বিপিনের সংসার – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ 

বিপিন সকালে উঠিয়া কলাই-চটা পেয়ালাটায় সবে এক পেয়ালা চা লইয়া বসিয়াছে, এমনসময়ে দেখা গেল তেঁতুলতলার পথে লাঠি হাতে লম্বা চেহারার কে যেন হনহন করিয়াউহাদের বাড়ির দিকেই চলিয়া আসিতেছে। 

বিপিনের স্ত্রী মনোরমা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বলিল, দেখ তো কে একটা মিনসে এদিকে আসছে! 

বিপিন বলিল, জমিদারবাড়ির দরওয়ান গো—আমি বুঝতে পেরেছি—ডাকের ওপরডাক, চিঠি দিয়ে ডাক, আবার লোক পাঠিয়ে ডাক! 

মনোরমা বলিল, তা এসেছ তো ধরো আজ দিন কুড়ি। ডাক দেওয়ার আর দোষ কি? বিপিনের বড় ভ্রাতৃবধূ এই সময় ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, পলাশপুর থেকে বোধ হয় লোক আসছে—এগিয়ে যাও তো ঠাকুরপো। 

বিপিন বিরক্তমুখে চায়ের পেয়ালাটায় চুমুক দিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া উঠানে গিয়াদাঁড়াইল এবং আগন্তুক লোকটির সঙ্গে দুই একটি কথা বলিয়া তাহাকে বিদায় দিয়া একখানি চিঠি-হাতে সোজা রান্নাঘরে গিয়া মাকে বলিল, এই দেখ মা, ওরা আবার চিঠি লিখেছে—দু’দিনযে জিরোব তার উপায় নেই। 

বিপিনের মা বলিলেন, তা তো এয়েছ বাপু, কুড়ি-বাইশ দিন কি তার বেশি! তাদের কাজের সুবিধের জন্যেই তো তোমায় রেখেছে? এখানে তুমিব’সে থাকলে তাদের চলে? 

সকলের মুখেই ওই এক কথা। যেমনই মা, তেমনই স্ত্রী। কাহারও নিকটে একটু সহানুভূতি পাইবার উপায় নাই। কেবল ‘যাও–যাও’ শব্দ, টাকা রোজগার করিতে পারো—সবাই খুশি। তোমার সুখ-দুঃখ কেহই দেখিবে না। 

বিরক্তির মাথায় বিপিন স্ত্রীকে বলিল, আর একটু চা দাও দিকি! 

মনোরমা বলিল, চা আর হবে কি দিয়ে? দুধ যা ছিল সবটুকুদিয়ে দিলাম।বিপিন বলিল, র চা খাব। তাই করে দাও। 

—চিনিও তো নেই, র চা-ই বা কেমন করে খাবে? –মাকে বল, ওঁর গুড়ের নাগরি থেকে একটু গুড় বের করে দিতে—তাই দিয়ে করো। 

মনোরমা ঝাঁঝের সঙ্গে বলিল, মাকে তুমি বলো গিয়ে। বুড়ো মানুষ; দশমী আছে, দোয়াদশী আছে—ওই তো একখানা গুড়ের নাগরি, তাও চা খেয়ে খেয়ে আদ্ধেক খালি হয়েগিয়েছে। এখনও তিন মাস চললে তবে নতুন গুড় উঠবে—ওঁর চলবে কিসে? এদিকে তো নতুন এক নাগরি আখের গুড় কিনে দেবার কড়ি জুটবে না সংসারে। মায়ের কাছ থেকে রোজরোজ গুড় চাইতে লজ্জা করে না? 

বিপিন আর কোনো কথা না বলিয়া চুপ করিয়া গেল। তাহার মনটা আজ কয়দিন হইতেইভাল নয়। প্রথম তো সংসারে দারুণ অনটন, তার উপর স্ত্রীর যা মিষ্টি বুলি! বেশ, সেপলাশপুরই যাইবে। আজই যাইবে। আর বাড়ি থাকিয়া লাভ কি? বাড়ির কেহই তেমন পছন্দকরে না যে সে বাড়ি থাকে। 

এমন সময় বাহির হইতে গ্রামের কৃষ্ণলাল চক্রবর্তী ডাকিয়া বলিলেন, বিপিন, বাড়ি আছহে? 

বিপিন পাশের ঘরের উদ্দেশে বলিল, কেষ্টকাকা আসছেন, স’রে যাও। পরে অপেক্ষাকৃতসুর চড়াইয়া বলিল, ‘আসুন কাকা আসুন, এই ঘরেই আসুন।’ 

কৃষ্ণলালের বয়স চুয়াল্লিশ বছর, কিন্তু চুল বেশি পাকিয়া যাওয়ায় ও অর্ধেক দাঁত পড়িয়াযাওয়ার দরুন দেখায় যেন ষাট বছরের বৃদ্ধ। তিনি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বলিলেন, ও কেএসেছিল হে, তোমার বাড়ি একজন খোট্টা-মতো? 

—ও পলাশপুর থেকে এসেছিল। আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে। 

—বেশ তো, যাও না। এখানে বসে মিছে কষ্ট পাওয়া— 

—আহা, সেজন্যে না কেষ্টকাকা। পলাশপুরে বাবা যখন চাকরি করতেন, সে একদিন গিয়েছে। এখন প্ৰজা ঠেঙিয়ে খাজনা আদায় করার দিন নেই। অথচ টাকা না আদায় করতে পারলে জমিদারের মুখ ভার। আমি ধোপাখালির কাছারিতে থাকি; আর পলাশপুর থেকে ক্লাগুলোক আসছে; ক্লাপ্ত লোক আসছে,ক্লাপ্ত টাকা পাঠাও, টাকা পাঠাও—এই বুলি। বলুন দিকি, আদায় না হলে আমি বাপের বিষয় বন্ধক দিয়ে এনে তোমাদের টাকা যোগাব মশায়? 

কৃষ্ণ চক্রবর্তী বলিলেন, তোমার বাবার আমলের সেই পুরোনো মনিবই আছে তো? তারা তো জানে, তুমি বিনোদ চাটুজ্জের ছেলে–তোমার বাপের দাপটে— 

—জানে বলেই তো আরও মুশকিল। বাবা যে ভাবে খাজনা আদায় করতেন, এখনকারআমলে তা চলে না কাকা,—অসম্ভব। দিনের হাওয়া বদলেছে, এখন চোখ কান ফুটেছেসবারই। সত্যি কথা বলছি, আমার ও কাজ ভাল লাগে না। প্রজা ঠেঙাবারজন্যেও না—তাতে আমার তত ইয়ে হয় না, কিন্তু জমিদার আর জমিদারগিন্নি ঘূণ একেবারে। কেবল ‘দাও দাও’ বুলি। না দিলেই মুখ ভার। 

—তা আর কি করবে বলো! পরের চাকরি করার তো কোনো দরকার ছিল না তোমার, বিনোদদাদা যা করে রেখে গিয়েছিলেন—পায়ের ওপরে পা দিয়ে বসে খেতে পারতে—সবই যে উড়িয়ে দিলে! বিনোদদাদাও চোখ বুজলেন, তোমরাও ওড়াতে শুরু করলে! এখন আর হা-হুতাশ করলে কি হবে, বলো? 

এ সব কথা বিপিনের তেমন ভাল লাগিতেছিল না। স্পষ্ট কথা কাহারও ভাল লাগে না।সে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, সে যাক কাকা, আমায় একটা শশার চারা দিতে পারেন? আছে বাড়িতে? 

 এই সময় বিপিনের বিধবা বোন বীণা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, দাদা, ডাকছে, একবাররান্নাঘরের দিকে শুনে যাও।

ইহার অর্থ সে বোঝে। সংসারে হেন নাই, তেন নাই—লম্বা ফর্দ শুনিতে হইবে–মানয়, স্ত্রীর নিকট হইতে। কৃষ্ণলাল বসিয়া থাকার দরুন মায়ের নাম দিয়া ডাক আসিতেছে। 

বিপিন বলিল, বসুন কাকা, আসছি। 

কৃষ্ণলাল উঠিয়া পড়িলেন, সকালবেলা বসিয়া থাকিলে তার চলিবে না, অনেক কাজ তার। 

মনোরমা দালানের দোরে আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। বলিল, কেষ্টকাকার সঙ্গে বসে গল্প করলে চলবে তোমার? 

—ঘুরিয়ে না ব’লে সোজা ভাবেই কথাটা বলো না কেন? কি নেই? 

—কিছু নেই। এক দানা চাল নেই, তেল নেই, ডাল নেই, একটি আলু নেই। হাঁড়ি চড়বে না এ বেলা। 

বিপিন ঝাঁঝের সঙ্গে বলিল, না চড়ে না চড়ুক, রোজ রোজ পারিনে। এক বেলা উপোস করে সব পড়ে থাক। 

মনোরমা কড়াসুরে জবাব দিল, লজ্জা করে না এ কথা বলতে? আমি আমার নিজেরজন্যে বলিনি। মা কাল একাদশীর উপোস করে রয়েছেন, উনিও কি আজও উপোস করে পড়ে থাকবেন? সব কি আমার জন্যে সংসারে আসে? ওই বীণারও গিয়েছে কালএকাদশী—ও ছেলেমানুষ, কপালই না হয় পুড়েছে, খিদেতেষ্টা তো পালায়নি তা বলে? 

মনোরমার যুক্তি নিষ্ঠুর… অকাট্য। 

বিপিন বাড়ি হইতে বাহির হইয়া তেমাথার মোড়ের বড় তেঁতুলতলার ছায়ায় একখানাযে কাঠের গুঁড়ি পড়িয়া আছে, তাহারই উপর আসিয়া বসিল 

চাল নাই, ডাল নাই, এ নাই, ও নাই—সে তো চুরি করিতে পারে না! একটি পয়সা নাইহাতে, বাজারের কোনো দোকানে ধার দিবে না, বহু জায়গায় দেনা—উপায় কি এখন? 

না, পলাশপুরেই যাওয়া স্থির। বাড়ির এ নরকযন্ত্রণার চেয়ে সে ভাল, দিনরাত মনোরমারমধুর বাক্যি আর কেবল ‘নাই নাই’ বুলি তো শুনিতে হইবে না। প্রজা ঠেঙানোর অনিচ্ছা ইত্যাদি বাজে ওজর, ও কিছু না, সে বিনোদ চাটুজ্জের ছেলে, প্রজা ঠেঙাইতে পিছপাও না; কিন্তু আর একটা কথাও আছে তাহার সেখানে যাইবার অনিচ্ছার মূলে। 

ধোপাখালি কাছারির তহবিল হইতে সে জমিদারদের না জানাইয়া চল্লিশটি টাকা ধার করিয়াছিল, তাহা আর শোধ দেওয়া হয় নাই। বিপিনের ভয় আছে, হয়তো এই ব্যাপারটা ধরাপড়িয়া গিয়াছে, সেই জন্যই জমিদারের এত ঘন ঘন তাগাদা তাহাকে লইয়া যাইবার জন্য! 

বিপিনের ছোট ভাই বলাই আজ চার-পাঁচ মাস অসুস্থ। তাহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্যই টাকা কয়টির নিতান্ত দরকার ছিল। বলাইকে রাণাঘাটে লইয়া গিয়া বড় ডাক্তারকেদেখানো হইয়াছে এবং এখন আগের চেয়ে সে অনেকটা সারিয়া উঠিয়াছে বলিয়া ডাক্তারআশ্বাস দিয়াছেন। বলাই বর্তমানে রাণাঘাটেই মিশনারি হাসপাতালে আছে। 

পরদিন পলাশপুরে যাওয়ার পথে বিপিন রাণাঘাট হাসপাতালে গেল। স্টেশন থেকে হাসপাতাল প্রায় মাইলখানেক দূরে। বেশ ফাঁকা মাঠের মধ্যে। বলাই দাদাকে দেখিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। 

—দাদা, আমায় এখানে এরা না খেতে দিয়ে মেরে ফেললে, আমায় বাড়ি নিয়ে যাবে কবে? আমি তো সেরে গেছি, না খেয়ে মলাম; তোমার পায়ে পড়ি দাদা, বাড়ি কবে নিয়ে যাবে বলো। 

—খেতে দেয় না তোর অসুখ বলেই তো। আচ্ছা আচ্ছা, পলাশপুর থেকে ফিরবারপথে তোকে নিয়ে যাব ঠিক। কি খেতে ইচ্ছে হয়? 

—মাংস খাইনি কতদিন। মাংস খেতে ইচ্ছে হয়—বউদিদির হাতে রান্না মাংস— 

—আচ্ছা হবে হবে। এই মাসেই নিয়ে যাব। 

বিপিন আড়ালে নার্সকে জিজ্ঞাসা করিল, আমার ভাই মাংস খেতে চাইছে—একটু আধটু—নার্স এদেশী খ্রিস্টান, পূর্বে কৈবর্ত্য ছিল, গোলগাল, দোহারা, বেশি বয়েস নয়— ভ্রূকুটি করিয়া বলিল, মাংস খেয়ে মরবে যে! নেফ্রাইটিসের রুগী, অত্যন্ত ধরাকাঠের মধ্যে না রাখলেযা একটু সেরে আসছে, তাও যাবে—মাংস! 

বৈকালের দিকে পাঁচ মাইল পথ হাঁটিয়া বিপিন পলাশপুরে পৌঁছিল। 

বিপিনের বাবা ৺বিনোদ চাটুজ্জে এখানে কাজ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং বিপিনের জমিদারবাড়ির সর্বত্র অবাধ গতি। সে অন্দরে ঢুকিতেই জমিদার-গৃহিণী বলিয়া উঠিলেন, আরেএসো এসো বিপিন, কখন এলে? তারপর, তোমার ভাই এখনও সেই হাসপাতালেই রয়েছে? কেমন আছে আজকাল? 

জমিদার অনাদি চৌধুরী বিপিনের গলার স্বর শুনিয়া দোতলা হইতে ডাক দিয়া বলিলেন, ও কে? বিপিন না? এলে এতদিন পরে? দশ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে করলে দু’মাস! এরকম করে কাজ চলবে? দাঁড়াও, আমি আসছি। 

বিপিন জমিদার-গৃহিণীকে প্রণাম করিল। গৃহিণীর বয়স চল্লিশ ছাড়াইয়াছে, রং ফর্সা, মোটাসোটা চেহারা, পরনে চওড়া লালপাড় শাড়ি, হাতে দুই গাছা সোনার বালা ছাড়া অন্যকোনো গহনা নাই। তিনি বলিলেন, এসো এসো, বেঁচে থাক। তোমাকে ডাকার আরও বিশেষ দরকার, খুকিকে নিয়ে জামাই আসছেন বুধবারে। ঘরে একটা পয়সা নেই। ধোপাখালির কাছারি আজ দু’মাস বন্ধ। তাগাদাপত্র না করলে জামাই এলে একেবারে মুশকিলে পড়ে যেতে হবে।সেইজন্যে কর্তা তোমার ওখানে কাল লোক পাঠিয়েছিলেন তোমায় নিয়ে আসতে। 

অনাদি চৌধুরী ইতিমধ্যে নামিয়া আসিয়াছিলেন। তার বয়স ষাটের উপর, বর্তমান গৃহিণীতার দ্বিতীয় পক্ষ। বাতের রোগী বলিয়া খুব বেশি নড়াচড়া করিতে পারেন না, যদিও শরীরএখনও বেশ বলিষ্ঠ। এক সময়ে দুর্দান্ত জমিদার বলিয়া ইহার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। 

অনাদি চৌধুরী বলিলেন, খুকি আসছে বুধবারে। এদিকে ধোপাখালি কাছারি আজ দু’মাস বন্ধ। একটি পয়সা আদায়-তশিল নেই। তোমার কাণ্ডজ্ঞানটা যে কি, তাও তো বুঝিনে!তোমার বাবার আমলে এই মহল থেকে তিনশো টাকা ফি মাসে আদায় ছিল তার এখন সেই জায়গায় পঞ্চাশ-ষাট টাকা আদায় হয় না! তুমি কাল সকালেই চলে যাও কাছারিতে। মঙ্গলবার রাতের মধ্যে আমার চল্লিশটা টাকা চাইই, নইলে মান যাবে, জামাই আসছে এতকাল পরে, কিমনে করবে, আদর-যত্ন করব কি দিয়ে? 

জমিদার-গৃহিণী বলিলেন, আর আসবার সময় কিছু কুমড়া, বেগুন, থোড় কিংবা মোচা আর ‘যদি পারো ভাল মাছ একটা রঘুদের পুকুর থেকে, আর কিছু শাকসবজি আনবে।ঘানি-ভাঙানো সর্ষে তেল এনো আড়াই সের, আর এক ভাঁড় আখের গুড় যদি পাও— 

বিপিন মনে মনে হাসিল। জমিদার-গৃহিণী যে এই সমস্ত আনিতে বলিতেছেন, সবই বিনামূল্যে প্ৰজা ঠেঙাইয়া! নতুবা পয়সা ফেলিলে জিনিসের অভাব কি, ‘যদি পাও’কথারমানেই হইল ‘যদি বিনামূল্যে পাও’– এমন ছোট নজর, আর এমন কৃপণ স্বভাব! পরের জিনিসএমনই যোগাইতে পারো, খুব খুশি! দায় পড়িয়াছে বিপিনের পরের শাপমন্যি কুড়াইয়া তাঁহাদের জন্যে বেসাতি আনিবার, এমনই তো ছোট ভাইটা হাসপাতালে পড়িয়া শুষিতেছে। এই সবজন্যই এখানকার চাকুরির অন্ন তাহার গলা দিয়া নামে না। 

পলাশপুর হইতে ধোপাখালির কাছারি আট ক্রোশ। নায়েবের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করিবেন।তেমন পাত্র নন অনাদি চৌধুরী—সুতরাং সারা পথ হাঁটিয়া সন্ধ্যার পূর্বে বিপিন কাছারি পৌঁছিল। কাছারি-ঘরে ক্যানেস্ত্রা-কাটা টিনের দেওয়াল, চাল খড়ের। স্থানীয় জনৈক নাপিতের পুত্র মাসিকবারো আনা বেতনে কাছারিতে ঝাঁটপাটের কাজকর্ম করে। বিপিন তাহাকে সংবাদ দিয়া আনাইল, সে ঘর খুলিয়া ঝাঁট দিয়া কাছারি-ঘরটাকে রাত্রিবাসের কতকটা উপযোগী করিয়া তুলিল বটে, কিন্তু বিপিনের ভয় হইতেছিল, মেঝেতে যে রকম বড় বড় চারপাঁচটা ইঁদুরের গর্ত হইয়াছে, রাত্রিবেলা সাপখোপ না বাহির হয়! 

চাকর ছোকরা একটি কাচভাঙা হ্যারিকেন লণ্ঠন জ্বালিয়া ঘরের মেঝেতে রাখিয়া বলিল, নায়েববাবু রাত্রে কি খাবা? 

কিছু খাব না। তুই যা। 

—সে কি বাবু! তা কখনও হতি পারে? খাবা না কিছু, রাত কাটাবা কেমন করে? একটুদুধ দেখে আসি পাড়ার মধ্যে, আপনি বসেন বাবু। 

এই ছোকরা চাকর যে যত্ন করে, দরদ দেখায়, বিপিন অনেক আপনার লোকের কাছেও তেমন ব্যবহার পায় নাই, একথা তাহার মনে হইল। 

অন্ধকার রাত্রি। 

কাছারির সামনে একটু ফাঁকা মাঠ, অন্য সব দিকে ঘন বাঁশবন, এক কোণে একটা বড়বাদাম গাছ। অনাদি চৌধুরীর বাবা হরিনাথ চৌধুরী কাছারিবাড়িতে এটি শখ করিয়াপুঁতিয়াছিলেন, ফলের জন্য নয়, বাহার ও ছায়ার জন্য। বাঁশবনে অন্ধকার রাত্রে ঝাঁকে ঝাঁকেজোনাকি ঘুরিয়া ঘুরিয়া চক্রাকারে উড়িতেছে, ঝিঁঝি ডাকিতেছে, মশা বিন্ বিন্ করিতেছে কানেরকাছে—কাছারির কাছাকাছি লোকজনের বাস নাই—ভারী নির্জন। 

বিপিন একা বসিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল। কত কথাই মনে আসে!বাড়ি হইতে আসিয়া মন ভাল নয়, হাসপাতালে ছোট ভাইটার রোগশীর্ণ মুখ মনে পড়িল।মনোরমার ঝাঁঝাল টক-টক কথাবার্তা। সংসারে ঘোর অনটন। বাজারে হেন দোকান নাই, যেখানে দেনা নাই। আজ শনিবার, সামনের বুধবারে মহাল হইতে চল্লিশটা টাকা ও একগাদা ফল, তরকারিপত্র, মাছ, দই জমিদারবাড়ি লইয়া যাইতে হইবে জামাইয়ের অভ্যর্থনার যোগাড় করিতে। তিন দিনের মধ্যে এ গরিব গাঁয়ে চল্লিশ টাকা আদায় হওয়া দূরের কথা, দশটি টাকা হয় কিনা সন্দেহ—অথচ জমিদার বা জমিদার-গিন্নি তা বুঝিবেন না—দিতে না পারিলেই মুখভার হইবে তাঁদের। কি বিষম মুশকিলেই সে পড়িয়াছে! অথচ চিরকাল তাহাদের এমন অবস্থাছিল না। বিপিনের বাবা এই কাছারিতে এক কলমে উনিশ বছর কাটাইয়া গিয়াছেন, এইজমিদারদের কাজে। যথেষ্ট অর্থ রোজগার করিতেন, বাড়িতে লাঙল রাখিয়া চাষবাস করাইতেন, গ্রামের মধ্যে যথেষ্ট নামডাক, প্রতিপত্তি ছিল। 

বাবা চক্ষু বুজিবার সঙ্গে সঙ্গে সব গেল। কতক গেল দেনার দায়ে, কতক গেল তাহারই বদখেয়ালিতে। অল্প বয়সে কাঁচা টাকা হাতে পাইয়া কুসঙ্গীর দলে ভিড়িয়া স্ফূর্তি করিতে গিয়া টাকা তো উড়িলই, ক্ৰমে জমিজমা বাঁধা পড়িতে লাগিল। 

তারপর বিবাহ। সে এক মজার ব্যাপার! 

তখনও পর্যন্ত যতটুকুনামডাক ছিল পৈতৃক আমলের, তাহারই ফলে এক অবস্থাপন্ন বড়গৃহস্থের ঘরের মেয়ের সহিত হইল বিবাহ। মেয়ের বাবা নাই, কাকা বড় চাকুরি করেন, শালাশালীরা সব কলেজে-পড়া, বিপিন ইংরাজিতে কোনো রকমে নাম সই করিতে পারে মাত্র। মনোরমা শ্বশুরবাড়ি আসিয়াই বুঝিল বাহির হইতে যত নামডাকই থাকুক, এখানকার ভিতরেরঅবস্থা অন্তঃসারশূন্য। সে বড় বংশের মেয়ে, মন গেল তার সম্পূর্ণ বিরূপ হইয়া; স্বামীর সহিতসদ্ভাব জমিতে পাইল না যে, ইহাতে বিপিন মনেপ্রাণে স্ত্রীকে অপরাধিনী করিতে পারে কই? 

—এই যে লায়েববাবু কখন আলেন? দণ্ডবৎ হই। 

বিপিনের চমক ভাঙিল, আগন্তুক এই গ্রামেরই একজন বড় প্রজা, নরহরি দাশ, জাতিতেমুচি, শুয়োরের ব্যবসা করিয়া হাতে দু’পয়সা করিয়াছে। 

বিপিন বলিল, এসো নরহরি, বড় মুশকিলে পড়েছি, বুধবারের মধ্যে চল্লিশটি টাকার যোগাড় কি করে করি বলো তো! বাবুর জামাই-মেয়ে আসবেন, টাকার বড্ড দরকার। আমি তো এলাম দু’মাস পরে। টাকা যোগাড় না করতে পারলে আমার তো মান থাকে না—কি করি, ভারী ভাবনায় পড়ে গেলাম যে! 

নরহরি বলিল, এসব কথা এখন নয় বাবু। খাওয়া-দাওয়া করুন, কাল বেবেলা আমিআসবো কাছারিতে— তখন হবে। 

ইতিমধ্যে কাছারির ছোকরা চাকর একটা ঘটিতে কিছু দুধ ও কোঁচড়ে কিছু মুড়ি লইয়াফিরিল। নরহরি বলিল, আপনি সেবা করুন লায়ে বাবু, আজ আসি। কাল কথাবার্তা হবে।। কাছারি-ঘরের দোরটা একটু ভাল করে আগড় বন্ধ করে শোবেন রাতে—বড্ড বাঘের ভয় হয়েছে আজ কড়া দিন। 

বিপিন সকালে একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইয়া বাঁচিল। তহবিলের টাকার ঘাটতি ইহারা টের পায় নাই। তবুও টাকাটা এবার তহবিলে শোধ করিয়া দিতে হইবে, জমিদার হিসাব তলব করিতে পারেন, এতদিন পরে যখন সে আসিয়াছে! তাহা হইলে অন্তত আশি টাকার আপাতত দরকার, এই তিনদিনের মধ্যে 

তিনটি দিন বাকি মোটে। এখন কোনো ফসলের সময় নয়, আশি টাকা আদায় হইবেকোথা হইতে? পাইক গিয়া প্রজাপত্র ডাকাইয়া আনিল, সকলের মুখেই এক বুলি, এখন টাকাতারা দেয় কি করিয়া? 

নরহরি দাশ পনেরোটি টাকা দিল। ইহার বেশি তাহার গলা কাটিয়া ফেলিলেও হইবে না। বিপিন নিজে প্রজাদের বাড়ি-বাড়ি ঘুরিয়া আরও দশটি টাকা আদায় করিল দুইদিনে। ইহার বেশিহওয়া বর্তমানে অসম্ভব। 

বিপিন একবার কামিনী গোয়ালিনীকে ডাকাইল। 

এ অঞ্চলের অনেকে জানে যে, বিপিনের বাবা বিনোদ চাটুজ্জের সঙ্গে কামিনীর নাকি বেশ একটু ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন কামিনীর বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন, একহারা, শ্যামবর্ণ— হাতেমোটা সোনার অনন্ত। সে বিপিনকে স্নেহের চক্ষে দেখে, বিপিন যখন দশ-বারো বছরের বালক, বাবার সঙ্গে কাছারিতে আসিত, তখন হইতেই সে বিপিনকে জানে। বিপিনও তাহাকে সমীহকরিয়া চলে। 

কামিনী প্রথমে আসিয়াই বিপিনের ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। 

—বাবা, তারে তুমি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বড় একটা ডাক্তার-টাক্তার দেখাও—ওখানেবাঁচবে না। রাণাঘাটের হাসপাতালে কি হবে? ছোঁড়াডাকে তোমরা সবাই মেলে মেরে ফেলবাদেখছি! 

—করি কি মাসিমা, জানো তো অবস্থা। বাবা মারা যাওয়ার পরে সংসারে আগের মতোজুত নেই। বাবার দেনা শোধ দিয়ে— 

কামিনী ঝাঁঝিয়া উঠিয়া বলিল, কর্তার দেনার জন্যে যায়নি—গিয়েছে তোমার উড়ঞ্চড়েস্বভাবের জন্যে—আমি জানি নে কিছু! কর্তা যা রেখে গিয়েছিলেন করে, তাতে তোমাদের দুইভায়ের ভাতের ভাবনা হত না। বিষয়- আশয়, গোলাপালা, তোমার পৈতের সময় হাজার লোক পাত পেড়ে বসে খেয়েছিল—কম বিষয়ডা করে গিয়েছিলেন কর্তা। তোমরা বাবা সব ঘুচুলে। তাঁর মতো লোক তোমরা হলে তো! 

বিপিন দেখিল সে ভুল করিয়াছে। বাবার কোনো ত্রুটির উল্লেখ ইহার সামনে করা উচিতহয় নাই— সে বরাবর দেখিয়া আসিয়াছে কামিনী মাসি তাহা সহ্য করিতে পারে না। ইহার কাছেকিছু টাকা আদায় করিতে হইবে, রাগাইয়া লাভ নাই। সুর বেশ মোলায়েম করিয়া বলিল, ও কথাযাক মাসিমা, কিছু টাকা দিতে পারো, এই গোটা চল্লিশ টাকা! কিস্তির সময় আদায় করে আবার দেব। 

কামিনী পূর্ববৎ ঝাঁঝের সঙ্গেই বলিল, টাকা, টাকা! টাকার গাছ দেখেছ কিনা আমার!সেবার এককাঁড়ি টাকা যে নিলে আর উপুড়-হাত করলে না, আর একবার দেলাম কুড়ি টাকা পুজোর সময়; তোমার কেবল টাকার দরকার হলেই—মাসি মাসি! বাতে যে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলাম কুড়ি-পঁচিশ দিন—খোঁজ করেছিলে মাসিমা বলে? 

বিপিন কামিনী মাসিকে কি করিয়া চালাইতে হয় জানে। তরুণ-তরুণীদের কাছে প্রৌঢ় বাপ্রৌঢ়াদের দুর্বলতা ধরা পড়িতে বেশিক্ষণ লাগে না। তাহারা জানে উহাদের কি করিয়া হাতে রাখিতে হয়। সুতরাং বিপিন হাসিয়া বলিল, খোকার ভাতের সময় তোমায় নিয়ে যাব বলেসব ঠিক মাসি, এমন সময় বলাইটা অসুখে পড়ল। তোমার টাকাকড়িও সব তো এতদিন শোধ হয়ে যেত, ওর অসুখটা যদি না হত! 

কামিনী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া কি ভাবিল, তারপর হঠাৎ জবাব দিল, আচ্ছা হয়েছে ঢের, আর বলার কাজ নেই বাপু। বেলা হয়েছে, চললাম আমি। ক’দিন আছ এখানে? 

—মঙ্গলবার সন্ধেবেলা কি বুধবার সকালে যাব। মাসিমা, যা বললাম কথাটা মনে রেখ।টাকাটা যদি যোগাড় করে দিতে পারতে, তবে বড্ড উপকার হত। তোমার কাছে না চাইব তো কার কাছে চাইব, বলো! 

কামিনী সে কথায় তত কান না দিয়া আপনমনে চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল, তোমার পাইককে কি ওই নটবরের ছেলেটাকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ো, পেঁপেপেকেছে—সঙ্গে দেব। 

মঙ্গলবার বৈকালে কামিনীর কাছে পাওয়া গেল পঁচিশটি টাকা। ধোপাখালির হাট হইতে জমিদার-গিন্নির ফরমাশমতো জিনিসপত্র কিনিয়া বিপিন বুধবার শেষরাত্রির দিকে গরুরগাড়িকরিয়া রওনা হইল এবং বেলা দশটার সময় পলাশপুর আসিয়া পৌঁছিল। জমিদারবাড়ি পৌঁছিবার পূর্বে শুনিল, জামাইবাবু কালরাত্রে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। জমিদারবাবুর অবস্থা এখন তত ভাল নয় বলিয়া তেমন বড় পাত্রে মেয়েকে দিতে পারেন নাই।জামাই আইন পাস করিয়া আলিপুর কোর্টে ওকালতি করেন। কলিকাতায় বাড়ি আছে— পৈতৃকবাড়ি, যদিও দেশ এই পলাশপুরের কাছেই নোনাপাড়া। 

তরিতরকারির ধামা গরুরগাড়ি হইতে নামাইতে দেখিয়া জমিদার-গৃহিণী খুশি হইয়া বলিলেন, ওই দেখ, বিপিন মহাল থেকে কত জিনিসপত্র এনেছে! কুমড়োটা কে দিলে বিপিন? কি চমৎকার কুমড়োটি! 

বিপিন বলিল, দেবে আবার কে? কাল হাটে কেনা! 

—আর এই পটল, ঝিঙে, শাকের ডাঁটা? 

—ও সব হাটে কেনা। দেবে কে বলুন, কার দোরেই বা আমি চাইতে যাব? 

—ওমা, সব হাটে কেনা! তা এত জিনিস পয়সা খরচ করে না আনলেই হত। মহলথেকে আগে তো দেখেছি কত জিনিসপত্র আসত, তোমার বাবাই আনতেন, আর আজকাল ছাইবলতে রাইও তো কখনও দেখিনে। ওটা কি, মাছ দেখছি যে, বেশ মাছ! ওটাও কেনা নাকি? 

—আড়াই সের, সাত আনা দরে, সাড়ে সতেরো আনায় নগদ কেনা। 

জমিদার-গিন্নি বিরক্তির মুখে বলিলেন, কে বাপু তোমায় বলেছিল নগদ পয়সা ফেলেআড়াই সের মাছ কিনে আনতে? মহালে নেই এক পয়সা আদায়, এর ওপর তরিতরকারি মাছেদু’টাকার ওপর খরচ করে ফেলতে কে বলেছিল, জিগ্যেস করি! 

বিপিন বলিল, দু’টাকার ওপর কি বলছেন, সাড়ে তিন টাকা খরচ হয়েছে। আপনি সেইএক নাগরি আখের গুড় আনতে বলেছিলেন, তাও এনেছি। সাড়ে সাত সের নাগরি, তিন আনা করে সের হিসেবে— 

জমিদার-গিন্নি রাগিয়া বলিলেন, থাক, আর হিসেব দেখাতে হবে না! তোমাকে আমিওসব কিনে আনতে কি বলেছিলাম যে আমার কাছে হিসেব দেখাচ্ছ! 

বিপিন খুশির সহিত ভাবিল, বেশ হয়েছে, মরছেন জ্বলে পয়সা খরচ হয়েছে বলে! কি কঞ্জুস আর কি ছোট নজর রে বাবা! 

মুখে সে কোনো কথা না বলিয়া চুপ করিয়া রহিল। 

জামাইটির সঙ্গে তাহার দেখা হইল বিকালের দিকে। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ বছর, একটুহৃষ্টপুষ্ট, চোখে চশমা, গম্ভীর মুখ—বৈঠকখানায় বসিয়া কি ইংরেজি কাগজ পড়িতেছিলেন।বিপিন বার কয়েক বৈঠকখানায় যাওয়া-আসা করিল বটে, কিন্তু জামাইবাবু বোধ করি তাহার অস্তিত্বের প্রতি বিশেষ কিছু মনোযোগ না দিয়াই একমনে খবরের কাগজপড়িয়া যাইতেলাগিলেন। 

বিপিনের রাগ হইল। তখনই সে সংকল্প করিল, সেও দেখাইবে, বড়লোকের জামাইকে সে গ্রাহ্যও করে না। তুমি আছ বড়লোকের জামাই, তা আমার কি! 

বিপিন বৈঠকখানা-ঘরে ঢুকিয়া ফরাশ বিছানো চৌকির এক পাশে বসিয়া রহিলখানিকক্ষণ নিঃশব্দে। দশ মিনিট কাটিয়া গেল, জামাইবাবু তাহার দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন নাবা একটা কথাও বলিলেন না। 

বিপিন পকেট হইতে বিড়ি বাহির করিয়া ধরাইল এবং ইচ্ছা করিয়াই ধোঁয়া ছাড়িতেলাগিল এমন ভাবে যাহাতে জামাইয়ের চোখে পড়ে। 

জামাইবাবু বোধ হয় এবার ধূম্র হইতে বহ্নিমান পর্বতের অস্তিত্ব অনুমান করিয়া খবরের কাগজ চোখের সম্মুখ হইতে নামাইলেন। বিপিনকে তিনি চেনেন, বিবাহের পর দুই তিন বার দেখিয়াছেন, শ্বশুরের জমিদারির জনৈক কর্মচারী বলিয়া জানেন। তাহাকে এরূপ নির্বিকার ও বেপরোয়া ভাবে তাহার সম্মুখে বিড়ি ধরাইয়া খাইতে দেখিয়া তিনি বিস্মিত তো হইলেনই, লোকটার বেয়াদবিতে একটু রাগও হইল। 

কিন্তু সে বেয়াদবি সীমা অতিক্রম করিয়া তাহাকে সম্পূর্ণ নির্বাক করিয়া দিল, যখন সেইলোকটা দাঁত বাহির করিয়া একগাল হাসিয়া বলিল, জামাইবাবু, কেমন আছেন? চিনতে পারেন? বিড়ি-টিড়ি খান নাকি? নিন না আমার কাছে আছে! 

কথা শেষ করিয়া লোকটা একটা দেশলাই ও বিড়ি তাহার দিকে আগাইয়া দিতে আসিল। নিতান্ত বেয়াদব ও অসভ্য। 

জামাইবাবু বিপিনের দিকে না চাহিয়া গম্ভীর মুখে সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, থাক, আছেআমার কাছে।—বলিয়া পকেট হইতে রৌপ্যনির্মিত সিগারেটের কেস বাহির করিয়া একটিসিগারেট ধরাইলেন। বিপিন ইহাতে অপমানিত মনে করিল। প্রতিশোধ লইবার জন্য পাল্টাঅপমানের অন্য কোনো ফাঁক খুঁজিয়া না পাইয়া সে বলিয়া উঠিল, জামাইবাবু, ও কি সিগারেট? একটা এদিকে দিন দিকি! 

বাড়ির গোমস্তা জমিদারবাবুর জামাইয়ের নিকট সিগারেট চায়, ইহার অপেক্ষা বেয়াদবি ও অপমান আর কি হইতে পারে! বিপিন সিগারেটের জন্য গ্রাহ্য করে না; কিন্তু লোকটাকে অপমান করিয়াই তাহার সুখ। 

জামাইবাবু কিন্তু রৌপ্যনির্মিত সিগারেট-কেস হইতে একটা সিগারেট বাহির করিয়া তাহার দিকে ছুঁড়িয়া দিলেন, কোনো কথা বলিলেন না। 

বিপিন সিগারেট ধরাইয়া বলিল, তারপর জামাইবাবু, কবে এলেন? 

কাল রাত্রে। 

বাড়ির সব ভাল তো? 

—হুঁ।

—আপনি এখন সেই আলিপুরেই ওকালতি করছেন? 

—হুঁ।

—বেশ বেশ। 

দিদিমণি আর ছেলেপুলেদের সব এখানে এনেছেন নাকি? 

—হুঁ।

এতগুলি কথার উত্তর দিতে গিয়া জামাইবাবু একবারও তাহার দিকে চাহিলেন না বাখবরের কাগজ সেই যে আবার চোখের সামনে ধরিয়া আছেন তাহা হইতে চোখও নামাইলেননা। 

বিপিনের ইচ্ছা হইল, আরও একটু শিক্ষা দেয় এই শহুরে চালবাজ লোকটাকে। অন্যকোনো উপায় না ঠাওরাইতে পারিয়া বলিল, মানীর শরীর বেশ ভাল আছে তো? 

মানী জমিদারবাবুর মেয়ে সুলতার ডাকনাম। ডাকনামে গ্রামের মেয়েকে ডাকা এমন কিছুআশ্চর্য নয়, যদি বিপিনের বয়স বেশি হইত। কিন্তু তাহার বয়স জামাইয়ের চেয়ে এমন কিছুবেশি নয় বা সুলতাও নিতান্ত বালিকা নয়, কম করিয়া ধরিলেও সুলতা বাইশ বছরে পড়িয়াছে।গত জ্যৈষ্ঠ মাসে। 

এইবার প্রত্যাশিত ফল ফলিল বোধ হয়, জামাইবাবু হঠাৎ মুখ হইতে খবরের কাগজনামাইয়া বিপিনের দিকে চাহিয়া একটু কড়া গম্ভীর সুরে প্রশ্ন করিলেন, মানী কে? 

অর্থাৎ মানী কে তিনি ভাল রকমেই জানেন, কিন্তু জমিদারবাড়ির মেয়েকে ‘মানী’ বলিয়া সম্বোধন করিবার বেয়াদবি তোমার কি করিয়া হইল—ভাবখানা এইরূপ। 

বিপিন বলিল, মানী মানে দিদিমণি–বাবুর মেয়ে, আমরা মানী বলেই জানি কিনা।আমাদের চোখের সামনে মানুষ — 

ঠিক এই সময়ে চা ও জলযোগের জন্য অন্দর-বাড়ি হইতে জামাইবাবুর ডাক পড়িল। 

বিপিন বসিয়া আর একটি বিড়ি ধরাইল, শহুরে জামাইবাবুর চালবাজি সে ভাঙিয়াদিয়াছে। বিপিনকে এখনও ও চেনে নাই। চাকুরির পরোয়া সে করে না, আর কেহ যে তাহারসামনে চাল দেখাইয়া তাহাকে ছোট করিয়া রাখিবে—তাহার ইহা অসহ্য। 

ঝি আসিয়া বলিল, নায়েববাবু, মা-ঠাকরুন বললেন, আপনি কি এখন জল-টল কিছুখাবেন? 

রাগে বিপিনের গা জ্বলিয়া গেল। এইভাবে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলে অতি বড় নির্লজ্জলোকও কি বলিতে পারে যে সে খাইবে! ইহাই ইহাদের বলিয়া পাঠাইবার ধরন। সাধে কি সেএখানে থাকিতে নারাজ! 

রাত্রে খাওয়ার সময়েও এই ধরনের ব্যাপার অন্য রূপ লইয়া দেখা দিল। 

দালানের একপাশে জামাইবাবু ও তাহার খাবার জায়গা হইয়াছে। জামাইয়ের পাতেরচারিদিকে আঠারোটা বাটি, তাহাকে দিবার সময় সব জিনিসই পাতে দিয়া যাইতেছে। তাহার পরে দেখা গেল, জামাইবাবুর পাতে পড়িল পোলাও, তাহার পাতে সাদা ভাত। অথচ বিপিনবিকাল হইতেই খুশির সহিত ভাবিয়াছে, রাত্রে পোলাও খাওয়া যাইবে। পোলাও রান্নার কথাসে জানিত। 

কি ভাগ্য, জামাইয়ের পাতে লুচি দেওয়ার সময় জমিদার-গিন্নি তাহার পাতেও খান চার লুচি দিলেন। 

বিপিন খাইয়ে লোক, চারখানি লুচি শেষ করিয়া বসিয়া আছে দেখিয়া জমিদার-গিন্নি বলিলেন, বিপিনকে লুচি দেব? 

ইহা জিজ্ঞাসা নয়, দিব্য পরিস্ফুট স্বগত উক্তি। অর্থাৎ ইহা শুনিয়া যদি বিপিন লুচিআনিতে বারণ করিয়া দেয়। কিন্তু বিপিন তরুণ যুবক, ক্ষুধাও তাহার যথেষ্ট, চক্ষুলজ্জা করিলেতাহার চলে না। সে চুপ করিয়া রহিল। জমিদার-গিন্নি আবার চারখানা গরম লুচি আনিয়াতাহার পাতে দিলেন, বিপিন সে ক’খানা শেষ করিতে এবার কিছু বিলম্ব করিল চক্ষুলজ্জায় পড়িয়া। কারণ ওদিকে জামাইবাবু হাত গুটাইয়াছেন। জমিদার-গিন্নি ঘরের দোরে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন, বলিলেন, বিপিনকে লুচি দেব? 

ইহাও জিজ্ঞাসা নয়, পূর্ববৎ স্বগত উক্তি, তবে বিপিনকে শুনাইয়া বটে। বিপিন ভাবিল, ভাল মুশকিলে পড়া গেল। লুচি দেব, লুচি দেব! দেবার ইচ্ছে হয় দিয়ে ফেললেই তো হয়, মুখেঅমন বলার কিদরকার! 

জমিদার-গৃহিণী যদি ভাবিয়া থাকেন যে, বিপিন আর লুচি আনিতে বারণ করিবে, তবে তাহাকে নিরাশ হইতে হইল, বিপিন কোনো কথা কহিল না। আবার চারখানা লুচি আসিল। 

চারখানি করিয়া ফুলকো লুচিতে বিপিনের কি হইবে? সে পাড়াগাঁয়ের ছেলে, খাইতেপারে, ওরকম এক ধামা লুচি হইলে তবে তাহার কুলায়। কাজেই সে বলিল, না মাসিমা, লুচিখাওয়া অভ্যেস নেই, ভাত না হলে যেন খেয়ে তৃপ্তি হয় না। 

জমিদার-গিন্নি ভাত আনিয়া দিলেন, মনে হইল তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিয়াছেন।বিপিন মনে মনে হাসিল। 

খাওয়া শেষ করিয়া সে বাহিরের ঘরে যাইতেছে, রোয়াকের কোণের ঘরের জানলারকাছ দিয়া যাইবার সময় তাহাকে কে ডাকিল, ও বিপিনদা! 

বিপিন চাহিয়া দেখিল, জানালার গরাদ ধরিয়া ঘরের ভিতরে জমিদারবাবুর মেয়ে মানী দাঁড়াইয়া আছে। 

মানী দেখিতে বেশ সুশ্রী, রংও ওর মায়ের মতো ফর্সা, এখনও একহারা চেহারা আছে, তবে বয়স হইলে মায়ের মতো মোটা হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে। মানী বুদ্ধিমতী মেয়ে, বেশভূষার প্রতি চিরকালই তাহার সযত্ন দৃষ্টি, এখনও যে ধরনের একখানি রঙিন শাড়ি ওহাফহাতা ব্লাউজ পরিয়া আছে, পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা তেমন আটপৌরে সাজ করিবার কল্পনাওকরিতে পারে না, একথা বিপিনের মনে হইল। 

বিপিনের বাবা বিনোদ চাটুজ্জে যখন এঁদের স্টেটে নায়েব ছিলেন, বিপিন বাপের সঙ্গেবাল্যকালে কত আসিত এঁদের বাড়িতে, মানীর তখন নয়-দশ বছর বয়স। মানীর সঙ্গে সে কত খেলা করিয়াছে, মানীর সাহায্যে উপরের ঘরের ভাঁড়ার হইতে আমসত্ত্ব ও কুলের আচার চুরিকরিয়া দুইজনে সিড়ির ঘরে লুকাইয়া দাঁড়াইয়া খাইয়াছে, মানীর পড়া বলিয়া দিয়াছে। বিপিনেরপৈতা হইবার পর মানী একবার বিপিনের ভাতের থালায় নিজের পাত হইতে কি একটা তুলিয়াদিয়া বিপিনের খাওয়া নষ্ট করার জন্য মায়ের নিকট হইতে খুব বকুনি খায়। সেই মানী, কতবড় হইয়া গিয়াছে। ওর দিকে যেন আর তাকানো যায় না! 

বিপিন বলিল, মানী, কেমন আছ? 

—ভাল আছি। তুমি কেমন আছ বিপিনদা? 

বিপিনের মনে হইল, তাহার সহিত কথা বলিবার জন্যই মানী এই জানালার ধারেঅনেকক্ষণ হইতে দাঁড়াইয়া আছে। 

মানীকে এক সময় বিপিন যথেষ্ট স্নেহের চক্ষে দেখিত, ভালবাসা হয়তো তখনও ঠিকজন্মায় নাই; কিন্তু বিপিনের সন্দেহ হয়, মানী তাহাকে যে চক্ষে দেখিত তাহাকে শুধু ‘স্নেহ’ বা ‘শ্রদ্ধা’ বলিলে ভুল হইবে, তাহা আরও বড়, ভালবাসা ছাড়া তাহার অন্য কোনো নাম দেওয়া বোধ হয় চলে না। 

মানীর কথা বিপিন অনেকবার ভাবিয়াছে। একসময়ে মানী ছিল তাহার চোখে নারীসৌন্দর্যের আদর্শ! মনোরমাকে বিবাহ করিবার সময় বাসরঘরে মানীর মুখ কতবার মনে আসিয়াছে, তবে সে আজ ছয়-সাত বছরের কথা, তাহার নিজের বয়সই হইতে চলিল সাতাশ-আটাশ 

—বিপিন বলিল, খুব ভাল আছি। তুমি যে মাথায় খুব বড় হয়ে গিয়েছ মানী! –বিপিনদা, ওরকম করে কথা বলছ কেন? আমি কি নতুন লোক এলাম? 

বিপিনের মনে পড়িল, মানীকে সে কখনও ‘তুমি’ বলে নাই, চিরকাল ‘তুই’ বলিয়াআসিয়াছে। এখন অনেক দিন পরে দেখা, প্রথমটা একটু সঙ্কোচ বোধ করিতেছিল, বলিল, কলকাতার লোক এখন তোরা, তুই কি আর সেই পাড়াগেঁয়ে ছোট্ট মানীটি আছিস? 

—তুমি কি আমাদের কাছারিতে কাজে ঢুকেছ? 

—হ্যাঁ। না ঢুকে করি কি, সংসার একেবারে অচল। তোর কাছে বলতে কোনো দোষনেই মানী, যেদিন এখানে এলুম এবার, না হাতে একটি পয়সা, না ঘরে একমুঠো চাল। আর ধরোলেখাপড়াই বা কি জানি, কিছুই না। 

—কিন্তু তুমি এখানে টিকতে পারবে না বিপিনদা। তুমি ঘোর খামখেয়ালী মানুষ, তোমায়আর আমি চিনি নে! বিনোদকাকা যে রকম করে কাজ করে টিকে থেকে গিয়েছেন, তুমি কিতেমন পারবে? আজই কি সব করেছ, দু’ তিন টাকা খরচ করে দিয়েছ—মা বলছিলেন বাবাকে! বলিয়া মানী হাসিল। 

বিপিন বলিল, যদি খরচই করে থাকি, সে তো তোদেরই জন্যে। তুই এসেছিস এতকালপরে, একটু ভাল মাছ না খেতে পেলে তুই-ই বাকি ভাববি! 

মানী মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, মহাল থেকে মাছ আনলে না কেন? 

—কে মাছ দেবে বিনি পয়সায় তোদের মহালে? বাবার আমলের সে ব্যাপার আর আছেনাকি? এখন লোক হয়ে গিয়েছে চালাক, তাদের চোখ কান ফুটেছে—তোর মা কি সে খবর রাখেন? 

—তা নয়, বিনোদকাকার মতো ডানপিটে দুদেও তো তুমি নও বিপিনদা। তুমিভালমানুষ ধরনের লোক, জমিদারির কাজ করা তোমার দ্বারা হবে না। 

শেষ কথাগুলি মানী যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সহিত বলিল। 

বিপিন হাসিয়া উঠিয়া বলিল, তাই তো রে মানী, একেই না বলে জমিদারের মেয়ে! দস্তুরমতো জমিদারি- চালের কথাবার্তা হচ্ছে যে! 

মানী বলিল, কেন হবে না, বল? আমি জমিদারের মেয়ে তো বটেই। সংস্কৃত তো পড়নি বিপিনদা, সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে—সিংহের বাচ্চা জন্মেই হাতির মুণ্ডু খায় আর— 

—থাক্ থাক্, তোর আর সংস্কৃত বিদ্যে দেখাতে হবে না, ও সবের ধার মাড়াইনিকখনও। আচ্ছা আসি মানী, রাত হয়ে যাচ্ছে। 

মানী বলিল, শোনো শোনো, যেও না, রাত এখন তো ভারী! আচ্ছা বিপিনদা, ভারী দুঃখ হয়আমার, লেখাপড়াটা কেন ভাল করে শিখলে না? তোমার চেহারা ভাল, লেখাপড়া শিখলে চাকরিতে তোমায় যেচে আদর করে নিত—এ আমি বলতে পারি। 

বিপিন বলিল, আচ্ছা মানী, একবার তুই আর আমি ভাঁড়ারঘর থেকে কুলচুর চুরি করেখেয়েছিলাম, মনে পড়ে? সিঁড়ির ঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়েছিলুম? 

মানী বলিল, তা আর মনে নেই। সে সব এক দিন গিয়েছে। কিন্তু আমার কথা ওভাবেচাপা দিলে চলবে না। লেখাপড়া শিখলে না কেন, বলো? 

বিপিন হাসিয়া বলিল, উঃ, কি আমার কৈফিয়ত-তলবকারিণী রে! 

পরে ঈষৎ গম্ভীর মুখে বলিল, সে অনেক কথা। সে কথা তোর শুনে দরকারও নেই।তবে তোর কাছে মিথ্যে কথা বলব না। হ’ল কি জানিস, বাবা মারা গেলেন বিস্তরবিষয়সম্পত্তি ও কাঁচা টাকা রেখে। আমি তখন সবে কুড়ি বছরে পা দিয়েছি, মাথার ওপর কেউনেই, টাকা উড়ুতে আরম্ভ করে দিলাম, পড়াশুনো ছাড়লাম, বিষয়সম্পত্তি নগদ টাকা পেয়ে কম দরে মৌরসী বিলি করতে লাগলাম। বদখেয়ালের পরামর্শ দেবারও লোক জুটে গেল অনেক। কতদূর যে নেমে গেলাম— 

মানী একমনে শুনিতেছিল, শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, বল কি বিপিনদা! 

—তোর কাছে বলতে আমার কোনো সঙ্কোচ নেই, সঙ্কোচ হলেও কোনো কথা লুকোব না। আজ এত দুঃখু পাব কেন মানী, এখানে চাকরি করতে আসব কেন—কিন্তু এখন বয়স হয়েবুঝেছি, কি করেই হাতের লক্ষ্মী ইচ্ছে করে বিসর্জন দিয়েছিলাম তখন! 

—তারপর? 

—তারপর ওই যে বলছিলাম, নানারকম বদখেয়ালে টাকাগুলো এবং বিষয়-আশয়জলাঞ্জলি দিয়ে শেষে পড়লাম ঘোর দুর্দশায়। খেতে পাইনে—এমন দশায় এসে পৌঁছলাম। 

মানীর মুখ দিয়া এক ধরনের অস্ফুট বিস্ময় ও সহানুভূতির স্বর বাহির হইল, বোধ হয়তাহার নিজেরও অজ্ঞাতসারে। বিপিনের বড় ভাল লাগিল মানীর এই দরদ ও তাহার সতেজ সহজ সজীব সহানুভূতি। 

—সে সব কথাগুলো তোর কাছে বলব না, মিছে তোর মনে কষ্ট দেওয়া হবে। এইরকমে দেড় বছর কেটে গেল, তারপর তোর বাবার কাছে এলুম চাকরির চেষ্টায়, চাকরি পেয়েও গেলাম। এই হল আমার ইতিহাস। তবে এ চাকরি পোষাবে না, সত্যি বলছি। এ আমার অদৃষ্টে টিকবে না। দেখি, অন্য কোথাও ভাগ্য পরীক্ষা করে। 

মানী অত্যন্ত একমনে কথাগুলি শুনিতেছিল। গম্ভীর মুখে বলিল, একটা কথা আমার শুনবে? 

— কি? 

—আমায় না জানিয়ে তুমি এ চাকরি ছাড়বে না, বলো? 

—সে কথা দেওয়া শক্ত মানী। সত্যি বলছি, তুই এসেছিস এখানে তাই, নইলে বোধ হয়এবার বাড়ি থেকে আসতাম না। তবে যে ক’দিন তুই আছিস, সে ক’দিন আমিও থাকব। তারপর কি হয় বলতে পারছিনে। 

চিরকালটা তোমার একভাবে গেল বিপিনদা! নিজের গোঁ ও বুদ্ধিতে কষ্ট পেলে চিরদিন। আমার কথা একটিবার রাখো বিপিনদা, তেজ দেখানোটা একবারের জন্যে বন্ধ রাখো। আমায় না জানিয়ে চাকরি ছেড়ো না, আমি তোমার ভালর চেষ্টাই করব। 

বিপিন হাস্যমিশ্রিত ব্যঙ্গের সুরে বলিল, উঃ, মানী পরের উপকারে মন দিয়েছে দেখছি!এমন মূর্তিতে তো তোকে কখনও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না মানী! 

মানী রাগতভাবে বলিল, আবার? 

—না না, আচ্ছা তোর কথাই শুনব, যা-রাগ করিস নে। 

—কথা দিলে? 

এইসময় ঘরের মধ্যে মানীর ছোট ভাই সুধীর আসিয়া পড়াতে মানী পিছন ফিরিয়া চাহিল। বিপিন তাড়াতাড়ি বলিল, চলি মানী, শুইগে, রাত হয়েছে। শরীর ক্লান্ত আছে খুব, সারাদিন মহালে ঘুরেছি টো টো ক’রে রোদ্দুরে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *