পরিক্রমা – ৬

শ্রীধর ছিল অতি দরিদ্র কলা ব্যবসায়ী। নবদ্বীপের বাজারে সে কলা-কলাপাতা, থোড়-মোচা, কাঁচা-পাকা কলা বিক্রি করত। এইখানেই ছিল তার কলাবাগান। এই কলাবাগান থেকেই তার সংসারযাত্রা নির্বাহ হতো। 

তরুণ নিমাই পণ্ডিতের নাম তখন নবদ্বীপে খুবই পরিচিত। তপ্ত-কাঞ্চনবর্ণ তনু, আজানুলম্বিত বাহু, পরনে দামি রেশমি বস্ত্র। শহরের অন্যতম ধনী শ্রেষ্ঠী বুদ্ধিমন্ত খান নিমাইয়ের একান্ত গুণমুগ্ধ। তাঁর কোনো অভাবই ঘটতে দেয় না বিখ্যাত ব্যবসায়ী বুদ্ধিমন্ত খান। 

তবু নিমাই বাজারে এসে মোচা-কলা এসব কিনবেই আর শ্রীধরের দোকানেই আসবে। একটা মোচা নিয়ে এমন দরাদরি শুরু হবে যে শ্রীধরও ক্লান্ত। দু’পয়সার জন্য নিমাইয়ের যেন সব কিছু চলে যাবে। নিমাইও ছাড়বে না—শ্রীধরও তার চেয়ে কম নয়। মোচা সে দেবে না—এই কাণ্ড চলে রোজই ওই দুজনের মধ্যে আবার সব মিটেও যায় সহজে। নিমাইয়ের এ এক কৌতুক, অহেতুক কৃপা। 

এই শ্রীধরকেও প্রসন্ন হয়ে শ্রীবাস অঙ্গনে নিমাই তাঁর প্রকৃত স্বরূপ দর্শন করিয়ে তার নরজন্ম সার্থক করেছিলেন। 

আজ সেসব ইতিহাসের অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে, তবু সেই জায়গাগুলো রয়ে গেছে। 

—তবে তন্তুবায় গ্রাম হইলেন পার।
দেখিলেন খোলা বেচা শ্রীধর-আগার।।
প্রভু বলে—এই স্থানে শ্রীগৌরাঙ্গ হরি।
কীর্তন বিশ্রাম কৈল ভক্তে কৃপা করি।।
এই হেতু শ্রীবিশ্রাম স্থান এর নাম।
হেথা শ্রীধরের ঘরে করহ বিশ্রাম।।
শ্রীধর শুনিল যবে প্ৰভু আগমন।
সাষ্টাঙ্গে আসিয়া করে প্রভুর পূজন।। 
বলে—প্রভু, বড় দয়া এ দাসের প্রতি। 
বিশ্রাম করহ হেথা আমার মিনতি।। 

ভুবনবাবুর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়, পাঠ করছেন তিনি এই মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তরা সমবেত। ভুবনবাবু বলেন, 

—প্রভু এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন তাই এই স্থান আজও বিশ্রামস্থান বলে পরিচিত। এখানে সেই প্রশান্তি আজও বিরাজমান। 

স্তব্ধ জনতা যেন আজও সেই শান্তির স্পর্শ অনুভব করে। তারা জয়ধ্বনি দেয়—জয় শচীননন্দন গৌর হরি।। 

বেলা বাড়ছে, এবার রোদের তেজও বাড়ছে। তবু যাত্রীদের চলার বিরাম নেই। 

নরহরি এর মধ্যে সাজগোজ করে পরিক্রমায় যোগ দিয়েছে। বিশাল বপু, কপালে ইয়া তিলকের দাগ কপালে হাতে এখানে ওখানে তিলক লাগিয়েছে, পরনে ধুতি আর উত্তরীয়। ট্যাকে টাকার গেঁজলা—মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দেখে সেটা ঠিক আছে কিনা, কারণ পরিক্রমায় সাধু-সেজে অনেক চোরও আসে। ট্যাক সাফ করে দেবে কখন কে জানে। তাই ওদিকে নজর দেয় আর নজর দেয় ওই কুন্তীর দিকে। কুন্তীকে নজরে রেখেছে। 

ওই নবীন ডাক্তারের চ্যালা অনিরুদ্ধ ছেলেটা মাঝে মাঝে এসে কি যেন বলছে ফিস ফিস করে। আর ওই চোরা যুধিষ্ঠিরকে দেখে ও ব্যাটা আজ জলের কলসি নিয়ে সঙ্গে চলেছে। তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের জল খাওয়াচ্ছে। ওর কাছে কুন্তীকেও জল খেতে দেখে খুশি হয় না নরহরি। 

কীর্তন চলেছে, এক ফাঁকে নরহরি এগিয়ে আসে ভিড় ঠেলে কুন্তীর দিকে। 

কুন্তী প্রথমদিন নরহরির সঙ্গেই ছিল পরিক্রমার সময়। ক্রমশ কুন্তী মেয়েদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আর মেয়েরাও এবার একটা দলেই পরিণত হয়ে নাম-গান করে চলেছে। আর পায়েল এই দলে গান কীর্তনের নেত্রী। তার কণ্ঠস্বরও অপূর্ব-গানও জানে। পায়েলের নাম-গান সকলকেই মোহিত করে। 

ললিতা, কুন্তী, গোপালের মা বুড়ি, অন্য মেয়েরা একত্রে চলার চেষ্টা করে। অবশ্য গোপালের মায়ের বয়স হয়েছে। শরীরের জোরও কমে আসছে। এই রোদে এইভাবে পথ চলা তার পক্ষে কষ্টকর। তাই থেমে জিরিয়েই চলেছে সে। 

অবশ্য অনিরুদ্ধর দলবল যাত্রীদের সুখ-সুবিধার দিকে নজর রেখেছে। চলেছে পরিক্রমা। চন্দনাও নাম-গান করে চলেছে। মানদা নাম-গান করার চেয়ে গজগজ করছে বেশি আর পান জর্দা মুখে পুরছে ঘন ঘন। 

কুন্তীর মনের অতলে রয়ে গেছে একটা অতৃপ্ত মাতৃত্ব। তার অর্থ গহনা এসবের কোনো অভাব নেই। নরহরি ওদিক থেকে অনেক বেশিই তাকে দিয়েছে। কিন্তু কুন্তীর কোল শূন্যই রয়ে গেছে। কত ডেকেছে ঠাকুরকে, আজ এসেছে পরিক্রমায় মনের অতলে সেই একটি ঐকান্তিক কামনা নিয়েই তার ঘর যেন নবাগত অতিথির কলরবে পূর্ণ হয়ে ওঠে। 

চলেছে কুন্তী—গোকুলকে দেখে রোদে ওই ভাবে নেচে ঘামছে কলকল করে। কুন্তী ডাকে তাকে, 

—শোন! এই গোকুল। 

গোকুল কাছে আসে কুন্তীর। পরিক্রমা চলছে অন্য পথ দিয়ে। পথের ধারে একটা গাছের ছায়ায় কুন্তী গোকুলকে কাছে ডেকে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর মাথা-মুখ-মুছে দেয়। গোকুল কেমন অস্বস্তি বোধ করে। 

কুন্তী এবার তার ব্যাগ থেকে কিছু সন্দেশ বের করে, 

—নে খা। জল খা—গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তোর। নে, খা বাবা। 

গোকুল বলে—না। খিদে নেই। এখন খাব না। 

কুন্তী প্যাকেটটাই ওর হাতে দিয়ে বলে—তাহলে এটা রেখে দে, পরে খাবি। প্যাকেটটা দিয়েছে গোকুলকে। সে নেবে না। 

কুন্তী বলে—নে। আমি দিচ্ছি—মাসিমা হই। 

গোকুল নিতে যাবে এমন সময় কোথা থেকে নরহরি এসে ছোঁ-মেরে গোকুলের হাত থেকে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে বলে, 

—অ্যাঁ, একি দানছত্র খুলেছ? একশো টাকা কেজির সরপুরিয়া আনালাম। আর নিজে না খেয়ে বিলোনো হচ্ছে। অ্যাই ছোঁড়া, তুই দেখি মহা শয়তান, তখন থেকে তক্কে তক্কে রয়েছিস এসব গ্যাড়াবার জন্য। ভাগ্‌— ভাগ্‌ এখান থেকে। 

গোকুল বলে—বারে। আমি নিতেই চাইনি। উনিই জোর করে দিচ্ছিলেন। কে নিতে যাবে ওই সন্দেশ। ওসবে আমার দরকারই নেই। 

চলে যায় গোকুল। কুন্তী চটে ওঠে। বলে সে, 

—কি গো তুমি! ও নিতে চায়নি। আমিই দিতে গেলাম ওকে, কেন বকলে ওকে?

নরহরি ধমকায়—বকবে না! দেখলে ওইটুকু ছোঁড়ার কথার ধার! বলে কিনা ওসবে আমার দরকার নাই। ক্যামন বংশ দেখতে হবে না? কেউটের বাচ্চা—এখন থেকেই ফোঁস করে। 

কুন্তী বলে—ছি-ছিঃ! এত নাম-কীর্তন করে—পরিক্রমাতে এসেও একটুকুও বদলাতে পারলে না নিজেকে? ঘরে-বাইরে একই রয়ে গেলে? সেই নীচ, পাপী, লোভীই রয়ে গেলে? সেই পাপে আমারও কোনো আশাই পূর্ণ হল না। আমার জীবনও ব্যর্থ হয়ে গেল। 

নরহরির চরম দুর্বলতা ফুটে ওঠে এইখানেই। সেও জানে কুন্তীর এই স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। আর এরজন্য সব দোষ, অক্ষমতা যেন তারই। 

নরহরি বলে–থাক, থাক ওসব কথা। ঠাকুরকে ডাকো- 

—ডাকব কি! সব পথই যে বন্ধ করেছ তুমি। শুধু নাম করলেই হবে? বাকিটা শুধু স্বার্থপরতা আর ভণ্ডামিতে-ভরা-ঠাকুরের দয়া পেতে গেলে এই স্বার্থ, অহংকার, লোভ সব ছাড়তে হবে। সেই চেষ্টাই করো—তবেই যদি কিছু হয়। 

কুন্তী আজ যেন ক্রমশ কঠিনই হয়ে ওঠে নরহরির উপর। নরহরি অবশ্য আগেও এইসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। 

কুন্তীকে সে বলে-দ্যাখো টাকাটাই জগতে সবচেয়ে বড়। ওটা রোজগার করতে পারলে সবই হাতের মুঠোয় আসবে। আর ওটা রোজগার করতে গেলে মানুষকে একটু স্বার্থপর, লোভী হতেই হবে। নিষ্ঠুরও হতে হবে। 

কুন্তী বলে—টাকাই তোমার কাছে সবচেয়ে বড়! কিন্তু ওর দাম কতটুকু একদিন তা বুঝবে। তখন আর করার কিছুই থাকবে না। দেখলে তো—কাল রাতে এখানেও তোমার পিছনে শত্রু এসে হানা দিয়েছে। তাই বলি ওসব ছাড়ো— 

নরহরি বলে—চলো, পরিক্রমা এগিয়ে গেছে। 

যুধিষ্ঠির এসে পড়ে জলের কুঁজো নিয়ে। বলে সে, 

—জল দেব বউঠান? 

নরহরি ফুঁসে ওঠে—লাগবে না। যা তো! 

যুধিষ্ঠিরকে দেখে নরহরি এবার তার কোমরে—বাঁধা গাঁজলাটা পরীক্ষা করে দেখে ঠিক আছে কিনা। 

যুধিষ্ঠির বলে—ওসব ঠিকই থাকবে গো বিশ্বাস মশায়। যুধিষ্ঠির আর ওসব কাজ করে না। গৌরহরির দয়ায় ভুল আমার ভেঙেছে গো—জয় শচীনন্দন গৌরহরি! সবই তাঁর কৃপা — 

যুধিষ্ঠির চলে যায়। কুন্তী বলে, 

—চোর যুধিষ্ঠিরও যদি তাঁর কৃপায় সাধু হতে পারে, এত নাম-ডাক করে তিলক কেটেও তুমি তা হতে পার না। কথাটা ভাবতেও দুঃখ হয়। 

নরহরি গর্জে ওঠে। থামো তো! 

পরিক্রমা চলেছে। ভিড় ঠেলে হুঙ্কার দিয়ে নরহরি এসে কীর্তনে যোগ দেয়। গর্জে ওঠে সে—জয় গৌর—জয় নিতাই। নিতাই হে-এ-এ! 

রোদও বাড়ছে। 

আজ পরিক্রমা চলেছে জনপদ-এর ছায়াস্নিগ্ধ পরিবেশ ছাড়িয়ে ধূ ধূ রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তরের বুক চিরে। গাছগাছালিও এদিকে তেমন নেই। 

এই মাঠে এক অতীতের অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। নবদ্বীপ ধামের ইতিহাস তাই বহু বৈচিত্রে ভরা। 

ভুবনবাবু বলেন—এই ময়ামারির মাঠ। এখানেই বলরাম তীর্থযাত্রায় এসে কুখ্যাত দানব ময়াসুরকে বধ করে এখানে মানুষদের বিপদমুক্ত করেছিলেন। 

—পৌরাণিক কথা এক করহ শ্রবণ। 
তীর্থযাত্রা বলদেব করিল যখন।।
নবদ্বীপে আসি যবে করিল বিশ্রাম। 
বিপ্রগণ জানাইল ময়াসুর নাম।।
ময়াসুর উপদ্রব শুনি হলধর।
মহাবেগে ধরে তাকে মাঠের ভিতর।
মহাযুদ্ধ কৈল দৈত্য বলদেব সাথ।
অবশেষে রাম তারে করিল নিপাত 
সেই অবধি ময়ামারির নাম খ্যাত হৈল। 
বহুকালকথা আজ তোমারে কহিল।।

ভক্তরা আজও কল্পনার চোখে যেন দৈত্যের সঙ্গে বলরামের সেই মহারণ-এর দৃশ্য কল্পনা করে। এই তীর্থে সর্ব দেবতারই পদার্পণ ঘটেছিল। চৈতন্যদেবকে দর্শনের আশায় বলরাম ও এসেছিলেন এখানে। 

হরিধ্বনি দিয়ে পরিক্রমা এগিয়ে চলে। 

ক্লান্ত যাত্রীদল চলেছে মাঠের বুক-চিরে, ওরা এই মাঠ পার হয়ে গিয়ে পৌঁছাবে দূরে জলঙ্গি নদীর তীরে, ওই নদী পার হতে হবে সব যাত্রীকে নৌকায়। জলঙ্গিতে জল ভালোই থাকে এসময়। নদী পার হয়ে এই সব যাত্রীদল পৌঁছাবে গোদ্রুম দ্বীপে সেখানেও চৈতন্য কালের প্রচুর লীলাভূমি আছে সেসব তীর্থ দর্শন হবে—প্রবচন কথকতাও হবে সেইসব তীর্থ প্রসঙ্গে। আর পরিক্রমার আজ রাত্রিবাস ওইখানেই। 

চলেছে জনতা। 

রোদে আজ যেন চলতে পারে না চন্দনা। তার পথচলারও অভ্যাস নাই। কলকাতায় আরাম-আয়েশের মধ্যে তার বাস, কিন্তু চন্দনা থামবে না। তার সারা মনে সেই এক চাওয়া- তার ঘরের মানুষটা তাকে পথের মাঝেও ফিরিয়ে দিয়েছে। মানদা-ওই ন্যাপা সরকারকেও মোনা মিত্তির চাপ দিয়েছে ওরা যেন চন্দনাকে এই পরিক্রমা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় কলকাতায়। কিন্তু চন্দনা তাদের কথায় বলে, 

—শুধুহাতে ফিরে যেতে আসিনি সরকার মশাই। পরিক্রমা শেষ করবই, দেখব গৌরাঙ্গের কৃপা পাই কিনা। মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ আমি করব না। 

চন্দনাকে ওরা ফেরাতে পারেনি। সে ওই দুঃসহ কষ্টের মধ্যেও চলেছে পরিক্রমার সঙ্গে। তাই মানদা আর ওই সরকারকেও যেতে হচ্ছে এইভাবে। রোদে যাত্রীরা চলেছে কোনোমতে।

চলেছে পায়েলও। আজীবন সে প্রাচুর্য আর বিলাসের মধ্যে থেকেছে। দেহপসারিণী সে—দেহের যত্নও জানে সে। কিন্তু এখন সে আমূল বদলে গেছে। পায়েলের জীবনে যেন এক নতুন সুর বাজে। এই তনুমন সবই যেন সে গৌরাঙ্গের চরণে সমর্পণ করেছে। তার ক্লেশও বোধহয় না। 

সে চলেছে এই রোদে সহজভাবেই নামগান করতে করতে। 

আজ যেন আকাশ ফেটে ঝরছে সহস্র সূর্যের তাপ-প্রবাহ। এসময় জলও মেলে না এই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। লোকালয়ও নেই। নদীও এখনও অনেক দূরে। 

হাজারো যাত্রীদল চলেছে, তাদের বুকে কি তৃষ্ণা। অনিরুদ্ধের দলও হিমশিম খেয়ে যায় তাদের জল জোগাতে। যুধিষ্ঠির—ওই জুয়াড়ি কৃষ্ণচন্দ্রও এবার ওদের সেই পেশা ছেড়ে জলের কলসি মাথায় নিয়ে যাত্রীদের তেষ্টা মেটাবার জন্য ঘুরছে। তাদের জলও ফুরিয়ে আসে। যুধিষ্ঠির শূন্য কলসি নিয়ে ছোটে দূরের গ্রাম বসতের দিকে পানীয় জলের সন্ধানে। 

আনন্দ মহারাজ চলেছেন পরিক্রমার সঙ্গে। বয়স হয়েছে, জীর্ণ দেহ—তবু এই রোদেও চলেছেন একাই। ভক্তরা এগিয়ে চলেছে। একটা গাছের ছায়ায় বসেছেন আনন্দ মহারাজ। তৃষ্ণার্ত। কমন্ডলু দেখেন যদি সামান্য পানীয় জল পাওয়া যায় তৃষ্ণার কিছু উপশম হবে। কিন্তু পাত্রও শূন্য—একবিন্দু পানীয়ও নেই তাতে। 

গাছতলায় বসে আছেন তৃষ্ণার্ত আনন্দ মহারাজ। 

নরহরি দেখছে ব্যাপারটা। আনন্দ মহারাজ যে এই সম্প্রদায়ের পরম শ্রদ্ধেয় এক সন্ন্যাসী তাও জানে নরহরি। ওই মহাপুরুষের কৃপা পেলে তার লাভই হবে। তাই নরহরি ছুটে এসে আনন্দ মহারাজের চরণে প্রণাম করে তার—স্ত্রী কুন্তীকেও বলে, 

—প্রণাম করো। সাক্ষাৎ মহাপুরুষ 

তারপরই নরহরি ব্যস্ত হয়ে ওঁর সামনে দুটো ডাব—একটা পাত্রে বেশকিছু সন্দেশ রেখে তাতে কিছু টাকা প্রণামি সাজিয়ে বলে, 

—মহারাজ, আপনি তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্ত ডাবের জল আর সন্দেশ খান প্রভু! খুব দামি উৎকৃষ্ট সন্দেশ, খাঁটি সরপুরিয়া—একশো টাকা কেজি। আর সরভাজা—ওর দামও অনেক। নব্বুই টাকা। আর সামান্য কিছু প্রণামিও দিয়েছি—পঞ্চাশ টাকা। ডাবের জল সেবন করুন। উৎকৃষ্ট ডাব—জয় গৌর জয় নিতাই। নিন প্রভু! প্রণামি—পঞ্চাশ টাকা! 

আনন্দ মহারাজ দেখছে ওই নরহরিকে। ওর কথায়—ওর চেহারায় লোভ আর পাপের চিহ্ন প্রকট। শুধু টাকার অর্থাৎ বিষয়ের গন্ধ আর অহংভাবই তার বড়। টাকার মাপেই সে সব কিছুকে মাপে। আনন্দ মহারাজ তৃষ্ণার্ত সত্যই। কিন্তু ওই বিষয়-বিষ মাখানো তার সন্দেশ স্পর্শ করতে তাঁর মন চায় না। আর প্রণামির অর্থ! অর্থ তাঁর কাছে অনিত্য। তাই আনন্দ মহারাজ উঠে পড়লেন ওসব কিছু গ্রহণ না করেই। 

নরহরি অবাক হয়—মহারাজ এসব? 

হাসেন আনন্দ মহারাজ। বলেন, 

—আগে যোগ্যতা অর্জন করো বাবা, তারপর সেবা করবে। চিত্তশুদ্ধি করো বাবা। জয় গৌর—জয় নিতাই। 

আনন্দ মহারাজ ওইসব ফেলে শূন্য কমন্ডলু নিয়ে ওই রোদের মধ্যেই এগিয়ে গেলেন পরিক্রমার দিকে। 

নরহরি অবাক হয়। 

আজ কুন্তীর মনে পড়ে নরহরির সেই কথাগুলো। কুন্তীও বারবার নিষেধ করেছে ওইসব লোভ-পাপের পথ ছাড়ো। টাকাটাই বড় নয়। 

কিন্তু নরহরি বলেছে—টাকাটাই সব। টাকা থাকলেই সব মেলে। 

আজ নরহরি তার টাকা দিয়েই ওই সাধু-মহাপুরুষকেও প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই সাধুও নির্মমভাবে সেই সবকিছুকে তুচ্ছ করে চলে গেলেন। কুন্তী বলে, 

দেখলে তো টাকার মুরোদ কতখানি? পারলে টাকা দিয়ে ওই সাধু-মহারাজকে হাতে আনতে? এখনও সময় আছে—ওইসব লোভ আর পাপের কাজ ছাড়ো। বিষয়ের লোভ ছেড়ে পরকালের কথাই ভাবো। এত পাপী তুমি যে মহারাজ সকলকেই দয়া করেন, তাঁর দয়ারও যোগ্য নও তুমি। এবার নিজের কথাই ভাবো। 

নরহরিও ভাবতে পারেনি যে, ওই সাধু-মহারাজ এইভাবে তার সেবাকেও অগ্রাহ্য করে চলে যাবে। সত্যিই সে এক অভাজনই। 

অন্য সময় হলে নরহরিও স্ত্রীর কথার কড়া জবাবই দিত। কিন্তু আজ তা পারে না। এবার মনে হয় দোষ এতদিন সেইই করেছে আর ওই সাধু-মহারাজ সেই কঠিন সত্যটাই ঘোষণা করে গেছেন। 

প্রায়শ্চিত্তই করবে নরহরি। কিন্তু কীভাবে তা জানে না। ওই পাপ আর লোভের পথে এতখানি এগিয়েছে যে ফেরার পথের সন্ধানও সহজে পায় না। তবে সেই পথের সন্ধান পেতেই হবে নরহরিকে। আজ তাই কাতর কন্ঠেই সে শরণ করে, 

—জয় শচীনন্দন গৌরহরি! তুমিই পথ দেখাও ঠাকুর। 

আজ নরহরির মতো কঠিন একটা মানুষের চোখে জল নামে। 

মনে হয় অনেক পাপই করেছে সে তাই সাধুর দয়াও পেল না। 

দুর্গম পথ, রাস্তা বলে তেমন কিছু নেই। গাছগাছালিও নেই—নেই ছায়ার আশ্বাস। মাঠের মধ্য দিয়ে এই খররোদে চলেছে পরিক্রমা—দূরে নদীর-বাঁধ দেখা যায়। 

গোপালের মা চলেছে কোনমতে। 

বুড়ির তেষ্টাও পেয়েছে। জলের জোগানও তেমন কাজ নেই। যেটুকু আছে যাত্রীর তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। 

বুড়ি আর চলতে পারছে না। গোকুলও রোদে আজ ক্লান্ত। মাকে সামলে নিয়ে চলেছে। ললিতারও যেন চলার সামর্থ্য নেই। কোনোমতে ওরা চলেছে। 

গোপালের মা বলে—তোমরা এগিয়ে যাও বউমা। আমি যেমন করে হোক ওপারে গে তোমাদের খুঁজে নেব 

গোকুল বলে—যেতে পারবে তো ঠাকুমা? না মাঠেই পড়ে থাকবে? 

বুড়ি বলে—না দাদাভাই, ঠিক চলে যাব। তোমরা এগোও, নাহলে আবার ওপারে রাতে থাকার জায়গা পেতে অসুবিধে হবে। 

ওই এক সমস্যা। নদী পার হতেও অনেক সময় নেবে। কখন নৌকা জুটবে কে জানে। তাই ওরা এগিয়ে যায় যাতে সময়মতো নদী পার হতে পারে। 

গোপালের মা কোনোমতে চলেছে। 

মনে হয় ওই যাত্রা বোধহয় শেষ হবে না। তেষ্টায় গলা কাঠ হয়ে আসছে, পা চলছে না। তবু কি যেন স্বপ্নের ঘোরে চলেছে বুড়ি। কানে বাজে দূরাগত নামমন্ত্র ধ্বনি, শঙ্খঘন্টার শব্দ—ধূ ধূ রোদ তবু চলা থামেনি ওর। জীবনের পথ আর পরিক্রমার পথ তার কাছে যেন একাকার হয়ে গেছে। সেখানে পদে পদে পেয়েছে বাধা—আর হতাশাই। এখানেও তার অভাব নেই।

মাঠের পথ, উঁচু আল বেয়ে যেতে হয়। চোখে ভালো করে ঠাওর হয় না বুড়ির। পা পড়ছে টলমল করে—হাতের লাঠি ঠুকে কোনমতে চলেছে সে। চোখেও ঠিক ঠাওর হয় না বুড়ির—ওই রোদে সব কেমন ধোঁয়াটে বোধ হয়। 

হঠাৎ একটা পা আলে না পড়ে শূন্যেই পড়ে আর বুড়ি উঁচু আল থেকে ছিটকে পড়ে নিচের জমিতে। হাতের লাঠিটাও ছিটকে পড়ে 

বুড়ির একটা পায়ে বেশ জোর চোট লেগেছে, বুড়ি জমিতে পড়ে যন্ত্রণায়-আর্তনাদ করে ওঠে। 

উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, পারে না। 

পরিক্রমার লোকজন, যাত্রীরা সবাই এগিয়ে গেছে। বুড়ি গোপালের মা ছিটকে পড়ে মাঠে একা। ওঠবার সাধ্য নেই। 

পা-টা টনটন করছে। বুড়ি একাই পড়ে আছে। 

গোপালের মা আর্তনাদ করে-এ কি করলে ঠাকুর! পা-টাও ভেঙে গেছে বোধহয়। তোমার পরিক্রমায় কি পাপীকে যেতে দেবে না? কী দোষ করেছি ঠাকুর? 

বুড়ির দু’চোখে নামে বেদনার অশ্রু। 

এই মাঠেই একা পড়ে থাকবে সে, বৈকাল নামছে—এরপর সন্ধ্যা নামবে। জনমানবহীন মাঠে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ে থাকবে সে। 

—একি করলে ঠাকুর! বুড়ির চোখে জল নামে। 

—কী হয়েছে বুড়িমা? অ বুড়ি মা! 

কেমন আচ্ছন্নের মতো একাই পড়ে আছে বুড়ি গোপালের মা। কার ডাকে চোখ মেলে তাকাল। অনিরুদ্ধ তার দলবল নিয়ে যাত্রীদের দেখাশুনার কাজেই রয়েছে। ওরা এগিয়ে গেছে, ওদিকে পরিক্রমা তখন নদীর ঘাটে হাজির হয়েছে। 

নদী পারাপারের জন্য কয়েকটা নৌকার ব্যবস্থা করা আছে। তবে এত যাত্রী পার হতে সময় লাগবে, তারই তদারক করছে অনিরুদ্ধের দলবল। 

 অনিরুদ্ধ সবার পিছনে আছে। হঠাৎ নির্জন মাঠে সে ওই বুড়িকে পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যায়।

—কী হল বুড়িমা? 

গোপালের মা চোখ মিলে তাকাল। বলে সে, 

—আল থেকে ছিটকে পড়েছি বাবা, কে জানে পা-টা ভেঙেই গেল কি না। উঠতেও পারছি না। ঠাকুরের নামে পরিক্রমায় এসে শেষে এই হল বাবা? 

অনিরুদ্ধ ফার্স্ট এড ট্রেনিং পাশ করা। সে বসে পড়ে বুড়ির পা-টা তুলে ধরে দু’হাতে। বলে,

—দেখি কী হয়েছে মা। 

বুড়ি এবার আর্তকন্ঠে ককিয়ে ওঠে 

—একে পাপের জন্যই ঠাকুর পরিক্রমায় যেতে দিলেন না। পা ভেঙে বসলাম। মহাপাপী আমি, আর তুমি আমার পাপের বোঝা বাড়িয়ো না বাবা। ছাড়—ছাড় পা ছাড়ো। বামুনের ছেলে হয়ে আমার মতো ইত্যিজাতের পা ধরবে? ওমা–পা ছাড়ো বাবা ঠাকুর-পা ছাড়ো। কেষ্ট বাবা- 

অবাক হয় অনিরুদ্ধ। পা-টা দেখছে বুড়ির। 

 বলে অনিরুদ্ধ—পাপ কী গো? মায়ের পায়ে হাত দিলে ছেলের পাপ নয়—পুণ্যিই হয় গো মা।

বুড়ি অবাক হয়—মা! তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে বাবা? 

অনিরুদ্ধ বুড়ির পা-টা পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে বলে 

—হ্যাঁ। তুমি আমার মায়ের মতোই। মা-ই 

বুড়ি গোপালের মা দেখছে ওই তরুণটিকে। ও যেন তার সেই হারানো সন্তান গোপালই। এতদিন পর আবার ফিরে এসেছে। 

তাকে ডাকছে মা বলে বুড়ির সব কষ্ট যেন মুছে গেছে। 

বলে গোপালের মা, 

—মা! বাবা, গোপাল মারা যাবার পর আর মা বলে কেউ আমাকে ডাকেনি। এতদিন পর তুমি আবার ডাকলে। 

ঠাকুর, অশেষ তোমার দয়া। এই পরিক্রমায় এসে আবার আমার হারানো গোপালকে খুঁজে পেলাম। 

ঠাকুর! তুমি দয়াময়! 

বুড়ির দু’চোখে নামে আনন্দের অশ্রু। তার নিঃস্ব জীবনপত্রে কি পরম পাওয়ার প্রসাদে পূর্ণ হয়ে উঠেছে কানায় কানায়। 

সব যন্ত্রণা তার মুছে গেছে। 

অনিরুদ্ধ কি একটা মলম লাগিয়ে একটু মালিশ করে দিতে পায়ের ব্যথাটারও আরাম হয়। অনিরুদ্ধ বলে, 

—ঠাকুরের দয়া তো আছে গো মা, নাহলে যা পড়েছিলে হুড়মুড়িয়ে, পাটাই ভাঙার কথা। নেহাত তাঁর দয়ায় সামান্যের উপর দিয়েই গেছে। ওঠো, আমার কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে চল। ঠিক যেতে পারবে। ওঠো— 

বুড়ি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। পাও ফেলতে পারে। 

আজ কি গভীর তৃপ্তিতে বুড়ি জয়ধ্বনি দেয়—জয় শচীনন্দন গৌরহরি। তোমার অশেষ দয়া ঠাকুর। 

বুড়ি আজ নিশ্চিন্তে চলেছে পরিক্রমার পথে, ধীরে ধীরে নদীর ধারে এসে বসল ঠান্ডা হাওয়ায় একটা বড় শিরীষ গাছের ঘন ছায়ায়। গোকুল ছুটে আসে—এলে ঠাকুমা? 

—হ্যাঁ ভাই, ঠাকুরই হাত ধরে নে এলেন রে। 

.

খিদেও লেগেছে গোকুলের। আজ দুপুরের প্রসাদ কখন হজম হয়ে গেছে। নদীর ধারে নৌকায় সার বেঁধে যাত্রীদের হিসাব করে তোলা হচ্ছে। সময়ও লাগবে ওপারের ক্যাম্পে পৌঁছোতে। 

এখানে খাবারও কিছু নেই। 

নরহরি সেই সাধু-মহারাজের নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের পর কুন্তীর কথাগুলোও নীরবে হজম করে এসেছে। তার মনে হয় সত্যিই সে এতকাল ভুলই করেছে। 

নিজেরও আজ খাওয়া হয়নি। জলও খায়নি। 

কুন্তীও দেখেছে ব্যাপারটা। ওই মানুষটা খিদে-তেষ্টা সহ্য করতে পারে না। আর সেই লোকটা আজ কিছু খাওয়া তো দূরের কথা জলও খায়নি। 

নদীর ধারে এসে বসে আছে—চুপ করে। 

কুন্তী বলে কিছু মুখে দাও। এখন ওপারে পৌছোতে দেরি আছে। দিনভোর কিছুইতো খাওনি।

নরহরি বলে—একদিন না খেলে মানুষ মরে না নতুন বউ। কতজন না খেয়েই চলেছে, আমিও না হয় গেলাম। 

—কিন্তু এত খাবার! 

নরহরি চুপ করে কি ভাবছে। হঠাৎ দেখে গোকুল মুখ শুকিয়ে বসে আছে। ছেলেটাকে দেখে মনে হয় ক্ষুধার্ত—তেষ্টাও পেয়েছে ওর। কিন্তু কাউকে কিছুই বলেনি। 

নরহরি এগিয়ে আসে। দেখছে ওকে। 

গোকুলও চেনে ওই লোকটাকে। তাকে দেখে উঠে চলে যাবে গোকুল, কুন্তীও দেখছে ওকে, ছেলেটাকে তারও কিছু খাবার দিতে মন চায়, কিন্তু জানে নরহরিকে। আবার চিৎকার করবে—বাধা দেবে। এসব অশান্তি এড়াবার জন্যই চুপ করে থাকে কুন্তী। 

কিন্তু আজ সেও অবাক হয়। নরহরি নিজেই এগিয়ে যায় গোকুলের দিকে। বলে সে,

—খুব তেষ্টা পেয়েছে—খিদে পেয়েছে নারে? 

গোকুল বলে—না-না। আমার ক্ষিধে তেষ্টা পায়নি। 

—শোন—শোন গোকুল! নে—খেয়ে নে বাবা! নে—খিদে পেয়েছে তোর! গোকুলের সামনে আজ নরহরিই খাবার এগিয়ে দেয়। কিন্তু ছোট ছেলেটা কালকের সেই অপমানটা ভোলেনি। তাছাড়া অন্য কারো দেওয়া খাবার সে খেতেও চায় না। তাই বলে গোকুল, 

—না, খাবার লাগবে না। খাবার চাই না। নিয়ে যাও ওসব। 

নরহরি কাতর স্বরে বলে—তুইও আমাকে ফিরিয়ে দিবি গোকুল? ওরে সাধু-মহারাজ ফিরে তাকাল না, তুইও ফিরিয়ে দিবি? ওরে এত বড় পাপী আমি? আমার পাপের কি ক্ষমাও নেই। ললিতা-ও এসে পড়েছে। নে, কিছু মুখে দে গোকুল। 

নরহরিকে ওইভাবে অনুরোধ করতে দেখে বলে ললিতা গোকুলকে, 

—নে বাবা, উনি এত করে বলছেন, নে! খা— 

গোকুল মায়ের কথায় সন্দেশগুলো নেয়। খিদেও পেয়েছে ছেলেটার। খাচ্ছে গোকুল। কুন্তী গ্লাসে জল এগিয়ে দেয়। গোকুল সরের নাড়ু খাচ্ছে, দেখছে নরহরি। ও যেন গোকুল নয়—আজ তার চোখের জলে নিবেদন করা ওই সন্দেশ খাচ্ছে যেন স্বয়ং বালগোপালই। নরহরির চোখ জলে ভরে ওঠে, হ্যাঁ সেই সুন্দর মূর্তিই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আজ নরহরির মনে হয় নিজের অহং-এর মোহ তার সব দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আজ সেই ভুল তার ভাঙছে। নরহরি কি পরম আনন্দে আজ জয়ধ্বনি দেয়। 

—জয় শচীনন্দন গৌরহরি—দয়া কর প্রভু! আমার মতো নরাধম, পাপীকে দয়া কর! কুন্তী দেখছে এক নতুন নরহরিকে। দু’চোখে তার আজ অশ্রু ঝরে—অনুতাপ আর অনুশোচনার অশ্রু। 

যাত্রীরা নদী পার হয়ে গোদ্রুম দ্বীপে এসে পৌঁছাল। 

আবার শুরু হয় পরিক্রমা। তখনও আকাশে সূর্যের তেজ রয়েছে—তবে তত বেশি নয়। পড়ন্ত সুর্যের সেই প্রদীপ্ত দীপ্তি ম্লান হয়ে আসছে ছায়াঘন তরুবীথিকায়। 

সামনে দেখা যায় সবুজ বনস্পতি পরিবৃত একটা টিলা—বেশ খানিকটা উঁচু জায়গা ঘিরে গাছ, কিছু ভগ্ন প্রাসাদের চিহ্ন বর্তমান, আর বেশির ভাগই অবলুপ্ত রয়েছে টিলার অতলে।

পরিক্রমা ওই টিলার উপর উঠছে—গাছগাছালির ফাঁকে দেখা যায় কয়েকটা মন্দির।

নাম কীর্তনের শব্দে শান্ত জনপদ মুখরিত হয়ে ওঠে। 

হাজারো ভক্ত জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে—জয় শচীনন্দন গৌরহরি। 

.

যুগ-যুগ ধরে ইতিহাসে একটা ঘটনাকে ঘটতে দেখা যায়। কোনো অবতার যখনই অবতীর্ণ হন তিনি একা আসেন না। 

দ্বাপরে কৃষ্ণ এসেছিলেন সাঙ্গপাঙ্গ এবং সখাসখীদের নিয়ে। তার আগে ত্রেতা যুগেও দেখা যায় রামচন্দ্র এসেছিলেন—তার সহচর-সহচরীদের নিয়েই। 

চৈতন্য অবতারেও দেখা যায় তিনি একা আসেননি। কৃষ্ণের যেমন বলরাম, অন্যরাও, তেমনি চৈতন্য অবতারেও দেখি নিত্যানন্দ শ্রীবাসাদি ভক্তদেরও আসতে। এই ভক্তদের মধ্যে অন্যতম সেবক ছিলেন বুদ্ধিমন্ত খাঁ। 

নবদ্বীপে নিমাই এখন সবে পাঠ শেষ করে নিজের পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়ে নিজেই এবার অধ্যাপনা শুরু করেছেন। তপ্তকাঞ্চনবর্ণ দেহ—আজানুলম্বিত বাহু, পরনে গরদের ধুতি—রেশমি উত্তরীয়। 

নিমাই পন্ডিতের গুণমুগ্ধ ছিলেন তখনকার দিনে নবদ্বীপের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী বুদ্ধিমন্ত খান। প্রচুর অর্থ—আর তেমনি বিশাল তার ব্যবসা। মা লক্ষ্মী তাঁর ঘরে যেন বাঁধা পড়েছেন। এ হেন বড় ব্যবসায়ী বুদ্ধিমন্ত খান তরুণ নিমাইকে সেবা করার জন্য ব্যস্ত। নিমাই-এর জন্য বহু মূল্যবান বস্ত্রাদি, নিমাইয়ের যা কিছু দরকার তা তখুনি জোগান দেন তার একনিষ্ঠ ভক্ত সেবক বুদ্ধিমত্ত খান। প্রভুর সেবায় সে আত্মনিয়োজিত। এ যেন তার জন্ম-জন্মান্তরের অধিকার। 

পরিক্রমা এসে পৌঁছেছে টিলার উপরেই প্রাচীন মন্দির চত্বরে। সামনে বিস্তীর্ণ ছায়াঘন বাগান—দিঘি। ওই মাঠে তাঁবুর বসতি গড়ে উঠছে। আজ পরিক্রমার ভক্তরা রাতে থাকবে এই সবুজ-শান্ত পরিবেশে। 

সন্ধ্যার আকাশে দিনের আলো মুছে আসছে। চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি, পাখিদের কলরব শোনা যায়। মন্দিরে তখনও পাঠ চলছে। ভক্তরা বসে আছে। ভুবনবাবুর পাঠ শোনা যায়। এই সুবর্ণবিহার প্রসঙ্গে পাঠ করছেন তিনি। 

সত্যযুগে এই স্থানে           ছিল রাজা সবে জানে, 
শ্রীসুবর্ণ সেন তার নাম। 
বহুকাল রাজ্য কৈল           পরেতে বার্ধক্য হৈল, 
তবু নাহি কাৰ্যেতে বিশ্ৰাম।। 
বিষয়ে আবিষ্ট চিত্ত           কিসে বৃদ্ধি হয় বিত্ত 
এই চিন্তা করে নরবর। 
কি জানি কি ভাগ্যবশে           শ্রীনারদ তথা আইসে, 
রাজা তারে পূজিল বিস্তর। 
নারদের দয়া হৈল           তত্ত্ব উপদেশ কৈল 
রাজারে ত’ লইয়া নির্জনে। 
নারদ কহেন রায়,           বৃথা তব দিন যায়, 
অর্থ চিন্তা করি মনে মনে।। 
অর্থকে অনর্থ জান,          পরমার্থ দিব্যজ্ঞান
 হৃদয়ে ভাবহ একবার। 
দারাপুত্র বন্ধুজন,           কেহ নাহি নিজ জন, 
মরণেতে কেহ নহে কার।। 
অতএব জ্ঞানীজন,             ভক্তিমুক্তি নাহি লন 
কৃষ্ণভক্তি করেন সাধন।। 
বিষয়েতে অনাসক্তি,            কৃষ্ণপদে অনুরক্তি, 
সমদ্ধাভিধেয়—প্রয়োজন। 
জীব সে কৃষ্ণের দাস,          ভক্তি বিনা সর্বনাশ 
ভক্তিবৃক্ষে ফলে প্রেমফল। 
সেই ফল প্রয়োজন           কৃষ্ণ প্রেম নিত্যধন 
ভুক্তিমুক্তি তুচ্ছ সে সকল।।

ভুবনবাবুর কণ্ঠে ওই পঙক্তিগুলো যেন আবেগে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ভক্তগণের সামনে অতীতের এক গৌরবময় অধ্যায়ের ছবি ফুটে ওঠে। নারদ বলেন, 

ধন্য কলি আগমনে,         হেথা কৃষ্ণ সবে গণে,
শ্রীগৌরাঙ্গ লীলা প্রকাশিবে। 
যেই গৌরনাম লবে            তাতে কৃষ্ণ কৃপা হবে, 
ব্ৰজে বাস সেই ত’ করিবে।। 

নারদ তত্ত্ব কথা শুনিয়ে বিদায় নিলেন। বিষয় বুদ্ধিতে নিমগ্ন রাজা সুবর্ণ সেনের মনে এবার ঝড় ওঠে। আজ মনে হয় ইহকাল নয়, পরকালের জন্য কৃত্যও তার আছে। 

সেদিন রাতে প্রাসাদে নিদ্রামগ্ন—হঠাৎ স্বপ্ন দেখেন রাজা গৌর গঙ্গাধর সপার্ষদ তার আঙিনায় সমাগত। প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে তাঁরা কীর্তন করছেন। 

স্বপ্ন ভেঙে যায় রাজার। এবার তার চিত্তে গৌরপ্রেমের বন্যা। কাতর হয়ে পড়েন সুবর্ণ রায়। দু’চোখে তার অশ্রু ঝরে—গৌর হা গৌর বলে ক্রন্দন করেন রাজা। 

এমন সময় দৈববাণী হয় 

—দৈববাণী হৈল তার         প্রকট সময়ে রায় 
হবে তুমি পার্ষদ গণন 
বুদ্ধিমন্ত খান নাম,         পাইবে হে গুণধাম, 
সেবিবে গৌরাঙ্গ শ্রীচরণ।

সত্যযুগের রাজা সুবর্ণ রায় কাশীতে গৌরাঙ্গ অবতারে পার্ষদ হয়ে জন্মেছিলেন।

ভক্তগণ জয়ধ্বনি দেয়—জয় শচীনন্দন গৌরহরি, সন্ধ্যারতির আয়োজন শুরু হয়। 

.

রোদের তাপ কমতে সন্ধ্যায় পার হয়ে যায় এখানে। ক’দিন ধরে বাতাসে যেন অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই পরিক্রমা চলেছে। 

ভক্তরা সারাদিন ওই রোদের তাপে তেতে-পুড়ে এবার দিঘিতে স্নান করে যেন শান্তি ফিরে পাবার চেষ্টা করে। 

বিস্তীর্ণ বাগানের মধ্যে নানারকম গাছগাছালির ভিড়—মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গায়, মাঠে তাঁবুগুলো খাটানো হয়েছে। 

ওদিকে মন্ডপের বিশাল তাঁবুতে নাম-গানের সুর ওঠে। 

নরহরি তার তাঁবুতে চুপ করে বসে আছে। 

ওর সেই নাম হুঙ্কার-এর দাপট কেমন কমে গেছে। মানুষটা ক্রমশ যেন বুঝেছে এযাবৎ যা করে এসেছে তা ঘোরতর শাস্ত্রবিরোধী—অন্যায় কাজই। তার জন্যই তার ঘরেও কোনো বংশধর আসেনি। তার স্ত্রীর আত্মবাসও সত্য। 

তার কাছে ওই অর্থই ছিল সবচেয়ে বড়, পরমার্থের সন্ধান তার জানা ছিল না। ওই সাধু-মহারাজ আজ তাঁর ব্যবহারে জানিয়ে দিয়েছেন নরহরির অন্তঃসারশূন্যতা। পাপের ভাগই তার বেশি, ধর্মের নামে এতকাল ভন্ডামিই করেছে, পুণ্যের লেশমাত্র নেই তার জীবনে। শুধু পাপেই পূর্ণ হয়ে গেছে তার জীবনপাত্র। 

কুন্তী দেখছে ওই মানুষটাকে। 

ওর মধ্যে যে একটা ভাঙনের পালা চলেছে, সেটা ওরও নজর এড়ায়নি। 

মানুষের বিবেক শত অন্যায়ের মধ্যে জেগে ওঠে—আজ সেই জাগরণই ঘটেছে ওর মধ্যে।

রাত্রি নামছে। ক্লান্ত যাত্রীদল যে সেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়ে নিদ্রার আয়োজন করছে। কাল ভোরেই আবার যাত্রা শুরু হবে। 

এবারের পথ আরও দীর্ঘ। 

এই অঞ্চলে পরিক্রমা সেরে ওরা গৌরাঙ্গ সেতু পার হয়ে গঙ্গার পশ্চিম তীরে যাবে। সেখানেও শ্রীচৈতন্য লীলার অনেক তীর্থ আছে। সেইসব স্থান পরিক্রমা করতে হবে। 

যাত্রীরা প্রায়ই শুয়ে পড়েছে। 

পায়েল আজ নিজের তাঁবুতে রয়েছে একাই, তার কাজের মেয়েটার সঙ্গে রয়েছে। সেও রোদে পথশ্রমে ক্লান্ত। আর দিনভোর পরিক্রমায় কদিন মোনা মিত্তির তার আশপাশেই থাকত। কাল তাকে একবার মাত্র এক নজর দেখেছিল পায়েল। 

ও চায় না মোনা মিত্তির আর তার জীবনে আসুক। পায়েল এই ভোগলালসার জীবন থেকে সরে এসে এবার গৌরাঙ্গ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চায়। 

তাই মোনা মিত্তিরকে সে এড়াতে চায়। এবং তার স্ত্রীকেও দেখেছে পায়েল। 

শান্ত লক্ষ্মীশ্রীযুক্ত একটি ঘরের বৌ, ওই ছন্নছাড়া মানুষের যে এমন স্ত্রী হতে পারে তা ভাবেনি পায়েল। কিন্তু তবু মোনা মিত্তিরের ঘরে মন বসে না। 

পায়েল তাকে তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চায়। মিত্তির মশাই এই পথ ছেড়ে ঘরে ফিরে যাক—সারা মন দিয়ে তাই চায় পায়েল। 

ওর কাজের মেয়েটা বলে, 

—দেখলাম মিত্তির মশাইকে, একাই চলেছে। লোকটা কী গো—মদের নেশা তবু গেল না?

পায়েল ধমকে ওঠে—যে যা করছে করুক গে। তাতেই তোরই বা কি, আমারই বা কী! নে শুয়ে পড়। 

কাজের মেয়েটা বলে—না, ওসব ভেবে লাভ কী! শুনেছি ওর বউ ঘর সংসার সব আছে, তবু মদের নেশায় টোর হয়ে এই রোদে ঘুরছে কেন? মরবে নাকি! 

পায়েল শুনছে কথাটা। মানুষটার জন্য তারও মায়া হয়। তার কথাও ভাবে। 

.

অবশ্য মোনা মিত্তির কারো কথাই ভাবে না। 

আজ সে একাই। ভিড়ের মধ্যে দেখেছিল তার স্ত্রী চন্দনাকেও, এড়িয়ে গেছে তাকে মোনা মিত্তির। বরং তার চোখ খুঁজছে বার বার পায়েলকেই। পায়েলও এড়িয়ে গেছে তাকে। 

আর কি রাগের জ্বালায় মোনা মিত্তির জ্বলে উঠেছে। 

ঘরে ফিরে যাবে না সে। এই পরিক্রমার শেষই দেখবে। 

সন্ধ্যার পর মোনা মিত্তির কোনো একটা পুকুরে বেশ স্নান করে এবার তাঁবুতে ফিরে মদের বোতল খুলে বসেছে। 

ভূধর সঙ্গেই আছে। তার উদ্যোগে চানাচুর-আলুভাজা-ইত্যাদি চাটও মেলে, আর কৃষ্ণনগর হোটেল থেকে মটন, চিকেন, তন্দুরী রুটি, তড়কা এসবও এসে যায়। 

মোনা মিত্তির মদ খাচ্ছে— 

হঠাৎ যুধিষ্ঠিরদের দেখে চাইল। এই পথে যুধিষ্ঠির আর জুয়াড়ি রামচন্দ্র দুজনে প্রসাদের সন্ধানে যাচ্ছিল। মূল মণ্ডপ থেকে ভক্তদের রাতের প্রসাদ-মুড়ি চিঁড়ে, ফল আর দুধ দেওয়া হয়। 

ওরা চলেছে। মোনা মিত্তির যুধিষ্ঠিরকে দেখে বলে 

—কইরে আয়, যা হয়েছে তা ভুলে যা। বোস। মাল খা, খাবারও অনেক আছে। বোস যুধিষ্ঠির দেখছে। বলে সে, 

—প্রসাদ নিতে যাচ্ছি গো বাবু, ওসব খাবো না আর। 

মোনা মিত্তির হাসছে—ওই নিরামিষ্যি মুড়ি-চিঁড়ের ফলার-এখানে বিলেতি আর চিলি-চিকেন, বিরিয়ানী-কাবাব- 

যুধিষ্ঠির বলে—গরীবের ওসব খাবারে দরকার কী বাবু? আর মদ! আপনিও ছেড়ে দ্যান বাবু, ওই বিষ আর খাবেন না গো ওসব। 

মোনা মিত্তির অবাক হয়! ব্যাটা চোরা যুধিষ্ঠিরও পরিক্রমায় এসে সাধু হয়ে গেছে? যাঃ বাবাঃ! গো টু হেল! ভাগ শালা। 

চলে যায় যুধিষ্ঠিররা। 

ওদিকে থেকে আসছিল পায়েল। সেও দেখেছে, শুনেছে ওই যুধিষ্ঠিরের কথা। মানুষগুলো যেন এতকালের কৃতকর্মের বোঝা নামিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজছে। পায়েল বলে

—একটা চোর, জুয়াডিও বদলাতে পারে মিত্তির মশাই, তুমি ভদ্রলোক হয়েও সব জেনে বদলাবে না? এমনি করে নিজের সর্বনাশকেই ডেকে আনবে? 

চাইল মোনা মিত্তির—পায়েল! এসো এসো। 

—থাক! আর ওখানে যাবার প্রবৃত্তিও আমার নেই। মিত্তির মশাই তোমার এমন কর্মফল যে দয়াল ঠাকুরের দয়াকণাও পেলে না? 

মোনা মিত্তির বলে, 

—তোমাদের দয়াল ঠাকুরও আমাকে জবাব দেছেন গো পায়েল! তাই তো এই নিয়েই সব দুঃখে ভুলে আছি। চাই না, কাউকে আমার চাই না। তুমি কেন এসেছ পায়েল? এই দুনিয়ায় কাউকে আমার চাই না—যাও। যাও এখান থেকে। 

মোনা মিত্তির ব্যর্থ হতাশার জালায় যেন জ্বলে ওঠে। 

.

চন্দনা মুখ বুজে এই দহন জ্বালা সহ্য করে চলেছে। মেয়েদের স্বভাব এটা। তারা মুখবুজে অনেক যন্ত্রণাই সয়ে যায়। দুঃসহ রোদের তাপে সারাদিন কেটেছে তার। 

মানদা বলে—এ যেন তোমার উমার তপস্যা বউদিমণি—তবু সোয়ামির নজর পড়ে না। আর ঠাকুর দেবতাও নাই গো, তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ ঠিক করতেন ঠাকুর। 

চন্দনা বলে—এত সহজে কি কেষ্ট মেলে রে, বহুৎ কষ্ট করতে হয়। 

মানদা বলে—পারেও বাবু। আমার সোয়ামির জন্য এত কষ্ট-সহ্য করতে হলে মিসের মুখে ঝাঁটা মারতাম। 

চন্দনা বলে—তাইতো জোটেনি তোর। নে, রাত হয়েছে, খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়। কাল ভোরে আবার বের হতে হবে। 

তাঁবু বসতের মানুষগুলো বিশ্রামের আয়োজন করছে। সারাদিন তপ্ত-হাওয়া চলার পর এখন বাতাসে ঠান্ডার আমেজ ফুটে ওঠে। 

হঠাৎ ওই নিস্তব্ধতার মাঝে কার-কান্নার স্বর ফুটে ওঠে। কান্নাভেজা স্বরে কোনো মা আর্তনাদ করে ওঠে তার অসুস্থ ছেলেটার পানে চেয়ে—একি সর্বনাশ হ’ল গো! একি করলে ঠাকুর? 

ওই স্তব্ধ অন্ধকারে ললিতার কাতর আর্তনাদ ধ্বনিত হয়। 

তাঁবু বসতের অনেকেই জেগে উঠেছে, অন্ধকারে মায়ের-কান্না শোনা যায়। 

বুড়ি গোপালের মাও ঘুমোতে পারেনি। 

তার পায়ের যন্ত্রণার জন্য ডাক্তারবাবু বৈকালে ওষুধ দিতে কিছুটা কমেছে। তবু তার ঘুম আসেনি। পাশেই শুয়েছিল তারা, তাঁবুতে ললিতা তার ছেলে গোকুলকে নিয়ে। 

ছেলেটা ওই রোদে ক’দিন খুব নেচেছে কীর্তনের দলে। খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক ছিল না। ওই রোদেই তেষ্টা পেয়েছে আর যেখানে-সেখানে জলও খেয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মও হয়েছে। 

ফলে গোকুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। 

দাস্ত আর বমি শুরু হয়, প্রথমে ততটা খেয়াল করেনি ললিতা। তারপর ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে এখন অসহায়—কান্নায় ভেঙে পড়ে। 

খবর পেয়ে এসেছেন ভুবনবাবুও। 

নবীন ডাক্তারও এসেছে, এসেছে অনিরুদ্ধ তার দলবল নিয়ে। তখন অসুখ বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। 

নবীন ডাক্তার নাড়ি দেখছে। 

বলে সে—ডি হাইড্রেশন শুরু হয়েছে ভুবনদা, স্যালাইন দিতে হবে। আরও দুটো ওষুধের দরকার। 

ওরা রয়েছে একেবারে দূর পল্লিগ্রামে। রাতও অনেক। কৃষ্ণনগর শহরে রাতে ওষুধ মিলতে পারে, কিন্তু শহর দূরের পথ। আর যাতায়াতের কোনো গাড়িও নাই। সাইকেল মিলতে পারে, তাতেও ঘন্টা দেড়েক প্রায় লাগবে যেতে। তাছাড়া রাতের অন্ধকারে এসব এলাকা চোর, ডাকাত-স্মাগলারদের দখলে চলে যায়। তখন ভয়ে কোনো সাধারণ মানুষ যাতায়াত করে না। গেলে তাকে আর পাওয়া যায় না, তার লাশই পড়ে থাকে পথের ধারের ঝোপে। ফলে রাতে ওপথে লোক—চলাচলই বন্ধ থাকে। 

কিন্তু নবীন ডাক্তার বলে, 

—ভুবনদা, স্যালাইন, ওষুধ এসব না হলে কিছুই করা যাবে না। দেরি হলে কেস আরও জটিলই হয়ে যাবে। 

গোকুলের অসুখের খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট ছেলেটাকে সকলেই ভালোবাসত। দিনভোর নেচে নাম-গান করত পরিক্রমায়। 

আজ সেইই শয্যাশায়ী। ললিতার চোখে জল নামে। অশ্রুভরা কন্ঠে বলে ললিতা—ঠাকুরের নাম নিয়ে পরিক্রমায় বের হয়েছিলাম—তাঁর দয়া পাব বলে। আর ঠাকুর এত নিষ্ঠুর ভুবনদা, আমার শিবরাত্রির সলতেটুকুকেও কেড়ে নেবেন? কী দোষ করেছি যে, আমার এতবড় শাস্তি! এ কেমন ঠাকুর? এ কেমন তার বিচার? 

ভুবন বলে—শান্ত হও মা। তাঁর দয়াতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। 

নবীন ডাক্তার বলে—তাঁর দয়া প্রার্থনা করছ করো, কিন্তু ওষুধগুলো চাই। 

এর মধ্যে নরহরির তাঁবুতেও খবর পৌঁছেছে, গোকুলের দাস্ত-বমি হচ্ছে—কেস খুবই জটিল। ডাক্তার বলছে, খাবার অনিয়ম হয়েছে। 

চমকে ওঠে নরহরি। ছেলেটাকে আজ জোর করে সে নিজের তৃপ্তির জন্যই অনেক কাটা ফল সন্দেশ এসব খাইয়েছে অবেলায়। তার থেকেই কিছু হল কিনা কে জানে? 

কুন্তীও বলে—তখন জোর করে খাওয়ালে, এখন সর্বনাশ না হয় বাপু। 

নরহরিরও ভয় হয়। 

গোকুলের এই বিপদের জন্য যেন নিজেকেই দায়ী মনে হয় নরহরির। তার অপবিত্র খাদ্যই ওই দেবশিশুকে অসুস্থ করে তুলেছে। 

নরহরি খবরটা পেয়ে দৌড়ালো ওই ললিতাদের তাঁবুর দিকে। 

সেখানে তখন অনেকেই এসেছে। নবীন ডাক্তার বলে, 

—ওষুধগুলো আনাবার ব্যবস্থা করুন শহর থেকে যে ভাবে হোক। নাহলে করার কিছু থাকবে না। 

কিন্তু কে যাবে ওই ডাকাতের রাজ্যে প্রাণ হাতে নিয়ে! তারপর টাকার ব্যাপার আছে। ওষুধের দাম—সেটা দেবার লোক হয়তো এসে যাবে। 

নরহরিই এসে পড়ে। বলে সে, 

—আমি টাকা দিচ্ছি ডাক্তার। যত টাকা লাগে নাও যে ওষুধের দরকার আনাও। ছেলেটাকে ভালো করে তোলো ডাক্তার।

—কিন্তু ওষুধ আনতে যাবে কে? এই রাতে— 

ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে চোর যুধিষ্ঠির। 

—ডাক্তারবাবু, আমি যাব শহরে— 

—ডাকাতের রাজ্যি—ভুবনবাবু অবাক হন। 

যুধিষ্ঠির বলে—আমিও এই লাইনের পাকা চোর গো— 

এতকাল নিজের জন্য আঁধার রাতে যাতায়াত করেছি—আজ ওই ফুলের মতো ছেলেটাকে বাঁচাবার জন্য যাব না? 

কোনো ভয় নাই—ও শালারা আমাকে চেনে। কিছুই করতে পারবে না যুধিষ্ঠিরের, আমি যাব আর ওষুধ নে আসব এই রাতেই। 

ডাক্তারবাবু ওকে টাকাটা দেন—ওষুধের ফর্দও দেন। বলেন, 

—সাবধানে যাবি। 

যুধিষ্ঠির বের হয়ে গেল ওই অন্ধকার রাতে জান কবুল করে গোকুলের জন্য ওষুধ আনতে।

ভুবনবাবু দেখছেন নরহরিকে। একটা টাকাও কাউকে হাতে তুলে দেয়নি কোনদিন, আজ অযাচিতভাবে এতগুলো টাকা এসে দিয়ে গেল। আর যুধিষ্ঠিরও জান কবুল করে দৌড়ালো। 

ভুবন দেখছেন, মানুষের আর এক রূপকে। বলেন তিনি, 

—এমনি হরির অহেতুক করুণা, প্রেমের এমনি জাদু, 

কয়লা হৃদয় গলি হিরা হয় তস্করও হয় সাধু। 

জয় গৌরহরি। 

.

গোকুলের অবস্থা খারাপের দিকেই চলেছে। ডাক্তার ওকে নুন-চিনি জল খাওয়াচ্ছেন, ওষুধও যা আছে তাই দেন। 

ললিতার চোখে-জল। যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে গোকুলের দেহটা। 

ললিতা বলে—একি করলে গৌরহরি, দয়া করো ঠাকুর! 

ভুবনবাবু বলেন—ওর মুখে দেবতার চরণামৃত দাও আর নাম-গান করো। নামাভাসে নিশ্চয়ই ওর কল্যাণ হবে। 

সমবেত কন্ঠে ওরা নাম-গান শুরু করে। 

রাতের প্রহরে ধ্বনিত হয় নামগান—চরণামৃত দিচ্ছে ওরা গোকুলকে, ললিতা হাওয়া করে। নাম-গান চলেছে, রাত গভীর হয়ে ওঠে। 

নাম-গান চলেছে। ডাক্তার নাড়ি পরীক্ষা করছে মাঝে মাঝে। হঠাৎ বলে ওঠে—ভুবনবাবু, অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে গোকুল। 

দাস্ত-বমিও বন্ধ হয়। ক্রমশ যন্ত্রণা কমে তার, মুখে ফুটে ওঠে প্রশান্তির ছায়া, নাম-গান চলেছে। ললিতার মুখে খুশির আভাস। 

—গোকুল, বাবা গোকুল। 

গোকুল চোখ চায়। জয়ধ্বনি ওঠে—জয় শচীনন্দন গৌরহরি- 

—অন্ধকারে যুধিষ্ঠিরও এসে পড়ে। ওর কপালে লাঠির চোট, রক্ত ঝরছে। যুধিষ্ঠির বলে,

—ডাক্তারবাবু। ওষুধ এনেছি গো। আর এই বারো টাকা ফেরত— 

—রক্ত। তোর কপালে রক্ত! 

হাসে যুধিষ্ঠির, 

—পথে এক শালা লাঠি হাঁক্কেছিল! তা পুরো কাটাতি পারিনি। 

লেগে গেল একটু। ও কিছু নয়, আগে চুরি করতে গে এর চেয়েও জব্বর প্যাঁদানি কত খেয়েছি। ই আর কি! কিছু লয়। 

ডাক্তারবাবু বলেন, 

—যুধিষ্ঠির, গোকুল অনেকটা ভালো আছে রে। তবু তোর ওষুধও দিচ্ছি ওকে। 

নাম-গান চলেছে। আজ ভক্তদের চোখের সামনে যেন নামগানের এক বিচিত্র পরিচয় ফুটে উঠেছে। অন্তর থেকে তাই ওরা নামগান করছে। 

নরহরি দেখছে গোকুল সেরে উঠেছে, সে আজ দেখেছে নাম-গানের প্রকৃত মহিমা। এই পবিত্র নাম নিয়ে সে ভন্ডামি করেছে, বেশাতি করেছে, নামপ্রেমী সেজে বহু অসহায়- মানুষের সর্বনাশ করেছে। এই পরিবেশে এসে নরহরি বুঝেছে তার জীবনের ভুলগুলো। তার স্ত্রী কুন্তী ও বারবার বলেছে ওই পথ ছেড়ে সৎপথে চলতে, কিন্তু তার সব অনুরোধও সে অগ্রাহ্য করে নিজের পথেই চলেছিল এতদিন। 

আজ মনে হয় কুন্তীর কাছেও সে অপরাধী। এই পোড়ামুখ, দেখাতে আজ তার লজ্জা বোধহয়।

রাত নেমেছে। নরহরি এসে রাতের অন্ধকারে গঙ্গার ধারে বসে। তারার আলোর শিহর জাগে গঙ্গার বুকে, বাতাসে ওঠে ঢেউয়ের কলতান। নরহরির সারা মনে দুঃসহ-গ্লানি আর অনুশোচনা জাগে। 

এই বেদনা—শূন্যতা তার একারই। 

একাকীই তাকে এই দুঃসহ কষ্ট-সহ্য করতে হবে। নরহরি বসে আছে ওই নদীর ধারে, যেন ভবনদীর তীরে শেষ পারাণির আশাতেই বসে আছে নরহরি। তার নিজের জীবনের উপর সব আশা-আশ্বাস-ভালোবাসা যেন হারিয়ে গেছে। 

কেষ্ট, কানাই, রাধুর দলও নজর রেখেছিল নরহরির উপর। 

ওদের সর্বস্ব ঠকিয়ে কেড়ে নিয়েছে নরহরি। ওদের পরিবার-সন্তান না খেয়ে মরেছে, নরহরি টাকার জোরে মিথ্যা-মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পুরেছিল। ওরা ফিরে এসে দেখে তাদের সংসারকেও শেষ করেছে নরহরি ঘোষ। 

ওরাও শপথ নিয়ে বের হয়েছে এই পরিক্রমার মধ্যেই ওই ভন্ড-শয়তান নরহরিকে ওরা শেষ করে দেবে, যাতে ওর শয়তানি দিয়ে আর কারোও সর্বনাশ না করতে পারে। 

কানাই-ই বলে—ব্যাটাকে সেই রাতে তাঁবুর মধ্যে খতম করতে পারিনি, ফিরে এসেছিলাম।

রাধু বলে—আজ কাজ হাসিল করতেই হবে। 

ওরা হাতিয়ার বের করে ওই রাতের অন্ধকারে সাবধানে নদীর ধারের দিকে এগোল। নরহরিকে খুঁজে বের করে ওই অন্ধকারেই ওকে শেষ করে নদীর জলে ফেলে দেবে লাশটা। 

ওরা আজ প্রতিশোধ নেবার জন্য মরিয়া হয়ে চলেছে নরহরির সন্ধানে। 

সারারাত প্রায় জেগে কাটিয়েছে অনেকে ওই মন্দির চাতালে গোকুলকে নিয়ে। আর নাম-কীৰ্তন চলেছে বহুক্ষণ। আজ ওই যাত্রীদের সামনে যেন বিচিত্র রহস্যময় একটা ঘটনাই ঘটেছে 

দেখেছে মৃতপ্রায় ছেলেটা যাকে ডাক্তারও আশ্বাস দিতে পারেনি, ওই নামগানে যেন আবার সুস্থ হয়ে উঠেছে। ঠাকুরের দয়ায় ওই বিপদসঙ্কুল পথ পার হয়ে ওষুধও পৌঁছে দিয়েছে যুধিষ্ঠির। ঠাকুরের দয়াতেই আবার ছেলেটা সেরে উঠেছে। 

ওরা যে-যার আশ্রয়ে ফিরে গেছে খুশি মনে। তবু কিছুটা ঘুমোতে পারবে। কাল সকাল থেকেই আবার শুরু হবে পরিক্রমা। 

কুন্তীও শুতে গেছে তার তাঁবুতে। নরহরির দেখা মেলে না, হয়তো গেছে কোথাও, এসে পড়বে। কুন্তী অপেক্ষা করছে। 

হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে যায়—তারও গা-পাক দিয়ে ওঠে আর হড়হড় করে বমি শুরু করে কুন্তী। 

কুন্তীর পাশের তাঁবুতে রয়েছে গোপালের মা। বুড়ি কুন্তীর এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায়, চিৎকার করে ওঠে। অনিরুদ্ধ কাছেই ছিল, সেও এসে পড়ে। কুন্তীর শরীর খারাপ দেখে নবীন ডাক্তারকে খুঁজতে যায়। বলে অনিরুদ্ধ, 

—বুড়ি মা, ওর মুখে মাথায় জল-টল দাও। আমি ডাক্তারবাবুকে খুঁজে আনছি। ঘোষ মশায় কোথায়? 

বুড়ি বলে—তা তো জানি না বাবা। 

নরহরি বসে আছে রাতের অন্ধকারে নির্জন গঙ্গার তীরে। তিনটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে চলেছে, আজ তারা নরহরিকে শেষ করবেই। এই সুযোগ তারা ছাড়বে না। 

নরহরি মাথা নিচু করে বসে আছে, তার আজ ওসব দিকে খেয়ালও নাই। তিনমূর্তি এসে এবার ঘিরে ফেলেছে তাকে। 

হাতে ওদের উদ্যত ছোরা, তরোয়াল—রাধুর হাতে পাত টাঙ্গি। ওর এক কোপে ধড় থেকে মুন্ডুটাকে আলাদা করে দেবে তারা। 

কানাই গর্জে ওঠে—এইবার কে বাঁচাবে তোমাকে ঘোষমশায়? 

রাধু বলে—আমাদের সর্বনাশ করে পার পাবে? তোমার খেল খতমই করব আজ–

টাঙি তুলেছে সে। ওরা খেয়াল করেনি যে অন্ধকারের মাঝে অনিরুদ্ধ আর নবীন ডাক্তার কখন এসে পড়েছে। নবীন দেখেছে ওরা টাঙি তুলে শেষই করবে নরহরিকে। 

অনি এসে রাধুর হাতটা ধরে ফেলে আর নবীন ডাক্তার বলে ওঠে—থাম—থাম তোরা! একি সর্বনাশ করতে গেছলি! খুন—খুনিই হবি শেষ অবধি, ওই লোকটাকে মেরে? থাম—হাতিয়ার নামা! 

ডাক্তারবাবুর ধমকে ওরা থেমে যায়। 

কানাই তবু গর্জায়—আমাদের জীবনটাই বরবাদ করেছে ও, ওকেও তাই— 

—থাম! খুন করলেই তোদের দুঃখ-অভাব কিছুই ঘুচবে না, উলটে জেলে পচে মরবি।

—তাই সই, গর্জায় রাধু! 

নরহরি বলে—ডাক্তার, ওদের বাধা দিও না ডাক্তার। কই রাধু, কানাই শেষ কর আমাকে, বাঁচার এই দুঃসহ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দে। ওরে পাপী, মহাপাপী আমি। অকারণে শুধু লোভের বশে তোদের সর্বনাশ করেছি। ঘর-সংসার তছনছ করেছি। ওরে ওই পাপীকে শেষ কর, মুক্তি দে! মার—মেরে ফেল আমাকে। এই পাপের জীবনটাকে শেষ করে দে! তার আগে শোন—আমি সবার সব কিছুই ফিরিয়ে দিতে বলেছি উকিলকে—তোদের সকলের সব জমি, বাড়ি। পাপের এই প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে চাই। মার—মার আমাকে। 

দেখছে কানাই, রাধু, কেষ্ট ওই নরহরিকে, আজ ওই পাষাণ হৃদয়হীন মানুষটার মধ্যে কি এক আমূল পরিবর্তন এসেছে। ওই পরম স্বার্থপর-লোভী মানুষটা আজ তার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, ওদের কাছ থেকে লুটে নেওয়া জমি-বাড়ি সব আবার ওদের ফিরিয়ে দিতে চায় নরহরি। 

অনিরুদ্ধ বলে—ঠিক ঠিক বলছ খুড়ো? ভুল বকছ না তো? ওইসব জমি-বিষয় ফেরত দেবে ওদের! সত্যি? 

নরহরি বলে—হ্যাঁ অনি, গৌরহরির নামে বলছি ওসবে আর আমার দরকার নাই। ওদের সকলের সব কিছু আমি ফিরিয়ে দিতে চাই। ফিরিয়ে দিয়ে শান্তি পেতে চাই রে। 

আর ওসবে দরকার নাই। দয়া করো গৌরহরি। 

নবীন ডাক্তার বলেন।—গৌরহরির দয়া তুমি পেয়েছ ঘোষ মশায়! তোমাকেই খুঁজছিলাম সেই সুখবরটা দিতে। 

—সুখবর! আমার! নরহরি অবাক হয়। বলে-আমার আবার সুখবর? 

নবীন ডাক্তার বলেন—হ্যাঁ, তোমার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়াতে পরীক্ষা করে দেখলাম, ওটা কিছুই নয়। 

—কেমন আছে সে? নরহরির কন্ঠে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। 

বলেন নবীন ডাক্তার—ভালোই। ওর জন্য ভাবনার কিছুই নাই। ঘোষ মশায়, আপনার স্ত্রী- মা হতে চলেছেন। আপনার শূন্য ঘর এবার নতুন অতিথির কলরবে ভরে উঠবে। আপনার বংশধর আসছে— 

নরহরি শুনছে কথাটা। 

আজ তার সব লোভ-স্বার্থপরতা মন থেকে মুছে গেছে। সামান্য নিয়েই তৃপ্ত হতে চায় সে। আর যেদিন সে নিজেকে নতুন করে গড়ার চেষ্টা শুরু করেছে তার শ্রীকল্যাণের পরিচয় নিয়েই তার ঘরে আসছে তার সন্তান, সারাজীবন কুন্তী যার পথ চেয়েছিল, যার জন্য অপেক্ষা করেছিল ওই হতভাগ্য নরহরি ঘোষ। আজ দৈবী কৃপায় যেন সেই মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। 

নরহরির দু’চোখে নামে আনন্দের অশ্রু। আজ সকলের সঙ্গে সুখ-দুখ ভাগ করে নিয়ে সামান্য নিয়ে সৎভাবে বাঁচার স্বপ্নই দেখে নরহরি। 

আজ তার সব ভুল ভেঙেছে। 

এতদিন মনের অতলে একটা নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার জ্বালা বুকে নিয়ে ঘুরছিল কানাই, কেষ্ট আর রাধুরা। আজ তারাও সেই যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে। আবার তাদের জমিজমাও সব ফিরে পাবে, তারা এই খুনের দায় থেকেও মুক্তি পেয়ে নতুন করে বাঁচবে। ওই অস্থিরচিত্ত তিনটি অতি সাধারণ মানুষের মনে হয় কোনো পরম করুণাময়ই তাদের এতবড় জ্বালাটাকে এইভাবে মুছে ফেলে সেখানে নতুন করে বাঁচার আশা এনে দিয়েছেন। 

এ যেন সব সেই গৌরহরিরই কৃপা। 

নরহরি আজ অন্তর থেকে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে শরণ করে, 

—জয় শচীনন্দন গৌর হরি—এ তোমার অশেষ দয়া, দয়াময় প্ৰভু। 

ওই হিংস্র তিনটি মানুষও আজ জয়ধ্বনি দেয়, সব হিংসা-ভুলে 

—জয় শচীনন্দন গৌরহরি। 

নবীন ডাক্তার দেখে আজ নরহরির চোখে-জল, সে ওই তিনটি পরম শত্রুকে আজ পরম মিত্রজ্ঞানে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। ওদের চোখে-জল। 

নরহরি বলে—আমাকে ক্ষমা কর তোরা। 

ওরাও বলে—আমরাও দোষী, পাপী ঘোষমশায় গো! মহাপাপী গ’। 

ওদের চোখের জলে সব পাপ যেন ধুয়ে যায়। গঙ্গার প্রবহমান জলধারার বুকে তারার আলোর শিহরন জাগে, বাতাসে ওঠে নদীর কলতান। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *