পরিক্রমা – ২

নবীন ডাক্তার এই কুসুমগ্রামে ডাক্তারি করতে এসেছিল ওই শশীবাবুর বাবার আমল থেকেই শশীবাবুর বাবার আমলে এদের নামডাকও ছিল জোর আর তখন জমিদারির আয়-পয়ও ছিল ভালো। শশীবাবুর বাবা গোপিকা বিলাস বাবুই গ্রামে তখন ওই ডাক্তারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

তার কিছুদিন পর নবীনবাবুকে তিনি আনেন এখানে। ডাক্তারি পাশ করেছে সবে নবীন, নবীন এখানে এসে ডাক্তারি শুরু করে, সে আজ বহুদিন আগেকার কথা। 

তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। গোপিকাবিলাস বাবুর শেষ বয়সেই তার জমিদারিতে ভাঙন ধরে। ডাক্তারখানা চালাবার সামর্থ্য আর তার ছিল না। 

সরকারই এখন কিছু সাহায্য করে, নবীন ডাক্তারই দেখাশোনা করে। আর তার জনপ্রিয়তার জন্য এখানে রোগীর ভিড়ও লেগেই থাকে। 

নবীন ডাক্তার এই গ্রামেরই একজন হয়ে রয়ে গেছে। 

ভুবনবাবু তারপর রিটায়ার করে গ্রামে এসে বসেন। নবীনও একজন ভালো সঙ্গী পায়।

সারাদিন ডাক্তারি করে সন্ধ্যার পর নবীনও মন্দিরে যায়, ভুবনবাবুর পাঠ শোনে, নানা আলোচনাও হয়। 

সেদিন সন্ধ্যার পর আকাশে মেঘ নামছে। কাল বৈশাখীর সূচনা হয়েছে। এদিনে বেশ গরমও পড়েছে। এই অঞ্চলে গরমটাও যেমন চেপে পড়ে—শীতও আসে জাঁকিয়ে, আর এখানে অন্যতম প্রধান ঋতু বর্ষাকাল। 

বৃষ্টিও হয় প্রচুর। কিছুটা নাবাল বিল অঞ্চল। এদিকে-ওদিকে বহু নিচু জমিতে জল জমে বর্ষার সময়। ফুলে-ফেঁপে ওঠা গঙ্গা আর জলঙ্গির বাড়তি জল এসে জমে থাকে—বিলে। শীতের শেষেও সেই বিলগুলোতে জল দেখা যায়। 

বর্ষার সময় এদিকের চেহারাই বদলে যায়। বিলের ধারের গ্রামগুলো ডুবু ডুবু হয়ে ওঠে। জল এসে ঠেকে রাস্তার ধারে। 

আবার শীতেও চারদিক রবিশস্য-গম, ছোলা-মসুরি কলাইয়ের গাছে সবুজ হয়ে ওঠে প্রান্তর।

গ্রীষ্মেও রবিশস্য উঠে যাবার পর চাষিরা মাঠ জুড়ে আবার বোরো ধানের চাষ শুরু করে। জলের অভাব নেই, বিলে রয়েছে অফুরান জল। দিগন্ত প্রসারী খেতে নামে সবুজের ঢল।

গ্রামগুলোয় মোটামুটি সাদৃশ্য রয়েছে, অবশ্য এর মধ্যে মাৎস্যন্যায় পর্ব ঠিকই চলে। বড় মাছরা চিরকাল ছোট মাছদের খাবেই এইটাই নিয়ম। 

তেমনি সমাজের কিছু বুদ্ধিমান মানুষ নিজেদের বুদ্ধির মারপ্যাঁচে ফেলে বেশ কিছু লোককে শোষণ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা-পুঁজি বাড়াবেই। তাই নরহরির দল চিরকালই সমাজের বুকে আছে, থাকবে। 

আবার ওই নবীন ডাক্তারের মতো মানুষও আছে, যে নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে আর্ত মানুষের সেবা করে চলে। ভুবনবাবুর মতো সর্বত্যাগী ধর্মপ্রাণ মানুষও আছে এই সমাজেই। 

.

আর পায়েল-এর মতো মেয়েরাও রয়েছে। বাঁচার তাগিদে তাদের এই পথে আসতে হয়েছে, কারণ মোনা মিত্তিরের মতো মানুষদেরও অভাব নেই সমাজে। 

তারা গাছেরও খাবে আবার তলারও কুড়োবে। ঘরে একজনকে বিয়ের নামে বন্দি করে রেখেছে। তার কথা ভাবার সময়ও নাই। তার প্রতি কোন কর্তব্য যে আছে তাও ভাবেনি। সংসারের ঘানিতে তাকে জুতে রেখে মোনা মিত্তির বের হয় পায়েলদের সন্ধানে। মৌজ মস্তিতেই তারা ডুবে থেকে জীবনটাকে কাটিয়ে দিতে চায়। পায়েলের মতো মেয়েরা তাদেরই শিকার 

পায়েল তবু এই জীবনকে মেনে নিতে পারেনি। তাই কলকাতা থেকে চলে আসে এই শান্ত-পরিবেশে। ওই মুজরো আর মদ্যপানের হল্লা থেকে সরে এসেছে। 

সন্ধ্যাটা এখানে কাটে পায়েলের নদীর ধারে ছায়া নামা ওই ভুবনের আশ্রমে, নাটমন্দিরে পাঠ হয়, ভুবনবাবুর সুরেলা কণ্ঠস্বরে চৈতন্যচরিতামৃত পাঠ—তার ব্যাখ্যা পায়েলের কাছে কি এক নতুন অনুভূতির স্পর্শ আনে। 

কলিযুগে শ্রীচৈতন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন পাপ-তাপ-সন্তপ্ত মানুষকে উদ্ধার করতে। তিনি পতিত জনের বন্ধু—পাপীতারণ। 

ভুবনের সুরেলা কণ্ঠস্বর ম্লান অন্ধকারে ধ্বনিত হয়—তাতে ফুটে ওঠে অন্ধকারের ভিতর আলোর দিশা—যে আলোয় পায়েলের মতো তমসাচ্ছন্ন মনও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। 

পায়েল স্তব্ধ হয়ে এক কোণে বসে ওই অপূর্ব ব্যাখ্যা শোনে—সারা অন্তরে কি যেন আশ্বাস জাগে—তার জন্যও রয়েছেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যাঁর আশ্রয়ের আশায় পায়েলের চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে। 

ভুবনবাবু, নবীনবাবু গ্রামের বহু মানুষ অনেকেই আসে। নরহরি বিশ্বাসকেও দেখা যায় মাঝে-সাঝে এই মন্দিরে। নরহরি বিশ্বাসের এখন দিনকাল ভালোই চলছে। 

ডাইনে-বাঁয়ে তার আমদানিও অব্যাহত রয়েছে। তাই মন্দিরে যখন আসে নরহরি তার আগমন বার্তাটা নিজেই ঘোষণা করে দেয় প্রকারান্তরে। 

মন্দিরে একটা থালা রাখা আছে দেবতার সামনে, কোনো ভক্ত যদি প্রণামি কিছু দিতে চান ওই থালাতে দিতে পারেন, অবশ্য এ নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। স্বেচ্ছায় যদি কেউ প্রণামি দেন তার জন্যই থালাটা রাখা আছে। 

নরহরি বিশ্বাস এসে ওই থালায় বেশ জোরে জোরে একটা করে টাকা ছুড়তে থাকে। সশব্দে থালায় টাকাটা পড়ে—প্রথমে একটা, তারপর আরও একটা, এইভাবে প্রণামির থালায় সশব্দে টাকা দিয়ে নরহরি বিশ্বাস তার আগমন বার্তা ঘোষণা করে সর্বজন-সমক্ষে। 

দেখেন ভুবনবাবু; তার ভাগবত পাঠের ছন্দ কেটে যায়, বিরক্তি-ভরে পাঠ বন্ধ করে চেয়ে থাকেন। নরহরি এবার গর্জে ওঠে। 

—জয় গৌর, জয় নিতাই। 

তারপর ওই বিশাল বপুখানাকে আলতো ভাবে ‘থ্রো’ করে দেয় নিপুণ গোল কিপারের মতো। অর্থাৎ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে এবার হুঙ্কার ছাড়ে নরহরি। 

—দয়া কর হে নিতাই, জয় গৌর। 

পায়েলও দেখেছে ওই বিশ্বাস মশায়ের উৎকট ভক্তির প্রচার। 

ভুবনবাবু আবার পাঠ শুরু করেন। 

.

মোনা মিত্তির অবশ্য মন্দিরের দিকে বড় একটা আসে না। সন্ধ্যার পর মোনা মিত্তির ওই বাগানবাড়িতেই থাকে— —ওদিকে তার শখের পায়রা কিছু আছে। মোনা মিত্তিরের পায়রার ঝোঁক অনেক দিনের। 

পায়রা-ওড়ানো তার একটা খেলা, আর মদ্যপানও। এ নিয়ে পায়েলও বহুবার বলেছে,

—এবার ছাড়ো। অনেক তো গিলেছ ওই মদ। এবার যে লিভার পচে মরবে মিত্তির মশাই। এসব ছেড়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। 

হাসে মোনা মিত্তির। 

—মোনা মিত্তিরকে জ্ঞান দিও না পায়েল। মোনা মিত্তির নিজের হিসেবেই চলে। কারও হিসাবের ধার ধারে না। 

মোনা মিত্তির তাই তার হিসাব মতো রয়ে গেছে এখানেই। পায়রা ওড়ায় শিস দিয়ে, আর বাগানের মালিকে দিয়ে মদ-এর সাপ্লাই লাইনটা বজায় রেখে চলে। 

বলে সে—বুঝলে পায়েল, কেবল বদনাম দাও, মদ খাও— মদ খাও, মাইরি। 

জীবনে মদ খেয়েছি একবার- 

অবাক হয় পায়েল—একবার? সেকি! তাহলে রোজ কী খাও? 

হাসে মোনা মিত্তির 

—হ্যাঁ অনলি একবারই মদ খেয়েছি, আর বাকি তো খোঁয়াড়ি ভাঙি। 

মোনা মিত্তির ওই মন্দিরের দিকে যায় না। 

বলে—সন্ধ্যায় ওরা নামকেত্তন করে মন্দিরে, আমিও এখানে আহ্নিকে বসি। 

অর্থাৎ সন্ধ্যার পর মোনা মিত্তিরও বোতল নিয়ে বসে। 

পায়েল অবাক হয় ওই বিচিত্র মানুষটাকে দেখে। কলকাতার নামী বনেদি পরিবারের ছেলে, ঘর-বাড়ি আপনজন—মায় স্ত্রীও রয়েছে সেখানে। তবু সেখানে না গিয়ে এখানেই পড়ে আছে। পায়েল বলে—বাড়ি যাও বাবু, এখানে কিসের আশায় পড়ে আছ? মোনা মিত্তিরের চোখে গোলাবি নেশার আমেজ। বলে সে, 

—বললাম তো, আমি আমার হিসেবে চলি। আমাকে ডিসটার্ব করো না। আমি কি তোমাকে ডিসটার্ব করি? বলো? 

পায়েল জানে লোকটার বিশেষ দাবি নেই, তাকে জ্বালাতনও করে না। তবু পায়েলের মনে হয়, লোকটার ঘরছাড়ার জন্য সেইই অপরাধী। এই অপরাধবোধটা তার মন থেকে মুছে যায় না। তাই প্রায়ই বলে পায়েল ওই চলে যাবার কথাটা, কিন্তু মোনা মিত্তির যায়নি আজও। এইখানেই রয়ে গেছে ওইভাবে। কি যেন দুঃখে-অভিমানে একটা মানুষ সব থাকা সত্ত্বেও তিলে তিলে নিজেকে এইভাবে শেষ করছে। পায়েলের কাছে এটা বিশ্রী লাগে। কিন্তু তারও করার কিছুই নাই। 

.

গোপালের মা কুসুমপুরের ইত্যিজনের মধ্যে অন্যতম। তার বিশেষ কোনো পরিচয়ও নাই। ওর স্বামী নিরাপদের ঘর ছিল মোড়ল পাড়ার একপ্রান্তে। সামান্য কিছু জমি ছিল নিজের, আর কিছু অন্যের জমি ভাগে চাষ করত। সংসার তার ছোটই। স্বামী-স্ত্রী আর তাদের একমাত্র সন্তান গোপালকে নিয়ে তার সংসার। 

গোপালের মা খুবই নিষ্ঠাবান মহিলা, তখন থেকেই দেব-দ্বিজে তার ভক্তি। সংসারটা ছিল সাজানো—ঘরই যেন তার কাছে মন্দির হয়ে উঠেছিল। 

মন্দিরে আসত। গাছের প্রথম ফল, গোরুর প্রথম দুধ যখন যা হতো তাই নিয়ে আসত মন্দিরে।

ভুবনবাবু বলতেন—এতসব কেন গো গোপালের মা? 

গোপালের মা ভক্তিভরে বলত—সবই ওঁর দয়ায় জুটছে, ত্যানাকে নিবেদন করব না বাবাঠাকুর? তাই নে এলাম। 

ভুবনবাবু জানেন, ওর সংসারের অবস্থা। 

ও জিনিসগুলো থাকলে ওদের সংসারের সাশ্রয়ই হতো, তবু বলার কিছুই নেই। ও আনবেই।

নিরাপদ হঠাৎ সর্পাঘাতে মারা গেল। অবশ্য নবীন ডাক্তারের কাছে এসেছিল। কিন্তু অনেক দেরিতে। প্রথমে রোজা পত্র করে তাতে তেমন কিছু না হতে তারপর এসেছে, তখন আর করার কিছুই নেই। 

নিরাপদ চলে যাবার পর মহিলা তার একমাত্র সন্তান গোপালকে নিয়েই কোনোমতে মুড়ি-চিড়ে ভেজে, টুকটাক কাজ করে সামান্য রোজগার করত। আর গোপালও ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে, মায়ের প্রত্যহের সংসার চালানোর ভাবনাটারও কিছুটা সুরাহা হয়। 

গোপালের মা ভেবেছিল তার দিন এইবার বদলাবে। আবার ঘরে চাষ ফাঁদবে, গোরু, বলদ কিনে চাষ শুরু করবে গোপাল। 

কিন্তু তা আর হয়নি। 

গোপালও হঠাৎ অসুখে পড়ে। জলে-বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগে হল নিউমোনিয়া; নবীন ডাক্তার তখন বাইরে, কোথায় যেন বেড়াতে গেছে কোন তীর্থে ভুবনবাবুর সঙ্গে। 

বুড়ি এবার বিপদে পড়ে। ডাক্তার থাকে বেশ দূরে—তার পয়সার জোরও তেমন নেই। ফলে ঠিকমতো চিকিৎসাও হয় না। 

গোপালের মা ছুটেছিল নরহরি বিশ্বাসের কাছে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায় এই বিপদের সময়। 

কিন্তু নরহরি বিশ্বাস এমনিতে লোভী-শয়তান। গোপালের মায়ের জমিটুকু গ্রাস করার মতলব তার। তাই গোপালের মাকে বলে, 

—টাকা তো হাতে নেই গোপালের মা, এসময় তোমাকে টাকা দেওয়াও কর্তব্য, প্রতিবেশীর বিপদ! তুমি বরং ওই দু’বিঘে জমির বন্ধকি দলিলে সই করে দাও, দু’হাজার টাকার ব্যবস্থা করছি। মানে অন্যের কাছ থেকে টাকা আনতে হবে তো, শুধুহাতে সে দেবে না। নাহলে – 

গোপালের মা বলে—ওইটুকুই শেষ সম্বল বিশ্বাস মশাই। 

জানে গোপালের মা একবার ওর কাগজে সই করলে আর বাঁচার পথ থাকবে না, ওইভাবেই নানা কৌশলে নরহরি বহুজনের সর্বস্ব গ্রাস করেছে। 

তাই গোপালের মা সর্বস্ব ওর হাতে তুলে দিতে পারে না, সরে আসে। 

কোথায় যাবে জানে না। বাবাঠাকুরও নাই, নবীন ডাক্তারও নেই গ্রামে। এমনি দিনে সব শুনে চাটুয্যে বাড়ির অনিমেষ বলে, 

—নরহরি বিশ্বাস এমনি শয়তান? ভেবো না খুড়ি, গোপালের চিকিৎসা হবেই। ক্লাব থেকেই আমরা ব্যবস্থা করছি। 

ওই অনিমেষ আর ছেলেরা তবু শেষ চেষ্টা করেছিল। বুড়িও দেখেছে ওদের অক্লান্ত পরিশ্রম, রাত জেগে সেবা—ওষুধ আনা। 

কিন্তু কিছুতেই শেষ রক্ষা হয়নি। 

গোপাল মারা গেল। বুড়ির চোখের সামনে নেমে আসে হতাশার জমাট অন্ধকার, দুর্নিবার শোকের কালো ছায়া। 

সব হারিয়ে গেল তার, কোন্ পাপে তা জানে না সে। 

ভুবনবাবু-নবীন ডাক্তাররা ফিরে আসে গ্রামে। 

গোপালের মা মন্দিরে এসে ভুবনের পায়ে মাথা রেখে অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ে—একি সর্বনাশ হলো বাবাঠাকুর? সব হারিয়ে গেল! 

ভুবনবাবু বৃদ্ধাকে কি সান্ত্বনা দেবেন জানেন না। বলেন— 

—সবই ঠাকুরেরই লীলা গোপালের মা, আমারও তো সব কেড়ে নিয়েছেন তিনিই, তাঁকে ডাকো তিনিই এই দুঃখের মধ্যেও সান্ত্বনা দেবেন। 

গোপালের মা হয়তো সান্ত্বনার সন্ধানই পেয়েছে। 

ক্রমশ সেই শোকও ভুলেছে। গোপাল নেই, তবু গোপালের মা হয়েই রয়ে গেছে। মন্দিরের কাজকর্মই করে, কোনোমতে চলে যায় বৃদ্ধার, নাম-কীর্তন নিয়েই যেন সে সব দুঃখ ভুলে আছে। 

.

নরহরি বিশ্বাস বেশ হিসাব করেই চলে। এতদিনের প্রচলিত জমিদারিপ্রথা এবার শেষ হয়েছে। এখন প্রজা নিজে খাজনা দেবে সরকারকে, মধ্যে জমিদার নায়েবের দল থাকবে না। 

শশীকান্ত বাবুদের দিন ফুরিয়েছে। 

নরহরি শকুনির মতো জমিদারদের শেষ পচা-গলা বিকৃত দেহটাকেও ঠুকরে শেষ করে নিজের আখের গুছিয়েছে। 

নরহরি সেদিন নিজের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে আছে। কপালে তিলক, গলায় কণ্ঠী, হাতে জপের মালা। এখন বলে সে. 

—আর নায়েবির চাকরি নাই গো, ঠাকুরের কৃপায় বাঁধন সব কেটে গেছে। এবার প্রভুর নাম-গান নিয়েই থাকব আর ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করব। জয় নিতাই—জয় গৌর! 

জমিদারির পাট চুকে গেছে। নায়েবীর চাকরিও আর নেই। শশীবাবুদের কাছারিও এখন বন্ধ সমাজে জমিদারদের একটা বিশিষ্ট স্থান ছিল। হঠাৎ সেখানে কেমন একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে।

প্রকৃতির নিয়মে দেখা যায় প্রকৃতির বুকে শূন্যতা থাকে না, শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য নতুন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়, সমাজে একটা পরিবর্তনই আসে। 

এবার জমিদারদের জায়গায় সমাজে নতুন একটা শ্রেণি মাথা তুলবে। সেটা হচ্ছে জোতদার, ব্যবসাদার—প্রতিপত্তিশালী নেতা এরাই। সমাজের বুকের শূন্যতাকে এরাই পূর্ণ করবে। 

নরহরি এবার নায়েবি চলে যাবার পর ব্যবসাপত্র করার কথাই ভাবছে। 

তার জায়গা জমি-টাকা পয়সা কোনো কিছুরই অভাব নেই। ধানকলই করবে বড়সড় করে, ব্যাঙ্কও টাকা দেবে তাকে। 

হঠাৎ কাদের দেখে তাকাল নরহরি। 

—তোরা! কানাই-রাধু 

কানাই, রাধু মোড়ল এই অঞ্চলের নামকরা দাগি ডাকাত। এর আগেও দু’চারবার জেল খেটে এসেছে ডাকাতির-দায়ে। কিন্তু আগে এমন ছিল না তারা। 

কানাই-রাধু দুই ভাই। 

এদের পৈতৃক বেশ কিছু জমি-বাগান ছিল। ওর আয়েই চলত কোনমতে। কিন্তু ওদের বাবা কোনকালে কিছু টাকা নিয়েছিল নরহরির কাছে। হঠাৎ নরহরি সেই পুরোনো দলিল বের করে ওদের নামে মামলাই শুরু করে। 

কানাই-রাধু ওদের গ্রামের পঞ্চানন এরা বিপদে পড়ে। মামলায় জিতেও যায় নরহরি আর সেবার ওর লাঠিয়ালরা ওই জমি-বাগান সবই দখল করে। কিন্তু কানাইরাও সহজে ছাড়েনি তাদের দখল। রীতিমতো ফৌজদারিই হয়ে যায়। নরহরির টাকার জোর আছে। থানা-পুলিশও তার হাতে। 

ফলে জমি-বাগান মুখের গ্রাস তো কেড়ে নিলই ওদের এই নরহরি, উলটে ফৌজদারি কেসের আসামি করে তাদের জেলেই পাঠাল। সে আজ দু’বছর আগেকার কথা। 

ওসব ব্যাপার ভুলেই গেছিল নরহরি, কারণ এসব তার কাছে খুবই সাধারণ ঘটনা।

এখন কানাই-রাধু এসেছে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে। 

বলে কানাই—খামোখাই মিথ্যা দেনার দায়ে সর্বস্বান্ত করলেন কর্তা! ওই জমি-বাগানটুকু ফিরিয়ে দেন, কোনোমতে তবু দুই ভাই-এর দিন চলে যাবে। আপনার তো ঢের আছে—গরিবের এতবড় সর্বনাশ নাইবা করলেন? 

নরহরি দেখছে ওদের। ওই জমি, বাগান এখন তার দখলে। নরহরি জীবনে তার দখল ছাড়েনি, বরং লুঠ করেই বহুজনের বহুকিছুর দখল নিয়েছে। 

বলে নরহরি—ওই জমি, বাগান আমার হকের সম্পত্তি, ও তো ফিরিয়ে দেব না বাপ। যা–-

কানাই-এর মাথায় যেন রক্ত উঠে যায়। গর্জায় সে, 

—দেবে না? 

নরহরি এতকাল নায়েবি করে অবাধ্য প্রজাদের কি করে সযুত করতে হয় জেনেছে। তাই কানাই-এর গর্জন শুনে গলা তুলে ডাকে—কালী! বাবা কালীচরণ। 

কালো মুশকো চেহারার কালীচরণ এসে হাজির হয়। নরহরি জানে তাকে সাবধানেই চলা ফেরা করতে হবে। তাই কালীচরণদের তার দরকার। 

মুখে বসন্তের দাগ, বীভৎস চেহারা কালীচরণের। 

বলে নরহরি—কেষ্টর জীবদের একটু মতিভ্রম হয়েছে, ওদের একটু সযূত করে দে কালীচরণ। বেশি মারপিট করবি না,—ওই একটু শিক্ষা দিয়ে দে, যেন নরহরি বিশ্বাসের পিছনে না লাগে। জয় নিতাই—গৌর হে— 

কালীচরণ কানাই রাধু দুজনকেই টেনে খামারবাড়ির ভিতর নিয়ে যায়। কানাইরা ভাবেনি যে অমনি অভ্যর্থনার ব্যবস্থা রাখবে তাদের জন্য নরহরি বিশ্বাস 

কানাই-রাধুদের নিয়ে পড়েছে কালীচরণের দল ওই খামার বাড়ির নির্জনে। মেরামতির কাজটা ভালোভাবেই করে তারা। 

.

নবীন ডাক্তার তার ডাক্তারখানাতে রোগীদের দেখছে। 

দূর-দূরান্তরের গ্রাম থেকে রুগিরা আসে তার কাছে। নবীন ডাক্তারের পয়সার খাঁই নেই, গরবী রোগীদেরই ওষুধপত্র কেনার জন্য টাকা দেয়। দুপুর হয়ে গেছে। রোগীদের প্রায় সবাইকে দেখা শেষ করে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখছে, এমন সময় কানাই আর রাধুকে আহত অবস্থায় আসতে দেখে তাকাল নবীন ডাক্তার। শুধোয় সে, 

—কিরে আবার ফৌজদারি বাধিয়ে এলি নাকি?

কানাই কিছু বলার আগে রাধুই বলে—না ডাক্তারবাবু।

—তবে? মারপিট কোথায় করলি? 

রাধু বলে-মারপিট করিনি ডাক্তারবাবু, ওই নরহরি বিশ্বাসের বাড়িতে গেছিলাম মিথ্যা দলিল দিয়ে মিছে মামলা সাজিয়ে পুকুর, জমি সব কেড়ে নিলে ডাক্তারবাবু, বলতে গেছিলাম — মুখের গেরাস কেড়ে নিয়ো না বিশ্বাস মশায়, গরিবদের ধনেপ্রাণে মেরো না। তা জমি তো দিলই না। উলটে ওর লোক দিয়ে কেমন মেরে—পাট, করেছে দেখুন ডাক্তারবাবু! 

কানাই গর্জায়—ওকে আমি ছাড়ব না ডাক্তারবাবু, এর জবাব দেবই। ওই নরহরি বিশ্বাস-এর ভণ্ডামি আমিই ছুটিয়ে দেব, না হলে আমার নাম কানাই না। 

নবীন ডাক্তার বলে, 

—এখন ওসব রাগ-রোষ ছাড়ো কানাই। এসো ব্যান্ডেজ করে ইনজেকশন দিয়ে দিই। ওষুধপত্রও ব্যবহার করো। আর নরহরিও বিচিত্র মানুষ। এত কাণ্ডের পর এইভাবে মারল তোমাদের? 

রাধু বলে—তাই দেখুন ডাক্তারবাবু, ভণ্ড-পিশাচের কাণ্ড দেখুন। 

.

বাজপড়া তালগাছ দেখলেই চেনা যায়। সবুজ পাতাগুলো যারা হাওয়ায় দাপাদাপি করত তাদের কেউ নেই। পত্রহীন কাণ্ডটা কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভিতরে ওর কোনো প্রাণের স্পন্দনও নেই। পোকায় কেটে কমজোরি করে দিয়েছে, আর অতর্কিতে বিনা নোটিশেই একদিন ভেঙে পড়ে কাণ্ডটা। 

শশীকান্তবাবুর অবস্থাও তেমনি হয়ে গেছে। 

ছেলেবেলায় জমিদারির দাপট তিনি দেখেছেন, নিজেও জমিদারি ঠাটবাটে মানুষ। কিন্তু তাঁর জীবনের শেষপাদেই জমিদারি নামক বস্তুটা যে এমনি এককথায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। 

ললিতাও দেখেছে স্বামীর দেহ-মন হঠাৎ কেমন ভেঙে যায়। 

শশীকান্তবাবু শয্যা নেন। 

নবীন ডাক্তারও আসে। দেখে-শুনে বলে নবীন ডাক্তার, 

—শশীবাবু, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। মনে জোর আনুন, যেভাবে হোক দিন ঠিক চলবে, এত ভাবনা করে লাভ কী? 

ললিতা বলে—তাই বলুন ওঁকে। দিনরাত ওই ভাবনা নিয়েই রয়েছেন। এ বিপদ তো একা ওঁরই হয়নি, সারা দেশের জমিদারদের হয়েছে। 

—শশীকান্তের মন মানে না। 

বেশ বুঝেছেন তিনি ললিতা আর তার একমাত্র সন্তান গোকুলের জন্য তেমন কোনো সঞ্চয়ই রেখে যেতে পারেনি। হাসিখুশি ওই কানাই জানে না, তার জন্য কি নিষ্ঠুর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। 

নরহরি বিশ্বাসও আর আসে না, শশীকান্তবাবুর তাকে দরকার, কিছু দলিলপত্র, ব্যবস্থাদি দেওয়ার কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছে না, জমা টাকার হিসাবেও গোলমাল দেখা দিয়েছে অনেক। এবার শশীবাবু বুঝেছেন যে, নরহরি বিশ্বাস যাকে তিনি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলেন সেই ভণ্ড লোকটা বহু অবিশ্বাসের কাজই করেছে। তাকে শশীবাবুর খুবই দরকার, কিন্তু নরহরি এখন ক্রমশ নিজেই মহাজন হয়ে সমাজের সেই শূন্য আসনটা দখলের চেষ্টায় ব্যস্ত, পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটার মতো সময় অবকাশ কোনোটাই তার নেই। তাই আসেনি নরহরি শশীবাবুর এখানে- 

এমনি দিনে শশীবাবু হঠাৎ মারা গেলেন। 

বাজপড়া তালগাছটা এতদিন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু ভিতরে তার মৃত্যু ঘটেছিল অনেক আগেই। আজ মানসিক মৃত্যুকে ছাপিয়ে দৈহিক মৃত্যুই ঘটল শশীবাবুর। 

সারা গ্রামের মানুষজন এসে পড়ে। ভুবনবাবু—নবীন ডাক্তার আরও বহুজন এসেছে। ভুবনবাবু বলেন, 

—গ্রামের ইন্দ্রপতন হয়ে গেল হে! 

এসে জুটেছে আজ এতদিন পর নরহরি বিশ্বাসও। 

বিরাট একটা পদ্মফুলের মালাও এনেছে, ডাগর চোখে অশ্রুধারা, নরহরি যেন শোকে দুঃখে একেবারে ভেঙে পড়েছে। বলে, 

—অন্নদাতা পিতাই চলে গেলেন ভুবনবাবু, দ্বিতীয়বার পিতৃহীন হলাম। 

কান্নায় ভেঙে পড়ে নরহরি বিশ্বাস। 

ললিতার এসব দেখার সময় নেই। আজ তার সামনে সমূহ বিপদ, এতবড় পৃথিবীতে সে আজ একা— আপন বলতে ওই ছোট্ট গোকুল। তার স্বামী আজ চলে চলে গেলেন। অমনি একটা চরম বিপর্যয় ঘটবে তা জানত ললিতা-তবু সেই চরম বিপর্যয়কে প্রত্যক্ষ করে সে আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। জানে না এরপর তার কর্তব্য কি! 

ভুবনবাবু নবীন ডাক্তার গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষ তবু ললিতার পাশে দাঁড়িয়ে তার স্বামীর শেষ কাজ সম্পন্ন করায়। নরহরি অবশ্য কেঁদে-কেটে নাটক করে সেই যে গেছে আর এদিকে আসেনি। ললিতার হাতে যা—ছিল তাই দিয়ে স্বামীর শেষ কাজ করে। 

অবশ্য ভুবনবাবুই বলেন, 

—বউমা, যখন-যেমন তখন তেমন। ছেলেটার ভবিষ্যৎ আছে, তোমারও দিন চালাতে হবে। তাই বলি, বাজে খরচা বেশি ঘটার দরকার নেই শশীবাবুর কাজে। যেটুকু না করলে নয়—তাই করবে মা! কেউ কোনো কথা বল্লে—আমাকে দেখিয়ে দিও। 

ললিতাও জানে তার অবস্থার কথা। তাই বলে, আপনি যা ভালো বোঝেন করুন। সাধ তো অনেকই ছিল, সাধ্য যখন নেই তখন ওসব ভেবে লাভ নেই। 

.

যুধিষ্ঠিরের চেহারা পাক দেওয়া শনের দড়ির মতো পাকানো। লম্বা সিটকে চেহারা—চোখ দুটো যেন কোটর থেকে জ্বলছে। আর ওই দেহটা নিয়ে যুধিষ্ঠির হাওয়ার বেগে দৌড়োতে পারে। পরনে কালো একটা ছোট জাঙিয়া মতো আর সর্বাঙ্গে তেল মাখানো—হাতে থলেতে তার গুরুদেব প্রদত্ত সিঁদকাঠি। 

রাতের অন্ধকারে দত্তপাড়ার সনৎ দত্তের ঘরে সিঁদ কেটেছিল, বেশ নিপুণ কারিগর এই যুধিষ্ঠির। তার সিঁদকাঠি চলে নিঃশব্দে, দেয়াল ফুটো হয়ে যায়, রাতের অন্ধকারে দেওয়ালে একটা মানুষ ঢোকার মতো গর্ত করে নিয়ে প্রথমে নিজে ঢোকে না। গৃহস্থও এখন চতুর হয়ে গেছে, ওরাও রামদা নিয়ে তৈরি থাকে। গর্তের মধ্য দিয়ে চোর মাথা গলালেই দে কোপ। একেবারে পাঁঠাবলি করে দেয় অনেক সিঁধেল চোরকে। তাই যুধিষ্ঠির দেওয়ালে গর্ত করে প্রথমে একটা লাঠির ডগে একটা মাটির হাঁড়ি ঢুকিয়ে ট্রায়াল দেয়, কখনও দায়ের কোপে কিংবা লাঠির ঘায়ে হাঁড়ি-চুরমার হলে যুধিষ্ঠিরও দৌড়ে পগার পার হয়ে যায়। সেদিন আর কাজ কিছু হয় না। 

ইদানীং যুধিষ্ঠিরের ব্যবসাটা মন্দাই চলেছে। আজ সে এসেছিল নরহরি বিশ্বাসের ঘরেই সিঁদ কাটতে। লোকটা টাকার কুমির। যুধিষ্ঠিরের খবর ছিল লোকটার বাড়িতে কচি-কাঁচা নেই, রাতে উঠতে হয় না। তোজপক্ষের তরুণী বউ-এর উপরও নরহরির কামনা-বাসনা তত নেই। নিশ্চিন্তে ঘুমোবে আর যুধিষ্ঠির তার কাজ শেষ করবে, নরহরির ঘরে ঠিকমতো মাল-হাতাতে পারলে বেশ কিছুদিনই চলবে যুধিষ্ঠিরের আরামসে। 

সেই ভেবে যুধিষ্ঠির হানা দিয়েছিল নরহরির বাড়িতে। দেওয়ালে গর্তও করেছে—হাঁড়ি ঢুকিয়ে ট্রায়ালও দিয়েছে, নাহ্ কেউ জেগে নেই। লাইন কিলিয়ার। 

এবার যুধিষ্ঠির গায়ে রেড়ির তেলটা মেখে নেয়। এটা ওর নিজের নিরাপত্তার জন্য, ধরলে পিছলে বের হয়ে যাবে সে, সহজে ধরাও পড়বে না। যুধিষ্ঠির গুরুর নাম নিয়ে ভিতরে যাবার জন্য রেডি, মাথাটা নয়, দুটো-পা আগে ঢুকিয়েছে ফোকরে তারপর বডি ও মাথাও যাবে এমন সময় টের পায় ঘরের ভিতর থেকে কে যেন তার চরণ-যুগল ধরবার চেষ্টা করছে, একখানা চরণ এর মধ্যে তার করতলগত হয়েছে—অন্য শ্রীচরণের জন্য হাতড়াচ্ছে আর যুগল চরণ ধরে ফেললেই যুধিষ্ঠিরও ধরা পড়ে যাবে। 

তাই নিমেষের মধ্যে যুধিষ্ঠির অন্য মুক্ত চরণ দিয়ে ঘরের মধ্যে তার ঠ্যাংধারী লোকটাকে সপাটে লাথি মারতে অতর্কিত লাথির আঘাতে সে তার হাতের মুঠি আলগা করে দেয় সেই মুহূর্তেই যুধিষ্ঠিরও তার দুইচরণ মুক্ত করে ফোকর দিয়ে চরণ যুগল পার করে নিয়ে খাড়া হয়ে সিঁদকাঠিটা তুলে নিয়ে দে দৌড়। আর শীর্ণ পাকানো চেহারা, চরণযুগলের সাহায্যে যুধিষ্ঠির নিমেষে যোজন ভরসা করতে পারে। তাই ধরাও পড়ে না। 

কিন্তু ভিতরে নরহরি তখন ঠেলে উঠেছে। লোকটা রাতেও বোধহয় ঘুমোয় না। টাকার বান্ডিল পাহারা দেয়। সে চেল্লাচ্ছে চোর—চোর— 

তার দু’চারজন অনুচরও পিছু নেয় পলায়মান যুধিষ্ঠিরের, কিন্তু যুধিষ্ঠির তখন মিলখা সিংহের মতো দৌড়োচ্ছে, পালাতে হবে তাকে। ধরা পড়লে মেরে ওরা আধমরা করে দেবে। নরহরির লোকরা কেষ্টার জীবদের অঙ্গসেবার ব্যাপারটা ভালোই করে। 

যুধিষ্ঠির দৌড়োচ্ছে আর তাড়া করে যারা আসছিল তারা অনেক পিছনে পড়ে আছে তবু যুধিষ্ঠির দৌড়চ্ছে, ওদিকে গ্রামের এ মাথায় রামু সাহার মদের দোকান—রামুর এটা পৈতৃক ব্যবসা। এতদিন সেই দোকান দেখত, এখন ছেলেরা লায়েক হয়েছে, তারাই এই ব্যবসা দেখভাল করে। আর রামচন্দ্রের অন্য ব্যবসাও আছে। সে এই অঞ্চলের এক নম্বর জুয়াড়ি। জুয়ার ছক সাজিয়ে মেলায় মেলায় বসে—কর্তাপক্ষ ওকে ডেকে নিয়ে যায়। জুয়ার ছকের চারিপাশে মৌমাছির মতো ভিড় করে খেলোয়াড়ের দল। সকলেই জুয়ায় মোটা টাকা জেতার স্বপ্ন দেখে, নোট বৃষ্টি হয় তার জুয়ার ছকে আর হাতের এইসা সাফাই রামচন্দ্রের যে সব টাকা সেইই চুম্বকের মতো টেনে নেয়। তার হাতে ওই চামড়ার কৌটার মধ্যে জুয়ার গুটিটা যেন কথা শোনে। জুয়ার ছকে ছটা ঘর। বিভিন্ন ঘরে টাকার বাজি ধরা হয়েছে, যে ঘরে টাকাটা খুবই কম, সেই ঘরের ছকেই গুটি ফেলতে পারে রামচন্দ্ৰ, ফলে কম লোকই বাজি জেতে—বাকি পাঁচ ঘরের টাকা সব রামচন্দ্র টেনে নেয়। 

সেই রামচন্দ্রের বাড়িটা সামনেই পড়েছে। 

যুধিষ্ঠিরের বাল্যবন্ধু রামু। 

যুধিষ্ঠির ওর বেড়ার পাঁচিল টপকে সোজা উঠানে পড়ে। 

রামুর ঘুম ভেঙে যায়, সেও জেগে ওঠে—কে-কে? 

—আমি। যুধিষ্ঠির। চুপ কর। 

রামু জানে যুধিষ্ঠিরের রাতের এই ব্যাবসার কথা। তখনও দূরে চোর চোর রব ওঠে। হাঁপাচ্ছে যুধিষ্ঠির দাওয়ায় উঠে। 

গজরায়—শালাদের জন্য কাজ কারবারই বন্ধ করতে হবে। 

মাল-এর দেখা নেই চেল্লাচ্ছে দ্যাখ! যেন সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে শালার, ওই নরহরির।

দম নিয়ে বলে যুধিষ্ঠির—দে রামু একটা ছোট খোকা দে। গলা শুকিয়ে গেছে। দাম কাল দেব।

রামচন্দ্র বলে—এসব কাজ কারবার ছেড়ে দে যুধিষ্ঠির। 

যুধিষ্ঠির বলে—শালা কলিকাল বুঝলি, একালে বাঁচার জন্য যুধিষ্ঠিরকেও চুরি করতে হয়, আর তুই রামচন্দ্র, একালে তোকেও চোলাই মদ বেচতে হয়—পেটের দায়ে জুয়া খেলতে হয়। আমি চোর, তুই জুয়া-চোর। 

রামচন্দ্রও মানে কথাটা—তা ঠিকই বলেছিস। 

রামু উঠে যায় মদের বোতল আনতে যুধিষ্ঠিরের পয়সায় তারও দু’ঢোক মিলবে। দূরে ওই চোর ধরা পার্টির কলরব ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে, তবে চারিদিকের গৃহস্থ সজাগ হয়ে উঠেছে। এখন কদিন আর চুরি করা যাবে না এখানে। অন্যদিকে চুরির সন্ধানে যেতে হবে যুধিষ্ঠিরকে। ক্রমশ এই এলাকার মানুষ যেন একটু বেশি সতর্ক হয়ে উঠছে, এখানে চুরির ব্যবসা আর চলবে না। 

যুধিষ্ঠিরও ভাবনায় পড়েছে। 

রামচন্দ্র বলে—সত্যি কাজ কারবার এবার বন্ধই করে দিতে হবে। মেলা খেলাও তেমন নাই এখন। 

যুধিষ্ঠিরই বলে—শুনছিলাম এবার খুব জোর ধুমধাম করে নবদ্বীপ পরিক্রমা হবে। দেশি-বিদেশি অনেক ভক্ত আসবে। সাতদিন ধরে সারা নবদ্বীপের আশপাশে ওরা ঘুরবে, দিনভোর চলা আর রাতে-মাঠে, বাগানে তাঁবু করে থাকবে এত লোক। দিনবেলায় আরও অনেক লোকজনও আসবে দর্শন করতে। বহু মানুষের চলমান মেলা। ওখানেই চল রামু—রাতে তোর আসর বসাবি, আর আমিও থাকব—যদি এই মৌকায় কিছু কামানো যায়। মেলা খেলাতে দমকা রোজগার হতে সময় লাগে না। ঠিকমতো ঘা দিতে পারলে ভালোই আমদানি হবে। 

রামচন্দ্র বলে—তা মন্দ বলিসনি। বসে থাকি না ব্যাগার দিই। চল তাই যাব। তবে তুই খবর-সবর নে। আমাদের ভুবন কর্তা ওসব খবর জানতে পারে। ওকেই শুধো। তবে সাবধান, আঁঠা দেখাসনি। তাহলে ভাববে অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। 

হাসে যুধিষ্ঠির—না-না! আমি ঠিক কৌশলে সব খবর জেনে নেব।

.

নরহরি জানে বহু লোকেরই সর্বনাশ করেছে সে। তার বাড়িতে হানা দেবার জন্য অনেকে মুখিয়ে আছে। তাই নরহরি সজাগ আর সাবধান থাকে। তার স্ত্রী কুস্তিও বলে—আর মানুষের সর্বনাশ করো না। টাকা—জমি—সোনা সবই তো আছে অনেক। দুটো মানুষের আর কত চাই? 

নরহরি বোঝে তার কি প্রয়োজন। টাকা তার দেহের রক্ত। এটা চাইই, তাই স্ত্রীর কথায় বলে সে, 

—থামো তো। সাধে বলে মেয়েছেলে? এগারো হাত কাপড়েও কাছা দিতে জোটে না। যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলো না। জয় রাধে। রাধারানিই যেন তাকে সব বোঝার ক্ষমতা দিয়েছে। আর সবকিছু করার অধিকারও দিয়েছে। 

তাই নরহরি এবার তার এতদিনের স্বপ্নকে সত্যি করতে চায়। এতকাল ধরে কুসুমপুরের জমিদারি এস্টেটে নায়েবের চাকরিই করেছে আর গোপনে জমিদারির সর্বস্ব ফাঁক করে তার পুঁজি বাড়িয়েছে। শশীকান্তবাবু মারা যাবার পর নরহরি এবার নিজমূর্তি ধরেছে। আর আগে সে কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজ যা করার সবই করে নিয়েছে আর কৌশলে অন্য কাগজপত্রের সঙ্গে সেগুলোতে শশীকান্তবাবুর সইও করিয়ে নিয়েছে। 

শশীকান্তবাবু নরহরিকে বিশ্বাস করতেন। নরহরির ওই তিলক সেবা আর মুখে হরিনাম আর হরিভক্তি দেখে শশীকান্ত বাবুর মনে হয়েছিল লোকটা সত্যিই ধর্মপ্রাণ, সৎ। 

অবশ্য তার গোমস্তা হরনাথ মাঝে মাঝে সাবধান করত ললিতাকে। জমিদারবাবুকে হরনাথ সমীহ করে তাই তাকে এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারে না। তবু ললিতাকে বলে হরনাথ। 

—মা, বাবুকে সব কাগজপত্র দেখে শুনে দস্তখত করতে বলবেন। খবর পাচ্ছি ওই নায়েব মশাই-এর মতলব ভালো নয়। 

ললিতাও শশীকান্তবাবুকে বলে এসব কথা। 

শশীবাবু শুনে অবাকই হন। বলেন— 

—না–না বড়বউ, নরহরি পুরনো লোক। তাছাড়া ধর্মপ্রাণ মানুষ। সে অধর্মের কাজ করতেই পারে না। এ নিয়ে তুমি ভেবো না। 

শশীকান্তবাবু ললিতার কথাগুলোকে নস্যাৎ করেছিলেন। 

নরহরির প্রতি তাঁর বিশ্বাস অটুটই ছিল। 

আর তাই শশীকান্তবাবু মারা যাবার পর এবার নরহরির নিজমূর্তি ধরার সাহসও হয়েছে। 

.

ললিতার মন-মেজাজ ভালো নেই। 

তার সাজানো বাগান যেন অকালেই শুকিয়ে গেল। শশীকান্তবাবুর বয়স তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু কালব্যাধিতেই তাঁর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে এসেছিল। নবীন ডাক্তারও সেই ভয়ই করেছিলেন তবু চিকিৎসা করেছিলেন তিনি কোনো ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু যার প্রদীপের তেলই ফুরিয়ে এসেছে তাকে বাঁচাবেন কি করে? ভুবনবাবুও বলেন— 

—ডাক্তার, শশীবাবুর প্রদীপের তেলই ফুরিয়ে এসেছে, তুমি আর কতখানি উস্‌কে রাখবে? নবীন ডাক্তার বলেন—তবু চেষ্টা তো করতেই হবে ভুবনবাবু। 

ভুবনবাবু বলেন—হ্যাঁ, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। দ্যাখো চেষ্টা করে। 

কিন্তু শশীবাবুকে শেষ অবধি বাঁচানো যায়নি। তিনি মারা গেছিলেন অকালেই, সংসারের কোনো কাজই তিনি করে যেতে পারেননি। বরং যা করে গিয়েছিলেন তার ফল ভোগ করতে হবে ললিতাকে, একথা ললিতা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। 

ললিতা স্বামী-মারা যার পর কেমন ভেঙে পড়েছিল। 

নরহরিও এ বাড়িতে আর আসেনি। সেই শ্রাদ্ধের সময় এসেছিল। তারপর আর আসেনি। তবু হরনাথ গোমস্তা আসে এবাড়িতে। সেইই ললিতার কাজকর্ম—কিছু আদায়পত্রের তাগাদা দেয়। কিন্তু ললিতা দেখেছে কর্তা মারা যাবার পর সকলেই যেন তাকে এড়িয়ে চলেছে। তাদের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে এখানে, জমিদারি প্রথাই উঠে গেছে তখন আর ভূতপূর্ব জমিদারের দাম কি? 

ললিতা ক্রমশ হরনাথ গোমস্তার কাছে তাদের দায়মুক্ত খাস জমি, পুকুর, বাগান এসবের খোঁজ খবর জানতে চায়। হরনাথও বলে—মা, সবই তো গেল। তবু যা আছে সেটুকু দেখাশোনা করলে আপনাদের মা-ছেলের দিন ভালো ভাবেই চলে যাবে। 

ললিতা বলে—ওকথা আমিও ভেবেছি বাবা, গোকুল এখনও ছেলে-মানুষ, নিজের জন্য ভাবি না কিন্তু ওর তো ভবিষ্যৎ আছে, তাই যা কিছু আছে সেটুকুও এবার নিজের হাতে আনতে চাই বাবা। 

হরনাথ বলে, 

—তাই ভালো মা। নিজেরা দেখাশোনা করুন, ততদিনে ছোটবাবুও বড় হয়ে উঠবেন। ওসব জমি-জমার হিসাব আমি দেব আপনাকে মা, ভাববেন না। 

হরনাথ-এর কথায় বলে ললিতা। 

—কিন্তু আপনাকে দেবার মতো টাকাও তেমন নেই। নরহরিবাবু তো আর আসেন না। কি বিপদে না পড়েছি, তবু আপনি ভরসা দিলেন। 

হরনাথ বলে—মা, আপনাদের নিমক খেয়েই মানুষ হয়েছি। সামান্য ওই কাজটুকুও করব না? 

হরনাথ গোমস্তা তাই আসে, জমি-জায়গার রেকর্ড-পড়চা-খতিয়ান দেখে বের করে। ললিতার আজ ওইসব জমিই একমাত্র সম্বল, আর এই বড় বাড়িটা। 

সেদিন নরহরি আর সঙ্গে কোর্টের বেলিফকে কাছারি বাড়িতে আসতে দেখে তাকাল হরনাথ। এখন কাছারি বাড়িতে কেউ আর আসে না। পাইক-পিয়াদারাও আর কেউ নেই। সামনের মাঠে এককালে ছিল বাহারের ফুলবাগান। ক’জন মালি দিনভোর খেটে সেখানে কতরকম ফুল ফোটাত। এখন সবই অবলুপ্ত। দু’চারটে গ্রামের গোরু এখানে ওখানে ঘাসের সন্ধানে ঘোরে। সব কেমন হারিয়ে গেছে ক’মাসের মধ্যেই, ফুটে উঠেছে নিরাভরণ দৈন্য আর নিঃস্বতার ছায়া। 

হরনাথও কাজ শেষ করে এনেছে। 

খাস জমি-জায়গার হিসাব গিন্নিমাকে দিয়ে সেও এতদিনের এই চাকরিস্থল ছেড়ে ফিরে যাবে তার গ্রামে। 

হরনাথ কাজ করছিল। নরহরি বিশ্বাসকে কোর্টের বেলিফ আর তার সঙ্গে তার বেশ কয়েকজন কুখ্যাত সহচরকে আসতে দেখে তাকাল হরনাথ। 

নরহরি কাছারি বাড়ি—শূন্য প্রায় বাগান, ওদিকে জমিদার বাড়ির শ্রীহীন অবস্থা দেখে বলে,

—ক’মাসেই যে সব একেবারে লন্ডভন্ড করে তুলেছ হে হরনাথ। মা লক্ষ্মীকে তাড়িয়েছ ক’মাসেই। ভিটেতে এবার ঘুঘুই চরবে দেখছি। 

হরনাথ বলে—গিন্নিমা একা কি করবেন! এতবড় বাড়ি বজায় রাখাই দায় হবে এবার।

নরহরি বলে—জয় নিতাই, জয় গৌর। তাইতো সেই দায় থেকে গিন্নিমাকে মুক্ত করতে এসেছি হরনাথ। 

—মানে! হরনাথ ওর কথায় অবাক হয়। 

নরহরি ততক্ষণে দলবল নিয়ে কাছারি ঘরে ঢুকে নিজেই জমিদারবাবুর এতদিনের শূন্য চেয়ারটাতেই বসে, আর ওর সঙ্গীদের, ওই বেলিফকে বলে, 

—বসুন। বসো হে তোমরা। 

হরনাথ অবাক হয় ওকে কর্তাবাবুর চেয়ারে বসতে দেখে। 

বলে সে—ওটা বড়বাবুর চেয়ার। 

হাসে নরহরি—যখন ছিলেন তখন বসতেন। এখন নেই—তার জায়গায় যে আছে সেই-ই বসবে। ও নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নাই। জয় নিতাই, জয় গৌর। হ্যাঁ—গিন্নিমাকে একবার খবর দাও। কোর্ট থেকে বেলিফ এসেছে তাঁর কাছে। 

—কোর্টের বেলিফ! গিন্নিমার কাছে! হরনাথ অবাক হয়। 

নরহরি বিরক্তি ভরা স্বরে বলে—ওই যে উনি, ওঁর সময়ের দাম আছে হরনাথ, গিন্নিমাকে খবর দাও। যা বলি তাই শোন, ফোড়ন কেটো না। 

হরনাথ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না। ওই নরহরি বিশ্বাসকে সে চেনে, ওকে এতটুকুও বিশ্বাস করে না সে। কে জানে আবার কি গোলমাল বাধিয়েছে। তাই গিন্নিমাকে খবর দেয় হরনাথ। 

.

ললিতা একটু অবাক হয়। স্বামী-মারা যাবার পর তার সংসারে কাজকর্মও যেন অনেক কমে গেছে। তখন অসুস্থ শশীকান্তের সেবা, ওষুধ-পথ্য সবকিছুতেই ললিতার সময় চলে যেত। এখন সেই কাজগুলোও মানুষটা চলে যাবার পর থেকেই ফুরিয়ে গেছে। গোকুলকে স্কুলে পাঠিয়ে ললিতা এবার নিজের পূজা-আস্রা নিয়েই ডুবে যায়। 

মাঝে মাঝে সে ভুবনবাবুদের মন্দিরেও আসে বৈকালে পাঠ শুনতে। সকাল থেকেই তার বেশির ভাগ সময় ওই পূজা-আস্রাতেই কাটে। সব দুঃখ—মনের শূন্যতাকে ললিতা ওই ঠাকুরের পূজা—ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেই ভুলতে চায়। শশীকান্ত বেনারস থেকে অষ্টধাতুর একটি গোপাল মূর্তি এনেছিলেন, সেটাকেই সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করে ললিতা পূজা করে। 

ললিতা সেদিন পূজা সেরে উঠেছে—তখনও জলগ্রহণ করেনি। এবার প্রসাদ পাবে। এমন সময় হরনাথ গোমস্তা এসে খবর দেয়—মা, কাছারি ঘরে নায়েব মশাই এসেছেন—সঙ্গে কোর্টের বেলিফ, অন্য লোকজনও রয়েছে। তারা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। 

—কেন? ললিতা অবাক হয়। 

হরনাথ বলে—আমি শুধিয়েছিলাম মা, তা নায়েবাবু বলেন—যা বলার আপনাকেই বলবেন। আমার ঠিক ভালো বোধ হচ্ছে না। 

ললিতা অবাক হয়। 

—সে কি! নায়েবমশাই আগে কিছু বলেননি, আজ হঠাৎ বেলিফ নিয়ে হাজির! কী ব্যাপার? চলোতো- 

গোকুল খেলছিল সেও মায়ের সঙ্গে যাবে—এমন সময় নরহরিকে বেলিফকে নিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে এসে হাজির হতে দেখে ললিতা একটু বিস্মিতই হয়। প্রতিবাদের স্বরে বলে ললিতা—এখানে? এখানে কেন? 

নরহরি বলে, 

—দেরি হচ্ছে, এদিকে বেলিফ মশাইকে কাজ শেষ করে ফিরতে হবে কোর্টে, তাই নিজেরাই চলে এলাম মা জননী। জয় নিতাই—জয় গৌর। তাহলে বেলিফমশাই, উনিই ললিতা দেবী, ওঁকে আইন মোতাবেক মহামান্য আদালতের রায়টা জানিয়ে দিন। 

বেলিফ বলে—এই বসতবাড়ি—মায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির আদালতের রায় মোতাবেক শ্রীনরহরি বিশ্বাসই বর্তমান মালিক। আদালত থেকে ওই নরহরি বিশ্বাসকে এই বসতবাড়ির নির্দয় দখল দেবার হুকুমই হয়েছে, আপনি এখুনি এই বাড়ি ছেড়ে নরহরিবাবুকে দখল দেন—অন্যথায় কোর্টের হুকুম না মানার জন্য আপনার বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

চমকে ওঠে ললিতা—সেকি! নরহরিবাবু এসবের মালিক! 

নরহরি বলে—আজ্ঞে হ্যাঁ, মা জননী। বাবুর অসুখের সময় প্রচুর টাকা আমিই দিয়েছি, সেবার সরকারের ঘরে খাজনা দিতে হ’ল, পুরো আটাশ হাজার টাকা তখনও দিয়েছি, এ ছাড়াও সতেরো হাজার টাকা হাত-হাওলাত ছিল, আরও—সব ঋণের কাগজপত্র, হ্যান্ডনোট সব আদালতে মজুত আছে, সেই দৃষ্টেই এই ডিগ্রি দিয়েছেন আদালত। কই বেলিফ মশাই—এদের চলে যেতে বলুন। না হলে আমি জোর করে ওঁকে—ওঁর ছেলেকে বের করে দখল নেব, নিতে বাধ্য হবো। 

হরনাথ বলে—সেকি! নায়েবমশাই, হাজার হোক উনি অন্নদাতার স্ত্রী— 

নরহরি ধমকে ওঠে। 

—তুমি থামো তো। বেলিফমশাই—ওটাকেও কনটেনমেন্ট অব কোর্ট—মহামান্য আদালতের হুকুম অমান্য করার জন্য অ্যারেস্ট করুন। 

ললিতা বলে—ওকে অ্যারেস্ট করতে হবে না। আমিই এসব ছেড়ে যাব কিন্তু কোর্টের হুকুম—

নরহরিই এবার কাগজ দেখায়—এই যে দেখুন কোর্ট অর্ডার। তারপর সেই-ই হুকুম দেয়—ওরে, এদের সব মালপত্র বের করে দে। 

ললিতা দেখছে কাগজটা। চমকে ওঠে সে। 

আদালতে মামলার শমনও চেপে গেছে নরহরি কৌশলে,–ললিতা জানতই না। সেই না জানার সুযোগে নরহরি যে ভাবেই হোক একতরফা ডিক্রি করিয়ে বেলিফ, পুলিশ নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। 

চোখের সামনে ললিতার শেষ আশ্রয়টুকুও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। তাকে চলে যেতেই হবে এই বাড়ি থেকে। 

ললিতা বলে—ঠিক আছে, ওই গোপালকে নিয়েই চলে যাব এই বাড়ি ছেড়ে। 

ললিতা গোপালকে নিতে যাবে এমন সময় নরহরি বাধা দেয়। 

—ওই মূর্তি আপনি পাবেন না। 

জানে নরহরি অষ্টধাতুর তৈরি ওই মূর্তির দামও অনেক। তাই ওটা হাতছাড়া করতে চায় না। বলে নরহরি। 

—এ বাড়ির সব কিছুই আমার! শূন্য হাতেই যেতে হবে আপনাকে 

হরনাথ দেখছে ওই ভন্ড লোকটাকে। ললিতা বলে— 

—কিন্তু কোথায় যাব? 

গোকুলও শুনছিল সব। সেও বুঝেছে তাদের এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। বাবা মারা যাবার পর তাদের অনেক কিছুই চলে গেছে। তাও সয়েছিল। এবার এই বাড়িও ছেড়ে যেতে হবে। 

মায়ের চোখে-জল নামে। গোকুল দেখছে। নরহরিও দেখে। এবার হঠাৎ সেই ভন্ড অমানুষটা যেন বদলে যায়। 

কি ভেবে বলে—মা জননী, বড় বাড়ির দখল ছেড়ে দেন, আপনাদের থাকার জন্য পুকুরের ওপারে গোয়াল বাড়ির লাগোয়া ওই বাড়িটা ছেড়ে দেব। ওটাকে মেরামত করে নিলে থাকা যাবে। হাজার হোক—অন্নদাতা। আজ দেনার দায়ে সব কেড়ে নিলেও একেবারে অমানুষ তো হতে পারি না। জয় নিতাই—জয় গৌর! এই গোয়াল বাড়িতেই থাকুন গে—আর গোপালের ওই পেতলের মূর্তিটাই নিয়ে যান। ঠাকুর সবই সমান,—ওই কাশীর মূর্তিটা পাবেন না, ওটা আমার। 

ললিতার চোখে-জল নামে। 

আজ সবই হারিয়ে গেল তার স্বামী মারা যাবার পর। এই বড় বাড়ি ছেড়ে ওই ভাঙা গোয়াল বাড়িতেই থাকবে সে—আর সামান্য জমি বাগানের আয় থেকেই সংসার চালাবে, স্বামীর ভিটে ছেড়ে তবু যাবে না। তার যাবার জায়গাও নেই। সব হারিয়ে নিজের ছেলেকে নিয়ে ভাইদের দয়া-ভিক্ষা করে বাঁচার চেয়ে এইভাবেই সংগ্রাম করেই বাঁচার চেষ্টা করবে ললিতা। 

তাই এই নরহরির ওই প্রস্তাবেই রাজি হয় ললিতা। 

আর নরহরিও ভাবতে পারেনি যে, এত সহজে সে এত বড় বাড়ি—সব কিছুরই মালিকানা পেয়ে যাবে। 

সুতরাং নরহরিও দাক্ষিণ্য দেখাতে কসুর করে না। 

ললিতা তার একমাত্র সন্তান গোকুলকে নিয়ে ওই ভাঙা বাড়িতেই চলে যায়। নরহরি ওই গোয়ালবাড়ির দখল নিতে আজ আগ্রহী নয়। তার স্বপ্ন ছিল জমিদারি চলে গেলে সেই-ই সেই শূন্য সিংহাসনে বসবে। আজ নরহরি শুধুমাত্র কিছু মিথ্যে দলিল আর কাগজের বলে সেই রাজ্যপাটই দখল করেছে। তাই জয়ধ্বনি দেয়—জয় নিতাই, জয় গৌর,জয় শচীনন্দন গৌরহরি। 

.

জীবনের এই চরম বিপর্যয়েও ললিতা ধৈর্য হারায় না। তার মনে হয় ওই গৌরাঙ্গদেবের কথা ললিতাও এতদিন ধরে গৌরাঙ্গদেবের পূজা করে এসেছে। 

নবদ্বীপ ধামের থেকে দূরে হলেও কুসুমপুর কেন এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ভাবধারার প্রচলনই বেশি। সাধারণ মানুষ এখানে ধর্মপ্রাণ—গৌর নিতাই তাদের উপাস্য দেবতা। 

ললিতার মনে হয় নরহরির এই গৌরপ্রীতি সবই তার ভন্ডামি মাত্র। সে জানে সাধারণ মানুষকে সে নানাভাবে বঞ্চিত করে তার পুঁজি বাড়াচ্ছে, নিজের স্বার্থসিদ্ধি করছে অন্যায় পথে। 

সেই পাপবোধকে ঢাকবার জন্যই, নিজের মনে আরও শক্তি ফিরে পাবার জন্যই ঘন ঘন গৌর নিতাইকে স্মরণ করে মাত্র। 

ললিতা চুপ করেই সরে এসেছে ওই এক কোণের পুরনো বাড়িতে। অতীতে কাছারির গোমস্তাদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত ছিল এই বাড়িটা, এখন ভূতপূর্ব জমিদারের স্ত্রী-সন্তানকেই ওই এঁদো প্রায়ান্ধকার ঘরে আশ্রয় নিতে হয়েছে। 

হরনাথ-এর কাজও শেষ হয়ে গেছে। সেই-ই তবু দু’চারজন চাষিকে ডেকে রানীমায়ের খাসের ওই জমিগুলো ভাগে চাষ করতে দেয়। 

কিছু সৎ মানুষ এখনও আছে সমাজে। তার চাষিদের মধ্যে দুচারজন এখনও রাজাবাবুকে শ্রদ্ধা করে। তারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এসে ওইসব জমি চাষ করার ভার নেয়। মধু কৈবর্ত বড় মাছ চাষি—তার বেশ কিছু পুকুরে ভালো মাছ চাষ হয়। সেই প্রবীণ মধু কৈবর্তও নিজে এসে বলে—রানিমা, আপনার ওই দুটো পুকুরে আমি মাছ চাষ করব—চারা-সার-খোল-জাল সব আমার, আধাআধি ভাগ। 

ভালো শর্ত দিয়েছে মধু। ললিতা তাতেই রাজি হয়। মধু কৈবর্ত প্রণাম করে ললিতার পায়ের কাছে হাজার দুয়েক টাকা নামিয়ে দিয়ে বলে—সামান্য রাজমান্যি মা। এটা রাখুন। 

অর্থাৎ তাদের লেনদেন পাকাপাকি হয়ে গেল। 

জমির চাষিরাও নিজেরাই রানিমার এই বিপদে সাহায্য করতে আসে। তারাও রাজি হয় আধাআধি বখরায়। 

হরনাথ বলে—মা, কাজ তো সব শেষ। এরাও আপনার সন্তানের মতোই, বিপদে-আপদে এরাই আপনার পাশে থাকবে, আর আমি তো গ্রামেই থাকছি মা, যখন প্রয়োজন হবে ডাকবেন, এসে যাব। আর আমিও সময় পেলেই আসব মা। 

হরনাথও চলে গেল। 

ললিতা আর গোকুল। মা ছেলেতে এই বিরাট বিশ্বের পথে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *