বিপিনের সংসার – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

দিন দুই পরে বলাই একটু সুস্থ হইলে বিপিন বাড়ি হইতে রওনা হইয়া পলাশপুরে আসিল। জমিদার অনাদিবাবু বেশ বিরক্ত হইয়াছেন মনে হইল; কারণ প্রায় পনেরো দিন কামাই হইয়াগিয়াছে বিপিনের। বাহিরের ঘরে বসিয়া তিনি বিপিনকে জমিদারি সম্বন্ধে অনেক উপদেশ দিলেন। প্রজাদের নিকট হইতে কিস্তিখেলাপী সুদ আদায় কিভাবে করিতে হইবে, সে সম্বন্ধে আলোচনা করিলেন। বলিলেন, নালিশ মামলা করতে পিছুলে চলবে না। এবার গিয়ে কয়েক নম্বর মামলা রুজু করে দাও, দেখি টাকা আদায় হয় কিনা! 

বিপিন বলিল, নালিশ করতে গেলেই তো টাকার দরকার। এখন মহালের যেমন অবস্থা, তাতে আপনাদের খরচের টাকাই দিয়ে উঠতে পারি না, তার ওপর মামলার টাকা— 

অনাদিবাবু কাহারও প্রতিবাদ সহ্য করিতে পারেন না। বলিলেন, তা বললে জমিদারির কাজ চলে না। টাকা যেখান থেকে পাবে যোগাড় করবে।তোমাকে তবে গোমস্তা রেখেছি কিমুখ দেখতে! সে সব আমি জানি না, টাকা চাই। 

বিপিনও বিনোদ চাটুজ্জের ছেলে। সে কাহারও কথা শুনিবার পাত্র নয়; বলিল, আজ্ঞে, আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, ওভাবে টাকা আদায় আমায় দিয়ে হবে না। এতেযদি আপনার অসুবিধে হয়, তা হলে আপনি অন্য ব্যবস্থা করুন। 

কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই ভাবিল, এই সংসারের দুরবস্থায়, বলাইয়ের অসুখের সময়, এ কি কাজ করিল সে? ইহার ফলে এখনই চাকুরি যাইবে! 

অনাদিবাবু কিন্তু তখনই তেমন কোনো কথা বলিলেন না। নিঃশব্দে বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলেন। বিপিন সেখানে বসিয়াই রহিল। 

কিছুক্ষণ পরে রাগটা কাটিয়া গিয়া তাহার মাথা একটু ঠাণ্ডা হইল। অনাদিবাবুর মুখে মুখে অমনতর জবাব দেওয়া তাহার উচিত হয় নাই। চাকুরি গেলে বাড়ি গিয়া খাইবে কি? তবে ইহাওঠিক, সে সুর নরম করিয়া ছোট হইতে পারিবে না, ইহাতে চাকুরি যায় আর থাকে! এদিকে আরএক মুশকিল। বেলা এগারোটা বাজে। স্নান-আহারের সময় উপস্থিত। যাহাদের চাকুরি একরূপ ছাড়িয়াই দিল এখনই, তাহাদের বাড়ি আহারাদি করিবেই বা কি করিয়া? না, তাহা আর চলে না।খাওয়ার দরকার নাই। এখনই সে রাণাঘাট হইয়া বাড়ি চলিয়া যাইবে। বাহিরে বসিয়া থাকিলে অনাদিবাবু ভাবিতে পারেন যে, সে ক্ষমাপ্রার্থনা করিবার সুযোগ খুঁজিতেছে। 

নিজের ছোট ক্যাম্বিসের ব্যাগটা হাতে ঝুলাইয়া বিপিন বৈঠকখানা ঘরের বাহির হইয়া রাস্তায় পড়িল। অল্পদূর গিয়া পথের মোড় ঘুরিতেই হঠাৎ অনাদিবাবুদের খিড়কি-দোর হইতে যে ছোট পথটা আসিয়া এই পথের সঙ্গে মিশিয়াছে, সেই পথের মাথায় গাব গাছটার তলায় মানীকে তাহারই দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল। মানী এখানেআছে তাহা সে ভাবে নাই। 

মানীদের খিড়কি-দোর খোলা। এইমাত্র সে যেন দোর খুলিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে। বিপিন কিছু বলিবার আগেই মানী বলিল, কোথায় যাচ্ছ বিপিনদা? 

তারপর আগাইয়া আসিয়া বিপিনের সামনে দাঁড়াইয়া আদেশের সুরে বলিল, যাও গিয়েবৈঠকখানায় বোসো। আমি তেল পাঠিয়ে দিচ্ছি, বেলা হয়েছে বারোটা। নাওয়া-খাওয়া করতেহবে না, কতক্ষণ হাঁড়ি নিয়ে বসে থাকবে লোকে? 

প্রায় কুড়ি-বাইশ দিন পরে মানীর সঙ্গে এই প্রথম দেখা। মানীর কথার প্রতিবাদ করিবার শক্তি যোগাইল না তাহার। সে কোনো কথাই বলিতে পারিল না, শুধু চুপ করিয়া মানীর দিকে চাহিয়া রহিল। 

মানী বলিল, আবার দাঁড়িয়ে কেন, বেলা হয়নি? 

এতক্ষণে বিপিন বাক্‌শক্তি ফিরিয়া পাইল। অপ্রতিভের সুরে আমতা আমতা করিয়াবলিল, কিন্তু আমি গিয়ে—বাড়ি যাচ্ছি যে! 

মানী পূর্ববৎ সুরেই বলিল, তোমার পায়ে আমি মাথা খুঁড়ে খুনোখুনি হব এই দুপুরবেলাবিপিনদা? জ্ঞানবুদ্ধি আর কবে হবে তোমার? যাও ফিরে বৈঠকখানায়! 

বিপিন অবাক হইল মানীর চোখমুখের ভাব দেখিয়া। কতটা টান থাকিলে মেয়েরা এমনজোরের সঙ্গে কথা বলিতে পারে, বিপিনের তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইল না; কিন্তু অনেক কথাবলিবার থাকিলেও সে দেখিল, খিড়কি- দোরের দিকের প্রকাশ্য পথের উপর দাঁড়াইয়া মানীর সঙ্গে বেশি কিছু কথাবার্তা বলা উচিত হইবে না এই সব পল্লীগ্রাম জায়গায়। দ্বিরুক্তি না করিয়াসে ব্যাগ হাতে আবার আসিয়া অনাদিবাবুদের বৈঠকখানায় উঠিল। 

বৈঠকখানায় কেহই নাই। অনাদিবাবু সম্ভবত বাড়ির মধ্যে স্নান করিতেছেন, সে যেবৈঠকখানা হইতে ব্যাগ হাতে বাহির হইয়া চলিয়া যাইতেছিল, ইহা মানী কি করিয়া জানিলবিপিন ভাবিয়া পাইল না। 

একটু পরে চাকর এক বাটি তেল ও একখানা গামছা আনিয়া বলিল, নায়েববাবু, নেয়েনিন মা বলে দিলেন। বিপিন বলিল, কে তোকে তেল আনতে বললে? 

—মা বললেন, নায়েববাবুর জন্যে তেল দিয়ে আয় বাইরে। দিদিমণি গিয়ে রান্নাঘরেমাকে বললেন, আপনি বাইরে বসে আছেন, তেল পাঠিয়ে দিতে। আমি মাছ কুটছেলাম, আমায় বললেন, দিয়ে আয়। আপনি যে কখন এয়েলেন, তা দেখিনি কিনা তাই জানিনে, নইলে আমিনিজেই তেল দিয়ে যাতাম। নায়েববাবু কি আজ আলেন? ভাল তো সব বাড়ির? 

এই একমাত্র চাকর জমিদারবাড়ির, সে তো তাহার যাতায়াতের কোনো খবরই রাখেনা, তবে মানী কি করিয়া জানিল, সে ব্যাগ হাতে চলিয়া যাইতেছে এবং রাগ করিয়াইযাইতেছে? 

খাইবার সময় মানীর আঁচলের ডগাও দেখা গেল না কোনো দিকে, কারণ রান্নাঘরের বারান্দায় অনাদিবাবুর সঙ্গেই তাহার খাবার জায়গা হইয়াছে। অনাদিবাবু উপস্থিত থাকিলে মানীবিপিনের সামনে বড় একটা বাহির হয় না। 

অনাদিবাবু খাইতে বসিয়া এমন ভাব দেখাইলেন যে, বিপিনের সঙ্গে তাঁহার যেন কোনোঅপ্রীতিকর কথাবার্তা হয় নাই। জমিদারিসংক্রান্ত কোনো কথাই উঠালেন না— বিপিনের দেশে মাছের দর আজকাল কি, ম্যালেরিয়া কমিয়াছে না বাড়িয়াছে, রাণাঘাটের বাজারে কাহার একখানা দোকান আগুন লাগিয়া পুড়িয়া গিয়াছে ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠাইয়া তাহাদের আলোচনারমধ্যেই আহার শেষ করিলেন। 

রাণাঘাট হইতে হাঁটিয়া আসিয়া বিপিনের শরীর ক্লান্ত ছিল। অনাদিবাবু বেলা তিনটারআগে বৈঠকখানায় আসিবেন না, মধ্যাহ্নে উপরের ঘরে খানিকক্ষণ নিদ্রা যাওয়া তার অভ্যাস, বিপিন জানে; সুতরাং সে নিজেও এই অবসরে একটু বিশ্রাম করিয়া লইবে। চাকরকে ডাকিয়া বলিল, শ্যামহরি, ও শ্যামহরি, বাবু নামবার আগে আমায় ডেকে দিস যদি ঘুমিয়ে পড়ি, বুঝলি? আর একটু তামাক সেজে নিয়ে আয়। 

একটু পরে মানীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া বিপিন আশ্চর্য হইয়া গেল। বাহিরের ঘরে মানীকে সেআসিতে দেখে নাই কখনও। 

মানী বলিল, বিপিনদা, রাগ পড়েছে? 

বিপিন মানীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আচ্ছা তুই কি করে জানলি আমি চলে যাচ্ছি! কেউ তো জানে না। শ্যামহরি চাকরকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, আমি কখন এসেছি তা পর্যন্ত সেখবর রাখে না। 

মানী হাসিতে হাসিতে বলিল, আমার টনক আছে মাথায় বিপিনদা, আমি জানতে পারি। 

—কি করে বলো না মানী! সত্যি, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তোকে দেখে! 

মানী তবুও হাসিতে লাগিল। কৌতুক পাইলে সে সহজে ছাড়িবার পাত্র নয়, বিপিনতাহা ছেলেবেলা হইতে দেখিয়া আসিতেছে, এবং ইহাও একটা কারণ যেজন্য মানীকে তাহারবড় ভাল লাগে। 

—আচ্ছা, হাসি এখন একটু বন্ধ থাক গে। কথার উত্তর দে। 

মানী দোরের কাছে দাঁড়াইয়া ছিল, দরজার শিকলটা দুই হাতে ধরিয়া তাহার হাসিবার ভঙ্গি দেখিয়া বিপিনের মনে হইতেছিল, মানী এখনও যেন তেমনই ছেলেমানুষ আছে, শিকল ছাড়িয়া মানী দরজার পাশে একখানা চেয়ারে বসিল। গম্ভীর মুখে বলিল, আচ্ছা, তুমি কি রকমমানুষ বিপিনদা! এসেছ কখন, তা জানি না। একবার দেখা পর্যন্ত করলে না। তারপর বাবা বুড়োমানুষ কি বলেছেন না বলেছেন, তুমি অমনই চটে গেলে, আর এই ঠিকদুপুরবেলা, খাওয়াদাওয়া না, কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পুঁটুলি হাতে! 

—তুই জানলি কি করে? 

—আমি জানব কি করে? বাবা রান্নাঘরে গিয়ে মার কাছে বললেন যে তোমার সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয়েছে কি নিয়ে। মাকে বললেন, শ্যামহরিকে দিয়ে তোমার নাইবার তেল পাঠিয়ে দিতে। বাবার মুখে তাই শুনে আমার ভয় হল, আমি তো তোমায় চিনি। তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে দেখি, তুমি ওই বাতাবি- নেবুতলা পর্যন্ত চলে গিয়েছ। চেঁচিয়ে ডাকতেপারি না তো আর। তখনই ছুটে খিড়কি-দোরে গেলুম, রাস্তার বাঁকে তোমায় আসতেই হবে।বাপ রে, কি রাগ! 

—রাগ নয়, মনে দুঃখু তো হতে পারে। 

—কি দুঃখু? তুমিই বলেছ বাবাকে যে, না পোষায় আপনি অন্য লোক রাখুন! বাবাতোমাকে তো কিছুই বলেননি! 

বিপিন চুপ করিয়া রহিল। এ কথার জবাব দিতে গেলে অনাদিবাবুর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলিতে হয়, তাহা সে মানীকে বলিতে চায় না। 

মানী বলিল, বিপিনদা, আমার কাছে তুমি কি বলেছিলে, মনে আছে? 

—কি কথা? 

—এরই মধ্যে ভুলে গেলে? বলেছিলে না, আমায় না জিজ্ঞেস করে চাকরি ছাড়বে না? কথা দিয়েছিলে মনে আছে? 

—মনে ছিল না, এখন মনে পড়ছে বটে। 

—তা নয়, রাগের সময় তোমার জ্ঞান ছিল না, এই হল আসল কথা। উঃ, কি জোরবেরিয়ে যাওয়া হল! দেখতে না দেখতে একেবারে বাতাবিনেবুর গাছের কাছে! ভাগ্যিস আমিছুটে গেলুম খিড়কির দোরে? নইলে এতক্ষণ রাণাঘাটের অর্ধেক রাস্তা— 

—কিন্তু এতক্ষণ পরে একটা কথা বলি মানী, তুই যে এসেছিস বা এখানে আছিস এ কথা আমি কিন্তু কিছু জানি না। আমি তোকে খিড়কি-দোরের পথে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। 

—বাবা কিছু বলেননি? 

—উনি তোর কথা আমার কাছে কি বলবেন? কখনও বলেন, না আমিই জিজ্ঞেস করি? 

—তা নয়। আমি থাকলেই তো খরচ বাড়ে, খরচ বাড়লেই জমিদারির তাগাদা জোর করে করবার ভার পড়ে তোমার ওপর। আমি ভেবেছিলুম, বাবা সেকথা তুলেছেন বুঝি; আমি আছিসুতরাং টাকা চাই, এমন কথা যদি বলে থাকেন! 

—না, সে কথা ওঠেনি। তুই চলে যাবি শিগির এ তো জেনেই গিয়েছিলুম, আবার এর মধ্যে আসবি তা ভাবিনি। 

—তা ভাববে কেন? দেখতে পেলে বুঝি গা-জ্বালা করে? দূরে রাখলেই বাঁচো বুঝি? 

—বলেছি কোন দিন? 

মানী ঘাড় দুলাইয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, তোমায় রাগাচ্ছি, বিপিনদা, রাগাচ্ছি। সেই সব তোমার ছেলেবেলার মতো এখনও আছে, কিছু বদলায়নি। আচ্ছা, একটা কবিতা বলবশুনবে? 

বিপিন হাত নাড়িয়া যেন মশা তাড়াইবার ভঙ্গি করিয়া বলিল, রক্ষে কর। ওসব ভাললাগে না আমার, বুঝি-সুঝি না। বাদ দাও, জানো তো আমার বিদ্যে! 

মানী গম্ভীর হইয়া বলিল, বিপিনদা, আমার আর একটা কথা রাখতে হবে। তোমায় পড়াশুনা করতে হবে। তোমায় কতগুলো ভাল বই দোব, সেগুলো কাছারিতে গিয়ে পড়বে, পড়ে ফেরত দেবে, আমি আবার দোব। বইয়ের আমার অভাব নেই, যত চাও দোব। 

বিপিন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলিল, বই আমি অনেক পড়েছি, তুই যা। বুড়ো বয়েসে আবারবই পড়তে যাই, আর উনি আমার মাস্টারনী হয়ে এসেছেন! 

মানী রাগিয়া বলিল, এসেছিই তো মাস্টারনী হয়ে। পড়তে হবে তোমায়। বই দিচ্ছি, নিয়ে যাও যদি ভাল চাও। এঃ, একেবারে ধিঙ্গি হয়ে উঠেছেন আর কি! পড়াশুনো শিকেয় তুলেছেন। 

বিপিন হাসিতে লাগিল। 

মানী বলিল, সত্যিই বলছি বিপিনদা, নিজের জীবনটা তুমি ইচ্ছে করে গোল্লায় দিলে। নইলে আজ আমার বাবার বাড়ি চাকরি করতে আসবে কেন তুমি? লেখাপড়া শিখলে কাঁকুড়, তোমায় ভাল চাকরি দেবে কে বল তো? আবার তেজ করে চলে যাওয়া হয়। যাও, বই দিচ্ছি, নিয়ে পড় গে, আর একখানা ডাক্তারি বই দিচ্ছি, সেখানা যদি ভাল করে পড়তে পারো, তবে আরচাকরি করতে হবে না। 

ডাক্তারি বইয়ের কথায় বিপিন উৎসাহিত হইয়া উঠিল। নতুবা এতক্ষণ মানীরগুরুমহাশয়গিরিতে তাহার হাসি আর থামিতেছিল না। বলিল, বেশ, ভালই তো। কি বই পড়তে হবে এনে দিয়ো, দেখি চেষ্টা করে। 

—মানুষ হও বিপিনদা, আমার বড্ড ইচ্ছে। তোমার বুদ্ধি আছে, কিছু কাজে লাগালে না তাকে। ডাক্তারি যদি শিখতে পারো, ভেবে দেখ, কারও চাকরি তোমায় করতে হবে না। আমারএক দেওর ডাক্তারি পাস করেছে, বীজপুরে ডাক্তারখানা খুলে বসেছে, দেড়শো টাকার কমকোনো মাসে পায় না। 

–সেসব পাস-করা ডাক্তারের কথা ছেড়ে দে! আচ্ছা, বাংলা বই পড়ে ডাক্তার হওয়াযায়? 

—কেন হওয়া যাবে না। খু-উ-ব যায়। তোমায় বই আমি আরও দোব। তারপর আমারসেই দেওরকে বলে দেব, তার কাছে ছ’মাস থেকে শিখলে তুমি পাকা ডাক্তার হয়ে যাবে। সেকথা পরে হবে, এখন তোমায় বই এনে দিই, সেগুলো নিয়ে কাছারি যেও, আর রোজ পড়ো।কবে যাবে সেখানে? 

—কাল সকালেই যেতে হবে, দেরি আর করা চলবে না। 

—আচ্ছা বোসো,আমি বই বেছে বেছে নিয়ে আসি। 

মানী বিপিনের দিকে চাহিয়া কেমন একপ্রকার হাসিয়া চলিয়া গেল।মানীর এ হাসিবিপিনের পরিচিত। ছেলেবেলা হইতে দেখিয়া আসিতেছে। 

মনে মনে ভাবিল, মানীটা বড় ভাল মেয়ে। এতটুকু ঠ্যাকার নেই, বেশ মনটি। তবে মাথায় একটু ছিট আছে, নইলে আমায় এ বয়েসে লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করে! 

মানী একরাশ বই লইয়া ঘরে ঢুকিয়া বিপিনের সামনে বইয়ের বোঝা নামাইয়া বলিল, দেখে ভয় হচ্ছে নাকি? কিছু ভয় নেই। এর মধ্যে দু’খানা শরৎবাবুর নভেল আছে, ‘শ্রীকান্ত’ আর ‘দত্তা’, পড়ে দেখো, কি চমৎকার! 

—উঃ, তুই দেখছি আমায় রাতারাতি পণ্ডিত না করে ছাড়বি না মানী! 

মানী আর একখানা মোটা বই হাতে লইয়া বিপিনের হাতে দিয়া বলিল, এইখানা সেই ডাক্তারি বই। এ আমার শ্বশুরবাড়ির জিনিস, তোমায় দিলাম। এ থেকে তুমি করে খেতেপারবে। 

বিপিন পড়িয়া দেখিল, বইখানার নাম ‘সরল চিকিৎসা-বিজ্ঞান’। গ্রন্থকারের নামব্যোমকেশ চট্টোপাধ্যায় এল, এম. এস.। 

মানীর দিকে চাহিয়া বলিল, বেশ ভাল বই? 

মানী ঘাড় নাড়িয়া আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলিল, খুব ভাল বই। 

এতে সব আছে ডাক্তারি ব্যাপারের। বাকিটুকু হয়ে যাবে এখন, আমার সেই দেওরের কাছে থেকে কিছুদিন শিখলে। আমি সব ঠিক করে দেব এখন 

—আর ওগুলো কি বই? 

—এখানা শরৎবাবুর ‘দত্তা’, বললুম যে! চমৎকার বই, পড়ে দেখো—উপন্যাস।উপন্যাস পড়োনি কখনও? 

—আমাদের বাড়িতে ছিল বাবার আমলের ‘ভুবনমোহিনী’ বলে একখানা উপন্যাস।সেখানা পড়েছি। 

—ওসব বাজে বই, ভাল বই তুমি কিছুই পড়োনি, খোঁজও রাখো না বিপিনদা। আজকালমেয়েরা যা জানে, তুমি তাও জানো না। দুঃখু হয় তোমার জন্যে। 

—শরৎবাবু ভাল লেখক? নাম শুনিনি তো? 

—তুমি কার নাম শুনেছ? বঙ্কিমবাবুর নাম জানো? রবি ঠাকুরের নাম জানো? 

—নাম শুনেছি ওই পর্যন্ত। পড়িনি কোনো বই। আছে তাদের বই? 

—এগুলো আগে পড়ে শেষ করো, পরে দোব। শোনো, আমি শ্যামহরি চাকরকে বলেদিচ্ছি, তোমার পুঁটুলি আর বই দত্তপাড়ায় কাছারিতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। নইলে তুমি নিয়েযাবে কি করে? 

—ওতে দরকার নেই মানী, তোমার বাবা কি মনে করবেন! আমার মোট বইবার জন্যেচাকরকে বলবার কি দরকার! 

—সে ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না। আমি বললে বাবা কিছু বলবেন না। আজই যাবে?

–এখুনি বেরুব। অনাদিবাবু ঘুম থেকে উঠলেই তার সঙ্গে দেখা করেই বেরিয়ে পড়ব। 

—বাবা ঘুম থেকে উঠলেই আমি চাকরের হাতে চা পাঠিয়ে দোব এখন, চা খেয়ে যেও। 

মানী চলিয়া যায় বিপিনের ইচ্ছা নয়। অনাদিবাবু এখনও উঠিবার সময় হয় নাই, মানীআরও কিছুক্ষণ থাকুক না।বিপিন কহিল, তোর সঙ্গে একটা পরামর্শ করি মানী, নইলে আর কার সঙ্গেই বা করব। বলাইকে নিয়ে বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি, ওর অসুখ আবার বেড়েছে, এদিকে এই তো অবস্থা, বাড়িতে থাকলে কুপথ্যি করে, কারও কথা শোনে না। কি করি বল তো, এমন দুর্ভাবনা হয়েছে ওর জন্যে! এই যে আসতে দেরি হয়ে গেল বাড়ি থেকে, সে ওরই অসুখ বাড়ল বলে। নইলে তোর কাছে যা কথা দিয়ে গিয়েছিলাম, তার আগেই আসতাম। 

বলাইয়ের অসুখের ভাবনা বিপিনের মনে যেন পাথরের বোঝা চাপাইয়া রাখিয়া দিয়াছে সব সময়, মানীর কাছে সে বোঝা কিছুক্ষণের জন্য নামাইয়াও সুখ। মানীকে সে মনে মনে বুদ্ধিমতী শিক্ষিতা মেয়ে বলিয়া শ্ৰদ্ধা করে, অন্তত সে মানীর চেয়ে বেশি বুদ্ধিমতী ও শিক্ষিতা মেয়ে কখনও দেখে নাই, সেইজন্য মানী কি পরামর্শ দেয় শুনিবার নিমিত্ত বিপিন উৎসুক হইল। 

মানী বলিল, ওকে তো সেবার হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেলে, হাসপাতালে আবার নিয়ে এসো না! 

—হাসপাতালের বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলুম, তারা ওকে হাসপাতালে রাখতেচায় না। বলে, ও রুগী হাসপাতালে রেখে উপকার হবে না। 

মানী একটু ভাবিয়া বলিল, তা হলে কি জানো, আমার দেওরকে না হয় একখানা চিঠিলিখি। বীজপুরে রেলের হাসপাতাল আছে, সেখানে যদি কোনো বন্দোবস্ত করা যায়, দেওরতো ওখানে ডাক্তার! কালই চিঠি লিখব। 

এই সময় বাড়ির মধ্যে অনাদিবাবুর গলা শোনা গেল। 

তিনি ঘুম হইতে উঠিয়া দোতলার বারান্দায় কাহার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। 

মানী বলিল, ওই বাবা উঠেছেন, আমি আসি, চা এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আর বইগুলো পড়তে হবে আর আমাকে বলতে হবে সব কথা, যেন ভুলে যেও না। 

বিপিন হাসিয়া ব্যঙ্গের সুরে বলিল, ওরে আমার মাস্টারনী রে! 

—বাজে কথা বোলো না বিপিনদা, বলে দিচ্ছি। আর ডাক্তারি বইখানার কথা যেন খুব করেমনে থাকে। জীবনে উন্নতি করবার চেষ্টা করো বিপিনদা, কেন চিরকাল পরের দাসত্ব করবে? 

মানীর কথায় বিপিনের হাসি পাইল। কি মুরুব্বিই হইয়া উঠিয়াছে মানী এই অল্প বয়সে! কথার খই ফুটিতেছে মুখে। বলিল, দাঁড়া মানী, একটা কথা, তুই ব্রেহ্মসমাজের মতো বক্তৃতাদিবি নাকি? কলকাতায় গিয়ে দেখছি মানুষ হয়ে গেলি! 

—আবার বাজে কথা! চুপ! কি কথা বলছিলে বলবে? এই বাজে কথা, না আর কোনোকথা আছে? 

—ইয়ে, তুই আর কতদিন আছিস এখানে? 

—ঠিক নেই। যতদিন ওরা রাখে—ওদের মজ্জি। কেন? 

বিপিন একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, এবার এলে তোর সঙ্গে দেখা হবে কি না তাইবলছিলাম! 

—খুব দেখা হবে। কতদিনের মধ্যে আসছ? বেশিদিন দেরি না-ই বা করলে? 

—খুব দেরি করা না-করা আমার হাত নয়। যদি আদায় হয় চট করে, এই হপ্তাতেইআসতে পারি, নয়তো পনেরো বিশ দিন দেরিও হতে পারে। 

মানী বলিল, আচ্ছা, যাই।মানী চলিয়া যায় বিপিনের ইচ্ছা নয়, কিন্তু অনাদিবাবু উঠিয়া হয়তো ওপরের বারান্দায়পায়চারি করিতেছেন, এ অবস্থায় তাহাকে আর ধরিয়া রাখাও উচিত নয়। সুতরাং সে বলিল, আচ্ছা এসো,তোমার বাবা আসছেন বাইরে। 

কিন্তু মানী চলিয়া যাইবামাত্র বিপিনের মনে হইল মানীর শেষ কথাটি—’আচ্ছা, যাই!’ 

মানী যখন চোখের সামনে থাকে, তখন বিপিন মানীর সব কথা ভাবিয়া দেখিবার, বুঝিবার, উপভোগ করিবার অবকাশ পায় না। এখন বিপিন হঠাৎ দেখিল, মানী এ কথা তাহাকেআর কখনও বলে নাই, অর্থাৎ বলিবার প্রয়োজন হয় নাই। কি জানি কেন, মানীর এ কথাবিপিনের ভারী ভাল লাগিল। 

একটু পরে শ্যামহরি চাকর চা আনিয়া দিল, আর আনিল ছোট একটা রেকাবিতেখানকতক পেঁপের টুকরা ও একটা সন্দেশ। 

এ মানীর কাজ ছাড়া আর কারও নয়, বিপিন তাহা জানে। এ বাড়িতে মানী যখন ছিল, বাহিরের ঘরে এক আধ পেয়ালা চা যদি বা কালেভদ্রে আসিয়াছে, খাবার কখনও যে আসেনাই, এ কথা সে হলফ করিয়া বলিতে পারে। 

কাছারি-ঘরে একা বসিয়া সন্ধ্যার সময় বিপিনের আজকাল বড়ই খারাপ লাগে। 

ধোপাখালিতে সে আসিয়াছে আজ প্রায় দেড় মাস পরে। এতদিন দেশে ছিল নিজের পরিবারের মধ্যে, নির্জনে বসিয়া আকাশের তারা গুনিবার বিড়ম্বনা সেখানে ভোগ করিতে হয় নাই। 

বিশেষ করিয়া মানীর সঙ্গে দেখা হইবার পরে দিনকতক এই নির্জনতা যেন একেবারে অসহ্য হইয়া পড়ে আবার কিছুদিন পরে সহিয়া যায়। 

কাছারির উঠানের সেই বাদাম গাছটার ডালপালার মধ্যে কেমন একপ্রকার শব্দ হয়, বিপিন দাওয়ায় বসিয়া চুপ করিয়া রাত্রির অন্ধকারের দিকে চাহিয়া থাকে। 

মানী যে বলিয়াছিল, জীবনে উন্নতি করো বিপিনদা—কথাটা বিপিনের বড় মনেলাগিয়াছে। তখন হাসি পাইলে কি হইবে, এখন সে বুঝিয়াছে, মানীর এই কথাটা তাহার মনে অনেকখানি আনন্দ ও উৎসাহ আনিয়া দিয়াছে। 

জীবনে উন্নতি তাহাকে করিতেই হইবে। 

সন্ধ্যার পরে কাছারির চাকরটা আলো জ্বালাইয়া রান্নার যোগাড় করিতে রান্নাঘরে ঢোকে।কিন্তু বিপিন এবেলা বড় একটা রান্নাবান্নার হাঙ্গামাতে যায় না। ওবেলার বাসি তরকারি থাকে, চাকরকে দিয়া খানকতক রুটি করাইয়া লয় মাত্র। খাটিয়া আসিয়া মানীর দেওয়া বইগুলি পড়িতে বসে। এ সময়টা একরকম মন্দ কাটে না। 

বইগুলি একবার আরম্ভ করিলে শেষ না করিয়া থাকা যায় না, মানী সত্যই বলিয়াছিল। 

ডাক্তারি বইখানা প্রথম প্রথম সে ভাল বুঝিতে পারে নাই, কিন্তু ক্রমে এই বইখানাই তাহার গাঢ় মনোযোগ আকৃষ্ট করিল। মানুষের শরীরের মধ্যে এত সব ব্যাপার আছে, সে কোনো দিন ভাবে নাই। দেহের নানা রকম যন্ত্রের ছবি বইয়ের গোড়ার দিকে দেওয়া আছে, বিভিন্ন যন্ত্রের কার্যবর্ণিত হইয়াছে, উপন্যাসের চেয়েও বিপিনের কাছে সে সব বেশি চমকপ্রদ মনে হইল। 

তিন চার দিন বইখানা পড়িবার পরেই বিপিন ঠিক করিয়া ফেলিল, ডাক্তারি সেশিখিবেই। এতদিন পরে তাহার জীবনের উদ্দেশ্য সে খুঁজিয়া পাইয়াছে। এতদিন সে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, মানীর কাছে সে কৃতজ্ঞ থাকিবে পথ দেখাইয়া লক্ষ্য স্থির করিয়া দিবার জন্য। 

দিন পনেরো লাগিল বইখানা শেষ করিতে। 

শেষ করিয়া একটা কথা তাহার মনে হইল, কি অন্যায় সে করিয়াছে পৈতৃক অর্থেরঅপব্যয় করিয়া! আজ যদি হাতে টাকা থাকিত, সে চাকুরি ছাড়িয়া কলিকাতায় কোনো ডাক্তারি স্কুলে ভর্তি হইয়া কিছুদিন পড়াশুনা করিত। বাংলা ভাষায় ডাক্তারি ব্যবসায় শেখানো হয়, এমনস্কুল কলিকাতায় আছে—এই বইখানার মধ্যেই সে স্কুলের বিজ্ঞাপন আছে শেষের পাতায়। 

তাহার মনে হইল মানী মেয়েমানুষ, কিছু তেমন জানে না, তাই সে বলিয়াছিল বীজপুরেতাহার দেওরের কাছে ছয় মাস থাকিলে বিপিন ডাক্তারি-শাস্ত্রে পটু হইয়া যাইবে। বেচারিমানী! 

এ সে জিনিস নয়, বইখানা আগাগোড়া পড়িবার পরে তাহার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে, ডাক্তারি শেখা ছয় মাস এক বছরের কর্ম নয়। ভাল ডাক্তার হইতে হইলে কোনো ভাল স্কুলেঅভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে না পড়িলে কিছুই হইবে না। বহু ব্যাপার শিখিবার আছে, এ বিষয়েমানীর দেওর কি শিখাইবে? 

বিপিনের আরও মনে হইল, ডাক্তারি সে ভাল পারিবে। তাহার মন বলিতেছে, এই কাজে নামিয়া পড়িলে যশ অর্জন করিবে সে। এই একখানা মাত্র বই পড়িয়া সে অনেক কিছুবুঝিয়াছে, বইতে যা বলে নাই, তাহার চেয়ে বেশি বুঝিয়াছে। 

মানীর সঙ্গে দেখা করিয়া এসব কথা তাহাকে বলিতে হইবে। মানীর সঙ্গেই পরামর্শকরিতে হইবে, ডাক্তারি শিখিবার আর কি উপায় স্থির করা যাইতে পারে! তাহার ভাল মন্দ মানী যেমন বোঝে, সে নিজেও যেন তেমন বোঝে না। 

 

বিপিন পাঁচ ছয় টাকা খরচ করিয়া রাণাঘাট হইতে কুইনাইন, লাইকার আর্সেনিক, লাইকার অ্যামোনিয়া, অ্যাসিড এন.এম.ডিল.প্রভৃতি কয়েকটি ঔষধ আনাইল, যাহা সাধারণ ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রেসক্রিপশনে লাগে বলিয়া বইতে লিখিয়াছে।অ্যালক্যালি-মিশ্চারেরউপকরণও ওইসঙ্গে কিছু আনাইল। 

আনাইবার পরদিনই কামিনীর প্রতিবেশিনী হাবু ঘোষের দিদিমা আসিয়া বলিল, ও নায়েববাবু, কামিনীর বড় অসুখ হয়েছে আজ তিন চার দিন হল, একবার আপনারে যেতেবলেছে। 

বিপিন ব্যস্ত হইয়া তাহার প্রথম রোগী দেখিতে ছুটিল। যদিও হাবুর দিদিমা ডাক্তারহিসাবে তাহাকে আহ্বান করে নাই, সে যে ডাক্তারি বই পড়িয়া ভিতরে ভিতরে ডাক্তার হইয়াউঠিয়াছে, এ খবর কেহ রাখে না। 

বিপিন এবার যখন কাছারিতে আসে, আজ দিন কুড়ি আগের কথা, কামিনী সেই দিনইগিয়া বিপিনের সঙ্গে দেখা করিয়াছিল। তারপর দুপুরের পরে প্রায়ই বুড়ি কাছারিতে আসিয়াকিছুক্ষণ গল্পগুজব করিয়া চলিয়া যাইত। তাহার অভ্যাসমতো কয়দিন দুধ ও ফলমূলও নিজে লইয়া আসিয়াছে। আজ সাত আট দিন হইল কামিনী কাছারিতে আসে নাই, বিপিনের এখন মনেপড়িল। সে নিজেকে লইয়া এমন মশগুল যে, বুড়ি কেন আজকাল কাছারিতে আসিতেছে না—এ প্রশ্ন তাহার মনে উঠে নাই। 

গোয়ালপাড়ার মধ্যেই কামিনীর বাড়ি। 

দুইখানা বড় চালাঘর, মাটির দেওয়াল। খুব পরিষ্কার করিয়া লেপা-পোছা। এক দিকেগোহাল, আগে অনেকগুলি গরু ছিল। বিপিন ছেলেবেলায় কামিনীর বাড়িতে আসিয়াছে, কামিনী কাছারি গিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাড়ি আনিত এবং ওই বড় ঘরের দাওয়ায় বসাইয়াকত গল্প করিত, খাবার খাইতে দিত, সে কথা বিপিনের আজও মনে আছে। তবে সে কামিনীরবাড়িতে আসে নাই আর কখনও সেই বাল্যদিনগুলির পরে, আসিবার আবশ্যকও হয় নাই। 

কামিনী ঘরের মেঝেতে বিছানার উপর শুইয়া আছে। 

বিছানাপত্রের অবস্থা দেখিয়া বিপিন বুঝিল, কামিনীর সচ্ছল দিন আর নাই। এক সময়েএই ঘরের মধ্যে এক হাত পুরু গদির উপরেতোশক ও ধপধপে চাদরপাতা চওড়া বিছানা সে নিজের চোখে দেখিয়াছে। ঘরে নানা রকম ছবি টাঙানো থাকিত, এখনও অতীতের স্মৃতি বহনকরিয়া দুই চারখানা ছবি ঝুলকালি মাখানো অবস্থায় দেওয়ালে ঝুলিতেছে—কালী, দশমহাবিদ্যা, মহারানি ভিক্টোরিয়ার রঙিন ছবি, গোষ্ঠবিহার। 

কামিনী ময়লা কাঁথার ভিতর হইতে মুখ বাহির করিয়া ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিল, এসো বাবা এসো, ওই পিঁড়িখানা পেতে দে তো ভাই! 

হাবুর দিদিমা পিঁড়ি পাতিয়া দিল। সেই সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে বিপিনকে। 

বিপিন বলিল, দেখি হাতখানা, জ্বর হয়েছে, তা আমায় আগে জানাওনি কেন? আজগিয়ে হাবুর দিদিমা বললে, তাই জানতে পারলাম। 

তুমি বসো বসো,ভাল হয়ে বসো। আমার কথা বাদ দাও, অসুখ লেগেই আছে। বয়েস হয়েছে, এখন এই রকম করে যে ক’দিন যায়! 

বিপিন হাত দেখিয়া বুঝিল, জ্বর খুব বেশি। মনে মনে ভাবিল, কি ভুলই হয়েছে! একটাথার্মোমিটার না পেলে কি জ্বর দেখা যায়? একদিন রাণাঘাট গিয়ে একটা থার্মোমিটার আনতেইহবে, নইলে রোগী দেখা চলবে না। 

বিপিন হাবুর দিদিমাকে বলিল, একটা শিশি নিয়ে চলো, ওষুধ দিচ্ছি।কামিনী আশ্চর্য হইয়া বলিল, তুমি ওষুধ দেবে কোথা থেকে!বিপিন হাসিয়া বলিল, বা রে, তুমি বুঝি জানো না, আমি ডাক্তারি করি যে আজকাল।কামিনী কথাটা বিশ্বাস করিল না। বলিল, আহা কেবল পাগলামি আর খেয়াল! 

হাবুর দিদিমা শিশি ধুইতে বাহিরে গিয়াছিল, এই সুযোগে কামিনী বলিল, সরে এসে বসোকাছে। 

বিপিন মলিন কাঁথা-পাতা বিছানার একপাশে বসিল। 

কামিনী সস্নেহে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল, চিরকালটা একরকম গেল। কামিনীআড়ালে-আবডালে যে তাহার সহিত মাতৃবৎ ব্যবহার করে, ইহা বিপিনের অনেকদিন হইতেইজানা আছে। সেও হাসিয়া বলিল, না, সত্যি বলছি, আমি ডাক্তারি শিখছি। শুনবে তবে, কেআমায় ডাক্তারি শেখাচ্ছে? আমাদের জমিদারের মেয়ে! 

কামিনী অবাক হইয়া বলিল, আমাদের বাবুর মেয়ে! সে আর কতটুকু, আমি তাকে দেখিনি যেন! কর্তা থাকতে একবার দোলের সময় জমিদারবাবুদের বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন সে খুকিকে দেখেছি, কর্তামশায় তাকে দেখিয়ে বললেন, এই দেখ, আমাদের বাবুর মেয়ে। ওই এক মেয়েই তো। কর্তা বলতেন—। আচ্ছা, কৰ্তা ইদানীং একটু চোখে কম দেখতেন, না? 

বিপিন দেখিল, বুড়ি তাহার বাবার কথা আনিয়া ফেলিয়াছে, হঠাৎ থামিবে না, এখন বাবার সম্বন্ধে বুড়ির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করিবার মতো মনের অবস্থা তাহার নাই। সে হাসিয়া বলিল, তুমি সে কতকাল আগে দেখেছিলে, তোমার খেয়াল আছে? সে মেয়ে কি চিরকাল তেমনই খুকি থাকবে? এখন তার বয়েস কুড়ি-বাইশ। অনাদিবাবুদের বাড়ি দোল হত।আজকের কথা নয়, আমার ছেলেবেলার কথা। 

—বাবুর মেয়ের বিয়ে হয়েছে কোথায়? 

—কলকাতার এক উকিলের সঙ্গে। 

—তা সে মেয়ে তোমায় ডাক্তারি শেখাচ্ছে কেমন কথা? সে ডাক্তারি জানলে কোথাথেকে? 

বিপিনের ইচ্ছা, মানীর সম্বন্ধে কথা বলে। অনেকদিন মানীর বিষয়ে সে কথা বলে নাই, তাহাকে দেখেও নাই, তাহার মনটা অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে, অন্তত মানীর বিষয় লইয়াকিছু বলিয়াও সুখ। কিন্তু ধোপাখালির প্রজাদের নিকট তো আর জমিদারবাবুর মেয়ের সম্বন্ধেআলোচনা করা চলে না! 

কামিনীর কথার উত্তরে বিপিন যাহা বলিয়া গেল, তাহা বৃদ্ধার প্রশ্নের সঠিক উত্তর নয়, মানীর রূপগুণের একটি দীর্ঘ বর্ণনা। 

কামিনী চুপ করিয়া শুনিতেছিল, বিপিনের কথা শেষ হইয়া গেলে বলিল, বেশ মেয়ে! তোমার সামনে বেরোয়? 

—কেন বেরুবে না? ছেলেবেলায় একসঙ্গে খেলা করেছি, আমার সামনে বেরুবে না? 

—একটা কথা বলি, তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তোমারও ঘরে সোনার পিরতিমের মতোবউ। আমার একটা কথা শোনো বাবা, তুমি তার সঙ্গে আর দেখাশুনো কোরো না। তুমি কালকের ছেলে, কি জানো আর কিই বা বোঝো! তোমার মাথায় এখনও অনেক রকম পাগলামি ঢুকে আছে। তোমায় জানতে আমার বাকি নেই বাবা, কর্তামশায়ের তো ছেলে! তুমি ও-মেয়ের ত্রিসীমানায়ঘেঁষো না, নিজে কষ্ট পাবে, তাকেও কষ্ট দেবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *