॥ ১০ ॥
তারপর ত্রিশ বছর দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে কেটে গেল, ভাবলেও অবাক হই। সেদিন ভোরে উঠে বালিগঞ্জে ভাইবোনদের বাড়িতে দরজা পিটিয়ে তাদের তুলে ঐ সংবাদ দেবার কথা ভোলা যায় না। ঘুম-জড়ানো চোখে ওরা যেন ঠিক বুঝতেই পারছিল না। ততদিনে চতুর্থ ভাই সরোজ বিলেতে গুছিয়ে বসেছে, লতিকা তো ডাও হিলের অধ্যক্ষা, ছোট ভাই যতির আলাদা সংসার, বাকি সব তখনো ৬৮বি যতীন দাশ রোডে পরস্পরকে অবলম্বন করে রয়েছে।
সকাল আটটার প্লেনে দাদা, দিদি, আমি রওনা হয়ে গেলাম। আর সকলের স্কুল, কলেজ, চাকরি বাকরি। দাদা দিদিও চাকুরে মানুষ, কি সব ব্যবস্থা করে রওনা হল। প্লেন থেকে চারদিকে চেয়ে দেখি আকাশে তেমনি রোদ আর মেঘের খেলা, নিচে তেমনি ধানক্ষেতের ওপর আলোছায়ার কাঁথা পাতা। উড়োজাহাজে সেকালে চমৎকার প্রাতরাশ দিত। দাদা, দিদি হতাশ ভাবে চেয়ে রইল। কেমন যেন মনে জোর পেলাম। কাছাকাছি বয়সী আমরা তিনজন। বললাম ‘খাও, যা পার, সেখানে পৌঁছে শরীর মনের শক্তির দরকার হবে।’
বাগডোগরা থেকে ছোট মোটর আমাদের কার্সিয়ং-এ নামিয়ে দিল। লতিকা ওরি মধ্যে ফোন করে গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সেই চেনা কার্সিয়ং স্টেশন। সেখানে ডাও হিল্ স্কুলের বড় দারোয়ান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার হাতে ধূপ কাঠি, ফুলের মালা, এইসব। কেমন যেন গলায় একটু ব্যথা করে উঠেছিল। সে-রকম কান্নাটান্না আসে না আমার। সেই চেনা পথে, পাহাড়ের মাথায় একটু পিছু হটে আবার স্পীড দিয়ে খাড়াইটুকু উঠে, অধ্যক্ষার সুন্দর বাড়ির সামনে পৌঁছলাম।
ভাবছিলাম লতিকা এই দুঃসময়ে একেবারে একা। দেখলাম সে ভাবনা অমূলক। বাড়ি ভরা সমব্যথী নরনারী। ফিরিঙ্গি, বাঙ্গালী, নেপালী। কারা সব অনাত্মীয় পরম আপন জনরা ফুল দিয়ে মাকে চমৎকার করে সাজিয়ে দিয়েছে। মার ভগবানে গভীর বিশ্বাস ছিল, উপাসনা ভালোবাসতেন। বলতেন আত্মার সদ্গতি হয় কি না বলা যায় না, ভগবানও খোশামুদিকে ভোলেন না, কিন্তু মনে সান্ত্বনা পাওয়া যায়। আজ মা চলে যাবার আগে কে ভগবানের নাম করবে? দাদা, দিদি বোবা। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। তখন নিচের রোমান ক্যাথলিক মঠের অল্পবয়সী সাধু ফাদার চার্লস্ বললেন, ‘আমি ভগবানের নাম করলে হবে না? তিনি তো একজনই।’ লতিকা হাতে চাঁদ পেল। হাঁটু গেড়ে বসে ফাদার চার্লস্ মধুর ভাষায় সেই এক ভগবানকেই ডাকলেন। দেখি সকলের চোখে জল।
সারা দিন বৃষ্টি পড়েছিল। বেলা তিনটেয় শ্মশানযাত্রীরা রওনা হল। তখনো টিপটিপ পড়ছে, কিন্তু আর দেরি করলে রাত হয়ে যাবে। অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। দাদা গেল। আমরা তিন বোন বাড়ির সামনের চাতালে দাঁড়িয়ে দেখলাম পাহাড়ি পথ দিয়ে এঁকে বেঁকে গম্ভীর এক শোভাযাত্রা চলেছে। ফুল নিয়ে চলেছে কত লোক, মঠ থেকে পাঠানো সাদা অর্কিড ফুলের মস্ত ক্রুসটিও ছিল সেই শোভাযাত্রায়। সবার পিছনে হয় তো পঞ্চাশ ষাটজন স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসী, প্রত্যেকের কাঁধে ছোট এক বোঁচকা কাঠ। জিজ্ঞাসা করাতে বলল, ‘এমন দয়ালু মানুষের চিতায় কাঠ জোগালে পূণ্য হয়।’ কেন জানি মনটা একটু ভালো হয়ে গেল।
ভালোভাবে কাজ সম্পন্ন করে সন্ধ্যার সময় দাদা ফিরে এল। গরম জলে স্নান করে, চোখ মুছতে মুছতে-বিষ্ণু এসে বলল, ‘রাতেও না খেলে মা কি বলতেন? যা হয় করি।’ তা-ও করতে হল না। স্কুলের সুন্দরী অঙ্কের শিক্ষিকা নিজে ভাতেভাত রেঁধে পাঠালেন। ওখানে উনিই একমাত্র বাঙ্গালী টিচার ছিলেন। এমনি করে সে দিনটা কেটে গেল। এ-সব কোনো না কোনো সময়ে সকলের পরিবারেই হয়ে থাকে, নিজেদের বেলায় মন জুড়ে বসে। মনে আছে তার পরের রবিবার ওখানকার প্রটেস্টান্ট গির্জায় মার নামে বিশেষ উপাসনা হল। উপাসনা-ঘরে লোকে লোকারণ্য। খৃষ্টীয় পদ্ধতি এমনি উদার যে ঐ প্রার্থনাগুলি হল যে কোনো ধর্মাবলম্বীরই মনের মতো কথা। আলাদা করে কোথাও যীশুর নাম করা নেই। বড় ভালো লেগেছিল। তারপর দিন দাদা দিদির ছুটি ফুরিয়ে গেল, তারা নেমে গেল। আমি বেকার-যুবক, আমার ছুটির দরখাস্ত করতে হয় না। মার সংসার যথাসম্ভব তুলে দিয়ে লতিকার সঙ্গে দিন সাতেক পরে ফিরলাম। লতিকাকে আবার গিয়ে শীতের ছুটি অবধি কর্মভার তুলে নিতে হবে। তারপর তার বিলেত যাওয়া সব ঠিক। খালি জানুয়ারির ঘোর শীতে একবার গিয়ে চার্জ বুঝিয়ে দিতে হবে।
এরপর ত্রিশ বছর কেটে গেছে, আর ডাও হিল্ যাইনি, কার্সিয়ং যাইনি। এখন নাকি সব বদলে গেছে। ঐ রোমান ক্যাথলিক মঠটিও আর নেই। স্কুলে ফিরিঙ্গিদের প্রাধান্যও নেই। পঃ বাংলা সরকার পরিচালিত, ইংরিজি মাধ্যমের মোটামুটি ভালো একটি স্কুলমাত্র।
১৯৫২-তে বয়স আমার চুয়াল্লিশ; জীবনের অর্ধেকের বেশি কেটে গেছে; বই বেরিয়েছে পাঁচটি; ছোটদের বড়দের গল্প প্রবন্ধ বেরিয়েছে বেশ কিছু; রেডিওতে গল্প বলি, রম্যরচনা পড়ি; লক্ষ্য করি লোকে বড় সরস জিনিস ভালোবাসে, যদিও দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রায় সবই দুঃখকে অবলম্বন করে থাকে। ভাবি দৈনন্দিন জীবনের বেদনা-ব্যর্থতা-হতাশায় ক্লিষ্ট সাধারণ মানুষরা একটু আনন্দের, একটু হাসির খোরাক চায়। তাই বলে জোর করে লোক হাসাতে বসি না, সরস কথাগুলো আপনি আসে কলমের আগায়। আগে ভাবতাম বড়দের জন্যেই বেশি লিখব। ক্রমে মনটা ছোটদের দিকে ঝুঁকতে লাগল। আসলে দুঃখকে আমি অস্বীকার করি না, দুঃখে বড় বেশি বেদনা বোধ করি, তাই ভাবি এদের মনের মধ্যে এমন কিছু আনন্দের খোরাক থাক, যার জোরে দুঃখেরো সম্মুখীন হবার বল পাবে। নিভৃত নিশীথের জন্য কান্নাগুলো থাক।
ক্রমে বেতারের সঙ্গে সম্বন্ধটি আরো ঘনিষ্ঠ হল। কিছু দিন মহিলাদের ও ছোটদের বিভাগ পরিচালনাও করেছিলাম। সে সময় একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম। বেশি শিক্ষিত বা কম শিক্ষিত প্রায় সব মহিলাই ঘরকন্নার বুকে বাস করেন বটে, কিন্তু ঘরকন্নার ওপর হাড়ে চটা। মনে একটা বাসনা ছিল এই সব আলোকপ্রাপ্তা নারীদের দিয়ে যদি শিশুপালন, রান্নাবান্না, সেলাইবোনা, ঘর-সাজানোর কথা বলাই, তাহলে বিষয়গুলি বেশি কার্যকরী এবং চিত্তাকর্ষক হবে। কাজেই দেখলাম দু-চারজন অসাধারণ মেয়ে ছাড়া— (যেমন ডঃ রমা চৌধুরী, বা নলিনী দাশ, বা কল্যাণী কার্লেকর, যাঁদের বিশেষ কৃতিত্ব সংসারের বাইরে!!)—অন্য শিক্ষিত মহিলারা দুটো প্রোগ্রাম করবার পর অভিমান করে বলেন, ‘কেন আমরা কি “বঙ্কিমচন্দ্রের নারী চরিত্র”, কিম্বা “রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে নারীর ভূমিকা,” বা ঐ রকম কোনো বিষয়ে বলবার যোগ্য নই? কিছুতেই তাঁদের বোঝাতে পারিনি বইয়ের চরিত্রের চেয়ে ঘরের গিন্নিদের ভূমিকার অনেক বেশি গুরুত্ব। তাদের কথা ভালো করে বলবার লোক পাওয়া যায় না। তা কে শোনে।
পরে যখন বেতারের প্রযোজক হয়েছিলাম, তখনো এই ব্যর্থতার দিকটা লক্ষ্য করেছিলাম। এর একটা মজার দিক-ও আছে। ঐ যে-সব উচ্চশিক্ষিতা অসাধারণ মেয়েদের কথা বললাম তাদের মধ্যে কয়েকজন মহিলা চিকিৎসকও ছিলেন, তাঁরা কিন্তু আনন্দের সঙ্গে এবং অতি দক্ষভাবে শিশু-পালন, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বলতেন। এখন মনে হয়, সেই কথিকাগুলো সংগ্রহ করে বেতার বিভাগ চমৎকার এক বই করতে পারতেন। কারণ চুক্তিপত্রে লেখা থাকত রচনাগুলি বেতারের সম্পত্তি হয়ে গেল। যে রকম আজেবাজে ব্যাপারে বেতার দিস্তা দিস্তা নোট, স্মরণিকা ইত্যাদি প্রকাশ করেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে হতভাগ্য লেখক আর প্রকাশকদের মতো কাজের জন্য তাঁদের হা-পিত্যেশ করতে হয় না। আর কেন্দ্রীয় সরকারের যে যা-খুশি তাই ছেপে বের করবার খুব সুবিধা আছে সে তো দেখাই যাচ্ছে। অর্থাৎ সামান্য খরচে বেতার একটা লাভজনক সুযোগ হেলায় হারাচ্ছে।
এতে আরেকটা মজার কথা মনে পড়ল। তার সাল তারিখ মনে নেই। বেতার থেকে আমাকে অনুরোধ করা হল যে হপ্তায় এক দিন করে ধারাবাহিকভাবে একটি করে ৯ মিনিটের ভাষণ দিতে হবে। দুপুরে মহিলামহলে। বিষয়বস্তু হল একজন মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ মেয়েকে ১১/১২ বছর বয়স থেকে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত সাধারণতঃ যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কি ভাবে তার মোকাবিলা করা যেতে পাবে। শুনে আমি মহা খুশি। দুপুরের মহিলামহলে ভাষণ দিতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। অবিশ্যি আমার প্রিয় বান্ধবী মৈত্রেয়ী দেবী একবার মহিলাহলে ভাষণ দেবার আমন্ত্রণ পত্রটি ফিরিয়ে দেবার সময়ে খাশা এক চিঠিও লিখেছিলেন, সে কথা না বলে পারছি না। তিনি বলেছিলেন আধা-ঘুমন্ত শ্ৰোত্রীদের কাছে বক্তৃতা করে তাঁর কোনো সাধ নেই। কথাটা অনেকখানি সত্যি হলেও, বক্তব্যটি প্রযোজ্য শুধুমাত্র উচ্চমধ্যবিত্ত মেয়েদের প্রতি। আমার মনে হয় বেতারের মহিলামহল মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তদের বেশি কাজে লাগে। তাঁদের কাছ থেকে কত উৎসাহ, কত কৌতূহল ভরা চিঠি পরে আমি পেয়েছি তার ঠিক নেই।
সে যাই হক ‘ঠাকুমার চিঠি’ ধারাবাহিক ভাবে মহিলামহলে প্রচারিত হল। সঙ্গে সঙ্গে তার সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়াও দেখলাম। বাংলাদেশ থেকে পর্যন্ত শ্রোতারা চিঠি লিখলেন। ঠাকুমার নাতনিটিকে ১১ বছর বয়স থেকে আগলে আগলে, একেবারে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে ছাড়লাম। অমনি প্রকাশকরা ছেঁকে ধরলেন। চুক্তিপত্রের পিঠের দিকে ছিল বেতারের অনুমতি ছাড়া ছাপা যাবে না। বন্ধুরা এবং বেতারের সহানুভূতিশীল কর্মীরা বললেন, এটা একটা ফর্ম্যালিটি মাত্র, এ-সব ভাষণ দিয়ে বেতার কি করবে? দিলাম পরামর্শমতো কলকাতার স্টেশন ডিরেকটরের প্রযত্নে সরাসরি দিল্লিীর হেডঅপিসে ডিরেক্টর জেনারেল মশাইকে ছাপার অনুমতি চেয়ে একটা দরখাস্ত ঠুকে। তারপর আর কোনো কথাবার্তা নেই। আমি নিজেও প্রায় ভুলেই গেলাম ব্যাপারটা। প্রকাশক মাঝেমাঝে তাগাদা দেন, শ্রোতাদের মনে থাকতে থাকতে বইটি বেরুলে বিক্রির সুবিধা হত। কিন্তু বেতার আপিস থেকে আমার কোনো স্মারকলিপির জবাব আসে না। এই রকম এক তরফা পত্রালাপের মাঝেমাঝে কিন্তু মাসে একবার ছোটদের আসরে, মহিলামহলে, সাহিত্যবাসরে নিয়মিত ভাষণ দিয়ে কুড়ি টাকা করে মুনাফা পেয়ে আসছি। সেটা যে কিছু কম তাও আমার মনে হত না। এই ভাবে কয়েক মাস ছেড়ে কয়েক বছর কেটে গেল। তার মধ্যে খবর পেলাম আমার দরখাস্তটিকে সুব্যবস্থার জন্য স্থানীয় মহিলা-মহলের কর্মাধিকারীকে দেওয়া হয়েছে। তিনি যে কিছু দিনের মতো বিলেতে গেছেন সে-কথা আর কেউ বলল না।
তারপর ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লি থেকে স্বয়ং ডিরেকটর জেনারেল আমাকে চায়ে নিমন্ত্রণ করে প্রস্তাব করলেন আমি যেন বেতারের একজন প্রযোজক হই। অনেক দোমনা করে, তর্কাতর্কি করে, শেষটা এপ্রিল মাসে কাজে যোগ দিয়েই আমার সেই দরখাস্তর তদন্ত করলাম। তখন ঐ ফাইল অন্য লোকের হাতে, স্টেশন ডিরেকটরের সহযোগিতায় আবিষ্কার হল দরখাস্তটি সযত্নে ফাইল করেই সেই ব্যক্তি বিলেত গেছিলেন। অনতিবিলম্বে ফিরে এসে যা যা করণীয় সব করেও ফেললেন। আমি ও আমার প্রকাশক স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। প্রকাশক আমার সঙ্গে চুক্তিপত্র ও অগ্রিম কিছু টাকাকড়ি দিয়ে ছাপার তোড়জোড় শুরু করলেন। বারবার বলে দিলাম অনুমতিপত্র না পৌঁছনো অবধি যেন ছাপার কাজ শুরু না হয়।
এবার অল্প সময়ের মধ্যেই কেন্দ্র থেকে দরখাস্তর উত্তর এল। স্টেশন ডিরেকটরের নামে চিঠি, আমাকে কপি। তার মর্ম হল যে পাণ্ডুলিপিকে যখন গল্প উপন্যাস বলা যায় না, তখন তার মালিক লেখক নয়, স্বয়ং আকাশবাণী। অতএব ঐ পাণ্ডুলিপি নিলামের ব্যবস্থা হয় এবং যে প্রকাশক সব চেয়ে বেশি হারে রয়েল্টি দেবেন, তাঁকেই ছাপতে দেওয়া হক। তিনি যদি দয়া করে ঐ রয়েল্টির ওপর আরো কিছু লেখককে দিতে চান, তাহলে অবিশ্যি বেতারের আপত্তি নেই। আমি তো তাজ্জব বনে গেলাম! বিপদে-আপদে প্রযোজকদের পরামর্শদাতা প্রেমেন্দ্র মিত্রও সময় বুঝে জ্বরে পড়েছেন! অগত্যা যে পদাধিকারীর হাতে ঐ ফাইল, শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছেই যেতে হল।
তাঁর নাম ছিল বিমল চক্রবর্তী, বয়সে আমার চেয়ে কিছু বড় হবেন। কালো, লম্বা এবং আমার ধারণা ছিল প্রযোজকদের প্রতি তাঁর সহানুভূতির যথেষ্ট অভাব আছে। তাই এই ক-মাস তাঁকে এড়িয়েই চলেছিলাম। এবার দেখলাম আমার সে ধারণা একেবারে ভুল। বিমলদার পরিস্থিতিটা ভালো করেই জানা ছিল। বললেন, ‘এ ব্যবস্থায় আপনি কি খুব সন্তুষ্ট?’ আমি চুপ করে রইলাম। বিমলদা বললেন, ‘কিন্তু বইটা বোধ হয় ছাপাবার ইচ্ছাও আছে?’ আমি বললাম, ‘হুঁ।’ বিমলদা বললেন, ‘আমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই সাত তাড়াতাড়ি বড়কর্তাদের কাছে অনুমতি চেয়ে বসার কি মানে?’ বললাম ৪১/২ বছর আগে চেয়েছিলাম।
তিনি মুচ্কি হাসলেন। তাঁকে আর কিছু বলে দিতে হল না। বললেন, ‘কলম আছে?’ কলম ছিল। একটা সাদা কাগজ দিয়ে বললেন, ‘যেমন বলছি লিখুন।’ কাকে লিখতে হবে, কি ভাবে বিনয় করে লিখতে হবে, সব শুনে আমি বড়কর্তাকে চিঠি লিখলাম যে ৫ বছর আগে দরখাস্ত করার পর আমার মত বদ্লেছে। ওভাবে ঐ পাণ্ডুলিপি ছাপার আমার আর আগ্রহ নেই। এ বিষয়ে এত কষ্ট দিলাম বলে আমি দুঃখিত। ইতি।
তারপর বিমলদা আমার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বললেন, ‘যান, এবার কষ্ট করে লেখা সুন্দর পাণ্ডুলিপির টেক্স্ট্ একটু বদলে, নাম বদলে ছাপুন গিয়ে। অবিকল এই টেক্সট দেবেন না। আমিও ফাইলটা বন্ধ করে দিই। বাঁচা গেল। নিলাম করতে হলে তো আমার ঘাড়েই পড়ত।’ তারপর আরেকটু হেসে বললেন, ‘সবচেয়ে মজা কি জানেন, ঐ পাণ্ডুলিপি একমাত্র আপনার কাছেই আছে। আমাদের কপি সম্ভবত কোনকালে সেরদরে বিক্রি হয়ে গেছে, নইলে অত পুরনো পাণ্ডুলিপি জমা রাখবার জায়গা কোথায়?’ মনে আছে ঘরসুদ্ধ সকলে খুব হেসেছিলাম আর ক্যান্টিন থেকে চা আনিয়ে খেয়েছিলাম। তার চেয়েও বড় লাভ হল বিমলদার কাঠখোট্টা বাইরেটা ভিতরে স্নেহশীল অন্তরটা দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম। ৭ বছর রেডিওতে ছিলাম, তাঁর স্নেহের বহু নিদর্শন পেয়েছিলাম। এই স্বীকৃতিটুকু তাঁকে না দিলে আমার অন্যায় হবে। তিনি বোধ হয় আর ইহলোকে নেই। তাছাড়া বেতার সেরেস্তার মেজাজমর্জি বিষয়ও খানিকটা সরস জ্ঞান লাভ করলাম।
ঐ পাণ্ডুলিপিই কিঞ্চিৎ শোধন করে ‘মণিমালা’ নামে এশিয়া পাবলিশিং ছেপেছিলেন। চারটে সংস্করণও হয়েছে।
এ-সমস্ত হল পরের কথা। তার আগে শান্তিনিকেতনে আমাদের আবাসনের কথা বলতে হয়। হয়তো ১৯৫৩ সালে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখলেন শান্তিনিকেতনের পূর্বাঞ্চলে সহৃদয় বন্ধু ও সহানুভূতিশীল বিশ্বভারতীর আজীবন সভ্যদের নামমাত্র দামে দু-বিঘা করে জমি দেবার প্রস্তাব হয়েছে, বাড়ি করার উদ্দেশ্যে। আমাদের যদি আগ্রহ থাকে ইত্যাদি। আগ্রহ আমার যথেষ্টই ছিল। অনেকবার আমরা ভেবেছি শহরের কোলাহলের বাইরে একটা আস্তানা থাকলে বেশ হয়। তার পক্ষে শান্তিনিকেতনই সবচেয়ে প্রশস্ত। আমার স্বামী বললেন, অবিশ্যি ঐ পরিকল্পনার ৯৯ বছরের লীজ্ না নিয়ে, আলাদা একটা জমি বরাবরের মতো কিনে ফেললেই তো হয়। তাই করা হল। উত্তরায়ণের উত্তরে শ্যামবাটির লাগোয়া জমি কেনা হল। আমার উৎসাহ দেখে কে! নিজে বাড়ির প্ল্যান করলাম। তাকে নিখুঁৎ বলা কোনো মতেই চলে না। কারণ ভিৎ করলাম দোতলার, কিন্তু ওপরে ওঠার সিঁড়ির জায়গা রাখলাম না! বাড়ির কেউ, কিম্বা কনট্র্যাকটররাও কিছু বলল না। কনট্র্যাকটর মানে পণ্ডিত জগদানন্দ রায়ের দুই নাতি, অনু আর রেন্টু তাদের ডাকনাম। এককালে ওরা আমার ছাত্র ছিল, কম শাসন-ও করিনি। খুব লক্ষ্মী ছেলে ছিল না। তারাই এখন আমাদের বাড়ি করল। এবং প্রাণ দিয়ে করল বললেও কম বলা হবে। সেই ১৯৫৪ সাল থেকে, আজীবন তারা আমাদের শান্তিনিকেতনের আবাসের এবং সংসারের যাবতীয় ঝামেলা হাসিমুখে বহন করেছিল। তিন বছর আগে রেন্টু গেল, গত বছর অনুও গেল। আমার আগে ওরা যাবে, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। অনু বিয়ে করেনি। রেন্টুর স্ত্রী লিলি হাসি মুখে আর বুকভরা সাহস নিয়ে তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করছে। বড় মেয়ের বিয়েও দিয়েছে। তারা আমাদের নিতান্ত আপনজন। এসব সম্পর্ককে আমি জীবনপথের বাড়তি মুনাফা বলে মনে করি।
সপ্তাহে একবার করে সকালের গাড়িতে এসে বাড়ি তৈরি বিষয়ে ওদের সঙ্গে পরামর্শ করে, অনেক সময় সেই দিনই বিকেলের গাড়িতে বা পরদিন সকালের গাড়িতে কলকাতা ফিরতাম। এমন দক্ষ এবং সৎ কনট্র্যাকটর কি করে হতে পারে ভাবতে পারি না। বাড়ির নক্সা হল, ঠিক যে ক-টি টাকায় রফা হল, তার চেয়ে এক পয়সা বেশি নিল না। ৬ মাসের বদলে শেষ করতে ৮ মাস লাগল, তাই আমার স্বামীর কাছে বকুনিও খেল। তবু এতটুকু ক্ষোভ নেই। এই মানুষ দুটি চিরদিনের মতো আমার ছোট ভাইয়ের স্থান নিয়ে ফেলল। শুনেছি শত্রুকে যদি মন্দ করতে চাও, তাহলে তাকে একটা বাড়ি করতে লাগিয়ে দিও। তার চেয়ে ভালো সাজা আর হয় না। আমি কিন্তু আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়ি তৈরির ব্যাপারটা ভারি উপভোগ করেছি।
প্রায় হপ্তায় হপ্তায় যেতাম, আমার বন্ধু বুবুর বাড়িতে উঠতাম। সে ততদিনে অমন দেবতুল্য স্বামীটিকে হারিয়ে, আশ্চর্য সাহস দেখিয়ে পাঠভবনে অধ্যাপনা করে ছেলেমেয়ে মানুষ করছে। ওদের বাড়ির মাথা হলেন ওর পিসি শাশুড়ি ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, সকলের বিবিদি। পিসিশাশুড়িও যেমন, তেমনি আপন জেঠিও বটে। দুজনে মিলে চারটি ছেলেমেয়েকে সুন্দর ভাবে মানুষ করেছেন। তখন সকলে স্কুলে পড়ে, বিবিদির তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্র সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরি হয়, আলাপিনী নামক মহিলাসমিতির মিটিং বসে। এক কথায় বাড়িতে নরক গুলজার। তার মধ্যে আমার মতো একটা বাড়তি মানুষ খবর না দিয়ে, যখন তখন উপস্থিত হলে ওদের কোনো অসুবিধে হলেও, আমি টের পেতাম না। এ সব ব্যাপার ঘটছে ১৯৫৪ সালে। আমি তখনো রেডিওতে যোগ দিইনি।
মজার মজার ঘটনা ঘটত। একদিনের কথা অনেক জায়গায় বলেছি। সে দিন সন্ধ্যার ট্রেন লেট করাতে বুবুদের বাড়িতে যখন পৌঁছেছি, ওরা তখন খেতে বসেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা বাড়তি জায়গা হয়ে গেল। হাত মুখ ধুয়ে হাসিমুখে টেবিলে বসেই, পরিস্থিতির থমথমে ভাবটা চোখে পড়ল। আমাকে স্বাগত জানিয়ে ক্ষণিক বিরতির পর বুবু তার বড় ছেলেকে বলল, ‘আমি তোমার মা হতে পারি, তার জন্য আমার সব কর্তব্য পালনেও প্রস্তুত আছ, কিন্তু তাই বলে তোমার জন্যে হাতে হাতকড়া পরে থানায় যেতে রাজি নই।’
এ কথা শুনে সুন্দর মুখটা লালটাল করে ছেলে বলল, ‘আমি বন্দুক দিয়ে পাখি মারলে তোমাকে থানায় যেতে হবে? বুবু বলল, ‘পাখি না, মানুষ মারলে। অমুক সময় অমুকের ছেলে কি করেছিল ভুলে গেছ?’ ছেলে গরম হয়ে বলল, ‘আমার ওপর কি তোমার এতটুকু আস্থাও নেই?’ বুবু বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে বলল, ‘না, নেই।’ অমনি ছেলে হড়হড় করে চেয়ার ঠেলে নিজের ঘরে দোর দিল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম হাত পর্যন্ত ধুল না। বুবুও তার চেয়ার ঠেলে শয্যা নিল। অবিশ্যি হাতমুখ ধুয়ে।
তখন বাকিরা উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘কাছে এসো লীলামাসি, আমরা খাওয়াদাওয়া করি।’ এতক্ষণ যে মানুষটি সংলাপে যোগ দেবার কোনো চেষ্টা না করে পেয়ালায় সূপের বড়ি ঘুঁটছিলেন, তিনি এবার মুখ তুলে তাকালেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ঐ বন্দুকটা তবে কার?’ বিবিদি বললেন, ‘আমার। মানে আমার স্বামীর ছিল, এখন হয় তো আমার।’ বললাম, ‘ওর লাইসেন্স নেই বুঝি?’ বিবিদি সূপ ঘুঁটতে ঘুঁটতে বললেন, ‘তা থাকতেও পারে। ঠিক বলতে পারছি না। ওটা কিনা পূর্ব পাকিস্তানেই আছে, আবার কোনো সম্ভাবনাও নেই।’ এই বলে একবার মুচকি হেসে, ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া সূপটা চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেললেন। আরেকদিন আরেক মজা। আমাদের বাড়ি শুরু করার সময় আমাদেরি এক বিদেশী বান্ধবীর বাড়ি অনুরেন্টুরা প্রায় শেষ করে আনছিল। সামান্যও ইদিক উদিক বাকি ছিল। আমাদের ভিৎ গাঁথার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো হচ্ছিল। এর মধ্যে একদিন চিন্তিত মুখে রেন্টু এসে বলল, ‘আপনার বান্ধবী এক কি অদ্ভুত ফরমায়েস করে পাঠিয়েছেন, আমি তো মানেই বুঝতে পারছি না। এতে খরচও তো অনেক পড়ে যাবে।’
কি ব্যাপার? না, তিনি বলে পাঠিয়েছেন তাঁর প্রত্যেক ঘরে দুটো করে ফিরিঙ্গি বসিয়ে দিতে হবে। অনুদের মহা ভাবনা, এত ফিরিঙ্গিই বা এখানে কোথায় পাবে আর তারা বসতে রাজিই বা হবে কেন? পরে বোঝা গেল ফিরিঙ্গি নয়, দিদিমণি জাফ্রি দেওয়া ঘুলঘুলি চান, যাতে ঘরে আলো-হাওয়া ঢোকে। জাফ্রি বলতে কাফ্রি মনে হয় আর কাফ্রি বলতে ফিরিঙ্গি! দিদিমণি তাই ভুলে ফিরিঙ্গি চেয়ে বসেছিলেন!
ছোট ছোট মজার স্মৃতি, কিন্তু তাই দিয়েই জীবনের রসের পাত্র ভরে থাকে। এর আগে একদিন বুবুর ছোট মেয়ে ঈশিতাকে কবি কান্তি ঘোষ চায়ের নেমন্তন্ন করেছিলেন। তা মেয়ে গিয়ে তার মাকে বলল ‘আমাকে একটা ভালো ফ্রক্ পরিয়ে দাও, মা।’ মা বললেন ‘কেন রে?’ মেয়ে বলল, ‘বাঃ, আমি যে কান্তিদাদুর এলিফ্যান্ট!’ শুনে সবাই অবাক! শেষটা বোঝা গেল কান্তিদাদু ওকে বলেন ওঁর ‘গার্ল-ফ্রেণ্ড’। সেই থেকেই এলিফ্যান্ট! এ-সব ঘটনার পর ত্রিশ বছর কেটে গেছে। কান্তি ঘোষ, তাঁর বিদেশী স্ত্রী এটা ঘোষ কবে স্বর্গে গেছেন। ঐ বাড়িতে অন্য লোকে বাস করে। ঈশিতা কলকাতায় গিন্নিবান্নি হয়ে অধ্যাপনা করে। কিন্তু আজও আমাদের বাড়ির ঠিক উত্তর দিকে ঐ বাড়ির দিকে তাকালে আমার মাঝে মাঝে কান্তিদাদুর এলিফ্যান্টের কথা মনে পড়ে আর মনটা ভালো হয়ে যায়।
সে যাই হক, ক্রমে বাড়ির কাজ এগুতে লাগল। আমার সাহিত্য-সেবা শিকেয় তোলা রইল। সামনের ১০ ফুট চওড়া বারান্দার নক্সা বদলে, নন্দলালের ২০ ফুট চওড়া দক্ষিণের বারান্দার নকলে বারান্দা হল। সে বারান্দায় প্রায় ত্রিশ বছর ধরে আমরা কত যে আনন্দানুষ্ঠান, কত যে প্রীতির মিলন, নিভৃত আলাপন, উপভোগ করেছি তার ঠিক নেই। মাস্টার মশায়ের ওয়ারিশরা তাদের বারান্দাটি গ্রিল দিয়ে ঘিরে ঘরের মতো করে ফেলেছে। কিন্তু আমাদেরটার মাথার ওপর আমরা বুগনভিলিয়া লতা তুলে দিয়েছি। তার ফুলের বাহার আমার অবিস্মরণীয়, অসাধারণ মাস্টার মশায়ের কথা বহন করছে। এ বছরও তাঁর জন্মের শতবর্ষপূর্তি উৎসবে গাছ ভরে শাদা লাল ফুল ফুটেছে। রেশমী কাপড় ছিঁড়ে যায়, গয়নাগাঁটি চোরে নেয়, কিন্তু এ-সব এমন জিনিস যা কেউ নিতে পারে না।
বাড়ি শেষ হয়ে এল, বসবার ঘরের জানলায় নক্সাকাটা গ্রিল্ লাগানো হবে। সে সব তখন কলকাতা থেকে করিয়ে আনতে হত। এক দিন দানাপুর প্যাসেঞ্জারে একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর (অর্থাৎ সেকালের দ্বিতীয় শ্রেণীর। এখনকার প্রথম শ্রেণীর চেয়েও ঢের ভালো!) কামরায় আমার ছোট স্যুটকেসের সঙ্গে ঐ ৫ ফুট x ৩ ফুট গ্রিলের চারটি অংশ আমার স্বামী তুলে দিলেন। পাছে আমার ঝামেলা হয়, তাই সেগুলো ওজন করে, পয়সা দিয়ে, টিকিট লাগিয়ে, তবে তোলা হল। তবু একজন কর্মচারি আপত্তি করছিলেন, কম্পার্টমেন্টে কি নেওয়া উচিত? এখানে শুধু ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস নেবার কথা। বাকি সব যাবে ব্রেকে। আমার স্বামী বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘এগুলো তো আমার গিন্নির ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য।’ কর্মচারি আশ্বস্ত হলেন, ‘ও, তাই নাকি? তাহলে ঠিক আছে।’
জিনিস নিয়ে তো রওনা হলাম। সমস্যা হল বোলপুরে গাড়ি থামে চার মিনিট, আমি একা এ-সব নামাব কি করে? এমন সময় তিনটি ১৭/১৮ বছরের ছেলে গাড়িতে উঠল। আমি তো মহাখুশি। ‘দেখ ভাই, এগুলো একা কি করে নামাব তাই ভাবছি।’ তারা বলল, ‘কিচ্ছু ভাববেন না, দিদি। আমরা নামিয়ে দেব।’
দুঃখের বিষয়, বর্ধমানে একজন জবরদস্ত চেকার উঠে যেই দেখলেন ওদের থার্ড ক্লাসের টিকিট, পত্রপাঠ নামিয়ে দিলেন। আমি আবার সমস্যায় পড়লাম। কিন্তু বোলপুর স্টেশনে গাড়ি থামবামাত্র ছেলে তিনটি এসে আমার গ্রিল্গুলো নামিয়ে দিয়ে, এক গাল হেসে বলল, ‘বলেছিলাম নামিয়ে দেব।’ এ-কথা মনে করলেও মন ভালো হয়ে যায়।
বাড়ি তৈরি হল। ১৯৫৪ সালের ৬ই আগস্ট গৃহ প্রবেশ করা হল। বন্ধুবান্ধবেরা আনন্দ করে খেয়ে গেলেন। কলকাতা থেকেও অনেকে এসেছিলেন। লতিকা ততদিনে লণ্ডনে এম-এ ইন্ এডুকেশনের জন্য তৈরি হচ্ছে। পরদিন অতিথিরা কলকাতায় ফিরে গেলে সন্ধ্যাবেলায় খালি বাড়িতে বসে শুনতে পাচ্ছিলাম দূরে কোথায়, সাঁওতাল গ্রামে দ্রিমি-দ্রিমি করে মাদল বাজছে। এখন চারদিকের খোলা মাঠে বসতি গড়ে উঠেছে, তবু মাঝেমাঝে নিস্তব্ধ রাতে দূর থেকে শুনতে পাই দ্রিমি দ্রিমি মাদল বাজছে। ভাবি কিছুই তো হারায়নি, এই ত্রিশ বছরে যত প্রিয় মানুষ চলে গেছে, প্রিয় জিনিস ফুরিয়ে গেছে, যত শখ-সাধ মাটি হয়েছে—কিছুই হারায়নি, একটা ফুলের গন্ধে, মাদলের শব্দে অমনি সব ফিরে এসে ধরা দেয়। বাড়ি হল, বিশ্বভারতীর বিশেষজ্ঞ রামবাবুর নির্দেশমতো গাছপালা লাগানো হল। প্রায় দু বিঘে জমির ধারে উত্তর দিকে এক সারি শ্বেত করবীর গাছ আর দক্ষিণ সীমানায় চারটি তালগাছ। একজন সেগুলিকে দেখে বললেন এগুলোতে কখনো ফল ধরবে না। ধরেও নি। কিন্তু কেমন রূপ তাদের। আর ঠিক যেখানটিতে কুয়ো খুঁড়ল রেন্টু, সেখানে একটি জামগাছ। আধবুনো। কি সুন্দর দেখতে, কি মিষ্টি ফল। কিন্তু সেই মিষ্টি ফলগুলো কুয়োতে পড়ে সব জল নষ্ট করে দিত বলে, একবার এসে দেখি রেন্টু সেটি কাটিয়ে দিয়েছে। রামমালি বলে যে দক্ষ মালিকে রামবাবু দিয়েছিলেন, দেখলাম এ ব্যাপারে খুব সমর্থন আছে।
বাড়ির চারদিকে গাছ লাগানো হল। আম, কাঁঠাল, আতা, পেয়ারা, লেবু, বাতাবি। কুলগাছটি আপনি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আমলকি মুচুকুন্দ, একেশিয়া, জারুল, বকুল, সোনাঝুরি, কাঠচাঁপা, পলাশ, অগ্নিশিখা—এরা বাঁচল না। মাদ্রাজ থেকে শম্ভু নাগলিঙ্গমের চারা পাঠাল। শম্ভু চলে গেছে, নাগলিঙ্গমের ফুল ফোটে, পড়লেই ঝরে যায়। ফুল ফোটে, ফুল ঝরে, ফল ধরে, ফল পাকে, ফল শেষ হয়, পাতা ঝরে, নতুন পাতা হয়। এমনি করে বছরের পর বছর ঘুরে আসে।
তাই বলে ১৯৫৪ সালে কিছুই কি আর লিখিনি। ‘মণিকুন্তলা’ বলে একটা কোমল বেদনার উপন্যাস লিখেছিলাম, বড়দের জন্য। কিসে যেন বেরিয়েছিল ভুলে গেছি। কবি বন্ধু অজিত দত্তর ‘দিগন্ত’ বলে একটি প্রকাশনালয় ছিল। সেখান থেকে বই হয়েও বেরিয়েছিল হয়তো ১৯৫৫ সালে। খানকতক কপি দিয়েছিল। তারপর আর ছাপা হয়নি। আমার বড় সাধের গল্প। একজন গায়িকা গলার স্বর হারিয়ে কি করে নিজেকে খুঁজে পেল, তার গল্প। একেক সময় আবার ছাপাতে ইচ্ছা করে। বাংলা নানান্ দৈনিক আর মাসিক পত্রে সরস ছোট গল্প লিখতাম। ভাবতাম সরস গল্প আরো লেখা হয় না কেন? কত মজার কথা বলে বাঙ্গালী বন্ধুবান্ধবেরা, লিখতে গেলেই খালি হতাশা ব্যর্থতার বিফলতার কথা। প্রেমের গল্পেও ফুর্তি নেই, খালি একটা বিশ্রী জিজ্ঞাসার চিহ্ন দিয়ে শেষ। ছিঃ! এ কি রকম অকৃতজ্ঞতা।
যতদূর মনে করতে পারি এই রকম সময় কটকে অখিল ভারত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অধিবেশন হয়। বয়সে ছোট বন্ধু শ্রীহরি গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুরোধে গেলাম শেষ পর্যন্ত। মহিলা শাখায় ভাষণ দিতে বলেছিলেন ওঁরা। কদাচিৎ আমি সাহিত্যের বাইরে কোনো বিষয়ে বিশেষ কিছু বলি। কিন্তু ঐ সভায় বলেছিলাম, হঠাৎ অন্তঃপুরের বাইরে বিক্ষিপ্ত উদ্বাস্তু মেয়েদের সঙ্গে কিছু মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলাম, সে বিষয়ে কিছু চিন্তা করবার অবকাশও পেয়েছিলাম। সে-সব চিন্তার কথা বলেছিলাম। বন্ধুরা খুশি হয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজিরা সেই ভাষণ পরে যখন কাগজে বেরিয়েছিল, সেটি পড়ে আমাকে কি সুন্দর চিঠি লিখেছিলেন। বলেছিলেন বিবেকানন্দ স্বামী এই ভাবে চিন্তা করতেন। আমি তাঁকে চিরকাল বড়ই শ্রদ্ধা করে এসেছি, স্বামীজিদের কথা শুনে বড় ভালো লেগেছিল। ঐ ভাষণ, বা বড়দের জন্য লেখা আমার কোনো প্রবন্ধই পুস্তকাকারে বেরোয়নি। অনেকগুলি হারিয়েও গেছে।
কটকের ঐ সাহিত্য সম্মেলন খুবই উপভোগ করেছিলাম। মূল সভাপতি ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ঐ তাঁকে কাছে পাওয়ার আমার শেষ সুযোগ। মনে আছে দুপুরে একদিন সবাই মিলে সারি সারি পাত পেড়ে খেয়ে ছিলাম। অন্যরা রোজই খেতেন, কিন্তু আমি আমার বড়দি সুখলতা রাওএর বাড়িতে ওঠাতে বাদ পড়ে যেতাম। সেদিন ওঁরাও গেছিলেন। বড়দির কথা আরো বলা দরকার।
॥ ১১ ॥
এবার অন্য কথা বলি। কলকাতাকেই ঘাঁটি করে ফেলেছিলাম, তবে শান্তিনিকেতনের আকর্ষণও কম ছিল না। আমার কাছে শান্তিনিকেতনের আশ্রমের বাড়িঘর পথঘাট গাছপালা কত কোমল স্মৃতিতে ভরা, দিনে দিনে টের পেতে লাগলাম। এখন যে সব জায়গায় ছোট বড় কোয়ার্টার তৈরি হয়েছে, অধ্যাপকদের ও কর্মীদের আবাসনের জন্য, ১৯৩১ সালে সেখানে খোলা মাঠ ছিল। তাতে হয়তো কয়েকটা শালগাছ, খেজুর গাছ, মনসা গাছ। থেকে থেকে ভাঙা ভাঙা, তাকে বলে খোয়াই। মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে খোয়াই তৈরি হয়। এখন আর খোয়াই বড় একটা চোখে পড়ে না। লোকে সেখানে বাড়ি করেছে, ঘাস লাগিয়েছে, পাঁচিল গেঁথেছে। জমি উদ্ধার হয়েছে, বৃষ্টি পড়া বেড়েছে, গ্রীষ্মের অসহ্য দহন কমে গেছে, চারদিক সবুজ হয়েছে। কিন্তু রূপ গেছে চলে। ভাবি মানুষের সুবিধার জন্যেই কি প্রকৃতির সম্পদ? ইন্টার ক্লাসে আসা যাওয়া করি। যতদূর মনে হয়, ভাড়া ছিল সাড়ে তিন টাকা, কি আরো কম।
মধ্যবিত্ত যাত্রীতে ঠাসা থাকত গাড়ি। ভারি ভদ্র তারা, ভারি রসিক। কোথায় গেল তারা ভেবে পাই না। পৌষ উৎসবের সময়, মনে আছে যে যেখানে পারে বসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। সবার মুখে এক গাল হাসি। তখন শুনতাম ৯৯ মাইলের পথ, পরে সেটা ৯৫ হল। ঐ ৯৯ মাইল ৯৯ রকম রসে ভরা থাকত। কত যে মজার মজার গল্প শুনতাম। যে যার সঙ্গে আনা খাবার, দুপাশের চেনা-অচেনা সঙ্গীদের সঙ্গে ভাগ করে খেত। যাদের সঙ্গে কিছু নেই, তারাও দু-চার আনার চিনাবাদাম কিনে খাওয়াত। বড় মধুর ছিল বাঙালী জীবন। সাজপোশাকের বালাই ছিল না। চুল ছোট করে কাটা, দাড়ি চাঁচা, মিলের ধুতি পরনে। শার্ট বা লংক্লথের পাঞ্জাবীর ওপর পৌষের শীত ঠেকাবার জন্য একটা সস্তা কিন্তু খাঁটি পশমের আলোয়ান জড়ানো। বোলপুর স্টেশনে গাড়ি খালি হয়ে যেত, সবাই পৌষমেলার যাত্রী।
পৌষমেলার কথা বলতে আজকাল, অনেকেই বলেন, ‘সে মেলা আর নেই, এখন সব শহুরে হয়ে গেছে! তার চেয়ে, ঐ সময় কলকাতা অনেক বেশি উপভোগ্যও, ক্রিকেট খেলা, ঘোড়দৌড়, নতুন বছরের কত পার্টি, প্রদর্শনী।’ বলা বাহুল্য এরা কেউ আমার মতো আ-যৌবন শান্তিনিকেতনের সঙ্গে একটা অদৃশ্য সুতো দিয়ে বাঁধা নয়। আমোদ আহ্লাদের নিয়মই তাই। অর্ধেকটা থাকে অকুস্থলে আর অর্ধেকটা নিজেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হয়। এই যেমন আমি ৫০ বছর ধরে পৌষ মেলা যেমন দেখে আসছি, এখনো তার খুব বেশি তফাৎ দেখি না। হয়তো মনের মধ্যে আগে যা দেখেছি আর এখন যা দেখছি, সব মিলেমিশে আছে। পাথরের বাসন ভারি ভেঙে যায়, লোকে কম ব্যবহার করে। তাই পাথরের দোকান কমে গেছে। প্ল্যাস্টিকের চাহিদা বেড়েছে। তাতে কি? বইয়ের দোকান থাকত না, এখন থাকে। অনেক বেশি খাবারের দোকান থাকত না, এখন থাকে। অনেক বেশি খাবারের দোকান, কিন্তু শিউড়ির মোরব্বা খুঁজতে হয়। আমি বলি এসব তুচ্ছ জিনিস, আলাদা আলাদা দোকান দিয়ে তো আর মেলা হয় না। মেলার একটা নিজস্ব প্রাণ আছে। সেই প্রাণটি আমি উপভোগ করি। সেটাই হল মানুষের মেলার আবহাওয়া। হাত বাড়ালেই আজ-ও তাকে ধরা যায়। তবে ঐ যা, মনের মধ্যে করে কিছু সামগ্রী নিয়ে যাওয়া চাই।
তাই বলে এই ৫০ বছরের প্রত্যেক পৌষ মেলা দেখিনি। মাঝেমাঝে বাধা পড়েছে। অসুখবিসুখ, অন্য কাজ। একবার, মনে হয় ১৯৫৪ সালে জানুয়ারিতে দিল্লি গেলাম সেন্ট্রাল অ্যাডভাইজরি বোর্ড অফ এডুকেশনের বার্ষিক অধিবেশন করতে। আসলে ওটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ঠিক হয়নি। যাঁদের সঙ্গে এবং যে কর্মধারার সঙ্গে সারা বছর কোনো যোগ থাকবে না, বৎসরান্তে তাঁদের সঙ্গে কি নিয়ে পরামর্শ করব? হুমায়ুন কবীর তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিভাগের সম্পাদক এই রকম মনে পড়ছে। আমার ছাত্রজীবন থেকে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্বন্ধ। এ বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল বলেই প্রধানত রাজি হয়েছিলাম। বহু গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, মনে আছে, কিন্তু কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্তে এসেছিলাম বলে মনে পড়ে না।
যতদূর মনে হয় ঐ ছিল আমার প্রথম দিল্লি যাওয়া। সঙ্গে ছিল আমার কন্যা কমলা, সে সেবার ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিল। ওর সঙ্গে পুরনো একটা চুক্তির কারণে উত্তর ভারত দেখাতে নিয়ে গেলাম। আগে গেলাম ডুন এক্সপ্রেস্ চেপে দেরাদুনে। সেখানে বন বিভাগীয় কলেজে আমাদের এক কুটুম্ব কাজ করতেন, তাঁকে আমরা নালু বাগচি বলতাম। তাঁর স্ত্রী আমার কলেজের বন্ধু, সুমতি বলে একজন মারাঠি মেয়ে। মারাঠিদের যত দেখেছি তত আপনজন বলে মনে হয়েছে। সেবারো স্বামী স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে আমাদের যারপরনাই আদর যত্ন করলেন। নালুদাকে বৃক্ষ বিশারদ বলা চলে। বাহির বাগান ও নানা রকম সুন্দর গাছের লালনভূমি। চড়াইয়ের ওপর বাড়ি, নিচের রাস্তা থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধাপে ধাপে গাছ লাগিয়েছেন দেখলাম। এত দিনে না জানি তাদের কত বাহার হয়েছে। নালু বাগচিও আর নেই। খিটখিটে, স্নেহশীল, সুদর্শন মানুষটিকে আর দেখতে পাব না।
মনে আছে কলকাতায় ফেরার পথে কমলি বলেছিল, ‘এই বেড়ানোর প্রত্যেকটি মুহূর্ত উপভোগ করেছি।’ ট্রেন থেকে দূরে আকাশের গায়ে তাজমহল দেখা যায়। কমলি যেন স্বপ্নরাজ্য দেখল। সকালে দেরাদুন পৌঁছলাম। নিচু প্ল্যাটফর্মে নালু বাগচি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর পাশেই রাশি রাশি গোলাপের কলম। বললেন, ওগুলো রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনিয়েছেন। মুসুরি পাহাড়ের পায়ের কাছে রাজপুর। সেখানে একটা বাংলো ভাড়া করে রথিবাবু আছেন। সামনেই তাঁর নিজের সুন্দর বাংলো তৈরি হচ্ছে। ব্যক্তিগত কারণে আত্মীয় পরিজন ছেড়ে ৭০ বছর বয়সের রথিবাবু সুদূর দেরাদুনে শেষ বয়সটা কাটাবেন স্থির করেছিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। শান্তিনিকেতনের খোলা মাঠ যাঁর যোগ্য পটভূমি, এখানে তিনি কেমন করে মন বসাবেন ভেবে পেলাম না। তাঁর বিষয়ে নানা কটু মন্তব্য শুনে এসেছিলাম। মনে হয়েছিল কোন গভীর বেদনা, অতৃপ্তি, হতাশা থেকে, মানুষ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এবং হয়তো অপ্রিয় আচরণ করে, বাইরে থেকে তার কখনো বিচার করা যায় না। আমি বহু বছর ধরে রথিদাকে দেখেছি প্রায় আমার মা-মাসির বয়সী। খুব একটা অন্তরঙ্গতা হয়নি কখনো। তবু শান্তিনিকেতনে যখনি সৌজন্যের প্রতিমূর্তি শ্যামল সুন্দর মানুষটিকে দেখেছি, তাঁর মুখে একটা বেদনার ভাব দেখেছি। আশ্চর্য শিল্পবোধ ছিল। হাতের কাজ কি সূক্ষ্ম, পরিকল্পনা কি স্বপ্নময়, অথচ কি কার্যকরী। এখনো আমাদের শান্তিনিকেতনের এই বাড়িতে পাঁচখানি রথিদার পরিকল্পিত এবং শ্রীনিকেতনে তৈরি ফোল্ডিং চেয়ার আমরা অষ্ট প্রহরব্যবহারকরে থাকি। আমার কাছে রথিদার তৈরি দুটি চামড়ার হ্যাণ্ডব্যাগ আছে, তার ওপর এমন সুন্দর নক্সা করা যে যখনি দেখি, এই ৪০—৫০ বছর পরেও আশ্চর্য হই। আমার মনে হয় অসাধারণ শিল্পী বলে তাঁর যে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল, রথিদা তা পাননি। লোকে তাঁকে craftsman ভাবে, আসলে তিনি ছিলেন artist।
সে যাই হক প্রায় ত্রিশ বছর আগে, নালুদা বললেন, ‘তোমার যদি আপত্তি না থাকে, আমরা বিকেলে রথিদার সঙ্গে দেখা করে আসব। তাঁর বড় ইচ্ছা।’ খুশি হয়ে গেলাম সেখানে। রথিদাও কি যে খুশি হলেন। ঘুরে ঘুরে তাঁর অসমাপ্ত বাড়ি দেখালেন। ইয়োরোপে আমেরিকায় যেমন করে, বাড়ি তৈরির সঙ্গে সঙ্গে বাগানের লে-আউট তৈরি হচ্ছে। সেই গোলাপের কলম কোথায় কোথায় লাগান হবে তাও দেখালেন।
সে-দিন হাতে বেশি সময় ছিল না। পরদিন রাতে কমলিকে আর আমাকে নেমন্তন্ন করলেন। বললেন আনা-নেওয়ার জন্য ওঁর গাড়ি থাকবে। পরদিন গিয়েছিলাম আমরা। ওদিকে শীতকালে বৃষ্টি পড়লে বেজায় ঠাণ্ডা পড়ে। গাড়ির জানলা তুলে পৌঁছলাম। ঘরে আগুন জ্বালা হয়েছিল। উত্তরায়ণে দেখা সুন্দর সুন্দর কিছু আসবাব দেখে মন কেমন করতে নাগল। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের আঁকা অনেকগুলি ছবি। কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা আর আঁকা হল জাতীয় সম্পদ। রথিবাবুর তা নিয়ে যাবার কোনো অধিকার নেই। মনে হয়েছিল বিশ্বকবির ছেলে হয়ে জন্মানোর জন্যে বড় বেশি দাম দিতে হচ্ছে। গরীব ঘরের ছেলেরাও বাপের জিনিস উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। এমনিতেই বাপের চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল প্রতিভার জন্যে, ছেলের অসাধারণ গুণগুলি অনেকেরি চোখে পড়ে না। যদি সাধারণ ঘরে জন্মাতেন রথিদা, আরো খ্যাতি পেতেন। মনে হচ্ছে শীঘ্রই একদিন তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে। দেশের লোক তখন তাঁকে মনে করবে কি না কে জানে।
শুনেছিলাম শান্তিনিকেতনের ওপর রথিদার আর কোনো টান নেই। কেন জানি বলে বসলাম, ‘শান্তিনিকেতনের জন্য মন কেমন করে না, রথিদা?’ এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন। দেখলাম চোখে জল জমছে। খালি বললেন, ‘তোমার কি মনে হয়?’ নিজের মূঢ়তার জন্যে নিজেই লজ্জা পেলাম। এর পর আর একবারই তাঁকে দেখেছিলাম। শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন বিষয় ব্যাপার নিয়ে কোনো কাজে। তার অল্প দিন পরেই তিনি মারা যান। আজও রথিদার কথা মনে হলেই আমার বড় কষ্ট হয়।
তার পর দিন আমরা হরিদ্বার গেলাম। কনখলে দু-দিন থাকব। মাখন-মহারাজ স্টেশনে এসেছিলেন। কনখলেও দুদিন ছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে আমাদের বড়ই ভালোবাসার সম্বন্ধ। তাঁরা সকলে আমার স্বামীর পেশেন্ট ছিলেন। এখনো আমার ছেলে তাঁদের অসাধারণ হাসপাতালে রুগীদের দাঁতের চিকিৎসা করে। ধর্ম বলতে আমি কোনো সময়ই ক্রিয়াকলাপ বুঝি না। শুনেছি রামকৃষ্ণ বলতেন ধর্ম মানে ভগবানে বিশ্বাস, জীবে দয়া আর মাঝেমাঝে সাধুসঙ্গ। এই হল আমারো মনের মতো কথা। আমাদের দিক থেকেও যেমন তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, তেমনি তাঁদের দিক থেকেও অযাচিত স্নেহ পেয়েছি আমরা। মাখন-মহারাজ বলতে গেলে কনখলের প্রধান ছিলেন। অথচ কোনো ছেলেমানুষ সাধুকে না পাঠিয়ে নিজেই আমাদের নিতে এলেন। যেন আমরা তাঁদের কতই না গণ্যমান্য অতিথি। সত্যি বলব, তাঁকে দেখেই গলে গেলাম আমরা।
আশ্রমসুদ্ধ সকলের আদরযত্নে দুটো দিন কেটেছিল। ওঁদের ছোট হাসপাতালটি এতদিনে নিশ্চয় অনেক বড় হয়েছে। একজন গেরুয়াপরা বৃদ্ধ ইউরোপিয়ান সাধুকে দেখেছিলাম। দীর্ঘকাল ওখানে সাধনা করেছিলেন। আশ্রমের নিজস্ব ঘোড়ার গাড়ি করে হরিদ্বারের বিখ্যাত স্নানের ঘাট, কিছু পুরনো মন্দির, দক্ষরাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখলাম। শেষেরটার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করাতে গাড়ির চালক খুব বিরক্ত হল। ঐ তো খুদে খুদে ইঁটের তৈরি চারতলার সমান উঁচু দেয়াল দেখছেন না কি। ঐ উপরে ছোট একটা ঝুলোনো বারান্দা। খরস্রোতা গঙ্গার ওপর প্রাচীন কালের ঘাট, চাতাল, বারবাড়ি সব ভেঙে পড়েছে। তাদের বড় বড় চাঙড় এখনো দেখা যাচ্ছে। এর বেশি প্রমাণের কি দরকার মানুষটি ভেবে পেল না। পরের দিন হৃষিকেশ লছমনঝোলা দেখে এলাম। মাখন মহারাজ একটা ভাড়ার মোটর ঠিক করে দিলেন। ভোরে বেরোতে হবে। সঙ্গে জলযোগের জন্য ফল মিষ্টি দিলেন। যেন মা হয়েছেন। খুব শীত, কন্কনে বাতাস বইছে। বললেন এখানকার বাতাস কখনো বন্ধ হয় না। শীতকালে কন্কনে ঠাণ্ডা আর গ্রীষ্মকালে আগুনের হল্কা। রাতে শোবার আগে একজন ছেলেমানুষ সাধুর হাতে মহারাজ দুটি বড় বড় কাঁচের গেলাস ভরে সুগন্ধী লালচে দুধ পাঠালেন। চিনি দিয়ে জ্বাল দেওয়া। কমলি তারটা চোঁ চোঁ করে শেষ করে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল। আমি পাতলা দুধ পছন্দ করি না। গেলাসটা ঢাকা দিয়ে রেখে দিলাম; ভোরে উঠে মোমবাতি জ্বেলে তৈরি হচ্ছি, দেখি কমলি গেলাসটা তুলে অবাক হয়ে দেখছে। ওপরটা শাদা, তার নিচে খানিকটা ঘি রঙের, তারো নিচে আরো গাঢ় ঘি রঙের। এক চুমুক খেয়ে বলল, ‘আইসক্রীম!’ তক্ষুণি গেলাস নিয়ে বড় এক ঢোক অবিকল উঁচু দরের আইসক্রীম খেলাম। আশ্রমের চিনি দিয়ে জ্বাল দেওয়া খাঁটি দুধ, রাতারাতি স্বাভাবিক আইসক্রীম হয়ে গেছে। মনে হল এ ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখা দরকার। পড়লেই মন ভালো হয়ে যাবে।
অনেকেই গেছেন হৃষিকেশ লছমনঝোলা। কিন্তু আমাদের মনে হল সশরীরে স্বর্গে এসেছি। এ পারে মোটর থেকে নেমে একটু হেঁটে ঝোলা পুলের ওপর উঠলাম। ছাগল ভেড়া পুল পার হচ্ছিল। সাঁকো দুলছিল। নিচে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নুড়ির মতো গোল পাথরের মধ্যিখান দিয়ে এক অচেনা গঙ্গা পাহাড় থেকে নেমে ছুটে চলেছে। ওপারে রাম আর লক্ষ্মণের মন্দির। একজন সাধু বললেন খুবই প্রাচীন! বাইরে থেকে দেখলাম। তারপর বনভূমির মধ্যে দিয়ে পথ। নাকি স্বর্গদ্বারে পৌঁছে নৌকো করে ওপারে যেতে হবে। সে বনভূমির তুলনা হয় না। বড় বড় গাছ। গাছতলায় মাটির কুটির। কুটিরের সামনে সন্ন্যাসীরা বসে আছেন। এই দেখেই কি বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘এই সেই সকল গিরিতরঙ্গিনী তীরবর্তী বনরাজি।’ কে জানে। হাঁটতে হাঁটতে যখন হদ্দ হয়ে কমলিকে বলছি, আর তো পারা গেল না! পেছন থেকে একজন সাধু বলে উঠলেন, ‘তা বললে তো চলবে না, মা। স্বর্গে পৌঁছবেন অথচ একটুও কষ্ট করবেন না।’ দ্বিগুণ উৎসাহে দেখতে দেখতে বাকিটুকুও হেঁটে ফেললাম।
স্বর্গদ্বারের ঘাটে নৌকো অপেক্ষা করছিল। হয়তো বিনি-পয়সার নয় তো যৎকিঞ্চিৎ পারানী। নদীর উদ্দাম স্রোতে বিশাল বিশাল মহাশির জাতের মাছ কিলবিল করছে। একজন লোক নৌকোয় বসে আটার গুলি জলে ফেলছে। মাছরা ঠেলাঠেলি করে খাচ্ছে। কখনো বা নৌকোয় ধাক্কা লাগছে, নৌকো টলমল করছে। সব যেন স্বপ্নের মতো। এক সময় ওপারে পৌঁছলাম। সেখানে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। হৃষিকেশে একবার নেমে ঘুরে দেখলাম। গঙ্গার স্রোত এরি মধ্যে কমে এসেছে মনে হল। বালির তীর থেকে ছোট ছোট নুড়ি কুড়িয়ে নিলাম। তারপর ত্রিশ বছর কেটে গেছে, সে নুড়ি কোথায় হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু লছমনঝোলার স্মৃতি আজও মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে।
পরদিন মাখন মহারাজ আমাদের লাক্সারি বাসে তুলে দিলেন। সে কি চমৎকার ব্যবস্থা। থেকে থেকে পাঁচ-দশ মিনিট করে থামে, চা খাবার, বাথরুমে যাবার জন্য। আমরা এরকম ভাবতে পারি না। যতগুলি বসবার জায়গা তার বেশি লোক তুলল না। এখনো ঐ রকম আছে কি না জানি না। পথে দেখলাম ব্রিটিশ আমলে কাটা বড় বড় খাল, তাতে সারি সারি শস্য বোঝাই নৌকো চলেছে। এই ভাবে ঐ সব খরার দেশে খাদ্য-জলের সমস্যা মেটায়। ভালোও লাগল, মনটা একটু খারাপও হয়ে গেল। আবার মনে হল মা বাংলাকে কেউ ভালোবাসে না, বাঙালীরা তো নয়ই।
বিকেল পাঁচটায় দিল্লি পৌঁছলাম। কোন একটা বড় গেটের পাশে বাসস্ট্যান্ড। ভেবেছিলাম কেউ নিতে আসবে। এই প্রথম দিল্লি আসা, পথঘাট চিনি না। শেষটা ট্যাক্সি করে নিজেরাই ৫নং হনুমান রোডে পৌঁছলাম। রমেন খুব বকাবকি করল, নাকি পাকা চিঠি পায়নি। তাই বলে আদরের অভাব দেখলাম না। রমেনের বুড়ো বাবা সম্পর্কে আমাদের নাতজামাই হতেন। রমেন আমার চেয়ে সামান্য বড় কিন্তু সম্পর্কে পূতি! দোতলার ওপর ওদের সুন্দর ফ্ল্যাট। কাছেই হনুমানজির মন্দির, তাই পথ কখনো নির্জন হয় না। একতলায় এক বুড়ো মজুমদার মশাই থাকতেন। এক সময় তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ছিলেন। নিয়মিত দিল্লি—শিমলা করতে হত। সে আরেক যুগের কথা। পরে আমাদের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা যখন ১৯৬১ সাল থেকে সত্যজিতের চেষ্টায়, উৎসাহে এবং প্রথম দু-বছর তার একলার খরচে, আবার প্রকাশিত হতে লাগল তখন মজুমদার মশায়ের কাছ থেকে তাঁর কর্মজীবনের কয়েকটি চমৎকার সরস স্মৃতিকথা প্রকাশ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। নাত-জামাই দ্বিজেন্দ্রনাথ, পুতি রমেন, একতলার মজুমদার মশাই সবাই এখন স্বর্গে গেছেন। তবু তাঁদের জন্য আমার মনে একটা কোমল উষ্ণ জায়গা রাখা আছে।
সে যাই হক রমেনের ছেলেমেয়ে এবং দিল্লিতে পোস্টেড্ আমার ভাসুরপো কাজকর্ম থেকে ছুটি নিয়ে আমাদের দিল্লি আগ্রা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিল। নিউ দিল্লির পরিপাটি ব্যবস্থার প্রশংসা না করে পারলাম না, কিন্তু মনে মনে নোংরা কলকাতার ঘরোয়া অন্তরঙ্গতার অভাবও টের পেলাম। অনেক বাড়ির সামনেটা যত সাজানো-গোছানো পাশ এবং পেছনটা তত নয়। একবার অরোরা স্টুডিওতে ফিল্ম তোলা দেখতে গেছিলাম। সেখানেও ঐ রকম সামনে-সাজানো, পাশ নেই, পাশ নেই পেছন নেই ঘরবাড়ি দেখেছিলাম।
তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, ওখানকার ঘরকন্না তখন ভারি সুবিধার ছিল। রোজ সকালে একজন লোক গরম কোট মাংকি-ক্যাপ পরে, ঠেলা-সাইকেল বোঝাই রসদ নিয়ে গেটের কাছে হাঁক দিত—‘মীটওয়ালা’! এমন অভিনব ডাক শুনে দোতলার বারান্দা থেকে দেখলাম রমেনের দক্ষ গৃহিণী লোকটির কাছ থেকে দেড়টাকা সেরে (তখনো কিলোর চল হয়নি) তাজা পোনা মাছ, মটন কিনল। ঐ ভাবে ঘরে বসে ফল তরকারি, রুটি মাখন ইত্যাদি কেনা যেত। সে তরকারি দেখবার মতো। দামও খুব সুবিধার। বিকেলের জলখাবার করার হাঙ্গামা করতে হত না। চওড়া ফুটপাথে ও তার পার্শ্ববর্তী চালাঘরের মতো দোকানে উৎকৃষ্ট দই-বড়া, আলুর চাট, পকৌড়া, ছোলে ইত্যাদি তখন পর্যন্ত আমার অজানা, (কিন্তু এখন কলকাতার নিত্যনৈমিত্তিক ভোজ্য, যদিও ঝালের চোটে আমার একটুও উপভোগ্য নয়) নানা রকম খাদ্য কিনে লোকে নিশ্চিন্ত মনে ও অপ্রত্যাশিত ভাবে বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে হানা দিত। মোট কথা সেই প্রথমবার থেকেই দ্বিজেন মৈত্রের বাড়িতে বড় সুখে দিন কাটিয়েছিলাম। এবং এর পরে রেডিওর কাজে যতবার দিল্লি যেতে হয়েছিল দ্বিজেনবাবুর বাড়িটাকে নিজের বাড়ির মতো ব্যবহার করেছি। হয়তো ওঁদের নানা অসুবিধা করেছি, কিন্তু সৌজন্যের জন্য তাঁরা কখনো কিছু বলেননি, সর্বদা সমান আদর করেছেন। সে আস্তানা ৫ নং হনুমান রোড থেকে উঠে গিয়ে আমার মনে বাসা বেঁধে আছে।
এ সবের থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে দিল্লীর জীবন যাত্রা আমি খুবই উপভোগ করতাম। তবে স্থায়ীভাবে বাস করতে রাজি ছিলাম না। এসব কথা পরে প্রকাশ্য।
মিটিং সেরে, তার বিফলতার জন্যে মনে একটা অতৃপ্তি নিয়ে, থলি বোঝাই নান্খাটাই, হালুয়া-সোহন, ফল ইত্যাদি নিয়ে সেবার ফিরে এসেছিলাম। মনে আছে হ্যাণ্ডিক্রাট্ফ্সের দোকান থেকে শান্তিনিকেতনের নতুন বাড়ির জন্য হাতে বোনা সুন্দর ছাপা বেডকভার, পরদার কাপড়, কুশন কভার ইত্যাদি এনেছিলাম। তার কিছু কিছু এখনো জীর্ণ অবস্থায় ব্যবহার করি।
তখনো স্বাধীনতার নতুন নতুন গন্ধটি লেগে ছিল, নিউ দিল্লির পথ-ঘাটে অনেক জায়গায় একটা নির্মীয়মান অসম্পূর্ণ চেহারা ছিল, যেখানে সেখানে চালাঘরে নানা রকম সুদৃশ্য গেরস্থালীর জিনিসপত্র মোড়া, পাপোষ, টুকরি, ঝোলাঝুলি, বাতিদান, বাজার ব্যাগ, চটি ইত্যাদি আশ্চর্য রকম কম দামে পাওয়া যেত। সস্তা চটিগুলি অবিশ্যি টিকত না, কিন্তু অন্য জিনিস বছরের পর বছর কাজে দিত।
এ সব ব্যবসা যাঁরা করতেন, তাঁদের অধিকাংশকে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধুদেশ ইত্যাদি নবনির্মিত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু বলে মনে হয়েছিল। এঁরা সরকারি সাহায্যের আশায় পুর্নবাসন উপনিবেশে বাস করতেন না। নিজেরা কাঠ, চাটাই ইত্যাদি দিয়ে একটা করে চালাঘর বানিয়ে, উদয়াস্ত ঐ সব হাতে তৈরি জিনিস বানিয়ে, পথের ধারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করতেন। সরকারি সাহায্য কিছু পেতেন কি না জানি না। এর পর বারংবার দিল্লি যেতে হয়েছে, প্রতিবারেই এঁদের অবস্থার উন্নতি লক্ষ্য করেছি। মোটা মোটা আটার রুটি একটু চাটনি দিয়ে এদের প্রধান আহার বলে শুনেছিলাম। এঁদের সঙ্গে আমাদের দেশের দুর্বলদেহ ম্লানমুখী নিরুৎসাহ নিরুদ্যম উদ্বাস্তুদের সরকারের উপর একান্ত নির্ভরের কথা মনে করে, মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠত। ভাবতাম আমাদের দেশের লোকদের শাক-ভাত কুচো মাছ আহারই কি এর জন্য দায়ী? এঁরাই আমাদের আপন জন, এঁরা অসৎ নন, নির্বুদ্ধি নন। তবু কেন এত অসহায় এবং অলস? দেশ বিভাগের পর ৩৫ বছরের বেশি কেটেছে তবু আমাদের উদ্বাস্তু-সমস্যা ঘুচল না কিসের জন্য? সে যাক গে, এসব দুঃখের কথা বলে পাতাভরানো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি বলি কি উদ্বাস্তু আবার কাকে বলে? এঁরা আমাদেরি স্বদেশবাসী, আমাদের দেশই ওঁদেরও দেশ, ওঁদের মাতৃভাষা বাংলা, ওঁরা আবার উদ্বাস্তু নাম নেবেন কেন? আমার মায়ের পূর্বপুরুষরা ফরিদপুরে থাকতেন, আমার ঠাকুরদা পর্যন্ত বাপ পিতেমোর বাসস্থান ছিল ময়মনসিংহ। তফাৎ শুধু এঁরা রাজনীতির বলি হয়েছেন। এঁরা আমাদের ঘরের লোক বই তো নন। আর কতদিন উদ্বাস্তু বলে আলাদা করে রাখব?
দিল্লীতে হুমায়ুন কবীরকে দেখে আমার মনে হতে লাগল জীবনটাকে কি নষ্ট করে ফেলছি? মনে মনে যে কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করেছি, সে কি আর করা হবে না? ভারি একটা অসন্তোষ আমাকে পেয়ে বসেছিল ঐ সময়। সুখের সংসার আমার, স্বামীর ভালো প্র্যাক্টিস, ছেলেমেয়ে ভালোভাবে বড় হচ্ছিল, কোনো বড় রকম সমস্যা দেখা দেয়নি। তবু ঐ আমার প্রথম দিল্লী যাওয়ার আগে থেকেই মাঝে মাঝে মনটা ভারি নিরুৎসাহ হয়ে পড়ত। সুখী হবার সব উপকরণ পেয়েও খুব সুখী হতে পারছিলাম না, অহেতুক অসন্তোষের কারণও নিজেই খুঁজে পেতাম না, তা বলব কাকে? অবিশ্যি একেবারেই অহেতুক বললে ভুল হবে। আমার আধখানা আমি দিনরাত আমাকে নীরবে গঞ্জনা দিত, কেন বৃথা সময় নষ্ট করছি। সমবয়সীরা যখন অবসর নেবার কথা ভাবছিলেন, (অন্ততঃ কারো কারো সে-কথা ভাববার সময় এসেছিল) তখনো আমার সামনে অকর্ষিত ভূমি ধূধূ করত। মনে মনে মরে যেতাম। ভাবতাম সেই অন্য আমিটা কারো মেয়ে নয়, বোন নয়, স্ত্রী নয়, মা নয়, বন্ধু নয়; নিজেকে ছাড়া তার কোন বাইরের সাহায্যকারীও নেই। সুখের বিষয় তার সেই অন্তরবাসী অদৃশ্য সত্তাটি তাকে এক মুহূর্তের জন্য এ-সব কথা ভাবতে দিত না।
অনেকে একটি যুগান্তকারী রচনা লিখে ঝপ্ করে রাতারাতি সাফল্যের সোপানের তিন ভাগ উঠে যায়। আমি এক-পা এক-পা করে এগোচ্ছিলাম। বলেছি তো গিরিজা ভট্টাচার্যর মতো শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুও সুশোভন সরকারকে বলেছিলেন—‘ভদ্রমহিলাকে এ-ভাবে কাগজ নষ্ট করতে বারণ কর।’ প্রিয় বন্ধু সুনীল সরকার আমাকেই বলেছিলেন, ‘এগুলো সাহিত্য নয়, সাহিত্য নিয়ে ইয়ার্কি’, নীরেন রায় বলেছিলেন, ‘লিন ইউটাঙের মতো লিখতে না পারলে, কলম ছাড়ো!’ এ-সবের কোনো উত্তর হয় না। আমার মনের মুকুরে যাকে দেখি, তার আত্মপ্রত্যয় এতে বিঘ্নিত হত না। কমলির আই-এ পরীক্ষার এক মাস আগে, সে বলেছিল, ‘এই একটা মাস শান্তিনিকেতনে গিয়ে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করছে।’ তাই গেলাম। আমার স্নেহময়ী সুদক্ষা ননদের হাতে সংসার দিয়ে গেলাম দুজনে। সে পড়ত, আমি ছুটি উপভোগ করতাম। শিল্পী প্রশান্ত রায় ছিলেন, এখনকার চেয়ে অনেক বেশি কোমল, সুকুমার এক শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন, আরো অনেকে ছিলেন। সময় মন্দ কাটত না। বাড়ির বন্ধ দরজার তালা খুলেই দেখলাম ৫ সপ্তাহ আগে পৌষমেলার কেনা চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলি মাটির ফুলদানিতে প্রায় নির্জলা অবস্থায় তখনো তেমনি জ্বল জ্বল করছে, অমনি মনটা অনেকখানি ভালো হয়ে গেল।
কমলি পড়ত আর আমি আমার প্রথম নাটিকা ‘বক-বধপালা’ একটু একটু করে লিখতাম। আট-দশ দিন আগে এক ছোট সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কোন বই আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল?’ টপ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল, ‘বিদ্যাসাগরের প্রথম ভাগ।’ ঐ বই পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, কাগজে কয়েকটা আঁকিবুকি দেখে অন্যের মনের কথা বোঝা যায় এবং তার চেয়েও আশ্চর্য কথা যে নিজের মনের কথা যা কাউকে মুখে বলা যায় না, তাও প্রকাশ করা যায়। বোধ হয় সেই দিন থেকেই আমার নিজের কাজ কতকটা আঁচ করে নিয়েছিলাম। তখন আমার ৫ বছর বয়স। তার পরেই বড়দার আবোলতাবোলের কবিতাগুলি এবং কালক্রমে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ আমার চিন্তাধারাকে নীরবে যেভাবে প্রভাবিত করেছিল, তেমন আর কেউ করেনি। আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ-ও নয়। তাঁরা আমার চিন্তাকে পুষ্ট করেছেন, পুলকিত করেছেন। কিন্তু দিক্-নির্দেশ করেছেন আমার বড়দা সুকুমার, যাঁর মৃত্যুকালে আমার বয়স ছিল পনেরো বছর।
বক-বধ-পালা এই প্রভাবের ফলস্বরূপ। আমার মতে নাট্য গুণে ওতে অনেক দুর্বলতা দেখা যায়। যাত্রা প্যাটার্নে লেখা নাটিকা। ভেবেছিলাম পৌষমেলায় বিশ্বভারতীর ছাত্ররা যে যাত্রা অভিনয় করে, তার জন্য খাসা হবে। দুঃখের বিষয় ঐ বছর থেকে বিদ্যালয়ের যাত্রা করা বন্ধ করা হল। পরের বছর আমি রেডিওর এক প্রযোজক হয়েছিলাম। জানুয়ারি মাসে রেডিও সপ্তাহ পালিত হত। ১ নং গার্সটিন প্লেসের দোতলার ছাদে মঞ্চ তৈরি করে ছোটদের নাটক হত। জয়ন্ত চৌধুরী প্রায় এক হাতে মহড়া দিয়ে সুকুমার অভিনেতাদের তৈরি করতেন। প্রথম বছর লক্ষ্মণের শক্তিশেল করালাম। ঐ নাটকের কত সম্ভাবনা অমনি প্রকট হল। আমি স্তম্ভিত। ছাদ প্রায় ভেঙে পড়ে!
পরের বছর জয়ন্তর ইচ্ছায় বক-বধ-পালা অভিনয় হল। এত ভালো অভিনয় আমি কম দেখেছি। এক মাস ধরে মহড়া চলল। তার গল্প পরে বলব। এক প্রকাশক নাটকটি পুস্তকাকারে প্রকাশ করলেন, ছোট ছোট ছবি দিয়ে। ১৯৬৩ সালে ঐ নাটকটি দিল্লীর সঙ্গীত-নাটক আকাদেমির পুরস্কার পেল।
এখানে একটি কথা বলি। কোনো সত্যিকার লেখক প্রশংসা বা পুরস্কার পাবার জন্য লেখে না। প্রশংসা পুরস্কার পেলে সে খুশি হয়, কারণ ওগুলি হল স্বীকৃতিস্বরূপ। কিন্তু ওগুলি উদ্দেশ্য নয়। যোগ্য লোক পুরস্কার পেল না এ বড় হতাশার কথা। তার চেয়েও বড় হতাশার কথা হয় যখন অযোগ্য লেখক পুরস্কার পায়, কারণ তাতে পুরস্কারের সম্মান চলে যায়। নাটক দেখে লোকে খুশি হবে চেয়েছিলাম বটে, কিন্তু পুরস্কারের কথা ভাবিনি। তবে পেয়ে খুশি হয়েছিলাম, এ-কথা বলা বাহুল্য। এর পর আরো অনেক নাটিকা লিখেছি, সবই রসের ব্যাপার। এমনিতেই জীবন নানা দুঃখে ভরা, তার ওপর আবার নাটক দেখেও কাঁদতে হবে এ আমার সহ্য হয় না।
॥ ১২ ॥
আমার ৭ বছরের রেডিও জীবন শুরু হয়েছিল এপ্রিল ১৯৫৬ আর শেষ হয়েছিল জুন ১৯৬৩। দিল্লী থেকে বেতার বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল. মাথুর সাহেব, আই-সি-এসের নিমন্ত্রণ পেয়ে ১ নং গার্সটিন প্লেসে গিয়ে শুনলাম বেতার বিভাগে কয়েকজন নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ এবং উৎসাহী লোক নেওয়া হবে প্রযোজকের পদে, প্রডিউসার, অ্যাসিস্টাণ্ট প্রডিউসার ইত্যাদি। আমাকে মহিলা ও ছোটদের আসর পরিচালনা করার ভার দিতে চান তাঁরা। কন্ট্র্যাক্ট সার্ভিস, মাইনে অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু ক্ষমতা অনেক। এঁরাই প্রোগ্রাম তৈরি করবেন, প্রযোজনা করবেন। এঁদের সাহায্যও করবেন প্রোগ্রাম একজেকিউটিভরা আর স্টাফ্ আর্টিস্টরা। এঁদের মাথার ওপর থাকবেন শুধু স্টেশন-ডিরেক্টর। এঁরা জবাবদিহি করবেন শুধু দিল্লীর কর্তৃপক্ষের কাছে। শুনে একটু ঘাবড়ে গেলাম যে আমার পদটি অ্যাসিস্টাণ্ট প্রডিউসারের। সোজাসুজি বললাম, আমি কোনো প্রডিউসারের হুকুমে চলতে পারব না। শুনলাম প্রডিউসার-ট্রডিউসার থাকবে না। কিন্তু পদটা অ্যাসিসস্টাণ্ট প্রডিউসারের। সে কি করে সম্ভব হতে পারে বুঝলাম না। পরে জেনেছিলাম পুরো প্রডিউসারদের বেশি মাইনে দিতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। আমাকে মাসে ৪৫০ দিতে চাইলেন। চটে গেলাম। ও আবার কি একটা মাইনে হ’ল নাকি! তাড়াতাড়ি সেটাকে ৫৫০ করে দেওয়া হল। আমি গলে জল। আসলে টাকাকড়ির আমার সত্যিকার প্রয়োজন ছিল না, তাই ব্যাপারটাকে এতটুকু তলিয়ে দেখলাম না। যদি দেখতাম, তাহলে তখনি একটা বোঝাপড়া করার চেষ্টা করতাম। তাতে হয়তো সব প্রযোজকদের কাজ করার পথটা অনেকখানি সুগম হত।
ব্যাপারটা খুলে বলি। কারণ অন্য জায়গাতেও হয়তো ঐ রকম একটা অযৌক্তিক পরিস্থিতি গড়ে উঠতে পারে। আসলে স্বাধীনভাবে কাজ করার কথাটা বাজে কথা। তাই কখনো হয়? আমাদের মতো প্রবীণ লেখকদের এ সব পদ নেওয়াটাই ভুল। এ কথা বুঝেছিলাম অনেক পরে।
আমার মনে হয় যাঁরা একটা শিক্ষিত ও সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবেশে মানুষ হয়েছেন, বিশেষ করে যদি তাঁদের নিজেদের কোনো মানসিক সংগতি থাকে, অর্থাৎ লেখেন, কি আঁকেন, কি গানবাজনা করেন—টাকাকড়ির মান-মূল্য সম্বন্ধে তাঁরা ততটা সচেতন হন না। তবে যদি তাঁদের টাকার অভাবে কাজের উপকরণের অসুবিধা হয়, তাহলে অন্য কথা। আমি ছোটবেলা থেকে যে-সব লোকের মধ্যে বড় হয়েছি, তারা কেউ বড়লোকও নয়, আবার অভাবগ্রস্তও নয়। যাদের শ্রদ্ধাভক্তি করেছি খুব বেশি, তাঁরা লেখক, কিম্বা গাইয়ে, কি ছবি আঁকেন। সাধারণ সাদাসিধে জীবনযাত্রা; যা আছে তাতেই চলে যায়। নিজের শখের কাজটি করতে পেলেই হল।
আমারো হয়েছিল তাই। ঘরকন্নার মধ্যে মধ্যে একটু আধটু লিখে লিখে জীবনের ৪৮টা বছর কাটিয়েছিলাম। বিধাতা যেটুকু গুণ দিয়েছিলেন, তার অনুপাতে কাজ বিশেষ কিছুই দেখাতে পারিনি। মনে হয়েছিল এই একটা সুযোগ এল, নিজের মূল্য কর্মক্ষেত্রে যাচাই করার। আর মাসে মাসে ৫৫০ টাকা হাত-খরচা তো অনেক টাকা। এই রকম ভেবে-টেবে, রাজি হয়ে গেলাম। আমার স্বামীও উৎসাহ দিলেন। ছেলে ডাক্তারি পড়ে, মেয়ে বি-এ পড়ে। কাজের যথেষ্ট অবকাশ।
যেটা বুঝিনি সেটা হল যে লেখকরা, শিল্পীরা যেভাবে চিন্তা করুন না কেন, কর্মজগতে মাইনের হার দিয়েই মান-সম্মান বিতরণ করা হয়। প্রযোজক হবেন কর্তা আর তাঁর নির্দেশ পালন করবে যে সব প্রোগ্রাম একজেকিউটিভরা তারা পাবে বেশি মাইনে, বাড়ি ভাড়া, প্রভিডেণ্ড ফাণ্ড, অবসর নিলে পেনশন ইত্যাদি এ রকম ব্যবস্থা একেবারে অচল। যারা বেশি টাকা রোজগার করে তারা কম-টাকা পাইয়েদের অশ্রদ্ধার চোখে দেখে। যদি না তাদের নিজেদের এতটা গুণ কিম্বা গুণগ্রাহিতা থাকে যে কম-মাইনের গুণীর কাছে মাথা নিচু করতে প্রস্তুত থাকে। আশ্চর্যের বিষয় যে এই দিকটা আমার আগে মনেই হয়নি। আমারো হয়নি এবং আমার সঙ্গে যে ক-জন প্রতিভাবান সাহিত্যিক সাঙ্গীতিক প্রযোজনার কাজ নিয়েছিলেন, তাঁদেরো কারো মনে হয়নি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শৈঁলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, যিনি নাটক বিভাগের প্রযোজক হয়েছিলেন। এখানে অবিশ্যি প্রচারের যান্ত্রিক ও কার্যকরী দিকটার অধিবেশন ছিল না। তখনকার যন্ত্রপাতিগুলিও কম জটিল ছিল না। মঞ্চের নাটক, কি চলচ্চিত্রের নাটকের প্রযোজনা আর বেতার নাটকের কাজ এক নয়। হয়তো এই কারণে শৈলজানন্দকে অনেক কষ্ট সইতে হয়েছিল। সে সময়েও শ্রীবীরেন ভদ্রের মতো সব দিক দিয়ে সুদক্ষ বেতার নাটক প্রযোজক, লেখক এবং অভিনেতা ঘরের মধ্যে থাকলেও, কেন যে বাইরের প্রতিভা আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা ভেবে পাই না। টিকতে পারেননি শৈলজানন্দ। আমাকে বলতেন, ‘আমার সঙ্গে সবাই অসহযোগিতা করে, কাজ করতে পারি না। আপনার সঙ্গে করে না?’
প্রথম প্রথম করত আমার সঙ্গেও। হয়তো ঐ ১৯৫৬/৫৭ সালে। ওতে আমার কিছু এসে যেত না। রেগে যেতাম অবিশ্যি, কিন্তু কাজের ক্ষতি হতে দিতাম না। সব কাজ রপ্ত করে ফেললাম। নিজেই খাতাপত্র তৈরি করে, হাতে করে যথাস্থানে নিয়ে গিয়ে সই করিয়ে, পাকা করে ফেলতাম। আমার ক্ষতি করবার চেষ্টার হয়তো মাস তিনেক আয়ু ছিল। আরেকটি কথা হল সমস্ত স্টাফ আটিস্টদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলাম। শ্রীমতী বেলা দে, ইন্দিরা দেবী আর জয়ন্ত চৌধুরী—এরা ছিল আমার সহায় ও সম্বল। জয়ন্ত আমাকে ধরে এঞ্জিনিয়ারিং রুমে নিয়ে গিয়ে রেকর্ডিং-এর যান্ত্রিক দিকটা হাতে ধরে শিখিয়ে, তবে ছেড়েছিল। এক বছরের মধ্যে আমিও দক্ষ হয়ে উঠলাম। তবে জয়ন্তর মতো কাউকে দেখিনি। যেমনি লিখত, তেমনি বলত, তেমনি অভিনয় করত, রেকর্ডিং করত। সকলের সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করত, এত দয়া মায়া ছিল ওর শরীরে যে যত দেখছি তত অবাক হয়েছি। আমার ও আমার স্বামীর সঙ্গে তার গভীর স্নেহের সম্বন্ধ হয়ে গেছিল। তার সঙ্গে কাজ করাই ছিল একটা আনন্দের ব্যাপার। সে কথা পরে বলব।
তবে প্রোগ্রাম অ্যাসিস্টাণ্টদের ক্ষোভের কারণটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কতকগুলো অনভিজ্ঞ বাইরের লোক এসে, ওদের নিজের এলাকায় প্রাধান্য পাবে, এটা সহ্য করা শক্ত। বিশেষ করে যদি ক্ষুব্ধ ব্যক্তিটির নিজের গুণ কম থাকে, জ্ঞানের দৌড় বেশি না হয় এবং মনের উদারতা না থাকে। এদের সঙ্গে পরে আমার খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরস্পরকে আমরা বুঝে নিয়েছিলাম।
শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্রের অন্য ব্যাপার। তাঁর মতো স্বাধীনচেতা, অতিশয় গুণী মানুষের কোনো রকম বাধ্যবাধকতার পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়াই উচিত হয়নি। তিনি তখন সাহিত্যজগতের শ্রেষ্ঠ রত্নদের একজন। এমন ছোট গল্প, এমন কবিতা ক-জনই বা লিখতে পেরেছেন। সিনেমার শখ তাঁর সাহিত্য কর্ম থেকে অনেকখানি সময় খাবলে নিয়েছিল। আমার মনে হত ক্ষমতার তুলনায় খুব কম লিখতেন। ধর-পাকড় করে অনেক সময় লেখাতে হত। মনে হত সিনেমার কাজ ছাড়লেও, মোহটা মন থেকে কাটেনি। সিনেমার চাঞ্চল্যকর কাজের পর, রেডিও-র রুটিন কাজ তাঁর নিশ্চয় অসহ্য লাগত। বেশি দিন থাকনেওনি। কিন্তু সে সময়টাতে আমাদের অশেষ আমোদের সামগ্রী দিয়েছিলেন।
মাথা ভরা কালো কোঁকড়া চুলের তলায় নানা অপ্রত্যাশিত বিষয়ে নির্ভুল এবং অপর্যাপ্ত জ্ঞান গিজগিজ করত। মাঝে মাঝে হাঁ করে শুনতাম। অসম্ভব আমুদে মানুষটা, আশ্চর্য রসবোধ, আশ্চর্য বুদ্ধি। আমাদের বাড়ির আজীবন অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছেন। উনি একা নন, ওঁর স্ত্রী বীণাও যে কি অসাধারণ নারী ছিলেন, না জানলে ভাবা যায় না। এদের আমরা হারিয়েছি, জয়ন্তকে, বীণাকে, শৈলজানন্দকে। তবে প্রেমেনবাবুর মতো মানুষ যে একটা বেতার কেন্দ্রের অধ্যক্ষের, কিম্বা অধ্যক্ষের অ্যাসিস্টাণ্টের আদেশ পালন করে চলবেন, এমন চিন্তাও হাস্যকর। নিজের ইচ্ছামতো কিছুদিন চলে, আমাদের মতো কয়েকজন লোকের আজীবনের বন্ধুত্ব আহরণ করে, বেতার বিভাগ থেকে কেটে পড়লেন।
থেকে গেলাম আমি সাত বছর। বহু প্রিয় বন্ধু লাভ করেছি ওখান থেকে। সাহিত্যকর্মের যে দরজাটা খুলতে পারছিলাম না, সেটা আপনা থেকেই এবার খুলে গেল। সকালে এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পাঁচটা ছ’টা, কিম্বা তারো পরে বেতারের কাজ করে, রাতে দেখি কলমের আগায় কথার ভিড়! ঐ সাত বছরে আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। চুপচাপ ভালো মানুষের মতো কাটাইনি কাল। সহকর্মীদের সঙ্গে অনেক সংঘর্ষ হয়েছে, অনেক তুফান নিজেই তুলেছি। তারপর পায়ের নিচে মাটি পেয়েছি। ৭ বছর বাদে যখন বুঝলাম এ পরিবেশ থেকে চলে যাবার সময় এসেছে, তখন ছেড়েও দিয়েছি। তবু বলব বড় আনন্দে আমার ঐ ৭টা বছর কেটেছিল। এত ভালো লোকের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, এত সব উপভোগ্য ব্যাপার ঘটত, যা আর কোথাও সম্ভব হত না। তার কিছু কিছু ভাগ সবাইকে দিতে ইচ্ছা করে।
১৯৫৬ সালের পর প্রায় ৩০ বছর কেটে গেছে। কথায় বলে এক পুরুষের মেয়াদ হল মাত্র ৩০ বছর। কিন্তু সে সময়কার অনেক বেতারকর্মী এখনো দক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে, বরং তখন ছিল কাঁচা এবং অনভিজ্ঞ, এখন তারা বিশেষজ্ঞের কোঠায় পড়ে। ২৭ বছর আগেকার ঐ প্রায় শিক্ষানবিশের দল আজকাল কলকাতার বেতার বিভাগের বড় অবলম্বন। যেমন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারি রসবোধ তার। কিংবা বেলা দে। কিম্বা দেবদুলাল, সে যখন বেতারে কাজের জন্য প্রথম এল, আমি তার পরীক্ষকদের একজন ছিলাম। লাজুক, সুকুমার, তালঢ্যাঙা শ্যামলা ছেলেটিকে দেখে মায়া লেগেছিল। মনে আছে সাদাসিধে শার্ট আর একটু খাটো ধুতি পরে, কায়দা দুরস্ত পরীক্ষকদের সামনে বসেছিল। তখন যেমন নিয়ম ছিল, মধ্যিখানে একটা বোধহয় কার্ডবোর্ডের যবনিকা ছিল। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু কানে যেই এল দেবদুলালের স্পষ্ট ও চিত্তাকর্ষক কণ্ঠস্বর, সকলে একবাক্যে তাকে মনোনয়ন করে ফেলেছিলেন। চেহারা দেখলে দিল্লীওয়ালারা ততটা আকৃষ্ট হতেন কি না জানি না। লিখিত পরীক্ষাতেও ভালো করেছিল। এখন সে বেতারের একজন দক্ষ কর্মী ভাবতে ভালো লাগে।
ছোটদের প্রোগ্রাম ইন্দিরা সুন্দরভাবে পরিচালনা করত। মাঝে মাঝে আমিও থাকতাম। তারকদা বলে একজন সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গেও যেমন, তেমনি পঙ্কজ মল্লিকের মতো নামকরা গাইয়ের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কি মধুর তাঁদের ব্যবহার, কি নিখুঁত তাঁদের কাজ। কোমল, নিরহংকার কত মানুষের সঙ্গে যে স্টুডিওতে দেখা হত ভার ঠিক নেই। সুধীর মুখুজ্জে বলে একটি ছেলে, সুকুমার বলে একজন সঙ্গীতজ্ঞ। কেউ এদের সেকালে কোন স্বীকৃতি দিত না। স্টাফ্ আর্টিস্টদের আবার স্বীকৃতি কিসের? ভালো করে গান বেঁধে, সুর দিয়ে ছোটদের তৈরি করে নিখুঁতভাবে ব্রড্কাস্ট করা তাদের কাজ। সেই জন্য তারা যৎকিঞ্চিৎ—খুবই কিঞ্চিৎ, প্রায় আতস কাচ দিয়ে দেখার মতো—মাইনে পায় না! ওটুকু ওদের কর্তব্য। এই সব শুনতাম দোতলার প্রোগ্র্যাম একজেকিউটিভদের মুখে। নাকি কারো কারোর মাসে মাসে কন্ট্র্যাক্ট, কারো তিন মাসের, কারোর বা এক বছরের নতুন কন্ট্র্যাক্ট নির্ভর করত উপরওয়ালাদের মর্জির ওপর। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড বা অন্য কোনো সুবিধা ছিল না। আরো শুনলাম প্রযোজকরাও ঐ পর্যায়ে পড়েন, তা তাঁরা যত গুণী লেখক বা সঙ্গীতজ্ঞ হন না কেন। ঐ সব সুবিধা তাঁরাও পান না। পেনশনও না। শুনে শুনে এবং দেখে দেখে ওদের জন্য ভারি সহানুভূতি হত। লক্ষ্য করতাম একজন উপরওয়ালা কামাই করলে অন্য যে-কেউ তার কাজ চালিয়ে দিতে পারত। কিন্তু একেকজন বিশেষ স্টাফ্-আর্টিস্ট না এলে, অমনি হুলস্থূল কাণ্ড হত। অবাক হতাম ভেবে যে প্রযোজকরা পরিকল্পনা তৈরি করবেন; কে কি করবে, কি বলবে ঠিক করে দেবেন; অজস্র স্ক্রিপ্ট লিখবেন, ভাষণ দেবেন, মহড়া দেবেন, রেকর্ড করাবেন; সমস্তই স্টাফ্-আর্টিস্টদের সাহায্যে। কিন্তু মান-মর্যাদা-মাইনে এদের কিছুই নেই। অবিশ্যি নামকরা লেখক বা গায়কের মান-মর্যাদা তো আর এরা কেড়ে নিতে পারত না। পারত শুধু কিছু নিন্দামান্দা আর অসুবিধা করতে আর লম্বা লম্বা বিপরীত রিপোর্ট দিতে। আমার নামেও এক আধবার দিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত সবাই খসে পড়লেন, বাকি রইলাম আমি আর দীপালি আর জ্ঞান ঘোষ, তার পদটি অবিশ্যি ঠিক আমাদের মতো ছিল না। তাছাড়া সে ছাড়লে আধুনিক সঙ্গীতকে মান দেবে কে? সে আমাকে বলত, ‘খবরদার, মামিমা, ওদের কথায় কক্ষণো ছাড়বে না। ছাড়লে নিজের ইচ্ছায় ছাড়বে। নইলে পরাজয় স্বীকার করা হবে।’ তা তো আর হতে পারে না। তাছাড়া অল্প সময়ের মধ্যে কি উপরওয়ালা, কি স্টাফ্ আর্টিস্ট সকলের সঙ্গে আমার সদ্ভাব হয়ে গেল। আর, একজন বাদে যত স্টেশন-ডিরেক্টর দেখলাম, সকলেই অতি ভালো। তাই ৭ বছর মহানন্দে কাটিয়েছিলাম। ঊষা ভট্টাচার্য আর সুকুমার রায়, আমার ঘরে এই দুজন প্রোগ্র্যাম একজেকিউটিভ বসত। সুধীন চট্টোপাধ্যায় প্রেমেনবাবুর সঙ্গে কাজ করত। লেখাপড়া জানা, সঙ্গীতজ্ঞ, দক্ষ, সুপটু সব, সৌজন্যের প্রতিমূর্তি, বহু গুণের অধিকারী। জেদ করে যদি লেগে না থাকতাম, এদের আসল পরিচয় পাবার সময় পেতাম না। ঐ যারা সরব হয়ে উঠত প্রযোজকদের বিরুদ্ধে, তারাই সংখ্যায় কম ছিল। এরা নীরবে কাজ করত বলে হঠাৎ চোখে পড়ত না। এ সব মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমার জীবনে অনেক সুখ জমেছে। সুনীল বসু ছিলেন অ্যাসিস্টাণ্ট স্টেশন ডিরেক্টর, সঙ্গীতজ্ঞ, ভারি রসিক।
ঐ আরেকটি জিনিস। গান-বাজনা, নাটক, গল্প, কবিতা, রসালাপের মিলিত প্রভাবে একরকম আবহাওয়া তৈরি হয়। সে হল রসের আবহাওয়া। ভারি উপভোগ্য; অন্য জায়গা থেকে তার স্বাদ একেবারে আলাদা। খুব সরস, হয়তো সামান্য একটু অসামাজিক, নিতান্ত নির্দোষ, ভারি উপভোগ্য। তবে আর কোথাও চলে না। বাড়িতে দু একটা উদাহরণ দিতেই প্রতিক্রিয়া দেখে সেটা বুঝলাম। জয়ন্ত বলল, ‘আহা, আপিসের ঠাট্টা-তামাসা কক্ষণো বাড়িতে বলতে হয় না, এ-ও জানেন না।’ জানতাম না সত্যি, তবে এবার জানা হল। সবাই এক বাক্যে বলল, ‘এখানকার কথা আমরা কক্ষণো বাড়িতে বলি না!’ ঐ একটা শিক্ষা হল।
তবে মজার মজার ঘটনাও ঘটত। জানুয়ারি মাসে রেডিও সপ্তাহ পালন করা হত মহা ধুমধামে। বিশেষ প্রোগ্র্যাম হত। লোকজন নেমন্তন্ন করে গান-বাজনা শোনানো হত। মঞ্চের ওপর চারটি নাটক হত। তার জন্য এক মাস আগের থেকে মহড়া চলত। শিশুমহলের পক্ষ থেকে ছোট একটি। গল্পদাদুর আসরের পক্ষ থেকে একটি, মহিলা-মহলের পক্ষ থেকে একটি। তাছাড়া নাটক বিভাগ থেকে ভালো কিছু হত। ঐ প্রথম তিনটি আমার দায়িত্বে ছিল। সুযোগ্য সাহায্যকারী থাকাতে আমি নির্ভয়ে কাজে নামলাম। যেমন দক্ষ ঊষা, তেমনি ইন্দিরা, আর জয়ন্ত তো একাই একশো। আমার নাটক প্রযোজনার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না কিন্তু প্রচুর আইডিয়া এবং পড়াশুনো ছিল। নাটক বাছাই হল। ছোটদের জন্য নাচ-গান মিলিয়ে ছোট্ট এবং সুন্দর কিছু। ইন্দিরা আর ঊষা তৈরি করে নিল। গল্পদাদুর আসরে জয়ন্তর দাদা নামকরা লেখক ও নাট্য-পরিচালক প্রশান্তর লেখা ‘কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ’ হল আর মহিলামহল থেকে আমার ‘মোহিনী’ নাটক হল। সে এক আনন্দযজ্ঞ। প্রতি বছর করা হত। আজ পর্যন্ত সে কথা মনে করলেই মন খুশি হয়ে যায়।
রোজ মহড়া হত। খুদে অভিনেতাদের অভিভাবকরা স্কুলের পর, তাদের নিয়ে আসতেন। তাঁরা নিচে অপেক্ষা করতেন। মহড়া হত দোতলায় বড় ৬ নং স্টুডিওতে, যাকে সবাই ভূতুড়ে স্টুডিও বলত। এক দিনের কথা বলি। যদ্দুর মনে হয় একটা শনিবার। বিকেল থেকে বৃষ্টি পড়ছে, চারদিকের আলো কমে গেছে। তাতে কি? ছাতা বর্ষাতি নিয়ে খুদেরা অভিভাবক সহ এসে, স্টুডিও জমিয়ে দিয়েছে। কর্মীরা যে যার বাড়ি গেছে। যারা ডিউটিতে তারা ব্যস্ত। ভূতুড়ে স্টুডিও হাসি কলরবে মুখরিত। এমন সময় দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে, অমনি দরজা বন্ধ করে, তাতে ঠেস্ দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রেমেনবাবু বললেন, ‘আমাকে বাঁচান!’ সঙ্গে সঙ্গে হাসি তামাশা বন্ধ, ঘরময় থমথম। আমরা বললাম, ‘কি হল?’ ‘কি হল?’ ‘আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে!’ ‘কি সব্বনাশ! কে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে?’ ‘এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একজন ষণ্ডামতো ছেলে!’
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, ‘কেন এসেছে?’ ‘ওদের বার্ষিক উৎসবের প্রধান অতিথি আসেননি, তাই।’ আমি বললাম, ‘আশা করি আপনি সেই প্রধান অতিথি নন্।’ প্রেমেনবাবু উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘না, কক্ষণো না!’ তখন জয়ন্তকে বললাম, ‘তুই গিয়ে তাকে ভাগিয়ে দিয়ে আয়। প্রেমেনবাবু এখানে বসুন।’ প্রেমেনবাবু ভারি বিরক্ত, ‘আহা, ওর কম্ম নয়। তাহলে তো সেপারজিও পারতেন! ওকে দিয়ে হবে না, আপনাকে একবার যেতে হবে।’ সেপারজি ছিলেন আমাদের হিন্দী প্রডিউসার। দক্ষ প্রযোজক, নামকরা হিন্দী লেখক এবং এমন অমায়িক বুদ্ধিমান লোক কম দেখা যায়। দুঃখের বিষয়, কয়েক বছর আগে হৃদ্রোগে তিনি মারা গেছেন। যাই হোক, সেই ১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে সন্ধ্যায় প্রেমেনবাবুকে আগে পাঠিয়ে, আমি একটু বাদে গিয়ে তাঁকে ডাকলাম ছোটদের মহড়ায় কিছু সাহায্য না করলেই নয়।
দেখি লম্বা চওড়া মিষ্টিমুখো যুবক, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবে ওঁর ঘরে বসে আছে। আমার কথা শুনেই বলল, ‘উনি তো যেতে পারবেন না। আমি ওঁকে শিবপুরে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছি।’ আমি তাকে অনেক কষ্টে বোঝালাম যে, আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। ও-ভাবে কর্তব্যের অবহেলা করতে পারি না। তখনো ৬টা বাজেনি, এই বেলা বিকল্প কাউকে পাওয়া যেতে পারে। আর দেরি করলে তাও যাবে না। এই বলে কয়েকজন সম্ভাব্য হতভাগ্যের নাম-ও বলে দিলাম, যাদের মধ্যে এক-আধজন শীতের বাদলা সন্ধ্যাকে ডরাবে না। কে গেছিল শেষ পর্যন্ত তা জানি না। তবে ছেলেটি বলেছিল কাউকে না কাউকে নিয়ে যেতে না পারলে অপেক্ষমান সহপাঠীরা ওকে ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলবে! কাজেই সে-ও বাড়ি চলে যাবে।
আরেকটা গল্প বলি। বোধ হয় তার পরের বছরের ব্যাপার। সেবার হয় লক্ষ্মণের শক্তিশেল, নয় আমার বক-বধ-পালা হয়েছিল। মোট কথা পোশাক আশাক স্টেজ-সাজানো ইত্যাদির জন্য বেশ কিছু উপকরণের দরকার হয়েছিল। বেতার নাটক নিত্য হয়, কিন্তু সে-তো অন্তরীক্ষের ব্যাপার, সাজসজ্জার দরকার হয় না। শেষ পর্যন্ত বিভাগীয় প্রোগ্র্যাম এক্জেকুটিভের পরামর্শে সেগুলো কেনাই স্থির হল। এক্জেকুটিভ বলল, ‘যা খরচ পড়ে, বিল করে দেবেন। অ্যাকাউন্ট বিভাগ থেকে টাকা পেয়ে যাবেন। মহড়ার সময় ছেলেমেয়েদের যে জলখাবার খাওয়ান, তারো দাম পেয়ে যাবেন।’ খুব বড় একটা অংক নয়, তবে মোট শ-দেড়েক মতো হবে। ইন্দিরা, জয়ন্ত আর আমি কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে ফুটপাথের স্টল থেকে সব কিনে আনলাম।
বলা বাহুল্য খুব সফল নাটক হল। প্রতি বছর-ই ঐ উৎসবের সব নাটক ভালো হত, এটা লক্ষ্য করেছিলাম। সব চুকেবুকে গেলে, আমাদের হিসাব খাতা দেখে নিখুঁৎ এক বিল তৈরি করলাম। স্কুলে-কলেজে আমি অংকে খুব কৃতিত্ব দেখাতাম। এত দিনে সে বিদ্যাটাকে কাজে লাগাতে পেরে আমার আহ্লাদের শেষ ছিল না।
দুঃখের বিষয় নিখুঁৎ বিল ফেরত এল। কোণায় লাল কালিতে লেখা—“সঙ্গে ভাউচার না থাকলে এ অপিসে কোনো বিল গ্রহণ করার নিয়ম নেই।” অনেক বোঝালেও যখন অ্যাকাউণ্টাণ্ট বললেন, ‘তা হতে পারে, কিন্তু তাদের কাছ থেকে ভাউচার না আনলে টাকা দেওয়া যায় না।’ মুশকিল হল ফুটপাথের ঐ দোকানদাররা বিল বা ভাউচার জাতীয় কিছু দিতে রাজি হয় না। বোধ হয় লাইসেন্সই নেই বেচারিদের। একবার ভাবলাম আমিই দিয়ে দিই টাকাটা। তারপর মনে হল ওরা হয়তো নিতে চাইবে না। তাছাড়া নিজের অক্ষমতা স্বীকার করা হবে। গেলাম স্টেশন ডিরেক্টরের কাছে পরামর্শের জন্য। সব শুনে মুচকি হেসে বললেন, ‘তা দিয়েই দিন না গোটা কতক ভাউচার।’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, ‘বলছি, ফুটপাথের দোকানদাররা ভাউচার দেয় না!’ তাতে কি হয়েছে? আপনি বানিয়ে বানিয়ে এত ছোটগল্প, নাটক নবেল লিখতে পারেন আর সামান্য কয়েকটা ভাউচারের জন্য এত দুশ্চিন্তা করছেন! উঠি, আমার আবার একটা মিটিং আছে!’ এই বলে সরে পড়লেন।
তখন আমার ঘরে ফিরে গিয়ে কে কোন ভাউচার আনবে তাই নিয়ে পরামর্শ হল। আমি দু একটা নমুনা তৈরি করে দেখালাম। কিন্তু জয়ন্ত বলল, ‘ওতে চলবে না, বড্ড বেশি শিক্ষিত হাতের লেখা হচ্ছে! ভাউচার ও-রকম হয় না!’ আমি তো চটে কাঁই! ‘কি! বাঁ হাতে লিখলাম, বললেই হল বড্ড বেশি শিক্ষিত!’ তখন পাশের টেবিল থেকে প্রসন্নবদন নীরব দর্শক ও শ্রোতা মোহন সিং সেঙ্গার বললেন, ‘বলেন তো আমি লিখে দিতে পারি। আমার ডান হাতের বাংলা লেখাটাও বেশ অশিক্ষিৎ মতো!’ আমরা তখুনি রাজি হয়ে গেলাম। চমৎকার কতকগুলো নানাবিধ হস্তাক্ষর সম্বলিত ভাউচার সহ বিলটি আরেকবার পেশ করতেই মঞ্জুর হয়ে গেল। যে যার টাকা পেয়ে গেল। কিন্তু আমাদের ঐ খুদে অভিনেতাদের জলখাবারের খরচটা আমরা নিজেরা সানন্দে বহন করেছিলাম। তার ভাউচার তৈরি করিনি।
এই রকম ছোট ছোট বহু মজাদার ঘটনা দিয়ে আমার ঐ সাতটা বছর ভরে ছিল। ওগুলোকে আমি আমার জীবনের একটা আনন্দময় অংশ বলে মনে করি। তখন অবিশ্যি মাঝে মাঝে সাময়িকভাবে মাথা গরম হয়ে যেত। সকলের কাছ থেকে তো আর সমান ব্যবহার পাওয়া যেত না। স্টাফ্ আর্টিস্টদের ওপর অনেক অবিচার হত। কিছু বলতে গেলে পরিচালকরা বিরক্ত হতেন। একবার আমার প্রিয় বন্ধু এবং স্টেশন ডিরেক্টর পি সি চ্যাটার্জি বলেছিলেন, ‘সব অবিচার নিয়ে আপনি মাথা ঘামান কেন, আপনি তো আর ভগবান নন।’ তার অনেক বছর পরে, তিনি যখন দিল্লীতে ডিরেক্টর জেনারেল হলেন, আমি তাঁকে লিখেছিলাম, ‘আমি কোনো সময়ই ভগবান না হলেও, তুমি তো এখন হয়েছ এবার দেখব তুমি কত অবিচার নিয়ে মাথা ঘামাও।’ মানুষটি বড়ই ভালো, এবং দক্ষ কর্মচারীও বটে। আজকাল স্টাফ্ আর্টিস্টদের দুঃখের দিন শেষ হয়েছে। যত দূর বুঝি অন্য অফিসারদের সঙ্গে তাদের পদমর্যাদা ও মান কিছু কম নয়। গোড়ার পরিকল্পনায় একটা বড় ভুল ছিল। দুজনার কাজের এলাকা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হওয়া উচিত ছিল এবং টাকাকড়ির দিক থেকে কোনো তফাৎ রাখা ঠিক হয়নি। আজকালকার দুনিয়ায় তেঁতুলপাতা সেদ্ধ খাওয়া পরম পণ্ডিতদের কেউ আদর করে না।
নাটকের বিষয়ে ফিরে আসি। বীরেনদা একদিন আমাকে বলেছিলেন যে নাটকের জগতে এসে তিনটি জিনিস ত্যাগ করে আসতে হয়, যথা লজ্জা ঘৃণা ভয়। তা সে ফিল্মেই হক, বা মঞ্চে, কিংবা বেতারেই হক। মহড়া দেবার সময় জয়ন্ত তার ছোট অভিনেতাদের শেখাত, ‘ভয় ছাড়ো, লজ্জা ভোল। যতদূর সম্ভব নিজেকে ছেড়ে দাও, বাড়াবাড়ি কর, সত্যি সত্যি কুম্ভকর্ণ কিম্বা বকরাক্ষস হয়ে যাও!’ ঐ বয়সের ছেলেমেয়েরা এমনিতে স্বাভাবিক আচরণ করে, খুব বেশি কৃত্রিমতা জানা থাকে না তাদের। বেশির ভাগকেই যা শেখানো যায়, তাই মেনে নেয়। কেউ কেউ শিক্ষকের হুবহু অনুকরণ করে। আমার মনে হয়, তারা বেশিদূর এগোয় না। আরেক দল আছে, তারা শিক্ষকের শিক্ষার সঙ্গে নিজের বুদ্ধিও জুড়ে দেয়। হয়তো খানিকটা সামলে দিতে হয়, কিন্তু তাদের যে নাট্যবোধ আছে, সেটুকু প্রমাণ হয়ে যায়। বীরেন্দ্রকিশোর ভদ্র আর জয়ন্ত চৌধুরী এই দুটি মানুষ যদি অন্য কোনো অগ্রসরবান দেশে জন্মাতেন, পৃথিবী জোড়া নাম হত। দুজনের পদ্ধতি দেখতাম আলাদা। বীরেনদার মধ্যে কতকগুলো ধ্রুপদী নিয়ম দেখতে পেতাম। জয়ন্ত একেবারে আধুনিক, যার চোখে নাটকে আর সত্যিকার জীবনের সংলাপে কোনো তফাৎ নেই। আমি ভাবতাম ধ্রুপদী বিষয়ে বীরেনদার জুড়ি নেই, সমসাময়িক নাটকে জয়ন্তর হাতের তুলনা হয় না। এসব আমার ব্যক্তিগত মন্তব্য। ইংরিজি সাহিত্যে এম-এ পড়ার সময়ে নাট্যশিল্প নিয়ে যে সমস্ত পড়াশুনো করেছিলাম, হয়তো আমার মতামতের ওপর তার প্রভাব আছে। ব্রাহ্মবাড়ির মেয়েরা সেকালে স্টেজের নাটক দেখার কতটুকু সুযোগ পেত, মহড়া দেখার কথা ছেড়েই দিলাম।
শব্দ সম্বন্ধে আগে এতটা সচেতন ছিলাম না। এখানে শব্দ বলতে আওয়াজ বুঝছি, কথা নয়। আমাদের চারদিকে রোজ রোজ সারা দিন ধরে কত রকমারি আওয়াজ হচ্ছে আর বৃথা নষ্ট হচ্ছে, এ-কথা আগে কখনো ভাবিনি। আমার আসল কাজ যে লেখা ছাড়া আর কিছু নয়, এ আমি চিরকাল জানি। লেখক যা দেখবে শুনবে ভাববে এবং যত দেখবে শুনবে ভাববে, ততই মনের প্রসারতা বাড়বে। আমার আরেকটা সুবিধাও হয়েছিল। কলকাতা ও তার আশেপাশে যত লেখক বাস করতেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হল। বহু গাইয়েদের ব্যক্তিগতভাবে চিনলাম। অভিনেতাও অনেককে কাছের থেকে দেখলাম। সজনীকান্ত দাশ, কি প্রমথ বিশী, কি নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, এই সব দুরের মানুষরা কাছে এসে গেলেন। কত আজীবনের বন্ধু পেলাম। যাদের সঙ্গে চাক্ষুষ দেখার সম্ভাবনা ছিল না, তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্বন্ধ হল। সে কি আমার পক্ষে কম লাভ।
বন্ধুরা মাঝে মাঝে বলতেন, ‘ছোটদের প্রোগ্র্যাম নিয়ে এত চিন্তা করলে, তোমার সাহিত্যরচনা মাথায় উঠবে।’ তা কিন্তু নয়, আমি মনে মনে জানতাম এদের নিয়ে আমার আসল কাজ। জয়ন্ত ছিল আমার মানস পুত্র। ওর সহযোগিতায় কত যে নতুন ধরনের প্রোগ্র্যাম করেছি, এখন আর কেউ তেমন করে না। কত সময় ভোরে যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, গোটা কতক ছেলেমেয়ে, যন্ত্র চালাবার দক্ষ কর্মী দু-একজনকে নিয়ে, রেডিওর গাড়ি করে বেরিয়ে বাইরে থেকে রেকর্ডিং করে আনতাম। সেগুলো যেমন উপভোগ্য, তেমনি শিক্ষাপ্রদ হত। চিড়িয়াখানার অধ্যক্ষের সঙ্গে একবার ঘোরা হল। এমন কি সাপের গর্জানি পর্যন্ত জয়ন্ত তুলে নিল। আরেকবার এখন যেখানে লেকটাউন, ঐ অঞ্চলে মস্ত মৎস্য প্রকল্প দেখতে গেলাম। দুটো নৌকো করে পরিদর্শক সহ মাছের চাষ দেখলাম। কত যত্ন, কত ব্যবস্থা। কয়েক ঘর রাজবংশীর সঙ্গে আলাপ হল। আমাদের গরম মাছভাজা খাওয়াল। মাছধরাই তাদের জীবিকা। তাদের বড় ভয় সরকার নাকি প্রকল্প তুলে দেবেন। তাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। সে লোকগুলো কোথায় গেল কে জানে। মনে আছে জেলেদের নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছিলাম। মাছ বড় হলে, কিম্বা সংখ্যায় বড় বেশি বেড়ে গেলে, ধরা হত। দেখলাম বেড়াজাল দিয়ে মাছ ধরছে। এক কোমর জলে নেমে। প্রকাণ্ড জাল অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফেলা হল। তার মধ্যে কত যে মাছ পড়ল তার ঠিক নেই। তারপর জালের মুখ ক্রমে ছোট করে আনা হতে লাগল। ছোট মাছরা জালের ফাঁস গলে পালিয়ে গেল। বড়গুলো আটকা পড়ল। কি তাদের আকুলি-বিকুলি! লাফ দিয়ে জাল ডিঙিয়ে অনেকে পালাল। জয়ন্ত তাদের লাফ দিয়ে পড়ার ঝুপ ঝাপ শব্দটি পর্যন্ত তুলল। জেলে সরদার সব বুঝিয়ে দিল। কি দক্ষ, সরল, বুদ্ধিমান মানুষ তারা। আমার ‘নাটঘর’ বইতে ওদের কথা একটু লিখবার চেষ্টা করেছিলাম।
আরেকবার বেহালার দিকে অনাথ ছেলেমেয়েদের আধা সরকারি আশ্রমে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে রেকর্ড করে আনলাম। এ-সব জিনিস বারে বারে শোনাবার যোগ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এত কষ্টের ধনগুলোকে একবার শুনিয়ে টেপ্গুলি মুছে ফেলে অন্য কাজে লাগানো হল। ভারি ক্ষোভ হয়েছিল। পি সি চ্যাটার্জি বলতেন, ‘কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন না, লীলাদি। তাহলে ক্ষুব্ধ হবার কারণ থাকবে না।’ আমি বলতাম, ‘তা কি করে হয়, কোনো জিনিসের জন্য মনে একটা দুর্বলতা না থাকলে, সে বিষয়ে আমি জোর পাই না।’ বছর পাঁচেক ঐ সব কাজ করেছিলাম। তারপর জয়ন্ত ভয়েস অফ অ্যামেরিকাতে কাজ পেয়ে বিদেশে গেল। প্রেমেনবাবু পদত্যাগ করলেন। সেঙ্গার দিল্লীতে বদলী হল। শৈলজানন্দ আগেই ছেড়েছিলেন। আমাদের ঐ পুরনো দলটির মধ্যে আমি ছাড়া আর বিশেষ কেউ বাকি রইল না। জ্ঞান ঘোষ আমাদের আগেই এসেছিলেন। বীরেনদাকে রেডিওরই লোক বলা যায়। তাঁর সঙ্গে কারো তুলনা হয় না। তাঁর বন্ধুত্ব পেয়েছি বলে আমি গর্বিত।
১৯৬১ একটা বিশেষ বছর। সারা বছর ধরে রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকী পালন করা হল। দিল্লীতে প্রবীণ সাংবাদিক এবং সমালোচক অমল হোম গেছিলেন শতবার্ষিক অনুষ্ঠানের প্রধান প্রযোজক হয়ে। কলকাতাতেও ঐ কাজে দু-তিনবার যাওয়া আসা করলেন। কাজটি তাঁর মনের মতো। সবচেয়ে উপযুক্ত কর্ণধার-ও তিনি। রবীন্দ্রভক্ত, সাংবাদিক, পড়াশুনো আছে। লেখেন ভালো, বলেন ভালো। সকলের সঙ্গে মিশতে পারেন। সস্ত্রীক গিয়ে গুছিয়ে বসতে না বসতে ভাগ্যের এমনি পরিহাস যে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকি জীবনটা অচল নির্বাক হয়ে কাটাতে হল। এর ১৪ বছর পরে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর কথা মনে করলেও আমার কষ্ট হয়। কিন্তু ১৯৬১ সালে তাঁর অসুখের প্রথম ফল হল যে আমাকে দিল্লী গিয়ে তাঁর কার্যভার গ্রহণ করতে হল। বাড়িঘর ছেড়ে সেখানে বাস করতে রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত রফা হল, প্রতি মাসের ১৫ দিন দিল্লীতে থাকব, বাকি ১৫ দিন কলকাতায় বসে শতবার্ষিক উৎসবের কাজ করব। আমার কাজের একটা নতুন পর্যায় শুরু হল। ছোটদের সঙ্গে আর কোন কারবার ছিল না। বাইরের রেকর্ডিং-ও দেখলাম আস্তে আস্তে উঠে গেল।
॥ ১৩ ॥
সেই যে ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের ভার নিয়ে দিল্লী যাওয়া আসা ধরলাম, আর কখনো ছোটদের অনুষ্ঠান করিওনি, করতে ডাকেওনি। অন্য কর্মীরা দক্ষভাবে পরিচালনা করতে লাগলেন, কিন্তু মনে হত জাদুগুণটা চলে গেছে। দিল্লীর কাজ অন্য মেজাজের। সেটাকে সাহিত্যের মেজাজ বলা যায় না। বরং সাহিত্য পরিচালনার মেজাজ। এখন হলে সে কাজটি যত সহজে পারতাম, তখন পারতাম না। তখনো সাহিত্যকে প্রথম স্থান দিতাম, পরিচালনাকে দ্বিতীয়। পরিচালনার একটা নিজস্ব নীতি আছে। সেটিকে রপ্ত করতে অনেক সময় নিল। সুখের বিষয় নামে Chief Producer, Tagore Centenary Programme হলেও, বরাবর আমার মনে হত, এ আমার নিজের কাজ নয়। সাময়িকভাবে অন্য লোকের কাজ করে দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সেই লোকটি হলেন অমল হোম। তাঁকে আমরা ডাকতাম ননী-কাকা। আমার বাপের বাড়ির সঙ্গে তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। ননীকাকার বাবা গগনচন্দ্র হোম ছিলেন আমার মেজ-জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোরের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং তাঁকে ব্রাহ্ম সমাজে আকৃষ্ট করবার আদি কারণ। এমন কি ময়মনসিংহে জ্যাঠামশায়ের স্কুল জীবন থেকে গগনদাদামশাই ঐ কুকর্মটি শুরু করেছিলেন। নিজে কলকাতায় যাওয়া-আসা করতেন আর বন্ধুর কানে একটা শিক্ষিত উদার সামাজিক ব্যবস্থার বিষ ঢালতেন। তার ফলে পরে যখন জ্যাঠামশাই নিজে কলকাতায় এসে প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি-এ এবং তার পরে আর্ট স্কুলে পড়াশুনা করতে লাগলেন, তিনিও যে তখনকার নবীন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের বলিষ্ঠ আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে, ক্রমে একদিন স্বার্থত্যাগী, উচ্চশিক্ষিত যুবকের এবং তাদের নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি? পরে তিনি ব্রাহ্ম সমাজে দীক্ষা নিয়ে, দ্বারিক গাঙ্গুলীর মেয়েকে বিয়ে করে, স্থায়ীভাবে ব্রাহ্ম হলেন। আমার ছোট জ্যাঠামশাই, কুলদারঞ্জন, বাবা, কিম্বা এইচ বসুর স্ত্রী ছোট পিসীমা-এঁরা সকলেই আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম, কিন্তু কেউ দীক্ষা নেননি। এই পুরনো ইতিহাসের ফলে ননীকাকারা নিজেদের আমাদের অভিভাবক সম্প্রদায়ের অংশীদার মনে করতেন। আমরা অবিশ্যি তাতে কিছু খুশি হতাম না এবং উপযুক্ত ব্যবহারও করতাম না। ননীকাকা আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। লম্বা-চওড়া ফরসা শৌখীন মানুষটি, অতি চমৎকার কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গী, অতিশয় কর্তব্যপরায়ণ ও স্নেহশীল। অনেকগুলি ছোট ভাই এবং একটি বোন—সকলেই কাকামণি বলতে অজ্ঞান। এরকম বড় একটা দেখা যায় না।
কলেজে পড়েননি ননীকাকা, ম্যাট্রিক পাস করেই সাংবাদিকতায় তালিম নিয়েছিলেন এবং দেখতে দেখতে বিশেষজ্ঞ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এলাহাবাদে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাগজেও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। আমার জ্ঞানচক্ষু ফুটে অবধি তাঁকে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটের স্বনামধন্য সম্পাদক বলে জানতাম। সৌজন্যে, সামাজিকতায় অদ্বিতীয় হলেও, মাঝে মাঝে স্পষ্টভাষায় লোকের মুখের ওপর নিজের মতামত ব্যক্ত করার জন্য, তাঁর সমালোচকের অভাব ছিল না। আমি সেগুলিকে প্রাধান্য দিতাম না। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। প্রাচীন ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যে দক্ষ। অভিজ্ঞ পরিচালক। সাংবাদিক-সুলভ তীক্ষ্ণদৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে যে গুণটি সব চাইতে বিরল, তার অধিকারী। অর্থাৎ পরম গুণগ্রাহী। আমার মনে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য এঁর চেয়ে ভালো লোক পাওয়া শক্ত।
তাঁর বয়স তখন ৭০। মহাউৎসাহে চমৎকার পরিকল্পনা তৈরি করলেন। প্রথম দর্শনে আমার সেটি যে খুব পছন্দ হয়েছিল তা বলতে পারি না। দেখলাম গুরুত্বপূর্ণ বহু অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তারা অ-বাঙ্গালী। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে শুধু অনুবাদের মাধ্যমে একজন সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় থাকলে, ঐ সাহিত্যিকের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব নয়। তার ওপর রবীন্দ্রনাথের কটা বইয়েরি বা ইংরিজি কি হিন্দী অনুবাদ উপযুক্তভাবে হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথের কাব্য, বা প্রবন্ধ রচনা, বা গল্প উপন্যাস, বা জীবন-দর্শন বিষয়ে মূল ভাষণ দেবেন এমন একজন কেউ, যিনি বাংলা জানেন না, বা যৎসামান্য জানেন?
দিল্লী গিয়ে আমার নিজস্ব মস্ত অপিসঘরে মস্ত টেবিলে, উঁচু-পিঠ সুন্দর চেয়ারে বসে যখন দেখলাম আমার পা-জোড়া পর্যন্ত মাটি থেকে চার ইঞ্চি উপরে ঝুলছে, তখন আমার সমস্ত আত্মপ্রত্যয় প্রচণ্ড নাড়া খেল। আমার সহকারী ছিলেন শ্রীগোপাল দাস। অতি দক্ষ, অতি চমৎকার স্টেশন ডিরেক্টর আচার্য বলে সুদর্শন কম-বয়সী সুপটু প্রোগ্রাম একজেকুটিভ; নাম ভুলে গেছি চালাক-চতুর অদর্শনপটু দক্ষিণ দেশী পার্সনাল অ্যাসিস্ট্যাণ্ট, প্রথমটা তার অস্তিত্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতে নানা অসুবিধায় পড়তাম। সুখের বিষয়, ততদিনে আমার পুরনো বন্ধু পি সি চ্যাটার্জি স্টেশন ডিরেক্টর তখন দিল্লীতে আরো উঁচু পদে ছিলেন। সেক্টার জি ওয়ান হিন্দী চীফ প্রোডিউসার। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বীরেন ভদ্র, জ্ঞান ঘোষ এবং আরো বহু চেনা মানুষকে দিল্লী আসা-যাওয়া করতে হত। তাই দেখতে দেখতে আমি ওখানকার হালচাল শিখে ফেললাম। ক্রমে বুঝলাম ভারত সরকারের নীতিই হল সব বড় ব্যাপারে, সব রাজ্যই যেন প্রতিনিধিত্ব পায়। গোপাল দাস বুঝিয়ে বললেন যে অবাঙ্গালীরা ভাষণটি লিখলেও, তথ্য সংগ্রহ করে দেবার জন্য রবীন্দ্রসাহিত্যে পণ্ডিত, এমন সব মানুষকে কন্ট্র্যাক্ট দেওয়া হয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন বিষয়ে যদিও মূল ভাষণ দিচ্ছেন বেনারসের একজন হিন্দীভাষী অধ্যাপক, তাঁর সামগ্রী জোগাচ্ছেন অধ্যাপক সরোজকুমার দাশ, যাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। কথাটা এত বেশি সত্য যে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল, এমন মানুষটি নিজে ভাষণ দেবার সুযোগ পাবেন না। নাকি ঐ বিষয়ে চারটি ভাষণের তথ্য সরোজ দাশ সংগ্রহ করছেন। এ ব্যাপারের ঐখানেই শেষ নয়। পরিণামটির কথা ভাবলে বোঝা যাবে তখনকার পণ্ডিতদের আর লেখকদের সাহিত্যের প্রতি কি গভীর শ্রদ্ধা ছিল। আজ থেকে ২২ বছর আগেও তাঁরা নিজেদের রচনাকে প্রধানতঃ একটা রোজগারের পন্থা বলে মনে করতেন না। তবে জিনিসপত্রের দামও ছিল এখনকার ১/৫ থেকে ১/১০ কিম্বা আরো কম। এখন কতকটা প্রয়োজনের তাগাদায়, কতকটা মূল্যায়নের দিক্ বদলেছে বলে, যে বইয়ের যত বেশি বিক্রি তাই দিয়ে তার সাহিত্যিক মান-ও স্থির হয়ে যায়। মোট কথা সরোজ দাশ তাঁর সমস্ত বিদ্যা আর যত্ন ঐ চারটি তথ্যমূলক প্রবন্ধে ঢেলে দিয়েছিলেন, যৎসামান্য পারিশ্রমিক নিয়ে। তাঁর, এই নিষ্ঠা কতটুকু স্বীকৃতি পেয়েছিল?
ঐ প্রোগ্রামগুলির জন্যে তাঁর সতীর্থ বন্ধুবান্ধব সাগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলেন। কাজের সময়ে দেখা গেল প্রবন্ধগুলি ভাষা ভাষা, অগভীর ভাষণমাত্র। আসল ব্যাপারের তল পর্যন্ত কোনোটাই পৌঁছয়নি। এমন কি সরোজ দাশের জ্ঞানগর্ভ উপাদানগুলি তার মধ্যে খুঁজে পাওয়াই শক্ত। যেটুকু ছিল তাও ইংরিজিতে ভাষান্তরের ফলে, ঠিক চেনা যাচ্ছিল না। বলা বাহুল্য সরোজ দাশ ভারি ক্ষুণ্ণ, ক্ষুব্ধ। কলকাতার বেতার কেন্দ্রই তাঁর সঙ্গে যোগস্থাপন করেছিল। অমল হোম তখনো কর্ণধার এবং তিনিই অবাঙ্গালী লেখকদের পাণ্ডুলিপিগুলি অনুমোদন করে ছিলেন। এ-সব আমি অনুপ্রবিষ্ট হবার আগে। কিন্তু আমি মাসান্তে কলকাতায় ফিরলেই আমার হাতে তাঁর কাছ থেকে একখানি কড়া চিঠি এল। কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টরকে লেখা। কন্ট্র্যাক্টের শর্ত-ভঙ্গের দায়ে আইনের শরণ-নেবার কথাও ছিল তাতে। স্টেশন ডিরেক্টর দেখলাম বেশ ঘাবড়ে গেছেন এবং সরোজ দাশের ক্ষোভের কারণ বুঝতে তিনি একেবারে অক্ষম।
কিন্তু আমি তাঁর মনের কথা ঠিকই বুঝেছিলাম। স্টেশন-ডিরেক্টরকে বুঝিয়ে সরোজ দাশকে একদিন আমার ঘরে নিমন্ত্রণ করে, তাঁর ক্ষুব্ধ চিত্তে যথাসাধ্য সহানুভূতির প্রলেপ দিলাম। সব লেখকরাই স্পর্শকাতর হন,অনাদরে সকলেই বেদনা বোধ করেন, যদিও কড়া চিঠি সকলে লেখেন না। কিন্তু আমি ঐ বুড়ো মানুষটির তেজ দেখে খুশি না হয়ে পারিনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে রফা হল যে ঐ চারটি প্রবন্ধ আগাগোড়া আমাদের কলকাতা কেন্দ্রের সাহিত্য বাসরে প্রচারিত হবে। তার জন্য নতুন করে চুক্তিপত্র হল এবং এখানকার নিয়মে যতটা বেশি ফী দেওয়া যায়, তারো ব্যবস্থা হল। এই ব্যাপার থেকে আমার শিক্ষা হল যে কোনো সরকারি সংস্থার মূল্যায়ন আর সাহিত্যিক বা সাহিত্য প্রেমিকের মূল্যায়ন এক হয় না।
এর দু-বছর পরে আমার নিজেরও একটা এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে বিবেকানন্দস্বামীর জন্মের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে কলকাতা থেকে ইংরিজিতে একটি সর্বভারতীয় অনুষ্ঠান করেছিলাম। তার জন্য প্রাণপাত করে খেটেছিলাম। বেলুড় মঠের আর রামকৃষ্ণ কালচারাল ইন্সটিটিউটের কর্তৃপক্ষের কাছে যথেষ্ট উপদেশ ও সাহায্য পেয়েছিলাম। খুব যত্ন করে প্রায় ১ ঘণ্টার অনুষ্ঠানটি টেপ করা হল। যাঁরা কণ্ঠ দিলেন, তাঁদের চেষ্টার আর শ্রদ্ধার তুলনা হয় না।
২৩ জানুয়ারি প্রোগ্রামটি প্রচারিত হল। তখন দিল্লীতে ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন মিঃ ভাট। ১৯৬১ সালে তাঁর কাছ থেকে অনেক সহানুভূতি ও সহযোগিতা পেয়েছিলাম। তিনি ঐ প্রোগ্র্যাম শুনে টেলিগ্রাফ করে তাঁর অভিনন্দন জানালেন। হিমালয়ের কোনো সামরিক ঘাঁটি থেকে একজন বাঙালী জোয়ান লিখলেন, ‘এখানকার জীবনযাত্রা এমন যে আমি ক্ৰমে ভগবানের মঙ্গল বিধানে আস্থা হারাচ্ছিলাম। বেতারে ঐ অনুষ্ঠানটি শুনে আবার আমার ভগবানে বিশ্বাস ফিরে এল।’ ঐ চিঠির কপি মিঃ ভাট আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের কলকাতার আপিসে দিল্লী থেকে তাঁদের অনুষ্ঠান সমিতির বিচারকরা লিখলেন, ‘প্রোগ্রামটি খুব ভালো উৎরোয়নি, কারণ গ্রন্থনা যথেষ্ট দৃঢ়-সংবদ্ধ হয়নি।’ অবিশ্যি তাতে আমি এতটুকু ক্ষুব্ধ হইনি, কারণ সেই জোয়ানের চিঠিখানি আগেই পেয়েছিলাম। তাছাড়া আরেকটা কঠিন সত্য-ও আছে। কি সঙ্গীতজ্ঞ, কি শিল্পী, কি নাট্যকার বা অভিনেতা, কিম্বা লেখক, হাজার চেষ্টা করেও সব সময় সব শ্রোতা ও দর্শকদের খুশি করতে পারেন না। এই সত্যটি বেতারের মতো অনুষ্ঠানে আরো তিক্তভাবে প্রতিফলিত হয়। কারণ, বিচারকরা সেখানে কদাচিৎ বিশেষজ্ঞ হন।
এই রকম ভালোয়-মন্দয় দিন কেটেছিল। সমস্ত ১৯৬১ সালটিতে ৬ বার দিল্লী গিয়ে, প্রতিবার ১৫ দিন করে থেকে এসেছিলাম। দুঃখের বিষয় যাওয়া আসার এবং থাকার জন্য যা আমার খরচ হত, (যদিও হনুমান রোডের মৈত্র পরিবারের আতিথেয়তার জন্য আমার কোনো কষ্টই হত না) তার অর্ধেকের বেশি প্রাপ্য হত না। হিসাবের নড়চড় হবার জো ছিল না এবং আমিও দিল্লীতে থাকতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু যে আনন্দ উপভোগ করেছিলাম তার তুলনা হয় না। ওঁরা ভারতের শ্রেষ্ঠ গাইয়ে, বাজিয়ে, নাট্যকার, অভিনেতা, শিল্পী, সাহিত্যিক এক জায়গায় জড়ো করার চেষ্টা করেছিলেন। সে-সব টেপগুলি যদি উপযুক্তভাবে সংরক্ষণ করে থাকেন, তাহলে ১৯৬১-এর ভারতীয় সংস্কৃতির চমৎকার একটি চিত্রশালা তৈরি হতে পারে।
বেতার কেন্দ্রে আমার ঐ ঘরটি ক্রমে শান্তিনিকেতনের আর কলকাতার বন্ধুদের মিলনস্থল হয়ে দাঁড়াল। আমার পুরনো বন্ধু ক্ষিতীশ রায় তখন গান্ধী স্মারক নিধিতে এক দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। বোধহয় মন কেমন করত। আমার প্রোগ্র্যাম এক্জেকিউটিভ আচার্য আমাকে একদিন তার ছিমছাম বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাওয়াল। বুঝতে পারলাম আমার শৈশবে, শিলং-এ তার দিদিমা (রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি) মণীষা দেবীর কাছে হতাশাজনকভাবে গান শিখতে যেতাম এবং মনে পড়ল তার মা, আমার চেয়ে হয়তো বছর তিন-চারের বড় রুবি ভারি দুরন্ত ছিল। এমনি করে জীবনের সূত্রগুলো পাক খেয়ে খেয়ে আবার হাতে ফিরে আসে।
ঐ যে মাঝে ৭ বছর বেতারে কাজ করে কাটালাম, তাতে কিন্তু আমার জীবনের স্রোতটা এতটুকু বিচলিত হয়নি, বরং জোর পেয়েছিল। তখনো মনে হত বড়দের জন্য লেখাটা হবে আসল পেশা, ছোটদের জন্য লেখাটা থাকবে মধুর নেশা। বেতারে নিয়মিত আমার গলা শুনে শুনে আমার বহু ভক্ত জুটেছিল। তারা নানা রকম চিঠি-পত্র লিখত। বেশির ভাগই মহিলা কিম্বা কিশোর-কিশোরী আর কলেজের পড়ুয়া। প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে কম চিঠি পেতাম। তার কারণ একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হলে পর উচ্ছ্বাস করার ইচ্ছাটা চলে যায়। অনেক লাভও হয়েছিল। আপিসের জীবনযাত্রা বিষয়ে একেবারে মুখ্যু ছিলাম, ফাইল বলতে ঠিক কি বোঝায় জানতাম না। আমার টেবিলে ফাইল এলে তাকে নিয়ে কি করতে হবে, তাও আমাকে অতুল বলে ফোঁটাকাটা লম্বাচুল অতি ভদ্র পিওন বুঝিয়ে দিয়েছিল। পিওনদের কাজ যে কাগজপত্র আনা-নেওয়া করা আর টেবিলের ওপর চায়ের পেয়ালা উল্টে দরকারি কাগজপত্র নষ্ট হবার উপক্রম হলেও তাতে তারা যে হাত লাগাতে পারে না, যেহেতু সেটা ফরাসদের কাজ, এটা বুঝতে সময় নিয়েছিল। যখন বুঝলাম তখন তাদের মান-সম্ভ্রমে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ না করে বাড়ি থেকে আনা ঝাড়ন দিয়ে চা মুছতে, কাগজপত্র বগলে নিয়ে টেবিল থেকে টেবিল গিয়ে সই সংগ্রহ করে, নিজের কাজের সুষ্ঠু নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে লাগলাম। শেষটা মনে হত বেতারের যে কোনো বিভাগে আমাকে ভরতি করে নিলে, কাজ চালিয়ে দিতে পারব। বলেছি তো প্রথম কয়েক মাসের পর, (মাঝে মাঝে দু-একজন উটকো পদাধিকারী ছাড়া) সকলের কাছ থেকে খুবই ভালো ব্যবহার পেয়েছিলাম। তারা সকলে মিলে আমাকে নানা বিচক্ষণ উপদেশ দিয়ে একজন জবরদস্ত কর্মচারী করে তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা করত। ঐ আমার সকলের সঙ্গে সমানে সমানে ভাব করার বদভ্যাসটি না থাকলে, বোধ হয় কালে একজন দক্ষ অপিসের বড়বাবু হয়ে উঠতে পারতাম। সুকুমার একদিন বলল, ‘এ-এস-ডি’র ঘর থেকে ঐ সব নোট্ এলে, অমন ব্যস্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি লাগান কেন? পত্রপাঠ পৃষ্ঠার নিচে লিখে দেবেন ও সব কাগজপত্র আমার কাছে নেই, ছিলও না কোনো দিন, এখন কোথায় আছে তা-ও জানি না।—তারপর আমাকে বললেই আমি খুঁজে দেখব কোথায় গুঁজে রেখেছেন!’
এ-এস-ডি হলেন অ্যাসিস্টাণ্ট স্টেশন ডিরেক্টর। আমি প্রথমে ছিলাম এ-পি-সি-ডব্লু, অর্থাৎ অ্যাসিস্টাণ্ট প্রডিউসার চিলড্রেন্স এণ্ড উইমেন্স প্রোগ্রাম্স। দিল্লীর পদটি ছিল সি-পি-টি-সি-পি, অর্থাৎ চীফ প্রডিউসার ট্যাগোর সেন্টেনারি প্রোগ্র্যাম্স। উৎসবান্তে ফিরে এলে তো আর আমাকে অ্যাসিস্টাণ্ট প্রডিউসার করা যায় না। বিশেষতঃ অন্য লোকে যখন এক বছর ধরে ঐ পদে অধিষ্ঠিত। তাছাড়া হয়তো এতকাল পরে আমার দক্ষতা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে, প্রেমেনবাবুর পুরনো পদে আমাকে পি-এস-ডব্লু করে দেওয়া হল। তার মানে প্রডিওসার স্পোক্ন্ ওয়ার্ডস্! যেখানে প্রায় সব-ই স্পোক্ন্, সেখানে ও নামের তাৎপর্য কি তা না বুঝলেও, এটুকু টের পেলাম যে, বাংলা সাহিত্যের দিকটা আমাকে দেখতে হবে এবং সব বিভাগের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি চেষ্টা করলে আমার ঘাড়ে চাপানো যাবে। ততদিনে কিছুদিন অ্যাডভাইজর, অর্থাৎ মন্ত্রণাদাতার পদে থাকার পর প্রেমেনবাবু খসে পড়েছিলেন। বেতার আপিসে কদাচিৎ আসতেন, ওঁর সরস কথা শোনার মজা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। তবে আগেও বলেছি, প্রেমেনবাবু সত্যিকার সৃষ্টিকার, কোনো আপিসের নিয়ম মেনে বা উচ্চতর পদাধিকারীদের নির্দেশ মেনে চলা তাঁর কুষ্ঠিতে লেখে না। আমিও মাঝে মাঝে গণ্ডগোল করতাম। অনেক কাল আগে আমি বাইরে থেকে এসে যখন ভাষণ দিতাম, তখন একদিন ১ নং গাসটিন প্লেসে এসে স্টুডিওতে চ্যাঁচামেচি শুনে গিয়ে দেখি, আমার বোনঝি কল্যাণী কার্লেকরকে নীলিমা সান্যাল বৃথাই বোঝাবার চেষ্টা করছে যে গণিকা কথাটি চলতে পারে বারাঙ্গনা বা জনপদবধূতেও আপত্তি নেই, কিন্তু বেশ্যা অচল। কল্যাণী তা মানবে কেন? সে বলছে ‘আমার আলোচ্য বিষয়ই হল বেশ্যা-সমস্যা, তা বেশ্যা শব্দটাকেই উচ্চারণ করতে পারব না? তাহলে আমার আলোচনাটাও অচল। আমি চললাম।’ শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে বেশ্যার বদলে গণিকা বলতে তাকে রাজি করানো গেল।
ঐ সমস্যাটা আমার মনে লেগেছিল। সেই সঙ্গে একটা যুক্তিযুক্ত কথাও মনে হয়েছিল। যে-সব দুঃখিনী বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে, তাদের নামটাকে পর্যন্ত অশ্রাব্য প্রতিপন্ন করে তাদের প্রতি কতটুকু সহানুভূতি দেখানো হয়? তাদের দুঃখ দূর করার তো কোনো চেষ্টাই হয় না। আমিও বেতারের ঐ হাস্যকর দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অনেক বছর কিছু করিনি, করার সুযোগও পাইনি। এবার একদিন আমাদের পুরনো বন্ধু শৈলজানন্দর এক পাণ্ডুলিপি আমার কাছে এল। সাহিত্যবাসরের জন্য একটি নতুন ছোট গল্পের কাগজ। মধ্যিখানে দাগ দেওয়া। ‘চাকর’ কথাতে আপত্তি। দাস চলতে পারে, ভৃত্য চলতে পারে, কিন্তু মীরার ভজনে চাকর শব্দ চললেও সাহিত্য বাসরে কোনো মতেই চলবে না। খচ্ করে সেই পুরনো অসন্তোষটা মনের মধ্যে সাড়া দিল। আমি বললাম, ‘কেন চলবে না? চাকরের কথাই তো হচ্ছে।’ কর্মচারীটি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কথাটা ভালো না।’ ‘ভালো না কেন? তোমরা চাকর রাখ না? চাকরটাকে বাজারে পাঠাও না? চাকর শব্দ উচ্চারণ কর না?’ সে বলল, ‘তা হতে পারে, কিন্তু বেতারে নিয়ম নেই।’ তখন আমার জিদ্ চেপে গেছে, বললাম, ‘নেই বুঝি? দাও তো কাগজটা। স্বচক্ষে দেখেই আসি বেতারের নিয়মাবলী এ বিষয়ে কি বলে।’
নিয়মাবলী থাকত স্টেশন ডিরেক্টরের ঘরে। বলেছি তো একজন বাদে সব স্টেশন ডিরেক্টরের সঙ্গেই আমার সদ্ভাব ছিল। গেলাম তাঁর ঘরে। প্রথমে তিনিও বললেন, ‘না, লীলাদি, ও-সব কথা রাখলে পাবলিক চিঠিপত্র লিখবে। আমরা মুশকিলে পড়ব। সত্যিই নিয়ম নেই।’
আমি বললাম, ‘কই দেখি নিয়মাবলীতে কি রকম নিয়ম নেই।’ শেষ পর্যন্ত নিয়মাবলী এনে, ঐ প্রসঙ্গটি খুঁজতে ডিরেক্টর মহাশয়ের পার্সনেল অ্যাসিস্টাণ্ট শম্ভু রায়চৌধুরীকে ডাকা হল। তার মতো দক্ষ লোক শুধু বেতারে কেন ভূভারতেও কম ছিল। পাঁচ মিনিটে যথাস্থানে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। জনসাধারণের জ্ঞাতব্য বলে, কি.দেখিয়ে দিল তা বলে দিচ্ছি। নিয়মাবলীতে শুধু এই কথা আছে যে বেতার ভাষণে এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, যাতে করে কারো বা কাদের প্রতি ঘৃণা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য, অপমান প্রকাশ পাবে। কাজেই ‘চাকর’ বা ‘বেশ্যা’ যদি সহানুভূতির সঙ্গে ব্যবহার হয় তো চলতে পারে। কিন্তু ‘পণ্ডিত’ বা ‘সাধু’-ও অবজ্ঞার্থে চলবে না। অর্থাৎ ‘ওঃ! ভারি সাধু হয়েছেন!’ কি ‘ও-সব পণ্ডিতগিরি ঢের দেখেছি’ কখনো বেতারে বলবেন না। ও-সব হল অসামাজিক। বলার নিয়ম নেই।
আরেকটি কথা বলে এ প্রসঙ্গ বন্ধ করি। হাজার হাজার অর্থহীন আধুনিক গান আমাকে প্রতি মাসে পড়তে হত। যেগুলি অনুমোদন করতাম, সেগুলি জ্ঞান ঘোষের কাছে সুর সংযোজনের জন্য যেত। সকলের দুঃখ এক হাজার গান পড়লে লীলাদির একটা পছন্দ হয়। এখন বেতারে আধুনিক গান শুনলেই টের পাই আমি আর সেখানে নেই!
আবার বলব আমার বেতার জীবন আমি ভারি উপভোগ করেছিলাম। আমার মনের বিস্তারও অনেক বেড়ে গেছিল। অজস্র ছোট গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখেছিলাম। সারা দিন কাজে ব্যস্ত থাকতাম আর মনটা চরকির মতো ঘুরত। ক্রমে প্রকাশকদের সঙ্গেও আলাপ হল। অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির। আর বিশেষ করে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি। প্রেমেনবাবু একদিন আমাদের দু-তিনজনকে সেখানে নিয়ে গেছিলেন। সেখানে পরিচালক ছিলেন জিতেন মুখোপাধ্যায়। এমন একাগ্রচিত্ত দক্ষ পরিচালক না হলে কোনো প্রকাশনালয় অল্প সময়ে অমন সুপ্রতিষ্ঠিত হয় না। দেখতে দেখতে বন্ধুর মতো হয়ে গেলেন। ওঁরা প্রতি বাংলা মাসের ৭ তারিখে নতুন বই বের করতেন। আমায় প্রথম দিককার বহু বই ওঁরা ছেপেছেন। এখনো ওদের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি। ওঁদের মালিক হলেন শ্ৰীত্রিদিবেশ বসু, স্বনামধন্য অ্যালজেব্রা-সম্পাদক কে পি বসুর ছেলে। ওঁরা বড়দের বইয়ের মধ্যে ‘ঝাঁপতাল’ উপন্যাস আর ‘গাওনা’ বলে নাটক সংগ্রহ ছাড়া ছোটদের জন্য আমার অনেকগুলি বই প্রশান্ত রায়ের আঁকা ওয়াশ দেওয়া ছবি হাফ্টোন ব্লকে ছাপিয়ে, অনবদ্য চেহারা দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। তার মধ্যে বক-ধার্মিক, গুপির গুপ্ত খাতা, জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে সহযোগিতায় লেখা ‘টাকা-গাছ’, ‘টংলিং’, ‘হলদে পাখির পালকে’র নাম করতে হয়। বেতারের যত দোষই থাকুক, সব সময় একটা সৃষ্টির হাওয়া বইত। যেখানেই শিল্পীদের কারবার সেখানেই একটা অন্য রকম আবহাওয়া তৈরি হয়। ৪৮ বছর বয়সে সেই আবহাওয়া আমাকে নতুন প্রাণ দিল, উৎসাহ দিল, পদার্থ দিল। আমি বেঁচে গেলাম। ঘরে বসে ফরমায়েসি লেখা এক আর রেডিওতে পড়া হবে, কিম্বা অভিনীত হবে যে লেখা, সে আলাদা। সে বেশি ভালো তা বলছি না। মোটেই বেশি ভালো নয়। কিন্তু তার মধ্যে এক রকম ডিসিপ্লিন, বা শৃঙ্খলা থাকে, যার কারণে কোনো অবান্তর তথ্য বা প্রকাশের জায়গা থাকে না। থাকলে আমরা সেগুলোকে ব্র্যাকেট করে বাদ দিতাম। ফলে জিনিসটাতে একটা শক্ত বন্ধন এবং প্রকাশের বলিষ্ঠতা দেখা যেত। অবিশ্যি অনেক চিন্তাশীল লেখাকে বা সমালোচনাকে, বা কবিতাকে এইভাবে বেঁধে দেওয়া যায় না। কিন্তু নাটককে, ছোট গল্পকে যায়। তাতে তাদের সাহিত্যগুণ বাড়ে তা-ও বলছি না। কিন্তু লেখকদের একটা নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস হয়ে যায়, তার সাহায্যে নিজেদের এলোমলো চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নেবার সাহায্য হয়। এবং অবান্তর কথা বাদ দিতে শিখে যান।
আমার ঐ সব ছোটদের উপন্যাস গল্পদাদুর আসরে ধারাবাহিকভাবে পড়া হত। টাকা-গাছও তাই। ‘হলদে পাখির পালক’ কাজের তাড়ার মধ্যে আমার মনে জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল। আমি ৬ দিনের ছুটি নিয়ে এই আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে বসে বইটি আগাগোড়া লিখেছিলাম। ওর মধ্যে এখানকার বাতাস বয়, রোদ ওঠে। ফিরে গেলে, প্রেমেনবাবু ওর নামকরণ করেন। তারপর জয়ন্ত গল্পদাদুর আসরে পড়ল। বইটি অনেকের ভালো লাগে। বহু পুরস্কারও পেয়েছে। আমার মনে হয় লেখকদের সচেতন মনের গভীরে একটা অবচেতন মনও থাকে। গল্প কবিতা তৈরি করে সে। মাঝে মাঝে হঠাৎ সেই সব গল্প কবিতা মনের ওপর ফুটে ওঠে। কোনো একটা কথা শুনে, এক ছত্র কবিতা পড়ে, আচমকা একটা সুর শুনে, বা ছবি দেখে, কতবার আমার চেতনার কাছে গোটা একেকটা গল্প ধরা দিয়েছে, যাকে তৈরি করার কৃতিত্ব আমার নয়। আবার তেমনি কত সময় মনটা শুকনো মরুভূমি হয়ে যায়। হয়তো ঠিক পুজোর আগে এমনি হল। তখন আমি একটিও ভালো গল্প লিখতে পারি না। কিন্তু বেতারের ঐ ৭ বছরে কেন আমার মনে এত গল্প উপন্যাস প্রায় তৈরি হয়ে ধরা দিত, এ আমি বলতে পারব না। তখনি যে লিখে ফেলতাম তাও নয়। মনের রসে কিছুদিন জারিয়ে নিয়ে তবে হয়তো লিখতাম। যদিও আমি বলে থাকি সাহিত্যের প্রধান উপজীব্যই হল সরসতা আর সততা, তবু এ-ও সত্যি যে সব লেখার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা উচিত। তা যদি না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে লেখক তাঁর মনের ভাবটি ঠিক প্রকাশ করতে পারেননি।
কয়েকটি ছোটদের উপযুক্ত সরস নাটক লিখেছিলাম এই সময়ে। তার মধ্যে ছিল বকবধ-পালা। জয়ন্ত সেটি একবার রেডিও সপ্তাহে মঞ্চস্থ করে, বলাকা প্রকাশনী থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশও করিয়ে দিয়েছিল। ‘লংকা-দহন’ লিখেছিলাম, ক্ষণস্থায়ী, কনটেম্পোরেরি পাবলিশার্স বই করেছিলেন ১৯৬৪ সালে, আমি রেডিও ছাড়বার পর।
বেতারে কাজ করতাম বলে যে আমার সাংসারিক দায়িত্ব সব এর-ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম তা নয়। ছেলে-মেয়ে কলেজে পড়ে তখন, ভাগ্নী সরোজনলিনী থেকে পাস করে কৃতিত্বের সঙ্গে বাটানগর স্কুলে সেলাই শেখায়। তার মেয়েদের কেউ কাজকর্ম করে, কারো বা বিয়ে হয়ে গেছে। ঐ ছিল আমার নিজের কাজ করার উপযুক্ত সময়। আমি পরিবারকে খুব উঁচুতে বসাই। মানুষের তৈরি সব অনুষ্ঠানের মধ্যে এর জুড়ি খুঁজে পাই না। পরিবার মানে মা বাবা দু একটি ছোট ছেলেমেয়ে, এক-আধজন আত্মীয়, যারা সবাই মিলে একই বাড়িতে বাস করে, একই সুখ দুঃখ ভাবনা-সাফল্য, সব কিছুর অধিকারী। যে-সব মেয়েরা চাকরিকে গৃহকর্মের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন, আমি তাদের মধ্যে নেই। বোধ হয় কিঞ্চিৎ সেকেলে আছি। আমি রান্নাবান্না ঘরকন্নাকে খুব বড় কাজ বলে মনে করি। যে মেয়েরা রান্না করতে জানে না, বা ছেঁড়া কাপড় রিপু করে না, বা সব কিছু দরজিকে দেয়, আমি তাদের নিন্দা করি। সুখের বিষয়, আধুনিক মেয়েরা দক্ষভাবে দুদিক সামলাতে জানে। এই সব নাটক নবেল লেখার মধ্যে মধ্যে আমার আধুনিক নিয়মে রান্নাবান্না ঘরকন্না আর শিশুপালনের কথা লিখতে ইচ্ছা করত। মহিলামহলের অনুষ্ঠানে এ-সবকে প্রাধান্য দেবার আমি পক্ষপাতী ছিলাম। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে উচ্চশিক্ষিত মহিলারা, যেমন রমা চৌধুরী, নলিনী দাশ ইত্যাদি এসব বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহী হলেও, যাদের শিক্ষা অপেক্ষাকৃত কম তারা এগুলিকে অবজ্ঞার চোখে দেখত। আমি রেডিও ছাড়ার প্রায় কুড়ি বছর পরে মনের ঐ বাসনা কিছুটা পূর্ণ করতে পেরেছি। রান্নার বই বেরিয়েছে, ঘরকন্নার বইও আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশ করার ব্যবস্থা করছেন। একথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করলাম, কারণ রেডিওর জন্যেই শখটা শুধু বেড়ে যায়নি, বাস্তবমুখীও হয়ে পড়েছিল।
১৯৫৮ সালে আমার মেয়ে কমলার বিয়ে হল অবনীন্দ্রনাথের বোন সুনয়নী দেবীর নাতি মনীষীর সঙ্গে। এ বিয়ে দুটি পরিবারের অশেষ সুখের ও আনন্দের কারণ হয়েছে।
॥ ১৪ ॥
এই কাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার নিজের বিয়ের গল্প দিয়ে। তার পরে, ১৯৮৩ সালের মে মাসে আমার মেয়ের বিয়ের কথায় এসে পৌঁছলাম। ইতিমধ্যে আমার জীবনের আরো ২৫ বছর কেটে গেছিল। মেয়ের বিয়ে হল দুই পরিবারের দিক থেকে সন্তোষ-জনক ও সুষ্ঠু ভাবে। হিন্দু মতে। গোঁড়ামি বাদ দিয়ে। যেমন আধুনিক ভাবাপন্ন হিন্দু বাড়িতে আজকাল হয়ে থাকে। এই ২৫ বছরে বোধহয় হিন্দুরাও যেমন, ব্রাহ্মরাও তেমনি অনেকখানি উদার হয়ে গেছিলেন। কিম্বা হয়তো আত্মসচেতনতা কমে গেছিল। ও-সব বিষয়ে মতভেদকে কেউ আর তেমন গুরুত্ব দিত না। মূল্যবোধই বদলে গেছিল। মোট কথা হিন্দু ও ব্রাহ্ম সব আত্মীয়স্বজনরাই আনন্দের সঙ্গে বিয়ের উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। চাঞ্চল্যকর কিছু দেখা যায়নি। যা যেমনটি হওয়া উচিত তেমনি হল। আগেও বলেছি আমি নিজেকে ব্রাহ্ম বলি, কারণ আমি মূর্তি পুজো করি না, জাত মানি না। আর তো কোনো তফাৎ দেখি না। আমি না করলেও, মূর্তি পুজোতে আমি কোনো দোষ দেখি না এক জীব-বলি ছাড়া। তাছাড়া উপনিষদের ধর্মকে আমি অ-হিন্দুই বা বলি কি করে। মোট কথা, আমার মেয়ের হিন্দু মতে বিয়ে হল। সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে।
এত কাল ধরে যত আত্মীয় বন্ধুদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে-থা-তে আমাদের নেমন্তন্ন হয়েছিল, সবাইকে ডাকা হল। বরের আত্মীয়স্বজন আর আমাদের গুরুজনদের ছাড়া সবাইকে ডাকে চিঠি দেওয়া হল। প্রায় সকলেই এলেন। সমাজ অনেকখানি উদার হয়ে গিয়েছে তত দিনে। শুধু উদার নয়, অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত আচরণ করতে আর পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা সম্বন্ধে সহানুভূতিশীল হতে শিখেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে এই মনোভাবের আরম্ভ বলে মনে হয়।
শিক্ষিত সংস্কৃতিবান পরিবারের সঙ্গে সম্বন্ধ করা আর সব জিনিস থেকে আলাদা।
ছেলের বাবা ডঃ মনোমোহন চট্টোপাধ্যায় নামকরা জিওলজিস্ট, এক সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের জিওলজি বিভাগের প্রধান। বিয়ের সময় অবসরপ্রাপ্ত। ওর মা শ্রীরামপুরের বিখ্যাত গোঁসাইবাড়ির মেয়ে। ঠাকুমা হলেন অবনীন্দ্রনাথের ছোট বোন, নাম করা চিত্র শিল্পী সুনয়নী দেবী। বহুকালের চেনা ঘর, বহু শ্রদ্ধা আর প্রীতির পাত্র-পাত্রী। ছেলে ডুন স্কুল থেকে বেরিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের গ্রাজুয়েট। তেল কোম্পানিতে কাজ করে। মাথায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি, দেখতে ভাল।
এত সব দেখে বিয়ে দিলেও সব সময় তার পরিণাম সুখের হয় না, এ আমি বহুবার দেখেছি। কত দুঃখী মেয়ের কথা মনে হয়েছিল। মনে মনে বলেছিলাম যার যত দুর্বলতাই থাকুক, যদি একান্তভাবে শুভেচ্ছা আর সু-সঙ্কল্প থাকে, তাহলে সুখী হবার সম্ভাবনা বেশী হয়। ওটা শুধু স্তোক বাক্য নাকি সত্যি, তাও জানি না। কিন্তু এ বিয়ে বড় সুখের হয়েছে। শুধু পাত্র-পাত্রীর দিক থেকে নয়, দুটি পরিবারের পরস্পরের প্রতি গভীর ভালোবাসার দিক থেকেও।
বিয়ে যেন শুধু আমাদের মেয়ের নয়, বেতার আপিসেরো কিছুটা দায়িত্ব ছিল। আমার প্রিয় বান্ধবী বেলা দে-র তুলনা হয় না। কোথায় কাকে, কি এবং কিভাবে দিতে হয়; কলকাতার কোন দোকানে সবচেয়ে ভালো দেখতে ও খেতে কি মিষ্টি হয়; তার শুধু নাম ঠিকানাই নয়, ঐ সব সুখাদ্যের নমুনাসহ নায়কদের আমাদের বাড়িতে এনে উপস্থিত করা এবং উপযুক্ত সময়ে সে সব যাতে অকুস্থলে হাজির হয় তার ব্যবস্থা করা—কিছু বাদ দিল না! তার ফলে শিখলাম যে উত্তর কলকাতার মতো কারিগর অন্য কোথাও নেই আর বেলা দে-র মতো করিৎকর্মা মেয়ে যদি কেউ থাকেও থাকে, তার সঙ্গে আমার দেখা হবার সৌভাগ্য হয়নি।
প্রকাশক বন্ধুরাও কম যাননি। ত্রিবেণী প্রকাশনীর বন্ধু কানাই সরকার বলা কওয়া নেই লোক মারফৎ একটি চিরকুট দিয়ে প্রায় হাজার টাকা নগদ পাঠিয়ে দিলেন। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘মেয়ের বিয়ে দিতে টাকা লাগে না নাকি?’ সে সময় হাজার টাকার দাম হাজার টাকা ছিল।
গায়ে-হলুদের আগে সিগনেট প্রেসের নীলিমাদেবী একটা চার সেরি, আগাগোড়া ক্ষীরের তৈরি পোনামাছ আর রেশমী শাড়ি পাঠালেন। অমনি আরো কতজনা, যে যার সাধ্য মতো। লেখক বন্ধুদের বলতে শুনি, এমন কি লিখতেও দেখেছি যে প্রকাশকরা সবাই তাঁদের ক্ষতি করতেই তৎপর। আমার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। মাঝে মাঝে আশানুরূপ রয়েল্টি পাই না; বইতে অজস্র ছাপার ভুল দেখলে রেগে যাই; আগ্রহ করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়ে অনেক দিন ফেলে রাখলেও রেগে যাই। তবু তাঁদের আমার বন্ধু বলেই মনে করি। তার যথেষ্ট কারণও আছে। লেখকের লেখা না পেলে তাঁদের চলে না, তেমনি আবার বই প্রকাশের সমস্ত ঝামেলা এবং অনিশ্চয়তা ঘাড়ে নেবার এমন লোক আমরাই বা কোথায় পাচ্ছি। শুধু এইটুকু বলি, বৎসরান্তে সে বছরের বিক্রি-মূল্যের নির্ধারিত অংশটুকু যদি তাঁরা নিজের থেকে নববর্ষে লেখকদের হাতে তুলে দেন, ঐ বিশেষ দিনটি আরো মধুর হয়। কেউ কেউ দেন-ও। মিত্র ঘোষ থেকে কেউ সেদিন খালি হাতে ফেরে না। আনন্দ পাবলিশার্সও সে বছরের সমস্ত প্রাপ্য বাড়িতে পৌঁছে দেন। বিশ্বভারতী, ওরিয়েন্ট লংম্যান, সবসময় খুব উদ্যোগী বিক্রেতা না হলেও এঁদের নিখুঁৎ ব্যবহার। কত নাম করব? মৌসুমী, নাথ, বিমলা, শৈব্যা, দে-জ, উদয়, এশিয়া, সকলেই আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। বিশেষ করে এশিয়া তো আছেই। মেয়ের বিয়ের স্মৃতি মনে জাগতেই এত কথা মনে পড়ল। সিগনেট, নিউ স্ক্রিপ্টের, সঙ্গে হৃদয়ের যোগ। এ-সব কথা না বললে আমার স্মৃতিকথা অসম্পূর্ণ থাকবে। আর কাউকে কাউকে হয়তো বাদ দিলাম। প্রসঙ্গ উঠলে বলা যাবে।
সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হবে যে মেয়ের বিয়েতে আমার ব্যবহারে অনিচ্ছাকৃত অনেক ত্রুটি ধরা পড়েছিল। অনেক প্রিয় বন্ধুকে নেমন্তন্ন করতে ভুলে গেছিলাম। মনে হয় নেমন্তন্ন না করার চেয়েও ভুলে যাওয়াটা বড় অপরাধ। অনেকে একটু সেকেলে, ডাকে চিঠি যাওয়াতে কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ। সঙ্গে সঙ্গে একটা ফোন করলেই হত। তাও ভুলেছিলাম। আমার বাল্যবন্ধু মীরা দত্তগুপ্ত এতই দুঃখিত হয়েছিল যে বিয়েতে এলই না। কারণটি অনেক দিন পরে জানলাম। এত অতিথির মধ্যে সবাইকে বোধহয় সমান আদর জানাতে পারিনি। এই সঙ্গে এ-ও বলব নতুন কুটুম্বদের নিখুঁৎ ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই থেকে স্বর্গীয় মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়দের বংশধররা আমাদের নিকট আত্মীয় হয়ে গেছেন। আমাদের দেশে তো শুধু দুটো মানুষের বিয়ে হয় না; দুটো বংশের বিয়ে হয়। এত সৌভাগ্য আমাদের। আমার নন্দাই বাঘশিকারী কুমুদ চৌধুরীর মে ফেয়ারের বাড়ীতে আমার বিয়ে হয়েছিল। আমার মেয়েরও সেইখানেই বিয়ে হয়েছিল। ননদ নন্দাই অনেক দিন স্বর্গে গেছেন।
এসব হল ১৯৫৮-এর কথা। মনে আছে বেতার থেকে ১৩ দিনের ছুটি নিয়েছিলাম। বিয়ের পর আবার ভালোমানুষের মতো আপিসে গিয়ে এপিসিবি বনে গেছিলাম। ঐ সময় থেকে কেমন যেন লেখার হাত খুলে গেছিল। মনে একটা দারুণ তাগাদা অনুভব করতাম। মনে রাখতে হবে অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেনবাবু, অজিত দত্ত, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, আশাপূর্ণা ইত্যাদি—কেউ আমার চেয়ে ৫ বছরের বড়, কেউ বা সমবয়সী কিম্বা দু-এক বছরের ছোট। এঁরা সবাই ততদিনে নামকরা লেখক বলে স্বীকৃত। এমন কি কারো কারো কলমের জোর কমেও আসছিল। অথচ আমার কাজ সব-ই প্রায় পড়ে ছিল। বয়সটা এদিকে বেড়েই চলেছে যদিও টের পাচ্ছি না। এখনো পাই না।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩-র মধ্যে কিন্তু অনেক লিখে ফেললাম। দিনে সময় হত না, রাত জেগে লিখতাম। আমার স্বামী কিছু খুশি হতেন না। হুমায়ুন কবির তখন দিল্লীতে, কিন্তু চতুরঙ্গ বলে বড়দের জন্য সুন্দর একটি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করতেন। যতদূর মনে পড়ে ত্রৈমাসিক। আতওয়ার রহমান বলে একজন স্বল্পায়ু, সুন্দর ছেলে হাসিমুখে সব ঝামেলা নিজের কাঁধে তুলে নিত। আমাকে বলা হল একটি ছোট ও সরস উপন্যাস লিখে দিতে। তবে বিষয়বস্তু হবে আধুনিক শহুরে সমাজ। ‘চীনে লণ্ঠন’ লেখা হল। বলাবাহুল্য বড়দের জন্য। পুরনো বন্ধু কানাই সরকার ত্রিবেণী বলে একটি প্রকাশনালয় করেছিলেন। সেখান থেকে বই হয়ে বেরোল। পরের বছর ‘ইষ্টকুটুম’ বেরোল ওখান থেকেই। সেকালের ইঙ্গবঙ্গ সমাজের নানা রকম সরস ছোট গল্প। তার নায়ক নায়িকারা সকলেই আমার তথাকথিত আত্মীয়। অথাৎ সম্পূর্ণ মনগড়া। গল্পগুলো তার আগে আনন্দবাজার, যুগান্তর, বিশ্বভারতী পত্রিকা, কথা-সাহিত্য, গল্প-ভারতী ইত্যাদিতে নানা সময়ে বেরিয়ে ছিল। সরস গল্প অনেকগুলির পটভূমি স্বচক্ষে দেখা, ঘটনাগুলো বানানো। ‘ইষ্টকুটুম’ নাম দিয়েছিল বেতারের ঊষা ভট্টাচার্য। সে-ও বড় গুণী মেয়ে, সার্থক পদাধিকারিণী হয়ে মৌলিক সৃষ্টি করার পথে বেশী এগোতে পারেনি। এত ভালো কর্মীর আমি শতশত প্রশংসা করি। ঐ ১৯৫৮ সালেই ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি থেকে ‘ঝাঁপতাল’ বেরোল, একজন বঞ্চিত মেয়ের জীবনে জয়ী হবার গল্প। কিসে যেন ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ভুলে গেছি। বই হয়ে বেরুতেই জনপ্রিয় হয়েছিল। পরের বছর আরেকটি বড়দের ছোট গল্প সংগ্রহ ‘লাল নীল দেশলাই’ প্রকাশ করলেন ‘আর্ট ইউনিয়ন’ বলে এক অল্পায়ু সংস্থা। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে বইখানি উৎসর্গ করেছিলাম। বড় খুশি হয়েছিলেন। একজন নির্যাতিত নারীর পুনর্বাসনের গল্প ‘নাটঘর’ লিখলাম, ত্রিবেণী থেকে প্রকাশিত হল। এসব-ই বড়দের জন্য লেখা। বেতারের জন্য বেশ কয়েকটি সরস নাটক লিখেছিলাম। ‘গাওনা’ নাম দিয়ে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড বইটি প্রকাশ করলেন।
এত দিন শুধু যে বড়দের বই রচনা করেছি তা-ও নয়। বড়দের জন্য যতই লিখি, মন ততই বিষণ্ণ হয়। ও তো আমার আসল কাজ নয়। আমার আসল পাঠক যারা, তাদের বয়স ১২ থেকে ১৬; ক্রমে এ বিষয়ে আমি সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। সচেতনতা থেকে কাজে নামতে আমার খুব বেশী সময় লাগেনি। ‘হলদে পাখির পালক’ আমার এই সময়কার একটি রচনা। কোথাও ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়নি। মনের মধ্যে কেবলি ঘুরত। মনে হত দম বন্ধ হয়ে আসছে। অন্য কাজে মন দিতে পারতাম না। শেষটা এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে ।শান্তিনিকেতনে বসে লেখা হল, এ-কথা আগেও বলেছি। ফিরে গিয়ে প্রেমেনবাবুকে পাণ্ডুলিপি পড়তে দিলাম। উনি নামটি দিলেন এবং ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড সেই থেকে আজ ২০ বছরের বেশি ধরে অনেকগুলি মুদ্রণ করেছেন।
গল্পদাদুর আসরে সপ্তাহে একদিন জয়ন্ত গল্পটি ধারাবাহিক ভাবে পড়ত। শুনে শুনে অবাক হয়ে ভাবতাম ও যে আমার লেখাটাকে দশগুণ ভালো করে দিচ্ছে। শ্রোতাদের কি উৎসাহ, কত চিঠি। স্বপ্নের মতো মনে হয়। এখনো মাঝে মাঝে পাঠকদের সুন্দর চিঠি পাই। মন ভরে যায়, কিন্তু কুড়ি বছর আগেকার সেই অনাবিল উচ্ছল আনন্দ কোথায় পাব? যে যোগান দিত সেই নেই। হলদে পাখির পালকের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে লীলা পুরস্কার আর পশ্চিম বাংলা থেকে আর দিল্লী থেকে দুবার দুটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। তার চেয়ে ঐ আনন্দটির মূল্য ঢের বেশী। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড আমার কথায় আমাদের প্রিয় বন্ধু প্রশান্ত রায়কে দিয়ে ৫টি ওয়াশ্ প্রথার ছবি আঁকিয়ে বইয়ের যে রূপ দিলেন তার তুলনা হয় না। হলদে পাখির পালকের কথা আগেও বলেছি। আমার বড় প্রিয় গল্প, তাই বার বার বলতে ইচ্ছা করে।
সেটা ছিল ১৯৫৯-৬০। ‘বাঘের চোখ’ বলে ছোটদের একটা গল্প সংগ্রহ বেরিয়েছিল। দুঃখের বিষয়, তার একটিও কপি পাচ্ছি না। গল্পগুলি এশিয়া প্রকাশিত আমার রচনাবলীতে ছড়িয়ে আছে। নিজেই তাদের চিনতে পারি না। ঐ বছরেই ‘গুপির গুপ্ত খাতা’ বলে আমার একটা দুঃসাহসিক অভিযানের সরস গল্প ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড বই করে বের করলেন। তার ছবিও প্রশান্ত আঁকল। এই সংস্করণটি এখন দুষ্প্রাপ্য। নতুন সংস্করণ অন্য ছবি দিয়ে এশিয়া থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গল্পটি এর কিছুদিন আগে রংমশালে ‘ভয় যাদের পিছু নিয়েছে’ নামে ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়ে ছিল। বকধার্মিক ঐ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। পরে হীরের প্রজাপতি নামে শান্তি চৌধুরী ছবি করে ১ম পুরস্কার পেয়েছিল। তবে খানিকটা বদলে দিয়েছিল। এ দুটিই একটু চাঞ্চল্যকর মজার গল্প।
এই রকম কাজকর্মের আবর্তের মাঝখানে ১৯৫৮, ৫৯, ৬০ কেটে গেল। বয়স হল ৫২। তাও টের পেলাম না। বাড়িতেও কাজকর্মের অন্ত ছিল না। ততদিনে আমার সেই ভাগ্নী আর তার তিন মেয়ে স্বাধীন ও সুষ্ঠু জীবন যাপন করছিল। আমার মেয়ের বিয়ের পর সেও তার তেল কর্মী স্বামীর সঙ্গে জামসেদপুরের একটি ছোট এবং সুন্দর ফ্ল্যাটে নিজের ঘরকন্না দক্ষভাবে পরিচালনা করছিল। সেখানে দু-চার দিনের জন্যে যাওয়া আমাদের এবং মেয়ের শ্বশুর শাশুড়ির পক্ষে অতিশয় আনন্দের ব্যাপার ছিল। ফ্রক পরা অবস্থা থেকে বেয়ানকে চিনতাম। তার নাম মণিমালা। আমার চেয়ে ৫১/২ বছরের ছোট, সুন্দর মিষ্টি মানুষটি। তাই বলে মিন্মিনে স্বভাবের নয়। মাঝে মাঝে তেজও দেখাতে পারত। তাদের আমরা বড়ই ভালোবাসি। বালিগঞ্জ পার্কের ভাড়া বাড়িতে থেকে, কাছেই তাঁদের নিজেদের বাড়ি তৈরি করাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে দেখতে যেতাম। অবনীন্দ্রনাথের ছোট বোন সুনয়নীদেবী মণিমালার শাশুড়ি। তখন অনেক বয়স হয়েছে, শরীরটা কিছু ভেঙেছে। যতই দেখতাম ততই আশ্চর্য হতাম। ছোট্ট খাট্টো মানুষটি, চোখমুখ ঝকঝক করত। ওদের সঙ্গেই থাকতে ভালোবাসতেন। এক দিন দেখি চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে কেবলি ডান হাতটা কব্জি থেকে নাড়ছেন। ভারি কৌতূহল হল। জিজ্ঞাসা করাতে, চোখ খুলে, হেসে বললেন, ‘মনে মনে ছবি আঁকছি। হাত তো আর তুলি ধরতে পারে না।’
মনে আছে বুকের মধ্যে ধুক্ করে উঠেছিল। সত্যিই তাই। মানব জীবনের সব কীর্তিই তৈরি হয় মনের মধ্যে। তারপর তাকে শাবল দিয়ে খুপরি দিয়ে হাতুড়ি-বাটালি-ছেনি দিয়ে, ওলন দিয়ে দোলন দিয়ে, মাপকাঠি দিয়ে, হাত দিয়ে, পা দিয়ে, চোখ-কান দিয়ে, গলা দিয়ে, যেখানে যার স্থান সেখানে নামানো হয়। কিন্তু তৈরি হয় সব একই জায়গায়, মানুষের মনে। সব বিজ্ঞান, সব জ্ঞান, শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য দর্শন। সেইখানে জন্ম নেয়। আর আমরা তারি সব চেয়ে অযত্ন অবহেলা করি।
এমনি করে ১৯৬১ সাল এসেছিল। ঐ সময় আমার প্রধান চাকরি-স্থল বদলাবার কথাও অনেক বলেছি। আর নয়। তাছাড়া তার চেয়েও বড় ঘটনা আমার জীবনে ঘটল। দুই নাতনির জন্ম অবশ্য খুবই বড় ঘটনা। কারণ তারা একেকজন উদয় হয়ে আমার বয়সটাকে দশ বছর করে কমিয়ে দিল। পরে ছেলের ঘরে কখন দুই নাতি উপস্থিত হল, তখন বয়সটা আরো এত বেশী কমে গেল যে প্রায় অপোগণ্ড হয়ে গেছি। সমবয়সীদের ধরে ফেলবার আর সময় নেই। অন্য বড় ঘটনাটি হল আমার বড়দা সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ ‘সন্দেশ’ পত্রিকাকে পুনর্জীবিত করল। একরকম একলা, সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে। এবং আমরা বড়রা যারা ছিলাম, তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে। একটুও যে দুঃখ হয়নি, তা বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। কিন্তু কাজটা এতই ভালো যে আনন্দ হয়েছিল তার শতগুণ বেশী।
সেই ইস্তক সব সময় মনের সব চেয়ে অন্তর কথাগুলো বলবার সুন্দর একটা জায়গা পেয়েছি। জায়গা না বলে ধারা বললে ভালো হয়। এমন প্রাণবন্ত গতিশীল কিছুকে মাটির সঙ্গে তুলনা করলে মন ওঠে না। কিন্তু আমাদের সন্দেশের মূলের নিচে যদি তাকে স্থিতি দেবার জন্য মাটি থাকে, তার স্রোত কখনো বিভ্রান্ত হবে না। এই সব ভাবি মাঝে মাঝে, বলবার লোক পাই না। আমার মেজ-জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোর যেদিন প্রথম বর্ষের সন্দেশের প্রথম সংখ্যাটি ৫ বছরের আমার সামনে তুলে ধরেছিলেন, উপস্থিত সকলের আনন্দ দেখে আমিও বেজায় খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু ঐখানেই যে আমার প্রাণের পথ এবং পাথেয় পেয়ে গেলাম তা বুঝিনি।
একদিক থেকে বলা যায় আমার এবং আমার জ্যাঠতুতো, পিসতুতো ভাইবোনদের আর তাদের বংশধরদের চিন্তাধারার ধাতা ছিল সন্দেশ। নিজেদের অজ্ঞাতসারে একটা বলিষ্ঠ, সরস সততা আমাদের মনের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গেছিল। তাতে কয়েকটা বংশগত গুণ ফুটবার সুবিধা হয়েছিল। শিখবার, আঁকবার, সঙ্গীত সাধনার, বিজ্ঞানচর্চার নানা গুণ নানা জনের মধ্যে অল্পবিস্তর ভাবে দেখতে পাই। আর উপেন্দ্রকিশোরের মতো সুকুমার সুবিনয়ের এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ভাবে সত্যজিতের মধ্যে এর অনেকগুলি গুণের একসঙ্গে সমাহার হয়েছে। এসব প্রকৃতিদত্ত জিনিস নিয়ে বড়াই করতে হয় না, কিন্তু ঋণকে সর্বদা স্বীকৃতি দিতে হয় এবং যে গুণই হক, তার সাধনা করতে হয়। সত্যজিৎ খুব সহজে এত সাফল্য পায়নি। এর প্রতিটি কণার জন্য সারা জীবন ধরে তাকে সাধনা করতে হয়েছে। এর পর কি হবে তা জানি না। কিন্তু সন্দেশকে যদি উপযুক্ত প্রাণশক্তি দিতে আমরা না পেরে থাকি, তাহলে সেইখানে আমাদের বিফলতা। কম সময় তো পাইনি।
১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে ‘সন্দেশ’ প্রাতিষ্ঠা করে, তার দু-বছর পরে বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের হাতে সব কিছু ফেলে উপেন্দ্রকিশোর চলে গেছিলেন। সুকুমারের বয়স তখন ২৭-২৮। তার ৮ বছর পরেই তিনিও স্বর্গে গেলেন। তার আগের বছর তাঁরই (বলা যায়) প্ররোচনায় আমার প্রথম গল্প লেখা ও পত্রিকায় ছাপা হল। সে গল্প আমার কোনো সংগ্রহে দিইনি। লেখা খুব খারাপ হলে বড়দা কখনোই ছাপতেন না। কিন্তু ঐ গল্পে এক মৎলবী ভাগ্নে তার মামার ভালোমানুষটির সুবিধা নিয়ে নিজে কিছু লাভ করেছিল। কোনো রকম সাজাও পায়নি। ও আমার পছন্দ নয়। লাভ হোক সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটা একটু জব্দ হলে খুশি হতাম। বড়দার মৃত্যুর অল্প দিন পরে সন্দেশ বন্ধ হল। ইউ রায় এণ্ড সন্স উঠে গেল। কয়েক বছর পরে আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার মণি দা, অর্থাৎ সুকুমারের মেজো ভাই সুবিনয়ের সম্পাদনায় বছর তিনেক সন্দেশ পত্রিকা বেরিয়ে ছিল। ১৯৩১ সালে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছিল। মণিদা আমার কাছ থেকে প্রতি মাসে একটি করে গল্প না নিয়ে ছাড়তেন না। তার প্রথম গল্প ‘দিন দুপুরে’। ঐ যে একটা পথ পেয়ে গেলাম, আর ছাড়লাম না। সন্দেশ উঠে গেলে মৌচাক, রামধনু, রংমশালের নিয়মিত লেখক হয়ে গেলাম। ১৯৫৬ সাল থেকে বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হাতটা আরো জোরালো হতে থাকল। কিন্তু মনের মতো পত্রিকা আর একটিও পেলাম না।
সুকুমারের স্ত্রী, আমার বড়বৌদি সুপ্রভা (তাঁর ডাক নাম ছিল টুলু) অসাধারণ মেয়ে ছিলেন। ২৯ বছর বয়সে বিধবা হয়ে অবধি সারা জীবন কত যে কাজ করেছিলেন তার ঠিক নেই। তাঁর কথা আগেও বলেছি। ৭০ বছর বয়সে হৃদরোগে তাঁর মৃত্যু হয়। শুনেছি কোনো সময়ে তিনি মানিককে বলে ছিলেন সন্দেশ পত্রিকা আবার বেরোলে তিনি খুশি হতেন। ১৯৬১ সালে ৩০ বছরের ব্যবধানের পর, মানিকের হাতে আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো অপূর্ব চেহারা নিয়ে আবার সন্দেশ বেরোল এবং সেই ইস্তক আজ ২২ বছর ধরে নানা বিপর্যয়ের মধ্যেও নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। তার প্রধান কারণ অবশ্য মানিকের আর নলিনী দাশের অক্লান্ত সহায়তা। নিজের টাকা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে পত্রিকাটিকে মানিক প্রতিষ্ঠা করল। প্রথম সম্পাদক হলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর নামের আর সাহায্যের গুণে সন্দেশের একটা প্রতিষ্ঠা হল। পরে পত্রিকা পরিচালনার নানা অসুবিধার কারণে সুকুমার সমবায় সমিতি বিধিমতে অনুষ্ঠিত হল এবং আজ পর্যন্ত তাঁরাই কাগজ চালিয়ে আসছেন। আমাদের তিনজন সম্পাদক। তার মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠা আমি; তারপর উপেন্দ্রকিশোরের মেজো মেয়ে পুণ্যলতার মেয়ে নলিনী দাশ, সবার ছোট সত্যজিৎ। তারো ৬২ বছর বয়স হল। ১৯৮১ সালে সন্দেশের কুড়ি বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষ্যে গত কুড়ি বছরের সন্দেশ থেকে বাছাই করা লেখা দিয়ে ‘সেরা সন্দেশ’ বেরুল। সম্পাদক সত্যজিৎ। সে-ই সমস্ত নতুন ছবি এঁকে দিল। আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশক। আমরা আরো পাঁচজনাও আপ্রাণ খেটেছি।
সারা জীবন ধরে যত রকম কাজ করেছি, তার মধ্যে সন্দেশের কাজ সবচেয়ে আনন্দদায়ক। যত সম্মান পেয়েছি, সন্দেশের সম্পাদক হবার কাছে তার কিছুই লাগে না। আমি ভালো করেই জানি যে জ্যাঠামশাই কিম্বা বড়দার কাজের তুলনায় আমাদের চেষ্টাগুলো কিছুই নয়। তবু এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলেও আনন্দ। এখন শান্তিনিকেতনে থাকি, কার্যালয়ের দৈনন্দিন কাজে অংশ নিতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সরে দাঁড়ানো উচিত। আবার ভাবি তাহলে আমি কি নিয়ে থাকব?
মোট কথা ১৯৬১ থেকে আমার অধিকাংশ ছোটদের ছোট গল্প প্রথমে সন্দেশে বেরিয়েছে আর যদুর মনে হয় পক্ষিরাজে প্রকাশিত ‘ময়না-শালিখ’ আর, রোশনাইতে নাকুগামা ছাড়া সব উপন্যাসও ধারাবাহিকভাবে সন্দেশে বেরিয়েছে। এইভাবে একে একে টংলিং, মাকু, নেপোর বই, বাতাস বাড়ি, হাওয়ার-দাঁড়ি, হট্টমালার দেশে (প্রেমেনবাবুর সঙ্গে লেখা), লংকাদহন নাটক, ভূতোর ডাইরি ইত্যাদি সব গল্পই সন্দেশের পাতায় প্রথম ছাড়া পেয়েছিল। অবিশ্যি শুভমের নতুন পত্রিকা ‘সবজান্তা মজারু’-তে এখন আমার ‘জল-মানু’ বেরোচ্ছে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের শত বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ত্রিবেণী থেকে ছোটদের জন্য কবির জীবনের গল্প ‘এই যা দেখা’ লিখেছিলাম। সরকারী অনুরোধে লেখা শুরু করে, ভুল বোঝার ফলে কানাই সরকারকে পাণ্ডুলিপিটি দিয়েছিলাম। ঐ বছর দিল্লীর সাহিত্য আকাদেমির অনুরোধে ১৬ পৃষ্ঠায় অতি সংক্ষেপে ‘কবি-কথা’ লিখেছিলাম। তার নব নব মুদ্রণ এখনো চলেছে।
এত কথা উঠল আমার ঐ সাতটি কেজো বছরের সাহিত্যকীর্তি প্রসঙ্গে। লেখাই ছিল আমার বাড়ির কাজ। আমাদের গুছনো সংসারে সব কিছু ছিল সময় ধরা। ফলে হাতে যথেষ্ট অবসর থাকত। সে সময়টা লেখা-পড়ায় ভরা থাকত। মৌলিক লেখা ছাড়াও খান কতক বিখ্যাত বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেছি। তবে তার বেশির ভাগই বেতার ছাড়ার পর। এরি মধ্যে কোনো সময়ে, সাল তারিখ কিছুই মনে নেই, সাহিত্য আকাদেমির সাধারণ সদস্যরূপে মনোনীত হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে দিল্লী যেতে হত। বহু লেখক, প্রকাশক, শিক্ষাবিৎ, সম্পাদকের সঙ্গে চেনাজানা হবার সুযোগ পেলাম। সে সময়ে শ্রীকৃষ্ণ কৃপালনি ছিলেন আকাদেমির অধ্যক্ষ। সকলের সঙ্গে তাঁর সমান ভালো ব্যবহার। আমার সঙ্গে বহুদিনের আলাপ, যদিও খুব ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি। আকাদেমির খরচের তুলনায়, কার্যকরী দিকের সমালোচনা শোনা যায়। আমি শুধু একটি কথাই বলব, আকাদেমি সর্বদা চেষ্টা করেন যাতে ভারতের সব রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা পরস্পরের কাছে পরিচিত হয়। অনেক দেশী ও বিদেশী বই-ও একেবারে ১৩-১৪টি ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হত। আমি জনাথান সুইফ্টের একটি বিখ্যাত ইংরিজি মূল বইয়ের আগাগোড়া বাংলা করে দিয়েছিলাম। তার নাম গালিভারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত। চার খণ্ডে লেখা ঐ ইংরিজি বইটির সবটা পড়ার সুযোগ সকলের হয় না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এমন সরস সার্থক বই পৃথিবীতে কম আছে। ইংরেজ পণ্ডিতরা কাব্যকে বলেছেন—জীবনের উপর মন্তব্য। এ বই-ও তাই। অথচ এক নাবিকের দুঃসাহসিক অভিযানের আকারে গল্পটি রচিত রসে ভরপুর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বইয়ের একটি। পড়ে যত আনন্দ পেয়েছি, অনুবাদ করতেও ততই। কিন্তু বড় বেশি পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই হলে ১৪টি ভাষায় অনুবাদ করা গেলেও, ক্রেতা পাওয়া যায় না।
১৯৬১ সালে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড ‘টাকা-গাছ’ প্রকাশ করলেন। জয়ন্ত চৌধুরী আর আমি যুগ্মভাবে গল্প দাদুর আসরের জন্য পালা করে ওর একেকটি অধ্যায় লিখেছিলাম। জয়ন্ত পড়েছিল। জয়ন্তর গল্প পড়া যারা শোনেনি, তাদের কাছে আর কি বলব। একমাত্র আমার ছাত্রীজীবনে শোনা অধ্যাপক প্রফুল্ল ঘোষের শেক্সপীয়র পড়ার সঙ্গে ওর তুলনা হয়। প্রফুল্ল ঘোষের মৃত্যুর পর আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের পত্রিকায় লিখেছিলাম যে আমাদের চোখের সামনে আমাদের গলা-বন্ধ কোট আর ধুতি পরা পুরুষ্টু প্রফেসারটি সুন্দরী ডেস্ডিমোনা হয়ে যেতেন, যাকে দেখলেই না পাওয়ার বেদনায় বিধুর হতে হয়। আদর্শবাদের গল্প, কিন্তু বাস্তব ভিত্তিক, সমবেদনায় ভরপুর সরস। এ বই ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড প্রকাশ করেছিলেন সুন্দর ছবি দিয়ে, প্রায় নির্ভুল ছাপা। ওঁদের সব বই-ই যেমন হত। দুঃখের বিষয়, জয়ন্তর জীবনকালে ওর আর দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়নি; এখন আবার ছাপার কথা হচ্ছে।
১৯৬২ সাল যে কোথা দিয়ে কি ভাবে কেটে গেছিল, কিছুতেই মনে করতে পারি না। মনে হয় ঐ সময় আমাদের চীনে আক্রমণের ল্জ্জাস্কর অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছিল। আমি অবিশ্যি মনে করি তাতে আমাদের যথেষ্ট উপকার হয়েছিল, কারণ বেশ কিছু শিক্ষা হয়েছিল। সে যাইহোক, ঐ বছর আমার কোনো বই বেরোয়নি। বেতারে নানা রকম চাঞ্চল্যকর সংবাদ ঘোষিত হত, হাঁ করে শুনতাম। কিছুদূর অনুপ্রবেশ করে, তারা নিজের থেকেই ফিরে গেছিল। সে-ও আরেক রহস্য।
সে যাইহোক ৬২-র পর ৬৩ এল। উপেন্দ্রকিশোরের শতবর্ষ পূর্তির বছর। জ্যাঠামশায়ের চিন্তাধারা দ্বারা যতই না প্রভাবিত হই, আমার সেই পাঁচ বছর বয়সের পর তাঁকে আর দেখিনি। তবু তিনি আমার জীবনের একটি জলজ্যান্ত নেতা। তার একটা কারণ হল আমার মা-কে তিনি মানুষ করেছিলেন। তাঁর কথা উঠলেই মায়ের মুখ স্নিগ্ধ মধুর হয়ে উঠত। কত যে ছোট ছোট ঘটনা তাঁর কাছে শুনেছি, তাতে জ্যাঠামশায়ের মূর্তিটি আমার মনের মধ্যে চলমান শক্তির মতো আজ-ও কাজ করে। মেজোমেয়ে পুণ্যলতার লেখা অপূর্ব বই ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’র প্রতিটি অক্ষর মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে ছিল। সেই অসাধারণ পুরুষের বাস্তব সান্নিধ্য যে কত কম পেয়েছিলাম, তা আমি টের পাইনি। শতবর্ষ উৎসবের জন্য একটি কমিটি করা হল। কমিটির সিদ্ধান্ত হল আমি তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখে দিই, ছোটদের উপযুক্ত করে।
কৃতার্থ হয়ে গেছিলাম। মায়ের কাছে শোনা সেই সব অবিস্মরণীয় ঘটনা আর বর্ণনা নিজের ছোটবেলা থেকে যে সব কথা মনে জমা ছিল, মেজদির বই পড়ে যা শিখেছিলাম, এই সবের সঙ্গে আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সমস্ত নিয়ে ছোট বই ‘উপেন্দ্রকিশোর’ বেরুল। তার-ও বেশ কিছু মুদ্রণ হয়েছে। নিউ স্ক্রিপ্টের প্রকাশনা। নিউ স্ক্রিপ্টের কর্মকর্তা হলেন অশোকানন্দ দাশ, পুণ্যলতার জামাই এবং জীবনানন্দের ছোট ভাই। এখনো ৮২ বছর বয়সে সমানে খেটে যাচ্ছেন।
কোন সময় যে প্রথম চিল্ড্রেন্স বুক ট্রাস্টের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম তা মনে পড়ে না। হয় তো যখন সেন্ট্রাল অ্যাডভাইজরি বোর্ড অফ এডুকেশনের সদস্য ছিলাম, তখন ঐ সংস্থার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল। ছোটদের নিয়ে কারবার, তক্ষুণি আকৃষ্ট হলাম। তাছাড়া সংস্থার প্রাণপুরুষ শংকর পিল্লেইকে একবার দেখলে ভোলা যায় না। শংকরস উইকলি বলে প্রধানতঃ রাজনীতি বিষয়ক ব্যঙ্গপত্রিকার মালিক, সম্পাদক, শিল্পী শংকরকে চেনে না এমন কেউ ছিল না। আমিও ছবিগুলো দেখে চমকে যেতাম। কি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কি হাতের টান! তখনো মানুষটিকে চাক্ষুষ দেখিনি। যেই দেখলাম, মুগ্ধ হলাম।
লোকটির একটু বর্ণনা দিই। রোগা, লম্বা, কালো, কালো রঙের জোব্বা টাইপের কি একটা পরনে স্রেফ একটি চতুর দাঁড় কাগের মতো দেখায়। মুখের দিকে তাকালে সরসতার ঝকমকে স্রোতে ভেসে যেতে হয়। এমন মানুষ খুব কম দেখেছি। কতবার যে আমাকে বলেছেন ওঁর সংস্থায় যোগ দিতে। তা কি করে সম্ভব হয়? আমি দিল্লী যাব না। তা ছাড়া উনি চান চারদিকে রাশি রাশি গুণী সংগ্রহ করবেন, কিন্তু আশা করেন সব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সকলের মতে মিলবে! আমি আবার অন্য লোকের মতকে শ্রদ্ধা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সব সময় মেনে চলতে রাজি নই। তাই আমার ঐ পছন্দের মানুষটির সঙ্গে যে কাজ করার সুযোগ পাই না, তার জন্য যেমনি আক্ষেপ করি, তেমনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি! আমার তিনখানি ইংরিজি বই ওঁরা প্রকাশ করেছেন:—টাইগার টেল্স, তার বাংলাও করে দিয়েছি ‘বাঘের বই’ নামে, রিপ দি লেপার্ড আর দি হাউস বাই দি উড। সত্যি বলব শংকর পিল্লেই-এর দেখা পেয়ে আমি কৃতার্থ হয়েছি, তাঁর স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি। দুজনেই ছোটদের কাজে রত, একই আদর্শ নিয়ে চলি। উনি কিছু বড় মাপে; আমি নিজের সাধ্যমতো।
১৯৬৩ সালে আমাদের ছেলে বিলেত থেকে ফিরে এল। এখান থেকে এম বি বি-এস্, বি ডি-এস্ করে, গাইজ্ হস্পিটাল থেকে প্র্যাক্টিকেল ট্রেনিং নিয়ে এল। কলকাতাতেই প্রাইভেট্ প্র্যাকটিসের সিদ্ধান্ত নিল। এই একটা খবর। আর জুন মাসে আমি আমার কনট্রাক্ট শেষ না করেই বেতারের কাজ ছেড়ে দিলাম। ঐ আরেকটা খবর। আরো আগেই ছাড়া উচিত ছিল। কেমন যেন আনন্দের স্রোতটা শুকিয়ে গেছিল। সাহিত্যিক অনুষ্ঠানগুলোতে মন উঠত না। নতুন স্টেশন ডিরেক্টর বড়ই মেজাজি লোক। বন্ধুরা অনেকেই চলে গেছেন। জয়ন্তও আমেরিকায়। বাতাস অন্য রকম। মাঝে মাঝে গুণী লোকেদের সঙ্গেও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতেন। মনে মনে ভাবতাম আমার সঙ্গে ওর শতাংশ করলেও পাকা ফলটির মতো টুপ করে ঝরে পড়ব। আমার স্নেহভাজন প্রোগ্রাম একজেকিউটিভ সুকুমার রায়কে তাই বলতামও। ও ভাবত রগড করছি।
ছাড়লাম অতি তুচ্ছ কারণে। একটি ইংরিজি অনুষ্ঠানের রেকর্ড করা মালমশলা আমার কাছে পাঠিয়ে বড়সায়েব বললেন, সংলাপ দিয়ে জুড়ে এটিকে সম্পূর্ণ করতে হবে। সংলাপও লেখা ছিল। রেকর্ড করিয়ে নিতে হবে। বিষয়বস্তু কয়লার খনি, নাম ‘কালো হীরে’। এ-রকম পরের কাজ শেষ করতে আমার ভালো লাগে না। তবু বার বার বলাতে কোনো রকমে করলাম। সত্যিই ভালো হয়নি। তবে তার দায়িত্বটি একা আমার ছিল না। হয়তো সবটা নতুন করে রেকর্ড করা উচিত ছিল; সহকারীদের উপরে অতটা নির্ভর করা উচিত ছিল না। সে যাইহোক, বড় সায়েবের মেজাজ দেখে আমারো গা জ্বলে গেল। তাঁকে কিছু স্পষ্ট কথা বলে, সেই যে বাড়ি গেলাম, আর আপিসের কাজে হাত দিলাম না। পরে শুধু একবার গিয়ে রেজিগ্নেশনটা দিয়ে এলাম। অন্যায় কথা বলব না, বড়সায়েব আমাদের বাড়ি এসে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। দিল্লি থেকে ডিরেক্টর জেনারেল এসে অনুরোধ করেছিলেন ত্যাগপত্র তুলে নিতে। আমি রাজি হইনি। আসলে নিজেরই অজান্তে আমি ছেড়ে যাবার জন্য তৈরি হয়ে ছিলাম। কারণটা খুবই অযোগ্য। এর চেয়ে ঢের বেশি আপত্তিকর কথা এর আগেও শুনেছি এবং উৎসাহের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে পড়েছি, কাজ ছাড়ার কথা ভাবিওনি। সে তো পরাজয় স্বীকার। এ এস ডি সুদেব বসুর সঙ্গে প্রায়ই আমার চটাচটি হত, তারপর মিটেও যেত। এবারকার কারণটা উপলক্ষ্য মাত্র, এ-কথা নিজেও বুঝেছিলাম। কিন্তু এক দিনের জন্যেও ফিরে যেতে ইচ্ছা করেনি। ৭ বছরের মোহ এক নিমেষে কেটে গেছিল। এখনো মনে করি রেডিওর কাজ কম বয়সীদের জন্যও। বয়স্ক প্রতিষ্ঠিত লোকদের মাঝে-মধ্যে এবং যথা সম্ভব বেশি ফী নিয়ে, বাইরে থেকে এসে পছন্দমতো প্রোগ্রাম করে বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। যেমন আমি গত ২০ বছর ধরে করেছি। এখন তাও ইচ্ছা করে না।
তবে ৭ বছরের অভ্যাস তো আর এক দিনে যাবার নয়। দিনগুলো ফাঁকা ফাঁকা ঠেকত। সারাদিন বেতার আপিসে কাজে ব্যস্ত থেকে, বাড়ি গিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে রাত এগারোটা অবধি লিখতাম আর সকাল ৫১/২ টা অবধি এক টানা ঘুমোতাম। অনেক সময় বিকেল ৫টা থেকে ৬টা একটু বিশ্রাম করে নিতাম। রেডিও ছেড়ে, আবার দুপুরে ১১/২ টা থেকে ৩১/২টা বই নিয়ে শোয়া ধরলাম। ফলে রাত দুটো অবধি চোখে ঘুম আসত না! সব তো আর হয় না। সব জিনিসের দাম দিতে হয়। এখনো আমার রাতে ভালো ঘুম হয় না।
ঐ বছর সঙ্গীত নাটক আকাদেমি আমার বক-বধ-পালা নাটকের জন্য আমাকে পুরস্কৃত করলেন। দিল্লী গিয়ে ডঃ রাধাকৃষ্ণানের হাত থেকে পুরস্কারটি গ্রহণ করলাম। সে বছর আমার প্রিয় মানুষ সবিতাব্রত দত্ত, তিমিরবরণ এবং আরো কেউ কেউ পুরস্কার পেয়েছিলেন। বেতারের গণ্যমান্য অনেকে সভায় উপস্থিত ছিলেন। মনে হল আমি তাঁদের ছেড়ে গেছি বলে, তাঁদের কাছে আরো আদরণীয় হয়েছি। তবে ভুল বুঝে থাকতে পারি।