বিপিনের সংসার – ১১

একাদশ পরিচ্ছেদ 

সেই দিনের ব্যাপারের পর হইতে বছরখানেক কাটিয়া গিয়াছে, পটল আর বীণার সঙ্গে দেখা করিবার চেষ্টা করে নাই। ইহাতে প্রথম প্রথম বীণা খুব স্বস্তি অনুভব করিল। কিন্তু সপ্তাহ যখনপক্ষে এবং পক্ষ যখন মাসে, এমন কি বৎসরে পরিবর্তিত হইতে চলিল— পটলের টিকিকোনোদিকে দেখা গেল না, তখন বীণার মনে হইল তাহার মনের এই যে নিরঙ্কুশ স্বস্তি, ইহা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সহজলভ্য জিনিস—বিধবা হইয়া পর্যন্ত এই বৈচিত্র্যহীন স্বস্তি সে বরাবর ইস্তকনাগাৎ পাইয়া আসিয়াছে—ইহার মধ্যে কিছু নূতনত্ব নাই। নূতনত্ব ও বৈচিত্র্য যাহার মধ্যে ছিল, তাহার নিকট হইতে দূরে সরিয়া গিয়াছে। 

খুব অল্পদিনের জন্য—কতদিন? বছর দুই? হাঁ, প্রায় দুই বছরের জন্য তাহার জীবনে এই অনাস্বাদিতপূর্ব বৈচিত্র্য দেখা দিয়াছিল। পটলদা তাহাদের বাড়িতে আসে—আসিত, মায়ের সঙ্গেকি বলাইয়ের সঙ্গে গল্প করিয়া হয়তো বা একটা পান কিংবা একগ্লাস জল, কখনো বা দুই-ই, চাহিয়া খাইয়া চলিয়া যাইত। 

মায়ের ডাকে বীণাই পান-জল আনিয়া দিত—কেননা মনোরমা ঘরের বউ, স্বামীরবন্ধুস্থানীয় লোকের সম্মুখে বাহির হইবার নিয়ম তাহাদের সংসারে নাই। 

হয়তো পান দিতে আসিয়া পটল দুই-একটা কথা বলিত, বীণা জবাব দিত। হয়তো পটলএক আধটা ছোটখাটো গল্প করিল, বীণা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শুনিত—ভাল লাগিত শুনিতে। হয়তো মা উঠিয়া যাইতেন সন্ধ্যাহ্নিক করিতে—বীণা ও পটল রোয়াকে পরস্পরের সঙ্গেকথাবার্তা বলিত। 

ক্রমে পটলদা যেন একটু ঘনঘন আসিতে আরম্ভ করিল। পটলের সাড়া পাইলে বীণারও যেন কি হয়। তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠে, রান্নাঘরে বউদিদির কাছে বসিয়া কুটনা কুটিতে, কি তেঁতুল কাটিতে, কি বাটনা বাটিতে আর ভাল লাগে না। ছুটিয়া গেলে কে কি মনে করিবে, ধীরে ধীরেই যাইত–অন্য ছুতায় যাইত। 

—মা, আজ কি বেগুন পোড়াতে আছে? বউদিদি বলছিল, আমি বললাম, আজ বুধবার, দাঁড়াও, জিগ্যেস করে আসি। 

—আচ্ছা মা, পাকানো সলতেগুলো কুলুঙ্গিতে রেখে দিইচি, তার কি একটাও নেই—তুমি নাওনি? 

—তোমার কলসিতে জল আনতে হবে না মা? বলো তো এখুনি আনি, আবার সন্ধেহয়ে গেলে তখন— 

ইত্যাদি, ইত্যাদি। 

তারপর কে জানে আধঘণ্টা, কে জানে একঘণ্টা, সে আর পটলদা গল্পই করিতেছে, গল্পই করিতেছে। যতক্ষণ পটলদা বাড়িতে থাকিবে বীণা নড়িতে পারিত না সেখান হইতে। 

ক্রমে পটলদা চাহিত একটু আড়ালে দেখা করিতে, বীণা তাহা বুঝিত 

বীণার কৌতূহল তখন বেশ বাড়িয়াছে, পুরুষমানুষ একা থাকিলে কি রকম কথাবার্তা বলে। পটলদা মজার মজার কথা বলে বটে। বীণার হাসি পায়, আনন্দও হয়। মা উপস্থিতথাকিলে পটলদা এ ধরনের কথা বলে না। হয়তো বীণার শোনা উচিত নয় এসব কথা, কিন্তু লাগে মন্দ নয়। 

তারপর গ্রামে কথা উঠিল, দাদা বাড়ি আসিয়া তাহাকে ডাকিয়া বুঝাইলেন, বউদিদিইদাদার কানে উঠাইল এসব কথা, বলাই মারা গেল, পটলদা সন্ধ্যার সময় ছাদের পাশে বাগানেঅন্ধকারে লুকাইয়া দেখা করিতে শুরু করিল, তাহাও একদিন বউদিদির চোখে গেল পড়িয়া—বীণার জীবনে সুখ নাই, আনন্দ নাই কোনোদিক হইতে। একটুকু আলো আসিতে সবে আরম্ভ করিয়াছে—যাই—অমনি সবাই মিলিয়া হৈ-হৈ করিয়া জানালা সশব্দে বন্ধ করিয়া দিল। 

সেদিন একাদশী। 

বীণা সারাদিন মায়ের সঙ্গে নির্জলা একাদশী করিয়া সন্ধ্যাবেলা মায়ের অনুরোধে একটুদুধ ও দুই-একটা ফল খায়। একদিন ঘরে ফলের যোগাড় ছিল না—পাড়াগাঁয়ে থাকেনা—মনোরমা বৈকালে বলিল, ও ঠাকুরঝি, মনুর মার কাছ থেকে এক পয়সার পাকা কলা নিয়েএসো তো? আমি ঘাটে বলেছি ওকে। গিয়ে নিয়ে এসো। 

বীণা এ-পাড়ার সকলের বাড়িতেই একা যাতায়াত করে—ও-পাড়ায় কখনও একা যায় না।মনুর মা থাকে এই পাড়ারই সর্বশেষ প্রান্তে, মধ্যে পড়ে ছোট একটা আমবাগান, সেটা পূর্বেছিল বীণার বাবা বিনোদ চাটুজ্জের নীলাম-খরিদা সম্পত্তি, আবার ওপাড়ার শ্রীশ বাঁডুজ্জে বিপিনের নিকট হইতে ক্রয় করিয়া লইয়াছেন। একটি আমগাছের নাম ‘সোনাতলী, বীণা ছেলেবেলায় এখানে আম কুড়াইতে আসিত—যখন তাহাদের নিজেদের বাগান ছিল। যাইতে যাইতে সে ভাবিল—কি চমৎকার আম ছিল সোনাতলীর! কত বছর এ গাছের আম খাইনি— এবারে খুড়িমাদের কাছ থেকে দুটো চেয়ে আনব আমের সময়। 

হঠাৎ সে দেখিল পটলদা বাগানের পথ দিয়া বাগানে ঢুকিতেছে। বীণার বুকের রক্ত যেন টল্ খাইয়া উঠিল। এখন সে কি করে? বাড়ি ফিরিয়া যাইবে? পটলদা তাহাকে দেখিতে পায়নাই—কারণ সে বাগানের কোনাকুনি পথটা বাহিয়া বোধ হয় মুচিপাড়ার দিকে যাইতেছে। 

পটলদার সঙ্গে কতকাল দেখা হয় নাই! 

হঠাৎ বীণা নিজের অজ্ঞাতসারে ডাক দিল, ও পটলদা? 

পটল চমকিয়া উঠিয়া চারিদিকে কেমন করিয়া চাহিতেছে দেখিয়া বীণার হাসি পাইল। 

—এই যে, ও পটলদা! 

পটল বিস্মিত ও আনন্দিত মুখে কাছে আসিল। 

—তুমি? কোথায় যাচ্ছ? 

—যেখানেই যাই, তুমি ভাল আছ? 

—তাতে তোমার কি? আমি মরে গেলেই বা তোমার কি? 

—বাজে বোকো না পটলদা। ওসব কথা বলতে নেই। 

—কতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হল! 

বীণা চুপ করিয়া রহিল। 

—আমার কথা একটুও ভাবতে বীণা, সত্যি বল! 

—বলে লাভ কি পটলদা? যা হবার হয়েগিয়েছে। 

—আমিও তো সেইজন্যে আর যাই না। তোমার নামে কেউ কিছু বললে আমার ভাল লাগে না। তাই ভেবে দেখলাম, দেখা না করাই ভাল, কিন্তু তা বলে ভেবো না যে তোমায় ভুলেগিয়েছি। 

বীণা কোনো কথা বলিল না। 

পটল বলিল, আচ্ছা বীণা, তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও—আমবাগানের মধ্যে কথা কইতেদেখলে কে কি ভাববে যে আমাদের গাঁয়ের লোক—এসো তুমি— 

—তুমি আজকাল সেই কোথায় চাকরি করতে সেখানে করো না? –সে চাকরি গিয়েছে। এখন বসে আছি। 

—কতদিন চাকরি নেই? 

—প্রায় তিন মাস। সংসারে বড় টানাটানি চলেছে—তাই যাচ্ছি মুচিপাড়ায় রঘু মুচির কাছে কিছু খাজনা পাব—গিয়ে বলি, খাজনা না দিস তো দুখানা গুড়ই দে। 

—আচ্ছা, এসো পটলদা। 

বীণা বাড়ি ফিরিয়া সারাদিন কেমন অন্যমনস্ক রহিল। পটলদার চাকুরি গিয়াছে। তাহার সংসারেবড় কষ্ট। ইচ্ছা হয়—কিন্তু সে ইচ্ছায় কি কাজ হইবে? ইচ্ছা থাকিলেও বীণার এক পয়সাদিয়াও সাহায্য করিবার সামর্থ্য নাই। 

তাহাকে কি পটলদা কিছু দিয়াছিল? 

প্রথমে বীণা লইতে রাজী হয় নাই। বিধবা মানুষে সাবান কি করিবে? একশিশি গন্ধ তেলশেষ পর্যন্ত লইয়াছিল, লুকাইয়া লুকাইয়া নারিকেল তৈলের সঙ্গে মিশাইয়া একশিশি গন্ধতেল দুই তিন মাস চালাইয়াছিল। 

এক-আধটা সহানুভূতির কথা বলা উচিত ছিল। ভুল হইয়া গিয়াছে, অত তাড়াতাড়িআমবাগানের মধ্যে কি সব কথা মনে আসে? পটলদার সংসারটি নিতান্ত ছোট নয়, বেচারিচালাইতেছে কি করিয়া? আহা! 

সন্ধ্যাবেলার দিকে মনোরমা নদীর ঘাট হইতে আসিল। ছেলেমেয়ে খাইখাই করিয়াজ্বালাতন করিতেছে, মনোরমা বলিল, ঠাকুরঝি, ওদের জন্যে একখোলা চাল ভেজে দাও না? ভাত হতে এখন অনেক দেরি। খাক ততক্ষণ গুড় দিয়ে। মরছে খিদে খিদে করে। 

বীণা বলিল, কোন্ চাল ভাজব বউদি? সেদিনকের সেই মোটা নাগরা আছে, দিব্যিফোটে—তাই ভাজি, হ্যাঁ? বীণার মা বলিলেন, আগে সন্ধেটা দেখা না তোরা, অন্ধকার তো হয়ে গেল মা—আরকখন— মনোরমা ভিজা কাপড় ছাড়িয়া ফর্সা কাপড় পরিয়া উঠানের তুলসীতলায় প্রদীপ দিতেগিয়া হঠাৎ চিৎকার করিয়া উঠিল, ও ঠাকুরঝি, আমায় কিসে কামড়াল, শীগির এসো— 

বীণা রান্নাঘর হইতে ছুটিয়া গেল, কি হল বউদি? 

সে রোয়াক হইতে উঠানে পা দিবার পূর্বেই মনোরমা আবার চিৎকার করিয়া উঠিল, সাপ! সাপ! অজগর গোখরো—গোলার পিঁড়ির মধ্যে, ও মা, ও ঠাকুরঝি — 

বীণা ততক্ষণ ছুটিয়া মনোরমার কাছে গিয়া পৌঁছিয়াছে, কিন্তু সে কিছু দেখিতে পাইলনা। মনোরমা উঠানে বসিয়া পড়িয়াছে, তাহার হাতের সন্ধ্যাপ্রদীপ ছিটকাইয়া উঠানে পড়িয়াতেল সলিতা ছড়াইয়া পড়িয়াছে। 

মনোরমা বলিল, আমার গা ঝিম্‌ঝিম্ করছে ঠাকুরঝি—আমায় ধরো 

বীণার মা বলিলেন, শীগির কেষ্ট ঠাকুরপোকে ডাক, জীবনের মাকে ডাক, ওমা, আমারকি হল গো, যা যা শীগির যা, হে ঠাকুর হে হরি, রক্ষে করো বাবা- 

বীণা বলিল, চেঁচিও না মা, আমি ডেকে আনছি, এখানে তার আগে দুটো বাঁধন দিই, গামছাখানা দাও— 

মিনিট পনেরোর মধ্যে গাঁয়ে রাষ্ট্র হইয়া গেল বিপিনের বউকে সাপে কামড়াইয়াছে এবংসঙ্গে সঙ্গে এপাড়া ওপাড়ার লোক ভাঙিয়া পড়িল বিপিনদের উঠানে। ভীম জেলে ভাল ওঝা, সে আসিয়া গাঁটুলি করিল, মন্ত্র পড়িল, ঝাড়ফুঁক চালাইল, মনোরমা অসাড় হইয়া পড়িয়া আছে, তাহার মাথায় ঘড়া করিয়া জল ঢালা হইয়াছে, তাহার মাথার দীর্ঘ কেশরাশি জলে কাদায়লুটাইতেছে, সেদিকে তখন কাহারও লক্ষ্য করিবার অবকাশ ছিল না। রোগিণীর অবস্থা লইয়াসকলে ব্যস্ত। 

কৃষ্ণলাল মুখুজ্জে বলিলেন, সতীশ ডাক্তারের কাছে কে গেল? ও হরিপদ, তুমি একবারসাইকেলখানা নিয়ে ছোট! 

পটলও আসিয়াছিল, সে ভাল সাইকেল চড়িতে জানে, বলিল, আমি যাচ্ছি কাকা। হরিপদভাই, তোমার সাইকেলখানা— 

বীণা দেখা গেল খুব শক্ত মেয়ে। সে অমন বিপদে হাত-পা হারায় নাই, ছুটাছুটি করিয়া কখনও জল, কখনও নুন, কখনও দড়ি আনিতেছে, সম্প্রতি বউদিদির মাথাটা উঠানেলুটাইতেছে দেখিয়া সে মাথা কোলে লইয়া শিয়রের কাছে আসিয়া বসিল। 

বিপিন দুপুরের পূর্বেই সোনাতনপুর হইতে রওনা হইয়া হাঁটিয়া আসিতেছিল, বেলা ছোট, আমতলীর বাঁওড়ের কাছে আসিতেই অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল। 

বিড়ি নাই পকেটে, ফুরাইয়া গিয়াছে, পথের পাশেই শরৎ ঘোষের মুদির দোকান। এখনও প্রায় আধক্রোশ পথ বাকি তাহাদের গ্রামে পৌঁছিতে, বিড়ি কিনিতে সে দোকানে ঢুকিল। শরৎবলিল, দাদাঠাকুর এলেন নাকি আজ? তামাক ইচ্ছে করুন—বসুন, বসুন। 

—না আর তামাক খাব না, সন্ধে হয়ে গিয়েছে, এক পয়সার বিড়ি দাও আমায়।

—তা দিচ্ছি, দাদাঠাকুর বসুন না। তামাকটা খেয়ে যান, এতটা হেঁটে এলেন। বিপিন তামাক খাইতে খাইতে বলিল, আখের গুড়ে এবার কেমন হল শরৎ? 

—কিচ্ছু না, কিছু না দাদাঠাকুর। পুঁজিপাটা সব খেয়ে গেল—স’ ন’ আনা মণ কিনলামবেচলাম সাড়ে সাত, আট। সেদিন আর নেই দাদাঠাকুর, ডাহা লোকসান। তবে কি করি, লেখাপড়া তো শিখিনি আপনাদের মতো, খাই কি করে বলুন? 

—আইনদ্দি চাচার খবর জানো? ভাল আছে? 

—বেশ আছে, পরশু বেলতলার মাঠে বিচুলি তুলতে গিয়ে দেখি বুড়ো দিব্যি খুঁটিরমতো বসে ধানের শাল পাহারা দিচ্ছে। 

—আচ্ছা, আসি শরৎ। 

—দাঁড়ান দাদাঠাকুর, পাকাটির মশাল আমার করাই আছে, একটা জ্বেলে নিয়ে যান—ওরে, নিয়ে আয় তত গোলার তলা থেকে একটা মশাল! ক’দিন থাকবেন বাড়ি? 

—থাকব আর কই? তিন চার দিনের বেশিরুগীপত্তর ফেলে— 

সদর রাস্তা দিয়া গেলে খুব ঘুর হয় বলিয়া সে গ্রামে ঢুকিয়াই নদীর ধারের রাস্তাটা ধরিল।এ দিকটা জনহীন, শুধু বৈঁচিবন, নিবিড় বাঁশবন ও আমবাগান। সন্ধ্যার পর বাঘের ভয়ে এপথে বড় কেহ একটা হাঁটে না, যদিও বাঘ নাই, কিংবা কালেভদ্রে এক-আধটা কেঁদো বাঘবাহির হইবার জনশ্রুতি শোনা যায় মাত্র। সুতরাং বিপিনের সহিত কাহারও দেখা হইল না। 

বাড়ির কাছাকাছি তাহাদের নিজেদের জমির সীমানায় ঘাটের পথের চালতা গাছটার তলায় যখন সে পৌঁছিয়াছে, তখন একটা গোলমাল ও কান্নার রব তাহার কানে গেল। কোনদিক হইতে শব্দটা আসিতেছে ভাল ঠাহর করিতে পারিল না। একটু আশ্চর্য হইয়া চারিদিকে চাহিয়াশুনিল। 

এ কি! তাহাদেরই বাড়ির দিক হইতে শব্দটা আসিতেছে না? তাহার বুকের ভিতরটা এক মুহূর্তে যেন ভয়ে অসাড় হইয়া গেল। কি হইয়াছে তাহাদের বাড়িতে? না—তাহাদের বাড়ি নয়, এ যেন কেষ্ট কাকাদের কিংবা পরাণ নাপিতের বাড়ির দিক হইতে—তাই হইবে, তাহাদের বাড়ি নয়। পরক্ষণেই সে দ্রুতপদে দুরুদুরু বক্ষে বাড়ির দিকে প্রায় ছুটিতে ছুটিতে চলিল। 

আর কিছু দূর গিয়া বিপিনের আর কোনো সন্দেহ রহিল না। এ কান্নার রব যে তাহারমায়ের গলার! পাগলের মতো ছুটিতে ছুটিতে সে বাড়ির পিছনের পথে আসিতেই তাহাদেরউঠানে ভিড় দেখিতে পাইল। তাহাকেও দুই-চারজন দেখিয়াছিল, তাহারা ছুটিয়া আসিল তাহার দিকে। সর্বাগ্রে ছুটিয়া আসিলেন কৃষ্ণলালমুখুজ্জে 

—এসো এসো বিপিন, বড় বিপদ–এসো— 

বিপিনের গলা দিয়া যেন কথা বাহির হইতেছে না, ভয়ে ও বিস্ময়ে সে কেমন হইয়াগিয়াছে। বলিল, কি–কি কেষ্ট কাকা, ব্যাপার কি? 

ভিড়ের ভিতর হইতে বীণা কাঁদিয়া উঠিল, ও দাদা, শীগির এসো, বউদিদি যে আমাদের ছেড়ে চলে গেল গো! 

মনোরমা! মনোরমার কি হইয়াছে? বিপিন ভিড় ঠেলিয়া অগ্রসর হইবার চেষ্টা না করিয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া ইহার উহার মুখের দিকে চাহিতে লাগিল। দুই-তিনজন হাত ধরিয়া তাহাকেলইয়া গেল। 

কে একজন বলিয়া উঠিল, আহা, সতীলক্ষ্মী বউ বটে, স্বামীও একেবারে ঠিক সময়ে এসে হাজির—এদেরই বলে সতীলক্ষ্মী। 

বিপিন গিয়া দেখিল উঠানে তুলসীতলার কাছেই মনোরমা মাটিতে শুইয়া। মাথার চুল মাটিতে লুটাইতেছে। সারাদেহ অসাড়, নিস্পন্দ। 

বিপিন আর যেন দাঁড়াইতে পারিল না। বলিল, কি হয়েছে কেষ্টকাকা? 

—সাপে কামড়েছিল। যাচ্ছিলেন বউমা পিদিম দিতে নাকি তুলসীতলায় — 

চার-পাঁচজন লোক একসঙ্গে ঘটনাটা বলিতে গিয়া পরস্পরকে বাধা দিতে লাগিল। বিপিনের মা তাহাকে দেখিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। বীণা কাঁদিতে লাগিল। 

বিপিন নাড়ী দেখিয়া বলিল, নাড়ী নেই বটে—কিন্তু কেষ্ট কাকা, এ মরেনি এখনও বীণা, শীগির জল গরম করে নিয়ে আয়—সতীশ ডাক্তারের কাছে একজন যা তো কেউ— 

বলিতে বলিতে সতীশ ডাক্তারকে লইয়া পটল আসিয়া উপস্থিত হইল। 

সতীশ ডাক্তার ও বিপিন দুইজনে কিছুক্ষণ দেখিল। বিপিন বলিল, আশা আছে বলে মনে হচ্ছে না কি? ইথার ইন ক্লোরোফর্ম দিয়ে দেখা যাক নাড়ী আসে কিনা—এ রকম রোগী আমিএকটা দেখেছিলাম, অবিকল এই লক্ষণ—এ মরেনি এখনও। 

—ইথার ইন ক্লোরোফর্ম দিয়ে কি হবে? দ্যাখো দিয়ে— 

—এ মরেনি সতীশবাবু। কতকটা ভয়ে, কতকটা বিষের ক্রিয়ায় এমন হয়েছে—আমারমনে হয় গোখরো সাপ নয়—এ ঠিক শেকড়চাঁদা সাপ—এই রকম লক্ষণ সব প্রকাশ পায়। কেউদেখেছিল সাপটা? 

বীণা বলিল, বউদিদি বলেছিল অজগর গোখরো সাপ–গোলার পিঁড়িতে ছিল— আমিকিছু দেখিনি অন্ধকারে— 

সতীশ ডাক্তার বলিলেন, ও কিছু না, ভয়ে অনেক সময় এ রকম হয়। উনি ভয়ে তখনচারিদিকে গোখরো সাপ তো দেখবেনই। অন্ধকারে কি দেখতে কি দেখেছেন- 

মনোরমাকে ধরাধরি করিয়া রোয়াকে লইয়া যাওয়া হইল। 

অনেক রাত পর্যন্ত সতীশ ডাক্তার রহিল। পটল যথেষ্ট উপকার করিল, ছোটাছুটি করা, ইহাকে উহাকে ডাকাডাকি করা। রাত দুপুর পর্যন্ত সে বিপিনদের বাড়িতেই রহিল। বিপদের সময় অন্য কথা মনে থাকে না— গরম জল আনিতে পটল কতবার রান্নাঘরে গেল—বীণাসেখানে একাই ছিল, ছেলেমেয়েদের ও দাদার জন্য রান্না না করিলে তাহারা খাইবে কি? বীণারমা বউয়ের শিয়রে সন্ধ্যা হইতে বসিয়া আছেন আর হাপুস নয়নে কাঁদিতেছেন। 

 

চারদিন পরে বিপিন মনোরমাকে বলিল—কাল যাব গো, এসেছিলাম দুটো দিন থাকববলে—তুমি যে ভয় দেখিয়ে দিলে, তাতে দেরি হয়েই গেল এমনি— 

মনোরমা হাসিয়া বলিল, ম’লেই বেশ হোত, না? 

—না, না, ওসব কথা বলতে নেই। ঘরের লক্ষ্মী মরতে যাবে কেন? ছিঃ! 

মনোরমা একটু অবাক হইয়া স্বামীর দিকে চাহিল। এত আদরের কথা সে স্বামীর মুখেকতকাল শোনে নাই! ভাগ্যিস সাপে কামড়াইয়াছিল! উঃ— 

মুখে বলিল, ছেলেমেয়ে দুটো ছোট ছোট—নয়তো আর কি! তোমায় রেখে যেতে পারাতো ভাগ্যির কথা গো!

বিপিন বলিল, আর আমার জন্যে বুঝি কিছু না? 

মনোরমা হাসিল। সে গুছাইয়া কথা বলিতে পারে না কোনো কালেই, মনের মধ্যে কি আছে বুঝাইতে পারে না। সে বোঝে কাজকর্ম, খাওয়ানো মাখানো, নিখুঁতভাবে সংসারচালানো। স্বামীকে সে ভালবাসে কি না বাসে, তা কি মুখে বলা যায়? ছেলেমেয়ের মা, এখনসে গিন্নিবান্নি মানুষ, অমন ইনাইয়া বিনাইয়া কথা বলা তাহার আসে না। 

বলিল, না গো তা নয়। আমি মরে গেলে তুমি আর একটা বিয়ে করে সুখী হতেপারো—কিন্তু ওরা আর মা পাবে না। 

বিপিন দুঃখিত হইল। সত্যই আজ যদি মনোরমা মারা যাইত! কখনও সে মনোরমাকে একটা মিষ্টি কথা কি ভালবাসার কথা বলিয়াছে? না পাইয়া না পাইয়া মনোরমার সহিয়াগিয়াছে। ওসব আর সে প্রত্যাশা করে না, পাইলে অবাক হইয়া যায়। মনে ভাবিল—আমারহাতে পড়ে ওর দুর্দশার একশেষ হয়েছে। ভাল খাওয়া কি ভাল কাপড় একখানা কোনোদিন–বা কখনও কিছু দেখলেও না। সংসারের হাঁড়ি ঠেলে আর বাসন মেজে জীবনটাকাটল ওর। 

সে বলিল, হ্যাঁ ভাল কথা, কাল দুটো ভাত সকালে সকালে যেন হয়। পিপলিপাড়া যাবকাল। 

মনোরমা বলিল, তা কেন? কাল যেও না। বিদেশে থাকো, একদিন একটু পিঠে-নাটা করি, সেখানে কে করে দিচ্ছে, খেয়ে যেও। 

বিপিন জানে মনোরমা মিষ্টি কথা কহিতে জানে না বটে, কিন্তু এ সব দিকে তাহার খুবলক্ষ্য। কিন্তু তাহার থাকিবার উপায় নাই। মনোরমাকে বুঝাইয়া বলিল, হাতে রোগী আছে, পিঠে খাইবার জন্য বসিয়া থাকিলে চলিবে না। 

হাসিয়া বলিল, যাবে আমার সঙ্গে সেখানে? চলো পিঠে খাওয়ানোর লোক নিয়ে যাই— 

মনোরমা বলিল, ওমা, আমি আবার বুড়োমাগী সংসার ফেলে, গরুবাছুর ফেলে, মা বীণাএদের রেখে তোমার সঙ্গে বাসায় যাব কি করে? 

যেন এ প্রস্তাবটা নিতান্তই আজগুবি। 

মনোরমা বলিতে পারিত, চলো তোমার সঙ্গেই যাই, তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেইযাব। তোমার কাছে আমার কেউ নয়! 

বিপিনের খুব ভাল লাগিত তাহা হইলে। 

বিপিন ভাবিল—মনোরমার শুধু সংসার আর সংসার! ওই এক ধরনের মেয়েমানুষ— 

৫ 

পিপলিপাড়ায় পৌঁছিল প্রায় সন্ধ্যাবেলা। দত্ত মশায় বাড়ি নাই, আজ দিন দুই হইল বড় ছেলের শ্বশুরবাড়ি কুমারপুরে গিয়াছেন কি কাজে। দত্ত মহাশয়ের ছেলে অবনী তাহাকে দেখিয়া বলিল, এই যে ডাক্তারবাবু! দুটো রুগী এসে ফিরে গিয়েছে কাল। এত দেরি হল যে? হাত-পা ধুয়েবিশ্রাম করুন। 

অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ পরে শান্তি এক হাতে একটি হ্যারিকেন লণ্ঠন ও অন্য হাতে একটা বাটিতে মুড়ি ও নারিকেলকোরা লইয়া আসিল। বাটিটা বিপিনের হাতে দিয়া হাসিমুখে বলিল, এত দেরি করলেন যে? 

—উঃ, সে আর বোলো না শান্তি! কি বিপদেই পড়ে গিয়েছিলাম। 

শান্তি উদ্বিগ্ন মুখে বলিল, কি? কি? 

—আমার স্ত্রীকে সাপে কামড়েছিল। 

—সাপে! কি সাপ? 

—রক্ষে যে জাতসাপ নয়, শেকড়চাঁদা বলেই আমার ধারণা। সে কি ঘটনা হলশোনো—সেদিন তো এখান থেকে গেলাম সেই— 

বলিয়া বিপিন সেদিনকার তাহার বাড়ি যাওয়ার পথে কান্নাকাটির রব শোনা হইতে আরম্ভকরিয়া সমস্ত ব্যাপারটা আনুপূর্বিক বলিয়া গেল, শান্তি অবাক হইয়া বসিয়া শুনিতে লাগিল। 

বর্ণনা শেষ হইয়া গেলে শান্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, উঃ, ভগবান রক্ষে করেছেন।নইলে কি হোত আজ বলুন দিকি? মুড়ি খান, আমি চা নিয়ে আসি—কি বিপদেই পড়েগিয়েছিলেন! 

শান্তি চা আনিয়া দিল। বলিল, আজ আর রাঁধতে হবে না আপনাকে—আমাদের তোরান্না হবেই—ওই সঙ্গে আপনাকে দু’খানা পরোটা ভেজে দিতে এমন কিছু ঝঞ্ঝাট হবে না। 

—রোজ রোজ তোমাদের ওপর— 

—ওসব কথা বলবেন না ডাক্তারবাবু। আপনি পর ভাবেন, কিন্তু আমি— 

—না না, সে কথা না—পর ভাবব কেন শান্তি? তা হবে এখন—দিয়ো এখন— 

শান্তি খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গল্প করিল। কথা বলিয়া আনন্দ পাওয়া যায় ইহার সঙ্গে। বেশির ভাগ কথা মনোরমাকে লইয়াই। মনোরমার কথা আজ আসিবার সময় বিপিন সারাপথ ভাবিয়াছে। তাহার আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাবনাটা যতই মনে হইতেছে, বিপিনের মনততই মনোরমার প্রতি স্নেহে ও সহানুভূতিতে ভরিয়া উঠিতেছে। 

শান্তি বলিল, দেখাবেন একদিন বউদিদিকে? 

—কি করে দেখাব শান্তি! সে তো এখানে আসছে না! 

—আমায় একদিন নিয়ে চলুন সেখানে। 

—তুমি যাবে কি করে? 

—আপনার সঙ্গে যাব। গরুরগাড়ি একখানা না হয় দু’টাকা ভাড়া নেবে। 

—আমার সঙ্গে একা যাবে? 

—কেন যাব না? 

বিপিন আশ্চর্য হইল শান্তির নিঃসঙ্কোচ ভাব দেখিয়া। মেয়েটি শুধু সরলা নয়, ইহার মনেসাহস আছে। অবশ্য সে শান্তিকে সত্যই লইয়া যাইতেছে না, বহু বাধা তাহাতে, সে জানে।তবুও শান্তি যে নিঃসঙ্কোচে তাহার সহিত যাইতে চাহিল—ইহাতেই উহার মনের পরিচয়পাওয়া যায়। 

হঠাৎ শান্তি একটি ভারি ছেলেমানুষি প্রশ্ন করিল। 

—আচ্ছা, পটলের ক্ষেতে মেয়েমানুষ যাওয়া বারণ কেন জানেন? 

—তা তো জানি না শান্তি। তবে শুনেছি বটে— 

বিপিন কারণটা খুব ভাল রকমই জানে সে পাড়াগাঁয়েরই ছেলে। কিন্তু শান্তির সামনে সেকথা বলিতে তাহার বাধিল। 

শান্তি দুষ্টুমির হাসি হাসিয়া বলিল, আমি জানি। বলব? মেয়েমানুষ অযাত্রা, পটলেরক্ষেতে ঢুকলে পটল ফলবে না—তাই নয়? আচ্ছা, মেয়েমানুষ কি সত্যিই অযাত্রা? 

বিপিন সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। বলিল, কে বলেছে ওসব কথা? এ কথা তোমার মাথায় উঠল কেন হঠাৎ?

-–না, কিছু না, এমনি মনে পড়ে গেল। আপনাদের গাঁয়ের দিকে এ নিয়ম আছে, না? 

—শুনেছি বটে, বললাম তো। বলে বটে, তবে মেয়েরা অযাত্রা এ কথা যে কেউ বলুক, আমি বিশ্বাস করি না। মেয়েরা অনেক উপকার করেছে আমার জীবনে। এই ধরো, আমিতোমায় দিয়েই বলি—কেমন চিঁড়ের ফলার খাওয়ালে সেদিন—খেয়েদেয়ে নিন্দে করব এমনমহাপাতকী আমি নই। 

বলিয়া বিপিন হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। 

শান্তি সলজ্জ হাসিমুখে বলিল, আপনার ওই এক কথা! যান! 

—না, যাব কেন, আমি অনেয্য কথা কি বলেছি বলো। তোমার যত্নের কথা যখন ভাবিশান্তি, তখন—সত্যিই বলচি—অমন খাওয়ানো অন্ততঃ— 

—আচ্ছা, আচ্ছা, থাক। আর আপনার ব্যাখ্যা করতে হবে না। আমি যাই, বউদিদি একারান্নাঘরে—গিয়ে ময়দা মাখব— 

—একটা পান পাঠিয়ে দিয়ো গিয়ে। পেয়ালাটা নিয়ে যাও। 

—না থাকুক। আপনার পান নিয়ে আসি, পেয়ালা নিয়ে যাব। বিপিনের মনে একটি অদ্ভুত তৃপ্তি। এ ধরনের সেবা সে চায়—মানীই কেবল সে যামিটাইয়াছিল কিছু দিন—আবার এই শান্তি কোথা হইতে আসিয়া জুটিয়াছে! 

বেচারি মনোরমা এ ধরনটা জানে না। সেও সেবা করে, কিন্তু সে অন্যরকমের। তাহাপাইয়া এমন আনন্দ হয় না কেন? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *