৫
ভুবনবাবুদের এখনও বিশ্রাম জোটেনি।
ভোরবেলাতে বের হয়েছেন পরিক্রমা নিয়ে দিনভোর পরিক্রমা করেছেন। নাম-কীৰ্তন— ভাষণ-প্রবচন দিতে হয়েছে তাঁকে। সবদিকে নজরও রাখতে হচ্ছে যাতে সকলেই প্রসাদ পায়, খাবার জল পায়, মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই পায়। বিশেষ করে মা-বোনদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
সন্ধ্যার পর আস্তানায় ধর্মসভার আয়োজনও করতে হয়। এসব কাজ নিয়ে হিমশিম খান ভুবনবাবু, তবে মন্দিরের সাধু, ব্রহ্মচারীরা এবিষয়ে অনেক পটু। তারাই এসব ব্যবস্থা করছেন আর অনিরুদ্ধের মতো কিছু তরুণ ও তাদের দলবল নিয়ে এসে এসব কাজে হাত লাগিয়েছে। সকলেই ক্লান্ত, আরও ক’দিন বাকি। ভুবনবাবু বলেন,
—ডাক্তার, এরপর দেখবে রোদে-গরমে অনেকে অসুস্থ হবে, তোমার হ্যাপা বাড়বে। আর অসুবিধা তো হচ্ছেই, ফলে অনেকেই সহজে চটে উঠবে।
নবীন ডাক্তার বলে—তবুও বলব, মানুষ এখানে জেনেশুনেই এসেছে যে অসুবিধা হবে। তাই সব কিছুকে মানিয়ে নেবার চেষ্টাই করবে।
ভুবনবাবু বলেন–তবু দেখবে এর ব্যতিক্রমও ঘটবেই। চলো, কাল দুপুরের ক্যাম্প কোথায় হবে—প্রসাদের ব্যবস্থাদি কি আছে দেখে আসি। সেইমতো পরিক্রমার প্রোগ্রাম করতে হবে।
ওঁরা কাজ নিয়েই ব্যস্ত!
.
আর কিছু লোক আছে তারা কাজ নয় অকাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। মোনা মিত্তির তাদেরই একজন। তাঁবুর ওদিকে সে মদ খেয়ে চলেছে—আর যুধিষ্ঠিরও মদের গন্ধ পেয়ে যেন শুঁকে শুঁকে এখানে এসে হাজির।
—বাবু, বাবুমশায় গো। যুধিষ্ঠির ডাকে।
মোনা মিত্তির এর গোলাবি আমেজটা ফিরে এসেছে। ওই ডাক শুনে বলে—কে বাবা?
—আজ্ঞে আমি যুধিষ্ঠির।
—তা এখানে কেন? হস্তিনাপুরে যাও।
এই যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের মহিমার খবর রাখে না। সে বলে,
—আজ্ঞে পেসাদ, মানে চরণামেত্ত পেসাদ দেবেন বল্লেন ওবেলায়, তাই এলাম আজ্ঞে!
মোনা মিত্তির এবার চেয়ে দেখে, আবছা আলোয় চিনতে পারে সেই মূর্তিকে—এসেছ বাবা! একটু আগে যে দেখলাম জুয়োর ছকে জোর দান মারছ!
যুধিষ্ঠিরও তো জুয়াখেলাতে সবই হেরেছিল, তা তুমি বাবা জিতলে না ‘ফুস্’?
যুধিষ্ঠির জানাতে পারে না আসল ব্যাপারটা। বলে সে,
—হেরেই গেছি, তবে ওই বাজি ঠিকই জিতব!
—সাবাস! এই তো চাই। আমাকেও ওই পায়েল রোজই তাড়াতে চায়, দ্যাট নাচনেওয়ালি। আমি বাবা মিত্তির বংশের ছেলে, যা চাইব তা নেবই। ছলে-বলে-কৌশলেও নেব। তাই লড়ে যাচ্ছি। নাও।
বোতলটা নামিয়ে দেয়। যুধিষ্ঠিরের নজর পড়ে মোনা মিত্তিরের গলার দামি সোনার চেনটার দিকে। নিরিবিলিতে মদের নেশাটা ওর বাড়িয়ে দিতে পারলে ও ঝিমিয়ে পড়বে, আর সেই অবকাশে যুধিষ্ঠির ওই দামি হারটা হাতাতে পারবে।
যুধিষ্ঠির বেশি মদ খেয়ে মাতাল হতে চায় না। তাই অল্প একটু খেয়ে গ্লাসে বাকিটা ঢেলে দেয় মোনা মিত্তিরকে।
—নিন বাবু। দারুণ জিনিস।
মোনা মিত্তির হাসে। বলে সে,
—মোনা মিত্তির ভালো মালই খায় হে। যা-তা জিনিস ছোঁয় না।
চোখ-বুজে আসছে মোনা মিত্তিরের। বলে সে,
—কী নাম বললে? যুধিষ্ঠির—হ্যাঁ, খাও হে, খাও।
যুধিষ্ঠির যত না খায়—বাবুকে তার চেয়ে বেশি মাত্রায় গেলায় আর মোনা মিত্তিরও ঝিমিয়ে আসছে মদের নেশায়।
যুধিষ্ঠির এমনি সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। মোনা মিত্তির ঝিমিয়ে পড়তে এবার আবছা অন্ধকারে দুই আঙুলের চাপে মোনা মিত্তিরের গলার হারটাকে খুলে নিয়ে ফতুয়ার পকেটে পুরে চুপচাপ উঠে বের হয়ে যায় যুধিষ্ঠির।
.
পায়েলের মনে এবার একটা প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। বারবার মনে হয়েছে তার, যে এইভাবে চলতে পারে না। তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। যে জীবনকে পিছনে ফেলে এসেছে সেখানে আর ফিরে যাবার বিন্দুমাত্র বাসনা তার নেই। তাই ওই মোনা মিত্তিরকে আর সঙ্গে রাখবে না সে।
আজ সন্ধ্যায় দেখেছে ওর স্ত্রীকে। তার চোখের জলই যেন পায়েলকে এই সিদ্ধান্ত নিতে জোর এনে দিয়েছে তার মনে।
পায়েল সন্ধ্যায় মন্ডপে ধর্মসভায় বসেছিল। দেখেছে সে ওই সৌম্যদর্শন সাধু আনন্দ মহারাজকে, তাঁর কথাগুলোও কানে বাজে,
—তাঁর চরণে শরণ নাও, তিনি দয়াময়, তাঁর কৃপায় সব তাপ-সন্তাপ দূর হবে।
জীবনের পথটাই যেন বদলে গেছে এবার পায়েলের। সে আর পার্থিব জ্বালার মধ্যে থাকতে চায় না, সংসারের মোহ থেকে মুক্ত হয়ে সে নতুন করে বাঁচতে চায় ওই গৌরাঙ্গ চরণে স্মরণ নিয়ে
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আরতির পর্ব চুকে গেছে। পায়েল তাঁবুতে ফিরেছে। তখন সবে মোনা মিত্তিরের সেই মদের নেশা ছুটেছে। জাতে মাতাল হলেও মোনা মিত্তির তালে ঠিকই আছে। তাই নেশা ছুটতেই খেয়াল হয় তার গলায় হারটা নেই। মোনা মিত্তির তার চাকর ভূধরকে ও বলে,
—টর্চটা আন। দেখ তো খুঁজে গলার হারটা এখানে পড়েছে কি না!
খোঁজাখুঁজি করেও পায় না। ভূধরই বলে
—এতদিন পড়েনি, আজ পড়ে যাবে হারটা? এ হতে পারে না। কেউ খুলেই নে গেছে বোধহয় গলা থেকে।
—মানে! চমকে ওঠে মোনা মিত্তির গজগজ করে—খুলে নে যাবে আমার গলা থেকে! অতবড় হিম্মত! কে সে?
ভূধরই বলে—তখন নেশার ঘোরে ছিলেন, সেই লোকটা এল।
কি যেন নাম—যুধিষ্ঠিরই।
মনে পড়ে মোনা মিত্তিরের, হ্যাঁ যুধিষ্ঠির বসেছিল মদ খেতে, আর ব্যাটা এতবড় বেইমান যে তারই মদ খেয়ে তার গলার সোনার চেন নিয়ে পালাবে!
মোনা মিত্তিরের নীলরক্ত জেগে উঠেছে, তার নেশাও ছুটে গেছে।
এসে পড়ে পায়েল। সব শুনে সে বলে,
—কী করবে? তাকে পাবে কোথায়? তার চেয়ে যা গেছে যাক—
তুমিও আর এ নিয়ে অশান্তি করো না মিত্তির মশাই। তীর্থপথে এসে এসব নাই বা করলে?
মোনা মিত্তিরের বৈষয়িক মন লাভ-ক্ষতির, মান-অপমানের চুলচেরা হিসাবই করে। তাই বলে সে,
—মোনা মিত্তিরকে টুপি পরাবে সে ব্যাটা এখনও মায়ের গর্ভে রয়েছে। ভূধর, চল তো। দেখি তো ব্যাটাকে।
পায়েল বলে—অশান্তি করো না এখানে। গোলমাল অশান্তি যেন না হয়।
—করবে না? ইয়ার্কি! আমার সঙ্গে!
মোনা মিত্তির অন্য সহচর, ভূধরকে নিয়ে হনহন করে বের হয়ে গেল রাতের অন্ধকারেই। একটা হেস্তনেস্ত করবেই সে। যুধিষ্ঠিরকে তার চাই।
.
যুধিষ্ঠির ফিরছে, তখন রাত নেমেছে।
দিনভোর রোদে-পুড়ে হেঁটে পরিক্রমা করে তীর্থযাত্রীর দল এবার রাতের খাওয়ার পর্ব যে যার মতো সেরে নিয়ে শুয়ে পড়েছে অনেকেই। তাঁবুগুলোর সামনের পর্দা বন্ধ, গাছতলাতেও খড় বিছিয়ে অনেকে গড়াগড়ি দেবার আয়োজন করছে। বড় মন্ডপেও বহুজন আশ্রয় নিয়েছে।
যুধিষ্ঠিরের মনে খুশির সুর। আজ রোজকার ভালোই হয়েছে—আর ওই বাবুটি টেরও পাবে না। যুধিষ্ঠির খুশির ধমকে গাছতলার দোকান থেকে মাটির বড় ভাঁড়ে চার টাকার ঘুগনি আর গোটা দুয়েক পাউরুটি কিনে নিয়ে আসে সেই গাছতলায়।
রামু আর সে দুজনে ওই গাছতলাতেই আশ্রয় নিয়েছে।
তখনও রামুর জুয়ার ছকের সামনে দশ বারোজন লোক গোল হয়ে বসে জুয়া খেলছে, গ্যাসের আলোয় রামচন্দ্র চামড়ার খোলে গুটিটা পুরে নাড়া দিচ্ছে আর চেল্লাচ্ছে,
—ধৰ্ম্মের গুটি ঠিকঠাক পড়বি বাবা। জয় ভানুমতীর জয়—গুটিটা পড়ে। মাত্র একটা নম্বরই ওঠে—সেই ঘরের টাকা দ্বিগুণ হয়ে ফেরত দিতে হবে খদ্দেরকে। বাকি সব টাকা জুয়াড়ির। দেখা যায় যে ঘরে কোনো দানই কেউ দেয়নি—নাহয় সবচেয়ে কম দান পড়েছে, গুটি ঠিক সেই ঘরেই পড়ে।
সামান্য কিছু ফেরত পায় দু একজন, বাকি সকলেরই টাকা গায়েবই হয়ে যায়। রামচন্দ্র আজ অনেকের টাকাই জিতেছে, অবশ্য ওরা বলে জোচ্চুরি করে রামচন্দ্র, ওর গুটিতে জাদু আছে।
নানা মন্তব্যই করে ওরা জুয়ায় হেরে গিয়ে আর রামুকে যে উচিত শিক্ষা দেবে, সেটাও প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে।
রামু অবশ্য ওসব কথা কানে তোলে না। সে বলে-এতো ধম্মের দানা বাবু, এতে হঞ্চতত্ত্ব কিছুই নাই। খেলতে আসো কেনে হে? না এলেই তো পারো। কথাটা মিথ্যা নয়। তবু ওরা খুশি নয় রামুর উপর।
যুধিষ্ঠির এসেছে খাবার আর মদের একটা বোতল নিয়ে।
আসর তখন প্রায় ফাঁকাই। যুধিষ্ঠির বলে,
—নে রাম, মাল খা—রুটি ঘুগুনিও এনেছি। বোস।
—রামচন্দ্র ছক তুলে এবার হাত-মুখ ধুয়ে মদের বোতল নিয়ে বসে।
যুধিষ্ঠির বলে—জুটে গেল। নে—
দুজনে বেশ জমিয়ে মদ্যপান করছে, যুধিষ্ঠির আজ ঘটাও করেছে। ঘুঘনি-রুটি ছাড়া কিছু ঝাল চানাচুর, আলু ভাজা—আরও কি সব ছিল মদের চাট হিসাবে।
হঠাৎ এমনি সময় অন্ধকার ফুঁড়ে মোনা মিত্তির—ভূধরকে নিয়ে এসেছে। সে মদ আর খাবার দেখে এবার রাগে ফেটে পড়ে।
যুধিষ্ঠির ভাবেনি যে মিত্তির মশাইয়ের নেশা এত ঠুনকো—যে হারের শোকেই তা ছুটে যাবে, আর হুঁশ-জ্ঞানও এমন টনটনে যে ঠিক হিসাব করে খুঁজে খুঁজে রামু জুয়াড়ির ঠেকেই এসে তাকে ধরে ফেলবে। গর্জে ওঠে মোনা মিত্তির,
—এই যে ব্যাটা সিঁটকে চোর, মোনা মিত্তিরের চোখে ধুলো দিয়ে হার নে পালাবি? বের কর হার।
যুধিষ্ঠিরও কম যায় না। নিখুঁত অভিনয় করে সে—
—হার। কার হার বাবু? কোনো হারের খবর আমি জানি না। মাইরি বলছি—
মোনা মিত্তিরও এবার ওর গালেই সপাট একটা থাপ্পড় কষে গর্জায়—বের কর হার। নাহলে পুলিশে দেব ব্যাটাদের। ভূধর—
দে ব্যাটাকে দু’চার ঘা-
রামচন্দ্র বলে—খামোকা মারাছেন কেন? বলছে লেয়নি—
মোনা মিত্তিরের ওই হাঁক ডাকে এর মধ্যে লোকজন বেশ জুটে গেছে।
মোনা মিত্তির বলে–চোরের সাক্ষী জুয়াড়ি, দুটোই একদলের, ওটাকেও দে ঘা-কতক। ব্যাটারা তীর্থস্থানে এসেও চুরি জুয়াচুরি করবে।
ভূধরও খপ করে যুধিষ্ঠিরকে ধরে তার ফতুয়ার পকেট থেকে হারটা বের করে।
যুধিষ্ঠির ওটাকে সরাবার কথা ভাবেনি। এবার হাতে-নাতে ধরা পড়ে যেতে আশপাশের লোকজনও এবার খেপে ওঠে। ওই রামুর উপর রাগ তাদের ছিল। জুয়ার আসরে তাদের সর্বস্বান্ত করেছে, মৌকা পেতে তারাও সমবেতভাবে এবার যুধিষ্ঠির আর রামুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের উত্তম-মধ্যম দিতে থাকে আচ্ছাসে।
যুধিষ্ঠির—রামচন্দ্র নিজেদের রক্ষা করায় পথও পায় না, পালাবার পথও বন্ধ। তাদের সবাই ঘিরে ধরে পেটাচ্ছে। হঠাৎ সকলেরই যেন দাবি চোর-জুয়াচ্চোর মুক্ত করবে সমাজকে। তাই নিষ্ঠা ভরে পিটিয়ে চলেছে তাদের।
হইচই কলরব ওঠে। সারা তাঁবু মণ্ডপ—গাছতলার লোকজনও জেগে গেছে। ফাঁকা মাঠ কে রটিয়ে দেয়—ডাকাত পড়েছে।
মেয়েরাও জেগে ওঠে।
অনিরুদ্ধ তার দলবল নিয়ে রাতের বেলায় এই অস্থায়ী জনবসত পাহারা দিচ্ছিল। ওই হইচই শুনে তারাই ছুটে এসে দেখে জনতা দুটো লোককে পেটাচ্ছে। পিটিয়ে প্রায় আধমরা করে এনেছে। অবশ্য মোনা মিত্তির চতুর, সাবধানী লোক। হার নিয়ে ঘা কতক দিয়ে সে সরে গেছে, আর তারপর পাবলিক ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর।
অনিরুদ্ধ নবীন ডাক্তার আর অন্যরা এসে থামায় ওদের।
অনিরুদ্ধ বলে—নাহয় চুরিই করেছে, তাই বলে মেরে ফেলবে? ছাড়ো ওদের।
কোনরকমে জনতার হাত থেকে ওদের দুজনকে উদ্ধার করে তারা।
জনতাও ধীরে ধীরে কেটে পড়ে।
.
খবরটা পেয়েছে পায়েলও। সারা এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়েছে। কলকাতার বাবু দলবল নিয়ে গিয়ে দুজনকে মেরেছে।
পায়েল জেগে গেছে। কোলাহল শোনা যায়।
দেখে বীরদর্পে মোনা মিত্তির ফিরছে। হাতে সেই উদ্ধার করা হারটা।
মোনা মিত্তির পায়েলকে বলে,
—মোনা মিত্তিরকে টুপি পরাবে? ব্যাটাকে পিটিয়ে লাশ করে মাল উদ্ধার করে এনেছি। এই যে—
হারটা দেখায় মোনা মিত্তির। পায়েল বলে,
—হার তো পেয়েছ মিত্তির মশাই, এবার ওইসব নিয়ে এখান থেকে বিদায় হও। তোমাদের বড়লোকপনা, ধনসম্পদ নিয়ে তোমরা কলকাতার মানুষ সেখানেই থাক গে। গরিব মানুষদের লোভে ফেলে চোর বানিয়ো না। কালই ফিরে যাও।
মোনা মিত্তির বলে, একা ফিরে যেতে তো আসিনি পায়েল।
একাই ফিরে যাবে। না যাও আমার এখান থেকে চলে যাবে। কাল সকালে যেন তোমাকে আমার তাঁবুতে না দেখি। এই আমার শেষ কথা। এসব ঝামেলা আমি পছন্দ করি না।
মোনা মিত্তির বলে—ঠিক আছে, তাই হবে। আমি যাই কিনা সেটা আমার ব্যাপার। তোমার তাঁবুতে থাকব না। মোনা মিত্তির কারোও দয়ায় দিন কাটায় না বুঝলে? সে তার হক্ ছিনিয়ে নিতে জানে। যা করার নিজেই করবে, তোমার ভরসায় সে থাকবে না তোমার তাঁবুতে।
পায়েল দেখছে ওকে। বলে সে,
—তাই করোগে মিত্তির মশাই। আমার এখান থেকে গেলেই খুশি হবো।
মোনা মিত্তিরের আত্ম-সম্মানে বাজে ওর কথাগুলো। সেও তাই চটে উঠেছে।
.
নৃপেন সরকার করিতকর্মা লোক। সে পরিক্রমায় এসেছে বউমণিকে নিয়ে। আর তার জন্য সব ব্যবস্থাই করেছে সে। আলাদা তাঁবুও ভাড়া করেছে। সেখানে মানদা রয়েছে বউমণির সঙ্গে। সন্ধ্যায় খাবার-দাবারও সংগ্রহ করে দিয়ে এসেছে ওদের তাঁবুতে। নিজে সরকার মশাই ওই বড় মণ্ডপের একপাশে শোবার ব্যবস্থা করেছে।
মানদা এখানে এসে মোটেই খুশি নয়। সামান্য অসুবিধাগুলো নিয়ে চন্দনা কোনো কথাই বলে না—কিন্তু মানদা গজগজ করে।
—কালও ওই রোদে ঘুরতে হবে মাঠে মাঠে, তারপর শুনলাম জলঙ্গি নদী পার হয়ে ওপারে স্বরূপগঞ্জের দিকে যাবে, কাল রাত কাটাতে হবে ওপারেই কোথায়।
চন্দনা চুপ করেছিল। তার চোখের সামনে তার স্বামীর চেহারাটা ভেসে ওঠে। পথে পথে ঘুরছে মানুষটা একটা বাজে মেয়ের সঙ্গে তাই শুনেছে। আজ এখানেও এসেছে তারই সঙ্গে তার স্বামী।
চন্দনা বারবার অনুরোধ করেছিল মিত্তির মশাইকে তার সঙ্গে ঘরে ফিরে যেতে। কিন্তু লোকটা যেন কি নেশার ঘোরেই রয়েছে। কিছুতেই ফিরে যাবে না মোনা মিত্তির।
সে বরং স্বামীত্বের দাবিতে তাকে শাসনই করেছে, ঘরের বউ হয়ে তাদের বংশে যা কেউ করেনি সেই কাজ করেছে চন্দনা। তাকে ঘরে ফিরে যেতেই বলেছে বারবার করে।
চন্দনা সরে এসেছে। ওই কথা সে মানবে না।
স্ত্রী হিসাবে স্বামীর উপর তার কোনো অধিকারই নেই—তাকে সব অন্যায়-সহ্য করে মুখ বুজে থাকতে হবে। এ আর হতে দেবে না চন্দনা, সেও শিক্ষিত মেয়ে, ন্যায়-অন্যায় সেও বোঝে।
তাই চন্দনাও স্থির করেছে সে স্বামীকে না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। ওই পরিক্রমাতেই থাকবে কদিন। শেষ অবধিই দেখবে চেষ্টা করে।
মানদা মুখে পান সুগন্ধি জর্দা পুরে বলে,
—কালও যাবে পরিক্রমায়?
চন্দনা এতক্ষণ চুপ করে ওর পাকা প্রতিবাদ, বেজার-বিরক্তির কথাগুলো শুনছিল! চন্দনা বলে,
—এত লোক যাচ্ছে সব কষ্ট-সহ্য করে। আর তুই এমন কোন্ মহারানি যে এটুকু সহ্য করতে পারবি না? তোর যদি অসুবিধা হয় যাসনে। তোর দেশের বাড়িতেই ফিরে যাবি। কাছেই তো। আর তোকে কলকাতাতেও যেতে হবে না। এখানেই থাকবি।
মানদা বউদিমণির কাছ থেকে এমনি কড়া জবাব আশা করেনি। একেবারে চাকরি ছাড়ার নোটিশই দিচ্ছে বউদিমণি। মানদা চমকে ওঠে।
বলে সে এবার—না-না। আমার কষ্টের কথা বলছি না বউদিমণি। বলছি—আপনার তো এসব সহ্য করা অব্যেস নাই।
চন্দনা বলে—আমার কথা তোকে ভাবতে হবে না। নে শুয়ে পড়। কাল ভোরে উঠতে হবে। সূর্যোদয়ের আগেই পরিক্রমা শুরু হবে।
.
কেষ্টচরণ, কানাই-রাধু মোড়লের দল এসেছে গ্রাম থেকে এই পরিক্রমায় বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। তাদের বুকে এক তীব্র অগ্নিজ্বালা জ্বেলেছে ওই লোভী নরহরি বিশ্বাস।
মানুষগুলো ছিল নিরীহ, সৎ। মাঠে খেটে কোনোমতে তাদের সংসার চালাত। সেই সংসারকে তছনছ করেছে নরহরি। ওদের জমি-বাড়ি-ঘর সব দখল করে নিয়েছে। ওদের মনে এসেছে তীব্র এক প্রতিহিংসার জ্বালা।
এই নাম-কীর্তন—সাধুসঙ্গ-প্রসাদ তাদের চিত্তের সেই অগ্নিজ্বালাকে কোনো অংশেই কমাতে পারেনি। বরং তীব্রতর করে তুলেছে। ওরা দেখেছে নরহরির বিলাস—তার বৈভব। ওইসব এসেছে তাদের মতো শত শত গরিবকে সর্বহারা করে। ওই শয়তাদের ভণ্ডামির শেষই করবে তারা।
রাত নামে। তাঁবু বসতে নেমেছে ঘুমের আবেশ। ক্লান্ত মানুষগুলো যে যেখানে পেরেছে শুয়ে পড়েছে।
নরহরির তাঁবুর আলো নেভানো। নরহরি ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি করেনি। তাঁবু-ক্যাম্প খাট-বিছানা সব ভাড়া করেছে—আরামের কোনো অভাবই রাখেনি সে।
ঘুমোচ্ছে সে। কোমরে তার টাকার থলি। ওটা দেহের সঙ্গেই বেঁধে রেখেছে। বিশাল দেহ—নাকের বাদ্যিও তেমনি। ওদিকে ক্যাম্প-খাটে কুন্তী শুয়ে আছে।
ক্লান্ত সে। ঘুমিয়ে পড়েছে।
কানাই আর রাধু ঢুকেছে তাঁবুতে, বাইরে পাহারা দিচ্ছে কেষ্টচরণ। এদিকের আলোগুলো নেভানো। সাবধানে ঢুকেছে ওরা।
হাতে ধারালো ভোজালি। কানাই অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে নরহরির বিছানার দিকে। হঠাৎ পায়ে লেগে একটা থালা সশব্দে পড়ে যেতে ধড়মড়িয়ে ওঠে কুন্তী।
—কে! কে ওখানে?
কানাই-রাধু ভাবেনি যে এইভাবে বউটা জেগে উঠবে থালা পড়ার শব্দে। ওর ডাকে ঘুম ভাঙে নরহরিরও। সেও উঠে পড়ে। বেগতিক দেখে কানাইরা দুজনে ছায়ামূর্তির মতো বের হয়ে যায় দ্রুতবেগে।
কুন্তী চিনতে পারে না তাদের। তবে দেখেছে দুটো মূর্তিকে। আলো জ্বেলেই চমকে ওঠে, বিছানার ধারে পড়ে আছে একটা ভোজালি।
নরহরি অবাক হয় ভোজালিটা দেখে,
—এটা এখানে কী করে এল?
কুন্তীও দেখেছে সেটাকে। ভোজালিটা তুলে নিয়ে বলে কুন্তী নরহরিকে,
—বহু লোকের সর্বনাশ করেছ—এবার বন্ধ করো ওসব। তারাই তোমার পিছনে ধাওয়া করে এখানেও এসেছে। আজ একটা চরম ফাড়া গেছে তোমার ঠাকুরের কৃপায়। তাই বলছি—ওগো এবার সাবধান হও। আর কারো বিষয়-আশয় অন্যায়ভাবে দখল করে নিও না, আর শত্রু বাড়িয়ো না।
নরহরি তখন গর্জাচ্ছে—এত বড় হিম্মত আমার তাঁবুতে ঢোকে ভোজালি নিয়ে। এর বিহিত আমি করবই।
কুন্তী বলে—আর বীরত্ব দেখিয়ে কাজ নাই। থামো এবার, যা বললাম তাই করো।
নরহরির বীরত্ব অবশ্য তাতেও থামে না। শূন্যে দু’হাত তুলে সে আস্ফালন করে বীর- বিক্রমে।
কানাইরা কোনোমতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে ওপাশের একটা গাছের নিচে অন্ধকারে শুয়ে পড়ে। তাদের বুক ঢিপ ঢিপ করছে।
কেষ্ট বলে—বউটা জেগে উঠে চেল্লাবে তা ভাবিনি। জোর বেঁচে গেল ব্যাটা নরু আজ।
কানাই বলে—আজ বাঁচল, তবে মৌকা পেলেই ওকে শেষ করে দেব। এখান থেকে ফিরতে দেব না খুড়ো।
কেষ্ট বলে—চুপ করে থাক। অন্ধকারে কে কোথায় শুনে ফেলবে। নে শুয়ে পড়—রাত হয়েছে।
ওরা শুয়ে পড়ে।
.
চুরিবিদ্যা শিখতে গেলে গুরু শরণ করা চাই। এ-তো গুরুমুখী বিদ্যা।
গুরুকৃপা ছাড়া এই বিদ্যাতেও পারদর্শী হওয়া যায় না। আর চুরিবিদ্যা শিখতে গেলে আর একটা বিদ্যাও শিখতে হয়, মার খেয়েও মার হজম করা। এইটা খুবই কঠিন। এতে প্রাণায়াম-ন্যাস এসবও করতে জানতে হয়। তাই যখন পাঁচ পাবলিকে প্যাঁদানি দেয় নির্মমভাবে, মনে হয় চোর ব্যাটা বোধহয় মরেই যাবে, কিন্তু দেখা যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই চোর বাবাজি আবার ঠিক হয়ে গেছে।
অবশ্য তখন কৌতূহলী দর্শকরাও সব সরে গেছে।
ওই জুয়াড়ি রামচন্দ্রের অবশ্য মার সহ্য করার বিশেষ ট্রেনিং তেমন নেই, তাই মারটা সে তখনও হজম করতে পারে না। পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে।
—জল! একটু জল!
যুধিষ্ঠিরই ওদিককার একটু জলের কুঁজো থেকে জল সংগ্রহ করে নিজেও খায় আর রামচন্দ্রকেও দেয়। রামচন্দ্র জলটুকু খেয়ে কাতরাতে থাকে।
যুধিষ্ঠির শুধোয়—কেমন আছো রামুদা?
রাম জবাব দেয় কোনমতে—আর নাই রে। হাড়গোড় বোধহয় ভেঙে দিয়েছে। ঢের হয়েছে, আর জুয়া খেলায় নাই। উঃ—
যুধিষ্ঠির ওর কথাগুলো শুনছে।
রামচন্দ্র জুয়ার ব্যবসা ছাড়তে পারে, তার অন্য ব্যবসা আছে। সরকারি মদের দোকান থেকে ও ভালোই রোজগার হয়। ওর চলে যাবে কিন্তু যুধিষ্ঠিরের পথ আর নাই। ভাবছে সে।
সামান্য সঞ্চয় যা ছিল তা ওই পাবলিক লোক মারধর করার সময়ই ম্যানেজ করে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ চোরের ধনে বাটপাড়ি করার লোকের অভাব এ সংসারে নেই। এখন যুধিষ্ঠিরের খাবার পয়সাও নেই। জামাটাও ছিঁড়ে গেছে আর চাদরটা ভোরে লাগে এখনও ফাঁকায়, সেই চাদরখানাও কে নিয়ে সরে পড়েছে। ঠাণ্ডাও লাগে এবার যুধিষ্ঠিরের মাঝরাতে।
সবচেয়ে ভাবনার কথা যুধিষ্ঠিরের পয়সা চাই, না হলে সকালে এক কাপ চা-ও জুটবে না।
.
তাঁবু বসত শুনশান।
রাতও গভীর হয়েছে। গঙ্গার জলো হাওয়া এখানে ঠাণ্ডার আমেজ আনে। কেউ তাঁবুতে—কেউ গাছতলায় যে যেখানে পেরেছে শুয়ে পড়েছে আর দিনভোর পরিশ্রমের ফলে ঘুমও এসে গেছে তাদের।
নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে তারা। ঘুম নেই যুধিষ্ঠিরের। মারধোর খাবার পর সামলে নিয়ে আবার বের হতে হয়েছে কিছু মালকড়ির সন্ধানে। নাহলে কাল তার খেতেও জুটবে না। পেট বড় বালাই, তার জন্য যুধিষ্ঠিরও আজ চোর সেজেছে। চলেছে সে—চোখ-কান খোলা রেখে শিকারের সন্ধানে।
আনন্দ মহারাজ মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমোন। শেষ রাতে উঠে পড়েন। তখনও শুকতারা জেগে থাকে পশ্চিম আকাশে। গঙ্গার বুকে কুয়াশার আভাস।
তাঁবু বসত তখনও ঘুমেও মগ্ন।
আনন্দ মহারাজ হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে একটা ছায়া মূর্তিকে দেখতে পান। তাঁর তাঁবুর পর্দা খোলাই থাকে কেউ বোধহয় ঢুকেছে।
মহারাজ বলে ওঠেন—কে! কে ওখানে?
যুধিষ্ঠিরের বরাতই খারাপ। সে ভাবেনি যে সাধু মহারাজদের কুঠিতে চুরি করা এক ঝামেলার কাজ। কারণ তাঁরা রাতে বেশি ঘুমোন না। যখন তখন জেগে ওঠেন। যুধিষ্ঠির এবারও যেন ধরা পড়ে যাবে আর তেমনি প্রহার জুটবে তার বরাতে। তাই যুধিষ্ঠির বলে ওঠে,
—আ-আমি মহারাজ। মাইরি, চুরি করিনি।
আনন্দ মহারাজ এর মধ্যে ল্যাম্পটা জ্বালেন। যুধিষ্ঠির অবশ্য অন্ধকারে হাতড়েই এর মধ্যে ক্যাম্প টেবিলের উপর রাখা কিছু টাকা হাতিয়েছে আর সেটাকে তখনও পকেটে চালান করতেও পারে নি। হাতেই রয়েছে টাকাটা। মহারাজ স্মিতহাস্যে বলেন-না-না। চুরি কেন করবে? টাকার দরকার তাই নিয়েছ বাবা।
যুধিষ্ঠির চুপসে যায়। ভয়ও হয় তার। এবার সাধু-মহারাজ তার চ্যালাদের ডাকবেন আর তারা চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটে যুধিষ্ঠিরকে ফালা ফালা করে দেবে।
কিন্তু তা হয় না। অবাক হয় যুধিষ্ঠির।
মহারাজ বলেন—শোনো বাপু, আরও কিছু টাকা দিয়ে গেছে একজন ভক্ত। সেটা নিয়ে ও আবার কে কি বাধাবে তার চেয়েও ওটাও নিয়ে আমাকে নিশ্চিন্ত করো বাবা। নাও—টাকাটা। তোমার কাজে লাগবে।
সাধু-মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে আর শ’খানেক টাকাই দেন।
যুধিষ্ঠির টাকাটা নিয়ে এবার কেটে পড়ার চেষ্টা করে। বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। মানুষের মন বলে কথা! বদলে যেতে কতক্ষণ! আর বদলে গেলেই যুধিষ্ঠিরের অবস্থাও বদলে যাবে। তাই যুধিষ্ঠির চলে আসার চেষ্টা করতে সাধু মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে ভোরের শীতে কাঁপতে কাঁপতে দেখে বলেন,
—শোনো বাবা!
যুধিষ্ঠির তাকাল। মহারাজ ততক্ষণে ওদিক থেকে একটা প্লাস্টিকে মোড়া একটা নতুন কম্বল বের করে বলেন
—শীতে যে কাঁপছ! চাদরও নাই তোমার?
চাদরটা যে কেউ প্রহার দিয়ে কেড়ে নিয়ে গেছে সেটা জানাতে পারে না।
বলে সেনা—ইয়ে!
সাধু বলেন—এক ভক্ত সেদিন এই কম্বলটা দিয়ে গেল। তা বাবা—একখানা কাঁথাতেই আমার চলে যাচ্ছে, এই ভূতের বোঝা নিয়ে কী করব! পথে পথে ঘুরি, এসব বোঝা কেন? তাই এটা তুমি নিয়ে যাও, গায়ে দেবে। আমার তো এতে দরকার নাই। তবু তোমার কাজে লাগবে। নাও বাবা। নাও—গায়ে দাও, শীতে কাঁপছ।
সাধু যুধিষ্ঠিরকে সেই নতুন কম্বলখানাও দিয়ে দেন। যুধিষ্ঠিরও অবাক হয়। চুরি করতে এসে হাতে-নাতে ধরা পড়ার পরও এই ব্যবহার পাবে ভাবতেও পারেনি সে। কম্বলটার খুবই দরকার ছিল। বের হয়ে আসবে সাধু মহারাজের মনে পড়ে আর একটা কথা। সব কিছু বোঝা থেকে তিনি মুক্ত হতে চান। তাই বলেন তিনি,
—বাবা আর একটা জিনিসও পড়ে আছে। সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ। সোনা-দানায় কী দরকার? কোথায় হারিয়ে ফেলব। তার চেয়ে তুমিই নিয়ে যাও। তোমার কাজে লাগবে। কোথায় গেল সেটা!
যুধিষ্ঠির দাঁড়িয়ে আছে, সাধু-মহারাজ তাঁর ওই কাঁথার ভাঁজ খুঁজছেন এবার কোথা থেকে একটা ছোট আংটির সুন্দর কৌটা বের করে সেটা খুলে দেখান
—এই যে। দেখ না, এক ভক্ত কাল জোর করে দিয়ে প্রণাম করে গেল। সোনার আংটি-এতে নাকি হিরে বসানো আছে। বললে অনেক দামি।
চোর যুধিষ্ঠির দেখছে আংটিটা। সত্যিই হিরে সেট করা বেশ দামি আংটিটি ঝকঝক করছে। সাধু বলেন,
—এটাও নিয়ে যাও। পথে পথে ঘুরি, আমার এসবে কি দরকার। তুমি নাও।
অবাক হয় যুধিষ্ঠির। এখানে ঢুকেছিল ছিঁচকে চোরের মতোই। আর এই সাধু-মহারাজ তাকে ধরে ফেলেও মারধোরও করেননি। উলটে আরও টাকা-কম্বল-সোনা-হিরে এসবও দিয়েছেন। এবার যুধিষ্ঠিরের অবাক হবার পালা।
এমন ব্যাপার সে জীবনেও দেখেনি। সাধু-মহারাজের ব্যাপার দেখে যুধিষ্ঠিরের মনে হয় ওর কাছে এমন কোনো সম্পদ আছে যা এই টাকা সোনা-হিরে জহরত এর থেকেও অনেক দামি। যুধিষ্ঠিরের সাধুকে দেখে মনে হয়—উনি দয়াবান পুরুষ। না চাইতেই টাকাকড়ি, সোনাদানা যে ভাবে দিয়ে চলেছেন, চাইলে এর থেকে দামি জিনিস নিশ্চয়ই তিনি দেবেন। যুধিষ্ঠিরের মনে হয় সাধুর কাছে পরশপাথর-টাথর নিশ্চয়ই আছে, যা কিছুতেই ঠেকানো যাবে সোনায় পরিণত হবে। তেমনি কোনো সম্পদেরই দরকার তার-যার ছোঁয়ায় পাথরও সোনায় পরিণত হবে।
যুধিষ্ঠির এবার সাহসে ভর করে বলে,
—মহারাজ, আপনার অনেক, অনেক বড় কিছু সম্পদ আছে, না?
—কেন? সাধু তাকালেন ওর দিকে।
—নাহলে এই টাকা, কম্বল সোনা-হিরে এসব এমনি করে বিলিয়ে দিতে পারতে না বাবা। নিশ্চয়ই এসবের চেয়ে অনেক দামি কিছু আছে তোমার কাছে—যার জন্য এসবকেও তুচ্ছ মনে কর তুমি!
আনন্দ মহারাজ হাসছেন। ওই সিঁটকে ভাগ্যহত চোরটা যেন কিছুটা সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছে। যুধিষ্ঠিরও দেখছে সাধু-মহারাজকে। এবার তারও মনে হয়েছে এর থেকে অনেক দামি কিছু জিনিস সাধুর কাছে নিশ্চয়ই আছে যা পেলে যুধিষ্ঠিরকে আর রাত জেগে, মার খেয়ে চোরের জীবন-যাপন করতে হবে না। যুধিষ্ঠির এমন সুযোগ ছাড়তে রাজি নয়। সে এবার সাধু-মহারাজের পায়ের কাছে বসে পড়ে, বলে কাতর কণ্ঠে,
—বাবা, এই নাও তোমার কম্বল, এই নাও তোমার টাকা—এই তোমার সোনা, হিরে, সব নাও বাবা। আমাকে সেই পরম সম্পদের কণামাত্র দাও—যাতে আমাকে এই চোরের মতো বাঁচতে না হয়। আমাকে সেই সম্পদের কণামাত্র দাও বাবা—এভাবে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার যন্ত্রণা থেকে আমাকে রক্ষা করো বাবা।
মহারাজ দেখছেন ওকে—আজ যুধিষ্ঠিরের দু’চোখে জল নামে। সে বুঝেছে, এই ভাবে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুই ভালো।
আনন্দ মহারাজ দেখছেন ওর অনুতাপ—অনুশোচনা। বলেন তিনি,
এই পথ ছেড়ে দিয়ে মানুষকে ভালোবাসার চেষ্টা কর-লোভ বিসর্জন দে। দেখবি অনেক বড় শান্তি পাবি বাবা—জীবনটা আনন্দে ভরে উঠবে। সেই দয়াল সাধু শ্রীচৈতন্যকে ডাক—মন প্রাণ দিয়ে ডাক। দুনিয়ার সব সম্পদ তাঁর দয়ায় তোর করায়ত্ত হবে। জয় গৌর—জয় নিতাই।
যুধিষ্ঠিরও কান্নাভিজে কণ্ঠে আজ শরণ করে—জয় গৌর—জয় নিতাই দয়া কর প্রভু। দু’চোখে তার জল নামে।
তারা সারা অন্তরে যেন একটা ঝড় উঠেছে, তার এতদিনের সংস্কার, ধ্যান-ধারণাগুলো সব কেমন ভেঙে, বদলে তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
চোখে নেমেছে জলের ধারা, জীবনের সব গ্লানি যেন চোখের জল হয়ে ঝরে চলেছে, অনেক হালকা মনে হয় নিজেকে। যুধিষ্ঠির আজ ওই মহাপুরুষের স্পর্শে যেন আমূল বদলে গেছে, পরিণত হয়েছে নতুন একটি সত্তায়।
.
ভোর হয়ে আসছে। পুব আকাশ জুড়ে চলেছে নবাগত দিনের আগমনী। পাখিগুলো জেগে উঠেছে, জেগে উঠেছে ভক্তের দল, গঙ্গার বুকে পড়েছে পুব আকাশের ওই অরুণাভা। কোনো ভক্তের উদাত্ত সুর শোনা যায়, গঙ্গা-স্তোত্রের প্রাণময় সুর!
দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি গঙ্গে
ত্রিভুবনতারিণী তরল তরঙ্গে।
শঙ্করমৌলিনিবাসিনি বিমলে
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে।।
ভাগীরথী সুখদায়িনী মাতস্ত
জলমহিমা নিগমে খ্যাত।।
নাহং জানে তব মহিমান
ত্রাহি কৃপাময়ী, মামজ্ঞানম্।।
হরিপাদপদ্ম তরঙ্গিনি গঙ্গে
হিমবিধুমুক্তাধবল তরঙ্গে।
দূরীকুরু মম দুষ্কৃতি ভাব
কুরু কৃপয়া ভব সাগরপারম্।।
সূর্যের প্রথম আলো নদীতে, ঘাসে, সবুজ আমবাগানে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিক্রমার যাত্রীরাও জেগে উঠেছে। এর মধ্যে প্রাতঃকৃত্য, স্নানাদি সেরে তারাও তৈরি হয়েছে।
.
গোপালের মাও ভোরে উঠে গোকুলকে ডেকেছে, ওর-মা ললিতাও উঠে পড়ে। গোপালের মা বলে,
—ভোরে এখনও নদীর ঘাট ফাঁকা আছে, চল বউমা, স্নান-টান সেরে আসি।
গোকুলও উঠে পড়ে সেও চলেছে ওদের সঙ্গে।
তাঁবুতে ক্রমশ জেগে উঠছে যাত্রীরা।
নরহরি কাল রাতে দেরিতে ঘুমিয়েছে। তাই তখনও ওঠেনি।
কুন্তি ভোরে উঠে স্বামীকে ডেকে দেয়। স্নানাদির পর নরহরির তিলক সেবা করতেও সময় লাগে, তাকে তৈরি হতে হবে।
নরহরি চোখ মেলে বলে ইস্, দেরি হয়ে গেল। ডেকে দেবে তো?
.
মোনা ভিত্তিরের অবশ্য তেমন তাড়া কিছু নেই।
কাল অনেক রাত অবধি নানা ধকল গেছে তার। ওই চুরির ঝামেলা তো ছিলই তারপর পায়েলের সঙ্গেও গোলমাল বেশ ভালোই হয়েছে।
মোনা মিত্তিরের ঘুম সকালে ভেঙে গেলেও ওঠার, তৈরি হবার লক্ষণ দেখা যায় না তার মধ্যে। তাঁবুতে শুয়ে আছে। পায়েলও কাল সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার তাঁবুতে যেন না থাকে। পায়েল নিজেই তার সব খরচ চালাবে, তার জন্য মোনা মিত্তিরকে ভাবতে হবে না।
মোনা মিত্তির যেন তার তাঁবুতে না যায়।
মোনা মিত্তির নিজের তাঁবুতেই শুয়ে আছে। সে ওই মেয়ের জেদের শেষ দেখবে। সেও মিত্তির বংশের যুবরাজ, একটা বাইজির তেজ ভাঙতে হয় কি ভাবে, তা সে জানে। সেই চেষ্টাই করবে। ওই পায়েলকে সে বশে আনবেই।
তার জন্য স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিয়েছে মোনা মিত্তির। সেই ন্যাপা সরকারকে খুঁজে দেখতে হবে। তাকেও বকবে, যেন বউমণিকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এখান থেকে। তার স্ত্রী এতবড় ঘরের বউ হয়ে মাঠে মাঠে ঘুরবে এ হতে দেবে না সে।
উঠে পড়েছে পায়েল আগেই।
সে আর ওই মোনা মিত্তিরের খোঁজও নেবে না। নিজে তৈরি হয়ে তার কাজের লোককে বলে—মালপত্র তাঁবু এসব নিয়ে কর্তাদের সঙ্গে চলে যাব, আজ রাতে যেখানে ক্যাম্প হবে সেখানে। আগে থেকেই তাঁবু খাটিয়ে জলে ব্যবস্থা করে রাখবি, আমি পরিক্রমার সঙ্গে গিয়ে পৌঁছব ওখানে বৈকালে।
লোকটা শুধায়, মিত্তিরবাবুকে ডাকি?
পায়েল বলে না। ডাকতে হবে না। ওঁর ব্যাপার উনিই বুঝে নেবেন, তোকে যা বললাম তাই কর।
লোকটা একটু অবাক হয়। অবশ্য পায়েলের সে পুরনো কর্মচারী। ওদের জীবনে বাবু কত আসে—কত মাখামাখি হয় আবার ঝরাপাতার মতো বাবুরা ঝরে পড়ে, আবার গাছে নতুন পাতা গজানোর মতোই নতুন বাবু আসে।
এসব ওদের ‘সহজ ব্যাপার। সুতরাং এ নিয়ে লোকটাও কোনো কথা বলে না। ও জানে পায়েলেরই হুকুমমতো চলাই তার কাজ। তাই চলবে সে।
পরিক্রমা শুরু হয়েছে। এবার পরিক্রমা এই অঞ্চলে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে এবার জলঙ্গি নদী পার হয়ে ওপারে গোদ্রুম দ্বীপ বর্তমানে স্বরূপগঞ্জের দিকে যাবে। এটা হাঁটাপথে কয়েক মাইল পথ।
আর তাঁবু-মালপত্র নিয়ে ট্রাক যাবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বহরমপুর রোড ধরে কৃষ্ণনগরের আগে সেতুপথে জলঙ্গি নদী পার হয়ে কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপের গঙ্গাতীরে অন্য পারে স্বরূপগঞ্জের দিকে—এটা বেশ কয়েক মাইলের ঘুরপথ! তবু এই পথেই তাঁবু মালপত্র আসছে, সেইখানেই আজ রাত্রিবাস করতে হবে যাত্রীদের।
.
সকালে যাত্রা শুরু হয়েছে।
ভুবনবাবু, ডাক্তারবাবু অন্যরা রয়েছেন। আনন্দ মহারাজও চলেছেন পরিক্রমায়। গোকুলের যেন বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই। ছোট ছেলেটার গলায় কে একটা মালা পরিয়ে দিয়েছে, গোকুলের খেয়াল নেই। গোকুল কীর্তনের আগে দু’হাত তুলে নেচে চলেছে।
গোপালের মা, ললিতা, সত্যজা চলেছে। তখনও বেলা বাড়েনি। বাতাসে দাবদাহ শুরু হয়নি। এরা চলেছে গ্রাম্যপথে কীর্তন করতে করতে। পায়েল ও আজ ওদের সঙ্গে এসেছে সকাল থেকেই। নাম-গান করে চলেছে।
চন্দনার কাজের মেয়ে মানদার নজর সব দিকে। সে দেখেছে বউদিমণি ভোরবেলাতে উঠে তৈরি হচ্ছে পরিক্রমার জন্য।
মানদার তখন শয্যাত্যাগ হয়নি। বিছানাতে গড়াচ্ছে সে। শুধোয় সে–বউদিমণি, আজও যাবে নাকি পরিক্রমায়? ওই মাঠে-মাঠে ধূপ রোদে ঘুরবে?
চন্দনা বলে—পরিক্রমা তো কদিন রোজই চলবে। মাঝপথে থামার জন্য আসিনি।
চন্দনার সারা মনে একটা ব্যাকুলতা। এই পরিক্রমা সে শেষ করবেই, দেখবে গৌরসুন্দরের কৃপা পায় কিনা? পরিক্রমায় তার জীবনে কোনো উত্তরণ ঘটে কিনা দেখতেই হবে তাকে। তার একান্ত প্রার্থনা—ঘরছাড়া স্বামীকে ফিরে পেতেই হবে তাকে। তাই শেষ অবধি দেখবে চন্দনা। ওসব কথা বলতে পারে না সে। তাই বলে,
—পরিক্রমা মাঝপথে ছাড়তে নেই।
মানদা গজগজ করে—পারোও বটে। কি যে হবে এই হা-ঘরের মতো ঘুরে।
চন্দনা বলে—যেতে হয় যাবি। না হয় যাবি না—এত কথা কিসের। বাড়িতেই চলে যা।
অর্থাৎ চাকরি ‘নটই করে দেবে বউদিমণি, তাই মানদাকে চলতেই হবে এই রোদে।
চন্দনা বলে—যাবি তো ওঠ। তাঁবুগুলো ওরা নিয়ে যাবে আজ রাতে থাকার জায়গায়।
নদা গজগজ করতে করতে উঠল। ক’বছরেই কলকাতার পাইপের জল পেটে পড়ার পর মানদাই বেশি আয়েসি হয়ে উঠেছে। মানদা উঠে গঙ্গার ঘাটে মুখ ধুয়ে ফিরে আসছে, হঠাৎ কাকে দেখে চমকে ওঠে।
প্রথমে ভাবতেই পারেনি যে, তাদের বাবুকে এখানে দেখবে, এই পরিক্রমার ভিড়ে। তাই ওকে দেখে থমকে দাঁড়ায় মানদা।
মোনা মিত্তির উঠেছে একটু বেলাতেই।
দেখে আশপাশের তাঁবুও সব ফাঁকা। ওদিকে মন্দিরের চত্বরে খোলকত্তাল বাজছে। হাজারো কণ্ঠে হরিনাম ধ্বনি উঠছে।
মেয়ে-পুরুষ ভক্তরা প্রায় সকলেই হাজির—এবার আজকের যাত্রা শুরু হবে।
অবশ্য মোনা মিত্তিরের তাড়া নেই। ও হাত মুখ ধুয়ে গাছতলায় অস্থায়ী চায়ের দোকানে চা-টা খেয়ে ধীরে-সুস্থে যাবে পরিক্রমার আগে-পিছনে ওর খুশি মত।
হঠাৎ মানদাকে দেখে তাকাল মোনা মিত্তির
মানদা এদিকে মিটমিটে শয়তান মেয়েছেলে, বুঝেছে দাদাবাবুকে খবরটা দিলে দাদাবাবু নিশ্চয়ই বউদিমণিকে পরিক্রমায় যেতে দেবে না। মানদাও বেঁচে যাবে।
তাই মানদা ওরা যে এসেছে এখানে এটা জানান দেবার জন্য এগিয়ে আসে—বাবু!
ঢং করে প্রণাম করে। বলে মানদা,
—বউদিমণিও এসেছেন পরিক্রমায়।
সেটা জানে মোনা মিত্তির, তার সঙ্গে কথা আগেও হয়েছে চন্দনার। বলে মোনা মিত্তির—তোমরা ফিরে যাওনি?
মানদা বলে—কই, না তো। বউদিমণি বললেন, পরিক্রমায় এসে মাঝপথে ছাড়তে নাই, আজও তো বের হচ্ছেন এই রোদে।
—হুঁ। মোনা মিত্তির বেশ বুঝেছে চন্দনা ফিরে যাবে না। শেষ অবধি দেখবেই। কী ভেবে মোনা মিত্তির বলে,
—সরকার মশাই কোথায়?
মানদা ন্যাপাল সরকারের উপরও হাড়ে-চটা। দশটা টাকা বাড়তি চাইলে দেবে না। আর মানদা কত ছলা-কলা করেও মিটকে লোকটাকে বশে আনতে পারেনি। তাই মানদার রাগও আছে ওর উপর।
মানদা বলে—ওই দিকে তাঁবুতে রয়েছে, ওই যে আমগাছের নিচের নীল রং-এর তাঁবু ওখানে।
মোনা মিত্তির কি ভেবে ওই দিকেই এগিয়ে চলে। বিছানা থেকে উঠেছে সবে। চোখে-মুখে ঘুমের আবেশ। পরনে সিল্কের লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, পায়ে দামি চটি। মানদা বাবুর সামনে কলাবউয়ের ঘোমটাও টানে। চলেছে সে বাবুর পিছু পিছু
তাঁবুগুলো তোলা হচ্ছে, ওদিকে মজুরের বাঁধা ত্রিপল ট্রাকে উঠেছে। ড্রাম-কড়াই-উনুন – বালতি-হান্ডা এসবও উঠছে অন্য ট্রাকে। পরিক্রমা ওদিকে চলতে শুরু করেছে।
মানদা কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও এখানে আর থাকতে পারে না। বউদিমণির জিনিসপত্র নিয়ে পরিক্রমায় শামিল হতে হবে, তাই চলে গেল মানদা ওই দিকে।
ন্যাপা সরকার সকালে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে ইষ্টনাম জপ করে জল-বাতাসা খায়, তারপর শুরু হয় তার নিত্য কাজ। জল-বাতাসা খেতে যাবে এমন সময় স্বয়ং হুজুরকে এখানে ওই বেশে দেখে চমকে ওঠে সে।
—হুজুর। আপনি, এখানে?
ন্যাপা বুঝেছে বউদিমণি এখানে এসেছে খবর পেয়েই হয়তো বাবু কলকাতা থেকে রেগে-মেগে নিজে এসেছে এখানে। কি অনর্থ বাধাবে কে জানে, তাই নিজের দোষ যে এতে নেই সেটা প্রকাশ করার জন্য ন্যাপা সরকার বলে,
—হুজুর আমি বউদিমণিকেই পই পই করে মানা করেছিলাম এই বাজারের মধ্যে পরিক্রমায় না আসতে, কিন্তু বিশ্বাস করুন হজুর, যথা ধর্ম বলছি, আমার কথা কানে তোলেননি, নিজে জেদ করে এলেন, তখন আমিও এলাম। ওঁকে একা ছাড়িনি হুজুর।
মোনা মিত্তির বলে,
—এখন ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। আজ না হোক কালই যেন ফিরে যান উনি।
ন্যাপা সরকার বলে–আপনিও একটু বলুন হুজুর।
বলে যে কোন ফলই হবে না তা বুঝেছে মোনা মিত্তির। তাই বলে,
—আমি যা বলার বলব। তবে আপনি এনেছেন আপনিই ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন, বুঝলেন।
মোনা মিত্তির কথাগুলো বলে চলে যায় ওর নিজের তাঁবুর দিকে। ভূধর জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। মোনা মিত্তিরকে ফিরতে দেখে বলে সে,
—আজ্ঞে পরিক্রমা অনেক দূর চলে গেছে।
-–মোনা মিত্তির বলে—যাক, ধরে নেব।
একটু চা অর্গানাইজ কর। তারপর দেখা যাবে।
.