॥ ১ ॥
পাহাড়ের মাথায় স্কুল, সেইখানে দিদিকে আমাকে নিয়ে গিয়ে মা ভরতি করে দিয়ে এলেন। বোধহয় সাহস দেবার জন্য বড় মাসিমা আমাদের সঙ্গে গেলেন। দিদির বয়স সাত, আমার বয়স ছয়। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে তিন-চার অক্ষরের ইংরিজি কথা একটু একটু পড়তে পারি। কিন্তু কেউ ইংরিজি বললে এক বর্ণ বুঝতে পারি না, নিজেরা তো বলতে পারি না-ই। মেমদের স্কুল, লোরেটো কন্ভেন্ট; যাঁরা পড়ান তাঁদের বেশির ভাগই সম্ভবত পাকা মেম, অন্তত সবাই সমান ফরসা। বিশেষত সাদা-কালো ঝোলা-ঝোলা পোশাক পরা, কান পর্যন্ত ঢাকা-চাপা দেওয়া—ফিরিঙ্গী সহপাঠিনীরা সানন্দে আমাদের জানাল যে ভেতরে ভেতরে সব নাকি ন্যাড়া মাথা—নান্দের এমনি সাদাতে গোলাপীতে মুখের আর হাতের রঙ যে আমরা দুই বোন হাঁ করে চেয়ে থাকতাম। ছাত্রীদের গায়ের রঙ দেখলাম বিচিত্র। খুব সুন্দর গোলাপীও ছিল, তারপর একটু হলদেটে একটু তামাটে করতে করতে আইরিস্ ডি-সিলভা ছিল আমাদের চেয়েও কালো। কিন্তু ওরা বলত ওরা সবাই খাঁটি মেম, এদেশের হরিড্ ক্লাইমেটে থেকে থেকে সত্যিকার রঙ চাপা পড়ে গেছে। তবে আছে ঠিকই তলায় তলায়। আইরিসের আত্মীয়স্বজনরা নাকি পর্তুগালে থাকে, বেজায় বড়লোক। আমাদের মতো নেটিভ নয়। ওরা যা বলত আমরা সব বিশ্বাস করতাম, যদিও মা শুনে হাসতেন।
বলা বাহুল্য এ-সব শুনে মন বড়ই দমে গিয়েছিল। ইংরিজি তো আর জানি না, তাই কথাগুলো অদ্ভুত এক হিন্দীতে বলা হয়েছিল। সেই ভাষায় বাবুর্চিকে বলে ‘বোর্চি’, জলের কুঁজো হল ‘সেরাই’। যাই হক বাইব্ল্ স্টোরিজের ছোট্ট বইখানি খুলে একটা চেনা মুখের ছবি দেখে, মনে কিছু বল পেলাম। ছবিটা নাকি গড্-এর। ছয় দিনে তামাম জগৎ সৃষ্টি করে, সপ্তম দিনে মেঘের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে গড্ একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। এই লম্বা দাড়ি-গোঁফ, কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়া চুল, টানলে নিশ্চয় আরো লম্বা হয়। পরনে পায়ের কব্জি অবধি ঝোলা একটা জোব্বা। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথদের বাড়ির লোকদের ঐরকম পরতে দেখেছিলাম। সে যাই হকগে, গড্-এর মুখখানি দেখে মনে হল একে যেন কোথাও দেখেছি। ভিড়ের মধ্যে হঠৎ দেখাও নয়, অনেক দিন ধরে দেখেছি। গলার স্বরটাও মনে পড়ল। সেই সঙ্গে মনে হল চোখে ইস্টিলের ফ্রেমের চশমা থাকা উচিত ছিল, তার ভাঙা ডাঁটি সুতো দিয়ে বাঁধা। দিদিকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “গড্-এর ছবি, দেখছিস্ না নাম লেখা রয়েছে। গড্ হল ভগবান, ভয়ঙ্কর ভালো উনি। আমাদের বানিয়েছেন।”
মনে ভারি খট্কা লাগল। ছোটবেলা থেকে শুনেছি ভগবানকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবে আবার তাঁর ছবি আঁকা হল কি দেখে? দিদি ভুল বলেছে, গড্ অন্য কেউ। রাতে শুয়ে শুয়ে হঠাৎ সেই অন্য কেউটিকে মনে পড়ে গেল। তাঁর নাম নীলমণিবাবু, সত্যি ভয়ঙ্কর ভালো, আমাকে ডাঁটা চিবুতে দিতেন। চেরাপুঞ্জিতে থাকতেন। তাঁর একটা সাদা-লাল্চে লোমশ কুকুর ছিল, তার নাম ভজহরি। সে বড় দুষ্টু ছিল, আমাদের ছোট ভাই কল্যাণের দুধ খাবার বোতল ভেঙে দিয়েছিল। কল্যাণের মুখে তখনো ভালো করে কথা ফোটেনি। সে ঘোর অনিচ্ছায় দুধের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বলেছিল, ‘ভজি বোতল ঠাঁই!’ যাক্, নীলমণিবাবুই তাহলে গড্! এ ভুল ভাঙতে অনেক সময় লেগেছিল। পরে শুনেছিলাম ভজি বেচারা মোটেই বোতল ভাঙেনি। বোতল অভ্যাস ছাড়াবার জন্য কল্যাণকে ঐ রকম বলা হয়েছিল।
সে কথা থাক, এটুকু সত্যি যে নিজেদের বাড়ির লোকেদের ছাড়া প্রথম যে বাইরের মানুষের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে, তিনি হলেন নীলমণিবাবু। চেরাপুঞ্জি শিলং থেকে মাত্র ৩৩ মাইল দূরে হলেও, সেকালে সেখানে যেতে দু দিন লাগত। মটরগাড়ি বা রেল ছিল না। হয় দুই চাকাওয়ালা এক ঘোড়ায় টানা টঙায়, নয়তো মান্ষে টানা পুশ-পুশে যেতে হত। মাঝপথে ভাম্পেপ বলে একটা জায়গা ছিল, সেখানকার সুন্দর ডাকবাংলায় রাত কাটাতে হত।
ভাম্পেপে পৌঁছনোর কথা আমার খুব মনে আছে। তখনো আমার তিন বছর পূর্ণ হয়নি। পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেছিল, আমাদের গাড়িতে বড়রা কেউ ছিলেন না। কল্যাণ ঘুমিয়ে আমার গায়ে গড়িয়ে পড়ছিল, আমি তাকে সামলাতেই ব্যস্ত। দাদা কাঠ হয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিল আর দিদি সে-সময় ফোঁৎ-ফোঁৎ করে একটু কেঁদে নেবার সুযোগ পেলে কখনো ছাড়ত না। চারদিক ভয়ঙ্কর চুপচাপ, আকাশটাকে বেজায় নিচু মনে হচ্ছিল।
এমন সময় হঠাৎ দেখি সারি-সারি আলো-জ্বলা একটা বাড়ি, লোকজনের হাঁক-ডাক, ঘোড়ার পা-ঠোকার, লাগাম ঝন্-ঝন্ করার শব্দ। ঐ আরেকটি সুন্দর জিনিস আমার মনের মধ্যে লেগে রইল; বিপদ অন্ধকার কাটিয়ে আলো-জ্বলা ঘরে এসে পৌঁছনো। বলা বাহুল্য, কতক পাকদণ্ডী বেয়ে হেঁটে, কতক ঘোড়ায় চড়ে, বড়রা অনেক আগেই পৌঁছে গেছিলেন। মা লম্বা কাঠের বারান্দায় আমাদের পথ চেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন । অমনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে আমাদের কোলে করে নামালেন। মায়ের মতো আছে কি! আলো-জ্বলা ঘরের মতো মিষ্টি আশ্রয় আর কোথায়?
গড্-এর ছবি দেখে ঐ একদিনেই অবিশ্যি এত কথা মনে পড়েনি, থেকে থেকে একটু একটু করে স্মরণ হয়েছিল! নীলমণিবাবু ছিলেন ব্রাহ্ম প্রচারক। চেরাপুঞ্জিতে ছিল তাঁর ডেরা। বহু দুঃখী পৰ্বতবাসী তাঁর বাড়িতে খেত, খাসিয়া ভাষায় লিখতে পড়তে শিখত। নিরক্ষর গাঁয়ের লোক সব, তখনো সভ্যতার আলো অতদূর পৌঁছয়নি, প্রাকৃতিক শক্তির পুজো করত তারা, সাপের পুজো করত, আদিম সব বিশ্বাস ছিল। তাদের মধ্যে নীলমণিবাবু কাজ করতেন। যতদূর মনে হয় যার খুশি তাঁর বাড়িতে যেতে পারত। নিরামিষভোজী সাত্ত্বিক মানুষটি বিয়ে-থা করেননি। এ সমস্তই পরে শোনা; এর জন্য তিনি আমার মনে দাগ কাটেননি। যে-জন্য তাঁকে মনে আছে সে হল তাঁর বাড়িতে যার খুশি আসছে, খাচ্ছে, আমিও ডাঁটা চিবুতে পাচ্ছি আর তাঁর ঐ অবিস্মরণীয় ভজহরি কুকুরটি।
তার ওপর এতকাল পরে দেখছি গড্-এর ছবির সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত সাদৃশ্য। এই সাদৃশ্য বোধহয় অন্য লোকেরও চোখে পড়ে থাকবে, কারণ যখন আমার কৈশোর শেষ হয়ে আসছে, সেসময় একজন ভক্ত ব্রাহ্ম আমাদের বাড়িতে এসে ঐ কথা শুনে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, খুব খাটতেন সত্যি, অনেক গ্রামবাসীকে পাহাড়-পথের জীব-জন্তুর পুজো ছাড়িয়ে একমাত্র ভগবানের উপাসনা করতে শিখিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, তাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছিল যে, নীলমণিবাবুই হলেন সেই একমাত্র ভগবান যার উপাসনা করা উচিত!”
যার তিন বছর পূর্ণ হয়নি, সে আবার কতখানি প্রভাবিত হতে পারে? তবে মনে হয় যা দেখা যায়, যা শোনা যায়, যা করা যায়, সব দিয়ে তিলে তিলে একেকটা মানুষ তৈরি হয়। ঐ যে আমার ছোটবেলাটি কেটেছিল পাহাড়ের বুকে, ছোট্ট নদীর কলধ্বনিতে, ঝরনার ঝরঝর শব্দে, বর্ষার প্রচণ্ড বরিষণে, গ্রীষ্মের মিষ্টি রোদে, শীতের বরফজমা স্পর্শে, দিনরাত অবিরাম সরলগাছের শোঁ-শোঁ শব্দের মধ্যিখানে, জন্তু-জানোয়ার, পাখি-প্রজাপতি, পোকা-মাকড় পরিবেষ্টিত হয়ে, তারা আমার মনের পটে যে দাগ রেখে গেছিল, কোনো মানুষের প্রভাবের চাইতে সে কম নয়।
বাইরের এই বিশ্ব-প্রকৃতি আর ঘরের নিরাপত্তা, মানুষের ছেলেমেয়ের আর কিছুর দরকার নেই। ইঁকড়ার দেয়াল, টিনের ছাদ, ওখানকার বাড়িগুলো খুব যে নিরাপদ ছিল তা-ও নয়, নিরাপত্তাটি অন্য দিক থেকে আসত। সে মনের জিনিস। তাকে ভাঙা যায় না, কারণ সে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। বড় নিশ্চিন্ত সুখে আমাদের শৈশব কেটেছিল। নিরাপদ নিশ্চিন্ত সুখে ছোটবেলাটি কাটলেও, বাবা বেজায় কড়া ছিলেন। তাঁর মনে কোনো সন্দেহই ছিল না যে ছেলেপিলেকে কষে না পেটালে তারা মানুষ হয় না। আমাদের জন্য বাবা সম্ভবত সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তাঁর কথার এতটুকু নড়চড় হলেই এমনি এক হুঙ্কার দিতেন যে আমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা! সত্যি কথা বলতে কি, ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে আমার একটুও বনত না এবং পরে একেবারে ছাড়াছাড়িই হয়ে গেছিল। কিন্তু তখনো টের পেতাম যে দুজনের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে। সে যাই হক, ছোটবেলায় বাবাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম, আবার বেজায় ভক্তিও করতাম। যেমনি কড়া, তেমনি গায়ের জোর। একবার কলতলা থেকে বাবার এঁটোপাতের কুলের বিচি চুষেছিলাম বলে এইসা চড় মেরেছিলেন যে এখনো মনে করলেই কান ঝিমঝিম করে। যেমনি কড়া, তেমনি গায়ে জোর ছিল। হকি-ক্রিকেট খেলানো, ঘোড়ায় চাপা ইটের মতো শক্ত শরীর ছিল। চড়-চাপড়গুলোও নেহাৎ ছেলে-খেলা ছিল না। আমার বড় জ্যাঠামশাই সারদারঞ্জন রায় বাবাকে মানুষ করেছিলেন। তিনিও ছেলেদের পিটিয়ে সিধে করার পক্ষপাতী ছিলেন। মেয়েদের কিছু বলতেন না। বাবা ছিলেন আরেক কাটি বাড়া।
আরেকটা দিক-ও ছিল তাঁর। মনে আছে চেরাপুঞ্জিতে আমাদের হাতি চাপিয়েছিলেন। হাওদা-টাওদা ছিল না, বোধহয় হাতির পিঠে কম্বলটম্বল জাতীয় কিছু পাতা ছিল, লবড়-ঝবড় করছিল। দিলেন তুলে আমাদের চারজনকে। প্রথমটা ভয়ে হাত-পা হিম। হাতিটা দুলে দুলে চলতে শুরু করল! তারপরেই ভয় ভেঙে গেল, অদ্ভুত একটা অহঙ্কারের ভাব এল মনে। কিন্তু নামবার সময় এ-ওকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। হাতিটা ছিল ভারত-জরীপ-বিভাগের, অর্থাৎ বাবার আপিসের। একটা নয়, অনেকগুলোকে সারি বেঁধে যেতে দেখেছিলাম। শুনেছিলাম ঐ সব হাতি, ঘোড়া আর খচ্চর বলে কিছু নিয়ে বাবারা ঘনবনে কাজ করতে যান। সেখানে বাঘ ভালুক থাকে। তাই শুনে বুকের ভিতরটাতে হাতুড়ি পিটতে লেগেছিল। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়।
গল্প বলার লোকের অভাব ছিল না আমাদের। অবিশ্যি তার বেশির ভাগ বলত আমাদের খাসিয়া ঝিরা; সবাই তাদের ‘কান্থাই’ বলত; কিন্তু মা বলতেন, ‘কান্থাই বলবে না, নাম ধরে ডাকবে। তোমাদের কেউ যদি মেয়ে! মেয়ে! বলে ডাকে তবে কেমন লাগবে? তবে খাসিয়া ঝিদের নাম বের করা মুশকিল ছিল। ছোটবেলায় একটা করে নাম থাকত বটে, কিন্তু যেই না বিয়ে হল, ছেলে কি মেয়ে হল, অমনি তাদের সবাই ডাকত ‘অমুকের মা’ বলে, তাদের নিজেদের নাম কেউ মুখেও আনত না, আনলে তারা বিরক্ত হত। আমাদের বাড়িতে কত কাকমি-উবিন, কাকমি ডোরেন, কাকমি মেডিলা কাজ করে গেছে তার ঠিক নেই। অথচ তাদের মাতৃ-প্রধান জাত। এরাই আমাদের গল্প বলত, ভয়াবহ সব গল্প, যদি নায়ককে বাঘে না খেত, কি কাত্তুরে না তীর মারত, তাহলে অপদেবতারা পিছু নিত, নিদেন হতাশ হয়ে তারা আত্মহত্যা করত! ঐ সুন্দর জায়গায় ওরা বাস করত, অথচ কখনো একটা হাসির গল্প বলত না। হয়তো জীবনযাত্রা বড্ড কঠিন ছিল। যাই হক, আমরা বিকট গল্প শুনতে বেজায় ভালোবাসতাম।
চেরাপুঞ্জিতে মৌসমাই জলপ্রপাতের গল্প শুনেছিলাম। কোনো রাজার মেয়ে তার বাপের শত্তুরের ছেলেকে ভালোবাসত, কিন্তু তার সঙ্গে বিয়ে হল না, কিম্বা দুঃখময় কিছু একটা ঘটে ছাড়াছাড়ি হল। সেই মেয়ে ঐ জলপ্রপাতের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে মল। তাই এখনো নিচে থেকে ধোঁয়ার মতো বাষ্পের বিন্দু ওঠে! যদি কেউ বলে ছোটরা ভালোবাসার গল্প বোঝে না, সে ভুল বলে। ভালোবাসা দিয়ে মোড়া থাকে ছোটদের জগৎ, ভালোবাসার মানুষকে হারানোর দুঃখ তারা যেমন বোঝে তেমন আর কেউ নয়।
অত ছোটবেলার স্মৃতি সব ভাঙা ভাঙা, একটা দুটো টুকরো কথা, অসমাপ্ত ঘটনা মনের মধ্যে লেগে থাকে। চেরাপুঞ্জি থেকে আমরা লাবান পাড়ার ব্রাহ্ম মন্দিরের ওপরে ছোট একটা বাড়িতে এসে উঠলাম। হয়তো প্রথমে কোনো বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে উঠে, সেখান থেকে এই বাড়িতে। আমরা চারজন আগে গেলাম মা আর যামিনীদার সঙ্গে। বাবা আসবেন পরে, শেষ জিনিসপত্র ঠেলাগাড়িতে তুলে। কাকমি-উবিনও আসবে সেই সঙ্গে।
পাহাড়ের ঢালের ওপর বাড়ি, নিচে রাস্তা, চারদিকে ইউকালিপটাস গাছ। এককালে কেউ ফুলগাছও লাগিয়েছিল, তখন সব আগাছায় ভরা। চারধারে ঝোপ-ঝাপ। তাতে লাল-হলুদ গোছা-গোছা ফুল, তার বিশ্রী একটা গন্ধ। কোনো কোনো ঝোপে ফল ধরেছে, ছোট্ট ছোট্ট আঙুরের মতো থোপা-থোপা, বেশির ভাগই সবুজ। কয়েকটা পেকে টুকটুক করছে। দাদা বলল, ‘লাল ফল ভালো।’ বলে একমুঠো তুলে নিজেও খেল, আবার দিদিকেও দিল। বদ্ খেতে, থু-থু করে ফেলেও দিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দুজনের মুখ দিয়ে কেবলি ফেনা উঠতে লাগল। সে আর থামে না। দাদা বলল, “বিষফল! আমরা মরে যাব!” কল্যাণ আর আমি ওদের মরার অপেক্ষা করতে লাগলাম। মরা পাখিটাখি দেখেছি, কিন্তু জ্যান্ত মানুষের মরা দেখিনি। দাদা দিদি ততক্ষণে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়েছে আর কথাটথা বলছে না। মা আমাদের খুঁজতে এসে ঐ অবস্থা দেখে কেঁদেকেটে একাকার! যামিনীদা গেল ডাক্তার ডাকতে।
এমন সময় বাবার সঙ্গে কাকমি-উবিনও জিনিসপত্র নিয়ে এসে হাজির হল। বাবার তো চক্ষুস্থির! কাকমি-উবিন একটুও ঘাবড়াল না। ছুটে রান্নাঘর থেকে মুঠো ভরে নুন এনে ওদের মুখে পুরে দিল। ওরা বমিটমি করে সুস্থ হয়ে উঠল। ততক্ষণে ডাক্তার এসে বললেন, “বিষ হলেও, ওতে মানুষ মরে না।”
বাগানের এককোণে ডালিমগাছের নিচে লম্বা একটা পাথর, তার পাশে কেউ একটা পাহাড়ি গোলাপলতা লাগিয়েছিল। পাশের বাড়ি থেকে সোনামণি বলে একটা ছেলে এসে বলল, “ওমা জান না! ওর নিচে মরা মানুষের ছাই আছে! এ-বাড়িটা যাদের, তাদের লীলা বলে একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল। অনেকদিন আগে বড় ভূমিকম্প হল, সবাই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ঐ ছোট্ট মেয়েটা—মা কোথায়? মাকে দেখতে পাচ্ছি না!—বলে ছুটে যেই না ভিতরে ঢুকেছে, অমনি বাড়ি ভেঙে পড়েছে। ঐ পাথরটা চাপা পড়ে লীলা মরে গেল! অথচ তার মা বাইরেই ছিলেন।”
মনে আছে সে গল্প শুনে আমরা কেঁদেকেটে একাকার করেছিলাম। তবে গল্প শুনে কাঁদার মধ্যে এক রকম মধুর ভাব আছে, কিন্তু সত্যিকার দুঃখ এলে চোখ-মুখ সব তিক্ততায় ভরে যায়।
সোনামণিরা পাশের বাড়িতে থাকত। তার দাদুর নাম ছিল বোস্ সাহেব। তাঁদের বাড়িতে সুন্দর একজন মেয়ে ছিলেন, পরে শুনেছিলাম তিনিই নাকি শ্রীঅরবিন্দের স্ত্রী। সত্যি কি না জানি না। বোস সাহেবের এক ছেলে ভিখারি দেখলেই পয়সা দিতে চাইত, তাকে সবাই বকাবকি করত। সে নাকি বলত,‘ওরা খায়নি, ওদের খেতে দাও!’ সেই ছেলে মারা গেল। বছরে বছরে সেই দিন ওঁদের বাড়িতে কাঙালী ভোজন হত। আমরাও কত সময় গিয়েছি। ঐ সুন্দর মানুষটি আমাদের যত্ন করে খাইয়েছেন। মনে কেমন দুঃখ লাগত। মাকে খুঁজতে গিয়ে পাথর চাপা পড়ে মরা আমার নামে নাম সেই ছোট্ট মেয়েটির জন্যেও বড় কষ্ট হত। তখন বোধ হয় ১৯১০ কি ১৯১১ সাল, কারণ একটু একটু মনে পড়ে বিলেতে বুড়ো রাজা মরে গেলেন, তাঁর ছেলে রাজা হলেন। তাই চারদিকে আলো জ্বেলে আনন্দ প্রকাশ করা হল। আমাদের বারান্দার কড়িকাঠ থেকেও সুন্দর সুন্দর চীনে-লণ্ঠন ঝোলানো হল। সে বড় সুন্দর জিনিস, আজকাল আর দেখা যায় না, তার কোমল রঙীন আলোতে ছায়ার ভাগই বেশি। কি রস, কি রোমাঞ্চ! ভিতরে একটি ছোট মোমবাতি জ্বেলে, কাগজের ঘেরাটোপটি টেনে দিয়ে, তারের হুকটি কোথাও টাঙিয়ে দিতে হত। অমনি কাগজের ঘেরাটোপে আঁকা রঙীন ছবিটিও ফুটে উঠত। তার নিচে কেউ দাঁড়ালে আমার তাকে সুন্দর দেখতে লাগত।
বাড়ি সাজিয়ে আমরা গেছিলাম অন্যদের বাড়ি সাজানো দেখতে। ফিরে এসে দেখি মোমবাতি জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে গেছে, কাগজে আগুন লেগে রঙীন ছবি সব পুড়ে তো গেছেই, কড়িকাঠ সুদ্ধ জায়গায় জায়গায় ঝল্সে গেছে। আর যামিনীদা রেগে টং হয়ে আছে!
ও-বাড়িতে বোধহয় খুব কম সময় ছিলাম, সেখান থেকে যেখানে উঠে এলাম, তার নিচে দিয়ে কুলকুল করে একটা নদী বয়ে যেত। নদীর ওপর কাঠের পুল, তাতে গাঢ় লাল রঙ করা। নদীর ওপারে ছিমছাম খেলার মাঠ। সেখানে সাহেবরা টেনিস খেলত, ক্রিকেট খেলত, গল্ফ খেলত। আমরা বাড়ি থেকে দেখতাম। খেলায় বাবার ভারি উৎসাহ, নিজে ভালো খেলতেন, তার জন্য রূপোর কাপ পেয়েছিলেন। বসবার ঘরের চিম্নি ওপরকার তাকে সেটি সাজানো থাকত। আমাদের কি গর্ব। আমার বড় জ্যাঠার খেলোয়াড় বলে খুব নামডাক ছিল। শুধু খেলোয়াড়ই ছিলেন না, এ-দেশে ক্রিকেট প্রতিষ্ঠা করার কাজে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তখন সারদারঞ্জন রায়ের নাম লোকের মুখে মুখে ফিরত। টাউন ক্লাবের গোড়া পত্তন তাঁর হাতেই হয়েছিল। মেট্রোপলিটান কলেজের—এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ—তিনি প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হাতে গড়া বে-পরোয়া বাঙালী ছেলে। তিনিও একপুরুষ নির্ভীক বলিষ্ঠ ছেলে তৈরি করে দিয়েছিলেন, যারা খেলাধুলোয়, কাজেকর্মে জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছিল। বাবা ছিলেন তাদের একজন; আমার ছোট জ্যাঠা কুলদারঞ্জন ছিলেন আরেকজন। এত সব ঐ বয়সে জানতাম না, তবে ক্রিকেট খেলার সঙ্গে যে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে তা বুঝতাম। ঐ বাড়িতে আমার সেজ ভাই অমিয় জন্মেছিল আর সেই দিনই গন্ধরাজ গাছের আড়ালে আমি বুড়ি কাকমি-উবিনকে ছাতাপেটা তো করেইছিলাম, খিমচেও দিয়েছিলাম। বাবা বারান্দা থেকে দেখতে পেয়ে কোথায় ধমকাবেন, না হো-হো করে হেসেছিলেন। তবুও কাকমি-উবিন আমাকে টেনে বেড়াতে নিয়ে গেছিল।
লাল পুলের অন্য মাথায় শশীবাবুর দোকান ছিল, সেখানে গোলাপী লজঞ্চুষ পাওয়া যেত। নিচে লম্বা লম্বা চালাঘর ছিল, সেখানে সপ্তাহে একদিন হাট বসত। তারই পাশ দিয়ে এঁকে-বেঁকে নদীটি চলে গেছিল। নদীর ধারে কাঠের বাড়িতে এক পাগলী থাকত। সে দিনরাত কাঁদত। আর কিছু মনে নেই, এর পরের অনেকগুলো দিনরাত গুলিয়ে গেছে। তারি মধ্যে কোনো সময় আমরা যে-বাড়িতে উঠে এসেছিলাম, তার নাম ছিল ‘হাই-উইণ্ড্স’। এমন সুন্দর নাম আর আমি শুনিনি। কে দিয়েছিল কে জানে। বাড়ির মালিক ছিলেন খাসিয়া, কিন্তু তাঁর নাম ছিল জীবন রায়, বড় বড় পাকানো গোঁফ ছিল, সবাই বলত নাকি খুব ভালো লোক। লেখাপড়া জানতেন।
ঐ বাড়িতে আমরা আট বছর ছিলাম, একবারো মনে হয়নি ওটি আমাদের নিজের বাড়ি নয়। এমন বাড়ি আর চোখে দেখলাম না। ৪৫ টাকা ভাড়া ছিল। পাহাড়ের ঢালের ওপর বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকে কাঁকর বিছানো পথ দিয়ে নেমে, বারান্দায় পৌঁছতে হত। একহারা লম্বা বাংলো, সামনে টানা বারান্দা, তার কাঠের রেলিং। বাড়ির তিনদিক ঘিরে বৃষ্টির জল যাবার জন্য নালা কাটা। তার ওপর দুটি চ্যাপ্টা পাথর ফেলা। তার ওপর দিয়ে বারান্দায় উঠতে হত। বারান্দার ছাদ থেকে তারের ঝোড়ায়, কাঠের ঝোড়ায় অর্কিড ফুল ঝুলত। তাদের তলায় সবুজ কাঠের বাক্সে জেরেনিয়ম ফুল ফুটত। লোকে এমন বাড়ির স্বপ্ন দেখে।
বাড়িতে কুকুর বেড়াল রাখার জো ছিল না, তবে লাল পুলের বাড়ির বাইরে ছোট একটা খুপরির নিচে আমাদের বড় মোরগ আর কয়েকটা মুরগি থাকত। খ্যাঁকশেয়ালের ভয়ে রাতে তাদের ঘরে তুলত কাকমি-উবিন। সকালে আবার যেই দরজা খুলে দিত ওরা কঁক্-কঁক্-কঁক্ করতে করতে বেরিয়ে আসত। একদিন দেখা গেল তিনটে বাসায় তিনটে ডিম! আমরা তো অবাক! ডিম যে এ-ভাবেও পাওয়া যায় এ আমাদের ধারণা ছিল না; আমরা দেখতাম ডিম-ওয়ালার কাছে ‘হালি’ হিসাবে ডিম কেনা হয়। চারটে ডিমে এক হালি। পরে শুনেছিলাম এক হালির দাম ছিল ৫ পয়সা।
অনেক দিন পরে কাক্মি-উবিন হঠাৎ এসে খবর দিল, ডিম ফুটে ছানা বেরিয়েছে দেখ গে! দাদা আগে ঢুকল; ঢুকেই বেরিয়ে এসে আমাদের ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। খালি বলে ঠক্রাবে! ঠক্রাবে! দেখলাম আমাদের পেয়ারের লাল মোরগের চেহারা বদলে গেছে, লাল ঝুঁটি উঁচু করে, চোখ পাকিয়ে, নখ্ বাগিয়ে পালক ফুলিয়ে ডবল বড় হয়ে, দাঁড়িয়ে আছে! দাদার হাত থেকে রক্ত পড়ছে! তাই দেখে সবাই মিলে সে যা চেল্লালাম!
ছোটদের জীবনের সবটা মোটেই আরামে-আদরে ভরা থাকে না, তার উল্টোটিও যথেষ্ট দেখা যায়। বাড়িতে সরোজিনী মাসিমা এসে ক’দিন ছিলেন। স্কুল ইন্সপেক্শনে এসেছেন, মা’র বন্ধু। আমাদের শোবার ঘরটি তাঁকে দেওয়া হল। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না, তবে কোথায় শুতাম মনে নেই। দুপুরে কেউ কোথাও নেই দেখে সরোজিনী মাসিমার ঘরে গিয়ে দেখি টেবিলের ওপর রাশি রাশি নীল খাম আর চিঠির কাগজ; একটা দোয়াত, তাতে কালি ভরা, দুটি কলম! একসঙ্গে এত আমরা কখনো দেখিনি। দাদা অমনি পোস্টমাস্টার সেজে চেয়ারে বসে, কালি দিয়ে খামের ওপর ঠিকানা, কাগজে লম্বা লম্বা চিঠি লিখে, দিদিকে আমাকে বিলি করবার জন্য দিতে লাগল। লিখতে জানত না বলে ওর কোনোই অসুবিধে হল না। দিদি আমি দুজনেই পিওন। চিঠির প্রাপক কল্যাণ। সেদিনের সেই অপ্রত্যাশিত আনন্দের কথা আজ পর্যন্ত মনে আছে। কিন্তু বেশির ভাগ আনন্দের ব্যাপারের মতো এর শেষটিও বড়ই নৈরাশ্যময়। সরোজিনী মাসিমার রাগ-মাগ, কানমলা, বকুনি, কান্না। বলা বাহুল্য এ-সব ঘটনার কতখানি আমার মনে ছিল আর কতখানি মার কাছে শুনেছি, সব একাকার হয়ে গেছে। তবে চোখের সামনেই পোস্টমাস্টার আর পোস্টাপিস দেখতে পাই।
॥ ২ ॥
কারো মনের মধ্যে যদি বাড়ি বানানো যায় তো আমার মনে হাই উইণ্ডস্ বাড়িটি তৈরি হয়ে আছে। হঠাৎ একদিনে, প্রথম দেখায় ও-বাড়ি আমার মনের মধ্যে গেঁথে যায়নি, তিলে তিলে তৈরি হয়েছে, ওর ছাদের নিচে দিনের পর দিন কাটানোর প্রাণশক্তি দিয়ে। কাঠের মেঝে, পা ফেললে একেকটা তক্তা ক্যাঁচ-কোচ করে, তার ওপর নারকেল ছোবড়ার ম্যাটিং পাতা; ইঁকড়ার দেয়াল, তার ওপর পলেস্তারা দিয়ে, চুনকাম করা, অসমান, কর্কশ করুগেট টিনের ছাদ, তাতে অজস্র ছ্যাঁদা, বর্ষায় জল চোঁয়াত। টিনের ছাদের তলায় ক্যাম্বিশের সীলিং, তার ওপর ধাড়ি ইঁদুররা রাতে দৌড়াদৌড়ি করত। নবাগত কেউ থাকলে ঘাবড়ে যেত। কাঁচের দরজা-জানলা। চারদিকে ফলের গাছ, ফুলের গাছ আর পিছনে অনেক নিচে, যেখানে তুঁতফলের গাছের পরেই আমাদের কাঁটাতারের বেড়া, তারা নিচে লাল পুলের তলার সেই নদীই কলকল করে দিনরাত বয়ে যেত। তুঁতগাছের তলায় দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনলে, শুঁয়োপোকাদের পাতা চিবুনোর কচর-কচর শব্দ শোনা যেত। রেশমের দেশ ঐ পাহাড়; ওখানকার লোকরা ঘরে ঘরে রেশমের সুতো কেটে মুগা-তসর বুনত।
নদীর ওপারেই লুমপারিং পাহাড়। ঘন সরল বন, রাতে সেখানে হুতুমপ্যাঁচা ডাকত আর খ্যাঁকশেয়াল খ্যাক্-খ্যাক্ করে হাসত। বনের পাশে চওড়া ফায়ার-লাইন, নদীর ধার থেকে পাহাড়ের মাথা অবধি উঠে গেছে; তারপর হয়তো ও-ধার দিয়ে আবার নেমে গেছে। পাহাড়ের ও-ধারে দেখবার জন্য মন ছট্ফট্ করত। ফায়ার-লাইনের পর পাহাড়ের গভীর খাঁজে লুমপারিং জলপ্রপাত দেখা যেত না, শুধু তার ঝর-ঝর শব্দ শোনা যেত আর ঝরনার নিচে জল জমে সরু নদী হয়ে, আমাদের নদীতে এসে মিশছে, সে-ও আমাদের তুঁতগাছের তলা থেকেই দেখা যেত।
এ-বাড়িতে আসার আগে কোনো বই-টইয়ের ওপর তেমন করে চোখ পড়েনি। ছিল বই অবিশ্যি, মা-বাবার বিয়েতে পাওয়া, কিন্তু তাতে ছবি ছিল না। মা’র পড়ার শখ ছিল, সেকালের বি-এ পড়া মেয়ে, মাসিক পত্রিকাও আসত, ইংরিজি বাংলা। কিন্তু আমার সেদিকে চোখ পড়েনি। ৫ বছর বয়স হতেই স্লেটের ওপর বড় বড় ক, খ আর A, B লিখে, তার ওপর পেন্সিল বুলোতে বলা হল।
নদীর ওপারের দিদিমা বললেন, “প্রভাত তাহলে লেখা-পড়া শিখছে, খুব ভালো কথা।” এ-সব হল গিয়ে লাল পুলের বাড়ি ছাড়ার সময়কার কথা। মার কাছে লেখা পড়া। সে বরং ভালো। দিদিমাকে মা ডাকতেন ‘মাসিমা’, তাঁর নাম ছিল সারদামঞ্জরী দত্ত, নাকি আমার দাদামশাইরা দিদিমাকে চিনতেন। নদীর ও-পারে ওঁদের বাড়িটিও আশ্চর্য। নিচে একটি ঘর, তার পাশে তরকারির বাগান; পাথরের সিঁড়ি; ওপরে তিনটি তিন রকম আলাদা বাড়ি, কোনোটার টিনের ছাদ, কোনোটা খড়ের, মধ্যিখানে উঠোন, লেপা-পোঁছা তক-তক করছে। তারি একধারে এমন আশ্চর্য এক জিনিস ছিল যে দেখে-দেখে শখ মিটত না। পাহাড়ের গায়ে একটা পাথরের গর্ত, তার তলায় দু-তিনটি ফুটো থেকে দিন-রাত বুড় বুড় করে জল বেরোচ্ছে! গর্তটার গায়ে ছ্যাঁদা করে পাইপ লাগিয়ে একটা কল বসানো ছিল। দিদিমারা সরকারি জল ব্যবহার করতেন না। এরকম আমরা আগেও কখনো দেখিনি, পরেও দেখিনি, একান্ত নিজের একটা জলের উৎস।
এখন ভাবি দিদিমা মানুষটিও অনন্যসাধারণ ছিলেন। ৬০/৬৫ বছর আগেকার কথা, তখনি কতজন অভিভাবকহীনা বাঙালী মেয়ে দেখেছিলাম যাঁরা পুরুষদের চাইতে কোনো দিক দিয়ে কম ছিলেন না। এঁদের অনেকেই ব্রাহ্ম সমাজের মেয়ে; তার একমাত্র কারণ হিন্দু-সমাজের তেজী মেয়েরাও সমর্থনের অভাবে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ পেতেন না। সারা জীবন তাঁদের কটুভাষী অনিচ্ছুক আত্মীয়স্বজনদের কাছে হাত পেতে থাকতে হত, নয়তো কুলত্যাগিনী হতে হত। শিলং-এ সরোজিনী মাসিমা ছিলেন; যামিনী সেন বলে আরেকজন শিক্ষব্রতীও ছিলেন, তাঁর চেহারাটি ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারি না। তবে সোনার বো-বাঁধা পিন্ দিয়ে বুকে একটা ছোট্ট সোনার ঘড়ি ঝোলাতেন, তার দিক থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারতাম না। এঁরা ছিলেন অবস্থাপন্ন ঘরের উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে। দিদিমার কথা আলাদা।
তাঁর চেহারা আমার ভুলবার কথা নয়, অনেক বছর পরে কলকাতায় মেয়ের কাছে মারা যান। ফুটফুটে ফরসা ছোট্ট-খাট্টো মানুষটি, অনবরত এবং চমৎকার গুছিয়ে কথা বলতেন। কারো জন্মদিন, কি শ্রাদ্ধ, কি বিয়ে উপলক্ষ্যে কোনো বইখাতার সাহায্য না দিয়ে, টলটলে পাহাড়ে নদীর স্বচ্ছ স্রোতের মতো অপরিসীম ভক্তিসহকারে ভগবানকে ডাকতেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ছে। গোড়ার দিকে তাঁর স্বামীও ছিলেন, গোলগাল, বেঁটে, মাথার সামনে টাক, লম্বা কালো দাড়ি। বোধহয় মানুষটি চুপচাপ থাকতেন। অন্য কোথাও গিয়ে অকালে মারাও গেলেন। মনে আছে, একদিন সকালে দিদিমাদের বাড়িতে উপাসনা হল, তার পর রোদে ভরা নীল আকাশের নিচে, একটা ফুলে-ঢাকা জায়গায়, ছোট্ট একটা সুন্দর কৌটো মাটির নিচে রাখা হল। দিদিমা সাদা থান পরে, খালি হাতে, ভগবানের নাম করতে লাগলেন আর তাঁর ছোট মেয়ে মুণুদি আমাদের বলল, “চুপ-চুপ, কথা বলতে নেই।” আমরা ফিস্-ফিস্ করে বললাম, “বল না কি আছে ওতে?” মুণুদি বলল, “বাবার ছাই।” বলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে আমাদের চেয়ে সামান্য বড় ছিল। শুনে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেছিল। মরে গেছেন তো মরে গেছেন, তাই বলে এই সুন্দর সকালে বেচারি দাদামশাইকে কৌটোয় ভরে মাটিতে পুঁতে ফেলবে, এ যে ভাবা যায় না! খুব খানিকটা কেঁদে নিয়েছিলেন, আর বলেছিই তো, দিদি কখনো কাঁদবার সুযোগ ছাড়ত না। চোখ লাল হয়ে যেত, নাক ফোলাত, সর্দি গড়াত, ফোঁৎফোঁৎ শব্দ করত, ভারি বিশ্রী লাগত। রাগে আমার কান্না সেরে যেত।
খুব ছোটবেলার কথা সঠিক মনে রাখা শক্ত, কেবলি আগের ঘটনার ওপর পরের ঘটনার ছায়া পড়তে থাকে। তার ওপর গল্প হয় কাটা কাটা, আলাদা আলাদা কয়েকটা ছবি, কারো সঙ্গে কারো কোনো যোগ নেই। কিন্তু তাই দিয়েই একেকটা মানুষের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়; তার একটা স্বকীয়তা এমনি করেই তিলে তিলে গড়ে ওঠে, একটা দৃষ্টিভঙ্গি রচনা হয়। আমার এই আমিত্বটা ঐভাবেই গড়ে উঠেছিল একথা বললে অবিশ্যি সবটুকু বলা হয় না। কারণ পুরুষানুক্রমেও নিশ্চয় কিছু নিয়ে এসেছিলাম আর শুধু মানুষই বা কেন, ঐ নীল পাহাড়ে ঘেরা, মাথার ওর উপুড়-করা নীল গামলার তলায়, মর্মর-মুখরিত, পাখির ডাকে চকিত যে পরিবেশে দিনগুলো কেটেছিল তারাও তাদের ছায়া রেখে গেছে। সরল-বনে যেই না পা দিয়েছি, অমনি টের পেয়েছি শির-শির সর-সর করে ছোট ছোট জানোয়ারের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে, গাছের কোটরে চকচকে চোখ বুজে গেছে, মগ্ডাল থেকে শাঁখের মতো সাদা পাখি উড়ে গেছে—এরাও তাদের চলে যাবার একটু শব্দ একটু ডানার হাওয়া রেখে গেছে। এত কথা কি আর একখানি বইয়ের দুটি মলাটের মধ্যিখানে ধরে দেওয়া যায়? যা আমার নাগালের বাইরে রয়ে গেল, তাকে কোন ভাষায় বোঝাব, যাকে ভুলে গেলাম তার কি পরিচয় দেব?
দূরে নীল আকাশের ওপর রূপোলী রঙে আঁকা ছবির মতো বরফের পাহাড় দেখা যেত, তাও সব দিন নয়। যেদিন আকাশে কুয়াশা থাকত না, সেদিন একটু উঁচু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে তবে দেখা যেত। একজন সুন্দর মানুষ মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে এসে থাকত, সে আমার ছোটমাসি, তার নাম ছিল রমা, সাদা গোলাপের মতো সুন্দর, হাত-পাগুলি পদ্মফুলের মতো। তার তখনো বিয়ে হয়নি। আমি তার গলা জড়িয়ে ঝুলে থাকতাম, গালে নাক ঘষে বলতাম, “মন্না, আমি তোমার চশ্মা হব!” ছোটমাসি কি বলত মনে নেই, তবে আমার ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলে হাত বুলিয়ে দিত মনে আছে। একচল্লিশ বছর বয়সে ছয়টি ছেলেমেয়ে রেখে ছোটমাসি মারা গেছিল। মারা গেলে কি কেউ ফুরিয়ে যায়? ছোটমাসির স্মৃতি আমার মনের মধ্যে অফুরন্ত মধুর উৎস হয়ে রয়েছে।
তখন একেবারে মুখ্যু ছিলাম, বইয়ের ধার-ধারতাম না। ঠিক সেই সময়ই যে কলকাতায় আমাদের মেজ-জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোর আর তাঁর বন্ধু যোগীন্দ্রনাথ সরকার ছোটদের জন্য কেমন বই লেখা হবে, কোথায় ছাপা হবে, কেমনধারা ছবি হবে, কি করে তার ব্লক তৈরি হবে, এই সব প্রশ্ন নিয়ে ভেবে আকুল হচ্ছিলেন, সেকথা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। ইতিমধ্যে জ্যাঠামশায়ের বেশ কতকগুলো বই বেরিয়েও গেছিল, হাফ-টোন-ব্লকে নিজের ছাপাখানায় তার জন্য চমৎকার সব নিজের হাতে আঁকা রঙীন ছবিও ছাপা হচ্ছিল, তাও জানতাম না। বেল পাকলে কাকের কি? আমরা ছিলাম আকাট মুখ্যু—বইপত্রের সঙ্গে আমাদের কি? আমাদের বাড়িতে কুকুর বেড়াল না থাকতে পারে, দু রকমের টিকটিকি ছিল। ঘরের ভিতরে ফিকে হলুদ টিকটিকি আর ঘরের বাইরে কালচে-পানা টিকটিকি। বাইরের দেয়ালের খাঁজে পেন্সিল কাটা ছুরি ঢুকিয়ে দাদা তিনটি সাদা ডিম বের করেছিল, এই আমার কড়ে আঙুলের নখের মতো। তার একটা আবার পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল, বাকি দুটো তাড়াতাড়ি আবার পুরে দেওয়া হল। দাদা বলল, না হলে মা-টিকটিকির কষ্ট হবে। এই সব নিয়েই আমাদের দিন কাটত।
এই সময় আমার মা’র বড্ড অসুখ করল, টন্সিল পেকে বিষিয়ে উঠল। সকলের বড় ভাবনার কারণ হল। আমরা এদিকে বাড়িতে দিনরাত মহা হট্টগোল করতাম, তাই আমাদের কয়েক দিনের জন্য নদীর ওপারে দিদিমার বাড়িতে পাঠানো হল। পুল অনেক দূরে, আমরা পাথরের ওপর পা রেখে নদী পার হতাম। যেদিন নদীর মাথায় বৃষ্টি হত, নদীতে ঢল নামত, সব পাথর ডুবে যেত। জল নামার জন্য বসে থাকতে হত। বেশিক্ষণ বসতে হত না, দেখতে দেখতে বৃষ্টি নেমে যেত, ঢলের জল বড়-পানিতে পৌঁছে যেত। আমাদের ছোট নদী যে-কে-সেই। মায়ের অসুখ শুনে ঐ নদী পার হয়ে দিদিমা এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। বলা বাহুল্য দিদি কেঁদেছিল। দিদিমা গরম জলে আমাদের হাত-মুখ মুছিয়ে দিয়ে, গরম লুচি আর মোহনভোগ খাইয়ে, মস্ত একটা খাটে, প্রকাণ্ড এক লেপের নিচে শুইয়ে দিয়ে, তাঁদের দেশের শেয়ালরা কেমন পাকা কাঁকুড় খেয়ে যেত, সেই সব গল্প বললেন। বাড়ির পিছনের নদীর কল-কল আর সরল-বনের শোঁ-শোঁ শব্দ এত দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল না, তবু আমরা খুব ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে দিদিমার ছেলে দেবপ্রসাদমামা ওদের খোবানি গাছের পাকা ফল পেড়ে দিয়েছিল। বাড়ির পিছন দিকে একটা ছোট্ট বারান্দা ছিল, সেখানে একটা দাঁড়করানো পায়া দেওয়া টুকরি ছিল, তার মধ্যে নানা রঙের নতুন কাপড়ের ছাঁট ছিল। হয়তো ওগুলো মুনুমাসির প্রিয় জিনিস, কিন্তু দিদিমা ওর অনেকগুলো দিদির আমার হাত ভরে দিয়ে বললেন, “কেঁদো না। এই দিয়ে পুতুলের জামা কর!” জামা করব না আর কিছু, দিদির সাড়ে পাঁচ, আমার সাড়ে চার বছর বয়স! পরে কাক্মি-উবিন কাঁচি দিয়ে ছোট্ট চারকোণা ছাঁটগুলোর মধ্যিখানে একটা করে ছ্যাঁদা করে দিয়েছিল। তার মধ্যে দিয়ে মাথা গলিয়ে আমাদের ইতু-পুতু-এলে-বেলেদের সে যে কি সুন্দর দেখিয়েছিল সে আর কি বলব!
তাছাড়া দিদিমার বসবার ঘরে একটা চার-কোণা জিনিস ছিল, তাতে হয়তো একশো দেড়শো রঙীন মাথাওয়ালা পিন গোঁজা থাকত। দিদিমা সেটি নামিয়ে দিয়েছিলেন। একটা কাঁচের গোল কাগজ-চাপা ছিল, সেটার ভিতরে ছোট্ট একটা বাড়ি দেখা যেত, তার পাশে একটা ন্যাড়া গাছ। কাগজ-চাপাটাকে ঝাঁকালে কাঁচের গোলাটার ভিতরে একরাশি সাদা বরফের কুচির মতো কি যেন উড়ত। এসব দেখে দিদি পর্যন্ত কান্না ভুলে গেছিল। মনে হয় সেই জন্যই দিদিমা তাঁর বাড়ির যা কিছু সুন্দর এবং ভঙ্গুর জিনিস ছিল সব আমাদের নামিয়ে দিয়েছিলেন। দিদিমা ওখানকার মেয়েদের মিড্ল্ ইংলিশ স্কুলে পড়াতেন। তাই দিয়েই বোধহয় ওঁর সংসার চলত। কি করে এত পারতেন জানি না।
এখন ভাবি কেমন মানুষ ছিলেন এঁরা সবাই? অনাত্মীয় পরের দিদিমা সেজে লেপের তলায় জায়গা করে দিতেন, ভালো জিনিস সব নামিয়ে দিতেন, হয়তো ভাঁড়ারে কখনো চাবি দিতেন না। আমরা তাঁকে কখনো কিছু দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। মা ডাকতেন ‘মাসিমা’ বলে, নিজের মাকে মায়ের বিশেষ মনে পড়ত না, সময়ে-অসময়ে দিদিমার কাছে ছুটে যেতেন। দিদিমার বড় মেয়ে সুবর্ণমাসির সঙ্গে ডঃ সুন্দরীমোহন দাশের ছেলের বিয়ে হয়েছিল। মেজ মেয়ে লাবণ্যমাসির সঙ্গে কর্ণেল মণীন্দ্র দাসের বিয়ে হয়েছিল। ভারি চমৎকার চেহারা ছিল তাঁর। সেজ মেয়ে আশামাসির সঙ্গে ডঃ মৃগেন্দ্রলাল মিত্রের বড় ছেলের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দিদিমা ছিলেন অন্য জগতের মানুষ। একদিকে গোঁড়া ব্রাহ্ম আর অন্য দিকে সমুদ্রের মতো উদার। শিলং-এর ব্রাহ্মদের সেকালের জীবন নিয়ে সুন্দর একখানি বইও লিখেছিলেন। বইটির নাম ভুলে গেছি, লেখিকার মতোই সরল, বলিষ্ঠ, অসঙ্কোচ, সুন্দর লেখা। নিজে এসে আমাকে দিয়ে একখানা কিনিয়েছিলেন, সেইজন্য আমিই ঋণী। আমার কোনো বই তাঁকে কোনো দিনও দিয়েছি বলে মনে পড়ছে না।
ঐ যা বলছিলাম, দুইদিন ছিলাম দিদিমার বাড়িতে। বিকেলে কাকমি-উবিনের সঙ্গে আমাদের বেড়াতে পাঠিয়ে দিয়ে, দিদিমা মাকে দেখে আসতেন। কাকমি-উবিনের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার মাঠে যেতে হলে সেই পাগলীর বাড়ির সামনে দিয়ে যেত হত। এই ছিল মুশকিল। কিন্তু তারপরেই শশীবাবুর দোকান। সেখানে বড় বড় গোলাপী লজঞ্জুষ পাওয়া যেত, তার মধ্যিখানে এই বড় একটা করে বাদাম থাকত। পরদিন বেড়িয়ে ফিরে আসতেই দিদিমা একগাল হেসে বললেন, “ওরে তোদের মা ভালো আছে রে। তোরা সবাই কলকাতায় যাবি।”
শুনে আমরা থ’। কলকাতায় যাব! সেখানে আমড়া, বিলিতী আমড়া পাওয়া যায়। জ্যাঠামশাইরা থাকেন! সে কি আনন্দ, সে কি উত্তেজনা! হয়তো তার পরেই আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম। ভাবতেই পারছিলাম না আমরা সত্যি বড় বড় মোটরে চেপে গৌহাটি যাব, সেখান থেকে রেলগাড়িতে কলকাতা যাব! আমরা সবাই যাব, বাবা আমাদের নিয়ে যাবেন। তবে কাক্মি-উবিন যাবে না। গোঁড়া খাসিয়া মেয়েরা পাহাড় ছেড়ে কোথাও যেতে চাইত না। অন্য লোকের বাড়িতে খেত না, রাত কাটাত না। নিজেদের পোশাক ছাড়া কোনো বিদেশী পোশাক পরত না। সেলাই করা জামা-কাপড় ওরা ঘেন্না করত, ডান বগলের তলা দিয়ে, বাঁ কাধের ওপর দিয়ে তাঁতে বোনা একটা গাঢ় রঙের কাপড় বাঁধত, আবার বাঁ বগলের তলা দিয়ে ডান কাঁধের ওপর আরেকটা বাঁধত। মাথায় একটা চাদর বাঁধত, আবার পিঠের ওপর দিয়ে বড় একটা চাদর ঝুলিয়ে সামনে মস্ত গিট দিত। বড়লোকেরা গলায় সোনার আর লাল পলার বড় বড় পুঁতির মালা পরত, কানে কাঁচা সোনার চমৎকার গয়না পরত। বিদেশী জিনিস ওরা ঘেন্না করত। কাক্মি-উবিন যে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে না, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই ছিল না। বাবা আমাদের পৌঁছে দিয়ে, আবার ফিরে গেলেন।
সেই কলকাতায় আসা থেকে আমার বড় হওয়া শুরু হল। আমার মেজ-জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে উঠলাম, ২২ নং সুকিয়া স্ট্রীটে, দোতলা একটা ভাড়া বাড়ি । সামনে রক্, তারপরেই ছাপাখানা, আমরা ঢুকতাম খিড়কিদোর দিয়ে একটা গলি পেরিয়ে, পিছন দিকে একটা বারান্দার পাশের সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ির দেয়ালে উপেন্দ্রকিশোর নিজের হাতে চমৎকার নক্সা এঁকেছিলেন। তাই দেখে বাড়িওয়ালা মহা খুশি হয়ে, ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, এ-কথা পরে শুনেছিলাম। বলেছিল অত কম ভাড়ায় নক্সা-করা বাড়ি পাওয়া যায় না।
ঐ সিঁড়িটি অনেক সময় ফেলে দেওয়া হাফ-টোন ছবির নানা রঙের চকচকে প্রুফে ভরে থাকত। আমরা মহানন্দে কুড়িয়ে আনতাম। তার কেমন একটা গন্ধ ছিল; এখনো কোনো ছাপাখানায় গেলে ঐ রকম গন্ধ পাই, মন কেমন করে। নিচে প্রেস চলত তার একটানা ঝম্ঝম্ শব্দ কানে আসত; মনে হত বাড়িটা বুঝি দুলছে, যে-কোনো সময় ডানা মেলে পাখির মতো উড়ে যাবে! সে-বাড়ির রোমাঞ্চের কথা মুখে বলার সাধ্য নেই আমার। অথচ খুব যে একটা সাজানো-গোছানো ছিল তাও নয়। তার দরকারও ছিল না। উপেন্দ্রকিশোর তাঁর আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব দিয়ে চারদিক ভরে রাখতেন। ঐ বয়সেও বুঝতাম ঐ যে ফরসা দাড়িওয়ালা লোকটি ছবি আঁকেন, বেহালা বাজান, হার্মোনিয়মের সঙ্গে গান করেন, ছাপাখানার লোকরা যেই লম্বা লম্বা কাগজ দিয়ে যায়, অমনি হাতে একটা কলম নিয়ে বসে পড়েন,—উনি একজন বিশেষ মানুষ। আর কেউ ওঁর মতো নয়।
এখন বুঝি যে তখনো তিনি ডাইবিটিসে ভুগতেন, যার জন্য দুই বছরের মধ্যে মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাঁর অমূল্য জীবনটি শেষ হয়ে গেছিল। কি রকম চিকিৎসা হত কে জানে। শুনেছি বিলেত থেকে কোন বিশেষ ওষুধ আসত, কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সে-ওষুধের চালান বন্ধ হয়ে গেছিল, তাতেই জ্যাঠামশায়ের কাল হয়েছিল। মনে আছে বিকেলে তিনি এক প্লেট টুকরো করে কাটা পাকা পেঁপে আর কলা খেতেন, কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে। কল্যাণ আর আমি হাঁ করে দেখতাম। তার আগে কাউকে কাঁটায় ফুটিয়ে কিছু খেতে দেখিনি। কাছে গিয়ে হাঁ করতাম। জ্যাঠামশাই বলতেন, “আগে পেঁপে, তারপর কলা।” সেটা আমাদের খুব পছন্দ ছিল না, কিন্তু কি আর করা। এখন ভাবি না পেঁপে, না কলা, কোনোটাই তাঁর পক্ষে খুব উপযুক্ত খাদ্য ছিল না।
বাবার চাইতে মুখ সুন্দর ছিল জ্যাঠামশায়ের, রঙ অনেক ফরসা ছিল। কিন্তু বাবা মাথায় ছিলেন প্রায় ছয় ফুট, পিটানো বলিষ্ঠ শরীর ছিল। জ্যাঠামশাই খানিকটা বেঁটে, শরীরটাও নরম। তবু একদিন বাবার কাঁধে হাত রেখে কল্যাণকে বলেছিলেন, “জানিস, আমি তোদের বাবার বড় ভাই। ইচ্ছে করলে তোদের বাবাকে আমি পেটাতে পারি!”
একথা শুনে হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনি। কল্যাণ তো মুচ্কি হেসে সজোরে মাথা নেড়েছিল। বাবাকে পেটাতে পারে না আরো কিছু!! পেটানোর ক্ষেত্রে বাবার ব্যুৎপত্তি নিয়ে সেদিন মনে মনে ভারি গর্ব হয়েছিল।
বাড়িতে আরো লোক ছিল। আমাদের ছোট জ্যাঠামশাই, কুলদারঞ্জন, জ্যাঠাইমা মারা যাবার পর থেকে তাঁর ছেলে আর মেয়ে দুটিকে নিয়ে ঐ-বাড়িতে উঠে এসেছিলেন। ছোট জ্যাঠামশাই নাকি বাবাকে ভয় পেতেন, অন্তত তাই বলতেন। দেশে ছোটবেলায় ওঁদের দুই ভাইয়ের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পাড়ার লোকে ঠাকুমার কাছে দরবার করত। ছোট জ্যাঠামশাইকে ধমক-ধামক দিয়ে যদিবা ম্যানেজ করা যেত, বাবাকে সামলাবার জন্য একজন ষণ্ডামার্কা চাকর রাখতে হয়েছিল! ওঁদের নানা দুষ্টুমির গল্প শুনে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। তার অর্ধেকের অর্ধেক করলেও বাবা যে পিটিয়ে আমাদের মাটিতে বিছিয়ে দিতেন সেটা নিশ্চিত। বলা বাহুল্য বেশির ভাগ গল্প ছোট জ্যাঠামশায়ের মুখেই শোনা।
তিনি আমাদের প্রথম ‘বায়োস্কোপ’ দেখিয়েছিলেন, প্রথম ‘সাকার্স’ দেখিয়েছিলেন। কি আশ্চর্য জায়গা কলকাতা, নিত্যি নতুন জিনিস দেখতাম। পাল্কি চড়ে দিদি আর আমি একদিন মায়ের সঙ্গে বড় জ্যাঠামশায়ের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে দেখি, ২২ নং সুকিয়া স্ট্রীটের খিড়কি দোরের বাইরে একটা লম্বা-ঠ্যাং টুলের ওপর, ড্রামের মতো কি একটা রঙচঙে জিনিস বসিয়ে একটা লোক ডেকে ডেকে কি যেন বলছে। মা বললেন, “বায়োস্কোপ দেখবি?” সে আর বলতে! এ বায়োস্কোপ একজন একজন করে দেখতে হয়। মা লোকটাকে দুটো পয়সা দিলেন, একটা গোল মতন কাঁচের ভিতর দিয়ে আমি আগে দেখলাম। সে এক স্বপ্নরাজ্য! সুন্দরী রাজকন্যে, মুখে-ফেনা তেজী ঘোড়ায় চাপা বীর রাজপুত্র, বিকট রাক্ষস, কেউ থেমে থাকছে না, শুধু ছুটছে আর ঘুরছে আর লোকটা সুর করে কি যেন বলে যাচ্ছে তার একবর্ণ মানে বুঝছি না। তারপর যেই কট্ শব্দ করে ছবি অন্ধকার হয়ে গেল, আমার পালাও শেষ হল। দিদি এসে চোখ লাগাল। পরদায় দেখা সেই বায়োস্কোপের চেয়ে এ যে কত বেশি ভালো, সে আর কি বলব। একেবারে কোলের কাছের ঘরোয়া জিনিস। দোতলায় উঠেও অনেকক্ষণ ধরে মনে হচ্ছিল এখানে আমি নেই! সেইবারই বড়দিকেও প্রথম দেখলাম। বড়দির নাম সুখলতা রাও, তাঁর নাম জানে না এমন লোক সেকালে কম ছিল। দেশ-বিদেশের পরীদের গল্প তিনি সংগ্রহ করে সে যে কি মিষ্টি বাংলায় লিখেছেন সে আর কি বলব। আর অপূর্ব সব কবিতা। আমার মায়ের চাইতে বড়দি ছিলেন দেড় বছরের ছোট, একসঙ্গে মানুষ, আপনার বোনের মতো। মা বলতেন বড়দি জীবনে কখনো কোনো স্বার্থপর কাজ করেননি। কিন্তু সদাই গম্ভীর মুখ। একটা মজার গল্পও শুনেছি। জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাব ছিল সেই সময় রাজর্ষি প্রকাশিত হয়েছিল, জ্যাঠামশাই বড় মেয়ে আর বড় ছেলে সুখলতার আর সুকুমারের ডাকনাম রাখলেন হাসি আর তাতা। সুকুমারের তাতা নাম থেকে গেল, কিন্তু সুখলতার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ আর তাকে ‘হাসি’ বলে ডাকবার সাহস পেল না। তবে এ-কথা আমার খুব ভালো করেই মনে আছে যে আমাদের পুতুল খেলার সময় বড়দি একবার যোগ দিয়ে কাঁচি দিয়ে কেটে ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল কাগজের লুচি বানিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স হয়তো ২৬ বছর হবে। জ্যাঠামশায়ের স্বল্পায়ু ছোট মেয়ে শান্তিলতার তখনো বিয়ে হয়নি। আমরা তাকে ডাকতাম টুনিদি বলে। যেমনি সুন্দর দেখতে, তেমনি মিষ্টি স্বভাবটি। রোজ রাতে আমাদের খাইয়ে দিতে দিতে টুনিদি গল্প বলত, ছড়া বানাত। তার লেখা দু-একটা কবিতা সন্দেশে বেরিয়েও ছিল। তার একটি হল, “ওগো রাঁধুনী শোন গো শোন!” এমন সরস কবিতা খুব বেশি হয় না। ছবি আঁকার হাত ছিল। আমরা শিলং-এ ফিরে গেলে আমাকে একটা পোস্টকার্ডে ছোট্ট ছোট্ট ছবি এঁকে লিখে পাঠিয়েছিল: “পিঠোপিঠি দুই বোন সুকু আর লীলা, পড়তে বসে বই ফেলে করছে পুতুলখেলা। তাই না দেখে প্রভাতরঞ্জন উঠলেন রাগে ফুলে। চুপিচুপি বেঁধে দিলেন দুই জনার চুলে। বাইরে গিয়ে যেই ডেকেছে লুচি খাব আয়! অমনি তারা হ্যাঁচ্কা টানে বাপরে কি চেঁচায়!”
এই টুনিদিকে আর দেখিনি। মাত্র ২৪ বছর বয়সে নিউমোনিয়া হয়ে, শেষ একটা “দাদা!” বলে ডাক দিয়ে সে মারা গেছিল। বড়দি আর টুনিদির মধ্যিখানে ছিলেন মেজদি পুণ্যলতা চক্রবর্তী। এঁরা সবাই জাত লেখিকা, কাউকে কিছু শেখাবার দরকার ছিল না। সবার ছোটভাই সুবিমল, আমাদের নান্কুদা। এমন সরস, কল্পনাপ্রবণ, খামখেয়ালী মানুষকে সঙ্গী পেয়ে আমরা আহ্লাদে আটখানা হতাম।
॥ ৩ ॥
নানকুদা বেজায় ভালো সঙ্গী হলেও বেশ একটু যে নিষ্ঠুর ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমাদের বয়স চার, পাঁচ, ছয়; ও যা বলত সব বিশ্বাস করতাম, এক রকম বলতে গেলে ওর অনুগত ভক্ত ছিলাম। রোদে তাতানো ছাদে আমাদের খালি পায়ে হাঁটাত। অন্ধকার লোহার সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামাত। বিকট সব গল্প বলে আলো নিবিয়ে ঘর থেকে চলে যেত। আবার কেউ পড়ে গেলে, ছুটে এসে কোলে তুলে ওষুধ দিত। তখনো সে স্কুলের গণ্ডী ছাড়ায়নি। ওর সমবয়সী পান্কুদা ছিল ছোট জ্যাঠার ছেলে, বড় বেশি ভারিক্কে ধরনের। ছোটবেলায় মা হারিয়ে কেমন যেন নিজের মধ্যে নিজে বন্ধ হয়ে গেছিল, সে-কথা পরে বুঝেছিলাম। এরা দুজনে আমার মাকে বড্ড ভালোবাসত, ডাকত ‘মান্তু’ বলে। সুকুমার তখন বিলেতে; সুবিনয় নিশ্চয়ই বাড়িতেই থাকত, কলেজে পড়ত, আমাদের সঙ্গে খুব একটা মিশত না। তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হত না। জ্যাঠামশায়ের বুড়ো চাকর প্রয়াগ আমাদের গল্প বলত। দেশের গল্প, জন্তু-জানোয়ারের গল্প।
মনে আছে আমরা আসার কিছুদিন পরেই দেওয়ালী হল। সুকিয়া স্ট্রীটের সব বাড়িতে তেলের পিদ্দিম জ্বালা হল, আমাদের বাড়িতে ছাড়া। শুনলাম ব্রাহ্মদের কালীপুজোয় আলো জ্বালবার দরকার নেই। শুনে অবাক হলাম। শিলং-এ আমাদের পাড়ার কাউকেই কালীপুজোয় আলো জ্বালতে দেখিনি। লাবানে নিশ্চয়ই পুজো হত, কিন্তু তার কিছুই মনে নেই। আলো দিতে না পেরে মনমরা হয়ে ছাদে গিয়ে চক্ষুস্থির! চারদিক আলোয় আলো-ময়! আর মাথার ওপর এত ফানুস উড়ছে যে আকাশটা প্রায় ঢেকে গেছে। মনে আছে একটা ফানুস ঠিক একটা হাতির আকারে তৈরি। সেটা আবার খুব নিচে দিয়ে উড়তে উড়তে হঠাৎ জ্বলে উঠল আর দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমাদের সে কি দুঃখ!
আরো মনে পড়ে আমার পিসতুতো বোন ময়নার দুই বছরের জন্মদিন হল খুব ঘটা করে। অগুন্তি অতিথি এসেছিল। পিসেমশাইকে চিনত না এমন লোক ছিল না। তাঁর নাম ছিল হেমেন্দ্রমোহন বসু, কুন্তলীন তেল আর দেলখোস সেণ্ট তৈরি করে তিনি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়ে আমাদের দেশে ও-সব বিলাস-দ্রব্য হতই না প্রায়। পিসেমশাই ছিলেন অগ্রণীদের একজন। নানান বিষয়ে উৎসাহ ছিল তাঁর। তখন গ্রামাফোনের জন্য ডিস্কের বদলে সিলিণ্ডার ব্যবহার হত। পিসেমশাই সেই সময় রবীন্দ্রনাথের গাওয়া বঙ্কিমের বন্দেমাতরম গানটি রেকর্ড করেছিলেন। তাঁর ছেলেদের কাছে ঐ সিলিণ্ডারটি এখনো আছে, তবে কেমন অবস্থায় তা জানি না। বাড়িতে বায়োস্কোপ দেখাবার ব্যবস্থা করতেন তিনি। ময়নার জন্মদিনেও দেখানো হয়েছিল। তখনো পিসেমশায়ের নিজের বাড়ি হয়নি, কোনো আত্মীয়ের বাগানে জন্মদিন করা হল।
বাগানের মধ্যিখানে দেখলাম সবুজ একটা কাঠের টবে একটা সত্যিকার গাছ পোঁতা রয়েছে। তার ডালে ডালে রঙীন কাঁচের গোলা, মোমবাতি আর অজস্র খেলনা ঝুলছে। গাছের মগ্-ডালে একটা পরী-পুতুল। সব খেলনায় একটি করে নম্বর দেওয়া ছিল। সক্কলকে একটা ঝুড়ি থেকে ইচ্ছেমতো টিকিট তুলতে বলা হল। টিকিটের যে নম্বর, সেই নম্বরের খেলনা সবাই পেল। পরী-পুতুল কে পেল মনে নেই, কিন্তু আমি পেলাম রঙ-চঙে বাক্সে চমৎকার ছবি দেওয়া এ-বি-সি ব্লক। এত খুশি হয়েছিলাম যে তার পরদিনই বসে বসে এ থেকে জেড্ পর্যন্ত শেখা হয়ে গেল। ততদিনে বাংলা অক্ষরও চিনতে শিখেছি। বড়দি আমাদের হাসিখুশি আর মোহনভোগ বলে দুখানি বই দিয়েছিলেন। ঐ আমার নিজের প্রথম বই।
তারপর বাবা তাঁর বনে বনে জরীপের কাজ সেরে ফিরে এলেন। যামিনীদা দেশ থেকে ক্ষীরের ছাঁচ আর নারকেল নাড়ু নিয়ে ফিরল। আমাদের শিলং-এ ফিরবার সময় হয়ে এল। তার আগে হ্যারিসন রোডে পিসেমশায়ের ভাড়া বাড়িতে কয়েক দিন থাকা হল। কি প্রকাণ্ড বাড়ি আর কি ভয়ঙ্কর দুরন্ত পিসেমশাইয়ের যে-সব ছেলেরা আমাদের সমবয়সী, বিশেষত গণেশ আর কার্তিক বলে দুজন। তারা আমাদের যাকে বলে এক হাটে কিনে আরেক হাটে বেচে আসতে পারত। কিন্তু ও-বাড়িতে আমাদের বেজায় ভালো লাগত। ওদের যেখানে যা ছিল সব আমাদের নিতে দিত; যখন খুশি যা খুশি নিজেরাও খেত, আমাদেরও দিত, সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা, কুলপী-বরফ। তবে বড়রা যেমন ভালো, ছোটগুলো তেমনি বাঁদর ছিল। মনে আছে আমার একটা পেয়ারের ডলি ছিল। একদিন গণেশদা বলল, ‘বুঁদী একটা চোর, বুঁদীর বিচার হবে।’ কার্তিকদা বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো হবেই, চুরি করবে আর তার বিচার হবে না! বুঁদী ভেবেছে কি! চল, ওকে ছাদে নিয়ে চল!” এই বলে বুঁদী বেচারির ঠ্যাং ধরে ঝুলিয়ে ছাদে নিয়ে চলল। দেখলাম দাদাও কিছু বলছে না। আমি ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে সঙ্গে গেলাম। বলা বাহুল্য দিদিও এমন সুযোগ ছাড়ল না। পিসিমার ছেলে বাপীর প্রায় আমার সমান বয়স, আমার ভাই কল্যাণ এক বছরের ছোট, এরা হল নীরব দর্শক। বিচারে বুঁদীর ফাঁসির হুকুম হল। শুধু তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে চিল-ছাদের দরজার শিকলিতে দড়ি বেঁধে লটকেও দেওয়া হল। তবু মরছে না দেখে, ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ওর হাত পা খসিয়ে ফেলা হতে লাগল।
আমি আর সইতে না পেরে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নিচে নামতে লাগলাম। মুকুলদা তার নিজের ঘরে ছিল। সে আমাকে ধরে ফেলে, চোখ মুছিয়ে, তার সত্যিকার বাষ্প-এঞ্জিন-টানা ট্রেন চালিয়ে দেখাতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে এঞ্জিনটা আবার লাইন থেকে সরে হুড়মুড় করে পড়ল। ততক্ষণে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেছিল। তখন মুকুলদার বয়স হয়তো তেরোর বেশি নয়।
এই মুকুলদা অন্য সকলের থেকে আলাদা একজন বিশেষ মানুষ। খুব ছোটবেলায় হাঁটু জখম হয়ে ওর একটা পা একটু ছোট হয়ে গেছিল। সারা জীবন ও সেই দুঃখ বয়ে বেড়িয়েছে। সিনেমা জগতে ফটোগ্রাফির জন্য ওর ভারত-জোড়া নাম! আমার চাইতে বছর আষ্টেকের বড় হবে, বুদ্ধিমান, হৃদয়বান। এর পরেও আমার প্রয়োজনের সময় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুদর্শন এই মানুষটির তুলনা নেই। আমি ওকে কখনো কিছু দিইনি। দেওয়া যায় না
বলা বাহুল্য গণেশদাদের যথেষ্ট বকাবকি করা এবং আমাকে একটা চমৎকার চোখ-খোলা-চোখ-বোজা ডলি কিনে দেওয়া হয়েছিল। এমনি করে তিলে তিলে আমাদের জীবনে রস-রোমাঞ্চের অবতারণা হয়েছিল।
ফিরে যাবার আগে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল, আমাদের ওপর যার প্রভাব ছিল সুদীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী। সে হল উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ। ১লা বৈশাখ ১৩২০। সেদিনটি আমার এখনো মনে আছে। সন্ধ্যেবেলা আমরা সকলে দোতলার বসবার ঘরে বসে আছি। দিদির, আমার, হাতের প্রথম সোনার চুড়ি হয়েছে, তার চকচকে রূপের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। এমন সময় জ্যাঠামশাই হাসতে হাসতে ওপরে উঠে এলেন। হাতে তাঁর ‘সন্দেশে’র প্রথম সংখ্যা। কি চমৎকার তার মলাট! গাল-ভরা সন্দেশ, হাতে ‘সন্দেশ’ ভাই-বোন শোভা পাচ্ছে। যতদূর মনে হয় এইটেই ছিল প্রথম মলাট। পরের বছর বোধ হয় দাদু-প্যাটার্ণের একজন সন্দেশের হাঁড়ি আর ‘সন্দেশ’ উঁচু করে ধরে রেখেছে আর ভাই-বোন সেগুলো পাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্রতি বছর জ্যাঠামশায়ের আঁকা নতুন রঙীন মলাট, হাফ-টোনে ছাপা, সাল-তারিখ গুলিয়ে যায়।
মা, বড়দিদি, টুনিদিদি সবাই মিলে যে-রকম আনন্দ কোলাহল করে উঠলেন, তাতে আমাদেরো বুঝতে বাকি রইল না যে আজ একটা বিশেষ দিন। কবিতা গল্প আমাদের পড়ে শোনানো হয়েছিল, কিন্তু তার কিছুই মনে নেই। ‘সন্দেশে’র ছোট হরপের তখনো সুবিধা করতে পারতাম না। ঐ যে জ্যাঠামশাই “সন্দেশ” ঢুকিয়ে দিলেন আমাদের জীবনে, আমার মনে হয় কালে কালে ও-ই আমাকে যতখানি প্রভাবিত করেছিল, তেমন আর কিছু নয়। এমন কি জ্যাঠামশাই নিজেও না। ১৯১৩ সালের এই ঘটনার পর তিনি মাত্র দু বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু আমার সমস্ত শৈশবের চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ঐ একটি ছোট মাসিক-পত্রিকা, তার কবিতা গল্প ছবি ধাঁধা; কোনো মানুষ না। জ্যাঠামশাই পরলোকে যাবার পরেও সে প্রভাব এতটুকু স্তিমিত হয়নি। কবে যে নিজে পড়ে বাংলা ভাষার রস গ্রহণ করতে শিখেছিলাম সে আর মনে নেই। কিন্তু সে যে “সন্দেশ” এবং জ্যাঠামশায়ের ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্সের প্রকাশিত নানান্ অবিস্মরণীয় বইয়ের জন্য-ই সম্ভব হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ১৯১৪ সালে দিদি আমি লোরেটো কন্ভেণ্টে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে বাংলা তো পড়ানো হতই না, তার ওপর সহপাঠিনীরা আর কোনো কোনো মাস্টারনীরাও যে ‘নেটিভ’দের এবং নেটিভ্ ভাষা, নিয়ম, চালচলনকে ঘৃণা করে, সেটা বুঝতে আমাদের দেরি লাগেনি। এর ফলে আমাদের কেমন একটা জেদ্ চেপে গেছিল। ইংরিজিতে তো ওদের সমান সমান হয়ে উঠলাম-ই, তার ওপর বাড়িতে বাংলা বইয়ের সংগ্রহটি দিনে দিনে বেড়ে উঠতে লাগল। ছেলেদের রামায়ণ, তার ছবিই বা কি অপূর্ব, অমন বিকট তাড়কারাক্ষসী অমন রঙ দিয়ে এঁকে ক্ৰীম-লেড কাগজে অমন চমৎকার করে আজ পর্যন্ত কেউ এঁকেছে বলে শুনিনি। ছেলেদের মহাভারত আর সেই কবিতায় ‘ছোট্ট রামায়ণ’ বাংলা ভাষায় যার তুলনা নেই। ছোট জ্যাঠামশায়ের ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসিয়্স’, ‘রবিন-হুড্’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘কথাসরিৎসাগর’। বড়দির ‘আরো গল্প’ ইত্যাদি আগ্রহের চোটে সময়কে ছাড়িয়ে যাচ্ছি, এ-সব হল ১৯১৪-১৫-র কথা। আমরা হয়তো ১৯১৩-র শেষের দিকে শিলং-এ ফিরেছিলাম। মনে আছে কোনো কারণে বাড়ি পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেছিল। তখন একে দিন ছোট হয়ে এসেছিল, তার ওপর পাহাড়-দেশের সূর্য বিকেল শেষ না হতেই টুপ করে পাহাড়ের পিছনে নেমে পড়ে। চুড়োয় চুড়োয় রোদ লেগে থাকে, অনেক উঁচুতে যে-সব বাড়ি তাদের জানলার সার্শিতে পড়ন্ত রোদ ঝিকমিক করে ওঠে, চোখ ঝলসে যায়। পাহাড়তলিতে তখন ঝোপে-ঝাড়ে জোনাকি-পোকা জ্বলতে আরম্ভ করে দিয়েছে, গাছের তলায় তলায় অন্ধকার জমেছে! তারপর হঠাৎ কখন সব লেপেপুঁছে একাকার হয়ে যায়। পথের তেলের বাতি টিমটিম করে আর মাথার ওপরকার নীল আকাশটাকে গাঢ় বেগুনি দেখায়, তার ওপর লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলতে থাকে। সে-তারার আলোই বা কি! চাঁদ না থাকলেও চারদিক ফুটফুট করে।
এই রকম দিনে, এই রকম সময়, আমরা ক্লান্ত শরীরে হাই-উইণ্ড্স-এ এসে পৌঁছলাম। লাল গেটের কাছ থেকে দেখতে পেলাম কাঁচের জানলার পিছনে সারি সারি তেলের ল্যাম্প জ্বলছে, সামনের দরজা খোলা, বারান্দায় লোকজন। সব মিলিয়ে যেন হাত বাড়িয়ে আমাদের কোলে তুলে নিল। অমনি সব ক্লান্তি, সব বিরক্তি দূর হয়ে গেল। আমরা গেট্ থেকে এক দৌড়ে কাঁকর দেওয়া পথ দিয়ে নেমে বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে অমরকাকাবাবু, খুড়িমা, হরিচরণ, নন্দ আমাদের জন্যেই পথ চেয়ে ছিলেন। গত ছয়টা মাস সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে মুছে গেল। এই তো আমাদের নিজেদের জায়গাটিতে ফিরে এসেছি। এত আরাম, এত নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা আর কোথাও নেই।
অমরকাকাবাবু বাবাদের অপিসের অফিসার। তাঁরা যে আমাদের সত্যিকার কেউ নন্ এ-জ্ঞান যখন হয়েছিল, তখন বুকটা টনটন করে উঠেছিল। অন্যদের কি হয় জানি না, ছোটবেলা থেকে আমার কিন্তু বেজায় দুঃখ হলে বুকের ভিতর সত্যি সত্যি ব্যথা করতে থাকে। আমাদের বাড়ির সামনেই ফিরিঙ্গিদের সরকারি স্কুল, পাইন্মাউণ্ট স্কুল। সেখানকার মেমরা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। তার পরেই ‘নরেস্ক’, প্রায় অবিকল হাই-উইণ্ড্স্-এর মতো, দুই বাড়ির একই মালিক। নরেস্ক্-এ অমরকাকাবাবুরা থাকতেন। ভারি ফ্যাশানেব্ল্ ছিলেন ওঁরা। কেমন সাদা পোশাক-পরা বাবুর্চি ওঁদের রান্না করত। কাকাবাবু কাঁটা চামচে খেতেন আর খুড়িমা যে কি সুন্দরী ছিলেন সে আর কি বলব। কি সুন্দর সব গোলাপী, নীল রেশমী শাড়ি পরতেন, দেখে দিদি আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। আমাদের বাড়িতে যে বাঙালী ব্যবস্থা এটাও তখন বুঝতাম না। শীতের দেশ, টেবিলে খাওয়া হত, এই যা তফাৎ। ২২নং সুকিয়া স্ট্রীটে পিঁড়ি পেতে বড় বড় কাঁসার থালায় সবাই খেতাম। তা হকগে; কাকাবাবুদের বাড়িতে কিছু ভালো রান্না হলে, আমরা ভাগ পেতাম। মাঝে মাঝে পার্টি হত, যা ঝড়তি-পড়তি বাকি থাকত, পরদিন তার খানিকটা আমাদের বাড়িতে আসত। রোজ দুবেলা যদি দেখা না হত, সে বড় আশ্চর্য ব্যাপার হত। থাকতাম দুই বাড়িতে, বড়রা যে যার নিজেদের জীবন কাটাবেন, কিন্তু আমাদের দিন কাটত এক সঙ্গে গাদাগাদি করে শুধু খাবার সময় যে যার বাড়ি যেতাম।
ঐ বাড়িতে যাওয়াটা একেবারে নিরাপদ ছিল না। পাইন-মাউণ্ট স্কুলের মেট্রনের একপাল রাজহাঁস, বিলিতী মুরগী আর মস্ত মস্ত পেরু ছিল। হরিচরণ, নন্দ, দাদা, কল্যাণ, অমিদের একটা খেলাই ছিল তাদের তাড়িয়ে বেড়ানো। তার ফলে সব কটা পাখির মেজাজ একেবারে খিঁচড়ে গেছিল। বেঁটে কাউকে দেখলেই গলা বাগিয়ে, ঠোঁট এগিয়ে সাপের মতো হিস্-হিস্ শব্দ করতে করতে তেড়ে আসত। আর ধরতে পারলে তো কথাই নেই, গোড়ালি ঠুকরে রক্তাক্ত করে দিত। দিদি, আমি ওর মধ্যে ছিলাম না, তবুও আমাদেরও বাদ দিত না। এমন কি সম্পূর্ণ অচেনা বেঁটে খাটো কাউকে দূর থেকেও দেখতে পেলে তেড়ে আসত। হাঁস পেরু যে কি ভয়ঙ্কর রকমের হিংস্র জানোয়ার তা খুব কম লোকেই জানে। হরিচরণদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে যাওয়া-আসাটা তাই সাধারণ ঘটনার পর্যায় থেকে একটা উত্তেজনাময় অভিযানে দাঁড়াত। ক্রমে দুই পক্ষই দক্ষ গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিলাম। অতর্কিতে আক্রমণ ও পশ্চাদপসরণ। বলা বাহুল্য বড়রা এর কিছুই জানতেন না।
আরো সব কাকাবাবু ছিলেন আমাদের। তাঁদের অযাচিত স্নেহের কথা ভুলবার নয়। সবাই বাবাদের আপিসে কাজ করতেন। প্রফুল্ল কাকাবাবুরা লাল পুলের ওপর আমাদের সেই পুরনো বাড়িতে থাকতেন। ও-বাড়ির নাড়ু, নীলু, হরিচরণ, নন্দর মতোই আমাদের খেলার সাথী ও সমবয়সী। সারাজীবন আমরা এদের কাছাকাছি বাস করেছি। আজ পর্যন্ত এরা আমাদের অন্তরের অন্তরঙ্গ। কে বলেছে এরা আমাদের সত্যিকার আত্মীয় নয়? কয়েক বছর পরের ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা সকলেই তখন কলকাতার বাসিন্দা। ভবানীপুরের অধিবাসী। মায়ের হল নিউমনিয়া, যায় যায় অবস্থা, চার বেলা ডাক্তার আসেন, কিছু টাকার টানাটানি পড়ল। কাকাবাবুরা বাবার জুনিয়র, তাঁদের সাহায্য নেবার কথা বাবা মনেও স্থান দিতে পারেন না। তাঁরা দুজনেই চুপিচুপি নোটের তোড়া এনে দিদির আমার হাতে গুঁজে দিয়ে গেছিলেন। বলেছিলেন, “বাবাকে বলিস না।” আমরা একটি কথাও বলতে পারিনি। বাবা যখন শুনলেন, আমাদের একটুও বকলেন না, অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। মা ভালো হয়ে গেলে সেই টাকা কাকাবাবুদের দিয়ে আসা হয়েছিল। এইরকম নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায়, স্নেহে প্রেমে আমার ছােটবেলাটা কেটেছিল। তাই আমার আজ পর্যন্ত যত লোক দেখি, প্রায় সক্কলকে ভালো লাগে। ঐ ভালো-লাগাটা এক-তরফা হলেও ভালো লাগে। আমার সব চিন্তা, সব কাজের পিছনে, সবাইকে আর প্রায় সব কিছুকে এই ভালো-লাগাটা কাজ করে। আমার ব্যাঙ পর্যন্ত ভালো লাগে; মাকড়সাও ভালো লাগে, তবে একটু দূর থেকে।
কলকাতা থেকে ফিরেই আবার শিলং-এর পুরনো জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বাড়ির পূবে সিসল-ঝোপের বেড়ায় দিনের বেলাও ঝিঁঝিঁ-পোকা ডাকত। তার পিছনে বন-বিভাগের বড় সাহেব মিঃ কাউই থাকতেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন পাগল। তাঁকে বন্ধ করে রাখা হত, একেক দিন পালিয়ে এসে মায়ের সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করতেন। একবার বলেছিলেন, “আমাদের বাড়িতে পার্টি হয়, সবাই আসে। কিন্তু আমাকে ওরা যেতে দেয় না।” অপূর্ব সুন্দরী মানুষটি। মায়ের খুব দুঃখ হয়েছিল। একটু পরেই আয়া, নার্স, বেয়ারা, সবাই ছুটে এসে তাঁকে বাড়ি নিয়ে গেছিল।
কাউই সাহেবের গোটা দশেক সোনালী রঙের বিলিতী বেড়াল ছিল। তাদের কি আহ্লাদ! দেখে আমাদের গা জ্বলে যেত। তারা টিনের মাছ খেত। গাছে চড়তে পারত না। পাড়ার বেড়ালরা তাদের ওপর হাড়ে চটা ছিল, দেখলেই তাড়া করত। তারাও ম্যাও-ম্যাও করতে করতে ঘরে পালাত আর বয়-বেয়ারা ঠ্যাঙা নিয়ে পাতি বেড়ালদের ভাগাত। বিশেষ করে একটা ছাই রঙের হুলো ছিল সব চাইতে গোঁয়ার-গোবিন্দ। একদিন একটা হলুদ বেড়ালকে একলা পেয়ে হুলো তাকে তাড়িয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এল। সে বেচারা গাছে চড়তে পারে না, তবু মরিয়া হয়ে তরতর করে আমাদের সরল গাছের মগ্ডালে চড়ে বসল। হুলোর গাছে চড়া হল না। হাঁকডাক শুনে বয়-বেয়ারারা বাঁশ নিয়ে এসে তাকে ভাগাল। তারপর হল মজা। আহ্লাদে আর নামতে পারে না! সাহেবের পেয়ারের চাকররা গাছে চড়তে পারে না! শেষটা একটা লম্বা মই এনে তাকে নামানো হল।
ঐ হুলো কিন্তু মহা পাজি ছিল। মাঝে-মাঝে আমাদের মাছ খেয়ে যেত। সেকালে ওখানে সপ্তাহে দুদিন বাজার বসত, তখন মাছ পাওয়া যেত। সকলে মাছ ভেজে দু-তিন দিন ধরে খেত। ঠাণ্ডা জায়গা, নষ্ট হত না। আমাদের রান্নাঘরের ছাদ থেকে শিকে ঝুলত, শেষটা যামিনীদা সেই শিকেতে ভাজা-মাছ তুলে রাখল। হুলোও হন্যে হয়ে, স্কাই-লাইটে চড়ে, সেখান থেকে লাফ দিয়ে, মাছ নামিয়ে, কতক খেয়ে, কতক নষ্ট করে দিয়ে চলে গেল। ভয়ানক রেগে গেছিলাম।
সেই রাতে স্বপ্ন দেখলাম আমি বসে আছি, একেবারে আমার গা-ঘেঁষে হুলো যাচ্ছে! হাতে কোনো হাতিয়ার নেই, কিন্তু এমন সুযোগ তো ছাড়া যায় না, দিলাম কষে হুলোর গালে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত! দিদি শুত আমার পাশে, মস্ত বড় একটা লেপের নিচে, ওর নরম-গরম পায়ে পা লাগিয়ে আমার ঠাণ্ডা গা গরম করতাম বলে এমনিতেই এ ব্যবস্থা ওর পছন্দ ছিল না। তার ওপর আজ রাতের চড়টা গিয়ে ওর গালে পড়াতে, ঠাণ্ডা মানুষটা রেগেমেগে উঠে বসে বলল, “ও কি হচ্ছে! আমাকে চড় মারছিস কেন?” আমি বললাম, “ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, স্বপ্নে মারছি রে, ও সত্যিকার চড় নয়।” দিদি বলল, “আমিও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে তোকে মারছি!” এই বলে আমাকে দু-ঘা দিয়ে পাশ ফিরে শুল! এর পরে ডালের ডুলি কেনা হল, তাতে মাছ বন্ধ করে রাখা হত।
এর মধ্যে কলকাতা থেকে চিঠি এল বড়-মাসিমা তাঁর ছোট মেয়ে নোটনকে নিয়ে শিলং-এ আসছেন। মেসোমশাই তখন বিলেতে, তিনি না ফেরা অবধি মাসিমারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। খুব খুশি হয়েছিলাম। সেকালে কেউ বড় বড় পরিবারে আপত্তির কারণ, আমরাও ততদিনে বাড়তে বাড়তে দুই বোন চার ভাইতে দাঁড়িয়েছি। বোনের সংখ্যা এবার বাড়বে ভেবে দিদির, আমার মহা উৎসাহ। আর মায়ের নিজের মানুষ বলতে ঐ দুটি বোন, আর তাঁর কেউ ছিল না। সেই বোন দুটি মায়ের চোখের মণি। বড় মাসিমা মায়ের চেয়ে দু বছরের বড় ছিলেন। আমরা মোটর আপিসে আনতে গেলাম। মস্ত গাড়ি থেকে নামলেন। এখন হলে বলতাম বাস্, কিন্তু তখনো বাস্ কথাটার চল হয়নি। কলকাতার রাস্তাতেও বাস চলত না, শুধু ট্রাম চলত।
বড় মাসিমার চমৎকার চেহারা ছিল, মার চাইতে মাথায় সামান্য লম্বা, শক্ত বলিষ্ঠ শরীর, চোখে সোনার চশমা, মায়ের মতো অতটা ফর্সা না হলেও খুবই সুন্দর রঙ। আর নোটন একটা মোমের ডলির মতো সুন্দর। দুঃখের বিষয়, আমরা কোলে নেবার চেষ্টা করলে, চ্যাঁ-ভ্যাঁ করে মুখ ফিরিয়ে, হাত দিয়ে আমাদের ঠেলে দিত। মাসিমা তাড়াতাড়ি ওকে তুলে নিয়ে বললেন “আহা, ওকে বিরক্ত কর না, তোমাদের তো আর চেনে না।” আমাদের ফূর্তি কোথায় উবে গেল।
বড় সুন্দর ছিল নোটন, যেমনি নাক-মুখ, তেমনি সুন্দর কোঁকড়া চুল, ভুরু যেন তুলি দিয়ে আঁকা, বড় বড় চোখ দুটো খুললে, পদ্মগুলো ভুরুতে ঠেকত। এমন সুন্দর মেয়ে আমি কম দেখেছি। তবে ঐ যা বললাম, বেজায় আহ্লাদী, নিজের মাকে ছেড়ে এক মিনিট থাকবে না, আমাদের খেলায় যোগ দেবে না। বয়স প্রায় তিন। ওর সঙ্গে ভাব করতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। পরে দেখলাম স্বভাবটাও তেমনি মিষ্টি। কারো সঙ্গে ঝগড়া করে না, কটু কথা বলে না। আমার সেজ ভাই অমিয় ওর চাইতে তিন মাসের বড়, সে কেবলি ওর পেছনে লাগত। ভাব-ও ছিল যথেষ্ট, একসঙ্গে খেলাধুলো হত, পরীদের মতো দেখতে নোটন আর কালো-কোলো গাঁট্টা-গোঁট্টা অমিয়। মনে আছে সেই সময় আমাদের নিজেদের চেহারা সম্বন্ধে আমাদের চোখ ফোটেনি। একদিন শুনেছিলাম মাসিমা মাকে বলছেন “এই সব কালো মেয়ে নিয়ে তোকে মুশ্কিলে পড়তে হবে!” মা সেদিকে কানই দিলেন না, বললেন, “কিচ্ছু মুশ্কিলে পড়তে হবে না। ওরা খুব ভালো। কিন্তু আমার বুকে হাতুড়ির ঘা পড়েছিল। হঠাৎ আমার চোখ খুলে গেছিল। নোটনের সুন্দর চেহারায় আমাদের ভারি আনন্দ, ভারি গর্ব ছিল। অসতর্কে বলা ঐ একটি কথা বড় আঘাত দিয়েছিল।
॥ ৪ ॥
বড়মাসিমা লোকটি সাধারণ লোকদের থেকে একটু আলাদা ছিলেন। সে সময় ভাবতাম তাঁকে বেজায় বেরসিক, ঠাট্টা বুঝতেন না, যা বলা যেত অমনি তাকে বাস্তব সত্য বলে ধরে নিতেন। পরে বুঝেছিলাম ছোটবেলায় যে স্নেহের পরিবেশে সব মানুষের ছেলেমেয়েদের বড় হওয়া উচিত, বড়মাসিমা তার কিছুই পাননি। পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে, কুড়ি বছর বয়সে, বি-এ পাশ করে, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের সঙ্গে বিয়ে হওয়া অবধি, মধ্যিখানের অতগুলো বছর স্নেহশূন্য বোর্ডিং-এ কেটেছিল। সেখানে শারীরিক যত্ন পেয়েছিলেন, শিক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু বড়দের ভালোবাসা পাননি। তবে বন্ধুবান্ধব অনেক জুটেছিল। পরে দেখেছিলাম কলকাতার শিক্ষিত সমাজের এমন মানুষ কম ছিল, মাসিমা যাদের চিনতেন না। সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। কিন্তু আমরা ভাবতাম কাঠখোট্টা। নিজের মেয়েকে ছাড়া কাউকে আদর করতেন না, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতেন না। তবে মাকে যে বড্ড ভালোবাসতেন, সেটা আর বলে দিতে হত না।
ভারি জ্বালাতন-ও করতাম। তরতর করে বাঁদরের মতো একটি ন্যাসপাতি গাছে উঠতাম। বাকি দুটিতে সুবিধা করতে পারতাম না। অমনি নোটনকে নিয়ে গাছতলায় এসে মাসিমা বলতেন, “ওরে নুটুর জন্য একটা ভালো দেখে পেড়ে দিস্ তো।” ‘নুটু’ শুনেই পিত্তি জ্বলে যেত। তার ওপর সরোজ আরো দু বছরের ছোট, তার নাম কচ্ছেন না বলে আরো রেগে যেতাম। সরোজের তখন হয়তো দেড় বছর বয়স, ন্যাসপাতির ওপর আগ্রহ নেই। তবু ভালো দেখে একটা ন্যাসপাতি পেড়ে মাসিমাকে ডেকে বলতাম, “এটা দেব? ভালো মনে হচ্ছে।” মাসিমা বললেন, “ভালো হলে দে, নইলে নয়।” বলতাম “দাঁড়াও দেখছি।” বলে এক কামড় দিয়ে আবার বলতাম, “খুব ভালো, এই নাও ধর!” বলে ছুঁড়ে ফেলতাম। জানতাম আমার মুখেরটা কখনোই নোটনকে দেবেন না। যদিও আমরা অকাতরে পরস্পরের মুখেরটা খেতাম। মাসিমা আমাকে বকতেন। তাই শুনে ঘর থেকে মা বেরিয়ে আসতেন। অমনি আমি তিন চারটে ভালো ফল ছুঁড়ে দিয়ে, গাছের আরো মগ-ডালে চড়ে ফল বাছতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম! মাকে ভয় করতাম না, বেজায় ভক্তি করতাম আর ভয়ঙ্কর ভালোবাসতাম। মা মুচকি হেসে আবার ঘরে ঢুকে যেতেন। আশ্চর্য মানুষ ছিলেন আমাদের এই মা-টি। আমাদের পাঁচ ভাই তিন বোনকে, তার ওপর বাড়তি আরো জনা দুইকে দিব্যি সুন্দর মানুষ করে দিয়ে গেলেন, কাউকে চড়-চাপড়টা পর্যন্ত না দিয়ে। হয়তো ভাবতেন সে-কাজটি বাবার হাতে স্বচ্ছন্দে ছেড়ে দেওয়া যায়। ‘কাউকে না’ বলতে অবিশ্যি আমাকে বোঝায় না। মার হাতে চড় কানমলা খাবার গৌরব আমার একার ছিল। একবার স্নানের ঘরে বন্ধও করে রেখেছিলেন। সেবার কল্যাণকে পিটিয়েছিলাম। খুব জল ঘেঁটেছিলাম, সাবান গুলে হাত দিয়ে চোঙা বানিয়ে বুদ্বুদ্ উড়িয়েছিলাম। লাল, নীল রামধনুর রঙ ধরে সেগুলো ঘরময় উড়ে বেড়িয়েছিল। বাইরের দরজার চৌকাঠে ফিকে হলুদ, ফিকে গোলাপী, ছাই রঙের ছোট্ট ছোট্ট ব্যাঙের ছাতা দেখেছিলাম। দরজার ফাঁক দিকে এক ফালি রোদ এসে টিনের টবের জলে পড়ছিল। টবটাতে একটু ঠেলা দিতেই হাজার হাজার ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ তৈরি হয়ে, যেই সেই রোদের কাছে আসছিল, ঝিকমিক করে উঠছিল। দেখে দেখে আর আশ মিটছিল না। একা কত দেখব? কাঁধ দিয়ে দরজায় ঠেলা দিতেই, বাইরের ছিট্কিনিটা পড়ে গেল, বেরিয়ে এসে ডাক দিলাম, “ওরে তোরা মজার জিনিস দেখবি আয়।” অমনি যে যার জলখাবার ফেলে, টেবিল ছেড়ে ছুটে এসেছিল। নোটন-ও, তার পিছন পিছন মাসিমা-ও। কেন জানি মনে হয়েছিল আমার শাস্তি পাওয়াটা তাঁর পছন্দ ছিল না। কিন্তু আমি ভালো করেই জানতাম মা ঠিক কাজই করেছিলেন। লোক আমি ভালো ছিলাম না। আমার কথামতো না চললে দাদাকে পেটাতাম, দিদিকে পেটাতাম। ওরা মাথায় আমার চাইতে লম্বা, বয়সে বড়, গায়ে জোর বেশি। তবু পেটাতাম। দাদা উলটে মারত আর দিদি ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদত। তাই দেখে বলতাম, ‘ছিঃ! ছিচকাঁদুনি!’ বলে আরো দু-এক ঘা দিয়ে দিতাম। তবু দিদিকে বেজায় ভালোবাসতাম। সে না হয় বোঝা গেল। ও যে কেন আমাকে ভালোবাসত সেটা আজ পর্যন্ত ভেবে পাইনি। সেইজন্যই আজ পর্যন্ত ও আমার প্রাণের প্রাণ, আমার অন্তরের দোসর।
বলেছি তো মাসিমা আসলে খুব ভালো ছিলেন। রাতে আমার পা কামড়াত, আমি কাঁদতাম। আমাদের আয়া ইল্বন নিচে বিছানা করে শুত। তাকে বলতাম, “ও ইল্বন, আমার পা টিপে দাও। বড় ব্যথা করছে।” ইল্বন বলত “পায়ে এঁটে দড়ি বেঁধে, পা টান করে শোও, ব্যথা সেরে যাবে।” কিছুতেই উঠত না। কিন্তু মাসিমা উঠতেন। শীতের রাতে গরম বিছানা ছেড়ে এসে আমার পা টিপে দিতেন। আমি ঘুমালে তবে আবার শুতে যেতেন। এর অনেককাল পরে, আমার আদরের ছোটমাসিমা ৪২ বছর বয়সে পাটনায় মারা গেলে, বড় মাসিমা তাঁদের বাড়িতে একখানা চিঠিও লেখেননি। ছোটমেসোমশাই দুঃখ করে আমাকে লিখেছিলেন। তখন আমি কলেজে পড়ি।
বড়মাসিমার সঙ্গে দেখা হতেই সে-কথা বলেছিলাম। তাঁর চোখের কোণে জল দেখলাম। বললেন, “ওরে, আমি ছোটবেলায় ভালোবাসার কথা শুনিনি বলে দুঃখ কিম্বা ভালোবাসা প্রকাশ করতে শিখিনি।” বড় দুঃখ হয়েছিল, মনে হয়েছিল এ কেমন দুঃখী যে ভালো করে কাঁদতেও শেখেনি।
চমৎকার গানের গলা ছিল বড়মাসিমার। নোটন-ও সেটি পেয়েছিল। আমার বড় মেসোমশাই সুরেন মৈত্র যেমন ভালো গাইতেন তেমনি ভালো লিখতেন। সুরেশ্বর শর্মা নামে তাঁর কবিতা প্রবাসী ইত্যাদি কাগজে বেরুত। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন; পি-ই-এনের সভ্য; সব গাইয়ে, আঁকিয়ে, লিখিয়েদের পরম বন্ধু। ওদিকে বিজ্ঞানের ছাত্র এবং অধ্যাপক। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞান ঘোষ, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এঁরা সব মেসোমশায়ের ভক্ত ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাড়িতেই এঁদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। মেসোমশাই বিদেশী কবিদের রচনার তর্জমা করতেন, বাংলা কাব্যে। আশ্চর্য ভালো লেখা। তিন-চারখানি বই-ও বেরিয়েছিল। তার মধ্যে ‘ব্রাউনিং পঞ্চশিকা’ আর ‘জাপানী ঝিনুকে’র নাম না করে পারছি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬৭ বছর বয়সে হৃদ্রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আমিও একজন ব্যথার ব্যথী, রসের রসিক, আজন্মের বন্ধু হারিয়েছিলাম। তাঁর কাছে কত যে ভালোবাসা পেয়েছি সে আর গুণে বলা যায় না। আমার কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে শিবপুরের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তাঁর কোয়ার্টারে নোটনের সস্নেহ সঙ্গতে, মাসিমার যত্নে আর মেসোমশাইয়ের সান্নিধ্যে ছুটির পর ছুটি কাটিয়েছি। তাঁর হৃদয়ের একরকম উদারতা ছিল, যাতে তিনি যেমন গুণগ্রাহী তেমনি বিচক্ষণ সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। কোনো ভালো জিনিসকে তিনি অশ্রদ্ধা করতেন না, তা মতের যতই অমিল থাকুক। বাড়িতে দেয়াল-ভরা বইয়ের আলমারি ছিল, তার বেশির ভাগ ইংরিজি বইতে ঠাসা। আমার মন গড়ে তুলতে এই মেসোমশায়ের তানেকখানি হাত ছিল। বলতেন, “তোমার উচিত ছিল আমার মেয়ে হয়ে জন্মানো!” তা কিন্তু নয়। আমার ঐ তীক্ষ্ণ-বুদ্ধি, অসহিষ্ণু, রাগী বাবা ছাড়া, কেউ আমার বাবা হতে পারত না। কি রসজ্ঞান, কি ছবি আঁকার হাত, কি গল্প বলার নেশা। প্রচণ্ড শক্তির কি অবাধ প্রকাশ!
এমনিতে ভয়ে আমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত, কিন্তু যেই না সন্ধ্যেবেলায় আমাদের স্কুলের পড়া তৈরি হয়ে যেত, বালিশে ঠেস-দিয়ে বসা বাবা অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। তখন আমরা তাঁর কোলে, পিঠে, পেটের ওপর চেপে বসে, গল্প শুনতাম। সব সত্যি গল্প। দেশে বাবাদের ছোটবেলার গল্প; জরীপ-বিভাগে কাজ করতে গিয়ে ঘোর বেঘো জঙ্গলে বাবার নানান্ লোমহর্ষণ অভিজ্ঞতার গল্প; কত হাসির, কত কান্নার গল্প। অমন গল্প বলতে পারে আমি সারা জীবনে আর একটিও লোক পাইনি। বাবার ডাইরি থেকে তুলে “বনের খবর” প্রকাশ করেছিলেন সিগ্নেট প্রেস। বাবা তখন ইহলোকে নেই। একাধিক সংস্করণ হয়েছিল তার। এখন আর পাওয়া যায় না। এমন তথ্যে, এমন সরসতায়, এমন পৌরুষে পরিপূর্ণ বই বাংলায় বেশি নেই। বাবাদের ছোটবেলার গল্প কিছু কিছু আমার ‘বাঘের বই’তে ভরে দিয়েছি। কিন্তু বাবার সেই চোখের দৃষ্টি, গলার স্বর, ঘরের সেই নিস্তব্ধতা আর ঘরের বাইরের সেই ঝোড়ো হাওয়ায় পাতা খসে পড়ার শব্দ দিয়ে যে ইন্দ্রজাল তৈরি হত, সে আমি কোথায় পাব? বাবার সঙ্গে আমার চিরদিনের মতো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল, কিন্তু ঐ একটি মানুষ ছাড়া কেউ আমার বাবা হতে পারত না। সব ঐ বাড়িটি, বাড়ির ঐ মানুষগুলি, বাইরের ঐ বিশেষ বিশ্বপ্রকৃতি, সব মিলে একটা পরিপূর্ণতা সৃষ্টি করেছিল, তার মধ্যিখানে আমাদের নিজেদের জায়গাটি খুঁজে পেয়েছিলাম। আর কোনো জায়গার কথা ভাবতেই পারতাম না।
দিনরাত ছোট নদী কলকল করে বয়ে যেত। বর্ষায় সেকি ভীষণ চেহারা ধরত। তীর ছাপিয়ে, পাথর ডুবিয়ে, ফেনা ছড়িয়ে, গর্জন করে ছুটে যেত। আবার বৃষ্টি থামলেই আস্তে আস্তে জল নেমে যেত। তখন দেখতাম, এখানে ওখানে, পাহাড়ের খাঁজে, পাথরের গর্তে, জল আটকা পড়ে, ছোট বড় পুকুর তৈরি হয়েছে। তাতে ছোট মাছরা খেলা করছে। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। তারপরদিন জল আরো শুকিয়ে যেত, পুকুর আরো ছোট হত, মাছদের জায়গা কমে যেত। আরো দুদিন যেতেই পুকুরের জল শুকিয়ে যেত, মাছরা মরে যেত, পচা দুর্গন্ধ বেরোত। আমাদের সে কি দুঃখ।
নদীর ধারে ধারে একটুখানি জায়গা, তার পাশ দিয়েই আমাদের বাড়ির ঢালু জমি উঠে গেছে। সেইখানে নদীর ধারে নিচু একটা গুহামতো। তার ভিতর উঁকি মেরে দাদা বলল, “কি জানি চকচক করছে।” দেখলাম একটা নয়, দুটো চকচকে জিনিস। ধনরত্ন নয়তো? অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে দেখলাম একটা চকচকে-চোখ মেঠো ইঁদুর, কোলের কাছে চারটে বাচ্চা নিয়ে, সামনের দুটো নখওয়ালা ছোট্ট ছোট্ট থাবা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাচ্চাদের কেউ ধরতে গেলে মজাটা টের পাবে !
আরেকদিন এক নির্জন জায়গায় পাহাড়ের গায়ে একটা গর্তে দেখেছিলাম সবুজ একটা সাপ, নীল দুটি চোখ খুলে, চুপ করে পড়ে আছে। আমাদের চাকর পন্নু বলেছিল, “ও ঘুমোচ্ছে। সারা শীত ওরা ঘুমোয়।” আমরা অবাক! “ঘুমোচ্ছে তো চোখ খোলা কেন?” পন্নু বলেছিল, ওদের চোখের ঢাকনি থাকে না, তাই চোখ বন্ধ করতে পারে না। শীত কাটলে জেগে উঠবে, ঐ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। ওটা পড়ে থাকবে, সাপের নতুন নরম খোলস হবে। তখন ওর গায়ে জোর থাকে না, যে কেউ ওকে মেরে ফেলতে পারে।”
পন্নুর বাড়ি ছিল হাজারিবাগের দিকের কোনো গ্রামে। ওরা নাকি সাপ খেত। আমরা বললাম, “তোমরা তখন ওদের মেরে ফেল বুঝি?” পন্নু চটে গেছিল, “দুব্লা শত্ৰু কখনো মারতে হয়! মোটা হলে তবে মেরে খাই।”
আমরা বললাম, “বিষ লাগে না?” পন্নু আশ্চর্য হয়ে গেছিল। “বিষ লাগবে কেন? মুণ্ডুতে তো বিষ, সেটা কেটে ফেলে দিলেই হল।”
প্রকৃতির বড় কাছাকাছি থাকতাম। টোমাটো গাছে, গায়ে নীল চোখ আঁকা, ল্যাজের দিকে সবুজ শুঁড়, চার পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, সবুজ শুয়োপোকা থাকত। তাদের গায়ে একটাও লোম ছিল না। পুষেছিলাম একটাকে। সাবানের বাক্সে ঢাকনিতে ছ্যাঁদা করে তাতে রেখেছিলাম, ইস্কুলের মেয়েদের দেখা-দেখি। তাকে রাশি রাশি টোমাটো-পাতা খেতে দিতাম। রাশি রাশি ময়লা পরিষ্কার করতাম। তা সে কিছুতেই গুটি বাঁধল না। আইরিস্ বলল, “খেতে দিও না, গুটি বাঁধবে। আমারটা বেঁধেছে।” দিলাম খাওয়া বন্ধ করে। কিন্তু মা শুনে রেগে গেলেন, “তোদের এক বেলা খাওয়া বন্ধ করলে কেমন লাগবে? যা, টোমাটো গাছে ছেড়ে দিয়ে আয়।” তাই দিতে হল। মার কথা না শুনবার সাহস পেতাম না। পরে ন্যাসপাতি গাছ থেকে একটা সোনালী গুটি ভেঙে এনেছিলাম। জালি-জালি দেখতে, ভিতরের মূক-কীটটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই গুটি কেটে প্রকাণ্ড বড় প্রজাপতি বেরিয়েছিল। ফিকে সবুজের ওপর গোলাপী চোখ আঁকা। মাসিমা বলেছিলেন, “ওটা মথ্, তাই ডানা পেতে বসেছে। প্রজাপতি ডানা তুলে রাখে। তাই মথের ডানার ওপরে নক্সা, প্রজাপতির ডানার তলায়।” জানতেন অনেক রকম মাসিমা, খুব পড়াশুনো করতেন।
একটা ড্র্যাগন-ফ্লাইকে দেখেছিলাম মুখে করে কি যেন এনে, আমাদের বসবার ঘরে সাজানো শিংয়ের খেলনার কলসীতে ভরে তার ওপর কিছুক্ষণ বসে থেকে আবার উড়ে গেল। ভারি কৌতূহল হল, কলসীটা তুলে দেখি মাটি দিয়ে মুখটা বোজা। কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে সেটা বের করে ফেলতেই একটা মরা মাকড়সা বেরুল, তারপর আরেকটু মাটি, তারপর আরেকটা মাকড়সা। আমি তো অবাক! মাসিমা বললেন, “দুর্দিনের জন্য খাবার জমা করে রাখছে। ভগবানের এইরকম ব্যবস্থা।” ভগবানের ব্যবস্থার আরো প্রমাণ পেয়েছিলাম। একদিন স্কুলে আমাদের টিচার বললেন, “বাইরে থেকে যার যা ইচ্ছা, ফুল, ফল, পাতা এনে আঁকো।” আমি পাথরের খাঁজ থেকে একটা সিল্ভার ফার্ণের গাছ উপড়ে, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা সুতোর মতো মিহি শিকড়ের আগায় একটা ছোট্ট টুপি পরানো। টিচার বললেন, “যাতে জলের খোঁজে পাথরের মধ্যে নেমে ওর ব্যথা না লাগে, তাই ভগবান ওর আগায় টুপি পরিয়ে দিয়েছেন। তিনি সব জানেন, সব পারেন।”
সবাই বললেও কিন্তু কথাটা মেনে নিতে পারতাম না, কারণ ভগবানের অব্যবস্থারও অনেক নমুনা চোখে পড়ত। একবার মাকে বলেছিলাম, “সবই যদি পারেন তাহলে আমাকে শিলাকের মায়ের ছেলের মতাে ফর্সা করেননি কেন? তাহলে বোধ হয় দয়ালু নন্?”
মা বলেছিলেন, “দয়া দিয়ে তৈরি তিনি। আমাদের মা মরে গেল, বাপ সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল, কই তবু তো আমরা জলে পড়লাম না। তিনি আমাদের এখানে ওখানে ব্যবস্থা করে দিলেন। ও কথা বলিস না।” তবু আমার খট্কা যায়নি, বলেছিলাম, “হয় পারেন না বলে ফর্সা করেননি, না হলে খুব নিষ্ঠুর বলে ইচ্ছা করে কালো করেছেন।” মা বেশি কথা বলতেন না, তবু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “শিলাকের মায়ের ছেলের বাবা সায়েব বলে সে ফরসা। তোদের বাবা বাঙালী।” শিলাকের মায়ের ছেলের বাবা সায়েব শুনে এমনি অবাক হয়ে গেছিলাম যে ফর্সা হবার কথা ভুলে গেছিলাম। কই, ওদের বাড়িতে তো কত গিয়েছি, সায়েবটায়েব তো দেখিনি। শিলাকের মা আমাদের জামাটামা সেলাই করত। লাবানে তার সুন্দর বাড়ি ছিল, ভারি মিষ্টি ভদ্র ব্যবহার ছিল তার, তাকে আমার বেজায় ভালো লাগত। সায়েবের রহস্যটা কেউ আমাকে খুলে বলল না।
এখন জানি ওদের ছিল মাতৃপ্রধান জাত, মায়ের পরিচয়ে ছেলে-মেয়েদের পরিচয় ছিল। অবাঞ্ছিত শিশু বলে কোনো কিছু ছিল না ওদের। সব শিশুই বাঞ্ছিত শিশু। সে জন্মালেই তার মা নিজের নাম ছেড়ে দিয়ে, তার মা বলে পরিচিত হত। বাপের সম্পত্তি পেত মেয়েরা, কিম্বা তাদের ছেলেরা। অবিশ্যি কাজ-কর্ম বেশির ভাগ করত মেয়েরা, পুরুষরা বড় শৌখিন ছিল। রাস্তায় পাথর ভাঙার কাজ করত মেয়েরা, অথচ তারা রোজ পেত চার আনা পয়সা, পুরুষরা পেত ছয় আনা-আট আনা! সেখানে পয়সা দেবার মালিক ছিল সভ্যভব্য শিক্ষিত মানুষরা কি না। এতদিনে হয়তো ওখানকার হালচাল সব বদলে গেছে। ষাট বছর কি কারো একভাবে চলতে পারে?
ভয়ঙ্কর ভালোবাসতাম জায়গাটাকে। নদীর ওপারেই লুমপারিং পাহাড়ের ফায়ার-লাইনের ঘাস-জমি। ছুটির দিনে মাঝে মাঝে দুপুরের খাবার আগে, আমরা বড়রা পাঁচজন নদী পার হয়ে ফায়ার-লাইন বেয়ে উঠতাম। কোনো পথ-টথ ছিল না, সোজা খাড়া উঠে যেতাম, দেখতে দেখতে অনেকটা উপরে পৌঁছে যেতাম। সেখান থেকে আমাদের বাড়িটাকে ছোট্ট খেলনার বাড়ি মনে হত। দেখতাম ন্যাসপাতি গাছ-তলায় মাসিমা, নোটন, ছোট্ট সরোজ দাঁড়িয়ে। আমাদের পাহাড়-চড়া দেখছে।
ফায়ার-লাইনটা একেবারে ন্যাড়া হলেও ভারি আশ্চর্য জায়গা। নদী পার হয়েই দেখতাম কেমন মোলায়েম দেখতে কালচে সব পাথরের টুকরো, অনেকটা মোমবাতির গা দিয়ে গড়িয়ে পড়া গলা মোমের মতো চেহারা। কেউ বলেছিল ওগুলো নাকি ‘লাভা’র টুকরো। আগে এখানে সব আগ্নেয়গিরি ছিল, এখন নিবে গেছে। এ তারি গলন্ত পাথর, জমে শক্ত হয়ে পড়ে আছে। পাহাড়টা বাস্তবিকই অদ্ভুত। জোরে পা ফেললে মনে হত জায়গায় জায়গায় ফাঁপা। বর্ষায় কোথাও কোথাও ওপরের মাটি বসে যেত, তলাকার হলদে হলদে কালচে কালচে মাটি বেরিয়ে পড়ত। সে মাটিগুলো বেজায় তেল-তেলা, জুতোর তলায় চট্চট্ করত। আমরা বলাবলি করতাম ওখানে মাটির নিচে তেলের খনি আছে। সত্যিই আছে হয়তো। পোলো-গ্রাউণ্ডের ওদিকে একটা নদী বয়ে যেত, তার জল থেকে আমাদের স্কুলের বড় মেয়েরা একবার শিশিতে ভরে ঝকঝকে পারা এনেছিল। আছে হয়তো তারো খনি। তবে সে নদীটা যে ঠিক কোথায় সে আর এখন মনে নেই। বড় ভালো এই পৃথিবীটা, আশ্চর্য জিনিস দিয়ে ঠাসা। সরল-গাছে এক রকম বিকট শুঁয়োপোকা গাছের সঙ্গে গায়ের রঙ মিলিয়ে থাকত। তাদের গায়ে কাঠি ছোঁয়ালে, ফ্যাঁশ করে একটা শব্দ হত, পিঠে সারি সারি খুদে ঢাকনি খুলে যেত। তার মধ্যে থেকে তিনটে করে লোম বেরুত, তার আগায় আঠা মতো লাগা। সে আঠা নাকি ভারি বিষাক্ত। শুঁয়োপোকারও শত্রু ঠেকাবার ব্যবস্থা করে রেখেছেন ভগবান! হিন্দুরা ঠাকুর-দেবতাকে ভক্তি করত; ব্রাহ্মরা মন্দিরে গিয়ে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না এক ভগবান, তাঁর উপাসনা করত! আমার ভক্তিটক্তি হত না। মাঘোৎসবের সময় যখন প্রার্থনা হত, আমি আস্তে আস্তে বেঞ্চিতে পা ঠুকতাম। কিন্তু যখনি চারদিকে চেয়ে দেখতাম গাছপালা ফুল-ফল, নদী, ঝর্ণা, পোকা, পাখি, নীল আকাশ আর তার বুকে আঁকা রূপোলী হিমালয়, আর হাতের কাছে এই আমাদের বাড়ি, মা, বাবা, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব, কি এক গভীর নিশ্চিন্ত আনন্দে মন ভরে যেত।
আজ পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে আমার মন সায় দেয় না। এসমস্ত ঘটনার সময় মেসোমশাইকে চোখে দেখিনি। আমরা যখন কলকাতায় গিয়েছিলাম, তিনি বোধহয় সেই সময়ই বিলেত যান। যতদূর মনে হয় ফিরেছিলেন ১৯১৬ সালে, আই ই এস্ হয়ে। তাঁর ফেরার আগে পর্যন্ত মাসিমারা আমাদের কাছে ছিলেন; একদিনের জন্যেও মনে হত না তাঁরা বাইরের কেউ। এরও অনেক পরে, আমার যখন ১৭ বছর বয়স, মেসোমশাই আমার অটোগ্রাফের খাতায় লিখে দিয়েছিলেন,
“গ্রামোফোনের চাকতিখানার নানান্ রেখার ফাঁকে
সুরের পাখি গুটিয়ে পাখা লুকিয়ে যেমন থাকে
তেমনি তোমার খাতার পাতার হিজিবিজি লেখায়
আমার গানের মৌন তানের সুরের লিপি ঘুমায়।
যদি সে ঘুম ভাঙতে পার, খুলে যাবে কান,
শুনতে পাবে জড়ের ফাঁকে পরমাণুর গান।”
আমি হয়তো সেই ছোট বয়সেই গাছপালায় ফুলে ফলে হাওয়ায়, নদীর জলে, আকাশে, বাতাসে, দূরের পাহাড় পর্বতে সেই পরমাণুর গান শুনবার জন্যই কান পেতে থাকতাম।
চারদিকের পাহাড়-বন-ঝর্ণার ধারে চড়িভাতি করা হত। কি যে ভালো লাগত। বলতে পারি না। একবার আমরা ‘লাইকর পীকে’ পিকনিক করতে গেলাম। অনেকটা ওপরে উঠতে হল। ঠিক আগেই ভারি একপশলা বৃষ্টি পড়ে গেছিল। তখনো সরল-গাছের ছুঁচলো পাতা বেয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছিল। লুচি, মাংস ভাগ করা হচ্ছিল। হঠাৎ চারদিকে চেয়ে দেখি আকাশটা ধোয়া-মাজা নীল ঝকঝক করছে আর তার তলায় মাইলের পর মাইল সারি সারি সাজানো ঘন সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়ের পর পাহাড়, শুধু দুটি পাহাড় ছিল, তাতে একটিও গাছ নেই। বনের মধ্যে কু-কু পাখি ডাকছিল। কোকিলের মতো মিষ্টি ডাক। শিলং থেকে চলে এসে অবধি এ-ডাক আর শুনিনি। সেদিন আরো দেখেছিলাম আগের মার্চ মাসের দাবানলে মাইলের পর মাইল ধরে যে গাছপালা ঝলসে লাল হয়ে গেছিল, তাদের ওপর আবার সবুজের ছোঁয়া লেগেছে। সেই বিশাল প্রকৃতির মধ্যে এই আমরা কটি মানুষ কি নিশ্চিন্ত নিরাপদ, এ-কথা যতবার মনে হত, মনের মধ্যে কি একটা কোমল উষ্ম ভাব জাগত, কথায় তাকে প্রকাশ করা এখন পর্যন্ত শক্ত। আর তখন তো গলা অবধি কথা এসে মুখ দিয়ে আর ঝরত না। তবু আমি ঠোঁট ফাঁক করলেই মা-মাসি ধমক দিয়ে বলতেন, “জ্যাঠামি কর না!”