ভারতের সাৰ্ব্বজনীন সম্পত্তি।

আর্য্য ও বৌদ্ধযুগের ভারত সম্বন্ধে সুধীগণ অনেক আলোচনা করিয়াছেন; সে সম্বন্ধে আমি কিছু না বলিয়া, মুসলমান যুগে ভারত নূতন কি পাইয়াছিল এবং তাহার কতটা এপর্য্যন্ত রাখিতে পারিয়াছে, তাহাই এখানে বিচার করিব। মুসলমান অধিকার আজ দেড় শত বৎসর হইল ভারতবর্ষ হইতে লোপ পাইয়াছে, কিন্তু ব্রিটিশ যুগের এই সব সহস্র সহস্র প্রবল পরিবর্তনের মধ্যেও মুসলমান যুগের দান কত বেশী রহিয়া গিয়াছে, ব্রিটিশ-শাসকেরা তাহার কত বেশী অংশ নিজস্ব করিয়া লইয়াছেন তাহা ভাবিলে আশ্চর্য্য হইতে হয়।

ভারতে মুসলমান বসতির বিশেষত্ব ও প্রকৃত স্বরূপ

মুসলমানদের পূর্ব্বে অনেক বিদেশী বিধর্মী জাতি আসিয়া ভারতে বসতি করে– যেমন গ্রীক, সিথীয় (শক), পার্থীয়, মোঙ্গোলীয়। কিন্তু তাহাদের বংশ দুই তিন পুরুষ পরেই হিন্দুসমাজে সম্পূর্ণভাবে মিশিয়া যায়, হিন্দু নাম, হিন্দু ভাষা, বেশভূষা, ধর্ম্ম ও চিন্তা অবলম্বন করে; আর এদিকে হিন্দু ধর্ম্ম এবং সমাজও এইসব জাতির বিদেশ হইতে আনীত প্রাচীন প্রথা ও পূজার সহিত একটা বোঝাপড়া করিয়া, তাহার কিছু কিছু নিজস্ব করিয়া লইয়া, সবটার উপর ভারতীয় ছাপ লাগাইয়া দেয়। অর্থাৎ হিন্দুসমাজ একটা সাৰ্ব্বজনীন মিলনের ও একত্রীকরণের প্রকাণ্ড যন্ত্র। এই যেমন,–খ্রিস্টের প্রায় দেড় শত বৎসর পূৰ্ব্বে, গ্রীক দিয়নের পুত্র হেলিওডোরস্, যবন-রাজ আন্টালকিদসের দূত হইয়া ভারতীয় রাজা ভাগভদ্রের সভায় আসেন; তিনি পথে মালব প্রদেশে বেসনগর নামক শহরে বিষ্ণুর পূজা করিয়া একটি গরুড়স্তম্ভ স্থাপিত করেন, এবং তাহার ফলকে নিজকে “ভাগবত” অর্থাৎ বৈষ্ণব বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। অর্থাৎ গ্রীক যবন (যবন-Ionian) অনায়াসে হিন্দু হইয়াছিল।

কিন্তু মুসলমান বিজয়ের পর এইরূপ মিলন ও একত্রীকরণ বন্ধ হইল। হিন্দুধর্ম্ম ইসলামকে নিজস্ব করিয়া, মুসলমান জাতিগুলিকে হজম করিয়া ভারতবর্ষের অঙ্গীভূত করিতে পারিল না। কারণ, ইসলামের মূলমন্ত্র একেশ্বরবাদ। ইহুদীধর্ম্ম হইতে ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্ম্মের জন্ম; এই তিন ধৰ্ম্মেই ঈশ্বর একমেবাদ্বিতীয়ম্, তিনি “জাগ্রত এবং প্রতিদ্বন্দ্বিহীন”,-অর্থাৎ আল্লার (বা জিহোবার) সঙ্গে সঙ্গে আর কোন দেবদেবীকে উপাসনা করিলে তিনি ভীষণ রাগ করিবেন। হিন্দুদের কথাই আলাদা, তাহারা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে পূজা করে, উহার সঙ্গে আল্লা, মহম্মদ বা যিশু নামে আর দু-তিনটা দেবতা যোগ করিয়া দিলে এই যৎসামান্য “বোঝার উপর শাকের আটি” হিন্দু উপাসক সমাজ অতি সহজে সহ্য করিতে পারিত–এই যেমন অনার্য্যদের ও বৌদ্ধদের কত দেবতা অপদেবতা আমরা পূর্ব্বে লইয়াছি, কিন্তু ইস্লামী (এবং ব্রিটিশ যুগে খ্রিস্টান) সম্প্রদায় কিছুতেই বহু-ঈশ্বর মানিতে সম্মত হইল না। হিন্দুরা অনেক চেষ্টা করিল, তাহারা “আল্লোপনিষৎ” লিখিল, বাদশাহ আকবরকে যুগ-ত্রাতা অবতার বলিয়া পূজা করিতে আরম্ভ করিল এবং দরকার হইলে আরবীয় দেবদূতকে রামানুজ শঙ্কর প্রভৃতির ভাই বলিয়া মানিয়া লইত। কিন্তু মুসলমানেরা কোনমতে ইসলামের মূলমন্ত্র ছাড়িয়া হিন্দুধর্ম্মের সহিত আপোষ করিলেন না। কোরাণে আছে– “অপবিত্র কেহই কাবাতে প্রবেশ করিতে পারিবে না। বহু-দেব-উপাসকগণ অপবিত্র”। এইজন্য হিন্দুসমাজ ইসলামকে গ্রাস করিতে পারিল না।

অতএব, হিন্দু ও মুসলমান (পরে হিন্দু ও খ্রিস্টান) একই দেশে শত শত বর্ষ বাস করিয়াও সমাজে জীবনে এক হইতে পারে নাই। ভারতীয় মুসলমানদের হৃদয়ের দ্বার ভারতের দিকে বন্ধ, ভারতের বাহিরের দিকে খোলা। এখনও তাঁহারা প্রার্থনার সময় মক্কার একটি গৃহের দিকে মুখ ফিরান; তাঁহাদের চিন্তার, আইন-কানুনের, শাসন-পদ্ধতির, প্রিয় সাহিত্যের আদর্শ ভারতের বাহির হইতে আসে, তাঁহাদের নিজস্ব সভ্যতার উৎস আরবে, সিরিয়ায়, পারস্যে ও মিশর দেশে–ভারতে ছিল না। হিন্দুদের সব দৃষ্টি, সব আদর্শ সব কেন্দ্রই ভারতবর্ষের মধ্যে আবদ্ধ; ইস্লামীয়দের ধর্ম্মের ভাষা, শকাব্দ, সাহিত্য, শিক্ষক, সাধুপুরুষ এবং তীর্থ সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া এক এসব ভারতের বাহিরের বস্তু।

মুসলমান যুগের দান

মুসলমান যুগে ভারতবর্ষের দশটি লাভ হয়, যথা-

(১) বাহিরের জগতের সঙ্গে আবার সংস্রব স্থাপন, আবার ভারতীয় নৌবল গঠন ও সমুদ্র পার হইয়া বাণিজ্য।

(২) একচ্ছত্র রাজত্বের ফলে ভারতের বহু প্রদেশ ব্যাপিয়া শান্তি, বিশেষরূপে আর্য্যাবর্ত বা বিন্ধ্যপর্ব্বতের উত্তরের দেশগুলিতে

(৩) সমস্ত দেশময় একই শাসন-প্রণালী এবং একই প্রভুর অধিকারের ফলে, লোকের মধ্যে কাজকর্ম্মে ব্যবসা-বাণিজ্যে, বাহ্যজীবনে এবং কিছু পরিমাণে চিন্তায়ও একতা স্থাপন।

(৪) হিন্দুমুসলমান-নির্বিশেষে উচ্চ এবং চাকুরে সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক আচার ব্যবহারে, পরিচ্ছদে ও ভব্যতায় এক প্রণালী অনুসরণ।

(৫) মুঘল চিত্রকলার উদ্ভব। ইহাতে প্রাচীন হিন্দু (অর্থাৎ অজন্তার) চিত্রপ্রণালী এবং নব আনীত চীনা প্রণালী একত্র মিলিত হইয়া তাহাদের সমাবেশ ও পরস্পর পরিবর্তনের ফলে এক নবীন রমণীয় প্রণালীর উদ্ভব হয়। হিন্দু বিষয় লইয়া মুঘল চিত্রপ্রণালী, যেসব দৃষ্টান্ত অঙ্কিত হইয়াছে তাহাদের “রাজপুত-প্রণালী”র চিত্র বলা হয়।

গৃহনির্ম্মাণে মুসলমান যুগের কীর্তি অমর হইয়া রহিয়াছে। হিন্দু রাজারাও ইহার অনুকরণ করিতেন। কতকগুলি নবীন শিল্প-যথা শাল, কিংখাব, মসলীন্, গালিচা বুনন, পাথর বসান বা অন্যধাতুর ফলকে সোনা রূপার কাজকরা (কোরী) প্রভৃতি।

(৬) সাধারণের জন্য একটা বিষয়কর্ম্মের উপযোগী চলিত ভাষা, উর্দু-অর্থাৎ সেনানিবাসের ভাষা, যে ভাষায়, তুর্কী ও পাঠান সৈন্যগণ ভারতীয় দোকানদার চাকর বা দূতদিগের সহিত কথাবার্তা বলিত। ফার্সীতে ইহার নাম “হিন্দবী” অর্থাৎ “ভারতীয়” ভাষা, বর্তমান নাম হিন্দুস্থানী, দাক্ষিণাত্যে নাম “রেতা” (অর্থাৎ পতিত, অপভ্রংশ)। কিন্তু এই কথিত ভাষায় উত্তর-ভারতে অনেক শতাব্দী পর্যন্ত সাহিত্য রচিত হয় নাই, সরকারী চিঠি, হিসাব এবং আদালতের রায় লিখিত হয় নাই। এই দুইটি কাজের জন্য ফার্সী ভাষা ব্যবহৃত হইত। হিন্দু, মুসলমান সব কর্মচারী এমন কি অনেক করদ হিন্দুরাজার দরবারও এই ফার্সী ভাষা ব্যবহার করিতেন; ইহাই সে যুগে ভারতে একমাত্র রাজকার্য্যের ভাষা (Official Language) ছিল। ইহাও জাতীয় একতাবন্ধনের একটি কারণ হয়। (৭) অপর দিকে, সংস্কৃতের ব্যবহার প্রায় লোপ পাওয়ায় মুসলমান যুগের দেওয়া শান্তি ও ঐশ্বর্য্যের ফলে হিন্দী বাঙ্গলা মারাঠী প্রভৃতি নব্য ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টি আরম্ভ হইল।

(৮) হিন্দুসমাজের ভিতর একেশ্বরবাদী ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব। বৈদান্তিক সুফী ধর্ম্মের প্রসার।

(৯) ইতিহাস-রচনা।

(১০) যুদ্ধবিদ্যায় এবং সভ্যতার সর্ব্বপ্রকার বিভাগে উন্নতি।

আমরা এখন কিছু বিস্তৃতভাবে এগুলি বুঝিবার চেষ্টা করিব।

ভারত বাহিরের জগতকে আবার চিনিল

বৌদ্ধযুগের শেষ পর্য্যন্ত ভারতের সহিত দক্ষিণ ও পূর্ব্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল, লোকের যাতায়াত, বাণিজ্যদ্রব্য ও গ্রন্থ বিনিময়, এমন কি বিদেশে উপনিবেশ-স্থাপন পৰ্য্যন্ত অবাধে চলিয়া আসিয়াছিল। কিন্তু হূণদের শেষ পরাভবের পর অষ্টম শতাব্দীতে নবজাগরিত হিন্দু ধর্ম নিজের ঘর গুছাইয়া তুলিল, হিন্দুসমাজকে নূতন করিয়া সাজাইয়া অতি কঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া রাখা হইল, বিদেশীবর্জ্জন সম্পূর্ণ হইল, সমাজের অঙ্গে নূতনের যোগ বা পরিবর্তন মাত্রই পাপ ও আচারভ্রষ্টতা বলিয়া গণ্য হইল। তখন হিন্দুসমাজ প্রকৃতই “অচলায়তন” হইল, দেশের ভৌগোলিক গণ্ডীর মধ্যে চোখ বুজিয়া নিজেকে বন্দী করিয়া রখিল যেন, এদেশের বাহিরে কোন জনমানব নাই।

কিন্তু মুসলমানদের ভারত জয় করিবার ফলে ভারতবর্ষ আর একঘরে কোণঠাসা হইয়া রহিল না, আবার অন্যান্য দেশের সহিত ভারতের সম্বন্ধ ও আদান-প্রদান আরম্ভ হইল। কিন্তু বৌদ্ধযুগে যেমন অগণিত ভারতীয় লোক-পণ্ডিত শ্রমণ বণিক ও উপনিবেশ-স্থাপনকর্তা-বিদেশে চলিয়া গিয়াছিল, এই মুসলমান যুগে ভারতীয় হিন্দু কেহই বাহিরে গেল না, গেল কতকগুলি ভারতীয় মুসলমান, আর আসিল অসংখ্য বিদেশী মুসলমান খ্রিস্টান প্রভৃতি; ভারতের সহিত বাহিরের বাণিজ্য আরব ও বোহোরা ডচ্ ও ইংরাজদের হাতে রহিল। বুখারা ও সমরকন্দ, বল্‌খ ও খুরাসান, খারিজম্ (খিভা) ও পারস্য হইতে জনস্রোত এবং পণ্যদ্রব্য আফগান গিরিসঙ্কট দিয়া স্থিরভাবে নির্বিবাদে ভারতবর্ষে প্রবেশ করিতে লাগিল, কারণ তখন আফগানিস্তান দিল্লী-সাম্রাজ্যের প্রদেশ মাত্র ছিল। (১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইহা ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন হয়)। বোলান পাস দিয়া প্রতিবৎসর চৌদ্দ হাজার ভারবাহী উট ভারতীয় পণ্যদ্রব্য কান্দাহার ও পারস্যে লইয়া যাইত (১৭ শতাব্দীর প্রথমাংশে)। বম্বে উপকূলের বন্দরগুলি বাহিরের সমুদ্র-বর্তী দেশগুলির পক্ষে ভারতে ঢুকিবার জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক দ্বার হইল। আর, আমাদের পূর্ব্ব উপকূলে মছলিপটন বন্দর হইতে অসংখ্য জাহাজ যাইত সিংহল, সুমাত্রা, জাভা, শ্যাম, চীনদেশে, এমন কি জানজিবরেও!

এক শাসন-যন্ত্রের ফলে জাতীয় একতা

মুঘল সম্রাটদের দুইশত বৎসর ধরিয়া সতেজ অধিকারের ফলে, সমস্ত উত্তর-ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের অনেক অংশও এক সরকারী ভাষা, শাসন-প্রণালী, মুদ্রা এবং কথ্য সাধারণ ভাষা লাভ করিল। জাতীয় একতা সাধন করিবার পক্ষে এই উপাদানগুলি অমূল্য। মুঘল বাদশাহদের নিজেদের শাসিত প্রদেশের বাহিরেও অনেক হিন্দুরাজা তাঁহাদের শাসন-পদ্ধতি, কৰ্ম্মচারী বিভাগ ও উপাধি, সভার আদব-কায়দা, মুদ্রা প্রভৃতি অনুকরণ করিয়া সমস্ত ভারতের বাহ্য একতা আরও বাড়াইয়া দিলেন।

দিল্লী-সাম্রাজ্যের বিশটি ভারতীয় সুবায়-অর্থাৎ পেশাওয়ার হইতে চাটগাঁ এবং কাশ্মীর হইতে কৃষ্ণা নদী পর্য্যন্ত– ঠিক এক ছাঁচে ঢালা শাসন-পদ্ধতি, কর্মচারীবৃন্দ, আইন-কানুন এবং দরবার ও আদালতের ভাষা এবং কাৰ্য্য-প্রণালী চলিত। সমস্ত সরকারী চিঠিপত্র ও হিসাবে এক ভাষা (ফার্সী) ব্যবহৃত হইত। রাজকর্মচারী ও সৈন্যগণ এক প্রদেশ হইতে অপর প্রদেশে ঘনঘন বদলি হইত। এইরূপে, কোন প্রদেশের অধিবাসী অপর প্রদেশে গিয়া বিদেশে আসিলাম বলিয়া মনে করিবার কারণ পাইত না; বণিক ও পথিকেরা এক সুবা হইতে অন্য সুবায় অতি সহজে যাতায়াত করিত। সকলেই বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের ছায়ার তলে ভারতকে এক দেশ এক জন্মভূমি বলিয়া বুঝিতে লাগিল। জাতীয়তার কল্পনা সম্ভব হইল।

মুঘল চিত্রবিদ্যার ক্রমবিকাশ

শিল্পকলায় মুসলমানদের দান ভারতবর্ষ এখনও হারায় নাই, এগুলি আমাদের অমূল্য সম্পদ হইয়া রহিয়াছে। আগে চিত্রবিদ্যার বিকাশ দেখা যাউক। মুসলমান যুগের প্রথম প্রথম যে সব চিত্র ভারতে পৌঁছিয়াছিল সেগুলি খুরাসান ও বুখারাতে (অর্থাৎ মধ্য এশিয়াতে) চিত্রিত হয়, তাহাদের শিল্পীরা চীনা চিত্রকর অথবা চীনাদের ছাত্র; এইসব “বিশুদ্ধ মধ্যএশিয়া বিদ্যালয়ের” ছবিগুলিতে চীনদেশীয় চিত্রপদ্ধতি ছত্রে ছত্রে দেখা যায়- মুখচোখ, পৰ্ব্বত, জলাশয়, আগুন এবং রাক্ষস সব অবিকল চীনা ধরনের, ইহা দেখিবামাত্র বুঝা যায়। আকবরের রাজসভায় এই চীনা চিত্রপদ্ধতি এবং প্রাচীন হিন্দু অর্থাৎ অজন্তার শিল্পরীতি একত্র জুটিল; প্রত্যেকেই নিজের প্রখর বিশেষত্বগুলি অল্পে অল্পে ছাড়িতে লাগিল, অপর পক্ষের রীতিনীতি লইতে লাগিল। চীন হইতে আনীত মধ্য এশিয়ার চিত্রকলার কঠিনতা, একঘেয়ে ভাবগুলি লোপ পাইল, তাহার বাহ্য আকারে পরিবর্তন হইল। আর অজন্তা-ইলোরার শিল্পীদের বংশধরগণও দেখিলেন যে শত শত বৎসর পূর্ব্বের পৈতৃক অচল প্রণালী ও নিয়ম এই নবীন যুগে চলে না, অন্যত্রও সৌন্দৰ্য্যবোধ আছে, অন্য দেশেও শিখিবার জিনিস আছে, তাহার দিকে চোখ বুজিয়া থাকিলে নিজেই ঠকিতে হইবে। তাই চীনা ও হিন্দু চিত্রকলার মিলনে ভারতে এক নবীন মিশ্র শিল্পরীতির জন্ম হইল, ইহাকে আজকাল “ইণ্ডিয়ান আর্ট”, “ইণ্ডো-স্যারাসেন বা মুঘল চিত্র-বিদ্যালয়” বলা হয়। প্রথম প্রথম অর্থাৎ আকবরের উৎসাহে অঙ্কিত চিত্রে, দেখি যে চীনা চিত্রকলা যেন গলিয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছে, পৰ্ব্বত জলাশয় আগুন প্রভৃতি এক নূতন ধরনে আঁকা হইতেছে, সে ধরনটা চীনা প্রণালীর আভাস দেয় বটে কিন্তু অনেক পরিবর্তিত আকারে, যেন কঠিন ধারাবাহিক বদ্ধমূল সংস্কার ছাড়িয়া দিয়া ঠিক প্রকৃতিকে অনুকরণ করিবার চেষ্টা করিতেছে। এইসব চিত্রে মানুষ ও জীবজন্তুর মুখ এবং বাহ্য প্রাকৃতিক দৃশ্য সব পরিষ্কার ভারতীয়।

আকবরের পরে পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া এইরূপে প্রাচীন ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দু চিত্রকলার প্রভাব মুসলমান চিত্রকলাকে সম্পূর্ণরূপে বদলাইয়া নূতন কলেবর দান করিল। শাহজাহানের সময়ে (১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) এই প্রণালীর পূর্ণ বিকাশ হইল, নব-ভারতীয় কলার সম্পূর্ণ জয় হইল, চীনা চিত্রবিদ্যার কোন চিহ্নই রহিল না, ভারতীয় প্রণালী সর্ব্বত্রই সুস্পষ্টভাবে দেখা যাইতে লাগিল; মুখে চোখে এমন একটা কোমলতা, লাবণ্য ও বর্ণের সামঞ্জস্য, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অংশগুলি এমন যত্নে আঁকা, অলঙ্কার ও সজ্জা এত বিবিধ এবং মহিমাশালী, এবং চিত্রগুলি প্রকৃতির এত অনুরূপ- যে দেখিলেই মনে হয় ইহা ইউরোপীয় প্রভাবের পূর্ব্বকালীন ভারতের হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ নিজস্ব উপহার। ইউরোপীয় চিত্রবিদ্যার দুটি সাধারণ নিয়ম অর্থাৎ পারস্পেকটিভ (দূরের বস্তুকে ছোট করিয়া দেখান) এবং লাইট এণ্ড শেড (ছায়ার দ্বারা উঁচুনীচু বুঝান) মুঘল চিত্রে কখনও আসে নাই, কিন্তু অপর সকল গুণই ছিল। পণ্ডিতেরা প্রায়ই মুঘল চিত্রকে “রাফেলের পূর্ব্বের” ইটালীয় চিত্রকলার মত বলেন। অসংখ্য অকৃত্রিম আদি মুঘল চিত্র দেখিয়া আমার বিশ্বাস হইয়াছে যে শ্রেষ্ঠ মুঘলচিত্র (অর্থাৎ শাহজাহানের যুগে অঙ্কিত দৃষ্টান্তগুলি) বটিচেলীর ছবিগুলির অনেক উপরে; এ দুটির মধ্যে ঠিক তুলনা হয় না।

মুঘল চিত্রশিল্পের বিস্তার ও অবনতি

বাদশাহের দরবারে যে সব বড় বড় চিত্রকরের ছাত্র শিক্ষা লাভ করিতে পারে তাহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ক’জন নিজ গুরুর পদ পাইত, অপর সব ছাত্র ওমুরা বা করদ রাজাদের দরবারে গিয়া অন্ন উপার্জ্জন করিত। ইহাদের চিত্রের বিষয় শাহনামা, জামী নিজামীর কাব্য, তাইমুর-জীবনী বা বাদশাহদের কীর্তিকলাপ নহে–রামায়ণ-মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দু সাহিত্য হইতে লওয়া। কিন্তু বিষয়গুলি হিন্দু হইলেও প্রণালী সম্পূর্ণ মুঘল রাজ-দরবারের অর্থাৎ ইণ্ডো-স্যারাসেন স্কুলের। সুতরাং ইহাকে এক স্বতন্ত্র “রাজপুত স্কুল” বলা ভুল। ক্রমে ক্রমে এইসব রাজার পালিত রাজস্থানের চিত্রকরগণ বাদশাহী সভার গুরুদের বিদ্যা অল্পে অল্পে ভুলিতে লাগিল, তাহাদের ছবিগুলিতে কোমলতা ও সূক্ষ্মদৃষ্টি লোপ পাইল, রঙ্গের জাঁকজমক প্রখর হইয়া চোখে রূঢ় ঠেকিতে লাগিল; ছবিগুলি দেখিয়াই বোধ হইল যেন কাঁচা কারিকরদের দ্বারা তাড়াতাড়ি আঁকা কম খরচে প্রস্তুত দ্রব্য। (মোলারাম ও কাংগ্রা-প্রদেশীয় চিত্রকরগণ এই স্কুল হইতে বিভিন্ন)

আওরংজীবের সময় হইতেই বাদশাহের অনাদরে, রাজকোষ শূন্য হওয়ায়, অবিরাম যুদ্ধে এবং তাঁহার পুত্র-পৌত্রগণের নৈতিক অবনতির ফলে মুঘল চিত্রবিদ্যা ডুবিয়া গেল, কারণ এটির জন্ম ও বৃদ্ধি রাজসভায়, ইহার জীবন রাজা ও ওমরার অর্থব্যয়ের উপর নির্ভর করিত।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হইতেই মুঘল চিত্রবিদ্যার দ্রুত অবনতি; ওস্তাদ চিত্রকরগণ বৃদ্ধ বয়সে না খাইয়া মারা গেল, তাহাদের পুত্রগণ পৈতৃক ব্যবসার বৃথা আশা ছাড়িয়া দিয়া মুটে মজুর হইয়া মোটা ভাতকাপড় উপার্জ্জন করিতে বাধ্য হইল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে লক্ষ্ণৌয়ের নবাবদের অনুগ্রহে যে ভারতীয় চিত্রকলা জাগিয়া উঠে তাহা ইংরাজী ও মুঘল স্কুলের এক হাস্যাস্পদ খিচুড়ী, পিতা-মাতার কোন গুণই পায় নাই। (“আকবরের খ্রিস্টান বেগম” এই মিথ্যা নামে পরিচিত চিত্রখানি এই স্কুলের একটি দৃষ্টান্ত)।

স্থপতি শিল্পে ভারতে মুসলমান কীৰ্ত্তি

আর, স্থপতিবিদ্যায় মুসলমান রাজা নবাবেরা ভারতকে যাহা দিয়া গিয়াছেন তাহার অনেকগুলিই আমাদের চোখের সম্মুখে বিদ্যমান। ভারতে মুসলমান অট্টালিকা-নির্ম্মাণ-কলার যুগে যুগে ক্রমবিকাশ এখনও অতি সুস্পষ্টভাবে দেখাইয়া দিতে পারা যায়। আকবরের পূর্ব্বেকার রাজবাড়ীগুলি প্রায় ধ্বংস হইয়াছে বা পরিবর্তিত হওয়ায় চেনা যায় না, কিন্তু অনেক মসজিদ, সমাধি এবং দুর্গ এখনও বর্তমান আছে। দিল্লী এবং দিল্লীর বাহিরে দশ বারো মাইল স্থান যত্নের সহিত ঘুরিয়া দেখিলে এই যুগের অসংখ্য দৃষ্টান্ত চোখে পড়িবে। দাস-বংশের, খিলজীদের, তুঘলকদের, লোদীদের এবং শূর-বংশীয়দের সমাধি মসজিদ প্রভৃতি প্রত্যেকটি পূর্ব্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের দৃষ্টান্ত হইতে বেশ ভিন্ন, অথচ প্রত্যেক দৃষ্টান্তটি যে পূৰ্ব্ব হইতে কোন কোন অংশ লইয়াছে এবং পরের যুগের স্থাপত্যকে কতকগুলি অঙ্গ দান করিয়াছে, ইহা পণ্ডিত না হইলেও দেখিবামাত্র বুঝা যায়।

তেমনি মুঘল যুগেও আকবর হইতে শাহজাহান (এবং আওরংজীবের প্রথম দশ বৎসর) পর্য্যন্ত যে-সব রাজকীয় প্রাসাদ ধর্ম্মমন্দির ও সমাধি নির্ম্মিত হয় তাহার মধ্যে একটা ক্রমবিকাশ আছে; এক কথায় বলা যাইতে পারে যে ক্রমে যেন শক্তি সরলতা ও কতকটা কর্কশতা সরিয়া গিয়া অলঙ্কার-বহুল স্নিগ্ধ কোমলতা বা দুর্ব্বলতাকে স্থান দিয়াছে। তাহার পর চিত্রের মত অট্টালিকা-নিৰ্ম্মাণ-শিল্পেরও অবনতি রাজকোষের অর্থাভাবে ঘটিল। অবশেষে মাটির বাড়ী বা সমাধি গড়িয়া তাহার বাহিরে একসার ইঁটের আবরণ অথবা সুর্কির আস্তর দিয়া ঢাকিয়া তাহার উপর রঙ্গের বাহার ফলান হইতে লাগিল (মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দী)!

নব্য প্রাদেশিক ভাষায় সাহিত্য-সৃষ্টি

কালক্রমে ভারতের অজস্র ভাগ্যবিপর্যয়ের মধ্যে প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যের ভাষা-সংস্কৃত এবং পালি লোপ পাইল। সংস্কৃতের জ্ঞান ও চর্চ্চা চলিতে থাকিল বটে, কিন্তু তাহাতে আর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি হয় না, শুধু Manual of Hindu Law, Astronomy made easy, A short cut to Yoga এই ধরনের বই, অর্থাৎ টিকার টিকা তস্যটিকা, লিখিত হইতে লাগিল। ইহা সাহিত্য নহে, ইহার ভিতর দিয়া জাতীয় প্রাণের সাড়া পাওয়া যায় না, লোকের হৃদয়ে পৌঁছান যায় না। এইরূপে দুঃখে অন্ধকারে কত শতাব্দী কাটিয়া গেল। তাহার পর মধ্যযুগের শেষাশেষি ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে জনসাধারণের ভাষা একটি–একটি প্রাদেশিক “প্রাকৃত”-মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল, নিজ অধিকার স্থাপিত করিল। আকবরের সময় হইতেই ইহার পূর্ণ প্রকাশ বলিতে হয়। সত্য বটে ষোড়শ শতাব্দীর অনেক পূর্ব্বেও এইসব আধুনিক প্রাকৃত ভাষায় কিছু কিছু দোঁহা, ধৰ্ম্মকথা, গান ও মন্ত্র দেখা দেয়, কিন্তু তাহাকে সাহিত্য বলা যায় না, এবং তাহার অবয়বও অতি ক্ষীণ ছিল। প্রকৃত হিন্দী, বাঙ্গলা, মারাঠী, আসামী ও পাঞ্জাবী সাহিত্যের প্রবহমান জীবনধারা ষোড়শ শতাব্দী হইতেই গণিতে হয়। মুঘল বাদশাহরা দেশকে শান্তি ও সুশাসন দান করিলেন, শান্তির ফলে লোকে নিশ্চিন্ত মনে অর্থ উপার্জ্জন করিতে লাগিল, দেশ ধনে ধান্যে পূর্ণ হইল; লোকে অবসর ও মনের শান্তি পাইল, সাহিত্যসৃষ্টির ইচ্ছা, সাহিত্য উপভোগের ইচ্ছা জাগিয়া উঠিল। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু পর হইতেই আমরা নানা প্রদেশে নানা নব্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি দেখিতে পাই। বঙ্গে বৈষ্ণব লেখকগণ, ধৰ্ম্ম জীবনী সঙ্গীত তর্ক প্রভৃতি বিভাগে অগণিত বাঙ্গলা গ্রন্থ রচনা করিয়া মহাপ্রভুর মৃত্যু (১৫৩৩) হইতে আওরংজীবের অধিরোহণ (১৬৫৮) পর্য্যন্ত সওয়া শ দেড় শ’ বৎসরকাল উজ্জ্বল করিয়া তুলিলেন। হিন্দীতে অতুলনীয় কাব্য রামচরিতমানস (তুলসীকৃত) ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়, কিন্তু এই পূর্ণচন্দ্রের উদয়ের পূর্ব্বে কতকগুলি তারকা হিন্দী-আকাশে দেখা দিয়াছিল-

যেমন মালিক মুহম্মদ জয়সীর পদুমাবৎ ১৫৪০ সালে সম্পূর্ণ হয়, এবং তুলসীদাসের সমকালে বা অল্প পরে অখরাবৎ, স্বপনাবৎ, মধুমালতী প্রভৃতি কাব্য লিখিত হয়। মধ্য-ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব্বে কবীর দাদু ও নানক যেসব ধৰ্ম্ম সঙ্গীত এবং বাণী রচনা করেন তাহা হিন্দী হইলেও ঠিক সাহিত্য নহে, ওগুলি যেন জীবনযাত্রার পক্ষে মন্ত্র, মুখস্থ করিয়া রাখিবার জন্য রচিত।

ভারতীয় বাদশাহদের দরবারে যেসব পারসিক কাব্য এবং রামায়ণ মহাভারতের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ রচিত হয় তাহা উল্লেখ করিব না, কারণ পারসিক সাহিত্যের ইতিহাসে ইহার স্থান অতি হেয়,–ঠিক যেমন আমাদের লেখা ইংরাজী কাব্য। অথচ পারস্যে জন্ম এমন পারসিক লেখকও কয়েকজন ভারতে আসিয়া এইরূপ কাব্য লেখেন। ফলতঃ রাজদরবারের সাহিত্য কখনও উচ্চ শ্রেণীতে উঠিতে পারে না, উহার প্রাণ নাই, বাহিরে বার্ণিশ আছে মাত্ৰ। সে যুগের ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে দশ হাজারে একজনের বেশী আরবী ভাষা ব্যবহার করিতে পারিতেন না, (কোরান মুখস্থ করা অন্য কথা), আর হয়ত পাঁচজন ফার্সী ভাষায় লিখিতে বলিতে পারিতেন। অবশিষ্ট সহস্র সহস্র মুসলমানের পক্ষে উর্দুই কথ্যভাষা ছিল। অথচ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্য্যন্ত ভারতীয় মুসলমানেরা উর্দুতে সাহিত্য সৃষ্টি করিতে, ইতিহাস রচনা করিতে, চিঠিপত্র ও আদালতের কার্যাবলী লিখিতে ঘৃণা করিতেন; বেতনভোগী কেরাণী দ্বারা এসব কাজ ফার্সী ভাষায় করা হইত। অর্থাৎ ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্ব সাহিত্য ছিল না। আওরঙ্গাবাদ নগরবাসী ওয়ালী (১৭১০-৩০) প্রথম উর্দু পদ্য ভদ্রসমাজে অধিক প্রচার করেন এবং পঞ্চাশ ষাট বৎসর পরে তাহাই সাৰ্ব্বজনীন হইয়া উঠে। দাক্ষিণাত্যে ওয়ালীর অনেক পূর্ব্বে রাজা উজীর রেতায় পদ্য লেখা অগৌরবের বিষয় মনে করিতেন না, কিন্তু এই রীতি উত্তর-ভারতে আসে নাই।

হিন্দু মুসলমান ধর্ম্মের মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাতের ফল

এই যে এত শত বৎসর ধরিয়া হিন্দু মুসলমান একই দেশে একই রাজার অধীনে বাস করিয়া আসিয়াছে, ইহার ফলে এই দুই ধর্ম্ম ও সমাজের মধ্যে পরস্পরের কি কি প্রভাব, কি কি আদান-প্রদান ঘটিয়াছে? প্রথমে ইহারা শত্রু ছিল, একের সহিত অপরের অস্তিত্বও যেন অসম্ভব, প্রকৃতির নিয়মের বিরোধী। কিন্তু আট শত বৎসরেও একে অপরটিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নাই, লোপ করিয়া দেয় নাই। দুইজনেই জীবিত আছে, কিন্তু অশেষ পরিবর্তন গ্রহণ করিয়া।

শিখ জাতির বিখ্যাত ঐতিহাসিক কানিংহাম্ মুসলমান- বিজয়ের নৈতিক ফল এইরূপে বর্ণনা করিয়াছেন:

“এই নবাগত জাতি বীরত্বে ক্ষত্রিয়দের অপেক্ষা কম নহে, অথচ ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠতা মানে না, এবং একেশ্বরবাদ প্রচার ও মূর্তিপূজার অবৈধতা ঘোষণা করে। ইহাদের দৃষ্টান্ত ও শিক্ষা ভারতীয় লোকদের মনের মধ্যে ক্রমে ক্রমে ঘাত-প্রতিঘাত করিতে লাগিল।… তাহার ফলে এদেশে নূতন নূতন কুসংস্কার গজাইয়া উঠিল, সেগুলি পুরাতন হিন্দু অন্ধবিশ্বাসের অনুরূপ; যেমন, পীর ও শহীদ, সাধু ও মৃত ধর্ম্মযোদ্ধা, কৃষ্ণ এবং ভৈরবের মতই অলৌকিক ক্রিয়া করিতে লাগিলেন। ভারতে আসিয়া মুসলমানেরা ঈশ্বরের একত্ব ভুলিয়া তাঁহার শত শত পার্থিব সেবক ও প্রিয়পাত্রকেই পরিত্রাণলাভের উপায় বলিয়া জড়াইয়া ধরিল, (যেন বুদ্ধকে ছাড়িয়া বোধিসত্ত্বের আরাধনায় মন দিল।)… অপর দিকে, হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম্মের সংঘর্ষের প্রথম ফল হইল রামানন্দ কর্তৃক ১৪ শতাব্দীর শেষভাগে এক মিলিত উপাসক সম্প্রদায় স্থাপন। ঈশ্বরের চোখে সব লোকই যে সমান, এই মতের উপর তিনি জোর দিলেন, সব খুঁটিনাটি আচার ও বিভাগের চিহ্ন ছাড়িয়া দিলেন, এবং সর্ব্বজাতের লোককে শিষ্য বলিয়া গ্রহণ করিতে লাগিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ঈশ্বর প্রেমে মাতোয়ারা ভক্ত জোলা কবীর একদিকে হিন্দুর মূর্তিপূজা ও ধর্ম্মশাস্ত্র, অপর দিকে কোরান এবং ধর্ম্মধ্বজিতার উপর আক্রমণ করিলেন, এবং প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের কঠিন ভাষা ছাড়িয়া নব্য চলিত ভাষায় ধর্মপ্রচার করিতে লাগিলেন। “

একেশ্বরবাদের প্রচার

কিন্তু স্যর উইলিয়ম হান্টার ও অন্যান্য ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মত যে জাতিভেদ-বিরোধী এবং একেশ্বরবাদী যে-সব ধর্ম্ম মধ্যযুগের ভারতে জাগিয়া উঠে ইসলাম হইতে সেগুলির জন্ম– ইহা ইতিহাসের বিরোধী। আমরা জানি যে অতি প্রাচীন কাল হইতে যুগে যুগে হিন্দু সমাজে সকল ধর্ম্ম-সংস্কারক, উচ্চচেতা মনীষী এবং ভক্ত সাধক চেঁচাইয়া বলিয়াছেন যে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর উপরে একমাত্র পরমেশ্বর আছেন, তিনিই সর্ব্বোচ্চ উপাস্য; প্রকৃত ভক্ত সাধকগণ সকলেই সমান, সকলেই একজাতের, সরল বিশ্বাস ও পবিত্র জীবন যাপন জমকাল বিপুল কৰ্ম্মকাণ্ড অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তাঁহারা সকলেই আরাধনা-পদ্ধতি ও মন্ত্রতন্ত্রকে সহজ এবং সাধারণের বোধগম্য করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এই যেমন, তামিল কবি গাহিয়াছিলেন-

How many various flowers
Did I, in bygone hours,
Call for the gods, and in their honour strew,
In vain how many a prayer
I breathed into the air,
And made, with many forms, obeisance due,
Beating my breast aloud
How oft I called the crowd
To drag the village car; how oft I stray’d
In manhood’s prime, to lave
Sunwards the flowing wave,
And, circling Shiva fanes, my homage paid,
But they, the truly wise,
Who know and realize
Where dwells the Shepherd of the Worlds, will ne’er
To any visible shirne,
As if it were divine,
Deign to raise hands of worship or of prayer.

কেহ কেহ বলেন যে খ্রিস্টীয় পাদ্রীদের প্রচ্ছন্ন প্রভাবে এই পদ্য সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত হয়; কিন্তু পাঠকেরা খাঁটি হিন্দু ভক্তি-সাহিত্য হইতে ইহার অনেক পূর্ব্বেকার একেশ্বরবাদী স্তোত্র দেখাইয়া দিতে পারিবেন।

সুতরাং, ইতিহাস পড়িয়া আমার মনে হয় যে মধ্যযুগে হিন্দুদের মধ্যে যাহা ঘটিয়াছিল তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে এইরূপ: মুসলমান ধর্ম্ম ও সমাজের নিত্য প্রতিবেশী হইয়া থাকিয়া, তাহাদের কাজকর্ম্ম দেখিয়া দেখিয়া, হিন্দুদের মধ্যে অন্তর্নিহিত ধর্ম্মসংস্কারের বা সমাজসংস্কারের চেষ্টা এবং গড্ডলিকা প্রবাহের মত পুরাতন রীতিনীতি অনুসরণ না করিয়া নূতন স্বাধীন সম্প্রদায় স্থাপন করিবার আকাঙ্ক্ষা সতেজ এবং ফলবান হইয়া উঠিল, নবজীবন লাভ করিল। মুসলমানদের চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত এসিডের মত হিন্দুদের কুসংস্কার গলাইয়া দিতে লাগিল; হিন্দু সংস্কারদিগের হৃদয়ে নূতন সাহস ও প্রেরণা আনিল।

এই যুগে অনেক নূতন ধৰ্ম্মসম্প্রদায় সৃষ্ট হইল, তাহাদের উদ্দেশ্য হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম্মের মধ্যে মিলন স্থাপন করা; এগুলির প্রতিষ্ঠাতারা ধর্ম্মের সব বিশেষ বিশেষ বাহ্য চিহ্ন, ক্রিয়াকাণ্ড, এবং বাঁধা মন্ত্রতন্ত্র ত্যাগ করিয়া, দুই দলেরই প্রকৃত ভক্ত ও সাত্ত্বিক লোকেরা যাহাতে আরামে একত্র মিশিতে পারে, এক উপাসনায় যোগ দিতে পারে, তাহার জন্য সহজ পথ খুলিয়া দিলেন। যাহারা তাঁহাদের নিকট দীক্ষা লইল তাহারা নিজের পূৰ্ব্বতন গোঁড়া ধৰ্ম্ম–ইসলাম বা হিন্দুত–ছাড়িয়া দিয়া এই নূতন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাইয়ের মত সমান হইয়া মিশিয়া গেল। কবীর ও দাদু, চৈতন্য ও নানক, ঠিক এইরূপে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভক্তদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ে স্থান দিলেন, এইসব শিষ্য এক নূতন একতার বন্ধনে আবদ্ধ হইল।

সুফী ধর্ম্মের বিস্তার

হিন্দু মুসলমান দুই সমাজেরই মূর্খ সাধারণ লোক, সংসার-বিরাগী সাধক, সন্ন্যাসী ফকির প্রভৃতির মধ্যে এইসব মহাপুরুষদের প্রভাব জয়লাভ করিল। আর, শিক্ষিত ভদ্রলোক, বিশেষতঃ কর্ম্মচারী-শ্রেণীর মধ্যে সুফী-মতের বহুল বিস্তৃতি হইল। সুফী-মতকে একটা ধৰ্ম্ম বিশেষ বলা ভুল; উহা চিন্তা করিবার, উপভোগ করিবার জিনিস যতটা, জীবনের কর্ত্তব্যের পথনির্দেশক নিয়মাবলী ততটা নহে। পণ্ডিত, দার্শনিক, লেখক, উদারচেতা সৰ্ব্বজীবে সমদর্শী বৈদান্তিক, ঈশ্বর প্রেমে মাতোয়ারা ভক্ত সাধক-এই শ্রেণীর লোকেরাই সুফী হইতে পারিতেন। ঈশ্বর সর্ব্ব জীবে সৰ্ব্ব দ্রব্যে- গাছপাতায়, প্রস্তরে নদীতে, চন্দ্রের কিরণে, নির্ঝরের জলতরঙ্গে, ধাতুর দ্রব্যে, মৃত্তিকায়–”ঘটে পটে” পৰ্যন্ত বিদ্যমান আছেন; তাঁহারই এক টুকরা আত্মার আকারে আমাদের দেহের মধ্যে আছে; মানুষের জীবাত্মা এই পরমাত্মার সহিত মিলিত হইলেই চরম শান্তি, পরম সুখ পায়, তাহার আর কোন উদ্বেগ আকাঙ্ক্ষা থাকে না, পুনর্জন্ম হয় না; মানব প্রেমিক যেমন প্রেয়সীর সঙ্গে বিচ্ছেদহীন বাধাহীন চিরমিলনের লালসায় পাগল, তাহাকে কাছে পাইবার জন্য জগৎ ব্যাপিয়া ব্যর্থ চেষ্টায় ছুটিয়া বেড়ায়, হতাশ ক্রন্দন করে, নিজ অঙ্গে আঘাত করে, আবার দূরে ক্ষণমাত্র তাহার মূর্তি দেখিলে আনন্দে নাচিতে থাকে–সেইরূপ ভক্তের প্রাণও প্রিয়তমের সহিত ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে চিরকালের জন্য লয় পাইবার, অর্থাৎ পূর্ণ একাত্মভাব (তৌহিদ্) সাধনার দ্বারা লাভ করিবার জন্য আজীবন চেষ্টা করে। তাই, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক মেঘমুক্ত রাত্রে পূর্ণচন্দ্রের বিকাশ দেখিয়া ছাদের উপর আত্মহারা হইয়া নাচিয়াছিলেন। শুভ্র জ্যোৎস্না-পুলকিত যামিনী, ফুল্ল কুসুমিত দ্রুমদল, জলপ্রপাতের জীবন্ত প্রবাহ– এ সমস্তই সেই চিরসুন্দর চিরকাঙ্ক্ষিত কিন্তু চির দূরবর্তী প্রিয়তমের মূর্ত্তি দেখাইয়া দিয়া সুফীকে পাগল করে। অনেক সুফী-সাধক প্রেমের উন্মাদনায় নাচিতে নাচিতে মূৰ্চ্ছা যাইতেন (যেমন রাধা-নামের প্রথম অক্ষর শুনিবামাত্র চৈতন্যদেবের ভাব হইত)। তখন তাঁহাদের মুখ হইতে ভবিষ্যদ্বাণী ভগবত্বাক্য আপনা হইতে বাহির হইয়া আসিত। ইহার ফার্সী ভাষায় নাম ‘হাল্ কাল’(=দশা ও দৈববাণী) এবং এগুলি সিদ্ধ সুফীর চিহ্ন বলিয়া গণিত হইত। সজ্ঞান অবস্থায় ইঁহারা–এমন কি নিরক্ষর সুফী সিদ্ধপুরুষগণও–অজস্রধারার মুখে মুখে এই ঈশ্বর প্রেমের কবিতা রচনা করিতেন। ইহাই সে যুগে শিক্ষিত ভারতবাসীদের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রিয়, অধিক প্রচলিত সাহিত্য ছিল। অনেক হিন্দু কেরাণী (লালা কায়েখ এবং পঞ্জাবী ক্ষত্রী) এরূপ পদ্য লিখিয়া বই ভরাইয়াছেন।

সুফী-মতের দুইটি শাখা পশ্চিম-এশিয়ার ও ভারতীয়। প্রথমটি গ্রীক দর্শনের, বিশেষতঃ আলেকজান্দ্রিয়া নগরের নব-প্লেতোনিষ্ট লেখকদের প্রভাবে গঠিত; দ্বিতীয়টি সংস্কৃত উপনিষদের নিকট ঋণী। বাদশাহ আকবর পারস্য হইতে আগত কয়েকজন বড় সুফী পণ্ডিত ও ভক্তকে আদর করিতেন, এবং নিজেও তাঁহাদের ধর্মালোচনায় যোগ দিয়া আনন্দ পাইতেন। তাঁহারই আহ্বানে এবং অনুগ্রহে গোঁড়ামীশূন্য হিন্দু ও মুসলমান প্রকৃত ভক্তদের একত্র করিয়া এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের এবং এক সম্মিলিত উদারচেতা উপাসক-সম্প্রদায় গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা হইল; দেশে সুফীমতের বহুল প্রসার হইল। উভয় ধর্ম্মের মধ্যে একটি সেতু বাঁধিয়া দিবার এই যে চেষ্টা তিনি আরম্ভ করেন, তাহাতে তাঁহার প্রপৌত্র দারাশুকো প্রাণ ঢালিয়া দিলেন। এলাহাবাদের সুবাদার থাকার সময় দারা কাশীর পণ্ডিতদের সাহায্যে পঞ্চাশখানা উপনিষদের ফার্সী অনুবাদ রচনা করিলেন, তাহার নাম দিলেন গূঢ়তম মন্ত্র, এবং বেদান্তে ব্যবহৃত দার্শনিক শব্দগুলির ফার্সী ভাষায় প্রতিশব্দ দিয়া, এবং পারসিক সুফী-সাহিত্য হইতে অনুরূপ বচন উদ্ধৃত করিয়া, মুসলমান জগতের পক্ষে সহজে বেদান্ত বুঝিবার উপায় করিয়া দিলেন। এই গ্রন্থের নাম মজমুয়া-উল-বহরাইন্ অর্থাৎ “দুই সমুদ্রের সঙ্গম” তাঁহার এই উদার মিলন-চেষ্টার প্রমাণ দিতেছে।

ইতিহাস-রচনা

ঐতিহাসিক সাহিত্য ভারতে যে মুসলমানদের দান তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই, এবং এই দান যে কত মূল্যবান তাহা যাঁহারা এ বিষয় চর্চ্চা করিয়াছেন তাঁহারাই পূর্ণমাত্রায় বুঝিতে পারেন। হিন্দুদের পার্থিব ঘটনার ইতিহাস লিখিবার এবং সময়ের হিসাব রাখিবার অভ্যাস, এমন কি প্রবৃত্তি পৰ্য্যন্ত ছিল না। (ইউয়ান্ চুয়াং কথিত “নীলপীত” বৃত্তান্তের কোন প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় নাই।) আমরা অকালের ধ্যানে এত মগ্ন যে কালের গতির প্রতি দৃষ্টিই রাখি না। এই বেদান্তিক জাতির নিকট মানুষের পার্থিব জীবন যেন একটা সরাই, অথবা যেমন-

নানাপক্ষী এক বৃক্ষে
নিশীথে বিহরে সুখে,
প্রভাত হইলে সবে
কে কোথায় উড়ে যায়!

অতএব এ সংসারে কি ঘটিল, কে কি করিল, তাহার বিবরণ রক্ষা করা, এমন কি তাহার দিকে মন দেওয়াও অমূল্য মানব জীবনের অপব্যয়মাত্র, নিজ চরম লক্ষ্য হইতে ভ্রষ্ট হওয়া। এই মনোবৃত্তির ফলে মুসলমান আসিবার পূৰ্ব্বে হিন্দুরা ইতিহাস লেখে নাই; রাজার স্তুতির প্রশস্তি বা অতিরঞ্জিত কাব্য কিছু কিছু আছে, কিন্তু তাহা ইতিহাস নহে, তাহাতে তারিখ নাই বলিলে হয়; এবং শকাবলী (chronology) শ্রেণীর গ্রন্থ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু আরবেরা খুব হিসাবী লোক, বাস্তব জিনিসের প্রতি সর্ব্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখে; এজন্য তাহারা ইস্লামের আদি যুগ হইতে ঘটনার ইতিহাস, শকাবলী এবং জীবনী লিখিয়া গিয়াছে, এবং তাহাদের কাহিনীতে প্রচুর পরিমাণে তারিখ দেওয়া। প্রত্যেক দেশেই মুসলমানগণ বিপুল ঐতিহাসিক সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছে, সেগুলি উচ্চ দার্শনিক চিন্তায় বা বিশ্লেষণে পূর্ণ না হইলেও, শ্রেণিবদ্ধভাবে সুসজ্জিত, বাস্তব ঘটনার ভিত্তির উপর গঠিত, অনেকস্থলে লেখকের নিজ অভিজ্ঞতা বা অনুসন্ধানের ফল, এবং প্রকৃত ইতিহাসের ভাষায় ও প্রণালীতে রচিত। অতীত যুগের ঘটনাপরম্পরা কার্য্যকারণ-সম্বন্ধ ও দেশের দশা সত্যরূপে জানিবার পক্ষে এগুলি অমূল্য এবং একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য উপকরণ। এইসব মুসলমান রচিত গ্রন্থ হইতে আমরা সে সময়কার হিন্দুজাতির এবং পার্শ্ববর্তী হিন্দুরাজাদের পৰ্য্যন্ত সত্য কাহিনী জানিতে পারি। ক্রমে এই দৃষ্টান্ত হিন্দু লেখকগণ অনুকরণ করিতে শিখিলেন, মুঘল যুগে অনেক হিন্দু ফার্সী ভাষায় ইতিহাস, জীবনী, ঐতিহাসিক পত্রাবলী লেখেন। এবং হিন্দুরাজগণও মুঘল বাদশাহদের অনুকরণে নিজ কীর্তিকলাপ এবং বংশচরিত রচনা করাইলেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারত এই কারণে আমাদের নিকট অতি বিশদভাবে পরিচিত হইয়া আছে, তাহাদের পূর্ব্ববর্ত্তী কোন শতাব্দী ইহার সিকির সিকি পরিমাণ ঐতিহাসিক উপকরণও রাখিয়া যায় নাই। প্রত্যেক মুঘল বাদশাহ এবং তাঁহাদের পূর্ব্বের সুলতানগণের মধ্যে অনেকেই নিজ নিজ রাজত্বের ঘটনা লিপিবদ্ধ করিবার জন্য বেতনভোগী লেখক রাখিতেন এবং তাহাদের সব সরকারী কাগজপত্র দেখাইয়া ঐ ইতিহাসগুলিকে বাস্তব ভিত্তি দান করিতেন। এই সাহিত্য এদিকে হিন্দুদের চোখ ফুটাইয়া দিল।

সভ্যতার বৃদ্ধি ও প্রচার

শত শত বৎসর মুসলমান রাজত্বের ফলে ভারতীয় সভ্যতা নানা দিকে বিস্তৃত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে। শিকার, বাজপক্ষী দিয়া অন্য পাখী মারা, নানা প্রকার খেলা এখনও তাহাদের মুসলমানী শব্দাবলী ও প্রণালী রক্ষা করিয়া এই বাহ্য প্রভাবের সাক্ষ্য দিতেছে। অসংখ্য ফার্সী তুর্কী ও আরবী শব্দ চলিত হিন্দী, বাঙ্গলা ও মারাঠী ভাষায় ঢুকিয়া তাহাদের স্থায়ী অংশ হইয়া রহিয়াছে মুসলমান যুগে রণনীতি খুব বেশী উন্নতি লাভ করে, কারণ ভারতীয় মুসলমানগণ বাহিরের গতিশীল ইস্লামীয় জগতের সঙ্গে সদা সংশ্রব রাখিত এবং তথাকার জ্ঞানের উন্নতির ভাগ পাইত। শেষে, স্বাধীন হিন্দুরাজারা মুঘল যুদ্ধ-পদ্ধতি ও অস্ত্রসজ্জা অনুকরণ করিতে লাগিলেন, মুসলমান সেনানী ভাড়া করিতে লাগিলেন। এই যুগে বারুদ ও কামানের ব্যবহার প্রথম আসিল, এবং তাহার অনিবার্য্য ফলে দুর্গ-রচনার প্রণালী সম্পূর্ণ বদলাইতে হইল। প্রাচীন হিন্দুযুগে যুদ্ধে গজের স্থান ছিল শ্রেষ্ঠ, এখন অশ্বারোহী সৈন্য প্রধান হইয়া উঠিল, আর হাতী শুধু সর্ব্বোচ্চ নেতার চড়িবার এবং শিবিরের বোঝা বহিবার বাহনে পরিণত হইল।

শুধু যুদ্ধের সরঞ্জাম ও প্রণালীতে, শাসনবিধি ও কর্মচারিবৃন্দের বিভাগ এবং নামকরণে, রাজসভার আদব-কায়দাতে নহে- বিলাসিতায়, অট্টালিকা-নিৰ্ম্মাণে, উদ্যান-রচনায়, উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের সর্ব্ববিধ বাহ্য জীবনে মুসলমান প্রভাব বিজয়ী হইয়া, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্য্যন্ত চলিয়া আসিয়াছিল; এই সেদিন মাত্র আমরা ব্রিটিশের অনুকরণ আরম্ভ করিয়াছি; আর মুঘল-প্রভাবের অর্দ্ধশশী অস্তমিত হইয়াছে।

অনেক শিল্প, অনেক কলাবিদ্যা মুসলমান যুগের দান-স্বরূপ ভারতে স্থান পাইয়াছে; তাহার মধ্যে কাগজ-নির্ম্মাণ এবং কাগজের পুঁথির পাতায় ছবি আঁকার প্রতি বিশেষ করিয়া পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আবশ্যক। আর সব দৃষ্টান্ত সকলের সহজেই স্মরণ হইবে, সেগুলি আজও নানা দিকে আমাদের নিত্য ব্যবহারে আসিতেছে।

[প্রবাসী, ভাগ ৩০, খণ্ড ১, সংখ্যা ৬, আশ্বিন, ১৩৩৭।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *