পাকদণ্ডী – ১.২০

॥ ২০ ॥

ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখলাম এ গড়পার সে গড়পার নয়। এখানে হাসি নেই, কথা নেই, কাজ নেই, আনন্দ নেই। প্রেস্‌ বন্ধ; প্রেসের ঝম্‌ ঝম্‌ শব্দ বন্ধ। কে যেন মনের কানে বলে দিল এখানে আর কোনো দিন ওসব হবে না। সব নাটক, সব গান, সব হাসি-ঠাট্টা চিরকালের মতো থেমে গেছে। কেউ কোনো কথা বলল না। একতলায় কোনো মানুষ আছে মনে হল না। সিড়ির ধাপে ধাপে লোক দাঁড়িয়ে ছিল। চেনা লোক প্রায় সবাই, কিন্তু সকলকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। বসবার ঘরের শ্বেত পাথরের মেঝের ওপর আমার ঠাকুমার ছেলে-মেয়ে-বৌ নাতি নাতনি নাত-বৌ নাত-জামাইরা কাঠ হয়ে বসেছিল।

বসবার ঘরের পাশ দিয়ে বড়দার ঘরে গেলাম। বড়দা চোখ বুজে বুকের ওপর হাত দুখানি জড়ো করে, একটা নিচু খাটের ওপর শুয়ে ছিলেন। সাদা কাপড়, সাদা চাদর, সাদা ফুল। বড়দার পায়ের ওপর মুখ থুবড়ে আমার হতভাগিনী জ্যাঠাইমা পড়ে ছিলেন। বড়দার পাশে একটা মোড়ার ওপর আমার অনন্যসাধারণ বৌঠান, চোখ বুজে, দুহাত যোড় করে বসে ছিলেন আর তাঁর দু গাল বেয়ে স্রোতের মতো জল পড়ছিল। মানিককে কোথাও দেখিনি; হয়তো তাকে কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছিল। মানিকের তখন দু বছর বয়স, তার মায়ের ২৯ বছর, তার বাবার ৩৬ বছর।

দেখে দেখে দেখে দেখে চিরকালের মতো সে দৃশ্য আমার মনের ওপর আঁকা হয়ে গেল। বড়দার কোঁকড়া চুল, শীর্ণ গাল, তার ওপর কোথায় একটা বড় আঁচিল। হৃদয়ের মধ্যে কাউকে যদি গুরুর আসন দিয়ে থাকি, এই সেই মানুষ। মনে আছে কেউ চেঁচিয়ে কান্নাকাটি করেনি। জ্যাঠাইমা-ও না। ব্রাহ্মবাড়ির এই একটি দিককে আমি বড় শ্রদ্ধা করি। শোকের সময় কখনো কাউকে সংযম হারাতে দেখিনি। মনে আছে কে যেন গান গেয়েছিল। বৌঠানের আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই বড় ভালো গাইয়ে। কণক দাশ, রেণুকাদেবী, সাহানা দেবী, আরো অনেকে। তবে সেদিন কারা গান করেছিলেন মনে নেই। বড়দার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার মুহূর্তটিও মনে করতে পারি না। শুধু এটুকু মনে আছে খালি-খালি মনে হচ্ছিল সব হারিয়ে ফেললাম, কিছু বাকি রইল না।

একদিন বালিশে ঠেস্‌ দিয়ে বসে, ‘আবোলতাবোলে’র একটা ছবিতে তুলি লাগাতে লাগাতে বড়দা বলেছিলেন, “তুই-ও এসব করবি, কেমন?” আমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে শুধু মাথা দুলিয়েছিলাম। আসলে পারিনি বিশেষ কিছু করতে। ছবি সামান্যই এঁকেছি। ওঁদের মতো জোরালো হাত কই? কবিতা আমার আসে না। গল্প লিখেছি অজস্র। বড়দার গল্পের মধ্যে এক ধরনের সততা আছে, যার সামনে যা কিছু মেকি, নকল, ভণ্ডামী, সব মাথা হেঁট করে। আমার সাধ্যমতো সেই সততাটুকুকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছি। সেই সততার তলায় তলায় সরসতার স্রোত বইয়ে দিতেন বড়দা। কোথাও এতটুকু তিক্ততা, কিম্বা গ্লানি থাকতে দিতেন না। আমিও সারা জীবন সেই চেষ্টাই করেছি। মেকি জিনিস পরিহার করতে চেয়েছি। মনের মধ্যে গল্পগুলি যেমন ফুটেছে, তেমনি সাজিয়ে দিয়েছি। নকল কিছুর জায়গা রাখিনি; মাস্টারি করার চেষ্টা করিনি।

এসব হল পরের কথা। সেদিন আমার পনেরো বছর বয়স, তখনো স্কুলে পড়ি। শুধু এটুকু বুঝতে পারছিলাম বড়দা যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, সেই আমার পথ। আমাকে দিয়ে অন্য কোনো কাজ হবে না। পণ্ডিতিয়ানা তো নয়ই। বড়দার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারের জীবনধারায় অন্যরকম সুর বাজতে আরম্ভ করল। যেন আত্মপ্রত্যয় কমে গেল। এখানে বড়দার বইয়ের বিষয়ও কিছু বলতে হয়। সব চাইতে আশ্চর্য কথা হল যে বড়দা একটা ছাপাখানার মালিক, একটা নামকরা প্রকাশনালয়ের মাথা, অথচ ৩৬ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের একখানিও বই ছেপে বের করেননি। ঐয়ে আবোল-তাবোল,—যার কবিতার মতো কবিতা রবীন্দ্রনাথও লেখেননি, যার ছবির মতো ছবি অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল চিন্তাও করেননি, যার মলাটের পরিকল্পনা দুনিয়াতে কেউ আজ অবধি করেনি—ঐ একখানি বইয়েরও পরিপূর্ণ রূপটি বড়দা, দেখে যাননি। শুধুমাত্র তাঁর জীবনের শেষ সময়ে, বইয়ের ডামি কপিটি একবার হাতে নিয়েছিলেন। ৩৬ বছর বয়সে কি কারো মরা উচিত? তারি মধ্যে এদিকে ওদিকে ছড়ানো ছিল তাঁর কত রচনা, কত ছবি আমার ৩৬ বছর বয়সে আমি তাঁর সিকির সিকি কাজও করে উঠিনি। বড়দার সব বই বহুকাল পরে মানিকের আর সিগ্‌নেট প্রেসের যুগ্ম চেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছিল।

এই তিনটি মানুষ; প্রথমে উপেন্দ্রকিশোর, তারপর সুকুমার, তারপর সত্যজিৎ, বাংলার শিশু-সাহিত্যের সাবালক-প্রাপ্তির জন্য যা করেছেন, সেটা অবধানযোগ্য। ছোটদের জন্য বই লিখলেই শিশুসাহিত্যিক হওয়া যায় না। শুধু তথ্যমূলক পাঠ্যপুস্তক লিখে গেলে তো নয়ই। ছোটদের বিষয়ে গল্প লিখলেও সব সময় শিশু-সাহিত্যিক হওয়া যায় না। ব্যাপারটা আরো গভীরে নামে। এখানে রবীন্দ্রনাথের নাম করতে হয়। তিনি জ্যাঠামশায়ের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন, দুজনার একই ধরনের আদর্শ ছিল। বড়দাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মনে আছে বড়দার শেষ অসুখের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। বলেছিলেন, “তোমার জন্য আমি কি করতে পারি?” বড়দা গান শুনতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গান গেয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় আমি সেখানে ছিলাম না।

রবীন্দ্রনাথ ছোটদের জন্য যা কিছু লিখেছেন, চমৎকার হলেও, আমি তার মধ্যে কিঞ্চিৎ আড়ষ্টতা দেখতে পাই। যেখানে বড়দের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হচ্ছে, সেখানেও বিদ্রোহটা মায়ের কাছে প্রকাশ করা, কাজেই তার বেপরোয়া ভাবটা নিছক ছেলেমানুষীতে দাঁড়ায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ খোকামি সইতে পারতেন না। ছোটদের জন্য তাঁর সব লেখাতেই দুটি জিনিস লক্ষ্যও করি। তিনি চাইতেন ছোটরা বিশ্ব-প্রকৃতির সব রস উপভোগ করুক এবং বলিষ্ঠভাবে বড় হতে শিখুক। এর মধ্যেই গুরুগিরির হাওয়া আছে। শিশু-সাহিত্যে গুরুগিরির স্থান নেই, এমনকি গুরুরও স্থান নেই। অথচ বিশ্বপ্রকৃতির সব রস উপভোগ করে বড় হতে পারার কথা আছে। যেমন করে সকলের অগোচরে ছোট ছেলের শরীরটিও বাড়ে।

উপেন্দ্রকিশোরের লেখার মধ্যে এই সহজ কথাটা বারে বারে প্রকাশ পাচ্ছে। এমন যে চমৎকার সৃষ্টি, একে ছোটদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এমন যে উপভোগ্য জীবন, এর মজা বুঝতে পারলে আপনা থেকেই একে শ্রদ্ধা করা যাবে। উপেন্দ্রকিশোরের আগে পর্যন্ত বাংলায় সামান্য যে শিশু-সাহিত্য রচিত হয়েছিল, তার মধ্যে শিক্ষা দেবার দিকটাতেই গুরুত্ব দেওয়া হত। আর তার প্রায় সবই ইংরিজি বই থেকে নেওয়া হত। তাও অনেক সময় নাম-ধাম বদলে, মূল বইটার রস সব নষ্ট করে দিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রসকেই শ্রেষ্ঠ আসন দিতেন। কিন্তু তাঁর লেখা গল্পগুলির মধ্যে খুব অল্পই মৌলিক গল্প। সন্দেশে প্রকাশিত তাঁর গল্প-সল্প ছাড়া। সেগুলি একেবারে মৌলিক এবং প্রাণরসে ভরপূর। ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতি-কথা, তথ্যমূলক রচনা সবই নিজে তৈরি করে লিখতেন। গল্পের বেলা কেন লিখতেন না জানি না। যে কোনো দেশের বলিষ্ঠ সাহিত্য মৌলিক হয়; ছোটদের জন্য রচনাও।

সেই মৌলিকত্ব সুকুমারের মধ্যে অপূর্ব খেয়াল রসে ভরতি হয়ে উপচে পড়ত। বড়দা প্রায় সব গল্প নিজে বানিয়ে লিখতেন। ক্কচিৎ দু-তিনটি প্রচলিত রসের গল্প লিখেছেন। ঐ সরসতা আর স্বকীয়তা দিয়ে বড়দা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেই বাংলার শিশু-সাহিত্যকে সাবালকত্ব দিয়ে গেছেন। যতদিন লেখকরা অন্যদের বই থেকে ভুরিভুরি সামগ্রী ধার করে আনতে থাকেন, ততদিন বুঝতে হবে তাঁদের নিজেদের দেবার মতো কিছু নেই। অর্থাৎ তাঁদের দেশের সাহিত্য তখনো দানা বাঁধেনি। দানা না বাঁধা মানেই রস তখনো কাঁচা, পাতলা পান্‌সে‌। সুকুমার সেই পাতলা রসে দানা বাঁধিয়ে দিলেন।

তখন আমার পনেরো বছর বয়স। হাজার উচ্চাশা থাকলেও, ক্ষমতা ছিল কাঁচা। তবে এটুকু বুঝতাম বাংলা শিশু-সাহিত্যের জন্য কিছু করতে হলে, শুধু পুরনো রচনার নির্ঘণ্ট দিলে হবে না, কিছু সৃষ্টির কাজ করতে হবে। তার পর ৫৪ বছর কেটে গেছে, আমাদেরও সন্ধ্যা নেমেছে, তবু দেখছি সৃষ্টির কাজের শেষ নেই। কে একজন চিন্তাশীল মনীষী বলেছিলেন, ‘দুনিয়াতে নতুন চিন্তা বলে কিছু নেই। সব কথাই কোনো না কোনো সময়ে, কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ, একবার না একবার বলে গেছেন।’ সেইগুলিই হয়তো আমাদের মূলধন। কিছু অনুবাদ করেছি, কিছু জীবন-কথা ভ্রমণ-কথা সংক্ষেপে ছোটদের জন্য লিখে দিয়েছি। তার কিছুই আমার নিজের বলে প্রকাশ করিনি। মূল্যবান জিনিস যদি পাঠকদের চোখ এড়িয়ে যায়, তাই তুলে ধরেছি। বড়দের বই যে অনুবাদ করেছি, সেও ঐ একই কারণে; নয়তো নিছক বাস্তব উদ্দেশ্যে। তাও বই পছন্দ না হলে নয়।

সত্যজিৎ আমার চাইতে তেরো বছরের ছোট। কর্মবহুল জীবনের মধ্যেও বাগ্‌দেবীর তাড়ায় না লিখে পারে না। সব মৌলিক, অভিনব, চমক্‌ময়। অতিশয় উত্তেজনাময় কাহিনীর তলায় তলায় সরসতার নদী বয়ে যায়। এমন গল্প এর আগে বাংলায় লেখা হয়নি, যদিও দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প ভালো ভালো আছে। এ-সব হল দুঃসাহসিক চিন্তার গল্প। এসব গল্পের বৈশিষ্ট্য হল যে পাঠকবর্গের যে একটা বৃহৎ অংশের যোগ্য বই বাংলায় বিশেষ লেখা হয় না—অর্থাৎ মোটামুটি ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়স্কদের কথা বলা হচ্ছে—মানিক তাদের অভাব ঘুচিয়ে দিচ্ছে। এবং যোগ্যভাবেই দিচ্ছে। যেমনি গল্পের রোমাঞ্চ, তেমনি ভাব, তেমনি ভাষা, রুচিও কোথাও এতটুকু ক্ষুন্ন হয় না। গুরুজনদের আপত্তিরও কোনো অবকাশ থাকে না। যে দেশেরই সাহিত্য পরিণতি লাভ করেছে, সেখানেই এই ধরনের বই দেখা দিয়েছে। গত কয় বছরের মধ্যে বাংলায় বেশ কটি তথ্যমূলক কিম্বা একেবারে কাল্পনিক দুঃসাহসিক অভিযান ও অভিজ্ঞতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি হল ছোটদের সাহিত্যের শেষ অধ্যায়। সুখের বিষয় মানিকের ভক্ত লেখকদের একটা বড় দল ক্রমে তৈরি হয়ে উঠছে। তারা যদি সত্যজিতের গল্পের উচ্চমান রক্ষা করতে পারে, বাংলা কিশোর-সাহিত্যের সুদিন তাহলে এসে গেল।

আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য হল এইটুকু প্রকাশ করা যে বড়দা উত্তরাধিকার স্বরূপ বাপের কাছ থেকে যে প্রতিভা লাভ করেছিলেন, ৩৬ বছরের জীবনে তাতে এমনি প্রাণশক্তির প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন যে আজ পর্যন্ত তার কাজ অদম্য গতিতে চলেছে। এ বিষয়ে সত্যজিতের অবদান নেহাৎ কম নয়।

তবে মাঝখানে মস্ত একটা মরুভূমি। তখন সেটা তত লক্ষ্য করিনি। নিজে সাবালিকা হবার কাজে বড় বেশি ব্যস্ত ছিলাম। ১৯২৩-২৪ সালের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। দেশে তখন স্বাধীনতা সংগ্রাম ক্রমে বল পাচ্ছিল। তার মানে নয় শুধু বোমা বারুদ বিস্ফোরণ পিকেটিং ও কারাবরণ। সেসব তো ছিলই। তাছাড়াও ভিতরে ভিতরে দেশটাকে যে একটা বড় কিছুর জন্য তৈরি হতে হবে এবং হচ্ছেও, এ কথা আমি বিশ্বাস করতাম।

কতকগুলো মুশ্‌কিলও ছিল। বাবা সরকারি চাকরে। পরীক্ষা দিয়ে নিজ গুণে সার্ভে অফ ইণ্ডিয়াতে ঢুকে, ক্রমে ক্রমে প্রভিন্‌সিয়াল সার্ভিস থেকে ইম্‌পিরিয়েল সার্ভিসে উন্নত হয়েছিলেন। সেটা তত লজ্জার বিষয় ছিল না—অক্ষমতাতে বাহাদুরি কোথায়?—যতটা ছিল বাবার প্রথমে রায়-সাহেব, পরে রায়-বাহাদুর উপাধি লাভে। আমরা সবাই জানতাম বাবা কোনো দিন কারো খোশামুদি করেননি, কারো বাড়ি গিয়ে বসে থাকেননি; বরং কখনো যদি বাধ্য হয়ে কোনো সভা বা পার্টিতে যেতে হয়েছে বেজায় বিরক্ত হয়ে, হাঁড়িমুখ করে গেছেন। উপাধি পেয়েছেন স্রেফ্‌ ভালো কাজ করার জন্য। অবিশ্বাসীরা যাই বলুক, তখনো মাঝে মাঝে যোগ্য ব্যক্তিরা শিরোপা পেত। এখনো পায়। তবে সবাই পায় না। এবং তখনো যেমন, এখনো তেমন অযোগ্যরাও অনেকে পায়। কোনটা যে বেশি খারাপ তা জানি না।

যাইহোক উপাধিগুলোর ওপর বাবা হাড়ে চটা ছিলেন। নিজে কখনো ব্যবহার করতেন না, আর কেউ করলে বিরক্ত হতেন। আসলে আমাদের দেশভক্ত বন্ধু-বান্ধবরা ঐ উপাধির কথা জানতে পারেনি। তাইতে আমরা বেঁচে গেছিলাম। কিন্তু বাবা কেন সরকারি চাকরি ছাড়ছেন না, তাই নিয়ে গঞ্জনা দিতে ছাড়ত না। মার কাছে একবার কথাটা পাড়লে, মা সোজাসুজি বললেন, “এতো কোনো বিশ্বাসঘাতকতার কাজ নয়। তাছাড়া বাবা কাজ ছাড়লে কি তোরা আর তোদের দেশপ্রেমিক বন্ধুরা আমাদের সংসার চালাবি?” এমন অকাট্য যুক্তির কোনো উত্তর হয় না বলে রণেভঙ্গ দিতে হল।

তখন কেউ বিদেশী কাপড় পরত না। শহরের নানা জায়গায় যে যার দামী দামী বিদেশী কাপড়-চোপড় এনে স্তূপাকার করে রেখে তাতে আগুন ধরিয়ে দিত। মা একবার বলেছিলেন, “শীতে কাঁপছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা গরীব মানুষ। পুড়িয়ে না ফেলে ঐ গরম জামাগুলো ওদের দিয়ে দিলে হত না?” আমরা তখন জোর গলায় বলেছিলাম, “না, মা, হত না। দেশ-প্রেমের জন্য সব্বাইকে কষ্ট করতে হবে।” এখন ভাবি মা মন্দ কথা বলেননি। এদিকে বাবা নিউ মার্কেট থেকে আমাদের জন্য চমৎকার সব ভয়লের কাপড় কিনে আনতেন। নিজেরা জামা করতাম। তখন খুব ভালো দিশী সুতির কাপড় পাওয়া যেত না, যদিও গরম কাপড় আর রেশমী কাপড় তৈরি হত। আমরা বঙ্গলক্ষ্মীর মোটা মোটা শাড়ি পরে স্কুলে যেতাম। ৪৬ ইঞ্চি বহর, ১০ হাত। আমার খুব আরাম হত; কিন্তু দিদি আর মা আমার চাইতে ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা, ওদের খাটো হত। সুখের বিষয় টাকা পাঁচেক দিয়ে চমৎকার ৪৮ ইঞ্চি বহরের ১১ হাত তাঁতের কাপড় পাওয়া যেত। সত্যি কথা বলতে কি শাড়ি নিয়ে কোনো কষ্ট ছিল না। কিন্তু দিশী মিল্‌ সবে চালু হয়েছে; জামার কাপড় বানায় খড়খড়ে, মোটা। আমরা খদ্দরের জামা পরা ধরলাম। খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনে আনতাম। আর কখনো বিলিতী কাপড়-জামা পরিনি। পরে সুন্দর ভয়ল্‌ও এদেশে তৈরি হত। এখনো “ফরেন” কাপড় গায়ে তুলতে পারি না।

আমার বন্ধু মীরা দত্তগুপ্তা আমাকে একটা তক্‌লি আর এক পুঁট্‌লি তৈরি-করা তুলো দিয়ে বলল, “গান্ধীজি বলেছেন এই দিয়ে সুতো কেটে, ঘরে ঘরে তাঁতে বুনে নিলে, দেশে কারো কাপড়ের কষ্ট থাকবে না।” কতকটা মীরার অকাট্য যুক্তি শুনে আর কতকটা ওকে বেজায় ভালোবাসতাম বলে, তক্‌লিটা নিয়ে সুতো কাটা অভ্যাস করতে লাগলাম। অবশ্য বাবাকে লুকিয়ে। এবিষয়ে তাঁর খুব সহানুভূতি ছিল না। বলতেন, “শখের কথা আলাদা। কিন্তু মিল্‌ না চললে দেশের আর্থিক উন্নতি হবে না।” সে যাইহোক, বেশ সুন্দর দেখতে হত আমার সুতোগুলো। শেষটা অনেক সুতো জমে গেল।

তখন মীরাকে বললাম, “এখন কি করা হবে? তাঁত বসাবার জায়গা আমাদের বাড়িতে নেই। তাঁত কিনবার টাকাও নেই আমার। তাঁত চালাতে জানিও না।” মীরা বলল, “ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।” নাকি খাদি প্রতিষ্ঠান না কোথায় ওঁরা কাপড় বুনে দিতেন। ওকে সুতোগুলো দিয়ে আশায় আশায় রইলাম। কবে আমার নিজের হাতে কাটা সূতির জামা গায়ে দেব। এমন সময় একদিন হাঁড়িমুখ করে মীরা এসে বলল, “এই নে তোর সুতো। আমাদের কারো সুতো ওঁরা নিলেন না। নাকি যথেষ্ট পাক দিই না; তাঁতে চড়ালেই ছিঁড়ে যাবে।” শুনে আমি অবাক হলাম। ওর বেশি পাক দেব কি! আর পাক দিলে যে সবটাই গুট্‌লি পাকিয়ে যায়! রইল আমার তক্‌লি কাটা! ঐ তক্‌লিটা বছর পাঁচেক আগেও আমার কাছে যত্ন করে রাখা ছিল। তারপর যে কোথায় গেল বলতে পারছি না।

মীরা আমাকে স্বাধীনতা-সংগ্রামী করে তোলার জন্য কম চেষ্টা করেনি। কবে ঠিক মনে নেই, হয় ঐ সময়, নয় ২-১ বছর পরেও হতে পারে, ভবানীপুরে ওদের কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে মহিলাদের লাঠি-খেলা ও অসি-শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। কাঠি-ফড়িং-এর মতো চেহারা ছিল দুজনার। যেমনি বেঁটে, তেমনি রোগা। ও আমার চেয়েও বেশি। তাতে কি হয়েছে? আমরা আরো উৎসাহী সদস্যা জুটিয়ে মহা আগ্রহের সঙ্গে বিকেলে গিয়ে ‘শির-মুড়া, দাড়ি-মুড়া’ ইত্যাদি করতাম। ভারি ভদ্র ও আদর্শবাদী মাস্টারও জোগাড় করেছিল মীরা। বলা বাহুল্য এ-সবের জন্য কেউ একটা পয়সা নিত না। গরীব হলেও না। আদর্শবাদের যুগ সেটা। দুষ্টুলোক ছিল নিশ্চয়, কিন্তু বাবা আমাদের এমনি কড়া পাহারায় রাখতেন যে তাদের অস্তিত্ব তেমন টের পেতাম না। খালি আমাদের কলেজ বিভাগের একজন মেয়ের দাদা সাইকেল করে রোজ দিদির আর আমার পেছন পেছন স্কুল থেকে বাড়ি অবধি আসত। কিচ্ছু বলত-টলত না। ওর মা-বোনরা আমাদের চেনা ছিলেন। আমরা ভাবতাম ঐরকম পাজির পা-ঝাড়া কেউ নেই। একবার ভালো করে শিরমুড়া দাড়িমুড়াটা রপ্ত হলেই একদিন দেখে নেব! সে সুযোগ আর আসেনি। লাঠি লাগানোর মধ্যে ভালোমানুষ মাস্টারটির ঠ্যাঙে একদিন এমনি বাড়ি মেরে দিলাম যে দুদিন ধরে বেচারি খোঁড়াল। তবে এখনো মনে হয় ঠ্যাংটা তার সময়মতো সরিয়ে নেওয়া উচিত ছিল, নইলে ও আবার কেমনধারা মাস্টার!

॥ ২১ ॥

ঐ বছর পুজোর সময় আমরা দেওঘরে গেছিলাম। মায়ের শরীর খুব ভালো যাচ্ছিল না। প্রফুল্লকাকাবাবুর কোনো আত্মীয়ের বাড়ি, রেলের গুমটির ওপরেই। সারা বছর খালি পড়ে থাকত। একটা দেখাশোনা করার লোকও ছিল না। পাশের বাড়ির পুলিস অফিসারের কাছে চাবি থাকত। বড় ভালো লোক। আমাদের খুব দেখাশুনা করতেন আর থেকে থেকেই জিজ্ঞাসা করতেন রাতে কেউ জ্বালাতন করেছে কি না। বৈদ্যনাথের এক পাণ্ডাও আমাদের তার পাখনার তলায় নিয়ে নিল। তার পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা মন্দির তপোবন ইত্যাদি নানা দ্রষ্টব্য স্থান দেখলাম। তাছাড়া বৈদ্যনাথের শ্রেষ্ঠ প্যাড়ার দোকান সেই আমাদের চিনিয়ে দিল। ফরসা শুটকো মিচকে চেহারা। কিন্তু উপকার করত সন্দেহ নেই।

দলটি আমাদের খুব ছোট ছিল না। জসিডি অবধি একটা গোটা থার্ড ক্লাস্‌ হাফ-কামরা রিজার্ভ করে গেছিলাম। তাতেও কিছু সীট বাকি থাকছে শুনে আত্মীয়স্বজনরা কেউ কেউ ঝুলে পড়ল। সুন্দর জ্যাঠার বড় মেয়ে প্রীতিলতা। আমাদের খুতিদি। তার বেশ লিখবার হাত ছিল। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে সিলেটে চলে যাওয়াতে, সে-প্রতিভা ফুটবার সুযোগ পায়নি। খুতিদির দুই ভাই, হৈমদা আর নীরজাদা। এরা খেলার মাঠে বিখ্যাত ছিল। দুজনেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। একজন শিবপুরে, একজন বেনারসে। বড়জ্যাঠার বড়ছেলের বড়ছেলে নরেশ। আমার চাইতে বছর তিন-চারের ছোট। ভারি মিষ্টি স্বভাব এবং তার চেয়েও মিষ্টি গানের গলা। তবে পরে শুনেছিলাম কোনো মেয়ে গাইছে মনে করে নাকি স্থানীয় যুবকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ছোট জ্যাঠার দুই মেয়ে তুতুদি, বুলুদিও ছিল। নরেশ ছাড়া এরা সকলেই আমাদের চেয়ে ৫-৭-১০ বছরের বড়। তবু খুব জমত। আরো কয়েক বছর আগে এই নীরজাদাই আমাদের কাছে অম্লানবদনে রবীন্দ্রনাথের লেখা ভূতের ও রোমাঞ্চের গল্প নিজের অভিজ্ঞতা বলে চালাত। এবার অবিশ্যি সে সম্ভাবনা ছিল না। আমরা বড় বেশি চালাক হয়ে গেছিলাম।

বাড়িতে এত লোক যে প্রায় সব ঘরেই শোবার ব্যবস্থা করতে হত। বাড়ির সব চাইতে ভালো ঘরটির তিন দিক খোলা, হু-হু করে হাওয়া দিত। কোনো ঘরেই বড় বড় তক্তাপোষ ছাড়া কোনো আসবাব ছিল না। আর ছিল প্রচুর দেয়াল আলমারি। এই ঘরটিতে মেয়েদের শুতে দেওয়া হয়েছিল। তার মানে তুতুদি, বুলুদি, দিদি, আমি। সারা রাত আর ঘুমুতে পারি না। কেমন একটা অস্বস্তি। থেকে থেকেই ঘুম ভেঙে যায়। চারজনেরি। দু-রাত এ-রকম হবার পর মা বললেন, “থাক গে, ওটাকে খাবার ঘর করে, এদিকের ছোট ঘরে তোরা শো।” তাই করা হল। উত্তরের ঘর, অনেক ছোট, তবু সারা দিন খোলা বাতাসে দূরে দূরে বেড়িয়ে, খুব ঘুমোতাম।

এই সময় হৈমদা, নীরজাদা এসে পড়াতে আবার জায়গার অভাব ঘটল। ওরা বলল, “আমরা ঐ খাবার ঘরটাতেই শোব। বারে বারে ঘুম ভেঙে যায় আবার কি? আমাদের ভাঙবে না। এই বলে ওরা ঐ ঘরে শুল। বলা বাহুল্য সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। দু দিন চেষ্টার পর, ভিতরের বন্ধ দালানে ছেলেদের জন্য ঢালা বিছানা পাতা হত। সবাই আরামে ঘুমোত।

এমন সময় আমাদের প্রতিবেশী কলকাতার বিখ্যাত হার্ট স্পেশ্যালিস্ট ডাঃ এস এন রায়ের স্ত্রী একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, তোমরা কি ঐ বাড়িতে খুব শান্তিতে আছ?” মা বললেন, “কেন বলতো?” “ও-বাড়িতে তো কেউ থাকতে পারে না। ওটা নাকি ভূতের বাড়ি। পূর্ব-দক্ষিণের বড় ঘরে একজন দুঃখিনী মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল।” আমরা বললাম, “ও-ঘরে কেউ শোয় না। আমরা তো বেশ ভালোই আছি।” এটাই আমার জীবনের একমাত্র প্রত্যক্ষ ভূতের কাহিনী। তবে ঐ সময় থেকেই ভৌতিক ব্যাপার সম্বন্ধে আমার মনটা কেমন স্পর্শকাতর হয়ে আছে। কত যে ভূতের গল্প লিখেছি তার ঠিক নেই। কিন্তু দেখিনি কিছু, ভয়ও পাইনি কেউ।

১৯২৩ সালে দিদি ম্যাট্রিক পাস করে ডায়োসেসান কলেজেই পড়ছিল। খুব ভালো কলেজ ছিল, চমৎকার একটা লাইব্রেরি ছিল। সে যাই হক, কলেজের নিয়ম ছিল সবাইকে খোঁপা বেঁধে যেতে হবে। দিদির চক্ষু স্থির। খোঁপা বাঁধতে কে শেখাবে? মা মাসি তো চুল টেনে বেণী বেঁধে, বেণী পাকিয়ে খুদে এক খোঁপা তৈরি করেই সন্তুষ্ট থাকতেন। সে-সবের চল উঠে গেছিল। কাজেই তুতুদি বুলুদির স্মরণ নিতে হল। ওরা এবং ওদের সব বন্ধুরা প্রায় মাথার সমান বড় বড় খোঁপা বাঁধত। খোঁপাগুলো ফোঁপরা হত, কারণ অনেকেরি মাথায় খুব বেশি চুল ছিল না। কিন্তু তাতেই নাকি ভালো খোঁপা বাঁধার সুবিধা। আমরা তো ওদের কাছে খোঁপা বাঁধা শিখতে বসলাম। সে কথাই বলি।

প্রথমে সব চুলগুলো আঁচড়ে পেছনে নিয়ে, একটা কালো ফিতে দিয়ে শক্ত করে গোড়া বাঁধা হত। তারপর সামনেটা চিরুণী দিয়ে ঠিক করা হত। এ কাজটি ভালো করে করতে হত; পরে চিরুণী লাগাতে গেলে সবসুদ্ধ ধ্বসে পড়বার ভয় ছিল। পেছনের চুল এবার তিন ভাগ করে, মধ্যের ভাগটাকে জড়িয়ে তুলে বেশ কয়েকটা কালো লোহার কাঁটা দিয়ে শক্ত করে আটকাতে হত। তারপর তার চারদিকে দু দিকের দুটি ভাগকে জড়িয়ে হেয়ার পিন দিয়ে যথাস্থানে এঁটে দিতে হত। বুলুদির নাকি ২১-২২ টার কম কাঁটাতে চলত না। কিন্তু দেখতে হত চমৎকার! আমরাও খুব চেষ্টা করতাম। কাজটা খুব সহজ ছিল না। অনেক সময় সব করে-টরে, সেজেগুজে কোথায় বেরুব, ঠিক সেই মুহূর্তে নাকের ডগায় একটা মাছি বসল। সেটাকে তাড়াবার জন্য যেই না একটু মুণ্ডু নেড়েছি, ব্যস সবসুদ্ধ ধ্বসে গেল! চারদিকে হেয়ার-পিনের বৃষ্টি! কোনো ভালো জিনিস কি আর সহজে হয়। আমি ৬ বছর ঐ রকম খোঁপা বাঁধার পর, শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখলাম আমার স্কুলের বন্ধু অণুকণা দিব্যি সুন্দর গোড়া না বেঁধে, হাতে জড়িয়ে খোঁপা করে, তার মধ্যিখানের ফাঁশটি টেনে বের করে আনে। অমনি দেড় মিনিটে চমৎকার এক অজন্তা প্যাটার্নের খোঁপা হয়ে যায়। তাতে দুটি বড় সেলুলয়েডের কিম্বা একটি রূপোর বড় কাঁটা গুঁজে রাখলে সারা দিনে আর খুলে পড়ে না। এই খোঁপাই আমি আজ পর্যন্ত বাঁধি। কেউ শিখতে চাইলে শিখিয়েও দিতে পারি। কাঁটা না দিলেও চলে।

পুজোর শেষে ফিরে এলাম কলকাতায়। কোথাও যেতে যেমনি ভালো লাগত, ফিরে আসতেও তার সমান ভালো লাগত। গড়পারের বাড়ির আবহাওয়া চোখের সামনে বদলে যেতে লাগল। নতুন বাড়ি, যে বাড়িতে কেউ বাস করেনি, শূন্য হলেও একেবারেই ফাঁকা হয় না, কারণ সেবাড়ি হয় সম্ভাবনায় ভরা। কিন্তু যে-বাড়ি থেকে সব চাইতে প্রিয় মানুষটি চলে গেছে, সেই বাড়ি হয় ফাঁকা। তার প্রাণ চলে যায়। যদি না আর কেউ প্রাণ দিতে পারে। গড়পারের বাড়ি তৈরি হবার পর মাত্র আট-নয় বছর কেটেছিল। এরি মধ্যে ঘরে ঘরে ‘ছাড়ি-ছাড়ি’ হাওয়া।

ও-বাড়ি ছাড়তেই হল। ব্যবসা রাখা গেল না। কত আশা করে বিলেত থেকে যন্ত্রপাতি আনিয়ে জ্যাঠামশাই ছাপাখানা করেছিলেন। তার কি সুনাম। সারা ভারত থেকে ইউ রায় এণ্ড সন্সে হাফ-টোন ব্লকে ছবি ছেপে দেবার ফরমায়েস আসত। আর কি সব ছবি! তার ফেলে দেওয়া রঙীন প্রুফ আমরা তুলে এনে যত্ন করে রাখতাম। কিন্তু ব্যবসা পোক্ত হবার সময় রইল না। জ্যাঠামশাই ৫২ বছরে, বড়দা ৩৬ বছরে চলে গেলেন। মণিদার ঘাড়ে সব পড়ল। তার বয়স হয়তো ৩২। ছোট ভাই সুবিমল এ-সব কাজের দিকও কখনো মাড়ায়নি। কি করে যে কি হয়ে গেল এখনো বুঝতে পারি না। শুনেছি ধার ছিল মাত্র ১ ১/২ লাখ আর নানা জায়গা থেকে পাওনা ছিল ২ লাখ। তবু কেন ব্যবসা উঠে গেল ভেবে পাই না। কোনো একটা ব্যাঙ্ক কি অন্য প্রতিষ্ঠান কি সর্বনাশ ঠেকাতে পারত না। মোট কথা পাওনাদাররা ছিল পেশাদার মহাজন, তারা একজোট হয়ে নালিশ করেছিল। ব্যবসা, গুড-উইল, বাড়ি ঘর সব নিলাম হয়ে গেছিল। কপর্দকশূন্য অবস্থায়, আমার দেবতুল্য জ্যাঠামশাইয়ের, যাঁর বাড়িতে কত অনাথ অভাজন আশ্রয় পেয়েছিল, সেই জ্যাঠামশায়ের দুঃখিনী বিধবা আর দিক্‌-ভ্রান্ত সন্তানরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিল। তবে এ সব ঘটতে সময় লেগেছিল দুই বছরের বেশি।

তার মধ্যে স্নেহের নীড় ভেঙে ফেলার বিষম ক্লেশ। কোর্ট থেকে বলেছিল বৌদের স্ত্রীধন ছাড়া আর সব জিনিসের নির্ভুল তালিকা তৈরি করে কোর্টের হাতে তুলে দিয়ে যেতে হবে। সে এক বেদনাময় অধ্যায়। তার হাল্‌কা দিকটাও ছিল। যারা চিরকাল রস বিলিয়ে এসেছে, তারা তালিকা করতেও রস পরিবেশন না করে পারেনি। মজার মজার বর্ণনা ছিল ঐ তালিকায়। কেউ পড়েছিল কি না জানি না। নিলেমে বাড়ি কিনেছিল পাশের বাড়ির ছেলেদের স্কুল। ব্যবসা কিনেছিলেন একদা ইউ রায় এণ্ড সন্সের সঙ্গে সংযুক্ত দুই ভাই, শ্ৰীকরুণাবিন্দু বিশ্বাস ও শ্রীসুধাবিন্দু বিশ্বাস। আরো খোদ্দের থাকতে পারে, আমি সবিশেষ জানি না।

আমার ছোট জ্যাঠামশাই কুলদারঞ্জন তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে ঐ বাড়িতেই বাস করেছিলেন। তাঁর নিজস্ব আসবাবপত্রে নাম লেখা ছিল না বা অধিকার প্রমাণ করা কোনো দলিল ছিল না বলে, সেগুলিও তালিকাভুক্ত হয়ে নিলেম হয়ে গেছিল। উপেন্দ্রকিশোরের পাণ্ডুলিপি, ‘সন্দেশ’ পত্রিকার স্বত্বাধিকার, প্রেস, প্রকাশনী, সব গেছিল। কেবল সুকুমারের উত্তরাধিকারী, সত্যজিতের তখন দু বছর বয়স ছিল বলে, নাবালকের সম্পত্তি বলে তাঁর কাগজপত্রে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।

সব কথা মনে করতে পারি না। ঐ দুটি দুঃখময় বছরের কথা সব জানিও না। তবে পুরনো চাকররা-এ বাড়িতে কাজ করে করে বুড়ো হয়ে গেছিল, তারা কেউ যেতে চাইছিল না মনে আছে। বলছিল কোথায় যাবে আজীবনের আশ্রয় ছেড়ে।

বড়দার মৃত্যু আর বাড়ি নিলেম হবার মাঝখানে ছিল ১৯২৪ সাল। তখনো সকলে গড়পারেই ছিল। শেষ একটি আনন্দোৎসবও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐ বাড়িতে। হয়তো খুব আনন্দের ব্যাপার হয়নি, কিন্তু বিয়ে বাড়ির নিজস্ব এক রকম মহিমা আছে, তাকে অস্বীকার করা যায় না। যতদূর মনে হচ্ছে বৈশাখ মাসে ছোট জ্যাঠামশায়ের ছোট মেয়ের আগে বিয়ে হল।

আমি সেবার ম্যাট্রিকুলেশন দিলাম। ডায়োসেসান স্কুলেই সীট পড়ত আমাদের। তখন পরীক্ষার হলে টোকাটুকির কথা শোনাই যেত না। এক-আধজন বে-পরোয়া অপরাধী দেখা গেলে, তাকে তখুনি ঘর থেকে বের করে দেওয়া হত। পরীক্ষার আগের তিন মাস পরীক্ষার্থিনীদের সে যে কি যত্নে তৈরি করা হত, এখনো মনে করে চিত্ত কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। সে অন্য রকম তৈরি করা। এখন দেখি ভালো ছাত্ররা যাতে বিদ্যালয়ের খ্যাতি বাড়ায়, তাই তাদের বেশি করে যত্ন নেওয়া হয় আর দুর্বল ছাত্রদের এক বছর আগে থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। আমাদের সময় এর ঠিক উল্টোটি হত। ভালোদের সাহায্য করতে শিক্ষিকারা তো সর্বদাই প্রস্তুত থাকতেন, কিন্তু শেষের ঐ তিনটি মাস ধরে যে ছাত্রী যে বিষয়ে কিঞ্চিৎ দুর্বল, তাকে সেই বিষয়ে তাঁরা আপ্রাণ তালিম দিয়ে যেতেন। শুধু যারা তিনটে চারটে বিষয়ে এত কাঁচা যে পাস করবার কোনো সম্ভাবনাই থাকত না, তাদের সে বছর পাঠানো হত না। কাজেই সকলেই ঐ তিনটি মাস খুব খাটত ।

আমি নিজে আগের মতো বাংলায় কাঁচা না থাকলেও, ঐখানেই আমার সব চাইতে দুর্বলতা। সুখের বিষয় খাঁটি ব্যাকরণের প্রশ্নে খুব কম নম্বর থাকত। বাক্য রচনা, ভ্ৰম-সংশোধন, ব্যাখ্যা করা, ইত্যাদি বুদ্ধি করে চালিয়ে দিতে পারতাম। অনুবাদ আর রচনায় আমাকে পায় কে! কিন্তু যতই নিজেকে প্রবোধ দিই না কেন, বাংলায় আমি একটু কাঁচাই ছিলাম। যেখানে যত বাংলা বই পেতাম, সব পড়তাম। কি ভালো ভালো মাসিক পত্রিকা বেরুত: প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী ইত্যাদি। সব পড়তাম। রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু লেখা ধারাবাহিকভাবে বেরুত। ‘শেষের কবিতা’ বোধ হচ্ছে ‘বিচিত্রা’য় বেরিয়েছিল; কোন সালে ঠিক মনে নেই। প্রথম প্রথম রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত ছিলাম। তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে বিচার-বুদ্ধি লোপ পেত।

কিন্তু ঐ স্কুলের শেষ বছরটাতে মনটা কেমন খুৎ-খুঁৎ করত। মনে হত রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলিতে কি একটা যেন বাদ পড়ে যায়। তখন তারাশঙ্করের নাম কেউ শোনেনি, কিন্তু শরৎবাবুর অনেক ভক্ত। আমাদের বাড়িতে শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে বড়রা খুব উৎসাহী না হলেও, তাঁর সব উপন্যাস আমাদের কিনে দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে আমার মা-বাবা ভারি উদার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কোনো নাম করা সাহিত্যিককে তখনো চোখে দেখেছি বলে মনে হয় না। এখনো ভাবি চোখে দেখার কি খুব গুরুত্ব আছে? দুচার দিন মিশবার সুযোগ পেলে হয়তো ব্যক্তিগত তথ্য কিছু জানা যেতে পারে। কিন্তু তারই বা কতখানি মূল্য? কত সময় যার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, তাকে কাছে থেকে দেখে হতাশ হয়েছি। ঐ যে কথাটা বারে বারে বলি, বারে বারে তার সমর্থন পেয়েছি। সৃজনের কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সৃষ্টিকর্মের দিক আর ব্যক্তিগত জীবনের দিক একেবারে আলাদা। কোথা থেকে, হৃদয়ের গভীরের কোন নিভৃত গোপন স্বর্গ থেকে সৃষ্টির মন্ত্রটি পান তাঁরা, তার সঙ্গে মলিন জগতের কোনো সম্পর্ক নেই, যতই ব্যথা, যতই প্রেম থাক না কেন। বড়দার মৃত্যুর পর সন্দেশ আর বেশি দিন চলেনি। সন্দেশ বন্ধ হয়ে গেলে, আর কোথাও লিখবার কথা মনেও স্থান দিইনি। তাছাড়া আরেকটা কথাও ছিল। ১৯২২ সালে ঐ একটি গল্প প্রকাশিত হবার সময়ই বুঝেছিলাম আমাকে আরো প্রস্তুত হতে হবে। খাতায়, কাগজের কুচিতে অজস্র লিখতাম। ছোট ভাইবোনকে ছবি এঁকে এঁকে রাশি রাশি গল্প বলতাম। কিন্তু কোথাও ছেপে বেরোক, এ ইচ্ছাও কখনো হত না। এক আমাদের স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘প্রসূন’-এ ছাড়া। তা সেই দলটি আমার এক বছর আগেই স্কুলের গণ্ডী পার হয়ে গেছিল; পত্রিকাও বন্ধ হয়ে গেছিল। ডায়োসেসান কলেজের নিজস্ব একটা ত্রৈমাসিক বেরুত, পরে তাতে লিখতাম। জানতাম যে না লিখে আমার উপায় নেই। কিন্তু হৃদয়ের দরজা জানলাগুলো তখনো খোলেনি।

গল্প লেখা আমাদের পরিবারের অনেকেরি অভ্যাস ছিল। এখনো মাঝে মাঝে পুরনো সন্দেশের পাতায় কারো কারো লেখা দেখে আশ্চর্য হই। যেমন ছোট জ্যাঠার ছোট মেয়ে তুতুদি যার ১৯২৪ সালে বিয়ে হল। সে সত্যি ভালো গল্প লিখত। কেন যে আর লেখেনি ভেবে পাইনে।

তুতুদির বিয়ে হবে গড়পারে, তার আগেই আমার পরীক্ষাও শেষ হয়ে যাবে। খুশি না হয়ে পারলাম না। ছিলাম গিয়ে কয়েকদিন গড়পারে। ফাঁকা ফাঁকা ঘরগুলো কয়েক দিনের জন্য ভরাট হয়ে ছিল। তুতুদির মা যখন মারা যান, তুতুদির বয়স হয়তো দু তিন মাস। মেজ জ্যাঠাইমার কোলেই সে মানুষ হয়েছিল। সে যে ওঁর নিজের মেয়ে নয় বোঝাই যেত না। এই ক’দিন জ্যাঠাইমাও যেন, নিজের দুঃখের বোঝাটা নামিয়ে রাখলেন। মফঃস্বল থেকে মেয়েদের নিয়ে মেজদি এলেন; মেজদি মানে উপেন্দ্রকিশোরের মেজ মেয়ে পুণ্যলতা। বড়দিও এলেন, তাঁর নাম সুখলতা। আরো কেউ কেউ এলেন। বাড়ি গম্‌-গম্‌ করতে লাগল। সবাই জানত এ বাড়ির এই শেষ কাজ। কেউ মুখে সেকথা আনত না।

মেজদির দুই মেয়ে কল্যাণী আর নলিনী দেখতে কিছু রূপসী নয়, কিন্তু হীরের মতো ঝিকমিক করে। নলিনীর হল জ্বর। ৭-৮ বছরের জ্বরো মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে রাখা এক ব্যাপার। বাড়িসুদ্ধ সবাই ব্যস্ত। মেজদির বড় ভয় ঐ মেয়ে না উঠে গিয়ে কোথায় কি খেয়ে বসে। আমিই একমাত্র বেকার। কাজেই ওকে আগলাবার ভার আমার ওপরেই পড়ল। বয়সের তফাৎটা আরেকটু বেশি কি আরেকটু কম হলে হয়তো আগেই ওর ওপর নজর পড়ত। কিন্তু ঐ বয়সে ৭-৮ বছরের ব্যবধান প্রায় অলক্ষ্য। মেয়ে ১০৩° জ্বর নিয়ে এই শোয় তো এই লাফিয়ে ওঠে। শেষটা বললাম, “শোও। তাহলে গল্প বলব।”

“কটা বলবে?”

“অনেক।”

“যতক্ষণ শুয়ে থাকব?”

“হ্যাঁ।”

চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে নিনি বলল, “আচ্ছা বল।”

বলে বলে হয়রাণ হয়ে গেলাম। একটার শেষ কথা বলতে না বলতে, বলে, “আরেকটা।” যখন প্রায় জিব বেরিয়ে পড়েছে, তখন বললাম, “আমি হাঁপিয়ে গেছি। এবার তুমি একটা বল।” বলবার সঙ্গে সঙ্গে নিনি আলি-ভুলির গল্প শুরু করল। মনে হয় নাম দুটি সুখলতাদি কিম্বা আর কারো লেখা থেকে নিয়েছিল। কিন্তু গল্পটি একেবারে আন্‌কোরা নতুন। গল্পের প্লটের যে খুব চাঞ্চল্যকর গুণ ছিল, তাও বলছি না। কিন্তু গল্পের সমস্ত সংলাপ ছিল নিখুঁৎ ছন্দের ছড়ায়। আগে থাকতে তৈরি করা জিনিস নয়, সঙ্গে সঙ্গে বানিয়ে বানিয়ে করে দিচ্ছিল। আমি একেবারে হাঁ করে শুনছিলাম। ভাবছিলাম এ মেয়ে রক্তে করে কি জিনিস নিয়ে এসেছে কোথা থেকে কে জানে। মাঝে-অনেক বছর উচ্চ প্রশংসার সঙ্গে ঈশাণ স্কলার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বড় বড় কলেজের অধ্যক্ষার পদ ভূষিত করেও, তিনি তার রক্তের দাবিকে অস্বীকার করতে না পেরে, এখন সন্দেশে ছোট মেয়েদের গোয়েন্দা-গল্প লেখে! কিন্তু সেই আলি-ভুলি ছিল অন্য জগতের জিনিস। সে কোথায় গেল?

॥ ২২ ॥

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। দুটি মানুষের কাছে আমরা এই সময় অনেকখানি আনন্দের জন্য ঋণী ছিলাম। তাঁরা হলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দুই মেয়ে সীতা দেবী আর শান্তা দেবী। চোদ্দ পনেরো বছর বয়সে রস-রোমাঞ্চ খোঁজাই স্বাভাবিক। অজস্র ইংরিজি বই পড়েছিলাম। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে দু বোন দুটি বই আনতাম। পাড়ায় দুজন মেয়ে থাকত, আমাদের চাইতে হয়তো ৩-৪ বছরের বড়। তারা ডায়োসেসান কলেজে পড়ত। যতদূর মনে হচ্ছে নাম ছিল রেণুকা আর কণিকা। তারাও কলেজ লাইব্রেরি থেকে দুটি বই আনত। প্রত্যেক সপ্তাহে দিদি আর আমি এই চারটি বই শেষ করতাম। এইভাবে স্কট্‌, ডিকেন্স, হস্‌কেন, রাইডার হ্যাগার্ড, মারি করেলি, টলস্টয়, ডস্টোএভ্‌স্কি, ভিক্টর হিউগো থেকে আরম্ভ করে যত নাম করা লেখকের বই এবং অগুন্তি অখ্যাত লেখকের বই পড়েছিলাম। কবিতার বই নিয়ে ডুবে থাকতাম। ব্রাউনিং আর টেনিসন ছিলেন আমার প্রিয় কবি। অবিশ্যি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কারো তুলনা ছিল না। বলেছি না তাঁর প্রচণ্ড প্রতিভা আমাদের বিচার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখত।

ততদিনে বাংলা সাহিত্যের রস উপভোগ করতে শিখেছি। বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র ছাড়াও তাঁদের চাইতে অনেক ছোট অনেক লেখকের সঙ্গে মনে মনে যে-রকম অন্তরঙ্গতা হয়েছিল, সে-রকম অন্তরঙ্গতা বঙ্কিম শরৎচন্দ্র, কিম্বা মাইকেল, হেমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্ভব ছিল না। তার কারণ ছোটরা ছিলেন অনেক কাছাকাছির মানুষ নিজেকে এঁদের গল্পের নায়িকা ভাবা অনেক সহজ ছিল। এঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় সীতা দেবীর আর শান্তা দেবীর আর সংযুক্তা দেবী বলে একজন অজানা লেখিকার। পরে জেনেছিলাম সীতা দেবী শান্তাদেবী দুজনে মিলে একেকটা বই লিখতেন, আর লেখিকার নাম দিতেন সংযুক্তা দেবী। ভারি উপভোগ করেছিলাম বুদ্ধিটাকে। আমার মাসিমা কিন্তু বলতেন, “ও-সব দ্বিতীয় শ্রেণীর বই নিয়ে সময় নষ্ট করিস কেন?” যাদের বই রোম্যান্স দিয়ে ঠাসা, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর বলতে আমরা রাজি ছিলাম না। এই হল সাহিত্য বিচারের মজা। ব্যক্তিগত রুচির এক্ষেত্রে এত বেশি প্রাধান্য যে কে সত্যি ভালো আর কে মন্দ তাই বুঝে ওঠা দায়। তাছাড়া রসের জগতে ভালো-মন্দ নেই। কাকে ভালো লেখা বলা হবে, মাস্টারমশাইরা, সমালোচকরা, সাহিত্যবিদ্রা যার প্রশংসা করেন, নাকি পাঠকরা যার মধ্যে কিছু রস, আনন্দ, সান্ত্বনা, জীবনের মানে খুঁজে পায়; তাকে? সত্যি কথা বলতে কি সমালোচকরা অনেক নীরস দুর্বোধ বইয়ের প্রশংসা করেন; সাধারণ লোকে যার মাথামণ্ডু কিছু বোঝে না, সেইসব জিনিস-ই তাঁদের বেশি পছন্দ। কারণ তাঁরা মস্তিষ্ক দিয়ে বই পড়েন। আর আধা-মুখ্যু জনসাধারণের মস্তিষ্ক বলে যা আছে, তার কথা বেশি কিছু না বলাই ভালো। কিন্তু তাদের বেদনা আছে, দুঃখ আছে, হতাশা আছে, সুখও আছে। তারা হৃদয় দিয়ে বইয়ের মানে করে। মুশকিল হল তাদের এক ঘেয়ে জীবনে রোমাঞ্চের বড় অভাব, তাই তারা উত্তেজনা খোঁজে। ভালো বইতে সেটি না পেলে, বাজে বই থেকেই নিশ্বাস বন্ধ করে ও-জিনিস আহরণ করে। বলেছিই তো সৃষ্টি-কর্মের ভালো-মন্দ বুঝে ওঠা দায়। আর তাই যদি বলা যায়, ভগবানের কেরামতিই কি সবসময় বোঝা যায়? শিলং-এ সরলগাছে একরকম বিকট শুঁয়োপোকা দেখতাম। ৬ ইঞ্চি লম্বা, বুড়ো-আঙুলটার মতো মোটা, নোংরা ছাই রঙের গা, পিঠের ওপর দু-সারি ছোট্ট ছোট্ট ঢিব্‌লি মতো। একটা কাঠি গায়ে লাগালেই ফ্যাঁশ করে শব্দ হত আর ঢিবলিগুলোর ঢাকনি খুলে গিয়ে, ভেতর থেকে তিনটি করে মোটা লোম বেরুত, প্রত্যেকটির আগায় আঠার মতো কি একটা লাগানো। আমাদের খাসিয়া ধাইমারা বলত ও-জিনিস হাতে লাগলে জীবনে কখনো ঘা শুকোবে না, খেয়ে খেয়ে হাড় অবধি গিয়ে পৌছবে। ভাবতাম, এত যাঁর ক্ষমতা, তিনি ঐ জানোয়ার তৈরি করলেন কেন? লেখকরা কোন ছার।

ছোটদের জন্যেও সেকালের সন্দেশে সীতাদেবী শান্তাদেবীর লেখা বেরুত, নিরেট গুরুর কাহিনী আর বিদেশী মজার গল্পের অনুবাদ। হিন্দুস্থানী উপকথা তো খুবই প্রশংসনীয়। তবে এ-সব গল্প মৌলিক ছিল না। আমি মৌলিক রচনার বেশি প্রশংসা করি। সীতাদেবী শান্তাদেবীর উপন্যাসগুলি ছিল একেবারে মৌলিক, অর্থাৎ একটা বিশেষ সমাজের নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনযাত্রার গল্পকে যদি মৌলিক বলা যায়। কিন্তু ঘটনাগুলি তাঁদের কল্পনা-প্রসূত। সে সময়কার অনেক নামকরা কাহিনীর বিষয়ে এ-কথা বলা যায় না। এমন কি ‘মন্ত্রশক্তি’র মতো একটি সার্থক রচনার অধের্কটির সঙ্গে ফ্লরেন্স বারক্লের ‘দি ফলোইং অফ এ স্টার’-এর অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। অবিশ্যি দুই দেশের দুজন গুণী নারীর পক্ষে একই কাহিনী কল্পনা করাও অসম্ভব নয়। মোট কথা সীতাদেব শান্তাদেবী গল্পের সঙ্গে আমাদের জীবনের বেজায় সাদৃশ্য ছিল। বলাবাহুল্য ঐ সব মনোহর রোমাঞ্চের অবকাশ বাবা একেবারেই রাখতেন না। ঘরোয়া জিনিস রূপদর্শীর চোখ দিয়ে দেখাটাও খুব সহজ গুণ নয়। পরে অবিশ্যি অন্য এবং আরো জোরালো লেখকরা এই দুই বোনকে নৃশংসভাবে আমাদের চিত্ত থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এবং তাঁদের মধ্যে কেউই নারী ছিলেন না। কয়েক বছর আগে কলকাতার এক দল অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েদের চেষ্টায় রবীন্দ্র সদনে যে ছয়জন সত্তরোত্তর লেখিকাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছিল, সুখের বিষয় তাঁদের মধ্যে এই দুটি বোনও ছিলেন। এঁদের চাইতেও প্রবল প্রতিভাসম্পন্না লেখিকাও ছিলেন, যেমন শৈলবালা ঘোষজায়া, গিরিবালা দেবী। কিন্তু আমাদের ঐ ১৩, ১৪, ১৫ বছর বয়সে সীতাদেবী শান্তাদেবীকেই বেশি অন্তরঙ্গ বলে মনে হত; শৈলবালা যে সমাজের কথা লিখেছেন, তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। আরেকটু দূরে দেখবার মতো জ্ঞানবুদ্ধিও ছিল না। এর পরেই শরৎচন্দ্রকে পেলাম। সীতাদেবী শান্তাদেবীর সঙ্গে অন্য লেখিকারা বিদায় নিলেন।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাংলা বইয়ের পাহাড় জমালাম। বুঝতে পারতাম শুধু ইংরিজি বিদ্যা দিয়ে হবে না; যদি কিছু লিখতে হয় বাংলাতেই লিখতে হবে। যে-সব ভারতীয়রা মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরিজিতে সাহিত্য-সাধনা করতেন, তাঁদের সঙ্গে আমার মনের মিল ছিল না। পরে কিছু ইংরিজি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, ভালোই লিখেছিলাম, কিন্তু ও-পথে আমার পা রাখার মাটি খুঁজে পাইনি। ইংরিজি বিদেশী ভাষা। এতাবৎ শুধু নিজেদের পরিবারের কথাই বলে এসেছি। তার একটা কারণ অনাত্মীয় সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া কাউকে দেখিনি। তাঁকেও দেখেছি বললে ঠিক বলা হবে না, বরং দর্শন করেছি। অর্থাৎ বাইরে থেকে দেখেছি। কলকাতায় সেই সময় আরেকটা বাড়িও ছিল, যাদের সঙ্গে আমাদের কোনো রক্ত-সম্পর্ক না থাকলেও এত বেশি ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসা ছিল যে অনেকে ভাবত ওরা আমাদের নিকট আত্মীয়। তাঁরাও ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন। মেজজ্যাঠামশায়ের বন্ধু গগনচন্দ্র হোম। এঁর বড় ছেলে অমল হোম সামাজিক কাজে,রবীন্দ্রসাহিত্য ব্যাখ্যায় আর মৌলিক সমালোচনায় এক সময় খ্যাতি লাভ করেছিলেন। আমার প্রিয় বন্ধু ডাঃ নীহাররঞ্জন রায় গগনচন্দ্রের ভাইপো।

গল্প শুনেছি এই গগনচন্দ্রের ব্রাহ্ম সমাজের গন্ধ-লাগা বিষময় প্রভাব থেকে তাঁর আদরের পোষ্যপুত্র উপেন্দ্রকিশোরকে রক্ষা করবার জন্য আমার বাপ-জ্যাঠাদের দূর সম্পর্কের কাকা হরিকিশোর প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন এবং বলাবাহুল্য একেবারে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ময়মনসিংহ থেকে উচ্চ প্রশংসার সঙ্গে এন্ট্রান্স পাস্ করে উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় পৌছে একেবারে গগনচন্দ্রের মুঠোর মধ্যে এসে পড়লেন। ব্রাহ্মসমাজের শ্রেষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে পরিচয় হল। ফলে যা হবার তাই হল। উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্ম হলেন। সেই ইস্তক গগনচন্দ্রের বাড়ির সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের আত্মীয়তা। উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে আত্মীয়তা মানে তাঁর ভাইদের সঙ্গেও আত্মীয়তা। উপেন্দ্রকিশোর যখন দ্বারিক গাঙ্গুলীর মেয়ে বিয়ে করলেন, সারদারঞ্জন প্রমাদ গণলেন। অমনি উপেন্দ্রকিশোরের পরের ভাই মুক্তিদারঞ্জনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। আসলে মুক্তিদার তখনো বিয়ের বয়স হয়নি। হয়তো সবে উনিশ পরে কুড়িতে পড়েছিলেন। নাকি কিঞ্চিৎ অনিচ্ছুক ছিলেন; এত শীগগির বিয়ে কিসের। তবে বিদ্রোহ করবার সাহস পাননি। আমি নিজের চোখে দেখেছি ঐ বিয়ে কত সুখের ছিল। তাছাড়া সারদারঞ্জনের আশঙ্কা যে নিতান্ত অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া গেল, যখন এসব ব্যাপারের অনেক বছর পরে কুলদারঞ্জন এবং আমার বাবা দুজনেই ব্রাহ্ম মতে বিয়ে করলেন। তবে উপেন্দ্রকিশোর ছাড়া কেউ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেননি। দীক্ষা না নেওয়াতে বাবার কোনো অসুবিধা হয়নি, তিনি দস্তুরমতো গোঁড়া ব্রাহ্ম ছিলেন। যিনি এই সর্বনাশের মূল, সেই গগনচন্দ্র হয়তো উপেন্দ্রকিশোরের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন না, তবু বাবারা সবাই তাঁকে গগনমামা বলতেন। আমরা বলতাম গগনদাদামশাই। এমন আমুদে স্নেহশীল মানুষ খুব বেশি দেখিনি। অবারিতদ্বার। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে অচেনা লোকেও খেয়েদেয়ে এলে তাঁরা কৃতার্থ হতেন। শুধু গগনদাদামশাই নয়, তাঁর স্ত্রী-ও। তাঁকে আমরা ডাকতাম গগন-বৌদি। তাঁর হাসিখুশি শাম্‌লা মুখখানি চোখের সামনে ভাসে। এঁদের বড় ছেলে অমল হোমকে আমরা বলতাম ননীকাকা। ননীকাকার বিয়ের সময় বাবার সঙ্গে গগনদাদামশায়ের মনোমালিন্য হল। সে আরো কয়েক বছর পরের কথা। তবে গগনদাদামশায়ের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধটা যে কত ঘনিষ্ঠ ছিল তাতেই বোঝা যায়।

সে সময় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম যুবকদের মধ্যে একটা বিদ্রোহের ভাব দেখা গেছিল। প্রশান্তচন্দ্র বললেন, হিন্দু বিয়ে যখন রেজিস্টার করতে হয় না, আদি ব্রাহ্ম সমাজে বিয়েও যখন রেজিস্টার করতে হয় না, নববিধান ও সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে বিয়েই বা রেজিস্টার করা হবে কেন? এই নিয়ে মহা আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। এদিকে বিখ্যাত ব্রাহ্ম নেতা হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের মেয়ের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রের বিয়ের সব ঠিক। হেরম্বচন্দ্র ভয়ানক রেগে গেলেন। রেজিষ্ট্রি না করলে ব্রাহ্ম বিয়ে বে-আইনী। তাঁর মেয়েকে তিনি এভাবে বিয়ে দিতে পারেন না। কেউ নিজের মত ছাড়লেন না। শেষ পর্যন্ত বাপের অমতেই মেয়ের বিয়ে হল। পরে বাপ তাঁদের ক্ষমাও করলেন। এর বছর দুই-তিন পরে অধ্যাপক সুশোভন সরকারের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র তাঁর কনিষ্ঠা বোনের বিয়ে দিলেন। সে বিয়েও রেজিস্ট্রি হল না। আরো পরে স্বয়ং শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে হেমলতা সরকারের মেয়ের সঙ্গে অমল হোমের বিয়ে হল। কে আমাদের বাড়িতে খবর দিল এ বিয়েও রেজিষ্ট্রি হবে না। শুনেই বাবা মহা চটে গেলেন। “তাহলে আমি বিয়েতে যাব না।”

বাবা বিয়েতে যাবেন না মানে আমরাও যাব না। আমাদের দুঃখ দেখে কে! বলাবাহুল্য বাবার কথা শুনে গগনদাদামশায় যেমনি অবাক, তেমনি ক্রুদ্ধ! “তবে প্রশান্তর বিয়েতে আর তার বোনের বিয়েতে কেন গেছিল?” বাবা বলতে চাইছিলেন যে তারা নিছক পর, তারা কি করে না করে তাতে আমি কি বলব। কিন্তু গগনমামার ছেলের কথা আলাদা! এসব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের সঙ্গে কারো সহানুভূতি থাকা সম্ভব নয়। বাবার সঙ্গে গগনদাদামশায়ের মুখ দেখাদেখি রইল না। রবিবার রবিবার মামার কাছে যাওয়া বাবা বন্ধ করলেন। তারপর অবিশ্যি মিটমাট হয়ে গেল। মৃত্যুকালে গগনদাদামশাই এর শোধ তুললেন। বলে বসলেন “কুলদা আর প্রমদা আমার জন্য যেন হবিষ্যি করে।” বলাবাহুল্য বাবা জ্যাঠামশাই তাই করেছিলেন। ভাবি আত্মীয়স্বজন আর কাদের বলে?

অমল হোমের বিয়ের অনেক আগেই তার একমাত্র বোন, আমাদের বীণাপিসির বিয়ে হল। এঁর স্বামী শ্রীসুকুমার বসুই কয়েক বছর আগে তাঁর ভূতত্ত্বের বইয়ের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। গগনবৌদি এসে আমাদের দুই বোনকে আর দাদাকে বিয়েবাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই প্রথম মায়ের তত্ত্বাবধানের বাইরে অন্য লোকের বাড়ি গিয়ে থাকলাম। সেখানে দেখলাম বীণাপিসি ‘দোলন-চাঁপা’ বলে একটা কবিতার বই উপহার পেয়েছে। কে যেন কবিতাগুলো পড়ে শোনাচ্ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পরে বাড়ি এসে ঐ বইখানার সঙ্গে নজরুলের আরো গোটা দুই বই কিনে ফেললাম। কোনো মুসলমান কবির মুখে এমন কাব্য শুনব আশা করিনি। কাজি নজরুল নাকি তখন জেলে ছিলেন। বইতে কামানের পাশে দাঁড়ানো তাঁর এক বেপরোয়া ছবিও দেখলাম। মনের গোড়ায় নাড়া লেগেছিল। আশ্চর্যের বিষয় সেই প্রথম মোহের এতটুকু আর বাকি নেই। অপূর্ব ভাষা, অপূর্ব ছন্দ, কিন্তু ভাবের দিকে কোথায় যেন অনেকখানি অতৃপ্তি থেকে যায়। এ হল নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত কথা। সর্বজনস্বীকৃত মহান্‌ কবিকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। সত্যি কথা বলতে কি শেলীর কবিতাকে আমার কেমন একটু পৌরুষের অভাব মনে হয়। সে-ও ব্যক্তিগত কথা। এই বইতে আমার প্রকৃত আর আন্তরিক মতামত ছাড়া একটি কথাও লিখব না। মোট কথা সে সময় কাজি নজরুলের কাব্যসুধার আস্বাদ পাওয়ার জন্য বীণাপিসির বিয়ের কথা এত বেশি করে মনে পড়ে।

আরেকজন মানুষকেও আবিষ্কার করলাম। আমি একা নয়; বাংলার পাঠকরা সবাই করল। তাঁর নাম প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর বয়স তখন কুড়ির নিচেই হবে যদ্দূর মনে হয়। আমাদের বাড়িতে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী, তিনটি পত্রিকাই আসত। সেকালের প্রবাসীর তুলনা খুঁজে পাই না। সব তরুণ লেখকদের নিদ্রার ও জাগরণের স্বপ্ন, প্রবাসীতে লেখা বেরুবে। টাকার জন্য নয়। প্রবাসী বা অন্য কোনো কাগজ লেখকদের তখন খুব বেশি টাকা দিত বলে মনে হয় না। কিন্তু প্রবাসীর লেখক হবার সম্মান অনেকখানি। আমরা পত্রিকাগুলোর সামনের মলাট থেকে পেছনের মলাট পর্যন্ত সব কিছু পড়তাম; চিঠিপত্র, বিজ্ঞাপন, সবকিছু প্রবাসীতে মাঝে মাঝে পুস্তক-সালোচনায় দেখতাম বইয়ের ও লেখকের নাম, পৃষ্ঠা সংখ্যা আর দামের পরে শুধু লেখা, ‘ছাপাই ও বাঁধাই ভালো। ব্যস্‌ আর কিছু না।

সেই প্রবাসীতে এক গরীব কেরাণী ও তার মুমূর্ষ স্ত্রীর গল্প পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম এর আগে কেউ শোনেনি। আমিও শুনিনি। সে এমন গল্প যে চিরকালের মতো মনে ছাপ দিয়ে গেল। ভাষার জন্য নয়, অন্য কোনো চমৎকারিতার জন্য নয়, স্রেফ্‌ মানবিকতার গুণে। তখন অবিশ্যি অত বুঝতে পারিনি। শুধু মনে হয়েছিল এমন গল্প কম পড়েছি।

কোনো বই পড়ে লেখকের সঙ্গে আলাপ করার জন্য কখনো আগ্রহে অধীর হইনি। ভবিষ্যতে কিসে আমার নিজের লেখার সুবিধে হতে পারে কখনো ভাবিনি। বড়দের জন্য লেখার কথা নিজের থেকে মনেও আসেনি। খালি ভেবেছি ছোটদের জন্য ভালো বই লিখতে শিখতে হবে। তার তখনো ঢের দেরি। সেকালে মার্চ মাসের গোড়ায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা হত, ফল বেরোত মে মাসের শেষে। কলেজের ক্লাস শুরু হত ১লা জুলাই নাগাদ। কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে কোনো সমস্যাই ছিল না। যে কোনো কলেজে যে কোনো সময়ে মেয়েরা ভর্তি হতে পারত। খুব একটা ভাবনাচিন্তা ছিল না। প্রথম বিভাগে পাস করত অর্ধেকের বেশি। মোট ৭৫% নম্বর পেলে নামের পাশে একটা তারা দেওয়া থাকত। কোনো বিষয়ে ৮০% পেলে, সেই বিষয়ের নামের আদ্যক্ষর থাকত। তাকে বলা হত ‘লেটার পাওয়া’। গোটা দুই লেটার পাব ভেবেছিলাম। নিজের ক্ষমতার দৌড় জানতাম না। তবে নিচের ক্লাস্‌ থেকে সর্বদা প্রথম হয়ে এসেছিলাম; ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফল না হলে, আত্মীয়স্বজনরা ক্ষুণ্ণ হবেন। ছোট জ্যাঠামশায়ের আগ্রহ সবচাইতে বেশি ছিল। এই যা ভাবনা।

পরীক্ষা দিয়ে যখন বাড়ি আসতাম মা বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করতেন না। আমার মা আসলে ভারি বুদ্ধিমতী ছিলেন। আমি নিজে খুব খুশি হতে পারতাম না। খালি মনে হত ওরি মধ্যে আরো ভালো করে লেখা যেত। মন খুঁতখুঁত করত। ছোটজ্যাঠামশাই বাংলার পরীক্ষকদের একজন ছিলেন। অবিশ্যি আমাদের কাগজ তাঁর কাছে পড়েনি। একদিন হঠাৎ বললেন, “বাংলা পেপারে ‘জাপান ইজ্‌ দি চিলড্রেন্স প্যারাডাইস’-এর কি বাংলা করেছিস?” আমি থতমত খেয়ে বললাম, “আমি লিখেছি জাপান শিশুদের স্বর্গ-স্বরূপ। ভুল হল নাকি?” জ্যাঠামশাই বললেন, “তা জানি না। তবে একজন লিখেছে—‘জাপান শিশুদিগের সরবৎ’—তাই ভাবলাম তুই কি লিখেছিস্‌।” ছেলেটা বোধহয় প্যারাডাইস্ ক্যাবিনের বিখ্যাত সরবতের কথা ভাবছিল।

একদিন মেসোমশাই এসে শিবপুরে নিয়ে গিয়ে বললেন, “এখন বড় হয়েছ, আমার বইগুলো সব পড়ে দেখ।” দেয়াল-আলমারিতে বই, বুক শেল্‌ফে বই, ঘরের মধ্যিখানটা জুড়ে একটা প্রাক্তন বিলিয়ার্ড টেবিল; তার ওপরকার বইয়ের স্তূপ দেখতে হয়। চেয়ারে বই। মেঝের ওপর বই। বইয়ের একরকম মিষ্টি গন্ধ হয়। তার সঙ্গে আমার মেসোমশায়ের চুরুটের গন্ধ মিশে এক বিশেষ ধরনের সুখ-স্বর্গ তৈরি করে রাখত। আমি তাতে ডুবে থাকতাম। স্বর্গে কি ডুবে থাকা যায়? সাহিত্য বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইতেন মেসোমশাই। ‘সুরেশ্বর শর্মা’ বেনামায় প্রবাসীতে তাঁর কবিতা বেরুত। আমাকে পড়তে দিয়ে, মুখের দিকে চেয়ে থাকতেন। যেন আমার মতামতের কত দাম! সত্যি বলছি মেসোমশায়ের আগ্রহ দেখে আমার মতামতগুলো গভীরতা লাভ করত। মেসোমশাই চাইতেন আমি কাব্যরসে ডুবে যাই। কিন্তু বিচারবুদ্ধি না হারাই। তাই যেতাম। ইংরিজি কবিতার বাংলা অনুবাদ করতেন। পরে তাঁর ব্রাউনিং-এর অনুবাদ, শেলীর অনুবাদ ইত্যাদি বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, “এই ক’টা লাইনের বাংলা করে দাও তো দেখি।” আমি বড় যত্ন করে, নিজের ভাষার দুর্বলতা সম্বন্ধে বড় সচেতন হয়ে, বাংলা করতাম। মাঝে মাঝে আনন্দে উদ্বেল হয়ে বলতেন, “বাঃ, বাঃ, আমিও যে প্রায় ঐরকমই একটা খসড়া করেছি।” এমনি করে আমার মেসোমশাই আমার মনে বল দিতেন।

একটা মহামূল্য রত্ন মেসোমশাই আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার নাম আত্ম-প্রত্যয়। তাঁর কাছে বসে মনে হত চেষ্টা করলে আমিও হয়তো কিছু কিছু লিখতে পারব। তখন কি আর জানি যে এসব জিনিস চেষ্টা করে হবার নয়। ভিতরে থাকল তো হল আর না থাকল তো হাজার চেষ্টা করলেও হবে না।

॥ ২৩ ॥

আমার বড়জ্যাঠামশাই সারদারঞ্জনের কথা যথেষ্ট বলিনি। তাঁর সঙ্গে কখনো গল্প করিনি। কখনো কাছে ডেকে কিছু বলেছেন বলে মনে পড়ে না। এর আগে তাঁর মৃত্যুর কথা বলতে, তারিখ সম্বন্ধে কিছু ভুল করেছি। তাঁর ছোট ছেলে, সংস্কৃতে পণ্ডিত, ডঃ কুমুদরঞ্জন রায়ের লেখা জ্যাঠামশায়ের খুদে জীবনীতে দেখছি তাঁর জন্ম তারিখ দেওয়া আছে ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৬৫, অর্থাৎ ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দের মে মাসের শেষের দিকে, হয়তো ২৬শে কিম্বা ২৭শে। তাঁর মৃত্যুকাল ১লা নভেম্বর ১৯২৫। আমাদের মনে হত বেজায় বুড়ো হয়েছেন, কিন্তু হিসাব করে দেখেছি মাত্র ৬৭ বছর পূর্ণ হয়েছিল। অনেকদিন কাশি আর জ্বরে ভুগে, হাওয়াবদলের জন্য বৈদ্যনাথ গিয়েছিলেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হলেও, নিজের রোগের গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। যাবার সময় মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে গেছিলেন আর সেখানে পৌঁছেই একটা ভালো পুকুরের সন্ধান নিয়ে রেখেছিলেন। জ্বরটাকে কোনোমতে ঝেড়ে ফেলেই ছিপ নিয়ে বসবেন। কিন্তু সে জ্বর ছাড়বার নয়। জ্যাঠামশায়ের ক্ষয়-রোগ হয়েছিল এবং তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। এইবারে আমার বাবা সত্যিকার পিতৃহীন হয়েছিলেন। নিজের বাবা মারা যাবার সময় বাবার বয়স পাঁচ, সঙ্গে সঙ্গে বড়দাদা তাঁর স্নেহের ছত্রখানি মাথার ওপর তুলে ধরেছিলেন। বাবাকে কখনো ঠাকুরদাদার কথা বলতে শুনিনি। ছোট জ্যাঠামশাই বলতেন নাকি লম্বা চওড়া ধপধপে ফরসা মানুষ ছিলেন। পরম পণ্ডিত, সে তো আগেই বলেছি।

বড় জ্যাঠার রঙ কালো না হলেও একেবারেই ফরসা ছিল না, মাথায়-ও খুব বেশি লম্বা ছিলেন না। তবে বেঁটেও না। ভারি বলিষ্ঠ জোরালো শরীর ছিল। ৬৫ বছর বয়সেও গড়ের মাঠে তাঁকে দৌড়তে দেখে সায়েব খেলোয়াড়রা হাঁ! কথা বলতে সাহস পেতেন না, তবু মনে হত পৌরুষের প্রতিমূর্তি। কুমুদরঞ্জন তাঁর পুস্তিকাটিতে লিখেছে সারদারঞ্জন জীবনে একটিমাত্র মানুষকে ভয় করতেন, তিনি হলেন ওঁর বাবা শ্যামসুন্দর। সারদারঞ্জনের একমাত্র রিপু ছিল ক্রোধ। একমাত্র ব্যসন ছিল মাছ-ধরা। ক্রিকেট-খেলাটা তিনি এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে তাকে ব্যসন বলা চলে না।

এইরকম মানুষের হাতে আমার বাবা মানুষ। বড়দাদাকে যেমন ভয় করতেন, তেমনি শ্রদ্ধা করতেন। শুনেছি দেশে ঠাকুমার কাছে বাবার আর ছোটজ্যাঠামশাইয়ের শৈশব কেটেছিল। বড় জ্যাঠা, মেজজ্যাঠা, সুন্দর জ্যাঠা কলকাতায় বা কর্মস্থলে থাকতেন। পুজোর ছুটিতে ভাইদের জন্য, মা-বোনের আর ছেলেমানুষ স্ত্রীর জন্য, নানারকম কাপড়চোপড় ফল মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতেন। যে কদিন থাকতেন খেলা-ধুলো আমোদ-আহ্লাদ করে কাটাতেন। তবে তার মধ্যে দরকার হলে শাসন-টাসনও করতেন। খেলাধুলোর মধ্যে ছিল শিকার, মাছ-ধরা আর ফাঁদ পেতে শেয়াল ধরা। একদিন সকালে ছোট ছোট ভাইদের নিয়ে ফাঁদ দেখতে গিয়ে দেখেন ফাঁদের মধ্যে শেয়ালের বদলে বাঘ-মশাই বলে আছেন। তারপর থেকে ফাঁদ পাতা বন্ধ হয়েছিল। শেয়ালগুলো তরমুজের ক্ষেত নষ্ট করত।

আশ্চর্য মানুষ ছিলেন, কঠোরে কোমলে মেশানো। ছোটভাইরা জানতেন বড়দাদা কাছে থাকলে আর কোনো ভয় নেই। তেমনি আবার পান থেকে চুন খসলেই কড়া শাসন। তাঁর সামনে থেকে ভাইরা পালাতে পারলেই বাঁচতেন। বাবার সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য ছিল। চেহারায় নয়, স্বভাবে। তবে বড়জ্যাঠামশায়ের মতো বাবা অত বেশি পড়াশুনো করতেন না। তেমনি বড় জ্যাঠারও বাবার মতো ছবি আঁকার হাত ছিল না। বাবার একমাত্র রিপু ছিল অন্ধ রাগ। ব্যসন যে কি ছিল ভেবে পাই না। গুণ তো যথেষ্ট ছিল। কোনো একটাকে আঁকড়ে ধরে, যাকে বলে, ‘হবি’ বানালে হয়তো রাগটা কমে যেত। হয়তো অতিরিক্ত প্রাণশক্তি রাগ হয়ে ফেটে পড়ত। জ্যাঠামশায়ের মতোই বাবাও কখনো কোনো প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিতেন না। কত লোক আমাদের বাড়িতে এসে থেকেছে, খেয়েছে, বাবার খরচে চিকিৎসা করিয়েছে। মনে হত তাদের জন্য কিছু করতে পেরে, বাবা কৃতার্থ হয়ে যাচ্ছেন। শরীর সারাতে চেঞ্জে গেলেও, বাড়তি কয়েকজনকে জুটিয়ে নেবার চেষ্টা করতেন। টাকাকড়িতে বাবার লোভ ছিল না। বাড়ির কর্তার খাওয়ার জন্য কেউ কোনো আলাদা ব্যবস্থা করলে বিরক্ত হতেন। সবকিছু সমান ভাগ হবে। মাঝে মাঝে বেশ মজা হত। আমরা ছিলাম আট ভাইবোন, তাছাড়া বড়পিসিমার নাতি অশোক আর পরে ইউ রায় এণ্ড সন্স উঠে গেলে, মেজজ্যাঠামশায়ের ছোট ছেলে সুবিমল, আমাদের নান্কুদা। মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি থেকে নোন্তা খাবার, ফল, মিষ্টি ইত্যাদি আসত। বলাবাহুল্য গোটাদশেক মানুষের তাতে কুলোত না। কাজেই নিয়ম হয়ে গেল যে নোনতা খাবার এলে বড়রা খাবে, আর ফল মিষ্টি ছোটরা খাবে। মা কিম্বা বাবাকে এ-সব বাড়তি লাভের জিনিস মুখেও দিতে দেখিনি। মা সন্ন্যাসীর মেয়ে, লোভ কাকে বলে জানতেন না। বাবার এই নির্লোভ দিকটা নিশ্চয় বড়জ্যাঠামশায়ের কৃত কর্ম। তবে মতামত সম্বন্ধেও বাবা যদি একদা উদার হতেন, তাহলে আমার অনেক সুবিধা হত।

সে যাক গে, বড়জ্যাঠামশায়ের কথা হচ্ছিল। এর আগেও বোধহয় বলেছি তিনি খানিকটা ‘সাইকিক’ ছিলেন। অলৌকিক কথাটা আমার পছন্দ নয়, মনে হয় এ-সমস্ত ক্ষমতাই অসাধারণ হলেও স্বাভাবিক। তবে হয়তো কিছুটা অতীন্দ্রিয়। সাধারণ মানুষের পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের যতখানি গোচর হয়, তার চেয়ে খানিকটা বেশি কিছু। পরীক্ষার আগের রাতে স্বপ্নে প্রশ্নপত্র দেখার কথা বলেছি। আরো অনেকবার নাকি স্বপ্নে যা দেখেছিলেন, বাস্তবে তাই ঘটেছিল। তিনি নিজেই বলতেন, “জান তো আমার স্বপ্ন কখনো মিথ্যা হয় না।”

শেষ অসুখের সময় অনেকের মনে আশা হয়েছিল হয়তো এবার সেরে উঠবেন। আমার মনে আছে, আমাদের বাড়ির সকলের ধারণা ছিল চেঞ্জে গিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই বড়জ্যাঠামশাই ভালো হয়ে যাবেন। কিন্তু মারা যাবার সাত দিন আগে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যেন একটা মন্দিরের সামনে পৌঁছেছেন। বড় ছেলে মনোরঞ্জন তাঁকে মন্দিরের দরজাটি দেখিয়ে দিতেই, ভিতর থেকে একজন ভক্ত এসে তাঁকে মন্দিরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানে সাদা সরস্বতীর মূর্তি ছিল। ভক্ত যেন জ্যাঠামশাইকে মূর্তির সামনে বসালেন।

ঠিক সেই সময় ঘুম ভেঙে যেতেই, ছোট ছেলে কুমুদরঞ্জনকে বললেন, ‘মনে হয় আমার যাবার সময় হয়েছে।’ সেই মুহূর্ত থেকে প্রফুল্লচিত্তে তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছিলেন আর যাকে বলে সজ্ঞানে স্বর্গে যাওয়া, শেষ পর্যন্ত তাই করেছিলেন।

এ-সমস্ত ঘটেছিল ১৯২৫ সালে। আমি তখন কলেজের ছাত্রী। হয়তো বৈদ্যনাথে মারা গেছিলেন বলে বড় জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর কথা আমি ভালো করে মনে করতে পারছি না। এটুকু মনে আছে যে তারপর বছরখানেক বাবার মুখে হাসি দেখিনি। তখন ১০০ নং গড়পার রোডের পাট-ও শেষ হয়ে আসছিল, সেই সময় বড়জ্যাঠামশাইকে স্মরণ করে একদিন সেখানে ব্রহ্মোপাসনা হল। মেজজ্যাঠামশাই ব্রাহ্ম হলে পর বড়জ্যাঠামশায়ের মনে যে তিক্ততা জমেছিল, সে তিক্ততা কবে কেটে গেছিল। তবে ব্রাহ্ম ভাইদের বাড়িতে বড়জ্যাঠামশাই খুব কম যেতেন। গেলেও জল-স্পর্শ করতেন না। ভাইরা তাঁকে এত ভালোবাসতেন আর ভক্তি করতেন যে ক্রমাগত আমহার্স্ট রোতে তাঁর বাড়িতে যেতেন, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন। বলাবাহুল্য বড়জ্যাঠার ছেলেমেয়েদের মনে কোনো ভেদজ্ঞান ছিল না।

আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরুল বোধহয় মে মাসে। এতটা ভালো হবে আশা করিনি। ছেলেমেয়েদের মধ্যে ১২তম কিম্বা ১৩তম স্থান নিয়েছিলাম। শ্ৰীমতী শান্তিসুধা ঘোষ বোধহয় সপ্তম স্থান নিয়েছিল। এতটা আশা না করলেও, এই মনে করে বেজায় দুঃখ হয়েছিল যে আরেকটু চেষ্টা করলই প্রথম দশজনের মধ্যে হতে পারতাম। এখানে বলি যে আমার মনে হয় পরীক্ষার ফলের তালিকায় প্রথম ২০-২৫ জনের মধ্যে কৃতিত্বের বিশেষ তফাৎ থাকে না। এক নম্বর, আধ নম্বর কম-বেশির জন্য কেউ ওপরে কেউ নিচে হয়। অন্য সব বিষয়ে ৮০-র বেশি পেয়েছিলাম, অঙ্কে ৯৯ আর এ্যাডিশনেল অঙ্কে ৯৮। কিন্তু বাংলায় ৭৮ আর ফ্রেঞ্চে ৭৫। এখন কি হয় জানি না, সেকালে কোনো একটা বিষয়েও ৮০-র কম পেলে প্রথম দশজনের মধ্যে হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।

স্কুলের দিদিমণিরা খুব খুশি। স্কুলের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম বলে প্রাক্তন ছাত্রীদের দেওয়া সোনার মেডেল পেলাম। এক ভরি সোনার তৈরি, সুন্দর গড়ন। তখন নাকি পঁচিশ-ত্রিশ টাকা খরচ পড়েছিল! এখনো আছে আমার কাছে। ইংরিজির জন্য মিসেস্ ইংলিস্ প্রাইজ পেয়েছিলাম। পছন্দমতো গোটা দশেক চমৎকার বই কিনেছিলাম, বাবার সঙ্গে গিয়ে, কলেজ স্কোয়ারের বুক কোম্পানি থেকে। শেলী, কীট্স্, ব্রাউনিং ইত্যাদির কবিতার বই। বাবা মুখে একবারো বলেননি যে খুশি হয়েছেন, কিন্তু আমাকে সুন্দর একটা ওয়াটারম্যানের কলম আর সোনা বাঁধানো প্রপেলিং পেন্সিল দিয়েছিলেন। একদিন ব্রিজ্ খেলার বন্ধুদের ডেকে খুব খাইয়েও ছিলেন। উপলক্ষটা আমাদের বলা হয়নি, পাছে অহংকার হয়। আর ছোটজ্যাঠামশাই হাসতে হাসতে দুই চ্যাঙারি ভর্তি আমার পেয়ারের ছানার মুড়কি আর ছানার গজা নিয়ে এসে, আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন; চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। এখনো ভাবি মানুষ কেন মানুষকে ভালোবাসে? আমি তো ছোটজ্যাঠাকে কক্ষনো কিছু দিইনি। অনেক তর্ক করেছি। বাবাকে যেসব কথা বলবার সাহস হত না, ছোটজ্যাঠাকে অম্লানবদনে বলেছি। কিন্তু মনে মনে খুব ভালোবাসতাম। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ভালবাসার মানুষদের কেন আমরা বলি না, ‘তোমাকে আমি ভালোবাসি’, কিম্বা ‘তুমি ভালো’, কিম্বা ‘তুমি সুন্দর’, কিম্বা ‘তোমার কোনো গুণ দেখতে পাই না, তবু ভালোবাসি।’ দেখতে দেখতে সুযোগ চলে যায়, সময় চলে যায়, ভালোবাসার মানুষগুলোও সব একে একে চলে যায়। তখন বুক-ভরা ভালোবাসা নিয়ে একা বসে থাকতে হয়।

সেকালে প্রথম দশজন ২৫ টাকার মাসিক বৃত্তি পেত। মেয়েদের মধ্যে যে প্রথম হত, সে-ও একটা ২৫ টাকার বৃত্তি পেত। শান্তিসুধা প্রথম দশজনের একজন হয়ে ঐ বৃত্তি পেল আর আমি মেয়েদের মধ্যে প্রথম হওয়ার বৃত্তিটি পেলাম, যদিও আমার আসলে দ্বিতীয় স্থান।

একটা শনিবার সকালে আমাদের স্কুলের পণ্ডিতমশাই ছোট্ট এক বাক্স সন্দেশ নিয়ে দেখা করতে এলেন। ভারি লজ্জা পেলাম। এই পণ্ডিতমশাই-ই ১৯২০ সালে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “বিলেত থেকে এয়েচ?” বললাম, “আপনি মিষ্টি নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন, কিন্তু আমি তো খুব ভালো নম্বর পাইনি।”

পণ্ডিতমশাই আমাদের ক্লাসে উত্তর-রাম-চরিত পড়াতে পড়াতে কাঁদতেন বলে আমরা হাসাহাসি করতাম। আজ দেখলাম আবার তাঁর কান্না পেয়েছে। বললেন, “সিস্টার ডরথি ফ্রান্সিস্ আমাকে বলেছেন আমি যদি আরেকটু যত্ন নিতাম, তাহলে তুমি বাংলাতেও ৮০-র ওপরে পেতে। কিন্তু তোমার ভবিষ্যৎ ভারি সুন্দর হবে।”

আমারো টন্‌সিলে ব্যথা করেছিল। বলেছিলাম, “কক্ষনো না। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া হতে পারে, কিন্তু কক্ষনো পক্ষিরাজ হয় না।” পণ্ডিতমশাইকে প্রণাম করেছিলাম। মা তাঁকে এক থালা সন্দেশ এনে দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা ব্রাহ্ম। আপনি কি আমাদের বাড়িতে খাবেন?” পণ্ডিতমশাই দু’ হাত পেতে মিষ্টির থালা নিয়ে বলেছিলেন, “আপনি রামানন্দ ভারতীর কন্যা, আপনার হাতে না খেলেই আমার পাপ হবে।”

সেই দিনটি, সেই সময়টি, পণ্ডিতমশায়ের সেই মুখখানি, মায়ের মুখ, সব আমার মনে খোদাই করা হয়ে আছে। সেই মুহূর্তে মনে মনে পুরনো সঙ্কল্পটি আবার উচ্চারণ করে নিয়েছিলাম, যেমন করে পারি, যতদিন বাঁচি, বাংলা ভাষার সেবা করব। পরে মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধব, পাঠক কেউ কেউ নাকি বলেছে “তোমার বাংলার চাইতে ইংরিজি লেখা বেশি ভালো। এত কম ইংরিজি লেখ কেন?” যারা এমন প্রশ্ন করতে পারে তাদের আমার বলার কিছু নেই! আমি ভাবতে পারি না বাংলা ছাড়া আমি আবার কোন ভাষা লিখব। যদি লিখি, তাহলে বাংলা বইয়ের ইংরিজি অনুবাদ কিম্বা শ্রেষ্ঠ ইংরিজি বইয়ের, বিশেষতঃ ছোটদের বইয়ের বাংলা করে, বাংলার-ই কাজ করব। ইংরিজি অনার্স নিয়ে বি-এ পাস করেছি, ইংরিজিতে এম্এ পাস করেছি—সেইজন্যেই আমাকে ইংরিজিতেই লিখতে হবে এ কি কোনো কাজের কথা হল? আমি মনে করি ইংরিজিতে এত লেখা-পড়া করেছি বলেই আমি বাংলা লেখার জোর পেয়েছি। আমার চোখ খুলেছে, মন খুলেছে। এতটা খুলেছে যে ধার করা ভাবের ধার করা ভাষার বিষয়ে আমার কোনো মোহ নেই। যতদিন বাঁচি বাংলাতেই লিখব।

তবে এত কথা ভাববার তখন আমার বুদ্ধি বা বিদ্যেও ছিল না। দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে মানুষ যেমন বাড়ে, তার চিন্তাও তেমনি পুষ্টি পায়। মোট কথা, পরীক্ষার ফল বেরুলেই কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়ে এলাম। ইংরিজি, বাংলা তো নিতেই হবে, তাছাড়া নিলাম লজিক, বটানি, অঙ্ক। বলাবাহুল্য ঐ আবশ্যিক বিষয় দুটিই আমার আসল উদ্দেশ্য, বাকি তিনটি শুধু নম্বর তুলবার ফিকির। এতদিনে নিজের ক্ষমতার একটা মাপ পেয়েছিলাম। ইন্টারমীডিয়েট পরীক্ষায় ১২তম কিম্বা ১৩তম হব না, সে বিষয়ে মন ঠিক করে ফেলেছিলাম।

ভর্তি তো হলাম, কিন্তু এখন থেকে যে খোঁপা বেঁধে কলেজে যেতে হবে, তার কি? সেই যে বলেছিলাম, ২০টা হেয়ার-পিন দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এলো-খোঁপা বাঁধা, রোজ রোজ তার পাট চলতে লাগল। খোঁপার মধ্যে কিছু পুরে, খোঁপাটাকে আরেকটু পুরুষ্ট করার কথা মনেও আসত না। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে একবার শুনেছি যে নকল জিনিস ভারি মন্দ যে নিজেদের অজান্তেই মনে প্রাণে নকল জিনিস ঘেন্না করে এসেছি। হালে, হয় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক অবনতি হবার দরুণ, কিম্বা এতকাল পরে বুদ্ধি খোলাতে, টের পাচ্ছি নকল জিনিসই বা মন্দ কি। নিউ মার্কেটে তৈরি করা নকল খোঁপা কিনতে পাওয়া যায়। চুলটুল না থাকলেও কোনো উপায়ে—সে উপায়টা এখনো রপ্ত করতে পারিনি—ঐ নকল খোঁপাটি মাথায় এঁটে কেশবতী কন্যা হওয়া যায়। নকল দাঁতে কখনো ব্যথা করে না, নড়ে না, পড়ে না। যদি না হাত থেকে ফেলে দেওয়া যায়। সে তো পড়ে গেলে ঠ্যাং-ও ভাঙে। নকল পশমের মোজা পোকায় কাটে না, আসল পশম খেয়ে-দেয়ে নাশ করে। আর কত বলব?

ষোল বছর বয়সে আমরা জানতাম নকল চুল ভারি খারাপ। ছিলও মাথায় এক ঢাল চুল, এলো খোঁপা করাতে বাধা ছিল না। ঠোঁটে রঙ, ভুরুতে রং, চোখের পাতিতে রং, নখে রং—এসব অন্য জগতের ব্যাপার। তবে নাক-মুখ চকচক করলে বিশ্রী দেখায়, তাই একটু পাউডার মাখা চলত। তাও মুখে মাখার জন্য আলাদা রকম পাউডার কিনতে হয়, সেটা শিখতে সময় লেগেছিল।

প্রসাধনের কথা বাদ দিয়েও অন্য সমস্যা ছিল। সারা দিন এক গাদা কাপড়-চোপড় টেনে বেড়াতে হত। সে পোশাকের ডিজাইন হয়েছিল মহারাণী ভিক্টোরিয়া যখন প্রথম সিংহাসনে চড়েন নির্ঘাৎ সেই সময়ে। ১৯২৪ সালে আমরা তখনো তাঁর সময়কার ভেতরের কাপড়-চোপড় পরতাম। ‘অন্তর্বাস’ কথাটার তখনো চল হয়নি; শুনলে নিশ্চয় একটু অসভ্য-অসভ্য মনে হত। আমরা কি পরে কলেজে যেতাম তাই বলি। প্রথমে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা ইজের। তার ওপর গলায় কণ্ঠা থেকে পায়ের কব্জি অবধি লম্বা একটা সাদা। লংক্লথের সেমিজ। তার ওপর কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি লম্বা লংক্লথের সায়া। ওপর দিকে সেমিজের ওপর, ছোট হাতাওয়ালা আঁটো একটা বডির ওপর, কনুই-হাতা, কণ্ঠা অবধি উঁচু একটা ব্লাউজ আর সবার ওপরে ডান কাঁধে পিন দিয়ে আঁটা ব্রাহ্ম-ফ্যাশানে পরা শাড়ি। তখন থেকেই সামনে কুঁচি দিয়ে মাদ্রাজি ফ্যাশানে কাপড় পরার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু বাবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ও ফ্যাশানটা ভারি অসভ্য, কাজেই দিদি আর আমি এম্-এ পাস করে স্বাধীন হবার আগে পর্যন্ত ব্রাহ্ম-ফ্যাশানে শাড়ি পরেছি পায়ে ছোট গোড়ালি পর্যন্ত। বাড়িতে বাঙালী ধরনের কাপড় আর পায়ে চটি, কিম্বা খালি পা। সে যাই হোক, আমি হলপ্ করে বলতে পারি আমরা ঐসব পরে যখন অরক্ষিতভাবে ট্রামে চড়ে এম্-এ পড়তে যেতাম আর ছেলেদের সঙ্গে ক্লাস্ করতাম, তখন আমাদের শরীরের কোনো জায়গায় এতটুকু উঁচু-নিচু টক্কর আছে বলে মালুম দিত না। তবে স্বাভাবিক ওজনের চাইতে নিশ্চয় আমরা সের দুই ভারি হয়ে যেতাম। তাছাড়া আরেকটা অসুবিধা ছিল যা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো টের পাওয়া অসম্ভব ছিল। সেটি হল যে ঐ তলাকার সেমিজটা তার ওপরকার পেটিকোটটা আর সবার ওপরকার শাড়িটার আড়াই প্যাঁচ পরস্পরের সঙ্গে মাঝে মাঝে এমনি জড়িয়ে যেত যে হাঁটাই দায় হয়ে উঠত। আর গরু তাড়া করলে যে কি হত সে ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।

॥ ২৪ ॥

কলেজে পড়তে বেজায় ভালো লাগত। সে সময় ডায়োসেসেন কলেজে ইংরিজি, ইকনমিক্স, ইতিহাস ইত্যাদি পড়াবার জন্য বিলেত থেকে ভালো ভালো খাঁটি মেম আনা হত। আর সিস্টার ডরথি ফ্রান্সিস তো ছিলেনই। মনে হয় খুব ভালো পড়ানো হত। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ইতিহাস পড়াতেন চারুলতা দাশ। এর কাছে আমরা স্কুলের ওপরের ক্লাসেও ইতিহাস পড়েছিলাম। পাতলা ছিপছিপে, অতি পরিপাটি করে কাপড়-চোপড় পরা, এক অভিজাত খ্রীশ্চান পরিবারের মেয়ে। ভারি কড়া, কিন্তু চোখ দেখে সন্দেহ হত সেইসঙ্গে বেজায় রসবোধও ছিল। পরে যখন নিয়ম হয়ে গেল যে এম-এ পাস না করলে কেউ কলেজে পড়াতে পারবে না, তখন আধ-বুড়ো চারুদি কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। সমানে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে নিজে পড়ে তৈরি হয়ে, ১৯৩০ সালে আমি যেবার এম-এ দিলাম, সেবার উনিও ইতিহাসে এম্-এ দিয়ে, পাস করে, পুরনো চাকরিতে ফিরে গেলেন। আরো আট-দশ বছর পরে উনি ডায়োসেসান স্কুলের অধ্যক্ষা হয়ে অনেকদিন অতি দক্ষভাবে বিদ্যালয় চালিয়ে ছিলেন।

পরে শুনতাম ওঁর নাকি বেজায় কড়া মেজাজ। শুধু ছাত্রীদের নয়, তাদের মা-বাবাদেরও নাকি বকে ভূত ভাগিয়ে দিতেন। আমি কিন্তু তাঁর কাছ থেকে আগাগোড়া অত্যন্ত স্নেহ ও সহানুভূতি পেয়েছি। এক সময় আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন। মনে আছে তখন আমার বাংলা শেখার চেষ্টা দেখে ভারি উৎসাহ দিতেন। মাস্টারনী জিনিসটি নিয়ে লোকে হাসাহাসি করে। যেন ভারি কৌতুককর কিছু। মা-বাবারা কত সময়ে—বিশেষ করে বাবারা—মেয়েদের কাছে তাদের দিদিমণিদের নীরস চেহারা আর কড়া মেজাজ নিয়ে তামাসা করেন। এ একটা মজার ব্যাপার। পুরুষ অধ্যাপকরা স্বাভাবিক জীবন কাটান, তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার থাকে। হয়তো মাঝে মাঝে মনে হয় না থাকলেই ছিল ভালো—তবু তাঁদের জীবন থেকে সব রস শুকিয়ে যায় না। তাছাড়া তাঁদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাইরের একটা সরস জীবনও থাকে। মেয়েদের কিছুই থাকে না। আমাদের দেশে সব মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার কথা, তা সে সুখেরই হক কি দুঃখেরই হক। তবু বিধবারা আছে আর যে-কোনো কারণেই হক বিয়ে হল না এমন অনেক মেয়ে আছে। তাদের মা-বাবা যতদিন বেঁচে থাকেন, তারা একটা বাড়ির আদর যত্ন পায়। তাঁরা গেলে, প্রায়ই দেখা যায় বোর্ডিং-এ, হস্টেলে, কিম্বা কোথাও একখানা ঘর নিয়ে, তাদের জীবন কাটে। সে ঘরটি একটা নিরাপদ আশ্রয় হলেও, নিজের বাড়ি নয়। মনের কোমল বৃত্তিগুলো শুকিয়ে গেলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ-সব মেয়েরা পরের ছোট ছেলে-মেয়েদের দেখলে হয় গলে কাদা হয়ে যায়, নয় নির্মম উগ্র মূর্তি ধারণ করে। উভয় ক্ষেত্রেই ছেলে-মেয়ে পড়াবার যোগ্যতা হারায়। আরেক রকম আছে, তাদের অবস্থা ভালো, নিজেদেরও গুণ আছে, হয়তো বিদেশ ঘুরে এসে ভালো চাকরি করে, কিন্তু নিঃসঙ্গ জীবন। কথায় কথায় তারা পারিবারিক জীবনের প্রতি ঘৃণা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে। কিশোর মন নিয়ে তারা করবেটা কি? যতই ‘উইমেন্স লিব্’ সম্বন্ধে লম্বা চওড়া কথা শুনি, ততই আমার সেই সব বঞ্চিতা নিঃসঙ্গ দিদিমণিদের কথা মনে পড়ে। তাঁদের একজনকেও আমার সুখী বলে মনে হত না। শুধু বিদ্যা দিয়ে জীবন ভরে রাখতে পারে লাখে একজন। আর পারে যাদের অসাধারণ প্রতিভা থাকে। নইলে পারিবারিক জীবনের মতো আছে কি? এত তেতো, কিন্তু এত মধুর। চার দিক দিয়ে এমনভাবে হাত-পা বেঁধে রেখে দেয়—একবার একা গিয়ে জ্বালামুখী দেখে আসার এত সখ সত্ত্বেও, সারা জীবনে হয়ে ওঠে না! পৃথিবীতে দর্শনীয় এত জায়গা ছেড়ে চারটি ঘরের মধ্যে ডানা গুটিয়ে বসা! আমাদের একটা মস্ত কাকাতুয়া ছিল, পায়ে শেকল পরে সে দাঁড়ে বসে থাকত। রোজ সন্ধ্যায় একবার সে একটানা পাঁচ মিনিট ধরে বিকট চ্যাঁচাত আর ডানা ঝাপটাত। মেয়ে-মানুষের জীবনেও তাই হয়; দিনান্তে একবার ডানা মেলে, যে জায়গা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে সেইখানে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। আবার ঐ চারখানি ঘরের মধ্যেও যে এতখানি ধরে কে জানত! আমি বাড়ি না থাকলে কারো অসুবিধা হয়, আমি এলে কেউ খুশি হয়, এমন সব মানুষ আছে আমার, যাদের জন্য সারাদিন কাজ করেও, আমার কাজের শেষ থাকে না। ফেলে দেবার মতো পাঁচ মিনিটও সময় আমার নেই। এই দুঃখ যে না পেল, সে কতটুকু সুখ পেল? তাই জীবনের প্রদোষে, আমার সেই সব দিদিমণিদের—যাঁদের এককালে জ্বালিয়েওছি কম নয়—তাঁদের কাছে আমার হৃদয়ের ভালোবাসা জানাই।

সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, যত পারি লেখা-পড়া করব, কিন্তু অধ্যাপনা করে কখনো আমি জীবন কাটাব না। ভাবতাম একটা বড় লাইব্রেরিতে দিন কাটাতে কেমন লাগবে? নয়তো একটা ছাপা-খানায় বা প্রকাশনালয়ে? নিদেন একটা বইয়ের দোকানে! যেখানে সারাদিন নতুন বইয়ের গন্ধ পাব; যে-বইতে কেউ হাত দেয়নি, সে বই প্রথম খুলব। কিন্তু সর্বদা তার পেছনে থাকবে একটা ছোট বাড়ি, একটা মানুষ আর দুটো একটা ছেলে-মেয়ে। আমার ঘর, আমার মানুষ। সেই ষোল বছর বয়সেই জানতাম এদের না পেলে আমার সুখ কোথায়? পৃথিবীর সমস্ত প্রয়াসের উদ্দেশ্যই হল একটি ছাদের তলায়, কটি মানুষ। তা না পেলে ছোটদের জন্য গল্প লিখব কি করে? জীবনের আধখানা ফাঁকা থাকলে তাকে ভরব কি দিয়ে? নকল জিনিসে তো কাজ হবে না।

বলা বাহুল্য এত গুছিয়ে কথাগুলো ভাবিনি, কিন্তু একবারও ইচ্ছা করেনি নিজেকে বেজায় রকম ভালো করে তৈরি করে, মস্ত একটা চাকরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিই। সে ইচ্ছে না হলেও, স্বাধীন হবার প্রবল বাসনা ছিল। এই বইতে আমি শুধু আমার প্রকৃত মনের কথা লিখব। সেই কৈশোর থেকে কারো কোনো কর্তৃত্ব আমি ভালো মনে মেনে নিতে পারিনি। না শিক্ষকদের, না বাবার, না মা-র। নিজের অক্ষমতা, মূর্খতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলাম বলে সেই অবাধ্যতা কখনো কাজে প্রকাশ করিনি। তবে তর্ক করে যতই গুরুজনদের অপ্রীতিভাজন হয়েছি, ততই মনে মনে সঙ্কল্প করেছি আমার এই ভালোবাসার মানুষগুলোর কাছেও আমার নিজেকে সমর্পণ করব না। তবে এও ভাবতাম যে ভালোবাসার মানুষগুলো সুখী না হলে, আমিও যখন সুখী হতে পারি না, তবে আবার স্বাধীন হব কি করে? অনেক পরে, অনেক সুখ অনেক দুঃখ পেরিয়ে বুঝেছিলাম স্বাধীনতাও বাইরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, তার নিবাস আমারি মনের মাঝে। এত কথা বলার মানে হল আমি ভারি অবাধ্য মেয়ে। অন্য লোকের কথামত চলা আমার পক্ষে বড় কঠিন।

বাবা আমাদের মাঝে মাঝে গড়ের মাঠে হকি ফুটবল খেলা দেখতে নিয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু যখন শেক্সপীয়র রেপার্টরি থিয়েটার এসে প্র্যাট্ স্কুলে অভিনয় দেখাল, কলেজ থেকে মেম দলবল নিয়ে টিকিট কেটে দেখতে গেলেন। বাবা আমাদের যেতে দিলেন না। মনে মনে বেজায় রাগ হয়েছিল। মার কাছে গিয়ে খুব খানিকটা গজ্ গজ্ করেছিলাম। মাকে কখনো বাবার বিচারের বিরুদ্ধে একটি কথা বলতে শুনিনি। কিন্তু চোখে বেদনা দেখেছি। এতগুলো ছেলেমেয়ের কারো গায়ে কখনো হাত তোলেননি, খালি আমার আর একটা দুরন্ত ভাইয়ের গালে এক-আধবার চড় কসিয়েছেন। মনে হয় ভগবান থাকলেও সে অবস্থায় চড় দিতেন। ভাগ্যিস্ তিনি নিরাকার, তাই বড় বাঁচা বেঁচেছি। বলেছি তো যাকে লক্ষ্মী মেয়ে বলে, আমি তা ছিলাম না। তবু কেন আমার মাসি, মেসো, পিসি, জ্যাঠা, জ্যেঠি, দাদা-দিদি আর এন্তার বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে এত স্নেহ পেয়েছিলাম জানি না। আশা করি তাঁদের মনে আমার অবাধ্য স্বভাব শুধরোবার উচ্চাশা ছিল না।

জ্যাঠতুতো পিসতুতো ভাই-বোনগুলোও ততদিনে অনেক বড় হয়ে গেছিল। সমবয়সীদের সঙ্গে একটা কোমল স্নেহের সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল, তাই বলে তর্কাতর্কিও কম হত না। আমার মাসিমা একবার মাকে বলেছিলেন, “আচ্ছা, এদের কারো সঙ্গে কারো মত মেলে না কেন?” মা কষ্টে হেসে বলেছিলেন, “বুঝতে পারছ না কেন? সবাই যে আর সকলের চেয়ে অনেক বেশি চালাক।” এহেন মন্তব্য শুনে আমরা একটুক্ষণের মতো হাঁ হয়ে গেছিলাম। মা-ও কিছু কম চালাক ছিলেন না।

১৯২৫ সালের মার্চ মাসে মায়ের ডবল নিউমোনিয়া হল। প্রাণ যায় যায়। ডাক্তার, ওষুধ, অক্সিজেন, রাত জাগা, টাকা-কড়ির শ্রাদ্ধ। একদিন সেই আমাদের ছোট বেলাকার পাতানো কাকারা দুজন আলাদাভাবে এসে দিদির আমার হাতে কয়েক শো টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, “বাবাকে এখন কিছু বলিস্ না। সে আমাদের বড় অফিসার। কিন্তু তাই বলে একা একা পারবে কেন?” বলে জোরে জোরে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেলেন। বাবাকে যখন দিদি বলল, আশ্চর্যের বিষয়, বাবা এতটুকু রাগ করলেন না। বললেন, “তুলে রাখ। দরকার হলে খরচ করা যাবে।” পরে মা সেরে উঠলে ঐ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন, “টাকা শোধ হলেও ও ঋণ শোধ হয়নি।” মা সেরে উঠতে উঠতে কল্যাণের ম্যাট্রিক আর দাদা দিদির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা এসে গেল। এবং দেখতে দেখতে শেষও হয়ে গেল। আড়াই মাস পরে ফল বেরোলে দেখা গেল তিনজনেই ভালো করে পাস্ করেছে। দিদি মেয়েদের একটা স্কলারশিপ্ও পেয়েছিল। এদিকে ডাক্তার বলেছিলেন রোগ সেরেও মা-র রোজ ৯৯° জ্বর হচ্ছে, কোনো শুকনো জায়গায় চেঞ্জে গেলে ভালো হয়। হাজারিবাগে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল; মায়ের সঙ্গে দিদি, কল্যাণ গেল; তাদের লম্বা ছুটি। আর ছোট বোন লতিকা আর ছোট ভাই যতি স্কুল থেকে ছুটি করে নিয়ে সঙ্গে গেল। আমরা বাকিরা কলকাতায় রইলাম, গরমের ছুটি হলে আমরাও যাব। আমি হলাম বাড়ির গিন্নি। আমার গিন্নিপনা অমি — সরোজের কিম্বা ভাইপো অশোকের নানান মন্তব্যের বিষয় ছিল। কিন্তু বাবা ঐ সময় আমাদের কাউকে একবারো বকেননি। তার মধ্যে আবার সরোজের গায়ে হাম বেরোল। সবাই মিলে সেবা করলাম। হাম বেরোলে লোককে কি বিকটই না দেখায়। সরোজকে সে কথা বলায় সে অনেকক্ষণ ধরে আয়নায় নিজের মুখ পরীক্ষা করে বলল, “ঠিক বলেছ!”

মাসিমা নোটন আমাদের সঙ্গে হাজারিবাগ যাবেন। মাঝে মাঝে শিবপুরে মাসিমার কাছে ছুটি-ছাটা কাটাতাম। বেজায় ভালো বাবুর্চি ছিল মাসিমাদের; চপ কাটলেট যা বানাত। আর মাসিমা বড্ড আদর যত্ন করতেন, কি করবেন কোথায় রাখবেন ভেবে পেতেন না। নিজের আত্মীয় বলতে তো ঐ দুই বোন। তার মধ্যে ছোট মাসিরা পাটনায় থাকতেন, আমাদের বাড়িতে দু-একবার যদি বা থেকে গেছেন, বড় মাসির বাড়িতে কখনো না। মাসিমা তাঁর বঞ্চিত শৈশবের যত দাবি সব আমাদের ওপর মেটাতে চাইতেন। এখন মুশ্‌কিল হল যে ওঁদের কারো বেশি খিদেটিদে পেত না। দুপুরে বারোটায় পেটভরে ভাত খাবার পর, কারো যে চারটে বাজতে না বাজতে আবার খিদে পেতে পারে একথা মাসিমা ভাবতেই পারতেন না। অথচ আমাদের বেজায় খিদে পেত। বাড়িতে বিকেলে পাঁউরুটি, মোহনভোগ কিম্বা পাতলা পরটা আলু-কুমড়োর ছক্কা, নিদেন আলু পটল কুচি ভাজা দিয়ে মুড়ি খেয়ে আমাদের অভ্যাস। মাসির বাড়ি বিকেলে বড়রা এক পেয়ালা করে চা খেতেন; জলখাবারের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। এমন সময় দেখা গেল বাগানে অযত্নে বেল গাছে পাকা বেল, পেয়ারা গাছে ছোট ছোট মিষ্টি পেয়ারা। জামরুল গাছ, কামরাঙা গাছও ছিল, কিন্তু সে-সব হয়তো ঐ সময়ে ফলত না। জলখাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেল, আর আমাদের পায় কে! বাস্তবিকই নোটনের মতো সুন্দরী আজ পর্যন্ত দেখিনি। সোনার মতো গায়ের রঙ। আঙুরের থোকার মতো কোঁকড়া চুল আর মুখখানি যেন প্রাচীন গ্রীসের ডায়নার মূর্তি থেকে কেটে বসানো। আমি একটা পুরনো ফটোগ্রাফ দেখে ডায়নার মুখের নকল করেছিলাম; অবিকল নোটনের মুখ।

সত্যি বলছি মনের মধ্যে তখন আর এতটুকু হিংসে ছিল না। হিংসা হয় সমানে সমানে। যার সঙ্গে কোনো তুলনাই হতে পারে না, তাকে কি কখনো হিংসা করা যায়? নোটনের রূপের গর্ব করতাম আমরা। শুধু রূপ নয়, চমৎকার গাইত, পিয়ানো বাজাত, ছবি আঁকত। আমাদের পেয়ে বেজায় খুশি হত। তবে কাউকে বেশি ভালোবাসার ক্ষমতা বোধহয় ওর একটু কম ছিল। কিন্তু বড্ড ভালো ব্যবহার করত, সেই যথেষ্ট। আমার কাছে রাতে চুল বাঁধতে আসত। আমি ইচ্ছে করে চুলে তেল ঘষে, একটা সরু চিরুণী দিয়ে হেঁচড়ে কোঁকড়া চুলগুলোকে মাথার পেছনে উঁচু করে এক টাইট বেণী বেঁধে দিয়ে, মুখখানি ঘুরিয়ে দেখতাম, তবু পদ্মফুলের মতো রূপ ঝরে পড়ছে। সমস্ত মনটা গলে জল হয়ে যেত।

সুন্দরকে নোটন নিজেও বড় ভালোবাসত। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে ওর ভারি একটা প্রসন্নতা ছিল। একবার আমাকে বলেছিল, “ঠোঁটের তলার কোণে কুচকুচে কালো ছোট্ট গোল তিল থাকলে, মুখটা আরো সুন্দর দেখায়। ওকে বিউটি স্পট্ বলে।” আমি তখন পড়াশুনো করছিলাম, হাতে কুচকুচে কালো কাজল-কালি ভরা কলম ছিল। বললাম, “আয়, তোর মুখে আমি বিউটি-স্পট বানিয়ে দিই, আমার মুখে তুই দে।” নোটন ভারি খুশি হয়ে আমার মুখে খুদে একটি কালো তিল বানিয়ে বলল, “বাঃ, বেশ দেখাচ্ছে!” তখন আমি কলমটা নিয়ে ওর ঠোঁটের নিচে খুদে একটা মাকড়সা এঁকে দিলাম। যখন আটটা ঠ্যাং আঁকছি, ও একবার বলল, “অত খোঁচা খোঁচা কি করছ ভাই? গোল হবে না?” আমি বললাম, “হুঁ, হবে, কিন্তু এখানে তোর একটা টোল আছে কি না, তাই অসুবিধা হচ্ছে।” ছোটবেলায় নোটনকে কখনো মিছে কথা বলতে শুনিনি। আর কেউ যে বলতে পারে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। কাজেই মাকড়সা এঁকে আমি যখন তিলটার ভুরি-ভুরি প্রশংসা করতে লাগলাম; ও ভারি খুশি হয়ে বসে রইল। আয়নায় গিয়ে দেখল না পর্যন্ত। এমন সময় আমার মা এসে সব মাটি করে দিলেন। নোটনের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে শূন্যে খাম্চা মারতে লাগলেন। নোটন বলল, “ও রকম কচ্ছ কেন, মাসিমা?” মা বললেন, “ছোট্ট একটা মাকড়সা রে!” মাকড়সা শুনে নোটন আঁৎকে উঠল, মাকড়সাতে তার বড় ভয়। তার পরেই মা বললেন, “দাঁড়া দাঁড়া, এ যে আঁকা মাকড়সা দেখছি।” বলেই চোখ পাকিয়ে আমাকে বললেন, “নিশ্চয় তোর কাজ?” নোটন এহেন বিশ্বাসঘাতকতায় ব্যথিত, মর্মাহত। কত বললাম যে মাকড়সার কুপের পাশে ওর মুখটা আরো সুন্দর দেখাচ্ছে, তা কে শোনে!

তবু সে আমাকে ক্ষমা করেছিল। এখানে ওখানে অদ্ভুত কথা বলে বলত, “আমার লীলুদি বলেছে। তার চেয়ে তোমরা বেশি জান? সে ক্লাসে ফার্স্ট হয়।” এই নোটন আর তার মা হাসিমুখে আমাদের সঙ্গে ট্রেনে উঠে বসল। গাড়িটা আলো হয়ে রইল। মাসিমা অনেক চপ কাটলেট করে এনেছিলেন নৈশ ভোজের জন্য। আমরা লুচি, আলুর দম, ফল, মিষ্টি নিয়েছিলাম। বেশ জমেছিল। কিন্তু মাসিমার মনে সুখ ছিল না। সদাই নোটনকে নিয়ে ভাবনা। বাবাকে কেবলি বলছিলেন, “দেখ, মুখটা একটু ফ্যাকাশে মনে হচ্ছে না?” বাবা বললেন, “ফ্যাকাশে নয়, ফর্সা।” মাসিমা বললেন, “মোটে খিদে হয় না।” বাবা বললেন, “বেশ তো খেল।” মাসিমা বললেন, “কিন্তু খেলে আবার রাতে হাত পা জ্বালা করে। কি করা যায় বল তো?” বাবার তো আর কখনো ধৈর্যের জন্য খ্যাতি ছিল না। এবার বললেন, “কেটে ফেলে দে!” শৈশব থেকে চেনাশোনা, বাবা বড় শ্যালীকে তুই তোকারি করতেন। মাসিমা ফোঁস করে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চুপ করলেন। সকালে জল খাবারের সময় দেখা গেল আমাদের আলুর দমের গা থেকে গরমের চোটে লম্বা লম্বা শুঁয়ো-মতো বেরিয়েছে, কিন্তু মাসিমার বাকি চপ্-কাটলেট অক্ষত রয়েছে। মাসিমা আমাকে ঘরকন্নার পাঠ দিলেন, “গরম জিনিস কখনো এঁটে বন্ধ করে রাখতে হয় না। ঠাণ্ডা হলে বন্ধ করলে টপ্ করে নষ্ট হয় না।” এই পাঠ যে পরে আমার কত কাজে লেগেছিল সে আর কি বলব।

হাজারিবাগে ছুটিটা খুব জমেছিল। সেখানে তখন উপেন্দ্রকিশোরের মেজজামাই অরুণনাথ চক্রবর্তী আর আমার মেজদি পুণ্যলতা ছিলেন। অরুণবাবু ওখানকার এস ডি ও। আমাদের জন্য সুন্দর বিলিতী কায়দায় তৈরি বাংলো ভাড়া করে দিয়েছিলেন। রোজ একসঙ্গে বেড়ানো; এদিকে ওদিকে দর্শনীয় স্থান দেখতে যাওয়া, রামগড়, ভেড়া নদী আর দামোদরের সঙ্গমস্থলে ছিন্নমস্তার ভয়াবহ মন্দির। বড় আনন্দে দিন কেটেছিল। আরেকটা কারণে আমার কাছে হাজারিবাগ যাওয়ার গুরুত্ব ছিল। সেখানে একজন বড় সুন্দর মানুষকে দেখলাম। তাঁর নাম কামিনী রায়। অনাত্মীয়া লেখিকা এই আমি প্রথম দেখলাম। চমরুবাগ বলে ছোট্ট একটি বাড়িতে তাঁর পঙ্গু কিন্তু অতিশয় বুদ্ধিমান এক ছেলেকে নিয়ে কিছুদিন থেকে বাস করছিলেন। বয়স হয়তো ষাটের কাছাকাছি। ঠিক বলতে পারছি না। চুল পেকেছে, থান পরা, কথায়-বার্তায় বুদ্ধি ঝলকাচ্ছে। কিন্তু তার পেছনে কোনো গভীর দুঃখ রয়েছে, বুঝতে পারছিলাম। দেখবামাত্র আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। উনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। ওঁর লেখা অজস্র কবিতা পড়ে শোনাতেন। বলতেন দুটি বই হয়ে কবিতাগুলি প্রকাশিত হবে; এখন কে সেগুলি বেছে দেয়। ওঁর ছেলে মনাদা তখনো বি এ পড়ে, তার একার কর্ম নয়। আগ্রহের চোটে বলে বসলাম, “আমি দেব।” দিয়েছিলাম, তবে একা নয়। মনাদার ভারি সাহিত্যানুরাগ ছিল। মাকে নিয়ে তার ভারি গর্ব ছিল। দেখে ভালো লাগত। এর আগে আমাদের পাঠ্য পুস্তকে কামিনী রায়ের লেখা কবিতা পেয়েছিলাম। ইংরিজি কবিতার বাংলা রূপ। ‘নাই কি রে সুখ? নাই কি রে সুখ? এ ধরা কি শুধু বিষাদময়।’ সেটি হল লং ফেলোর, ‘টেল্ মি নট্ ইন্ মোর্ণফুল নাম্বার্স লাইফ ইজ্‌ বাট্‌ অ্যান এম্প্‌টি ড্রীম’ কবিতাটির বাংলা। সেই বয়স থেকেই আমি মৌলিক লেখার ভক্ত ছিলাম। অন্যের রচনা নিয়ে তাতে নিজের রঙ-ব্যাখ্যানা দিয়ে লেখা সম্বন্ধে আমার উৎসাহ ছিল না। তাই মনের মধ্যে কামিনী রায়কে বিশেষ স্থান দিইনি। এবার বুঝলাম তাঁর প্রতি অবিচার করেছিলাম। অপূর্ব সব মৌলিক রচনা আছে তাঁর। ‘দীপ ও ধূপ’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে আছে সেসব।

বিশেষ করে একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে। কামিনী রায়ের তখনো বিবাহ হয়নি, সবাই তাঁকে কামিনী সেন বলে জানত। একদিন তাঁরা জগদীশ বসুর পরীক্ষাগারে গিয়ে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে এক ফোঁটা ময়লা জল দেখেছিলেন। তাতে প্রাণ-কণিকা ঝিকমিক করছে। তাই নিয়ে কবিতা। শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। অনেক পরে আবার ওটি পড়ে সমান ভালো লেগেছিল। খুব ইচ্ছা করত কবিতা লিখতে। কলেজের ম্যাগাজিনে ইংরিজিতে কিছু কিছু লিখে প্রশংসাও পেয়েছিলাম। কিন্তু নিজে জানতাম সেরকম কিছু হয়নি। এবার থেকে বাংলায় কবিতা লিখবার চেষ্টা করতাম। একটা খাতায়। সেটিকে ভরিয়ে ফেলে আরেকটা শুরু করেছিলাম। সুখের বিষয় ততদিনে মাস ছয় কেটে গেছিল এবং আমার জ্ঞান-চক্ষু ফুটে গেছিল। কাব্য আমার পন্থা নয়। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে রস তো আর কবিতায় সীমাবদ্ধ নয়, অন্য পন্থাও আছে। কিন্তু আমি কখনো কবি হব না, একথা জেনে মনে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। এখন ভাবি অন্য লোকে সেকথা আবিষ্কার করবার আগে আমি নিজেই যে করেছিলাম সে আমার বহু ভাগ্য। তবে একেবারে যে কবিতা লিখি না তা নয়। আমার নাটক ইত্যাদিতে অনেক কবিতা, মায় গান পর্যন্ত লিখেছি। তবে সে সবই আজগুবি, উদ্ভট, স্রেফ মজা করে লেখা। তাকে কাব্য বলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *