পাকদণ্ডী – ২.১৫

॥ ১৫ ॥

১৯৬৩ সালে আমার বয়স ছিল ৫৫। সেকালের ঐ বয়সে লোককে অকেজো মনে করে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হত। অথচ আমার মনে হয় অধিকাংশ কাজের মানুষদের কর্মক্ষমতার ঐ সময়েই হয় চরম বিকাশ, শরীরে সাধারণত এত আগে বার্ধক্য বাসা বাঁধে না; অথচ যৌবনের অনিশ্চয়তা থিতিয়ে পড়ে; অভিজ্ঞতা যথেষ্ট পরিমাণে অর্জন হয়, সুবুদ্ধির বিকাশ দেখা যায়; মনটা স্বাভাবিক ভাবে সদয় ও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। এ সব গুণের জন্যে শারীরিক শক্তির হ্রাস অনেকখানি মিটে যায়। তাছাড়া, শিক্ষিত মানুষের বাহুবলের চেয়েও মনোবল, বুদ্ধিবলই সাধারণত বেশি কাজে লাগে। আর ঠিক তখনই তাদের বরখাস্ত করে দেওয়া হয়। এ কথা যতই মনে হত, ততই আশ্চর্য লাগত।

সৃজনশীল কাজেও ঐ নিয়মই খাটা উচিত ছিল। দুঃখের বিষয়, অনেক সময় কম বয়সে অনেক গুণী সাংসারিক তাড়নায় নিজেদের একেবারে উজাড় করে দেউলে হয়ে যান। হাত থেকে যখন শ্রেষ্ঠ কাজ বেরোবার কথা, হাত তখন ক্লান্ত হয়ে এসেছে। আমার বেলায় এর উল্টোটি হয়েছিল। বহু বছর নানা কাজে নিজেকে নিবিষ্ট করে রেখেছিলাম, সাহিত্যরচনা ছিল শখের ব্যাপার। তাকে ভালো করে রাখতেও পারতাম না, ছাড়তেও পারতাম না। অবনীন্দ্রনাথ মনের পুঁজির কথা বলতেন। আমিও ছোটবেলা থেকে আমার সব গভীর অনুভূতিগুলোকে মনের মধ্যে জমা করে রেখেছি। এখন পর্যন্ত চোখ বুজলেই ছোটবেলাকার সেই নীল আকাশের বুকে গাঢ় সবুজ পাহাড়ের সারি, সরল গাছের ঝুলো পাতার ফাঁকে বাতাস বওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দ দেখতে পাই, শুনতে পাই। নাকে আসে ধূপ কাঠের ধুনো-ধুনো গন্ধ। ছোট ছোট দৃশ্য, ছোট ছোট কথা হয়তো ষাট-সত্তর বছর কানে লেগে আছে। শিলং-এর সেরেস্তার এক দপ্তুরি নাকি ধর্মভাবাপন্ন হয়ে ব্রাহ্ম হয়েছিল। তার একটি মা-মরা ছোট ছেলে ছিল। তার নাম গোবিন্দ। সে তিন সাইজের বড় জামা-পাজামা পরত। তার চোখে বিশ্বের সমস্ত বিষাদ মাখানো ছিল। একবার কি কাজে ভুল করেছিল বলে ঝিনুক দিয়ে সৎ-মা তার গাল ছিঁড়ে দিয়েছিল। আজ পর্যন্ত গোবিন্দর ছেঁড়া গাল আর সজল চোখ ভুলতে পারি না। আশা করি বিধাতা তাকে পরে আরাম দিয়েছিলেন, সুখ দিয়েছিলেন।

এত দিনে ছোটদের বড়দের জন্য অজস্র ছোট গল্প লিখেছিলাম। সেগুলি নানা বই হয়ে, নানা প্রকাশকের হাতে বেরিয়েছিল। তাতে খুব যে একটা বড়লোক হয়ে গেছিলাম, তাও নয়। কিন্তু মনে মনে কেমন একটা আরাম পেয়েছিলাম। আগেও বলেছি ছোট গল্প মনের মাটিতে আপনি জন্মায়। বড় জোর তাকে খানিকটা ঘষা-মাজা করা যায়। কিন্তু ভালো গল্প কোনো নির্দিষ্ট মালমশলা দিয়ে চেষ্টা-কৃত হবার নয়। আপনি হল তো হল, নইলে না লেখাই ভালো। প্রেমেনবাবু একবার কোনো নামকরা বিদেশী সাহিত্যিকের উক্তির কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে যৌবন হল ছোট গল্প লেখার বয়স। ৪৫-এর পর কেউ যেন ছোট গল্প লিখতে চেষ্টা না করে। আমার কিন্তু মনে হয় চেষ্টা করে লিখবার জিনিসই নয় ছোট গল্প। সে মাটিতে ফুলের মতো, আকাশে তারার মত ফোটে। তার বয়স ধরে দিলে মুশকিল। আমার খুব অসুবিধা হবে। আমি এখনো সারা বছরে বেশ কিছু ছোট গল্প লিখি। নিয়ম করেছি প্রতি পুজোয় ১০টা ছোট গল্প লিখব। তার বেশি লিখতে গেলে কষ্ট-কল্পিত হবে। মাঝে মধ্যে অনুরোধে পড়ে, তাও লিখেছি। দ্বিতীয় শ্রেণীর জিনিস। পূজা সংখ্যায় উপন্যাস কখনো লিখি না।

উপন্যাস বরং অনেক দিন ধরে, ভেবে চিন্তে, মাল-সামগ্রী সংগ্রহ করে গড়ে তোলা যায়। তবে অনেক সময় উপন্যাসের মূল বক্তব্যটিও বিদ্যুতের মতো মনের মধ্যে ঝলসে ওঠে। হয়তো লেখা হয় অনেক পরে।

১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এর মধ্যে লেখা আমার প্রকাশিত বইয়ের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। মনে আছে ঐ সময়ের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বানে সে বছরের লীলা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। অবনীন্দ্রনাথের লেখা ও ছবির বিষয়ে। তিনটি বক্তৃতা। আশুতোষ বিল্ডিং-এর যে ঘরটিকে আমরা লাইব্রেরি বলতাম, সেই ঘরে। বোধ হয় শ্রীপ্রমথ বিশী সভাপতিত্ব করেছিলেন। ঘরে যত লোক ধরে, তার অর্ধেক হয়েছিল। প্রিয় বন্ধু শিল্পী প্রশান্ত রায় এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে অবনীন্দ্রনাথ যখন মূল বাগেশ্বরী বক্তৃতা দিতেন, তখন আরো কম শ্রোতা উপস্থিত থাকত। ঐ বক্তৃতার সঙ্গে কিছু সংযোজন করে দেবার পর, বিশ্বভারতী থেকে বক্তৃতাগুলি বই হয়ে প্রকাশ পায়। কোন বছরে এসব হয়েছিল মনে নেই।

এর কিছুদিন পরে হয়তো ১৯৬৭ সালে ঐ একই জায়গায় শরৎচন্দ্র স্মৃতি বক্তৃতা দিয়েছিলাম সুকুমার রায়ের সাহিত্য রচনা বিষয়ে। এ বই প্রকাশ করেছিলেন মিত্র ঘোষ। পরে আমার রচনাবলীর ৩য় খণ্ডে সম্বলিত হয়েছে। আরো অনেক তথ্য দেওয়া উচিত ছিল বলে মন খুঁৎ-খুঁৎ করে। কোনো সময়ে ওটির পুনর্লিখন করার ইচ্ছা আছে। বই করার সময়ে তথ্যের অপ্রাচুর্যের জন্য। প্রকাশকরা সুকুমারের রচনা থেকে রাশি রাশি অপূর্ব উদাহরণ জুড়ে দিয়েছেন। তাতে আমার সাহিত্য খ্যাতি একটুও বাড়েনি। মনে হয় ৪৫ মিনিট ব্যাপী তিনটি বক্তৃতা দিয়ে ঐ মানুষটির প্রতি সুবিচার করা যায় না।

অবনীন্দ্রনাথের বাগেশ্বরী প্রবন্ধমালার আগাগোড়া ইংরিজি করেছি। বেশ কিছু বছর ধরে। তবে আমার জীবনকালে প্রকাশক পাব বলে আশা করি না। এই তো গেল গভীর বিষয়ে গভীর চিন্তার কথা। এ ছাড়া গল্পের বইও কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছিল। শ্রী প্রকাশ ভবন থেকে ‘ছোটদের ভালো ভালো গল্প’-এর দুটি মুদ্রণ হয়ে, মনে হয় বন্ধ হয়ে গেছে। ‘বাঘের চোখ’ হয়তো ১৯৫৯ সালে বেরিয়েছিল। ‘গুণ পণ্ডিতের গুণপনা’ ১৯৬৬ সালে। ছোট ছোট অস্থায়ী প্রকাশনালয়ের সুন্দর বই দুটি। এখন দুষ্প্রাপ্য।

ঐ বছর ‘হট্টমালার দেশে’ পুস্তকাকারে বেরোল। প্রেমেনবাবুর সঙ্গে যুগ্ম প্রচেষ্টা। সে এক মজার গল্প। তখন তিনি নিয়মিত প্রযোজকের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তবে পরিদর্শক হিসাবে মাঝে মধ্যে আসেন। সন্দেশের যুগ্ম-সম্পাদক হয়েছি, কি তখনো হইনি। তা সন্দেশের জন্য একটা বড় গল্প চেয়ে বসলাম। প্রেমেনবাবু আকাশ থেকে পড়লেন, যেন এমন অবুঝের মতো কথা জন্মে শোনেননি। শেষটা বললেন, ‘নতুন কিছু দিতে টিতে পারব না। তবে একটা শুরু করেছিলাম রং মশালের যুগে, তার গুটি তিন অধ্যায় হয়েছে। ঐটে নিয়ে শেষ করে নিন না। আমিও সাহয্য করব।’ বলা বাহুল্য তাতেই রাজি হলাম। কপিগুলি পাঠিয়ে দিলেন। সত্যি বলব গোড়ায় খুব একটা উৎসাহী হইনি। ২০-২৫ বছর আগেকার অসমাপ্ত গল্প। তাও আবার আমাকে লিখতে হবে! কিন্তু পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি অবাক! ওঁকে ধরলাম, ‘আমি না হয় লিখছি, কিন্তু শেষটা কি হল বলে দেবেন তো?’

প্রেমেনবাবু বললেন, ‘তাই যদি মনে থাকবে তবে আর আপনাকে দিয়ে লেখাবার তালে আছি কেন?’ সত্যিই বলতে পারলেন না। অগত্যা ঐ গল্পের একমাত্র পরিণাম যা হতে পারে, তাই লিখে ফেললাম। উনিও খুব খুশি! ঐ বইয়ের নতুন সংস্করণ সম্প্রতি ‘অন্য ধারা’ নামক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। দুই জাত চোরের গল্প। শেষটা তারা—নাঃ, থাক, রসভঙ্গ করতে নেই।

কলের পুতুল ‘মাকু’র গল্প সন্দেশে ধারাবাহিক ভাবে বেরোল। পরে ১৯৬৯ সালে নিউ স্ক্রিপ্ট থেকে বই-ও হল। ‘নেপোর বই’-ও সন্দেশে বেরোল ধারাবাহিক ভাবে। মিত্র ঘোষ পুস্তকাকারে ছাপলেন। বেড়ালীয় ব্যাপার। খুব রসের।

এবার হাসির কথা রাখি। ১৯৬৫ সালে আমার সবার ছোট ভাই যতিরঞ্জনের ৪৯ বছর বয়সে মৃত্যুর পর মনের মধ্যে প্রচণ্ড একটা আঘাত লাগল। সংসারে সুখী হবার সব উপকরণ তার ছিল। রূপ, গুণ, বিদ্যা, ভালোবাসা, কর্মক্ষেত্রে সাফল্য। কিন্তু আসলে ও সব কিছু নয়। ১৯৫৪ সালে ওর স্ত্রী ওর প্রাণপ্রিয় ছেলে দুটিকে নিয়ে বিদেশে চলে গেল। ওর জীবনে সুখের সামগ্রী কিছু বাকি রইল না। কাজ-কর্ম, অন্য ভালোবাসা দিয়ে সে ফাঁক ভরাবার চেষ্টাও করল না। সকলের কাছ থেকে মনটাকে সরিয়ে রাখত। বাইরে মেলামেশা, বাড়িতে লোক আসা সবই করত। প্রার্থীকে কখনো ফেরাত না। বলত দুঃখীর আবার যোগ্য-অযোগ্য কি? সামান্য কারণে বড় বেশি আহত হত। শেষটা একদিন বলেছিলাম, ‘ডিভোর্স যখন হয়েই গেছে, ছেলেদের আনাবে না?’ বলেছিল, ‘মার কাছ থেকে ছেলে ছিনিয়ে আনার মতো নিষ্ঠুরতা হয় না।’ এমনি করে দশ বছর কাটল, তারপর ১৯৬৫ সালে হৃদ্‌রোগে মারা গেল। হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে। দু-পাশে দু-জন দীন-দরিদ্র রুগীর মধ্যিখানে শুয়ে। তাই হয়তো সে চাইত। চোখের সামনে রাখবার জন্য ক্যাবিনে রাখেননি ডাক্তার। এই একটা আঘাত আমি কিছুতেই জয় করতে পারিনি। তার কথা মনে হলেই বুকটা আজ পর্যন্ত টন্‌টন্ করে। কত রূপ, কত গুণ, কত সাফল্য, কিন্তু ভাগ্যে সুখ ছিল না।

কষ্ট হলে কাঁদতে পারি না আমি। অন্তরের অন্তঃস্তলে কোথায় একটা ঘট রাখা আছে, সব চোখের জল সেইখানে জমা হয়। তবে ছোটবেলার স্মৃতিগুলো হঠাৎ কেমন সজাগ সচেতন হয়ে উঠল। মনে আর কিছুতেই শান্তি পাই না। সেই সময় আমার প্রিয় বন্ধু গজেন মিত্র একদিন বললেন—‘যা মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলুন। আমি কথাসাহিত্যে ধারাবাহিক ভাবে ছাপি।’ তাই করলাম। মনটা হাল্কা হল। পরের বছর ঐ বই রবীন্দ্র-পুরস্কার পেল। তখন আজকালের মতো আনুষ্ঠানিক ভাবে পুরস্কার দেওয়া হত না। মনে আছে তখনকার শিক্ষাবিভাগের বিশিষ্ট কর্মী আমার স্নেহভাজন অমিয় সেন, ঠিক কাগজে মোড়া এক বাক্স সন্দেশের মতো করে নোটের তোড়া বেঁধে, আমাদের চৌরঙ্গীর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে গেছিল। আজ সে-ও নেই। সে রাত্রি খুব দুঃখে কেটে ছিল। কেবল মনে পড়ছিল যতু আমার সুখে সুখী দুঃখে দুঃখী ছিল। ১৯৬৩ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি থেকে পুরস্কার নিয়ে যেদিন সকালে দিল্লি থেকে ফিরলাম, সে দিন বিকেলে কথা নেই, বার্তা নেই, আরো কয়েকটি প্রিয়জনকে জুটিয়ে এনে, যতু আমাদের নানা রকম ভালো ভালো খাবার খাইয়েছিল। ভাবি কাকে সুখ বলে, কাকে দুঃখ বলে বুঝতে পারি না। বুকের মধ্যে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে।

ঐ টাকাগুলোও আকাদেমি পুরস্কারের টাকার মত আমাদের কলকাতার বাড়ি-তৈরির কাজে ঢেলে দিয়েছিলাম। আমার স্বামীর আপত্তিতে কান দিইনি। বাড়িটাকে অনেক যত্ন নিয়ে করেছিলাম। তবে অক্ষমতার ত্রুটি থেকে গেছে। নক্সা তৈরি থেকে, আলো-পাখা কেনা অবধি সব কিছুর ভার নিয়েছিলাম। কিন্তু সংসার করিনি ওখানে। একটা তলা মেয়েকে, একটা তলা ছেলেকে দানপত্র করে, একটা তলা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আমরা সর্বদা চৌরঙ্গীর ফ্ল্যাটে বাস করেছি। সেখানে বাস করার একটা অন্য রকম ছন্দ আছে। লেখক নিরঞ্জন মজুমদারও ঐ বাড়ির অন্য একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন। চৌরঙ্গী-জীবনের বই আছে তাঁর, যদিও তিনি নেই। তবে আমি ওখানে ছাড়া-ছাড়া ভাবে সর্বদা ক্যাম্পে বাস করার মতো থেকেছি। জায়গাটাকে কখনো অধিকার করিনি। সুখ-সুবিধাগুলো উপভোগ করেছি। হাট-বাজার, নিউমার্কেট, ব্যাঙ্ক, পোস্টাপিস, মায় ইনকাম ট্যাক্স অপিস, রেস্তোরাঁ, সিনেমা, সব হাতের কাছে।

এই বাড়িতে ত্রিশ বছর ধরে কত আনন্দোৎসব, কত সাহিত্যসভা, কত কার্যকরী সভার মিটিং হয়েছে। কবি অন্নদাশঙ্কর শান্তিনিকেতনে যাবার আগে আমার ওপর পি-ই-এনের দায়িত্ব চাপিয়ে বন্ধুর কাজ করলেন। তার মিটিং হত। ছানার পুডিং খাওয়াতাম, ফ্যানি ফার্মারের রান্নার বই দেখে। নরেন দেব, (আমাদের সকলের নরেন দা) ফোন করে মনে করিয়ে দিতেন। তখনো মাধ্যমিক শিক্ষা পরিষৎ হয়নি। শিক্ষা বিভাগ থেকে একটি অস্থায়ী পরিষৎ করা হল। অপূর্ব চন্দ, চারু ভট্টাচার্য, পুলিন সেন, মীরা দত্তগুপ্ত, সজনী দাস ও অন্তত আরো ৪০ জন পুরনো বন্ধু মিলে তর্কাতর্কি হত। মনে আছে একবার আলোচ্য বিষয় ছিল মোটার্নিটি লীভ কিভাবে দেওয়া হবে, শিশুর জন্মের ক-দিন আগে থেকে ক-দিন পরে অবধি। বকে বকে সবাই যখন থেমে গেছে, তখনো অপূর্ব চন্দের আর মীরা দত্তগুপ্তের প্রায় লাঠালাঠি ভাব। তখন আমি উঠে বললাম, ‘আমার তো মনে হচ্ছে আলোচ্য বিষয়ে যে দুজন সদস্যের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে কম, তাঁদেরি মতামত সবচেয়ে জোরালো!’ তর্ক অমনি থেমে গেল। একেক দিন ছোট কমিটির মিটিং আমাদের বাড়িতে হত। ভালোমন্দ খাওয়া হবে এই আশায় সকলে উপস্থিত হতেন। ঐ সব মিটিং ভারি আনন্দের ব্যাপার ছিল। কাজও অনেকখানি সম্পাদিত হত, একটা ঘরোয়া আবহাওয়ায়। সে সব দিন আর নেই, কাজে আনন্দ নেই; পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে প্রীতির বদলে তিক্ততা। মিটিং করা ছেড়ে দিয়েছি। এই মন্তব্য থেকে শিশু-সাহিত্য-পরিষদকে বাদ দিচ্ছি।

বলা বাহুল্য ঐ সব ঘটনার সাল তারিখের একটা মোটামুটি ধারণা ছাড়া সব গুলিয়ে গেছে। তবে আমার বহু ভালোবাসার নরেনদা যে অনেক অনাছিষ্টির আদি কারণ, তাতে সন্দেহ নেই। যত দূর মনে পড়ে শিশু-সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে আমাকে জড়িত করার মূলে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও নরেনদা অগ্রণী। উনি আর রাধারানী বৌদি এক সময়, যুগ্ম-সভাপতি ছিলেন। তারপর আমাকে গাছে তুলে দিয়ে মই নিয়ে সরে পড়লেন। আশাপূর্ণাও এক সময় সভানেত্রী হয়েছিল। কেউ বেশি দিন থাকেনি। টাকা-কড়ি নেই। সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে উৎসাহী যারা, তাদের তেমন প্রতিপত্তি নেই। এ সব কাজে কোনো আর্থিক বা পারমার্থিক লাভ তো নেই-ই, শিশু-সাহিত্যের সেবা করে অবজ্ঞা অবহেলা ছাড়া কিছু পাওয়াও যায় না। এমন কি আজ থেকে অল্প কিছু দিন আগেও একজন ক্ষুব্ধ শিশু-সাহিত্যিক বন্ধু এসে বললেন চেতলায় কোনো স্কুলের উৎসবে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল। ঐ অধিবেশনে অরুণবাবু বলে নাম-করা অধ্যাপক সভাপতিত্ব করছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে অবজ্ঞার সঙ্গে বলেছিলেন, আগে কিছু হলেও, এখন শিশু-সাহিত্যে ভালো কিছু লেখা হয় না। তারপর আমার আর সত্যজিতের নাম করে বললেন, এঁরা আজকাল খুব ছড়ি ঘোরান শুনতে পাই—আমি পড়ি না অবিশ্যি ওসব—তবে কাজ কিছু হয় না ইত্যাদি।

এই রকম ধরনের কথা তাঁরাই বলেন, যাঁরা নিজেদের বিষয়টুকুর বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে বিষয়ে একেবারে অজ্ঞ। শুধু আজ নয়, যারা শিশুদের বই পড়ে না, তারা এই ধরনের মন্তব্য বরাবর করে আসছেন। সেকালে যে মৌলিক কাজ কম হত, আজকাল বাংলা শিশু সাহিত্য কত সমৃদ্ধ, কত মৌলিক, এ খবর দেশবাসীদের জানাতে হলে, একটা শিশুসাহিত্য পরিষদের দরকার আছে। এই সব মনে করে জড়িয়ে পড়লাম। সত্যি কথা বলতে কি ভালবেসেও ফেললাম। ভালোবাসা বড় জ্বালা। এখনো প্রায় ১০০ মাইল দূরে থেকে লম্বা লম্বা চিঠি লিখি। কেজো অকেজো পরামর্শ দিই। নরেনদা নেই, আশাপূর্ণা দূরে থাকে, ঐ ছোট দলটি এখনো কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, ডাঃ ননীগোপাল মজুমদার, পূর্ণ চক্রবর্তী, শৈল চক্রবর্তী,উপেন মল্লিক ইত্যাদি প্রবীণরা আর একদল নবীন কর্মী পরিষদকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এদের সঙ্গে সহযোগিতা করে সন্দেশের নলিনী দাশ আর উৎসাহী “সন্দেশী”রা। আমাকে দলে টানবার আগেই আমাকে আজীবন শিশুসাহিত্য সেবার জন্য ভুবনেশ্বরী পদক দিয়ে ওরা সম্মানিত করল। পূর্ণদার অপূর্ব ডিজাইন। চারকোণা রূপোর ফলকে, সোনার পদকটি খচিত। এমন সুন্দর পদক আর আছে কি না সন্দেহ। সেই ইস্তক আমি এদের একজন হয়ে গেছি।

ক্রমে কাজের ক্ষেত্র আরেকটু বাড়ল। আগেও বলেছি দিল্লীর চিলড্রেন্স বুক ট্রাস্ট আমার টাইগার টেল্স্ ও ক্রমে আরো দুটি বই প্রকাশ করলেন। টাইগার টেল্‌স্-এর বাংলাও করে দিলাম। বিশাল প্রতিষ্ঠান। গোড়ায় নেহরুর সময় সরকারি অনুদানে প্রতিষ্ঠিত, এখন নিজের খরচ নিজে বহন করে। যা কিছু লাভ হবে, নিয়ম হল খরচ বাদ দিয়ে, তার সবটাই আবার ঐ প্রতিষ্ঠানেই ঢালতে হবে। দিনে দিনে প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ হচ্ছে। কয়েকটা পত্রিকা বেরোয়, লেখক-শিবির বসে, নানা রকম প্রতিযোগিতা, ছোটদের বই মেলা, আলোচনা সভা হয়। সব কিছুর কেন্দ্রে ৮০ বছরের শঙ্কর পিল্লেই। চমৎকার ছবি দিয়ে, চমৎকার সব বই। ছোটবেলায় বাবার মুখে শোনা ময়মনসিংহের নানা বাঘের ব্যাপার, বইয়ের পাতায় জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। এই ভেবে দুঃখ হয় বাংলায় এত প্রতিভা, এত ভালো ভালো বই লেখা হয়—তা অরুণবাবু যা-ই বলুন না কেন—কিন্তু এমন চমৎকার ব্যবস্থাপনা কোথাও নেই। এখন তবু বই-মেলা হয়ে সে অভাব কিছুটা মিটেছে।

ছোটদের নাট্য পরিষৎ আছে ওখানে। তাঁরা ১৯৬৬ সালেই যতদূর মনে হয়, দিল্লীতে একটা নাটক বিষয়ে পাঠ-চক্র করলেন। কলকাতা থেকে বিমল ঘোষ (মৌমাছি), অখিল নিয়োগী আর আমি গিয়েছিলাম, আলোচনায় যোগ দিতে। কিছু বিদেশীও এসেছিলেন। শ্রীমতী লক্ষ্মী মজুমদারের চেষ্টাতেই অনুষ্ঠানগুলি এত সফল হয়েছিল। কলকাতাতেও সহজেই ঐ রকম আয়োজন করা যায়। বাংলা শিশুসাহিত্যে নাটকের দিকটাই দুর্বল মনে হয়।

এর দু-এক বছরের মধ্যে হাইদ্রাবাদে শ্রীমতী লক্ষ্মীকান্তাম্মার চেষ্টায় চমৎকার এক মহিলাদের সাহিত্য-সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাণী রায়ও গিয়েছিল এবং ওর মুখে স্বরচিত কবিতা পাঠ শুনে সকলে মুগ্ধ। এক বর্ণ মানে না বুঝেও ভাষার লালিত্যে এতগুলি লোককে অভিভূত হতে দেখে আমার এক নতুন শিক্ষা হল।

তখন গরমের ছুটি। নব-নির্মিত মেয়েদের ছাত্রাবাসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। নিরামিষ খাওয়া দাওয়া। কিন্তু হস্টেলের ফিরিঙ্গি মেট্রন রোজ আমার প্লেটের পাশে একটি ঢাকা পাত্রে নিজের হাতে তৈরি আমিষ সুখাদ্য রেখে একটু হেসে বলতেন, ‘খাও, ডার্লিং, নিরামিষ খেয়ে খেয়ে হাঁপিয়ে উঠবে।’ মেমের কালো খাঁদা মুখটি তখন অপূর্ব সুন্দর হয়ে উঠত। যেখানে গেছি, বারেবারে, এই দেখে মুগ্ধ হয়েছি লোকে কত ভালো ব্যবহার করে। ঐ মানুষটিকে আর দেখিনি, কিন্তু তার স্নেহের স্পর্শটি মন থেকে মুছে যায়নি।

বাণীর বিষয়ে একটা ভাল গল্প না বললে এ কাহিনী অসম্পূর্ণ থাকে। বাণীকে আমি তার প্রথম যৌবন না বলে বরং কৈশোরের শেষ বলা উচিত, তখন থেকে চিনি। আমিও এম-এ পাশ করে এক বছর শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করে, আশুতোষ কলেজের নব-প্রতিষ্ঠিত মহিলা শাখার একমাত্র মহিলা অধ্যাপক হয়ে এসেছি আর বাণীও ম্যাট্রিক পাস করে কলেজের প্রথম বর্ষে ভরতি হল। এখনো তার উজ্জ্বল সম্ভাবনায় ভরা মুখখানি আমার মানস চোখের সামনে ভেসে উঠলে, মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। সে দিন থেকে ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। ওকে একবার দেখলে ভোলা যেত না। সুন্দর অসুন্দর কাকে বলে আজও বুঝতে পারি না। কিন্তু ঐ নীরস ইঁটের’ঘরটাতে ও আলোরমতো জ্বলত। আরো অনেক কাজ ওর বাকি আছে মনে হয়। গল্প ওর ক্ষেত্র নয়। কিন্তু এমন বুদ্ধিদীপ্ত ন্যায়-যুক্ত সাহিত্য সমালোচনা সকলের কলম থেকে বেরোয় না। আর মনটি কাব্যে ভরা। কেন সে কাব্য উৎসারিত করে দু-হাতে’দান করছে না জানি না। ও বাণী, আমি যে কালের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পাই। আর কত দেরি করবে?

সে যাই হক হাইদ্রাবাদে সে দিন এই দুটি মূর্তির কোনোটাই দেখিনি। তার বদলে একটা দৃঢ়চিত্ত কেজো মূর্তি দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। হয়েছিল কি, ডেলিগেটদের ফিরতি রেজার্ভেশন করে দেবার ভার কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে নিয়েছিলেন। কোন গড়বড় হয়ে থাকবে। মোট কথা শেষ দিন সকালে যখন সকলে ফেরার চিন্তা করছে, বাণী শুনে এল কলকাতার কোনো রেজার্ভেশন নেই। আমাকে সে কথা বলতেই বললাম, ‘আমি মাদ্রাজে পুরনো বন্ধু শম্ভুর কাছে দুদিন কাটিয়ে যাব। প্লেনে যাব ঐটুকু পথ, সে সব ব্যবস্থা হয়ে আছে। কিন্তু তুমি কি করবে, ভাই? বড় ভাবনা হল। ও দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘যা করে সব ক্ষেত্রে সবাই জয়যুক্ত হয়, তাই করব। ‘সেটা কি?’ শুনে বাণী আশ্চর্য হল, ‘ওমা! জানেন না, এসব ক্ষেত্রে অ্যাজিটেশন ছাড়া উপায় নেই। ঐ যে গোপাল রেড্ডি ইত্যাদি হোমরা চোমরারা’ এসেছেন। এই হল অ্যাজিটেশনের সময়।’

আমি বললাম, ‘তা হলে আমি দূরের ঐ গাছতলায় দাঁড়াই। তুমি অ্যাজিটেশন করে এসো।’ সেই গাছতলা থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ভিড়ের মধ্যে বাণী হাত নেড়ে অ্যাজিটেশন করছে এবং বলাবাহুল্য কিছুক্ষণ পরেই হাসিমুখে রেজার্ভেশন শ্লিপ হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে উপস্থিত হল!

দাক্ষিণাত্যের মেয়েদের নতুন করে চিনেছিলাম ঐ চারপাঁচ দিনে। এ দেশে যদি প্রমীলা রাজ্য থাকে, তবে সে ঐখানে। এমন দলেদলে দক্ষ, কর্মক্ষম, নির্ভীক, উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে ভারতের আর কোথাও নেই। দেখতে খুব রূপসী নয়, সাজে বিলিতিয়ানার নামগন্ধ নেই, কিন্তু তবু বলব সুবেশা। অত বড় একটা নারীসম্মেলন বিনা বিভ্রাটে সুপটুভাবে লক্ষ্মীকান্তাম্মা আর তার সখীরা চালালেন দেখে মুগ্ধ হলাম। কোনো ঝগড়াঝাটি পর্যন্ত হল না।

ওখানকার মহিলা সমিতির কাজ দেখবার মতো। একটি কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান চালান ওঁরা। হাতের কাজের পেশাদারী মান দেখে প্রশংসা না করে পারা যায় না। নিজেদের রোজগারেই চলে। সরকারি সাহায্যের জন্য হাত পেতে থাকেন না। তাছাড়া একটি অনাথাশ্রমও দেখলাম। মহিলারা বেশিদিন অনাথার ভূমিকা নিয়ে হাত পেতে থাকেন না। একটা কাজ শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে যান। ছোট ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ে। তারপর কৃতীরা কলেজে যায়। অন্যরা কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।

আমরা যা গল্পে কাহিনীতে দিবা-স্বপ্নে আর নানা সংস্থার পরিকল্পনায় দেখি, ওঁরা তাকে মাটির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ওখানেও কি বধূনির্যাতন হয়? মনে তো হয় না।

চলে আসবার আগে সুন্দর একটি বিদায় অধিবেশন হল। কোনো খ্যাতনাম্নী অভিনেত্রী আগন্তুক অতিথিদের সকলকে একটি হিমরু স্কার্ফ আর বিদ্‌রি কাজের বাক্স উপহার দিলেন। মন ভরে গেল।

১৯৬৮ সালেই বোধ হয় ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের পক্ষ থেকে শিমলায় শিশুসাহিত্য বিষয়ে একটা সর্বভারতীয় আলোচনা শিবির হয়েছিল। কলকাতা থেকে প্রেমেনবাবু আর আমি গেছিলাম। মহাশ্বেতাকেও ওঁরা আমন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু সে মানালী বেড়াতে গিয়ে কোনো ভূস্বর্গে কাঁধে নিদারুণ ব্যথা আর মনে আশাভঙ্গ নিয়ে পড়ে থাকল। আলোচনায় যোগ দিতে পারল না।

এবার সরকারি ব্যবস্থা হলেও খুব ভালো হয়েছিল। সারা ভারত ঢুঁড়ে ওঁরা প্রত্যেক রাজ্য থেকে জনা ৩/৪ অভিজ্ঞ শিশুসাহিত্যিক জড়ো করেছিলেন। সেই বিচিত্র জনসমাগমের মধ্যে ক্রমে একটা পরিচ্ছন্ন নিয়মানুবর্তিতা ধরা পড়ল। তার একমাত্র কারণ সকলেই যথার্থ শিশুসাহিত্যের নানা ক্ষেত্রকে জীবনের কাজ বলে বেছে নিয়েছিলেন এবং তার চেয়েও বড় কথা শিশুসাহিত্যকে ভালোবাসেন। ‘মেল’ হবার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন থাকে না। সম্পাদিকা মোহিনী রাওয়ের সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ এবং ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সূত্রপাত। বেতারের ডুগাল সাহেব ঐ সংস্থার অধ্যক্ষ ছিলেন। চমৎকার লোক এঁরা, সাহিত্য ভালোবাসেন, লেখেন। এ-সব জায়গায় ভারি উপভোগ্য একটা আবহাওয়া তৈরি হয়। তার ফলে ছোট ছোট অসুবিধাগুলো গায়ে লাগে না।

যেখানে আমাদের বাসস্থান হয়েছিল, সেখানে নাকি এক সময় হিমাচল প্রদেশের শাসনকর্তাদের অনুচররা থাকত। লম্বা তিনতলা বাড়ি। পিঠটা তার পাহাড়ের গা ঘেঁষে। দুপাশে অন্য ঘর থাকাতে সেদিকও বন্ধ। খালি সামনের দিকটা খোলা। ডবল দরজা, তার দুপাশে জানলা, ওপরে স্কাইলাইট। ঐ দিকটা বোধ হয় দক্ষিণ। তবে আমার দিক্ভ্রমও হয়ে থাকতে পারে। দুজন করে একেক ঘরে থাকার ব্যবস্থা। আমার সঙ্গে বেতার কর্মী শ্রীমতী লীলাবতী ভাগত ছিলেন। তিনি বোধ হয় উত্তরপ্রদেশীয়, তবে পুণেতে বাড়িটাড়ি আছে। মনে হয় বম্বে হল কর্মস্থল। সঙ্গে গরম স্কার্ফ আর একটা পাতলা কম্বল, ছাড়া কিছু আনেননি। বললেন পুণে নাকি সিমলার চেয়েও ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডাকে ওঁরা ভয় পান না। আমাদের বাংলা রুটির মতো চ্যাপ্টা এবং গরম, আমাদের কথা আলাদা। কিছুতেই মানলেন না যে সিমলা পুণের চেয়ে উঁচু এবং ঠাণ্ডা।

বৃষ্টি হওয়াতে রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়ল। মিসেস্ ভাগত একটা সুজনি গায়ে শুয়েছিলেন। তারপর অনেকটা সেই প্রথম প্রহরে প্রভু ঢেঁকি অবতারের পুনরাভিনয় হল। দ্বিতীয় প্রহরে ধনুতে টংকারের সময়ে তিনি স্কার্ফটা মাথায় জড়িয়ে শুলেন। তৃতীয় প্রহরে যখন কুকুর কুণ্ডলী হলেন, আমি আর সইতে না পেরে, আমার বাড়তি কম্বলটা নিঃশব্দে ওঁর গায়ে চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে জেগে দেখি বেগের পুঁটুলি হয়ে ভদ্রমহিলা অকাতরে নিদ্রা যাচ্ছেন। এইভাবে তাঁর সাথে ভাব হয়ে গেল।

আমার ভাষণের দিন ডঃ নীহার রঞ্জন রায় সভাপতিত্ব করলেন। তিনি তখন ওখানকার জাতীয় মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। সবই ভালো হল। খালি উনি ছোটদের কোনো বই না পড়াতে ভাষণটা খোঁড়ার মতো নেংচে চলল। তারপর যখন সেই মামুলী কথাটা বললেন যে আগে ভারতে ভালো ভালো ছোটদের বই লেখা হত, তখন আমি কিছু বলবার আগেই লক্ষ্ণৌ থেকে আগত উর্দু লেখিকা বেগম ওয়াজির না কি যেন, উৎকৃষ্ট যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে বেচারাকে এমন করে মাটিতে বিছিয়ে দিলেন যে বাকি সময়টা ভালো ভালো কথা ছাড়া নীহারদার মুখ দিয়ে আর কিছু বেরোল না। পরে প্রেমেনবাবুকে আর আমাকে তাঁর জীপে করে নিজের চমৎকার বাংলোতে নিয়ে গেলেন। সেখানকার গোছলখানার কমোডটা রাজসিংহাসনের চেয়ে কোনো অংশে হীন নয় দেখে আমরা দুজন দেহাতী তো হাঁ! তবে তার পরে ওঁদের হস্টেলে সকলের সঙ্গে যে মধ্যাহ্ন ভোজ খাওয়ালেন সেটা নিতান্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর। ও-ই খাবারই সকলেই খেতেন। নীহারদাকে একটা ‘আর কোনখানে’ উপহার দিলাম। একদিন সেটার প্রথম অধ্যায় ইংরিজি করে শুনিয়েছিলাম। অনেকে বলেছিলেন ওটা অনুবাদ করে ফেলুন। সে আজও হয়নি।

ফিরবার পথেও মজা। আশিস্ সান্যালকে গুণী কবি ও লেখক বলে এখন সবাই চেনে। ১৫ বছর আগে সে নিতান্ত ছেলেমানুষ ছিল এবং প্রেমেনবাবুর ভারি ভক্ত। রোজ বিকেলে গল্প করতে আসত। তাতে প্রেমেনবাবুও খুব অখুশি ছিলেন না, কারণ ও না এলে আমরা হয়তো সবাই মিলে ওঁকে পাহাড়ে চড়াতাম। তাতে ওঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আশিস্ আলাদা নিজের দায়িত্বে গেছিল, কালীবাড়িতে উঠেছিল। ফেরার দিন ছোট ট্রেন থেকে নেমে দেখি কিউলে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের রেজার্ভেশন ছিল, কিন্তু আশিসের ছিল না। এ দিকে গাড়ি বোঝাই সব ছুটি-ফেরতা আর বেঙ্গল জোয়ান! ঐ শেষের গাড়িতে ছাড়া, মাছি মশারাও ঢুকতে পারছে না। ঢুকতে পারছিল না। শুনেই প্রেমেনবাবু নেমে গেলেন। আমি খুব বিরক্ত। আশিস্ ছেলেমানুষ, সে-ই পারল না আর ওঁর ৬৪ বছর বয়স, উনি ওকে ওঠাবেন! আধঘণ্টা পর ফিরে এসে বললেন, ‘দিয়েছি ঢুকিয়ে জোয়ানদের গাড়িতে। সত্যি আমাদের জোয়ানদের তুলনা হয় না।’ পরদিন সকালে শুনলাম কোথাও জায়গা নেই দেখে জোয়ানদের গাড়ির দরজার সামনে গিয়ে বলেছিলেন—‘আমার নাম প্রেমেন্দ্র মিত্র। আমার এই বন্ধুটির কি তোমাদের গাড়িতে জায়গা হবে না?’ সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল, আশিসকে ওরা আদর করে নিয়ে নিল! আমিও খুশি হলাম। আমাদের জোয়ানরা তাহলে কবিতা পড়ে। ভেবেও মনটা ভালো হয়ে গেল। আর ঐ ছোটখাটো ছিপছিপে মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। যদিও ১৯৫৭ সালে আমেদাবাদ যাবার সময় অ্যাটাসে কেস উল্টে ফেলে, আমাদের সবাইকে—মায় বিভূতি মুখোপাধ্যায়কে সুদ্ধু—গাড়িময় হামাগুড়ি দিয়ে পিন কাঁচি ওষুধের কৌটো চিঠিপত্র কলম হেনাতেনা সাত-সতেরো খুঁজিয়ে তবে ছেড়েছিলেন। সুখের বিষয়, বাক্সে কি কি ছিল সে বিষয়ে ওঁর নিজেরি কোনো ধারণা না থাকাতে, হারানো জিনিস নিয়ে কাউকে মাথা এবং শরীর ঘামাতে হয়নি! এই রকম মানুষটাকে শ্রদ্ধা না করে, ভাল না বেসে থাকি কি করে?

আমার মনে হয় দিল্লীর ঐ আলোচনা-চক্রটা বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল। জওহরলালের স্মৃতিতে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট সংকল্প নিয়েছিলেন একশোটা ছোটদের নতুন বই প্রকাশ করবেন। পরিকল্পনার নাম নেহরু চিল্ড্রেন্স লাইব্রেরি। আমাদের সকলের কাছেই বই চেয়েছিলেন। প্রেমেনবাবুও ‘ভারতের তীরভূমির কথা’ লিখবেন বলেছিলেন। মনে হয়েছিল কতই না উৎসাহ। অপ্রত্যাশিত সব বিষয়ে ওঁর মগজটি একটা তথ্যকেন্দ্র বিশেষ। বলা বাহুল্য ঐ বইটি দিনের আলো দেখেনি। আমাকে ফরমায়েস দেওয়া হল নদী কথা লিখে দিতে হবে। আমি উত্তর ভারতের নদ-নদী নিয়ে নির্দিষ্ট মাপের একখানি বই করে দিলাম। পরে আরেকটি চাইলেন, আমি ‘বড়-পানি’ লিখলাম, গল্পের আকারে। শিলং-এর উপকণ্ঠবাসীদের জীবনযাত্রার গল্প। মূল ঘটনাটি সন্দেশে লিখেছিলাম। তাকে কেন্দ্র করে এই বই। ১৯৮০ সালে আরেকটি চেয়েছিলেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের শৈশব কৈশোরের কথা। তাঁর প্রথমবারের বিলেতযাত্রা দিয়ে শেষ। নদী-কথা ১৪টি ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। অন্য দুটি বোধ হয় ইংরিজিতে আর বাংলায়। হিন্দীতেও হবে হয়তো।

শিমলার সভার সদস্যরা সকলেই বাছাই করা শিশুসাহিত্যিক। অনেকেই ভালো ভালো বই লিখেছেন ঐ পরিকল্পনার জন্যে। কেউ কেউ আগেই লিখে ঐখানে পাণ্ডুলিপি পেশ করেছিলেন। তাই নিয়ে মাঝে মাঝে বেশ মজার ব্যাপারও হত। একজনের রামায়ণের গল্প নিয়ে মহা তর্কাতর্কি উঠল। তিনি লিখেছিলেন বন-পর্বে রাম-লক্ষ্মণ পাখি ও অন্য জানোয়ার শিকার করে আনতেন। মা সীতা সেগুলি রাঁধতেন। রাম-লক্ষ্মণের খাওয়া হলে যা অবশিষ্ট থাকত, সীতা তাই খেতেন। এ-কথা পড়ে দু-তিন জন সদস্য মহা আপত্তি করলেন। এ কি সাংঘাতিক কথা! দেবতা তাঁরা, মাছ-মাংস তাঁদের কাছে অস্পৃশ্য! লেখকও ছাড়বেন না। তিনি মূল রামায়ণ থেকে ঐ তথ্য আহরণ করেছেন। মূল রামায়ণ এনে দেখিয়ে দিতে পারেন। অনেক কষ্টে শান্তি স্থাপন হল, বিষয়-বস্তুটিকে মুলতুবি রেখে!

বড় সুন্দর জায়গা শিমলা। অনেক বাঙ্গালীর বাস। তাঁদের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা দেখে বড় আনন্দ হয়েছিল। কলকাতায় বসে থাকলে সংস্কৃতির একটা দিক অজানা থেকে যায়। সেটি হল এর সর্বভারতীয় রূপটি।

আমি বই না লিখলে এবং সে বই কেউ কেউ না পড়লে, কোনো সম্পাদক আমার জীবনকথা ছাপতেন না, এ বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। আমিও সেই সুযোগে সারা জীবন ধরে যে হাজার হাজার লোকের কাছে নানা ভাবে ঋণী, সেকথার স্বীকৃতি দেবার চেষ্টা করেছি। সকলকে মনেও করতে পারি না, সব ভুলে ভুলে যাই। হঠাৎ একটা মুখ স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে ওঠে। যেমন আমার ৫ বছর বয়সে হ্যারিসন রোডে আমার ছোট পিসেমশাই কুন্তলীন আবিষ্কারক এইচ্ বোসের বাড়িতে যখন আমার চেয়ে সামান্য বড় দাদারা, গণেশদা, কার্তিকদা ইত্যাদি স্রেফ্ ঠেঙিয়ে আমার আদুরে পুতুলের ঠ্যাং খুলে আনল আর আমি কেঁদে কেটে একাকার করলে ছিচকাঁদুনে বলে অপমান করল, তখন আমার ১২ বছর বয়সের মুকুলদা, (এককালে চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার মুকুল বোস) আমার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তার সত্যিকার স্টীমে চলা রেলগাড়ি চালাতে দিয়েছিল। সে আদরটুকু আমার গা থেকে মুছে গেলেও মনের মধ্যে চিরকালের মতো লেগে আছে, ৭০ বছরেও মিলিয়ে যায়নি। পরে অবিশ্যি অন্য সঙ্কটের সময়েও মুকুলদার সস্নেহ সহযোগিতা পেয়েছি। ঐ সব বন্ধুদের দলে মুকুলদা সবার আগে।

সবাই তারা মানুষও নয়। কুকুর, বেড়াল। ছোটবেলা থেকে কুকুর বেড়াল পোষার শখ। দুঃখের বিষয়, বড়দের বিশ্বাস মুরগি পরিষ্কার, কারণ ভালো ভালো ডিম দেয়, টাট্টু ঘোড়া পরিষ্কার, কারণ জরীপের সময় বাবাকে পিঠে নিয়ে যায়। এরা ছাড়া সব জন্তু জানোয়ার অকথ্য নোংরা, ছুঁলে কার্বলিক সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়! অথচ রোজ সকালে কান্হাই আর পন্নু-সহিস কোদাল দিয়ে মুরগির ঘর আর আস্তাবল থেকে রাশি রাশি ইয়ে বের করে মস্ত গর্তে জমা করে,এ তো আমাদের সকলের নিজের চোখে দেখা। হ্যাঁ, তবে অবিশ্যি ঐ সব দিয়ে আমাদের ফল-ফুল-তরকারির বাগানে সার হত। বড়দের কি করে বোঝাব যে অনেক অকেজো জিনিস কেজো জিনিসের চেয়েও শতগুণ উপভোগ্য। নিজেরাই সে কথা ভালো করে বুঝতাম না। ঐসময়ে একটা নিষিদ্ধ ছাই রঙের বেড়াল, সম্ভবতঃ স্কাইলাইট দিয়ে, রোজ রাতে আমার পায়ের তলায় লেপের নিচে এসে শোয়া ধরল। বিষম মায়া পড়ে গেল। কাউকে কিছু বলিনি। খালি পাশে শোয়া দিদি জানত। সারা জীবনে সে কখনো আমার নামে লাগায়নি। তাই বলে আমার কার্য-কলাপ অনুমোদনও করেনি।

ছাই বেড়ালের নরম গরম গায়ে আমার ঠাণ্ডা পা লাগিয়ে-সুখে ঘুমোতাম। তার রাজত্ব আরো কতদিন চলত বলতে পারি না, যদি না আস্কারা পেয়ে তার লোভ বেড়ে যেত। শেষে একদিন রান্নাঘর থেকে এটা-ওটা অদৃশ্য হতে লাগল। ছোট ছোট নোংরা আঙুলের ছাপ দেখে যামিনীদা আমাদের সন্দেহ করত! তারপর একদিন রান্নাঘরের শিকে থেকে থালা ভরা ভাজা মাছ নিচে ফেলে, কতক খেয়ে, কতক ভেঙে কে যেন সব নাশ করল, তখন আমার চোখ ফুটে গেল। সকলের সঙ্গেই ছাই বেড়ালকে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। পাওয়া গেল কয়লার গাদার পেছনে কিন্তু এক ঝলক কালো বিদ্যুতের মতো সে হাওয়া হয়ে গেল। যামিনীদার বেঁটে লাঠি গায়ে লাগতেই বিকট ইঁ-য়াঁ-ও শব্দ করে চিরকালের মতো আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও, প্রায়ই তাকে দেখা যেত পাশের বাড়ির সাহেবের পেয়ারের বিলিতী বেড়ালদের জন্য সারি সারি পাতা মাছের পাত্র থেকে টপ করে মাছ তুলে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে!

আমার বিয়ের পর প্রথম যে পোষা জানোয়ার আমাদের বাড়িতে এসেছিল, তার নাম ছিল ডিকি। ৬ মাস বয়স, শাদা কালো উঁচু জাতের ফক্স-টেরিয়ার। বেঁড়ে ল্যাজটা সারাক্ষণ নাড়ত, মুখ দেখে মনে হত বেজায় হাসি পাচ্ছে! দুঃখের বিষয়, প্রয়োজনীয় ইন্‌জেক্শন দিইনি, অকালে সে মারা গেছিল।

ডিকিকে দেখে শিখলাম ট্রেনিং দিলে কুকুররা ঘর নোংরা করে না। দু-বেলা একটু হাঁটাতে হয়। ব্যস্। ডিকির পর আমাদের ল্যাডি বন্ধু। আমাদের বন্ধু হলেও এবং সারা দিন আমাদের ঘরে কাটালেও, দোতলার বাসিন্দাদের কুকুর। একটু একটু বুল্-ডগ্, একটু একটু নেড়ি। মহা পাজি। বাড়ির লোকদের ছাড়া সবাইকে তাড়া করে, ধরতে পারলে কামড়ে দেয়। ওর জন্য যে কত পুলিশের লোকদের নানা রকম মিষ্টি কথা বলে শান্ত করতে হয়েছিল সে আর কি বলব। কুকুরের মালিক অতি শান্ত মিষ্টি বিধবা মানুষ। তাঁর চারটি নবালক ছেলেমেয়ে। অগত্যা আমাকেই ঠেকাতে হত।

তারপর অন্য বাড়িতে গেলাম। সেখানে ব্রাউনি বলে এক অপরূপ সুন্দর কুকুর উপহার পেলাম। ৬ মাস বয়স। বিরাট চেহারা। মা কলি, বাপ রামপুর হাউণ্ড। কুকুর তো নয়, ঠিক একটা মানুষ। আমরা যা খাই প্রায় তাই খায়। সকালে চা টোস্ট দুপুরে ভাত দিয়ে হাড় সেদ্ধ, নুন ছাড়া। রাতে একটু মাংসের ঝোল কি পুডিং দিয়ে এক ডজন হাত রুটি। আমার ছেলেমেয়ের চিরসঙ্গী। কোনো উৎপাত নেই। খালি নোংরা-কাপড় পরে কেউ এলে তাকে কামড়ায়। আর বাড়ি থেকে কেউ কিছু নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে, তাকে কামড়ায়। সে জিনিসটা আগন্তুক নিজে এনে থাকলেও, কামড়ায়। কেউ কিছু ধরে টানলে কামড়ায়। নিচু হলে কামড়ায় ; আমাদের কাউকে মজা করেও জোরে কিছু বললে বা গায়ে হাত দিলে কামড়ায়। আমাদের খুব কম বন্ধুই অক্ষত দেহে আমাদের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করতে পেরেছিল। ১৪ বছর পরে যখন জলাতঙ্ক হয়ে হাসপাতালে ব্রাউনি মারা গেল, আমাদের বাড়ি নিরানন্দ হল। জিমি বলে একটা বুড়ো এবং অতি ভদ্র কুকুর-ও ছিল কিছুদিন। কিন্তু মনে তেমন দাগ কাটেনি।

রোশ্ফুকো বলেছিলেন, ‘যতই মানুষ দেখি, ততই কুকুর ভালোবাসি।’ আমার ঠিক ততটা না হলেও যতই কুকুর দেখেছি, ততই তাদের ভালোবেসেছি। ব্রাউনি মারা গেলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কুকুর রাখব না,বড় কম দিন বাঁচে। খালি দুঃখটা টিকে থাকে। কিন্তু কিছুদিন পরেই সতীশ দাশ বলে যে-বন্ধু ব্রাউনিকে জিমিকে দিয়েছিলেন, তিনিই একদিন সন্ধ্যায় ১ বছর বয়সের আইরিশ সেটার, লাল রূপের ডালি জনিকে রেখে চলে গেলেন। বলে গেলেন, “যারা একবার কুকুর ভালোবেসেছে, তারা কুকুর ছাড়া বাঁচে না। দু-দিন ওকে বেঁধে রাখলে, আর কোথাও যাবে না।ֹ’

প্রকাণ্ড কুকুর। দাঁড়ালে খাবার টেবিলের ওপর থুতনি রাখতে পারে। ছেলেমেয়ের প্রাণের বন্ধু হয়ে গেল। তাদের স্কুল-কলেজ থেকে ফেরার ১৫ মিনিট আগে থেকে সদর দরজার কাছে দাঁড়াত। কোনো খুঁৎ ছিল না জনির। খালি খুব ছোটবেলায় কোনো নিষ্ঠুর ছেলের হাতে পড়ে ল্যাজের কাছে জখম হয়েছিল। দেখা যেত না, কিন্তু ঐখানটা কমজুরি ছিল। দুই বছর পরে জনি বড় কষ্টে মারা গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট ফক্সটেরিয়ার ভুলো এল। ততদিনে ছেলেমেয়ে যে যার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আসীন। বাড়িতে আমরা দুজন। ভুলো ১০/১২ বছর ধরে আমার আর আমার স্বামীর নিত্যসঙ্গী হয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত হয়তো রোশফুকোর সেই কথাই বলতে হত, ‘যতই মানুষ দেখি, ততই কুকুর ভালোবাসি!’ ভাগ্যিস সারা জীবন ধরে এত ভালো ভালো, এত ভালোবাসার মানুষ দেখেছি, তাই আমার মুখে ওকথা সাজে না।

অভিনেতা রাধামোহন স্বর্গে গেলেন। ভাগ্যিস তাঁকে ‘উদয়ের পথে’ অভিনয় করতে দেখেছিলাম। আজকাল শন্তিনিকেতনের পথে তাঁকে মাঝে মাঝেই দেখতাম। গোড়ায় চিনতে পারিনি। যাঁর কাছে এত আনন্দের ভাগ পেয়েছি তাঁর চেহারা চিনতে পারিনি। তিনিই পরিচয় দিলেন। রাধারমণ মিত্রের কথা বলেছি কি? তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন শুনেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল। দেশ-প্রেমিক বটে ; দেশপ্রেমিক হবার আক্কেল-সেলামীও স্বচ্ছন্দে দিয়েছেন। কোথায় কবে প্রথম আলাপ হল মনে নেই। আমার উপেন্দ্রকিশোরের খুদে জীবনী পড়ে, বাড়িতে এসে বকে গেলেন—‘নিজের জ্যাঠামশায়ের বাড়ির নম্বর ভুল লেখ, ছিঃ! বারবার করে বললাম, ‘কি করব, আমি তখন জন্মাইনি। ওঁর মেয়ে, আমার মেজদির কাছে নম্বরটা পেয়েছি।’ বললেন, ‘সে তো আরো খারাপ। নিজেদের বাড়ির নম্বর ভুল করা! স্ট্রীট ডিরেক্টরি কেন আছে?

বুঝলাম এই একজন নিখুঁৎবাদী পারফেকশনিস্ট পেলাম! আমাদের দেশের পণ্ডিতদের বইতেও রাশি রাশি ভুলচুক থেকে যায়। হয় কারো চোখে পড়ে না, নয়তো অকিঞ্চিৎকর মনে করে শুধরোনো হয় না। চমৎকার সব জিনিসে কলঙ্ক লেগে থাকে। কিন্তু জ্ঞানের জগতে ভুলের একমাত্র সার্থকতা হল কোনো একজন ভবিষ্যৎ জ্ঞানসাধক তাকে দূর করার সুযোগ পাবেন। জ্ঞানে ভুলের স্থান নেই। নাম, ঠিকানা, সময়, স্থান, পরিচয়, সম্পর্ক, যত তুচ্ছ তথ্যই হক না কেন, তার হওয়া দরকার নির্ভুল নিঁখুৎ। কত ভালো ভালো বইতে বিদেশী নামের ভুল উচ্চারণ লেখা দেখি। যার একটা বই রচনা করার সাধ্য আছে, তার একটা উচ্চারণ বিশুদ্ধ ভাবে লিখবার তৎপরতা নেই, এ কি আশ্চর্য ব্যপার! একদিন রাধারমণ দুপুর দুটোয় আমাদের বাড়িতে এসে দেখেন আমরা ঘুমোচ্ছি। আর আসেননি।

রাধারমণ বলতে আমাদের কুটুম্ব রাধাচরণ বাগচীর কথা মনে পড়ল। অতি গুণী শিল্পী। শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে অধ্যাপনা করে দীর্ঘকাল কাটিয়ে, সেখানেই অকালে দেহ রেখেছেন। নিঁখুৎ সব ছবি তাঁর। বয়সে আমার চেয়ে কিছু ছোট, আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্বন্ধ ছিল, যদিও ওর শ্বশুর আর আমার স্বামী আপন মামাতো পিসতুতো ভাই। রাধাচরণের ভারতজোড়া নাম। ডাকটিকিটের নক্সা চান কেন্দ্রীয় সরকার, রাধাচরণেরটাই শ্রেষ্ঠ বলে গৃহীত হয়। কিন্তু তার নিজের বাড়ি আর তৈরি হয় না। জমি কেনা, টাকা রাখা। জিজ্ঞাসা করাতে রাধাচরণ বলল, “একেবারে নিখুৎ নক্সা করতে চাই, কাকিমা, তার কাজও নিখুঁৎ হওয়া চাই।’ জানতে চাইলাম কেমন নিখুঁৎ। যা বলল তার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি, তবে তার ভাবার্থটুকু মনে আছে। মানুষের চারপাশ ঘিরে আটটা দিক, মাথার ওপর উর্ধ্ব, পায়ের নিচে অধঃ। সব তো আর সমান এবং একরকম নয়। প্রত্যেকের নিজের রূপ আছে। নক্সাতে সেটা ধরতে পারা চাই। কাজেও সেটা সপ্রকাশ হওয়া চাই। বলেছিলাম, ‘তবেই তোমার বাড়ি হয়েছে!’

এর অনেক দিন পরে যখন সত্যি করে রাধাচরণের বাড়ি হল, সে আমাকে বাড়ি দেখাবে বলে নেমন্তন্ন করল। আমার বেয়াই মশাই-ও ছিলেন। তিনি সুনয়নীদেবীর ছেলে শুনে মহা উৎসাহে তাঁকেও যেতে বলল। ওর উৎসাহ দেখে বেয়াইমশায়েরো উৎসাহ বেড়ে গেল। সারাটা পথ রিকশায় বসে, ‘ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ গাইলেন। গিয়ে দেখলাম চমৎকার সব ছবি আঁকা দেয়ালে দেয়ালে। খুব আদর যত্ন করল রাধাচরণ। তারপর বলল, ‘কেমন মনে হচ্ছে?’ সেই দশদিকের কথাটা পাড়তেই কেমন যেন উদাস হয়ে গেল রাধাচরণ। তারপর লজ্জিত ভাবে বলল, ‘ইয়ে সিঁড়িটার জায়গাও রাখিনি।’ চেয়ে দেখি দেয়াল জোড়া অপূর্ব ছবির পাশ দিয়ে মঞ্চের মাথায় উঠে পরী কিম্বা রথ নামাবার জন্য সেকালে যেরকম উইংসের আড়ালে সরু সিঁড়ি থাকত বলে শুনেছি, সেই ধরনের একটা সিঁড়ি। সত্যিকার শিল্পী ছিল রাধাচরণ। রাধাচরণ মারা যাবার আগে অনেক দিন দেখা হয়নি। আমরাও মাঝে এক বছর শান্তিনিকেতনে যাইনি আর ও-ও অসুস্থ হয়ে ঘোরাঘুরি কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। স্বপ্নগুলিকে নিয়েই বোধহয় চলে গেছে। ওর স্ত্রীর কথাও একটু বলতে হয়। সে বড় গুণী মেয়ে। সারা জীবন শিক্ষকতা করে, এখন দক্ষিণ-পল্লীর ঐ বাড়িতে একটা চমৎকার স্কুল করেছে। বাস্তব কর্মীদের ভূমিকা স্বপ্ন বিলাসীদের চেয়ে একটুও কম গুরুতর নয়।

বাস্তব কর্মী বলতে আমাদের নেপোর কথা বলতে হয়। নেপো মানে নেপোলিয়ন। সেই আদি যোদ্ধা নেপোলিয়ন নয়। তাকে কোথায় পাব? পেলেও মহা অনর্থ ঘটাবে। আমাদের নেপো একটা বৃহদাকার হুলো বেড়াল। সে-ও কম অনর্থ ঘটায়নি। কিন্তু বড়ই উপকারী ছিল। চৌরঙ্গীর ফ্ল্যাটের নিচে একটা বড় স্টোরের গুদোমঘর। চিজ্, বিস্কুট, টিনের মাছ, নানা রকম মাংসজ বস্তু দিয়ে ঠাসা। সেখানে নেংটি ইঁদুর কিলবিল করে। তারা যখন তখন যে কোনো পথে ওপরে উঠে এসে, সব কেটেকুটে খেয়ে দেয়ে, অবাঞ্ছিত বাচ্চা পেড়ে, জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলল। অগত্যা একজন ফিরিঙ্গি প্রতিবেশী নেপোকে প্রদান করল। সে অবিশ্যি মহিলা বেড়াল পাচার করবার তালে ছিল। কিন্তু পোড়-খাওয়া জীবন আমার, তাতে রাজি হইনি। সে বলেছিল, ‘মেয়ে বেড়াল যেমন বাচ্চা দিয়ে বাড়ি ভরে, ছেলে বেড়াল তেমনি বাড়িতেই থাকে না। পাড়া জ্বালায়।’

বাস্তবিকই তাই। নেপোর আকৃতি দিনে দিনে শশীকলার মতো বৃদ্ধি পেতে লাগল। সব খাবার জিনিস বন্ধ করে রাখতে হত। আমাদের খাটে নিমন্ত্রিত ও অযাচিত ভাবে শুয়ে থাকত। ঠেললেও নামত না। তেমনি আবার ওর মুখে একসঙ্গে তিনটে ইঁদুর দেখেছি। তাছাড়া সারাদিন ও টো-টো করে ঘুরে বেড়ালেও ওর গায়ের গন্ধেই বাড়ি থেকে দেখতে দেখতে চিরকালের মতো সব ইঁদুর বিদায় হল! নেপো সুখে বিরাজ করতে লাগল। ওর ভয়ে অন্য বেড়াল এ তল্লাটে আসত না। যখনি ওর শিকারী স্বভাব তৃষিত হয়ে উঠত, কোনো সময়ে বেরিয়ে গিয়ে মারামারি করে বিজয়-গর্ব এবং কিছু আঁচড় কামড় নিয়ে ফিরত। ক্রমে নেপো বুড়ো হল। মনে হত চোখে ভালো দেখে না। আঁচড় কামড়ের সংখ্যাও বাড়ল। অন্য বেড়ালরা মাঝে মাঝে আমাদের পাঁচিলে বসে, বেড়ালীয় ভাষায় বোধ হয় ওকে টিটকিরি দিত। কাছে আসত না।

আমরা নেপোর দুঃসময়ে ওর কম যত্ন করিনি। সকলে মিলে বোঝাতাম, ‘কেন বাড়ির বাইরে যাস্? দ্যাখ্ তো কি রকম কামড়েছে।’ মুখের সামনে খাবার ধরা হত। ও সব কিছু চেটেপুটে সাবাড় করত। এইভাবে আরো কত দিন চলত কে জানে। এমন সময়ে একদিন কোথাও যাব বলে নিচে গেছি, হঠাৎ দেখি কম্পাউণ্ডের উঁচু পাঁচিলের ওপর দিয়ে দশটা হুলো বেড়াল ল্যাজ খাড়া করে জঙ্গী কায়দায় চলেছে। তাদের লীডার আমাদের নেপো ছাড়া কেউ নয়! আমাদের ড্রাইভার তার পা চেপে ধরে বলল, ‘নেপো, নেপো, নেপো! ওরা তোকে খেয়ে ফেলবে!’ নেপো ‘ফঁডা—শ্’ করে একটা বিশ্রী শব্দ করে, পা টেনে নিয়ে, পাশের বাড়ির দোতলার রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দলবল সহ ঢুকে পড়ল!! ঝন্ঝন্ করে বাসন ভাঙার আর বকাবকির শব্দের মধ্যে আমাদের প্রস্থান। এইসব নানা অভিজ্ঞতার মাঝখানে বেড়ালদের সঙ্গে আমার কোনোদিনই ভালোবাসা জমেনি। কি করে যে এত অল্প সময়ের মধ্যে জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল সে কথা যত ভাবি ততই আশ্চর্য হই। নিজের মনের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ টের পাই না। সেই একই ভাল -লাগা মন্দ লাগাগুলো, নিজের ওপর সেই অসহিষ্ণুতা। খালি এটা চাওয়া, ওটা চাওয়া, হাজার রকম দাবি-দাওয়াগুলো কেমন যেন সকাল বেলার শিশিরের মতো কখন জানি নিজের অজ্ঞাতসারে উপে গেছে। এখনো ভালো জিনিস ভালো লাগে, কিন্তু সেগুলোকে আয়ত্ত করতে আর ইচ্ছা করে না। বন্ধুত্বের দাম যেন অনেকখানি বেড়ে গেছে। কেউ ভালো বললে মনটা খুশি হয়; কিন্তু মন্দ বললে রাগ হয় না; খোশামোদ করলে বিরক্ত লাগে। সবাইকে কেমন যেন ভালো লাগে। কারো কাছে কিছু আশা করি না। সর্বদা কাজ করবার তাগাদা দেয় মন। ছোটদের চলচ্চিত্রসংস্থা হল একটা। শৈল চক্রবর্তী তার সঙ্গে জড়িত আর দিলীপ ভট্টাচার্য বলে স্বল্পায়ু সুদর্শন একজন ছেলে। কিছু মিটিং হয়, খুব বেশি কাজের নমুনা দেখি না। কোন সময় ছেড়েও দিই।

এদিকে ছোটদের গল্পগুলো তৈরি হয়ে কলমের আগায় অপেক্ষা করে। এক সময়ে সন্দেশের পাতায় ধারাবাহিক ভারে ছাড়া পায়। কলের মানুষ ‘মাকুর গল্প’, বেড়ালের ছায়া-লাগা ‘নেপোর বই’। কয়েকটা বড়দের গল্পও লিখি সম্পাদক বন্ধুদের অনুরোধে। ‘পাখি’ প্রকাশ করেন মিত্র ঘোষ। অমৃতে ‘ফেরারী’ বেরোয়, পরে মিত্র ঘোষ থেকে পেপার-ব্যাক্ হয়ে ছাড়া পায়। ৭১ সালে নিউ স্ক্রিপ্ট গোটা কতক রস ও রহস্যের গল্প এক সঙ্গে করে ছাপে। তিন বছর পরে আরেক খণ্ডও বেরোয়। ৭২ সালে চিলড্রেন্স বুক ট্রাস্ট থেকে ‘রিপ দি লেপার্ড’ বেরোল ; ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে ‘বড়-পানি’। প্রথমটিতে বন্ধুবান্ধবদের কাছে শোনা জানোয়ারের গল্প, দ্বিতীয়টিতে ছোটবেলায় দেখা শিলংএর মুল্‌কি পাহাড়ের পরিবেশ। ৭১ সালে ওরিয়েন্ট লংম্যান ছোটদের জন্য বাংলায় গল্পের বই প্রকাশের প্রকল্প নিলেন। প্রেমেনবাবুর, আমার এবং হয়তো আরো কারো কারো অমনিবাস বেরোল, খুব জনপ্রিয়ও হল। ৭৪ সালে এশিয়া সম্পাদিত ‘রোশনাই’ পত্রিকাতে ধারাবাহিক ভাবে দুটি ছোট ছেলের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প, ‘নাকু-গামা’ বেরোল। ১৯৬১ সালে সন্দেশ প্রকাশিত হবার পর, এটি ছাড়া অন্য কোনো ছোটদের পত্রিকায় ধারাবাহিক গল্প দিইনি। রোশনাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত সম্বন্ধ না থাকলেও, এশিয়া আমার রচনাবলী এবং অন্য কয়েকটি ছোট বইয়ের প্রকাশক। এশিয়ার মালিকরা বহুকাল আগে আমার ‘ঠাকুমার চিঠি’কে মণিমালা নামে বই করেছিলেন। বর্তমান মালিক মৃণাল তাদেরি ছোট ভাই আর আমার স্নেহের পাত্র। যদিও কটুভাষী বলে অনেকে ওর কথায় আহত হয়। তাই মাঝে মাঝে ওকে বকি-টকি।

৭৪ সালে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে আমার প্রথম বই ‘বাতাসবাড়ি’ বেরোল, নিরাভরণ চেহারা নিয়ে, নিঃশব্দে। বিশেষ কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করল বলে মনে হয় না। যাকে বলে ফ্যান্টাসি। আগে সন্দেশে বেরিয়ে গেছিল। আমাদের পাঠকরা মহা খুশি। এখানে ফ্যান্টাসি, কল্প বিজ্ঞানের গল্প, বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, আজগুবি ও গাঁজাখুরি গল্পের মধ্যে একটু তফাৎ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা যায়। কারণ এর ভিতরে একটা মারাত্মক ফাঁদ পাতা আছে, যার মধ্যে পা পড়লেই সর্বনাশ। ফ্যান্টাসি বিজ্ঞান নয়।

ছোটদের জন্য লিখতে হলে বড় সাবধানে পা ফেলতে হয়। এর মধ্যে আমি যে কবে বড়দের জন্য গল্প লেখা কমিয়ে এনে, প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি নিজেই টের পাইনি। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, ছোটদের জন্য লেখাকে আমি যতটা গুরুত্ব দিই, বড়দের ততটা দিই না। বড়দের বই হল সময় কাটানোর উপায় এবং খুবই উৎকৃষ্ট উপায়। এমন কি শ্রেষ্ঠ উপায়ও বলা যায়। কিম্বা মন ভোলাবার পন্থা। জীবনের ব্যর্থতা হতাশার মহৌষধ। তাছাড়া থীসিস্ লেখার এন্তার সামগ্রী থাকে বড়দের উপন্যাসে। স্রেফ বড়দের গল্পের বই পড়ে পড়ে বহু লোক ডক্টরেট লাভ করেছেন। তাঁরা নিজেরা মৌলিক কিছু লেখেন না। কিন্তু অন্য লেখকদের বইয়ের ভালোমন্দ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। আমার অনেক সময় মনে হয় বড়দের গল্পের বই তথ্যান্বেষীদের অনেক কাজে লাগলেও সাধারণ মানুষদের ততটা উপকারে আসে না, যতটা আসে ছোটদের ভালো বই। তাই দিয়ে মানুষ তৈরি হয়। সব বড়রাই একদিন ছোট থাকে। সেই সময়ে যা শুনল, যা দেখল আর বিশেষ করে যা পড়ল, তার ছাপ তারা মনে মনে সারা জীবন বহন করে।

বড়রা মন্দ বইয়ের ছাপ, ভুলে-ভরা বইয়ের প্রভাব সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে। কিন্তু ছোটদের অশেষ ক্ষতি হয়। মানুষ তৈরি করতে হলে সব চাইতে ভালো জিনিসের দরকার। সততা, সৎসাহস, সরসতা—এইসব দিয়ে ছোটদের বই তৈরি করতে হয়। বাস্তব-বিরোধী হলেও চলবে না। কাল্পনিকতা, বলিষ্ঠতা, আদর্শবাদ ইত্যাদি ভুল শিক্ষার জায়গা নেই। যা হয়নি, হবেও না বলে মনে হয়, তার মধ্যে এক রকম যুক্তি-যৌক্তিকতা থাকা চাই।

কাজেই বোঝাই যাচ্ছে আজগুবি গল্প লেখাও খুব সহজ নয়। বিজ্ঞান-ভিত্তিক গল্প আমি চেষ্টা করি না। ফ্যান্টাসি লিখি। প্রকাশকরা বলেন কল্প-বিজ্ঞানের গল্প। কথাটা অদ্ভুত। পুত্ৰ-কল্প মানে যদি পুত্রের মতো হয়, তাহলে কল্প-বিজ্ঞান মানে দাঁড়ায় বিজ্ঞানের মতো কিছু। অর্থাৎ ঠিক বিজ্ঞান নয়, তবে দেখলে বিজ্ঞান বলে ভুল হতে পারে। এ তো বড় সাংঘাতিক ব্যাপার!! ছোট ছোট পাঠক, যাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে প্রায় কোনো জ্ঞানই নেই, তাদের যদি এমন সব গল্প শোনানো যায় যা পড়লে বৈজ্ঞানিক ব্যাপার বলে মনে হবে, কিন্তু আসলে তা নয়—তাহলে ঐ কচি পাঠকদের কপালে ভবিষ্যতে দুঃখ থাকতে পারে। তার চেয়ে সোজাসুজি আমি বলি ‘আজগুবি গল্প’। ফ্যান্টাসি। তার মধ্যে যেটুকু বৈজ্ঞানিক তথ্য পুরে দিই, সেগুলি বাস্তব সত্য। কিন্তু তাদের সম্ভাব্য পরিণামগুলো স্রেফ আজগুবি ব্যাপার। তার সঙ্গে বাস্তবের সম্বন্ধ নেই, যে গল্প পড়বে সে-ই একথা বুঝবে।

সত্যিকার বিজ্ঞান-ভিত্তিক গল্প লেখেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, অজেয় রায়, সঙ্কৰ্ষণ রায় এবং আরো কেউ কেউ। অদ্রীশ বর্ধনও বিশেষ করে বিখ্যাত বিজ্ঞান ভিত্তিক বিদেশী গল্প অনুবাদ করে। এ সব গল্পকে আমি অনেক উঁচুতে স্থান দিই। অতি ভালো জিনিস। যারা সব সময় চমক চায়, তারা কিন্তু বিজ্ঞান চায় না, অন্তত গল্পে চায় না। তারা সত্যজিতের গল্প, আমার গল্প পছন্দ করে। ফ্যান্টাসি। আজগুবি। পড়লে মন ভালো হয়। কল্পনা শক্তি চন্‌মন্ করে ওঠে। মজা লাগে। অন্তত আমার ঐ ধরনের গল্পের ঐ উদ্দেশ্য। তার সঙ্গে যদি একটু ইকলজি বা পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠকদের সচেতন করে দেওয়া যায় তো মন্দ কি? ঐ সচেতনতাটাই অনেকখানি। তবে একে বিজ্ঞান শেখানো বলে না। বিজ্ঞান শেখানো অত সহজ নয়। অনেক অনুশীলন চাই। এক বিখ্যাত লেখকের জনপ্রিয় বইতে এবং তার চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল তেজস্ক্রিয় বস্তু পিণ্ডের চারধারে একটু ঘেরা আছে আর সবাই ভিড় করে সেটি দেখে, দিব্যি সুন্দর অক্ষত দেহে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে!! বিজ্ঞানের ব্যবহার বড় সাবধানে করা দরকার। নয়তো ফ্যান্টাসি লিখতে হয়, যাকে বিজ্ঞানের পাঠ বলে কেউ ভুল করবে না! তাছাড়া সত্যি কথা বলতে হলে, আজগুবির ভারি একটা মাধুর্য আছে, অনেকটা কাব্যের মতো। মন ছাড়া পায়। অসীম অবাধের স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু আজগুবিটাকে বুদ্ধির ঠেকো দিয়ে রাখতে হয়। যাতে নন্‌সেন্স হলেও, রাবিশ না হয়। মানব হৃদয়ের সব অনুভূতির জায়গা আছে আজগুবিতে। কিন্তু যতই অসম্ভব পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যাক না কেন, যুক্তি দিয়ে তাকে দাঁড় করাতে হবে। নিজের আজগুবির কাছে নিজে হার মানলে চলবে না। ভালো আজগুবির বই ছোটদের চেয়ে বড়রা হয়তো আরো বেশি উপভোগ করে। তাই করাই উচিত। নইলে বুঝতে হবে আজগুবিটা উৎরোয়নি।

ছোটদের ছবির বেলাও তাই। যে দুটি শিশু চলচ্চিত্র কমিটির সদস্যা ছিলাম, সে দুটিই ব্যর্থ হয়েছিল। ছবি যদি এমন হয় যে তার জন্য প্রেক্ষাগৃহ ভিক্ষে করতে হয়, এমন কি ছোটদের সঙ্গে যাবার লোক পর্যন্ত পাওয়া যায় না, তাহলে সে ছবি উৎরোয়নি। আমাদের দেশে সার্থক শিশু চলচ্চিত্র আঙুলে গোনা যায়। শিল্পের আর সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ছোটদের জন্য দিতে এক্ষেত্রেও আমরাও অনিচ্ছুক। যে দু-একজন দিয়েছেন, তাঁদের মাথায় তারার মুকুট পরানো উচিত। আমাদের সৌভাগ্য যে এমন লোকও আছে।

এমনি করে ১৯৭১, ৭২, ৭৩ কেটে গেল। ৭৪ থেকে আমাদের সুখ-শান্তিতে—এবং মাঝেমাঝে উত্তেজনাময় তর্কাতর্কিতে-ভরা জীবন যাত্রায় বাধা পড়ল। আমার স্বামীর চোখের কষ্ট শুরু হল। তাঁর কর্মময় জীবনে ছেদ পড়ল। তাঁর অবসর যাপনের দুটি প্রধান উপায়—ক্যালকাটা ক্লাব থেকে রাশি রাশি বই এনে পড়া এবং ইংরিজি, বাংলা ভালো চলচ্চিত্র এলেই গিয়ে দেখা—দুই-ই বন্ধ হল।

যাদের কোনো প্রিয় কাজকর্ম নিয়ে দিন কাটে, বয়স তাদের সহজে স্পর্শ করে না। ১৯৭৪ সালে আমার স্বামীর বয়স ৭৫, আমার ৬৪। বুড়ো হয়ে গেছি অথচ টের পাইনি। জেনেশুনে অস্বীকার করেছি তা নয়, ও বিষয়ে ভাবিনি, তাই টের পাইনি। এবার ভাবতে হল। আমার স্বামী প্রথমে অর্ধেক দিন প্র্যাক্টিস করতেন। বন্ধুবান্ধব ম্যাগনিফাইং গ্লাস এনে দিয়েছিলেন, তার সাহায্যে পড়তেন। অস্ত্র করার সময় হয়নি তখনো। মনে পড়লো তার ১২/১৪ বছর আগে সজনী দাসকে বেতারে ভাষণ দিতে দেখেছিলাম, আধ ইঞ্চি বড় হরপে লেখা পাণ্ডুলিপি ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে পাঠ করে। কেমন একটা বেপরোয়া ভাব ছিল সজনীদার। সহজে পরাজয় স্বীকার করতেন না,নিজে ভুল করে ফেললেও, না। লোকে তাকে ভুলে যাচ্ছে। আমিও কতদিন দেখিনি। চোখে ভালো দেখছেন না তবু যেমন করে পারেন ভাষণ দিয়ে গেলেন।

নিজের চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করতাম দেখতে না পাওয়া কেমন জিনিস। ওঁকে সাহস দিতাম ছানি তুলে দিলেই আবার আগের মতো দেখবে। চেনাজানাদের মধ্যে থেকে উদাহরণ দিতাম। বুঝতে পারি অন্যের কষ্টের কথা শুনে মোটেই নিজের কষ্ট কমে না। বহুকাল ধরে মাসে একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে এক সপ্তাহ থাকতাম। জীবনটা একটা প্যাটার্ণের মধ্যে পড়ে গেছিল। বন্ধুরা আশা করে থাকত। সব বন্ধ হল। এক বছর সেখানে যাওয়া হল না। তারপর একজন নামকরা ডাক্তার ডান চোখের ছানি তুললেন। সুস্থ হয়ে উনি বাড়িও এলেন। আরো পরে শান্তিনিকেতনেও যাওয়া হল। সকলে মিলে আনন্দ করা গেল। মনে আছে সেটা ফেব্রুয়ারি মাস। আমার জন্মদিনে ভাইবোনরা সবাই এসেছিল। সেইদিন থেকে চোখে ব্যথা। সে ব্যথা আর সারল না ; ঐ চোখটাকে বাঁচানো গেল না।

মনে আছে অন্য চোখটাতেও তত দিনে কম দেখেন। জয়ন্ত চৌধুরী আমাদের শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দিত, ছেলে গিয়ে নিয়ে আসত এই প্রথম পর- নির্ভরশীল হলাম। যত ভালোবাসাই থাকুক। তারপর সব দুঃসময়ের মতো, এর-ও অবসান হল। কমবয়সী ডাক্তার সুনীল বাগচির যত্নে বাঁ চোখটি সুস্থ হল। মনে আছে আমার স্বামী অনেক দিন পরে আবার পৃথিবীর রূপ দেখে অবাক হলেন। ক্রমে এই সব কষ্টের স্মৃতি মনের মধ্যে ক্ষীণ হয়ে এল।

১৯৭৪-তে আমার ৬৬ বছর বয়স। সবাই ততদিনে কাজ শেষ করার কথা ভাবে আর আমি ভাবি কি কি করা বাকি আছে। কয়েকটা আক্ষেপ মনে মনে পুষে রেখেছি। নিজের ওপর আক্ষেপ। ছবি আঁকাটা ছাড়া ঠিক হয়নি। ভালো করে সংস্কৃত পড়া উচিত ছিল। এই সব। তার বদলে বই-বই করে মেতে উঠেছি। ছোটবেলা থেকে কিছু তৈরি করতে, কিছু গড়তে, কিছু বানাতে ভালোবাসি। আগে এই ভালোবাসাটাকে বাগ মানাতে পারতাম না, ঠিক বুঝে উঠতেও পারতাম না। স্কুলে তখনো ভরতি হইনি, হয়তো পাঁচের নিচে বয়স। পাশের বাড়িতে পাহাড়ি সান্যালের শ্বশুর শাশুড়ি থাকেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা আমাদের বয়সী। একসঙ্গে খেলাধূলা করি। একদিন বিকেলে দাদা আর আমি গেছি ওদের বাড়ি। ওদের মা ছাড়া কেউ বাড়ি নেই। দাদা চলে আসতে পারলে বাঁচে। আমার চেয়ে দু-বছরের বড়, ওর শাসনও মানি না। ভালোমানুষ। কি যেন মনে হল, মাসিমাকে বললাম, ‘দাদাকে আমাকে ডাকাতে ধরে নিয়ে গেছিল।’

শুনে মাসিমার চেয়েও দাদা বেশি অবাক। আমাকে টেনে নিয়ে যাবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। আমি গ্যাঁট হয়ে বসে, লম্বা এক কাহিনী পেশ করলাম। কি নিষ্ঠুর ডাকাতরা, কি আশ্চর্য সাহস দেখিয়ে আমরা—বিশেষ করে আমি—শেষ পর্যন্ত নিজেদের মুক্তি সাধন করলাম। দাদার মুখে কথা নেই। কোনমতে আমাকে নিয়ে বাড়ি এল। কাকেও কিছু বলল না। ও না বললেও মাসিমা মাকে এসে বিস্তারিত গল্প করলেন। তিনি সব বিশ্বাস করেছিলেন। পরে মা আমাকে খুব বকাবকি করলেন, ‘ছিঃ, এতগুলো মিথ্যা কথা বলে এলি!’ কিছুতেই বুঝলেন না বানানো গল্প আর মিছে কথা এক নয়। মনে আছে বকুনি খেয়েও আমি উল্লসিত। মাসিমা তাহলে সব বিশ্বাস করেছেন!! মা বললেন, ‘বানানো গল্প বললে আগে বলে দিবি এটা সত্যি নয়। নইলে মিছে কথা বলা হয়।’

এই কথাটা আমার খুব পছন্দ হয়নি। সারা জীবন বানানো গল্প লিখে কাটিয়েছি। অনেক সময় সত্যিকার সামগ্রী দিয়ে। ভাবি—যা হয়েছে তা সত্যি বটে। যা হয়নি, কিন্তু যে-কোনো সময়ে হতে পারে—তাই বা মিথ্যে হবে কেন? ঐ সব বানানো গল্পের জোরে কত যে বন্ধু লাভ করেছি তার ঠিক নেই। কত পাঠক, কত লেখক, কত সম্পাদক আর প্রকাশক। ও-সব গল্প দুঃখ ব্যর্থতার ওষুধ। সুখের বাড়। প্রথম প্রকাশক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণের কথা বলেছি। দ্বিতীয় প্রকাশক দিলীপ গুপ্তের কথাও বলেছি। তারপরের প্রকাশক এশিয়ার মৃণাল দত্তর দাদা বৌদি এবং তারা বিদেশে চলে গেল। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেডের ত্রিদিবেশ বসু ও তাঁর দক্ষ সহকারী জিতেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দিলীপ কিন্তু সবার সেরা। সে শুধু আমার বই ছেপে বের করত না। ডুবুরি নামিয়ে মনের কথা তুলে আনত। তাকে ভুলতে পারি না। সে সময়ে আমার সব লেখা হয় সিগনেট প্রেস্, নয় ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেডের হাত দিয়ে বেরোত। অন্য কারো কথা ভাববার কথা মনেও হত না। সেকেলে বইয়ের সামান্য দাম হত, রয়েল্টির অঙ্ক ছোট হত। কিন্তু সিগনেট বৎসরান্তে নিয়মিত হিসাব, রয়েল্টি ও এক বাক্স সন্দেশ বাড়ি দিয়ে যেত। আর ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেডের জিতেনবাবু পাণ্ডুলিপি অনুমোদন করেই সেই সংস্করণের ২০%হিসাবে রয়েল্টির সবটাই অগ্রিম দিয়ে দিতেন। রয়েল্টি নিয়ে যে মনভেদ হতে পারে, তা-ও জানতাম না!

ছোট বড় অন্য প্রকাশকদের কথা এর পরে বলব। ১৯৭৩ সালের একটা কথা এখানে না বললেই নয়। সে বছর দিল্লীর ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট কলকাতায় প্রথম সর্ব-ভারতীয় বই-মেলা করলেন। খোলা ময়দানে নয়, অতটা সাহস তখনো হয়নি, ময়দানের পাশে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। আমার পুরনো বন্ধু মোহিনী রাও ওঁদের সম্পাদক। ভারি করিৎকর্মা মানুষটি। সাদাসিধে, দক্ষ এবং বন্ধুবৎসল। তার থাকার অসুবিধা হচ্ছে খবর পেয়ে আমাদের বাড়িতে ধরে আনলাম এবং ফলে নিজেও বই-মেলায় জড়িয়ে পড়লাম।

এ যে কি আনন্দের ব্যাপার, আগে বুঝতে পারিনি। এখন প্রতি বছর বাংলার নানা জায়গায় কত বইমেলা হয়। আগে কেন এর কথা মনে হয়নি, তাই ভাবি। লাভ না হলেও, চমৎকার বিজ্ঞাপন হয়। আমরা সন্দেশ কার্যালয়ে ও নিউস্ক্রিপ্টের সহযোগিতায় প্রায় প্রত্যেক বছর শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় বইয়ের দোকান দিই। অন্যান্য পুস্তকালয়ও দেন। গ্রামের আর ছোট শহরের ছেলে মেয়েদের আর তাদের অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া একটা দেখার জিনিস। যারা বলে বাংলার প্রাণ নেই, তারা কিছুই বোঝে না। একাধারে আমোদের আর শিক্ষার এমন আয়োজন আর কোথায় হতে পারে?

এমনি করে ১৯৭৫ সাল এসে গেল। আমরা ক্রমে ক্রমে কলকাতার পাট তুলে, শান্তিনিকেতনবাসী হবার ব্যবস্থা করতে লাগলাম। ঝপ করে নয়, অল্পে অল্পে।

॥ ১৬ ॥

এখন মনে হচ্ছে ১৯৭৩ সালকে অত অল্পে বিদায় করা যায় না। তার একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। সে বছর আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পৃথিবীর নারীরা নাকি এত দিনে স্বীয় মহিমায় অধিষ্ঠিত হলেন। এখন থেকে কেউ তাঁদের স্বীয় নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। মূল সভা বসেছিল আর্জেন্টিনা না কোথায় যেন। সভাপতি ছিলেন একজন পুরুষমানুষ। অকুস্থলে রাজনীতিঘটিত বিক্ষোভ হয়েছিল। এঁরা তবু সাহস দেখিয়ে সভা করেছিলেন। ভাবলেও হাসি পায়। আমাদের দেশেই সবার আগে সব মেয়েরা—তা যতই নিরক্ষর হক না কেন—ভোটাধিকার পেয়েছিল আর নারীবর্ষের ১০ বছর পরেও আমাদের দেশের শ্বশুরবাড়ির লোকরা যথেষ্ট যৌতুক না পেয়ে অসহায় ছেলেমানুষ বৌগুলোকে পুড়িয়ে মারছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন ঘটনা হয় না। বলা বাহুল্য আন্তর্জাতিক সভায় আমাদের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।

ভাবি নিজেদের দেশকে আমরা আর ভালোবাসি না বলেই এমন হতে পারে। দেশকে ভালোবাসি না, ধর্মকে মানি না। সদসৎ বিচার হারিয়েছি। নীতি-শিক্ষাকে বিদ্রুপ করি। স্কুলপাঠ্য থেকে তাকে তুলে দিয়েছি। বিধাতাকে ভক্তি করি না। দয়া, ক্ষমা, ত্যাগ এসবকে দুর্বলতা মনে করি। লোভ আর ভোগ ছাড়া সব ছাড়তে প্রস্তুত। তাই আমাদের সুন্দর দেশের এই দশা! তবু মনে হয় এ ক্ষণিকের, এ কেটে যাবে, আবার সুবুদ্ধি হবে, আবার মানুষ হব। আরো আলো আছে দিগন্তের নিচে। নারীবর্ষ বলতে এত কথা বেরিয়ে এল। প্রতি বছর যেন নারীবর্ষ হয়।

তা সেই বছরে মনে ভারি একটা উৎসাহ এসেছিল। ‘কথা-সাহিত্যে’ একটা ধারাবাহিক ছোট উপন্যাস লিখে ফেলেছিলাম। কিছুটা বাস্তব পরিবেশ নিয়ে। চরিত্রগুলির কেউ কেউ সত্যি মানুষের ছায়া। নাম দিলাম ‘যাত্রী’। স্বাধীনতার পথে তো আর থেমে থাকা যায় না। সব সময় চলতে হয়, তাই যাত্রী। চলার পথের যাত্রী। সে বই মিত্র-ঘোষ গত বছর প্রকাশ করলেন। প্রথমে ভেবেছিলাম বড় বেশি দেরি করে ফেললেন। এখন বুঝেছি যদি দয়া, ক্ষমা, উদারতা, সৎসাহসের কথা বলতে হয়, তবে এই হল তার সময়। যদি বলিষ্ঠ হতে হয় ন্যায়ের পথ ধরতে হয়, তবে এই হল যাত্রীদের বেরিয়ে পড়ার সময়। আলো আছে দিগন্তের নিচে।

মনে আছে ঐ বছর রবীন্দ্রসদনের বিশাল প্রেক্ষাগৃহে কলকাতার কয়েকজন উৎসাহী মেয়ে, শ্রীমতী চিত্রা ঘোষের নেতৃত্বে মস্ত এক সভা করেছিল। সেই সভায় পুণ্যলতা চক্রবর্তী, গিরিবালা দেবী, শৈলবালা ঘোষজায়া, জ্যোতির্ময়ী দেবী, শান্তা দেবী ও সীতা দেবীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়া হল। তাঁরা সবিনয়ে অল্প কিছু বললেন। শুনে সবাই মুগ্ধ। ঘরে লোক ধরে না। এমন সুন্দর সুপরিচালিত অনুষ্ঠান এ শহরে খুব বেশি হয়নি, এ কথা অনেকে বলেছিলেন। সব ব্যবস্থাপনা খরচপত্র মেয়েরাই করেছিল, আমি শুধু অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাটি এঁকে দিয়েছিলাম।

ঐ সভার কথা ভাবলে মন ভালো হয়ে যায়। এই দশ বছরে শান্তাদেবী আর জ্যোতির্ময়ী দেবী ছাড়া সকলেই একে একে বিদায় নিয়েছেন। তাঁদের জায়গা কে নেবে তা ভেবে পাই না।

আরো কত কথা মনে পড়ছে। আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে বোধ হয় ঐ সময়ের কাছাকাছি এবং ঐখানেই মস্ত অনুষ্ঠান হয়েছিল। দুঃখের বিষয় উপলক্ষ্যটা কি তা ভুলে গেছি। চমৎকার স্মারক-সংখ্যা প্রকাশ করে সভায় ওঁরা বিতরণ করেছিলেন। তাতে আমি ‘স্বাধীনতা লিব্ নয়’ নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধে আমাদের দেশের মেয়েদের সচেতন করে দেবার চেষ্টা করেছিলাম। যাক সে-সব দুঃখের কথা। আমার স্বাধীনতাই পছন্দ, লিব্ দিয়ে কি হবে? সভ্যতাই আমার যথেষ্ট, আধুনিকতা নিয়ে কি করব? আজ যা আধুনিক, পাঁচ বছর পরেই তা সেকেলে হয়ে যায়। তাছাড়া পেট বের করে কাপড় পরতে আমার লজ্জা করে, তাই আর আধুনিক হওয়া হল না। এবং যারা নিজেদের বাড়ির সেবা করাকে দাসীগিরি বলে, তারা আবার আধুনিক কোথায় হল? দাসী তো সেকেলে জিনিস। বাড়ির সেবা চিরকালের।

স্কুল কলেজের বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই চলে গেছে। মীরা দত্তগুপ্তা, কল্যাণী ভট্টাচার্য, এরাও গেল। আমি তবু ভাবি হাতের কাজগুলো শেষ হলে, আসছে বছরে কি কি করব। পুরনো ব্যক্তিগত বন্ধুদের সংখ্যা খুব কমে গিয়েছে। তবে নিজের ভাইবোনেরা, মাসতুতো পিসতুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোনেরা অনেকে এখনো আছে। তাদের কথা ভাবলে শিরার মধ্যে রক্ত উদ্বেল হয়ে ওঠে। আমার দিদিমার, ঠাকুমার রক্ত এদেরো শিরায় বইছে। দেখা হক না হক, এরা আমার আপনজন, আমার জন্মগত উত্তরাধিকার

তবে আপনজন আরো আছে। যারা আমার জীবনকে ভরপূর করে রেখেছে। তাদের নইলে আমার চলে না। এরা আমার প্রকাশক, সম্পাদক, পাঠক, আমার প্রিয় পত্রিকা সন্দেশের লেখক আর অগুন্তি উট্কো মানুষ, যারা নিজের থেকে আমার চারদিকে জুটেছে। কিছু চায় না তারা খালি সঙ্গ দেয়, সঙ্গ নেয়। অনেকে গ্রামের মানুষ, কিম্বা দূরের কোনো ছোট শহরের। তাদের আগে হয়তো কখনো দেখিনি, এখন তারা আমার জগৎটিকে ভরিয়ে রাখে। লেখে কেউ কেউ, ভালো লেখে কয়েকজন। পড়ে প্রায় সকলেই। এদের কথা আরো বলব।

প্রকাশকদের কথা শেষ হয়নি। অনেকে বলেন তাঁরা মন্দ লোক। তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য লেখকদের ঠকিয়ে নিজেদের পকেট ভরানো। হিসাব দেন না, রয়েল্টি দেন না। বারবার চাইতে হয়। আমি প্রকাশকদের বন্ধু বলে মনে করি। তাঁদের নইলে আমার চলে না, আমি নইলে তাঁদের চলে না।

এক সময় ছিল যখন বইয়ের দাম ছিল কম, এক টাকা, কি দু টাকা, কি আরো অনেক কম। গোটা সংস্করণের পাওনা হত হয়তো ৩৫০ টাকা। লিখতামও না এত বেশি। নানা সাংসারিক কাজের চাপ ছিল। আমার দুটি ছেলেমেয়ে ছাড়া, ভাগ্নীর তিনটি মেয়ে ছিল। সবাই বাড়িতে আমার কাছে পড়ত। ঐ সব চলত রাত ৮১/২ টা অবধি। তারপরে খাওয়া-দাওয়া চুকলে, আরো রাতে নিজের ঘরে নিরিবিলিতে বসে সাহিত্যসাধনা করতাম। আমার স্বামী বই পড়তেন। হয়তো ১১টার পরে আলো নিবিয়ে দিতাম।

নিরিবিলি বলতে, বন্ধুরা ভাবতেন যে-মানুষ পার্ক স্ট্রীট আর চৌরঙ্গীর মোড়ে বাস করে, সে আবার নিরিবিলি কোথায় পায়? আসলে যান্ত্রিক গোলমাল আমার কানে পৌঁছলেও মনকে স্পর্শ করত না। কিন্তু বাড়িতে এতটুকু অশান্তি হলে, লেখা মাথায় উঠত। এই পরিবেশে আমার সব বড়দের গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। পরে সংসারিক অশান্তিও আমার মনের নাগাল পেত না। কলম নিয়ে বসলে সব কিছু দূরে সরে যেত। এখনো তাই হয়। খালি শরীর খারাপ হলে, দুশ্চিন্তা হলে আর গুমোট গরমে পাখা বন্ধ হলে, লিখতে পারি না।

প্রকাশকদের কথা বলতে এত কথা উঠল। বলেছি তো রয়েল্টি জিনিসটার খুব গুরুত্ব ছিল না। বছরে দেড় হাজার টাকা রয়েল্টি পেলেও সন্তুষ্ট থাকতাম। খালি কেউ যদি ফাঁকি দিত, খুব রাগ হত। কড়া চিঠি লিখতাম। একবার আমার সম্পর্কে ভাগ্নে দুর্গা চক্রবর্তী তিনজন অবুঝ প্রকাশকের কাছ থেকে সব রয়েল্টি তিনদিনে আদায় করে দিয়েছিল! ওর একটা কায়দা আছে, আমার রপ্ত হয়নি। ঐ দু-একজন উটকো প্রকাশক ছাড়া রপ্ত করার দরকারও হয়নি। কিন্তু কারো সব দিন সমান যায় না। আমারো যেমন সংসারের চাহিদা বাড়ল, ওঁর শরীরও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা কর্মক্ষমতা হারাল, তখন রয়েল্টিগুলোর গুরুত্বও বাড়ল।

ততদিনে সিগনেট প্রেসের আকাল শুরু হয়েছে। দিলীপকে প্রথমে অন্য জায়গায় চাকরি নিতে হল। তারপর গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে, শেষ পর্যন্ত অকালে চোখ বুজল। সিগনেট প্রেসের দুর্দিন শুরু হল। দিলীপের শাশুড়ি নীলিমা দেবী সংস্থাটির পুরনো ঐতিহ্য রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সবই বৃথা হল। ক্রমে অবস্থা আরো পড়ে গেল। আমার প্রথম দুটি সার্থক বই ‘দিন দুপুরে’ ‘পদিপিসির বর্মী বাক্স’ এবং বড়দের প্রথম দুটি উপন্যাস এককালে জনপ্রিয় ‘শ্রীমতী’, ‘জোনাকি’ আর আমার বাবার অতুলনীয় ‘বনের খবর’ ওঁদের হাতে এক সময় এত মান মর্যাদা পেয়েছিল, এখন তুলে নিতে মন সরছিল না। আজ পর্যন্ত ‘দিন দুপুরে’ আর ‘পদিপিসি’ ওঁদের হাতেই রয়েছে। নীলিমাদেবীও নেই। দিলীপের স্ত্রী নন্দিনী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাফল্য আসুক তাদের।

যখন বেতারে ঢুকলাম, আমার বয়স ৪৮, কিন্তু প্রকাশক বলতে ঐ একজন। তার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারত? দুঃখের বিষয় তাঁদের মন্দ সময় এল। প্রেমেনবাবু আমাকে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেডের জিতেনবাবুর কাছে নিয়ে গেলেন। ‘হলদে পাখির পালক’ দিয়ে তাঁরা আমার বই ছাপা শুরু করলেন। জিতেনবাবু অন্যত্র যাওয়ার পর এঁদেরো ছোটদের বইয়ের কাজ একটু থিতিয়ে এল। আমাকে অন্য প্রকাশকের কথা ভাবতে হল। এইভাবে চক্রবৃদ্ধির মতো আমার প্রকাশকদের বৃত্ত বড় হতে লাগল। ১৯৬৮ থেকে মিত্র-ঘোষও আমার কিছু বই ছেপেছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্বন্ধী।

তারপর আরো নবাগতরা আছেন, বিমলারঞ্জন, মৌসুমী, অন্নপূর্ণা, নাথ, শৈব্যা, নির্মল বুক এজেন্সি, বিশ্বভারতী, শিশুসাহিত্য সংসদ। এশিয়ার সঙ্গে ১৯৫৬ থেকে সম্পর্ক। মনে আছে দেখতে দেখতে সকলের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক হয়ে গেল। এর মধ্যে একবার মহা অসুবিধায় পড়েছিলাম। হঠাৎ এক সঙ্গে অনেকগুলো টাকা ট্যাক্স বাবদ দিতে হবে। সবে বাড়ি তৈরি হয়েছে। পুঁজি প্রায় খালি। তখন কোথায় কি পাওনা আছে একটু ভেবে নিয়ে, শেষ মুহূর্তে কয়েকজন প্রকাশকের কাছে চেয়ে বসলাম এবং তাঁরা প্রায় সকলে রাতারাতি টাকাগুলো জোগাড় করে পরদিন সকালে আমাদের বাড়িতে নিজেরা এসে নগদ পৌঁছে দিয়ে গেলেন। মনে আছে আমার মন ভরে গেছিল। এই তো বন্ধুর কাজ। এঁদের মধ্যে একজনের কথা না বলে পারছি না। বিমলারঞ্জনের সঙ্গে অল্পদিনের সম্পর্ক, একটিমাত্র বই ছেপেছেন। ছোট ব্যবসা তখন, হিসাব করে খরচ করতে হয়। তিনি অমনি একটা রুমালে খুচরো ও নোটে অনেকগুলো টাকা আমার হাতে দিয়ে গেলেন। হয়তো দোকানের দুদিনের সমুদয় বিক্রির টাকা।

এদের আমি ফেলি কি করে? কেউ কেউ এমনিতে হয়তো বাকি ফেলে রাখে, আমার দরকার হলেই দেয়। কেউ নিজেরা বিপদে পড়েছে, দিতে পারছে না। তবে জেনে শুনে বঞ্চিত করছে বুঝলে খুব রাগ হয়। হিসাবপত্র খুব একটা পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়নি আমার। আমাকে বঞ্চিত করা খুব শক্ত নয়। তবু করে না বিশেষ কেউ।

১৯৭৫ থেকে একটু একটু করে অনেকটা আমার নিজের অজ্ঞাতসারে আমরা শান্তিনিকেতনবাসী হয়ে গেছি। গত ৫ বছর খুব অল্প সময়ের জন্যই কলকাতায় যাই। সেখানে গেলেই আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদিকে আমি কলকাতার মেয়ে। সেখানে জন্মেছি। বারো বছর বয়স থেকে বাস করেছি। সেখানেই লেখাপড়া শিখেছি, বিয়ে হয়েছে, সমস্ত বিবাহিত ও কর্মজীবন কাটিয়েছি। কলকাতাকে আমি ভালোবাসি। কলকাতার কেউ নিন্দা করলে আমার কষ্ট হয়। কলকাতা হল পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা শহর, এ-কথা আমি বিশ্বাস করি না। খুব নোংরা জায়গা আছে মানছি। সে-রকম নোংরা অন্য শহরেও আছে। পুরনো দিল্লীতেও খুঁজলে পাওয়া যায়। নোংরা দিয়ে কলকাতা তৈরি নয়। ইঁটকাঠ, কাচ আর ইস্টিল দিয়েও নয়। দুশো বছরের স্বপ্ন দিয়ে কলকাতা তৈরি। বাংলার শ্রেষ্ঠ চিন্তার জন্ম এইখানে। রাস্তা ঝাঁট না দিলে, কিম্বা কর্পোরেশনের গাড়ি না এলেও সে কলকাতা এতটুকু টসকায় না। তাছাড়া সমস্ত মধ্য কলকাতা আর ভবানীপুর বালিগঞ্জে আমি হেঁটে দেখেছি, বাজারের কাছে ছাড়া মোটেই সে-রকম নোংরা নয়। চৌরঙ্গীপাড়া আমি কি দারুণ ভালোবাসি। সব দোকানদারদের সঙ্গে আমার চেনা ছিল। সব দরকারের জিনিস হাত বাড়ালেই পেতাম। আর স্বপ্নের জিনিস আমাকে ঘিরে থাকত। খালি বিলাসিতা আর স্বেচ্ছাচারের পাড়া নয় চৌরঙ্গী।

সেই কলকাতা ছেড়ে শুধু আমার অসুবিধাই হয় না, কষ্টও হয়। সেখানে আমার ভাইবোন, ছেলে মেয়ে, কর্মসঙ্গীরা। সন্দেশ কার্যালয় সেখানে, শিশুসাহিত্য পরিষৎ সেখানে। শান্তিনিকেতন হাজার সুন্দর হলেও আমার আধখানা আমি কলকাতাবাসী। সত্যি সুন্দর জায়গা শান্তিনিকেতন। যে দিকে চাই, চোখ জুড়োয়। এই নিরিবিলি সাদাসিধে বাড়িটি আমার পরিকল্পনা মতো আমার তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল প্রায় ৩০ বছর আগে। এই ৩০ বছরের স্মৃতি এ-বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমার ৪৫ বছর বয়স থেকে এ আমাকে ক্রমে ক্রমে বুড়ো হতে দেখেছে। কত সুখ-দুঃখের সাক্ষী এ। তবু আমার সবখানি একে দিতে পারিনি। এখানে ৭ দিনে আমার ‘হলদে পাখির পালক’ লেখা হয়েছিল। ‘খেরোর খাতা’ এখানে লিখেছি। ‘পাকদণ্ডী’র আগাগোড়ায় এখানকার জল-হাওয়া-মাটির গন্ধ লেগে আছে। গত ১০ বছরের বেশির ভাগ রসের গল্প, আজগুবি গল্প, কল্পবিজ্ঞানের গল্প এখানে, এই ঘরে, এই ডেস্কে বসে লেখা। লেখা আবার কি? সে তো শুধু শেষ পর্যায়টুকু। সব তৈরি হয়ে গেলে, তবে লেখা কাগজে নামে। তৈরি হয় মনে মনে। তার আবার এখানে ওখানে কি? শিলং-এর সরলবনের মর্মরে আর ধূপধুনোর মতো সুবাসে যে-মন প্রথম সচেতন হয়েছিল, এ-ও সেই মন। একে নিয়েই আমার জীবন কেটেছে। এ কলকাতাতেও যা, এখানেও তা। তবে এখানকার শান্তি আর নৈঃশব্দ্য সেই মনের কথাগুলোকে কাগজে নামাতে সাহায্য করে। কেমন একটা প্রসন্নতা আছে এখানকার বাতাসে। বাতাসে, কি আমার নিজের জীবনে তা বলতে পারি না। লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে গেলে, গল্প লেখা হয় না আমার। যা পেয়েছি তাতে মন ভরে আছে, যা পাইনি তাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছি।

তবে একটা কথা আছে। এখানকার জীবনযাত্রা অনেক বেশি সরল এবং অকপট। বেশি উন্নত, তা বলছি না। বেশি নিরাবরণ। কৃত্রিমতার ইচ্ছা যদি বা কারো থাকে, তার স্কোপ কম। এই সরলতা ও অকপটতা সাহিত্যসৃষ্টির সাহায্য করে। কত ভালো ভালো লেখা লিখেছে কত লোকে এখানকার মাটিতে। খ্যাত অখ্যাত কতজন। আমারো লেখার যে সাহায্য হয়, তাতে সন্দেহ নেই। তবে সম্পাদক প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগের অসুবিধা আছে। শেষ প্রুফ দেখে দিতে পারি না, অনেক বইতে বহু ভুল ছাপা থাকে। আগে এমন হত না। ভুলগুলো মনকে পীড়া দেয়। সময় করে কোনো কোনো প্রকাশক এখানেও আসেন। কথা হয়, কিন্তু তাঁদের কাজে সহযোগিতা করা যায় না।

আগে যাঁরা সবচেয়ে কাছের ছিলেন, তাঁরা কালের ফেরে যেমন সরে গেলেন, তেমনি নতুন প্রকাশকদের পেলাম। সকলে খুব নতুন-ও নন। ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে আমার বাতাস বাড়ি প্রকাশের কথা বলেছি। তাঁদের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠতা হল। তাহলে আনন্দবাজারের কথা বলতে হয়। প্রয়াত অশোক সরকারের মা নির্ঝরিণী দেবী থেকে শুরু করতে হয়। শান্তিনিকেতনে আমাদের পাশের বাড়িটি ওঁদের। প্রথমেই নির্ঝরিণী দেবীর সঙ্গে চেনা হল। বুদ্ধিমতী, স্নেহশীলা। তখনো সাহিত্যের জগতে তত নাম হয়নি আমার। তবে আনন্দবাজারে গল্প লিখি বহু দিন থেকে। তখন একজন ছেলেমানুষ নীরেন চক্রবর্তী সলজ্জ ভাবে ফোন করে আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়ের জন্য গল্প চাইত। বলতাম ‘কিসের গল্প’? না, ‘হয় ভূতের, নয় চোরের,নয় প্রেমের।’ ভাবতাম এ ছেলে অনভিজ্ঞ হলেও গল্পের মর্মকথা বোঝে! কত যে ঐ রকম গল্প লিখে দিয়েছি, তার ঠিক নেই। সামান্যই বই হয়েছে। ভাবছি যাবার আগে ঐ সব চোরের আর প্রেমের ব্যাপারগুলো দিয়ে মোক্ষম একখানা বই করে ফেলব!

নীরেন চমৎকার কবিতা লেখে। ওর ‘নীল নির্জনে’র জুড়ি নেই। আধুনিক কবিতা বলতে আমি এই জিনিস বুঝি। সহজ ভাষায় গভীর কথা। বেদনায় বিধুর, আনন্দে ভরপুর। যা পড়লে সংসারের দুঃখ-কষ্টগুলোকে অকিঞ্চিৎকর মনে হবে। সাহসী, সৎসাহসী। আমার নীরেনের কবিতার মতো। আর নানা চালাকি দিয়ে ভরা, চটকদার জিনিস এক পুরুষও টিকবে না। বাংলা কাব্যের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায় ভরা।

আরেকজন আসত কি একটা পত্রিকার জন্য লেখা নিতে। বেশ একটা গালভরা নাম, স্বদেশ, কি স্বাধীনতা, কি ঐ ধরনের কিছু। বলত সম্পাদক বলেছেন টাকা দেবেন। কিন্তু সে টাকা ও নিজেই সম্পাদকের কাছ থেকে আদায় করতে পারত না, তা আমাকে দেবে কোত্থেকে! সুখের বিষয়, আমিও কিছু আশা করতাম না, রাগও হত না, মনেও থাকত না। দিনকাল অন্যরকম ছিল। মোটা চালের দাম ছিল চার টাকা মণ। কিন্তু গৌর ঘোষ বলে ঐ ছেলেটির মনে ব্যাপারটা খচ্খচ্ করত। সে আমাকে এড়িয়ে চলত। আমি নিজের এবং অপরের ৫/৬টা অপোগণ্ডকে সামলাতে এতই ব্যস্ত থাকতাম যে তাও লক্ষ্য করিনি। অনেক বছর পর গৌর নিজে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল।

তবে ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ ছিল আমার কাজের সময়। আগেও বলেছি লোকে যখন কাজ ছাড়ে, আমি কাজ আঁকড়ে ধরি। লোকের যখন সব কথা বলা হয়ে যায়, লেখা না ছাড়লেও ছাড়াই উচিত, সেই বয়সে পৌঁছে আমার না বলা কথাগুলো এত বেশি দেরি করার জন্য আমাকে গঞ্জনা দেয়। মনে হয় ঐ দশ বছরের মধ্যে, কিম্বা হয়তো বছর দুই আগে থেকেই অনেক কাজ সেরেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে লীলা বক্তৃতা দেওয়ার কথা বলেছি, আধা-শূন্য হলে। সে বক্তৃতার বিষয় ছিল অবনীন্দ্রনাথের শিল্প আর সাহিত্য। পরে বিশ্বভারতী প্রকাশ করেছিলেন সুন্দর ছবি দিয়ে। শরৎচন্দ্র স্মৃতি বক্তৃতার বিষয় ছিল সুকুমার রায়। ঘর ভরা লোক শুনতে এসেছিল। সে বই মিত্র ঘোষ ছেপেছিলেন। এখন আমার রচনাবলী ৩য় খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। এসব কথা আগেও বলেছি।

সংক্ষিপ্ত জীবনী যারা চায়, তারাও বলে পুরস্কার ইত্যাদির কথা লিখবেন। সারা জীবন ধরে দেখেছি যোগ্য ব্যক্তিরা সব সময় পুরস্কার পায় না, আবার অনেক সময় অযোগ্যরা পায়। মাঝে মাঝে অযোগ্য উপায়েও। কাজেই আমার পুরস্কার পাওয়াকে খুব একটা গুরুত্ব দিই না। আমার সতীর্থদের দেওয়া শিশুসাহিত্য পরিষদের ভুবনেশ্বরী পদক নিয়ে আমার সবচেয়ে বেশি গর্ব। সতীর্থদের সমর্থন পাওয়া খুব কঠিন। সুরেশ স্মৃতি পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার পেয়ে আমার বা অন্য কোনো প্রাপকের লেখার কোনো উন্নতি না হলেও, আনন্দ হয়েছে যথেষ্ট। পাইনি শুধু সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার! আর পাবার সময়ও নেই। আক্ষেপও নেই। অবিশ্যি যে-বই কোনো পুরস্কার পায়, সে হাজার অযোগ্য হলেও হু-হু করে বিক্রি হয়। পুরস্কার বা বিক্রি দিয়ে সাহিত্যের মাপ হয় না।

আমার ‘রান্নার বই’য়ের কথা বলি। ছোটবেলা থেকে মা-কে দেখতাম ‘মিসেস্ ডীন্‌স্ কুক-বুক্’ বলে একটা ইংরিজি বই থেকে কেক, বিস্কুট, পুডিং মুরগীর স্ক্যালপ ইত্যাদি রোমাঞ্চময় নামের ও স্বর্গীয় আস্বাদের জিনিস করতে। কয়লার উনুনের ওপর একটা লোহার পাত ফেলে, তার ওপর বাক্স-তন্দুর চাপিয়ে ঐ সব হত। সব সময় সব উপকরণ পাওয়া যেত না। তখন মা বিকল্পের সাহায্য নিতেন। দিদি আর আমি জোগাড় দিতাম। দুজনারি ভারি কৌতূহল। আরো ছোটবেলায় শিলং-এ বাড়ির গাছে পীচ্, প্লাম, ন্যাসপাতি হত। বাড়ির পেছনে পাহাড়ের গায় নানা রকম বেরি হত। সেই সব তুলে এনে মা জ্যাম জেলি করতেন। হলুদ-সবুজ পীচ চিনি দিয়ে সিদ্ধ করলে গাঢ় লাল রং ধরত দেখে আশ্চর্য হতাম। তখনি শিখেছিলাম কোনো জিনিস খেতে হলে তাতে পারতপক্ষে জল দিতে হয় না। টক ফলের জ্যামে খানিকটা নুন দিতে হয় আর প্রায় ফলের সমান পরিমাণে চিনি দিতে হয়। দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে নয়, পেয়ালা করে মেপে। এই সব টুকরো পাঠগুলো মনের মধ্যে জমা ছিল। পরে নিজের সংসারে কাজে লাগিয়ে ভালোফল পেয়েছি। আমার বইতেও কিছু দিয়েছি।

লেখাপড়া নিয়ে জীবন কাটাই বলে ও সব কাজে আমার এতটুকু অরুচি নেই। ওগুলোকেও সৃজনশীল কাজ মনে করি। এবং মুখে যে যাই বলুক, কার্যতঃ দেখেছি শতকরা ৯০ জন তোক একটা ভালো ছবি দেখে যতই আনন্দ পাক, একটা নতুন রকম ভালো জিনিস খেয়ে তার শতগুণ আনন্দ পায়। সবাই স্বীকার করে না। মায়ের একটা রান্নার খাতা ছিল, কয়েকটা বাছাই জিনিস লেখা। আমি কখনো খাতা করিনি। মহিলাদের ইংরিজি মাসিক পত্রিকাতে নানা রন্ধন প্রণালী থাকলেও যে-সব উপকরণ, বাসনপত্র, যন্ত্রপাতির কথা থাকে, তা আমাদের মেয়েরা চোখেও দেখেনি। কিন্তু আমার স্বামীর কথায়, এক অ্যামেরিকাবাসী বন্ধু আমাকে ফ্যানি ফার্মারের রান্নার স্কুলের রান্নার বই এক কপি পাঠিয়ে দিলেন। একশো বছরের চল ঐ বইয়ের। প্রতি সংস্করণে সংশোধন ও সংযোজন। ঐ হল আমার কাল। দেখলাম মা-র সেই বিকল্প প্রয়োগের প্রচুর সুবিধা। কলকাতাই বাসন ও জিনিসপত্র দিয়ে, গ্যাস কিম্বা জনতা স্টোভে ঐ বই থেকে এবং বইয়ের বাইরে থেকে শত শত পরীক্ষা করে দেখলাম ভালোই উৎরোয়।

কি করে যে খবরের কাগজের লোকরা যা নেই তারো গন্ধ পায় জানি না। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে, পুজোর মুখে আনন্দবাজার থেকে ফরমায়েস এল মহালয়ার ড্র-আউটের জন্য ‘পুজোর ক-দিন কি রাঁধব, কি খাব’—এই বিষয়ে একটি লেখা দিতে হবে। তাই তো আমি চাই। এতে আমি অপমান বোধ করা দূরে থাকুক, ভারি গর্ব হল। আমি তাদের দলে নই যারা নিজের বাড়ির রান্নাঘরের কাজকে দাসীর কাজ বলে ঘেন্না করেন। এই প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। আমাদের সময়কার এবং তার ঠিক পরের যুগের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্তা মেয়েদের ঐ রকম মনোভাব থাকলেও, এখনকার আধুনিকারা সাহায্যকারীর আকালে এবং মাগ্যিগণ্ডার বাজারে, খুশি হয়ে শুধু রান্নাবান্না করে না, হাট-বাজার পর্যন্ত করে আনে। তাদেরি জন্য আমার ঐ খুদে লেখাটি। সহজ-প্রাপ্য উপকরণে (এক নুড়নুড়ি শাক ছাড়া) সহজ উপায়ে রান্নার নিয়ম। যাতে খেতেও ভালো হবে, খাদ্যগুণও নষ্ট হবে না, খেয়ে অসুখও করবে না। দিলাম রসিয়ে লিখে।

ঐ খুদে লেখাটির পর আমার এবং প্রকাশকদের মাথায় যে-সব চিন্তা ঘুরতে লাগল, তার-ই ফলে আমার রান্নার বই লেখা হল। দু বছর লেগেছিল। কারণ প্রণালীগুলো নিজে, কিম্বা আমার নির্ভরযোগ্য কারো দ্বারা রান্না করা এবং খেয়ে দেখা চাই। যতটা পারি আদি রচয়িত্রীদের পরিচয়ও দিয়েছি বইতে।

মজার কথা হল ঐ একটা বই থেকে আমি যত রয়েলটি পাই আর সমস্ত বই একসঙ্গে জুড়েও তা পাই না। শুনেছি এখানকার পুস্তকালয়ে একজন খদ্দের এসে রান্নার বইটি চাইতেই, আরেকজন বললেন ‘এ বই নিশ্চয়, ঐ নামের সাহিত্যিকের লেখা নয়?’ বিক্রেতা বললেন, ‘হ্যাঁ, তাঁরই।’ সে ভদ্রলোক বললেন ‘আশ্চর্য!’ একজন দর্শক আর থাকতে না পেরে বললেন, ‘কেন, আশ্চর্যের কি হল? যিনি বানিয়ে বানিয়ে এতগুলো গল্প উপন্যাস লিখতে পারেন, তিনি সামান্য একটা রান্নার বইতে কতকগুলো রান্না বানিয়ে লিখতে পারবেন না!’ তাই শুনে আমার এক কম-বয়সী বন্ধু লাফাতে লাফাতে আমার কাছে রিপোর্ট করল! আমি বলি কি বানিয়ে বানিয়ে এতগুলো ভালো খাদ্যের প্রণালী লিখবার ক্ষমতা যদি আমার থাকত, তাহলে তো কথাই ছিল না। এসব হল বহু কালের বহু রাঁধিয়ের অভিজ্ঞতা আর অধ্যবসায়ের ফল।

সে যাই হোক, ঐ সময়, অন্নপূর্ণা প্রকাশনীর জন্য দুটি ইংরেজি বইয়ের বাংলা করে দিয়েছিলাম। একটি হল লালবিহারী দে-র ফোক টেল্‌স অফ বেঙ্গল। অপরটি তাঁরই বেঙ্গল পেজেন্ট লাইফ। প্রথমটি ঠিক অনুবাদ নয়। অনেক গল্পের শুধু কাঠামো দেওয়া। বয়স্ক ইংরেজ পাঠকের জন্য লেখা। আমি কাঠামোতে দেহ গড়ে, ছোটদের উপযুক্ত করে দিয়েছিলাম। খুব জনপ্রিয় হয়েছে ঐ বই। দ্বিতীয়টি অনুবাদ। নাম দিতে চাইলাম ‘বাংলার কৃষি জীবন’। তা প্রকাশকের পছন্দ হল না। নাম দিলেন ‘গ্রাম-বাংলার উপকথা’। বইটি কৃষি বিদ্যার্থীদের অবশ্য পাঠ্য। অথচ নামের জন্য তাঁরা বইটির খবর রাখেন না। দু-তিন জায়গায় একটু সংশোধন করেছি, নইলে মূল বইটি অক্ষুণ্ণ আছে। সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় হল বাংলার গ্রাম গত দেড়শো বছরে এতটুকু অগ্রসর হয়নি। টিপ-কল আর অকেজো বিজলি তার ছাড়া।

অনুবাদের কথা বলতে হয়, কারণ আমি ভাবি পৃথিবীর সব ভাষায় শ্রেষ্ঠ রচনার অন্য সব ভাষায় অনুবাদ হওয়া উচিত। শুধু উড়োজাহাজ বেতার টি ভি নয়, তার চেয়েও মানবজাতির বড় সম্পদ মানুষের লেখা বই, পুঁথি। অনেক অনুবাদ করেছি। সব যে খুব মনের মতো বই তাও নয়। এক আধটা স্রেফ আর্থিক কারণেও করেছি, তবে খুব কম। হয়তো চমৎকার সাহিত্যকর্ম, কিন্তু আমাদের বাঙ্গালী শিক্ষিত সমাজের মনের মতো নয়। আমাদের প্রফেসার প্রফুল্ল ঘোষ বলতেন, সাহিত্যে অচল বলে কিছু নেই। যা কিছু মানুষ চিন্তা করে, তার সবই সাহিত্যের উপকরণ হতে পারে। সব নির্ভর করছে সেই উপকরণের ব্যবহারের উপর। কলম যেন নির্মল থাকে।

আগরতলার ঝরণা প্রকাশনীর জন্য ঈনিড ব্লাইটনের দশটি বাছাই করা ছোটদের রহস্যের বই অনুবাদ করে দিয়েছি। মূল বইগুলি ভবিষ্যৎ লেখকদের পথ দেখাতে পারবে। ঝরঝরে ভাষা, কৌতূহলোদ্দীপক রহস্য, বুদ্ধি দিয়ে সমস্যার সমাধান। রহস্যের বই লেখাও একটা শিল্প বিশেষ। গালিভারের ভ্রমণবৃত্তান্তের কথা আগেও বলেছি। হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যাণ্ড দি সী’ করেছি। চিল্ড্রেন্স বুক ট্রাস্টের অনেক বই করে দিয়েছি। পড়ুক সবাই। কোথায় কি ভালো লেখা হচ্ছে, জানুক। বন্ধুরা বলেন, ‘কেন অনুবাদ করে সময় নষ্ট করছ? মৌলিক গল্প লিখলে কি অনেক ভালো হয় না?’ তাই কি? অন্য কোনো দেশের শ্রেষ্ঠ বইয়ের চেয়ে আমার মৌলিক বাংলা বই অনেক ভালো হবে, এ-কথা বলতে পারলাম না। এইটুকু বলি সব কৃতিত্ব মৌলিক লেখকের, অনুবাদক কেউ না, বাহকমাত্র। অনুবাদ করে খুব একটা আনন্দও পাই না।

হয়তো ১৯৭২-৭৩ থেকে মাঝেমাঝে আমাদের চৌরঙ্গীর ফ্ল্যাটে একজন ফরসামতো, অমায়িক ও বিনয়ী মানুষ দেখা দিত। কি, না আমার একটা ছোটদের বই ছাপবে। খুদে বই হলেও আপত্তি নেই। বড় হলে তো কথাই নেই। আমি সর্বদা ভালোমন্দ কথা বলে ভাগিয়ে দিই। অমনি চলে যায়, কখনো রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করে না। ৬ মাস ৮ মাস পরে আবার আসে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, একটু গোলগাল, অতি ভদ্র মানুষটি। ওর ওপর কেমন মায়া পড়ে গেল। সে লোকটি বিমলারঞ্জন চন্দ্র।

সে সময়ে অমৃতে আমার পাকদণ্ডীর প্রথম পর্যায়ের তিন পৃষ্ঠা করে প্রতি সপ্তাহে বেরোয় আর যুগান্তরে ‘খেরোর খাতা বেরোয়। বিমলা মাঝে মাঝে ওগুলোর কথা বলত, আমি বলতাম পাকদণ্ডী ছোট প্রকাশককে দেব না, খেরোর খাতার বিষয়ে কিছু স্থির করিনি। তার বদলে বিমলাকে হাতির গল্পে ভরা হাতি! হাতি! বইখানি দিলাম। গল্পগুলো আমার স্বপরিকল্পিত নয়। কতক শুনেছি, কতক কাগজে পড়েছি, কতক আমার চেনা জানার মধ্যে ঘটেছে। তাপস দত্তর আঁকা সুন্দর ছবি দিয়ে, সুন্দর বই করল। পাঠকরাও খুব পছন্দ করল। ততদিনে ‘খেরোর খাতা’ শেষ হয়ে গেছে। তাপসকে দিয়ে, তার ছবিও আঁকিয়েছি। শেষটা বিমলাকেই দিলাম। সে খুশি হলেও, এতদিন ফেলে রাখল যে আমি ধৈর্য হারিয়ে তুলে নিলাম। ১৯৭৮-এ ঐ বই ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ প্রকাশ করেছেন। বিমলাকে পর পর আরো দুটি বই দিলাম, ‘আরো ভূতের গল্প’ ১৯৮১ আর সন্দেশে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘ভূতোর ডাইরি’ ১৯৭৯। ভালো করে সব বই ছাপে বিমলা। তবে ছোট প্রকাশকদের যে অসুবিধা বিমলাকেও তার সম্মুখীন হতে হয়। বিজ্ঞাপনের বড় বেশি খরচ। ফলাও করে যেসব বইয়ের বিজ্ঞাপন বেরোয়, সেগুলোই বেশি বিক্রি হয়। তা সে ভালোই হোক কি মন্দই হোক। বিমলা কখনো আনাড়ি বই প্রকাশ করে না।

ততদিনে আমরা শান্তিনিকেতনবাসী হয়ে গেছি। গোড়ায় হয়তো ৬ মাস এখানে ৬ মাস ওখানে করতাম। তারপর কলকাতার মেয়াদ কমতে কমতে তিন মাসে দাঁড়াল। আমার যা লিখবার, তা কলকাতাতেও যেমন, এখানেও তেমন করা যায়। কিন্তু খোপ-খোপ দেওয়া ৪৮ বছরের পুরনো ডেস্কটার জন্যও মন-কেমন করে। ভাবি গোল চেয়ারটি হলেও বেশ হত। হয়তো ৩০ বছর আগে রাসেল স্ট্রীটে একটা পুরনো আসবাবের দোকান থেকে ৪০ টাকা দিয়ে কিনে এনেছিলাম। আনা-নেওয়ার অসুবিধা আছে, তবু ভাবি ও-দুটোকে নিয়ে এলেও হয়।

আমার স্নেহাস্পদ সমরেশ বসুর ছেলে দেবকুমার। সে কলকাতায় আমার সঙ্গে আলাপ করল। ওদের প্রকাশনীর নাম মৌসুমী। তাদের আমার ছোটদের আরব্য রজনী দিলাম। আগে অন্য প্রকাশক নিয়েছিল। তার ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য আমাকে না বলেই দেবকুমারকে পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিয়েছিল। দেবকুমার এসে সব কথা বলে আমার অনুমতি নিয়ে সুন্দর করে বইটি প্রকাশ করল। রয়েলটির সবটাই আমাকে অগ্রিম দিয়ে গেল। আমি এত খুশি হলাম যে খানিকটা রিবেট দিয়ে দিলাম! ঐ বইয়ের তিনটি সংস্করণ হয়ে গেছে। চতুর্থ-ও হবে। অরেকটি বইও দু-খণ্ডে প্রকাশ করেছে। সেটি হল ছোটদের জন্য দেশ-বিদেশের সেরা গল্প। অনুবাদ নয়। গল্পগুলির সারাংশ সরস বাংলায় লেখা।

বয়স থেমে নেই, তবে ঐ যা বললাম, টের পাই না। প্রায় তিন বছর আগে আমার দাদা কলকাতায় পথের দুর্ঘটনায় মারা গেল। দাদা ছাড়া জীবন আমি ভাবতে পারতাম না। আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। চুপচাপ, তীক্ষ্ণ মেধা, অমন অংকের মাথা আর দেখলাম না। ছোটবেলা থেকে যত সব জটিল অংক জলের মতো করে বুঝিয়ে দিত। পেশায় স্ট্যাটিস্টিশিয়ান। ক্রিকেট খেলা বিষয়ে এত জ্ঞান কম বাঙালীর দেখা যায়। সেই দাদা স্কুটারের ধাক্কায় মাথায় চোট লেগে, মারা গেল।

পড়াশুনো ভালোবাসত। গল্প লিখত। বিজ্ঞান-নির্ভর বাস্তব গল্প। তার একটির নাম ‘তুষারমানবের সন্ধানে’। তিনটি সংস্করণও হয়েছে। পরেরগুলি বিমলা করেছে। আরো দুটি গল্প ‘গ্রহের অবসান’ আর ‘অন্য গ্রহের আমি’ ধারাবাহিক ভাবে সন্দেশ ও অন্য কাগজে বেরিয়েছে। বই হয়নি। বড্ড বেশি জটিল তথ্যে ভরা। ভাবি একটু সরস করে পুনর্লিখন করে দিই। দাদা রসটসের ধার ধারত না। আমাকে বলত তুই লিখে দে নতুন করে। ভাবি তাই দেব। যদিও আমার বিজ্ঞানের বিদ্যা খুব গভীর নয়।

দাদা নেই এ-কথা মেনে নিতে কিছু দিন লাগল। তার মধ্যে আমার মেজ ভাই কল্যাণের টি-বি হল। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে ওর আট মাস সময় আর বারো হাজার টাকা লাগল। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম মরণের দোরগোড়া থেকে কেমন দিব্যি সুন্দর ফিরে এল। না বলে দিলে এখন কেউ বুঝবে না সে বিপদের কথা।

আমার ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি ভাই-বোন কলকাতায় থাকে। আমরা এখানে থাকি। খুব সুখে থাকি। তবু বলেছি তো মনের অর্ধেকটা সেখানে পড়ে থাকে। লেখার কোনো অসুবিধা হয় না। আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু, মৌসুমীর দেবকুমার, বিমলা, অন্নপূর্ণার অজয় দাশ, নাথ ব্রাদার্সের সমীর, শৈব্যার রবীন বল,নবম-দশমের নীরদ হাজরা, এবং আরো অনেকে দরকার হলেই এসে যায়। অসুবিধাকে ওরা ভয় পায় না। আনন্দ পাবলিশার্সের বাদলের কথা বলি। লম্বা শ্যামলা মানুষটি, বয়স বেশি নয়। কত তা বলতে পারছি না, কারণ পঞ্চাশের নিচে সবাইকে আমার ছেলেমানুষ মনে হয়। পঞ্চাশের ওপরের কাউকে কাউকেও। বাদল হল বুদ্ধিমান ও সহৃদয়। প্রকাশকের কাজ খুব সহজ নয়। বিশেষ করে যদি সে কোনো বিশাল সংস্থার কর্মচারী হয়। তখন তাকে কতকগুলো বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে যেতে হয়। ইচ্ছামতো ঝুঁকি নিতেও পারা যায় না। দিলীপ গুপ্তর ব্যাপার ছিল আলাদা। সে স্বাধীনভাবে কাজ করত। লাভ-লোকশান দুই-ই বহন করত। নতুন লেখক খুঁজে বেড়াত। পুরনো লেখকদের অনুপ্রেরণা দিত। আমি তার চেয়ে ১০ বছরের বড়, আমাকেও বারবার বলত, ‘আপনার মধ্যে কি সম্পদ আছে, আপনি নিজেই জানেন না। সব উজাড় করে দিন।’ অমন আর দেখলাম না। আমার নতুন প্রকাশকরা ও-কথা বলার সাহস না পেলেও, সম্ভব হলেই সুযোগ করে দেয়। বাদল তো বটেই।

মনে আছে তিন বছর আগে নববর্ষে তাদের আপিসে গিয়ে দেখি বাদল, ফণীবাবু, অভীক তো আছেই, উপরন্তু পূর্ণেন্দু পত্রীও আছে। আমি বললাম, ‘তোমাদের আগ্রহ থাকে তো একটা প্রস্তাব দিই।’ ওরা বলল, ‘খুব আগ্রহ, বলুন কি প্রস্তাব।’ তখন আমি সেরা সন্দেশ প্রকাশের কথা পাড়লাম। নতুন সন্দেশের ১৯৮১-এ ২০ বছর পূর্ণ হল। এই কুড়ি বছরে প্রকাশিত রচনা থেকে বাছাই করে একটি বড় বই ওরা প্রকাশ করতে রাজি কি না। রয়েলটির ভিত্তিতে। তক্ষুণি রাজি। বাদলের কি উৎসাহ। তাই দেখে আমার উৎসাহ আরো জোর পেল। লেখা আমরা দেব, বাছাই করে। সব খরচ এবং দায়িত্ব ওদের। তখুনি রাজি এবং যত শীঘ্র সম্ভব কাজ আরম্ভ। সকলে মিলে খেটেছিলাম। সত্যজিৎ সব নতুন ছবি, প্রচ্ছদ, লেআউট করে দিয়েছিল। বই করতে কত খরচ পড়েছিল ভাবতেও সাহস হয় না। সন্দেশ পত্রিকা সেই প্রথম সংস্করণে ৩০ হাজার টাকা রয়েল্টি পেয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন দামটা বড্ড বেশি, রিবেট পেলেও অনেকে কিনতে পারবে না। কিন্তু ওর মান খর্ব না করে, ওর চেয়ে কমে হয় না। লেখকরা, কর্মীরা এক পয়সা নেননি।’

কয়েক মাসের মধ্যেই সংস্করণটি শেষও হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল। তাতে কয়েকটা বাড়তি লেখা আছে আর সবচেয়ে ভালো কথা পিছন দিকে লেখক পরিচয় দেওয়া আছে। বিদেশে আজকাল প্রায় সব বইতেই লেখকের বিষয়ে কিছু তথ্য দেওয়া থাকে। আনন্দ পাবলিশার্স ঐ একটি চমৎকার নিয়ম পালন করেন। গোড়া থেকেই আমার ঐ রকম ইচ্ছা ছিল। প্রথমবার হয়ে ওঠেনি, দ্বিতীয় সংস্করণে সন্দেশের কয়েকজন ভক্তের সাহায্যে জনা ৭/৮ বাদে সকলেরই পরিচয় সংগ্রহ করা হয়েছে। পাঠকদের জানা উচিত এ-সব তথ্য।

আরেকজন প্রবীণ প্রকাশকের নাম ভুলে গেলে চলবে না। তিনি সকলের ওপরে। সাহিত্য সংসদের শ্রীমহেন্দ্র দত্ত। ইনি আমার সম্পাদনায় সুকুমারের কিছু বই আর আমার যুক্তাক্ষর বর্জিত গল্প সংগ্রহ ‘জানোয়ার’ প্রকাশ করেছেন। মহেন্দ্রবাবু শিশুসাহিত্য পরিষদের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। প্রতি বছর পরিষদের হাত দিয়ে দুটি হাজার টাকার পুরস্কার দেন। একটি হল সে-বছরের শ্রেষ্ঠ ছোটদের বইয়ের লেখককে, একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পীকে। মুশকিল হল বইগুলি দশ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের যোগ্য হওয়া চাই। ঐ বয়সের জন্য ভালো বই কত কম বেরোয় দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি। আমি নিজেও লিখি আরেকটু বড়দের জন্য। উপযুক্ত বই খুঁজে হদ্দ হতে হয়। তবে ক্রমে দেখছি অনেক প্রতিভা সম্পন্ন এবং সুরসিক ইলাস্ট্রেটর দেখা দিচ্ছেন। এই একটা নতুন লাইন তরুণ শিল্পীদের জন্য খোলা হয়ে গেল। জল রঙের, তেল রঙের দামী ছবি আর ক-জন কেনে? কিন্তু প্রতি বছর হাজার হাজার সচিত্র বই বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, তার জন্য শিল্পী দরকার হয়। শুনেছি আর্ট কলেজে এ-সব শিক্ষা দেওয়া হয় না। তবে কমার্শিয়াল আর্টে কিছুটা প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়, আর অভিজ্ঞতার মতো আছে কি?

অনেকে বলে এই বয়সে এত লেখ কি করে? আমি বলি লেখার আবার এখন তখন কি? কত লেখা বহু বছর ধরে মনে ঘোরাঘুরি করেছে, এতদিনে তাদের নামিয়েছি। কতক আপনা-আপনি লেখা হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর পুজোর সময় গোটা দশ-বারো গল্প লিখতে হয়, বই হয় না, ফাইলে জমে থাকে। আজকাল সেগুলোকে বিষয়বস্তু অনুসারে প্রকাশ করার চেষ্টা করি। বিমলা হাতির বই ছেপেছে, এবার কুকুর এবং অন্যদের বিষয়ে একটা নতুন বই করছে। নিউস্ক্রিপ্ট আরো হাস্য ও রহস্যের গল্প ছেপেছিল, এ বছর ‘আজগুবি’ ছাপল। শৈব্যা ছাপল ‘কল্প-বিজ্ঞানের গল্প’, আনন্দ পাবলিশার্স ছাপল ‘সব ভূতুড়ে’। এর আগে তারা ‘কাগ নয়’ বলে বাছাই করা ছোট গল্প সংগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এ-সব গল্প আগে বই হয়নি। ‘কাগ নয়’ গল্পটি আমার ১৯/২০ বছর বয়সে লেখা। আজগুবি। আজগুবির প্রতি আমার বড় দুর্বলতা। কিম্বা বলিষ্ঠতাও বলা যায়। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড ‘হাওয়ার দাঁড়ি’ প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ বিজ্ঞানের গল্প। স্রেফ আজগুবি। উদয় থেকে ‘ময়না-শালিখ’ বেরিয়েছে, আজগুবি নয়, একটু খামখেয়ালী। বাস্তবিকই বইয়ের মধ্যে গেঁথে না দিলে গল্প হারিয়ে যায়। একথা ৫২ বছর আগে আমার প্রথম বই বেরোবার অনেক আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন।

শান্তিনিকেতনবাসী হয়ে অন্য একরকম দিগন্ত দেখতে পাই। আগে যেমন বহু দূরে নীল আকাশের সঙ্গে নীল বনানীকে মিলে যেতে দেখতাম, সে আর এখন নেই। এখানেও দেখি কেবলি বসতি হচ্ছে, বন সরে যাচ্ছে। আগে সন্ধ্যাবেলায় অদ্ভুত চেহারার ছোট ছোট ডানাওয়ালা কচ্ছপের মততা, শিরা-কাটা শুকনো পাতার মতো পোকারা বারান্দার আলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারা সব ঐ নিয়ত অপসৃয়মান বনান্তরেখার সঙ্গে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। তবু আপিস আদালত বিদ্যালয় ছুটি হলেই এখানে গভীর শান্তি বিরাজ করে। কোনো অস্থায়ী শোচনীয় ও হিংসাত্মক ঘটনা তাকে দূর করতে পারে না। বরং সেগুলোকেই অবাস্তব বলে মনে হয়। এই হল শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত রচনার আদর্শ স্থান। এখানে চাহিদা খুব কমে যায় ; আগে যাকে অতি আবশ্যক বলে ভাবতাম, এখন দেখছি তাকে ছাড়া দিব্যি চলে যায়।

এখানে আমাদের পুরনো বন্ধুরা আছেন, ৯১ বছর বয়সের প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ৭৯ বছরের প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায়। হীরেন দত্ত, শ্যামল ঘোষ, রসরচনায় ও পৌরুষে অতুলনীয়। আমার প্রায় সমবয়সী রণজিৎ রায় যেমন দক্ষ আই-সি-এস, তেমনি অতুলনীয় শিকারী আবার তেমনি লেখক ; কিছু কমবয়সী ডাঃ সুবোধকুমার দাশগুপ্ত। তার চেয়েও ছোট অজেয় রায়, যে বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং অন্য স্বাদের চমৎকার গল্প লেখে ; সাংবাদিক অশেষ চট্টোপাধ্যায় গল্প লেখকও বটে ; কবি অশোকবিজয় রাহা। সম্পাদনার কাজে দক্ষ পুলিন সেন থাকেন মাঝে মাঝে ; তাঁর হাতে তৈরি অধ্যাপক অনাথনাথ দাশ আছে। আরো বহু লোক আছে, সুরসিক প্রিয় বন্ধু সব। ডাক দিলেই এসে জড়ো হয়। ডাক না দিলেও। বোলপুরে থাকে স্বপন ঘোষ, লাইব্রেরিতে কাজ করে এবং বিশ্বের সকলের সব সমস্যার সমাধান করে। লেখক বীরেন বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। উদীচী বলে সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেন, স্বপন ঘোষের সাহায্য নিয়ে। গাইয়েরা আছে, শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্রও আসে মাঝে মাঝে। আর আছে এখানকার প্রাণের প্রাণ ছোট বড় শত শত ছাত্র-ছাত্রী। কতখানি দরকার হয় পরিপূর্ণরূপে বাঁচতে হলে? আমার মনের পিছনে মহানগরের কোলাহল শুনতে পাই। দূর থেকে শুনি বলে কান জুড়োয়। পুরীর সমুদ্রে ঢেউ ভাঙার শব্দের মতো। ছোটবেলায় মাঝরাতে জেগে উঠে সরলবনে বাতাস বওয়ার শব্দের মতো। গ্রামে কখনো বাস করিনি। গ্রামের দুঃখ-কষ্ট শুধু বইতে পড়েছি। গাড়ি করে যেতে সেখানকার দৈন্যদশা চোখে পড়েছে। শহরের দৈন্যের গ্লানি বোধ হয় আরো বেশি। গ্রামের একটা মধুর দিকও আছে, এখানে এসে মাঝে মাঝে টের পাই। গ্রাম নিতান্ত গ্রাম্য নয়। সেখানেও বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি সযত্নে লালিত হয়।

বোলপুরে কেষ্ট বলে এক ঢ্যাঙা ছেলে আছে। সব সময় চুল ছাঁটে না, প্রায়ই দাড়িও কামায় না, কখনো সেজেগুজে আসে, কখনো আধময়লা কাপড় চোপড়ে সোজা কর্মস্থল থেকে। বোলপুর কলেজের আপিসে কাজ করে সে। গত বছর সে আমার কাছে মুরারৈ গ্রামের কয়েকজন উৎসাহী ছেলেকে নিয়ে এসেছিল। তারা লেখে, কাগজ প্রকাশ করে, সভা করে, সঙ্গীত চর্চা করে। আর প্রতি বছর একজন কি আরো বেশি কজনকে শ্রদ্ধার্ঘ দেয়। নভেম্বরে আমাদের বাড়িতে তারা জনা পঞ্চাশেক চমৎকার এক অনুষ্ঠান করে গেল। বীরভূমের কবি অভয়পদ রায়কে, প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায়কে আর আমাকে মাল্য চন্দন, রেশমী উত্তরীয় আর সুন্দর একটি করে স্টেনলেস্ স্টিলের থালা দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ সাজাল। কি সুন্দর অকপট সব ভাষণ। মুক্তি বলে একজন সুন্দর ছড়া লেখে ; তার স্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ ; সাগর বলে তাদের দলের নেতা ; সব নিয়ে ছোটখাটো দলটি আমার মনের ওপর কোমল একটা ছাপ রেখে গেল। অনুষ্ঠানের পর সকলে মিলে খিচুড়ি খাওয়া। ব্যবস্থাপনা দেখে অবাক হলাম। এতটুকু অশান্তি, তর্কাতর্কি নেই, সে যে কি আনন্দে উৎসবটি সম্পন্ন হল কি আর বলব। এরাও আমার বন্ধু বটে। এখানে না এলে এদের নাগাল পেতাম না।

এর কয়েক মাস আগে বিধান নগরে শিশু উদ্যানের সুন্দর সভায় সমাদর পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কি সর্বাঙ্গসুন্দর অনুষ্ঠান। অত বড় হলের প্রত্যেকটি মানুষের কি আগ্রহ। নীরেন চক্রবর্তী চমৎকার ভাষণ দিল। এ আমার সেই নীরেন। অনেক জায়গায় তাকে যখন তখন উঠে দাঁড়িয়ে অলিখিত ভাষণ দিতে শুনেছি। চিন্তার এত পারিপাট্য আর ভাষার মাধুর্য কম লোকের আছে। একটা সম্পাদকীয় খোলসে আত্মগোপন করলেও কবি-মন ঢাকা যায় না। আরেকজনের কথা না বললে অন্যায় হবে। তাঁর নাম অতুল্য ঘোষ। বহু বছর ধরে তাঁর নামও জানি, দেখেওছি। কিন্তু রাজনীতির লোকদের এড়িয়ে চলি, তাই আলাপ হয়নি। মানুষটিকে চিনিনি। ভুল বুঝেছি। ঐ সভার কিছুদিন আগে একজনের কাছে শুনলাম রাজনীতির মানুষ বলে আমি যা বলতে চাই উনি আদৌ তা নন। বিদ্বান লোক। বিদ্যা দান করতে ভালোবাসেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে জেল খাটার সময় একজনকে তিনি এত উৎসাহ দিয়েছিলেন আর যত্ন নিয়ে পড়িয়েছিলেন যে সে ভালো ভাবে এম এ পাশ করেছিল। এইসব শুনতে ভালোবাসি। লোকটিকে নতুন চোখে দেখলাম। শিশু উদ্যান বলতে গেলে তাঁর ‘অনুপ্রেরণাতেই হয়েছে। বিধান রায়ের স্নেহ একসময়ে আমরা পেয়েছিলাম। মনটা নরম হয়ে গেল। এ-ভাবে আমরা কত মানুষকে ভুল বুঝি। ভাগ্যিস ওই সুযোগটি পেয়েছিলাম। ওখানকার ছেলেমেয়েগুলোর তুলনা হয় না। মনে হল গোছাগোছা ফুল রোদে ঝলমল করছে। শীতকালে একবার গিয়ে শিশু উদ্যানটি ভালো করে দেখার ইচ্ছে আছে। এসব দেখি আর ভাবি কে বলেছে আমাদের দেশটা নষ্ট হয়ে গেছে? যেদিন এইসব ছেলেমেয়েরা তাদের উত্তরাধিকার পাবে, সেদিন দেখা যাবে অন্যরকম জগৎ। জন্মমুহূর্তে কেউ সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে মাটিতে পড়ে না। যতদিন বাঁচে তিলে তিলে তৈরি হয়। যা দেখে, যা শোনে, যা পড়ে, যা ভাবে, সব মিলিয়ে তিলে তিলে তৈরি হয়। এই বয়সেও ওইরকম করে আমার মোহ ঘুচছে, জগৎটাকে প্রসারিত হতে দেখছি।

সারা জীবনটা একটা চলচ্চিত্রের রিলের মতো মনের সামনে খোলা থাকে। আমার সব ভুলচুক, দৈন্য, অক্ষমতা, অন্যায় সুদ্ধ আমার জীবনকে আমি দেখি। এ বছর ফাল্গুন মাসে আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বন্ধুবান্ধবদের ডেকে, আমাদের বাগানের গাছতলায় আমরা উৎসব করলাম। বুঝলাম কত পুরনো ব্যথা অভিমান কবে যে বুদবুদের মতো বিলীন হয়ে গেছে নিজেই টের পাইনি। কত স্নেহ পেয়েছি, কত লোকের কাছ থেকে কত সাহায্য পেয়েছি। মা-বাপ থেকে শুরু করে এই আমার নতুন প্রতিবেশীদের পর্যন্ত সকলের কাছে আমি কত ঋণী। আমাদের ওই সুবর্ণজয়ন্তীর দিন বার বার সে-কথা ভেবেছি। যা পাইনি তার জন্যে দুঃখ নেই, যা পেয়েছি তা দিয়ে মন ভরে আছে। বিধাতা যতদিন রাখেন, যেন কাজ করে যেতে পারি আর যখন ডাক দেবেন, সব ছেড়েছুড়ে কলম নামিয়ে যেন চলে যেতে পারি।

____

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *