বিপিনের সংসার – ৬

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

আরও দুই দিন কাটিয়া গেল। 

দুপুরের পরে বিপিন কাছারিতে বসিয়া হিসাবপত্র দেখিতেছে, নিবারণ গোয়ালার ছেলে পাঁচু আসিয়া বলিল, নায়েববাবু, কামিনী পিসি একবার আপনাকে ডেকেছে। 

বিপিন গিয়া দেখিল, কামিনীর অসুখ বাড়িয়াছে। গায়ের উত্তাপ খুব বেশি জ্বরের ধমকে বৃদ্ধা যেন হাঁপাইতেছে, বেশি কথা বলিবার শক্তি নাই। 

বিপিন বলিল, কি খেয়েছ? 

কামিনী ক্ষীণস্বরে বলিল, নিবারণের বউ একটু জলসাবু করে দিয়ে গেল, দুপুরের আগে তাই একচুমুক— মুখে ভাল লাগে না কিছু! 

—আচ্ছা আচ্ছা, চুপ করে শুয়ে থাক। 

—তুমি আমায় আজ দেখতে আসোনি কেন? কথাটা কেমন যেন গোঙাইয়া গোঙাইয়া বলিল; বেশ একটু অভিমানের সুরও বটে। 

বিপিন মনে মনে অনুতপ্ত হইল। দেখিতে আসা খুব উচিত ছিল; সকালে কাছারিতেজনকতক প্রজার সঙ্গে গোলমাল মিটাইতে দেরি হইয়া গেল, নতুবা ঠিক আসিত। কামিনীরকেহ নাই, বৃদ্ধা হয়তো আশা করে, বিপিন তাহার অসময়ে পুত্রবৎ দেখাশোনা করিবে; যদিওবিপিন কামিনীর মনের এত কথা বুঝিতে পারে না, নিজেকে লইয়াই ব্যস্ত, অপরের দিকেচাহিবার অবসর তাহার কোথায়? 

কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিবার পরে বিপিন বলিল, এখন যাই, প্রজাপত্তর আসবে, আর আমায় একবার গদাধরপুর যেতে হবে একটা জমির মীমাংসা করতে। সন্ধের পর আবার আসব। 

কামিনী উঠতে দেয় না, হাত বাড়াইয়া টানিয়া টানিয়া বলিল, যেও না, যেও না, ও বাবা বিপিন, যেও না, বসো,বসো। 

বিপিনের কষ্ট হইল বৃদ্ধাকে এভাবে ফেলিয়া যাইতে। কিন্তু সত্যই তাহার থাকিবারউপায় নাই। গদাধরপুরে কয়েকঘর জেলে প্রজা আছে, তাহারা স্থানীয় বাঁওড়ের দখল লইয়া নিজেদের মধ্যে বিবাদ করার ফলে কাছারির খাজনা আদায় হইতেছে না। বিপিন নিজে গিয়া এ ব্যাপারের মীমাংসা করিয়া দিলে তাহারা মানিয়া লইবে, এরূপ প্রস্তাব করিয়া পাঠাইয়াছে।সুতরাং যাইতেই হইবে তাহাকে। অনাদিবাবুর কানে যদি কথা যায়, তবে এতদিন সে যায় নাই কেন, এজন্য কৈফিয়ত তলব করিয়া পাঠাইবেন। 

আড়ালে পাঁচুকে ডাকিয়া বলিল, পাঁচু, তোমার মাকে বলো এখানে একটু থাকতে। আমিআবার আসব এখন, একবার কাজে যাব গদাধরপুরে। আর একবার একটু সাবু করে খাইয়েদিতে বলো তোমার মাকে। খরচপত্তর যা হবে, সব আমার। আমি সব দোব। আচ্ছা একটা লোক দিতে পারো, রাণাঘাট থেকে কমলালেবু আর বেদানা কিনে আনবে? 

বিপিন কাছারির নায়েব বটে, কিন্তু সে ভালমানুষ নায়েব। লোকে সেজন্য তাহাকে তত ভয় করে না। বিপিনের বাবার আমলে প্রশ্নের প্রয়োজন ছিল না, মুখের কথা খসাইয়া হুকুম করিলেই চলিত। 

পাঁচু বলিল, আচ্ছা বাবু, আমি দেখছি যদি হাবুল যায়, বলে দেখছি। 

—এই আট আনা পয়সা রাখ। হাবুলকে পাও বা যাকে পাও, দিয়ে বল ভাল বেদানা আরকমলালেবু আনতে; আর যে যাবে তার জলখাবার আর মজুরি এই নাও চার আনা। 

বিপিন কাছারি আসিয়া গদাধরপুর যাইবার জন্য বাহির হইয়াছে, এমন সময় পাঁচুআসিয়া বলিল, কেউ গেল না নায়েববাবু, আমি নিজেই চললাম রাণাঘাটে। ফিরতে কিন্তুআমার রাত হবে, তা বলে যাচ্ছি। 

বিপিন বুঝিল, মজুরি ও জলখাবারের দরুন চারি আনা পয়সার লোভ সম্বরণ করা পাঁচুরপক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে, তারপর বাকি আট আনার ভিতর হইতে অন্তত চার ছয় পয়সাউপরিই বা কোন না হইবে! 

বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। 

গদাধরপুর এখান হইতে তিন চার মাইল পথ। বিপিন জোরে হাঁটিতে লাগিল। বজরাপুরপর্যন্ত সে ও পাঁচু একসঙ্গে গেল। তারপর রাণাঘাটের রাস্তা বাঁকিয়া পশ্চিমদিকে ঘুরিয়া গিয়াছে।পাঁচু সেই রাস্তায় চলিয়া গেল। গদাধরপুর যাইবার কোনো বাঁধা-ধরা পথ নাই। মাঠের উপরদিয়া সরু পায়ে-চলার-পথ, কখনও বা ফুরাইয়া যায়, কিছু দূরে গিয়া অন্য একটা পথ মেলে। মাঠে লোকজনও নাই যে পথ জিজ্ঞাসা করা যায়। নানা সরু সরু পথ নানাদিকে গিয়াছে, কোপথ যে ধরিতে হইবে জানা নাই। বিপিন একপ্রকার আন্দাজে চলিল। 

বেলা পড়িয়া আসিল। রোদের তেজ কমিয়া গেল। 

মাঠের মধ্যে ঝাড় ঝাড় আকন্দগাছে ফুল ফুটিয়াছে। সোঁদা, রোদপোড়া মাটি ও শুকনোকাশঝোপের গন্ধ বাহির হইতেছে। ফাঁকা মাঠ, গাছপালাও বেশি নাই, কোথাও হয়তো বাএকটা নিমগাছ, মাঝে মাঝে খেজুরগাছ। 

অবশেষে দূর হইতে জলাশয় দেখিয়া বিপিন বুঝিল, এই গদাধরপুরের বাঁওড়, সুতরাংসে ঠিক পথেই আসিয়াছে। 

গদাধরপুরের প্রজারা বিপিনকে খাতির করিয়া বসাইল। গ্রামের মধ্যে একটা কলু-বাড়িরবড় দাওয়ায় নূতন মাদুর পাতিয়া দিল বিপিনের জন্য। এ গ্রাম অনাদিবাবুর খাস তালুকেরঅন্তর্গত, গোটা গ্রামখানার সব লোকই কাছারির প্রজা। 

বাঁওড়ের দখলের মীমাংসা করিতে প্রায় সন্ধ্যা হইল। 

দুই-তিনজন প্রজা বলিল, নায়েববাবু, বলতে আমাদের বাধো-বাধো ঠেকে, কিন্তু আপনারএকটু জল মুখে দিলে হত। 

বিপিন বলিল, না, সে থাক। এখনও অনেক কাজ বাকি। আমাকে আবার সব কাজ সেরেফিরতে হবে এতখানি রাস্তা। 

প্রজারা ছাড়িল না, শেষ পর্যন্ত বিপিনকে একটা ডাব খাইতে হইল। 

একটি চাষাদের বউ কি মেয়ে এক কাঠা ধান হাতে কলুবাড়ির উঠানে আসিয়া বলিল, হ্যাদে, ইদিকি এসো! তেল দ্যাও আধপোয়া আর এক ছটাক নুন, আধপয়সার ঝাল— 

সে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা কি ধান দিয়ে জিনিস কেনো? 

মেয়েটি বলিল, হ্যাঁ বাবু, কনে পয়সা পাব? শীতকাল গেল, একখানা বস্ত্র নেই যে গায়ে দিই। যে ক’বিশ ধান পেয়েলাম, সব মহাজনের ঘরে তুলে দিয়ে খাবার ধান চাট্টি ঘরে ছেল, তাই দিয়ে তেল নুন হবে সারা বছরের, আর খাওয়াও হবে। 

—এতে কুলোবে সারা বছর? 

—তা কি কুলোয় বাবু? আষাঢ় শ্রাবণ মাসের দিকি আবার মহাজনের গোলায় ধামা হাতে যাতি হবে। ধান কর্জ না করলি আর চলবে না তারপর। 

কলু-বাড়িতে একটা ছোট মুদীর দোকানও আছে। আরও কয়েকটি লোক জিনিসপত্র কিনিতে আসিল। মেয়েটি তেল নুন কিনিয়া যাইবার সময় বলিল, মুসুরি নেবা? 

হরি কলু বলিল, নতুন মুসুরি? কাল নিয়ে এসো। 

—মুসুরির বদলে কিন্তু চাল দিতি হবে। 

বিপিন বলিল, তোমার ঘরে ধান আছে তো চাল নিয়ে কি করবে? 

মেয়েটি উঠানে দাঁড়াইয়া গল্প করিতে লাগিল। তাহার ভাই জন খাটিয়া খায়, কিন্তু তাহারহাঁপানির অসুখ, দশ দিন খাটে তো পনেরো দিন পড়িয়া থাকে। সংসারের বড় কষ্ট, সাত জনলোক এক এক বেলায় খায়, দুবেলায় চোদ্দো জন। যে কয়টি ধান আছে, তাহাতে কয় মাসযাইবে? সামান্য কিছু মুসুরি ছিল, তাহার বদলে চাল না লইলে চলে কি করিয়া! 

এই সব প্রজা, ইহাদের নিকট খাজনা আদায় করিয়া তাহাকে চাকুরি বজায় রাখিতেহইবে। অনাদিবাবুর চাকরি লইয়া সে মস্ত বড় ভুল করিয়াছে। এ সব জিনিস তাহার ধাতেনাই। বাবা কি করিয়া কাজ চালাইতেন সে জানে না, কিন্তু তাহার পক্ষে অসম্ভব। 

মানী ঠিক পরামর্শ দিয়াছে। 

ডাক্তারি শিখিতেই হইবে তাহাকে। ডাক্তারি শিখিলে এই সব গরিব লোকেরঅনেকখানি উপকার করিতেও তো পারিবে। 

এখানকার আর একজন প্রজার কাছে অনেকগুলি টাকার খাজনা বাকি। বিপিন সন্ধ্যারপরে তাহার বাড়ি তাগাদা দিতে গেল। গিয়া দেখিল, খড়ের ঘরের দাওয়ায় লোকটা শয্যাগত, মলিন লেপকাঁথা গায়ে দিয়া শুইয়া আছে। তিন-চারটি পাড়ার লোক নায়েববাবুর আগমনসংবাদ শুনিয়া বাড়ির উঠানে আসিয়া উপস্থিত হইল। রোগীর বিছানার পাশে দুইটি স্ত্রীলোক বসিয়া ছিল, বিপিনকে দেখিয়া ঘোমটা টানিয়া দিল। 

লোকটির নাম বিশু ঘোষ, জাতিতে কৈবর্ত্য। বিপিনকে সে অনেকবার দেখিয়াছে, কিন্তু বিপিন দাওয়ায় উঠিয়া বসিতেই তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, কে, ছিরাম? তামাক দে, ছিরাম খুড়োকে তামাক দে! 

বিপিন তো অবাক! পরে রোগীর চোখের দিকে চাহিয়া দেখিল, চোখ দুইটা জবাফুলেরমতো লাল। ঘোর বিকার। রোগী মানুষ চিনিতে পারিতেছে না। বিপিন বলিল, ওর মাথায় জলদাও। দেখছে কে? 

একজন উত্তর দিল, ফকির সায়েব দেখছেন। 

—কোথাকার ফকির সায়েব? ডাক্তার? 

—আজ্ঞে না, তিনি ঝাড়ফুঁক করেন খুব ভাল। তিনি বলেছেন, উপরিভাব হয়েছে। বিপিন বুঝিতে না পারিয়া বলিল, উপরিভাব কি ব্যাপার? 

দুই তিন জন বুঝাইয়া দিবার উৎসাহে একসঙ্গে বলিল, আজ্ঞে, এই দৃষ্টি হয়েছে আর কি, অপদেবতার দৃষ্টি হয়েছে! 

—ভূতে পেয়েছে? –ভূতে পাওয়া না ঠিক, দিষ্টি হয়েছে আর কি! 

বিপিনের যতটুকুডাক্তারি-বিদ্যা এই কয়দিন বই পড়িয়া হইয়াছে, তাহারই বলে সেবলিল, ওর ঘোর জ্বরবিকার হয়েছে। লোক চিনতে পারছে না, চোখ লাল, মাথায় জল ঢাল। উপরিভাব-টাব বাজে, ওকে ডাক্তার দেখাও, নইলে বাঁচবে না। ফকিরের কর্ম নয় এ সব। 

উহাদের মধ্যে একজন বলিল, এ দিগরে বরাবর থেকে ফকির সায়েব ঝাড়ান-ফাড়ান, তেলপড়া দিয়েই রোগ সারান বাবু। ডাক্তার কোথায় এখানে? ডাক্তার আছে সেই রামনগরের হাটে, নয়তো সেই চাকদার বাজারে। আর এক আছে রাণাঘাটে। দু কোশ রাস্তা। এক মুঠো টাকা খরচ করে কি গরিবোগুবরো লোকে ডাক্তার আনতি পারে? 

গদাধরপুর হইতে বিপিন যখন বাহির হইয়া ফাঁকা মাঠে পড়িল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াগিয়াছে। অন্ধকার রাত্রি, একটু পরেই চাঁদ উঠিবে। চাঁদ ওঠার জন্যই সে এতক্ষণ অপেক্ষাকরিতেছিল। 

মাঠে জনপ্রাণী নাই। অপূর্ব তারাভরা রাত্রি। আকাশের দিকে বিপিনের নজর পড়িত না, যদি চাঁদ কখন ওঠে, ইহা দেখিবার প্রয়োজন তাহার না হইত। কিন্তু আকাশের দিকে চাহিয়ানক্ষত্রভরা অন্ধকার আকাশের দৃশ্য দেখিয়া জীবন এই বোধ হয় প্রথম বিপিনের বড় ভাল লাগিল 

কেমন নিস্তব্ধতা, কেমন একটা রহস্যময় ভাব রাত্রির এই নিস্তব্ধতায়! এত ভাললাগিবার প্রধান কারণ, এই সময় মানীর কথা তাহার মনে পড়িল।। 

আজ যে এই সব দরিদ্র রোগপীড়িত মানুষদের সে চোখের উপর অজ্ঞতার ফলে মরণেরপথে অগ্রসর হইতে দেখিয়া আসিল, মানীই তাহাকে পথ দেখাইয়া বলিয়া দিয়াছে, ইহাদিগকে মৃত্যুর হাত হইতে কি করিয়া বাঁচাইতে হইবে। ডাক্তার নাই, ঔষধ নাই, সৎপরামর্শ দিবারমানুষ নাই, কঠিন সান্নিপাতিক বিকারের রোগী, সম্পূর্ণ অসহায়। জলপড়া, তেলপড়ার চিকিৎসাচলিতেছে। ওদিকে কামিনী-মাসির এই অবস্থা, তাহার ভাইয়ের ওই অবস্থা। 

মানী তাহাকে পথ দেখাইয়া দিয়াছে, যে পথে গেলে অর্থ ও পুণ্য দুইই মিলিবে। 

গরিব প্রজাদের প্রতি অত্যাচার করিয়া, তাহাদের রক্ত চুষিয়া তাহার বাবা এবং মানীরবাবা দুইজনেই ফুলিয়া ফাঁপিয়া মোটা হইয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের ছেলেমেয়েরা সে পাপ পথে চলিবে তো না-ই, বরং পিতৃদেবের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করিবে নিজেদের দিয়া। 

মানী তাহাকে জীবনের আলো দেখাইয়াছে। 

একটি অদ্ভুত মনের ভাবের সহিত বিপিনের পরিচয় ঘটিল আজ হঠাৎ এই মাঠের মধ্যে। 

মানীর সঙ্গে ভালবাসার যে সম্পর্ক তাহার গড়িয়া উঠিয়াছে, এতদিন অন্তত বিপিনের মনেরদিক হইতে তাহা দেহসম্পর্কহীন ছিল না, মনে মনে মানীর দেহকে সে বাদ দিতে পারে নাই।বিপিনের স্বভাবই তা নয়, সূক্ষ্ম মানসিক স্তরের আদানপ্রদান তাহার ধাতুগত নয়। মানীর সম্বন্ধে এ আশা বিপিন কখনও ছাড়ে নাই যে, একদিন না একদিন সে মানীকে নামাইবে তাহারনিজস্ব নিম্নস্তরে। সুবিধা সুযোগ এখন নাই বলিয়া ভবিষ্যতেও কি ঘটিবে না? 

আজ হঠাৎ তাহার মনে হইল, মানীর সহিত তাহার সম্বন্ধ অন্য ধরনের। মানী তাহাকে যে স্তরে লইয়া গিয়াছে, বিপিনের মন তাহার সহিত পরিচিত ছিল না। অনেক মেয়ের সঙ্গে বিপিন মিশিয়াছে পূর্বে অন্যভাবে। মন বলিয়া জিনিসের কারবার ছিল না সেখানে। হয়তো মনজিনিসটাই ছিল না সে ধরনের মেয়েদের। 

কিন্তু মনোরমা? বিপিন জানে না, মনোরমা মন সম্বন্ধে বিপিনের কখনও কৌতূহল জাগেনাই। তেমন ভাবে মনোরমার কখনও বিপিনের সঙ্গে মিশে নাই। হয়তো সেটা বিপিনের দোষ, মনোরমার মনকে বিপিন সে ভাবে চাহিয়াছে কবে? যে সোনার কঠিন স্পর্শে মনোরমা মনেরঘুম ভাঙিত, বিপিনের কাছে সে সোনার কাঠি ছিল না। 

বিপিনের মনের ঘুম ভাঙাইয়াছে মানী। সে সোনার কাঠি ছিল মানীর কাছে। 

দূর মাঠের প্রান্তে চাঁদ উঠিতেছে। বিপিন একটা খেজুরগাছের তলায় ঘাসের উপর বসিয়াপড়িল। ভারী ভাল লাগিতেছিল, কি যে হইয়াছে তাহার, কেন আজ এত ভাললাগিতেছে—এই আধো-অন্ধকার মাঠ, পুব-আকাশে উদীয়মান চন্দ্র, মাঠের মধ্যে ঝাড় ঝাড় সাদাআকন্দফুল, হুহু হাওয়া—কখনও তেমন ভাবে বিপিন এদিকে আকৃষ্ট হয় নাই, আজ যেন কিহইয়াছে তাহার।বলিতে লজ্জা করিলেও বলিতে হইবে, তাহাদের গ্রামের দোকানে সে সন্ধ্যার পরগোপনে তাড়ি পর্যন্ত খাইয়া দেখিয়াছে—কি রকম মজা হয়। এই বছর পাঁচ আগেও বাবা তখনঅল্পদিন মারা গিয়াছেন। হাতে কাঁচা পয়সা, বিপিন তখন খুব উড়িতেছে। অবশ্য কৌতূহলেরবশবর্তী হইয়াই খাইয়াছিল। খানিকটা বাহাদুরিও বটে। ভোলা ছুতারের ছেলে হাবুলের সহিতবাজি ফেলা হইয়াছিল। 

এ সব কথা বিপিনের আজ এমন করিয়া কেন মনে হইতেছে? 

সে মানীর বন্ধুত্বের উপযুক্ত নয়। নিজেকে ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া বিপিনের তাহাইমনে হইল। নিজেকে সে কলঙ্কিত করিয়াছে নানা ভাবে। মানী নিষ্পাপ নির্মল। 

বিপিন উঠিয়া পথ চলিতে লাগিল। বোধ হয় সে অপেক্ষা করিতেছিল, চাঁদ ভাল করিয়াউঠিবার জন্য। 

একটা নীচু খেজুরগাছে এক ভাঁড় খেজুর রস দেখিয়া সে ভাঁড় পাড়িয়া রস খাইল, সন্ধ্যায় টাটকা রস সাধারণত মেলে না। ভাঁড়টা আবার গাছে টাঙাইয়া রাখিবার সময় সে ভাঁড়টার মধ্যে দুইটি পয়সা রাখিয়া দিল। পল্লীগ্রামে এত ধার্মিক কেহ হয় না, কিন্তু আজ বিপিনের মনে হইল, চুরি সে করিতে পারিবে না। মানীর কাছে দাঁড়াইতে হইবে তাহাকে, চোরের বিবেক লইয়াদাঁড়াইতে পারিবে সেখানে? 

কাছারি ফিরিয়া দেখিল, ছোকরা চাকরটা তাহার জন্য বসিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে। 

বিপিন বলিল, এই ওঠ, উনুন ধরাগে যা। দুধ দিয়ে গিয়েছে এবেলা? 

চাকরটা চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, বাবা! কত রাত করে আলেন নায়ে বাবু! আমি বলি রাত্তিরি বুঝি থাকবেন সেখানে! 

—কামিনী-মাসি কেমন আছে রে? রাণাঘাট থেকে লেবু নিয়ে ফিরেছে কিনা জানিস?

—জানিনে বাবু। 

বিপিন আহারাদি শেষ করিয়া কামিনীকে দেখিতে গেল। 

বেশ জ্যোৎস্নাভরা রাত। কিন্তু গাঁয়ের লোক প্রায় সব ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, গোয়ালাপাড়ারমধ্যে কাহারও বড় একটা সাড়াশব্দ নাই। 

কামিনীর ঘরের দোর ভেজানো ছিল, ঠেলিতে খুলিয়া গেল। ঘরের মেঝেতে একটা পিলসুজের উপরে মাটির পিদিম টিমটিম জ্বলিতেছে, বোধ হয় পাঁচুর মা জ্বালিয়া রাখিয়া দিয়াগিয়াছে। রোগী কাঁথামুড়ি দিয়া একলাটি শুইয়া বোধহয় ঘুমাইতেছে। 

বিপিন ডাকিল, ও মাসি, কেমন আছ, ও মাসি? 

সাড়াশব্দ নাই। 

বিপিন বিছানার পাশে গিয়া বসিয়া বৃদ্ধার গায়ে হাত দিয়া দেখিল। নাড়ী দেখিয়া মনেহইল, নাড়ীর গতি খুব ক্ষীণ। খুব ঘাম হইতেছে, বিছানা ভিজিয়া গিয়াছে ঘামে। বৃদ্ধাঘুমাইতেছে, না ক্রমশ অবস্থা খারাপ হওয়ার দরুন জ্ঞানহারা হইয়া পড়িয়াছে, বোঝাও কঠিন। 

যাই হোক, অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিবার পরে কামিনী চোখ মেলিয়া বিপিনের দিকে চাহিল। কি যেন বলিল, বোঝা গেল না, ঠোঁট যেন নড়িল। 

বিপিন বলিল, কি মাসি, কেমন আছ? বলছ কিছু? 

কামিনীর জ্ঞান নাই। সে দৃষ্টিহীন নেত্রে বিপিনের দিকে চাহিল, ঘরের বাঁশের আড়ার দিকে চাহিল, আলনায় বাঁধা পুরানো লেপকাঁথার দিকে চাহিল। বৃদ্ধার এই ঘরে বিনোদ চাটুজ্জেনিয়মিত আসতেন, কামিনী তখন দেখিতে বেশ ফর্সা ও দোহারা চেহারার স্ত্রীলোক ছিল, কালাপেড়ে কাপড় পরিত, পান খাইয়া ঠোঁট রাঙা করিয়া রাখিত, হাতে সোনার বালা ও অনন্তপরিত, কালো চুলে খোঁপা বাঁধিত, এ কথা বিপিনের অল্প অল্প মনে আছে। বাইশ তেইশ বছরআগের কথা। এই যে বৃদ্ধা বিছানার সঙ্গে মিশিয়া শুইয়া আছে, মাথায় পাকা চুল, গায়ের রং হাজিয়া আধকালো, দাঁত পড়িয়া গালে টোল খাইয়া গিয়াছে, বিশেষত জ্বরে ভুগিয়া বর্তমানে তারকা রাক্ষসীর মতো চেহারা হইয়া উঠিয়াছে যাহার, এই যে সেই একদিনের হাস্যলাস্যময়ী সুন্দরী কামিনী, যাহার চটুল চাহনিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিনোদ চাটুজ্জে নায়েব মহাশয়ের মাথাঘুরিয়া গিয়াছিল, ইহাকে দেখিয়া কে বলিবে সে কথা? 

প্রথম যৌবনে দুইজনের দেখাশোনা হয়। কামিনী ছিল গোয়ালার মেয়ে—বালবিধবা, সুন্দরী। বিনোদ চাটুজ্জেও ছিলেন লম্বা-চওড়া জোয়ান, বড় বড় চোখ, গলার স্বর গম্ভীর ওভারী-পুরুষের মতো শক্ত-সমর্থ চেহারা। তা ছাড়া ছিল অসম্ভব দাপট। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বৎসরআগের কথা, তখন নায়ে বাবুই ছিলেনএ অঞ্চলের দারোগা, নায়েবাবুই ম্যাজিস্ট্রেট। 

কামিনী বিনোদ চাটুজ্জেকে ভালবাসিবে, এ বিচিত্র কথা কি? 

সারাজীবন একসঙ্গে যাহার সহিত কাটাইয়া, নিজের উজ্জ্বল যৌবন যাহাকে দান করিয়াকামিনী নারীজন্মের সার্থকতাকে বুঝিয়াছিল, সেই বিনোদ চাটুজ্জের অভাবে তাহার জীবন শূন্যহইয়া পড়িবে ইহাও বিচিত্র কথা নয়। 

হয়তো এইমাত্র জ্বরঘোরে অজ্ঞান অচৈতন্য কামিনীর মন ঘুরিয়া ফিরিতেছিল তাহার প্রথম যৌবনের সেই পাখি-ডাকা, ফুল-ফোটা, আলো-মাখা মাধবী রাত্রির প্রহরগুলি অনুসন্ধান করিয়া, আবার মনে মনে সেখানে বাস করিয়া হারানো রাত্রির শিশিরসিক্ত স্মৃতির পুনরুদ্বোধনকরিয়া। 

হয়তো মনে পড়িতেছিল প্রথম দিনের সেই ছবিটি। 

ষোড়শী বালিকা তাহাদের বাড়ির সামনের বেগুন ক্ষেত হইতে ছোট্ট চুপড়ি করিয়াবেগুন তুলিয়া ফিরিতেছিল। 

পথে আসিতেছিল যুবক বিনোদ চাটুজ্জে, ধোপাখালি কাছারির নায়েব, ধোপাখালি গ্রামেরদণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সবাই বলাবলি করিত, নায়েবাবুর কাছে গেলে সব জব্দ হয়ে যাবে এখন!নায়েব এসেছে যা জবর! কোনো ট্যাঁ-ফোঁ খাটবে না সেখানে! নায়েবের মতো নায়েব! 

সে কৌতূহলের সহিত চাহিয়া দেখিল, বেশ মনে আছে, বেগুনের ক্ষেতের কঞ্চি-বাঁধা আগড়ের কাছে দাঁড়াইয়া। 

লম্বা, সুপুরুষ টকটকে ফর্সা, মাথায় ঢেউ-খেলানো কালো চুল—তবে বয়স খুব কম নয়, ত্রিশ-বত্রিশ হইবে, কিংবা তারও কিছু বেশি। 

নায়েববাবু যখন কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছেন, তাহার তখন বড় লজ্জা হইল। বাঁ হাতে বেগুনের চুপড়িটা, ডানহাতে কঞ্চির আগড়টা শক্ত করিয়া ধরিয়া রহিল। 

হঠাৎ বিনোদ চাটুজ্জে তাহারই দিকে মুখ ফিরাইয়া চাহিলেন। 

—বেগুন ওতে? এ কাদের ক্ষেত? সে লজ্জায় সঙ্কোচে বেড়ার সহিত মিশিয়া কোনোরকমে উত্তর দিল, আমাদের ক্ষেত। —তুমি কি রসিক ঘোষের মেয়ে? 

—হ্যাঁ। 

—বেগুন কি বিক্রি করো তোমরা? 

—না, এ খাবার বেগুন। 

—তোমার বাবা কোথায়? 

—চিলেমারি দুধ আনতে গেছে। 

—ও। 

নায়েববাবু চলিয়া গেলেন। 

তাহার বুক ঢিপঢিপ করিতেছিল। কপাল ঘামিয়া উঠিয়াছে। ভয় না লজ্জা, কে জানে!বাড়ি আসিয়া দিদিমাকে (মা তাহার আগের বছর মারা গিয়াছিল) বলিল, আইমা, ওই বুঝিকাছারির নতুন নায়েব? যাচ্ছিলেন এখান দিয়ে, আমার কাছে বেগুন দেখে বললেন, বেগুনবিক্রির? কি জাত, আইমা? 

তাহার দিদিমা বলিল, বামুন যে, তাও জানো না পোড়ারমুখো মেয়ে! চাইলেন কিনতে, বেগুন ক’টা দিয়ে দিলেই হত। আমার তো মনে থাকে না, তোর বাবাকে বেগুন দিয়ে আসতে বলিস কাছারিতে। বামুন মানুষ 

এক চুপড়ি ভাল কচি বেগুন ও এক ঘটি দুধ সে-ই কাছারিতে দিয়া আসিয়াছিল। পরদিনবিকেলবেলা বাবার সঙ্গে গিয়াছিল। 

কিন্তু হায়! সে প্রেমমুগ্ধা তরুণী পল্লীবালিকা আর নাই, সে সুপুরুষ বিনোদ চাটুজ্জে নায়েবাবুও আর নাই। 

অনেক কালের কথা এ সব। সেকালের কথা। 

বিপিন পড়িল মহা মুশকিলে। 

কামিনী যখন মারা গেল, তখন রাত দেড়টার কম নয়। মৃতদেহ ফেলিয়াই বা কোথায় সেযায় কেন? বাধ্য হইয়া ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করিতেই হইল। বৃদ্ধার মৃতদেহ এ ভাবে ফেলিয়া সে যাইতে পারিবে না, মনে মনে সে মায়ের মতোই ভালবাসিত কামিনীকে। ভোর হইল। কাককোকিল ডাকিয়া উঠিতেই বিপিন গিয়া হাঁকডাক করিয়া লোকজন উঠাইল। পাঁচু কাল অনেকরাত্রে রাণাঘাট হইতে কমলালেবু লইয়া ফিরিয়াছিল, সকালে দিতে আসিতেছিল, পথে দেখা।তাহাকে পাঠাইয়া ওপাড়া হইতে গোয়ালার পুরোহিত বামনদাস চক্কত্তিকে আনাইল। এসবপাড়াগাঁয়ে ‘প্রাচিত্তির’ না করাইলে মড়া কেহ ছুঁইবে না, বিপিন জানে। কামিনীর আপনার বলিতেকেহ ছিল না, দূর-সম্পর্কের এক বোনপো আছে রাণাঘাটে, তাহাকে খবর দিবার জন্য লোকপাঠাইল। তাহাকে দিয়াই শ্রাদ্ধ করাইতে হইবে। সব কাজ শেষ করাইয়া দাহ করিতে বেলা একটা বাজিল। 

কাছারি ফিরিয়া দেখিল, পলাশপুর হইতে জমিদারবাবুর পত্র লইয়া লোক আসিয়া বসিয়াআছে। নানারকমের কাজের তাগাদা চিঠির মধ্যে, বিশেষ করিয়া টাকার তাগাদা–ত্রিশটি টাকাএই লোকের হাতে যেন আজ‍ই পাঠানো হয়। 

লোকটাকে বিপিন বলিল, আজ কাছারিতে থাক। এখন টাকা অবেলায় কোথায় পাব? কাল যাবে। দেখি, নরহরি দাসকে বলে। 

লোকটা আর একখানি ক্ষুদ্র খামের চিঠি বাহির করিয়া বিপিনের হাতে দিয়া বলিল, মনেছেল না নায়েববাবু, দিদিমণি এই চিঠিখানা আপনাকে দিতে বলেছেলেন। আমি যখন আসি, খিড়কি-দোরের পথে এসে দিয়ে গেলেন। 

মানীর চিঠি! কখনও তো সে বিপিনকে চিঠি দেয় নাই! কি লিখিয়াছে মানী? বিপিননিজেকে সামলাইয়া লইয়া যতদূর সম্ভব উদাসীন মুখে বলিল, ও, বোধ হয় বড় মাছ চাই!বাবাকে লুকিয়েমাঝে মাঝে মাছ চেয়ে পাঠায় বটে! আচ্ছা, তুমি ততক্ষণ বিশ্রাম করো। 

বাদামতলায় দাঁড়াইয়া মানীর চিঠি খুলিয়া পড়িল। ছোট্ট চিঠি। লেখা আছে— 

“বিপিনদা, 

প্রণাম নেবে। অনেকদিন গিয়েছ, আদায়পত্র কেমন হচ্ছে! নায়েবির কাজে যেন গলদ না হয়, তাগাদাপত্রঠিকমতো হচ্ছে তো? নইলে কৈফিয়ত তলব করব, মনে থাকে যেন। আমিওজমিদারের মেয়ে। 

আর একটি বিশেষ কথা। আমি এই মাসেই চলে যাব, আমার ছোট দেওরের বিয়ের হঠাৎ ঠিক হয়েছে। যাবার আগে তুমি অবিশ্যি একবার এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবে।একবার এসেই না হয় চলে যেও, কিন্তু আসা 

চাই-ই। আবার কবে আসব, তার ঠিকানা নেই।চিঠির কথা কাউকে বল না। 

ইতি – 

মানী” 

 

পরদিন অনাদিবাবুর লোক বিপিনের একখানা চিঠি লইয়া চলিয়া গেল, তাহাতে বিপিন লিখিল, টাকা আদায় হইলেই কাল কিংবা পরশু নাগাদ সে নিজে লইয়া যাইতেছে। মানীর সঙ্গে দেখা করিবার এই উত্তম সুযোগ। 

সন্ধ্যা হইল। বাদামগাছের পাতায় হাওয়া লাগিয়া একপ্রকার শব্দ হইতেছে। অন্ধকাররাত্রি, জ্যোৎস্না উঠিবার দেরি আছে। 

কামিনীর মৃত্যু বিপিনের মনে বিষাদের রেখাপাত করিয়াছে, পুরাতন দিনের সঙ্গে ওইএকটি যোগসূত্র ছিন্ন হইয়া গেল চিরকালের জন্য। 

আজ তাহার মনে হইল, এই প্রবাসে বৃদ্ধা তাহার সুখদুঃখ যত বুঝিত, এত আর কেবুঝিত? তাহার খাওয়ার কষ্ট, শোওয়ার কষ্ট হইলে কামিনীর মনে তাহা বাজিত, সাধ্যমতোচেষ্টা করিত সে কষ্ট দূর করিতে। টাকার দরকার হইলে বিপিন যদি হাত পাতিত, কামিনী তাহাকে বিমুখ করিত না কখনও। গতবার যে পঞ্চাশটি টাকা সে ধার দিয়াছিল বিপিন একবারদুইবার চাওয়ামাত্র, সে দেনা বিপিন শোধ করে নাই। পুত্রহীনা বৃদ্ধা তাহাকে সন্তানের মতোইস্নেহ করিত 

তাহার বাবার কথা উঠিলে বৃদ্ধা আর কোনো কথা বলিতে ভালবাসিত না। কতবার এ ব্যাপার বিপিন লক্ষ্য করিয়াছে। তরুণ মনের স্পর্ধিত ঔদাসীন্যে হয়তো বিপিন এই ব্যাপারে কৌতুকই অনুভব করিয়া আসিয়াছে বরাবর, আজ তাহার মনে হইতেছে, বৃদ্ধা কি ভালই বাসিত তাহার স্বর্গগত পিতা বিনোদ চাটুজ্জেকে! আগে যাহা সে বুঝিত না, আজকাল তাহা সে ভালকরিয়াই বোঝে। মানী তাহার চোখ খুলিয়া দিয়াছে নানা দিকে। 

অথচ আশ্চর্য এই যে, মানীকে সে কখনও এ ভাবে দেখে নাই। এই কয় মাসে যে মানীকেসে দেখিতেছে, সে কোন মানী? ছেলেবেলার সাথী সেই মানী কিন্তু এ নয়। বালক-বালিকাহিসাবে সে খেলা তো বিপিন অনেক মেয়ের সঙ্গেই করিয়াছে; অন্য পাঁচটা ছেলেবেলার সঙ্গিনীমেয়ের সহিত যেমন ভাব হয়, মানীর সহিত তাহার বেশি কিছু হয় নাই, এ কথা বিপিন বেশজানে। 

মধ্যে সে হইয়া গিয়াছিল জমিদার অনাদিবাবুর মেয়ে সুলতা। 

তখন কলিকাতায় থাকিয়া কোনো মেয়ে-স্কুলে মানী পড়িত। খুব সম্ভব ম্যাট্রিক পাসওকরিয়াছিল—সেকথা বিপিন ঠিকমতো জানে না; বাবা মারা গিয়াছেন তখন, বিপিন আর পলাশপুরে জমিদারবাটীতে আসে নাই। 

তবে সুলতার কথা মাঝে মাঝে বিপিনের মনে পড়িত—বাল্যপ্রীতির দিক দিয়া নয়, সুলতা সুন্দরী মেয়ে এইজন্য। না জানি সে এতদিনে কেমন সুন্দরী হইয়া উঠিয়াছে! সেই সুন্দরী সুলতা আবার ‘মানী’ হইয়া দেখা দিন তো সেদিন! 

টাকা যোগাড় করিতে পারিলেই পলাশপুর জমিদারের বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু এখনওএমন টাকা যোগাড় হয় নাই, যাহা হাতে করিয়া সেখানে যাওয়া চলে। এদিকে বেশি দেরীহইলে যদি মানী চলিয়া যায়! 

কামিনী মাসি থাকিলে এসব সময়ে সাহায্য করিত। 

উপায় অন্য কিছু না দেখিয়া নরহরি মুচিকে সন্ধ্যার পর ডাকিয়া পাঠাইল। নরহরি আসিয়াপ্রণাম করিয়া বলিল, লায়েব মশাই, কি জন্যি ডেকেচ? দণ্ডবৎ হই। 

—এসো নরহরি, বসো। গোটা কুড়ি টাকা কাল যেখান থেকে পারো দিতে হবেই। জমিদারবাবু চেয়েছেন, নিয়ে যেতে হবে। 

নরহরি চিন্তিত মুখে বলিল, তাই তো, বিষম হ্যাঙ্গনামায় ফ্যাললেন যে! কুড়ি টাকা এখন কোথায় পাই? আচ্ছা দেখি। কাল বেবেলা এস্তক যদি যোগাড়যন্তর করতে পারি, তবে সে কথা বলব। হ্যাঁ, একটা কথা বলি লায়েব মশাই— 

— কি? 

—কামিনী পিসির কিছু টাকা ছেল। সিন্দুক-প্যাঁটরা খুলে দেখেছেলেন? ওর বেশ টাকাছেল হাতে, আমরা যদ্দুর জানি। আপনি তো সে রাত্তিরি ওর কাছে ছেলেন, আপনাকে কিছুবলে যায়নি? 

বিপিনের এ কথা বাস্তবিকই মনে হয় না। কামিনীর টাকা ছিল, সে শুনিয়াছে বটে; কিন্তু তাহার মৃত্যুর সময়ে বা তাহার পরে এ কথা বিপিনের মনে উদয় হয় নাই যে, তাহার টাকাগুলি কোথায় রহিল বা সে টাকার কি ব্যবস্থা কামিনী করিতে চায়! 

আর যদি থাকেই টাকা, তাহাতেই বা বিপিনের কি? কামিনী বিপিনের নামে উইল করিয়া দিয়া যায় নাই, সুতরাং অত গরজ নাই বিপিনের কামিনীর টাকা কোথায় গেল তাহা জানিতে। মুখে বলিল, ছিল বলে জানতাম বটে, তবে আমায় কিছু বলে যায়নি। কেন বলো তো? 

কথাটা বলিয়াই বুঝিল নরহরি যে প্রশ্ন করিয়াছে, তাহার বিশেষ অর্থ আছে। নরহরি বৃদ্ধব্যক্তি, তাহার বাবার সঙ্গে কামিনীর সম্পর্ক যে কি ছিল, এ গ্রামের বৃদ্ধ লোকেরা সবাই জানে।কামিনীর টাকার যদি কেহ ন্যায্য ওয়ারিশন থাকে, তবে সে বিপিন। সেই বিপিন কামিনীরমৃত্যুর সময়ে উপস্থিত ছিল অথচ টাকার কথা সে কিছু জানে না, পাড়াগাঁয়ে ইহা কে বিশ্বাসকরিবে? 

—কামিনীর বাড়িডায় ভাল চাবিতালা লাগিয়ে দেবেন, লায়েব মশাই। রাতবিরেতের কাণ্ড, পাড়াগাঁ জায়গা— কখন কি হয়, কার মনে কি আছে, বলা তো যায় না! আচ্ছা, কালআসব বেবেলা। এখন যাই। 

নরহরি চলিয়া গেলে বিপিন কথাটা ভাবিল। সিন্দুক তোরঙ্গ একবার ভাল করিয়া খুঁজিয়াদেখিবে। টাকাকড়ি এ সময় পাইলে কিছু সুবিধা ছিল বটে। কিন্তু বাক্স ভাঙ্গিয়া টাকা হাতড়াইতেগেলে শেষে কি একটা হাঙ্গামায় পড়িয়া যাইবে! যদি কামিনীর কোনো দূর-সম্পর্কের ভাসুরপোবাহির হইয়া পড়ে, তখন? না, সে দরকার নাই। বরং মানীর সঙ্গে পরামর্শ করা যাইবে। তার কিমত জানিয়া তবে যাহা হয় করিলে চলিবে। 

সন্ধ্যাবেলা একা বসিয়া একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিল বিপিনের জীবনে। 

বিপিন কখনও কাহারো জন্য চোখের জল ফেলে নাই। সে এই দিক দিয়া বেশ একটুকঠোর প্রকৃতির মানুষ, কথায় কথায় চোখের জল ফেলিবার মতো নরম মন নয় তাহার। আজহঠাৎ একা বসিয়া কামিনীর কথা ভাবিতে ভাবিতে তাহার অজ্ঞাতসারে চোখ দিয়া জল গড়াইয়াপড়িল। মনে মনে সে একটু লজ্জিত হইয়া উঠিয়া কোঁচার কাপড় দিয়া জল মুছিয়া ফেলিল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহা ভাবিয়াও আশ্চর্য হইল, কামিনী মাসিকে সে এতখানি ভালবাসিত! 

আজ সে স্নেহময়ী বৃদ্ধা নাই, যে দুধের বাটি, কি লাউটা শসাটা হাতে আসিয়া তাহাকে খাওয়াইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিবে, দুটা মিষ্ট কথা বলিবে! 

নিঃসঙ্গ ঘরের রোগশয্যায় একা মরিল, কেহ আপনার জন ছিল না যে একটু মুখে জল।দেয়। 

কে জানে, তাহার পিতা স্বর্গগত বিনোদ চাটুজ্জে পুরাতন বন্ধুর মৃত্যুপার্শ্বে অদৃশ্য চরণেআসিয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন কিনা? 

বুড়ি ভালবাসা কাহাকে বলে জানিত। বিনোদ চাটুজ্জে মহাশয় পরলোকগমন করিলে পরআর সে ভাল করিয়া হাসে নাই, ভাল করিয়া আনন্দ পায় নাই জীবনে। 

তাহাকে ছুটিয়া দেখিতে আসিত এইজন্য যে, তাহার মুখে-চোখে হাবে-ভাবে স্বর্গীয়নায়েব মহাশয়ের অনেকখানি ফুটিয়া বাহির হয়। কর্তা মহাশয়েরই ছেলে, কর্তা মহাশয়েরতরুণ প্রতিনিধি। তাহার সঙ্গে দুইটা কথা কহিয়াও সুখ। 

আজ সে বোঝে, এই যে মানীর সম্বন্ধে কথা বলিতে তাহার ইচ্ছা হয়, কাহারও সঙ্গেঅন্তত কিছুক্ষণ সেকথা বলিয়াও সুখ, না বলিলে মন হাঁপাইয়া উঠে। দেখা তো হইতেছেই না, তাহার উপর তাহার সম্বন্ধে কথা না বলিলে কি করিয়া টিকিয়া থাকা যায়—এরকম তো কামিনী মাসিরও হইত তাহার বাবার সম্বন্ধে! 

অভাগিনী যে আনন্দ হয়তো পায় নাই প্রথম জীবনে, বিনোদ চাটুজ্জে নায়েব মহাশয়েরসাহচর্যে তাহা সে পাইয়াছিল। তাহার বঞ্চিতা নারী-হৃদয়ের সবটুকুকৃতজ্ঞতা প্রেমের আকারেঢালিয়া দিয়াছিল তাই নায়েব মহাশয়ের চরণযুগলে। কি পাইয়াছিল, কি না পাইয়াছিল, আজতাহা কে বুঝিবে? ত্রিশ বছর পরে কে বুঝিবে মানী তাহার জীবনে কি অমৃত পরিবেশন করিয়াছিল একদিন? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *