পিতাপুত্রে

পিতাপুত্রে

আকবরের বিদ্রোহ

১৬৮১ সালের ১লা জানুয়ারী দেবসুরীতে আকবর নিজকে দিল্লীশ্বর বলিয়া ঘোষণা করিলেন। তাঁহার অনুগত চারিজন মোল্লা এক ফতোয়া সহি করিয়া বাহির করিল যে আওরংজীব ইস্লাম-বিরুদ্ধ কাজ করিবার ফলে সিংহাসনে বসিবার অনুপযুক্ত, সুতরাং ধর্ম্মপ্রাণ কুমার আকবরকে বাদশাহ করিয়া ইসলাম ধর্ম্ম রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানেরই কর্তব্য! এখানে মনে রাখিতে হইবে যে, ১৬৫৮ সালে আওরংজীব যখন পিতার সিংহাসন কাড়িয়া লন, তখন তিনি প্রচার করিয়াছিলেন যে দারা পৌত্তলিক, তাহাকে স্নেহ করিয়া বাদশাহ শাহজাহান ইসলাম ধর্ম্মে গ্লানি আনিয়াছেন, সুতরাং ধর্ম্মরক্ষার জন্য ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য হইয়া তাঁহাকে দিল্লীসাম্রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে লইতে হইল, নচেৎ তিনি পরমেশ্বরের নিকট পাপী হইবেন! আর,

কাজী আবদুল ওহাবও এই যুক্তি দেখাইয়া পিতৃ-সিংহাসনহরণ যে পাপ নহে, বরং এক্ষেত্রে ধার্ম্মিক মুসলমান রাজকুমারের কর্তব্যকর্ম্ম, তাহা প্রমাণ করিয়াছিলেন। আজ ২৩ বৎসর পরে সেই নাটকের পুনরাভিনয় মাত্র হইল।

আকবর আজমীরের দিকে অগ্রসর হইলেন। আওরংজীব তখন আজমীরে অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় ছিলেন; তাঁহার বড় বড় সেনাপতিরা সসৈন্য রাজপুতদের বিরুদ্ধে দূরে নানা স্থানে চলিয়া গিয়াছে, এমন কি বাদশাহের শরীর-রক্ষী সৈন্যদলও নিকটে নাই। কেবল জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধ সিপাহী, চাকর-বাকর, কেরানী ও খোঁজারা বাদশাহের সঙ্গে অবস্থান করিতেছে। অথচ বিদ্রোহী আকবরের সঙ্গে তাঁহার নিজ মুঘল সৈন্যদল (প্রায় দশ হাজার অশ্বারোহী) ছাড়া সমস্ত রাঠোর এবং অর্দ্ধেক শিশোদীয়া যোদ্ধা; লোকে বলে সত্তর হাজার অশ্বারোহী এইরূপে একত্র হইয়াছে।

আকবরের বিদ্রোহের সংবাদ পাইয়া সম্রাট মনোদুঃখে বলিলেন, “আমি এখন অসহায়। ঐ যুবক বীর মহা সুযোগ পাইয়াছে। তবে কেন সে আমাকে মারিতে আসিতে বিলম্ব করিতেছে?”

আকবরের বিলাসিতা, যুদ্ধ কার্য্যে অনভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধিহীনতার ফলে তাঁহার চেষ্টা বিফল হইল। তিনি আমোদ-প্রমোদে সময় নষ্ট করিতে লাগিলেন; দেবসুরী হইতে আজমীর ১২০ মাইল, চারি-পাঁচদিনে আসা যায়; আকবর ইহাতে পনের দিন লাগাইলেন। এই অপ্রত্যাশিত সময় পাইয়া আওরংজীব সত্বর চারিদিক হইতে নিজ সৈন্য ফিরাইয়া আনিয়া আত্মরক্ষার পাকা বন্দোবস্ত করিয়া ফেলিলেন। কুমারে বিদ্রোহের সংবাদ পাইয়া শিহাবুদ্দিন খা (প্ৰথম নিজামের পিতা) বাদশাহের আহ্বানের অপেক্ষা না করিয়া নিজ অশ্বারোহী দলসহ দুই দিনে ১২০ মাইল পথ পার হইয়া আজমীরে আসিয়া পৌঁছিলেন, অন্যান্য জনকয়েক সেনাপতিও আসিয়া জুটিল। আকবরের একমাত্র সুযোগ নষ্ট হইল।

বিদ্রোহের অবসান

তখন আওরংজীব আজমীর হইতে বাহির হইয়া দশ মাইল দক্ষিণে দো-রাহা নামক স্থানে শত্রুর অপেক্ষায় সুসজ্জ দাঁড়াইয়া রহিলেন। ১৫ই জানুয়ারী সন্ধ্যার সময় আকবর তাহার তিন মাইল দূরে পৌঁছিয়া তাঁবু ফেলিয়া থাকিলেন। সেই রাত্রেই তাঁহার কপাল চিরকালের জন্য ভাঙ্গিল।

বিলাসী যুবক রাজকুমার আকবর নিজ উজীর তাহাউর খাঁরার হাতের পুতুল মাত্র। তাহাউই তাঁহার সব কাজ করেন, সৈন্যদের হুকুম দেন, এবং রাজপুতদের সঙ্গে কথাবার্তায় মধ্যস্থতা করেন। তাহাউরের শ্বশুর ইনাএৎ খাঁ আওরংজীবের শিবিরে উচ্চকর্ম্মচারী; বাদশাহের কথায় ইনাএৎ খাঁ জামাতা তাহাউকে সেই রাত্রেই লিখিয়া পাঠাইলেন-”তুমি এখনই আসিয়া বাদশাহের নিকট মাফ চাও, নচেৎ তোমার স্ত্রীগণকে প্রকাশে বেইজ্জত করা হইবে এবং তোমার পুত্রদিগকে ক্রীতদাস করিয়া কুকুরের দামে বিক্রয় করা হইবে।’ তাহাউরের পরিবারবর্গ বাদশাহের নিকট ছিল।

এই পত্র পাইয়া তাহাউর্ কাহাকেও কিছু না বলিয়া মহা উদ্বিগ্নচিত্তে রাত্রে একাকী আকবরের শিবির ত্যাগ করিয়া বাদশাহের সৈন্যাবাসে উপস্থিত হইয়া বাদশাহের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিল। তখন রাত্রি দুপুর। বাদশাহ হুকুম দিলেন, সে যেন নিরস্ত্র হইয়া তাঁহার দরবারে ঢোকে। পরাজিত শত্রু বা অপরাধী কয়েদিকেই নিরস্ত্র অবস্থায় দরবারে আনা হয়; তাহাউর্ আজ আকবরের সমস্ত চেষ্টা পণ্ড করিয়া দিবার জন্য বাদশাহের নিকট আসিয়াছে, সম্রাটের এত বড় উপকার আর কেহ করে নাই, সে মহা পুরস্কার ও সম্মানের আশা করিয়াছিল। সুতরাং অস্ত্র ত্যাগ করা অপমানজনক মনে করিয়া তাহাউর আপত্তি করিল; তাঁবুর বাহিরে উচ্চস্বরে তর্ক হইতে লাগিল। এই সংবাদ পাইয়া বাদশাহ রাগিয়া, জপের মালা হাত হইতে ফেলিয়া দিয়া, তরবারি খুলিয়া চেঁচাইয়া বলিলেন, “বেশ তো উহাকে তলোয়ার-হাতেই আসিতে দাও!”

তাঁহার অনুচরগণ এ সঙ্কেত বুঝিল। একজন দ্বাররক্ষী তাহাউর্-এর বুকে ধাক্কা মারিল। তাহাউর্ তাহার গালে চড় মারিয়া পলাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু অন্ধকার রাত্রে তাঁবুর দড়ি পায়ে বাধিয়া হোঁচট্ খাইয়া পড়িয়া গেল। আর অমনি বাদশাহের অনুচরগণ আসাসোঁটার ঘা দিয়া তাহাকে জখম করিল। তাহাউর কুর্তার নীচে বর্ম্ম পরিয়া আসিয়াছিল, সুতরাং সহজে তাহার প্রাণ গেল না; অবশেষে একজন তাহার মাথা কাটিয়া ফেলিয়া গণ্ডগোলের অবসান করিল।

ইতিমধ্যে আওরংজীব এক ফন্দি করিয়াছিলেন। তিনি আকবরকে এক পত্র লিখিয়া পাঠাইলেন-”আমার মন্ত্রণা অনুসারে তুমি সব কার্য্যই করিতে, এবং সব রাজপুত সৈন্যদিগকে ভুলাইয়া আমার ফাঁদের মধ্যে আনিতে পারিয়াছ,এজন্য খুব তুষ্ট হইলাম। কাল প্রাতে যুদ্ধের সময় তুমি ঐ রাজপুতদের তোমার সেনার অগ্রগামী করিয়া আমাকে কপট আক্রমণ করিও, তখন সামনে হইতে আমার ও পিছন হইতে তোমার মুঘল সৈন্যদল ঐ রাজপুতদের পিষিয়া নির্মূল করিবে।” আওরংজীবের শিখান-মত এই পত্রের বাহক আকবরের শিবিরে না গিয়া দুর্গাদাসের সৈন্যমধ্যে গেল, এবং ধরা পড়িয়া একটু মার খাইবার পর চিঠিখানা সমর্পণ করিল।

চিঠি পড়িয়া রাজপুতদের চক্ষুস্থির! দুর্গাদাস তখনই চিঠি-হাতে আকবরের তাঁবুতে গেলেন; তখন রাত্রি গভীর, নবীন সম্রাট ঘুমাইতেছেন, হারেমে গিয়া তাঁহাকে জাগাইবে এমন সাহস কাহারও নাই।

তাহার পর দুর্গাদাস তাহাউর্-এর খোঁজে গেলেন, কিন্তু সারা শিবির ঘুরিয়াও তাহার সন্ধান পাওয়া গেল না।

রাজপুতদের মনের সন্দেহ বদ্ধমূল হইল। এ হেন বিশ্বাসঘাতক সম্রাট ও শাহজাদার ফাঁদ হইতে রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায়-আর এক মুহূর্ত্ত বিলম্ব না করিয়া তৎক্ষণাৎ ঐস্থান হইতে পলায়ন। সেই শেষরাত্রেই চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার রাজপুত-সেনা আকবরের শিবির ত্যাগ করিয়া দেশে ফিরিয়া গেল। প্রাতে আকবর জাগিয়া দেখিলেন, শিবিরে তিনি একা! তখন পলায়ন ভিন্ন প্রাণ বাঁচান অসম্ভব।

আকবরের প্রতি আওরংজীব

১৬ই জানুয়ারী জানা গেল, আকবর নিজের অবশিষ্ট সাড়ে তিন শত অশ্বারোহী লইয়া পশ্চিমদিকে পলাইয়াছেন, আর তাঁহার অধীনস্থ বাদশাহী সৈন্যদলের প্রায় সকলেই আওরংজীবের দলে যোগ দিয়াছে, কারণ এতদিন পৰ্য্যন্ত

কুমার তাহাদিগকে জোর করিয়া নিজ সঙ্গে বাদশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আনিয়াছিলেন। দুই দিন ও এক রাত্রি একাকী পলাইবার পর, আকবর দুর্গাদাসের দর্শন পাইলেন। কারণ ইতিমধ্যে রাঠোরেরা বুঝিতে পারিয়াছিল যে আকবর তাহাদের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করেন নাই, ঐ চিঠিখানির কথা সর্ব্বৈব মিথ্যা,–আওরংজীবের কূটনীতির খেলা। তখন আশ্রয়প্রার্থী কুমারকে রক্ষা করাই রাজপুতদের কর্তব্য বুঝিয়া দুর্গাদাস তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া, রাঠোর-সৈন্য দিয়া রক্ষা করিয়া, রাজপুতানার নানা স্থানে ঘুরিতে লাগিলেন। পিছনে বাদশাহী সৈন্যগণ ধরিতে আসিতেছে। গুজরাতে পলাইবার পথ বন্ধ, কারণ তাহার সীমানায় মুঘল কর্ম্মচারিগণ সজাগ হইয়া পাহারা দিতেছিল। কয়েক মাস অবিশ্রান্ত ছোটাছুটির পর অবশেষে আকবর দুর্গাদাসের আশ্রয়ে ৯ই মে নর্ম্মদা পার হইয়া দাক্ষিণাত্যে প্রবেশ করিলেন, এবং নাসিক নগরের পাশ দিয়া গিয়া মহারাষ্ট্র-রাজ্যে আশ্রয় লইলেন। শম্ভুজী তাঁহাকে কোঁকনে পালী নামক গ্রামে বাস করিবার স্থান দিলেন, অর্থসাহায্যও করিলেন (১লা জুন)।

আজমীরের নিকট হইতে আকবর পলায়ন করিবার পর আওরংজীব পুত্রকে কাছে ফিরাইয়া আনিবার জন্য এই পত্র লিখেন:-

“প্রাণপ্রিয় পুত্র মহম্মদ আকবর! ঈশ্বর সাক্ষী, আমি সকল পুত্র অপেক্ষা তোমাকে বেশী ভালবাসিয়াছি; কিন্তু ভাগ্যদোষে তুমি শয়তান-সদৃশ রাজপুতগণের প্রতারণা ও প্রলোভনে ভুলিয়া আদমের মত স্বর্গের সম্পদ হইতে বঞ্চিত হইয়াছ এবং বিপদের গিরিমরুতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। আমি ইহার কি প্রতিবিধান করিতে পারি? তোমার বর্তমান দুর্দ্দশার কথা শুনিয়া আমার হৃদয় দুঃখে ভরিয়া গিয়াছে, এমন কি জীবন তিক্ত বোধ হইতেছে। হায়! হায়! হাজার বার হায়! হায়! বাদশাহজাদার মান-সম্ভ্রম ভুলিয়া গিয়া, নিজ তরুণ বয়সের কথা একবারও না ভাবিয়া, নিজ স্ত্রীপুত্রের প্রতি সদয় না হইয়া, নির্বুদ্ধিতার ফলে তুমি তাহাদের ঐসব পশু-সদৃশ হিংস্র-প্রকৃতি বদমায়েস রাজপুতের হাতে বন্দী অবস্থায় অতি দুর্দ্দশার মধ্যে ফেলিয়া দিলে! আর তুমি নিজে পোলো খেলার বলের মত চারিদিকে অবিরাম ছুটিতেছ!

বিশ্বপিতা সকল পিতার হৃদয়েই পুত্রস্নেহ দিয়াছেন; অতএব, যদিও তুমি মহা অপরাধ করিয়াছ, আমি চাহি না যে তুমি নিজ কার্য্যের শাস্তি ভোকর।

ভস্মের পঞ্জর হয় যদ্যপি নন্দন, জনকজননী কাছে আঁখির অঞ্জন।
যাক, যাহা হইয়াছে তাহা হইয়াছে।

এখন যদি তুমি অতীতের জন্য অনুতাপ করিয়া যেখানে ইচ্ছা আমার সঙ্গে দেখা কর, আমি তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করিব এবং তোমাকে কল্পনাতীত অনুগ্রহ দিব।… রাজপুতদের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ রাজা যশোবন্ত সিংহ দারাশুকোকে কে সাহায্য ও সমর্থন করিয়াছিল (তাহা কিরূপ বেশ জানা আছে) সেইমত তুমিও নিশ্চয় জানিও, (রাঠোরদের প্রতিশ্রুত সাহায্যের ফলে) তোমার লজ্জা ও উল্টা ফল ভিন্ন আর কিছুই হইবে না। ঈশ্বর তোমাকে সরল পথ দেখান!”

আওরংজীবের প্রতি আকবরের বিষময় পত্র

এই চিঠি পাইয়া আকবর যে উত্তর দিলেন তাহাতে নিশ্চয়ই দুর্গাদাসের হাত ছিল। চিঠিখানি কোন সুলেখক ফার্সী মুশির লেখা। রচনা-চাতুর্য্য ও শ্লেষ উক্তির দৃষ্টান্ত-স্বরূপ ইহা পূর্ব্বে ছাত্রদের পড়ান হইত। উত্তরটি এইরূপ:-

“…আপনি লিখিয়াছেন ‘আমি তোমাকে আমার আর সব পুত্র অপেক্ষা বেশী ভালবাসি।’… ইহালোক ও পরলোকের বাদশাহ! সালাম। পিতার সন্তোষ-বিধান ও সেবা করা যেমন পুত্রের কর্ত্তব্য, তেমনি সকল পুত্রের প্রতিপালন, নৈতিক ও আর্থিক মঙ্গলচেষ্টা, এবং স্বত্ব রক্ষা পিতার কর্তব্য। ঈশ্বর ধন্য হউন! আমি এতদিন পর্য্যন্ত পিতৃসেবায় কোন অংশে ত্রুটি করি নাই। …কনিষ্ঠ পুত্রকে রক্ষা ও স্নেহ করা সর্ব্বত্রই পিতার প্রধান সাধনা। আর, আপনি পৃথিবীর এই রীতির বিপরীত পথে গিয়া সব পুত্র অপেক্ষা আমাকে কম স্নেহ করিয়াছেন। আপনি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে ‘শাহ’ (= রাজা) উপাধি দিয়া সম্মানিত এবং নিজ উত্তরাধিকারী নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন। ইহা কিরূপ ন্যায় বিচার? সব ছেলেরই পিতার ধনে সমান অধিকার আছে। এক পুত্রকে বড় করা এবং আর সকলকে তাহার নীচে ফেলা ধর্ম্মপুস্তকের কোন বিধি অনুযায়ী?… অথচ আপনার ধর্ম্মপ্রাণতা, কোরান মানিয়া চলা এবং ন্যায় ও সত্যের অনুসরণ জগৎ প্ৰসিদ্ধ!…

‘সত্যসত্যই এই পথের (অর্থাৎ পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের) পথপ্রদর্শক ও শিক্ষাগুরু আপনি নিজেই, অপরে শুধু আপনার পদানুসরণ করিতেছে। যেপথে আপনি নিজে চলিয়াছিলেন তাহাকে কিরূপে ‘অশুভ পন্থা’ বলা যায়? (পদ্য)

আমার পিতা স্বর্গের উদ্যান দুইটি
গমের বদলে বিক্রয় করিয়াছিলেন;
আমি তাঁহার উপযুক্ত পুত্র হইব না যদি
এক দানা যবের লোভে বিক্রয় না করি।

(অর্থাৎ, শয়তানের প্ররোচনায় মানবের আদি পিতা বাবা আদম নিষিদ্ধ ফল– খ্রিস্টান বাইবেলে আপেল্ মুসলমান কোরানে দুই দানা গম-খাইবার অপরাধে স্বর্গের উদ্যান হইতে পৃথিবীতে তাড়িত হন। আওরংজীব উপরের চিঠিতে লিখিয়াছেন যে রাজপুতদের প্ররোচনায় আকবর পিতৃগৃহের স্বর্গসুখ হইতে স্বেচ্ছায় নির্ব্বাসিত হইয়াছেন। এটা তাহারই উত্তর!

আকবর যে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কালযাপন করিতেছেন বলিয়া আওরংজীব শোক প্রকাশ করেন, তাহার উত্তরে আকবর লিখিলেন (ভাবার্থ)

দুঃখ বিনা সুখলাভ হয় কি মহীতে?
এবং ‘বিপদের ভিতর দিয়াই সিংহাসন লাভ করা যায়।’

তাহার পর, আওরংজীব যশোবন্ত সিংহ ও রাজপুত জাতির যে নিন্দা করিয়াছিলেন সে সবগুলির খন্ডন করিয়া এবং ভারত-ইতিহাস হইতে রাজপুতদের প্রভু ভক্তির বহু দৃষ্টান্ত দিয়া, আকবর দেখাইলেন যে রাঠোরেরা নিজ রাজা যশোবন্তের নাবালক পুত্রের রাজ্যরক্ষার জন্য তিন বৎসর ধরিয়া অকাতরে প্রাণ দিয়া এমন যুদ্ধ করিয়াছে যে হিন্দুস্থানের বাদশাহ, তাঁহার পুত্রগণ এবং ওমরাগণ নিষ্ফল ও নাকাল হইয়া এখনও তাহাদের বিরুদ্ধে ঘুরিতেছে।)

‘আর, কেনই বা এমন হইবে না? আপনার রাজত্বে উজিরদের ক্ষমতা নাই, ওমরাদের উপর বিশ্বাস নাই, সিপাহীরা হীন দরিদ্র, লেখকেরা কর্মহীন, সওদাগরদের সম্পত্তি নাই, রায়তেরা পদদলিত। সেইমত দাক্ষিণাত্যের মত প্রকাণ্ড মহাদেশ–উৎসন্ন হইয়া মরুভূমির আকার ধারণ করিয়াছে।…হিন্দুদের উপর দুই বিপদ পড়িয়াছে, সহরে জজিয়া আদায়, আর মাঠে শত্রুদের (অর্থাৎ মারাঠাদের) অত্যাচার।…সদ্বংশীয় পুরাতন ঘরের লোকেরা সব লোপ পাইয়াছে; আর আপনার রাজ্যের নানা বিভাগের কাজের এবং রাজকীয় মন্ত্রণার ভার পড়িয়াছে শুধু মুটে-মজুর, ছোটলোক, জোলা, সাবান-বিক্রেতা, পিরানের দর্জি প্রভৃতির উপর। তাহারা জুয়াচুরির বিশাল আলখাল্লা বগলে, এবং প্রতার- ণার ফাঁস, অর্থাৎ জপের মালা, হাতে লইয়া মুখে কতকগুলি ধৰ্ম্মগ্রন্থের শ্লোক এবং নীতিবাক্য আওড়াইতে থাকে। আপনি এই সব লোককে স্বর্গদূত জব্রিয়েল আস্রাফিল ও মিকায়েলের মত ভাবিয়া নিজের সঙ্গী, অন্তরঙ্গ এবং বিশ্বস্ত মন্ত্রী করিয়াছেন এবং নিজকে অসহায়ভাবে ইহাদের হাতে সমর্পণ করিয়াছেন।…

(রাজা মোদের) শাহ আলমগীর গাজী,
তাঁর যুগে হয়েছে সাবানওয়ালারা সদর আর কাজী,
জোলা আর তাঁতির হয়েছে এত অহঙ্কার,
যে এই ভোজে রাজা হয়েছেন তাহাদের সহচর।
ছোটলোকের হাতে এসেছে এমন অধিকার,
যে পণ্ডিত আশ্রয় লয় তাদের দ্বার।
মূর্খের হয়েছে এমন পদ উঁচু
যে বিজ্ঞেরও তাহা না হয় কভু।
আল্লা বাঁচান আমাদের এই যুগের বিপদ হ’তে
যখন আরবী ঘোড়া লাথি খায় গাধার পদ হ’তে।

“আপনার রাজকর্মচারীরা সওদাগরের ব্যবসা ধরিয়াছে, তাহারা টাকা দিয়া সরকারী চাকরী কেনে, আর ঘৃণ্য লাভের জন্য তাহা বিক্রয় করে। যে নুন খায় সে নুনের পাত্রটি ভাঙ্গিয়া ফেলে এবং বিশ্বস্ততার বদলে অনাচার অত্যাচার করে।

“যখন আমি দেখিলাম, দেশের এই সব অন্যায় আপনার দ্বারা সংশোধিত হওয়া অসম্ভব, তখন রাজবংশের উচ্চপ্রবৃত্তি আমাকে এই সংস্কার-কার্য্য নিজ হাতে লইয়া পুনরায় দেশে শান্তি ও সুখ, গুণের আদর ও জ্ঞানের সম্মান ফিরাইয়া আনিতে প্রণোদিত করিল’

“কি সুখের বিষয় হইবে, যদি আপনার এমন সুমতি হয় যে, এই কাৰ্য্য আপনার ক্ষুদ্রতম পুত্রের হাতে দিয়া স্বয়ং মক্কায় তীর্থযাত্রা করেন! তবেই লোকে আপনাকে প্রশংসা ও আশীর্ব্বাদ করিবে।

আপনি এতদিন ধরিয়া সমস্ত জীবন ধন ও পার্থিব বস্তুর অন্বেষণে কাটাইয়াছেন– সেগুলি স্বপ্ন অপেক্ষা অলীক এবং ছায়া অপেক্ষাও অনিশ্চিত। এখন সময় হইয়াছে– আপনি পরলোকের জন্য পাথেয় সঞ্চয় করুন, তবে ত ঐহিক মোহবশে পূর্বে পিতা ও ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে যেসব দুষ্কর্ম্ম করিয়াছিলেন তাহার প্রায়শ্চিত্ত হইবে। (পদ্য)

বয়স হয়ে গেল আশী, আর এখনও ঘুমাচ্ছ,
এই দুচার দিনের বেশী আর সময় পাবে না।
আপনার পত্রে আমাকে যে উপদেশ দিয়াছেন তাহা
পড়িয়া আপনার নির্লজ্জ সাহস দেখিয়া লজ্জা পাই।
নিজের বাপকে কেমন ব্যবহার করেছিস্
যে পুত্রের কাছে এইমত ভক্তি আশা করিস?
তুমি জগতকে নীতি উপদেশ দিতেছ,
পরকে না শিখাইয়া সেই নীতি নিজে মানিয়া চল, দেখি।’

আওরংজীবের আক্রোশ

এই চিঠি পাইবার পর আর ক্ষমা করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আকবর ত পলাইয়া মহারাষ্ট্রে গেলেন, কিন্তু তাঁহার অনুচরদের ধরিয়া অতি নিষ্ঠুর শাস্তি দেওয়া হইল। রাজকুমারী জের্-উন্-নিসা (‘মফী’ ছদ্মনামধারী কবি আকবরকে বড় ভালবাসিতেন, তাঁহার চিঠিগুলি আকবরের পরিত্যক্ত শিবিরে পাওয়াতে তাঁহার সমস্ত ধন ও জাগীর জৎ করিয়া তাঁহাকে দিল্লীর সলিমগড় দুর্গে আমরণ বন্দী করিয়া রাখা হইল। যে চারজন মোল্লা আওরংজীবকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া আকবরকে সম্রাট করিবার ফতোয়া সহি করিয়াছিল, তাহাদের খালিপায়ে গড়বিটলীর চূড়ায় হুড় হুড় করিয়া টানিয়া হাঁটাইয়া লইয়া যাওয়া হইল, আবার সেইমত নীচে আনিয়া কাজীর বাড়ীতে লইয়া গিয়া তক্তার সহিত বাঁধিয়া পেচান চামের দড়ির চাবুক (দুরা) দিয়া কশাঘাত করা হইল। সমস্ত দিন বারংবার এই মতো পাহাড়-চড়ান ও চাবুক মারা চলিতে থাকিল; সন্ধ্যা হইলে তাহাদের কারাগারে লইয়া গিয়া শিকলে বাঁধিয়া রাখা হইল।

বিদ্রোহের অপর সব সাহায্যকারীকে, এমন কি যাহারা আকবরকে পত্র লিখিত তাহাদের পর্য্যন্ত, ধরিয়া কয়েদ করা হইল– তাহাদের সম্পত্তি জব্‌ৎ করা হইল। বাদশাহ হুকুম দিলেন, ভবিষ্যতে সব সরকারী চিঠিপত্র ও ইতিহাসে আকবরের নাম ‘বাঘী’ (=বিদ্রোহী) এবং ‘আন্তর্’ (= অধমতম) লেখা হইবে, –’আকবর’ (=সর্ব্বপ্রধান) নহে।

দাক্ষিণাত্যে পলাইবার সময়, পাছে কেহ আকবরকে চিনিয়া বা মুসলমান রাজকুমার বলিয়া সন্দেহ করিয়া ধরিতে না পারে, এইজন্য তাঁহাকে ছদ্মবেশ পরাইয়া একেবারে রাঠোর রাজপুত সাজান হইল। তিনি দাড়ি কামাইয়া, আকর্ণ বিস্তৃত গোঁফ রাখিয়া, কানে মুক্তা পরিলেন-দেখিতে যেন ঠিক রাজপুত। মুসলমানের চিহ্নই দাড়ি। পুত্রের এই হিন্দু-সাজিবার সংবাদ পাইয়া গোঁড়া আওরংজীব রাগভরে কিছুক্ষণ নিজের লম্বা দাড়ি মুখে দিয়া চিবাইলেন, তাহার পর দাক্ষিণাত্যের পথের ও ঘাটির প্রহরী কর্মচারীদিগকে অযত্নের দোষ দিয়া ভর্ৎসনা ও বেতন কম করিলেন। (জয়পুর-কাগজ)

কয়েক মাস পরে বাদশাহের দরবারে আরব দেশের চিঠিতে সংবাদ আসিল যে একদিন মক্কায় অতিবৃষ্টি হইবার ফলে বন্যা হইয়া শহরের রাস্তা ও বাড়ীগুলি ডুবিয়া যায় এবং ছয় হাজার দেশবাসী ও দুই হাজার বিদেশী যাত্রী (হাজী) প্রাণ হারায়। আওরংজীব জিজ্ঞাসা করিলেন এটা কোন তারিখে ঘটে; সংবাদপত্র পড়িয়া জানা গেল ৩রা জানুয়ারী ১৬৮১। অমনি বাদশাহ বলিয়া উঠিলেন, “তা আর হবে না কেন? ঠিক সেই সময়ই আমার মতো ধাৰ্ম্মিক মুসলমানের পুত্র বিদ্রোহী হয় এবং কাফিরদের সঙ্গে যোগ দেয়-ইসলামের পক্ষে এমন অশুভ দিন আর কি হইতে পারে।’

আকবর রাজপুতানা হইতে দাক্ষিণাত্যে পৌঁছিয়াছেন শুনিয়া বাদশাহ বলিলেন, “আকবর যখন এই ভীমরুলের চাক হইতে বাহির হইয়াছে, তখন ঈশ্বরেচ্ছায় শীঘ্রই তাহাকে ধরা যাইবে।” (জয়পুর-কাগজ)

শম্ভুজীকে লিখিত আকবরের পত্র

মারাঠা দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া আকবর পথ হইতে শম্ভুজীকে ১১ই মে ১৬৮১ এই পত্র লেখেন:-

“নিজ রাজত্বের প্রথম হইতেই আলমগীরের মনের অভিপ্রায় ছিল হিন্দুদের সমূলে ধ্বংস করা। মহারাজা যশোবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর এই মতলব স্পষ্ট প্রকাশ পাইল; আর মহারাণা [রাজসিংহ]-কে আক্রমণও সেই অভিপ্রায়ে।”

সব মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তিনি সকলেরই রক্ষক; অতএব, যখন আমরা হিন্দুস্থানের বাদশাহ, তখন এই ভূম্যধিকারী জাতি (অর্থাৎ রাজপুত)-যাহাদের জন্যই হিন্দুস্থান দেশটা–তাহাদের সমূলে উচ্ছেদ করিবার চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে উচিত নহে।

আলমগীর বাদশাহের কর্ম্ম যখন সীমা অতিক্রম করিল, আমি নিশ্চয় বুঝিলাম যে যদি এই জাতির (অর্থাৎ রাজপুতদের) অধঃপতন হয়, তবে হিন্দুস্থান রাজ্য আমার রাজবংশের হাতে থাকিবে না। অবএব, নিজ পিতৃপুরুষের সম্পত্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া, আমাদের অতি প্রাচীন শুভাকাঙ্ক্ষী এই জাতির রক্ষার জন্য, রাণা রাজসিংহ ও দুর্গাদাস রাঠোরের প্রার্থনায়, এই স্থির করিলাম যে সৈন্য লইয়া আজমীর গিয়া রাজার মত (বাদশাহের সহিত) যুদ্ধ করিব, তবে ঈশ্বরের যাহা অভিপ্রায় তাহা প্রকাশ হইবে। তাহার পর রাণা রাজসিংহের মৃত্যু হওয়ায় এই কাজে কয়েক দিন বিলম্ব হইল [নূতন] রাণা জয়সিংহ এক মাস পরে বাদশাহ কুলী খাঁ (অর্থাৎ তাহাউর]-কে দিয়া পিতার সেই প্রার্থনাই আবার জানাইলেন, এবং বলিয়া পাঠাইলেন, “হিন্দুস্থানের সম্মান বাঁচুক– ইহাই যদি আপনার মনের বাঞ্ছা হয়, আমরা সকলে আপনার পোশাকের কিনারায় ভিক্ষার হাত দিয়া, আপনার নিকট হইতে বিপদে ত্রাণ এবং মঙ্গলের আশা করি।’–তখন এই দুই প্ৰধান রাজপুত জাতির প্রার্থনায় আমি পৈত্রিক রাজ্য অধিকার করিবার জন্য আজমীর-এর দিকে অগ্রসর হইলাম।…’ [পত্রের বাকী অংশে যে বিবরণ আছে তাহা আগে দেওয়া হইয়াছে। ]

আকবরের মহারাষ্ট্র-প্রবাস

মহারাষ্ট্র দেশে আশ্রয় লইয়া আকবর সাড়ে পাঁচ বৎসর কাটাইলেন। শম্ভুজী তাঁহাকে বার বার আশ্বাস দিলেন যে অনেক হাজার মারাঠা সৈন্য সঙ্গে দিয়া তাঁহাকে রাজপুতানায় পাঠাইবেন এবং সেখানে রাঠোর ও শিশোদিয় দলের সহিত আবার জুটিয়া বাদশাহজাদা আগ্রা দিল্লী সহজেই জয় করিয়া নিজকে ভারত-সিংহাসনের অধীশ্বর করিবেন, আর আওরংজীব দাক্ষিণাত্যে আবদ্ধ থাকিয়া সব হারাইবেন। কিন্তু বৎসরের পর বৎসর চলিয়া গেল, শম্ভুজী নিজ প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিলেন না, এবং তিনি যে সাহায্য করিবেন তাহার কোন চিহ্নও দেখা গেল না। ইতিমধ্যে বাদশাহের পরম শত্রু মারাঠারাজের সহিত আকবর যোগ দেওয়ায় আওরংজীব অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া স্বয়ং দাক্ষিণাত্যে আসিলেন (নভেম্বর ১৬৮১), এবং শীঘ্র প্রবল সৈন্যদল পাঠাইয়া আকবরের উত্তর পূর্ব্ব ও দক্ষিণে যাইবার পথ বন্ধ করিয়া দিলেন। অবশেষে, পিতৃরাজ্য কাড়িয়া লইবার কোন সাহায্য শম্ভুজীর নিকট পাওয়া যাইবে না বুঝিয়া আকবর তাঁহার সহিত ঝগড়া করিয়া পারস্যে যাইবার জন্য জাহাজ ভাড়া করিবার উদ্দেশ্যে গোয়া শহরের দশ মাইল উত্তরে বিচোলী নামক স্থানে আশ্রয় লইলেন (১৬৮৩ সালে), এবং গোয়া ও অন্যান্য বন্দরে লোক পাঠাইয়া জাহাজ সংগ্রহ করিবার চেষ্টায় থাকিলেন। তাঁহার ভয় ছিল পাছে বাদশাহের আদেশে মুঘল নৌ-সেনাপতি সিদ্দী রণপোত লইয়া তাঁহাকে পথে বন্দী করে। ১৬৮৩ সালের নভেম্বরে হতাশ আকবর একখানা জাহাজে উঠিলেন বটে, কিন্তু শম্ভুজীর মন্ত্রী ‘কবিকলশ’ তাড়াতাড়ি আসিয়া দুর্গাদাসের সাহায্যে তাঁহাকে হাতে পায়ে ধরিয়া দেশত্যাগের ইচ্ছা হইতে বিরত করিলেন, কারণ আকবর চলিয়া গেলে শম্ভুজীর বড় দুর্নাম হইত।

আকবর নানাপ্রকার নূতন প্রতিজ্ঞায় ভুলিয়া আবার মহারাষ্ট্র দেশে আশ্রয় লইলেন, এবং মাকাপুর, রাজাপুর, সাখরপে প্রভৃতি স্থানে (রত্নগিরি জেলায়) আরও কয়েক বৎসর কাটাইলেন। কিন্তু তাহাতে কোনই লাভ হইল না। এমন কি শম্ভুজী তাঁহার মণিমুক্তা কাড়িয়া লইয়াছিলেন এরূপ কথা এক পত্রে পড়া যায়। অবশেষে ১৬৮৬ সালের শেষাশেষি যখন আওরংজীব বিজাপুর-দুর্গ অধিকার করিয়া সেই রাজ্য নিজ দখলে আনিলেন, তখন আকবরের ভারতে আর কোন আশাই রহিল না, এমন কি এদেশে বাস করাও ভয়ানক বিপদজনক হইল। তখন (ফেব্রুয়ারি ১৬৮৭) তিনি ফরাসীদের সাহায্যে রাজাপুরবন্দরে একখানি ছোট জাহাজ ভাড়া করিয়া মাত্র ৪৫ জন অনুচর সঙ্গে লইয়া পারস্য-দেশের দিকে রওনা হইলেন। সমুদ্রে ঝড়ে তাঁহার জাহাজ মস্কটের অধীন একদ্বীপে গিয়া আশ্রয় লইলেন।

মস্কটের শাসনকর্তা (ইমাম্) তাঁহাকে নজরবন্দী করিয়া রাখিয়া আওরংজীবের নিকট লিখিয়া পাঠাইল যে, যদি তাহাকে দুই লক্ষ টাকা নগদ এবং সুরত-বন্দরে আমদানী সমস্ত মস্কটি পণ্যদ্রব্যের উপর মাশুল মাফ করার সনদ দেওয়া হয় তবে সে আকবরকে বন্দী করিয়া বাদশাহের নিকট সমর্পণ করিবে। কিন্তু পারস্যের রাজা শাহ সুলেমান্ সফবী সংবাদ পাইয়া আকবরকে নিজ দরবারে পাঠাইবার জন্য ইমাকে হুকুম দিলেন, কারণ আকবর পারস্য-রাজের আশ্রয়প্রার্থী অতিথি হইয়া আসিয়াছিলেন। শাহের আক্রমণের ভয়ে ইমাম্ কুমার আকবরকে শাহের দূতের হাতে ছাড়িয়া দিল।

নির্ব্বাসিত আকবর

পারস্য-রাজধানী ইস্‌ফাহানে আকবর পৌঁছিলে শাহ সুলেমান তাঁহাকে সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা করিলেন; দুপক্ষে ঐ সময়ের উপযোগী হাফিজের পদ্য আবৃত্তি হইল! আকবর মহা আরামে অতিথি সেবা পাইতে লাগিলেন। কিন্তু যখন ভারত-সাম্রাজ্য অধিকার করিবার জন্য পারস্যের সৈন্য ও অর্থ সাহায্য চাহি-ে লন, শাহ উত্তর দিলেন, “পিতৃদ্রোহ মহাপাপ; আপনার পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আমি সাহায্য করিতে পারি না। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর ভ্রাতাদের সঙ্গে লড়িয়া আপনার পৈত্রিক সিংহাসন অধিকার করিবার জন্য আপনাকে যথাসাধ্য সৈন্য ও অর্থ বল দিব।”

তখন আকবর আর কি করেন? দিন-রাত বসিয়া পিতার আশু মৃত্যু প্রার্থনা করিতে লাগিলেন! এই সংবাদ পাইয়া আওরংজীব তিক্ত হাসি হাসিয়া এই পদ্যটি আবৃত্তি করিলেন-

‘আমার মন থেকে কুম্ভকারের সেই কথাটা
যাইতেছে না;
সে একটি অতি কোমল পিয়ালা নিৰ্ম্মাণ
করিয়া তাহাকে বলেছিল,–
জানি না আকাশ হইতে অদৃষ্টে ঢিল পড়ে
তোকে আগে ভাঙ্গবে কি আমাকে আগে।’

ফলত তাহাই ঘটিল। শাহ সুলেমানের মৃত্যুর পর হুসেন পারস্যের শাহ হইলেন। আকবর তাঁহার নিকট একবার পিতার মিথ্যা মৃত্যু-সংবাদ রটাইয়া সৈন্য প্রার্থনা করিলেন। শাহ উত্তর দিলেন যে, ভারতবর্ষের পশ্চিম-বন্দরগুলিতে তাঁহার গুপ্তচর আছে, তাহাদের নিকট হইতে বাদশাহের মৃত্যু-সংবাদ সঠিক জানিবার জন্য অপেক্ষা করিতে হইবে। পরে যখন আকবরের কথা মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইল, তখন পারস্য-রাজদরবারে তাঁহার প্রতি অবজ্ঞা ও অযত্ন দেখা দিল।

অবশেষে বিরক্ত হইয়া আকবর পারস্যের দক্ষিণ-পূর্ব্ব প্রদেশ খুরাসানে আসিয়া বাস করিতে লাগিলেন। ইহা মুঘল-সাম্রাজ্যের আফগানিস্তান প্রদেশের গায়ে সংলগ্ন, এখান হইতে অতি দ্রুত মুঘল দেশ আক্রমণ করা যায়। এজন্য কাবুলের সুবাদার কুমার শাহ আলম অত্যন্ত ভাবনায় রহিলেন। যাহা হউক, অবশেষে ভগ্নহৃদয় নির্ব্বাসিত আকবর ১৭০৩ সালের শেষে, অর্থাৎ‍ পিতার মৃত্যুর তিন বৎসর পূর্ব্বেই, প্রাণত্যাগ করিলেন। শুনিয়া আওরংজীব বলিলেন-

“হিন্দুস্থানের মহা অশান্তির কারণ থামিল।”

বিদ্রোহের পর মাড়োয়ারে পরিত্যক্ত আকবরের পুত্র-কন্যাকে দুর্গাদাস কেমন যত্নে প্রতিপালন করেন এবং আওরংজীবের নিকট তাহাদের আনিয়া দেন, সে এক মনোরম কাহিনী।

[ প্রবাসী, ভাগ ২৯, ২য় খণ্ড, সংখ্যা ৩, পৌষ, ১৩৩৬। ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *