বিপিনের সংসার – ৮

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

বলাইয়ের দাহকার্য সম্পাদন করিয়া বিপিন রাত্রি দুপুরের পর বাড়ি আসিল। বাড়িসুদ্ধ সবাইচিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল—ওপাড়া হইতে কৃষ্ণলাল চক্রবর্তী আসিয়া অনেকক্ষণ হইতে বসিয়া ছিলেন, বিপিনের মাকে নানারকম বুঝাইতেছিলেন—তিনি বুঝিলেন, এ সময় সান্ত্বনাদেওয়া বৃথা, সুতরাং হুঁকা হাতে রোয়াকের এক পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন। 

বিপিন বলিল, কাকা, কখন এলেন? তামাক পেয়েছেন? 

—আর বাবা তামাক! তামাক তো আছেই, এখন যে বিপদে পড়ে গেলে তা থেকেসামলে উঠলেই বাঁচি। বউদিদিকে বোঝাচ্ছি সেই সন্দে থেকে, উনি মা, ওঁর কষ্ট তো চোখেদেখা যায় না—এসো বাবা-পরে বিপিনের চোখে জল পড়িতে দেখিয়া বলিলেন— আহা-হাতুমি অধৈর্য হলে চলবে কেন বাবা? এদের এখন তোমাকেই ঠাণ্ডা করতে হবে—বোঝাতেহবে বউদিদি, বউমা, বীণা–তোমাকে দেখে ওরা বুক বাঁধবে—তোমার চোখের জল পড়লে কিচলে?… 

এমন সময় আরও দু-পাঁচজন প্রতিবেশী আসিয়া উঠানে দাঁড়াইলেন। একজন ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বিপিনের মাকে বোঝাইতে গেলেন, একজন বিপিনের হাত ধরিয়া পাশের ঘরে লইয়াগিয়া বসাইলেন। 

—রাত অনেক হয়েছে, শুয়ে পড়ো সব। সকলেরই শরীর খারাপ, কেঁদেকেটে আর কিহবে বলো বাবা, যা হবার তা হয়ে গেল। সবই তার খেলা, দুনিয়াটাই এইরকম বাবা—আজআমার, কাল আর একজনের পালা— শুয়ে পড়ো— 

কৃষ্ণলাল চক্রবর্তী রাত্রি এখানেই কাটাইবেন। ইহারা একা থাকিবে তাহা হয় না। আজরাত্রে অন্তত বাড়িতে অন্য কেহ থাকা খুব দরকার। বিপিন সারারাত্রি ঘুমাইতে পারিল না, কৃষ্ণলালের সঙ্গে কথাবার্তায় রাত কাটিয়া গেল। 

কৃষ্ণলাল বলিলেন—তুমি ক’দিনের ছুটি নিয়ে এসেছ বাবাজি? 

—আজ্ঞে ছুটি তো নয়, রাণাঘাট কোর্টে এসেছিলাম কাজে–সেখান থেকে বাড়ি এলামএকদিনের জন্যে। তারপর তো বলাইয়ের অসুখ ক্রমেই বেড়ে উঠল, আর যাই কি করে—আটকে পড়লাম। তবে জমিদারবাবুকে চিঠি লিখে সব জানিয়েছি—এ কথাও লিখে দেবকাল। এখন ধরুন এদের ফেলে হঠাৎ কি করে বাড়ি থেকে যাই? মায়ের ওই অবস্থা, আমিকাছে থাকলেও একটা সান্ত্বনা, তারপর ছোঁড়াটার শ্রাদ্ধশান্তির একটা ব্যবস্থাও আমি না থাকলে কি করে হয় বলুন? 

শ্রাদ্ধশান্তি আর কি, তিলকাঞ্চন করে দ্বাদশটি ব্রাহ্মণ খাইয়ে দাও-এ তো জাঁকিয়েশ্রাদ্ধ করার কিছু নেই, কোনোরকমে শুদ্ধ হওয়া। 

সকালের দিকে মা চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন দেখিয়া বিপিন বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। গ্রামের মধ্যে কাহারও বাড়িতে যাইতে ভাল লাগে না—সকলে সহানুভূতি দেখাইবে, ‘আহা উহু’ করিবে—বর্তমান অবস্থায় বিপিনের তাহা অসহ্য মনে হইতে লাগিল। ভাবিয়া চিন্তিয়া সে আইনদ্দির বাড়িতে গেল, পাশের গ্রামে আইনদ্দির বয়স একশত বছরহইলেও (অন্তত সে বলে) বসিয়া থাকিবার পাত্র সে নয়। বাড়ির উঠানে একটা আমড়াগাছেরছায়ায় বসিয়া বৃদ্ধ জালের সুতা পাকাইতেছিল। 

—বাবাঠাকুর সকালে কি মনে করে? বোসোতামাক খাবা? সাজি দাঁড়াও। আইনদ্দিরসঙ্গেই তামাক খাইবার সরঞ্জাম মজুত। সে চকমকি ঠুকিয়া সোলা ধরাইয়া হাতে করিয়া সোলারটুকরাটি কয়েকবার দোলাইয়া লইয়া কলিকায় কাঠকয়লার উপর চাপিয়া ধরিল। 

বিপিন বলিল—চাচা, দেশলাই বুঝি কখনও জ্বালো না? 

—ও সব আজকাল উঠেছে বাবাঠাকুর—ও সব তোমাদের মতো ছেলেছোকরারা কেনে। সোলা-চকমকির মতো জিনিস আর আছে? আপনি ভাল হয়ে বোসো। সেকালের দু-একটা গল্পকরি শোনো। ওই যে দ্যাখচো অশথ গাছ, ওর পাশের জমিটার নাম ছেল ফাঁসিতলার মাঠ।নীলকুঠীর আমলে ওখানে লোকের ফাঁসি হোত। আমার জ্ঞানে আমি ফাঁসি হতে দেখেছি। তুমিআজ বলচ দিশলায়ের কথা—দিশলাই ছেল কোথায় তখন? তুষের আর ঘুঁটের আগুন মাগীন্নামালসায় পুরে রেখে দিত ঘরে—আর প্যাঁকাটির মুখে গন্ধক মাখিয়ে এক আঁটি করে রেখে দিতমালসার পাশে। এই ছেল সেকালের দিশলাই বাবাঠাকুর—তবে তামাক খাতি সোলা চকমকির রেওয়াজ ছেল। চাঁদমারির বিলি সোলার জঙ্গল—এক বোঝা তুলে এনে শুকিয়ে রাখো, ভোর বছর তামাক খাও। একটা পয়সা খরচ নেই। আর এখন? একটা দিশলাই এক পয়সা, একটাদিশলাই দেড় পয়সা—হুঁ— 

কথা শেষ করিয়া অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে আইনদ্দি একবার চারিদিকে চাহিয়া লইয়া জোরেজোরে তামাক টানিতে লাগিল। 

বিপিন বলিল—আচ্ছা চাচা, তুমি তো অনেক মন্তরতন্তর জানো—মানুষ মলে তাকেএনে দেখাতে পারো? 

আইনদ্দি বিপিনের হাতে কলিকা দিয়া বলিল—ধরো, একটা সোলা ফুটো করে তোমায়হুঁকো বানিয়ে দিই। মন্তরতন্তর অনেক জানি বাবাঠাকুর তোমার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে। শূন্যভরে উড়ে যাব, আগুন খাব, কাটামুণ্ডুজোড়া দেব- 

বিপিন এই কথা অন্তত ত্রিশবার শুনিয়াছে বৃদ্ধের মুখে। 

—কিন্তু মরা মানুষ আনতে পারো চাচা? 

—মলে কি মানুষ ফেরে বাবাঠাকুর? আশমানে তারা হয়ে ফুটে থাকে—নয়তো শেয়ালকুকুর হয়ে জন্মায়। তবে একটা গল্প বলি শোনো— 

ইহার পর আইনদ্দি একটা খুব বড় আজগুবি গল্প দিল—কিন্তু বিপিনের সেদিকে মনছিল না—সে আইনদ্দির বাড়ির উত্তরে সুবিস্তৃত বেতার মাঠ ও চাঁদমারির বিলের ধারেরসবুজ পাতি ঘাসের বনের দিকে চাহিয়া অন্যমনস্ক হইয়া গেল। যখনই এখানটিতে আসিয়াবসে, তখনই তাহার মনে কেমন অদ্ভুত ধরনের সব ভাব আসিয়া জোটে। 

বলাই চলিয়া গেল…কতদূরে, কোথায় কে জানে? সে-ও একদিন যাবে, বীণাও যাইবে, মনোরমাও যাইবে…মানী…মানীও যাইবে। 

কেন খাটিয়া মরা? কেন দুমুঠা অন্নের জন্য অনর্থক লোকপীড়ন করিয়া অভিশাপকড়ানো? আজ গেল বলাই…কাল তাহার পালা। 

একটা জিনিস তাহার মনে হইতেছে। মানী তাহার মাথায় ঢুকাইয়া দিয়াছিল…মানীর নিকট এজন্য সে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। 

বলাই বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। গরিব লোক এমনি কত আছে এই সব পাড়াগাঁয়ে—যাহারা অর্থের অভাবে রোগের চিকিৎসা করাইতে পারে না। সে ডাক্তারি বই পড়িয়া কিছুশিখিয়াছে, বাকিটা না হয় মানীকে বলিয়া, তাহার দেওর বীজপুরে ডাক্তারি করে, তাহার অধীনেকিছুদিন থাকিয়া শিখিয়া লইবে। ডাক্তারিই সে করিবে—প্রজাপীড়ন কার্য তাহার দ্বারা আর চলিবে না। 

তাহার বাপ বিনোদ চাটুজ্জে প্রজাপীড়ন করিয়া যথেষ্ট জমিজমা করিয়াছিলেন— যথেষ্টপসার প্রতিপত্তি, যথেষ্ট খাতির। আজ সে সব কোথায় গেল? বিনোদ চাটুজ্জে আজ মাত্রসতেরো-আঠারো বছর মারা গিয়াছেন— ইহার মধ্যেই তাহার পুত্রবধূ খাইতে পায় না—পুত্র বিনা চিকিৎসায় মারা যায়—বিধবা কন্যার সম্বন্ধে গ্রামে নানা বদনাম ওঠে। অসৎ উপায়েউপার্জনের পয়সাই বা আজ কোথায়—কোথায় বা জমিজমা! 

মানী তাহার চক্ষু ফুটাইয়া দিয়াছে নানা দিক দিয়া। 

জীবনে মানীকে সে গভীর কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করিতে চায় বহুবার, বহুবার।সারাজীবন ধরিয়া। 

বিপিন উঠিল। আইনদ্দি বলিল—কি নিয়ে যাবা হাতে করে বাবাঠাকুর? দুটো মুরগীর আন্ডা নিয়ে যাবা? না, তোমরা বুঝি ও খাও না! তবে দুটো শাকের ডাঁটা নিয়ে যাও। ভালশাকের ডাঁটা হয়েল বাবাঠাকুর, সুমুন্দিদের গরুর জন্য বাড়তি পারল না। ও মাখন—হ্যাদে ওমাখন— 

বিপিন প্রভাতের রৌদ্রদীপ্ত সুবিস্তীর্ণ বেতার মাঠের দিকে চাহিয়া ছিল। চমৎকার জীবন।এই রকম বাঁশতলার ছায়ায়…এই রকম সকালের বাতাসে বসিয়া চুপ করিয়া মানীর কথা ভাবা… 

কিন্তু ইহা জীবন নয়। ইহা পুরুষমানুষের জীবন নয়। বিনোদ ৺চাটুজ্জে পুরুষমানুষ ছিলেন—তিনি পৌরুষদীপ্ত জীবন কাটাইয়া গিয়াছেন—হৈ-হৈ, হল্লা, কঠিন কাজ, মামলা মোকদ্দমা, জমিদারি শাসন, দাঙ্গাহাঙ্গামা—বিপিন জানে সে এই সব কাজের উপযুক্ত নয়। সেশাসন করিতে পারে না তাহা নয়—সে দুর্বল বা ভীরু নয়—কিন্তু তাহার ধাতে সহ্য হয় না ওসব। বিশেষতমানীর সংস্পর্শে আসিয়া সে আরও ভাল করিয়া এসব বুঝিয়াছে। জীবনে অনেক ভাল জিনিস আছে—ভাল বই, ভাল গান, ভাল কথা-খাওয়া-দাওয়ার কথা, মামলামোকদ্দমা বা পরচর্চা ছাড়াও আরও ভাল কথা জগতে আছে, মানী তাহাকে দেখাইয়াছে। 

জমিদারি শাসন ছাড়াও পুরুষমানুষের জীবন আছে—রোগের সঙ্গে, মৃত্যুর সঙ্গে, নিজের দারিদ্র্যের সহিত সংগ্রাম করিয়া বড় হইতে চেষ্টা পাওয়াও পুরুষমানুষের কাজ। একবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেই সে। 

তিন মাস কাটিয়া গিয়াছে। 

এই তিন মাসের মধ্যে অনেক কিছু ঘটিয়া গেল। বিপিনকে বলাইয়ের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত বাড়ি থাকিতে হইল। বীণার ব্যাপার একটু আশঙ্কাজনক বলিয়া মনে হইল বিপিনের কাছে। মনোরমাপ্রায়ই বলে, দুজনে গোপনে দেখাশোনা এখনও করে—মনোরমা স্বচক্ষে দেখিয়াছে। বীণাকে বিপিন এজন্য তিরস্কার করিয়াছে, কড়া কথা শোনাইয়াছে, বীণা কাঁদিয়া ফেলে ছেলেমানুষের মতো, বলে—ও সব মিছে কথা দাদা। আমি তোমার পায়ে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমিপটলদার সঙ্গে আর দেখাই করিনে। 

কথার মধ্যে খানিকটা সত্য ছিল। 

বলাইয়ের মৃত্যুর পর বীণার ধারণা হইল, পটলদা’র সঙ্গে গোপনে কথা বলিবার এলোভ ভাল নয়, এ সব অনাচার, বিধবা মানুষের করা উচিত নয় যাহা, তাহা সে করিতেছেবলিয়াই আজ ভাইটা মরিয়া গেল। 

বলাই মারা যাওয়ার ছ’দিন পরে পটল একদিন তাহাদের বাড়িতে আসিল। বীণার মাবাহিরের রোয়াকে বসিয়া তাহার সহিত কথাবার্তা কহিতেছিল—বলাইয়ের মৃত্যু সংক্রান্ত কথাই বেশি।বীণা লক্ষ্য করিল কথা বলিতে বলিতে পটলদা জানালার দিকে আগ্রহ-দৃষ্টিতেচাহিতেছে। অন্য অন্য বার এতক্ষণ বীণা মায়ের কাছে গিয়া দাঁড়ায়,পটলের সঙ্গে কথা শুরুকরে—কিন্তু আজ সে ইচ্ছা করিয়াই যায় নাই। আর কখনও সে পটলদার সামনে বাহির হইবেনা। বেড়াইতে আসিয়াছ, ভালই; মায়ের সঙ্গে গল্পগুজব করো, চলিয়া যাও—আমার সঙ্গেতোমার কি? বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে তোমার কি? 

প্রায় এক ঘণ্টা থাকিয়া পটল যেন নিরাশ মনে চলিয়া গেল। পটল যেমন বাড়ির বাহিরহইল—বীণার তখন মনে পড়িল ছাদের উপর ওবেলা বউদিদির রাঙাপাড় শাড়িটা রৌদ্রেদেওয়া হইয়াছিল—তুলিয়া আনা হয় নাই। ছাদে উঠিয়া কাপড় তুলিতে তুলিতে সে নিজেরঅজ্ঞাতসারে পথের দিকে চাহিয়া রহিল। ওই তো পটলদা চলিয়া যাইতেছে… তেঁতুল গাছটারকাছে গিয়াছে…সে ছাদের উপরে দাঁড়াইয়া তাহার দিকে চাহিয়া আছে…যদি পটলদা হঠাৎফিরিয়া চায়? পটলদাকে একটা পান সাজিয়া দিলে ভাল হইত—দেওয়া উচিত ছিল, মা যেনকি! লোক বাড়িতে আসিলে তাহাকে শুধু-মুখে বিদায় করিতে নাই। ইহা ভদ্রতা। তাহাকে ডাকিয়া পান সাজিয়া দিতে বলিলেই সে পান দিত 

কাপড় তুলিয়া বীণা নামিয়া আসিল। তাহার মন খুব হালকা—ভালই হইয়াছে, আজ সেবুঝিয়াছে—পটলের সঙ্গে দেখা না-করা এমন কঠিন কাজ নয়, ইচ্ছা করিলেই হয়। একটা কঠিনকর্তব্য সে সম্পন্ন করিয়াছে। 

বলাইয়ের শ্রাদ্ধ মিটিয়া গেলে পটল আর একদিন আসিল। বীণা উঠান ঝাঁট দিতেছিল, মুখ তুলিয়া সে আসিতেছে দেখিয়াই সে হাতের ঝাঁটা ফেলিয়া ছুটিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিল। তাহারবুকের মধ্যে যেন ঢেঁকির পাড় পড়িতেছে। মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়াই মনে হইল, ছিঃ, অমন করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া আসা উচিত হয় নাই!—পটলদা কি দেখিতে পাইয়াছে? বোধহয় পায় নাই, কারণ তখনও সে তেঁতুলতলার মোড়ে; তেঁতুলগাছের গুড়িটার আড়ালে। যাহাহউক, পটলদা তো বাঘ নয়, ভালুকও নয়—অমনভাবে ছুটিয়া পলাইবার মানে হয় না।সহজভাবে মায়ের সামনে গিয়া কথা বলাই তো ভাল। ব্যাপারটাকে সহজ করিয়া তোলাই ভাল। 

কিন্তু বীণা একদিনও বাহিরে আসিল না—এমন কি যখন পটল জল খাইতে চাহিল—বীণার মা বলিলেন, ওমা বীণা, তোর পটলদাদাকে এক গেলাস জল দিয়ে যা—বীণা নিজে না গিয়া বিপিনের বড়ছেলে টুনুর হাতে দিয়া জলের গ্লাস পাঠাইয়া দিল। 

তাহার হাসি পাইতেছিল। মনে মনে ভাবিল—সব দুষ্টুমি পটলদার! জলতেষ্টা না ছাইপেয়েছে। আমি আর বুঝিনে ও সব যেন! 

সে যাইবে না, কখনও যাইবে না। জীবনে আর কখনও পটলদার সঙ্গে দেখা করিবে না। শেষ, সব শেষ হইয়া গিয়াছে। 

ইহার পাঁচ-ছ’দিন পরে বীণা একদিন সন্ধ্যার সময় ছাদে শুকাইতে দেওয়া মুসুরির ডাল তুলিতে গিয়াছে— ছাদের আলিসার কাছে আসিতেই দেখিতে পাইল, পটলদা নীচে বাগানেরকাঁঠালতলায় দাঁড়াইয়া ওপরের দিকে চাহিয়া আছে। 

বীণার সমস্ত শরীর দিয়া যেন কি একটা বহিয়া গেল! হঠাৎ পটলদাকে এ ভাবে দেখিবে তাহা সে ভাবে নাই। কিন্তু আজ কয়দিন বীণা দুপুরে ও বিকালের দিকে নির্জনে থাকিলেই ভাবিয়াছে পটলদার কথা। অন্য কিছু নয়, সে শুধু ভাবিয়াছে এই কথা–আচ্ছা এই যে দু’দিন সে পটলদার সঙ্গে ইচ্ছা করিয়াই দেখা করিল না, পটলদা কি ভাবে লইয়াছে জিনিসটা? খুব চটিয়াছে কি? কিংবা হয়তো তাহার কথা লইয়া পটলদা আর মাথা ঘামায় না। তাহাকে মনহইতে দূর করিয়া দিয়াছে। দিয়া যদি থাকে, খুব বুদ্ধিমানের মতো কাজ করিয়াছে। পটলদা কষ্টপায়, তাহা বীণা চায় না। ভুলিয়া যাক্, সেই ভাল। মনে রাখিয়া যখন কষ্ট পাওয়া, ভুলিয়া যাওয়াই ভাল। 

দুপুরে এ কথা ভাবিয়া বীণা দেখিয়াছে বেলা যত পড়ে সেই কথাই মনের মধ্যে কেমনএকটা—ঠিক বেদনা বা কষ্ট বলা হয়তো চলিবে না—কিন্তু কেমন একটা কি হয় ঠিক বলিয়াবোঝানো কঠিন—কি বলিয়া বুঝাইবে সে ভাবটা?…যাহোক, যখন সেটা হয়, বিশেষত সন্ধ্যারদিকে, যখন বড় তেঁতুল গাছটায় কালো কালো বাদুড়ের দল ঝাঁক বাঁধিয়া ফেরে, সন্তুদেরনারকেল গাছটার মাথায় একটা নক্ষত্র ওঠে, বউদি সাঁজালের মালসা হাতে গোয়ালঘরে সাঁজাল দিতে ঢোকে, একটু পরে ঘুঁটের ধোঁয়ায় উঠানের পাতিলেবুতলাটা অন্ধকার হইয়া যায়— তখনছাদের ওপর একা দাঁড়াইয়া বাঁশঝাড়ের মাথার দিকে চাহিয়া চাহিয়া বীণার যেন কান্না আসে…কোথাও কিছু যেন নাই—কোথাও কিছু নাই… 

এ ভাবটা সে বেশিক্ষণ মনে থাকিতে দেয় না—তখনি তাড়াতাড়ি ছাদ হইতে নীচেনামিয়া আসে। নিজের কান্নাতে নিজে লজ্জিত হয়, ভীত হয়। 

অথচ কাহাকেও কিছু বলিবার উপায় নাই। কাহারও নিকট একটু সান্ত্বনা পাইবার উপায় নাই। মা নয়, বউদিদি নয়—কাহারও কাছে কিছু বলা চলিবে না, বীণা বোঝে। এ তার নিজস্বকষ্ট, অত্যন্ত গোপন জিনিস— গোপনেই সহ্য করিতে হইবে। 

হঠাৎ এ সময় পটলদাকে এ ভাবে দেখিয়া বীণা যেন কেমন হইয়া গেল। তাহার মুখ দিয়াকথা বাহির হইল না। পটল গাছের গুড়িটার দিকে আর একটু হটিয়া গেল। বীণার দিকে চাহিয়াএকটু হাসিয়া বলিল—বীণা, আমার ওপর তোমার রাগ কিসের? 

বীণা এবার কথা খুঁজিয়া পাইল। বলিল—রাগ কে বল্লে? 

—দু’দিন তোমাদের বাড়ি গেলাম, বাইরে এলে না, দেখা করলে না—রাগ নয় তো কি? 

—রাগ নয়, এমনি। কাজে ব্যস্ত ছিলাম। 

—মিথ্যে কথা। কাজে ব্যস্ত থাকলেও একটু বাইরে আসা যায় না কি? না, সত্যি বলোলক্ষ্মীটি, আমি কি দোষ করেছি? 

—তুমি পাগল নাকি পটলদা? আচ্ছা, সন্ধ্যাবেলায় এখানে এসেছ আবার, লোকে দেখলেকি মনে করবে— তোমায় একদিন বারণ করে দিইছি মনে নেই! যাও বাড়ি যাও— 

বীণা কথাটা বলিল বটে কিন্তু তাহার মনের মধ্যে হঠাৎ একটা অদ্ভুত ধরনের আনন্দ আসিয়া জুটিয়াছে— সন্ধ্যার অন্ধকার অদ্ভূত হইয়া উঠিয়াছে, জোনাকী-জ্বলা অন্ধকার, সাঁজালের ঘুঁটের চোখ-জ্বালা-করা ধোঁয়ায় ঘনীভূত অন্ধকার।… 

তাকে কেহ চায় নাই জীবনে এমন করিয়া—সে কথা কহে নাই বলিয়া ছুটিয়াআশসেওড়া বিছুটিবনের আগাছায় জঙ্গলের মধ্যে, সাপে খায় কি ব্যাঙে খায়, সন্ধ্যার অন্ধকারেভূতের মতো দাঁড়াইয়া থাকে নাই কখনও—কাঙালের মতো, একটুখানি মিষ্ট কথার প্রত্যাশীহইয়া—বিশেষ করিয়া যখন সে তাচ্ছিল্য দেখাইয়াছে, সামনে বাহির হয় নাই, কথা কয়নাই—তাহার পরেও,–এক পটলদা ছাড়া। 

পটল মিনতির সুরে বলিল—কেন এমন করে তাড়িয়ে দেবে, বীণা? আমি কি করেছিবলো— 

—তুমি কিছু করোনি। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কথাবার্তা আর চলবে না— 

কেন চলবে না বীণা? 

—কেউ পছন্দ করে না। 

—কেউ মানে কে কে, শুনতে পাব না? 

—না, তা শুনে কি হবে? ধরো আমার বাড়ির লোক। আমি তো স্বাধীন নই—তারা যদিবারণ করেন, অসন্তুষ্ট হন, আমার তা করা উচিত নয়। 

—তুমি আমায় ভালবাসো না?

বীণা চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। 

—আমার কথার উত্তর দাও, বীণা! 

—আচ্ছা পটলদা, ও কথার উত্তর শুনে লাভই বা কি? আমার আর তোমার সঙ্গে দেখাকরা চলবে না। তুমি কিছু মনে কোরো না পটলদা, এখন বাড়ি যাও, লোকে কি মনে করবেবলো তো! সন্ধেবেলা এখানে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছ দেখলে বউদি এখুনি ছাদের ওপর আসবে, তুমি যাও এখন। 

—আচ্ছা এখন যাচ্ছি, কাল আসব? 

—না। 

—পরশু আসব? 

—না। 

—কবে আসব, আচ্ছা তুমিই বল বীণা! 

—কোনোদিন না। কেন আমায় এসব কথা বলাচ্ছ পটলদা? আমি এক কথার মানুষ—যাবলেছি তা বলেছি, এখন যাও। 

—তাড়াবার জন্যে অত ব্যস্ত কেন বীণা, যাবই তো, থাকতে আসিনি। বেশ তাই যদিতোমার ইচ্ছে হয় তবে চল্লাম—এ-ও বলে রাখছি, জীবনে আর কখনও আমায় দেখতে পাবেনা। 

—না পাই না পাব, তা আর কি হবে? না পটলদা, আর বকিও না, কথায় কথা বাড়ে, আমি নীচে নেবে যাই, বউদিদি কি মনে করবে—কতক্ষণ ছাদের ওপর এসেছি! 

পটল আর কোনো কথা না বলিয়া চলিয়া গেল। কিন্তু বীণা যেমন সিঁড়ির মুখে নামিতেযাইবে দেখিল অন্ধকারের মধ্যে মনোরমা দাঁড়াইয়া আছে। বউদিদির ভাব দেখিয়া বীণার মনেহইল সে বেশিক্ষণ আসে নাই— এবং সিঁড়িতে দাঁড়াইয়া তাহাদের শেষ কথা শুনিয়াছে। 

আসলে মনোরমা কিছুই শুনিতে পায় নাই—কিন্তু ছাদে উঠিবার সময় বীণা কাহার সঙ্গেসন্ধ্যাবেলা কথা কহিতেছে জানিবার জন্য সিঁড়ির মুখে অন্ধকারে দাঁড়াইয়া ছিল। এবং অল্প কিছুক্ষণ দাঁড়াইবার পরেই বীণা কথা বন্ধ করিয়া তাহার সঙ্গে ধাক্কা খাইল। 

মনোরমা বলিল—কার সঙ্গে কথা বলছিলে ঠাকুরঝি? 

বীণা ঝাঁজের সঙ্গে বলিল—জানিনে—সরো—রাস্তা দাও—উঠে এসে দাঁড়িয়ে তো আছদিব্যি অন্ধকারে! বাবারে, সবাই মিলে খাও আমাকে খেয়ে ফেল—বলিয়া সে তরতর করিয়া নামিয়া গিয়া মায়ের ঘরে একখানা ছেঁড়া মাদুর এককোণে পাতিয়া সোজাসুজি শুইয়া পড়িল। 

মনোরমা মনে মনে বড় অস্বস্তি বোধ করিল। বীণা আবার গোপনে পটলের সঙ্গেদেখাশুনা করিতেছে তাহা হইলে! নিশ্চয়ই পটল ও–আর কাহার সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা ছাদ হইতে চাপাসুরে কথাবার্তা বলিবে সে! ঠাকুরঝির রাগের কারণই বা কি আছে তাহা সে বুঝিয়া পাইলনা।সে আড়ি পাতিয়া কাহারো কথা শুনিতে যায় নাই সিঁড়ির ঘরে। কি কথা হইতেছিল, কাহার সহিত কথা হইতেছিল তাহাও সে জানে না—তবে আন্দাজ করিয়াছিল বটে। দুশ্চিন্তায় মনোরমার রাত্রে ভাল ঘুম হইল না। ঠাকুরঝি দিনকতক পটলের সামনে বাহির হইত না, তাহাতে মনোরমা খুব খুশি হইয়াছিল মনে মনে। কিন্তু এত বলার পরেও আবার যখন শুরু করিল, তাও আবার লুকাইয়া, তখন ফল ভাল হইবে না। 

কি করা যায়, কি করিয়া সংসারে শান্তি আনা যায়? তাহাদের বাড়িটাকে যেন অলক্ষ্মীতেপাইয়া বসিয়াছ। দারিদ্র্য, রোগ, মৃত্যু…অনাচার…কুৎসা কলঙ্ক…বীণা ঠাকুরঝি যে রাগ করে, নতুবা কাল দুপুরবেলা রান্নাঘরে বসিয়া সে বেশ করিয়া বুঝাইয়া সুঝাইয়া বলিতে পারে। বলিতেপারে যে, এসব ব্যাপারের ফল কখনও ভাল হয় না। পটল বিবাহিত লোক, তাহার স্ত্রী-পুত্রবৰ্তমান—বীণাকে লইয়া নাচানো ছাড়া তাহার আর কি ভাল উদ্দেশ্য থাকিতে পারে? সমাজে থাকিতে হইলে সমাজ মানিয়া চলিতে হয়—বীণা বিধবা, বিশেষত ছেলেমানুষ, অনেক বুঝিয়া তাহাকে এখন সংসারে চলিতে হইবে।…কিন্তু বীণা শুনিবে কি তাহার হিতোপদেশ? 

 

ইহার পর পটল আর একদিন আসিল। অমনি সন্ধ্যাবেলা, অমন ভাবে লুকাইয়া। কিন্তু একদিনবীণা গৃহকর্মে ব্যস্ত ছিল, ছাদে যাইবার প্রয়োজন ছিল না বলিয়া যায় নাই। ছাদে গিয়াছিলমনোরমা। সিঁড়ির মুখে নামিবার সময় দেখিতে পাইল পটল কাঁটালতলায় দাঁড়াইয়া আছে।তাহাকে দেখিয়াই পটল গুঁড়ির আড়ালে সরিয়া যাইবার উপক্রম করিল, একটু থতমত খাইয়া গেল—তাহাকেই বীণা বলিয়া ভুল করিয়াছিল সন্ধ্যার অন্ধকারে নাকি? মনোরমার হাসিও পাইল। ভাবিল পোড়ারমুখো ড্যাকরার কাণ্ড দ্যাখো! জঙ্গলের মধ্যে এই ভর-সন্ধেবেলা দাঁড়িয়ে মরছেন মশার কামড় খেয়ে! খ্যাংরা মারো মুখে! বীণাকে সে কিছুই বলিল না নীচেনামিয়া। তাহাকে চোখে চোখে রাখিল, বীণা চুপি চুপি ছাদে যায় কিনা। ওদের মধ্যে নিশ্চয় পূর্বহইতে বলা-কওয়া ছিল। 

রাত্রে শুইবার সময় সে কৌশল করিয়া বীণাকে কথাটা বলিল। 

—আজ হয়েছে কি জানো ঠাকুরঝি, ওপরে তো ছাদে গিয়েছি সন্ধের সময়—দেখি কেএকজন কাঁটালতলায় দাঁড়িয়ে—ভাল করে চেয়ে দেখি— 

বীণার মুখ শুকাইয়া গেল। বলিল—পটলদা? 

মনোরমা খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল। হাসির ধমকে কথা উচ্চারণ করিতে না পারিয়া ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, “পটলই বটে।” 

—আমি তোমার পা ছুঁয়ে বলতে পারি বউদি, আমি কিছুই জানিনে। 

বীণা কিন্তু একথা বলিতে পারিল না যে সে পটলদাকে সেদিনই আসিতে নিষেধ করিয়া দিয়াছে। সেকথা তাহার আর পটলদার মধ্যে গুপ্ত থাকিবে—বাহিরের লোককে তাহা জানাইলে পটলদার অপমান হইবে। লোকের সামনে পটলদাকে সে ছোট করিতে চায় না। তাহার মনতাহাতে সায় দেয় না। 

কিন্তু আশ্চর্য, এত বলার পরও পটলদা আবার আসিয়াছিল! রাত্রে শুইয়া শুইয়া কতবার পটলের উপর রাগ করিবার…দারুণ রাগ করিবার চেষ্টা করিল। ভারি অন্যায় পটলদা’র, যখনসে বারণ করিয়া দিয়াছে, তখন কেন আবার দেখা করিবার চেষ্টা পাওয়া? ছিঃ ছিঃ, বউদিদি নাদেখিয়া যদি অন্য লোক দেখিত? পটলদা লোক ভাল নয়—ভাল লোক নয়, খারাপ চরিত্রের লোক। ভাল চরিত্রের লোক যারা তারা এমন করে না। 

আচ্ছা একটা কথা—তাহারই সঙ্গে বা পটলদা দেখা করিবার অত আগ্রহ কেন দেখায়? আরও তো কত মেয়ে আছে। এই অন্ধকারে…আগাছার জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়াইয়া সত্যি যদিসাপে কামড়াইত? কথাটা মনে করিবার সঙ্গে সঙ্গে পটলের উপর এক প্রকার অদ্ভুত ধরনের সহানুভূতি আসিয়া জুটিল বীণার মনে। মাগো, পটলদাকে সাপে কামড়াইত! না, ভাবিতেও কষ্ট হয়। তাহারই জন্য পটলদাকে সাপে কামড়াইত তো? আর কেহ তো তাহার জন্য ভাবে না, তাহার মুখের কথা শুনিবার অত আগ্রহ দেখায় না, সংসারে কে তাহার জন্য ভাবিয়া মরিতেছে? কোন্ আলো আছে তাহার জীবনে?… 

এই শূন্য, অন্ধকার জীবনের মধ্যে তবুও পটলদা তাহার সঙ্গে একটু কথা কহিবার ব্যাকুল আগ্রহে রাত্রি, অন্ধকার, সাপের ভয়, মশার কামড়, লোকনিন্দা আগ্রাহ্য করিয়া চোরের মতো দাঁড়াইয়া থাকে ভাঙা কোঠার পাত্রে জঙ্গলের মধ্যে—যেখানে বিছুটি জঙ্গল এমন ঘন যে দিনমানেই যাওয়া যায় না! তাও দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বৃথা ফিরিয়া গেল চোখের দেখাও তোতাহাকে দেখিতে পায় নাই! 

নিজের স্বামীকে বীণা মনে করিতে পারে—খুব সামান্য, অস্পষ্ট ভাবে। এগারো বৎসরবয়সে বীণার বিবাহ হয়। এক বৎসর পরে বাপের বাড়ি থাকিতেই একদিন সে শুনিল স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে। মনে আছে, বেশ ছেলেটি। খুব অল্পদিন দেখাশোনা হইয়াছিল। কোথায় স্কুলে পড়িত, শ্বশুর-শাশুড়ি তাহাকে বাড়ি বেশিদিন থাকিতে দিতেন না—স্কুল-বোর্ডিং-এ পাঠাইয়া দিতেন। 

সে-সব আজকার কথা নয়—বীণার বয়স এখন তেইশ-চব্বিশ—বারো বছর আগের কথা, স্বপ্ন হইয়া গিয়াছে। 

হঠাৎ বীণা দেখিল সে কাঁদিতেছে—হাপুস নয়নে কাঁদিতেছে, বালিশের একটা ধার একেবারে ভিজিয়া গিয়াছে চোখের জলে। 

 

দেনা জড়াইয়া গিয়াছে একরাশ। কোনো দোকানে আর ধার পাইবার জো নাই। 

কৃষ্ণলাল চক্রবর্তী সংসারের বন্ধু, দুবেলাই যাতায়াত করেন, খোঁজখবর যা লইবারতিনিই লইয়া থাকেন, অন্যলোকে বড় একটা ইহাদের লইয়া মাথা ঘামায় না। 

সেদিন সন্ধ্যাবেলা রোয়াকে বসিয়া কথাবার্তা কহিতে কহিতে কৃষ্ণলাল বলিলেন, পলাশপুর যাবার তোমার আর দেরি কিসের হে বিপিন? বেরিয়ে পড়ো, চলে যাও এবার।তোমার দোষ, একবার বাড়ি এসে চেপে বসলে তুমি নড়তে চাও না! 

—আপনার কাছে আর লুকোব না কাকা, চাকুরি গিয়েছে আজ মাসখানেক হল, অনাদিবাবু চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যদি আমি এক হপ্তার মধ্যে না ফিরি, তিনি অন্য লোক রাখতে বাধ্য হবেন। সে চিঠির উত্তর দিইনি। 

—চিঠির উত্তর দাওনি? না খেতে পেয়ে কষ্ট পাচ্চ সে ভাল খুব, না? তোমার উপায় যেকি হবে আমি কিছু বুঝিনে বাপু! না, শোনো, আমার মনে হয় তোমার চাকুরি এখনও যায়নি।নতুন লোক খুঁজে পাওয়া শক্তও বটে, আর বিশ্বাস যাকে-তাকে করাও যায় না বটে। তুমি যাও, কাল সকালেই দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়ো। 

—বেরিয়ে পড়ব কাকা, তবে সেদিকে নয়। আমি ডাক্তারি করব ভেবে রেখেচি অনেকদিন। ওই সোনাতনপুর, কামার গাঁ, পিপলিপাড়া এ সব অঞ্চলে ডাক্তার নেই। কে যাবে ওসবঅজ পাড়াগাঁয়ে মরতে? আমি সোনাতনপুরে বসব ভেবেচি। সোনাতনপুরের রামনিধি দত্ত ওখানকার মধ্যে একজন বিশিষ্ট লোক, সেখানে গিয়ে বাবার পরিচয় দিয়ে ওই গাঁয়েই বসব।দেখি কি হয়। জমিদারি শাসন আর প্রজা ঠ্যাঙানো, ૭ আর করচিনে কাকা। বলাই মারাযাওয়ার পর আমি বুঝতে পেরেছি, ও কাজে সুখ নেই। আর আমি ওপথে— 

কৃষ্ণলাল অবাক হইয়া বলিলেন, ডাক্তারি করবে! ডাক্তারি শিখলে কোথায় তুমি যে ডাক্তারি করবে! যত বদখেয়াল কি তোমার মাথায় আসে! 

—ডাক্তারি আমি করেচি এর আগেও। ধোপাখালির কাছারিতে বসে। আর শেখার কথাবলছেন, কেন, বই পড়ে বুঝি শেখা যায় না? জমিদারবাবুর মেয়ে আমাকে কতকগুলো ডাক্তারিবই দিয়েছিল, তাই পড়ে শিখেচি। সে-ই আমায় ডাক্তারি করতে পরামর্শ দেয়, কাকা। বলেছিল, তার এক দেওর বীজপুরে ডাক্তারি করে, তার কাছে গিয়ে শেখার ব্যবস্থা করে দেবে—ও-ই বলেছিল। বেশ চমৎকার মেয়ে, মনটিও খুব ভাল, আমায় বলেছিল— 

হঠাৎ বিপিন দেখিল মানীর কথা একবার আসিয়া পড়িয়াছে যখন, তখন ওর কথাইবলিবার ঝোঁক তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে। ডাক্তারির কথা গৌণ, মুখ্য কাজ মানীর সম্বন্ধে কথাবলা। কৃষ্ণকাকার সামনে! 

বিপিন চুপ করিল। 

কৃষ্ণলাল বলিলেন, জমিদারবাবুর মেয়ে? বিয়ে হয়েছে? তোমার সঙ্গে কি ভাবেআলাপ? 

—আজ্ঞে হ্যাঁ, বিয়ে হয়েছে বৈকি। বাইশ-তেইশ বছর বয়েস। আমার সঙ্গে তো ছেলেবেলা থেকেই আলাপ ছিল কিনা! বাবার সঙ্গে ওদের বাড়ি ছেলেবেলায় যেতাম, তখনথেকেই আলাপ। একসঙ্গে খেলা করেছি। এখনও আমাকে যত্নআত্তি করে বড্ড, আর কিসেআমার ভাল হবে সর্বদা ওর সেদিকে— 

বিপিনের গলার সুরে কৃষ্ণলাল একটু আশ্চর্য হইয়া উহার দিকে চাহিয়া ছিলেন, বিপিনআবার দেখিল সে মানীর সম্বন্ধে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলিয়া ফেলিতেছে। কি যেনঅদ্ভুত নেশা! মানীর সম্বন্ধে কতকাল কাহারও কাছে কোনো কথা বলে নাই। আজ যখন ঘটনাক্রমে তাহার কথা আসিয়া পড়িয়াছে, তখন আর থামিতে ইচ্ছা করে না কেন? অনবরততাহার কথা বলিতে ইচ্ছা করে কেন? 

বিপিন আবার চুপ করিয়া রহিল। 

কৃষ্ণলাল বলিলেন, তা বেশ। তোমার সঙ্গে এবার বুঝি দেখাশুনো হয়েছিল? শ্বশুরবাড়িথেকে এসেছিল বুঝি? না, বিপিন আর কিছু বলিবে না। সে সামলাইয়া লইয়াছে নিজেকে। কৃষ্ণলালের প্রশ্নের উত্তরে সংক্ষেপে বলিল, হ্যাঁ। তাহার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করিতেছে, কেমন এক প্রকারের উত্তেজনা। মানীর কথা এতদিন কাহারও সহিত হয় নাই, অনেক জিনিস চাপা পড়িয়াছিল। হঠাৎ অনেক কথা, অনেক ছবি তাহার মনে পড়িয়া গেল মানীর সম্বন্ধে। কান দুটা যেন গরম হইয়া উঠিয়াছে লাল হইয়া উঠিয়াছে কি দেখিতে? কৃষ্ণলাল কি দেখিতে পাইতেছেন? 

দিন পনেরো পরে। 

রাত্রে একদিন মনোরমা বলিল, তোমায় তো কোনো কথা বললেই চটে যাও। কিন্তু আমার হয়েছে যত গোলমাল, ঝক্কি পোয়াচ্ছি আমি। তিন দিন কাঠা হাতে করে এর-ওর বাড়িথেকে চাল ধার করে আনি, তবে হাঁড়ি চড়ে। আমি মেয়েমানুষ, ক’দিন বা আমাকে লোকে দেয়? পাড়ায় আর ধার পাওয়া যাবে না, এবার বে- পাড়ায় বেরুতে হবে কাল থেকে। তা আরকি করি, কাল থেকে তাই করব! ছেলেগুলো উপোস করবে, মা উপোস করবেন, এ তো চোখেদেখতে পারব না! 

মনোরমার কথাগুলি খুব ন্যায্য বলিয়াই বোধ হয় বিপিনের কাছে তিক্ত লাগে। সেঝাঁজের সহিত বলিল, এখন তোমাদের জন্যে চুরি করতে পারব না তো! না পোষায়, ভাইকে চিঠি লিখো, দিনকতক গিয়ে বাপের বাড়ি ঘুরে এসো। সোজা কথা আমার কাছে। 

মনোরমা কাঁদিতে লাগিল। 

নাঃ, বিপিনের আর সহ্য হয় না। কি যে সে করে! চাকুরি তাহার নিজের দোষে যায় নাই। বলাইয়ের অসুখ, বলাইয়ের মৃত্যু, বীণার ব্যাপার, নানা গোলযোগ। সে ইচ্ছা করিয়া চাকুরি ছাড়িয়া আসে নাই। অথচ স্ত্রী দেখিতেছে সবটাই তাহার দোষ। 

রাত্রি অনেক হইয়াছে। পল্লীগ্রামের লোক সকালে-সকালেই শুইয়া পড়ে। কোনো দিকে কোনো শব্দ নাই। উত্তরে দিকের ভাঙা জানলাটার ধারেই তক্তপোশখানা পাতা। বিপিন উঠিয়া দালান হইতে তামাক সাজিয়া আনিয়া তক্তপোশের উপর বসিয়া জানালা দিয়া বাহিরের দিকেচাহিয়া হুঁকা টানিতে লাগিল। জানালার বাহিরের কোঠার গায়ে লাগানো ছোট্ট তরকারিরক্ষেত, বলাই গত চৈত্র মাসে কুমড়া পুঁতিয়াছিল, কেন খুব বড় গাছ হইয়া অনেকখানি জায়গাজুড়িয়া লইয়াছে বাগানে। তরকারির ক্ষেতের পর তাহাদের কাঁঠাল গাছ, তারপর রাস্তা, রাস্তার ওপারে নবীন বাঁড়ুয্যের বাঁশঝাড় ও গোহাল। ঘন ঠাস্-বুনানি কালো অন্ধকার বাঁশঝাড়ের সর্বাঙ্গে অসংখ্য জোনাকি জ্বলিতেছে। 

মনোরমার উপর তাহার সহানুভূতি হইল। বেচারি অবস্থাপন্ন গৃহস্থঘরের মেয়ে, তাহাদের বাড়িতে অনেক আশা করিয়াই উহার জ্যাঠামশাই বিবাহ দিয়াছিলেন। এখন খাইতেপায় না পেট ভরিয়া দু’বেলা। পাড়ায় কোথাও সে বাহির হয় না, সমবয়সী বউ-ঝিয়ের সঙ্গেকমই মেশে, কারণ গরিব বলিয়াও বটে এবং বীণার ব্যাপার লইয়াও বটে, নানা অপ্রীতিকর কথাশুনিতে হয় বলিয়া সে কোথাও বড় একটা যায় না। ঘরের কাজ লইয়াই থাকে। 

বিপিন বলিল, কেঁদো না, বলি শোনো। 

মনোরমা কথা কহিল না, আঁচল দিয়া চোখ মুছিতে লাগিল। আধ-ময়লা শাড়ির আঁচলটা মাদুর হইতে খানিকটা মেঝের উপর লুটাইতেছে। সত্যই কষ্ট হয় দেখিলে। 

—শোনো, আমি কাল কি পরশু বাড়ি থেকে যাই। পিপলিপাড়া গিয়ে ডাক্তারি করবভেবেছি। তুমি কি বলো? পিপলিপাড়া বেশ গাঁ, চাষিবাসী লোক অনেক। হয়তো কিছু কিছুপাব। তুমি কি বলো? 

স্বামী তাহার মতামত চাহিতেছে, ইহা মনোরমার কাছে এক নূতন জিনিস বটে। সেএকটু আশ্চর্য হইল, খুশিও হইল। চোখের জল মুছিয়া বিপিনের দিকে চাহিয়া বলিল, তুমি ডাক্তারি জানো? 

—জানিই তো। ধোপাখালি থাকতে রুগী দেখতাম। 

—কোথা থেকে শিখলে ডাক্তারি? 

—বই পেয়েছিলাম জমিদারবাড়ির ইয়ে মানে লাইব্রারি থেকে। বেশ বড় লাইব্রারি আছে কিনা ওঁদের বাড়ি। 

মনোরমার পিতৃগৃহ গোয়াড়ি কৃষ্ণনগর। সে বলিল, লাইব্রারি আবার কি? লাইব্রেরি তোবলে! আমাদের পাড়ায় মস্ত লাইব্রেরি আছে গোয়াড়িতে। জেঠিমা বই আনাতেন, আমরাদুপুরবেলা পড়তাম। 

—ওই হল, হল। তা আমি বলছিলাম কি, দিনকতকের জন্যে একবার ঘুরে এসো নাকেন সেখানে? আমি একটু সামলে নিই। যদি পিপলিপাড়ায় লেগে যায়, তবে পুজোর পরেইনিয়ে আসব এখন, কি বলো? 

মনোরমা বলিল, সেখানে যাব কোন মুখ নিয়ে? নিজের বাবা-মা থাকলে অন্য কথাছিল। জ্যাঠামশায় বিয়ের সময় যা দিয়েছিলেন, তুমি তা ঘুচিয়েছ। শুধু-গায়ে শুধু-হাতে তাদেরসেখানে গিয়ে দাঁড়াব যে, তারা হল বড়লোক, দুই জ্যাঠতুতো বোন ইস্কুল কলেজে পড়ে, বউদিদিরা বড়লোকের মেয়ে, তারা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে হাসে। তার চেয়ে না খেয়েএখানে পচে মরি সেও ভাল। 

যুক্তি অকাট্য। ইহার উপর বিপিন কিছু বলিতে পারিল না। বলিল, তা নয় মনোরমা, আমি ডাক্তারিতে বসলেই আজই যে হুড়হুড় করে টাকা ঘরে আসবে তা তো নয়। দু’দিন একটুআমায় নির্ভাবনায় থাকতে না দিলে আমি তোমাদের বেহ্মডাঙায় ফেলে রেখে গিয়ে কি সোয়াস্তি পাব? তাই বলছিলাম। 

মনোরমা বলিল, তুমি এসো গিয়ে, আমাদের ভাবনা আমরা ভাবব। 

—ঠিক? সে ভার নেবে তো? 

—না নিয়ে উপায় কি বলো! 

দিন চার পাঁচ পরে বিপিন ছোট্ট একটি টিনের সুটকেস্ হাতে করিয়া পিপলিপাড়া রামনিধি দত্ত মহাশয়ের বহির্বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। বেলা প্রায় বারোটা বাজে। সকালে বাড়িহইতে বাহির হইয়া হাঁটিতে হাঁটিতে আসিয়াছে। পায়ে এক পা ধূলা, গায়ের কামিজটি ঘামেভিজিয়া গিয়াছে। 

রামনিধি দত্তের বাড়ি দেখিয়া সে কিছু হতাশ হইল। ভাঙা পুরানো কোঠাবাড়ি, বহুকাল মেরামত হয় নাই, কার্নিসে স্থানে স্থানে বট-অশ্বত্থের চারা গজাইয়াছে। আর কি ভয়ানক জঙ্গল গ্রামটিতে! শুধু আমের বাগান আর ঘন নিবিড় বাঁশবন! 

দত্ত মহাশয়কে পূর্বে সে একখানা চিঠি লিখিয়াছিল, তিনি বিপিনকে আসিতেও লিখিয়াছিলেন। তবুও নতুন অচেনা জায়গায় আসিয়া বিপিনের কেমন বাধো-বাধো ঠেকিতে লাগিল, বাহিরবাটীর চণ্ডীমণ্ডপে উঠিয়া সে সুটকেসটি নামাইয়া একখানা হাতল-ভাঙা চেয়ারেরউপর বসিয়া চারিদিকে একবার চাহিয়া দেখিল। চণ্ডীমণ্ডপটি সেকালের, দেখিলেই বোঝা যায়।নিম কাঠের বড় কড়ি হইতে একটা কাঠের বিড়াল ঝুলিতেছে, সেকালের অনেক চণ্ডীমণ্ডপে এ রকম বিড়াল কিংবা বাঁদর ঝুলিতে বিপিন দেখিয়াছে। একদিকে রাশীকৃত বিচালি, অন্যদিকে একখানা তক্তপোশের উপর একটা পুরানো শপ বিছানো। ঘরের মেঝেতে একস্থানে তামাকখাইবার উপকরণ—টিকে, তামাক, হুঁকা, কলিকা। ইহা ব্যতীত অন্য কোনো আসবাব চণ্ডীমণ্ডপেনাই 

রামনিধি দত্ত খবর পাইয়া বাহিরে আসিয়া বলিলেন—আপনিই ডাক্তারবাবু? ব্রাহ্মণেরচরণে প্রণাম। আসুন আসুন। বড় কষ্ট হয়েছে এই রোদ্দুরে? 

বৃদ্ধ বিবেচক লোক, অল্প কিছুক্ষণ কথা বলিবার পর তিনি বলিলেন, আপনি বসুন, আমি জল পাঠিয়ে দিই হাত-পা ধোবার। জামা খুলে একটু বিশ্রাম করুন, তারপরে পাশেই নদী, ওই বাঁশ-ঝাড়টার পাশ দিয়ে রাস্তা। নেয়ে আসবেন এখন। তেল পাঠিয়ে দিচ্ছি। 

স্নান করিতে গিয়া নদীর অবস্থা দেখিয়া বিপিন প্রমাদ গনিল। কচুরীপানার দামে স্নানেরঘাটের জল পর্যন্ত এমন ছাইয়া ফেলিয়াছে যে, জল দেখাই যায় না। জল রাঙা, স্নান করিয়াউঠিলে গা চুলকায়। কোনোরকমে স্নান সারিয়া সে ফিরিল। 

বৃদ্ধ বলিলেন, এত বেলায় রান্না করতে গেলে আপনার যদি কষ্ট হয় তবে বলুন চিঁড়ে আছে, দুধ আছে, ভাল কলা আছে, নারকোলকোরা আছে, আনিয়ে দিই। ওবেলা বরং সকালসকাল রান্নার ব্যবস্থা করে দেব এখন। 

ইতিমধ্যে দশ-এগারো বছরের একটি ছেলে একখানা রেকাবিতে একপাশে খানিকটা নারিকেলকোরা আর একপাশে একটু গুড় লইয়া আসিল। বৃদ্ধ বলিলেন, জল খেয়ে নিন, সেইকখন বেরিয়েছেন, ব্রাহ্মণ দেবতা, স্নান-আহ্নিক না হলে তো জল খাবেন না, কষ্ট কি কমহয়েছে! ওরে, জল আনলি নে? খাবার জল ঘটি করে নিয়ে আয়, সন্ধে-আহ্নিক হয়েছে কি? 

বিপিন দেখিল দত্ত মহাশয় গোঁড়া হিন্দু। এখানে যদি সুনাম অর্জন করিতে হয়, তবে তাহাকে সব নিয়মকানুন মানিয়া আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণসন্তান সাজিয়া থাকিতে হইবে। সুতরাং সেবলিল, সন্ধে-আহ্নিক নদী থেকে সারব ভেবেছিলাম কিন্তু তা তো হল না, এখানেই একটু— 

—হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সব পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখানেই সেরে নিন। 

ওঃ, ভাগ্যে সে বাড়িতে পা দিয়াই একঘটি জল চাহিয়া লইয়া খায় নাই! তাহা হইলে এ বাড়িতে তাহার মান থাকিত না। অবস্থা-বিপর্যয় ঘটিলে কি কষ্টেই পড়িতে হয় মানুষকে। 

—তা হলে রান্নার ব্যবস্থা করে দেব, না চিঁড়ে খাবেন এ বেলা? 

—না না, রান্না আর এত বেলায় করতে পারব না। এ বেলা যা হয়— 

দত্ত মহাশয় মহাব্যস্ত হইয়া বাড়ির ভিতর চলিয়া গেলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *