৭
ভোর হচ্ছে। জেগে উঠছে তাঁবুর যাত্রীদল। গাছের নীচে শুয়ে থাকা যাত্রীদেরও ঘুম ভেঙেছে। গোপালের মা বুড়ি ঘ্যানঘেনে গলায় গাছের ডালের পাখিদের উদ্দেশে তখন ব্রজবুলি আওড়ে চলেছে।
মুখপোড়াদের কান্ড দ্যাখ বউমা! একেবারে চুনকাম করে দিয়েছে গা। ওই বড় গাছে রাতের বেলায় অনেক পাখিই আশ্রয় নেয়। বুড়িও ঘুমিয়েছে ওই গাছের নীচে, আর তারাও রাতভোর বিষ্ঠা ত্যাগ করে বুড়ির কাপড় গা-মাথা চিত্র বিচিত্র করে তুলেছে।
গোকুল এখন অনেকটা সুস্থ। সেও হাসছে। বলে,
—ঠাক্মা ওরা দোল খেলেছে তো তোমার সঙ্গে।
গোপালের মা তখন ঢিল কুড়িয়ে পাখি তাড়াতে ব্যস্ত। স্নান করে পরিক্রমায় বের হতে হবে।
ললিতা আজ পরিক্রমায় বের হতে যাবে, নবীন ডাক্তার গোকুলকে দেখতে এসে ওকে পরীক্ষা করে বলে,
—তুই তো এখন ফিট রে গোকুল।
গোকুলও উঠে বসেছে। বলে সে,
—হ্যাঁগো, ডাক্তারবাবু, চান-টান করে পরিক্রমায় বের হতে হবে গো। গঙ্গার ওপারে যাব আজ না?
ললিতা বলে—এই রোদে পরিক্রমায় যাবে।
গোকুলও জেদ ধরে—যাবই।
নবীন ডাক্তারই বলেন—আজকের দিনটা রোদে হাঁটবি না গোকুল। কাল যাবি। কেউ কিছু বলবে না। গাড়ি তো কটাই আছে, আজ গাড়িতে করে যাবি। আমি বলে দিচ্ছি—হেঁটে আজ যাবি না, বুঝলি। দুর্বল শরীর।
ললিতা বলে— ওই ছেলেকে তাই বলুন বাবা। আমার কোনো কথাই কানে তোলে না, ওকে নিয়ে কী যে করি।
নবীন ডাক্তার বলেন— না-না। গোকুল আমাদের লক্ষ্মী ছেলে, ও মায়ের অবাধ্য কখনই হবে না।
ললিতাও কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। গোকুল বলে,
—গাড়িতে চেপে ঘুরব আজ কিন্তু কাল থেকে আবার পায়ে হেঁটে যাব। পরিক্রমায় এসে গাড়িতে চাপবে কি—গো মা? পায়ে হেঁটে নাম-গান করেই তো আনন্দ।
গোপালের মা বলে—আজ তবু তোর সঙ্গে গাড়িতেই ঘুরব গোকুল। পায়ের ব্যথাটাও একটু জিরেন পাবে। নে তৈরি হয়ে নে। গাড়ি এসে পড়বে। ও বউমা, নেয়ে নাও বাছা। ওর খাবার-দাবারও গুছিয়ে নিতে হবে। খাবার জলও।
.
এদিকে মন্দির চাতালে মূল মণ্ডপে ভুবনবাবু এসে পড়েছেন। নাম-কীর্তনের দলের লোকজন ও তৈরি হয়ে এসে পড়েছে। যাত্রীরা এবার সমবেত হয়ে নাম-কীর্তন শুরু করে পরিক্রমায় বের হবে। ভক্তরাও এসে পড়েছে। খোল-কর্তাল, অন্য যন্ত্রপাতি, কাঁসর-ঘণ্টাগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।
একজন বলে—বাবা ঠাকুর কাল রাত্রে নাম কীর্তন শেষ হবার পর যন্ত্রপাতি খোল-কর্তাগুলো এই মন্দির চত্বরেই সব রেখে গেলাম। ভোরেই লাগবে। কিন্তু খোল-কত্তাল, কাঁসর-ঘণ্টা কিছুই নাই। সব চুরি হয়ে গেছে বোধহয়।
ভুবনবাবুও অবাক হন—তাই তো এসব গেল কোথায়? কে বলে–চোরের অভাব নেই। গেল তো সব।
ভুবনবাবু বলে—অনি, তোর দলবলকে বল ভাই খোঁজাখুঁজি করুক। না হলে পরিক্রমা বের হবে না।
ওরা খুঁজছে। এদিক-ওদিকে ঘন জঙ্গল। একটা ধস পড়া পুরোনো বাড়ি—গাছে ঢাকা। সবাই খুঁজছে। ভুবনবাবুর মনে পড়ে যুধিষ্ঠিরের কথা। ওর এসব অভ্যাস আছে। তাই যুধিষ্ঠিরকে দেখে বলেন তিনি,
—কোথায় গেল এসব, জানিস তুই। বল সত্যি বলবি?
যুধিষ্ঠির বলে—আজ্ঞে জানি!
—মানে! চমকে উঠে ভুবনবাবু বলেন—চুরি করেছিস?
যুধিষ্ঠির ঘাড় চুলকে বলে
—আজ্ঞে না প্রভু। চুরি করিনি। ওসব ছেড়ে দিইছি।
—তবে!
যুধিষ্ঠির এবার অকপটে স্বীকার করে,
—আজ্ঞে বহুদিনের অভ্যেস। অন্ধকার হলেই হাত নিশপিশ করে। চুরি আর করব না দিব্যি নিয়েছি, তাই ওইসব খোল-কর্তাল, খঞ্জনি এদিক-ওদিকে সরিয়ে দিয়েছি বাবা ঠাকুর। অপরাধ নিও না—আমি সব বের করে দিচ্ছি।
যুধিষ্ঠির ওই বনজঙ্গল-ভাঙা বাড়ির এদিক-ওদিক থেকে মালপত্র সব বের করে এনে আবার মন্দির চত্বরে গাদা করে।
ভুবন ঠাকুর বলেন,
—যুধিষ্ঠির তোকে বরং একজোড়া খঞ্জনিই দেব। রাতের অন্ধকারে যখন হাত নিশপিশ করবে তখন খঞ্জনি বাজিয়ে গলা তুলে নাম কেত্তন করবি। চুরির অভ্যেস চলে যাবে।
যুধিষ্ঠির বলে—তাই দেবেন প্রভু। ই-শালা বদভ্যাসটা ছাড়তেই হবে গো।
.
নরহরি আজ যেন নতুন এক চেতনাকে ফিরে পেয়েছে।
আগেকার সেই মানুষটা আজ বদলে গেছে। কুন্তীও আজ খুশি হয়েছে। পরিক্রমায় এসে গৌরসুন্দরের দয়ায় তার এতদিনের ব্যাকুল প্রার্থনার পূরণ হয়েছে। মা হতে চলেছে সে।
নরহরিও একে দেবতার পরম আশীর্বাদ বলেই মেনে নিয়েছে। সে আজ ঠিক করেছে ওদের জমি-জায়গা সব ফেরত দেবে—আর ওই লোভ-পাপের পথে যাবে না।
নরহরি তাই এসেছে ললিতার কাছে।
ললিতা বের হবার জন্য তৈরি হচ্ছে। গোকুলও এখন সুস্থ। নরহরিকে দেখে তাকাল ললিতা।
নরহরি বলে—মা, জীবনে অনেক পাপই করেছি। তোমার কাছে আমি মহাপাপী। আমার এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও মা, নাহলে আমার সংসারে কল্যাণও আসবে না।
ললিতা অবাক হয়—কি বলছেন এসব নায়েব মশাই? ললিতা ওকে ওদের পুরোনো নায়েব বলেই জানে। নরহরি বলে,
—পরিক্রমায় এসে আমার ভুল ভেঙেছে মা। আমি ফিরে গিয়ে তোমাদের বাড়ি-ঘর সব ফিরিয়ে দেব মা। ছোটবাবু—রাজাবাবু তোমাকে ঠকিয়েছি, এ পাপের আমার শেষ নেই গো। এর প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।
নরহরি বলে—মা, গাড়িটা খালিই যাচ্ছে, ছোটবাবুকে এই রোদে হেঁটে যেতে হবে না। ওই গাড়িটাতেই যাবেন মা। আমি ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি। পরে কথা হবে। চলি—
নরহরি চলে গেল।
গোপালের মা বুড়ি বসেছিল ওদিকে। ও সব কথাই শুনেছে নরহরির।
বলে গোপালের মা–এ যে ভূতের মুখে রাম নাম গো। এতকাল সারা দেশের লোকের যথাসর্বস্ব হরে হম্মে নিয়েছে, আজ যেন দাতাকন্ন হয়ে উঠল, কি ব্যাপার গো বউমা!
ললিতা ওই নরহরির কথাগুলো ভাবছে। ওদের অনেক কিছুই লুটে নিয়েছে নরহরি। গোকুলকে নিয়ে ললিতা ওই গোয়াল বাড়িতে রয়েছে, জমি-জারাতও অনেক চলে গেছে। বহু কষ্টে ছেলেকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে ললিতা, তবু কাউকে কিছু বলেনি। নিয়তির বিধান বলেই সব কিছু মুখ-বুজে সহ্য করেছে সে। আজ গৌরসুন্দরের দয়াতেই যেন নরহরির ওই পরিবর্তন ঘটেছে, ললিতা আবার সব ফিরে পাবে, একটু ভালোভাবে রাখতে পারবে গোকুলকে। এসবই সেই পরম করুণাময়েরই দয়া।
.
পরিক্রমা শুরু হয়েছে।
শান্ত-সবুজ পরিবেশে গ্রাম্য পথে চলেছে হাজারো মানুষ নাম-গান গাইতে গাইতে।
ছায়াস্নিগ্ধ পরিবেশ, রোদের তাপ তত নেই। ওরা এসে হাজির হল ছায়াঘন এক বিশাল আমবাগানে। এই আমবাগান গৌরাঙ্গদেবের স্মৃতি-বিজড়িত এই আম্রহট্ট। গৌরাঙ্গদেব সপার্ষদ লীলা-কীর্তনে বের হয়েছেন, ভক্তদের জিজ্ঞাসা করেন—কী খেতে চাও তোমরা?
কোনো ভক্ত বলে—পাকা আম হলে মহোৎসব ভালো জমত
গৌরাঙ্গদেব তখনই সেখানে আমের আটি সংগ্রহ করে পুঁতে—সেই গাছে আম ফলিয়েছিলেন আর সেই পাকা আম দিয়ে ভক্তদের সেবাও করেছিলেন। সেই থেকেই নাকি এই আম্রহট্টের উৎপত্তি। আজও বিস্তীর্ণ অঞ্চল বহু আমগাছে সমাকীর্ণ।
সেই ছায়াঘন আম্রকানন দিয়ে চলেছে পরিক্রমার ভক্তবৃন্দ। আকাশ-বাতাস নাম-গানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
ওরা এসে পড়েছে কিছু পথ পার হয়ে সুরভিকুঞ্জে। এখানে সুরভি মাতার পুণ্য অধিষ্ঠান হয়েছিল অতীতে। আজও সেই স্থানে মন্দির প্রতিষ্ঠিত।
দ্বাপরে ইন্দ্র গোকুলকে প্রবল বৃষ্টিতে শেষ করার ব্যবস্থাই করেছিল। তখন শ্রীকৃষ্ণ গিরি গোবর্ধন ধারণ করে গোকুলকে রক্ষা করেছিলেন। পরে ইন্দ্রের দর্পচূর্ণ হলে ইন্দ্র কৃষ্ণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন তাঁর কৃতকর্মের জন্য, কৃষ্ণ তাকে ক্ষমাও করেছিলেন।
ভক্তরা মন্দিরে সমবেত হয়েছে, ভুবনবাবুর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়।
তথাপি ইন্দ্রের রহিল ভয়। সুরভি নিকটে তখন কয়।।
কৃষ্ণলীলা মুই বুঝিতে নারি। অপরাধ মম হইল ভারি।।
শুনেছি কলিতে বজ্ৰেন্দ্ৰসুত। করিবে নদীয়া-লীলা অদ্ভুত।।
পাছে সে-সময় মোহিত হব। অপরাধী পুনঃ হয়ে রহিব।।
তুমিত সুরভি সকল জান। করহ এখন তাহার বিধান।।
সুরভি বলিল চলহ যাই। নবদ্বীপ ধামে ভজি নিমাই।।
কামধেনু সুরভি এসে নবদ্বীপ ধামে গৌরলীলা দর্শনের আশায় রয়ে গেল।
শুধু সুরভিই নয়—এই পুণ্য মৃত্তিকায় গৌরলীলা দর্শনের আশায় এসেছিল তীর্থরাজ পুষ্কর, গড়ে উঠেছিল শ্রীমহাবারাণসী, শ্রীহরিহর ক্ষেত্র প্রভৃতি।
ভুবনবাবু ভক্তদের সামনে অতীতের বহু পুণ্য কাহিনির অবতারণা করেন।
ঋষি মূকন্ডসুত তপস্যা কবে সাতকল্প আয়ুর বর পেয়েছিলেন। মহাপ্রলয় কালে সারা সৃষ্টি জলমগ্ন হয়ে গেল। মূকন্ডসুত সেই প্লাবনে ভাসতে ভাসতে এখানে সুরভি মাতার স্থানে আশ্রয় পেয়েছিলেন, আর মাতা সুরভি তার দুধ দিয়ে ক্ষুধার্ত ঋষির প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।
ভুবনবাবুর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়,
সবল হইয়া মূকন্ড-সুনু।
সুরভির প্রতি কহয় পুনঃ।।
তুমি ভগবতী, জননী মোর
তোমার মায়ায় জগৎ ভোর।।
না বুঝিয়া আমি লয়েছি বর।
সপ্তকল্প জীব হয়ে অমর।
প্রলয় সময়ে বড়ই দুখ
নানাবিধ ক্লেশ নাহিক সুখ।।
সুরভি তখন বলিল বাণী।
ভজহ ‘গৌরপদ’ দু’খানি।।
এই নবদ্বীপ প্রকৃতি-পার।
কভু নাশ নাহি হয় ইহার।।
…… …… …….
তুমি মার্কন্ডেয় গৌরাঙ্গ পদ।
আশ্রয় করহ জানি সম্পদ।।
ঋষি মার্কন্ডেয় এই পুণ্যভূমিতে গৌরাঙ্গপদ ভজনা করে সর্বসিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ভক্তগণ জয়ধ্বনি দেয়,
—জয় শচীনন্দন গৌরহরি।
পরিক্রমা চলেছে আবার তার পথ ধরে।
এবার রোদের তেজ বাড়ছে, তবু ভক্তদের চলার বিরাম নেই। ওরা চলেছে এই পথের আশপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে বহু তীর্থ দেবতার অতীতের নিশানা
নৈমিষ্যারণ্য-হরিহরক্ষেত্র, মহাবারাণসীক্ষেত্র এই দ্বীপেই বিরাজমান—তারা সকলেই গৌর লীলা দর্শনের আশায় এই পুণ্য মৃত্তিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
সেই তীর্থ দেবতা—সপ্তর্ষিদের বলেছিলেন শ্ৰীকৃষ্ণ,
স্বল্প দিনান্তরে নদীয়া নগরে
হইবে প্রকটলীলা।
তুমি সবে তবে, দর্শন করিবে
নাম সঙ্কীর্তনে খেলা।।
…… …… ……
ইহার দক্ষিণে দেখহ নয়নে
আছে এক জলাধার।
এইতে গোমতী, সুপবিত্র অতি
নৈমিষ কানন আর।।
এই তীর্থপথের ধারে বিরাজমান বহু তীর্থ, পরিক্রমা চলে সেই পথ ধরেই। এসে উপস্থিত হয় এক জলাশয়ের ধারে, উঁচু টিলার পাশে।
এখানে রোদের তাপ বেশ প্রবলই। ওই ভক্তদের মধ্যে রয়েছে চন্দনাও। ফর্সা-রং দু’দিনেই রোদে-পুড়ে তামাটে হতে চলেছে। খালি পায়ে চলা-অভ্যাস নাই। বড় ঘরের বউ সে। সূর্যের আলো পর্যন্ত তারা কম দেখে। কিন্তু এখানে সে এই দুঃসহ রোদে পথে বের হয়েছে। চলেছে নাম-গান করে, সে দেখবে ঠাকুরের কৃপা পায় কিনা।
ওর কাজের মেয়ে মানদার এসব মোটেই ভালো লাগে না। ন্যাপা সরকারও দু’দিনেই ওইভাবে ঘুরে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। বউদিমণিকে বারবার বোঝাবার চেষ্টা করে ন্যাপা–বউদি, এসব করে লাভ কী! বাবু তো উলটে বেশি চটে উঠেছেন। তিনি আপনাকে ঘরে ফিরে যেতেই বলেছেন। তাহলেই তিনিও কলকাতায় ফিরবেন।
চন্দনা বলে—আমাদের সঙ্গেই যেতে বলুন তাকে কলকাতায়, এখুনিই যদি তিনি যান, আমিও এখুনিও যাব। নাহলে পরিক্রমা শেষই করব। সে যত কষ্টেরই হোক তবু থামব না।
চন্দনা চলেছে ওই রোদে নাম-গান করতে করতে।
আরও যেন নিবিড় বিশ্বাস হয়েছে তার। কালকের রাতের ওই গোকুলের ঘটনাটাও দেখেছে চন্দনা। ডাক্তারও আশা ছেড়ে দিয়েছিল, ওষুধ নাই। গোকুলকে বোধহয় বাঁচানো যাবে না। সবাই ভেঙে পড়েছিল।
কিন্তু ভুবনবাবুই বলেন,
—ডাক্তার-ওষুধ পারে করুক। তোমরা নাম-গান কর। অন্তরমন দিয়ে গৌরাঙ্গকে ডাকো—তিনি দয়াময়। কাতরভাবে ডাকলে তাঁর দয়া ঠিকই পাওয়া যায়!
ওরা সমবেতভাবে নাম গান শুরু করেছিল। চন্দনা দেখেছে ক্রমশ সেই নামধ্বনির প্রভাবেই যেন গোকুল ধীরে ধীরে দৈবী আশীর্বাদে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আর ওষুধও এসে গেছিল। সেই দুঃখের আঁধার রাত্রি কেটে আবার আলো ফুটেছিল করুণাময় গৌরাঙ্গদেবের দয়ায়।
চন্দনাও নিশ্চয়ই তাঁর আশীর্বাদ পাবে।
তাই কাতর কণ্ঠে সেই এই রোদের মধ্যেও নাম-গান করে চলেছে। পায়ে ফোস্কা পড়েছে। সেদিকেও নজর নাই।
চলেছে পায়েল। সেও আজ বিলাস বিভব ছেড়ে নিজের অতীতকে ভুলে এক নতুন সত্তায় পরিণত হতে চায়, দেবতার চরণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অক্ষয় শান্তি পেতে চায় ভোগ নয়, দুঃসহ ত্যাগের মাধ্যমে।
পরিক্রমা চলেছে ওই রোদের মধ্যে।
ওরা গঙ্গার তীরে এসে পড়েছে। আগে পরিক্রমার যাত্রীদের নৌকায় গঙ্গা পার হয়ে পশ্চিম কূলে যেতে হতো, এখন সেই গঙ্গার উপর বিস্তীর্ণ সেতু হয়েছে আর আজকের মানুষ সেই সেতুর নামকরণ করেছে গৌরাঙ্গ সেতু। পাকা রাস্তাটা এখানে পাহাড়ের বুকে চড়াই-এর মতো ঠেলে উঠেছে। রোদে রাস্তার পিচ গলছে।
এতক্ষণ ওরা তবু মেঠো রাস্তা নাহয় কাঁচা মাটির রাস্তাতে এসেছে। এবার ওই বড় রাস্তায় গলা পিচে পা-পুড়ছে তবু পরিক্রমার যাত্রীদের যেন এতটুকু ক্লেশবোধও নেই। কি এক আনন্দে
তারা চলেছে নাম-গান করতে করতে।
মোনা মিত্তিরও চলেছে কি যেন এক মোহের বশে।
তার স্ত্রী-চন্দনাকে ফেরাতে পারেনি। কিন্তু সে নিজে ফেরেনি ওদের তাঁবুতেও।
মোনা মিত্তির পায়েলের সঙ্গে আজ সকালেই দেখা করেছিল। বলেছিল—ঘরে ফিরে চল পায়েল, নাহয় তোমার সঙ্গে চলতে দাও।
পায়েল এবার বদলে গেছে। আর ওই মোনা মিত্তিরের ঐশ্বর্যের তার কোনও প্রয়োজন নেই। ওই টাকাকড়ি, সম্পদ প্রতিষ্ঠার চেয়ে অনেক বড়, অনেক স্থায়ী কোনো সম্পদের সন্ধান সে পেয়েছে। যার জন্য এত দিনের সম্পদের প্রাচুর্যকে আজ মূল্যহীন বলে ভাবতে পেরেছে।
তাই বলে সে মোনা মিত্তিরকে,
—তুমি তোমার বাড়িতে ফিরে যাও মিত্তির মশাই, আমার ভরসা আর করো না। ভুলে যাও আমাকে, আমার পথে আমাকে চলতে দাও। তোমাকে আর চিনি না, চিনতে চাই না।
পায়েল সরে যায়।
মোনা মিত্তিরের জেদ যেন বেড়ে ওঠে।
মোনা মিত্তির আশা ছাড়েনি পায়েলের, জানে পরিক্রমা শেষ হলে পায়েল ঘরে ফিরবেই আর মোনা মিত্তিরও ফিরবে তার সঙ্গে তারই ঘরে। তাই পরিক্রমাতে চলেছে মোনা মিত্তির।
কেমন যেন ভেঙে পড়েছে সে। স্ত্রীকে এড়িয়ে চলে সে আর পায়েল এড়িয়ে চলে মিত্তির মশাইকে। তবু মিত্তির মশাই চলেছে ওই ভাবেই।
রোদে গরমের মধ্যে পথ চলতে কষ্ট হয় তার।
অবশ্য ভূধর তার সহচর তা জানে, তাই বরফঠাণ্ডা বিয়ারের আয়োজনও করেছে। মোনা মিত্তির ফ্লাক্সে তা রেখেছে আর মাঝে মাঝে যেন জলই খাচ্ছে তেমনি ফ্লাক্স থেকে চুমুক মেরে আবার চলতে থাকে। ঈষৎ টলছে।
যুধিষ্ঠির যাত্রীদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ঠাণ্ডা জল নিয়ে ঘুরছে। তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের জলদান করছে। সে দেখে মোনা মিত্তিরকে ওই অবস্থায় পথ চলতে।
মোনা মিত্তির বলে—কি হে ধম্মপুত্তুর, ধূপরোদে ঘুরছ হয়ে যাক এক পাত্তর চিল্ড বিয়ার, মৌজ আসবে হে।
যুধিষ্ঠির দেখছে ওই লোকটাকে, যেন চলন্ত একটা ধ্বংসস্তূপই চলেছে। মোনা মিত্তিরের পাও ঠিক মতো পড়ছে না। দেহটাকে টেনে টেনে চলেছে। পরিক্রমায় এসেছে কিন্তু মুখে নাম-গানও নাই। মদ—মাছ-মাংস সব গিলে চলেছে আর ওই একটা মেয়েছেলেকে ধ্যান- জ্ঞান করে চলেছে রোদ-এর দুঃসহ দাবদাহের মধ্য দিয়ে।
যুধিষ্ঠির বলে,
বাবা, ওই মদ-মেয়েছেলের জন্য এত কষ্ট-সহ্য করে চলেছেন। যদি ওই কষ্টটা ভগবানের জন্য করতেন, ত্যানারও দর্শন বোধহয় পেতেন। এই মোহনেশা ছেড়ে গৌরাঙ্গকে ডাকুন বাবু, তাঁর দয়ায় শান্তি পাবেন। তিনি দয়াময় গো—তাঁকে ডাকলে সব বিপদ অন্ধকার কেটে যায়।
হাসে মোনা মিত্তির। বলে সে,
—তোমাদের গৌরাঙ্গদেব আমার মতো পাপীকে উদ্ধার করবেন না হে। তিনি আমার মতো তুচ্ছ ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেবেন কেন? হোয়াই?
যুধিষ্ঠির তার জবাব জানে না। সে দেখছে ওই ফুরিয়ে যাওয়া মানুষটাকে। অন্তরে কি এক সর্বনাশা নেশার জ্বালা নিয়ে চলেছে ও, কাঞ্চন সে চায়নি, কাচ পাবার নেশাতেই সে চলেছে কি দুর্বার টানে।
নবীন ডাক্তারও দেখেছে ব্যাপারটা। ভুবনবাবু বলেন,
–এ এক উন্মাদনা ডাক্তার, মানসিক রোগই।
নবীন বলে—চাই। মদের নেশা যেমন এ তেমনি নেশা। নাহলে এইভাবে পাগলের মতো চলতে পারে পরিক্রমার সঙ্গে? নামকীর্তনও করে না, মদ খেয়ে টোর হয়ে চলেছে।
মোনা মিত্তির এসবে কান দেয় না।
ও বলে—কারোও বাপের পয়সায় খাই? আর পথ, ও তো সরকারি পথ, ট্যাক্সো দিই পথ চলি। আটকাবে কোন শালা!
সুতরাং মোনা মিত্তির নিজের স্টাইলেই চলেছে একটা বিচিত্র সত্তায় পরিণত হয়ে। তার সহচর ভূধরও রয়েছে সঙ্গে।
চন্দনা দেখে। স্বামীকে সেদিন পথ চলতি অবস্থায় গাছের ছায়ায় বসে বিয়ার পান করতে দেখে এগিয়ে আসে।
বলে চন্দনা—এই অবস্থায় তবু পড়ে থাকবে এখানে?
তাকাল মোনা মিত্তির।
দুপুরের রোদ চনচন করছে। যাত্রীরা চলেছে নামকীর্তন করতে করতে। পথের ধারে বসে আছে মিত্তির মশাই। চোখে নেশার ঘোর। কোনোমতে তাকাবার চেষ্টা করে সে। চন্দনাকে দেখে বলে,
—তুমি! তা স্বামীর কথা শুনে নিজে তো বাড়ি ফিরে যাওনি। পরিক্রমায় চলেছ, আমি চললেই দোষ?
বলে চন্দনা—এর নাম চলা? মাতাল হয়ে ঘুরছ—এর চেয়ে বাড়ি চলো—দোহাই তোমার চন্দনার কথায় বলে মোনা মিত্তির,
মোনা মিত্তির শেষ দেখে তবে যাবে। একটা মেয়েছেলের এত ডাঁট। সেই ডাঁট ভেঙে তবে যাব। তার আগে? নেভার। নট গোয়িং। মোনা মিত্তিরের মরদ কা বাত! হাতিকা দাঁত! বুঝলে!
মোনা মিত্তির ধমকে ওঠে চন্দনাকে।
—নাও গেট আউট। নো ভ্যানতাড়া বিজনেস। যাও—মোনা মিত্তির টলতে টলতে চলছে। চন্দনা হতাশ হয়ে দেখছে ওই বিচিত্র মানুষটাকে।
পরিক্রমা চলেছে গঙ্গার সেতু পার হয়ে, পথটা এখানে অনেক উঁচুতে উঠেছে। এখান থেকে দেখা যায় নিচের প্রবহমান গঙ্গা জলধারা, চারিদিকের সবুজ জনপদ, বিভিন্ন মন্দিরের চূড়া।
অতীতের এক বিস্মৃত যুগ যেন আজও তার ঐতিহ্য নিয়ে বিরাজমান আর এপাশে মায়াপুরে গড়ে উঠেছে একালের চৈতন্যভক্তির পরিচয় নিয়ে নতুন সব মন্দির জনপদ। নিচে প্ৰবাহিতা পুণ্যতোয়া গঙ্গা!
ভুবনবাবু যাত্রীদের শোনাল-
নিত্যানন্দ প্রভু বলে, শুন সর্বজন।
পঞ্চবেদী রূপে গঙ্গা হেথায় মিলন।
মন্দাকিনী অলকা সহিত ভাগীরথী।
সুপ্তভাবে হেথায় আছেন সরস্বতী।।
পশ্চিমে যমুনাসহ আইসে ভোগবতী।
তাহাতে মানসগঙ্গা মহাবেগবতী।।
মহা মহা প্রয়াগ বলিয়া ঋষিগণে।
কোটি কোটি যজ্ঞ হেথা কৈল ব্ৰহ্মা-সনে।।
সেই পুণ্যতোয়া গঙ্গা পার হয়ে পরিক্রমা চলেছে এবার নবদ্বীপ জনপদকে ডাইনে রেখে বাঁ-দিকে সমুদ্রগড়ের দিকে।
বৈকাল হয়ে আসছে। গাছগাছালির আড়ালে দিনের সূর্য অগ্নিবৃষ্টি থামিয়ে এবার নিঃস্ব নিস্তেজ হয়ে বিদায় নিচ্ছে। আকাশ জুড়ে তারই মহিমা—ঘরে ফেরা পাখিদের কলরব ওঠে। পরিক্রমা চলেছে সমুদ্র গড়ের দিকে।
.
৭
দ্বাপরে এই স্থানে সমুদ্রসেন নামে এক পরাক্রমশালী পরম ভক্ত রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন পরম কৃষ্ণভক্ত! এমনি সময় ভীমসেন দিগ্বিজয়ে এলেন বঙ্গদেশে, আর এই সমুদ্রসেন ভাবলেন—ভীমসেন শ্রীকৃষ্ণের আশ্রিত। যদি ভীমসেনকে সত্যিই বিপদে ফেলতে পারেন শ্রীকৃষ্ণ আসবেনই। সমুদ্রসেন তবেই শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পাবেন।
সন্ধ্যা নামছে। যাত্রীদের আজ এখানে বিশ্রাম। মন্দির চত্বরে ভুবনবাবু পাঠ করছেন সমবেত ভক্তদের সামনে।
এত ভাবি নিজ সৈন্য সাজাইল রায়।
গজ-বাজি-পদাতিক লয়ে যুদ্ধে যায়।।
শ্রীকৃষ্ণ স্মরিয়া রাজা বাণ নিক্ষেপয়।
বাণে জর জর ভীম পাইল বড় ভয়।।
মনে মনে ডাকে কৃষ্ণ বিপদ দেখিয়া।
রক্ষা কর ভীমে নাথ শ্রীচরণ দিয়া।।
সমুদ্রসেনের সহ যুঝিতে না পারি।
ভঙ্গ দিলে বড় লজ্জা, তাহা সৈতে নারি।।
ভীতের করুণ, নাদ শুনি দয়াময়।
সেই যুদ্ধ স্থলে কৃষ্ণ হইল উদয়।।
না দেখে সে রূপ কেহ অপূর্ব ঘটনা।
শ্রীসমুদ্র সেন মাত্র দেখে একজনা।।
নবজলধর রূপ কৈশোর মুরতি,
গলে দলে বনমালা মুকুতার ভাতি।
সেই পরম ভক্ত সমুদ্রসেন করযোড়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেন,
কিন্তু মোর ব্রত ছিল, ওহে দয়াময়।
এই নবদ্বীপে তব হইবে উদয়।।
হেথায় দেখিব তব রূপ মনোহর।
নবদ্বীপ ছাড়িবারে না হয় অন্তর।।
সেই ব্রত রক্ষা মোর করি দয়াময়।
নবদ্বীপে কৃষ্ণরূপ হইলে উদয়।।
তথাপি আমার ইচ্ছা অতি গূঢ়তর।
গৌরাঙ্গ হউন মোর অক্ষির গোচর।।
শ্রীকৃষ্ণ রাজা সমুদ্রসেনকে সেই অপরূপ প্রেমময় গৌরাঙ্গ লীলাও দর্শন করিয়েছিলেন, এই সমুদ্রগড় তীর্থে।
তাই এই তীর্থ পরম পবিত্র এক তীর্থ। এখানে ভক্ত সমাবেশে গৌরাঙ্গদেবও পরিক্রমা করেছেন—কয়েক শতাব্দী পরও এই পুণ্যতীর্থে বহু ভক্ত আসেন পরিক্রমায়।
রাত নামছে। ক্লান্ত যাত্রীদল যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়ে বিশ্রাম করছে। পথশ্রমে ক্লান্ত মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়ে।
আজ নরহরিও অনেকটা হাল্কা হয়েছে। সেই বিষয়-চিন্তা আর তাকে বিব্রত করে না। ও স্থির করেই ফেলেছে আর বিষয়-বিষে জড়াবে না নিজেকে।
খুশি হয়েছে কুন্তী। পরিক্রমায় এসে তার মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন তীর্থ দেবতা। আজ তার শূন্য ঘর পূর্ণ হবে কোনো দেব শিশুর আগমনে।
তাই নরহরিও এবার বুঝেছে লোভ নয়, ভোগ নয়, সত্যিকার ত্যাগের পথেই শান্তির সন্ধান করবে সে। ঈশ্বরের এই অহৈতুকী করুণার যোগ্য করে তুলবে নিজেকে প্রায়শ্চিত্ত করে।
ললিতাও আজ পরিক্রমায় এসে শান্তি পেয়েছে। তার ছেলে গোকুল ঠাকুরের দয়ায় সেরে উঠেছে। আরও সুখের কথা নরহরি নায়েব এবার তার নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে তাদের বাড়ি, বেশ কিছু সম্পত্তিও ফিরিয়ে দেবে।
ললিতাকে আর সংসার চালাবার জন্য ভাবনা করতে হবে না। গৌরাঙ্গ দেবের কৃপাতেই এসব সম্ভব হয়েছে। ললিতা তাই অন্তর মন দিয়ে গৌরাঙ্গকে প্রণাম জানায়।
.
পায়েলও সেই গৌরাঙ্গদেবের চরণে নিজেকে উৎসর্গ করে তার সেবায় দিন অতিবাহিত করতে চায়। ভোগবিলাস নয়—ত্যাগের পথেই যেতে চায় সে। তাই পিছনের সব বৈভব-বিলাসকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
রাত্রি নামে। তাঁবুতে সে ওই গৌরাঙ্গমূর্তির সামনে যেন ধ্যানস্থা হয়ে বসে আছে। মনপ্রাণ দিয়ে পায়েল আজ সেই মহাদেবতার চরণে স্থান পেতে চায়। জীবনে এতদিন যা করেছে তা ভুলই, আজ যেন সঠিক পথের সন্ধান করছে সেই দেবতার কাছে। সে একান্ত ভাবে চায় শান্তি, মুক্তি এই মোহবন্ধন থেকে।
চন্দনার ঘর-বাঁধার স্বপ্ন-স্বপ্নই রয়ে গেছে।
বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল, অনেক আশা নিয়েই এসেছিল সে। কিন্তু কোনো আশাই তার পূর্ণ হয়নি। স্বামীকে সে ঘরেই পায়নি। তার স্বামী ঘর ছেড়ে পথে পথেই ঘুরছে অন্য একটা মেয়ের পিছনে, যে তাকেও অবহেলা করে।
তবুও তার স্বামীর মোহভঙ্গ হয়নি।
চন্দনার মনে হয় এ তার নিজেরই অক্ষমতা, স্ত্রী হয়ে স্বামীকে ঘরে ফেরাতে পারেনি। তার স্বামীর যা চাওয়া সেই চাওয়াকে পূর্ণ করতে পারেনি চন্দনা।
তাই সেই পরাজয়টা বারবার ঠেকেছে বড় হয়ে। আর ততই নিজেকে ছোট মনে হয়েছে। তাই এসেছে এত কষ্ট-সহ্য করে চলেছে পরিক্রমায় নাম-গান করতে করতে, বলে—এই পরিক্রমায় এসে গৌরাঙ্গদেবের কৃপা লাভ করে মানুষ। তাদের চিত্তশুদ্ধি ঘটে পায় মনে শান্তির স্পর্শ।
কিন্তু চন্দনা এখনও সেই কৃপা লাভ করেনি। জানে না—আদৌ গৌরসুন্দরের কৃপা সে পাবে কিনা
রাতে ঘুম আসে না।
দিনরাত্রি যেন চন্দনার কাছে একাকার হয়ে গেছে।
রাতেও তাঁবুতে গৌরাঙ্গদেবের ছবির সামনে তন্ময় হয়ে বসে থাকে। ধূপ জ্বলছে—চোখে অশ্রুধারা। গৌরসুন্দরের কাছে তার চাওয়া সামান্যই। পথের ওই মানুষটার সুমতি দাও ঠাকুর, শান্তি দাও। বাঁচার পথ দেখাও ওকে দয়াময় প্রভু!
মানদা দেখছে বউদিদিমণিকে।
এই পূজা-ভক্তির বাতিকটা যেন বাড়ছে ওর। মানদার এসবের কোনো দরকার নেই। খায়-দায় ঘুমোয় সে। তাতেই খুশি। আর শাড়ি-টাকাই তার কাম্য। বলে সে,
—বউদিমণি, রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়। কাল ভোরেই তো আবার বের হতে হবে। সেই রোদে রোদে পথচলা-
চন্দনা বলে—তুই ঘুমো তো। যখন সময় হবে ঘুমোব।
মানদা খুশি হয় না। আর দু’তিনটে দিন পরিক্রমা চলবে। কটা দিন কাটলে বাঁচে সে। উঃ—এমন ধকল হবে জানলে এই পথে আসত না সে। খাওয়া-দাওয়ার জুতও নাই। নিরামিষ সৌপক্ব খেয়ে এই পথচলা। মানদার আক্কেল যথেষ্ট হয়েছে—এপথে আর নেই। এখন কলকাতা ফিরতে পারলে বাঁচে সে।
চন্দনার চোখে—ঘুমও নাই। তার মনোবাসনা কি পূর্ণ হবে না?
.
ছায়াঘন ছোট্ট জনপদ চম্পাহাটি।
সকালে পরিক্রমা এসেছে চম্পাহাটির মন্দিরে। আজ একটি নিস্তব্ধ ছায়াচ্ছন্ন জনপদ। অতীতে এখানে ছিল চম্পক বন। বাতাস চম্পা ফুলের সৌরভে আমোদিত হয়ে থাকত।
এই শান্ত-সুন্দর পরিবেশে থাকতেন কবি জয়দেব আর তাঁর স্ত্রী-পদ্মাবতী। পরম ভক্ত কবিব জয়দেব।
এর আগে তিনি ছিলেন গঙ্গার অপরপারে রাজা বল্লাল সেনের রাজধানীর ওদিকে ছোট কোনও জনপদে।
সেখানেই তিনি দশাবতার স্তোত্র রচনা করেছিলেন। আর তাঁর সেই কাব্য-প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রাজা বল্লালসেন গিয়ে উপস্থিত হলেন কবি জয়দেবের কুটিরে। প্রস্তাব দিলেন—তাঁর মতো প্রতিভাবান কবিকে তিনি সভাকবি পদে বরণ করে রাজসভায় রাখতে চান।
কবি জয়দেব ওই রাজধানীর ভিড়-কলরব, ঐশ্বর্য আর সভাকবির শোভনীয় পদ কোনো কিছুই চান না। তাই ওই কর্মব্যস্ত কোলাহলমুখর জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে গঙ্গার অন্যপারে নির্জন সবুজ চম্পক সুবাসময় এই স্থানে এসে তাঁর কুটির গড়লেন স্ত্রীকে নিয়ে।
এই চম্পকহট্টেই কবি জয়দেব গীতগোবিন্দ রচনা করেছিলেন। তাঁর পূজিত বিগ্রহ আজও এই মন্দিরে পূজিত। মন্দির চত্বরে ভক্তদের কে গীতগোবিন্দের শ্রীকৃষ্ণের বসন্তলীলা কীর্তন করছে মধুরস্বরে-
চন্দনচর্চিতনীলকলেবর পীতবসনবনমালী।
কেলিচলন্মণিকুন্ডল মণ্ডিতগন্ডযুগস্মিতশালী।।
হরিরিহ মুগ্ধবধূনি করে।
বিলাসিনী বিলসতি কেলিপরে।।
করতলতালতরলবলয়াবলিকলিতকলস্বনবংশে।
রাসরসে সহনৃত্যপরা হরিণা যুবতিঃ প্রশংসে।।
শ্রীজয়দেবভণিতমিদমদ্ভুতকেশবকেলি রহস্যম্।
বৃন্দাবনবিপিনে ললিতং বিতনোতু শুভানি যশস্যম্।।
সেই অমর কাব্য সৃষ্ট হয়েছিল এই পরিবেশে আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে। ভক্ত কবিবরের পদরজপবিত্র এই তীর্থে সেদিন ভক্তের আহ্বানে স্বয়ং ভগবান এসেছিলেন তাঁর প্রিয় ভক্তকে দর্শন দিতে। ভগবানকে দর্শন করেন এখানে জয়দেব।
ভুবনবাবুর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়,
—পদ্মহস্ত দিয়া প্ৰভু তোলে দুই জনে।
কৃপাকরি বলে তবে অমিয় বচনে।।
তুমি দোঁহে মম ভক্ত পরম উদার।
দরশন দিতে ইচ্ছা হইল আমার।।
অতি অল্পদিনে এই নদীয়ানগরে।
জনম লইব আমি শচীর উদরে।।
সর্ব অবতারে সকল ভক্তসনে।
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে বিতরিব প্রেমধনে।।
চব্বিশ বৎসরে আমি করিব সন্ন্যাস।
করিব অবশ্য নীলাচলেতে নিবাস।।
তথা ভক্তগণ সঙ্গে মহাপ্রেমাবশে।
শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দ আস্বাদিব অবশেষে।।
তবে বিরচিত গীতগোবিন্দ আমার।
অতিশয় প্রিয়বস্তু করিলাম সার।।
এবে তুমি দোঁহে যাও যথানীলাচল।
জগন্নাথে সেব গিয়া, পাবে প্রেমফল।।
এইখানেই গৌরচন্দ্র দর্শন দিয়েছিলেন কবি জয়দেবকে। প্রভুর নির্দেশে এখান থেকেই জয়দেব
সস্ত্রীক নীলাচল যাত্রা করেন।
প্রভুই দৈববাণী করেছিলেন,
—জগন্নাথে তুমি পুন ছাড়িয়া শরীর।
নবদ্বীপে দুই জনে নিত্য হবে স্থির।।
অর্থাৎ আজও সেই পরমভক্ত কবি যেন এই নবদ্বীপের প্রশান্তির মধ্যে নিত্য বিরাজমান। সন্ধ্যার আকাশে তারা ফুল ফুটে ওঠে। জয়দেব প্রবচন শেষ হয়। ভক্তবৃন্দ জয়ধ্বনি দেয়।
—জয় শচীনন্দন গৌরহরি।
বেশ ক’দিন পথে পথে কেটেছে যাত্রীদের। এই রোদে—নানা অসুবিধার মধ্যে তবু চলেছে পরিক্রমা। বিদ্যানগরে পরিক্রমা সমাগত।
সবুজ ছায়াস্নিগ্ধ একটি জনপদ।
এইখানেই ছিল গঙ্গাদাসের চতুষ্পাঠী। এই বিদ্যানগর বহু প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত জনপদ। ভক্তরা সমবেত হয়েছে অতীতের সেই চতুষ্পাঠীতে। এখনও দেখা যায় সেখানে যেন কলম উলটে রেখেছে কেউ কলমদানের মধ্যে। আর কলম সেগুলো নয়—বর্তমানে এক একটা সোজা নাম না জানা—অচেনা বনস্পতিতে পরিণত হয়েছে। অনেকে বলে ছাত্র নিমাই ওখানে পড়ার সময় কিছু কলম রেখেছিলেন—সেগুলোই এখন বনস্পতিতে পরিণত হয়েছে। ভক্তরা সেই সবুজ-স্নিগ্ধ পরিবেশে নামকীর্তন শুরু করেছে।
কথিত আছে,
—ঋতুদ্বীপ অন্তর্গত এ বিদ্যানগরে।
মৎস্যরূপী ভগবান সর্ববেদ ধরে।।
সর্ববিদ্যা থাকে বেদ আশ্রয় করিয়া।
শ্রীবিদ্যানগর-নাম এই স্থানে দিয়া।।
মহাপ্রলয়কালে মৎস্যরূপী ভগবান সর্ববেদ ধারণ করে এইখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর পরে সর্বঋষিগণ এখানে এই বিদ্যানগরে এসে সর্ব শাস্ত্রাদির পাঠ গ্রহণ করতেন। এই বিদ্যানগরই ছিল অতীতে সর্ববিদ্যাদানের কেন্দ্র।
এই বিদ্যানগরে জন্মেছিলেন চৈতন্যদেবের প্রায় সমসাময়িক বিরাট পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম। তাঁর সম্বন্ধে কথিত আছে,
—এই ধন্য কলি যুগ সর্বযুগসার।
যাহাতে হইল শ্রীগৌরাঙ্গ অবতার।।
বিদ্যালীলা করিবেন গৌরাঙ্গসুন্দর।
গণসহ বৃহস্পতি জন্মে অতঃপর।।
বাসুদেব সার্বভৌম সেই বৃহস্পতি।
গৌরাঙ্গ তুষিতে যত্ন করিলেন অতি।।
প্রভু মোর নবদ্বীপে শ্রীবিদ্যাবিলাস।
করিবেন জানি মনে হইয়া উদাস।।
ইন্দ্রসভা পরিহরি নিজগণ লয়ে।
জন্মিলেন স্থানে স্থানে আনন্দিত হয়ে।।
এই বিদ্যানগরেতে করি বিদ্যালয়।
বিদ্যা প্রচারিল সার্বভৌম মহাশয়।।
বাসুদেব সার্বভৌম পরে নীলাচলে গিয়ে সেখানের রাজপণ্ডিত হন এবং প্রভূত খ্যাতিলাভ করেন এবং পরে শ্রীচৈতন্য নীলাচলে গেলে সেখানে রাজপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম তাঁকে স্বীকৃতি দেন এবং বরণ করে নেন।
নীলাচলে চৈতন্যদেবকে তিনি সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেন। শুরু হয় ভারতের ধর্মজগতের এক নতুন অধ্যায়।
.
পরিক্রমা চলেছে এবার শেষ পর্যায়ের দিকে।
ক’দিন ধরে হাজারো মানুষ চলেছে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়। মাথার উপরে তপ্ত সূর্যের রশ্মি। বালি মাটিভরা গ্রাম্যপথ তেতে উঠেছে। ঠিকমতো খাবার, বিশ্রাম এমনকি পানীয় জলেরও ব্যবস্থা করা যায়নি। অল্পসময়ের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে এসব করাও যায়নি।
অনেক অসুবিধার মধ্যে এই মানুষগুলো দিনরাত কাটিয়েছে। তবু কারো মুখে কোন অভিযোগ নাই—কি এক নির্মল আনন্দে তারা গৌরাঙ্গ লীলার কীর্তন গেয়ে—মহানাম মন্ত্র নিয়ে গ্রামবাংলার পথে পথে ঘুরেছে।
আর এই পরিক্রমার মধ্য দিয়ে যেন তাদের মনের সব গ্লানি, মালিন্যও ধীরে ধীরে মুছে গেছে।
নরহরি এখন যেন অন্য মানুষ। আজ দ্বিধাহীন চিত্তে সে কীর্তনে যোগ দেয়।
মেয়েদের সঙ্গে কুন্তীও মিশে গেছে।
ক’দিন ওরা প্রত্যেকের সুখ-দুঃখের শরিকান হয়ে গেছে চন্দনা চলেছে মুখ বুজে।
দু’চোখে ওর বেদনার অশ্রু। আজও সেই ছন্নছাড়া মানুষটাকে সে ঘরে ফেরাতে পারেনি।
আর পায়েলও মোনা মিত্তিরকে এড়িয়ে গেছে। তবুও মোনা মিত্তিরের জেদ যায়নি। মদের মাত্রাই বেড়েছে আর চলেছে সে।
যুধিষ্ঠির ভোলেনি ওই ছন্নছাড়া মানুষটাকে। ও চলে ওর সঙ্গে।
ওরা আজকের পরিক্রমা শেষ করবে মামগাছিতে।
গঙ্গার তীরের একটি প্রাচীন জনপদ। আজ শেষ রাত্রিবাস এই পরিক্রমার। কাল ভোরে ওরা গঙ্গা পার হয়ে মায়াপুর মন্দিরের দিকে যাবে। সেইখানে শেষ হবে পরিক্রমার।
অদ্য শেষ রজনী।
বৈকাল নামছে, ছায়াঘন পথ। এদিকে গাছপালা একটু বেশি। বাঁশের বন-গাছগাছালির আবেষ্টনীতে সূর্যের আলোও যেন ঢোকে না। বৈকাল—এখুনিই যেন সন্ধ্যার-ম্লান আঁধার ঘনিয়ে আসছে।
পরিক্রমা এসে থামল সারঙ্গদেবের আদি মন্দিরের মাঠে। এর মধ্যে সেখানে গাছগাছালির মধ্যে—ওদিকের ফাঁকা মাঠে তাঁবু পড়ছে।
এদিকে গড়ে উঠেছে বৃদ্ধ এক বকুলগাছের ওপাশে আদি মন্দিরের গায়েই সভামণ্ডপ। সেখানে নাম কীর্তন চলেছে।
এই মন্দিরের নাম সারঙ্গ মুরারীর পার্ট।
ভুবনবাবু ভক্তদের নিয়ে কথকতার আসর বসিয়েছেন।
এই স্থানের প্রকৃত নাম জাহান্নগর। অতীতে নিমাই সহচরদের নিয়ে নৌকা-ভ্রমণে এদিকে আসতেন। আর সারঙ্গদেবের এই মন্দিরেও আসতেন। তখন ওই বকুলগাছও ছিল। বকুলের সুবাসে এখানের বাতাস আমন্থর হয়ে উঠত।
সারঙ্গদেব গোপীনাথ বিগ্রহের সেবা করতেন। পরম ভক্ত এই সারঙ্গদেব।
বয়স হয়েছে, তাই নিমাই তাঁকে বলতেন—বয়স হচ্ছে, তোমার বিগ্রহের সেবা পূজার কাজ চালাবার জন্য একজন শিষ্য খুঁজে নাও। নাহলে তোমার অবর্তমানে এসব দেখবে কে?
সারঙ্গদেব এসব কথা ভাবেননি। এবার নিমাইয়ের কথায় সত্যিই ভাবনায় পড়েন। এদিকে বয়সও হয়েছে তাঁর। সঠিক শিষ্য খুঁজে পাওয়াতো মুশকিল, শেষে কে না কে ঘাড়ে চাপবে। তাই
তিনি বলেন—ঠাকুর এতসব বাছ-বিচার করার সাধ্য আমার নাই। কাল ভোরে প্রথমে যার মুখ দেখব তাকেই মন্ত্র দিয়ে শিষ্য করে নেব।
নিমাইও বলেন—তাই করো।
পরদিন ভোরে গঙ্গাস্নান করতে গেছেন সারঙ্গদেব। স্নানকালে তার কোলে এসে ঠেকে একটি কিশোরের মৃতদেহ। মুণ্ডিত মস্তক—যজ্ঞ উপবীতও রয়েছে। সৌম্যশান্ত চেহারা, যেন ঘুমিয়ে রয়েছে। ওই মুখ দেখে সারঙ্গদেবের মনে বাৎসল্যভাব জাগে। তাঁর মনে পড়ে সেই মন্ত্রদানের কথা। ওই মৃত বালকের কানে মহামন্ত্র দিতে ধীরে ধীরে বালক প্রাণ ফিরে পায়।
ঘাটে বহু লোক স্নান করছিল তারাও দেখে ওই বিচিত্র ঘটনা। চারিদিকে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। নিমাইও পরে এখানে আসেন তখন বালক সুস্থ—কাজকর্ম করছে।
তাকে সাপে কামড়েছিল, সর্পাঘাতে মৃত বালককে তার বাবা-মা জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল, সারঙ্গদেবের কৃপায় সে প্রাণ ফিরে পায়। তার পূর্বাশ্রমের নাম ছিল মুরারী।
তার বাবা-মাও আসেন বালককে নিতে, কিন্তু বালক আর ঘরে ফিরে যায়নি। এইখানেই থেকে দেবসেবায় আত্মনিয়োগ করে সে।
সেই প্রাণপ্রতিষ্ঠার দৃশ্য—নিমাইয়ের আবির্ভাব—তাঁরই অহৈতুকী করুণার কথা আজ কয়েক শতাব্দী আগেকার এক ঘটনা, কিন্তু ওই পুরাতন সিদ্ধ বকুল বৃক্ষ আজও বিদ্যমান সেই সারঙ্গ-মুরারীর ঘাটে। সিদ্ধ বকুল সেই দৈবী কৃপার নীরব সাক্ষী।
ভুবনবাবুর কথকতায় অতীতের সেই ঘটনা যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ভক্তদের সামনে।
মন্দিরে সুগন্ধি ধূপ জ্বলে, আজও যেন সেখানে সেই নিত্যলীলার প্রকাশ চলেছে। ভক্তদের কণ্ঠে জয়ধ্বনি ওঠে,
—জয় শচীনন্দন গৌরহরি।
.