আওরংজীবের সাতারা অবরোধ

আওরংজীবের সাতারা অবরোধ

সম্রাট আওরংজীবের জীবনের শেষ আট বৎসর মহারাষ্ট্রের দুর্গ অবরোধ করিতে কাটিয়া যায়। এ কাজের অন্ত ছিল না, ফললাভ হয় নাই; এত সময় অর্থ ও সৈন্যগণের জীবন ব্যয় করিয়া শেষে কিছুই হাতে আসিল না, শুধু বাদশাহ নিজের জীবন নষ্ট করিলেন, মুঘল সৈন্য ক্লান্ত ভীত ধ্বংসপ্রাপ্ত হইল, রাজকোষ শূন্য, সাম্রাজ্য চূর্ণ হইল।

এইসব দুর্গ অবরোধই এই আট বৎসরের বাদশাহী দরবারের ইতিহাস; আর সব অবরোধগুলির কাহিনী প্রায় এক প্রকার। ইহার মধ্যে যে কোন একটি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিলে, অপরগুলির ইতিহাস পড়া আবশ্যক হয় না।

সাতারা অবরোধে আওরংজীবের সাড়ে চারিমাস কাল, বা ঠিক ১৩৪ দিন, (৮ই ডিসেম্বর ১৬৯৯ হইতে ২১শে এপ্রিল ১৭০০ পৰ্য্যন্ত) লাগিয়াছিল। এই কয়মাসের দরবারের সৈনিক সংবাদপূর্ণ পত্র (‘আখবারাৎ-ই দরবার-ই-মুয়ালা) আমাদের হস্তগত হইয়াছে। পাওয়া যায় নাই কেবল রমজান মাসের (১০ ফেব্রুয়ারি-১০ই মার্চ ১৭০০) সংবাদপত্রগুলি; কারণ রমজান মুসলমানদের উপবাসের মাস, এ সময়ে বড় একটা কোন কাজ-কৰ্ম্ম হয় না। এইসব দৈনিক সংবাদপত্রের সাহায্যে, সাতারা অবরোধ কালে রাজদরবারের অবরোধকারীদের শিবিরের, বাহিরের মারাঠাদের কার্য্যকলাপের ও দুর্গমধ্যস্থ শত্রুসৈন্যের সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সংগৃহীত সংবাদপত্রের মধ্যে অপর মাসগুলির কোন কোন তারিখের লিপি নাই; এগুলির অভাব এবং সংগৃহীত পত্রগুলিতে কোন কোন অংশে সংবাদপত্রের অল্পতা ফার্সী সরকারী ইতিহাস মাসির-ই–আলমগীরীর দ্বারা অনেকটা পরিপূরণ হইতে পারে। বাদশাহ আওরংজীবের মৃত্যুর পরই তাহার মুনশী ইনায়েৎ উল্লার অনুরোধে, দিল্লীর রাজকীয় দপ্তরের কাগজপত্র পড়িয়া সাকী মুস্তাক খাঁ এই সরকারী ইতিহাস রচনা করিয়াছিলেন।

এই সব সমসাময়িক দলিল অবলম্বনে সাতারা অবরোধ কাহিনী এখন সবিস্তারে নূতন করিয়া লেখা যাইতে পারে। এগুলি এমনই সুসম্বন্ধ যে, দৈনিক ঘটনার গতি কখন কোন দিকে প্রবাহিত হইয়াছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়। মনে হয়, ঘটনাগুলি যেন আমাদের চোখের সামনে ঘটিতেছে-আমরা যেন সেই যুগেরই লোক।

সাতারা অভিযানে আওরংজীবের মতো অসাধারণ প্রতিভাশালী, উদ্যোগী পুরুষ-সিংহ ও বিচক্ষণ পরিপক্ক যুদ্ধনেতার দ্বারা চালিত হইয়াও মুঘল বাহিনী মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধে তেমন সুবিধা করিয়া উঠিতে পারে নাই; ইহা মুঘল সৈন্যের অযোগ্যতার অকাট্য প্রমাণ। চতুর আওরংজীবের লোক চিনিবার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল; তিনি স্বীয় সেনা সামন্তদের অযোগ্যতা সম্বন্ধে যে অভিমত প্রকাশ করেন, তাহা ২৯শে শবান তারিখের সংবাদপত্রে এইরূপে বর্ণিত হইয়াছে;-’রাত্রি এক প্রহর চারি ঘড়ির সময় সম্রাট প্রধান কাজী মুহম্মদ আক্রমকে তলব করিলেন। কাজী আসিয়া দরবারের এক কোণে বসিলে, সম্রাট সিংহাসন ছাড়িয়া, তাঁহার পাশে গিয়া (গালিচার উপর) বসিয়া তাঁহাকে বলিলেন-’শোলাপুরে বসিয়া খোদার নাম করিয়া রমজান মাসটা কাটাইব ভাবিয়াছিলাম; কিন্তু সেনাপতিরা আমার কাজে গা দেয় না- বার বার তাহাদের তাগিদ করিয়াও কোন ফলোদয় হয় না।’ দুই ঘড়ি কাল এইভাবে কর্ম্মচারীদের বিরুদ্ধে অনুযোগ করিয়া, সম্রাট কাজীকে বিদায় দিলেন।’ এখন সাতারা অবরোধের কথা আলোচনা করিব।

ব্রহ্মপুরী গ্রাম ভীমা নদীর তটে। বাদশাহ তাঁহার সভা ও সৈন্য সহিত অনেকদিন এখানে অবস্থান করায় ব্রহ্মপুরী ক্রমে রীতিমত সহরে পরিণত হইয়াছিল। ‘ব্রহ্মপুরী’ হিন্দুনাম, গোঁড়া মুসলমান আওরংজীব ইহা সহ্য করিতে পারেন নাই; তাই তিনি ইহার নূতন নাম করিয়াছিলেন-’ইস্লামপুরী’। চারি বৎসর ইস্লামপুরীতে কাটাইয়া বাদশাহ ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে অক্টোবর তারিখে মারাঠা দুর্গগুলি দখল করিবার জন্য স্বয়ং যাত্রা করিলেন। ৩০শে নভেম্বর তিনি হঠাৎ সাতারা অভিমুখে অগ্রসর হইলেন; রূহুল্লা ও হমীদ-উদ্দিন–এই দুই বিখ্যাত সেনাপতি পানহালা ও সাতারার মাঝামাঝি জায়গাটা মরুভূমিতে পরিণত করিবার আদেশ পাইয়া আগেই রওনা হইয়াছিলেন– বাদশাহ এখন তাহাদিগকে সাতারা দুর্গের দিকে ফিরিয়া আসিতে বলিয়া পাঠাইলেন।

সাতারা একাধারে মারাঠাদের রাজধানী ও অস্ত্রাগার ছিল। ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী ইহা দখল করিয়া ইহাকে নিজ প্রিয় বাসস্থান করেন। সাতারা চমৎকার স্বাস্থ্যকর স্থান বটে, কিন্তু শিবাজীর পক্ষে প্রধান আকর্ষণ ছিল যে তাঁহার শুরু রামদাস তিন ক্রোশ দূরে পড়লী পর্ব্বতে বাস করিতেন, এবং শূন্যের মধ্য দিয়া শিবাজীর সহিত কথোপকথন করিতেন। যখন আমি এই দুর্গ দর্শন করি, আমার পথ প্রদর্শক (একজন মারাঠা-সৈন্য) দুর্গদ্বারের উপরে একটি বাঁধানো আসন দেখাইয়া দিয়া বলিল যে এখানে সন্ধ্যাবেলায় ছত্রপতি শিবাজী বসিতেন এবং ছয় মাইল দূরে গুরুর সহিত দৈববলে প্ৰশ্ন উত্তর পরামর্শ করিতেন। আওরংজীবের অবরোধের সময় মারাঠা-রাজা রাজারামের দপ্তর ও শাসন-বিভাগগুলি এই দুর্গে স্থাপিত ছিল।

সাতারা দুর্গের উপরিভাগ, সমতল পাদদেশের সমভূমি হইতে ৯০০ ফিট উঁচু। পৰ্ব্বতচূড়া ত্রিকোণ, পূৰ্ব্ব পশ্চিমে ১১০০ গজ লম্বা, এবং উত্তর দক্ষিণে ৬০০ গজ। একেবারে খাড়া ৪০ ফিট উঁচু কৃষ্ণ পাথর এই দুর্গের ভিত্তি, তাঁহার উপর পাথর গাঁথিয়া ২০ হাত দেওয়াল। এই দেওয়ালের উপর ভিতর দিকে সৈন্য চলিবার জন্য একটি আলিসা এবং তাহাদের রক্ষা করিবার জন্য অপেক্ষাকৃত কম চওড়া আর একটি দেওয়াল (breast work) এই শেষোক্ত দেওয়ালে গুলি চালাইবার জন্য ছিদ্র আছে। দুর্গের দুটি দরজা; দক্ষিণ দিকেরটি অত্যন্ত খাড়া পাহাড় এবং উঁচু সিঁড়ির উপর স্থাপিত, ইহা কম ব্যবহার হইত। উত্তর দেওয়ালে স্থাপিত দরজাটি বড় সুরক্ষিত, এবং প্রায় সব কাজের জন্য ইহার ভিতর দিয়াই যাতায়াত হইত।

দুর্গের দেওয়াল ১০ ফিটেরও অধিক পুরু এবং উপরকার প্যারাপেট বা প্রস্তরের বেড়া দুই হাত উঁচু ও দুই হাত চওড়া। দুর্গের মধ্যে পাথর কাটিয়া নয়টি পুকুর করা হইয়াছে, তাহা সৰ্ব্বদাই জলে পূর্ণ থাকে।

সাতারা পর্ব্বতের উত্তর-পশ্চিম কোণের একটু দূরেই যাতেশ্বর পৰ্ব্বত, এবং ৬ মাইল পশ্চিমে পড়লী দুর্গ (১০৪৫ ফিট উঁচু), আওরংজীবের সময়ে সাতারার প্রধান দরজা ছিল ‘মঙ্গলাই’, এটা দেওয়ালের উত্তর-পূর্ব্ব কোণের একটু পশ্চিমে, এখন ইহা গাঁথিয়া বন্ধ করা হইয়াছে। আধুনিক প্রধান দরজা দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণের কাছে; এটি সুপ্রশস্ত এবং সুগম্য চওড়া পথ বহিয়া এখানে পৌঁছান যায়। দুর্গমধ্যে মারাঠা-রাজাদের প্রাসাদ এখনও দাঁড়াইয়া আছে, যদিও গত শতাব্দীতে ইংরাজ সৈন্য থাকার সময় ঘরগুলিতে অনেক পরিবর্তন করা হইয়াছিল। একধারে একটি পৃথক ঘরে, পাথর খুঁড়িয়া দুটি প্রকাণ্ড গর্ত করা হইয়াছে, এখানে কি (তুপ) জমা করিয়া রাখা হইত।

দুর্গচূড়া হইতে চারিদিকের দৃশ্য অতি চমৎকার। সাতারার চারিপার্শ্বে বাতাস খুব পরিস্কার বলিয়া এখানে ইংরাজরা বন্দুক চালান শিখিবার বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছেন। আওরংজীবের অবরোধের সময়ে চারিদিকে বর্জ ছিল, সেখানে মুঘলেরা বাঘ ও হরিণ শিকার করিত। দুর্গের বাগানে চামলী ফুল ফুটিত। বাহিরে তরমুজ জন্মিত। এসব ছোট ছোট সংবাদ আমরা সেই ফার্সী ‘আখবার’ হইতে পাই।

যুবরাজ আজম্ শাহ ও খোদবান্দা খাঁ, পড়লী দুর্গ এবং সাতারার পশ্চিম দিকে অবস্থিত যাতেশ্বর পর্ব্বতের মাঝামাঝি জায়গায় নিজ সৈন্য লইয়া বসিলেন; উত্তর দিকে মঙ্গলাই তোরনের সামনে বাদশাহী গোলন্দাজ সৈন্যের নেতা তরবিয়ৎ খাঁ ও তাঁহার দক্ষিণে মুমিন খাঁ স্থান লইতে আদিষ্ট হইলেন; দক্ষিণ পার্শ্বের সামনাসামনি রূহুল্লা খাঁ এবং তাঁহার পার্শ্বভাগে দক্ষিণাত্যের মুঘল গোলন্দাজ সৈন্যের নেতা মনসুর খাঁ। সম্রাটের শিবির পড়িল-দুর্গের উত্তর-পূর্ব্ব কোণের, দুই মাইল উত্তরে করঞ্জা গ্রামে।

সাতারার উত্তরে বসন্ত-গড় হইতে অগ্রসর হইয়া আওরংজীব ৮ই ডিসেম্বর (১৬৯৯) কৃষ্ণানদী পার হইলেন। নদীর মাঝামাঝি উপস্থিত হইলে, তক্ত-রওয়াঁ হইতে নামিয়া একটা টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া, এক টুকরা কাগজে খোদার নামে প্রার্থনা লিখিয়া, নদী গর্ভে ফেলিয়া দিলেন। সন্ধ্যার সময়ে তিনি সাতারা দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছিলেন এবং ঐ পাহাড়ের দুই মাইল উত্তর-পূর্ব্বে করঞ্জা গ্রামে ছাউনি করিলেন। এই স্থানটিকে চিহ্নিত করিয়া রাখিবার জন্য ব্রিটিশ সরকার এখানে একটি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।’ একখানা কাগজের দুর্গের ও আশপাশের ম্যাপ আঁকিয়া, তাহাতে সেনাপতিজনের শিবিরের স্থান চিহ্নিত করিয়া, সম্রাট তাঁহাদের শিবির স্থাপন করিতে উপদেশ দিলেন (১০ই ডিসেম্বর)।

৯ই ডিসেম্বর তারিখে অবরোধ কার্য্য আরম্ভ হইল। ৭ই তারিখে গোলন্দাজ সৈন্যের নেতা তরবিয়ৎ খাঁ সাতারা দুর্গের চারিপাশ ঘুরিয়া একটা নকশা আঁকিয়া লইয়াছিলেন, এবং কাঠুরিয়া (বলদার) দলের দারোগা হিরাচাঁদ, কুলী (কাহাড়) দলের দারোগা দুলার সাহায্যে গড়খাই খননের ও উঁচু দমদমা (raised battery) গঠন করিবার স্থানগুলি ঠিক করিয়া লইলেন। ৮ই তারিখ রাত্রে নকশাখানা সম্রাটকে দেখান হইলে তিনি সেনাপতিদের কে কোথায় থাকিবে, নির্দ্দেশ করিয়া দিলেন। তরবিয়ৎ খাঁ জানাইলেন, এই পাহাড়ে দেশে মাটি কাটিয়া গড়খাই প্রস্তুত করিতে বিশেষ শ্রম করিতে ও কষ্ট পাইতে হইবে।

তরবিয়ৎ খাঁ দুর্গের প্রধান তোরণ অভিমুখে সুড়ঙ্গ খনন করাইতে লাগিলেন, তোরণের পার্শ্ববর্তী বুরুজের সামনাসামনি দুর্গ প্রাচীর হইতে ১৩ গজ দূরে এক উঁচু দম্দমার নির্মাণ কার্য্য আরম্ভ হইল। দুর্গমধ্যে শত্রু সৈন্যের গোলাবারুদ প্রচুর ছিল। কি দিন কি রাত্রে তাহারা ঘন ঘন হাউই, বন্দুক, বোমা (হুক্কা) চাদর, মক ও মাওয়ালা ছুঁড়িতে লাগিল। (মাসির ৪১৪ পৃ:)। একদিন দুর্গ হইতে ৮০টা গোলা ছোঁড়া হয়; কিন্তু ইহাতে দুইজন মজুরের মৃত্যু ছাড়া মুঘলদের আর কোন ক্ষতি হয় নাই। মুঘলেরা এই উঁচু জায়গার উপর ‘কড়ক্ বিজলী “ নামে একটা বড় কামান বসাইয়া সাতারা দুর্গের বুরুজের উপর গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল; হাউই ছুঁড়িয়া দুর্গে ফেলিতে লাগিল। কিন্তু বাদশাহী গোলন্দাজদের লক্ষ্য ছিল না; তাই কামান হইতে উদগীর্ণ পাথরের গোলা অনেকবার লক্ষ্যস্থলে না পড়িয়া কুমার আজম শাহর শয়নের তাঁবুর নিকট পড়িয়াছিল! সম্রাট দেখিলেন কুমারের নিরাপদের জন্য কামানটা স্থানান্তরে সরান প্রয়োজন; কিন্তু কামান বসাইবার জন্য উঁচু জায়গা না পাওয়ার হুকুম দিলেন, যেন অধিকতর সাবধানে কামান দাগা হয়! (২৯শে জানুয়ারি) দুইদিন পরে কুমার আজমের শিবির সীমার মধ্যে দুর্গ হইতে নিক্ষিপ্ত আ-ফাটা একটা বোমা পাওয়া গেল; সম্রাট ইহা পরীক্ষা করিয়া নিজ গোলন্দাজ বিভাগকে ঠিক এই ধরণের বোমা তৈয়ার করিতে বলিলেন।

কিন্তু চারিদিক ভালরূপ অবরুদ্ধ না হওয়ায়, শত্রুরা দুর্গে যাতায়াত করিতে পারিত। পড়লীর দিকে, অর্থাৎ পশ্চিম দিকটার, তেমন কড়া পাহাড়া ছিল না; তাই কুমার আজমের সতর্কতার উপর সম্রাটের সন্দেহ জন্মিল। বাহির হইতে নূতন সৈন্য ও খাদ্য দুর্গমধ্যে ঢুকিতেছে। কুমার নিশ্চয়ই এসব দেখিয়া দেখিতেছেন না, এরূপ কথা উঠিল। এদিকটা আরও সতর্কতার সহিত রক্ষা করিবার জন্য পড়লীর নিকট এক থানা বসিল; থানার চারিধার গাছের ডালপালা, কাঁটাগাছ দিয়া বেড়া (খার-বন্দী) দিয়া ঘেরা হইল (১৩ই ডিসেম্বর)। ৬ই জানুয়ারি সম্রাট শুনিলেন, শত্রুরা দুর্গ হইতে বাহির হইয়া, রূহুল্লা খাঁর গড়খাই অতিক্রম করিয়া কুমার আজমের শিবিরের নিকটবর্তী পর্ব্বতগাত্রের এক ঝরনা হইতে দুর্গমধ্যে জল লইয়া যায়। তাঁহার আদেশে ১৩ই তারিখে কুমারের একদল সৈন্য সেই ঝরনাটাকে আটক করিল।

অবরুদ্ধ শত্রু সৈন্যেরা দুর্গ হইতে বাহির হইয়া প্রায়ই মুঘলদের অতর্কিত আক্রমণ করিত। ১১ই ডিসেম্বর তাহারা মুমিন খাঁর গড়খাই-এর উপর আসিয়া পড়িল। কিন্তু মুমিন খাঁ সজাগ সতর্ক ছিলেন;– তাহাদিগকে বিতাড়িত করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই। পাঁচ দিন পরে মধ্যরাত্রে শত্রুরা এই স্থানটা পুনরায় আক্রমণ করিল। মুমিন্ খাঁ, সত্বাজী দাফলের পুত্র ও অন্যান্য সকলে কাষ্ঠ প্রাচীরের (কাঠগড়ার) নিকট দাঁড়াইয়া, বিশেষ বিক্রমের সহিত একঘণ্টা যুদ্ধ করিলেন। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের অনেক লোকক্ষয় হয়, যাহারা প্রাণে বাঁচিল, তাহারা রাত্রের অন্ধকারে সরিয়া পড়িল। মুঘল পক্ষে মুমিন্ খাঁ শত্ৰুনি- ক্ষিপ্ত একখানা পাথরে আঘাত পাইয়াছিলেন; তাঁহার সঙ্গীদের অনেকে আহত হইয়াছিল। ৩

মারাঠারা বিপুল আয়োজনে মুঘলদের উপর ১লা এপ্রিল চড়াও করিবার মতলব আঁটিল। রাত্রে একদল শত্রু সৈন্য পড়লী হইতে সাতারা দুর্গের সৈন্যগণকে সাহায্য করিবার উদ্দেশ্যে আসিতেছিল; কিন্তু রূহুল্লা ও ফহ্-উল্লা মধ্য পথে বাধা দেওয়ায়, তাহারা অনেক লোকজন ক্ষয় করিয়া পলায়ন করে। পরদিন বেলা দুইটার সময় ৩০০ শত্রু সৈন্য সাতারা হইতে বাহির হইয়া বিশেষ বিক্রমের সহিত ফত্-উল্লার গড়খাই-এর উপর পতিত হয়, এবং দু’একটা কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত কাজ্‌ওয়াo ভাঙ্গিয়া ফেলে। কিন্তু অবশেষে পলাইয়া আত্মরক্ষা করিতে বাধ্য হয়। খাঁ শত্রু-নিক্ষিপ্ত একখানা পাথরে আহত হইয়াছিলেন। শত্রুপক্ষের পাঁচজন মরিয়াছিল।

কিন্তু দুর্গের বাহিরের মারাঠা সৈন্যদল (Field armies) মুঘলদের বিশেষ ক্ষতির কারণ হইয়াছিল; প্রকৃতপক্ষে তাঁহারা সম্রাট শিবির ঘেরাও করিয়া রাখিয়াছিল। বিনা রক্ষীতে সম্রাটপক্ষের কেহ ঘোড়া গরুর খাদ্যান্বেষণে বাহির হইতে পারিত না। উচ্চপদস্থ প্রধানেরা পালাক্রমে এইসব আহারান্বেষী সৈন্যের নেতা হইয়া বাহির হইতেন।

শত্রুর উপদ্রবে নিকটবর্তী স্থান হইতে শস্য বা ঘোড়া-গরুর খাদ্য সরবরাহের পথ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল– ইহাই সম্রাট শিবিরের সর্ব্বপ্রধান বিপদ হইয়াছিল। ব্যবসায়ী শস্য বাহকদের (বঞ্জারা) গরু, এমন কি সরকারী হাতী উট ও শিবিরের চৌহদ্দি অতিক্রম করিলেই শত্রুরা সেগুলি হস্তগত করিয়া সরিয়া পড়িত।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তরবিয়ৎ খাঁ দুর্গের ১৩ গজ দূরবর্তী স্থান পৰ্য্যন্ত গড়খাই করাইলেন, এবং তথায়, দুর্গের ঠিক সামনে, ২৪ গজ উঁচু এক দম্দমা (raised battery) গাঁথিয়া তুলিলেন। এই কার্য্যে তাঁহার এত কাঠ লাগিয়াছিল যে, সাতারার ৩০/৪০ ক্রোশ পথের মধ্যে কোন গাছপালার চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রহিল না। (মাসির ৪১৪)। দম্দমার চারিদিকে শত্রুর অস্ত্রশস্ত্র হইতে বাঁচাইতে পারে, এরূপ দেওয়াল গড়িবার জন্য, বাজার হইতে আট হাজার খালি থলে লইয়া, বালি ভরিয়া, সাজান হইল। দম্দমা গড়িবার কাঠ বহিয়া আনিবার জন্য ৩০০ গরু নিযুক্ত হইল।

শত্রুরা ইহা ধ্বংস করিয়া দিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইল। ৯ই ফেব্রুয়ারি রাত্রে তাহারা ইহার উপর অজস্র পাথর বর্ষণ করিতে লাগিল; ইহার ফলে একজন হত, চারিজন আহত এবং চারিদিকে আবরণ-যুক্ত তিনটি উটের হাওদা ধ্বংস হইয়া যায়। সম্রাট হুকুম দিলেন-”দমদমা বাঁচান চাই। সরকারী তোষাখানা ও পোদ্দারদের শূন্য থলি পাথর বালিতে ভরিয়া, খাড়া করিয়া দেওয়ালের কাজ চালাও।”

দুর্গমধ্যস্থ শত্রুর অবিরাম পাথর নিক্ষেপের ফলে তরবিয়ৎ খাঁ দেখিলেন, আর মাটি কাটিয়া অধিক দূর অগ্রসর হওয়া অসম্ভব; তিনি তখন দুর্গ প্রাচীর পর্য্যন্ত পৌঁছিবার জন্য এক সুড়ঙ্গ পথ প্রস্তুত করাইতে লাগিলেন। নিকটবর্ত্তী বন-জঙ্গল হইতে কাঠ আনিতে হইবে; গোলন্দাজ-বিভাগের মুশরিফ –কুঞ্জমনের উপর এই কার্য্যের ভার পড়িল। রক্ষীর সাহায্যে তিনি দুই হাজার উট লইয়া অবিলম্বে বাহির হইবার জন্য আদিষ্ট হইলেন।

খোঁড়া মাটি ও পাথর দিয়া সুড়ঙ্গের দুপাশে দেওয়াল তুলিয়া, আঁকাবাঁকা পথ নির্ম্মিত হইলে মাথার উপর মই-এর সিঁড়ির মতো তক্তা বিছান হইল। এই কাষ্ঠমঞ্চ তৈয়ার করিতে হাজার উটের হাওদা, নিকটবর্ত্তী সমতল ভূমি হইতে আনীত কাঠ, বস্তা বস্তা সোন (flax), এমন কি টাকায় ৪ গজ দামের সূতার কাপড় লাগান হইয়াছিল। (মাসির ৪১৫ পৃ.)। সুড়ঙ্গপথ এরূপ ভাবে নিৰ্ম্মিত হইল যে, দুর্গ হইতে শত্রু সৈন্য গোলা ছুঁড়িলেও তাহা কাষ্ঠমঞ্চ ভেদ করিয়া সুড়ঙ্গমধ্যে প্রবেশ করিতে না পারে।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ২৪ গজ পাথুরে মাটি কাটিয়া সুড়ঙ্গ দুর্গপাদমূলে পৌঁছান হইল। কিন্তু এই সমস্ত আয়োজন দুর্গ জয় করিবার পক্ষে যথেষ্ট বলিয়া বিবেচিত হইল না। তবে মুঘলদের পক্ষে একটি লাভ হইয়াছিল, –তাহারা দম্দমার উপর কামান তুলিয়া বসাইতে পারিয়াছিল। ইহার ফলে শত্রুরা আর দুর্গপ্রাচীরের উপর হইতে বন্দুক ছুঁড়িতে পারিত না;- দেওয়ালের পিছনে মুখ লুকাইয়া, পাথর ছুঁড়িত। ৩রা এপ্রিল দম্দমাকে বাড়াইয়া দুর্গ-প্রাকারের সমান উঁচু করা হইল।

মুঘলেরা একবার মই-এর সাহায্যে দুর্গপ্রাচীর লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল; কিন্তু সফলকাম হইতে পারে নাই। তাহারা ‘দুর্গ দখলে সিদ্ধহস্ত দুই হাজার মালে পদাতিক সৈন্য নিযুক্ত করিয়াছিল। সাতারা দুর্গ বলে অধিকার করিয়া দিতে প্রতিশ্রুত হওয়ায় তিন বৎসরের মাহিনা-এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার টাকা– তাহাদের অগ্রিম দেওয়া হইয়াছিল। দুর্গ আক্রমণের জন্য মই, চামড়ার থলি প্রভৃতি সংগ্রহ করা হইল। ২৩শে জানুয়ারী প্রভাতের একঘণ্টা পূর্ব্বে মালেরা দুর্গ-প্রকারে মই লাগাইয়া ভিতরে ঢুকিবার চেষ্টা করিল। ঠিক এই সময়ে অন্য একটি দুর্গ হইতে দুইশত মারাঠা-পদাতিক সৈন্য সাতারার সৈন্যজনকে সাহায্য করিবার জন্য আসিতেছিল। সম্রাট সৈন্যদের দেওয়াল লঙ্ঘন করিতে দেখিয়া, তাহারা চীৎকার করিয়া দুর্গের সেনাসান্তীদের জাগাইয়া দিল। ব্যর্থকাম মালেরা তখন নবাগত মারাঠা সৈন্যদলকে সবেগে আক্রমণ করিয়া, তাহাদের পাঁচজনকে মারিল– ১৪জনকে বন্দী করিল। কিছুদিন পূর্ব্বে একদল মুঘল সৈন্য চন্দন-বন্দন দুর্গের নিম্নে, রাস্তার পাশে লুকাইয়া থাকিয়া তিনজন শত্রুকে বন্দী করিয়াছিল। তাহাদের এবং এই রাত্রে ধৃত ১৪ জন মারাঠা-সম্বন্ধে সম্রাট হুকুম দিলেন–”সবকয়জন বন্দীকে কৃষ্ণা নদীর বক্ষে লইয়া গিয়া কাটিয়া ফেল।” এই বন্দীদের মধ্যে একটি বালক ছিল। কাজীকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি জবাব দিলেন কুরানের বিধি মতে তাহারও প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত। বন্দীরা সকলেই তলোয়ারের মুখে প্রাণ দিল। কেবল বাঁচিয়াছিল চন্দন-বন্দন দুর্গের কিলাদারের পুত্র। পুত্রের প্রাণরক্ষা করিলে দুর্গপতি সম্রাট-সৈন্যের হাতে দুর্গ ছাড়িয়া দিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন।

হামীদ উদ্দীন খাঁন আহকাম-ই আলমগীরী গ্রন্থ (Anecdotes of Aurangzib)-এ ঘটনারই এইরূপ বিবরণ আছে:-

“সাতারা অবরোধের সময়, পবিত্র রমজান মাসে একদল শত্রু হঠাৎ দুর্গ হইতে বাহির হইয়া সম্রাট-সৈন্য আক্রমণ করে। তাহাদের মধ্যে চারিজন মুসলমান ও ছয়জন হিন্দু বন্দী হয়। সম্রাট দরবারের কাজী মুহম্মদ আক্রমকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, মুক্তিগণের সাহায্যে বন্দীদের কিরূপ সাজা হওয়া উচিত, তাহা স্থির করিয়া বলিবেন। ধৰ্ম্মশাস্ত্র উল্টাইয়া কাজী সম্রাটকে লিখিয়া জানাইলেন যে, বন্দী কাফেরগণ মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিতে চাহিলে তাহারা মুক্তি পাইতে পারে। আর মুসলমান বন্দীদের তিন বৎসর কারাবাস হওয়া উচিত।

“এই পত্রের একপাশে শাহানশাহ্ লিখিলেন,–‘হনফি মতে এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। কিন্তু এই বিচার সমীচীন নহে; রাজার উপর কর্তৃত্ব নষ্ট না হয়, এজন্য এই মোকদ্দমার অন্যরূপ বিচার হওয়া উচিত। আমরা গোঁড়া শীয়া মতাবলম্বী নই যে, এক গ্রামে একটি মাত্র গাছ, একথা মানিয়া লইব (অর্থাৎ কেবল একটি মাত্র সিদ্ধান্তই আমাদের অবলম্বনীয় হইবে) খোদাকে ধন্যবাদ। সুন্নীদের চারি মত; তাহার প্রত্যেকটিই সময় কাল অনুযায়ী সত্যের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

“সম্রাটের এই মন্তব্য পড়িয়া কাজী ও মুক্তিগণ নূতন সিদ্ধান্ত করিয়া সম্রাটকে জানাইলেন, ফওয়া-ই-আলম-গীরী মতে আমরা স্থির করিয়াছি যে, যুদ্ধে বন্দী মুসলমানদের প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত, যেন তাহাদের শাস্তি দেখিয়া অন্যান্য শত্রুরা সাবধান হয়।’ তখন সম্রাট মন্তব্য লিখিলেন, ‘আমি ইহাতে সম্মতি দিলাম। সূর্যাস্তের পূর্ব্বেই বিদ্রোহীদের বধ করা হউক, তাঁহাদের ছিন্নমুণ্ড না দেখিয়া আমি রোজা খুলিব না; মুহরম খাঁ, কোতোয়াল সরবরাহ খাঁর সাহায্যে সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে বন্দীদের মস্তক ছিন্ন করিয়া আনিয়া, দরবারে সম্রাটের সামনে হাজির করিল।”

তরবিয়তের দিক হইতে দুর্গ-আক্রমণ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তাঁহার দুর্নাম হইবে। সম্রাট হুকুম দিলেন, রূহুল্লা খাঁর নেতৃত্বে দুর্গদ্বারের দিক হইতে অপর একটি গড়খাই করা হউক। একমাস পরিশ্রমের পর সুড়ঙ্গ দুর্গের পাদমূলস্থ মাটির দেওয়াল (রেডনী) স্পর্শ করিল। ইতিমধ্যে তরবিয়ৎ খাও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না- পূৰ্ব্ব সুনাম লাভ করিবার জন্য প্রাণপণ শ্রম করিতে লাগিলেন। তিনি দুর্গের পাষাণসাজান প্রাচীরে (সংচিন) একটি গর্ভ করিলেন- গৰ্ত্ত অবশেষে ৪ গজ ১০ গজ আকার ধারণ করিল। দুর্গস্থ শত্রুর এবং সম্রাট সৈন্যের মধ্যে শুধু এক গজ প্রশস্ত একটা পাতলা দেওয়াল ব্যবধান ছিল। সম্রাট-সৈন্য দেওয়ালের গর্ভের নিকট সজাগ সতর্ক অবস্থায় রহিল। কিন্তু কোন পক্ষই আড়ালের ব্যবধান অতিক্রম করিতে সাহস করিল না। শেষে মুঘলেরা সাব্যস্ত করিল যে, গর্ভে বারুদ ভরিয়া তাহাতে আগুন ধরাইয়া, দেওয়ালের খানিকটা উড়াইয়া দিবে, আর হুড়মুড় করিয়া দুর্গের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবে। (মাসির, ৪১৬ পৃ.)

সুড়ঙ্গের অগ্রভাগে যেখানে উহা দুর্গ স্পর্শ করিয়াছে, সেখানে, একটি বারুদ ঘর (mine) প্রস্তুত হইয়া গেল, (২৭ মার্চ)। তারপর পলিতা দ্বারা এই বারুদ-প্রকোষ্ঠের সহিত বাহিরে তরবিয়ৎ খাঁর সুড়ঙ্গ মুখের যোগ রাখা হইল। বারুদ-ঘরে আগুন দিবার পূর্ব্বে সম্রাট দমদমা ও বারুদ-প্রকোষ্ঠ সম্রাটের আদেশে বারবার পরীক্ষা করা হইল; কাজেই দুর্গ আক্রমণে বিলম্ব ঘটিল।

অবশেষে, বারুদ-ঘরে আগুন দিবার আদেশ হইল। ১৩ই এপ্রিল ভোরবেলা ভীমরবে প্রথম বারুদ-প্রকোষ্ঠ ফাটিয়া, দুর্গের খানিকটা কাঁচা দেওয়াল ভাঙ্গিয়া দিল। দুর্গমধ্যে সেই দেওয়ালের নিকট শত্রুরা অনেক অবস্থান করিতেছিল–ভাঙ্গা দেওয়াল তাহাদের উপর পড়িয়া অনেকের মৃত্যু ঘটাইল। গ্রান্ট ডফ্ যে মারাঠী বিবরণের সাহায্যে নিজ গ্রন্থ রচনা করেন, তাহাতে লেখা আছে, দেউড়ির নীচে পড়িয়া, দুর্গের হাবিলদার প্রাগজী প্রভুর জীবন্ত গোড় হইবার উপক্রম হইয়াছিল-শেষে মাটি খুঁড়িয়া তাঁহাকে জীবিত অবস্থায় বাহির করা হয়। কিন্তু ফার্সী ইতিহাস এ সম্বন্ধে নীরব।

দ্বিতীয় বারুদ-ঘর ফাটিয়া মুঘলদের ভয়ানক ক্ষতি করিল। দশগজ উঁচু ও ২০ গজ লম্বা দুর্গের একটি পাকা বুরুজ উড়িয়া গেল বটে, কিন্তু সম্রাটের আদেশে আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করিয়া দুর্গে ঢুকিবার জন্য যেসব মুঘল সৈন্য বুরুজের ঠিক নীচে ঠেসাঠেসি ভাবে অপেক্ষা করিতেছিল, ভাঙ্গা বুরুজের পাথর ও মাটি দুর্গের মধ্যে না পড়িয়া, একেবারে সবেগে তাহাদের উপরে পড়িল। ফলে সম্রাটের বহু অশ্বারোহী, পদাতিক, গোলন্দাজ, খাসচৌকী (bodyguards) আফঘান, গখর, কর্নাটকী ও অন্যান্য সৈন্য মরিল; যাহারা গর্ভে লুকাইয়া ছিল, তাহাদের গোর হইল; অনেকে হস্তপদ ছিন্ন হইয়া ভীমবেগে আকাশ মার্গে উৎক্ষিপ্ত হইল। প্রায় দুই হাজার বীর মুঘল রাজপুত এবং চারি পাঁচ শত মালে সৈন্য বিনষ্ট হইল। দ্বিতীয় বারুদ ঘরের পলিতায় আগুন দিবার সময় এই সমস্ত সৈন্যদের সরিয়া আসিবার জন্য কোনরূপ হুকুম না দেওয়াতেই এই দুর্ঘটনা ঘটে।

মুঘলপক্ষে বিশেষ ক্ষতি হইল বটে, কিন্তু দুর্গ প্রবেশের পথ সুগম হইল সম্রাটের জনকয়েক বীর পদাতিক সৈন্য, বিশেষত বাজী দালে” বিজাপুর জেলায় জাঠ নামক জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা, সত্বাজী দালের পুত্র), দুর্গ প্রাচীরের উপর চড়িয়া চেঁচাইয়া ডাকিতে লাগিল,–”এস,এস-শত্রুদের কেহই এখানে নাই।” কিন্তু কেহই তাহাদের সহযাত্রী হইল না। দুর্গ প্রাচীরের পতনের সময় গড়খাই-এ অবস্থিত যে সব মুঘল সৈন্য প্রাণে বাঁচিয়াছিল, ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া তাহাদের নড়িবার সামর্থ্য ছিল না। সুতরাং বাজী দালে ও তাঁহার সঙ্গী সৈন্যেরা কিছুই করিয়া উঠিতে পারিল না- অবশেষে শত্রুর হাতে প্রাণ হারাইল; কারণ মুঘলদের দুর্ঘটনা দেখিয়া সাহস পাইয়া, মারাঠারা দুর্গপ্রাচীরের ভাঙ্গা অংশের নিকট সবেগে ধাবিত হইয়া মুঘলদের যাহাকে পাইল, কাটিয়া কুচি কুচি করিল। কিছুক্ষণের জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে তীর ও বন্দুকের গুলি চালাচালি হইল। শত্রুরা দৃঢ়ভাবে বুরুজের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া মুখলিস খাঁ, তরবিয়ৎ খাঁ হমীদ উদ্দীন ও অন্যান্য যে কেহ দুর্গমধ্যে অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিতেছিল, তাহাদের হটাইয়া দিল।

যে সব মুঘল সৈন্য পাথর চাপা পড়িয়াছিল, তাহাদের অনেকের আত্মীয়-বন্ধুরা দুর্ঘটনার স্থলে উপস্থিত হইয়া, মৃতদেহ বা আহত লোকজনকে সরাইয়া, নিজেদের বাসায় লইয়া গেল। স্বজাতীয় সঙ্গীদের অনেককে হারাইয়া মালে সৈন্যেরা বিশেষ দুঃখিত হইয়াছিল; ‘মাটি ও পাথরের স্তূপের নীচে’হইতে সঙ্গীদের মৃতদেহ উদ্ধার করিতে অসমর্থ হইয়া তাহারা রাত্রিকালে কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত সেই আবৃত-পথে আগুন ধরাইয়া, হিন্দুমতে মৃতদেহের সৎকার করিল। বহু অর্থব্যয়ে নির্ম্মিত কাষ্ঠমঞ্চগুলি সাতদিন ধরিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল। (মাসির, ৪১৯ )

এই সময়ে মারাঠাদের রাজা রাজারামের মৃত্যু হয়। তাঁহার পাঁচ বছরের পুত্র শিবাজীকে প্রধানগণ পিতৃসিংহাসনে বসাইলেন, কিন্তু এই বালক-রাজাও বসন্তরোগে ধেলনায় মারা গেলেন। সম্রাট আওরংজীব মার্চ মাসে দুইজনেরই মৃত্যু সংবাদ শুনিতে পাইলেন। মারাঠা রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী পরশুরাম এক্ষণে সম্রাট পক্ষে যোগদান করিলেন। এই সংবাদে সাতারা দুর্গের কিলাদার সুভানজী হতাশ হইয়া পড়িলেন। হইবারই কথা। কারণ তরবিয়ৎ খাঁ দুর্গ প্রাচীরের ৭০ গজ ধ্বংস করিয়াছে; ফহ্-উল্লার গড়খাই দুর্গের প্রধান তোরণের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছিয়াছে– তাঁহার কামান দুর্গের উপর মুহূর্মুহূ গোলা বর্ষণ করিতেছে; শাহজাদা আজমের শিবির-সীমার পিছনে একটা ছোট পাহাড়ের উপর হইতে ‘মুলক-জব্‌ৎ’ নামক মুঘলদের প্রকাণ্ড কামান গোলা উদগীরণ করিয়া দুর্গমধ্যস্থ ঘরবাড়ী ধ্বংস করিয়া দিতেছে; দুর্গ-প্রাচীরের ভগ্নাংশ চাপা পড়িয়া মারাঠাপক্ষের চারিশত লোক মরিয়াছে। মারাঠা সেনাপতিদের অনেকেই সম্রাটপক্ষে যোগদান করিতেছে। আর কোন আশা নাই। দুর্গপতি তখন হতাশ হইয়া সম্রাটের ক্ষমা লাভের আশায়, মীয়ানজীকে শাহজাদার শিবিরে পাঠাইলেন। মাসির ৪২০ পৃ.। অনুকূল সত্ত দিয়া সম্রাট তাঁহার সহিত সন্ধি করিলেন।

২১শে এপ্রিল সাতারা দুর্গে পতপত শব্দে মুঘল পতাকা উড়িল। ইহার পূর্ব্বদিনে রুহুল্লা এবং তরবিয়ৎকে গড়খাই ত্যাগ করিয়া আসিতে বলা হয়। আর মতলব খাঁকে বলা হইয়াছিল, দুর্গদ্বারের সামনে হাজির থাকিয়া, যাহাতে দুর্গ হইতে বাহিরে আসিবার সময় মারাঠাদের কেহ বাধা না দেয়, সে বিষয়ে যেন তিনি লক্ষ্য রাখেন। মারাঠারা কিন্তু এইসব লোকজন দেখিয়া ভয় পাইয়াছিল। তাই শাহজাদার নিজ শরীর রক্ষীরা আসিয়া সেখানে থাকিল; তবে দুর্গবাসীদের মন আশ্বস্ত হইল। ২২শে তারিখে দুর্গের লোকজন সূর্যোদয়ের পাঁচ ঘণ্টা পরে দুর্গ ছাড়িয়া, শাহজাদার শিবিরের নিকট তাহাদের জন্য যে স্থান নিৰ্দ্দিষ্ট হইয়াছিল, সেখানে গিয়া থামিল। সূর্যাস্তের তিন ঘণ্টা পূর্ব্বে দুর্গপতি বাহির হইয়া আসিলেন; তিনি কুমারের নিকট হইতে ৪৪০ টাকা মূল্যের একটি দামী পদক উপহার পাইলেন। পরদিন তাঁহাকে সম্রাটের নিকট উপস্থিত করা হইলে, বাদশাহ তাঁহাকে পাঁচ হাজারী মনসবদার (দুই হাজার অতিরিক্ত সৈন্য) নিযুক্ত করিলেন– নানা উপহার ও নগদ ২০ হাজার টাকা দিলেন। দুর্গপতির সঙ্গী মারাঠা-সেনাপতিরাও সম্রাটের সৈন্যদলে যোগদান করিল।

কুমার আজমের মধ্যস্থতায় মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি হয় বলিয়া তাঁহার সম্মানার্থ সাতারা-দুর্গের নূতন নাম হইল–’আজম-তারা’। মুঘলদের শিবিরে শিবিরে জয়ধ্বনি উঠিল। নহবৎ আনন্দের সুর গাহিল। কুমার এবং নিকটে ও দূরদূরান্তের বাদশাহী কর্মচারীরা এই জয়লাভ উপলক্ষে সম্মান দেখাইবার জন্য সম্রাটকে বহু উপঢৌকন পাঠাইলেন।

[প্রভাতী, ভাগ ১, নং ১, নিদাঘ সংখ্যা, ১৩২৭।]

* ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লীতে রেকর্ড কমিশনের অধিবেশনে পঠিত ইহাতে গড়খাই শব্দ trench অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে–দুর্গ পরিখা অর্থে নহে।

১। এই স্তম্ভটি করঞ্জা গ্রামের পশ্চিমে এবং পুনা সাতারা রোডের উত্তরে অবস্থিত।

২।আমার পুঁথিতে ভ্রমক্রমে ‘কড়ক আলি’ লেখা আছে।

৩। ১৭ই ডিসেম্বর তক্ত রওয়ায় (খোলা পালকীর মতো সিংহাসনে) বসিয়া সম্রাট তরবিয়ৎ খাঁর, গড়খাই-এর পিছনে তাঁহার জন্য পাতা, তাঁবুর দিকে গেলেন। তাঁবুতে না ঢুকিয়া তিনি আরও কিছুদূর অগ্রসর হইয়া পাহাড়ের তলদেশে নামিয়া, দূরবীনের সাহায্যে সাতারা দুর্গ দেখিতে লাগিলেন। তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া শত্রুরা গোলা ছুঁড়িল। গোলা তাঁহার আশপাশে আসিয়া পড়িতে লাগিল– পুত্র আজম হটিয়া আসিবার জন্য জিদ্ করিলেন–তথাপি আওরংজীব অবিচলিত চিত্তে সেখানে ঘণ্টাখানেক দাঁড়াইয়া রহিলেন। শিবিরাবাসে যখন ফিরিলেন, তখন বেলা দ্বিপ্রহর।

৪। কাজওয়া অর্থাৎ উটের পিঠের হাওয়া। এগুলি কাষ্ঠ নির্ম্মিত ও চতুষ্কোন ইহার চারিদিকে কাঠের আবরণ বা প্রাচীর থাকাতে ইহার মধ্যে লুক্কায়িত সৈন্যের গায়ে শত্রুপক্ষের তীর ও গুলি লাগিত না। আর, দুইপাশে এই কাজওয়া সারি করিয়া দিয়া মধ্য দিয়া নিরাপদে মাটি কাটিয়া গড়খাই (trenches) প্রস্তুত করা হইত।?

৫। এগুলি দিশী নৌকার পাটাতন অথবা শব-বহনের বাঁশের মাচার মতো। ২৫শে ডিসেম্বরের সংবাদ পত্রে লেখা আছে:- ‘সম্রাট একখানি পাটাতন পরীক্ষা করিয়া বলিলেন– ইহাতে কাজ হইবে না। এক হাত চওড়া ও এক গজ লম্বা কতকগুলি নূতন পাটাতন প্রস্তুত কর’।

৬। সরকারী ইতিহাস মাসির-ই-আলমগীরীতে ঘটনাটি বর্ণিত হইয়াছে; কিন্তু এই বীরের নাম দেওয়া হয় নাই। বাজী দাফুলের নাম আমি তাঁহার বংশধর, বর্তমান জাঠ ষ্টেটের সর্দ্দার বাহাদুরের লিখিত পত্র হইতে জানিতে পারিয়াছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *