বাদশাহী গল্প
(ফার্সী হইতে)
‘প্রজাঃ প্রজাঃ স্বা বৈ তন্ত্ৰয়িত্বা।’ (কালিদাস)
১. শাহজাহানের প্রজাবাৎসল্য
এই বাদশাহের হৃদয় সর্ব্বদা রাজ্যের খবর লইতে ব্যস্ত থাকিত। একদিন দুপুর রাত্রে রাজস্বের কাগজপত্র দেখিতেছিলেন। দেখিতে দেখিতে একখানা কাগজ হইতে জানিতে পারিলেন যে কোন একটি মহালের খাজনা গতবৎসর অপেক্ষা কয়েক হাজার টাকা বেশী করা হইয়াছে। অমনি ইহার কারণ জানিবার জন্য রাজস্বসচিব (দেওয়ান) প্রধান মন্ত্রী সাদুল্লা খাঁকে ডাকিয়া পাঠাইলেন ঘটনাক্রমে তখন সাদুল্লা রাজস্ব, বিভাগের তোষাখানের মধ্যে হিসাবের কাগজ হাতে লইয়া বসিয়া ছিলেন; রাত জাগিয়া হিসাব ঠিক এবং কাগজপত্র তৈয়ারি করিতে হওয়ায় তাঁহার চক্ষু দুটি ঘুমে বুজিয়া আসিতেছিল। বাদশাহের দূত তৎক্ষণাৎ তাহাকে আনিয়া উপস্থিত করিল এবং মন্ত্রী ঠিক কি অবস্থায় ছিলেন তাহা বর্ণনা করিল। শাহজাহান একটু ভাবিয়া বলিলেন, “তুমি সজাগ থাকিয়া রাজ্যের সব নিয়মগুলি চালাইতেছ এবং তত্ত্ববধান করিতেছ, এই বিশ্বাস করিয়া আমি একটু বিশ্রাম ভোগ করিতাম। কিন্তু যখন আমার বিশ্রাম তুমি নিজেই লইয়াছ, তখন আমাকেই রাত জাগিতে হইবে।” সাদুল্লা খাঁ নিজের দোষের জন্য কিছু কারণ দেখাইয়া মিনতি করিলেন; তাঁহার পর বাদশাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই মহালের জমা-বৃদ্ধির কারণ কি? এই পরিবর্তন কেন হইল? আমার রাজত্বকালে ত চাষের উপযুক্ত কোন জমি পতিত ছিল না যে, তাহা চাষ করাইয়া তাহা হইতে খাজনার পরিমাণ বাড়ান যাইতে পারে। এই মহালের কর্মচারীর নিকট সন্ধান কর।”
পরে সেখানকার কর্ম্মচারী লিখিয়া পাঠাইল যে সে বৎসর নদী সরিয়া যাওয়াতে কতকটা জমি দেখা দিয়াছে, এবং এই নূতন জমির জন্য খাজনার পরিমাণ বৃদ্ধি হইয়াছে। বাদশাহ আবার জানিতে চাহিলেন যে এই জমি সরকারী খাস মহাল, অথবা লাখরাজ দানের ভূমির সঙ্গে লাগা কিনা। খুঁজিয়া জানা গেল যে উহা দানের ভূমির মধ্যে। তখন বাদশাহ বলিলেন, “এই সব লাখরাজ–ভোগী অসহায় পিতামাতাহীন অথবা বিধবা প্রজাদের ক্রন্দনে নদী শুকাইয়া গিয়াছে। ও জমিতে তাহাদের সত্ব। ও জমি সরকারী জমির মধ্যে আনা শুধু ঐ বেচারাদিগকে ধ্বংস করিবার চেষ্টা।” এবং সাদুল্লাঃর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “ঐ মহালের হতভাগ্য ফৌজদার একটি দ্বিতীয় শয়তান, তাহাকে হাতীর পায়ের নীচে ফেলিয়া মারিলে ঠিক হইত; কিন্তু ঈশ্বরের সৃষ্ট জীবের প্রাণনাশ করা উচিত নয়। এখন তাহাকে শুধু কাজ হইতে ছাড়াইলেই শাস্তি দেওয়া হইবে, এবং ইহা দেখিয়া ভবিষ্যতে অন্য কেহ এরূপ ন্যায্য-সত্ব-নাশকারী কর্ম্ম করিবে না। অতিরিক্ত যে খাজনা আদায় হইয়াছে তাহা সরকারী কোষাগার হইতে সেই সেই প্রজাদের ফেরৎ দেওয়া হউক।”
২. বিজাপুর রাজ্যে প্রজার সুখ
মুহম্মদ আদিলশাহ ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৬৫৬ পর্য্যন্ত বিজাপুরের রাজা ছিলেন। একদিন জ্যোৎস্না রাত্রে আদালত মহল নামক উচ্চ রাজবাড়ীর ছাদে সাদা ফরাশ বিছাইয়া সাদা পোশাক পরিয়া মহা সমারোহে মন্ত্রী ও সামন্তদের সহিত বসিয়া আমোদ করিতেছিলেন। মধ্য রাত্রে যখন সকলেরই হৃদয় আহ্লাদে মগ্ন ছিল, রাজা বিজাপুর সহরের প্রজাদের অবস্থা জানিবার জন্য ইচ্ছুক হইয়া কান খাড়া করিয়া রহিলেন এবং সহর হইতে যে শব্দ আসিতেছিল তাহা লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন যে আমোদের ধ্বনি গান ও বাদ্য আর কিছুই শুনা যাইতেছে না তখন তিনি সন্তুষ্ট হইয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন যে তাঁহার রাজত্বকালে প্রজারা এত নিরাপদ ও সুখে আছে, এবং কোথায়ও ক্রন্দন বা আর্তনাদ শুনা যাইতেছে না। বিশ্বস্ত মন্ত্রী ও প্রিয়পাত্র আফজল খাঁ সিংহাসনের পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন। রাজা তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আফজাল খাঁ জি! সহর কি বলিতেছে?” আফজল খাঁ উচিত সম্ভাষণ করিয়া উত্তর করিলেন, “সহর হুজুরের গুণগান করিতেছে এবং এই প্রার্থনা করিতেছে যে আপনার ঐশ্বর্য্য, আয়ু এবং ক্ষমতা বাড়িতে থাকুক, কারণ এসব সুখ ও আনন্দ শুধু আপনার ন্যায়বিচার, সৎকার্য্য, প্রজাবাৎসল্য এবং দানশীলতার ফল।” রাজা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, যদি দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে আমার যুদ্ধ হয় তবে তাহার ফল কি হইবে?” আফজল খাঁ উত্তর করিলেন, “এই আমোদ আহ্লাদের শব্দের পরিবর্তে কাঁদাকাটি, আৰ্ত্তনাদ ও বিলাপের ধ্বনি উঠিবে।”
৩. বিজাপুরের রাজার দয়া
বিজাপুরের সুলতান মুহম্মদ আদিলশাহ একদিন উচ্চ প্রাসাদের ছাদে উঠিয়া চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিলেন। দূরে গ্রামের বাড়ীগুলির দিকে তাকাইয়া দেখিলেন যে আর সব পাড়া হইতে ধুঁয়া উঠিতেছে, শুধু একটি পাড়ার বাড়ীগুলির উপর ধুঁয়ার চিহ্ন নাই। আশ্চর্য্য হইয়া পারিষদদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর সব পাড়া হইতে রান্নার ধুঁয়া দেখা দিতেছে, কিন্তু ঐ পাড়ায় নহে। ইহার কারণ কি?” তাহারা উত্তর করিল, “ওটা ব্ৰাহ্মণপাড়া ব্রাহ্মণেরা দিনে শুধু একবার মাত্র রাঁধে ও খায়।” কিন্তু দয়ালু সরল রাজার মনে এই সন্দেহ উঠিল যে হয়ত উহারা দারিদ্র্যের জন্য শুধু একবার আহার করে। দুঃখে তাহার চোখে জল আসিল এবং তিনি হুকুম দিলেন যে ঐ ব্রাহ্মণদের আহারের খরচ রাজসরকার হইতে দেওয়া হউক, যেন উহারা প্রাণ ভরিয়া দুবার করিয়া খাইতে পারে। তিনি জানিতেন না যে ব্রাহ্মণ জাতি, কি ধনী কি দরিদ্র দিনে একবারের বেশী রাধা জিনিস আহার করা আচার-বিরুদ্ধ মনে করে।
৪. নূরজাহানের জন্ম ও বিবাহ
জাহাঙ্গীরনামা নামক ইতিহাসের লেখক সময় উপযুক্ত নয় দেখিয়া এবং উভয় পক্ষের মান রাখিয়া চলা আবশ্যক বলিয়া এই কাহিনীর আদি ও অন্ত বর্ণনা করিতে অনেকগুলি ঘটনা চাপা দিয়াছেন এবং বিষয়টি অন্যরূপ করিয়া সাজাইয়াছেন। কিন্তু আমি (অর্থাৎ খাফি খাঁ) অনুসন্ধান করিয়া যাহা সত্য বলিয়া জানিয়াছি, এবং সূজার চাকর মুহম্মদ সাদিক তররেজী লিখিত মনহজ-উল-সাদিকাইন্ নামক গ্রন্থ পড়িয়াছি, তাহা এইরূপ:-
নূরজাহানের পিতা ঘিয়াস বেগ পারস্যদেশের একজন সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন এবং শাহ্ তহমাস্প নামক রাজার অধীনে খুরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। পরে তাঁহার নিকট অনেক রাজস্ব বাকী হওয়ায় এবং অন্যান্য বিপদ ঘটায়, তিনি অত্যন্ত নিঃস্ব হইয়া পড়িলেন, এবং দেশত্যাগ করিয়া নিজের স্ত্রী, দুই কন্যা এবং এক পুত্র সহিত হিন্দুস্থানে আসিবার পথিকদলের সঙ্গে জুটিলেন। পথে তাঁহার উপর আরও বিপদ আসিয়া পড়িল এবং সৰ্ব্বস্ব নষ্ট হইয়া গেল। তাঁহার অবস্থা এমন শোচনীয় হইল যে এই পাঁচ ছয়জন লোকের চড়িবার ও জিনিস বহিবার জন্য শুধু দুইটি উট অবশিষ্ট ছিল, এবং তাঁহারা পালাক্রমে তাহাতেই চড়িতেন। তাঁহার স্ত্রী গর্ভবতী থাকায় তাঁহাকে উটে চড়ানই বেশী আবশ্যক হইয়াছিল। কান্দাহারের নিকট পৌঁছিলে নূরজাহানের জন্ম হইল। শুশ্রূষা করিবার লোক নাই; এবং ক্ষুধার্ত, পথশ্রমে ক্লান্ত ও পীড়িত মাতার স্তনে কন্যার পানের জন্য যথেষ্ট দুগ্ধ দেখা দিল না। তখন তাঁহারা মেয়েটাকে একখানা কাপড়ে জড়াইয়া ভগবানে সমর্পণ করিয়া রাত্রিকালে পথিকদলের মধ্যে রাখিয়া দিলেন। প্রাতে সকলে যখন যাত্রা আরম্ভ করিবে, শিশুর ক্রন্দন মালিক মাসূদ নামক ঐ দলপতির কোন চাকরের কানে পৌঁছিল। সে উহাকে তুলিয়া প্রভুর কাছে আনিল। মেয়ের মুখ দেখিয়াই তাঁহার হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইল, এবং নিজের সন্তান না থাকায় সন্তানের মতন পালন করিতে লাগিলেন। মেয়েটিকে স্তনপান করাইবার জন্য খুঁজিয়া তাঁহার মা ভিন্ন আর কোন স্ত্রীলোক পাওয়া গেল না। পথিকদের নেতা তখন ঘিয়াস্ বেগ ও তাঁহার স্ত্রীকে আদর করিয়া কাছে আনিলেন এবং তাঁহাদের চড়িবার উট এবং জিনিষপত্র দান করিলেন। মেয়ের মাই তাহার ধাত্রী নিযুক্ত হইলেন, এবং তাঁহাদের ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হইল।
মালিক মাসুদ প্রতি বৎসরই পারস্য হইতে পথিক দল লইয়া ভারতে আসিতেন এবং বাদশাহ আকবরকে নিজের বাণিজ্য দ্রব্য হইতে বাছিয়া ভাল ভাল উপহার দিতেন। আবার বলিলেন, “তোমার এবারকার কোন উপহারই যে আমার উপযুক্ত বোধ হইতেছে না।” যাত্রী-দলপতি উত্তর করিলেন, “আমরা কাপড়-বিক্রেতা; আমাদের কোন উপহার এই সম্রাটের যোগ্য হইতে পারে? কিন্তু এ বৎসর আমি কয়েকটি সজীব অমূল্যরত্ন সঙ্গে আনিয়াছি। যদি আপনি তাহাদের প্রতি স্নেহদৃষ্টি করেন, তবে বলিতে পারি যে এমন উপহার ইরান ও তুরান হইতে ভারতবর্ষের সম্রাটদের জন্য এ পৰ্য্যন্ত কখনও আসে নাই।” তাহার পর বাদশাহ তাহাদিগকে উপস্থিত করিতে বলিলেন, এবং ঘিয়াস বেগ ও তাঁহার পুত্র আবুলহসনকে নিজের কর্ম্মচারী নিয়োগ করিলেন। তাঁহাদের সৌভাগ্যক্রমে এবং কার্যদক্ষতায় দিন দিন তাঁহাদের পদবৃদ্ধি হইতে লাগিল।
মালিক মাসুদের স্ত্রীর বাদশাহের অন্তঃপুরে যাইবার অনুমতি ছিল। তিনি নূরজাহান ও নূরজাহানের আপন মাতার সহিত তথায় যাতায়াত করিতেন এবং উৎসবের দিনে বেগমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া গৌরব ও নগদ টাকা, গহনা, কাপড় প্রভৃতি উপহার পাইতেন। যখন নূরজাহান যৌবনকালে উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহার বুদ্ধি ও বিচার শক্তি সৌন্দর্য্যের সঙ্গে দিন দিন বাড়িতে লাগিল মধ্যে মধ্যে তাঁহার সহিত যুবরাজ সেলিমের প্রেমকটাক্ষ বিনিময় হইত। যুবরাজ তাঁহার প্রেমের বশ হইয়া পড়িলেন। একদিন অন্দর মহলের এক কোণে নূরজাহানকে একা পাইয়া সেলিম আদর করিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া নিজের দিকে টানিলেন। নূরজাহান পলাইয়া গিয়া বেগমদিগের কাছে নালিশ করিলেন। অন্তঃপুরের গুপ্তচরেরা বাদশাহকে এ খবর দিল। আকবর ন্যায়পরায়ণতায় অদ্বিতীয় ছিলেন। অধীনস্থ লোকদের মানসম্ভ্রমের দিকে চাহিয়া তিনি সেলিমের উপর রাগ করিলেন এবং নূরজাহানের গুরুজনকে ডাকিয়া হুকুম দিলেন, যে, এই অমূল্য কুমারী রত্নকে কাহারও সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হউক। ঘিয়াস বেগ উত্তর করিলেন “আমরা আপনার দাস মাত্র; এ বিষয়ে আমাদের কি ক্ষমতা আছে?”
তুর্কী জাতির আস্তা শ্রেণীর আলীকুলী নামক এক যুবক প্রথমে পারস্যরাজ শাহতাস্পের পরিবেষণকারী ভৃত্য ছিল, পরে ভারতে আসিয়া সুলতানের শাসনকর্তার অধীনে কাজকর্ম্ম ভাল করায় খ্যাতিলাভ করে এবং বাদশাহের নিকটস্থ কৰ্ম্মচারীদের দলভুক্ত হয়। আকবরও তাহাকে ভালবাসিতেন; তাহাকে শেরান্ অর্থাৎ ‘ব্যাঘ্রহস্তা’ উপাধি দিয়া তাহার সহিত তাড়াতাড়ি নূরজাহানের বিবাহ দিয়া ফেলিলেন, এবং বাঙ্গলায় এক জাগীর দান করিলেন। শেরাফকন কিছুদিন মহারাণার সহিত যুদ্ধে উপস্থিত থাকিয়া পরে জাগীরে গিয়া বাস করিতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর সম্রাট হইয়া তাঁহার দুধভাই কুতুবুদ্দীন খাঁ কোলতাকে বাঙ্গলার সুবাদার করিয়া পাঠাইলেন এবং বিদায় দিবার সময় গোপনে শেরাফকন্ সম্বন্ধে কিছু বলিয়া দিলেন। শেরাফকন্ দরবারে তাহার প্রতিনিধির চিঠি হইতে এই গোপনে কথাবার্তার সংবাদ পাইল, এবং ‘প্রেম ও কস্তুরীর গন্ধ লুকান যায় না’ এই প্রচলিত বচন অনুসারে বাদশাহের অভিপ্রায় বুঝিয়া লইল। সেইদিনই জেলার সংবাদলেখক কর্ম্মচারীকে কহিল “আজ হইতে আমি আর বাদশাহের চাকর নই।” অস্ত্রসজ্জা করা ছাড়িয়া দিল। কুতুবুদ্দীন খাঁ বাঙ্গলায় পৌঁছিয়া শেরাফককে দেখা করিবার জন্য কত চিঠি লিখিলেন। কিন্তু সে আসিল না। তখন কুতবুদ্দীন সরকারী কাজের ভান করিয়া তাহার জাগীরের নিকট পৌঁছিলেন এবং শেরাফককে ডাকিয়া পাঠাইলেন। শেরাফকন্ অর্দ্ধ-আস্তীন জামার নীচে বর্ম্ম ও তরবারী পরিয়া দু চারজন অনুচরসহ কুতবুদ্দীনের কাছে আসিয়া দেখা করিল। কুতবুদ্দীন সম্ভাষণ ও কুশল জিজ্ঞাসার পর বাদশাহের প্রস্তাবটি নিষ্ঠভাবে শেরাফকরে সম্মুখে উপস্থিত করিতে অনেক চেষ্টা করিলেন এবং সম্রাটের হুকুম মানিবার জন্য অনেক উপদেশ দিলেন। কিন্তু সেই সিংহহৃদয় বীর বুঝিল যে কথায় রাগ প্রকাশ করা বৃথা, এবং কুতবকে মারিয়া নিজে মরা ভিন্ন মানের সহিত প্রাণ লইয়া সে স্থান হইতে বাহির হওয়া অসম্ভব। তখন শেরাফকন্ আস্তীনের নীচে হইতে ছোরা বাহির করিয়া কুতুবুদ্দীনের পেটে এমন জোরে ঘা মারিল যে তিনি ঘোড়া হইতে পড়িয়া গেলেন। শের ছুটিয়া পলাইবে এমন সময় সুবাদারের একজন কাশ্মীরি চাকর পথরোধ করিয়া তরবারের আঘাত করিল; শের তাহাকে মারিয়া ফেলিল; কিন্তু ইতিমধ্যে কুতবের আর সব অনুচর পৌঁছিয়া অনেক অস্ত্রাঘাতে শেরের প্রাণ লইল।
৫. নূরজাহানের ব্যাঘ্র শিকার
একদিন বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাঁহার দুই স্ত্রী, অর্থাৎ প্রথম বিবাহিতা রাণী (মানসিংহের ভগিনী, খসরুর মাতা,) এবং নূরজাহানকে সঙ্গে লইয়া শিকার করিতে গিয়াছেন। একটা প্রকাণ্ড বাঘকে দূর হইতে (জালের) বেড়া দিয়া ঘেরাও করা হইয়াছিল। বাদশাহ তাহাকে মারিতে যাইবার আগেই অভ্যস্ত সময়ে ঘুমাইয়া পড়িলেন। জাহাঙ্গীর প্রায় সব রকম নেশাই করিতেন, কাজেই দুপুরে না ঘুমাইলে তাঁহার চলিত না। তাঁহার বন্দুক ও বারুদ জ্বলাইবার জ্বলন্ত পলতে বিছানার পাশে রহিল। দুই রাজমহিষী এবং তিনজন দাসী কাছে পাহারা দিতে লাগিল।
এমন সময়ে বাঘটা গৰ্জ্জন করিয়া বেড়া হইতে বাহির হইয়া আসিল। সে সময়ে ভারতের বাদশাহদিগের স্ত্রী ও প্রিয় দাসীদিগকে বিশেষ যত্ন করিয়া ঘোড়ায় চড়া এবং তীর ও বন্দুক ছোঁড়া শেখান হইত; কেবল নূরজাহান এসব বিদ্যা জানিতেন না। যেই বাঘ দূরে দেখা দিল, রাণী বন্দুক তুলিয়া বুকে লাগাইয়া চাকী দিয়া বারুদে আগুন দিলেন। এমন লক্ষ্য ঠিক, যে, বাঘের কপালে গুলি লাগিয়া সেই ভীষণ জন্তুটা একবার মাত্র হুঙ্কার ছাড়িয়া অজ্ঞান হইয়া মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগিল। বন্দুকের আওয়াজ এবং ব্যাঘ্রের গর্জ্জন শুনিয়া বাদশাহ জাগিয়া দেখিলেন যে বাঘ যেই অবস্থায় পড়িয়া আছে, রাণী বন্দুক-হস্তে আহ্লাদে দাঁড়াইয়া আছেন, আর নূরজাহান দূরে ভয়ে কাঁপিতেছেন ও কাঁদিতেছেন। তখন তিনি রাণীকে প্রশংসা করিয়া আলিঙ্গন করিলেন, এবং সে দিন হইতে তাঁহাকেই বেশী অনুগ্রহ করিতে লাগিলেন; নূরজাহান যেন দুয়ো রাণী হইলেন। নূরজাহানের মা বুদ্ধিতে স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে অদ্বিতীয় ছিলেন, তিনি বাদশাহের মন ফিরাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন, বলিলেন “মহাত্মা আলীর উক্তি আছে যে অনেকগুলি গুণ পুরুষের পক্ষে প্রশংসার কারণ, কিন্তু তাহা স্ত্রী লোকের পক্ষে দোষ বলিয়া গণ্য হয়, যেমন বীরত্ব এবং দানশীলতা (অপব্যয়)”।
সেই দিন হইতে নূরজাহান বন্দুক চালান শিখিতে লাগিলেন, এবং অল্পদিনে তাহাতে দক্ষ হইলেন। পূর্ব্বে বর্ণিত ঘটনার দু এক বৎসর পরে বাদশাহ আবার শিকারে গেলেন। চাকরেরা চারিটা বাঘ বেড়ায় ঘিরিল, নূরজাহান তাহাদের মারিতে অনুমতি লইলেন, এবং অব্যর্থ গুলিতে পরে পরে চারিটিকেই শিকার করিলেন। বাদশাহ খুশী হইয়া তাঁহাকে এক লক্ষ টাকা দানের হীরা পুঁছী (অলঙ্কার) উপহার দিলেন।
৬. তাজমহল নিৰ্ম্মাণ
বাদশাহ শাহজাহান তাঁহার পত্নী মমতাজমহলকে বড়ই ভালবাসিতেন, কি যুদ্ধযাত্রায়, কি ভ্রমণে, কি স্থির হইয়া বাস কালে, কখনও তাঁহাকে ছাড়িয়া যাইতেন না। বেগমের শেষ সন্তান হইবার কিছু পূর্ব্বে তাঁহার জঠরের ভিতর হইতে ছেলের কান্নার মত শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। এই কুলক্ষণ হইলে প্ৰসূতি বাঁচে না। জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহানারাকে দিয়া বাদশাহকে ডাকিয়া পাঠাইলেন শাহজাহান ছুটিয়া বেগমের পাশে আসিলেন। সম্রাজ্ঞী বলিলেন, “নাথ! এতদিন আমি আপনার চিরসহচরী ছিলাম, আপনার যৌবরাজ্যকালে, কি সুখে কি দুঃখে, কি গৌরবে কি পিতৃকারাগারে বন্দী থাকার সময়ে আমি আপনা হইতে ভিন্ন হই নাই। এখন আপনি সিংহাসনে চড়িলেন, আর আমার এমন দুর্ভাগ্য যে এই সময় আপনাকে ছাড়িয়া যাইতে হইবে! আমার কাছে দুইটি প্রতিজ্ঞা করুন যে আমি মনের সুখে মরিতে পারি।” বাদশাহ প্রাণের দিব্য দিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন যে বেগমের প্রার্থনা রাখিবেন। তখন বেগম বলিলেন, “আমার প্রথম প্রার্থনা এই যে আপনি আর বিবাহ করিবেন না। ভগবান আমাদের চারিপুত্র দিয়াছেন, তাহারাই যথেষ্ট। আবার নূতন বিবাহ করিলে সে স্ত্রীর সন্তানের সঙ্গে আমার ছেলেদের সিংহাসন লইয়া যুদ্ধ হইবে। দ্বিতীয় প্রার্থনা এই যে আমার জন্য এমন সমাধি-মন্দির রচনা করিবেন যে তাহা যেন পৃথিবীতে অদ্বিতীয় হয়।” বাদশাহ কাঁদিতে কাঁদিতে সম্মত হইলেন। কিছুপরে এক কন্যা প্রসব করিয়া বেগম মারা গেলেন।
তখন বাদশাহ চারিদিকে ঘোষণা করিয়া দিলেন যে বেগমের সমাধি নির্মানের জন্য কারিগরেরা নকশা প্রস্তুত করিয়া দেখাক। যে নকশা পছন্দ হইল তাহার অনুসারে একটি ছোট নমুনা (model) তৈয়ারি করা হইল। সেইটা মঞ্জুর করিয়া ঠিক সেই ধরনে তাজমহল নির্ম্মাণ করা হইল।
[মমতাজমহলের দম্পতি জীবন ১৮ বৎসর ছিল। তাঁহার ১৪টি সন্তান হয়। শাহজাহানের সিংহাসন আরোহণের পর চতুর্থ বৎসরে, শেষ সন্তানটি প্রসব করার পর সাম্রাজ্ঞী তাপ্তী নদীর তীরে বুহানপুর নগরে প্রাণত্যাগ করেন। শাহজাহান প্রথম বয়সে পিতা কর্তৃক কারারুদ্ধ হন নাই, কিন্তু পিতার সেনাপতিদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া অনেকদিন ধরিয়া তাঁহাকে পলাইয়া বেড়াতে হইয়াছিল।]
৭. আওরংজীবের প্রজাপালন
বাদশাহ আওরংজীব তখন পাঞ্জাবের হসন্ আব্দাল নামক শহরে বাস করিতেছিলেন। রাজবাড়ীর দেওয়ালের বাহিরে একজন গরীব বুড়োর দোকান ছিল। রাজ-বাগানের মধ্য দিয়া যে জল বাহির হইয়া নালায় পড়িত তাহাতে তাহার যাঁতা ঘুরিত এবং এইরূপে ময়দা পিষিয়া বেচিয়া যে কোনক্রমে খাওয়া চালাইত। বাদশাহ আসায় নাজীরের চাকরেরা ঐ জল বাহির হওয়ার পথ বন্ধ করিয়া দিল; বুড়ো ময়দাওয়ালা অনাহারে মারা যায় যায়। মাসির-ই–আলমগীরী গ্রন্থের লেখক সাকী মুস্তাদ খাঁ খবর পাইয়া একজন উচ্চ কৰ্ম্মচারী, বখ্তাত্তর খাঁ দ্বারা বাদশাহকে জানাইলেন। আওরংজীব হুকুম দিলেন যে বাত্তর খাঁ স্বয়ং গিয়া দেখুন যেন জলের মুরী খুলিয়া দেওয়া হয় এবং চাকরদের কড়া করিয়া বলিয়া দেন যে বুড়োর ব্যবসায়ে বাধা না ঘটে। দেড় প্রহর রাত্রে দুই থালা খাদ্য ও পাঁচটা মোহর একজন কর্মচারীর হাতে দিয়া বলিলেন “এগুলি বখতাত্তর খাঁর কাছে লইয়া যাও, যে তোমাকে ওই বুড়োর বাড়ীর পথ দেখাইয়া দিবে। বুড়োকে আমার সেলাম দিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া আমার পক্ষ হইতে বলিও– ‘তুমি আমার প্রতিবেশী, অথচ আমার আগমনে তোমার কষ্ট হইয়াছে। আমাকে মাফ কর।” কর্মচারী বখ্তাত্তর খাঁর বাসায় পৌঁছিয়া অনেক খোঁজ লইবার পর একজন পেয়াদার নিকট জানিলেন যে আর একটি ছোটো পাহাড়ের পর বুড়োর কুঁড়ে ঘর আছে। দুপুর রাত্রে যেখানে পৌঁছিয়া বুড়োকে জাগাইয়া, তাহার ক্ষমা লাভ করিয়া তবে সকলে ফিরিল।
পরদিন বাদশাহ নাজীরকে হুকুম করিলেন যে বাদশাহী পাল্কী পাঠাইয়া বুড়োকে অন্দরমহলে আন। বুড়ো জীবনে কখন পাল্কীর নামও শুনে নাই, রূপার ডাঁট যুক্ত পাল্কী দেখা ত দূরে থাকুক। তাহাকে ঐ পাল্কীর ভিতর বসাইয়া আনা হইল। বাদশাহ তাহার অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন, জানিলেন যে তাহার স্ত্রী, দুই কুমারী কন্যা ও নেংটা দুই পুত্র আছে। সরকার হইতে তাহাকে দু শ টাকা দেওয়া হইল, তাছাড়া আর সকলে অনেক টাকা, গহনা ও কাপড় দিলেন। দুদিন রাজবাড়ীতে কাটাইয়া সে ঘরে ফিরিল। তখন তাহার গায়ে শাল, কিংখাবের পাজামা, সুন্দর কেনারাযুক্ত পেশওয়াজ জামা, এবং বাদলা কাজ করা টুপী পরা, কোঁছায় মোহর টাকা ও গহনা! অথচ মুখখানি শত শত লোলচে ঢাকা এবং চোখ দুটি অন্ধপ্রায়! মুস্তাদ খাঁ তাম্বুর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি তো চিনিতেই পারেন না, পুছিলেন, “কে হে তুমি?” বুড়ো বলিল, “আজ্ঞা, আমি সেই বুড়ো। আপনার এবং বখ্তাত্তর খাঁর অনুগ্রহে আমার এই সৌভাগ্য হইয়াছে!” খাঁ উত্তর করিলেন “ঈশ্বর তোমার ভাল করুন!”
দু’তিন দিন পরে বাদশাহ পাল্কী করিয়া বুড়ো ও তাহার কন্যাদের আনাইলেন এবং যৌতুক স্বরূপ হাজার টাকা দিলেন। বেগমরাও অনেক গহনা, পোশাক ও টাকা দিলেন। বুড়োর আর একটি যাঁতা বসাইয়া তাহার জন্য সরকারী বাগান হইতে জল দিবার হুকুম হইল, এবং তাহাকে সব ট্যাক্ হইতে মাফ করিয়া সনদ দেওয়া হইল। রাজবৈদ্যকে পাঠাইয়া বুড়োর চক্ষুর চিকিৎসা করা হইল। তাহার মেয়েদের বিবাহ হইয়া গেল, এবং উলঙ্গ ছেলেদের জরীর পোশাক পরান হইল। তাহার স্ত্রীর এতদিন গ্রামের বুড়ি ডাকিনী বলিয়া গণ্য হইত, কিন্তু বাদশাহের অনুগ্রহে যেন তাহারও চেহারা ফিরিল, লোলচর্ম্ম চলিয়া গেল, চক্ষে জ্যোতি আসিল, সে আবার সুন্দরী হইল!
৮. আওরংজীব ও বাঙ্গালী মুসলমান
দাক্ষিণাত্যে কৃষ্ণানদীর তীরে বদ্রিগ্রামে বাদশাহ আওরংজীব বসিয়া কাছারি করিতেছেন, এমন সময় সালাবৎ খাঁ মীর তুজুক একজন লোককে উপস্থিত করিল। লোকটি বলিল, “আপনার শিষ্য হইবার জন্য আমি সুদূর বাঙ্গলাদেশ হইতে এখানে আসিয়াছি। আশা করি আমার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে।” বাদশাহ মুচকি হাসিয়া পকেটে হাত দিয়া প্রায় একশত টাকা ও সোনা রূপার টুকরা বাহির করিয়া ঐ লোকের নিকট পাঠাইয়া বলিলেন, “উহাকে বল যে আমার নিকট হইতে যে অনুগ্রহ প্রত্যাশা করিতেছে তাহা এই।” লোকটা টাকা লইয়া ফেলিয়া দিল এবং নদীতে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। হুকুম পাইয়া চাকরেরা তাহাকে জল হইতে টানিয়া তুলিল। তখন বাদশাহ একজন মন্ত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বাঙ্গলা হইতে একজন লোক আমার শিষ্য হইবে এই পাগলা খেয়াল লইয়া এখানে আসিয়াছে। (হিন্দী কবিতা)
টুপী লেণ্ডী, বাউরী ডেণ্ডী, গহরে নিলজ্জ্।
চুহা খাদন্ মাউলী, তু কাল্ বান্ধে ছজ্ ॥
উহাকে সরহিন্দ সহরের পণ্ডিত মিয়া মুহম্মদ নাফির নিকট লইয়া গিয়া তাহার শিষ্য করিয়া দাও।”*
[প্রবাসী ভাগ ১১, খণ্ড ১, সংখ্যা ৬, আশ্বিন, ১৩১৮।]
* আদি গ্রন্থ-প্রথম গল্পের, ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীর ৩৭০ নং ফার্সী হস্তলিপি; দ্বিতীয় ও তৃতীয় গল্পের, ‘বসাতীন-ই-সালাতীন’ নামক হস্তলিপি; চতুর্থ ও পঞ্চম গল্পের, কাফি খাঁর “মুনতখাব-উল্-লবাব’ ১ম বালুম, ২৬৩-২৬৮ এবং ২৮৭-২৯০ পৃ.; ষষ্ঠ গল্পের, ‘দিউয়ান-ই-আফ্রিদি’ নামক হস্তলিপি; সে দুই গল্পের ‘মাসির-ই-আ- লমগীরী’ নামক ইতিহাসের ১৩৩-১৩৬ এবং ৩৩৩-৩৩৪ পৃষ্ঠা।