আওরংজীবের আদি লীলা
সাধারণের মনে একটা ধারণা আছে যে, বাদশাহ আওরংজীব বড় জিতেন্দ্রিয় ঋষিতুল্য লোক ছিলেন। এমন কি, মাসির উল্ আলমগিরি রচয়িতা তাঁহাকে ‘সিংহাসনারূঢ় দরবেশ’ আখ্যা দিয়াছেন। কুমার অবস্থায়, ২৬ বৎসর বয়সে, তিনি একবার সংসার ছাড়িয়া পর্ব্বতে গিয়া তপস্বী হন, কিন্তু পিতা তাঁহাকে ফিরাইয়া আনেন। আওরংজীবেব শেষ বয়সে অনবরত ধর্ম্মশাস্ত্ৰ হইতে শ্লোক উদ্ধৃত করা, বিলাস ও আমোদের কঠোর নিষেধ, এবং ‘সম্মুখে টাক ও পশ্চাতে টিকি’ দেখিয়া অনেকে ভাবেন, যে তিনি বুঝি চিরজীবনই ঐরূপ ছিলেন। নিম্নের ঐতিহাসিক ঘটনা হইতে পাঠক বুঝিতে পারিবেন যে, কুসুমায়ুধ এই সহ্যাদ্রিপর্ব্বতে ধ্যানরত পিনাকপাণিরও ধৈর্য্যচ্যুতি করিয়াছিলেন। (ফার্সী হইতে অনুবাদ যথাসম্ভব অবিকল করিলাম, কেবল সুরুচির অনুরোধে এবং অর্থ সরল করিবার জন্য কয়েক স্থানে অল্প অল্প পরিবর্তন ও যোগ করিয়া দিয়াছি।)
১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে শাহজাদা আওরংজীব সুবাদার হইয়া দ্বিতীয় বার দাক্ষিণাত্যে শাসন করিতে যান। সঙ্গে মুর্শীদকুলী খাঁ খোরাসানী দেওয়ান ছিলেন। (ইনি বাঙ্গলার নবাব মুর্শীদকুলী খাঁ নহেন।) কুমারের আপন মেসো (অর্থাৎ সাম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের ভগ্নীপতি) মীর খলীল খাঁজমান্ দাক্ষিণাত্যে মুঘল তোপখানার দারোগা ছিলেন। তাঁহার সহিত কুমারের অত্যন্ত হৃদ্যতা জন্মে। আওরংজীবের বয়স তখন ৩৩ চান্দ্র বৎসর ইতিপূর্ব্বে তাঁহার তিন পুত্র ও চার কন্যা হইয়াছে; সুতরাং তাঁহাকে নিতান্ত যুবক বলিয়া মনে করা যায় না। এই সময়ে জৈনাবাদীর ঘটনা ঘটে। ফার্সীতে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্ভ্রান্তবর্গের জীবনীর এক অভিধান আছে; উহা ১৭৪২ খ্রিঃ অব্দে লেখা; নাম মাসির-উল্-উমরা। উহার প্রথম বালুম ৭৯০-৯২ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে:- (অনুবাদ) ‘খাঁজমান্ খুব আগ্রহের সহিত পার্থিব ব্যাপারে লিপ্ত হইতেন এবং আমোদ প্রমোদ ভালোবাসিতেন। মধুরকণ্ঠা সুন্দরীগণ এবং বিলাসপটু গায়িকাগণকে নিজের বাটীতে রাখিতেন। শুনা যায় যে সুবিখ্যাত জৈনাবাদী যাহাকে আওরংজীব যুবরাজ অবস্থায় অত্যন্ত ভালোবাসিতেন–ইঁহারই অন্তঃপুরচারিণী (মুলা) ছিল।’
‘একদিন শাহ্তাদা আওরংজীব বুহানপুর সহরের হরিণবাড়ী (আহুখানা) নামক বাগানে মেয়েদিগকে লইয়া উপস্থিত হন; এবং প্রমোদ-সহচরীদিগের সহিত ইতস্ততঃ বেড়াইতে থাকেন। জৈনাবাদী সঙ্গীত-চাতুর্য্যে চেতনা- লোপকারিণী এবং হাবভাবে অতুলনীয়া হৃদয়হারিণী ছিল। কুমারের মাসী খাঁজমানের পত্নীর সঙ্গে সেও আসিয়াছিল। বেড়াইতে বেড়াইতে একটি ফলভারনত আমগাছ দেখিয়া, কুমার উপস্থিত আছেন বলিয়া কিছুমাত্র সম্ভ্রম না করিয়া, সে আহ্লাদ ও বিলাসবশতঃ আগাইয়া গেল এবং লাফ্ দিয়া একটি আম পাড়িল। এটা আগা-গোড়া হৃদয়হরণের চাতুরীমাত্র। কুমার ইহাতে একেবারে দিশেহারা হইয়া চেতনা ও আত্মসংযম ত্যাগ করিলেন। নির্লজ্জভাবে জিদ্ করিয়া উহাকে মাসীর নিকট হইতে চাহিয়া লইলেন। কোথায় রহিল তাঁহার যত কঠোর যন্ত্রিত ও সংযম, এবং কোথায় তাহার বিশুদ্ধ শাস্ত্ৰজ্ঞান! উহাকে হৃদয় সমর্পণ করিলেন, এবং এক পেয়ালা শরাব্ নিজহাতে পূর্ণ করিয়া উহাকে দিলেন।
‘শুনা যায়, একদিন জৈনাবাদীও এক পেয়ালা মদ শাহজাদার হাতে দেয় এবং খাইতে অনুরোধ করে। কুমার কত কাকুতি মিনতি করিলেন যে, অনুরোধ রক্ষা হইতে ক্ষমা হউক; কিন্তু সে কিছুতেই শুনিল না। অবশেষে নিরুপায় হইয়া কুমার পান করিবার উপক্রম করিলেন; অমনি সেই চতুরা মায়াবিনী তাহার হাত হইতে পেয়ালা কাড়িয়া লইল, এবং বলিল “আমার ইচ্ছা ছিল আপনার প্রণয় পরীক্ষা করা, এই পাপ ও দুর্ভাগ্যজনক পানীয় খাওয়াইয়া আপনার মুখ তিক্ত করা নহে!” এই প্রণয়-ব্যাপার এতদূর গড়াইল যে, বাদশাহ শাহজাহানের কানে পৌঁছিল। জ্যেষ্ঠ কুমার দারাশুকো আওরংজীবকে হিংসা করিতেন, তিনি এই ঘটনাতে নিন্দার সুযোগ পাইয়া বাদশাহকে বলিলেন, “দেখুন এই ভণ্ড বদ্মাইসটা কি অদ্ভুত তাপব্রত ও সংযম শিখিয়াছে! মেসোর একটা দাসী (কনীজ)র জন্য নিজকে একেবারে উচ্ছন্নে দিয়াছে!”
‘দৈবক্রমে যৌবন বসন্তেই জৈনাবাদীর জীবনকুসুম শুকাইয়া গেল এবং শাহজাদাকে চিরবিচ্ছেদের দগ্ধশলাকা দ্বারা ক্লিষ্ট করিল। আওরংগাবাদ শহরের বড় পুষ্করিণীর নিকট উহার গোরস্থান। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ লোককে অধীর করে; এজন্য উহার মৃত্যুর দিন শাহজাদার অবস্থা বড়ই খারাপ হইল। অত্যন্ত অস্থির বোধ করায় তিনি ঘোড়ায় চড়িয়া শিকার করিতে রওনা হইলেন। সঙ্গে মীর আস্করী আকীল খাঁ অনুচর ছিল। সে নিরিবিলি পাইয়া নিবেদন করিল, “এইরূপ শরীরে শিকার করিতে যাওয়া কি ভাল?” শাহজাদা উত্তর করিলেন–
নালাহা-এ-খানগী দিল্রা তসল্লী-বখ্শ্ নীস্ত।
দর বেয়াবান্ মিতওয়াঁ ফরিয়াদ্ খাতরখবাঃ কৰ্দ।।
অর্থাৎ
গৃহেতে রোদন করি সান্ত্বনা না পাই।
অরণ্যে কাঁদিয়া তাই হৃদয় জুড়াই
আকীল খাঁ উপযুক্ত স্থান বুঝিয়া এই কবিতা আওড়াইল :-
ইক্ চেঃ আসান্ নমুদ! আঃ চেঃ দুষওয়া বুদ্!
হজর চেঃ দুয়ার বুদ! ইয়ার্ চেঃ আসান্ গেরেফৎ!!
অর্থাৎ
কত সুখকর প্রেম দূরেতে ভাবিনু,
কাছে এসে, আহা! কত কঠোর দেখিনু!
বিয়োগ আমার কত কঠিন লাগিল,
কিন্তু সেই প্রিয়া তাহে কত শান্তি পেল!!
নিরুপায় শাহজাদা কাঁদিয়া কাদিয়া, অবশেষে কবিতাটি মনে রাখিলেন।’ কিন্তু জৈনাবাদী সম্বন্ধে আমরা আরও কিছু জানিতে পাই। আওরংজীবের চেলা হামিদুদ্দীন খাঁ নিমচা আহকাম-ই-আলমগিরি নামে এক বহি লেখেন। ইহা সভ্য জগতে এবং ভারতবর্ষের মৌলবিগণের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিবিলিয়ন্ মিষ্টর বিলিয়াম্ আর্ভিন সাহেব (এখন অবসরপ্রাপ্ত,) গেরখপুরে ইহার একমাত্র হস্তলিপি সংগ্রহ করেন, এবং কৃপা করিয়া আমাকে নকল লইতে দেন। সেই হস্তলিপির ২০ক-২১ক পৃষ্ঠায় লেখা আছে:- (অনুবাদ)
জৈনাবাদীর ঘটনা এইরূপ– শাহজাদা দাক্ষিণাত্যের সুবাদার থাকার সময় আওরাঙ্গাবাদ সহরে যাইতে বুহানপুর পৌঁছেন। তথাকার সুবাদার সৈফ্ খাঁর স্ত্রী, আসখাঁর কন্যা, শাজাদার মাসী, সালিহাবানু উহাকে নিমন্ত্রণ করেন এবং উনিও তাঁহাকে দেখিতে যান। মাসীর বাড়ী বলিয়া কুমারের আসিবার আগে অন্তঃপুরের স্ত্রীলোকদিগকে তত সাবধানে সরাইয়া রাখা হইত না; উনিও খবর না দিয়া অন্দরে ঢুকিতেন। জৈনাবাদী- যাহার পূর্ব্বনাম হীরাবাই ছিল–একটি গাছের নীচে দাঁড়াইয়া দক্ষিণহস্তে এক ডাল ধরিয়া মৃদু স্বরে গান করিতেছিল। তাহাকে দেখিবামাত্র শাহজাদা তথায় বসিয়া পড়িলেন, এবং কিছু পরে মাটিতে লম্বা হইয়া মূর্ছা গেলেন। মাসী খবর পাইয়া খালি পায়ে ছুটিয়া আসিয়া কুমারকে বুকে তুলিয়া লইলেন এবং কাঁদাকাটি আরম্ভ করিলেন। তিন চারি ঘড়ি পর শাহজাদা সচেতন হইতেন। মাসী যতই জিজ্ঞাসা করেন, “কি অসুখ হয়েছে? আগে কি কখনো এ অসুখ হয়েছিল?” কুমার একেবারে নিরুত্তর নির্ব্বাক থাকেন। মাসী-বাড়ীর আমোদ ও খানা সব বন্ধ হইয়া গেল এবং শোক ও বিষাদ উপস্থিত হইল। অর্দ্ধরাত্রে কুমারের কথা ফুটিল; মাসীকে বলিলেন, “যদি আমার ব্যারামের কথা বলি, চিকিৎসা করিতে পারিবেন?” মাসী কথা শুনা মাত্ৰ অত্যন্ত খুশী হইয়া দানধ্যান করিয়া পরে বলিলেন, “চিকিৎসা ত কি জিনিস, আমার প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে পারি!” তখন শাহজাদা ঘটনা বিস্তারিত প্রকাশ করিলেন শুনিয়া মাসীর (ভয়ে) জ্ঞান লোপ পাইল এবং জিহ্বা আড়ষ্ট হইয়া গেল; আর কি উত্তর দিবেন? অবশেষে কুমার বলিলেন, “আপনি মিছিমিছি আমার অবস্থা জানার জন্য এত ব্যগ্রতা দেখাইলেন। আমার কথার উত্তর পর্য্যন্ত দিতেছেন না; তবে আর কি চিকিৎসা করিবেন?” মাসী বলিলেন, “আমি যেন তোমার বলি হই! কিন্তু সেই হতভাগা (অর্থাৎ স্বামী সৈফ্ খাঁ) কে ত তুমি জান; ভয়ানক খুনী লোক, বাদশাহ ও তোমাকে বিন্দুমাত্র ভয় করে না। এই প্রস্তাব শুনিবামাত্র সে প্রথমে হীরাবাইকে তারপর আমাকে কাটিয়া ফেলিবে। উহাকে এই কথা জানাইলে আর কোনও লাভ হইবে না, কেবল আমার প্রাণটাকে বলি দেওয়া হইবে। কিন্তু সেই নির্দোষী নিষ্পাপ বেচারা (হীরাবাই)র জীবনটা কেন নাশ করিবে?” শাহজাদা উত্তর করিলেন, “ঠিক কথা বটে, অন্য ফিকির করিব।”
‘সূর্যোদয়ের পর কুমার নিজ বাসায় আসিলেন, এবং আহারে একেবারে হাত দিলেন না। নিজ কর্মচারী ও দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান, মুর্শীদকুলী খাঁকে ডাকিয়া সেই বিশ্বস্ত মন্ত্রীকে গোপনে সব কথা জানাইলেন। মুর্শীদ বলিল, “আমি গিয়া আগে সৈফ্ খাঁর দফা শেষ করি, তারপর যদি তাহার লোকেরা আমাকে মারিয়া ফেলে, ক্ষতি নাই; আমার জীবনের বদলে প্রভুর কাজ ত সম্পন্ন হইবে।” শাহজাদা উত্তর করিলেন, “তুমি যে প্রকৃতই আমার কাজে জীবন দিতে প্রস্তুত তাহা আমি জানি। কিন্তু মাসীকে বিধবা করিতে আমার অন্তর স্বীকার পায় না। বিশেষত: নির্ঘাত খুন করাটা ধর্ম্মশাস্ত্রে নিষিদ্ধ। এখন ঈশ্বর ভরসা করিয়া (সৈফ্ খাঁকে) সব কথা বলিতে হইবে।” মুর্শীদ কুলী বিনা ওজরে রওনা হইল, এবং সব কথা সৈফ্ খাঁকে জানাইল। সৈফ খাঁ বলিলেন, “শাজাদাকে আমার কুর্নীশ দিবেন এবং বলিবেন যে, ইহার উত্তর তাহার মাসীকে দিব।” তখনই অন্দরে গিয়া স্ত্রীকে বলিলেন, “ক্ষতি কি? শাহ নওয়াজ খাঁর কন্যা (আওরংজীবের বিবাহিতা স্ত্রী দিল্রস্ বানু) বেগমে আমার কাজ নাই। শাহ্াদা নিজের অন্তঃপুরচারিণী (হরম্) চত্তর বাইকে আমায় দিন; আর তার বদলে আমি হীরাবাইকে পাঠাইয়া দিব।” সেই মুহূর্তেই মাসীকে পাল্কী করিয়া কুমারের নিকট পাঠাইলেন। মাসী প্রথমে আপত্তি করিতেছিলেন যে যাব না; তাঁহার স্বামী বলিলেন, “যদি প্রাণ বাঁচাতে চাস্, এখনি যা!”, মাসী নিরুপায় হইয়া আসিয়া শাজাদাকে সব কহিলেন। তিনি মহা খুশী হইয়া বলিলেন, “এক দাসী তো কি? যে পাল্কীতে আপনি আসিয়াছেন, তাহাতে আমার দুই দাসী সঙ্গে করিয়া লইয়া যান; যেন সৈফ্ খাঁর কোন আপত্তি না হইতে পারে!” মাসী খোঁজা পাঠাইয়া স্বামীকে এ সংবাদ দিলেন। সৈফ্ খাঁ তখন কহিলেন, “এখন আর পর্দ্দা রহিল না”; এবং হীরাবাইকে অবিলম্বে পাল্কীতে কুমারের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।
এখানে মন্তব্য এই যে, উপরের বৃত্তান্তে কয়েকটি ভুল আছে। প্রথমতঃ সৈফ্ খাঁর স্ত্রীর নাম মালিকাবানু, সালিহাবানু নহে। দ্বিতীয়ত সৈফ্ খাঁ যদিও আওরংজীবের এক মেসো, কিন্তু আওরংজীবের দাক্ষিণাত্যে সুবাদারীর সময় তিনি বুর্হানপুরে ছিলেন না, এবং তাঁহার স্ত্রী মালিকাবানুও তৎপূর্ব্বে (১৬৩৯ খ্রি:) মৃত হন। গ্রন্থকার নিশ্চয়ই দুই মেসোর মধ্যে গোলমাল করিয়াছেন।
বাদশাহেরা তাহাদের প্রিয় দাসীদিগকে যে সহরে প্রথম গ্রহণ করিতেন সেই সহরের নামে ডাকিতেন; যেমন শার্জাহানের আকবরবাদী-মহল, আওরংজীবের আওরঙ্গবাদী-মহল। বুহানপুরের অপর নাম জৈনাবাদ (= আবাসের অলঙ্কার); তাহা হইতে হীরাবাইয়ের জৈনাবাদী নামকরণ হয়।
[প্রবাসী, ভাগ ৪, সংখ্যা ৭, কাৰ্ত্তিক, ১৩১১।]