দ্বিতীয় পর্ব : হাইল্যান্ড

দ্বিতীয় পর্ব : হাইল্যান্ড

অধ্যায় এক

১১ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার

আরও জোরালো হয়েছে বৃষ্টির বেগ। উইপার চালু করে দিয়েছে আসাকাওয়া। ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয় হ্যাকনের আবহাওয়া। ওয়াওয়ারা পর্যন্ত পরিষ্কার ছিল আকাশ, এরপর যতই ওপরে উঠেছে ততই বেড়েছে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাসও ছিল কয়েক জায়গায়। দিনের বেলা হলে মেঘ দেখেই মাউন্ট হ্যাকনের ওখানকার আবহাওয়ার ব্যাপারে ধারণা করতে পারত ও। কিন্তু এখন রাত। হেডলাইটে যা দেখা যাচ্ছে ওটুকুই ভরসা। গাড়ি থামিয়ে আকাশের দিকে না তাকানো পর্যন্ত আসাকাওয়া বুঝল না, মেঘের আড়ালে ঢেকে গেছে আকাশের তারাগুলো। টোকিও স্টেশন থেকে কোদামা বুলেট ট্রেনে ওঠার সময়ও শহর মোড়ানো ছিল গোধূলির আস্তরণে। আতামি থেকে যখন গাড়ি ভাড়া করল আসাকাওয়া, সেইসময়ও মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ। কিন্তু এখন পুরোদমে আকাশ থেকে পানির ফোঁটা এসে পড়ছে হেডলাইট বিম আর উইন্ডশিল্ডে।

স্পিডমিটারের ওপর ডিজিটাল ক্লক সময় বলছে ৭ : ৩২। এতদূর আসতে কতক্ষণ সময় লেগেছে, দ্রুত হিসেব করে নিল আসাকাওয়া। ৫ : ১৬ মিনিটে টোকিও থেকে রওয়ানা দিয়েছে ও। আতামি পৌঁছেছে ৬ : ০৭ এ। এরপর গেট থেকে রেন্ট-এ কারের ওখানে গিয়ে গাড়ি ভাড়ার জন্য পেপারওয়ার্ক শেষ করতে ৬ : ৩০ বেজেছে। মার্কেটে থেমে দুটো কাপ নুডলস আর একটা ছোট বোতল হুইস্কি কিনেছে ও। শহরের বাইরের রাস্তায় এসে পৌঁছাতে বেজে গিয়েছে সাতটা।

সামনে পড়ল একটা টানেল। টানেলের প্রবেশপথে জ্বলছে কমলা লাইট। প্রবেশ করার পর দেখল অপর প্রান্তে আতামি-কানামি হাইওয়ে। সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ডের সাইন দেখতে পেল ও। দীর্ঘ টানেল শেষে তানা রিজ-এ এসে পৌঁছাল আসাকাওয়া। বাতাসের শব্দ বদলে গেছে এখানে। একইসাথে ওর দেহ, প্যাসেঞ্জার সিট আর গাড়ির ভেতরের বাকি সবকিছু স্নান করল কমলা আলোয়। আসাকাওয়া অনুভব করল কেটে যাচ্ছে ওর শান্তভাবে, পরিবর্তে জেগে উঠছে শিহরণ। কোনো গাড়ি আসতে দেখা গেল না বিপরীত দিক থেকে। প্রায় শুকনো উইন্ডশিল্ডে খড়খর শব্দ সৃষ্টি করল উইপার। উইপার বন্ধ করে দিল ও। আটটার মধ্যে পৌছানো উচিত গন্তব্যে। রাস্তা ফাঁকা থাকা শর্তেও গতি বাড়ানোর কথা ভাবল না ও। অবচেতন মনেই নিজের গন্তব্যস্থলের ওপর একটা ভয় সৃষ্টি হয়েছে আসাকাওয়ার মনে।

বিকেল ৪: ২০ এ অফিসেই ফ্যাক্স পায় আসাকাওয়া। ফ্যাক্সটা এসেছে আতামি ব্যুরো থেকে। আসাকাওয়া আশা করছিল এটা ভিলা লগ কেবিনের ২৭ থেকে ৩০ আগস্টের মধ্যেকার গেস্ট রেজিস্টারের কপি I হাতে পাওয়ার পর মনে মনে নেচে উঠেছিল সে। ধারণা ঠিকই ছিল ওর। লিস্টের চারটা নাম ওর পরিচিত : নোনোইয়ামা, তোমাকো ওশি, হারুকো সুজি, তাকেহিও নোমি। এই চারজন রাত কাটায় সেখানকার বি-৪ কেবিনে। সুইশি আইওয়াতা ব্যবহার করেছে নোনোইয়ামার নাম। এখান থেকেই আসাকাওয়া বুঝে গেছে কোথায় একত্রিত হয়েছিল ঐ চারজন : ২৯ আগস্ট, সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ড, ভিলা লগ কেবিন, রুম নম্বর বি- ৪। ঠিক ওদের মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে।

ঠিক তখনই আসাকাওয়া ফোন উঠিয়ে ভিলা লগ কেবিনের বি-৪ রুমটা রিজার্ভ করে আজকের রাতের জন্য। আগামীকাল সকাল এগারোটায় স্টাফ মিটিং রয়েছে ওর। আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে আরামে মিটিংয়ে জয়েন করা যাবে আগামীকাল।

যাইহোক, অবশেষে সঠিক জায়গায় যাচ্ছি আমি, ভাবল আসাকাওয়া।

ব্যাকুল হয়ে আছে ও। দুঃস্বপ্নেও ধারণা নেই কি হতে চলেছে ওখানে। টানেল থেকে বেরিয়েই একটা টোলবুথের মুখোমুখি হলো আসাকাওয়া। একশো ইয়েন ধরিয়ে দিয়ে এটেন্ডেন্টকে জিজ্ঞেস করল, “সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ড কি সামনেই?”

ভালোমতোই নিশ্চিত ও এই ব্যাপারে। ম্যাপ দেখে নিয়েছে বেশ কয়েকবার। আসাকাওয়ার মনে হলো, বহুযুগ পর দেখা পেয়েছে কোনো মানুষের। শুধু সেকারণেই আরকি কোনো কথা বলতে চাইল ও।

“সামনে একটা সাইন আছে। সেখানে থেকে বামে যাবেন।”

রিসিপ্ট নিয়ে নিল আসাকাওয়া। রাস্তায় যানবাহন নেই কোনো। মনে হয় না সচরাচর কোনো গাড়ি এসে থামে এখানে। কতক্ষণ ধরে বুথের মধ্যে একা একা বসে থাকে এই লোক? গাড়ি স্টার্ট দিল না আসাকাওয়া। লোকটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়েছে ওর দিকে। জোর করে হেসে গাড়ি নিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে গেল ও।

চারজনের যোগসূত্র ও স্থান বের করার ফলে যে উত্তেজনা ও আনন্দ বোধ করেছিল আসাকাওয়া, সময়ের সাথে স্তিমিত হয়ে গেছে সেটা। বারবার চারজনের চেহারা ভেসে উঠছে ওর চোখে। ভিলা লগ কেবিনে রাত কাটানোর ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় মরেছে চারজন।

এখনই এসবকিছু বাদ দিয়ে পিছু হাঁটার সময়, চারজন হয়তো অজানা কোনো দুনিয়া থেকে আড়চোখে দেখছে ওর দিকে, ভাবল আসাকাওয়া। কিন্তু বাস্তবে, আর ফিরে যাওয়ার পথ খোলা নেই। প্রথমত একজন রিপোর্টার হিসেবে ওর প্রবৃত্তি এখন তুঙ্গে। অপরপক্ষে মানতে বাঁধা নেই, ওখানে একা যেতে ভয় লাগছে ওর। ইয়োশিনোকে ডাকলে হয়তো ছুটে চলে আসত সে, কিন্তু এক্ষেত্রে একজন কলিগকে জড়ানো সঠিক মনে হয়নি ওর। এরইমধ্যে কেসের খুঁটিনাটি যা জানা গেছে সেসব লিখে ফ্লপি ডিস্কে সেভ করে রেখেছে আসাকাওয়া। এমন কাউকে আসাকাওয়ার দরকার, যে বাঁধা সৃষ্টি করবে না ওর পথে। বরং সাহায্য করবে বিনাবাক্যে… এমন না যে, এরকম কারো নাম মাথাতে নেই ওর। পরিচিত একজন রয়েছে আসাকাওয়ার যে শুধুমাত্র কৌতূহল বশত-ই জড়াতে চাইবে এসবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টটাইম লেকচারার সে। ফলে অফুরন্ত সময় আছে তার হাতে। এরকম ধরনের-ই লোক সে। কিন্তু লোকটা বেশ খেয়ালী। লোকটার এরকম ব্যক্তিত্বের সাথে কতক্ষণ খাপ খাওয়ানো যাবে, আসাকাওয়া নিশ্চিত নয়।

মাউন্টসাইডে সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ডের সাইন দেখতে পেল আসাকাওয়া। নিয়ন আলো জ্বলছে না সেখানে। সাদা প্যানেলের ওপর কালো লেটারিং শুধু। হেডলাইট বন্ধ রেখে খুঁজলে জীবনেও চোখে পড়ত না সেটা। হাইওয়ে ছেড়ে মাউন্টেন রোড ধরে ড্রাইভ করতে লাগল আসাকাওয়া। রাস্তাটা ভয়াবহ রকমের সরু। খালি চোখে মনে হচ্ছে রাস্তার শেষমাথায় রয়েছে কোনো কানাগলি। সরু রাস্তার উঁচুনিচু খাদের কারণে খুবই মনোযোগ দিয়ে নিয়ন্ত্রণের সাথে গাড়ি চালাতে হলো ওকে। আশা করল বিপরীত দিক থেকে কোনো গাড়ির মুখোমুখি যেন না হতে হয়। দুটো গাড়ি মুখোমুখি অতিক্রমের মতো জায়গা নেই এই রাস্তায়। একটা জায়গা পার হওয়ার পর নাই হয়ে গেছে বৃষ্টি। যদিও ব্যাপারটা কেবল-ই খেয়াল করল আসাকাওয়া। তানা রিজের পূর্ব-পশ্চিমের থেকে এখানকার আবহাওয়ার ধরনটা আলাদা।

রাস্তার শেষপ্রান্তে কোনো কানাগলি নেই, তবে উঁচুতে উঠেই চলেছে রাস্তাটা। কিছুক্ষণ পর রাস্তার চারিদিকে সামার হোম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখল আসাকাওয়া। হঠাৎ করেই দুই লেনের হয়ে গেছে রাস্তাটা। ভালো হতে শুরু করেছে রাস্তার অবস্থাও। রাস্তার দুইধারে স্ট্রিটলাইট। এই হঠাৎ পরিবর্তনে আনন্দিত হয়ে উঠল আসাকাওয়া। যে মুহূর্তে প্যাসিফিক ল্যান্ডের এলাকায় প্রবেশ করল, তখনই ভিন্ন সাজসজ্জা চোখে পড়ল ওর। তাহলে ঐ উদ্যানের মতো রাস্তায় এখানে এনেছে ওকে? রাস্তার ধারের ভুট্টাগাছ ও জংলা আগাছা রাস্তাটাকে সরু করেছে আরও। তবে এই পথটুকুর শেষে যা অপেক্ষা করছে সেটা ভাবতেই সকল দুশ্চিন্তা উবে গেছে ওর।

একটি ত্রিতল ভবন দেখা যাচ্ছে পার্কিং লটের অপর প্রান্তে। প্রশস্ত পার্কিং লটের সাথে রেসিপশন ও একটি রেস্টুরেন্ট। দ্বিতীয়বার না ভেবেই আসাকাওয়া গাড়ি পার্ক করে হেঁটে গেল হলের দিকে। ঘড়ির দিকে তাকাল ও। ঠিক আটটা বাজে। নিকটে কোথাও থেকে শব্দ আসছে বল বাউন্স করার। সেন্টারের নিচে রয়েছে চারটা টেনিস কোর্ট। হলুদ আলোতে টেনিস খেলছে কয়েকজন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, টেনিস খেলা চলছে চারটা কোর্টেই। অক্টোবরের মাঝামাঝি, বৃহস্পতিবার রাতে কি মনে করে শুধুমাত্র টেনিস খেলতে এতদূর এসেছে এরা, বুঝে উঠতে পারল না আসাকাওয়া।

টেনিস কোর্টের ওখানে থেকে দেখা যাচ্ছে বেশ দূরে অবস্থিত মিশিমা শহরের মৃদু আলো। অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে ঐ আলো। ধূধূ মরুর মতো ফাঁকা অঞ্চলের পরেই ট্যাগো বে।

ইনফরমেশন সেন্টারে প্রবেশ করল আসাকাওয়া। রেস্টুরেন্টটির অবস্থান ঠিক ওর সামনাসামনি। রেস্টুরেন্টের জায়গাটা কাঁচঘেরা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রেস্টুরেন্টের ভেতরটা। আরেকটা চমক অপেক্ষা করছিল আসাকাওয়ার জন্য। বলা আছে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ার কথা আটটায়, কিন্তু ভেতরটা এখনও পরিপূর্ণ। পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে রয়েছে লোকজন। কি চলছে ওখানে? সংশয়ে মাথা নাড়ল আসাকাওয়া। এরা সবাই কোন দিক দিয়ে এসেছে? আসাকাওয়ার বিশ্বাস হলো না এতগুলো লোক ওর মতো একই পথ ধরে এসেছে এখানে। হয়তো ওর ব্যবহৃত পথটা অপ্রচলিত। নিশ্চয়ই ভালো কোনো পথ রয়েছে এই জায়গায় আসার। কিন্তু ফোনে যে মহিলার সাথে কথা হয়েছিল সে তো বলেছিল এই পথের কথায়।

আতামি-কানামি রোডের অর্ধেক গিয়ে বামে মোড় নেবেন। সেখান থেকে ধরবেন পাহাড়ি পথ। বলেছিল মেয়েটা। ঠিক এটাই করেছে আসাকাওয়া। অপর কোনো পথ থাকা খুবই অস্বাভাবিক।

ওকে জানানো হলো রেস্টুরেন্টে অর্ডার নেয়ার সময় শেষ। তবুও নড করে রেস্টুরেন্টে ঢুকল ও। রেস্টুরেন্টের প্রশস্ত জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সামনের লন আর অদূরের শহর। উজ্জ্বলতা কমিয়ে রাখা হয়েছে রেস্টুরেন্টের ভেতরের। যেন স্বল্প আলোতেই পরিবেশটা উপভোগ করতে পারে কাস্টমাররা। একজন ওয়েটারকে থামিয়ে আসাকাওয়া জিজ্ঞেস করল ভিলা লগ কেবিনের ব্যাপারে। যে হল ধরে আসাকাওয়া এসেছে সেটাই দেখিয়ে দিল ওয়েটার।

“ঐ হল ধরে দুশো মিটারের মতো যাবেন, অফিস চোখে পড়বে।”

“পার্কিং লট আছে কোনো?”

“অফিসের সামনেই পার্ক করতে পারবেন আপনি।”

এই রাস্তাটুকুই। এখানে না থেমে এগিয়ে যেতে থাকলে নিজেই খুঁজে পেত অফিসটা। আসাকাওয়া কম বেশি বুঝতে পারছে কেন রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগে এই আধুনিক ভবনে ঢুকেছে ও। একটু হলেও স্বস্তিবোধ করল আসাকাওয়া। আসাকাওয়া ভেবেছিল ভিলা লগ কেবিন কোনো প্রত্যন্ত এলাকায়, অন্ধকার, স্যাতস্যাতে, প্রাচীন কোনো বিল্ডিং। ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ এর কোনো দৃশ্যের মতো। তবে বাস্তবে আদতেই তেমনটা নয়। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া বেশ ভালোমতোই আছে এখানে। সামান্য হলেও নিশ্চয়তা ও ভরসা বোধ করল আসাকাওয়া। যে একটা জিনিস ওকে খোঁচাচ্ছে সেটা হলো এখানে আসার খারাপ রাস্তাটা। আর রাস্তাটা খারাপ থাকা সত্ত্বেও এতগুলো মানুষের এখানে ডিনার ও টেনিস খেলতে আসা। আসাকাওয়া নিশ্চিত নয়, কেন এই ব্যাপারটা এত খোঁচাচ্ছে ওকে। মনে হচ্ছে এখানকার কেউ ঠিক স্বাভাবিক নয়।

রেস্টুরেন্ট আর টেনিস কোর্ট লোক দিয়ে ভর্তি, ভিলা লগ কেবিন থেকেও শোনা যাচ্ছে হৈহুল্লোড়ের আওয়াজ। ঠিক এমনটাই আশা করছিল ও। তবে পার্কিং লট থেকে দশটার মধ্যে কেবল ছয়টা কেবিন-ই চোখে পড়ছে ওর। পাহাড়ি ঢালের ওপর, গাছপালার আড়ালে নির্মিত সেগুলো। সবকিছু যেন ছেয়ে রয়েছে বনের গভীর অন্ধকার আর স্ট্রিটলাইটের ম্লান আলোয়। কেবিনের ভেতরকার আলোও কমাতে পারেনি অন্ধকার। বি-৪ কেবিন, যেখানে আসাকাওয়া আজকের রাত কাটাবে, সেটার অবস্থান অন্ধকার ও ম্লান স্ট্রিটলাইটের বর্ডারে। এখান থেকে শুধু দরজার ওপরের অংশ দেখতে পাচ্ছে ও।

অফিসে গিয়ে, দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল আসাকাওয়া। টেলিভিশনের আওয়াজ শুনল ও। তবে কারো কোনো চিহ্ন দেখল না। পেছনের বামদিকে একটি জাপানি স্টাইল রুমে বসে রয়েছে ম্যানেজার। আসাকাওয়াকে লক্ষ করেনি সে। দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হয়েছে কাউন্টারের কারণে, ফলে ঐ রুমের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে না আসাকাওয়া। মনে হলো ভিডিওতে আমেরিকান মুভি দেখছে ম্যানেজার, টিভির কোনো প্রোগ্রাম নয়। ইংলিশ ডায়লগ শুনতে পাচ্ছে আসাকাওয়া। সেইসাথে ক্যাবিনেটের কাঁচের ওপরে টিভি স্ক্রিনের প্রতিফলন পড়ায় দেখতেও পাচ্ছে ও। ক্যাবিনেটে সারি করে সাজানো ভিডিওটেপ। কাউন্টারে হাত রেখে কথা বলে উঠল আসাকাওয়া। তৎক্ষণাৎ প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়সের একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বো করে বলল, “ওহ, স্বাগতম।” আতামি ব্যুরো আর আইনজীবীদের হাসিমুখে গেস্ট রেজিস্টার বের করে দেখিয়েছে এই লোকটাই নিশ্চয়ই, ভাবল আসাকাওয়া। তার দিকে তাকিয়ে আন্তরিকতার হাসি হাসল ও।

“আমার একটা রিজার্ভেশন রয়েছে, আসাকাওয়া নামে।”

নোটবুক খুলে রিজার্ভেশন কনফার্ম করল লোকটা। “আপনি বি-৪ এর। আপনার নাম ঠিকানা দয়া করে এখানে লিখবেন?”

নিজের নামটাই লিখল আসাকাওয়া। নোনোইয়ামার কার্ড ফেরত দিয়ে দিয়েছে ও। ফলে ব্যবহার করতে পারেনি সেটা।

“শুধু আপনি একাই?” আসাকাওয়ার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল ম্যানেজার। এখানে হয়তো একা থাকতে কেউ আসে না। কারণ নন মেম্বার রেটে একজনের জন্য এখানে থাকার চেয়ে হোটেল বেশি সস্তা। আসাকাওয়ার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে ক্যাবিনেটের দিকে ঘুরল ম্যানেজার।

“আপনি চাইলে এখানে থেকে একটা ভাড়া নিতে পারেন। আমাদের কালেকশনে জনপ্রিয় সব সিনেমা আছে।”

“ওহ, আপনারা ভিডিও ভাড়া দেন?” আসাকাওয়ার নজর পড়ল দেয়ালজুড়ে থাকা ভিডিওটেপগুলোর টাইটেলে। রেইডার টু দ্য লস্ট আর্কস, স্টার ওয়ার্স, ব্যাক টু দ্য ফিউচার, ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ। সবগুলো জনপ্রিয় আমেরিকান মুভি। বেশিরভাগই সায়েন্স ফিকশন। কয়েকটা সদ্য মুক্তি পাওয়া। সম্ভবত কেবিনে যারা আসে ওরা বেশিরভাগই তরুণ। এখানে থেকে নেয়ার মতো কিছু নেই আসাকাওয়ার। তাছাড়া এখানে একটা কাজের লক্ষ্যে এসেছে ও।

“আমার কাজ আছে অনেক।” নিজের ওয়ার্ড প্রসেসর বের করে মেঝেতে নামিয়ে ম্যানেজারকে দেখাল ও। মনে হলো সেটা দেখে ম্যানেজার বুঝতে পারছে কেন এখানে রাতটা একা কাটাতে চায় আসাকাওয়া।

“তাহলে এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে?” এমনিই নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল আসাকাওয়া।

“হ্যাঁ, ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারবেন আপনি।”

শুধুমাত্র একটা জিনিসই ব্যবহার করা লাগবে আসাকাওয়ার। সেটা হলো কেটলি। পানি গরম করতে, কাপ নুডলসের জন্য। কাগজ আর ঘরের চাবি নিয়ে নিল ম্যানেজারের কাছে থেকে। ম্যানেজার ওকে জানাল কীভাবে বি-৪ রুম খুঁজে পাওয়া যাবে। ভদ্রতার খাতিরে বলল সে, “নিজের বাড়ির মতো মনে করে থাকবেন।”

নবে হাত দেয়ার আগে রবার গ্লোভস পরে নিল আসাকাওয়া। মানসিক স্বস্তির জন্য এটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে ও। অজানা ভাইরাস থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যেও বলা চলে।

দরজা খুলে এন্ট্রি হলের লাইট সুইচ টিপল ও। প্রশস্ত লিভিংরুমে জ্বলে উঠল একশো ওয়াট বাতি। কাগজ দিয়ে মোড়ানো দেয়াল, চারজনের বসার মতো সোফা, টেলিভিশন, ডাইনিং, কার্পেট সবই আছে এখানে। জুতো খুলে প্রবেশ করল আসাকাওয়া। লিভিংরুমের কোনায় রয়েছে একটি ব্যালকনি। নিচতলা ও দোতলায় রয়েছে ছোট জাপানি স্টাইলের রুম। একজন গেস্টের জন্য জায়গাটা মোটামোটি বিলাসবহুল বলা যায়। জানালার পর্দা সরিয়ে গ্লাস ডোর খুলে দিল ও। যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে রাতের বাতাস। ঘরটা নিখুঁতভাবে পরিষ্কার। যেমনটা আশা করেছিল ও, ঠিক সেটার বিপরীত। হঠাৎ করেই মনে হলো, কোনো ক্লু না পেয়ে শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরতে হতে পারে ওর।

জাপানি স্টাইল রুমে গিয়ে ক্লোজেট চেক করল আসাকাওয়া। কিছুই নেই। শার্ট আর স্ল্যাক্স বদলে সোয়েটশার্ট ও সোয়েটপ্যান্ট পরে নিল ও। ক্লোজেট ছেড়ে রাখা কাপড় ঝুলিয়ে রাখল ও। এরপর উপরতলায় গিয়ে জাপানি স্টাইল রুমের লাইট জ্বলল আসাকাওয়া। বাচ্চাদের মতো আচরণ করছি আমি, বিরক্ত হয়ে ভাবল ও। তবে সেটা বুঝে ওঠার আগেই জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘরের প্রত্যেকটা লাইট।

ঘর যথেষ্ট আলোকময়, এই অবস্থাতে খুলল বাথরুমের দরজা। ভেতরটা দেখে নিল আগে, এরপর ভেতরে ঢুকে দরজা আলতো করে সামান্য ভিড়িয়ে দিল ও। ছোটবেলার ভয়ের কথা মনে পড়ে গেল আসাকাওয়ার। সেসময়ে রাতের বেলা টয়লেটে গেলে ভয়ে এভাবেই দরজা অল্পখোলা রাখত ও। আর অর্ধখোলা দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখত বাবাকে। এই বাথরুমের ভেতরে রয়েছে একটি কাঁচঘেরা শাওয়ার রুম। স্টিম দেখা গেল না কোথাও। বাথটাব আর এটার আশেপাশের জায়গা একেবারে শুকনো। নিশ্চয়ই বহুদিন ধরে কেউ থাকেনি এখানে। রবার গ্লোভস খুলে ফেলতে লাগল আসাকাওয়া। ঘেমে যাওয়া হাতের সাথে চেপে বসেছে সেটা। বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছে ঘরের ভেতরে। আলোড়ন উঠেছে জানালার পর্দায়।

ফ্রিজার থেকে আইস বের করে গ্লাসে রাখল আসাকাওয়া। সঙ্গে আনা হুইস্কি গ্লাসে ঢালল এরপর। ট্যাপের পানি দিয়ে গ্লাসটা পূর্ণ করতে লেগেছিল ও। কিন্তু ইতস্তত বোধ করল। ট্যাপ বন্ধ করে, সরাসরি হুইস্কি পানের সিদ্ধান্ত নিল আসাকাওয়া। এই ঘরের কিছুই মুখে দেয়া যাবে না। যদিও এরইমধ্যে আইস ব্যবহার করে ফেলেছে ও। কিন্তু কোনো ক্ষুদ্র জীবাণু অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম সহ্য করতে পারে না, ভাবল আসাকাওয়া।

সোফায় বসে ছেড়ে দিল টিভি। গান চলছে টিভিতে। সঙ্গীতের মূর্ছনায় ছেয়ে গেল ঘর। নতুন কোনো পপ আইডলের গান। টোকিও স্টেশনেও এখন দেখানো হচ্ছে একই প্রোগ্রাম। চ্যানেল বদল করল ও। যদিও নির্দিষ্ট কিছু দেখার ইচ্ছে নেই, তবুও ভলিউম কমিয়ে নিজের ব্যাগ খুলল আসাকাওয়া। একটি ভিডিও ক্যামেরা বের করে রাখল টেবিলের ওপর। অদ্ভুত কিছু ঘটলে সেটা ভিডিও টেপে বন্দি করতে চায় ও। মুখভর্তি করে চুমুক দিল হুইস্কিতে। সামান্য হলে সাহস ও উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করল অতটুকু হুইস্কি। যা যা এই পর্যন্ত জানা আছে, সবকিছু ভাবতে লাগল ও। যদি এখান থেকে আজ রাতে কোনো ক্লু না পাওয়া যায়, তবে ওর লিখতে চাওয়া আর্টিকেলের পরিকল্পনা নিশ্চিতভাবেই জলে যাবে। অন্যভাবে ভাবলে হয়তো সেটাই ওর জন্য ভালো। কোনো ক্লু না পাওয়া মানে হলো, ভাইরাসের ব্যাপারে খোঁজ না পাওয়া। যতই হোক, ঘরে রয়েছে ওর বউ বাচ্চা। ওদের নিয়েও ভাবতে হবে আসাকাওয়াকে। এখনই মরতে চায় না ও, অন্তত অদ্ভুত উপায়ে নয়। টেবিলের ওপর পা তুলল আসাকাওয়া।

তাহলে কিসের জন্য অপেক্ষা করছ, নিজেকেই জিজ্ঞেস করল ও। ভয় পাচ্ছ না? তোমার কি ভয় পাওয়া উচিত নয়? মৃত্যুদূত হয়তো এখন তোমাকে নিতে আসবে। আনমনেই এসব কথা খেলে গেল ওর মাথায়।

নার্ভাস ভঙ্গিতে রুমের চারপাশে তাকাল আসাকাওয়া। দেয়ালের কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় দৃষ্টি স্থির রাখতে পারল না ও। ওর মনে হলো, কোথাও নিজের দৃষ্টি স্থির করলে ভয়টা বাস্তবিক আকার ধারণ করবে।

কাঁপন ধরানো বাতাস বয়ে গেল বাইরে। পূর্বের চেয়েও শক্তিশালী। জানালা বন্ধ করে দিল আসাকাওয়া। পর্দা টানার সময় তাকাল বাইরের নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে। একেবারে সামনেই বি-৫ এর ছাদ। ওখানে অন্ধকার যেন আরও গভীর। অনেক মানুষ রয়েছে টেনিস কোর্ট ও রেস্টুরেন্টে। কিন্তু এখানে আসাকাওয়া একা। পর্দা টেনে ঘড়ির দিকে তাকাল ও। ৮ : ৫৬ বাজে। আধা ঘণ্টাও হয়নি এই রুমে আসার। কিন্তু মনে হচ্ছে পেরিয়ে গেছে কয়েক ঘণ্টা। আবার এখানে অবস্থান করাটাও মনে হচ্ছে না ক্ষতিকর। এই কথাটা বিশ্বাস করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল ও। এই কেবিন বানানোর পর গত ছয়মাসে কত মানুষই তো এখানে থেকেছে। এমন না যে এদের সবাই মারা গেছে রহস্যজনক ভাবে। শুধু ঐ চারজনই, আসাকাওয়ার রিসার্চ অনুযায়ী। হয়তো আরও গভীরে গেলে আরও কিছু জানা যেত। কিন্তু আপাতত যা জানে ওটুকুই যথেষ্ট। স্বাভাবিক ভাবে ভাবলে এখানে অবস্থান করাটা কোনো সমস্যার কিছু নয়। ওরা এখানে কি করেছিল, সেটাই আসল সমস্যা।

তো, কি এমন করেছিল ওরা এখানে?

প্রশ্নটা বারবার ভাবতে থাকল আসাকাওয়া।

আসলেই, করেছিল টা কি ওরা?

কোথাও কোনো ক্লু পেল না আসাকাওয়া। বাথরুমে, বাথটাবে, ক্লোজেটে, ফ্রিজে, কোথাও নয়। যদি ধরে নেয়াও হয় কিছু ছিল ওসব জায়গায়, তবে ম্যানেজার পরিষ্কার করার সময় সরিয়ে ফেলেছে ওটা। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বসে বসে হুইস্কি খাওয়া বাদ দিয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বলা উচিত। অতিদ্রুত।

প্রথম গ্লাস শেষ করে, দ্বিতীয়বার অল্প একটু ঢালল ও। মাতাল হওয়া চলবে না। অনেকগুলো আইস নিল সেইসাথে গ্লাস পূর্ণ করল ট্যাপের পানিতে। বিপদের ভয় খানিকটা কমেছে আসাকাওয়ার। হঠাৎ করেই নিজেকে বোকা মনে হতে লাগল ওর। অফিসের কাজ থেকে সময় বাঁচিয়ে চলে এসেছে এতদূর। গ্লাস উঠিয়ে, মুখটা ধুয়ে নিল একটু। এরপর তাকাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। আয়নায় দেখা যাচ্ছে একজন অসুস্থ মানুষকে। হয়তো এতক্ষণে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে ও। পানিসহ হুইস্কি গিলে শুরু করল আরেক গ্লাস বানাতে।

ডাইনিং রুম থেকে ফিরে টেলিফোন স্ট্যান্ডের নিচের শেলফে একটা নোটবুক দেখতে পেল আসাকাওয়া। কভারে লেখা ‘স্মৃতিচারণ’। কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টালো ও।

শনিবার, এপ্রিল ৭
এই দিনটা কখনো ভুলবে না নোনকো, কেন? এটা..
গো-প-ন। ইউচি দারুণ একজন মানুষ। হি-হি!
– নোনকো

বিভিন্ন হোটেলে দেখতে পাওয়া যায় ধরনের নোটবুক। যেন এখানে আসা গেস্টরা লিখে যেতে পারে তাদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা। পরের পাতায় কাঁচা হাতে মা-বাবার ছবি আঁকা। কোনো ফ্যামিলি ট্রিপ সম্ভবত। তারিখ দেয়া ১৪ এপ্রিল, শনিবার।

বাবা মোটা
মা মোটা
তাই আমিও মোটা।

এপ্রিল ১৪

পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকল আসাকাওয়া। অজানা কোনো শক্তি যেন পৃষ্ঠা উল্টে একবারে শেষে যেতে বাধ্য করছে ওকে। ক্রমানুসারে উল্টে গেল আসাকাওয়া। ওর মনে হচ্ছিল ক্রমানুসারে না গেলে কিছু একটা চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।

অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না ও। কেননা অনেক অতিথি সম্ভবত কিছুই লেখেনি এখানে। কিন্তু ওর মনে হলো গ্রীষ্মকাল শুরুর আগে এখানে শুধু শনিবারই আসত লোকজন। এরপর প্রত্যেকটা এন্ট্রির সময়কাল গায়েব। আবার আগস্টের শেষের দিকে এসে কমে গেছে এন্ট্রির পরিমাণ। গ্রীষ্মকালের শেষাংশ হওয়ার কারণে।

রবিবার আগস্ট ২০

আরেকটা সামার ভ্যাকেশন কেটে গেল চোখের পলকেই। বালমার্কা কাটল পুরোটাই। কেউ আমাকে সাহায্য করো। বাঁচাও বালের জীবন থেকে

আমার ৪০০ সিসির একটা বাইক আছে। আমি দেখতেও মোটামোটি সুদর্শন।

চলবে!

এ. ওয়াই।

মনে হচ্ছে এই ছেলেটা নোটবুককে নিজের বিজ্ঞাপনপত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। অথবা চেয়েছে নিজের মতো কাউকে খুঁজতে। দেখে মনে হলো জায়গাটার ব্যাপারে অনেক মানুষের ধারণা এক। কোনো যুগল এখানে থাকলে, সেটা বোঝা যাচ্ছে এন্ট্রি দেখেই। আর নিঃসঙ্গদের রয়েছে কোনো সঙ্গী পাওয়ার আকুতি।

তারপরও এই ডায়েরি পড়াটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ঘড়িতে নটা বাজছে এখন। পাতা উল্টালো আসাকাওয়া :

বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট

উফ! নিজ থেকে সাবধান হোন! সাহসী না হলে জিনিসটা না দেখাই ভালো।

আর দেখলে পস্তাবেন (শয়তানী হাসি)

এস. আই

এটুকুই লেখা সেখানে। আগস্ট ৩০ হল, চারজন যেদিন এখানে রাত কাটিয়েছে তার পরেরদিন সকাল। আদ্যক্ষর এস. আই মানে হয়তো সুইশি আইওয়াতা। তার এন্ট্রি বাকিদের থেকে ভিন্ন। কি বোঝাতে চেয়েছে সে? জিনিসটা না দেখাই ভালো। এই ‘জিনিসটা আসলে কী? গেস্টবুক বন্ধ করে এক সাইড থেকে ওটার দিকে তাকাল আসাকাওয়া। এক জায়গায় সামান্য ফাঁক। সেখানে ঠিকমত বন্ধ হয়নি ডায়রিটা। আঙুল ঢুকিয়ে ঠিক ঐ পৃষ্ঠাটা বের করল আসাকাওয়া।

উফ! নিজ থেকে সাবধান হোন! সাহসী না হলে জিনিসটা না দেখাই ভালো।

আর দেখলে পস্তাবেন (শয়তানী হাসি) এস.আই, এগুলোই লেখা ঐ ভাঁজ দেয়া পৃষ্ঠাতে। কেন ডায়রিটা এই নির্দিষ্ট পৃষ্ঠাতেই খুলতে চাইবে? এক মুহূর্ত ভাবল আসাকাওয়া। সম্ভবত নোটবুকটি খুলে ঐ পৃষ্ঠাতে ভারী কিছু দ্বারা চাপা দিয়ে রেখেছিল ঐ চারজন। নোটবুকের ভেতরে ঐ ভারের ফলে সৃষ্ট ফাঁকা স্থানটা রয়ে গেছে এখনো, ফলে ঠিক এই পৃষ্ঠাতেই খুলতে চায় নোটবুকটা। হয়তো নোটবুকের ওপর রাখা ভারী কিছু হল সেই ‘জিনিসটাই যেটা না দেখাই ভালো। এমনটাই হওয়ার কথা।

ঘরের চারিদিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাল আসাকাওয়া। প্রত্যেকটা কোনায়, টেলিফোন স্ট্যান্ডের নিচে ভালোমত দেখল ও। কিচ্ছুই নেই। এমনকি একটা পেন্সিলও না।

সোফায় বসে আবারও পড়তে আরম্ভ করল আসাকাওয়া। পরবর্তী এন্ট্রি পহেলা সেপ্টেম্বর শনিবার। সাধারণ কথাবার্তায় লেখা। ঐ চারজন ছাত্রছাত্রী যে জিনিসটা দেখেছে সেটার কথা লেখা নেই সেখানে। পুরো নোটবুকের কোথাও-ই উল্লেখ নেই আর।

গেস্টবুক বন্ধ করে সিগারেট ধরাল আসাকাওয়া। সাহস না থাকলে জিনিসটা না দেখাই ভালো। এই ‘জিনিসটা নির্ঘাত ভয়ঙ্কর কিছু, মনে হলো আসাকাওয়ার। নোটবুকের পৃষ্ঠাটা খুলে সেখানে হাত দিয়ে চাপ দিতে লাগল ও। যেটা দিয়ে চাপা দেয়া হোক না কেন, জিনিসটা নষ্ট করে দিয়েছে নোটবুকের স্বাভাবিকভাবে বন্ধ থাকার অবস্থা। দুই একটা ভৌতিক ছবির এমনটা করার ক্ষমতা নেই। হয়তো কোনো উইকলি অথবা হার্ডকভার বই… যাইহোক, খুঁজে দেখতে হবে। ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, ত্রিশ আগস্ট গেস্টরা চলে যাওয়ার পর কেবিনে সে অদ্ভুত কোনো বস্তু পেয়েছিল কিনা। ম্যানেজারের মনে থাকবে কিনা নিশ্চিত নয় আসাকাওয়া। তবে অদ্ভুত কিছু দেখলে নিশ্চয়ই মনে রাখার কথা তার। পা বাড়াল আসাকাওয়া, ঠিক তখনই ওর চোখে পড়ল ভিসিআর। টিভি এখনো চালু। একজন বিখ্যাত নায়িকাকে ভ্যাকিউম নিয়ে তার স্বামীকে তাড়া করে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে টিভিতে। হোম এপ্লায়েন্সের বিজ্ঞাপন।

হ্যাঁ, ভিএইচএস টেপ নোটবুক খোলা রাখার মতো ভারী। সেইসাথে ওদের সাথে সম্ভবত ছিল একটা হ্যান্ডি ক্যামও।

কাউচে বসেই সিগারেট নিচে ফেলে দিল আসাকাওয়া। ম্যানেজারের অফিসে দেখা ভিডিও কালেকশনের কথা মনে করল ও। হয়তো ওরা কোনো নির্দিষ্ট হরর মুভি দেখেছিল, আর নোটবুকে লিখে সেটা রিকমেন্ড করে গেছে অন্য গেস্টদের- হেই, এটা দারুণ, দেখতে পারো। যদি এমনটাই হয় তবে…কিন্তু। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তবে সুইশি আইওয়াতা নিজের নাম ব্যবহার করল না কেন। যদি ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ দারুণ কোনো মুভি হয়ে থাকে তবে ‘ফ্রাইডে দ্য থার্টিনথ দারুণ মুভি’ এমনটা বলাই কি সহজ নয়? নোটবুকের ওপরে ভারী কিছু রেখে এত কথা লেখার তো দরকার ছিল না। তাহলে ঐ ‘জিনিসটা হলো এমন কিছু যেটার নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই। যেটা ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘জিনিস’ বলে। আচ্ছা? চেক করে দেখার মতোই কিছু?

যাইহোক, হারানোর মতো কিছু নেই আসাকাওয়ার। কোনো ব্লুও ধরা দিচ্ছে না নিজে থেকে। তাছাড়া এখানে বসে এত ভাবনা চিন্তা করে লাভের লাভ কিছুই হবে না। কেবিন থেকে বেরিয়ে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে অফিসে প্রবেশ করল আসাকাওয়া।

পূর্বের মতোই ম্যানেজারের কোনো চিহ্ন নেই সেখানে, ব্যাকরুম থেকে ভেসে আসছে শুধু টেলিভিশনের আওয়াজ। লোকটা সম্ভবত শহরের কোনো চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করে প্রকৃতি মাতার নিকট সপে দিয়েছে নিজেকে এজন্যেই চাকরি নিয়েছে রিসোর্টের ম্যানেজার হিসেবে। কিন্তু এই কাজটাও হয়তো তার জন্য বোরিং। এখন প্রতিদিন বসে থেকে ভিডিও দেখে সে। এরইমধ্যে আসাকাওয়া এসে বিঘ্ন ঘটিয়েছে ম্যানেজারের পরিস্থিতে। লোকটাকে ডাকার আগেই দরজা থেকে মাথা বের করে উঁকি দিল সে। ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে কথা বলতে আরম্ভ করল আসাকাওয়া।

“ভাবলাম একটা ভিডিও ভাড়া করা উচিত আমার।”

সন্তুষ্টির ছাপ দেখা গেল ম্যানেজারের চেহারায়।

“বেছে নিন, আপনার ইচ্ছামত। একেকটা তিনশো ইয়েন।”

ভয়ানক হরর মুভির খোঁজে টাইটেলগুলো দেখতে থাকল আসাকাওয়া। লিজেন্ড অব হেল হাউজ, দ্য একসরসিস্ট, ওমেন। ছাত্রজীবনে সবগুলোই দেখে ফেলেছে ও। বাকি রয়েছে কিছু? এমন কিছু রয়েছে যা এখনও দেখেনি ও। শেলফের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত চেক করে দেখল আসাকাওয়া। পাওয়া গেল না ওরকম ধরনের কিছুই। পড়তে থাকল শুরু থেকে প্রায় দুশো ভিডিওর টাইটেল। আর তারপর, শেলফের একদম নিচের তাকের কর্ণারে একটি কেইস বিহীন ভিডিও ক্যাসেট দেখতে পেল ও। পড়ে রয়েছে একদিকে। এখানকার প্রত্যেকটা টেপের জ্যাকেটে লাগানো ছবি, লোগো। কিন্তু একটা লেবেলও লাগানো নেই এটাতে।

“ওখানে ঐটা কি?” প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার পর বুঝল আসাকাওয়া টেপটা দেখাতে সর্বনাম ‘ঐটা’ ব্যবহার করে ফেলেছে ও। যদি কোনো নাম-ই না থাকে তবে কি নামেই বা ডাকবে?

বিরক্তির সাথে ভ্রূকুচকে অনিচ্ছার সাথে বলল ম্যানেজার, “হুহ?” এরপর টেপটা উঠিয়ে নিল সে, “এইটা? এইটা কিছুই না।”

….আমি ভাবছিলাম লোকটা হয়তো জানে কি রয়েছে টেপে, ভাবল আসাকাওয়া

“আপনি চালিয়ে দেখেছেন, ঐটা?” জিজ্ঞেস করল ও।

“দেখে বলছি দাঁড়ান,” দেখার জন্য মাথা নিচু করল ম্যানেজার। এই জিনিসটা কি করছে এখানে, তার ভাব দেখে মনে হলো এটাই ভাবছে সে।

“কিছু মনে না করলে, আমি এটা ভাড়া নিতে পারি?”

জবাব দেয়ার আগে নিজের কনুইয়ে থাবা দিল ম্যানেজার। “আহ, এখন মনে পড়েছে আমার। একটা ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল এটা। আমাদের বুঝতে পেরে এখানে এনে রেখেছি আমি। কিন্তু…”

“আমার মনে হয়, এটা বি-৪ এর ঘটনা না, তাই না?” জানার উদ্দেশ্যে নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল আসাকাওয়া। হেসে মাথা নাড়ল ম্যানেজার।

“আমার ঠিক স্পষ্ট মনে নেই। তবে কয়েক মাস আগের ঘটনা এটা।”

“আপনি কি, এই ভিডিওটা… দেখেছেন?” আবারও জিজ্ঞেস করল আসাকাওয়া।

মাথা নাড়ল ম্যানেজার, হাসি উধাও হয়ে গেছে মুখ থেকে। “না।”

“যাইহোক, আমাকে ভাড়া দেন এইটা।”

“আপনি কি টিভি থেকে রেকর্ড করবেন কিছু?”

“হ্যাঁ, আচ্ছা, আমি, আহ…”

ভিডিওর দিকে নজর দিল ম্যানেজার। “ট্যাবটা ভাঙা, দেখছেন? এতে রেকর্ড করতে পারবেন না।”

বিরক্ত লাগল আসাকাওয়ার, হয়তো অ্যালকোহলের কারণে। নির্বোধ, আমাকে ভাড়া দিতে বলছি, দিয়ে দাও ভালোমত, ভাবল আসাকাওয়া। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল ও। কিন্তু যতই মাতাল থাকুক না কেন, মানুষের সাথে কঠোর আচরণ করা সম্ভব নয় ওর দ্বারা।

“প্লিজ, ফেরত দিয়ে যাব আমি।”

বো করল সে। অতিথি কেন এটা ভাড়া নিতে উদগ্রীব, জানা নেই ম্যানেজারের। হয়তো ইন্টারেস্টিং কিছু রয়েছে এতে, হয়তো কেউ মুছে ফেলতে ভুলে গেছে সেটা। খুঁজে পাওয়ার পরই দেখে ফেলা লাগত, ভাবল ম্যানেজার। এখনই দেখতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু অতিথি যখন চাচ্ছে, তাকে তো ফিরিয়ে দেয়া যায় না। টেপটা ওকে দিল ম্যানেজার। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওয়ালেট বের করতে চাইল আসাকাওয়া। ম্যানেজার হাত নেড়ে থামাল ওকে

“ঠিক আছে। আপনাকে পে করতে হবে না। এর জন্য দাম নিতে পারব না আমি এখন, বুঝলেন?”

“অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে। ফেরত দিয়ে যাব আমি।”

“যদি ইন্টারেস্টিং কিছু হয় তবে দয়া করে পেমেন্ট করবেন।” ম্যানেজারের কৌতূহল পৌঁছেছে শিখরে। এখানকার বেশিরভাগ ভিডিও দেখা শেষ তার। ওগুলোতে আর আগ্রহ পায় না সে। কীভাবে এটা মিস করলাম আমি? কয়েক ঘণ্টা সময় কাটানো যেত দেখে। অথবা এতে কোনো স্টুপিড টিভি শো রেকর্ডিংও থাকতে পারে। ভাবল ম্যানেজার।

ম্যানেজার নিশ্চিত আবারও এখানে ঠিকমতোই ফেরত আসবে ভিডিওটা।

অধ্যায় দুই

রিওয়াইন্ড করা ছিল টেপটা। সাধারণ ১২০ মিনিটের একটা টেপ। এরকম টেপ পাওয়া যায় যেকোনো জায়গাতেই। ম্যানেজার টেপটা দেখিয়ে বলেছিল, আসলেই টেপের এন্টি-ইরেজার লকটা ভাঙা। ভিসিআর চালু করে স্লটে টেপটা রাখল আসাকাওয়া। স্ক্রিনের সামনে পা ছড়িয়ে বসে প্লে বাটন চাপল সে। পাওয়া গেল ফিতা গুটানো শব্দ। আসাকাওয়ার বিশ্বাস চারজনের মৃত্যুর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই টেপের ভেতরেই। টেপটা থেকে কোনো সংকেত সামান্য আকার ইঙ্গিত পেলেই সন্তুষ্ট থাকবে ও। এটা বিপদজনক কিছু নয়, ভাবল আসাকাওয়া। একটা ভিডিও টেপ থেকে কি-ই বা এমন বিপদ হবে?

একনাগাড়ে শব্দ আর ভঙ্গুর ইমেজ দেখা গেল স্ক্রিন থেকে। চ্যানেল নির্ধারণ করার পর পর্দায় স্থির হলো ছবি। কালির মতো কালো হয়ে রয়েছে স্ক্রিন। এটাই ভিডিওর প্রথম দৃশ্য। কোনো আওয়াজ নেই। ভিডিওটাতে সমস্যা রয়েছে কিনা সেটা দেখতে স্ক্রিনের সামনাসামনি মুখ নিয়ে গেল ও। আপনাকে সাবধান করা হলো : না দেখাই ভালো। দেখলে পস্তাতে হবে আপনাকে। সুইশি আইওয়াতার লেখা কথাগুলো ঘুরতে থাকল ওর মাথায়। পস্তাতে হবে কেন? এসব ব্যাপারে অভ্যস্ত আসাকাওয়া। লোকাল নিউজ কভার করে অভ্যস্ত ও। যত ভয়ঙ্কর কিছুই দেখানো হোক না কেন, নিজেকে আত্মবিশ্বাসী মনে হলো ওর। আর যাই হোক দেখে পস্তাবে না ও অন্তত।

কালো স্ক্রিনের মাঝে দেখে মনে হলো জ্বলছে বিন্দুর মতো ক্ষুদ্র একটা আলো। ধীরে ধীরে প্রসারণ ঘটছে সেটার। বাম থেকে ডানে। অবশেষে বাম প্রান্তে চলে গেল বাকি অংশ। শাখা বিস্তার করল স্ক্রিনজুড়ে। জীর্ণ হয়ে গিয়েছে আলো। স্ক্রিনজুড়ে নড়াচড়া করছে পোকার মতো। সেটা কয়েকটা শব্দ গঠন করল অবশেষে। ফিল্মে যেমন ক্যাপশন দেখানো হয় ওরকম কিছু নয়। কাঁচা হাতে লেখা, মনে হচ্ছে যেন জেট-ব্ল্যাক পেপারে লেখা হয়েছে ব্রাশ দিয়ে। কি লেখা রয়েছে সেটা কোনোমতে পড়ল আসাকাওয়া : ‘শেষ পর্যন্ত দেখো।’ এই কথাটুকু হারিয়ে গেল শব্দগুলো। পরবর্তী কয়েকটা শব্দ ভেসে এলো স্ক্রিনে। ‘শূন্যতা গিলে খাবে তোমাকে…’ শেষ কথাটা থেকে বোঝা গেল না বেশি কিছু। কিন্তু গিলে খাবার ব্যাপারটা ভালো শোনায় না। দেখে মনে হলো এরপর ছিল ‘অথবা’ জাতীয় কিছু। অর্ধেক দেখে ভিডিও বন্ধ করা যাবে না নাহলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে : এটাতো রীতিমতো একটা হুমকি।

“তোমাকে গিলে খাবে শূন্যতা…’ ক্রমেই বড় হতে থাকল শব্দগুলো। একসময় ছেয়ে গেল পুরো কালো স্ক্রিন জুড়ে। কালো থেকে এখন দুধের মতো সাদা। কেমন যেন প্যাচানো, কৃত্রিম রঙ। মনে হচ্ছে যেন ক্যানভাসে আকানো হয়েছে কোনো বিমূর্ত চিত্র। কোনো চলন্ত, অবচেতন আর্তনাদ যেন খুঁজে ফিরছে বের হওয়ার পথ অথবা প্রাণের স্পন্দন। চিন্তারও রয়েছে একক শক্তি, চিন্তাগুলো যেন অন্ধকারে চিৎকার করছে প্রাণীর মতো। আসাকাওয়ার ইচ্ছে হলো না ভিডিওটা থামাতে। এই অজানা কিছু যা ওকে গিলে ফেলতে চায় সেটার কারণে ভীত, না হয়ে নয়, এই অজানা দৃশ্য থেকে আলাদা রকমের একটা ইচ্ছাশক্তি অনুভব করার কারণে।

দুধের মত সাদা স্ক্রিনে জ্বলে উঠল লাল বর্ণের কিছু একটা। একইসাথে অবর্ণনীয় আওয়াজ করে মাটি কেঁপে উঠতে দেখল আসাকাওয়া। মনে হলো আওয়াজ ভেসে আসছে চারপাশ থেকে।

কাঁপছে পুরো কেবিনই। মনে হলো না শব্দের উৎপত্তিস্থল স্পিকার। প্রসারণ হতে থাকল স্ক্রিনের লাল রঙ। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাল হয়ে গেল পুরো স্ক্রিন। কালো থেকে সাদা আর এখন লাল… অদ্ভুত বর্ণ পরিক্রমা ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন পর্যন্ত স্ক্রিনে প্রাকৃতিক কিছুর দেখা মেলেনি। শুধুই বিমূর্ত ব্যাপার স্যাপার। রঙের খেলার মাধ্যমে যা স্থান করে নিচ্ছে ওর মস্তিষ্কে। ব্যাপারটা বাস্তবিক-ই ক্লান্তিকর। ঠিক তখনই দর্শকের মন পড়তে পেরেই কিনা, স্ক্রিন থেকে উধাও হয়ে গেল লাল বর্ণ। সেখানে স্থান পেল পাহাড়ের দৃশ্য। এক নজর দেখাতেই আসাকাওয়া বলতে পারল, এটা আগ্নেয়গিরি। মসৃণ চূড়া রয়েছে এতে। আগ্নেয়গিরি থেকে সাদা ধোয়া গিয়ে মিশছে নীল আকাশে। সম্ভবত ক্যামেরাটা পাহাড়ের গোড়ার কাছে কোথাও রাখা। সমতল অঞ্চল কালচে-বাদামী লাভায় পরিপূর্ণ। আবারও কালো হয়ে গেল স্ক্রিন। নীল আকাশ যেন হঠাৎ করেই হয়ে গেছে অন্ধকার। কিছুক্ষণ পরই কেন্দ্র থেকে স্ক্রিনের চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল টকটকে লাল লিকুইড। নিম্নগামী হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে রঙটা। আরেকটা বিস্ফোরণ। স্ক্রিনে আগুনলাল রঙ ছড়িয়ে পড়ার পরেও পাহাড়ের আকৃতি ঠিকই বুঝতে পারছে আসাকাওয়া। দৃশ্যগুলো এখন কিছুটা বাস্তবিক। আগে ছিল বিমূর্ত। বোঝাই যাচ্ছে, যা দেখা গেল সেটা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, প্রাকৃতিক ঘটনা। এমন একটা দৃশ্য, যার রয়েছে যৌক্তিক ব্যাখ্যা। আগ্নেয়গিরি থেকে গলিত লাভা নির্গত হয়ে নিম্নগামী হয়ে জমছে নিচে। কিন্তু ক্যামেরাটা কোথায় রাখা? বিশেষভাবে না রাখা হয়ে থাকলে, দেখে মনে হলো ক্যামেরাটা হারিয়ে গিয়েছে নির্গত লাভার মধ্যে। লাভাগুলো পাথরের ওপর গিয়ে না পড়া পর্যন্ত কাঁপতেই থাকল দৃশ্য। এরপর হঠাৎ করে বদলে গেল স্ক্রিন। এক দৃশ্য থেকে অপর দৃশ্যের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। শুধুই হঠাৎ পরিবর্তন। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে আবারও ভেসে উঠল মোটা কালো হরফে লেখা। কোনাগুলো ঝাপসা। কিন্তু কোনোভাবে বুঝে নিল আসাকাওয়া, লেখা রয়েছে ‘পর্বত’। শব্দটার অক্ষরগুলো থেকে গড়িয়ে পড়ছে কালো রং। মনে হচ্ছে কাঁচা হাতে রঙতুলি দিয়ে কোনোভাবে লেখা হয়েছে শব্দটা। অক্ষরগুলো একেবারে স্থির। স্থির হয়ে গিয়েছে স্ক্রিনও।

আবারও হুট করেই পরিবর্তীত হলো স্ক্রিন। একজোড়া ডাইস গড়িয়ে এসে পড়ল একটা পাত্রের মধ্যে। ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা, পাত্রের তলা কালো, আর একটা ডাইস লাল। পূর্বেই এই তিনটি রঙ স্ক্রিনে ভাসতে দেখেছে ও। শব্দহীন ভাবে গড়াতে থাকল ডাইস দুটো। থামল অবশেষে। একটাতে উঠেছে পাঁচ অপরটিতে এক। লালটাতে এক আর অপরটিতে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে পাঁচটি কালো ডট। এর মানে কি?

পরের দৃশ্যে প্রথমবারের মতো দেখা গেল মানুষ। একজন বয়স্ক মহিলা, ভাঁজ পড়ে গেছে তার চামড়ায়। বসে রয়েছে কাঠের মেঝেতে পাতা তাতামি ম্যাটের ওপর। হাঁটুর ওপর রাখা তার হাত, বাম কাঁধ এগিয়ে রয়েছে সামান্য সামনে। সামনে তাকিয়ে ধীরে কিছু একটা বলছে সে। চোখের পাতা ফেলার সময় মনে হলো তার দুটো চোখের আকার দুইরকম। পলক ফেলছে না, মনে হচ্ছে চোখ টিপছে। অপরিচিত কোনো উপভাষায় কথা বলছে সে। ছাড়া ছাড়া ভাবে শব্দগুলো ধরতে পারল আসাকাওয়া।

…থতোমার স্বাস্থ্যৰ্থ… তারপরথ…সময় ব্যয় করোথ…বুঝতে হবে তোমাকে? সাবধান হওথ…যা করতে চলেছ সেটার ব্যাপারে…থ দাদীমার কথা শোনো কারণথ… দরকার নেই…

অভিব্যক্তিহীন মহিলা হারিয়ে গেল নিজের বক্তব্য পেশ করার পরপরই। অনেকগুলো শব্দের অর্থ বুঝতে পারল না আসাকাওয়া। কিন্তু বুঝতে পারল ওকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে কিছু। কিছু একটা ব্যাপারে সাবধান হতে বলল ওকে, সতর্ক করল। কে এই বুড়ি? কিসের ব্যাপারেই বা কথা বলল।

সদ্যজাত এক শিশুর চেহারা ভেসে উঠল স্ক্রিনে। কোথাও থেকেও কান্না শোনা যাচ্ছে বাচ্চাটার। এবার ও নিশ্চিত, কান্নার শব্দটা টেলিভেশন স্পিকারের ভেতর থেকে হচ্ছে না। ভেসে আসছে ওর চেহারার খুব কাছ থেকে। একেবারে বাস্তবিকই শোনাচ্ছে। দুটো হাত জড়িয়ে ধরেছে বাচ্চাটাকে, স্ক্রিনে দেখতে পেল আসাকাওয়া। বাম হাতটা বাচ্চার মাথার নিচে ডানহাত পিঠে। ধরে রেখেছে সতর্কতার সাথে। সুন্দর দুটো হাত। দৃশ্যটিতে পুরোপুরি ডুবে গেছে আসাকাওয়া। টের পেল একই পজিশনে রেখেছে ওর নিজের হাতও। সরাসরি নিজের থুতনির নিচে বাচ্চার কান্না শুনতে পেল ও। কেঁপে উঠে সরিয়ে নিল নিজের হাত। কিছু একটা অনুভূত হচ্ছে ওর। উষ্ণ কোনো কিছু, ঘন তরল রক্তের মতো অথবা এক খণ্ড মাংস স্পর্শের অনুভূতি। হাত ঝাড়া দিল আসাকাওয়া, দেখে মনে হলো ঝেড়ে ফেলল কিছু হাত থেকে। চেহারার কাছাকাছি নিয়ে গেল নিজের হাতের তালু। গন্ধ বের হচ্ছে একটা। সদ্যজাত শিশুর শরীরে লেগে থাকা উষ্ণ রক্তের গন্ধ, নাকি..? ভেজা মনে হলো ওর নিজের হাত। কিন্তু বাস্তবে একদমই স্যাতস্যাতে নয়। আবারও স্ক্রিনে চোখ রাখল ও। এখনও সেখানে ভেসে রয়েছে বাচ্চার দৃশ্য। কান্না সত্ত্বেও বাচ্চাটার অভিব্যক্তিতে রয়েছে একধরনের শান্তির ছাপ। কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়েছে বাচ্চাটার পুরো শরীরে।

স্ক্রিনে পরের দৃশ্যে দেখা গেল শ’খানেক মানুষের চেহারা। প্রত্যেকের চেহারায় ঘৃণা ও বিদ্বেষ। চেহারাগুলো আলাদা করার মতো আর কিছু দেখতে পেল না ও।

অগণিত চেহারাগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোনো পৃষ্ঠে আকানো হয়েছে তাদেরকে। চেহারাগুলো চলে যেতে লাগল স্ক্রিনের গভীরে। একেকটা চেহারা যতই ছোট হতে থাকল, স্ক্রিনে ততই বাড়তে থাকল চেহারার সংখ্যা। বাড়তেই থাকল, গণনাহীন পর্যায়ে। অসংখ্য চেহারার অদ্ভুত সমাহার। যদিও মাথা উঁচু করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, তবুও আওয়াজ আসতে থাকল ওদের মধ্যে থেকে। মুখগুলো স্লোগান দিচ্ছে কিছু একটা বলে, যদিও ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে চেহারাগুলো। দেখে মনে হচ্ছে বড় কোনো সমাবেশ, কিন্তু স্লোগান শুনে মনে হলো দুয়ো আর গালি দেয়া হচ্ছে। কি বলা হচ্ছে বুঝতে পারল না আসাকাওয়া। তবে নিশ্চিতভাবেই ভালো কিছু বলছে না কণ্ঠস্বরগুলো। অবশেষে একটা শব্দ ধরতে পারল ও: “মিথ্যাবাদী!” আরেকটা শব্দ, “ভুয়া!” এখন স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে কমপক্ষে হাজারটা চেহারা। ক্ষুদ্র কালো কণা ব্যতীত কিছুই মনে হচ্ছে না ওগুলোকে। পুরো স্ক্রিন জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে ওগুলো। মনে হচ্ছে টেলিভিশন বন্ধ কিন্তু হয়ে চলেছে আওয়াজ। আসাকাওয়র সহ্য সীমার বাইরে এসবকিছু। মনে হচ্ছে সব গালাগালি, দুয়োধ্বনি দেয়া হচ্ছে ওকেই। এরকমই অনুভূতি হলো ওর।

পরবর্তীতে দৃশ্যে দেখা গেল কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর রাখা একটি টেলিভিশন। পুরোনো ঘরনার উনিশ ইঞ্চি টেলিভিশন। রাউন্ড চ্যানেল সেক্টর রয়েছে এতে। কাঠের ক্যাবিনেট রাখা খরগোশের কানের ন্যায় অ্যান্টেনা। নাটকের মধ্যে নাটক নয়, তবে টিভির ভেতরে টিভি। টিভির ভেতরকার টিভির স্ক্রিনে এখন পর্যন্ত কিছুই দেখা গেল না। কিন্তু মনে হচ্ছে চালু আছে টিভিটা। জ্বলছে নবের ওখানকার লাল আলো। কেঁপে উঠল স্ক্রিনের মধ্যেকার স্ক্রিন। স্থির হয়ে কেঁপে উঠল আবারও, এরপর আবারও। প্রত্যেকবার বৃদ্ধি পাচ্ছে ফ্রিকোয়েন্সি। এরপর আবছা ভাবে একটি শব্দ আসল স্ক্রিনে: সাড়া। শব্দটা ধীরেধীরে ম্লান হয়ে ভেঙে গিয়ে মনে হলো উৎপত্তি ঘটবে আরেকটা শব্দের। কিন্তু ঘটল না। ব্ল্যাকবোর্ড থেকে যেভাবে চকের গুঁড়া ঝরে পড়ে ওভাবে হারিয়ে গেল শব্দটা। দেখার সময় হঠাৎ করেই টের পেল নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। নিজের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারছে ও, বুঝতে পারছে বেড়ে গেছে নিজের রক্তপ্রবাহ। একধরনের গন্ধ সেইসাথে টক স্বাদের অস্তিত্ব টের পেল নিজের জিহ্বায়। অদ্ভুতভাবে কিছু একটা আলোড়িত করছে ওর পঞ্চইন্দ্রিয়কে। কোনো মাধ্যমের সাহায্য শব্দ ও স্বাদ এসে পৌছাচ্ছে আসাকাওয়ার কাছে। যেন ওগুলোকে আহবান করেছে আসাকাওয়া।

স্ক্রিনে ভেসে উঠল একজন লোকের চেহারা। এই লোকটার চেহারা যেন জীবন্ত। চেহারায় স্পন্দিত হচ্ছে জীবনীশক্তি। দেখার সময় নিজের ভেতরের ঘৃণা অনুভব করল আসাকাওয়া। ঠিক বুঝতে পারল না, কেন ও ঘৃণা করছে এই লোকটাকে। লোকটা দেখতে বীভৎসও নয়। লোকটার কপাল সামান্য উঁচু, এছাড়া বেশ পরিপাটি সে। কিন্তু ভয়ানক কিছু একটা রয়েছে তার চোখে। শিকারের অপেক্ষায় থাকা কোনো জন্তুর চোখের মতো

ঐ চোখদুটো। ঘেমে একাকার লোকটার চেহারা। দৃষ্টি ওপরের দিকে, ক্রোধের সাথে নিঃশ্বাস ফেলছে সে, ছন্দের তালে শরীর দুলছে তার। একটি গাছ জন্মাল লোকটার পেছনে। বিকেলের রোদ পড়ছে গাছের ডালপালায়। চোখ নামিয়ে আবারও সামনে তাকাল লোকটি। তার দৃষ্টি এখন দর্শকের দিকে। আসাকাওয়া ও লোকটির দৃষ্টি এখন মুখোমুখি। শ্বাসরোধের অনুভূতি হলো ওর, ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল ঐ দৃষ্টি। লালা ঝরছে লোকটার মুখ দিয়ে, লাল হয়ে গিয়েছে চোখ। লোকটার দেহ দিয়ে পূর্ণ হয়ে যেতে লাগল স্ক্রিন, হঠাৎ করেই স্ক্রিন থেকে উধাও হয়ে গেল সে।

কিছুক্ষণের জন্য শুধুই গাছের কালো ছায়া দেখা গেল স্ক্রিনে। ভেতরে থেকে শোনা যাচ্ছে আর্তচিৎকার। ঠিক সেইসময় লোকটার কাঁধ দেখা গেল স্ক্রিনে, এরপর গলা, অবশেষে আবারও তার চেহারা। তার কাঁধ নগ্ন। ডান কাঁধের ওপর দেখা যাচ্ছে কালশিটের দাগ। রক্তের ফোঁটা দেখা গেল ক্যামেরার লেন্সের সামনে। বড় হতে থাকল রক্তের ফোঁটা। একসময় গ্রাস করে নিল পুরো দৃশ্যটা। কালো হয়ে গেল স্ক্রিনটা, পিটপিট করে উঠল কালো স্ক্রিন। স্ক্রিনে আলো ফিরে এলে লাল হয়ে গেল সবকিছু। লোকটার চোখে এখন খুনে দৃষ্টি। স্ক্রিনে আরও সামনে এগিয়ে এসেছে তার চেহারা ও কাঁধ। কাঁধের কালশিটে পড়া অংশ গর্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছে হাড়। বুকের মধ্যে চাপ অনুভব করল আসাকাওয়া। আবার গাছ দেখতে পেল ও। আকাশটা কাঁপছে। আকাশের গোধূলির রঙ, শুকনো ঘাসের মতো ধূসর। আবর্জনা, আগাছার পর আবারও আকাশ দেখতে পেল আসাকাওয়া। আবারও শুনতে পেল বাচ্চার কান্না। অবশেষে আবারও কালো হয়ে গেল স্ক্রিন, কেন্দ্র থেকে ছেয়ে যেতে লাগল অন্ধকার। আলো ও আধারকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যাচ্ছে এখন। স্ক্রিনের মাঝে, অন্ধকারে চাঁদের মতো ছোট্ট গোলাকার আলো ফুটল। মানুষের চেহারা দেখা যাচ্ছে চাঁদের মধ্যে। হাতের মুঠির সমান কিছু একটা পড়ল ঐ চাঁদ থেকে। সৃষ্টি করল নিস্তেজ শব্দের। বারবার। প্রত্যেকবার শব্দ হওয়ার সাথে সাথে কেঁপে উঠছে স্ক্রিন। আওয়াজ পাওয়া গেল মাংস কোপানোর, এরপর আবারও নেমে এলো অন্ধকার। যদিও তখন বোঝা যাচ্ছে পালস, টের পাওয়া যাচ্ছে রক্ত চলাচল, হৃদস্পন্দন। পুনরাবৃত্তি হতে থাকল একই দৃশ্যের। যেন ঘিরে থাকা, হার না মানা কোনো অন্ধকার। যা হয়তো চলবে অনন্তকাল ধরে। ঠিক তখনই, শুরুর মতো শব্দ ভেসে উঠল স্ক্রিনে। প্রথম দৃশ্যের লেখাটা কাঁচা হাতের মনে হচ্ছে সদ্য লেখা শিখতে থাকা কোনো বাচ্চা চেষ্টা করছে কিছু লেখার। হয়তো এর থেকে একটু উন্নত লেখাগুলো। ভেসে উঠল সাদা অক্ষর, এরপর ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যেতে লাগল :

“যারা এই দৃশ্যগুলো দেখছে ঠিক একসপ্তাহ পর, এই সময়ে মৃত্যু লেখা হয়ে গিয়েছে তাদের ভাগ্যে। যদি মরতে না চাও, তবে নির্দেশনাগুলো মানতে হবে ঠিকমতো।”

হা হয়ে বড় চোখে আসাকাওয়া তাকিয়ে থাকল টেলিভিশনের দিকে। কিন্তু তখনই বদলে গেল দৃশ্য। একেবারে পুরোপুরি। শুরু হয়ে গিয়েছে বিজ্ঞাপন। খুবই সাধারণ, স্বাভাবিক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন। রোমান্টিক কোনো গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় একজন অভিনেত্রী বসে রয়েছে বারান্দাতে। আকাশে চলছে আতশবাজির খেলা। মশার কয়েলের বিজ্ঞাপন। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে শেষ হয়ে গেল বিজ্ঞাপন। হাজির হলো আরেকটা দৃশ্য। আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে স্ক্রিন। অন্ধকার, হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলোর ঝরে পড়া অংশ। এরপরই শব্দ হয়ে শেষ হয়ে গেল টেপটা।

চোখ কচলিয়ে, রিউইন্ড করার পর পুনরায় শেষ দৃশ্যটা চালাল আসাকাওয়া। একই দৃশ্য, আবারও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বিজ্ঞাপনের আগমন। ভিডিও থামিয়ে টেলিভিশন অফ করে দিল আসাকাওয়া। কিন্তু চেয়ে থাকল স্ক্রিনের দিকে। গলা শুকিয়ে গিয়েছে ওর।

“কি ছিল এইটা?”

কিছু বলার নেই। একের পর এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। আর যে এগুলা দেখবে, ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবে সে। আর যে অংশে এই দুর্ভাগ্য এড়ানোর উপায় বাতলে দেয়ার কথা সেখানে শুরু হয়েছে বিজ্ঞাপন।

কে সরিয়েছে এটা? ঐ চারজন?

চোয়াল ঝুলে গেল আসাকাওয়ার। চারজনের মৃত্যুর ব্যাপারে না জেনে থাকলে হয়তো এই ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দিত ও। কিন্তু ওর জানা আছে, রহস্যজনক উপায়ে মারা গেছে চারজন, ভবিষ্যৎবাণী মোতাবেক।

হঠাৎ করে বেজে উঠল ফোন। ফোনের আওয়াজে বুক কেঁপে উঠল আসাকাওয়ার। রিসিভার উঠিয়ে নিল ও। কোনো কিছু নিজেকে আড়াল করে গোপনে দেখছে ওকে, এমনটাই মনে হলো ওর।

“হ্যালো,” কোনোমতে বলতে সমর্থ হলো আসাকাওয়া। জবাব পাওয়া গেল না অপর প্রান্ত থেকে। অন্ধকারে চক্কর খাচ্ছে কোনোকিছু। শোনা গেল গাঢ় গোঙানির আওয়াজ, মনে হচ্ছে যেন কেঁপে উঠছে পৃথিবী। নাকে এলো ভেজা মাটির সোদা গন্ধ। কানের দিকটা কেঁপে উঠল আসাকাওয়ার। খাড়া হয়ে গেল কাঁধ। যেন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে আসাকাওয়ার বুকের ভেতরে। মনে হলো পৃথিবীর গর্ভ থেকে ভেসে আসা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল ওর মেরুদণ্ড দিয়ে। অব্যক্ত চিন্তাভাবনা ও অজানা ক্রোধে ভরে উঠল আসাকাওয়ার মন। জোরে করে রিসিভার নামিয়ে রাখল আসাকাওয়া। মুখে হাত চেপে বাথরুমের দিকে দৌড় দিল ও। এখনও মেরুদণ্ডে বয়ে চলেছে ভয়ের স্রোত, সেইসাথে যোগ হয়েছে বমি বমি ভাব। কিছুই বলা হয়নি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে। কিন্তু আসাকাওয়া জানে কি চায় সেটা। কনফার্মেশন কল ছিল এটা

তুমি দেখে ফেলেছ। এর মানে কি, বুঝতেই পারছ। যেমনটা বলা হয়েছে করো। নাহলে…

টয়লেটে বমি করে ফেলল আসাকাওয়া। পেটে খুব বেশি কিছু ছিল না ওর। একটু আগে পান করা সমস্ত হুইস্কি উগড়ে দিল আসাকাওয়া। তিক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে দেহ জুড়ে, পানি বেরিয়ে এলো ওর চোখ দিয়ে, অস্বস্তিবোধ হচ্ছে নাকের ভেতরেও। হঠাৎ করে মনে হলো বমির সাথে সাথে বেরিয়ে গিয়েছে ওর দেখা দৃশ্যগুলোও।

“আমি যদি না করি, তাহলে? জানিনা? কি করতে বলা হয়েছে আসলে? হুহ? করবো টা কি আমি?”

বাথরুমের মেঝেতে বসেই চিৎকার করল আসাকাওয়া। পাত্তা দিতে চাচ্ছে না ভয়কে।

“চারজন মিশিয়ে দিয়েছে ওটা। গুরুত্বপূর্ণ অংশটা…বুঝতে পারিনি আমি। কেউ সাহায্য করো আমাকে।”

অজুহাত বানানো ছাড়া কিছুই করার নেই আসাকাওয়ার। বাথরুমের মেঝে থেকে উঠে বসল ও। কতটা ভয়াবহ দেখাচ্ছে ওকে, ধারণা নেই ওর। রুমের প্রত্যেকটা আনাচে কানাচে ঘুরে দেখল আসাকাওয়া। মাথা নিচু করে মিনতি করল ও, আনাচে কানাচে যদি কোনো সত্ত্বা থেকে থাকে তার নিকট। নিজেকে করুণভাবে উপস্থাপনের আর সহমর্মিতা আদায়ের চেষ্টা করছে ও, নিজেও বুঝতে পারল না সেটা। শীত লাগতে থাকল হঠাৎ করেই। তাকাল জানালার দিকে। বাতাসে কাঁপছে পর্দাগুলো।

ভেবেছিলাম জানালা বন্ধ করেছি, মনে মনে বলল ও।

পর্দা টানার আগে জানালার কাঁচ টেনেছে, স্পষ্ট মনে রয়েছে আসাকাওয়ার। এই ব্যাপারে নিশ্চিত ও। কোনো কারণ ছাড়াই অন্ধকার আকাশের দৃশ্য ভাসতে থাকল ওর মনে। আলো-আধারীতে জানালার পর্দায় সৃষ্টি হয়েছে ছকের মতো ছায়া। মাঝেমধ্যে মনে হলো সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন চিহ্নের ছায়াও। বড় বড় দালান বা বিল্ডিংকে কবর ফলক ধরা হলে, এগুলোর দেহের ওপর পতিত আলো হচ্ছে এপিটাফ। পর্দা থেকে সরে গেল ছায়া, কিন্তু এখনও বাতাসে কাঁপছে জানালার পর্দা। দ্রুত ক্লোজেট থেকে নিজের ব্যাগ বের করে নিল আসাকাওয়া। ব্যাগের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল ওর জিনিসপত্র। আর এক সেকেন্ডও থাকা যাবে না এখানে।

যে যা খুশি বলুক, এখানে থাকলে আজ রাতেই মরে ভূত হয়ে যাব, এক সপ্তাহ তো বহুদূরের কথা, ভাবল আসাকাওয়া।

ঘামে ভিজে একাকার হয়ে এন্ট্রিওয়েতে পৌঁছাল আসাকাওয়া। বাইরে যাওয়ার আগে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করল ও। ভয়ে পালিয়ে না বেরিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি: আবারও লিভিং রুমে ফিরে ইজেক্ট বাটন টিপল আসাকাওয়া। তোয়ালাতে ভিডিওটেপটি ভালোমত পেচিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। টেপটা-ই একমাত্র ব্লু। কোনোভাবেই এটা ফেলে রেখে যেতে পারে না ও। হয়তো ধাঁধাটা ভালো মতো বুঝে নিজেকে বাঁচানোর একটা উপায় বের করে ফেলতে পারবে। মাত্র এক সপ্তাহ রয়েছে ওর হাতে। ঘড়ির দিকে তাকাল আসাকাওয়া। রাত ১০ : ১৮ বাজে। ভিডিওটা দেখা শেষ হয়েছে ১০ : ০৪ এ। হঠাৎ করেই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে ওর কাছে। চাবিটা টেবিলে রেখে ঘরের আলো জ্বালিয়েই বেরিয়ে গেল আসাকাওয়া। অফিসে না থেমেই দৌড়ে গাড়ির কাছে গিয়ে ইগনিশনে চাবি ঢুকিয়ে দিল ও।

“কাজটা একা করতে পারবো না আমি, সাহায্য চাইতে হবে আমাকে।” গাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজেকেই বলল ও। রিয়ার ভিউ মিররে না তাকিয়ে পারল না আসাকাওয়া। কোনোভাবেই চেষ্টা চালিয়ে গাড়ির গতি

বাড়াতে পারল না ও। মনে হচ্ছে কোনো দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে ওকে, ধীরগতিতে চলছে সবকিছু। বারবার তাকাল রিয়ার ভিউ মিররে। আসাকাওয়াকে তাড়া করা কালো ছায়াটা আর দেখা গেল না কোথাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *