৩
কুসুমপুরের জীবনযাত্রায় বহু পরিবর্তন এসেছে। নরহরি বিশ্বাস এখন তার পৈতৃক সেই মাটির বাড়ি ছেড়ে তার দখল-করা জমিদার বাড়িতে এসেছে। বাড়িটাকে রং করিয়েছে, মন্দিরে এখন অষ্টপ্রহর অখণ্ড নাম সংকীর্তনের ব্যবস্থা করে নরহরি ঝুড়ি ঝুড়ি পুণ্য অর্জনের ব্যবস্থা করেছে।
কিন্তু একজনের কাছে সব ব্যাপারটাই কেমন ভন্ডামি বলেই বোধহয়। সেই নরহরির স্ত্রী কুন্তী। গরিবের ঘরের মেয়ে সে—নরহরি তার টাকার জোরে গরিব ঘরের ওই সুন্দরী মেয়েটিকে নিজের দখলে এনেছে, কিন্তু স্বামীর কোনো কর্তব্য করার মতো সময় বা শারীরিক সামর্থ্য তার নেই। অথচ স্ত্রীর কাছে সেবা—সে চায় ষোলো আনা। পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। নরহরি তাহলে অনর্থ বাধাবে, বাধায়-ও। কুন্তী দেখেছে লোকটাকে। ও নিজেকেই চেনে—আর বোঝে নিজের স্বার্থ।
কুন্তীর মাতৃত্ব অপূর্ণই থেকে গেছে।
মা হতে সে পারেনি। এই ব্যর্থতা—অপূর্ণতাই তার মনে এনেছে দুঃসহ-জ্বালা। ততই সে মনে মনে চটে উঠেছে ওই লোকটার উপর।
জমিদার বাড়িটা দখল করে নরহরি এবার দরাজ হাতে খরচা করে মেরামত করে তারপর একদিন গ্রামশুদ্ধ মানুষদের প্রসাদ দেবার ব্যবস্থাও করে।
ভুবনবাবু নবীন ডাক্তার অন্যদেরও বলে নরহরি। সবাই জানে নরহরি এবার নিজের ঐশ্বর্যই দেখাতে চায়।
ভুবন বলে—নাম গানে যাব নরহরি। জানোই তো খাওয়া-দাওয়া বাইরে ছেড়ে দিয়েছি। গ্রামশুদ্ধ মানুষকে নরহরি সেদিন জমিদার বাড়ির নাটমন্দিরে প্রসাদ বিতরণ করে নাম কীর্তনের দলসহ সবৎসা গাভি নিয়ে সস্ত্রীক গৃহপ্রবেশ করেছিল ওই নতুন দখল-করা জমিদার বাড়িতে। এখন তার নামকরণ করেছে নরহরি-’হরিধাম’।
একটা বড় মার্বেল পাথরের ফলক লাগিয়েছে নরহরি এই প্রাসাদের গায়ে। হরিধাম—সেবক নরহরি বিশ্বাস, সাং-কুসুমপুর।
অর্থাৎ অতীতের জমিদারির ইতিহাসটাকেও নরহরি মুছে ফেলে নিজেকে সেই প্রবহমান ইতিহাসের ধারায় শামিল করতে চায়। কিন্তু তার স্ত্রী কুন্তী বলে এই প্রাসাদে এসে,
এসব কাণ্ড করার কি দরকার ছিল? বেশ তো ছিলাম ওই পুরনো বাড়িতে। এতবড় বাড়ি—
নরহরি বলে—কেন, চিরকালই কি মাটির বাড়িতে থাকতে হবে? গৌরাঙ্গদেবের দয়ায় এসব হয়েছে।
কুন্তী বলে—যে ভাবে এসব করেছ তার সঙ্গে গৌরাঙ্গদেবের নামটা-জুড়ে আর পাপের বোঝা বাড়িয়ো না।
নরহরি স্ত্রীর দিকে তাকাল। জবাবটা সে দিতে পারে না, কারণ নরহরি নিজে জানে যে ওর কথাগুলো এতটুকু মিথ্যে নয়। সে সবকিছু পাপের পথেই অর্জন করেছে। তাই মনে সাহস পাবার জন্যই, পাপবোধকে অন্তরে-চাপা দেবার জন্যই উচ্চৈঃস্বরে হুঙ্কার তোলে,
—জয় শচীনন্দন গৌরহরি।
আর অমায়িকভাবে হেসে বৈষ্ণবোচিত বিনয়ের প্রকাশও করে। ওই হাসিটাকে নরহরি বহুদিনের সাধনায় রপ্ত করেছে। রাগলেও তার সর্বনাশের মতলব আঁটার সময়ও মুখে ওই বিনয়ের হাসিটা ঠিক ফুটে ওঠে।
তাই দুষ্ট লোকে আড়ালে বলে—নরহরির হাসি গলায় দেয় ফাঁসি। কথাটা নরহরি শুনেছে, শুনে সেইভাবেই হেসে জয়ধ্বনি দেয়।
—জয় নিতাই, জয় গৌর, সবই তোমার লীলা ঠাকুর।
.
মোনা মিত্তির মাঝে মাঝে যখন তখনই কলকাতা থেকে সটান এসে পায়েলের বাড়িতে উপস্থিত হয়। সঙ্গে তার বিলাস-ব্যসনের সবকিছু আনে। বিলাতি মদও আনে। পায়েল কলকাতার জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে এখানে এসেছে। এখানে গ্রামের প্রান্তে নিজের একটা বাগান বাড়ি আছে মোনা মিত্তিরের, ওই বাড়িটাতেই থাকে পায়েল, এক শর্তে। মাসে মাসে ভাড়া নিতে হবে।
কিন্তু মোনা মিত্তির ভাড়া নেয় না।
সে চায় পায়েলকে। পায়েল ভাড়াটা প্রতি মাসে কলকাতায় মোনা মিত্তিরের এস্টেটে মনিঅর্ডার করে পাঠায়।
আর মোনা মিত্তির এলে বলে পায়েল,
—এখানে আসবেন না মিত্তিরমশাই। এ কলকাতা শহর নয়, গ্রাম। গ্রাম-সমাজে এ নিয়ে কথা হবে।
হাসে মোনা মিত্তির। এর মধ্যে এসেই মোনা মিত্তির মদের বোতল নিয়ে বসে। সবে দু’এক পাত্র চড়েছে এমন সময় পায়েলের ওই কথায় মোনা মিত্তির বলে—
—বেশ রসিক তো তুমি পায়েল। এতকাল কলকাতা শহর মাতিয়ে আজ বলো কিনা এখানে এলে গ্রাম-সমাজে কথা হবে। শোনো—মোনা মিত্তির তার মেয়েছেলের কাছে আসবে, তাতে কার কি? মোনা মিত্তির ওসবের পরোয়া করে না।
পায়েল বলে—না—আমি ও পথে আর নেই।
মোনা মিত্তির বলে,
—আমি এসব ছেড়ে দেব। দুজনে ঘর বাঁধব পায়েল। তাই তো আসি। বার বার আসি তোমার কাছে।
পায়েল বলে—তা হয় না বাবু! পোকায় কাটা ফুল—
হাসে মোনা মিত্তির—ফুল ফুলই। ছাড়ো তো ওসব, নাও স্কচ এনেছি, খাস বিলেতি, দুঢোক খাও—ওসব ভালো মানুষি ছুটে যাবে।
পায়েল এতকাল ওসব খেয়েছে। আর ভালো লাগে না।
সে চলে যায়। মোনা মিত্তির গজগজ করে।
—সতীপনা! আমিও তোমার সতীপনা ছুটিয়ে দেব, হ্যাঁ।
অন্ধকার অতলেই মানুষ আলোর সন্ধান করে। হতাশা, গ্লানি আর ব্যর্থতায় মন যখন ভরে যায় তখনই মানুষ নতুন করে বাঁচার আশ্বাস খোঁজে।
গোপালের মায়ের একমাত্র অবলম্বন তার ওই সন্তান গোপাল। বুড়ি ওই গোপালকে নিয়ে স্বামীর শোক ভুলেছিল। সাধারণ গরিবের ঘরের মানুষ ছিল নিরাপদ। স্ত্রী আর সন্তান গোপালকে নিয়ে তার সংসার। নিজের কয়েক বিঘে জমি ছিল—সেই সামান্য জমিতে হাল- বলদ রেখে চাষ করলে পোষাবে না তাই গ্রামের কিছু মানুষের কাছে জমি ভাগে নিয়ে নিজের হাল- বলদ করে নিরাপদ চাষ-আবাদ করে নিজের জমির ধান আর অন্যের জমি থেকে সংগৃহীত ভাগের ধান-গম দিয়ে কোনমতে সংসার চালাত।
গোপালের মায়ের চাহিদা বেশি ছিল না। স্বামী-পুত্রকে নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই ছিল তার কাছে বড় কথা। তাতেই সে ছিল খুশি।
কিন্তু গোপালের মায়ের এই সামান্য খুশিটুকুও রইল না। সেদিন মাঠে চাষ করছিল নিরাপদ সবে বর্ষা নেমেছে—গ্রীষ্মের দাবদাহ মুছে আকাশ ছেয়ে এসেছে বর্ষার কালো মেঘ, বৃষ্টির ধারা স্নান নামে। মাটির বুক থেকে উঠছে মিষ্টি-সোঁদা গন্ধ। লাঙলের ফলায় নরম মাটি উলটে যাচ্ছে—তাকে উর্বরা করে বীজ ধান বপন করবে, আসবে প্রাণের সাড়া। সবুজ ধানে ভরে যাবে দিগন্ত। বৃষ্টির মধ্যে লাঙল দিচ্ছে নিরাপদ, হঠাৎ ওই নরম ওলটানো মাটিতে ফণা তোলে সাপটি, কি ভাবে এসে পড়েছে লাঙলের মুখে—সরে যাবার চেষ্টা করে নিরাপদ, কিন্তু সাপটা তার আগেই বিদ্যুৎ বেগে ছোবল মেরেছে ওর পায়েই।
তীব্র জ্বালা শুরু হয়। মাঠের অন্য চাষিরাও এসে পড়ে।
তারা দেখে সাপটা ছোবল মেরে পালাচ্ছে—আর যন্ত্রণায় কাদায় লুটিয়ে পরে নিরাপদ।
চাষিরাই ধরাধরি করে তাকে বাড়িতে আনে।
গোপালের মা যেন দিশাহারা হয়ে যায়। সুস্থ মানুষটা সকালে মাঠে গেল আর ফিরল কিনা কালসাপের দংশন নিয়ে।
ওঝাও এসেছে। মন্ত্র-তন্ত্র ঝাড়-ফুঁক শুরু হল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না, নিরাপদ ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে, গোপালের মা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তবু এই কঠিন শোককে ভুলে যেতে হয়। অভাবের সংসার, শোক করার সময়ও নেই। তাই বুক বেঁধে সংসারের কাজে নামে সে। গোপালকে মানুষ করতে হবে। সেইই একমাত্র ভরসা। গোপালকে নিয়েই তার দিন কাটে। গোপালকে স্কুলেও পাঠায় সে।
কিন্তু হঠাৎ গোপালও মারা গেল মাত্র তিনদিনের জ্বরে।
নবীন ডাক্তারের কাছে যখন তাকে নিয়ে গেছে তখন গোপালের প্রায় শেষ অবস্থা। নবীন ডাক্তার বলে,
—আগে আনতে পারলে না গোপালের মা? এখন কি করি?
গোপালের মা বলে,
—বদ্যিকে দেখাচ্ছিলাম। তুমি গেরামে ছিলে না।
—একেবারে শেষ সময় আনলে।
তবু নবীন ডাক্তার অনেক চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু কিছু করা যায়নি। চারদিনের মাথায় চলে গেল গোপাল।
অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ে গোপালের মা। তার সব হারিয়ে গেল। এই পৃথিবীতে বাঁচার মতো আর কোনো অবলম্বন তার নেই।
তবু জীবনের যাত্রা থামে না।
গোপাল নেই—ওই গোপালের মায়ের নামটা রয়ে গেছে, ওই নামেই পরিচিত হয়ে রয়েছে বুড়ি।
আজ অন্ধকার অতল থেকে তাই গোপালের মাও যেন আলোর সন্ধান করে। আসে ভুবনবাবুর মন্দিরে, পাঠ শোনে আর নাম-গানের আসরেও যোগ দেয়, এই নিয়েই দিন কাটে তার।
শীতের সময় গ্রামে আসে পূর্ণতার ছবি। দিগন্ত প্রসারী সবুজ ধান খেত সোনা রং ধরে, ধানের মঞ্জরির ভারে অবনত হয়ে যায় ধানগাছগুলো। আখের খেতে সবুজের ঢেউ জাগে, সোনাধান কাটার দিন, ফসল ওঠার দিন।
ধান এর পরই শুরু হয় আলু-গম-ছোলা-মটরের চাষ, দিগন্ত সবুজ হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর আগমন। তাই পৌষ মাসকে বলে এরা লক্ষ্মী মাস। ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর পাদস্পর্শ।
শীতের আমেজ তখনও রয়েছে। তত তীব্রতা নেই।
ফসল তোলার কাজও শেষ। চাষিদের এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত অবকাশ। এমনি দিনে সেদিন ভুবনবাবু বলেন মন্দিরে পাঠের সময় কথাটা উপস্থিত সকলকেই।
অনেকেই শুনেছিল এসম্বন্ধে। কিন্তু সঠিক ভাবে কিছুই শোনেনি ওরা। আজ ভুবনবাবু জানান—নবদ্বীপ পরিক্রমায় যাব দোল পূর্ণিমার সময়। যদি তোমরা যেতে চাও জানাবে। সাতদিন প্রায় লাগবে পরিক্রমায়।
কেষ্ট-হরিদাস এরাও বসেছিল। ওদিকে গোপালের মা দেবতার জন্য মালা গাঁথছিল। সেও তাকাল ওই পরিক্রমার কথা শুনে।
হরিদাস বলে—নবদ্বীপ যাবেন দা-ঠাউর?
ভুবনবাবু বলেন—নবদ্বীপ পরিক্রমা অন্য ব্যাপার গো। অতীতে নয়টি দ্বীপ নিয়ে বৃহত্তর নবদ্বীপ গড়ে উঠেছিল। এখনও সেই নয়টি দ্বীপ অন্য নামে পরিচিত, মায়াপুর থেকে পরিক্রমা বের হয়ে গঙ্গার পূর্ব তীর—পশ্চিম তীরে বিস্তীর্ণ এইসব অঞ্চল ধরে পরিক্রমা করে ভক্তদল। সাতদিন ধরে এই পরিক্রমা চলে—দিনভোর নামগান করতে করতে যে যে জায়গায় লীলা প্রকট হয়েছিল, যে-যে স্থানে দেবতারা এসে সেই লীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেই সব স্থান পরিক্রমা করে সাতদিন পর মায়াপুরে ফিরে আসে আবার ভক্তরা।
—এ যেন জীবনের বহু পথ পরিক্রমা গো।
নবীন ডাক্তার বলে—এই পথ পরিক্রমায় অতীতের সব তীর্থের সঙ্গে পরিচিত হয় আজকের মানুষ?
ভুবন বলে—তা তো হয়ই। আর কি জানো ডাক্তার—
অদ্যাপি নিত্যলীলা করে গোরারায়
কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।
কারো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দর্শনও ঘটে কিন্তু সারা মন কি অপরূপ শক্তিতে ভরে ওঠে এই নামের প্রভাবে, সাধসঙ্গের পুণ্যফলে। এই পরিক্রমায় দেহমন শুদ্ধ হয়ে ওঠে, গৌরচন্দ্রের আশীর্বাদে জীবনের সব তাপ-সত্তাপ দূর হয়। মিথ্যা-অহংভাবও মুছে যায়।
.
ভুবনবাবু এই নবদ্বীপধাম পরিক্রমার ইতিহাসও বর্ণনা করেন বিকালে পাঠের সময়। আজ পাঠের বিষয় আলোচনায় নবদ্বীপ ধাম-মাহাত্ম্য আর নবদ্বীপের পুণ্যমৃত্তিকায় পরম দেবতার অবতারের মূল কাহিনি ফুটে ওঠে।
.
বৈকাল নামছে।
মন্দিরের প্রাঙ্গণে গুলঞ্চ গাছের ফুলের মঞ্জরি। মন্দিরের দেবতাকে সাজিয়েছে। বাতাসে ওঠে বেল জুঁই ফুলের সুবাস। ভুবনবাবুর সুরেলা কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়।
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম্ ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
নাট্যমন্দরে ভক্তরা সমবেত। ভুবনবাবু বলেন,
—কলিযুগে সেই সময় সমাজের সর্বত্র শুরু হয়েছিল অনাচার, অত্যাচার আর অন্যায়। পাপের ভারে ধরণী কলুষিত হয়ে উঠেছিল।
সেদিন নবদ্বীপেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
এই অনাচার, দেশব্যাপী অন্যায় আর অধর্মের প্লাবন দেখে ভক্ত অদ্বৈত আচার্য তুলসী গঙ্গাজল নিয়ে ধ্যান শুরু করেন। ত্রিকালদর্শী এই মহামানব সেদিন ঘোষণা করেছিলেন,
—মোর প্রভু আসি যদি
করে অবতার
তবে হয় এ সকল জীবের উদ্ধার,
তবে হয় অদ্বৈতসিংহ আমার বড়াই
আনিয়া বৈকুণ্ঠনাথ সাক্ষাৎ করিয়া,
নাচিব গাহিব সর্ব জীব উদ্ধারিয়া।
হুঙ্কারে করহে ‘কৃষ্ণ’ আবেশের তেজে
যে ধ্বনি ব্রহ্মাণ্ড ভেদি বৈকুণ্ঠতে বাজে।।
ভুবনবাবুর পাঠ যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
ভুবনবাবু পাঠ করছেন গীতার সেই শ্লোক।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহাতি নরোহপরাণি
তথা শরীরাণি বিহায় জীৰ্ণান্যামানি।
সংযাতি নবানি দেহী।।
আমাদের প্রকৃত স্বরূপ এই দেহটি নয়, আমাদের প্রকৃত স্বরূপে আমরা চিন্ময় আত্মা। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন গীতায়—বসন পুরনো, জীর্ণ হয়ে গেলে জীর্ণ বসন পরিত্যাগ করে আমরা নতুন বসন গ্রহণ করি, তেমনি দেহটি জীর্ণ হয়ে গেল সেই পুরাতন দেহটি ছেড়ে আমরা একটি নতুন দেহ ধারণ করি।
নবদ্বীপে এই অনাচারের মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। অদ্বৈতাচার্যও সেদিন নবদ্বীপে তরুণ নিমাইকে দেখে চিনতে ভুল করেননি।
নাট মন্দিরে কে বলে—দাঠাউর। শ্রীকৃষ্ণ আর চৈতন্যদেবের কথা কেন বারবার আসে?
নরহরি বিশ্বাস এসে ঢোকে। সর্বাঙ্গে তিলক ছাপ, গলায় কণ্ঠী, গায়ে রেশমের চাদর, হাতে জপমালা। নরহরি ঢুকে হেঁড়ে গলায় গর্জন করে—জয় শচীনন্দন গৌরহরি।
আর হুঙ্কার ছেড়ে নাটমন্দিরে দেবতার সামনে তার বিশাল বপুখানা সাটপাট করে ফেলে এবার ওই প্রণামির থালায় এক একটা করে টাকা ছুড়তে থাকে। ঠং-ঠং করে টাকাগুলো থালায় পড়ছে—নরহরি আড়চোখে চেয়ে দেখে অন্যরা তার মতো দানশীলকে কি ভাবে দেখছে।
ভুবনবাবু ওকে অগ্রাহ্য করার ভঙ্গিতে সেই ভক্তের কথার জবাব দেন—ঠিক বলেছ মুকুন্দ তবে জেনে রাখো—শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুই হচ্ছে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।
কোনো ভক্ত বিস্মিত হয়—সেকি!
স্তব্ধ শ্রোতৃবৃন্দ। ললিতাও আসে পাঠ শুনতে। আসে গোপালের মা, ওদিকে এক কোণে বসে আছে পায়েলও। তাকেও এই মন্দির যেন কি এক দুরন্ত আকর্ষণে টানে। এসেছে নবীন ডাক্তারও, সন্ধ্যার পর তার চেম্বারে রুগী কমই থাকে। সারা নাটমন্দির ভরে গেছে ভক্তদের ভিড়ে।
ভুবনবাবু বলেন—হ্যাঁগো, দ্বাপরে তিনি তার স্বয়ংরূপ প্রকাশ করে এসেছেন আর কলিতে অবতীর্ণ হয়েছে ভক্তরূপে।
স্বয়ং ভগবান দ্বাপরে এসে বললেন—আমিই ভগবান। কিন্তু কলিযুগে অধঃপতিত মানুষ তাকে মানবেন কিনা প্রশ্ন ওঠে। তাই ভগবান স্বয়ং ভক্তরূপে অবতীর্ণ হয়ে আমাদের শিক্ষা দিলেন এই শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান।
কলিতে নবদ্বীপে তিনি ভক্তরূপে অবতীর্ণ হন, তাই নবদ্বীপ ধামও বৃন্দাবন ধামের মতোই পবিত্র, পুণ্যধাম। শ্রীভগবান সেখানে গৌরাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন—লীলা করেছিলেন।
আর বৃন্দাবনধাম পরিক্রমায় যে পুণ্য অর্জন হয় এই নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমাতেই সেই পুণ্যই অর্জিত হয়। তাই পরিক্রমায় দেশ-দেশান্তরের বহু মানুষ এসে যোগ দেন। কৃষ্ণ প্রেমের লীলা মাধুর্যে তাদের অন্তর মন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
তাই এবার পরিক্রমাতে যাবার মনস্থ করেছি।
অনেকেই এগিয়ে আসে—আমরাও পরিক্রমায় যাব বাবাঠাকুর। ভুবনবাবু বলেন।
—বেশ তো চলো এতে যাবার অধিকারী সবাই।
যাবার আয়োজন করছি। দোল পূর্ণিমার আগেই বের হয়ে শ্রীধাম মায়াপুর গিয়ে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকেই শুরু হবে পরিক্রমা।
গোপালের মা বুড়ি বলে।
—বাবা ঠাকুর আমাকে সঙ্গে নেবে বাবা? আমার তো তিনকুলে কেউ নাই। তীর্থ-ধৰ্ম্ম করার মতো ট্যাকাও নাই, দিন আনি দিন খাই। নে যাবে বাবা?
ভুবন বলেন—বেশ তো, চলো। পরিক্রমায় যাবে এ তো ভালো কথা।
গোকুল বসেছিল ওর মায়ের পাশে।
ছেলেটা মন্দিরে প্রায়ই আসে। আর বাগানের ফুল সে রোজই আনে। ভুবনবাবুও ভালোবাসেন সুন্দর ছেলেটাকে। এককালে ওরাই ছিল এই অঞ্চলের জমিদার।
আজ ভাগ্যের ফেরে শশীকান্তবাবু মারা গেলেন—আর নরহরি নায়েবও যেন ওত পেতে বসেছিল। শশীবাবু মারা যাবার পর সর্বস্বই দখল করে ওদের একটা ভাঙা গোয়াল ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেছেন।
তবু দেখেছেন ভুবনবাবু ওই ললিতা মায়ের কোনো অনুযোগ, অভিযোগ নেই, নরহরির বিরুদ্ধেও কিছু বলেননি। একমাত্র সন্তান ওই গোকুলকে নিয়ে মুখ বুজে সব দুঃখ কষ্ট সহ্য করে বাঁচার লড়াই করে চলেছে ললিতা।
আর মন্দিরে আসে। সব দুঃখ-কষ্ট থেকে ত্রাণ পাবার জন্য প্রার্থনা জানায় ওই দেবতার কাছে গোকুলের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।
গোকুল পরিক্রমার কথা শুনে এগিয়ে এসে বলে ভুবনকে—বাবা ঠাকুর, আমরাও যাব কিন্তু মা আর আমি।
ভুবনবাবু তাকালেন, বলেন,
—পারবি? হাঁটতে হবে ক’দিন, রাত কাটাতে হবে তাঁবুতে—না হয় গাছতলায়। খাবার দাবারের ব্যবস্থাও ঠিক তেমন থাকবে না।
গোকুল বলে—হ্যাঁ—হ্যাঁ ঠিক পারব। মাও পারবে। মতো মাসে একাদশী, পূর্ণিমা বারের, পুজোর কত উপোস দেয়। আমিও পারব হাঁটতে। নে যেতে হবে কিন্তু নাহলে তোমার সঙ্গে আড়ি করে দেব।
হাসেন ভুবনবাবু। ললিতার উদ্দেশে বলেন তিনি।
—ছেলের শাসানো শুনছ মা। বলে আড়ি করে দেব।
তা পারবে তো মা? পথের ধকল বলে কথা।
ললিতাও মনে মনে চেয়েছিল ওই পরিক্রমায় শামিল হতে। জীবনে তার অনেক অশান্তি হাহাকার, দয়াল ঠাকুরের দয়ায় যদি তা দূর হয়—তাই।
যাবে সে ওই পরিক্রমায়। ভুবনবাবুর কথায় বলে,
—পারব বাবা তাঁর দয়াতেই সব অসুবিধাও সয়ে যাবে। গোকূল যখন বলছে তাহলে নিয়ে যাবেন তো।
ভুবনবাবু বলেন—চলো। ওহুে ডাক্তার—তুমিও চলো।
নবীন ডাক্তার বলে,
—আমাকে আবার টানাটানি কেন? এদিকে রোগীপত্তরও রয়েছে, গ্রাম ছেড়ে যাবে সাতদিনের জন্য।
ভুবনবাবু বলেন,
—রোগীর অভাব সেখানেও হবে না। বরং ভক্তদের সেবা করার পুণ্য পরিক্রমার পুণ্য, ডবল পুণ্যি লাভ হবে হে। আর সঙ্গে এত ছেলেমেয়ে চলেছে, তুমি থাকলে ভালোই হবে।
নবীন ডাক্তার বলে,
— পুণ্যির লোভও কম নয় ভুবনবাবু, এখন তো সময় আছে। দেখি রোগীপত্তর যদি সামলাতে পারি তবেই যাব।
নরহরি এতক্ষণ শুনছিল এদের কথা।
এবার বলে সে—জয় গৌর—জয় নিতাই। ডাক্তার, তাঁর কৃপা নাহলে কেউ যেতে পারে না হে। ওই যে দেখছ গাছের পাতা নড়ছে—তাও ওই গৌর সুন্দরের কৃপাতেই। আর পরিক্রমায় যেতে গেলে ওইসব তীর্থ—সব স্থান মাহাত্ম্য ও গোচরে থাকা আবশ্যক। ধর্মগ্রন্থ তো পড়নি ডাক্তার, কি বুঝবে স্থান মহিমা? কি অনুভব করবে তীর্থ মাহাত্ম্য? এর জন্য চাই নিষ্ঠা-ভক্তি-অধ্যয়ন—জ্ঞান লিপ্সা। গৌর হে—
জয় গৌর ধন্য মায়াপুর-
নরহরি যে বিরাট এক জ্ঞানী ভক্ত, বৈষ্ণব-শাস্ত্র ইতিহাস তাঁর নখদর্পণে সেইটাই দেখাতে চায়। নরহরি বলে গদগদস্বরে।
—ভূমির্ষত্র সুকোমলা বহুবিধ প্রদ্যোতিরত্নচ্ছটা
নানা চিত্র মনোহরং খগ—মৃগাদ্যাশ্চর্য রাগান্বিতম্।
বল্লীভূরুহজাতয়োহদ্ভুততমা যত্র প্রসূনাদিভি
স্তণ্মে গৌরকিশোর কেলিভবনং মায়াপুরং জীবনম্।।
নরহরি বাংলা তর্জমাটা জানিয়ে যে গদগদ স্বরে
—আর দুঃখ কেন বহুসাধনের জন্য।
অন্তদ্বীপাশ্রয়ে এবে হও ভাই ধন্য।
যথা রত্নচ্ছটাময়ী ভূমি সুকোমল।
খগ মৃগ যথা অনুরাগেতে বিহ্বল।।
বৃক্ষ লতা ফুল ফলে অদ্ভুত দর্শন।
সেই মায়াপুর হয় আমার জীবন।।
নরহরি বলে ওঠে—জয় গৌর, জয় নিতাই। মহাভাগ্য না হলে সেই মহাপুণ্য স্থানে কেউ যেতে পারে? কত কি দর্শনের আছে জানার আছে মূঢ়মতি মানুষ সংসার পাঁকে জড়িত হয়ে সেই চেতনাকে হারিয়ে ফেলেছে।
নবীন ডাক্তার চেনে ওই মহাপুণ্যবান মানুষটিকে
যার কীর্তি-কাহিনির কথা এখানের উপস্থিত সকলেই জানে।
ওর জন্যই ললিতা আজ তার একমাত্র সন্তানকে নিয়ে পথে দাঁড়িয়েছে আর নরহরি দখল করেছে ওর সর্বস্ব।
নাটমন্দিরের নিচে বসেছিল গ্রামের কিছু মানুষের দল। কেষ্ট-কানাই মোড়লরা জানে ওই নরহরির লোভ কত! ওর জন্যই কানাইকে মিথ্যা দেনার দায়ে সর্বস্ব হারিয়ে জেলে যেতে হয়েছিল। কেষ্ট-রাধু মোড়লদের সব জমি-জমা গেছে। আজও তাদের বুকের আগুন নেভেনি। ওরা ওই নরহরিকে চরম আঘাত দেবার শপথ নিয়ে ঘুরছে—সুযোগ পেলেই শেষ করে দেবে তাকে। নরহরির হরিভক্তির পালা চিরকালের জন্য চুকিয়ে দেবে।
কে আড়াল থেকে নরহরির ওই গদগদ ভাব দেখে বলে চাপা-স্বরে—অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।
ভুবনবাবুর কানেও যায় কথাটা। এখানে আরও কিছু মন্তব্য প্রকাশ পেতে পারে, তাই ওগুলোকে এড়াবার জন্যই ভুবনবাবু বলে সকলের উদ্দেশে—তাহলে কে কে যাবে কালই এখানে এসে নাম লিখিয়ে যেও, তখনই বলে দেব কি কি জিনিস নিতে হবে, আর কবে কখন যাত্রা শুরু হবে।
সকলেই যেতে চায়। তারা ভিড় করে নরহরিকে ছেড়ে।
এবার নরহরির মনে হয় ভুবনবাবু যেন তাকে এড়াতে চায় ওই পরিক্রমায়। কিন্তু নরহরি এ সুযোগ ছাড়বে না তার জ্ঞানের পরিচয় দিতে। তাই নরহরি বলে এগিয়ে এসে,
—কি গো ভুবনবাবু আমাকে নেবে না পরিক্রমায়?
যেচেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে চায় সে, ভুবনও আর এড়াতে পারেনা, বলে- সেকি কথা গো বিশ্বাসমশাই, আপনি কর্মব্যস্ত মানুষ, ভেবেছিলাম, সাত-আট দিন কি এসব কাজ ছেড়ে যেতে পারবেন পরিক্রমায়?
নরহরি বলে—ইহকালের কাজ তো অনেক হল ভুবনবাবু; এবার পরকালের কাজই করতে হবে। তাই পরিক্রমাতে যাব ভাবছি।
ভুবনবাবু বলেন—এ তো মহা আনন্দের কথা। আপনি সঙ্গে থাকলে অনেক প্রবচন শোনা যাবে, অনেক তত্ত্ব-তথ্য জানা যাবে।
নরহরি গর্জন করে—জয় শচীনন্দন গৌরহরি।
—তাহলে কাল বৈকালে এসে যাত্রার সব আয়োজন করা যাবে। আজ চলি—
নরহরি উঠল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
নরহরি বিশ্বাস নিজেকেই বিশ্বাস করে না। তার মনে হয় তার পিছনে অনেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ঘোরে। অনেকের বহু সর্বনাশ করেছে সে, তাই নরহরি গ্রামে তার আশপাশে দুজনকে রাখে, সহচর হিসাবে থাকে তারা। হ্যারিকেনটা নিয়ে তারাও ভিড়ের মধ্য থেকে উঠে নরহরির সঙ্গে চলে গেল।
কানাই-কেষ্টরা ওদিকে নাটমন্দিরের নীচের চাতালে বসেছিল ওদের নজর রয়েছে নরহরির উপর। কিন্তু মৌকামতো পায়নি এখনও। আজও তারা দেখে নরহরি বডিগার্ডদের নিয়েই চলে গেল এখান থেকে। ওদের সুবিধা হয় না। কানাই বলে চাপা-স্বরে,
—তাক মতো কোনোদিন ঠিকই পাব ব্যাটাকে।
কেষ্ট কি ভেবে বলে,
—শুনলে তো পরিক্রমায় যাচ্ছে বল্লে। ওখানে তো মাঠে-ঘাটে ঘুরতে হবে, তাঁবুতে রাত কাটাতে হবে। কে তখন পাহারা দেবে ওকে?
কানাই যেন সুযোগ পেয়ে গেছে। বলে সে,
—ঠিক বলেছিস কেষ্টা। আমরাও ভিড়ে মিশে পরিক্রমায় যাব, আড়ালে থাকব। রাতের বেলায় মৌকা পেলেই ব্যাটাকে খতম করে ওর ভণ্ডামি জীবনের মতো চুকিয়ে দেব। রাধু! রাধু যেন জ্বলছে। শোধ সে নেবেই। তাই বলে সে,
—নিশ্চয়ই পারব। তাই চল দাদা, ওই পরিক্রমাতেই ব্যাটাকে স্বপ্নের টিকিট কাটিয়ে দেব।
.
সারা-গ্রামে, আশ-পাশের গ্রামেও খবরটা ছড়িয়ে যায়। গ্রামের সাধারণ মানুষ কিছুটা ধর্মপরায়ণ, পরিক্রমার পুণ্যলাভ থেকে তাদের অনেকেই বঞ্চিত হতে চায় না। তাই অনেকেই যাবার কথা ভাবছে। আসছে ভুবনবাবুর কাছে।
অনিরুদ্ধ গ্রামের উৎসাহী তরুণ। কলেজের পড়া শেষ করে এখন চাকরির সন্ধান করছে। গ্রামেই রয়েছে আপাতত। গ্রামের স্কুলের শিক্ষকতা করছে আর অবসর সময়ে গ্রামের ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে কোনোদিন কোনো পুকুর পরিষ্কার করে, কোনোদিন রাস্তা মেরামতের কাজেই লেগে গেল দলবল নিয়ে, কোনোদিন বা পাড়ার বাজার, পাড়ার সব জঞ্জাল সাফাই-এর কাজে হাত লাগায়।
সেই অনিরুদ্ধকে ডাকিয়ে এনেছেন ভুবনবাবু। এত লোক যাবে, তাদের জন্য কিছু চাল-ডাল এসবের প্রয়োজন। কিছু তাঁবুও ভাড়া করতে হবে। কিছু তাঁবুতে আর গ্রীষ্মের দিন কিছু গাছতলাতেই রাত কাটাতে পারবে।
এ ছাড়া পরিক্রমা কমিটিকে জানানো দরকার তাদেঁর ভক্ত-সংখ্যা। জানালে সেখানে দুপুরে প্রসাদের ব্যবস্থা করা যাবে।
ভুবনবাবু তাই অনিরুদ্ধকে ডেকে পাঠিয়েছেন এসব কাজের জন্য। মন্দিরে এসেছে অনেকেই গোকুল-এর এখন স্কুলের ছুটি। পরীক্ষা হয়ে গেছে। তাই সেও এসে হাজির হয়েছে। ফুলের রাশ এনে মালা গাঁথছে আর পরিক্রমায় কী সব হবে তাই শুনছে।
অনিরুদ্ধকে আসতে দেখে গোকুল বলে,
—কি অনিদা, তুমিও যাবে তো পরিক্রমায়?
অনিরুদ্ধ বলে—তুই তো যাবি নির্ঘাৎ। আমার শখ নেই এই রোদে-পুড়ে মাঠে মাঠে ঘোরার, তবে ভুবনদার পাল্লায় পড়ে কি দশা হবে জানি না। কই গো ভুবনদা—
ভুবনবাবু মন্দির থেকে বের হয়ে আসেন। ওকে দেখে বলেন,
—এসে গেছিস অনি, নেমে তো পড়েছি একটা কাজে, এখন তোকে যে শেষ রক্ষা করতে হবে ভাই। তুই আমার বল-ভরসা।
অনিরুদ্ধ বলে—নাহ! তুমি ভক্ত হতে পারলে না। বলো—গৌরসুন্দর বল-ভরসা। জয় শচীনন্দন গৌরহরি। নরহরিকে দেখে ভক্তি কাকে বলে শেখো ভুবনদা। একেবারে ভক্তপ্রবর। ভুবনবাবু হাসেন। বলেন—ওসব কথা ছাড়। যাবার জন্য মনস্থির করেছি। এখন এত লোকের ব্যবস্থাদি করতে হবে। চিঠি লিখে দিচ্ছি তুই মায়াপুরে মহারাজাদের কাছে যা, ওঁদেরও জানানো দরকার। নাহলে এত লোকজন, মেয়েছেলে নিয়ে বিপদে পড়ব সেখানে গিয়ে। কোনো ব্যবস্থাই থাকবে না।
অনিরুদ্ধ বলে—তীর্থে যাচ্ছ যাও, তা দলবেঁধে কেন?
—ও তুই বুঝবি না। বোঝার বয়স হোক তারপর বুঝবি। তুই একটু সাহায্য কর ভাই, তুই পারবি এসব ব্যবস্থা করতে। নিজেদের রসদপত্রও কিছু নিতে হবে। দু’চারটে তাঁবুও।
অনিরুদ্ধ বলে—ঠিক আছে। ওই নরহরিকে কিছু ক্যাশকড়ি ছাড়তে বলো, বাকি সব ব্যবস্থা ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে করে ফেলব।
ভুবনবাবু বলেন—নরহরির সাহায্যের দরকার হবে না অনি, যারা যাচ্ছে তাদের অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছু দিচ্ছে, তাতেই চলে যাবে। নরহরির সাহায্যের দরকার হবে না।
অনিরুদ্ধ বলে— তোমার গুপ্তধন কিছু আছে ভুবনদা। ঠিক আছে, তোমার টাকা খর্চা করবে করো। আমি তার ব্যবস্থাও করে দেব।
সুবলবাবু বলে—জয় গৌরহরি, তরি দয়াতেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে তা জানি। তুই আজই চলে যা ওখানে। ওসব ব্যবস্থাদি করে আয়।
অনিরুদ্ধ বলে—দেখা যাক। কিছু তো করতেই হবে।
.
নরহরি এসে বিজয়গর্বে খবর দেয় তার স্ত্রীকে।
—বুঝলে, ওই ভুবনবাবু, ওই নাহয় কলেজে মাস্টারিই করেছিস তাই বলে বৈষ্ণব শাস্ত্রের কী বুঝিস তুই? গৌরাঙ্গ লীলারই বা কতটুকু জানিস? জয় গৌর—জয় নিতাই
কুন্তী দেখছে তার পতিদেবতাকে, হঠাৎ গৌরলীলা বিশারদ হয়ে উঠতে দেখে বলে—তা তুমি বুঝি অনেক জানো?
নরহরি দু’হাত জোড় করে বলে—সবই তাঁর দয়া, তাঁর দয়াতেই লীলামৃত পান করি, জয় গৌর। বুঝলে, তাই তো বল্লে ভুবন শেষে–বিশ্বাসমশাই পরিক্রমায় যাচ্ছি, আপনি সঙ্গে না গেলে চলবে না। কে সব লীলাপ্রসঙ্গে প্রবচন দেবে? কার এত জ্ঞান? আপনাকে তাই ছাড়ছি না। যেতেই হবে পরিক্রমায়।
কুন্তীও শুনেছে পরিক্রমার কথা। বলে সে,
—এই রোদে-গরমে আমি বাপু মাঠে মাঠে ঘুরতে পারব না। যেতে হয় তুমিই যাও। আমি বাড়িতেই থাকব।
—অ্যাঁ! নরহরির মাথায় যেন বাজ পড়ে। তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীকে একা বাড়িতে ফেলে রেখে পরিক্রমায় যাওয়া মোটেই সঙ্গত হবে না, অথচ পরিক্রমাতেও যেতেই হবে তাকে।
নরহরি বলে—তা কি করে হয় ছোটবউ, সস্ত্রীক আচরয়েত ধর্ম। শাস্ত্রে বলে সস্ত্রীক ধর্ম আচরণ করতে হয়। এত কাজ ছেড়ে আমি পরিক্রমায় যাচ্ছি, গ্রামের অনেকেই যাচ্ছে। মেয়ে পুরুষ সব। কোনো অসুবিধা হবে না। তোমার জন্য আলাদা তাঁবুই নেব। কাজের লোকজনও থাকবে। চলো, ক’টা দিন ঘুরেই আসবে। এই বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকার চেয়ে বাইরের ওই নাম-গান পরিক্রমা অনেক ভালো লাগবে, চলো।
কুন্তী কি ভাবছে। শুধোয় সে,
—গ্রামের বৌ-ঝিরা কেউ যাচ্ছে?
নরহরি বলে—অনেকেই যাবে শুনলাম। গোপালের মা—এই গোকুল, গোকুলের মাও যাবে।
কুন্তী চেনে ললিতাকে, গোকুলকেও চেনে। ছোট ছেলেটাকে ওদিকের ভাঙা বাড়িতে ঢুকতে দেখে, হাসি-খুশি ছেলেটাকে ভালো লাগে কুন্তীর। তবু এবাড়িতে ওদের আসা পছন্দ করে না নরহরি। আর ললিতারাও চায় না এবাড়িতে আসতে। যেখানে সবকিছুর মালিক ছিল সে, সেখানে কাঙালিনীর মতো আসতে চায় না ললিতা।
তবু পথেই দেখা হয় তাদের। কুন্তীর মনে হয় পরিক্রমাতে গেলে তবু ঘনিষ্ঠ হতে পারবে। নিঃসঙ্গ জীবনে কুন্তীও মুক্তির স্বাদ পেতে চায়
তাই রাজি হয় যেতে, নরহরির কথায় বলে সে।
—তাহলে চলো, ঘুরেই আসি। পরিক্রমায় গেলে মানুষ শান্তি পায়? বলছ তুমি?
নরহরি বলে—পায় বৈকি। তাহলে সব ব্যবস্থা করছি। জয় গৌর—জয় নিতাই। জয় শচীনন্দন গৌরহরি।
নরহরি নিশ্চিন্ত হয়েছে।
.
গ্রামে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। আশপাশের গ্রামের মানুষজনও যাবে পরিক্রমায়। অনিরুদ্ধ এর মধ্যে মায়াপুর এসে কর্তাপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের দলের যোগদানের খবরও জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষও এমনি স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের জন্য খুশি, বহুজনই আসছে বহুস্থান থেকে। সকলেই গৌরাঙ্গ নামে মাতোয়ারা হয়ে আসবে, তা নিশ্চয়ই নয়। তবু বহু মানুষই যায় পরিক্রমায়।
যুধিষ্ঠির-এর মতো মানুষরাও আসবে এই পরিক্রমায়। অবশ্য যুধিষ্ঠির আর ওই জুয়াড়ি রামচন্দ্র আগেই এসব ভেবেছিল, এখন সেটাকে তারা কাজে পরিণত করতে চায়। কারণ গ্রামের গৃহস্থরা এখন সাবধান হয়ে গেছে। চোরদের আর এখানে নিরাপদে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর ইদানীং ব্যাঙ্ক খুলেছে গ্রামের ভিতরেও। গৃহস্থ আগে টাকাকড়ি-সোনাদানা ঘরেই বাক্স, সিন্দুকে রাখত। চোরদেরও সুবিধা হতো। হানা দিলে কিছু মিলত।
কিন্তু এখন ওই ব্যাঙ্ক হওয়ায় গৃহস্থ চাষিবাসীরাও ব্যাঙ্কেই টাকা জমা রাখে, এমনকি সোনাদানাও সব রাখে ব্যাঙ্কের মজবুত লোহার সিন্দুকে।
চুরি করার মতো মালও ঘরে থাকে না। তাই যুধিষ্ঠিরদের এখন বাজার খুবই মন্দা। চুরি করে আর দিন চলে না।
সেদিকে রামচন্দ্রের বাজার ভালোই। মদের বাজার কদাপিও মন্দা যায় না। তুলসীদাসের আমলেও দেখা যায় দুধ যে বিক্রি করে তাকে গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে দুধ বেচতে হতো কিন্তু মদ যে বিক্রি করে তার ঘরেই খদ্দেরের লাইন পড়ে।
—গোরস গলিগলি ঘুরে।
সুরা বৈঠল বিকায়।।
সুতরাং রামচন্দ্রের দোকান ঠিকই চলছে আর জুয়ার ছকের ব্যবসাও ঠিক আছে। মানুষ দমকা কিছু টাকা পেতে চায়, এই লোভ তার চিরন্তন। তাই জুয়া খেলবেই মানুষ।
তবু মেলায় পরিক্রমায় বহু ধরনের মানুষ আসে। হাজার হাজার রকমারি মানুষের ভিড় জমে। ওদের মধ্যে কেউ আসে সত্যিই শান্তি পেতে, কেউ আসে গৌরকৃপা লাভের আশায়, অনেকেই আসে মজা দেখতে। আর বেশ কিছু মানুষ ওই পরিক্রমার সঙ্গে থাকে। কেউ ঠাণ্ডা পানীয় — ডাব সন্দেশ এসবের চলমান দোকান নিয়ে চলে। বিক্রিবাটা ভালোই হয়।
কেউ ওদের বিশ্রামের জায়গাতে নিরামিষ ভাত সবজির দোকান দেয়। কেউ পান-পূজার দ্রব্য ফিরি করে। আর যুধিষ্ঠিরের মতো কিছু পেশার লোকও থাকে দলে।
এখানে খোলামেলা, চুরি—পকেটমারি, বাটপাড়ির সুযোগও বেশি। তাই তারাও জোটে আর সারাদিন পরিক্রমার পর সন্ধ্যায় কোনো লোকালয়ের কাছে মন্দির চত্বরে নাহয় বাগানে অস্থায়ী তাঁবুতে রাত কাটায় যাত্রীরা, অনেকে গাছতলাতেই আশ্রয় নেয়, না হয় সাধারণ মণ্ডবেই থাকে। যুধিষ্ঠিরদের হাত সাফাই-এর কাজও যেমন চলে, তেমনি রামচন্দ্রও জুয়ার ছক পেতে বসে গাছতলায় আর মেলায়— যেমন লোক আসে পরিক্রমা দেখতে তেমনি আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন ভেঙে পড়ে, তারাই জুয়ার ছকেও বাজি ধরে, আর যুধিষ্ঠিরদের হাত সাফাইয়ের পাত্রও হয়ে যায়।
এইভাবেই দমকা কিছু আমদানি হয় যুধিষ্ঠির-এর। তাই যুধিষ্ঠির বলে—রামদা, গাঁয়ে তো পেটও ভরবে না। উলটে ধরা পড়ে প্যাঁদানি খেতে হবে, তার চেয়ে চল ওই পরিক্রমায়। হরিনাম করে খেতেও জুটবে কদিন আর রাত-বিরেতে ঠাকুরের দয়ায় যদি মাল কিছু জুটে যায়— তবু সুরাহা হবে। তোমার জুয়ার আসরও বসে যাবে।
রামচন্দ্র ভাবছে কথাটা। বলে সে,
—তা মন্দ বলিসনি। বসে থাকি না ব্যাগার দিই। বসেই তো খাব ঘরে, তার চে হরিবোল করে খাওয়াও জুটবে আর হাত সাফাই করে যদি কিছু আসে মন্দ কি। চল পরিক্রমাতে চল। জয় গৌরহরি—দয়া করো ঠাকুর।
.
গৌরহরি সত্যিই অপার করুণাময়।
নরহরি ডাকে গৌরহরিকে তার পাপের ভার বইতে, ভুবন ডাকে শান্তির আশায়। ললিতা ডাকে আলোর সন্ধানে, চোরা যুধিষ্ঠির ডাকে তাকে—যাতে চোরাই মাল বেশি জোটে।
রামচন্দ্র ঠাকুরকে ডাকে, যাতে লোককে জুয়ার নেশায় সর্বস্বান্ত করতে পারে সে। নানাজন নানা উদ্দেশ্যেই দেবতাকে ডাকাডাকি করে। দেবতারা কতটা সাড়া দেন না, দেবতারাই জানেন। তবু পাবলিকের ডাকাডাকির বিরাম নাই।
.
ভুবনবাবুর মন্দিরে আজ বহুভক্তের সমাবেশ হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় সকলে সমবেত হয়েছে। কাল ভোরে ব্রাহ্মমুহূর্তে শুরু হবে ওদের যাত্রা।
সন্ধ্যায় পাঠ করছেন ভুবনবাবু। ভাঁর উদাত্ত-কণ্ঠস্বর শোনা যায়। নবদ্বীপ মাহাত্ম্য বর্ণনা করছেন তিনি ভক্তদের সামনে। এই প্রসঙ্গে বলেন,
—শ্রীকৃষ্ণের ধাম-বৃন্দাবন। চিন্ময় গোলক বৃন্দাবনের বিস্তার এই জড় জগতে। তেমনি চৈতন্য মহাপ্রভুর ধাম নবদ্বীপ চিন্ময় জগতের একাংশ। গোলকের দুটি প্রকোষ্ঠ। তার একটি বৃন্দাবন অন্যটি নবদ্বীপ। শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ভক্তদের নিয়ে তার মাধুর্য লীলা বিলাস করেন আর নবদ্বীপ ধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেই ভক্তদের নিয়েই কৃষ্ণপ্রেম কিরণরূপ ঔদার্য লীলাবিলাস করেন। সেই ঔদার্য ধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা এখনও প্রকট। যাঁদের বিস্ময় চক্ষু-উন্মীলিত হয়েছে, তাঁরা তা দেখতে পান।
—অদ্যপি নিত্যলীলা করে গোরা রায়।
কোন কোন ভাগ্যবান দেখিবারে পায়।।
সারা নাটমন্দিরে সেই ভাষণ ছড়িয়ে পড়ে। ললিতা গোকুলকে নিয়ে এসেছে। এসেছে গোপালের মা—মন্দিরে বসে আছে আরও অনেকে। পায়েলও এসেছে—তার জীবনে যেন একটা পরিবর্তনের সুর ফুটে উঠছে।
.
কদিন ধরেই দেখছে মোনা মিত্তির ওই পায়েলকে। কলকাতার নামকরা বাইজি। ওর নাচগান মুজরোতে টাকা ওড়ে। বহু কোটিপতি আসে ওর কৃপা-কটাক্ষ লাভের আশায়। মোনা মিত্তিরও এসে পড়েছিল—তারপর পায়েল কলকাতার ওই জীবন ছেড়ে চলে এসেছে এখানে। মোনা মিত্তিরও তার পিছু ছাড়েনি।
এককালে মোনা মিত্তিরদের খুবই নামডাক ছিল কলকাতা শহরে। মনমোহন মিত্তিরের পিতার নামে কলকাতা শহরে রাস্তা আছে। ওরই পাশে মোনা মিত্তিরদের চকমিলানো বাড়ি। দোল-দুর্গোৎসবও হয় বেশ ঘটা করে। কলকাতা শহরে বেশ কিছু বাড়ি-জমিও রয়েছে। মিত্তিরদের আগে বিস্তীর্ণ জমিদারি ছিল বিহারে, উড়িশায়, উত্তরবঙ্গে। জমিদারি চলে যাবার পর অবস্থা পড়ে এসেছে। তবুও মরা-হাতি সওয়া লাখ। নাই নাই করেও এখন যা আছে, মোনা মিত্তিরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে তা কম নয়।
কিন্তু নেই সংসারে শান্তির আশ্বাস। মোনা মিত্তির তাই ঘরে থাকতে পারে না। ঘরে অভাব কিছুর নেই। তার স্ত্রী চন্দনা রূপে-গুণে কম কিছু নয়। মোনা মিত্তিরের পিতৃদেব জানতেন তাদের বংশে পুরুষদের এক ফুলে মন বসে না। মিত্তির বংশের রক্তে সেই জ্বালা রয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষরা অনেকেই রাতে জুড়ি গাড়ি নিয়ে বের হতেন, তাদের বাঁধা মেয়েমানুষ ছিল—সেখানে গভীর রাত অবধি নাচগান-এর পালা চুকিয়ে মদ্যপান করে কোচম্যান দারোয়ানের ঘাড়ে চেপে বাড়ি ফিরতেন প্রায় শেষ রাতে।
এই বাইরের নেশা ঘোচাবার জন্যই মিত্তিরমশাই—তস্য পুত্র মনমোহনের বিয়ে দিয়ে বউ এনেছিলেন—নামকরা রূপবতী একটি কন্যাকে।
চন্দনা খুব বড় লোকের ঘরের মেয়ে ছিল না। তার রূপগুণের জন্যই সে এসেছিল মোনা মিত্তিরের জীবনসঙ্গিনী হয়ে, আর আসার কিছুদিন পরই বুঝেছিল চন্দনা এদের অর্থ আছে, আর সেই অর্থ প্রতিষ্ঠা তার পতিদেবতাকে অমানুষই করে তুলেছে।
সন্ধ্যার পর লোকটা ঘরে থাকে না। দিনভোর ঘুমায়—ওঠে বেলা এগারোটা নাগাদ, তখন তার সকাল। প্রাতঃকৃত্য সেরে জলখাবার খায় মোনা মিত্তির বেলা বারোটা নাগাদ–আর দুপুরের খাওয়া সারতে তার বৈকাল চারটে বাজে—তারপর নিদ্রা—ওঠে সন্ধ্যা আটটায়।
সব ব্যাপারটাই তার আলাদা। আটটায় চা-টা খেয়ে স্নান সেরে এবার চুনাট করা ধুতি কলকাদার আদ্দির পাঞ্জাবি পরে গলায় চাদর জড়িয়ে ইয়ারবক্সীদের জন্য অপেক্ষা করে। তারাও এসে যায়। বৈঠকখানায় দু’ এক পাত্র চড়িয়ে হাতে গোড়ের মালা জড়িয়ে জুড়ি হাঁকিয়ে এবার মোনা মিত্তির তার বাঁধা বাইজি বাড়িতে গিয়ে মুজরো বসায়।
রাত্রি বারোটায় তাদের মজলিশ, মদ্যপান শুরু হয় মাত্র।
.
ঘরে চন্দনা স্বামীর পথ চেয়ে থাকে।
তার জীবনে অনেক আশাই ছিল। আর পাঁচজন মেয়েদের মতো সেও স্বপ্ন দেখেছিল, স্বামীকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। তার বিয়ের পর আত্মীয়-স্বজন বলেছিল—চন্দনা তোর বহু ভাগ্য রে তাই এমনি নামী ঘর বর পেয়েছিস।
কিন্তু ক্রমশ চন্দনা জেনেছিল বাইরে থেকে দেখে প্রকৃত সত্যটাকে জানা যায় না। ক্ৰমশ সেটাকে কাছে থেকে জেনেছে, আর ততই হতাশ হয়েছে চন্দনা। স্বামীকেও বলে সে— রোজ রাতে না গেলেই নয়?
মোনা মিত্তির হাসে। বলে—ও তুমি বুঝবে না। তোমার কোনো অভাব তো রাখিনি। তবে আমার পিছনে কেন লেগেছ বাবা। তুমি যেমন আছো থাকো—আমাকেও আমার পথে চলতে দাও।
চন্দনা দেখেছে রোজ রাতে স্বামী বের হয় সেজেগুজে আর গভীর রাতে ফেরে কোচম্যান, দারোয়ানের ঘাড়ে চেপে, কোনোরকমে বেহুঁশ মদের ঘোরে বেঘোর মানুষটাকে তারা এনে বিছানায় জমা করে চলে যায়।
বমিও করে কখনও। বিশ্রী পচা-দুর্গন্ধ ছাড়ে—দনা নিজেই সেসব সাফ করে, জুতো- মোজা খুলে শুইয়ে দেয়। এই তার পতিসেবা।
বেলায় যখন ঘুম ভাঙে— খোয়াড়ি ভাঙে। তখন মনমোহন মিত্র আলাদা মানুষ।
চন্দনার খাস ঝি-মানদা এবাড়িতে আছে অনেকদিন। এবাড়ির পুরুষদের রীত-রেওয়াজ সে জানে। চন্দনাকে আড়ালে বলে, –এই বড় বাড়ির এই রেওয়াজ দিদিমণি। সোয়ামি আছে এই মাত্তর—তারা রাত কাটায়, ফূর্তি করে অন্য মেয়ের ঘরে। আর নেশা ভাঙে—তাদের নিজের ঘরে। আর কোনো দোষই নেই।
চন্দনা তাই দেখেছে। এটাকে সে মেনে নিতে পারে না। তাই বলে সে
—এ কেন হবে? স্বামীর কি কোনো কর্তব্যও নাই? স্ত্রীর কি কিছু পাবার অধিকার নেই?
মোনা মিত্তির স্ত্রী কথায় তাকাল। বলে সে,
—ওরে বাবা, এ যে লেকচার দেয় গো, অ্যা–ঝাণ্ডা নিয়ে মিটিং মিছিল করবে নাকি? কলেজে-পড়া মেয়েদের নিয়ে যত বিপদ!
চন্দনা বলে—আমাদের দাবি কেন মামকে না? সংসার যখন করেছ—স্ত্রীর অধিকার দিয়েছ, কেন দাবি করব না?
—কী করতে হবে? শুধোয় মোনা মিত্তির।
চন্দনা বলে ওই মুজরোয় রাতে যাওয়া চলবে না।
—মদও ছাড়তে হবে।
চন্দনা বলে, ছাড়তে পারলে ভালোই হবে। একেবারে পারবে না। যদি খেতে হয় বাড়িতেই খাবে।
হাসে মোনা মিত্তির—অ্যাঁ! গুডবয় হতে হবে? শোনো—জরুকা গোলাম এই মিত্তির বংশের কেউ হয়নি। আমিও হবো না। তোমার ওইসব কথা বন্ধ করে যেমন আছ, তেমনি থাকো। আমাকে কিছুদিন বাইরে যেতে হবে। ফিরে এসে কথা হবে।
বাইরে যাবার নাম করে মোনা মিত্তির এসে হাজির হয়েছে এখানে ওই পায়েলের বাগান বাড়িতে। এখানেই গেড়ে বসেছে। পায়েল এটা ঠিক পছন্দ করে না। বারবার বলে সে,
—মিত্তির মশাই কত বড় ঘরের ছেলে তুমি তা জানি। ঘরে তোমার সতীলক্ষ্মী স্ত্রী, সংসার। সব ছেড়ে একটা বাজারের বাইজির পিছনে ঘুরবে না, এ হয় না। তুমি কলকাতায় যাও। বাড়ি ফিরে যাও। আমাকে আমার পথে চলতে দাও।
মোনা মিত্তির বলে—নতুন কোনো শাঁসালো মক্কেল জুটেছে নাকি? কত টাকা দিচ্ছে বলো? মোনা মিত্তির তার ডবল দেবে পায়েল। নাচো—গাও। খুশি করে দেব তোমায়।
পায়েলের মনে বাজে ভুবনবাবুর কথাগুলো। তার জীবনের পরিচয় দিয়েছিল পায়েল ভুবনবাবুকে। বলে পায়েল—আমি নটী, পাপী বাবা।
ভুবনবাবু বলেন,
শত কোটি জন্মের পাপ শুধুমাত্র নামাভাসেই দূর হয় মা, নাম কর। মহানামের প্রভাবে তুমি সব পাপ মুক্ত হয়ে আবার গৌরকৃপায় নতুন করে বাঁচবে মা। সব পাপ-তাপ তোমার দূর হয়ে যাবে।
কথাগুলো সারা মনে ঝড় তোলে পায়েলের।
মোনা মিত্তিরের মনে ওই সমস্যা—দ্বিধা কিছুই নাই। সে মদ বোঝে—আর ভোগ বোঝে তাই বলে,
—নাচো পায়েল, তোমার নাচে যেন মনে আগুন জ্বলে ওঠে। নাচো—
পায়েল ওই জীবনে আর ফিরে যেতে চায় না। ঘুঙুরগুলো সশব্দে ছুড়ে ফেলে সে ঠাকুর ঘরে গিয়ে কৃষ্ণরাধা মূর্তির সামনে আছড়ে পড়ে।
পায়েল ভুবনবাবুর কাছ থেকে ওই মূর্তিটা এনে নিত্যপূজা করে—আজ ওই মূর্তির সামনে তার দু’চোখ জলে ভরে ওঠে।
আর্তকণ্ঠে গায় সে।
—মানস, দেহ গেহ যো কিছু মোর।
অর্পিলু তুয়া পদে, নন্দকিশোর।।
সম্পদে বিপদে, জীবনে মরণে।
দায় মম গেলা, তুহা ও-পদ বরণে।।
মারবি রাখবি— যো ইচ্ছা তোহারা।
নিত্য দাস প্রতি তুয়া অধিকারা।।
জনক, জননী দয়িত তনয়।
প্রভু গুরু, পতি—তুহুঁ সৰ্বময়।।
ভকতি বিনোদ কহে শুন কান।
রাধানাথ। তুই হামার পরাণ।।
এ যেন এক নতুন পায়েল—আত্মনিবেদন করে সে আজ ওই রাতুল চরণে।
.
চন্দনা এভাবে নিজেকে বঞ্চিত করতে চায় না। চন্দনার বাবা ছিলেন বহরমপুর কলেজের অধ্যাপক, আর তখন থেকেই চন্দনা পিতৃবন্ধু অধ্যাপক ভুবনবাবুকেও চেনে। পাশাপাশি কোয়ার্টার। ভুবনবাবুর মেয়ে ছিল না—চন্দনাকেই মেয়ের মতো দেখতেন। ক্রমশ তার চোখের সামনে মেয়েটা বড় হয়ে ওঠে–বিয়ে-থাও হয় তার।
ভুবনবাবুও খুশি হন চন্দনার এমন বড় ঘরে বিয়ে হবার জন্য। তাই কলকাতায় এলে ভুবনবাবু চন্দনার সঙ্গে দেখাও করেন তাদের এই বড় বাড়িতে এসে। চন্দনাও কাকাবাবুকে আদর যত্ন করে।
ভুবনবাবু কিন্তু কোনোদিনই মোনা মিত্তিরকে দেখেনি। সকালে যখন যান তিনি ওবাড়িতে, তখন মোনা মিত্তির গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন
তবু ভুবনবাবুর মনে হয় এত ঐশ্বর্য সত্ত্বেও চন্দনার মনে একটা হতাশার ছায়া রয়েছে। কোথায় সে নিঃস্ব-রিক্ত।
ওর কথায় সেই বেদনাই ফুটে ওঠে।
বলে চন্দনা—ঠাকুরকে ডাকলে সব দুঃখ তিনি দূর করেন কাকাবাবু?
ভুবনবাবু বলেন—হ্যাঁ মা।
চন্দনাকে তিনিই গৌরাঙ্গদেবের একটা ছবি দেন।
—এঁকে ভক্তি-ভরে পুজো করবি মা। সব অশান্তি দূর হবে।
চন্দনা তারপর থেকে কেমন যেন ভক্ত হয়ে যায় চৈতন্যদেবের। নাম-কীর্তন করে, নিজের মনে কীর্তন করে, শান্তি পায়।
মানদার দেশও নবদ্বীপের ওদিকেই। মানদা বলে,
—বড় জাগ্রত দেবতা গো। সারা দেশের মানুষ ওকে পুজো করে। সকলের সব কষ্ট তিনি ঘুচিয়ে দেন গো। নবদ্বীপধাম পরিক্রমাও হয় কদিন ধরে। কত মানুষ যায়—আমাদের গাঁয়ের উপর দ্বে পরিক্রমা যায়। ওই পরিক্রমায় গেলে গৌরাঙ্গের দয়ায় সব ঘুচে যায় দিদিমণি।
চন্দনার কষ্ট অনেক। এই সম্পদ বৈভবে তার রুচি নাই, প্রয়োজনও নাই। তার স্বামীও ঘরবাসী হল না, কি এক বাইজির মোহে ঘর ছেড়ে তার পিছনেই ঘুরছে।
কথাটা ভাবলে চন্দনার দুচোখ জলে ভরে আসে। এ তার নারীত্বের চরম পরাজয়। অতি বড় লজ্জার কথাই, যা কাউকে বলা যায় না।
স্বামীকে ঘরে সে ফিরিয়ে আনবেই তাই গৌরাঙ্গের চরণে আকুল প্রার্থনা জানায়। মানদা ঝি বলে,
—দিদিমণি পরিক্রমায় যাবে? ওই গৌরাঙ্গদেবের ধাম পরিক্রমায় গেলে তাঁর দয়ায় সব অশান্তি কেটে যায়। সব মনস্কামনা ঠাকুর পূর্ণ করেন।
চন্দনা ভাবছে কথাটা। মানদা বলে,
—তাহলে চলো, ওই পরিক্রমার কর্তারাও আমার চেনা-জানা, আমার বাবাও যায় গো। কোনো অসুবিধা হবে না। না হয় সরকার মশায়কেও সঙ্গে নেবে।
চন্দনার কথাটা মনে ধরে। বলে সে,
—সরকার মশাইকে ঘরে গে বলবি আমি ডাকছি।
.