॥ ৩০ ॥
আমি ডায়োসেসান্ কলেজ থেকে পাস্ করে বেরোবার পর ৫০ বছর কেটে গেছে, কিন্তু এতদিনেও তার চাইতে ভালো একটা কলেজ দেখলাম না। মনে হত প্রত্যেকটি ছাত্রী সেখান থেকে কপালে একটা ছাপ নিয়ে বেরোত। সে ছাপ শুধু কৃতিত্বের বা যোগ্যতার ছাপ নয়, সে এক আশ্চর্যরকমের আত্ম-প্রত্যয়ের, একটা বলিষ্ঠতার ছাপ। সে সময় সে জিনিসের বড় প্রয়োজন ছিল, কারণ আমাদের নেতারা কাঁধ থেকে ভূত ঝাড়বার মতো করে সমস্ত ব্রিটিশ আদর্শ ঝেড়ে ফেলার কথা ভাবতেন, ভালোমন্দ নির্বিচারে। আমরাও ভুলে যেতাম যে জ্ঞানের কোনো দেশকাল-পাত্রের বিচার নেই, জ্ঞান মানবজাতির সম্পত্তি। সুখের বিষয় এই সঙ্কীর্ণতা থেকে ডায়োসেসান কলেজের সন্ন্যাসিনী পরিচালিকারা মুক্ত ছিলেন। হয়তো বিদেশে এসে সারা জীবন একটা শিক্ষালয়ে পড়ে থাকার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল খানকতক আত্মাকে খৃষ্টের পাদপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া। তাই যদি হয়েও থাকে, আমি চার বছর ডায়োসেসান স্কুলে আর চার বছর কলেজে পড়েও একদিনের জন্যেও নান্দের মুখে হিন্দু ধর্মের নিন্দা বা খৃষ্টীয় ধর্মের প্রকৃষ্টতার কথা শুনিনি। একবার বটে গুজব শুনেছিলাম যে কলেজের অধ্যক্ষা সিস্টার ডরথি ফ্রান্সিস্ কোনো অধ্যাপিকার কাছে নাকি আক্ষেপ করেছিলেন যে হিন্দুদের না হয় অনেকগুলো প্রাচীন নিয়ম ও বিশ্বাসের গণ্ডি কেটে বেরিয়ে আসা মুশকিল, কিন্তু ব্রাহ্মদের তো সেসব বালাই নেই, তারা কি বলে খৃষ্টীয় ধর্মের মতো একটা উন্নত ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় না? মিশনারীদের খাতা পরীক্ষা করে নাকি দেখা গেছে যে যদি বা কিছু শিক্ষিত হিন্দু খৃশ্চান হয়েছেন, সে তুলনায় শিক্ষিত ব্রাহ্ম খুব কমই হয়েছেন। এর উত্তরে আশা করি তাঁকে বলা হয়েছিল যে ব্রাহ্ম হয়েই যাঁরা তাঁদের বাঞ্ছিত সুখ-সুবিধাগুলো পেয়েছেন তাঁদের আর খৃস্টান হবার প্রলোভন কিসের।
সে যাই হোক, এঁরা ভারি বুদ্ধিমতী ও উদার ছিলেন। সিস্টার ডরথি ফ্রান্সিস্ একটি অসাধারণ চরিত্র ছিলেন, যেমনি কড়া তেমনি ন্যায়নিষ্ঠ, যেমনি গম্ভীর। তেমনি সরস, যেমনি কঠিন তেমনি দয়ালু। অতিশয় বুদ্ধিমতী, উচ্চশিক্ষিত, নিষ্কাম, শান্ত-সমাহিত, অথচ সহানুভূতিশীলা। এরা সন্ন্যাসিনী হবার সময় নিজেদের শ্রাদ্ধ না করলেও, পূর্ব-জীবনের সমস্ত ব্যক্তিগত পরিচয় লুপ্ত করে দিয়ে সিস্টার হতেন, এঁদের ধর্মই হল সেবা। যখনই খৃস্টান মিশনারিদের নিন্দা শুনি, আমার সিস্টার ডরথি ফ্রান্সিসের কথা মনে পড়ে। মানুষকে যে মানুষ বলে শ্রদ্ধা করে, সে আমার মনের মানুষ। তবে অন্যদের কথা বলতে পারি না। বিলিতী মেমদের কাছে ইংরিজি পড়তাম, ছোটবেলা থেকে তাই পড়েও এসেছিলাম, বিশুদ্ধ ইংরিজি উচ্চারণ একেবারে স্বভাবগত হয়ে গেছিল। তখন এদেশে সাহেব-মেমদের প্রাচুর্য ছিল; যেকোনো সাধারণ বি-এ পাস করা ছেলেমেয়ে নির্ভুল ইংরিজি বলত; যারা সায়েব অধ্যাপকদের ছাত্র ছিল তাদের অনেক সময় চমৎকার উচ্চারণ করতে শোনা যেত। এখন এই জিনিসটির একান্ত অভাব। নির্ভুল ইংরিজি বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা। অনেকে বলেন, “তাতে কি হয়েছে? হাজার হোক বিদেশী ভাষা। কটা বিদেশী ভালো বাংলা উচ্চারণ করে?” ওসব হল গিয়ে কৈফিয়ৎ এবং ঐ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে সুন্দরভাবে সম্পন্ন কাজের মর্যাদাই আলাদা। চার বছর বিলেত অ্যামেরিকায় কাটিয়ে যখন কেউ ভুল উচ্চারণ করে, আমার গা শিউরে ওঠে। যাক গে সেকথা, আজকালকার লোকদেরও এমন অনেক গুণ আছে, যা আমাদের সময়ে ছিল না। যেমন, এরা অনেক বেশি স্বাভাবিক ও স্বাবলম্বী, কাজকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করে। আমার মেয়ে ও তার বন্ধুরা নিজেরা একলা বাজারে গিয়ে সুবিধে মতো দরে উৎকৃষ্ট মাছ কিনে আনে; রান্নাবান্না, কাপড়-কাচা এক হাতে করে, মটর-গাড়ি চালায়, ব্যাঙ্কের কাজ, ট্যাক্সের কাজ অবলীলাক্রমে সারে। আমাদের সময় এসব দুঃস্বপ্নের বাইরে ছিল।
বি-এ পরীক্ষার জন্য নিজেকে খুব ভালো করে তৈরি করেছিলাম। ইংরিজি সাহিত্যের যেকোনো ভালো বইয়ের কথা শুনলেই লাইব্রেরি ইত্যাদি থেকে জোগাড় করে পড়ে ফেলে, নোট করে, ছেড়ে দিতাম। একেকটা ছোট নোটবই হঠাৎ হঠাৎ খুঁজে পাই আর নিজের অধ্যবসায় দেখে অবাক হয়ে যাই। বেড়ে নোটগুলো, একথা মানতেই হবে। অথচ সর্বদা মনে মনে জানতাম ইংরিজিতে বিদ্যাদিগ্গজ হওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়; আমি বাংলায় আমাদের দেশের ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য লিখতে চাই। বড় পদ অলংকৃত করতে চাই না; একদিন যদি আমার দেশবাসীরা বলে, ‘এ মেয়ে তার বংশের উপযুক্ত সন্তান’ তবেই আমার জীবন সার্থক হবে।
এসব কথা সত্যি হলেও সাহিত্যিক বিষয়ে প্রবন্ধ লিখবার জন্য কেবলি কলমটা উস্খুস্ করত। কিন্তু কলেজের খাতায় এবং ইংরিজিতে ছাড়া তাকে কোথাও মুক্তি দিতাম না। নিজের যোগ্যতার ওপর এতটুকুও আস্থা ছিল না। অন্তরে অন্তরে জানতাম যে ক্রমে বাংলা শব্দের ওপর দখল আসছে; দু-চারটি সহজ কথায় যতখানি আমি বলে ফেলতে পারি, অন্যদের ততখানি বলতে আধ পাতা জায়গা লাগে। কিন্তু তৎসম শব্দের বানান মাঝে-মাঝেই অভিধান খুলে দেখে নিতে হয়। বলেছি তো বাংলায় আমি কাঁচা; কিন্তু বাংলা আমার প্রাণ; তাই টপ করে কথা ধরি, ধরি আর মনের মধ্যে জমা করি। যেমন করে ইংরিজি কথা শেখে সবাই; দেখে দেখে, চিনে চিনে, ভালোবেসে-বেসে, আমিও তেমনি করে দেখে দেখে, চিনে চিনে, ভালোবেসে-বেসে বাংলা শিখেছি। ব্যাকরণকে শ্রদ্ধা করি বটে, তৎসম তদ্ভব শব্দ সম্বন্ধে সাবধানে থাকি বটে, কিন্তু হৃদয় ভরে যায় লোকের মুখে শোনা বঙ্গজ শব্দে, দিশী গেঁয়ো কথায়, তার মধ্যে হাজার ব্যাকরণের অশুদ্ধি আছে তাও জেনেশুনে।
তবে এসব নিয়মের বাইরের ভালোবাসায় নম্বর ওঠে না। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বাংলা বাদ দিলে আমি প্রথম হতাম। বাংলা জুড়তেই সুনীতকুমার ইন্দ্র হয়েছিল প্রথম, আমি দ্বিতীয়। বি-এতেও যদি বাংলার নম্বর জোড়া হত, তাহলে আবার তাই হত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুখের বিষয় যারা কোনো বিষয়ে অনার্স নেয়, তাদের অন্য বিষয়ে পাস্ নম্বর রাখলেই হল। অবিশ্যি কয়েকটা পদক, বৃত্তি ইত্যাদি দেবার সময় সব নম্বর জোড়া হত। যাই হোক, বি-এতে আমি প্রথম হলাম, সোনার পদক পেলাম, অনেক পুরস্কার পেলাম, জুবিলি স্কলার হয়ে ৫০ টাকার বৃত্তি পেলাম। যারা নানা বিষয়ে প্রথম হয়েছে তাদের মধ্যে যাদের নম্বর সবচেয়ে বেশি, সেইরকম ১০-১২ জনকে জুবিলি স্কলার বলত। দাদাও আগের বছর জুবিলি স্কলার হয়েছিল।
এদিকে দিদি তো আগের বছর থেকেই এম-এ ক্লাসে ভর্তি হয়ে, হাতে হাত-ঘড়ি, বগলে হ্যাণ্ডব্যাগ আর একটা নোটবই, গলায় এক ফাউণ্টেন পেন নিয়ে কলেজে যেত। পরে দেখতাম দুটো একটা কবিতা-নাটকের বইও নিত। শুনলাম প্রফুল্ল ঘোষ বলে একজন আশ্চর্য মাস্টারমশাই আছেন, শেক্সপীয়র পড়ান, তাঁর ক্লাসে বই না নিয়ে উপায় নেই। আমাদের পাড়ায় লীলালতিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে একজন বয়স্কা বিবাহিতা মহিলা শখ করে বেশি বয়সে এম-এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন; আমার মা যখন বেথুন কলেজে পড়তেন তিনি তখন বেথুন স্কুলে পড়তেন। তিনি বললেন, “তাতে কি, সুলেখা একা যাওয়া-আসা করবে কেন? আমাদের গাড়িতে যাবে আসবে।” ইনি পরে বহু বছর ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনের অধ্যক্ষা ছিলেন। সেই ব্যবস্থাই হল। এখন ভাবতে অদ্ভুত লাগে। যে ৫০ বছর আগেও মেয়েদের ট্রামে করে কলেজ যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠত। বাস তখনো ঠিক চালু হয়নি, তবে পরীক্ষার্থে দুটো চারটে প্রাইভেট বাসকে পথে ছাড়া হয়েছিল। অনেকটা এখনকার পুলিসের ভ্যানের মতো, পেছনে কিম্বা পাশে দরজা, মাঝখানে প্যাসেজ, দুদিকে দুটি লম্বা সীট। কিন্তু ট্রামের অর্ধেক সময়ে পৌঁছে দেয়। তাই সঙ্গে সঙ্গে বাস ভারি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ট্রাম কোম্পানী বড় বড় বাস নামাল, দোতলা বাসও নামাল, তার ছাদ থাকত না। বৃষ্টি পড়লে নেমে এসে একতলার ভিড় বাড়াতে হত।
অন্য লোকের সঙ্গে চলাফেরা দিদির পছন্দ ছিল না; আমি ভর্তি হতেই, দুজনে একসঙ্গে ট্রামে যেতাম। এসপ্ল্যানেডে গাড়ি বদল করতাম। সে তো আমাদের চেনা পথ; ছোটবেলায় ছোটজ্যাঠার সঙ্গে, পরে মা-বাবার সঙ্গেও কত গেছি। বাবা কোনোদিনও গাড়ি কেনেননি, যদিও তাঁর জুনিয়র পদাধিকারীরা কিনেছিলেন। পরে ট্রামে বেশি সময় লাগে বলে আমরা বাসেই যেতাম। এক বছরের মধ্যে বহু মেয়েকে একা যাতায়াত করতে দেখা যেত। বলাবাহুল্য কলেজেও মেয়েদের আলাদা বসবার ঘর ছিল; ক্লাসে যাবার সময় সেখান থেকে অধ্যাপকরা মেয়েদের ডেকে নিয়ে যেতেন, আবার ক্লাসের পর পৌঁছে দিতেন। কিন্তু লাইব্রেরিতে ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে পাশাপাশি বসে কাজ করত। মোট কথা কর্তৃপক্ষ ছেলেমেয়েদের আলাদা করে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন, আর ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই পরস্পরকে জানবার প্রাণপণ চেষ্টা করত। তবে প্রেম করবার জন্য নয়, যদিও তাও হত মাঝে মাঝে, কিন্তু সেটাই আসল উদ্দেশ্য ছিল না। এতকাল পারিবারিক পাখনার আড়ালে মানুষ হয়েছিলাম।২০ বছর বয়স হল তবু আলাদা একটা নিজস্ব জীবন গড়ে তুলবার সুযোগ পেলাম না। এমন একটা জীবন যেখানে বাইরের সাহিত্য-শিল্পও স্থান পায়। যেখানে লেখা বলতে শুধু সন্দেশের আর রায় বাড়ির আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কৃতিত্ব বোঝায় না। তবে একটা বিষয় মানতেই হবে, আমার মা বাবা কখনো আমাদের বাইরের পড়াশুনোয় হস্তক্ষেপ করতেন না। যেখান থেকে যা খুশি বই এনে আমরা পড়তাম, কোনো দিনও বাধা দেননি। অবিশ্যি বাইরের পুরুষমানুষদের কথা আলাদা। তাদের সকলকে আমরা সন্দেহের চোখে দেখতে শিখেছিলাম। এর আগেও বলেছি ৫০ বছর আগে এর একটা কারণ ছিল, তখন যেসব মেয়েরা স্বাধীনভাবে বাইরে বিচরণ করত—অর্থাৎ পুরুষ রক্ষাকর্তা ছাড়া কলেজ যেত, সিনেমা দেখতে যাবার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবত না—তাদের মধ্যে সবাই না হলেও ২/৩ ভাগ ছিল ব্রাহ্ম মেয়ে। যেসব হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে তাদের দেখাশোনা হত, তাদের ৯০% হিন্দু এবং ৮০% ছেলের বাড়ির মেয়েরা অন্য পুরুষদের সঙ্গে কথা বলত না। এসব ছেলেদের পক্ষে একথা ভাবা অসম্ভব ছিল না যে যে-সমস্ত মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে পড়াশুনো করে, তাদের পক্ষে ভালো থাকা অসম্ভব। এই মনে করে মেলামেশায় তাঁরা বাধা দিতেন, কানে সতর্কবাণী ঢালতেন। তবে আমাদের বাড়ির আবহাওয়া একটু অন্যরকম ছিল। কারণ আমরা ছিলাম যাকে বলা হত “এক পুরুষের ব্রাহ্ম”। আমাদের আপন জ্যাঠী-পিসিদের অর্ধেক হিন্দু কেউ কেউ গোঁড়া হিন্দু। হিন্দুদের নৈকট্য আমাদের হাড়ে হাড়ে।
তাছাড়া হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে মিশব না তো কার সঙ্গে মিশব? আমাদের ক্লাসের ১০০টি ছেলের মধ্যে একটিও ব্রাহ্ম ছিল কি না সন্দেহ। তিনটি মেয়ের মধ্যে অবশ্য দুজন ব্রাহ্ম! তৃতীয়জন একজন অসাধারণ মেয়ে, তার নাম কমলা দাশগুপ্তা, সে সারা জীবন স্বদেশকে ভালোবেসেছে, সাধ্যমতো সেবা করেছে, দীর্ঘকাল জেল খেটেছে, সাধ আহ্লাদ উচ্চাশা সব ত্যাগ করেছে। তার স্বাস্থ্য ভেঙেছে, জনসাধারণ তাকে ভুলেছে, কিন্তু আমার হৃদয়ে আমি তাকে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছি। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। বছরের পর বছর যদিও তার সঙ্গে দেখা হয় না।
তারপর অধ্যাপকদের কথাই যদি ধরা যায়, তাঁদের মধ্যে তিনজন মাত্র ব্রাহ্ম ছিলেন। অগ্রণী হলেন অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, যাঁর বৈদগ্ধ্য ও খটমট বাক্যালাপ এবং গোঁড়া ব্রাহ্মত্বের পিছনে একটা উজ্জ্বল পৌরুষ বিরাজমান ছিল। সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। ট্রাস্ট-ডীড অনুসারে সেখানকার মাটিতে কোনো ধর্মানুষ্ঠান হতে পারে না। অথচ ছেলেরা সরস্বতী পুজো করবেই। তখন আইন-অমান্য আন্দোলন আর ছাত্র জাগরণ চরমে উঠেছিল; কোনোরকম বাধা, তা সে ন্যায্যই হোক কি অন্যায়ই হোক, ছেলেরা সইতে পারল না। সরস্বতী পূজা বন্ধ করার জন্য রেগেমেগে তারা ঐ পরম পণ্ডিত মানুষটির গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দিয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম না, কিন্তু একজন সহপাঠী—বলাবাহুল্য সে হিন্দু—আমাকে বলেছিল যে তাঁর মুখে এতটুকু রাগ-অপমানের ছাপ পড়ল না, বললেন—একটু নাকি সুরে কথা বলতেন—”দাঁও, তাই দাঁও, অন্য লোকে ফুলের মালা পায়, আমাকে জুতোর মালাই দাঁও!” এখানে বলা উচিত যে সিটি কলেজে যাই হোক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিনের জন্যেও কেউ তাঁকে অশ্রদ্ধা দেখায়নি।
আমি দু-বছর পড়লাম নানারকম হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে, কখনো কারো আপত্তিকর ব্যবহার চোখে পড়ল না। মাঝে মাঝে খানিকটা দূরত্ব রেখে পিছন পিছন আসত বটে, কিন্তু কিছু বলত না। এর বহু কাল পরে, বেতারে কাজ করার সময় গোপাল দাশগুপ্ত বলে একজন সঙ্গীত প্রযোজকের কাছে কিছু সহযোগিতা চাইতে গেছি, তিনি বললেন, “কি, এখন কেন? ইউনিভার্সিটির দালান দিয়ে যখন কেবলি পেছন পেছন হেঁটেছি, তখন তো নাক তুলে চলে যেতেন!”
এমনি লেকচারের সময় কথা বলবার সুযোগ না হলেও ৮-১০টি ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে একেকটি টিউটরিয়েল গ্রুপ হত, তখন আমরা খোলাখুলি নানা বিষয়ে আলাপ করতে পারতাম। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের বেছে আমাদের গ্রুপটি তৈরি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন আমার আজীবনের বন্ধু হয়ে গেছে; শুধু তারাই নয়, তাদের পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের আত্মীয়তার সম্বন্ধ হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই প্রিয় বন্ধুগুলির মধ্যে অনেকেই আর নেই। তাদের কথা না বলে পারছি না। একজন হল সেই সুনীতকুমার ইন্দ্র, যে আই-এতে প্রথম হয়েছিল। বেঁটে, শামলা, অল্পভাষী মানুষটি, মাঝে মাঝে তারার মতো জ্বলজ্বল করে উঠত, কি কোমলতা কি স্নেহ তার মধ্যে ছিল, কি সাহিত্যানুরাগ। আগে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করত, পরে মৌলানা আজাদ কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিল। সেই পদে অধিষ্ঠিত থাকতে থাকতেই নিতান্ত অকালে হৃদ্রোগে মারা গেছিল।
আরেকজন ছিল গোপাল মজুমদার। খুব ভালো ছাত্র, আদর্শবাদী। কয়েক বছর আগে রেলের চাকার তলা থেকে দুটি অচেনা শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে, নিজের প্রাণ দিয়েছিল। একটি শিশু বেঁচেছিল। আরেকজন ছিল অমৃতলাল গঙ্গোপাধ্যায়, পরে বিদ্যাসাগর কলেজে দেখেছিলাম। শিক্ষা ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে। বিশ্বভারতীর বিনয় ভবনের জনপ্রিয় অধ্যক্ষ সুনীলকুমার সরকার আরেকজন। কয়েক বছর হল সেও আমাদের ছেড়ে গেছে। যেমন মধুর গানের গলা ছিল, তেমনি মিষ্টি মানুষটি। চমৎকার সাহিত্যবোধ ছিল; অতিশয় উৎকৃষ্ট কিছু লেখা রেখে গেছে। সুনীলের স্ত্রী কৃষ্ণাকে আমি বড়ই ভালোবাসি; ওর একমাত্র ছেলে বিশ্বভারতীর সম্মানিত কর্মী। প্রফুল্লনাথ মুখোপাধ্যায় বলে আরেকজন ছিল। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনি মধুর তার ব্যবহার, শিল্পী মন ছিল, সাহিত্যানুরাগী ছিল। দীর্ঘকাল জামশেদপুরে প্রশংসার সঙ্গে কর্মজীবন কাটিয়ে এখন কলকাতার অধিবাসী। এই মানুষটির সঙ্গে আমার যথেষ্ট অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। শিবনাথ শাস্ত্রীর দৌহিত্রের কন্যা বিবাহ করেছে। সবচাইতে গভীর ও অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যার সঙ্গে হয়েছে, তার নাম জ্যোৎস্নানাথ মল্লিক, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বড় ছেলে। জ্যোৎস্না আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো, আমাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার। পড়াশুনোয় ভালো ছিল, আইন পরীক্ষার উজ্জ্বল তারকা; পরে মুন্সেফি করে, জজিয়তি করে, এখন অবসর নিয়েও নানান উচ্চ পদ ভূষিত করছে। তবে সেইটেই বড় কথা নয়। এমন তীক্ষবুদ্ধি, সরস, সস্নেহ মানুষ কম হয়। সাহিত্যের এমন বুদ্ধিমান সমালোচকও খুব বেশি নেই। বিদগ্ধ প্রবন্ধ লেখে, তবে ক্বচিৎ কদাচিৎ। ভালো প্রবন্ধ লিখতে হলে যে নির্মম ভেদজ্ঞানের সঙ্গে, গভীর বৈদগ্ধ্য রসবোধ আর সহানুভূতি থাকা দরকার সেসব গুণ যে জ্যোৎস্নার প্রচুর পরিমাণে আছে, একথা তার সম্প্রতি প্রকাশিত “সাহিত্যের সীমানা” নামক প্রবন্ধ পুস্তক পড়লেই বোঝা যায়।
এম-এ ডিগ্রি ও পদক আমার জীবনে বিশেষ কোনো কাজে না লাগলেও, এই বন্ধুত্বগুলি এবং এই বন্ধুত্বের স্মৃতি আমার পরম সম্পদ।
মাস্টার মশাইদের কথাও বলতে হয়। এর আগে আমার “আর কোনোখানে” নামক স্মৃতি-গ্রন্থে আমি প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলাম যে এম-এ ক্লাসে ঢুকে প্রথম বাঙালীদের কাছে ইংরিজি পড়লাম। গোড়ায় তাঁদের ইংরিজি উচ্চারণ শুনে চমকে গেলেও, অনতিবিলম্বে বুঝেছিলাম যে উচ্চারণ যতই অশুদ্ধ হোক না কেন, এঁদের গভীর পাণ্ডিত্যর কাছে আগেকার ঐ মেমরা দাঁড়াতে পারবেন না। তবে পূর্বোল্লিখিত সিস্টার ডরথি ফ্রান্সিসকে এই মন্তব্য থেকে বাদ দিতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে শুনেছিলাম তিনি ইংল্যাণ্ডের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ খেতাবধারিণী এবং এক কালে একটি সুখী পরিবারের গৃহিণী ছিলেন। সেই সুখে বজ্রাঘাত হবার পরে হয়তো সন্ন্যাসিনী হয়েছিলেন। তবে সাংসারিক সম্পদ ছাড়লেও হৃদয়ের সম্পদগুলো সঙ্গে করে এনেছিলেন।
সে যাই হোক, ইউনিভার্সিটির মাস্টারমশাইদের সঙ্গে আমাদের নিতান্ত লেখাপড়ার সম্বন্ধ ছিল। তার বেশি আমরা আশা করতাম না, পাইওনি। তাঁরা ছিলেন নিতান্ত মাস্টারমশাই; গুরুর আসন নেবার কোনো চেষ্টা করেননি। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন, যাঁর অসাধারণত্বের জোরে তিনি স্বচ্ছন্দে ঐ শতাধিক ছেলেমেয়ের গুরুর পদ দাবি করতে পারতেন। তাঁর নাম প্রফুল্ল ঘোষ। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের আতিথ্যে অধ্যাপনা করতেন। পড়াতেন শেক্সপীয়র, মাঝে মাঝে চসার। মোটা বেঁটে শ্যামলা খাঁদামতো নাক-মুখ, গলাবন্ধ কোটের সঙ্গে সাধারণ ধুতি পরা; সাজসজ্জা করবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই; বয়স তখন হয়তো ৫১-৫২র বেশি নয়, তবে মাঝখানে ৩০বছরের ব্যবধান থাকাতে আমাদের মনে হত বুড়ো; বাবার কাছাকাছি বয়সী তো বটেই।
কারো সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সম্বন্ধ স্থাপন করবার চেষ্টা ছিল না, কাউকে কাছে ডাকতেন না, ভালো ছাত্রদেরও কখনো বিশেষ দৃষ্টি দিতেন না, সবাই তাঁর কাছে সমান। শেষ দুটি ঘণ্টা ক্লাস নিতেন, সপ্তাহে এক দিন। সেই দুই ঘন্টা মাঝে মাঝে সাড়ে তিন ঘন্টায় দাঁড়াত। শেক্সপীয়রের একেকটি নাটক একবারে পড়ে শেষ করতেন। পড়তেন বললে ঠিক বলা হবে না; অভিনয়ও করতেন না, তাতে কিছু কৃত্রিমতা থাকে; বরং বলতে হয় দান করতেন। প্রফুল্ল ঘোষ আমাদের চোখের সামনে একটির পর একটি চরিত্র বলে যেতেন। এমন কি ওঁর সেই শামলা ভোঁদা শরীরটা চোখের সামনে সুন্দরী ডেস্ডিমোনা হয়ে যেত। একটা মানুষের গলা দিয়ে যে এত চরিত্র কথা বলতে পারে এ আমার ধারণা ছিল না। কোনো নাটুকেপনা ছিল না; হাত পা এতটুকু নাড়তেন না; কণ্ঠ দিয়ে সমস্ত সম্পন্ন হত। ওঁকে যেন দৈব-দশায় পেত। ক্লাসরুমের দেয়াল কোথায় সরে যেত; আমরা সকলে নিঃশব্দে কোনো এক রসলোকে উপনীত হতাম। দেখতে দেখতে অন্য ক্লাসের, অন্য কলেজের ছাত্ররা এসে ভিড় করত। কারো মুখে কথা নেই। পড়া শেষ হলে, কি অধ্যাপক কি তাঁর শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো যে যার পথ দেখত। শুধু শেক্সপীয়র পড়াতে নয়, চসার পড়াতেও তাঁর অসাধারণ প্রতিভা প্রস্ফুটিত হত। একবার একটি রঙের নাম পাওয়া গেল, কিন্তু সে শব্দটি এখন আর ব্যবহার হয় না, ঠিক কি যে রঙ বোঝা গেল না, মেটে কি বেগ্নি, কি ঐ ধরনের কিছু। আমাদের অধ্যাপকও ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। পরের সপ্তাহে ৫-৬টি মোটা মোটা মধ্য-যুগীয় ইংরিজি কাব্যের বই এনে রঙটি যে বাস্তবিকই মেটে-বেগ্নি সে কথা প্রতিষ্ঠা করলেন। দুঃখের বিষয় এমন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও, তিনি পরবর্তী কালের ছাত্রদের জন্য এক লাইনও লিখে গেলেন না। তাঁর নাম এখন একটা প্রবাদ মাত্র।
॥ ৩১ ॥
আমার ছাত্র-জীবনের কাহিনী ক্ৰমে শেষ হয়ে আসছে। এম্-এ পাস্ করবার পর আর আমি কখনো কোনো পরীক্ষা দেবার কিম্বা মস্ত প্রবন্ধ লিখে খেতাব পাবার চেষ্টা করিনি। ও-সবের সঙ্গে আমার কি? ঐ দু-বছরে আমি অনেক বিদগ্ধজনের দেখা পেয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে সকলে আমার মাস্টারমশাই ছিলেন না। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নাম আগে বলি। বিদগ্ধ-শিরোমণি জয়গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। আমাদের শেলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ইত্যাদি পড়াতেন। ছোট খাটো প্রৌঢ়, ফিটফাট কাপড়চোপড়, কিঞ্চিৎ কাঠখোট্টা চেহারা, কিন্তু কাব্যরসে ডুবে থাকতেন। শেলি কীটসের গুণ স্বীকার করেও ওঁদের আমার মনে ধরত না। কেমন একটু মরে গেলাম, গলে গেলাম, উচ্ছ্বাসের ভাব মনে হত। ওয়ার্ডসওয়ার্থ অমনটি না হলেও এত সামান্য জিনিস নিয়ে এত দীর্ঘ ভাব জমান যে আমার ধৈর্য থাকত না। সেকালে যাঁর দ্বারা আমি সব চাইতে প্রভাবিত হয়েছিলাম, তিনি হলেন রবার্ট ব্রাউনিং। তাঁর বলিষ্ঠ, মাঝেমাঝে রূঢ় রুক্ষ পদগুলি আমার মনের মধ্যে গেঁথে যেত। দুঃখের বিষয় আমাদের বিশেষ পাঠ্য-বিষয় ছিল রোমাণ্টিক কবিদের গোড়ার কজনা। তাই কার্য-কলাপে যিনি সব চাইতে রোমাণ্টিক চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁকে নমোনম করে ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু আমি তাঁকে আজ পর্যন্ত ছাড়তে পারিনি।
আরেকজন ছিলেন রজনীকান্ত গুহ, প্রৌঢ়, ব্রাহ্ম, প্রচ্ছন্ন একটু সরসতায় চোখ মিটমিট করত, বার্ক কারলাইল্ পড়াতেন। দিদিদের ক্লাসে একদিন যা বলেছিলেন, তার বাংলা হল, “বন্ধুগণ, আমি তোমাদের এমন সব কথা বলতে পারি, যার ফলে যদি এখনো অবিবাহিত থাক, তো চিরকাল অবিবাহিতই থাকবে!” দেশকর্মী ছিলেন, অশ্বিনীকুমার দত্তের সহকর্মী, দেশের জন্য অনেক কষ্টও সহ্য করেছিলেন, কিন্তু সে-সব তাঁর মনে কোনো তিক্ততা রেখে গেছে বলে মনে হত না। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম।
মোহিনীমোহন ভট্টাচার্য ছিলেন, মেধাবী, আইনজ্ঞ, বিদ্বান, কিন্তু দুঃখের বিষয় মেয়েদের দিকে পাশ ফিরে গড়গড় করে ল্যাণ্ডর পড়িয়ে যেতেন বলে, আমাকে একটুও প্রভাবিত করেননি। আরো অনেকে ছিলেন, প্রত্যেকে পণ্ডিত মানুষ, কর্তব্যপরায়ণ, কিন্তু কেউ আমার মনে আলো জ্বালাননি, সেটা নিশ্চয় আমারি অনবধানতার জন্য। প্রিয়রঞ্জন সেন, কুমুদবন্ধু রায়, সুহাসচন্দ্র রায়, পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু এঁদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার পথ আমার যে বড়ই উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল তাতে সন্দেহ নেই। আরেকজন ছিলেন, তাঁর পুরো নামটি নিয়ে গোলমাল লাগছে, বোধ হয় কে-সি মুখার্জি, শৌখিন, অমায়িক, বিদগ্ধ, অক্সফর্ড কিম্বা কেমব্রিজে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিতও ছিলেন, তাঁকে আমার ভালো লাগত।
সে-সময়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে ছাত্ররা ভারি শ্রদ্ধার চোখে দেখত। দুঃখের বিষয় তাঁর কাছে পড়বার সুযোগ পাইনি, কারণ তিনি ছিলেন বি-গ্রুপের মাস্টারমশাই। যে-দুজন অধ্যাপককে আজ-ও মাঝে মাঝে দেখি, তাঁরা হলেন শ্রদ্ধেয় অমিয়কুমার সেন আর শ্রদ্ধেয় রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যাঁর স্নেহ লাভ করে, এ-বয়সেও আমি কৃতার্থ। তবে সত্যের খাতিরে বলতে বাধ্য হচ্ছি এঁরা কেউ আমাদের দিকে ফিরেও দেখতেন না; আমরা আছি কি নেই সে বিষয়ে চৈতন্য ছিল কি না টের পেতাম না। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভাষায় অমন পাণ্ডিত্য আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি। তার ওপর ছিল রসবোধ, সেকালের অধ্যাপকদের মন থেকে যে জিনিসটি উপচে পড়ত, কিন্তু এখন খুঁজে দেখতে হয়। একদা আমার বড়দা সুকুমার রায়ের মণ্ডে ক্লাবের সদস্য ছিলেন সুনীতিকুমার। তাঁর পি-আর-এস্ লাভ উপলক্ষ্যে তাঁর ঘাড় ভেঙে অন্য সদস্যরা ১৭১/২ টাকার ভোজ খেয়েছিল, অন্য সূত্রে সে-কথাও জানতাম।
যতদূর মনে হচ্ছে তখন ভারতীয় ভাষা বিভাগে শ্রদ্ধাভাজন শ্রীবিশ্বপতি চৌধুরী অধ্যাপনা করতেন। আমাদের প্রিয় বন্ধু নীহাররঞ্জন রায়ের বৈদগ্ধ্য তখনি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। খুবই কম বয়সে পি-আর-এস্ হয়ে, ফাইন-আর্টস বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সারা জীবন তাঁর বঙ্গ-সাহিত্যের দিকে, বিশেষ করে রবীন্দ্র-সাহিত্যের দিকে মন ছিল। আমার চাইতে খুব বেশি বড় নন, বড় জোর বছর চারেকের, কিন্তু সে সময়ে দুজনার মধ্যে তাঁর জ্ঞানের গরিমার জন্য আকাশ-পাতাল ব্যবধান ছিল। আমার সাহিত্য জীবন অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে, মাঝে মাঝে অনেক দিনের নীরবতা রেখে, অগ্রসর হয়েছিল। আমি যখন পায়ের নিচে মাটি খুঁজছি, তখন আমার সম-বয়সীরা, বুদ্ধদেব বসু, আশাপূর্ণা দেবী, অজিত দত্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি যশস্বী লেখক বলে সকলের কাছে পরিচিত। তবে ছোটদের জন্য লেখার কথা অন্য এক জিনিস। নীহারদাকে আমার ষোল বছর বয়স থেকেই চিনতাম। উনি অমল হোমের আপন খুড়তুতো ভাই। ওঁদের আসল পদবী হোম রায়। অমল হোমরা রায়টা ছাড়লেন, নীহারদারা হোমটা ছাড়লেন। যতদূর মনে হয় নীহারদা সে সময়ে ইউনিভার্সিটি ত্রৈমাসিকের সম্পাদক ছিলেন। আশুতোষ বিল্ডিং-এর তিন তলায় রঙীন কাচের জানলা দেওয়া আশুতোষ হল্-এর উদ্বোধন হল। আমি সেখানে এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং-এর সনেট্স্ ফ্রম দি পর্টুগীজ সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। নীহারদা পাণ্ডুলিপিটি সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ত্রৈমাসিকে ছেপে দিলেন। সমালোচনার জগতে এই আমার প্রথম পদক্ষেপ; ইংরিজি কাব্য প্রসঙ্গ, ইংরিজিতে রচনা। বাংলা সমালোচনায় নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে আমার এতটুকু আস্থা ছিল না, কিন্তু কিছু পড়লেই মনের মধ্যে কতকগুলো জিজ্ঞাসা সর্বদা ভিড় করে আসত। ঐ জিজ্ঞাসাই হল সমালোচকের প্রধান উপজীব্য এ-কথা পরে বুঝেছিলাম। অপরের চিন্তারাজ্যে পথ চিনে হাঁটা; নিজের চিন্তারাশির তার ওপর আরোপ করা নয়। অন্যের লেখার ভালো-মন্দ বিচার করা নয়, বলিষ্ঠতা দুর্বলতা প্রকাশ করা। যে পড়বে সে বিচার করুক। এ-কাজ বড় সহজ নয়; এক সঙ্গে নির্মমভাবে অন্যের চিন্তা-রাজ্যে দৃষ্টিপাত করা, এবং হৃদয়ের সমস্ত সহানুভূতি দিয়ে তার যুক্তি অনুধাবন করা। অবশ্য তার মানে নয় যে যুক্তি গ্রহণ করতে হয়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর কোমল সমবেদনা না থাকলে, সমালোচনায় হাত না দিলেই ভালো। আমি কে যে আমার উপলব্ধি আরেক জনের ওপর চাপাব? শুধু সমালোচনা লিখে সাহিত্যিক হতে ১০০জনের মধ্যে একজন হয়তো পারে। শুধু অপরের দোষ গুণ বলে দিয়ে তো আর সাহিত্যিক হওয়া যায় না, নিজেকে কিছু দিতে হয়। মৌলিক লেখা ছাড়া অন্য কিছুকে আমি সাহিত্যের আসরে আসন দিই না। সমালোচনা লিখি মাঝেমাঝে, কিন্তু ভয়ে ভয়ে, সেই ইংরিজি কবিতা মনে রেখে
“ট্রেড সফ্ট্লি, ফর ইউ ট্রেড্ আপন মাই ড্রীমস!” আস্তে পা ফেল, কারণ আমার স্বপ্নের ওপর পা ফেলেছ। সে যাই হক একটি বয়ঃপ্রাপ্তদের পত্রিকায় আমার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ‘ফরওয়ার্ড’ বলে একটি ইংরিজি সাপ্তাহিক, তার সম্পাদক কে মনে নেই, যে-কোনো বিষয়ে একটি প্রবন্ধ চেয়ে বসল। আমি আধুনিক ছেলেমেয়েদের মনোভাব সম্বন্ধে ছোট-খাটো একটি প্রবন্ধ লিখে দিলাম। ইংরিজিতে। পাঠকদের সেটি ভালো লেগেছিল। কিন্তু আমার এতটা ভালো লাগেনি যে যত্ন করে তুলে রাখব। বয়স্ক পাঠকদের জন্য বাংলায় লিখবার সৎ-সাহস আমার ছিল না, অথচ বক্তব্য যথেষ্ট ছিল। আমি আমাদের পূর্ববর্তীদের রক্ষণশীলতা সম্পর্কে ক্রমে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম। তবে আমার চিন্তাগুলো যে বড় কাঁচা তাও জানতাম।
ছোটদের জন্য গল্প লেখায় নিজেকে ছেড়ে দিতে পারতাম। সবগুলি গল্প যে খুব ভালো হত তাও নয়। তবু মনে হত আমার মনের মধ্যে থেকে কেউ আমাকে লিখতে বাধ্য করে। গল্পগুলো তৈরি করে আমার কলমের আগায় এনে উপস্থিত করে। রাফ্ খাতা থাকত না; ভুল-ভাল শুধরে একটা সংশোধিত সংস্করণ নেই; মনে মনে টৈটম্বুর হয়ে না উঠলে, কলম সরে না। লেখা হয়ে গেলে একবার বানান ব্যাকরণ দেখে দেওয়া। আর কিছু নয়। তবে মাঝেমাঝে খানিকটা লেখা হলে আমার ঐ ভেতরকার মানুষটা আমাকে ত্যাগ করে, তখন লেখা ছিঁড়ে ফেলতে হয়। মাঝেমাঝে সে আমাকে ভুলে যায়; তখন আমি কিছু লিখতে পারি না। যদি পেড়াপিড়ির পাত্রী হয়ে জোর করে লিখি, সে লেখা উৎরোয় না। ইঁট কাঠ খড় দিয়ে আমি গল্পটা তৈরি করতে পারি না। মোট কথা ‘সন্দেশে’ ২-১ মাস পর পর একটি করে গল্প লিখি। তার জন্য একটি করে চাইনিজ্ ইংক দিয়ে ছবিও এঁকে দিই। একবার সন্দেশের সম্পাদক আমার মণিদা, (অর্থাৎ সুবিনয় রায়) ধরলেন, “জল রঙ দিয়ে ফুল-পেজ একটা ছবি এঁকে দাও, তাকে দিয়েই গল্প হবে।” জল-রঙ-এর কাজ ভালো করে শিখিনি। সেই যে আমার স্কুল-জীবনে পরেশ গুপ্ত বলে একজন ছবি আঁকার মাস্টারমশাই ছোট জ্যাঠা ঠিক করে দিয়েছিলেন, তিনি আমাকে যত্ন করে ক্রেয়নের কাজ আর তেল-রঙের কাজ শিখিয়েছিলেন। তা ছাড়া আমার বড়দিকে তাঁদের কটকের বাড়িতে বসে তেল-রঙে অপূর্ব সব সমুদ্রের দৃশ্য আঁকতে দেখেছিলাম। নিজেও কিছু কিছু এঁকে একে ওকে দিয়েছিলাম। কিন্তু জল-রঙ সামান্যই জানতাম। তবে শখ ছিল। শখ মানুষকে যতদূর নিয়ে যায়, তেমন আর কিছুতে নয়। দিলাম একটা পুকুরের দৃশ্য এঁকে। পুকুরে মাছ-মায়ের পাশে মাছ-মেয়ে বিকট মেছো ভেংচি কাটছে। অবিশ্যি এ-সব করবার সঙ্গে সঙ্গেই জানতাম, এ আমার কাজ নয়। ঐ লেখাটুকু আমার আসল কাজ। গোটা দশেক সচিত্র গল্প সন্দেশে ছাপা হবার পর, “সন্দেশ” বন্ধ হয়ে গেল। আমার গল্প লেখায় ছেদ পড়ল। কিন্তু তখন আর থামবার কথা ওঠে না। রামধনুতে, মৌচাকে, মাঝে-মাঝেই গল্প বেরুত। একটা বিষয়ে সচেতন ছিলাম, আমার লেখা ছোটদের গল্প যদি সম্পাদক গ্রহণ না করেন, তাহলে দুঃখে আমার বুক ফেটে যাবে। তাই জীবনে কখনো নিজের থেকে কোনো সম্পাদককে লেখা পাঠাইনি। সম্পাদক চেয়েছেন, তবে দিয়েছি। ফেরৎ দেননি কেউ। শুধু অনেক পরে বুদ্ধদেব বসুর আমার একটি গল্প পছন্দ হয়নি। তার বদলে ‘বৈশাখীর’ জন্য আরেকটি চেয়ে নিয়েছিলেন। অপছন্দের গল্পটি বিশ্বভারতী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তার নাম ‘সবুজ যার চোখ’।
এই সময় শ্রীযুক্তা রাধারাণী দেবীকে প্রথম দেখলাম। তাঁর লেখা কবিতা অনেক দিন থেকেই পড়তাম। প্রেসিডেন্সি কলেজে এক সাহিত্য-সভা হয়েছিল, কে উদ্যোক্তা কি উপলক্ষ্য কিছুই মনে নেই। বক্তা শ্ৰীমতী রাধারাণী দেবী। তখনো তাঁর কবি নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে বিবাহ হয়নি। শুনেছিলাম বাল-বিধবা। প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন মেয়েরা পড়ত না, তাই আসর জমাবার জন্য ইউনিভার্সিটির ছাত্রীরা নিমন্ত্রিত হল। শ্রীমতী রাধারাণী দেবী রবীন্দ্রসাহিত্য সম্বন্ধে বলেছিলেন। মনে আছে যে ভালো লেগেছিল, কিন্তু বক্তব্যের বেশি কিছু মনে করতে পারছি না, তবে এটুকু মনে আছে তিনি বলেছিলেন ঘরে-বাইরের একেকটি চরিত্র একেকটি প্রতীক। শুনে মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সব চরিত্রই একেকটি বিশেষ চিন্তাধারার প্রতীক। এখনো ভাবি সত্যিই তাই, ওরা কেউ রক্ত-মাংস দিয়ে তৈরি আস্ত আস্ত মাটির মানুষ নয়। ওদের স্থান সাধারণত্বের খানিকটা ওপরে। মনটা রাধারাণী-বৌদির কথায় সায় দিয়েছিল। পরে তাঁকে আরো কাছে থেকে অনেকবার দেখেছি। প্রথম দিনের ঐ কথাগুলি যতখানি মনে ধরেছিল তেমন আর কোনো কথা নয়।
সে সময় কলেজের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে মোট ২০জন মেয়েও পড়ত কি না সন্দেহ। তাদের মধ্যে দেশকর্মী কল্যাণী দাশ ছিল। এমন নির্মল দৃঢ় চরিত্র, এমন আদর্শবাদী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। পরবর্তী কালে এর ছোট বোন বীণা দাশেরও লাট সাহেবকে হত্যা করার চেষ্টার জন্য বহু দিন কারাবাস দণ্ড হয়েছিল। কল্যাণীও দীর্ঘকাল জেলে থেকে অশেষ অপমান আর লাঞ্ছনা ভোগ করেছিল। এদের আজকালকার সাধারণ লোকরা ভুলেই গেছে। এক দিকে নির্মম দেশকর্মী, অন্য দিকে কি কোমল স্বভাব, মানুষের দুঃখে ওদের চোখে জল আসত। গান্ধীজি যেদিন অনশন করতেন, ওরাও সেদিন জল স্পর্শ করত না। পরিবারটাই ছিল অন্য রকম। আদর্শবাদী। কটকে ওদের বাবা বেণী মাধব দাশের ছাত্র ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এবং গুরুর কাছেই স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। কল্যাণী দর্শন শাস্ত্রে এম-এ পড়ত। আমার কৈশোরের বন্ধু মীরা দত্ত গুপ্তা পড়ত গণিতে। মেয়েদের আলাদা একটা কমন্রুম ছিল, দোতলার দালানের এক মাথা পার্টিশন দিয়ে আলাদা করে বসবার ঘরটি হয়েছিল। মধ্যিখানে একটা বড় টেবিল, তার চারদিকে অনেকগুলি কাঠের চেয়ার। মেয়েদের ব্যবহারের জন্য আলাদা একটা বাথরুম্-ও ছিল। কিন্তু সেটি কমনরুমের সংলগ্ন না হয়ে, তিনতলায় অবস্থিত ছিল। তার দরজায় তালা দেওয়া থাকত। দরোয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলতে হত। তবে সে তালা-চাবি অভেদ্য ছিল না। ঘরের দেওয়ালে মাঝে মাঝে পেনসিল দিয়ে অশ্লীল মন্তব্য লেখা আর ছবি আঁকা থাকত। এখানে সব ভদ্রঘরের শিক্ষিত যুবকরা পড়ত, তবু কি করে সেটা সম্ভব হত জানি না। আগেও বলেছি যে-মেয়েরা উচ্চ-শিক্ষা গ্রহণ করত, তখনো আমাদের দেশের লোকদের বেশির ভাগ তাদের শ্রদ্ধা করতে শেখেনি। আমরা আমাদের আত্মসম্মান রক্ষা-কবচের মতো হাতের মুঠোর মধ্যে করে নিয়ে বেড়াতাম। মাঝে মাঝে ছেলেরা ব্ল্যাক-বোর্ডে আমাদের নামেও কবিতা লিখে রাখত। আমার নামেও বার দুই লিখেছিল। কিন্তু সেগুলো খোশামোদ-প্যাটার্নের হওয়াতে, যতটা চটতে পারতাম, ততটা চটিনি। একদিন কমনরুমে ঢুকে দেখি আবহাওয়া কেমন থমথমে।
টেবিলের ওপর ‘ভোট-রঙ্গ’ বলে গোলাপী একটা দৈনিক পড়ে আছে। আমরা ‘ভোট-রঙ্গ’ পড়তাম না, এর আগে কখনো হাতেও পাইনি। ভোটরঙ্গ ঘিরে হাঁড়ি-মুখ করে ৬-৭জন মেয়ে বসে আছে। কি ব্যাপার? না, খুলে পড়েই দেখ না। ভোটরঙ্গে একটা লম্বা কবিতা। কোনো ছাত্রীকে নাকি বৃষ্টি পড়ার সময় লেকের ধারে একজন ছাত্রের সঙ্গে এক বর্ষাতি গায়ে দিতে দেখা গিয়েছিল। এই হল ব্যাপার। কবিতার শিরোনামায় অপরাধী যুগলের নামের ইঙ্গিত রয়েছে। উত্তেজিত ভাবে ছাত্রীরা বলতে লাগল, এতে সমস্ত ছাত্রীদের নিন্দা হয়। এ-রকম হতে দেওয়া উচিত নয়। ওকে এক-ঘরে করা হবে। ওকে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হক। আমরা ওকে একশো বার বলেছি ঐ রিসার্চ স্টুডেন্টের সঙ্গে অত কি ভাব! ইত্যাদি। শুনে আমি অবাক হলাম, “তোমরা একথা জানতে নাকি?”
“নিশ্চয় জানতাম, রোজ রোজ ওর সঙ্গে বেড়াতে যায়। সে ভালো ছাত্র হলে কি হবে, এ কি রকম জঘন্য ব্যবহার!”
“জানতে তো এর আগে ওকে একঘরে করনি কেন? মোট কথা আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। কোথায় সে?”
“কোথায় আবার? দালানে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে, এখানে মুখ দেখাতে লজ্জা করছে।” সেই মেয়েকে খুঁজে নিয়ে তার ক্লাসের দোর-গোড়া অবধি পৌঁছে দিয়েছিলাম। ব্যাপারটা বেশি দূর গড়ায়নি, ছাত্রীরা ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। পরে ঐ মেয়ের সঙ্গে ঐ রিসার্চ স্টুডেন্টের বিয়ে হয়েছিল। ভোটরঙ্গের ঘটকালিতে বিয়েটা একটু আগেই হল, নইলে ওদের ইচ্ছা ছিল পাত্র ডক্টরেট নিয়ে চাকরি পেয়ে তবে বিয়ে করবে। বড় কষ্টে কিছুদিন কাটাতে হয়েছিল, আশা করি পরে সুখী হয়েছিল।
আমিও এই ব্যাপার থেকে শিক্ষিত নর-নারীর মন সম্বন্ধে আমার প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম। নিজেদের দুর্বলতা বিষয়ে যত ক্ষমাশীল, অন্যের ভুল-চুক বিষয়ে ঠিক ততটা সচেতন। এর মধ্যে খানিকটা আত্মপ্রসাদের সঙ্গে অনেকখানি নিষ্ঠুরতা থাকে। লোকে পাপ বলতে ভাবে নারী-পুরুষ সংঘটিত কিছু, কিন্তু আসলে নিষ্ঠুরতা হল সব চাইতে জঘন্য পাপ।
পুজোর সময়ে মীরাদের সঙ্গে এই প্রথম দারজিলিং গেলাম। শিলং ছাড়বার পর এই প্রথম পাহাড় দেখা। মীরার জ্যাঠামশাই এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বাবার সহপাঠী ছিলেন। নইলে একটা অচেনা হিন্দু পরিবারের সঙ্গে কোথাও একা যাবার অনুমোদন পাওয়া যেত না। বড় ভালো এই পরিবার। শিক্ষিত, উদার, কিন্তু সেকালের নিয়মে ওদের ঘরকন্না চলত। ওদের সঙ্গে কদিন থেকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আর পাহাড়? এমন মহান পাহাড় আমি ভাবতে পারিনি। হিমালয়ের মতো আছে কি?
শিলং-এ যে হিমালয় দেখেছিলাম, কোনো কোনো বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে, পরিষ্কার দিনে, সে হিমালয় দেখে মনে হত বুঝি আকাশের পটে তুলি দিয়ে আঁকা, বাস্তব নয়। আর এই হিমালয়ও বাস্তব নয়, বাস্তব জিনিস এমন মহান মহিমাময় হয় না। কেবলি আমার দাদামশায়ের কথা মনে হত। তিনি হিমালয়ের তীর্থে তীর্থে শেষ জীবনটা কাটিয়েছিলেন। বাস্তব ছিল বটে আমার হৃদয়ের শিলং পাহাড়। এর মধ্যে দুর্গাপুজো এসে গেল। বাজারের ওপরে সুন্দর ঠাকুর গড়ে, ঘটা করে পুজো হল। বিকেলে দেখতে গেলাম। পথে ‘মহারাণী স্কুলের’ ২-৩ জন ব্রাহ্ম শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা, তারাও আমার সঙ্গে গিয়ে ঠাকুর দেখে এল। পরদিন স্কুলের অধ্যক্ষা, শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে হেমলতা সরকার ওদের বকলেন, “ব্রাহ্ম হয়ে মূর্তি পুজো দেখতে গেলে?” ওরা আর কিছু ভেবে না পেয়ে বলল, “লীলাও গেছিল।” হেম মাসিমা বলেছিলেন, “ওর কথা আলাদা। ওর দাদামশাই একবার ব্রাহ্ম হয়েওআবার হিন্দু হয়েছিলেন।” শুনে আমি অবাক! আবার মনে হয়েছিল যে যারা উপনিষদের মন্ত্র পড়ে উপাসনা করে, তারা আবার অ-হিন্দু কিসে? তবে মূর্তি পুজোয় আমারো মন সায় দেয় না; তাই বলে তাকে নিরাকার পুজোর থেকে ছোট বলে দেখি না। সেদিন ওদের এত কথা বলিনি। কলকাতায় ফিরে এসে দিদিকে বলেছিলাম, “আমি যখন বিয়ে করব, একজন হিন্দুকে বিয়ে করব।” দিদি বলেছিল, “সে আমি সর্বদাই জানি।”
তারপর পড়াশুনোয় ডুবে গেছিলাম। বড় অশান্তির সময় ছিল সেটা, ১৯৩০, আইন-অমান্য আন্দোলনের বছর। হিংসাত্মক কার্য-কলাপ। অত্যাচার। সন্ত্রাস। নির্দোষ লোকদের গ্রেপ্তার। গুলি চালানো। এমন কি কলেজ স্ট্রীটের দোকান থেকে ‘রোম্যান্টি রেভলুশ্যন ইন্ দি নাইনটিনথ্ সেঞ্চুরি’ বইটিকেও দোকানের মালিকের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী পাঠ্য বিক্রির দায়ে ধরে নিয়ে গেল। বন্ধু-বান্ধব অনেকে জেলে গেল। বিলিতী জিনিসের ব্যবহার প্রায় উঠে গেল। বই ছাড়া আমরা কোনো বিলিতি জিনিস কিনতাম না। বিলিতী? জ্ঞান কখনো কোনো দেশের সম্পত্তি হয়?
আমাদের পরীক্ষা পেছিয়ে গেল। মে-জুনে না হয়ে হল নভেম্বরে। আমি পরীক্ষা দিয়েই হেম-মাসিমাকে চিঠি লিখলাম আমাকে কিছুদিনের জন্য শিক্ষিকার পদ দিতে। হেম-মাসিমা শক্ড্। এ ছোট কাজ কি তোমার ভালো লাগবে? কি করে বোঝাই যে আমার জীবনে এমন একটা সময় এসেছে যখন আমার একান্তভাবে একা থাকা দরকার। আমাদের বাড়িতে সবাই সবাইকে এত ভালোবাসত যে কারো পক্ষে একা থাকা অসম্ভব ছিল। সেই জীবনযাত্রা তার নিরাপত্তা আর স্নেহ দিয়ে আমাদের ‘আমিত্ব’কে পঙ্গু করে দিত। তার ওপর বাবার সঙ্গে আমার কিছুতেই মতের মিল হত না।
গেলাম চলে দারজিলিং-এ, ১৯৩১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি। আমার তখন ২৩ বছর বয়স। দিদির ২৪। আমাদের বাড়ির অভিভাবকরা ঠিক-করা বিয়েতে বিশ্বাস করতেন না আর বাইরের পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশাও পছন্দ করতেন না। অনেকে বলতে লাগলেন আমাদের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে।
যাবার কয়েক দিন আগে পরীক্ষার ফল বেরোল। একজন ফিরিঙ্গি মেয়ে আর আমি একসঙ্গে প্রথম হয়েছি। এইখানেই আমার ছাত্র-জীবনের শেষ। কোনো উচ্চতর উপাধির জন্য চেষ্টাও করিনি। ছাত্র-জীবনের শেষ আর সংসারের প্রতিদিনকার বিদ্যালয়ের শিক্ষা-জীবনের শুরু। তার পাট চলেছে আজ পর্যন্ত।
এরপর আমার কর্ম-জীবন। সে আরেক কাহিনী।
॥ ৩২ ॥
২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ সালের সন্ধ্যায় দার্জিলিং মেলে রওনা হলাম। তার আগের দিন ২৩ বছর পূর্ণ হয়েছে, বাড়িতে রাতে কিছু খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল ফুলকপি দিয়ে ঘি-ভাত, মাংস, টোমাটোর চাট্নি, পায়েস। অন্যান্য বছরের মতো গণেশদা, বাপি, বড় জ্যাঠামশায়ের বড় নাতি নরেশ, বুলুদি, বুলাদা ইত্যাদি এসে আমার জন্মদিনের ভাগ নিয়েছিল। সকলেই জানত একটা যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর কখনো এভাবে জন্মদিন করা হবে না হয়ওনি। ঐ আমার বাপের বাড়তে শেষ জন্মদিন।
তারো কয়েকদিন আগে এম-এ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছিল। আমি আর একজন ফিরিঙ্গি মেয়ে একসঙ্গে প্রথম হয়েছিলাম। সোনার মেডেল পেয়েছিলাম, অবশ্যি ১ বছর পরে। সবাই ভেবেছিল হয়তো গবেষণা করব, পি-আর-এস হব। আমি মনে মনে জানতাম ও-সব কিছুই হব না, কোনো উচ্চ পদও অলংকৃত করব না, জীবনে একটিমাত্র কাজ করব, সেটি হল সাহিত্য। কি ভাবে করব, কোথায় করব তার কিছু ভাবিনি। আগের বছর ভেবেছিলাম একটা স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে বিলেতে যাব, তা আমাকে ইন্টারভিউতেও ডাকেনি। ডাকলে আমাকেই দিতে হত, আমার চাইতে যোগ্য প্রার্থী ছিল না। ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম, কারণ অন্যায়টার প্রতিবাদ করতে পারলাম না, কিন্তু নিরাশ হইনি। আমার মনে অন্য চিন্তা।
আমার কিছুদিন একলা থেকে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করার দরকার ছিল। পরীক্ষার ফল বের হবার আগেই দার্জিলিং-এর মহারাণী স্কুলের অধ্যক্ষ, শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে, হেমলতা সরকারকে চিঠিতে লিখেছিলাম তাঁদের স্কুলে আমাকে ইংরিজি পড়াবার কাজ দেবেন কিনা। তাঁকে আমরা হেম-মাসিমা বলতাম, তাঁর মা-বাবা আমার ছোট মাসিকে মানুষ করেছিলেন। তাই একটু আত্মীয়তার দাবি ছিল। হেম-মাসিমা খোলাখুলি লিখলেন, এসো, কিন্তু বলে রাখছি সোনার করাতকে এখানে কাঠ কাটবার কাজে লাগাবো। একশো টাকা মাইনে পাবে। তার বেশি একমাত্র মিস বোস পান। ভাবলাম একশো টাকা তো অনেক টাকা। আসলে আমার নিজের পরিবেশের বাইরে অনাত্মীয়দের মধ্যে কিছুকাল কাটানো দরকার। অবিশ্যি সে কথা বাইরে বা বাড়িতে কোথাও প্রকাশ করিনি।
বলাবাহুল্য অক্ষত হৃদয়ে আমার তেইশ বছর বয়স হয়নি। সেকালের অনেকের মতে ২৩-এ মেয়েদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়। আমাদের পরিবারের সবই আলাদা। মেয়েরা বড় বেয়াড়া, যাদের কম বয়সে ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা কেউ কেউ অবাধ্য ঘোড়ার মত পা ঠুকতে ঠুকতে, চোখের সাদা দেখাতে দেখাতে ছাদনা-তলায় গেছিল। এবং সক্কলে শ্বশুরবাড়িতে সুনাম কিনেছিল। মা কিন্তু বিয়ে-টিয়ের বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন না। কোনো সম্বন্ধ এলে এমনি ভাগিয়ে দিতেন, আমাদের জিজ্ঞাসাও করতেন না। কিন্তু আমার একজনকে ভালো লাগত। এবং আমাদের বাড়ির সকলেও তাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করে দিয়েছিল।
খুব যা-তা ছিল না সে, মাথায় লম্বা, রং ফর্সা, দেখতে সুন্দর, স্বভাব কোমল, ব্যবহার মিষ্টি সুকুমার, কমনীয়, সাহিত্যানুরাগী সদ্বংশজাত, আমার চেয়ে দু বছরের বড়। আমি মনে মনে মুগ্ধ। একটুখানি মন জানাজানি, দুটি সলজ্জ কথা, পৃথিবীটাকে স্বর্গ মনে হয়েছিল। কিন্তু যতই দিন যায় ততই বুঝি সে বড় ছেলেমানুষ, বড় কোমল, আমার আরো কড়া ওষুধ দরকার। কিন্তু সে কি মায়া, তার মনে কষ্ট দিতে বুক কাঁপে। চলে না গিয়ে উপায় ছিল না।
স্টেশনে সবাই এসেছিল বিদায় জানাতে, হাসি গল্প, নানা রসিকতা। ট্রেন ছেড়ে দিল, আমি আমার পুরনো জীবন থেকে শেকড়গুলো উপড়ে নিলাম। নিজে বুঝিনি, কিন্তু আসলে তখনি আমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছিল। চারদিক থেকে কিসের একটা বেড়া খসে গেল, আমি মুক্তি পেলাম। সেকালের সেকেণ্ড ক্লাস কামরা, পাশাপাশি দুটি। একটিতে হেম-মাসিমা আর প্রবীণ চারজন দিদিমণি, অন্যটিতে তিন-চারজন অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের সঙ্গে আমি। আমাদের সঙ্গে বছর চোদ্দ বয়সের, মণিকা। আমার সুখলতাদিদির মেয়ে, তার পিসি বনলতা রাও ওখানে পড়াতেন, তাঁর হেপাজতে যাচ্ছে। শুনলাম স্কুলের বোর্ডিং নানা কারণে উঠে গেছে, তবে মণিকা তার পিসির কাছে থাকবে। ক্লাস্ নাইনে পড়বে। মণিকা অসাধারণ গুণী মেয়ে ছিল, গান বাজনায় জন্মগত প্রতিভা, চমৎকার পিয়ানো বাজাত, ঐ বয়সেই সুর রচনা করত। দুঃখের বিষয়, মাত্র সতেরো বছর বয়সে ওর মা বাবা ওর বিয়ে দেন, তার এক বছর পরে ওর মৃত্যু হয়। এই কোমলা ভীতু স্বভাবের মেয়েটি আমার ঘরে শুত। আমি বকাবকি করলে, কাঁদত। কাঁদলে আমার খুব খারাপ লাগত, তাই আরো খানিকটা বকতাম। ভালোও বাসতাম। আসলে আমার নিজের মনে অশান্তি ছিল।
পরদিন সকালে শিলিগুড়িতে নেমে আমরা ছোট ট্রেনে উঠলাম। উদগ্রীব হয়ে জানলা দিয়ে চেয়ে রইলাম। কখন দিগন্তে নীল নীল পাহাড় দেখা দেবে। আমি পাহাড়ের মেয়ে, পাহাড় বড় ভালোবাসি। শিলিগুড়ির পর অনেকখানি পথ পার হলে পর দূরে বিশাল বিশাল কালো ছায়ার মতো দেখলাম। তারপর ঘন বনের মধ্যে দিয়ে রেলগাড়ি আস্তে আস্তে উঠতে লাগল। যতই উঠি মন ততই হাল্কা হয়। দুপুরে যখন দার্জিলিং স্টেশনে নামলাম, বুঝলাম সমতলের দুশ্চিন্তা সমতলেই পড়ে আছে।
বাড়ির নাম অর্কিড লী, রেলের লাইনের ঠিক নিচে, ঢালের ওপর বাড়ি, পাহাড়ের গায়ে বড় বড় গাছ, তার ডালে ডালে অর্কিড ফুল। কার্ট রোড থেকে খাড়া পথ ধরে নেমে দেখি ফুল বাগানের সামনে লাল টিনের ছাদ দোতলা বাড়ি, ছাদের ওপর চিমনির ধোঁয়া বেরুবার টুপি পরানো নল। আমাদের সাড়া পেয়ে এক ঝাঁক নীল রঙের ছোট ছোট পাখি ছাদের তলা থেকে উড়ে বেরিয়ে এল। কে যেন বলল ওরা হল হাউস্ মার্টিন। বাগানে থোপা থোপা নীল ফর্গেট-মি-নট্ আর হলুদ প্রিম্রোজ ফুটেছিল, উত্তরের আকাশ জুড়ে রূপোলী কাঞ্চনজংঘা। নাকে এল কুয়াশার ধোঁয়াটে গন্ধ। ভাবলাম এখানে আমার সব দ্বন্দ্বের অবসান হবে।
বেজায় শীত, বাসিন্দারা সবে এসে পৌঁছেছে, ঘরকন্না গোছানো হয়নি। রান্না ঘরের উনুনে আঁচ দেওয়া ছিল বটে, কিন্তু এতগুলো মানুষের গরম জল করে দেওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিন, বড় ঠাণ্ডার সময়, শরীর মন জমে বরফ। খিচুড়ি আর ভাজাভুজি খেতে ভালোই লাগল। দোতলায় মস্ত উত্তুরে ঘরটিতে মণিকা আর আমি থাকব; সমস্ত উত্তর দিকটা জুড়ে বে-উইণ্ডো, গোল করে জানলা বসানো। বাইরে তাকালেই বরফের পাহাড়। জানলায় পাতলা গরম কাপড়ের পরদা, পুরনো হয়ে তার গরমত্ব চলে গেছে। কাঠের মেঝের ওপর গাল্চে নেই। একশো টাকা মাইনের দিদিমণির জন্য কে গাল্চে পেতে দেবে। ঐ ঘরে স্বচ্ছন্দে ২০টা খাট পড়তে পারত। বে-উইণ্ডোতে মস্ত আয়না দেওয়া পালিশজ্বলা সেগুন কাঠের ড্রেসিং টেবিল। মণিকার জন্য আরেকটি ছোট ড্রেসিং টেবিল। ঘরটির এক কোণে দুটি লড়ঝড়ে সস্তা লোহার খাট। বাকি ঘরটা ফাঁকা খাঁ-খাঁ করছে। আমাদের দুজনের জন্য দুটি আগাগোড়া পেতলের তৈরি সুন্দর খাট। তার লোহার স্প্রিং মচ্মচ্ করে কিন্তু সুঠাম পেতলের গড়ন এতটুকু টস্কায়নি। কে থাকত এ-ঘরে? কারা শুত এমন সুন্দর খাটে। এই লম্বাটে বিলিতী আয়নায় কে মুখ দেখত? আয়নার তুলাকার দেরাজ টেনে খুললাম। হলদে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজ পাতা, আর কিছু নেই। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। তার ওপর স্নানের জল যথেষ্ট গরম ছিল না। ঠাণ্ডা স্নানের ঘরে ঢুকে হঠাৎ মনে হল ও-ঘরে নিশ্চয় কারো ভালোবাসার মানুষ থাকত। জলের গামলাতে নীল ফুল আঁকা।
বাড়ির গিন্নি কমলা সেন, গোলগাল বেজায় ফর্সা মানুষটি, মাথা ভরা কালো কোঁকড়া চুল। বছরের পর বছর পাহাড়ে থেকে থেকে দু গালের মধ্যিখানটুকু আপেলের মতো লাল। সে এমনি পাকা রঙ যে শীতকালে তিনমাস কলকাতায় বাস করেও ঝরে যায় না। তখন মনে হয়েছিল প্রচুর বয়স, এখন ভাবি হয়তো চল্লিশের বেশি নয়। মেজাজ রুক্ষ। কোনোরকম উচ্ছলতা সইতে পারতেন না। খুব সুন্দরী হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু সব জমে বরফ হওয়া। পরে শুনেছিলাম তাঁর ভালোবাসার মানুষটি অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছিল বলে তিনি আর বিয়ে-থা করেননি। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। আমি তো আর সভ্যভব্য বাধ্য ছিলাম না। এক খাঁচা থেকে বেরিয়ে পাখি কি আর অন্য খাঁচায় ঢোকে?
সেই প্রথম দিনই খেতে বসে লীলা বোসের সঙ্গে ভালো করে আলাপ হল। বিখ্যাত অস্ত্র-চিকিৎসক ললিত ব্যানার্জির ভাগ্নী, আমাদের ডায়োসেসান কলেজ থেকে বি-এ বি-টি পাস করা, আমি তাঁকে অনেক দেখেছি। তবে তাঁর চেয়ে অনেক নিচের ক্লাসে পড়ি, তিনি আমাকে লক্ষ্য করেননি। রোগা ফর্সা মানুষটি ভালো কাপড়চোপড় পরা, নাকে চিমটি-কাটা চশমা, তার ফ্রেম নেই। মিস্ বোস বললেন, আমি আশা করে আছি, তুমি আমার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করবে। আমার আয়া রান্নাবান্নাও করে। সে তোমার বিছানাও করে দেবে, কাপড় কেচে দেবে। তুমি মাসে ৫০ টাকা দেবে। আমি রোজ মাংস খাই, সসেজ হ্যাম আনাই।
লীলা বোস থামতেই ফোঁশ করে একটা নিশ্বাসের শব্দ শুনলাম। কমলাদি বললেন, আমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলে আমরা খুশি হব। সাদাসিধে ব্যাপার, মাসে ২০ টাকা। সোমবার থেকে সাঁইলা রান্না করবে, সে আলুবাড়িতে মামার কাছে গেছে। ততদিন আমিই রাঁধার ভার নেব। রবিবারের জলখাবার পালা করে করা হয়। কাল থেকে মালী স্যালামাণ্ডারে স্নানের জল করবে। আজ বোধহয় কষ্ট হল। নিশ্বাস নেবার জন্য কমলাদি থামলেন। আমি ‘আলুবাড়ি’ আর ‘স্যালামাণ্ডার’ শুনে মুগ্ধ হয়ে বললাম, ‘সকলে যা খায়, আমিও তাই খাব।’
মিস্ বোস চুপ করে রইলেন।
বিকেলে হেম মাসিমা এসে কমলাদিকে বললেন, ‘সেই খিচুড়ি আর ভাজা খাওয়ালে ওদের? ওদের অন্য রকম অভ্যাস। আমি তো বাড়িতে মাংস করেছিলাম।’ আমাকে বললেন, ‘মণিকা তার পিসির কাছে থাকবে, কিন্তু আমার কাছে দুজন টিচার থাকে, তুমিও থাকতে পার। যথেষ্ট জায়গা আছে।’
কমলাদি আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি বললাম, ‘এখানে সকলের সঙ্গে আমার ভালোই লাগবে।’ হেম-মাসিমা বোধহয় খুসি হলেন। আশ্চর্য মানুষ ছিলেন উনি, হয়তো সেকালের বি-এ পাস, বি-টি পড়েননি। কালো রং, কর্মঠ শরীর, প্রফুল্ল চিত্ত; সকলের সঙ্গে মেলামেশা; ওঁদের ভাড়াবাড়ি নর্থভিউয়ের অবারিত দ্বার, যে আসত আদর পেত। দুঃখ কষ্ট কম পাননি; স্বামী শুনেছি পরম সুদর্শন এবং তার চেয়েও বেশি খামখেয়ালী ছিলেন। অপেক্ষাকৃত কম বয়সে মারা যান। হেম-মাসিমা তাঁর দুই ছেলে আর তিন মেয়েকে চমৎকার করে মানুষ করে ভালো ভালো বিয়ে দিয়েছিলেন। সহানুভূতিশীলা আর সুরসিকা ছিলেন। গোঁড়া ব্রাহ্ম। আনন্দমোহন বসুর বেয়ান, অমল হোমের আর হিরণকুমার সান্যালের শাশুড়ি।
সত্যি কথা বলতে কি মহারাণী স্কুলের শিক্ষিকাদের মধ্যে একটা উগ্র ব্রাহ্ম ভাব ছিল। হয়তো সেই জন্যেই বাবা পর্যন্ত আমার দার্জিলিং যাওয়া সমর্থন করেছিলেন। রবিবার সকালে সবাই দল বেঁধে ব্রাহ্ম-মন্দিরের উপাসনায় যেতেন। পিসির সঙ্গে মণিকাও যেত। আমিও প্রথম রবিবার ওদের সঙ্গে গেছিলাম। দ্বিতীয় রবিবার খোলাখুলি বললাম,আমি যাব না। কমলাদি শক্ড্।
‘ঐ সময়টা কি করবে?’ ‘হিমালয়ের ছবি আঁকব।’ কমলাদি বললেন, ‘বনলতা, চল আমরা যাই। উপাসনার পর একেবারে সপ্তাহের বাজার করে ফিরব।’
সারা সকাল আমার শোবার ঘরের জানালায় বসে কাঞ্চনজংঘার ছবি আঁকলাম। আর যাইনি মন্দিরে। সমবেত উপাসনায় আমার মন সায় দেয় না। এখনো দেয় না। বিকেলে হেম-মাসিমার বাড়ি গেলাম। ভাবলাম বকুনিটা খেয়েই আসি। হেম-মাসিমা বললেন, ‘তোমার দাদামশাই হিমালয় ভালবাসতেন। একরকম বলতে গেলে তাঁর জীবনের অর্ধেকের বেশি হিমালয়ের কোলে কেটেছিল।’
আমি বললাম, ‘আপনি তাঁকে দেখেছিলেন?’ হেম-মাসিমা অবাক হলেন, ‘বাঃ রে, দেখব না? আমার বাবার বন্ধু ছিলেন যে। পরে ব্রাহ্ম সমাজ ছেড়ে গেলেন, বাবা তাতে খুব দুঃখিত হয়েছিলেন।’ বলে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালেন। দাদামশায়ের কথা শুনলেই আমার মনটা অন্যরকম হয়ে যেত। ভাবতাম আমিও যদি আরো দশ বছর আগে জন্মাতাম, দাদামশাইকে দেখতে পেতাম।
হেম-মাসিমা বললেন, স্কুলে পড়িয়ে তোর কি হবে রে? তার চেয়ে ঘর-সংসার করা ঢের ভালো। যখন শুনি কালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, আমার বেজায় হাসি পায়। আমার মতো কালো কে? কিন্তু আমার স্বামীকে যদি দেখতিস, কি চমৎকার দেখতে ছিলেন। প্রথম দিন দেখেই ভেবেছিলাম এঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে বেশ হয়। হয়েছিলও তাই। ওরে, চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই। বলে হেম-মাসিমা হাসতে লাগলেন। ওঁর মতো মানুষ আমি আর দেখিনি। মতে না মিলতে পারে, কিন্তু মনের কি বলিষ্ঠতা আর আত্মপ্রত্যয়ের প্রসন্নতা। উইমেন্স লিব্ বলতে আমার এই আরেকজনের কথাও মনে পড়ে। সামাজিক ব্যাপারে যে রকম আগ্রহ, ভগবানেও তেমনি গভীর বিশ্বাস। এঁরাই হলেন ব্রাহ্মসমাজের উদার আদর্শের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। হাসিমুখে পুরুষের কাজ করে গিয়েছেন, নারীর কোনো গুণ খর্ব না করে।
হেম-মাসিমার বাড়ি ‘নর্থ ভিউ’ শুনেছিলাম বাস্তু-বিভাগের বাড়ি, নিচু ছাদ, ছোট ছোট জানলা—উত্তুরে হাওয়ার ভয়ে প্রায় সর্বদাই সেগুলোকে বন্ধ থাকতে দেখেছি, ঘরগুলো একটু অন্ধকার মতো, একটু স্যাঁতসেতে গন্ধ, কিন্তু বাইরের দেয়ালে ফুলগাছ বেয়ে উঠত, টবে চন্দ্রমল্লিকা গজাত, বাড়ির বাসিন্দারা হাসত গল্প করত। অবিশ্যি অতগুলো মেয়ে এক বাড়িতে থাকত, নিশ্চয় মান-অভিমান মন-কষাকষিও হত, তবে আমি কখনো দেখিনি।
‘অর্কিড লী’ ছিল ঠিক তার উল্টো, ওখানে প্রাণের স্পন্দন ছিল না। বাসিন্দারা কাজকর্ম করতেন, কিন্তু বেশি হাসি-গল্প শোনা যেত না। কমলাদি নিজে বাজার করে এনে কি চমৎকার রাঁধতেন; সাঁইলা এলে পরেও রান্নার মান নিচু হয়নি, কারণ সাঁইলা কমলাদির নিজের হাতে তৈরি। অবিশ্যি কুড়ি টাকায় আর কত ভালো খাবার হয়, তার মধ্যে থেকে সাঁইলার মাইনেও বাদ যেত। বাড়িতে খাবার টেবিলে আমাদের যত রাজ্যের রসের গল্প হত, এখানে কেউ বিশেষ কথাই বলত না। তার ওপর মিস্ বোস একদিন আমাকে বললেন, ‘সোনার মেডেল তো পেয়েছ শুনলাম, অ্যাটাভিজম্ মানে জান?’ আমি অ্যাটাভিজম্ মানে বলে বললাম, ‘আপনার বুঝি এসব জিনিসের খুব ইন্টারেস্ট? আমি ঐ রকম আরো অনেক কথা বলতে পারি।’ কমলাদি কটমট করে চেয়ে রইলেন, পরে আমাকে বললেন, ‘ওটা বলা উচিত হয়নি, হাজার হক বয়সের একটা সম্মান আছে তো?’ কিন্তু খুব অখুসি মনে হল না।
অর্কিড লী নাকি কোনো চা-বাগানের সাহেব তাঁর রুগ্না স্ত্রীর জন্য করেছিলেন। আমার ঐ বড় ঘরটি ছিল তার শোবার ঘর। স্ত্রী মারা যাবার পর সাহেব আর ওখানে টিকতে না পেরে, সব বেচেবুচে দিয়ে দেশে চলে গেলেন। বাড়ির নাম আর গাছে গাছে অর্কিড ফুল তাঁদের চিহ্নস্বরূপ পড়ে রইল। আর রইল শখ করে কেনা কিছু আসবাব। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করাই যদি আমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তার জন্য প্রচুর সময় পেয়েছিলাম। নিজের বিষয়ে একটা আবিষ্কারও করে ফেলেছিলাম। কারো প্রভুত্ব আমি সইতে পারি না। কেউ হুকুম দিলে আমি বিগড়ে যাই অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো দায়িত্বপূর্ণ কাজের আমি উপযুক্ত নই। কেবলি মনের সঙ্গে মনের মিল খুঁজি। সারা জীবন ধরে এর প্রমাণ পেয়েছি। এরমধ্যে অহংকারের কথা নেই। অপর পক্ষের যুক্তি যদি গ্রহণযোগ্য মনে হয়, সর্বদা মত বদলাতে প্রস্তুত থাকি। কিন্তু আর কেউ বলল বলে কোনো কিছু মেনে নিতে পারিনি। এইখানেই বাবার সঙ্গে আমার বিরোধের মূল।
এর মধ্যে মাসিমা চিঠি লিখলেন, ‘আমরা এপ্রিল মে দার্জিলিং-এ কাটাতে চাই। একটা মাঝারি গোছের ফ্ল্যাট ঠিক করে দাও।’ পাওয়াও গেল ফ্ল্যাট; অর্কিড লী’র সামনেই কার্ট রোডের ওপারে, পাহাড়ের ওপরের তিনতলা বাড়ির দোতলাটি, নাম উড্ল্যাণ্ডস। ভাঙা বাড়ি বারান্দার তক্তা ঝুলে পড়েছে, মস্ত মস্ত ঘর, পুরনো আসবাব, মেঝের ওপর ম্যাটিং। তাতে লক্ষ লক্ষ পিসু বাস করলেও ঘর বেশ গরম থাকে। বাগানের বালাই নেই, একতলার মাঠেও যা ছিল সব শুকিয়ে খড়। কিন্তু যে দিকে তাকানো যায় ঘন নীল আকাশে হিমালয়ের ছবি আঁকা। আরো ওপরে উঠলে দেখা যায় গোল দিগন্তের তিন ভাগ জুড়ে বরফের পাহাড়। জলাপাহাড়ের একেবারে চুড়ো থেকে মনে হয় বালার মতো গোল হয়ে এসেছে হিমালয়, মুখটি একটু খোলা। পৃথিবী যে গোলাকার তার আর কোনো প্রমাণ বাকি থাকে না। পাহাড়ের গায়ে লম্বা লম্বা ঝাউ গাছ। নীল আকাশে বাজপাখি ওড়ে। বাগান-এর কিবা দরকার।
কমলাদি, বনলতা, মীরা সরকার বলে আমার চেয়ে অল্প বড় একজন শিক্ষিকা, এদের সকলের বাড়ি-খোঁজার ব্যাপারে ভারি আগ্রহ। ছোট্ট মানুষটি বনলতা; আমি মাথায় ৫ ফুট, আমার চেয়েও খানিকটা বেঁটে। মাথা ভরা ঢেউ খেলানো চুল, কাটাকাটা নাক-মুখ, কথায় কথায় মুখ রাঙ্গা হয়ে ওঠে, বড়দের কথা মাথা নিচু করে মেনে নেয়, নাম রাখলাম ‘খুদি’। খুদিকে আমি ক্রমে কমলাদির কাছ থেকে ভাগিয়ে এনে, ঝোড়ো সন্ধ্যায় আমার ঘরের আড্ডায় ঢুকিয়ে দিলাম। আমার চেয়ে বয়সে বড়, কিন্তু কি কোমল কি মিষ্টি। মীরা সরকারকেও আগে দেখেছিলাম। ডায়োসেসানে বি-টি পড়ত। আমি তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। আমার এতটুকু কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারলে ব্যাকুল হয়ে উঠত, কি করবে ভেবে পেত না। আর ছিল মণিকা, সে ভালোমানুষ হলেও এটা জানত যে নীরব শ্রোতা হয়ে থাকলে কেউ বলবে না—‘অ্যাঁ! তুমি বড়দের কথা শুনছ?’ কমলাদি নেই, মীরা নেই, মণিকা নেই, খুদিও বোধ হয় নেই। জলে আঁকা ছবি সব। আমার মনের মণিকোঠায় জমা। এ লেখা অমৃতে ছাপা হলে পর খুদি চিঠি লিখেছে সে আছে! বড্ড ভালো লাগল।
মাসিমারা বুদ্ধি করে রাঁধবার লোক নিয়ে এসেছিলেন। দু মাসের মতো উড্ল্যাণ্ডস্-এ সংসার পাতলেন। আমাকে বললেন, ‘তুই এসে থাক। এখান থেকে স্কুল করিস।’ আমার তাতে মত ছিল না। আমার ওপর যাদের দাবি আছে, তাদের আমি ঝেড়ে ফেলে এসেছি। তবে ওঁদের সঙ্গে কত যে শনি-রবি আনন্দে কাটিয়েছি সে আর কি বলব। নোটনের তখন ২০ বছর বয়স। সর্বাঙ্গ থেকে সুষমা ঝরে পড়ছে। আই-এ পাস করে আর পড়েনি। নাকি শরীর দুর্বল। আমি অবিশ্যি দুর্বলতার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাইনি। চমৎকার পিয়ানো বাজায়, ভালো গায়, ভালো ছবি আঁকে, বাপের অবস্থা ভালো, ওর একমাত্র সন্তান। এন্তার বিয়ের সম্বন্ধ আসে।
মুশকিল হল কন্যের কাউকে পছন্দ হয় না। খালি বলে অমুক পাত্রের রূপ-গুণের সঙ্গে তমুক পাত্রের টাকাকড়ি থাকলে হত। অর্থাৎ পাত্ররা হিসাব-খাতায় স্থান পায়, মনের মাঝে পায় না। এক বছর আগে একজনের দিকে মনটা একটু ঝুঁকেছিল, রূপে গুণে ধনে মানে তার জুড়ি মেলা ভার। দুঃখের বিষয় পাত্রটি যবন। মেসোমশাই ব্যাপারটা আঁচ করে বলে বসলেন—‘ওকে বিয়ে করলে আমি তোমাকে ত্যাগ করব। সব সম্পত্তি ব্রাহ্ম সমাজকে দিয়ে যাব।’ ব্যাপার শুনে আমি রোমাঞ্চিত। এমন ঘটনা বইয়ের পাতার বাইরে দেখব ভাবিনি। নোটন আমার পরামর্শ চাইতে এল। আমি বললাম, এ আবার একটা সমস্যা নাকি! আমি যদি কাউকে ভালোবাসতাম এবং অন্য কোনো আপত্তির কারণ না থাকত, তাহলে কারো কথা শুনতাম না। কিন্তু নোটন মন ঠিক করতে পারেনি। সে পাত্র এক বছর অপেক্ষা করে অন্য মেয়ে বিয়ে করে আমাদের জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল। আর নোটন অন্য কারো গলায় মালা দিতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত আইবুড়োই থেকে গেল। ১৯৩১ সালে অবিশ্যি মেসোমশাই অপাত্র ভাগিয়ে প্রসন্ন মনে সুপাত্র দেখছিলেন। সুপাত্রদেরও নোটন একের পর এক সবাইকে ভাগাতে লাগল।
সঙ্গে এক গাদা বই এনেছিলেন মেসোমশাই। ব্রাউনিং-এর কবিতার বাংলা অনুবাদ করছিলেন, কাব্যে। আমাকে মাঝে মাঝে দুটো একটা পদ তর্জমা করতে বলে নিজে যেভাবে করেছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন। চোখ বুজে বসে থাকতেন, আমাকে বলতেন, তোমার ইচ্ছামতো ইংরিজি কবিতা পড়ে শোনাও। আমি শেলিকে বাদ দিতাম। ঐ সব ফিকে বেগুনি ফিকে নীল ছাই ছাই ধোঁয়া ধোঁয়া বর্ণনা আর ভালো লাগত না। বেন জনসন পড়তাম, লী হাণ্ট, শেক্সপিয়র। হঠাৎ চেয়ে দেখতাম আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন মেসোমশাই কিন্তু অন্য কিছু দেখছেন। বইখানি ওঁর হাতে দিয়ে বলতাম তুমি পড় আমি শুনি।
নিরাশ্রয়ের মতো দু-একবার বইয়ের দিকে তাকিয়ে হয়তো বলতেন, ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না কেন? চোখ দুটো এক্কেবারে গেছে। আমি মেসোমশায়ের নাক থেকে চশমা নামিয়ে আঁচল দিয়ে মুছে আবার নাকে বসিয়ে দিতাম। খুসি হয়ে বলতেন, হ্যাঁ এইবার ঠিক হয়েছে। নোটন একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হয়তো বলত আর কতক্ষণ পড়া হবে? মেসোমশাই যেন কোনো অচেনা বিঘ্নকারীকে বলতেন, যাও ব্যাঘাত কর না। আরো পরে আমাকে বলতেন, তুমি আমার মেয়ে হলে আমি সুখী হতাম। আমি হাসতাম। না মেসোমশাই, কারণ তুমি আমাকে যদি বলতে কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তি দেবে না, আমি তক্ষুণি গিয়ে তাকে বিয়ে করে ফেলতাম। পরে আমার জীবনের সমস্যার সময় মেসোমশাইয়ের সস্নেহ প্রশ্রয় পেয়েছিলাম।
একদিন একজন সাধু এসে মাসিমাদের ছোট বসবার ঘরে ঢুকে বললেন, আমি মন পড়ে দিতে পারি। বেটিরা দুজনে দুটি ফুলের ইংরিজি নাম মনে কর তো। নোটন ভাবল গোলাপ, রোজ, আমি ভাবলাম গন্ধরাজ গার্ডেনিয়া। সে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে বলল, তুমি ভেবেছ রোজ আর তুমি ভেবেছ গার্ডেনিয়া। মাসিমা ভারি প্রভাবিত হলেন। তাহলে এদের ভাগ্যেও কি আছে বলে যান। সাধু নোটনের দিকে ফিরে বললেন, তোমার ভাগ্যে আছে দীর্ঘ জীবন আর মেলা টাকা। আমাকে বললেন, টাকা যার কাছে ছাই, তুমি সেই জিনিস পাবে। নোটন আশ্চর্য হয়ে বলল, সে আবার কি জিনিস? সাধু বললেন, সে তুমি বুঝবে না। বলে চলে গেলেন। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, এক হপ্তা বাদে একটা চিঠি পাবে। এক মাস বাদে এখন যেমন আছ, সব বদলে ফেলবে। এই বলে চলে গেলেন। পরীদের গল্পের মতো।
রবীন্দ্রনাথ এই সময় দলবল নিয়ে দার্জিলিং-এ এসেছিলেন। ম্যাকিনটশ রোডে আশানটুলি এবং তার পাশেই আরেকটা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। দিনু ঠাকুর তাঁর স্ত্রী, এক ভাগ্নী, দুই ভাগ্নে সঙ্গে এলেন। তাছাড়া রথি ঠাকুর, প্রতিমা দেবী, প্রশান্ত মহলানবিশ, তাঁর স্ত্রী, নীলরতন সরকারের মেয়েরা এবং আরও অনেকে। দার্জিলিং-এর যত বাঙালী বিকেলে সব সেখানে ভেঙ্গে পড়ত। মেসোমশাই আমাকে নিয়ে গেলেন। নোটন বলল, আমি তো অনেকবার দেখেছি, অতটা হাঁটতে পারব না। এই প্রথম আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বললাম। দিনু ঠাকুরের ভাগ্নী পূর্ণিমা আমার বাল-বন্ধু। তার বাবা সুহৃদনাথ প্রমথনাথ চৌধুরীর ছোট ভাই। পূর্ণিমার ডাক নাম বুবু। পরে ওর সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ছেলে সুবীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়। সুবীর মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যায়, বুবু আজ পর্যন্ত আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন। ওর বড় ছেলে সুপ্রিয় শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের দক্ষ অধ্যক্ষ।
মেসোমশাইয়ের সঙ্গে আমাকে দেখে বুবু কি খুসি। অমনি আমি ওদের বাড়ির একজন হয়ে গেলাম। সন্ধ্যের পর সেদিন অর্কিড লীতে ফিরলাম। বুবুর দুই দাদা—তাদেরও ছোটবেলা থেকে চিনতাম—আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল। কমলাদি বললেন, তোমার মা-বাবা কি ওদের চেনেন?
মনে আছে একটুও খুসি হইনি, মনে হয়েছিল কমলাদি অনধিকার প্রবেশ করছেন। এখন ভাবি অধিকার আবার কি? আমার অনিষ্ট হলেই বা কমলাদির কি?
প্রায় রোজ গেছি আশানটুলিতে, রবীন্দ্রনাথকে দেখার সুযোগ ছাড়ি কি করে? কোনো দিন বুবু বলে চা খেয়ে যা। কখনো বলে কাল ছুটির দিনটা এখানে কাটাস। দিনু ঠাকুরের আলাদা মহল, সেখানে গিয়ে অতিথি হই আর সেই মোটা মানুষটিকে যত দেখি তত মুগ্ধ হই। গান তো রোজই গাইতেন, আগেও গেয়েছেন। আমার বন্ধু অলকার বিয়েতে একটা কৌচে বসে আশ্চর্য ভালো গাইলেন। উনি উঠে গেলে পর দেখা গেল কৌচের তলা ফুঁড়ে ম্প্রিংগুলো ঝুলছে। তা এখন সেকথা বলাতে দিনদা কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না। বললেন, মোটা হতে পারি, তবে সে রকম কিছু নই। বড় ভালো লাগত ওঁকে। তখন হয়তো বছর পঞ্চাশেক বয়স ছিল। পরে আরো ভালো করে চিনবার সুযোগ পেয়েছিলাম।
দেখতাম রবীন্দ্রনাথও ভারি আমুদে মানুষ। একদিন আমি গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, তোমার বন্ধু যে মাদরাজিতে আদ রাজি। নাকি এক দক্ষিণী আই সি এস ঠাকুর বাড়ির মেয়ে বিয়ে করতে চায়, না পেলে ঠাকুর বাড়ির দৌহিত্রীতেও রাজি। তা বুবু কিছুতেই মত দিচ্ছে না। আর সব ভালো হলেও রংটা যেন আবলুস। সে পাত্র অন্য ভালো মেয়ে বিয়ে করেছিল।
আরেক দিন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, একটি ছোট মেয়ে কিছুতেই উঠবে না। তার মা বললেন, ‘এই তো রবি ঠাকুর দেখা হল আবার বসে আছিস কেন?’ মেয়ে বলল, ‘চলতে দেখিনি।’ সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ উঠে একটু পাইচারি করে এসে বললেন, ‘এই তো চলতেও দেখলে, এবার তাহলে বাড়ি যাও।’
তারপর একদিন রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনলাম, পাহাড় আমার ভালো লাগে না। মনে হয়, চারদিক থেকে বুকের ওপর চেপে বসছে। শুনে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। দুদিন বাদে গিয়ে দেখি বাঁধা-ছাঁদা হচ্ছে, ওঁরা সদলবলে নেমে যাচ্ছেন। বাবামশায়ের আর ভালো লাগছে না। তারপর দিনই চলেও গেলেন সবাই। বিকেলে একবার ঐ দিকে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম সব শূন্য খাঁ-খাঁ করছে, চৌকিদার কয়েকটা রোদে দেওয়া গালচে তুলছে। আমার সঙ্গে খুদি আর মীরা গেছিল। সকলের সে কি দুঃখ। ফিরবার পথে মাসিমার বাড়ি গেলাম। ওঁদের ছুটির অর্ধেক ফুরিয়ে গেছে, মেসোমশাই অবিশ্যি অবসর নেওয়া মানুষ কিন্তু আলিপুরের নিউ রোডে ওঁদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে তার তদারক করা হল চাকরির বাড়া। আপিস থেকে যদি বা বলে কয়ে ছুটি বাড়ানো যায়, নিজে বড় কড়া মুনিব, তার কাছে কোনো ওজর চলে না।
সত্যি কথা বলতে কি অধ্যাপনা আমার ভালো লাগত না। এ সত্য আবিষ্কার করে নিজেই স্তম্ভিত। আমি কেবল তৈরি করতে চাই, নতুন কিছু বানাতে চাই। কতকগুলো অপোগণ্ড শিশুকে অন্যের লেখা বই থেকে অন্যের দ্বারা নির্দিষ্ট পাঠক্রম অভ্যাস করাতে গিয়ে আমার হাঁপ ধরত। উঁচু ক্লাসের অঙ্ক আর ইংরিজি পড়াতে বেজায় খারাপ লাগত। সারা সপ্তাহে মাত্র দুটি ক্লাস আমি উপভোগ করতাম : একটি হল ৬-৭ বছরের ছেলেমেয়েদের গল্প বলা আর একটি হল তাদের ছবি আঁকার ক্লাস। হয় বানিয়ে গল্প বলতাম, নয় তো রামায়ণ-মহাভারত থেকে মজার মজার ঘটনার কথা বলতাম। ছবি আঁকার ক্লাসে বলতাম বাগান থেকে যা খুসি দেখে এসো বা নিয়ে এসো তারপর সেটিকে আঁকো। এ দুটি ক্লাস ওরা বেশি উপভোগ করত, নাকি আমি করতাম জানি না। ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে বড্ড ভাল লাগত।
ভালো অধ্যাপিকা ছিলাম না বোধ হয়, তবে জনপ্রিয় হয়েছিলাম। মিস বোস গিয়ে হেম-মাসিমার কাছে নালিশ করেছিলেন যে আমি ডিসিপ্লিনের ধার ধারি না। বোকা মেয়েরা পড়া না বুঝলে তাদের পাশে বসে, তাদের পিঠে হাত রেখে, বুঝিয়ে দিই। কমলাদি গিয়ে নালিশ করলেন, আমার গল্প বলার আর ছবি-আঁকার ক্লাসে বড্ড হট্টগোল হয়। হেমমাসিমার কাছেই কথাটা শুনলাম। একটুও অসন্তোষ প্রকাশ করলেন না। আমিই বরং অসহিষ্ণু হয়ে বলতাম, ‘ঘণ্টা পড়লেও ওরা উঠতে চায় না।’ হেমমাসিমা একটু হাসলেন, সে-হাসির মানে বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হল না—‘অবিশ্যি ছাত্রদের খুসি করাই অধ্যাপনার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।’ আমি আবার মনে করি ঐ খুসি হওয়ার ওপর দিয়েই অনেক শিক্ষা পাচার করে দেওয়া যায়। সে যাক গে, ওখানে অধ্যাপনা করতে আমার ভালো লাগত না। পালাবার পথ খুঁজতাম। ইচ্ছা করে এসেছি, কাউকে কিছু বলারও জো ছিল না।
এমন সময় পথ পেয়ে গেলাম। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়েই আমাকে চিঠি লিখলেন : ‘আশা অধিকারী শিশু-বিভাগ পরিচালনা করেন, তিনি এক বছরের ছুটি নিচ্ছেন, তুমি এসে এক বছরের জন্য তাঁর জায়গা নাও।’ সাধুর বলার এক সপ্তাহ পরে চিঠিটা এল।
আর কথা নেই। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই লিখে দিলাম গরমের ছুটির পর থেকে শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দেব। রবীন্দ্রনাথ ডেকেছেন, সেই যথেষ্ট। এ-ও যে অধ্যাপনার কাজ মনেও হল না। মাসিমা মেসোমশাই শুনে খুব খুসি, মা হতাশ, বাবা রেগে চতুর্ভুজ! শান্তিনিকেতনের ওপর বাবা হাড়ে চটা ছিলেন। যত সব লম্বা-চুলো, চিবিয়ে-কথা বলা ন্যাকার দলের আবাস। তার ওপর এরকম কথায় কথায় মত বদলানোর কোনো মানে হয় না। এদিকে বিপরীত সমালোচনায় আমি হাতে-পায়ে বল পাই। হেমমাসিমার কাছে গিয়ে কথাটা বললাম। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, একটুও রুষ্ট হলেন না। বললেন, আমি তো বলেইছিলাম সোনার কুড়ুল দিয়ে কাঠ কাটা যায় না। এ-ও হতে পারে যে অসন্তোষজনক অধ্যাপিকা নিজের থেকে খসে পড়াতে পুনরায় শান্তি বিরাজ করবে ভেবে একটু প্রসন্নও হয়েছিলেন। মোট কথা তাঁর কাছ থেকে আর তাঁর ছেলে-মেয়ে জামাইদের কাছ থেকে অশেষ স্নেহ ছাড়া কিছু পাইনি।
খুদিকে আর মীরাকে দলে টেনে ছিলাম, তাদের সান্ধ্য আড্ডা ভেঙে যাবে বলে একটু ক্ষুণ্ণ হলেও, সবাই খানিকটা স্বস্তি বোধ করছিল, এটা আমি টের পাচ্ছিলাম। মীরা আমাকে ঘোর নীল মীনে করা কাঠের মোমবাতিদান উপহার দিয়েছিল। অনেক দিন সে-দুটিকে যত্ন করে রেখেছিলাম। তবে আর তাকে এত কাছে পাইনি। খুদি মহারাণী স্কুলে জীবন কাটিয়েছিল, মীরা কলকাতায় এসে শিক্ষাবিভাগে, পরে গোখলে স্কুলে কাজ করেছিল। বিয়ে করে সুখী হয়েছিল, একটি মেয়ে রেখে সেও চলে গেছে। যতদূর মনে হয় মে মাসের শেষে মাসিমাদের সঙ্গে নেমে এলাম মানে পাহাড়ের রেলে গয়াবাড়ি স্টেশন অবধি এলাম। সেখানে মাসিমারা নেমে গেলেন। ওখানে ওঁদের ভাগ্নী ইলা পালচৌধুরীদের চা-বাগান আর বসতবাড়ি। দুদিন কাটিয়ে যাবেন। স্টেশনে ওরা মাসিমাদের নিতে এসেছিল, আমাকেও পেড়াপিড়ি করতে লাগল। কিন্তু আমার থাকার উপায় ছিল না। ইলা পালচৌধুরীর ডাক নাম ছিল টুবলি, আমাদের পুরনো বন্ধু হয়তো বছর তিনেকের বড়। ওর বাবা বিজয় বসু ছিলেন আলিপুরের চিড়িয়াখানার অধ্যক্ষ। ছোটবেলা থেকে কত ছুটির দিনে বাগানে বেড়িয়ে টুবলিদিদের পুকুর ধারের ঘাসজমিতে বসে নানারকম উপাদেয় সামগ্রীর সঙ্গে চা কিম্বা লেমোনেড খেয়েছি, তার লেখাজোকা নেই। ঐখানে বিজয় বসুর ভাগ্নে কালিদাস নাগ, তাঁর অল্পায়ু ছোট ভাই গোকুল নাগ, হেমমাসিমার ছোট জামাই হাবল সান্যালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অবিশ্যি তাঁদের চাইতে প্রায় ১০-১২ বছরের ছোট হওয়াতে, তাঁরা সে আলাপে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। টুবলিদির মাকে আমরা বলতাম ইন্দুমাসি, মাসিমার ননদ, তিনি আমাদেরও মাসিই ছিলেন। অবারিতদ্বার তাঁদের বাড়ি, সকলেই খুব বাজনার ভক্ত ছিলেন। গোকুল নাগ চমৎকার বেহালা বাজাতেন এবং সেকালের বহুআলোচিত ফোর আর্টস ক্লাবের সভ্য ছিলেন। আমাদের কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনত না। ভালো কথা, বিজয় বসুকে নিয়েও তাঁর বাড়ির লোকরা মাঝে মাঝে মহা মুশকিলে পড়তেন। গান-বাজনার ধার ধারতেন না তিনি। বাড়ির লোকেরা তাঁর সাংস্কৃতিক উন্নতিকল্পে অনেক টাকা খরচ করে তাঁকে চেম্বার অফ মিউজিকের কনসার্টে নিয়ে যেতেন, উনি পত্রপাঠ চেয়ারে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। এবং তার চেয়েও খারাপ হল যে থেকে থেকে বাজনার মার্গ চড়লে, নাক দিয়ে খুব জোরে ‘ফঁ-ড়া-ৎ’ করে একটা শব্দ করে জেগে উঠে বলতেন, ‘এ্যাঁ কি বলল?’ শুধু স্নানের ঘরে তাঁকে গুণ গুণ করে গান গাইতে শোনা যেত তবে নোটনের কাছে শুনেছিলাম যে ওরা নাকি কৌতূহলবশত দরজায় কান দিয়ে শুনেছে বিজয়-মেসো ঘরের ভেতরে গাইছেন, সা-গা। গা-ধা। গা-ধার-পা নাকি মা-নু-ষের ‘পা’!
বেঁটে গাঁট্টা গোঁট্টা মানুষটির চোখের পেছনে হাসি চক চক করত। আমাদের ওঁকে বড্ড ভালো লাগত। উনি টের পেতেন কিনা জানি না। ওঁর শোয়ার ঘরে মশারির ভেতরে পাখা ঘুরত, আমরা হাঁ করে দেখতাম। বাগানে একবার এক জোড়া পার্শিয়ান ক্যাট দেখেছিলাম, ফিকে নীল-ছাই গা, গাঢ় নীল চোখ। কাছে যেতেই ফ্যাঁচ করে আমার ভাই অমির হাতে আঁচড়ে দিল। আইডিন লাগাতে হল। মাসিমারা নেমে গেলে এত কথা আমার মনে পড়ল। টুবলিদির বিয়ের ঘটকালি মা করেছিলেন। টুবলিদির বড় ননদ ছিলেন মার প্রাণের বন্ধু। মহেশগঞ্জে একবার তাঁদের কাছে থেকেও এসেছিলাম। তাঁর মেজ ভাই অমিয় পালচৌধুরী। তার সঙ্গে ১৭ বছর বয়সে টুবলিদির বিয়ে হল। আমরা গিয়ে নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম। টুবলিদি দেখতে ভালো ছিল, বেহালা বাজাত, মিষ্টি নরম ব্যবহার ছিল। অপেক্ষাকৃত কম বয়সে বিধবা হয়েছিল, তারপর দুই ছেলে এক মেয়ে মানুষ হয়ে গেলে, রাজনীতিতে ঢুকে, রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিল অনেকদিন। সে-ও আর নেই।
স্টেশনে আমাদের ভাইপো অশোক এসেছিল। তার কথায় বুঝলাম আমার শান্তিনিকেতনের পরিকল্পনাটি মোটেই জনপ্রিয় হয়নি। তবে আমি যে কারও কথা শুনে চলব না এও সবাই জানত। ভাইবোনরা রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, মাও রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন। এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই যেকোনো কারণে ভাইবোনদের প্রীতি হারালে আমার বড্ড কষ্ট হবে। সুখের বিষয় সারা জীবন ধরে আমার সব কাজে তাদের অকৃত্রিম সহানুভূতি পেয়ে এসেছি। মতে না মিললেও। আমরা ভাইবোনরা চিরকাল যে যার নিজের বিচার অনুসারে কাজ করেছি, তাই নিয়ে কখনো কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। গুরুজনদের কথা আলাদা। তবে স্বাধীন সাবালকত্ব পেয়ে অবধি আর কখনো তাঁদের কথামতো চলিনি। বাড়িতে আমার শেকড় নড়ে গেছিল। আমি অন্য কোনো জায়গার নাগরিক হয়ে গেছিলাম। বাবা বলতেন আমার মনে অনিশ্চয়তা বিরাজ করে, তাঁকে কোনোদিনও বোঝাতে পারিনি, ওটা অনিশ্চয়তা নয়, নিশ্চয়তার বহিঃপ্রকাশ, আমার আত্মপ্রত্যয় জন্মেছে।
বাড়ি এসে দেখি রবীন্দ্রনাথের এক চিঠি এসেছে। তাতে লিখেছেন তুমি জায়গাটা একবার দেখে যাও, তারপর বিদ্যালয় খুললে স্থায়ীভাবে এসো। আমি সেই নিদারুণ গরমে একা শান্তিনিকেতনে গেলাম। কলকাতাতেও তখন গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে, তবু কেউ যে আমার সঙ্গে আসতে চাইল না সেটা আমি লক্ষ্যই করিনি। দুপুরের গাড়ি দানাপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার, তাতে করে একদিন একলা একলাই চলে গেলাম। মা পথে খাবার জন্য লুচি তরকারি করে দিলেন। মায়ের মতো আছে কে? আমার সেজভাই অমি আমাকে গাড়িতে তুলে দুটো রসের কথা বলে গেল।
এখন যে পথের প্রত্যেকটা স্টেশনের গুদোম, গুমটি, কোয়ার্টার, বাড়ি, বাগান, সাঁকো, পুকুর, খাল, গাছপালা এমনকি মগরার ক্রসিং-এর চুল-পাকা মোষ পর্যন্ত, নিজের হাতের তেলোর মতো চেনা হয়ে গেছে, সেই পথ সেদিন আমি প্রথম দেখলাম। খানা জংশনের পর থেকে লুপ লাইনও আলাদা হয়ে গেছে, পৃথিবীর চেহারাও বদলে গেছে। লুপ লাইনে আগে কখনো আসিনি, সেই প্রথম দেখার বিস্ময় আজো ভুলিনি। শুকনো মাটির রঙ ক্রমে লালচে হয়ে এল। বড় গাছের দূরত্ব বেড়ে গেল। বর্ধমানের বড় বড় তাল-পুকুরের জায়গায় ছোট ছোট ডোবা, গুটিকতক খড়ের চালের ঘরকে ঘেঁষে আছে, বড় বড় ধান-ক্ষেত। ক্রমে বেঁটে বেঁটে খেজুর গাছ দেখা দিল, দুপাশে শিমুল গাছ। রেলের লাইন থেকে থেকে কাটিং-এ নামলে চাকার ঝমঝমানির সুর বদলায়। স্টেশনের লোকেরা কালো, লম্বা, কোঁকড়া চুল, তাঁদের মুখের ভাষা অনেক বেশি শুদ্ধ। হয়তো এ-সব মন্তব্য প্রথম দেখার ফল নয়, বারে বারে দেখে একটু করে মনে জমা হয়েছে। মেয়েদের গলার স্বর তত কর্কশ নয়, একটু যেন লাজুক, টিকিট কেটে গাড়িতে উঠে বেঞ্চিতে না বসে মাটিতে বসতে চায়। খরার সময়, দুপুরের গাড়ি বড় গরম। তারপর একসময় বোলপুর পৌঁছলাম।
তখন স্টেশন আরো ছোট ছিল। এক সারি অপিস-ঘর, অনেকখানি লাল কাঁকর বিছানো প্ল্যাটফর্ম, ওরা বলত লাটফর্ম। পেণ্টেলুন পরা সাহেব সুবো দেখলে ভাবত লাট সাহেব হবেও বা। শান্তিনিকেতনের সাহেবরা তো অনেকেই খদ্দরের ধুতি পরত, মেমরা শাড়ি পরত। সবার পায়ে চটি, নয়তো খালি। অনেকেই বাংলা বলত। বোলপুর স্টেশনের লোকেরা অমন ঢের ঢের সাহেব দেখেছিল। প্ল্যাটফর্মের ধারে ধারেও পলাশ শিমুলের গাছ।
‘ধীরেনদা, অর্থাৎ ডঃ ডি. এম. সেন, যিনি পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা সচিব হয়েছিলেন, আমাকে নিতে এসেছিলেন, অনঙ্গবাবুর লড়ঝড়ে মটর গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার সঙ্গে ছোট্ট একটা স্যুটকেস, ছোট একটা হোল্ড-অল। অনঙ্গবাবু কেঠো কেঠো হাত দিয়ে সেগুলো গাড়ির পেছনে তুললেন। কুলি-ভাড়া এক আনা। মটর ভাড়ার কথা কেউ কিছু বললেন না, আমি ভাবলাম হয়তো মিনি-মাগনা বিদ্যালয় থেকে পাঠিয়েছে। পরে এক বছর ধরে কতবার যে অনঙ্গবাবু সে ঋণের কথা আমাকে মনে করিয়ে ভাড়া আদায় করেছিলেন মনে নেই। ধীরেনদার সাইকেল ছিল। বললেন, শ্রীভবনে আপনার ঘর ঠিক আছে। হাত মুখ ধুয়ে তৈরি থাকবেন। আমি এসে উত্তরায়ণে নিয়ে যাব। গুরুদেব ওখানে চা খেতে বলেছেন।
তখন ঐ একটিই ছাত্রী আবাস ছিল, শ্রীভবন। দোতলা বাড়ি, পেছনে পাঁচিলে ঘেরা ঘাসে ঢাকা উঠোন, তার পেছনে স্নানের ঘরের সারি আর মস্ত কুয়ো। কলের জল ছিল না। রাত দশটায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেত। অনঙ্গবাবুর গাড়ি আমাকে নিচু বাংলার পথ, দেহলী, মহর্ষির উপাসনার পাহাড়, তার পাশের পুকুর, সেটি এখন বুজিয়ে দিয়ে বাগান হয়েছে—তারপর তালধ্বজ কুটির, কাঁচের মন্দির, শান্তিনিকেতন বাড়ি, ছাতিমতলা বাঁয়ে রেখে এগিয়ে চলল।
বাঁয়ে মোড় নিতে নিতে অনঙ্গবাবু বললেন, ‘উত্তরে উত্তরায়ণ, ডাইনে আমাদের ছাপাখানা, বাঁয়ে স্কুলের অপিস ঘর, তার ওপাশে লাইব্রেরী, আমরা ডাইনে ঘুরছি। এই গেল রান্নাঘর, সামনের গুজরাটি কিচেন, তারপর গোয়াল ঘর, লাল গরু পাজি, যখন তখন খুঁটি উপড়ে তাড়া করে, খুব সাবধানে থাকবেন—বাঁয়ে খেলার মাঠ তার দক্ষিণে গুরুপল্লীর মাটির ঘরের সারি, ক্ষিতিমোহনবাবু, নন্দবাবু, অজিত চক্রবর্তী মশায়ের পরিবার, প্রমোদবাবু—তাঁকে সবাই ‘মশাই’ বলে—নেপালবাবু, গোঁসাইজী ইত্যাদি সবাই ওদিকে থাকেন। খেলারমাঠের দক্ষিণে বীরেনদার ছোট বাড়ি, উনি কন্ট্রাকটরী করেন—স্টেশনে যাঁকে দেখলেন তিনি বীরেনদার ছোট ভাই ধীরেনদা, বিলেত থেকে ডক্টরেট পাওয়া, শ্রীনিকেতনে কাজ করেন—এই যে শ্রীভবনের ফটক, ভেতরে আমার যাওয়া নিষেধ, নেমে পড়ুন। বাড়িটা অবিশ্যি মেয়েদের জন্য হয়নি, ছেলেদের জন্য হয়েছিল। তারপর যখন মেয়েদের দেওয়া হল, ছেলেদের কি রাগ। রাতারাতি গেট উপড়ে ফেলে দিল—একবার নয়, দুবার—কোন ফল হল না, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম—এই রইল আপনার বাক্স, বিছানা, সিঁড়ির ওপর রেখে গেলাম—আচ্ছা চলি।’
কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রমের যতটুকু দেখা গেল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিয়ে অনঙ্গবাবু চলে গেলেন। সামনের দরজা খুলে দুজন থান-পরা আধা-বয়সী মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন, একজন রোগা, দুঃখী চেহারা, তাঁর নাম সরোজিনীদি, অন্যজন মোটা-মোটা হাসি-খুশী, তিনি বালবিধবা হিরণদি। এঁরা রান্নাঘরের মেট্রন। শ্রীভবনের অধ্যক্ষা হেমবালা সেন ছুটিতে রাঁচি গেছেন। উত্তর দিকে আমাকে যে ঘর দেওয়া হল, তার লাগোয়া বাথরুম, জানলা আছে, কিন্তু সেদিক দিয়ে হাওয়া আসে না, গুমোট গরম, পাখাটাখার বালাই কোন ঘরেই নেই। স্নান করে তৈরি হলাম। ধীরেনদা এসে উত্তরায়ণে নিয়ে গেলেন।
এখন যাকে বলা হয় উদয়ন, তখন তাকেই সবাই বলত উত্তরায়ণ, অন্য বাড়িগুলোর মধ্যে শুধু উত্তরায়ণের উত্তরে কোণার্ক ছিল, আর তার পাশে বাঁধান ভিতের ওপর সুন্দর একটি মাটির বাড়িতে শ্রীঅমিয় চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী হৈমন্তী তাঁদের ছোট্ট মেয়ে নিয়ে থাকতেন। বাকী সব খোলামেলা, উত্তর-পূর্ব কোণে পঞ্চবটি বনের মত। তার বাইরে লাল মাটির পথ গোয়ালপাড়া পার হয়ে, কোপাই পার হয়ে, সিউড়ির দিকে চলে গেছে। উত্তরায়ণের সামনে গোলাপ-বাগান, টেনিস-কোর্ট, দক্ষিণের গাছের আড়ালে একটা ছোট বাড়ি, সেটি চোখেই পড়ত না। সেখানে কাজকর্ম হত।
যেদিকে তাকাই ধূ-ধূ করছে খোলা মাঠ, দূরে দিগন্তের কাছে নীল বনরেখা, পূবে রেলের উঁচু বাঁধ, নীচের কাটিং দিয়ে ট্রেন গেলে ধোঁয়া দেখা যায়। রেলের ওপারে মাঠ পেরিয়ে পারুলডাঙা। পূর্বপল্লী নেই, উঁচু উঁচু ছাত্রাবাস নেই, গেস্ট হাউস নেই, বিশ্বভারতীর মস্ত আপিসবাড়ি নেই, নতুন লাইব্রেরী নেই। গোয়ালপাড়ার পথে শুধু হাসপাতালটি একটু পেছিয়ে আছে। একতলা একটা ডাকঘর, তার লাগোয়া পোস্ট মাস্টারের বাড়ি, অসময়ে ডাকলেও হাসি মুখে বেরিয়ে আসেন। আর কতকগুলি মাটির ঘর, তাতে মাস্টারমশাইরা থাকেন। পশ্চিমে শ্রীনিকেতন পর্যন্ত ফাঁকা রাস্তার দু ধারে খোলা মাঠ, ভাঙা খোয়াই ধূ-ধূ করছে। চেয়ে চেয়ে দেখলাম আর বুঝতে পারলাম রবীন্দ্রনাথ কেন বলেছিলেন, পাহাড় তাঁর বুকের ওপর বোঝার মত চেপে বসে। তবে ভালও লাগত নিশ্চয়, নইলে কেন ছুটে ছুটে কালিম্পং যেতেন?
মনে আছে উত্তরায়ণের সামনের চওড়া বারান্দার একেবারে পূবের কোণে খুদে এক চাপাটির মত হল। প্রতিমাদি সেজেগুজে এসে আমাদের চা জলখাবার পরিবেশন করলেন, বনমালী দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল। আরও অতিথি ছিলেন, শ্রীনিকেতন থেকে কোয়েকার ডাক্তার হ্যারি টিম্বার্স, তাঁর স্ত্রী আর ৬/৭ বছরের দুটি মেয়ে, অমিয়দা, হৈমন্তী, আরও কে কে। যা দেখি তাই ভাল লাগে। ভাল লাগার জন্য মন তৈরি হয়েই এসেছিল। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমি চাই তুমি এখানে মনের সুখে থাক। ভেবেছিলাম তুমি ছোটদের জন্য গল্প লেখ—সন্দেশ পড়ি আমি—তোমাকে দিয়ে শিশু বিভাগের কাজ করিয়ে নেব। এখন মনে হচ্ছে তার চেয়ে তুমি কলেজে ইংরিজি সাহিত্য পড়িও, স্কুলের ওপরের ক্লাসেও ইংরিজি পড়িও। টাকার আছেন, তনয় আছেন, তাঁদের তোমার ভাল লাগবে। কিছু বলবার থাকলে আমাকে বলে যেও।’
আমার কিছু বলবার ছিল না। কি থাকতে পারে? রবীন্দ্রনাথ আমাকে ডেকে কাজ করতে বলেছেন, সে-ই আমার যথেষ্ট।
রাতে রান্নাঘরে খেলাম, ভাত, ডাল, তরকারি, নিরামিষ তরকারি, মাছের ঝোল, ভালই লাগল, ভাল রান্না। অনেকে অনেক কথা বলত, কিন্তু আমার কখনো রান্নাঘরের খাবার খারাপ লাগেনি। যদিও কিঞ্চিৎ একঘেয়ে। তবে বিকেলের জলখাবারটি যথেষ্ট বলে মনে হত না। হিরণদি, সরোজিনীদি খুব যত্ন করে খাওয়ালেন, পরে কোত্থেকে একটু সন্দেশও এনে দিলেন। বিদ্যালয় খুলতে কয়েকদিন বাকি ছিল, রান্নাঘরে মুষ্টিমেয় খাইয়ে টিম টিম করছিল।
পরদিন সকালে দুটি ছেলে আমাকে সমস্ত আশ্রম দেখিয়ে দিল। তখন আশ্রম এলাকা ছিল ছোট্ট, এক বেলাতেই দেখে নিলাম। বাইরের লোকের বাস ছিল না। কাচের মন্দিরের পরে শান্তিনিকেতনের আদি বাড়ি, আগে এরই একতলায় দীপু ঠাকুর থাকতেন, আর আমবাগানে যেসব ছোট ছেলেরা আম চুরি করতে আসত, তাদের লজ্জা দিতেন। তখন সবটাই অতিথিশালা। বাইরের কুয়োর একটা পোস্তোয় লেখা ছিল ‘অতিথি’, উল্টোদিকের পোস্তোয় লেখা ছিল ‘শালার জন্য।’ তাই দেখে অতিথিরা হাসাহাসি করত। দক্ষিণে আমবাগান তখনো ছিল, আরও সতেজ, আরো সবুজ। তখনো কাউকে পাকা আম খেতে হত না। আরও দক্ষিণে শালবীথি।
বড় রাস্তা থেকে ঢুকতে শালবীথির প্রথম বাঁয়ের বাড়ি ‘দ্বারিক’ ছিল কলাভবনের ছাত্রাবাস। সে বাড়ি আর নেই। তার সামনে দেহলী, আগে যেখানে রবীন্দ্রনাথ অনেকদিন থেকেছেন। এখন সেখানে মৃণালিনী পাঠশালা। তখন কলেজের অধ্যক্ষ গাঙ্গুলীমশাই থাকতেন। তারপর অনেকগুলো মাটির বাড়ির শেষে একতলা পাকা লাইব্রেরী, তার দেয়ালে সুন্দর ছবি আঁকা। আমাকে দেখে কাল দাড়ি, লম্বা, ফর্সা, সুন্দর একজন মানুষ বেরিয়ে এলেন। তাঁর সঙ্গে সেই মুহুর্তেই একটা গভীর প্রীতির সম্বন্ধ তৈরি হয়ে গেল। তিনি হলেন শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, লাইব্রেরিয়ান।
লাইব্রেরির সামনে ঘণ্টাতলার মাঠ এখন যেমন, প্রায় তেমনি ছিল, শিশু বিভাগ, সিংহ সদন। তার পেছনে খোলা মাঠ। একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে গুরুপল্লীর মাটির বাড়ির সারিতে গুরুরা সকলে থাকতেন। ছবির মত দেখতে লাগত। তারই পূবে দ্বিজেন ঠাকুরের নিচু বাংলা, তার ফলের গাছের ছায়া মেখে অপেক্ষা করে থাকত। আশে-পাশে কয়েকটা মাটির বাড়িতে কয়েকজন মাস্টারমশাই থাকতেন। কিছু ছোট ছোট ইঁটের বাড়িও বোধহয় ছিল। আগের দেখা, পরের দেখা ভাল করে মনে করতে পারি না।
বিকেলের গাড়িতে আমাকে তুলে দিয়ে, ধীরেনদা বললেন, ‘গুরুদেব বলেছেন, বিদ্যালয় খুলে গেলে আর দেরি করবেন না। জিজ্ঞাসা করতে বললেন কত হলে আপনার চলবে?’ ভারী লজ্জা পেলাম। বললাম, ‘উনি আমাকে যা দেবেন, তাতেই আমার চলে যাবে।’
বিদ্যালয় খুলবার সময় আমার শরীর খারাপ হয়েছিল, সাত দিন দেরি করে গেছিলাম। আমার এক সপ্তাহ পরে আমার বাল-বন্ধু পূর্ণিমা—দ্বিজু ঠাকুরের মেয়ে নলিনী চৌধুরীর ছোট মেয়ে, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর দেওরঝি এবং পরে যখন পূর্ণিমার সুরেন ঠাকুরের বড় ছেলে সুবীরের সঙ্গে বিয়ে হল, তখন ভাইপো-বৌও বটে—এসে কাজে যোগ দিল। তাকেই দার্জিলিং-এ দেখেছিলাম। সে মিনি-মাগনা পড়াবে। তার অভিভাবকদের মতে মেয়েদের পরনির্ভরশীল হতে হয়, নইলে তাদের পুরুষ আত্মীয়দের মনে থাকে না। আমার মাইনে ঠিক হল ৮৫ টাকা, তার থেকে হস্টেলের খরচ ২০ টাকা কাটা হত। বাকিটা ওস্তাদ বলে একজন চাপরাশি আমার হাতে নগদ দিয়ে, সই করিয়ে নিত। আমি তাতেই অত্যন্ত সম্ভষ্ট ছিলাম। বাপের বাড়িতে কে আমাকে মাসে মাসে ৬৫ টাকা দিত? তাছাড়া বেশির ভাগ অধ্যাপকরাই ছিলেন অত্যন্ত গুণী এবং মাইনে পেতেন ৩০ থেকে ৭০—৭৫-এর মধ্যে। নন্দলাল বসু, ক্ষিতিমোহন সেন, কালীমোহন ঘোষ, নেপালচন্দ্র রায় ইত্যাদিও কেউ ২০০—২২৫-এর বেশি পেতেন না বলে আমার ধারণা। তাতেই সকলের সাদাসিধেভাবে চলে যেত, শান্তিনিকেতনের কর্মীরা বিলাসিতার ধার ধারতেন না। দারুণ ভাল লাগত। কি কি ভাল লাগত একটু বলি :
গাছতলায় ক্লাস, বাহুল্যবর্জিত ব্যবস্থা। একটা ব্ল্যাকবোর্ড, যে-যার বগলে বসবার আসন, একজন গুরু, কয়েকজন ছাত্র, খানকতক বই, এর বেশি কি-ই বা দরকার? মাথার ওপর ছাদ নেই, চারদিকে দেয়াল নেই।
আরও ভাল লাগত আশ্রম এলাকা তকতক ঝকঝক করছে। বুধবার ছুটির দিন। সেদিন ছেলেরা ছোট ছোট দল বেঁধে আগাছা পরিষ্কার করত। রান্নাঘরের পরিবেশনের কাজ, বাসন ধোয়ার কাজ, অতিথি আপ্যায়নের কাজ, পালা করে ছেলে-মেয়েরা করত। তাতে পড়ার যেটুকু ক্ষতি হত, সেটুকু তৈরি করে নিতে বিশেষ অসুবিধা ছিল না। দুষ্টু ছেলেমেয়ে তখনও ছিল, তাদের শাসনের জন্য বিচার সভাও ছিল, তার সদস্যরা সবাই ছাত্রছাত্রী। কোন অন্যায় কাজ বা অন্যায়কারী পার পেত না, নিজেরাই বিধান দিত, আন্দোলন করবার কোন দরকার হত না।
রবীন্দ্রনাথের তখন ৭০ বছর বয়স, নিয়মিত পড়ান না, কিন্তু অবারিতদ্বার। যার সাহসে কুলোত সেই গিয়ে তাঁকে মনের কথা বলে আসতে পারত। সপ্তাহে সপ্তাহে সাহিত্য সভা হত, ছেলেমেয়েরা নিজেদের রচনা পড়ত, অধ্যাপকরা উপস্থিত থাকতেন, সভাপতিত্ব করতেন। ভোর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত গানের হাওয়া বইত। মনে হত সমস্ত আশ্রমটাই গান গাইছে। বাংলার ছয় ঋতু যে কি মহান, কি মধুর, সেকালের শান্তিনিকেতনে পা দিলেই টের পাওয়া যেত। এখনো যায়। গান বন্ধ হয়ে গেছে, তবু যায়।
সাত দিন পরে বুবু এসে অবাক হয়ে দেখল আমি আশ্রম-জীবনের মধ্যে একেবারে তলিয়ে গেছি। আমার মনে হত আমার মনের দরজা-জানলাগুলো একে একে খুলে যাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে কত কথা গুণগুণিয়ে উঠত তার ঠিক নেই। যত দূর মনে পড়ছে দার্জিলিং-এর ঐ তিন মাসে একে-ওকে কয়েকখানা আবেগপূর্ণ চিঠি লেখা, চার্কোল দিয়ে খানকতক নিরাভরণ কাঞ্চনজংঘার ছবি আঁকা ছাড়া আর কোন কাজ করিনি। তবে নিজের সঙ্গে খানিকটা বোঝাপড়া করেছিলাম বটে। শান্তিনিকেতনে তার সময় পাইনি। কিন্তু প্রতি মাসে দুটো-একটা গল্প, প্রবন্ধ, সন্দেশে, মৌচাকে ও অন্যান্য কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘ওগুলো সংগ্রহ করে একটা ছোট বই করে ফেল, নইলে হারিয়ে যাবে। আমার কত লেখা হারিয়ে গেছে।’ আমি কিন্তু সাহস পেতাম না, ইউ রায় এন্ড সন্স উঠে গেছে, কে আমার বই ছাপবে? তাছাড়া সত্যি কথা বলতে কি, যদিও ২৩ বছর পূর্ণ হয়ে গেছিল, কাছাকাছি বয়সের অনেক লেখক,—বুদ্ধদেব বসু, শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ—পাকা সাহিত্যিক বলে খ্যাতি পেয়েছিলেন—তবু আমার নিজের ওপর কোন আস্থা ছিল না। মনে হত বড় বেশি আশ্রিত—আচ্ছাদিতভাবে জীবন কাটিয়েছি, গাদা গাদা বই পড়েছি বটে, কিন্তু বহির্জগতের হালচাল কতটুকু জানি।
একটা শিক্ষা আমার অল্প দিনের মধ্যেই হল। আশ্রমে যত স্বাধীনতাই থাকুক না কেন, সঙ্গে সঙ্গে এত বেশি পরচর্চা যে নিজের কানকে বিশ্বাস করা যেত না। সামনা-সামনি বেশির ভাগ লোক যা বলে, পেছনে তার একেবারে উল্টো কথা বলে। পরের আচরণে খুঁৎ দেখলে মুখে রাগমাগ করলেও, বেশির ভাগ লোক ব্যাপারটাকে বেজায় উপভোগ করে। দয়া-মায়া-ক্ষমা এসব জিনিসের এত অভাব আগে জানিনি। একদিন উত্তরায়ণে কবির কাছে গিয়ে শুনতে পেলাম কলেজের উচ্চপদস্থ একজন অধ্যাপক, বি-এ ক্লাসের একজন মেয়ের নামে নালিশ করছেন। তাই নিয়ে উপস্থিত পুরুষ ও মহিলারা—যাঁদের অনেকের সঙ্গে বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজের কোন সম্পর্ক ছিল না—নানারকম বিরূপ মন্তব্য করলেন। মেয়েটিকে ডাকা হল না, জিজ্ঞাসা করা হল না, তখন-তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ওকে চিঠি লিখে শান্তিনিকেতন থেকে চলে যেতে বলা হবে। মনে আছে আস্তে আস্তে চলে গেছিলাম। আমার জ্ঞানচক্ষু একটু একটু করে ফুটছিল।
পরে ভেবেছি ব্যক্তিগত আক্রোশ, কিম্বা একটা ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে রেষারেষি হিংসা-দ্বেষ, পরনিন্দা, নিজের সুবিধা করে নেবার চেষ্টা—এসব হবেই। কিন্তু এতে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার আদর্শ এতটুকু ম্লান হয় না। প্রকৃতির বুকে ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দেবার কথা যে কবি বলতেন, এখানে এসে দেখলাম সে কি মনোহর জিনিস। প্রকৃতির এমন অপরূপ প্রকাশই বা আছে কোথায়। যেমন চাঁদের আলো, তেমনি কাল মেঘের ঘনঘটা, যেমন সকাল, তেমনি সন্ধ্যা, সমস্ত আকাশটা যেন নাগালের মধ্যে চলে আসত। কি কঠিন রুক্ষ জমি। কিন্তু কি উর্বরা, এতটুকু জল, এতটুকু যত্ন পেলেই যা ছিল মরুভূমি, তা হয়ে ওঠে তপোবন। কি সে পাখির কি সে পলাশ শিমুলের বাড়াবাড়ি। এইটুকু বাতাস উঠল তো চারদিকে শিরশির সরসর করে মাতন লেগে গেল। মনে হত একটা নিশ্বাসের শব্দও এখানে নষ্ট হয় না। রবীন্দ্রনাথ একদিন পাকা ধানের ক্ষেতের ধারে আমাকে দাঁড় করিয়ে ধানের গান শোনালেন। বাতাসের দোলা লেগে পাকা ধানের শীষ একটার পর আরেকটা আছড়ে পড়ছে আর মধুর এক ঝম-ঝম-ঝম শব্দ উঠছে।
এর আগেও কত সুন্দর জায়গায় থেকেছি, প্রকৃতির লীলাভূমি শিলং-এ শৈশব কাটিয়েছি, পরে দার্জিলিংয়ের মহান সুন্দর দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু শৈশবে ছাড়া প্রকৃতি কোথাও এমন করে আমার অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করেনি। এখানে আমার সমস্ত অনুভূতিগুলো সচেতন সজীব হয়ে উঠেছিল। আমার পুরনো সমস্যা যা কিছু ছিল, সমস্তই আপনা থেকে সমাহিত হয়ে গেছিল। সমস্যার সমাধান মন নিজে করে, বাইরে থেকে হয় না। এখানে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। ছোটবেলার সেই চেতনা আবার মনে জেগে উঠেছিল। আমি নতুন করে টের পাচ্ছিলাম ২৩ বছরেও বিশেষ কিছু করিনি, কিন্তু লেখা ছাড়া আমাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। বাংলায় লেখা। যে ভাষায় বাঙালী শিশুরা মাকে ডাকে, বাঙালী বুড়োরা মরার সময় ভগবানকে ডাকে, সেই সহজ ভাষায় লিখতে হবে। কোন বই পড়ে সে ভাষা শেখা যাবে না। শান্তিনিকেতনে এক সঙ্গে এত মানুষকে এত ভাল লেগেছিল, সেখানে, এত আজীবনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল যে বারে বারে বলেও মন ওঠে না যে, ঐখানে আমার মনের নিবাস। সেই সব মানুষদের কথা বার বার বলি।
মাত্র এক বছর ছিলাম বিশ্বভারতীর কর্মী হয়ে। তারপর কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছিলাম। বুবুও সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছিল। কিন্তু দুজনেই চিরজীবনের মত হৃদয় দান করে এসেছিলাম। ওখানকার কাজ আমার ভাল লাগত না। হয়ত অধ্যাপনাই ভাল লাগত না, সে-ই ছিল একটা বড় কারণ। প্রতিদিনের জীবন আকণ্ঠ উপভোগ করতাম, শ্রদ্ধা করবার অনেক পেতাম, মাথার ওপর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। গলদ সেইখানে। মাঝে-মাঝেই দীর্ঘকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতেন, পারস্যদেশে, নানা জায়গায়। তা না হলে অশান্ত হৃদয় নিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই উনি বাজপাখির মত তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে একবার তাকিয়ে নরম গলায় যেই বলতেন, ‘ওরা বলেছে বলে কি তোমার গায়ে ফোস্কা পড়েছে?’ অমনি ক্ষুব্ধ চিত্ত শান্ত হয়ে যেত। বলতেন—‘ছোট মুখের ছোট কথায় কান দিও না। আমাকেও তো কত কি বলে। চিরকাল বলেছে।’ তবু শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত এক বছরের বেশী থাকিনি। ভাবতাম নিজে চলে না গেলে এরা আমাকে ঝেড়ে ফেলে দেবে। রবীন্দ্রনাথ তখন ইরানে। ছোট মুখের ছোট কথাই বটে। বার-তেরো বছরের ছেলে-মেয়েদের কোপাই নদীর ধারে পিকনিকে নিয়ে গেলাম। সারা দিন আনন্দ করে ফিরে এলাম। পর দিন কবি মুচকি হেসে বললেন, ‘তোমরা নাকি কাল মিকসড বেদিং করে এসেছিলে?’ ঝপ করে মনের মধ্যে আনন্দের বাতিটা নিবে গেল। দোলের মেলা থেকে আমার বি-এ ক্লাসের ছাত্র গোবর্ধন মপারা আমাকে একটি সুন্দর ফুলের মালা কিনে গলায় পরিয়ে দিল। তাও ডালপালা গজিয়ে, সব মাধুর্য হরণ করে কবির কানে গিয়ে উঠল। বৃহৎ যাঁরা ছিলেন, নমস্য যাঁরা, আমার আজীবনের অনুকরণীয় আদর্শ যাঁরা, আমার প্রিয় বন্ধু যাঁরা, ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দনাল, প্রভাতদা, তেজুদা, গোঁসাইজী, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধুশেখর ভট্টাচার্য এঁরাও ঐ পরিবেশে দীর্ঘকাল, কেউ কেউ আজীবন কাটিয়ে দিলেন। হয়ত এসব তুচ্ছ জিনিস লক্ষ্যই করলেন না, তার কারণ তাঁরা তাঁদের কর্মজীবনের দিশা পেয়েছিলেন, কিন্তু আমি পাইনি।
অধ্যাপনা আমার কাজ নয়। অথচ তার মানে নয় যে, ক্লাস নিতে আমার খারাপ লাগত। প্রায়ই ভারি মজা হত। তবু কেবলই মনে হত এ কাজে জীবনের অমূল্য সময় বৃথা ব্যয় করছি। কবির কাছ থেকে তাঁকে দেখবার আগে যা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে চলে আসার পরেও যা পেয়েছি এবং আজও যা পাচ্ছি, তা যেন ঐ কাছে কাছে থাকার এক বছরের পাওয়ার চাইতে ঢের বেশি। তবে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানবার এমন সুযোগ আর কোথায় পাব। একবার অমিয়দা ছুটিতে গেলেন, আমি এক মাস কবির সচিব হলাম। মেয়ে বোর্ডিং-এর অধ্যক্ষা হেমবালাদি চাইতেন অন্যান্য বোর্ডিং-বাসিনীদের মতো আমরাও বাধ্য মেয়ে হয়ে থাকি, ঘণ্টা পড়লে ছাত্রীদের মতো ঘরে গিয়ে ঢুকি। চিরকাল আমি নিয়ম-শৃংখলার ভক্ত, কিন্তু কারো প্রভুত্ব সইতে পারি না। হেমবালাদির পক্ষে কি করে আমাকে ভালো লাগা সম্ভব হতে পারে? রাতে খাওয়ার পর, হয়তো পৌনে ন’টার সময় বুবু আর আমি প্রায় রোজ উত্তরায়ণে চলে যেতাম। সেখানে চারু দত্ত বলে একজন আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। আই সি এস। স্বদেশীয়ানার জন্য বরখাস্ত হওয়া, সাহিত্যপ্রেমিক, অপূর্ব চন্দর শ্বশুর। এককালে টাউন ক্লাবের সদস্য হয়ে আমার বড় জ্যাঠা সারদারঞ্জনের কাছে ক্রিকেট খেলা মকস করেছিলেন, পশ্চিম ভারতের পরিবেশে অতি চমৎকার অনেকগুলি রোমাঞ্চময় বই লিখেছিলেন। কি সুন্দর গল্পই যে করতে পারতেন। সে সময়ে বিশ্বভারতীর মিনি-মাগনার পরিদর্শক গোছের হয়ে ছিলেন। তাঁর পরে আসতেন আরিয়মদা, যিনি পরে আশা অধিকারীকে বিয়ে করে ওয়ার্ধা সবরমতী ইত্যাদি নানা জায়গায় কাজ করে জীবন কাটিয়েছিলেন, ডঃ আলি যিনি শ্রীনিকেতনের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের ম্যালেরিয়া দূরীকরণের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, প্রফেসার টাকার অ্যামেরিকার কোনো সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় অধ্যাপনা করতে এসেছিলেন এবং কলেজে ইংরিজি পড়াতেন, ধীরেনদা, তিনিও লন্ডন থেকে ডি এস সি হয়ে এসে শ্রীনিকেতনের বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং অপটুত্বের জন্য আমাকে বকাবকি করতেন, ভারি কর্মদক্ষ এবং কটুভাষী মানুষটি নিজেকে অপ্রিয় করতে ওস্তাদ। দেশ-বিদেশের গল্প হত, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, খেলাধুলো কিছু বাদ যেত না, কেউ কেউ ব্রিজ খেলতেন, লোক কম পড়লে আমাকে নিতেন, খুব দক্ষ ছিলাম না, ধীরেনদা বকতেন। হস্টেলে ফিরতাম রাত দশটায় আলো নিবে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে কিম্বা সঙ্গে সঙ্গে। হেমবালাদি এই নিশাচরণ সমর্থন করতেন। না। কবিকে বলেও কোনো লাভ হত না। একে আমরা অধ্যাপিকা, তায় তাঁর বাড়িতেই বসে দেরি করছি! তাছাড়া তাঁর মন ছিল সমুদ্রের মতো উদার।
ভোর থেকে ঘণ্টা, কুঁড়েদেরও শুয়ে থাকার জো ছিল না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে জলখাবার খেয়ে ঘণ্টাতলার মাঠের ধারে লাইব্রেরির সামনে বৈতালিকে যোগ দিতাম। সারাদিন ধরে ভোরের বৈতালিকের আমেজ আমার মনে লেগে থাকত।
অথচ ব্যাপারটা কিছুই নয়, দুটি গান, একটু মন্ত্রপাঠ, পাঁচ-সাত মিনিটেই শেষ। কিন্তু সমস্ত বিদ্যালয় উপস্থিত থাকত। ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপকমণ্ডলী, অতিথি অভ্যাগত মায় উত্তরায়ণ থেকে অনেকে। মাথার ওপর স্নিগ্ধ নীল আকাশ তার নিচে শাল-মহুয়া গাছের সারি, বাতাস তখনো শীতল, পাখিরা গাইছে। ভালোভাবে দিন শুরু হত। আমার পাশে জগদানন্দ রায় অঙ্ক ক্লাস নিতেন, মাঝে মাঝে ধমক-ধামক কানে আসত, শুনেছি রেগে বই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াও ওঁর অসম্ভব ছিল না। কিন্তু ছাত্রগত প্রাণ, অজস্র ভালো ভালো বই লিখেছেন, প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিষয়ে। আরো দূরে তনয়েন্দ্রনাথ ঘোষ ইংরিজি পড়াতেন, যেমনি কড়া, তেমনি স্নেহশীল। প্রথমদিন ক্লাস নাইনে ইংরিজি ক্লাস নিতে গিয়ে একজন ছেলের কাছ থেকে বই নিয়ে খুলে দেখি ইংরিজি শব্দ ‘সুট’-এর পাশে বাংলায় মানে লেখা ‘ঝোল’। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘সুট’ মানে ‘ঝোল’ লিখেছ কেন রাখেশ? সে অম্লান বদনে বলল, ‘তনয়দা বলেছেন।’ তাই শুনে ক্লাসশুদ্ধ সকলের কি হাসি! একজন বুঝিয়ে বলল, ‘ও বাঙাল দেখুন। রান্নাঘরে মাছের ঝোলকে ‘মাছের ঝুল’ বলেছিল বলে আমরা হেসেছিলাম। তাই ও ভেবেছে তনয়দাও নিশ্চয় বাঙাল ‘সুট’ মানে ঝোল বলতে বলছেন, ‘ঝুল’। শুনে মনটা বেজায় ভালো হয়ে গেছিল। ঐ তনয়দার মতো সৎ, সৎসাহসী, রাশভারি, স্নেহশীল শিক্ষক আর দেখিনি।
নিচের ক্লাস নিতেন তেজেশচন্দ্র সেন, সকলের তেজুদা। সাদাসিধে হাসিখুসি, বাগান বলতে পাগল, গাছপালা সম্বন্ধে জ্ঞান ছিল অপার। কাচের মন্দিরের পাশে মাঝখানে তালগাছ ঘিরে যে কুটির, তার নাম তাল-ধ্বজ, কবির দেওয়া। সেখানে তেজুদা থাকতেন, বাইরে কয়েকটা পুরনো ভাঙা থাম পড়ে থাকত, তার ওপর বসতেন। ছোটরা তেজুদা বলতে অজ্ঞান, এমনি রসের গল্প বলতেন। তেজুদার বন্ধু ছিলেন দিন্দা, দ্বিজেন ঠাকুরের বড় ছেলে দীপেন্দ্রনাথ, তাঁর ছেলে দিনেন্দ্রনাথ। সঙ্গীতের রাজা, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলতেন ওঁর গানের ভাণ্ডারী, কারণ কবি গান লিখে সুর দিয়ে নিজেই সে সুর ভুলে যেতেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে দিনুকে না শেখালেই নয়, দিনু কখনো ভুলতেন না।
বুবুর আপন মামা দিনদা, আমি তাঁর বিশাল হৃদয়ের অগাধ স্নেহের ভাগ পেয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে নাতি। এমন ভক্ত শিষ্য তাঁর আর ছিল কিনা সন্দেহ। পরে ভুল বোঝাবুঝির ফলে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে গেছিলেন। বুক ভেঙে গেছিল। সে আঘাত বেশিদিন সইতে পারেননি, মাত্র ৫২-৫৩ বছর বয়সে মারা গেছিলেন। কিন্তু ১৯৩১ সালে তাঁর বাড়ি ছিল আনন্দ নিকেতন। গান বাজনা, গাল-গল্প। ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা এসে আলাদা করে বিনি পয়সায় গান শিখে যেত, সবাইকে প্রচুর জলপান করানো হত। আমিও যে কত খেয়েছি ওঁদের বাড়িতে, দিনদার আর কমলবৌঠানের কাছ থেকে আদর পেয়েছি তা বলতে পারব না। বই পড়ার নেশা ছিল, বাড়ি ভরা ইংরিজি বই, কত নিয়ে পড়েছি।
এক ছুটির দিন তেজুদার বাড়িতে বুবু আমি মাছ তরকারি রাঁধলাম, দিনদার বাড়িতে তেজুবাবু শুঁটকি মাছ রাঁধলেন। দিনদার বাবুর্চি শিক্কাবাব রাঁধল। সে এক এলাহি ব্যাপার। তবে ওই শুঁটকিটা কিছুতেই গিলতে পারলাম না। যদিও দিনদা আর তেজুদা বার বার বলতে লাগলেন যে এভাবে রাঁধলে কক্ষণো গন্ধ লাগতে পারে না, শিলেটের ছেলে তেজুবাবু জানবে না তো কে জানবে, ইত্যাদি। তবু আমার নাক সে কথা মানল না। দিনদা আর তেজুদা রেগে টং। যত সব বেরসিক মেয়ে।
এই গল্প শুনে, রবীন্দ্রনাথও আমাদের দিয়ে উত্তরায়ণের ছোট রান্নাঘরে রাঁধালেন। একজন চাকর উনুন ধরিয়ে মশলা বেটে দিয়ে চলে গেল। আমরা মাছ কোটা থেকে পায়েস নামানো পর্যন্ত সব করলাম। তবু কবিকে খুসি করতে পারলাম না। বলেছিলেন সাড়ে বারোটায় খাবার পরিবেশন করা চাই, আমাদের হয়ে গেল ১টা।
কত কথাই মনে পড়ে। সন্ধ্যায় রোজ উত্তরায়ণের বারান্দায় এসে বসতেন। অধ্যাপক কর্মী অতিথি-অভ্যাগতের ভিড় জমে যেত। বেশিরভাগই নিঃস্বার্থভাবে তাঁর পায়ের কাছে বসে তাঁর মুখের কথা শোনার আশায় থাকতেন। কেউ হয়তো তাঁর গলায় যুঁই ফুলের মালা পরিয়ে দিল, তিনি তাই পরেই বসে রইলেন। আমার বাবা বলতেন ওখানে যতসব মেয়েলীপনা। আমি রেশমি জোব্বা পরে গলায় ফুলের মালা পরে রবীন্দ্রনাথকে বসে থাকতে দেখতাম, বলিষ্ঠ দেহ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, দৃঢ় কণ্ঠ, যেন পৌরুষের প্রতিমূর্তি। ফুলের মালা পরলে কি পৌরুষ কমে?
সন্ধ্যা হয়ে যেত, কবি তাড়াতাড়ি খেতেন। বনমালী এসে দোরগোড়ায় দাঁড়াত। যে যার উঠে প্রণাম করে বাড়ি যেতেন।
একদিন বুবু নেই, আমি একা। আমাকে বললেন, ‘তুমি যেও না, আমার কাছে বস।’ উনি খেতে বসলেন, আমি ওঁর পাশে বসে দেখতে লাগলাম। বনমালী খাবার দিল। মীরাদি আসেননি, প্রতিমাদি অসুস্থ। এরকম মাঝে মাঝে হত, উনি একা খেতেন। সেদিন নিজের ছোট কোয়ার্টার-প্লেটখানি আমার সামনে ঠেলে দিয়ে, নিজের হাতে পাত থেকে লুচি তরকারি সন্দেশ তুলে আমাকে দিলেন আর কত যে গল্প করলেন। তারপর প্রণাম করে চলে আসবার সময় বললেন, ‘দাঁড়াও, দক্ষিণা দিতে হবে না?’ বলে গলা থেকে ফুলের মালাটি খুলে আমার হাতে দিলেন। আমি কিছুই বলতে পারলাম না, মনে মনে বুঝলাম এ আমার জীবনের একটি বিশেষ উজ্জ্বল মুহূর্ত।
এইরকম ছোট ছোট স্নেহের নিদর্শন শান্তিনিকেতনের কর্মীরা সবাই হয়তো পেতেন, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল আমার কোনো যোগ্যতাই নেই। চাঁদের হাট জমা হয়েছিল তাঁর চারপাশে। তার মধ্যে যিনি আমাকে সব চাইতে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন, তিনি হলেন নন্দলাল বসু, আমাদের মাস্টারমশাই। রোজ সকালে ক্লাসের পর কলাভবনে গিয়ে জল-রংয়ের ছবির সরঞ্জাম নিয়ে আমার ছোট নিচু ডেস্কটির সামনে বসতাম। কখনো একাই তালগাছ-টাছ আঁকতাম, কখনো সুরেন কর এসে পাশে বসে পাঠ দিতেন, কখনো মাস্টারমশাই নিজে। যেই তিনি গিয়ে কারো পাশে বসতেন, অমনি কলাভবনে সে সময়ে যারা যারা উপস্থিত থাকত, সবাই এসে ঘিরে দাঁড়াত। এই হল সৃষ্টিকর্মের সবচাইতে ভালো পাঠের নিয়ম।
একবার আমার পাশে বসে ছবির পরিকল্পনা সম্বন্ধে বলছেন আর আমার ফ্যাঁচড়া মতো তুলিগুলোকে ছেঁটে ঠিক করে, তুলি ধোয়া জলে ডুবিয়ে, একটা ছেঁড়া কাগজে পরখ করে দেখছেন। অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি আমাদের মতো যেমন তেমন তুলির আঁচড় দিচ্ছেন না, একেক টানে একটা পাখির বাসা, তাতে পাখির ছানা, তাদের এই বড় বড় হাঁ, দূরে মা-পাখির আসার ইঙ্গিত—সব হল। এইসব করছেন আর বলছেন ‘ছবি তৈরি হয় মনের মধ্যে, হাত দিয়ে কাগজের ওপর নয়, সে তো শুধু সেই মনের ছবিটার বাইরের প্রকাশ।’ আর গোটা ছবিটা মনের মধ্যে তৈরি হয়ে না গেলে, কাগজে আঁচড় দিও না। ছবি আঁকা হয়ে গেলে মিছিমিছি বাড়তি আঁচড় দিও না।’ এইভাবে গল্প করতে করতে ছবি আঁকার বিদ্যে শেখাতেন। কেউ পারত, কেউ পারত না। আমার শখ ছিল, কিন্তু সেরকম বলিষ্ঠ প্রতিভা নেই। ছবি ভালোবাসি, কিছু কিছু বুঝি, কিন্তু আঁকি না। এক সময় কিছু এঁকেছি, প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে, রূপোর পদকও পেয়েছি, কিন্তু হাতে আমার সে জাদু নেই। ছবির বিষয়ে পড়েছি অনেক। অনেক সাহস করে মাস্টারমশায়ের গুরু অবনীন্দ্রনাথের বাগেশ্বরী বক্তৃতামালার ইংরিজি অনুবাদ প্রায় শেষ করে এনেছি। এমন বই পৃথিবীতে আর আছে কিনা জানি না। এর মধ্যে সৃষ্টিকর্মের—তা সে শিল্পই হক, সঙ্গীতই হক, নাচই হক, নাট্যই হক, কি সাহিত্যই হক—মর্মকথা ধরা আছে। লিখি আর ভাবি এইখানে আমাদের মাস্টারমশাইও তাঁর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, যদিও এ-বই তখনো কাগজে প্রকাশ পায়নি, গুরুর অন্তরে ধরা ছিল, ছাত্ররা তার ভাগ পেয়েছিল।
এই আরেকটি মানুষ যে আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। শুধু ছবি আঁকার পাঠ দিয়েই উনি সন্তুষ্ট থাকতেন না। রবীন্দ্রনাথ যে প্রকৃতির লালন-ভূমিতে সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করার স্বপ্ন দেখতেন, আজকের বিশ্বভারতী যে স্বপ্ন হারাতে বসেছে, মাস্টারমশাইও সেই স্বপ্নে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই ১৯৩১ সালে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে কলাভবনের ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে ‘ভলি-বল’ খেলাতেন। কি সব মানুষ তৈরি করে দিয়েছিলেন সেই আবহাওয়ায়, বিনোদদা, মাসোজি, নিশিকান্ত রায়চৌধুরী, রামকিংকরদা, নিজের দুই মেয়ে গৌরী, যমুনা, মুকুলদার দুই বোন বুড়ি আর রাণী, আরো কত। তারা শিখেছিল শিল্পীর জাতটাত নেই, দুনিয়ার সব কাজই শিল্পীর কাজ। গান্ধী দিবসে আশ্রমের পরিচারকদের ছুটি দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা আর অধ্যাপকরা সব কাজ করেন। তখন ছিল খাটা পায়খানার যুগ। মাস্টারমশাই তাঁর শিল্পীর দল নিয়ে কোদাল কাঁধে বালতি হাতে খাটা পায়খানা সাফ করতে যেতেন। রান্নাঘরে মেয়েরা বাসন মাজছিল, রান্না চড়াচ্ছিল। আমি একবার মুখ তুলে দেখলাম শরদিন্দু সিংহ, বনবেহারী ঘোষ, সত্যেন বিশী, কোদাল নিয়ে, ‘ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ গাইতে গাইতে চলেছে। এমনি ছিলেন আমার মাস্টারমশাই।
লাইব্রেরীতে শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন কড়া পাহারাদার। হট্টগোল করবার জো ছিল না। প্রায় ছ’ ফুট লম্বা, কুচকুচে কালো চুল দাড়ি, ফর্সা রং, সুন্দর নাক-মুখ—এই মানুষটিকে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরাই দেখতাম। জামা-জোব্বা ধরেছিলেন চুল-দাড়ি পাকলে পর। তদ্গতচিত্তে কাজ করতেন। ভারি শ্রদ্ধা হত। ডিগ্রি ডিপ্লোমা ডক্টরেটের চাইতে সে বড় জিনিস। অবসর সময় রবীন্দ্র-জীবনীর নোট লিখতেন। কাজের পর রোজ বিকেলে একবার উত্তরায়ণে গিয়ে গুরুদেবকে শুনিয়ে, দরকার মতো সংশোধন করিয়ে আনতেন। এখন যখনি কেউ বলে, ‘জীবনীতে ভুল আছে, তখনি আমার সেই কথা মনে হয়। এমন তথ্য-বিশিষ্ট, সযত্নে সংযোজিত বই বাংলা ভাষায় আর আছে কিনা সন্দেহ। কোথাও নিজেকে জাহির করা নেই। আগাগোড়া নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি; মাঝে মাঝে ছোটখাটো নীতিপাঠ থাকলেও সেগুলি মানিয়ে যায়। যত দিন যায় এ বইয়ের দাম ততই বাড়ে।
শ্রীনিকেতনে মাঝে মাঝে সান্ধ্যভ্রমণে যেতাম। হেঁটে যাওয়া আসা করতাম। কোয়েকার ডাক্তার হ্যারি টিম্বার্সের বাড়িতে কফি আর জলখাবার খেতাম। নানান মারাত্মক সংক্রামক রোগের বিশেষজ্ঞ। বয়স হয়তো ৩৫-৩৬, নাচ-গান ভালোবাসতেন, নিজেও চমৎকার নাচতেন, অমায়িক, পরদুঃখকাতর। আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘তোমার নিজের দেশের জন্য তুমি কি করছ বল দিকিনি?’ প্রশ্নটা ধক্ করে বুকে বেজেছিল। আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে ভালোবাসি, আমি কি দেশের কোনো কাজে আসতে পারি? এখনো মাঝে মাঝে সে প্রশ্নের জবাব খুঁজি। ডঃ টিম্বার্স রাশিয়াতে টাইফাসের গবেষণা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন।
শ্রীনিকেতনে আরো বন্ধু ছিলেন, গৌর ঘোষ ফুটবলার, যিনি মুকুলদার বোন বুড়িকে বিয়ে করেছিলেন; ধীরানন্দ রায়, যিনি জাপানী কর্মী কাসাহারার মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন; বৌদিকে জাপানী বলে চেনাও যেত না। কাসাহারা ছিলেন বৃক্ষপালনের বিশেষজ্ঞ; গোটা গোটা বড় বড় আমগাছ এক জায়গা থেকে তুলে আরেক জায়গায় লাগাতেন। ১৯৩১ সালে তিনি ইহলোকে ছিলেন না, কিন্তু একটা বড়গাছের ওপর একটা কাঠের তৈরি সুন্দর গাছ-ঘর তাঁর কল্পনাপ্রবণ মনের সাক্ষী ছিল। কল্পনাপ্রবণ না হলে কখনো গাছ তৈরি করা যায়? ডঃ আলির কথা আগেই বলেছি। তিনি আমাদের ডেকে চা খাওয়াতেন, হেমবালাদি অসন্তুষ্ট হতেন। এক বছর গভীরভাবে বাঁচলে কি তার কথা কটা পাতার মধ্যে ধরে দেওয়া যায়? কলাভবনে সুকুমারী দেবী আশ্চর্য সব সেলাইয়ের ফোঁড় তুলতে শেখাতেন। আমার সময় হত না, পরে মেয়েদের কাছ থেকে শিখে নিতাম। ভালোমানুষ নগেন আইচ মশাই সামান্য বেতন পেতেন, কিন্তু স্বয়ং কবির কাছে শুনেছিলাম একবার আশ্রমের অর্থসংকটের সময় দুর্ভাবনায় তাঁর রাতে ঘুম হয় না, এমন সময় নগেনদা তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় গুরুদেবের পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করলেন। সে দান তাঁর গুরুদেব মাথা পেতে নিয়েছিলেন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথিবী ভুলে গিয়ে, নিচু ডেস্কের সামনে বসে অভিধান রচনা করতেন। ক্ষিতিমোহনবাবু প্রসন্নবদনে বাংলার হারানো সাহিত্য সম্পদ উদ্ধার করতেন। নেপালবাবুর স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব আর অযাচিত আতিথেয়তা জীবনে কখনো ভুলব না। তাঁর বিষয়ে নানান সরস গল্প প্রচলিত ছিল। যদিও তাঁর পুত্র আমাদের প্রিয় বন্ধু কালিপদদা সে গল্প বললে বিরক্ত হন, বলেন সব বানানো, তবু একটি না বলে পারছি না।
ভুলো মানুষ নেপালবাবুকে একবার কলকাতা যেতেই হবে। অভ্যাস মতো তোড়জোড় করতে দেরি করে ফেলে, স্টেশনে পৌঁছে দেখেন ট্রেন প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তখন আশ্চর্য উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে নেপালবাবু গার্ডের গাড়ির পা-দানি থেকে, গার্ডের কোমর জড়িয়ে তাকে নামিয়ে নিলেন। সবুজের বদলে লাল নিশান উড়ল, ট্রেন থামল। অমায়িকভাবে নেপালবাবু গার্ডকে বললেন, ‘কিছু মনে কর না, বাবা, ডোন্ট মাইণ্ড, আই হ্যাভ টু গো।’ গার্ড আবার সবুজ নিশান নাড়তে লাগল।
আরো ছিলেন, সবাই আপনজনের মতো হয়ে গেছিলেন। প্রমোদবাবুর কথা মনে পড়ে। তাঁকে সবাই ডাকত ‘মশাই’ বলে, নিচের ক্লাসে পড়াতেন। আমাদের জন্য সাড়ে তিন টাকা দিয়ে সুন্দর সুন্দর রংয়ের বাগের হাটের শাড়ি এনে দিতেন। শ্রীসত্যেন বিশী কলাভবনের পাঠ সবে শেষ করে এনেছিল, সে আমাদের জন্য দেড় টাকা দামের চটি কিনে এনে দিত কলকাতা থেকে। তখনকার বোলপুরের এত বোলবোলাও ছিল না। ‘ডেলি প্যাসেঞ্জার’ বলে একজন লোক যাবতীয় দরকারি জিনিস সরবরাহ করত। আশ্রমের ধারেকাছে কোনো খাবারের দোকান ছিল না, কিছু কিনতে হলে বোলপুর অবধি হাঁটতে হত। বাস ছিল না, রিকশা ছিল না। রান্নাঘরের পেছনে ‘কো-অপ’ বলে একটা ব্যবস্থা ছিল, সেখানে দু পয়সা দিয়ে কাগজে মোড়া মাখন আর চার পয়সা দিয়ে প্রমাণ সাইজের একটা পাঁউরুটি পাওয়া যেত। তার একটা বড় সুবিধা ছিল যে টোস্ট করবার দরকার হত না, নোড়া দিয়ে ভেঙে নিলেই হল।
নদীর স্রোতের মতো দিনগুলো কেটে গেছিল। সে বছর রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছরের জন্ম-জয়ন্তীর উৎসব হল কলকাতায়। টাউন হলে বিরাট সম্বর্ধনা সভা হল, প্রদর্শনী হল, তিনদিন ধরে জোড়াসাঁকোয় আর নিউ এম্পায়ারে নাটক হল। টিম্বার্স নৃত্যনাট্যের ‘রাজা’ হয়ে খুব প্রশংসা পেয়েছিলেন। নটির পূজায় আমি গেরুয়া পরে ভিক্ষুণী উৎপলপর্ণা সাজলাম। নিউ থিয়েটার্স নাটকটির ফিল্ম তুলল, রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন, তবু জনতার সে ফিল্ম পছন্দ হল না, বেঞ্চিটেঞ্চি ভেঙে দিয়ে চলে গেল। বছর তিনেক আগে বোলপুরে সেই ছবি আবার দেখানো হয়েছিল, এবার লোক চুপ করে আগাগোড়া শুনেছিল। সাধারণের জন্যে নয় ও জিনিস। তবে সত্যি কথা বলতে কি, বোধহয় খুব ভালো হয়নি। এর মধ্যে গান্ধীজি গ্রেপ্তার হলেন, উৎসব বন্ধ করে কবি শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন। মাঝে মাঝে ক্লাস নিতে চাইতেন। আমি একবার ১৩-১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গেলাম, উনি শেলির স্কাইলার্ক পড়ালেন। ইংরিজি কথাগুলো পাঠ করলেন, পড়ালেন বাংলায়। সেই ক্লাসটাই একটা কাব্য হয়ে উঠল। আজো মনে পড়ে কবির ঘাড়ের ওপর দিয়ে নীল আকাশে চিল উড়ছিল।
প্রথম গুবগুবি পাখির ডাক শুনলাম, সুন্দরী হাঁড়ি চাঁচা দেখলাম। বছর ঘুরে এল। আমার প্রথম পৌষ উৎসব দেখলাম। আজও যারা বলে পৌষ উৎসবে দেখবার কিছু নেই তারা বোধহয় দেখতে জানে না। আসল জিনিসই আছে, নানা রকম মানুষ। পৌষের শেষে দল বেঁধে হেমবালাদিকে পাণ্ডা পাকড়ে কেঁদুলীর মেলা দেখে এলাম। সারা রাত শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা ঘটনার বিষয়ে দলে দলে বাউলরা গান গাইল। দেখলাম এদের দলে ঠাকুমা থেকে নাতি গাইছে।
গাছের পাতা খসল; দলে দলে বুনো হাঁস দুমাস আগেই এসেছিল, রোজ তাদের ডানার শব্দ শুনতাম। শীত। পরপর শীত গেল, পাখিরা গাইতে শুরু করল, রাতারাতি গাছে গাছে পাতার কুঁড়ি দেখা দিল। সকালের বৈতালিক আরো মধুর হয়ে উঠল, কোনোদিন শান্তিদেব গান করত, কখনো বা সুধীর কর, কিম্বা আর কেউ। মহুয়া গাছে ফল ধরল, তার নিচে ক্লাস নিতাম, টুপটাপ করে কোলের ওপর ফল পড়ত আর আমিও টের পেতাম এবার আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে। এত সুন্দর জায়গা, এমন চাঁদের হাট, এখানে আমি থাকি কি করে?
গরমের ছুটি হলেই দলের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে গেলাম, আর এলাম না। রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখলেন, যদি আস, দেখবে তোমার জায়গা তোমার জন্যেই রয়েছে। সেই জায়গাটুকুই আজ পাথেয়! তাই এখন শান্তিনিকেতনে আমার বাড়িঘর।
সারা বছর ধরে প্রতিদিনকার জীবনে যে রসের পালা চলত, এর মধ্যে তার কথা কিছুই বলা হল না। কলকাতায় ফিরে এসে, দিনের পর দিন ধরে সারা গ্রীষ্মকাল আমি সেই সব রসের কথা আরেকবার করে উপভোগ করেছি। তার ছোঁয়া লেগে আমার সমস্ত চিন্তাধারায় রঙ ধরে গেছিল। সে এক নতুন পালা।