তৃতীয় পর্ব : দমকা বাতাস – ১০

অধ্যায় দশ

১৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার

কালো মেঘ একপাশে সরে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আকাশ। কিন্তু জোরালো হাওয়া বইছে এখনও। টাইফুন নম্বর ২১ গত সন্ধ্যায় এই ওশিমার উত্তরের বোসো পেনিনসুলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হারিয়ে গেছে সাগরে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার শুরুতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সাগর। এখন বিরাজ করছে শরতের প্রশান্তিকর আবহাওয়া। বোটের ওপর থেকে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে নিজেকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলে মনে হলো আসাকাওয়ার। যে অপেক্ষায় রয়েছে দণ্ড কার্যকরের। চোখ তুলে মাঝামাঝিতে অবস্থিত ইজু আইল্যান্ডের ঢাল দেখতে পেল ও। আজকেই ডেডলাইনের মুখোমুখি হতে হবে ওকে। এখন সকাল দশটা। ঠিক বারো ঘণ্টা পর নিঃসন্দেহে হাজির হবে মৃত্যুদূত। ভিলা লগের বি-৪ কেবিনে বসে ভিডিও দেখার কাটায় কাটায় এক সপ্তাহ হলো আজ। যদিও মনে হচ্ছে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘকাল। এক সপ্তাহে যে পরিমাণ আতঙ্কের মুখোমুখি হয়েছে আসাকাওয়া, অনেক মানুষ সারাজীবনও হয় না। ওশিমায় বুধবার সারাদিন কাটানোর কড়া মূল্য চুকাতে হবে কিনা নিশ্চিত নয় আসাকাওয়া। গতকাল উত্তেজিত হয়ে ফোনের মধ্যেই দোষারোপ করছিল ইয়াশিনোকে। কিন্তু আজ সকালে ঠান্ডা মাথায় ভেবেছে আসাকাওয়া। সত্যি বলতে যেভাবে সাহায্য করেছে ইয়াশিনো সে কারণে তার ওপর কৃতজ্ঞ ও। যদি নিজেই লিড খুঁজতে দৌড়ে বেড়াত, তবে নিশ্চিত কিছু না কিছু মিস করে যেত ও। অথবা গিয়ে পড়ত কানাগলিতে।

ভালো লক্ষণ, মনে হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় মুখ তুলে চেয়েছে আমাদের দিকে, ভাবল আসাকাওয়া। এভাবে না ভাবলে অবশ্য সামনেও আগানো যাবে না। নিজের মনকে প্রস্তুত করছে আসাকাওয়া। যেন মৃত্যুর সময়ে পাওয়া না পাওয়ার আফসোস করতে না হয়।

ওর হাতে থাকা তিন পৃষ্ঠার প্রিন্ট আউট-ই ওদের সর্বশেষ ভরসা আর ব্লু। ইয়াশিনো গতকাল হাফ বেলা খেটে সংগ্রহ করেছে তথ্যগুলো। এরপর ফ্যাক্স করেছে ওদের। সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ড নির্মাণের আগে ওখানে একটি ফ্যাসিলিটি ছিল। সেই সময়ে শুধুমাত্র যক্ষ্মার জন্য আলাদা চিকিৎসা কেন্দ্র বা হাসপাতাল থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। যদিও বর্তমানে একটু অস্বাভাবিক। কেননা বর্তমানে খুব কম মানুষই যক্ষ্মার আতঙ্কে থাকে। তবে যুদ্ধ পূর্ববর্তী ফিকশনগুলো কারও পড়া থাকলে এই ব্যাপারে জানার কথা। সেখানে উল্লেখ থাকে এইধরনের হাসপাতাল বা ফ্যাসিলিটির। যক্ষ্মা রোগ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই থমাস মান লিখেছিলেন ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন’। মৃত্যুর আগে মোতোজিরো কাইজি গানও বেঁধেছিলেন এটা নিয়ে। ১৯৪৪ সালে আবিষ্কৃত হয় স্ট্রেপটোমাইসিন আর ১৯৫০ সালে হাইড্রাজাইড। যেগুলো ব্যবহৃত হয় যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে। ফলে ধীরে ধীরে কমে আসে যক্ষ্মায় মৃত্যুর প্রকোপ। যক্ষ্মা নেমে আসে সাধারণ রোগের পর্যায়ে। ১৯২০ থেকে ৩০ সালের দিকে বছরে প্রায় ২০০০০০ মানুষ মারা যেত এই রোগে। যুদ্ধের পর বৃহত্তাকারে কমে আসে মৃত্যুসংখ্যা। যদিও ব্যাসিলাস তখনও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তবে এখনও বছরে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ মারা যায় যক্ষ্মায়। যে সময়ে ভয়ানক রূপ ধারণ করেছিল যক্ষ্মা, তখন মুক্ত বাতাস, খোলামেলা পরিবেশ রোগীর সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এই কারণে যক্ষ্মা নিরাময় কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হতো পাহাড়ি এলাকায়। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির কারণে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা কমে গেলে এই নিরাময় কেন্দ্ৰ বা ফ্যাসিলিটিগুলো কমিয়ে আনে নিজেদের সেবা প্রদানের সীমা। অন্যভাবে বলতে গেলে, অন্যান্য রোগের সেবা প্রদান ও সার্জারিও শুরু করে ওরা। তাছাড়া আর্থিকভাবে টিকে থাকা সম্ভব হতো না ওদের পক্ষে। ১৯৬০ সালে আর্থিক সংকটে পড়ে সাউথ হ্যাকনের ঐ ফ্যাসিলিটিজ। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান হওয়ার কারণে আরও বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এটাকে। কোনো যক্ষ্মা রোগী একবার এখানে ভর্তি হলে আর বেরুনোর দরকার পড়ত না। ফলে রোগীর যাওয়া আসা সমস্যা ছিল না কোনো। সমস্যাটা হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ার কারণে এটাকে জেনারেল হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে পারেনি ওরা। ফলে ১৯৭২ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই নিরাময়কেন্দ্র।

অপেক্ষায় ছিল প্যাসিফিক রিসোর্ট। গলফ কোর্স বানানোর জন্য নিরিবিলি জায়গার খোঁজে ছিল ওরা। ১৯৭৫ সালে একখণ্ড জমি কেনে প্যাসিফিক রিসোর্ট, জমির-ই অংশ ছিল নিরাময়কেন্দ্র। দ্রুতই সেখানে গলফকোর্স নির্মাণ করে ওরা। পরবর্তীতে সামার হোম, হোটেল, অ্যাথলেটিক ক্লাব, টেনিস কোর্ট ইত্যাদির সুবিধাসহ জায়গাটাকে পুরো একটা রিসোর্ট বানিয়ে ফেলে প্যাসিফিক কর্তৃপক্ষ। আর ছয় মাস আগে, এপ্রিলে তুলির শেষ আঁচড় হিসেবে নির্মাণ করে ভিলা লগ কেবিন।

“কেমন ধরনের জায়গা এটা?” জিজ্ঞেস করল রুজি। ডেকে থাকার কথা তার। কিন্তু এসে বসেছে আসাকাওয়ার পাশের সিটে।

“হু?”

“সাউথ প্যাসিফিক ল্যান্ডের কথা বলছি।”

ঠিকই তো, ওখানে কখনো যায়নি সে, ভাবল আসাকাওয়া।

“রাতের বেলায় দারুণ দৃশ্য দেখা যায় ওখানে।” ওখানকার জনমানববিহীন পরিবেশের কথা স্মরণ করল আসাকাওয়া। মনে পড়ল কমলা আলোয় শুনতে পাওয়া টেনিস বলের শব্দ।

এরকম জনমানবহীন পরিবেশ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে ওখানে? কতজন মানুষ মরেছে ঐ নিরাময়কেন্দ্রে? ভাবল আসাকাওয়া। নুমায়ু আর মিশিমার সন্ধ্যার আলো কীভাবে ঠিকরে পড়ছিল, মনে পড়ল ওর।

প্রিন্টআউটের প্রথম পৃষ্ঠা বের করল ও। বাকি দুই পৃষ্ঠা ওর কোলের ওপর। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আঁকা ডায়াগ্রাম। নিরাময় কেন্দ্রের লেআউট। তৃতীয় পৃষ্ঠায় বর্তমান বিল্ডিংয়ের ছবি। আধুনিক তিনতলা বিল্ডিং ওটা। ভেতরে রয়েছে ইনফরমেশন সেন্টার ও রেস্টুরেন্ট। ভিলা লগ কেবিন কোনদিকে সেটা জানতে এই বিল্ডিংয়ে-ই ঢুকেছিল আসাকাওয়া। দুটো পৃষ্ঠায় চোখ বুলাল ও। এই দুই পাতাতেই রয়েছে ওখানকার প্রায় ত্রিশ বছরের উত্থান পতনের ইতিহাস। ওখানকার প্রবেশ পথের ব্যাপারে আগে থেকেই না জানা থাকলে কোনোদিনও এই দুই পৃষ্ঠার ম্যাপের মাথামুণ্ডু ধরতে পারত না ও। ধারণা থাকার কারণে, দেখার পর ভালোমতোই মাথায় ঢুকছে দ্বিতীয় পৃষ্ঠার লে আউট। কেবিনের জায়গায় পূর্বে আসলে কি ছিল, সেটা বোঝার চেষ্টা করছে ও। নিশ্চিত নয় যদিও, তবুও ওর মনে হলো ঐ জায়গায় কিছুই ছিল না আগে। শুধু ঘন জঙ্গলে ছেয়ে ছিল জায়গাটা।

প্রথম পাতায় ফিরে গেল ও। নিরাময় কেন্দ্রকে রিসোর্টে রূপান্তরের কাহিনি ছাড়াও ওখানে রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। জোতারো নাগাও, ৫৭ বছর বয়সী ডাক্তার ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, আতামিতে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতেন তিনি। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন এই নিরাময় কেন্দ্রে। সেসময় বয়সে তরুণ ছিলেন, কেবল ইন্টার্ন সম্পন্ন করা একজন। ঐসময় যেসব ডাক্তার সেখানে নিযুক্ত ছিল তাদের মধ্যে শুধুমাত্র বেঁচে রয়েছে নাগাও আর ইয়েজো তানাকা। তানাকা এখন অবসরপ্রাপ্ত। নাগাসাকিতে মেয়ে ও মেয়ের স্বামীর সাথে বসবাস করেন তিনি। নিরাময় কেন্দ্রের হেড সহ আর বাকিসব ডাক্তার-ই বর্তমানে মৃত। ফলে নাগাওয়ের কাছে থেকেই একমাত্র সুযোগ রয়েছে নিরাময় কেন্দ্রের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার। ইয়েজো তানাকার বয়স এখন আশি। আর নাগাসাকি বহুদূরের পথ। যাওয়ার মতো সময় নেই ওদের হাতে। ঐ জায়গার বর্তমানে জীবিত কোনো ব্যক্তির খোঁজ করতে ইয়াশিনোকে তাড়া দিয়েছিল আসাকাওয়া। কিছু না বলে, দাঁতে দাঁত চেপে তথ্য সংগ্রহ করেছে ইয়াশিনো। ফলে পাওয়া গিয়েছে ডক্টর নাগাওয়ের খোঁজ। শুধুমাত্র লোকটার নাম ঠিকানা নয়, তার ক্যারিয়ারের সারাংশও পাঠিয়ে দিয়েছে ইয়াশিনো। সম্ভবত এসব রিসার্চ করে বের করেছে সে। আর অতশত না ভেবেই সবশেষে সংযুক্তি আকারে যোগ করে দিয়েছে তথ্যগুলো। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত নিরাময় কেন্দ্রে ছিলেন ডক্টর নাগাও। কিন্তু পাঁচবছর একটানা ওখানে ডিউটি পালন করেননি তিনি। দুই সপ্তাহের মতো ডাক্তার থেকে রোগীতে পরিণত হয়ে আইসলেশনে চলে যেতে হয় তাকে। সময়টা সংক্ষিপ্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৬ সালে একটা ওয়ার্ডে পর্যবেক্ষণে গিয়ে সতর্ক না থাকার কারণে গুঁটি বসন্তের ভাইরাসের স্বীকার হন। সৌভাগ্যবশত কয়েক বছর আগে টিকা নিয়েছিলেন তিনি সেকারণে বড় কোনো সমস্যা হয়নি। জ্বর বা অসুস্থতা দেখা দেয়নি, শুধুই সামান্য লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল আরকি। কিন্তু বাকিদের সুরক্ষিত রাখতে আইসলেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে। মজার ব্যাপার হলো, এই ঘটনা নাগাওকে জায়গা করে দিয়েছে মেডিকেল ইতিহাসে। জাপানের সর্বশেষ গুঁটি বসন্তের রোগী হচ্ছে নাগাও। অবশ্য গিনেস বুকে নাম ওঠানোর মতো কিছু নয় এটা। তবে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে ইয়াশিনোর কাছে। আসাকাওয়া ও রুজির জেনারেশনে গুঁটি বসন্ত বলে কিছু ছিল না।

“রুজি কখনো তোমার গুঁটি বসন্ত হয়েছে?”

“নির্বোধ। কখনোই না। এটা বিলুপ্ত।”

“বিলুপ্ত?”

“হ্যাঁ। মানবদেহ থেকে সমূলে উৎপাটনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এটার।”

অক্লান্ত চেষ্টা ও ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিরতরে বিলুপ্তি ঘটানোর ব্যবস্থা করেছে গুঁটি বসন্তের। ফলে ১৯৭৫ সাল নাগাদ দুনিয়ার বুক থেকে হারিয়ে যায় ভয়াবহ এই রোগ। রেকর্ড রয়েছে বিশ্বের সর্বশেষ গুঁটি বসন্তে আক্রান্ত রোগীর। একজন সোমালিয়ান কিশোর। ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর আক্রান্ত হয় সে।

“কোনো ভাইরাস কি চিরতরে বিলুপ্ত হতে পারে? এমনটা আদৌও সম্ভব?” ভাইরাসের ব্যাপারে খুব বেশি জ্ঞান নেই আসাকাওয়ার। তবে এটুকু জানে ও, যতই একটা ভাইরাসকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হোক না কেন, কোনো না কোনোভাবে জিন বদলে সামান্য হলেও টিকে থাকে সেটা।

“দেখ, ভাইরাস জড় ও জীব উভয়েই বিচরণ করতে পারে। কিছু বিজ্ঞানীর থিওরি অনুযায়ী এসব বালছাল ভাইরাস মানব জিনের-ই অংশ। কিন্তু কেউ জানে না কোথায় থেকে উৎপত্তি ও জন্ম নেয় এই ভাইরাস। তবে সত্যিটা হলো জীবের সৃষ্টি ও বিবর্তনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ভাইরাসের জীবনচক্র।”

বুকের ওপর হাত জড়ো করে রেখেছে রুজি। চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল তার। “ব্যাপারটা মজার, তাই না আসাকাওয়া? কিছু বিজ্ঞানীর আইডিয়াকে সত্যি ধরে নিলে, বলতে হয় জিনের একটা ক্ষুদ্রাংশ আমাদের দেহকোষ থেকে বেরিয়ে নতুন জীবন ধারণ করে। সম্ভবত দুনিয়ার সকল বিপরীত কিছুই একে অপরের অনুরূপ। আলো ও আধার বিগ ব্যাঙের আগে একত্রে শান্তিতে বসবাস করত। এদের মধ্যে ছিল না কোনো সংঘর্ষ। এমনকি ঈশ্বর ও শয়তানও একে অপরের অনুরূপ। প্রত্যেকটা শয়তান-ই একেকজন পতিত ঈশ্বর, যারা হয়তো পূর্বে ছিল একই সত্ত্বা। আবার পুরুষ ও নারীর কথা ভাবো। যদি এমন হতো, প্রত্যেকটা জীব-ই নপুংসক। যেমন সকল পোকামাকড়। সকল নারীপুরুষ একই জননাঙ্গ বিশিষ্ট। তাহলে কি হতো? তোমার কি মনে হয় না, জীবনে সৌন্দর্য্যের প্রতীক এসবই?” হাসল রুজি। “এমনটা হলে মানুষজনকে সেক্সের জন্য এত সময় নষ্ট ও ঝামেলা করতে হতো না।”

রুজির চেহারার দিকে সরাসরি তাকাল আসাকাওয়া। বোঝার চেষ্টা করল এত মজার কী আছে এতে। নিঃসন্দেহে নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের ভিন্নতা একধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

“পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত আর কোনো ভাইরাস রয়েছে?”

“দেখ, এই ব্যাপারে এত বেশি আগ্রহী হলে টোকিওতে ফেরার পর এটা নিয়ে ভালোমত ঘাঁটাঘাঁটি করবে।”

“আমি ফিরবোই।”

“হেহে। দুশ্চিন্তা কোরো না। তুমি অবশ্যই ফিরবে।”

ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের গন্তব্য ইজু পেনিনসুলায় পৌঁছানোর জন্য ঠিক অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করল উচ্চ গতিসম্পন্ন বোটটি। পৌছাল ওশিমা আর ইতোর মাঝামাঝি অবস্থানে। দ্রুতই আকাশপথে টোকিওতে যেতে পারত ওরা। কিন্তু চাচ্ছিল আতামিতে গিয়ে ডক্টর নাগানোর সাথে দেখা করতে। এজন্য বেছে নিয়েছে জলপথ।

সামনে দেখা যাচ্ছে আতামি কোরাকুয়ানের ফেরিস হুইল। ঠিক ১০ : ৫০ নাগাদ পৌঁছাল ওরা। রাস্তায় নেমে-ই দৌড়ে পার্কিং লটে গেল আসাকাওয়া। রেন্টাল কারটা পার্ক করা সেখানে।

“শান্ত হও ভাই,” বলল রুজি। অলস ভঙ্গিতে হাঁটছে সে। নাগাওয়ের ক্লিনিক কিনোমিয়া স্টেশনের কাছাকাছি। বেশি দূর নয় এখান থেকে। অধৈর্য্যের ভঙ্গিতে তাকিয়ে রুজিকে কারে উঠতে দেখছে আসাকাওয়া। এরপর ওয়ান ওয়ে স্ট্রিট ধরে এগিয়ে গেল আতামির দিকে।

গাড়িতে বসার কিছুক্ষণ পর সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে বলল রুজি, “পুরো ঘটনার পেছনের অশুভ শক্তির কথা ভাবছিলাম।” স্ট্রিট সাইনের দিকে তাকিয়ে ছিল আসাকাওয়া। ফলে জবাব দিতে পারল না ও। বলেই চলল রুজি, “অশুভ শক্তি সবসময়ই ভিন্ন ভিন্ন রূপে হাজির হয়। তেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপের প্লেগের ব্যাপারে জানো? মোট জনসংখ্যার অর্ধেক-ই মারা গিয়েছিল। বিশ্বাস করা যায়? জাপানের অর্ধেক মানুষ মরে গেলে তো জনসংখ্যা ষাট মিলিয়নে নেমে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই সেই আমলে শিল্পীরা প্লেগকে শয়তানের রূপ দিতে পছন্দ করত। এখনও ব্যাপারটা এরকমই, এইডসকে কি আধুনিক শয়তান বলা চলে না? কিন্তু মনে রাখবে, শয়তান কখনো মানবজাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে ফেলে না। কেন? কারণ মানবজাতি যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে তো শয়তানও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভাইরাসের ক্ষেত্রেও কথাটা একই। বাহক কোষ ধ্বংস হয়ে গেলে ভাইরাসেরও অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু মানুষ গুঁটি বসন্তকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। সত্যি? এমনটা কি সত্যি সম্ভব?”

বর্তমানের আধুনিক দুনিয়ায় গুঁটি বসন্তের আতঙ্কের কথা চিন্তা করা অসম্ভব। পৃথিবীর বুকে বিচরণ করে অসংখ্য মানুষকে নির্মম মৃত্যু উপহার দিয়েছে এইটা। গুঁটি বসন্তের ভোগান্তির কারণে জাপান সহ সমগ্র বিশ্বে বৃদ্ধি পেয়েছে অসংখ্য মানুষের ধর্ম বিশ্বাসও। মহামারীর দেবতাকে পূজা করত মানুষজন। ওদের মতে সেই দেবতায় গুঁটি বসন্তকে ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। সম্ভবত বলা উচিত এটা ছড়িয়ে দিয়েছেন শয়তানরূপে। ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়েও কী মানবজাতি ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখতে পেরেছিল? রুজির প্রশ্ন নিঃসন্দেহে-ই জন্ম দেয় অনিশ্চয়তার।

রুজির একটা কথাও শুনছে না আসাকাওয়া। হারামজাদা রুজি এখন এই প্রসঙ্গে এত বকবক করছে কেন, ভাবল ও। এই মুহূর্তে কোনো ভুল পথে চালিত হতে চাচ্ছে না ওর মন। আসাকাওয়ার প্রত্যেকটা স্নায়ু প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে দ্রুত ডক্টর নাগানোর ক্লিনিকে পৌঁছানোর।

অধ্যায় এগারো

কিনোমিয়া স্টেশনের সামনের লেনটা ছোট। সেখানে অবস্থিত একটা একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনের সাইনবোর্ডে লেখা নাগাও ক্লিনিক: মেডিসিন ও শিশু বিশেষজ্ঞ। দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আসাকাওয়া ও রুজি। নাগাওয়ের কাছে থেকে কোনো তথ্য না পেলে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। নতুন লিড খুঁজে বের করার মতো সময় নেই। কিন্তু তার কাছে থেকে কি জানার আছে ওদের? ত্রিশ বছর আগের সাদাকো ইয়ামামুরার ব্যাপারে কিছু মনে রেখেছে সে এমনটা আশা করাও তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। সাউথ হ্যাকনের নিরাময় কেন্দ্রের সাথে সাদাকো ইয়ামামুরার কোনো সম্পর্ক সত্যিই ছিল, এই ব্যাপারে কোনো শক্ত প্রমাণও নেই ওদের হাতে। ইয়েজো তানাকা ব্যতীত নাগানোর সব কলিগ মারা গিয়েছে বৃদ্ধ হয়ে। চেষ্টা করলে ওরা হয়তো কয়েকজন নার্সের নাম মনে করতে পারত, তবে এখন দেরী হয়ে গিয়েছে সেটার জন্য। ঘড়ির দিকে তাকাল আসাকাওয়া। সকাল ১১:৩০ বাজে। ডেডলাইনের দশ ঘণ্টার মতো বাকি আর। আর এখানে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে ইতস্তত করছে ওরা।

“দাঁড়িয়ে কিসের অপেক্ষায় আছে? ভেতরে চল।” তাড়া দিল রুজি। অবশ্যই সেও বুঝতে পারছে তাড়াহুড়ো থাকার পরেও আসাকাওয়ার এমন ইতস্ততবোধের কারণ। আসলে আতঙ্কিত হয়ে আছে ও। বেঁচে থাকার সর্বশেষ আশা ও ভরসাটাও যদি ধ্বসে যায় এই আতঙ্ক। ওর সামনে এসে দরজা খুলল রুজি। ছোট্ট ওয়েটিং রুমের দেয়াল ঘেঁষে একটা কাউচ রাখা। তিনজন বসার মতো যথেষ্ট সেটা। যদিও কোনো রোগী-ই নেই সেখানে এইমুহূর্তে। রেসিপশনিস্টের জানালার কাছে নিচু হয়ে সেখানে বসা মোটা, মাঝবয়স্ক নার্সের সাথে কথা বলল রুজি।

“এক্সকিউজ মি! ডক্টরের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম একটু।”

ম্যাগাজিনের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই বলল নার্স, “অ্যাপয়নমেন্ট করাতে চান নাকি?”

“নাহ, কয়েকটা ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে চাই তাকে।”

ম্যাগাজিন রেখে চশমাটা পড়ে নিল সে, “জানতে পারি কি ব্যাপারে?”

“যেমনটা বললাম, কয়েকটা প্রশ্ন করব শুধু।”

বিরক্ত হয়ে রুজির পেছন থেকে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল আসাকাওয়া, “ডাক্তার আছে না নাই?”

চশমার রিমে স্পর্শ করে দুজনকে পড়ার চেষ্টা করল নার্স।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুজি ও আসাকাওয়া। শুনতে পাওয়ার মতো উচ্চঃস্বরেই বলল রুজি, “এর মতো রেসিপশনিস্ট থাকলে রোগীদের আসার কথাও না।”

“এক্সকিউজ মি?” বলল নার্স।

হতাশায় মাথা নিচু করল আসাকাওয়া; রুজির কথাটা শুনতে পেয়ে ও রেগে ওঠেনি মহিলা। ঠিক তখনই খুলে গেল ডাক্তারের কক্ষের দরজা। বেরিয়ে এসেছে নাগাও। তার পরনে সাদা ল্যাব কোট। পুরোপুরি টাক পড়ে গেছে তার মাথায়। তবুও মনে হলো তার বয়স ৫৭ বছরের কম-ই। ভু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকাল সে।

নাগাওয়ের কণ্ঠস্বর শুনে তার দিকে ঘুরে তাকাল ওরা। তার চেহারা দেখে একসাথে ঢোক গিলল দুজনই।

আর আমরা ভাবছিলাম কিনা এই লোক হয়তো সাদাকোর ব্যাপারে কিছু জানলেও জানতে পারে? ফাইজলামি নাকি!

অদ্ভুত একটা তড়িৎ বয়ে গেল আসাকাওয়ার মস্তিষ্কে। এই মুহূর্তে ভিডিওর সর্বশেষ দৃশ্য রিপ্লে হচ্ছে ওর মাথার ভেতর। ঐ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছিল, কাঁপতে থাকা, ঘর্মাক্ত, চোখ লাল হয়ে যাওয়া এক ব্যক্তি। কাঁধে ছিল কালশিটের দাগ। রক্ত ঝরছিল সেখান থেকে। যা সম্মোহিত করে ফেলেছিল দর্শকের চোখ। আর এটা দেখে বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি হয়েছিল দর্শকের। দৃশ্যের ঐ চেহারায় ছিল খুনে অভিব্যক্তি। আর এখন ওরা চোখের সামনে যা দেখছে, এটাই ছিল দৃশ্যের সেই চেহারা: ডক্টর নাগাও। বর্তমানে বয়স হয়ে গিয়েছে তার। তবে ওদের ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ-ই নেই

দৃষ্টি বিনিময় হলো আসাকাওয়া ও রুজির মাঝে। এরপর ডাক্তারের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল রুজি, “হেহেহে। এসব কারণেই সবসময়ই গেমগুলো ইন্টারেস্টিং হয়। এখানে ছুটে আসার আগে কে ভাবতে পেরেছিল এমন কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?”

তাকে দেখে দুজন অচেনা আগন্তুকের প্রতিক্রিয়ায় স্বাভবিকভাবেই অসন্তুষ্ট নাগাও। উচ্চঃস্বরে বলল সে, “কে আপনারা?” পাত্তা না দিয়েই তার কাছে এগিয়ে গেল রুজি। টেনে ধরল তার কলার। রুজির থেকে কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা নাগাও। শক্ত হাতে কলার টেনে নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসল লোকটার কান। এরপর ভদ্রভাবে বলতে আরম্ভ করল সে।

“জানোয়ারের বাচ্চা, আমাকে এখন বলতো, কি করেছিলি তুই সাদাকো ইয়ামামুরার সাথে, ত্রিশ বছর আগে, নিরাময়কেন্দ্র?”

শব্দগুলো ডাক্তারের মগজে গেথে যেতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। নার্ভাস ভঙ্গিতে চারিদিকে তাকাচ্ছে নাগাও। মনে হলো স্মৃতি হাতরাচ্ছে সে। এরপরই ভেসে উঠল সেই স্মৃতি, সেসব দৃশ্য যা তার পক্ষে ইহ জীবনে ভোলা সম্ভব নয়। দুর্বল হয়ে পড়েছে তার কনুই। মনে হলো দেহ থেকে সব শক্তি বেরিয়ে গেছে তার। জ্ঞান হারানোর আগেই তাকে টেনে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরল রুজি। শুধুমাত্র স্মৃতিগুলো মনে পড়ে শকে চলে যায়নি নাগাও। বরং এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়ানো লোকদুটি, যাদের বয়স ত্রিশ কিনা সন্দেহ, ওরা জানে ঘটেছিল আসলে। এই ভাবনা-ই অজানা এক আতঙ্কে কাঁপিয়ে তুলেছে তাকে।

“ডক্টর!” বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল নার্স ফুজিমুরা।

“মনে হয় লাঞ্চের বিরতির জন্য বন্ধের সময় হয়ে গেছে,” আসাকাওয়াকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল রুজি। প্রবেশের দরজা টেনে দিল আসাকাওয়া। যাতে কোনো রোগী প্রবেশ করতে না পারে।

“ডক্টর!” কীভাবে পরিস্থিতি সামলাবে বুঝতে পারছে না নার্স ফুজিমুরা। নির্বোধের মতো নাগাওয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছে সে। কোনোমতে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে নাগাও। ভাবছে কি করবে। যদিও এত চিন্তাভাবনা করেও কি ঘটতে চলেছে সেটা এই নির্বোধ মহিলাকে বোঝানোর উপায় পেল না। নীরব অভিব্যক্তি প্রকাশ করল সে।

“নার্স, আপনি এখন ব্রেক নিতে পারেন। গিয়ে কিছু খেয়ে আসুন।”

“কিন্তু ডক্টর…”

“যা বললাম তাই করুন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।“

প্রথমে দুজন লোক এলো, এরপর ফিসফিস করে কিছু একটা বলল ডক্টরের কানের কাছে মুখ নিয়ে, এরপর জ্ঞান হারাতে বসেছিল ডক্টর। এহেন পরিস্থিতিতে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না নার্স। ফলে কয়েক মুহূর্ত হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। চিৎকার করে উঠল ডক্টর।

“এখনই যান!” আক্ষরিক অর্থেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে।

“তাহলে জনাব এখন বলুন, শুনি, কি বলার আছে আপনার। ভেতরের ঘরটায় প্রবেশ করল রুজি। তাকে অনুসরণ করল ডাক্তার। তাকে দেখতে লাগছে সদ্য ক্যান্সার ধরা পড়া রোগীর মতো।

“শুরুতেই বলে রাখছি, মিথ্যে বলার চেষ্টা করবেন না। আমি আর এই ভদ্রলোক কিন্তু সবকিছু জানি, নিজ চোখে দেখেছি সবকিছু।

“কি…” দেখেছে মানে? কি বলছে শালারা? চারিদিকে ঘন জঙ্গল ছিল। কেউ ছিল না আশেপাশে। আর বলাই বাহুল্য দুজনের বয়সও অনেক কম। সেসময় হয়তো ওদের বয়স ছিল মাত্র..ভাবল ডাক্তার।

“বুঝতে পারছি, কেন আমার কথা বিশ্বাস করতে এত কষ্ট হচ্ছে আপনার। কিন্তু আপনার চেহারা আমরা দুজনেই খুব ভালোমত চিনি।” হঠাৎ করেই কণ্ঠস্বর বদলে গেল রুজির। “আপনার দেহের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে বলবো? আপনার ডান কাঁধে এখনও কালশিটের দাগ রয়েছে, তাই না?”

বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেছে নাগাওয়ের। ঝুলে পড়ল তার চোয়াল। একমুহূর্ত থেমে বলল রুজি, “বলবো, কেন আপনার কাঁধে ঐ কালশিটে পড়েছে?” রুজি সামনে এগিয়ে তার কাঁধের কাছে নিয়ে গেল নিজের মুখ। “সাদাকো ইয়ামামুরা কামড় বসিয়েছিল এখানে, তাই না? ঠিক এভাবে।” মুখ হা করে কামড় দেয়ার অভিনয় করল রুজি। কাঁপুনি বেড়ে গেছে নাগাওয়ের। অস্থিরচিত্তে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে সে। কিন্তু একটা শব্দও বের হলো না তার মুখ থেকে।

“আশা করি আমার পয়েন্টটা ধরতে পেরেছেন। যেগুলো বললাম, সেগুলোই আমাদের রিপিট করবেন না। সাদাকো ইয়ামামুরার কি হয়েছিল, এই ব্যাপারে সবকিছু জানতে চাই আমরা।”

যদিও কিছু ভাবার মতো অবস্থায় নেই নাগাও, তবুও তার মনে হলো ফাঁক আছে রুজির কথায়। রুজি বলেছিল সবকিছু দেখেছে ওরা। সবকিছু যদি দেখেই থাকে, তাহলে ডাক্তারের মুখ থেকে শুনতে যাবে-ই বা কেন?

দাঁড়াও, পুরো ব্যাপারটা হলো, ওরা যা দেখেছে সেটা খুবই সামান্য। সম্ভবত কিছুই দেখেনি ওরা। সেসময় হয়তো জন্মই হয়নি ওদের। তাহলে কি হচ্ছে এসব? কি দেখার কথা বলছে ওরা?

যতই ভাবল ততই সবকিছু এলোমেলো লাগল ডাক্তারের। মনে হচ্ছে ফেঁটে যাবে মাথাটা।

“হে, হে, হে,” হেসে আসাকাওয়ার দিকে তাকাল রুজি। লোকটার চোখ-ই সাক্ষ্য দিচ্ছে সবকিছুর। এভাবে ভয় দেখালেই সব পরিষ্কার বলে দিবে ব্যাটায়। যেকোনো কিছুই বলবে সে, ভাবল রুজি।

আর কথা বলাও আরম্ভ করল নাগাও। ঐসময় ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল সে নিজেও, ফলে পুরো ঘটনায় স্পষ্ট মনে আছে তার। কথা বলার সময় মনে হলো সেদিনের স্মৃতি মনে পড়ে উত্তেজনায় কাঁপছে তার দেহ। মনে পড়ছে সেই আবেগ, সেই স্পর্শ, সাদাকোর উজ্জ্বল ত্বক, পাখির ডাক, ঘাসের ঘ্রাণ, ঘর্মাক্ত দেহ আর পুরোনো কুয়া …

“আমি নিজেও জানিনা কীভাবে ঘটে গেছিল এসব। সম্ভবত জ্বর মাথাব্যথায় আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। এগুলো ছিল গুঁটি বসন্তের প্রাথমিক লক্ষণ। মানে তখন ইনকিউবেশন পিরিয়ডটা পার করেছি কেবল। কিন্তু কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এই রোগে আক্রান্ত হবো আমি। সৌভাগ্যবশত, আমার দ্বারা ওখানকার আর কেউ আক্রান্ত হয়েছিল না। যদি কোনো যক্ষ্মা রোগী শুঁটি বসন্তেও আক্রান্ত হয় তাহলে কি হতো সেটা ভেবে এখনো আতঙ্কিত হই আমি। ঐদিন বেশ গরম পড়েছিল। নতুন এক রোগীর টোমোগ্রাম পরীক্ষা করে দেখছিলাম আমি। তার ফুসফুসে পয়সার সমান একটা ফুটো দেখতে পেলাম। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এক বছরের জন্য আমাদের ওখানে ভর্তি হওয়ার নির্দেশ দিলাম তাকে। ডায়াগনোসিসের একটা কপিও দিলাম, যেন কোম্পানিকে দেখাতে পারে। আর সহ্য হচ্ছিল না আমার। বাইরের বেরুতেই হতো। কিন্তু পাহাড়ের নির্মল বাতাসে শ্বাস নিয়েও কমল না আমার মাথা যন্ত্রণা। ফলে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওয়ার্ডের পাশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাতে বাগানের শেডে বসে একটু বিশ্রাম করতে পারি। তখন দেখতে পেলাম এক তরুণী বসে রয়েছে গাছের সাথে হেলান দিয়ে। তার দৃষ্টি মাটির দিকে। আমাদের কোনো রোগী নয় সে। সে আমাদের একজন রোগীর মেয়ে। ঐ রোগী আমি আসার আগে থেকেই ভর্তি ছিল এখানে। তার নাম ছিল হিহাচিরো ইকুমা, তাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আর মেয়েটার নাম সাদাকো ইয়ামামুরা। নামটা স্পষ্ট মনে আছে আমার। কেননা তার বাবার নামের চেয়ে ভিন্ন ছিল তার নামের পদবী। মাসখানেক ধরে বেশ কয়েকবার নিরাময়কেন্দ্রে যাওয়া আসা করছিল সে। কিন্তু বাবার সাথে সময় কাটাত না বেশি। এমনকি বাবার শারীরিক অবস্থার ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করত না ডাক্তারদের। যতদূর মনে হয়, নির্মল দৃশ্য উপভোগের জন্যেই আসত সে। তো তার পাশে বসে হাসলাম ও তার বাবার খবরাখবর জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিন্তু মনে হলো বাবার অসুস্থতা নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ-ই নাই তার। অপরদিকে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সে জানে বেশিদিন বাঁচবে না তার বাবা। তার কথা বলার ধরন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল সেটা। কয়েকদিনের মধ্যেই তার বাবা যে নিশ্চিত মরবে সেটা কোনো কোয়ালিফাইড ডাক্তারের থেকেও ভালোভাবে জানত সে।

ওভাবে তার পাশে বসে, তার জীবন ও পরিবার নিয়ে কথা বলার সময় আমার মাথা ব্যথার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠলাম আমি। অসহ্যকর ব্যথাটা নেই। তবে সেটার পরিবর্তে জ্বরের সাথে অন্যরকম এক উত্তেজনা অনুভব করলাম। জীবনীশক্তি টের পাচ্ছিলাম নিজের মধ্যে। মনে হচ্ছিল যেন রক্তের গরম বেড়ে গিয়েছে। তার চেহারার দিকে তাকালাম আমি। বরাবরের মতো অনুভব করলাম, এত সুন্দর চেহারার বৈশিষ্ট্যের এই রমণী পৃথিবীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা জানা ছিল না আমার। তবে ডক্টর তানাকা, বয়সে আমার থেকেও বিশ বছরের বড়, তিনিও তার ব্যাপারে এরকমটা অনুভব করতেন। তার মতে, সাদাকো ইয়ামামুরার মতো এত সুন্দর আর কাউকে জীবনে দেখেননি তিনি। জ্বরের কারণে শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল আমার। কোনোভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সাদাকোর কাঁধে আলতো স্পর্শ করে বলেছিলাম, ‘চলো কোথাও বসে ঠান্ডাভাবে কথা বলা যাক। শেডের ওখানে চলো।”

কোনো কিছুই সন্দেহ করেনি সে। নড করে উঠে দাঁড়াতে আরম্ভ করেছিল সাদাকো। নিচু হওয়ার কারণে তার ব্লাউজের ভেতর দিয়ে, সুন্দর ধবধবে সাদা স্তনে চোখ যায় আমার। এত সাদা ছিল ওগুলো, কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছিল আমার দৃষ্টি। আর এই কারণেই হয়তো আমি আর আমি ছিলাম না।

আমার লালসা বিন্দুমাত্র টের পায়নি সে। নিচু হয়ে স্কার্টের ময়লা ঝাড়ছিল কেবল। তার অঙ্গভঙ্গি ছিল নিষ্পাপ ও আদুরে।

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম গভীর বনের দিকে। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। কোথায় যাব সেটা ঠিক করেছিলাম না, তবে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় দিকেই এগিয়ে চলেছিল আমার পা। ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম আমি। খুলে ফেললাম শার্ট। পরনে তখন কেবলই একটা আন্ডার শার্ট। একটা পশুর চলার পথ অনুসরণ করে এগোচ্ছিলাম আমরা। অবশেষে থামলাম একটা পুরানো বাড়ির সামনে গিয়ে। কমপক্ষে দশ বছর ধরে ওখানে থাকে না কেউ। নষ্ট হয়ে গিয়েছে দেয়ালগুলো, আর ছাদ দেখে মনে হচ্ছিল ভেঙে পড়বে যেকোনো সময়। ঐ ভূতুড়ে, ভাঙাচোরা বাড়ির পাশে ছিল একটা কূপ। ওটা দেখার পর দৌড়ে সেখানে চলে গেল সে, ‘উফ, খুবই তেষ্টা পেয়েছে।’ নিচু হয়ে দেখতে লাগল সে। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল পরিত্যক্ত কূপ ওটা। আমিও দৌড়ে গেলাম কুয়োর পাশে। তবে ওটা দেখার জন্য নয়। আমি গেছিলাম উপুড় হয়ে থাকা সাদাকোর বুক দেখতে। কুয়োর প্রান্তে দুই হাত রেখে ভালোমতন দেখতে চাচ্ছিলাল তার বুক। কুয়োর ভেতরে থেকে ভেসে আসা বদ্ধ, ঠান্ডা বাতাস অনুভব করছিলাম আমি। বদ্ধ, অন্ধকার কুয়ো থেকে এক ধরনের আবহ শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল আমার চেহারায়। তবে সেটা আমার ভেতরকার কামনা স্তিমিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমি জানিনা কোথায় থেকে উৎপত্তি হয়েছিল এই কামনা। তবে এখন মনে হয় গুঁটি বসন্তের জ্বরের কারণে হারিয়ে গিয়েছিল আমার স্বাভাবিক মেকানিজম। কসম কেটে বলছি, ওরকম অনুভূতি আর জীবনেও হয়নি আমার।

নিজেকে আবিষ্কার করলাম তার বুকে হাত দেয়া অবস্থায়। একটা তাড়না কাজ করছিল আমার ভেতরে। এরপরের আমার সব স্মৃতি ঝাপসা। ভাঙা ভাঙা ভাবে মনে পড়ে সব দৃশ্য। মাটির সাথে ঠেসে ধরলাম সাদাকোকে। উঁচিয়ে তুললাম তার ব্লাউজ আর এরপর… যদ্দুর মনে পড়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল সে বাঁচার, কামড় বসিয়েছিল আমার কাঁধে। কামড়ের ব্যথাতেই হুঁশ ফিরে আসে আমার। কাঁধের ক্ষতস্থান থেকে তার মুখের ওপর রক্ত ঝরতে দেখি আমি। তার চোখের ওপরেও পড়েছিল রক্ত, আচমকা মাথা ঝাঁকায় সে। আমিও নিজেকে এডজাস্ট করে নিই ঐ ছন্দের সাথে। কেমন দেখাচ্ছিল আমার চেহারা তখন? কি দেখেছিল আমার চেহারায় সে? নিশ্চিতভাবেই কোনো হিংস্র পশুকে। সবশেষে এমনটাই মনে হয়েছিল আমার। শেষ হওয়ার পর আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সে। শোয়া অবস্থাতেই কোনোমতে কনুই উঁচিয়ে, দক্ষতার সাথে কনুইয়ে ভর করে পিছিয়ে গিয়েছিল সে। আবারও তার দেহের দিকে তাকিয়েছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল নিজের চোখ-ই ধোঁকা দিয়েছে আমাকে। কোমরের ওপর উঠে ছিল তার কুঁকড়ে যাওয়া স্কার্ট। নিজের বুক ঢাকার কোনোরকম চেষ্টায় করছিল না সে। সূর্যের এক চিলতে আলো পড়ছিল তার নগ্ন উরুর ওপর। ঐ আলোয় দেখা যাচ্ছিল একটা ছোট্ট, কালো মাংসপিণ্ড। আমি তার সুন্দর বুকের দিকে নজর ফেরালাম। এরপর আবারও তাকালাম নিচের অংশে। তার লোমে ঘেরা মাংসপিণ্ডের নিচে ঝুলছিল একজোড়া প্রাপ্তবয়স্ক অণ্ডকোষ।

ডাক্তার না হলে হয়তো সেটা দেখেই ফিট খেয়ে পড়ে যেতাম। কিন্তু মেডিকেল টেক্সট ও ফটোর কল্যাণে এইধরনের কেসের ব্যাপারে জানা ছিল আমার।

একে টেস্টিকুলার ফেমিনিজেশন সিন্ড্রোম বলে। অতি বিরল একটা সিন্ড্রোম এটা। পাঠ্যবইয়ের বাইরে নিজের চোখে, এরকম পরিস্থিতিতে এমন কিছু দেখব জীবনেও ভাবতে পারিনি। টেস্টিকুলার ফেমিনিজেশনে এক লিঙ্গের মানুষের জননাঙ্গ বিপরীত লিঙ্গের মতন হয়ে থাকে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, তাদের বাকিদের মতোই স্তন, যোনি থাকে, তবে থাকে না কোনো জরায়ু। ক্রোমোজোম অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি ঢণ, মানে পুরুষ আরকি। আর কিছু কারণে এরকম কেসের ব্যক্তিরা অতিরিক্ত সুন্দর হয়।

তখনও আমার দিকে চেয়ে ছিল সাদাকো।

আমি-ই সম্ভবত তার পরিবারের বাইরে প্রথম কেউ, যে তার এই অবস্থার কথা জানে। বলা বাহুল্য, কয়েক মিনিট আগেও কুমারী ছিল সে। মেয়ে হিসেবে বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা সেটার ট্রায়াল বলা চলে। আসলে এসব ভেবে আমি নিজের কাজকে বৈধতা দিতে চাচ্ছিলাম আরকি। তখনই হঠাৎ করে মাথার ভেতরে কয়েকটা শব্দ শুনতে পেলাম আমি।

“খুন করে ফেলবো তোমাকে।”

কথাটার পেছনের প্রবলতা অনুভব করার পর তৎক্ষণাৎ মনে হলো, সত্যিই টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা রয়েছে তার। এই ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ-ই নেই। এটাকে নিশ্চিত বলেই ধরে নিয়েছিল আমার দেহ। মনে হচ্ছিল, আমাকে খুন করে ফেলবে সে, যদি না তাকে আমি খুন না করে ফেলি। নিজেকে রক্ষার খাতিরে আদেশ পাচ্ছিলাম আমার দেহের ভেতর থেকেই। তার ওপর চড়ে, তার গলায় দুহাত রাখলাম আমি। এরপর চাপ দিলাম সর্বশক্তি দিয়ে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সামান্যই বাঁধা দিল সে এবার। সন্তুষ্টির সাথে চোখ সরু করে রিল্যাক্স করে ফেলল নিজের দেহকে। মনে হচ্ছিল যেন, মারা যেতেই চায় সে।

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে কিনা সেটা দেখার জন্য থামলাম না। আমি তার দেহ উঠিয়ে নিয়ে গেলাম কুয়োর কাছে। সম্ভবত তখন আমার কাজকর্ম আমার ইচ্ছাধীন ছিল না। অন্যভাবে বললে, আমি নিজে তাকে উঠিয়ে নিয়ে কুয়োর মধ্যে ফেলতে চাইনি, কুয়োর অন্ধকার মুখ যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। বারবার বলছিল কাজটা করতে। মনে হচ্ছিল, সবকিছু যেন ঘটছে নিখুঁতভাবে। যেন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে একেবারে অচেনা কোনো সত্ত্বা। তবে কি হতে চলেছে এই ব্যাপারে স্বাভাবিক ধারণা ছিল আমার। মাথার ভেতরে একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, বলা হচ্ছিল দুঃস্বপ্ন এসব।

অন্ধকার ছিল কুয়োটা। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে থেকে এর তলা দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। তবে গন্ধ শুঁকে মনে হচ্ছিল তলায় কিছুটা হলেও পানি রয়েছে। দেহটা ছেড়ে দিলাম। কুয়োর একপাশে পড়ে গেল সাদাকোর দেহ। শব্দ হলো পড়ার পর। কুয়োর অন্ধকারে চোখ সয়ে না আসা পর্যন্ত কুয়োর দিকেই তাকিয়ে থাকলাম আমি। কিন্তু তার নড়াচড়ার আভাস পেলাম না। যদিও তখনও কাটছিল না আমার অস্বস্তি। কুয়োর ভেতরে আবর্জনা আর পাথর ফেলে চিরজীবনের মতো তার দেহ ঢেকে দিতে চাচ্ছিলাম আমি। পাথরের টুকরো গিয়ে আঘাত হানছিল তার দেহে, কুয়োর তলায় সৃষ্টি করছিল অদ্ভুত শব্দের, ততই আলোড়িত হচ্ছিল আমার কল্পনা। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম, ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যাচ্ছে তার সৌন্দর্য্যে মোড়ানো দেহটা। এর বেশি কিছু ভাবতে পারছিলাম না আর। যদিও এর কোনো অর্থ নেই। একদিকে আমি চাচ্ছিলাম তার দেহটা ধ্বংস করে দিতে, অপরদিকে চাচ্ছিলাম যেন কোনো ক্ষতি না হয় তার দেহের।”

নাগাওয়ের কথা বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার হাতে সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ডের ম্যাপ ধরিয়ে দিল আসাকাওয়া।

“কুয়োটা কোথায় ছিল, ম্যাপে অবস্থানটা দেখান?” দ্রুত জানতে চাইল আসাকাওয়া। কি দেখানো হয়েছে সেটা বুঝতে একটু সময় নিল নাগাও। তবে এরপর সে জানাল, নিরাময়কেন্দ্রের জায়গাতে এখন নির্মাণ করা হয়েছে রেস্তোরা। আবারও স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে নাগাও।

“আমার মনে হয় এখানে ছিল জায়গাটা,” ম্যাপে জায়গাটা নির্দেশ করে দেখাল সে।

“কোনো সন্দেহ নাই, এখানেই ভিলা লগ কেবিন এখন,” উঠে দাঁড়িয়ে বলল আসাকাওয়া। “চলো যাওয়া যাক।”

কিন্তু শান্ত হয়ে রইল রুজি। “তাড়াহুড়ো করো না। এই বুড়ো ভামকে আরও কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমার। যে সিন্ড্রোমের কথা উল্লেখ করলেন…

“টেস্টিকুলার ফেমিনিজেশন সিন্ড্রোম।”

“এই রোগের নারীরা গর্ভধারণ করতে পারে?”

মাথা নাড়ল নাগাও। “না, পারে না।”

“আরেকটা কথা, সাদাকো ইয়ামামুরাকে যখন ধর্ষণ করলেন ততদিনে গুঁটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন আপনি, ঠিক?”

মাথা নেড়ে সায় জানাল নাগাও।

“সেক্ষেত্রে, জাপানের সর্বশেষ শুঁটি বসন্তের রোগী সাদাকো ইয়ামামুরা, তাই না?”

নিশ্চিতভাবেই মৃত্যুর আগমুহূর্তে সাদাকো ইয়ামামুরাও আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল গুঁটি বসন্তের ভাইরাস দ্বারা। কিন্তু তখনই মরতে হয় তাকে। পালক মারা গেলে ভাইরাসও বেঁচে থাকতে পারে না। কি জবাব দেবে ঠিক করতে পারল না নাগাও। রুজির দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখল সে। তার জবাব অস্পষ্ট।

“হেই? করছ টা কী? যেতে হবে তো আমাদেরকে!” ডোরওয়েতে গিয়ে রুজিকে তাড়া দিল আসাকাওয়া।

“বাল যত্তসব! আশা করি সুখে থাকবেন।” ডাক্তারের নাকে টোকা মেরে বলল রুজি। এরপর অনুসরণ করল আসাকাওয়াকে।

অধ্যায় বারো

যুক্তি দিয়ে বিচার না করা গেলেও বিভিন্ন উপন্যাস ও উদ্ভট সব টিভি শো দেখার কারণে ও জানে কীভাবে সাজানো থাকে এসব ধাঁধার প্লট। যেভাবে কাহিনি এগিয়ে চলেছে ওর মনে হচ্ছে এক্ষেত্রেও সমাধানটা একই। রয়েছে রহস্য উন্মোচনের একটা নির্দিষ্ট ধারা। আসলে সাদাকো ইয়ামামুরার দেহ লুকানো স্থলের খোঁজে ছিল না ওরা। কিন্তু ভাগ্য তাকে যেখানে ছুঁড়ে ফেলেছে, যেখানে অনাকাঙ্খিত কবর হয়েছে সাদাকোর, তার চোখের পলক ধারণ করেছে সেখানের দৃশ্যটা-ই।

রুজি যখন বলল, “হার্ডওয়্যারের দোকানের সামনে থামবে।” স্বস্তিবোধ করেছিল আসাকাওয়া। রুজিও আমার মতো একই জিনিস-ই ভাবছে, মনে হয়েছিল ওর। কত কঠিন আর অসম্ভব কাজ পড়ে রয়েছে সামনে, ভাবতেও পারছে না আসাকাওয়া। সম্পূর্ণ ভরাট না করা হয়ে থাকলে ভিলা লগ কেবিনের আশেপাশে পরিত্যক্ত কুয়ো খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে না। আর কুয়ো খুঁজে পাওয়ার পর সাদাকো দেহাবশেষ বের করা সহজ-ই হওয়ার কথা। খুবই সাধারণ একটা কাজ। সাধারণ হিসেবেই ভাবতে চাইল ও। দুপুর একটা বাজে। রিসোর্টে যাওয়ার পাহাড়ি রাস্তায় মাথার ওপরে কিরণ দিচ্ছে সূর্য। উজ্জ্বল দিন, আর উইক ডে হওয়ার কারণে ফুরফুরে মেজাজেই রয়েছে আশেপাশের এলাকার মানুষজন। এমনটা মনে হলো আসাকাওয়ার।

কুয়োটা চার অথবা পাঁচ ফিট গভীর হলেও, বাইরের উজ্জ্বল দুনিয়ার থেকে এর ভেতরের দুনিয়াটা সম্পূর্ণ-ই আলাদা, অচেনা, এটা মাথায় আসল না ওর।

নিশিযাকি হার্ডওয়্যার। সাইনবোর্ড দেখে ব্রেক কষল আসাকাওয়া। মই, হাতুড়ি, ড্রিল সারি করে সাজানো দোকানের সামনে। যা যা দরকার ওদের সবই এখানে পাওয়ার কথা।

“যা যা লাগে কিনে নাও,” সামনের ফোনবুথের দিকে এগিয়ে বলল আসাকাওয়া। ওয়ালেট থেকে ফোনকার্ড বের করার জন্য থামল ও।

“ফোন কল করে সময় নষ্ট করার মতো সময় নাই আমাদের।” কিন্তু শুনল না আসাকাওয়া। ফুঁসে উঠে দোকানের দিকে এগিয়ে গেল রুজি। দড়ি, বেলচা, পুলি, বালতি আর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্ল্যাশলাইট কিনল সে। মরিয়া হয়ে আছে আসাকাওয়া। হয়তো এটাই ওদের সাথে বলা শেষ কথা হবে। নষ্ট করার মতো কত কম সময় আছে ওর, সে ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত ও। ডেডলাইনের বাকি মাত্র নয়ঘণ্টা। ফোনে কার্ড রেখে আশিকাগায় স্ত্রীর বাপের বাড়ির নম্বর ডায়াল করল ও। ফোন ধরেছে ওর শ্বশুর।

“হ্যালো, আসাকাওয়া বলছি। শিজু আর ইয়োকোকে ডেকে দেবেন একটু?” কুশল বিনিময় না করাটা অভদ্রতা হয়ে গেছে, বুঝতে পারল ও। কিন্তু এসব নিয়ে চিন্তা করার মতো সময় নেই এখন। ওর শ্বশুর কিছু একটা বলতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে মেয়ে ও নাতনিকে ডেকে দিল সে। শ্বাশুড়ি ফোন ধরেনি দেখে আনন্দিত হয়েছে আসাকাওয়া। মহিলা ফোন ধরলে একটা কথা বলার সুযোগও পেত না ও।

“হ্যালো?”

“শিজু, তুমি বলছ?” কণ্ঠস্বর শুনে ইতোমধ্যেই তাকে মিস করতে আরম্ভ করেছে আসাকাওয়া।

“কোথায় তুমি?”

“আতামিতে। ওখানে কি অবস্থা?”

“ওহ, একই। নানা নানীর সাথে ভালো সময় কাটছে ইয়োকোর।”

“ও কি পাশেই আছে?” বাচ্চার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে ও। কোনো কথা নয় অবশ্য। মনে হলো মায়ের কোলে ওঠার চেষ্টা করছে সে।

“ইয়োকো, বাবা ফোন দিয়েছে।” তার কানে ফোন ধরল শিজু। “বাবাহ বাবাহ,” কোনোমতে শুনতে পেল শব্দ দুটো। যদি ওগুলো কোনো শব্দ হয়ে থাকে তবে। এটুকুই, এরপর শুধু শোনা গেল তার নিঃশ্বাসের অথবা গালের সাথে মাউথপিস ঘষার শব্দ। কিন্তু ওটুকু আওয়াজ শুনেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল ওর। সবকিছু ছেড়েছুড়ে ফিরে এসে তাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছাটা সামলে নিয়েছে ও।

“ইয়োকো, সোনা আমার, তুমি ওখানেই অপেক্ষা করো, আচ্ছা? বাবা খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বেড়াতে নিয়ে যাবে তোমাকে।”

“সত্যি? কখন ফিরছ তুমি?” ও বুঝে ওঠার আগেই ফোন নিজের কানে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল শিজু।

“রবিবার রাতে। কার রেন্ট নিয়ে আসবো। সবাই মিলে পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে যেতে পারব তাহলে। নিক্কন বা অন্য কোথাও।“

“সত্যি? দারুন না ইয়োকো? বাবা ঘুরতে নিয়ে যাবে আমাদেরকে।”

কান জ্বলছে আসাকাওয়ার। সত্যি এরকম কোনো কথা দেয়ার মতো অবস্থায় আছে ও? রোগীদের মিথ্যে আশ্বাস দেয়ার জন্য ডাক্তাদের কখনো দোষারোপ করা হয় না। ওদেরকেও এমন কিছু বলা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওর, প্রাথমিক ভয়টা কাটানোর জন্য হলেও।

“মনে হচ্ছে ঝামেলাটা থেকে বেরিয়ে আসার পথ বের করতে পেরেছ।”

“ওরকম-ই কিছু।”

“কথা দিয়েছিলে, ঝামেলা মিটে গেলে এই ব্যাপারে শুরু থেকে সবকিছু খুলে বলবে আমাকে।”

এমনটা কথাও দিয়েছিল ঠিকই। বিনিময়ে শর্ত ছিল সেসময় জিজ্ঞেস করা যাবে না কিছু। ঝামেলা মিটলে নিজেই খুলে বলবে সব। শর্ত পূরণ করেছে ওর স্ত্রী।

“আর কতক্ষণ কথা বলবে ভাই?” পিছন থেকে তাড়া দিল রুজি। ঘুরে তাকাল আসাকাওয়া। গাড়ির ট্রাংক খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। ট্রাংক ভর্তি যন্ত্রপাতি।

“আবার কল দিব। আজ রাতে সম্ভব হবে না যদিও।” হুকের ওপর হাত রাখল আসাকাওয়া। চাপলেই কেটে যাবে কল।

কেন কল দিয়েছিল, জানা নেই ওর। শুধুমাত্র ওদের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য নাকি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার ছিল ওদেরকে? কিন্তু ঘণ্টাখানেক কথা বললেও এখনকার মতো একই শূন্য অনুভূতি হতো, জানা আছে আসাকাওয়ার। মনে হলো, যা বলতে চেয়েছিল তার অর্ধেকটাই বলতে পেরেছে কেবল। হুক চেপে লাইনটা কেটে দিল ও। যেটাই ঘটুক, আজ রাত দশটার মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আজ রাত দশটা…

দিনের বেলা এই সময়ে সাধারণ-ই দেখাচ্ছে সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ডকে। যে অস্বস্তিকর অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল শেষবার, সেটা ঢাকা পড়ে গেছে সূর্যালোকের আড়ালে। এমনকি স্বাভাবিক শোনাচ্ছে টেনিস বলের আওয়াজও। আগের মতো ভয়ানক বা গমগমে লাগছে না। কুয়াশাচ্ছন্ন, সাদা দেখাচ্ছে মাউন্ট ফুজিকে। এর নিচের বাড়িগুলোর চালের ওপর ঠিকরে পড়ছে সূর্যালোক।

উইক ডে বিকালবেলা হওয়ার কারণে ফাঁকা হয়ে আছে ভিলা লগ কেবিন। মনে হলো উইকেন্ড আর সামার ভ্যাকেশন ছাড়া ফাঁকাই পড়ে থাকে জায়গাটা। আজও ফাঁকা বি-৪। রুজিকে চেকইন করতে দিয়ে গাড়ি থেকে যন্ত্রপাতি নামাতে গেল আসাকাওয়া। এরপর হালকা পোশাক পরে নিল ও। তাকাল ঘরটার চারিদিকে। এক সপ্তাহ আগে এই ঘরেই সৃষ্টি হয়েছিল ভূতুড়ে আবহ। দৌড়ে বাথরুমে যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ল ওর। অবস্থা হয়েছিল ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে দেয়ার মতো। প্রায় স্পষ্টভাবেই মনে আছে বাথরুমের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসার পর দেখা গ্রাফিতির কথা। বাথরুমের দরজা খুলল ও। আগের জায়গাতেই রয়েছে গ্রাফিতি।

দুপুর দুটো বেজে পার হয়েছে কেবল। ব্যালকনিতে বসে আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে করতে সাথে করে নিয়ে আসা বক্স লাঞ্চ খেল ওরা। নাগাওয়ের ওখান থেকে ফেরার পর খিটখিটে মেজাজের উন্নতি হয়েছে ওদের। অন্তরের ভয়ানক আতঙ্ক থাকা সত্ত্বেও ওরা কাটাচ্ছে এরকম ছন্নছাড়া মুহূর্ত। সময়ও যেন বইছে ধীরে। কখনো কখনো এরকম হয়। মাঝেমধ্যে প্রতিবেদন তৈরির ডেডলাইনের তাড়া থাকা সত্ত্বেও অলসভাবে কফি মেকার থেকে কফির ফোঁটা পড়তে দেখে আসাকাওয়া। পরে টের পায়, কি দারুনভাবেই না সময়টা নষ্ট করেছে ও।

“খেয়ে নাও। আমাদের শক্তি দরকার,” বলল রুজি। নিজের জন্যেই দুই প্যাকেট লাঞ্চ কিনেছে সে। এদিকে নিজেকে খুব বেশি ক্ষুধার্ত মনে হলো না আসাকাওয়ার। একটু পরপরই চপস্টিক নামিয়ে কেবিনের দিকে তাকিয়ে থাকছে ও।

হঠাৎ করেই বলে উঠল আসাকাওয়া। যেন এখনই মনে পড়েছে কথাটা। “খোলাখুলি কথা বলা উচিৎ আমাদের। এখানে আসলে করবো টা কি আমরা?”

“অবশ্যই সাদাকোর খোঁজ চালাব।”

“আর তাকে পাওয়ার পর কি করব?”

“সাসিকিজিতে নিয়ে গিয়ে দেহাবশেষ দাফন করে দিব।”

“তাহলে এটাই সমাধান। তোমার মতে, এমনটাই চায় সে?”

কিছুক্ষণ মুখভরা খাবার চিবুতে থাকল রুজি। তার দৃষ্টি সামনে, অসীমের দিকে। সেও এই ব্যাখ্যায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়, চেহারা দেখেই বুঝল আসাকাওয়া। আতঙ্কিত বোধ করছে আসাকাওয়া। এটাই শেষ সুযোগ ওর। ঠিক পথেই রয়েছে ওরা অন্তত এটুকু নিশ্চয়তা চাচ্ছে ও। পাওয়া যাবে না দ্বিতীয় কোনো সুযোগ।

“এরচেয়ে বেশি আর কিছুই করার নেই আমাদের,” লাঞ্চবক্স ছুঁড়ে ফেলে বলল রুজি।

“হয়তো যে তাকে খুন করেছে, তাকে দিয়েই কোনোভাবে সন্তুষ্ট করা যাবে সাদাকোকে। এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কেমন?”

“জোতারো নাগাওয়ের কথা বলছ? মানে বলতে চাচ্ছ, আমরা তার মুখোশ টেনে খুললে সন্তুষ্ট হবে সাদাকো?”

রুজির চোখের দিকে তাকাল আসাকাওয়া। বোঝার চেষ্টা করল আসলে কি ভাবছে রুজি। যদি দেহাবশেষ উদ্ধার করে সমাহিত করার পরও মরতে হয় আসাকাওয়াকে তখন হয়তো নাগাওকে খুন করার পরিকল্পনা করবে সে। হয়তো আসাকাওয়াকে দিয়ে নিরীক্ষা চালাচ্ছে সে, নিজের চামড়া বাঁচানোর চেষ্টায়।

“আরে ধুর! নির্বোধের মতো কথা বলো না,” হেসে বলল রুজি। “নাগাও-ই যদি সাদাকোর অসন্তুষ্টির কারণ হতো তাহলে এতদিনে নির্ঘাত মরে ভূত হয়ে যেত ব্যাটায়।”

ব্যাপারটা সত্যিই। এরকম ক্ষমতা ভালোমতো রয়েছে সাদাকোর।

“তাহলে কেন নিজেকে তার হাতে মরতে দিল সে?”

“বলতে পারব না। কিন্তু দেখ, তার চারপাশের আপন সবাই-ই মারা যাচ্ছিল একে একে। হতাশা ছাড়া আর কিছুই বাকি ছিল না তার জীবনে। এমনকি ওভাবে থিয়েটার কোম্পানি থেকে চলে যাওয়াও তার জন্য হতাশাজনক ছিল, ঠিক কিনা? এরপর নিরাময়কেন্দ্রে গিয়ে দেখল বাবাও মৃত্যুর মুখে।”

“তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এর পেছনে যে ব্যক্তি দায়ী, তার ওপর কোনো রাগ নেই সাদাকোর। এমনটাই বলতে চাচ্ছ?”

“ঠিক সেটা নয়। বরং এমনটাও হতে পারে নাগাওকে এমন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল সাদাকো। অন্যভাবে বললে, আত্মহত্যা করেছে সাদাকো, তবে সেটা নাগাওয়ের মাধ্যমে।”

আগ্নেয়গিরিতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছিল মা, যক্ষ্মায় মৃত্যুমুখে ছিল বাবা, ভেঙে গিয়েছিল তার নিজেরও অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন, এর ওপর আবার তার জন্মগত সমস্যা। আত্মহত্যা করার যথেষ্ট কারণ-ই ছিল তার। শিগেমোরির নাম উল্লেখ আছে ইয়াশিনোর রিপোর্টে। উড্ডয়ন থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ছিল লোকটা। মাতাল অবস্থায় সাদাকোর ওখানে গিয়েছিল সে। ঠিক পরেরদিন-ই কার্ডিয়াক প্যারালাইসিস-এ মরে সে। প্রায় নিঃসন্দেহে-ই বলা চলে সাদাকো তার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা ব্যবহার করে মেরে ফেলেছে তাকে। সহজেই কোনো এভিডেন্স ছাড়াই দুই-চারজন মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে তার। তাহলে এখনও বেঁচে আছে কেন নাগাও? কেউ নিজে থেকেই নিজের মৃত্যুকে বেছে না নিলে এর কোনো মানেই নেই।

“আচ্ছা, চলো ধরেই নিলাম এটা আত্মহত্যা। তবে মৃত্যুর আগে ধর্ষণ করার সুযোগ দিল কেন সে? এখন আবার বলো না, সে কুমারী হয়ে মরতে চাইত না তাই।”

একেবারে জায়গামত প্রশ্ন করেছে আসাকাওয়া। জবাব খুঁজতে গিয়ে হতবিহ্বল দেখাল রুজিকেও। কারণ এটাই বলতে চাচ্ছিল সে।

“ব্যাপারটা কি এতটাই নির্বোধ শোনায়?”

“হুহ?”

“কুমারী অবস্থায় মরতে না চাওয়াটা কি এতটাই অদ্ভুত শোনায়?” ব্যগ্রভাবে নিজের যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করল রুজি। “আমি হলে… কোনোভাবে যদি তার জায়গায় আমি থাকতাম, আমারও এমনটাই মনে হতো। ভার্জিন অবস্থায় মরতে চাইতাম না আমি।”

রুজির কথাবার্তা এরকম নয়, মনে হলো আসাকাওয়ার। যদিও যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবে না ও, তবুও মনে হলো, এসব কথাবার্তা অথবা মুখভঙ্গি কোনোটাই রুজির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়।

“তুমি কি আদৌও সিরিয়াস? এক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলার মনোভাব কিন্তু আলাদা। বিশেষ করে সাদাকো ইয়ামামুরা।”

“হেহে। মজা করছিলাম একটু। সাদাকো ধর্ষিত হতে চায়নি। নিশ্চয়ই চায়নি। মানে, কে চাইবে নিজের সাথে এমন নারকীয় কিছু ঘটুক? নাগাওয়ের কাঁধে কষে কামড়ও বসিয়েছিল সে। মৃত্যুর চিন্তা মাথায় আসার আগেই ঘটেছে এসব। এরপর কিছু বিবেচনা না করেই নাগাওকে উদ্বুদ্ধ করেছে সে। এমনটাই ঘটেছে আমার মনে হয়।”

“কিন্তু এরপরও কি নাগাওয়ের ওপর তার সামান্য হলেও রাগ থাকার কথা নয়?” এখনো ব্যখায় সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে না আসাকাওয়াকে।

“ভুলে যাচ্ছ কেন? আমাদের ভাবতে হবে তার অসন্তুষ্টির সীমা কতদূর। তার অসন্তুষ্টি নির্দিষ্ট কারোর ওপর নয়। বরং সমাজের সবার ওপর। এদিকটা বিবেচনা করলে, নাগাওয়ের প্রতি তার ক্ষোভ সাগরের মধ্যে শিশিরবিন্দুর মতো।”

যদি ভিডিওটা সমাজের প্রতি সাদাকোর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়, তবে সমাধানটা কি? কি হতে পারে সেটা? নির্বিচারে আক্রমণ কথাটা মাথায় আসল আসাকাওয়ার। রুজির ভরাট কণ্ঠস্বর বাধাগ্রস্ত করল তার চিন্তা

“যথেষ্ট হয়েছে বাল। এসব বালছাল ভেবে সময় নষ্ট করার চেয়ে সাদাকোর দেহ খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। সে-ই সব ধাঁধার সমাধানের একমাত্র চাবিকাঠি।”

ওলং চায়ের শেষটুকু গিলে কাপটা নিচে ফেলে দিল রুজি।

হিলসাইডে দাঁড়িয়ে লম্বা ঘাসের দিকে চেয়ে রয়েছে ওরা। আসাকাওয়ার হাতে একটা কাস্তে ধরিয়ে বি-৪ কেবিনের বাম প্রান্তের দিকে ইশারা করল রুজি। ঘাস কেটে ওখানকার ভূমি পরীক্ষা করে দেখতে চাচ্ছে সে। হাঁটু গেড়ে বসে কাস্তে চালাতে লাগল আসাকাওয়া। কেটে যাচ্ছে ঘাসগুলো।

ত্রিশ বছর আগে জীর্ণ একটি ঘর ছিল এইখানে। সেটার সামনে ছিল একটা কুয়ো। উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাল আসাকাওয়া। এখানে বসবাস করতে হলে কোথায় ঘর বানাত ভাবল ও। সম্ভবত সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় এমন কোথাও বানাত। এছাড়া এখানে ঘর বানানোর কোনো মানেই নেই। কিন্তু সেরা দৃশ্যটা কোথায় থেকে পাওয়া যায়? গ্রিনহাউজের ছাদের দিকে চোখ রেখে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল আসাকাওয়া। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে জায়গাটা। এই মুহূর্তে যেখানে রয়েছে সেখানে খুব পরিবর্তন হয়নি দৃশ্যের। কিন্তু ওর মনে হলো, যদি ঘর নির্মাণ করতে হতো তবে বি-৪ যেখানে রয়েছে সেখানকার বদলে এ-৪ এর ওখানে নির্মাণ করা সহজ হতো। নিচু হয়ে দেখার পর বুঝল ওটাই একমাত্র সমতল জায়গা। এ-৪ আর বি-৪ এর মাঝামাঝিতে বিচরণ করে ঘাস কাটতে থাকল ও। সেইসাথে হাত দিয়ে আন্দাজ করল ভূমির ব্যাপারেও

কুয়ো থেকে কখনো পানি উঠিয়েছে বলে মনে হয় না ওর। মনে পড়ল কখনো কুয়ো-ই দেখেনি। কুয়ো দেখতে কেমন, বিশেষ করে এরকম পাহাড়ি এলাকায়, সেই ব্যাপারে কোনো ধারণায় নেই আসাকাওয়ার। সত্যি কি ভূগর্ভস্থে পানি রয়েছে এখানে? তবে কয়েকশো মিটার দূরে রয়েছে গাছঘেরা একটা জলাভূমি। কোনোভাবেই নিজের চিন্তাগুলো একত্রিত করতে পারছে না আসাকাওয়া। কীভাবে মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব এরকম একটা কাজে? কোনো ধারণায় নেই ওর। মনে হলো দ্রুত রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে ওর মাথার ভেতর। তাকাল ঘড়ির দিকে। তিনটা বাজে প্রায়। সাত ঘণ্টা বাকি এখনো। এত চেষ্টা করে ডেডলাইনের আগে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে? এসব চিন্তা আরো এলোমেলো করে দিল ওকে। কুয়োর দৃশ্যটাও অস্পষ্ট হয়ে উঠছে ওর কল্পনায়। কীভাবে চিহ্নিত করা যাবে পুরানো, পরিত্যক্ত কুয়োকে? কিছু পাথর দিয়ে ঘেরা থাকবে জায়গাটা? যদি মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকে তাহলে? তাহলে নিঃসন্দেহে জীবনেও সময়মত খুঁড়ে বের করতে পারবে না ওরা। ঘড়ির দিকে আবারও তাকাল ও। কাটায় কাটায় তিনটা। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রায় ৫০০ মিলি উলং চা খেয়েছে ও। এরইমধ্যে শুকিয়ে গেছে গলা। মাথার মধ্যে একটা কথা খেলে চলেছে: ফাঁপা জায়গার খোঁজ করো, পাথর ছড়িয়ে রয়েছে এমন জায়গার খোঁজ করো। বেলচা ফেলল আবর্জনার মধ্যে। সময় আর রক্ত মস্তিষ্কে বয়ে চলেছে স্রোতের মতো। স্নায়ু দুর্বল হয়ে গেছে আসাকাওয়ার তবে অবসন্ন বোধ করছে না ও। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ের থেকে এখনকার সময় এত ভিন্নভাবে বয়ে চলছে কেন? কাজ শুরু করার পর এত আতঙ্ক ভর করছে-ই বা কেন? আর অন্য কাজও করা উচিত নয় ওদের?

ছোটবেলায় একটা গুহা খুড়েছিল আসাকাওয়া। পঞ্চম কি চতুর্থ গ্রেডে পড়ত তখন ও। স্মৃতিটা মনে পড়লে দুর্বলভাবে হেসে উঠল ও।

“কি করতেছ বাল, বলতো?” রুজির কণ্ঠস্বর শুনে মাথা তুলে তাকাল আসাকাওয়া। “এটুকু জায়গার মধ্যে করছ কি? আরও বড় জায়গা জুড়ে খোঁজ করা উচিত।”

হা করে রুজির দিকে তাকাল ও। রুজির মাথার পিছনে সূর্য। ছায়া পড়ছে তার মুখে। চেহারা থেকে ঘাম ঝরে পড়ল ঘাসের ওপর। করছি কি আমি আসলে? সামনে একটা গর্ত খোড়া। আসাকাওয়া খুড়েছে ওটা।

“কি বাল খুঁড়ে রেখেছ ওটা?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুজি। ভ্রুকুচকে ঘড়ির দিকে তাকাল আসাকাওয়া।

“বালের ঘড়ির দিকে বারবার তাকানো বন্ধ কর!” ওর হাতে থাবা দিল রুজি। আসাকাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। শান্তস্বরে বলল রুজি, “তোমার একটু ব্রেক নেয়া উচিত।”

“সময় নেই।”

“বারবার বলছি ধৈর্য ধরো। আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নাই।”

কাঁচুমাচু হয়ে গেল আসাকাওয়া। ওর বুকে হালকা টোকা দিল রুজি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল রুজি।

“এটাই করো, কিছুক্ষণ বাচ্চাদের মতো শুয়ে বিশ্রাম করো।”

ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল আসাকাওয়া।

“নড়াচড়া করবে না। শুয়ে থাকো। শক্তি বাঁচাতে হবে।”

আসাকাওয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রুজি। দাঁড়িয়ে থাকল তার নড়াচড়া বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। চোখ বন্ধ করে ফেলল ও। নড়াচড়া করল না আর। স্থির হয়ে গিয়েছে রুজিও। চোখ খোলার পর দেখতে পেল ছোট ছোট পা ফেলে বি-৪ কেবিনের ব্যালকনির ছায়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রুজি। তার চলনভঙ্গি অভিজাত্যে ভরপুর। কুয়োটা খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে একধরনের অনুপ্রেরণা পেল ও। হতাশার ভাবটা কেটে যাচ্ছে ধীরেধীরে।

রুজি চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল আসাকাওয়া। হাত পা ছড়িয়ে, পিঠে ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ও। সূর্যটা উজ্জ্বল। রুজির চেয়ে ওর মনোবল কত দুর্বল! বিরক্তিকর। ধীরেসুস্থে নিঃশ্বাস নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করল ও। পরবর্তী সাত ঘণ্টায় ভালোমত টিকে থাকতে পারবে কিনা এই ব্যাপারে নিশ্চিত নয় আসাকাওয়া। রুজির সব নির্দেশ পালন করবে ও। এই মুহূর্তে এটাই সর্বোত্তম পন্থা। নিজেকে হারিয়ে এমন কারও ওপর ভরসা করবে ও, যার রয়েছে হার না মানা মানসিকতা।

হারিয়ে ফেলো নিজেকে! এর মাধ্যমেই ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে আতঙ্ককে। এরপর মাটির নিচে দাফন করা হবে তোমাকে। তুমি হয়ে উঠবে প্রকৃতির একজন। মাথার মধ্যে এসব খেলে চলেছে আসাকাওয়ার। যেন এসব কথায় সাড়া দিয়েই হাল ছেড়ে দিল শরীর, জ্ঞান হারাল ও। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখল ইয়োকোকে নিয়ে, স্বপ্নের মধ্যেই ফিরে গেল ওর গ্রেড স্কুলের দিনগুলোতে।

যেখানে বেড়ে উঠেছে আসাকাওয়া ওখানে ছিল একটা মিউনিসিপালিটির খেলার মাঠ। মাঠের কিনারায় ছিল একটা বাঁধ। ওখানে চাষ করা হতো গলদা চিংড়ির। বন্ধুদের সাথে মিলে ওখানে চিংড়ি ধরতে যেত আসাকাওয়া। কিছু কিছু দিনে, বাঁধের ওপর গনগনে সূর্য থাকলে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠত মাছধরা। সূর্যের তাপে ছিপ হাতে বসে থাকতে ক্লান্ত হয়ে উঠত ও। তখন বাঁধের পাশে গিয়ে গর্ত খুঁড়ত প্লাস্টিকের একটা বোর্ড দিয়ে। মাটি নরম থাকায় সহজেই খনন করা যেত গর্তটা। এরপর ওর সাথে যোগ দেয় আরও তিনজন বন্ধু। অথবা চারজন, ঠিক মনে নেই। গুহা খননের জন্য যথেষ্ট ছিল ঐ কয়জন-ই। সংখ্যায় এরচেয়ে বেশি হলে ঝগড়া লেগে যেত আর কম হলে করতে হত হাড়ভাঙা পরিশ্রম। একদিন ঘন্টাখানেক খোঁড়ার পর একজনের হামাগুঁড়ি দিয়ে প্রবেশের মতো বড় গর্ত করে ফেলেছিল ওরা। খুঁড়তেই থাকল গুহা। আসলে স্কুল থেকে ফেরার পথে খুঁড়তে আরম্ভ করেছিল গর্তটা। এরমধ্যে একজন বলে উঠল, বাড়ি ফিরতে হবে তার। চুপ করে ছিল শুধুমাত্র আসাকাওয়া-ই। গুহা খননের বুদ্ধি ওর- ই। আর সূর্যাস্ত নাগাদ যে কয়জন শেষ পর্যন্ত ছিল ওরা, সবার চাপাচাপি করে প্রবেশের মতো বড় হয়ে গিয়েছিল গুহাটা। গুহায় ঢুকে হাঁটু গেঁড়ে বসে খিলখিল করে হেসেছিল আসাকাওয়া আর ওর বন্ধুরা। লালচে মাটিতে গড়াগড়ি রত অবস্থায় নিজেদেরকে প্রস্তর যুগের মিকিবি মানব মনে হচ্ছিল ওদের। যাদের ব্যাপারে ওরা জেনেছিল সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে।

কিছুক্ষণ পর গুহার প্রবেশ পথে ভেসে উঠেছিল এক নারীর চেহারা। সূর্যাস্তের সময় হওয়ার কারণে মুখের ওপর ছায়া পড়েছিল তার। এজন্য বুঝা যাচ্ছিল না তার মুখভঙ্গি। আশেপাশের এলাকার কোনো বয়স্ক মহিলা হবে, বুঝতে পেরেছিল আসাকাওয়া।

“এখানে গর্ত খুড়েছ কেন তোমরা? তোমরা জ্যান্ত মাটিচাপা পড়লে খুবই খারাপ হবে,” গুহায় ঢোকার চেষ্টা করে বলেছিল মহিলা। দৃষ্টি বিনিময় করেছিল ছোট্ট আসাকাওয়া ও বাকিরা। কম বয়সী থাকার পরেও মহিলার হুমকিতে অশুভ কিছু টের পেয়েছিল ওরা। কোনো সাবধান বাণী ছিল না মহিলার কথায়। বরং মনে হয়েছিল ওরা মাটি চাপা পড়ে মরলে উটকো ঝামেলায় পড়বে এলাকাবাসী, এই নিয়েই চিন্তিত সে। মহিলা ওদেরকে সাবধান করেছিল সম্পূর্ণ নিজ স্বার্থে। আবার খিলখিল করে হেসে উঠেছিল ওরা। প্রবেশপথ আটকে রেখেছিল মহিলার চেহারা।

চোখ খুলতেই মহিলার বদলে ভেসে উঠল রুজির চেহারা।

“এখন একটু রিল্যাক্স দেখাচ্ছে তোমাকে। রাতের আগেই এখান থেকে কেটে পড়ার কথা ভাবতে হবে। একা একাই পাগলার মতো হাসছ কেন?”

তাকে জাগিয়ে তুলল রুজি। পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেছে সূর্য। আঁধার ঘনিয়ে আসছে দ্রুতই। আবছা আলোয় পূর্বের থেকে বেশি কালো দেখাচ্ছে রুজির অবয়ব।

“এক মিনিটের মধ্যে উঠে আস।” পা ধরে আসাকাওয়াকে টেনে তুলল রুজি। এরপর হাঁটা ধরল বি-৪ এর ব্যালকনির দিকে। তাকে অনুসরণ করল আসাকাওয়া। ব্যালকনির নিচে, সাপোর্টিং পিলারের মাঝে বের হয়ে আছে বোর্ডের একটা অংশ। বোর্ডটা হাত দিয়ে সর্বশক্তিতে টানতে থাকল রুজি। শব্দ করে তীর্যকভাবে ভেঙে গেল বোর্ডটা। কেবিনের ভেতরের সাজসজ্জা বেশ আধুনিক। কিন্তু এই বোর্ডগুলোর অবস্থা বেহাল। ভেঙে ফেলা যায় হাত দিয়েই। চোখের আড়ালে থাকা জিনিসগুলো নিয়ে কাজই করে না বিল্ডার্সরা। এটার ভেতরে ফ্লাশলাইট মারল রুজি। আলোকিত হয়ে উঠল কেবিনের ভূ গর্ভ।

নড করল রুজি। বোঝাতে চাইল এখানে এসে দেখ। ফাঁকা অংশে দৃষ্টি স্থির করে ভেতরের দিকে তাকাল ও। ফ্লাশলাইটের আলো ভেতরে প্রসারিত হয়ে পড়েছে পশ্চিম দিকে। ওদিকে তাকিয়ে অমসৃণ একটা গঠন লক্ষ করল ও। মনে হচ্ছে পাথরের স্তূপ। কংক্রিট দিয়ে ঢাকা রয়েছে ওপরের অংশ। পাথর ও কংক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে জন্মেছে ঘাস। সরাসরি কিসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, বুঝতে পারল আসাকাওয়া। কেবিনের লিভিংরুমের নিচের অংশ। আর লিভিংরুমে ঠিক কুয়ার ওপরে রাখা আছে টেলিভিশন ও ভিসিআর। এত কাছাকাছি-ই ছিল সাদাকো ইয়ামামুরা। লুকিয়ে থেকে সর্বদা লক্ষ রেখেছে, কি চলছে ওপরে। বোর্ডটা আরও ভাঙতে থাকল রুজি। যতক্ষণ না প্রবেশের উপযুক্ত হয় জায়গাটা। বোর্ডের গর্ত দিয়ে মাথা নিচু করে প্রবেশ করল দুজনেই। হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছাল কুয়োর কাছে। ঢালু ভাবে নির্মিত হয়েছে কেবিনটা। ঢালের উতরাই প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে ওরা। ফলে যতই এগোতে থাকল, মনে হলো ওপর থেকে বোর্ডের অংশ চেপে ধরছে ওদেরকে। পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল থাকা সত্ত্বেও নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে আসাকাওয়ার। বাইরের থেকে এখানকার মাটি বেশি স্যাঁতস্যাঁতে। এখন ওদেরকে কি করতে হবে ভালোমত জানে আসাকাওয়া। জানার পরও এখন পর্যন্ত আতঙ্কিত বোধ করেনি ও। মাথার ওপরের ফ্লোর বোর্ডের কারণে ক্লস্ট্রোফোবিক বোধ হচ্ছে ওর। কিন্তু হয়তো ওকে নামতে হবে পরিত্যক্ত কুয়োর গভীরে। যেখানে রাজত্ব আরও বেশি অন্ধকারের..হয়তোবা নেই। তবে সাদাকোকে বের করতে অবশ্যই কুয়োতে নামতে হবে ওদের।

“হাত লাগাও এখানে,” বলল রুজি। কংক্রিটের ভেতর থেকে বের হয়ে থাকা রিবার ধরে আছে সে। টেনে তোলার চেষ্টা করছে কংক্রিটের তৈরি ঢাকনাটা। কিন্তু ওপরের সিলিং নিচু হওয়ায় খুব বেশি সুবিধা পেল না। রুজির মতো কেউ, যার ১২০ কেজি ওঠানোর ক্ষমতা রয়েছে, জায়গামত পা রাখতে না পারলে অর্ধেক হয়ে যায় সেই ক্ষমতা। কুয়োর চারপাশটা হেঁটে দেখল আসাকাওয়া। সুবিধামত জায়গায় পিঠে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ল ও। এরপর কলামে দু হাত রেখে সর্বশক্তিতে পা দিয়ে ঠেলতে লাগল ঢাকনা। পাথরের সাথে কংক্রিটের ঘর্ষণে সৃষ্টি হলো অদ্ভুত আওয়াজ। আরও বেশি শক্তি প্রয়োগের জন্য চিৎকার করে উঠল আসাকাওয়া আর রুজি। সরে গেছে ঢাকনা। কত বছর ধরে কুয়োর মুখে আটকানো রয়েছে এটা? ভিলা লগ কেবিন নির্মাণের পর কুয়োটা আটকানো হয়েছে নাকি প্যাসিফিক ল্যান্ড নির্মাণের পর নাকি যে সময়ে নিরাময়কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখন? ধারণা করে নেয়া ছাড়া জানার কোনো উপায় নেই। পাথর ও কংক্রিটের সাহায্যে সিলগালা করে রাখা কুয়োর ঢাকনা ভেঙে গেল মানবিক শক্তি প্রয়োগের কারণে। সম্ভবত ছয়মাস অথবা এক বছরের বেশি হয়নি এটার মুখ আটকানোর। যাইহোক, খুলে গেছে কুয়োর মুখ। যতটুকু ফাঁকা করতে পেরেছে সেখানে বেলচার ব্লেড ঢুকিয়ে চাপ দিতে আরম্ভ করল রুজি।

“আচ্ছা, আমি সিগন্যাল দিলেই হ্যান্ডেলে চাপ দিবা।”

ঘুরে দাঁড়াল আসাকাওয়া।

“রেডি। ওয়ান, টু, থ্রি, চাপ দাও।”

লিভার কার্যকর করার জন্য আসাকাওয়া হাত লাগালে ঢাকনার দিক বরাবর চাপ বাড়াল রুজি। আওয়াজ সৃষ্টি করে খুলে মাটিতে পড়ল ঢাকনাটা।

স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে রয়েছে কুয়োর মুখ। ফ্ল্যাশলাইট বের করে কুয়োর স্যাঁতস্যাতে প্রান্তে হাত রাখল দুজন। এরপর উঠে দাঁড়াল। লাইট জ্বালানোর আগে কাঁধ ও মাথা নেড়ে কুয়োর ওপরে আশেপাশের পঞ্চাশ সেন্টিমিটার ভালোভাবে দেখে নিল ওরা। নাকে এসে লাগল পচা একটা গন্ধ। কুয়োর ভেতরটা এতই গভীর, মনে হলো নামার সাথে সাথেই গিলে নেবে ওদেরকে। ওখানেই রয়েছে সাদাকো। অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা ও টেস্টিকুলার ফেমিনিজেশন সিন্ড্রোম সম্পন্ন এক নারী। ‘নারী’ শব্দটাও সঠিক বলা চলে না। ডিম্বকের গঠনের ওপর নির্ভর করে লিঙ্গ। যতই সুন্দর নারীদেহ হোক না কেন, ডিম্বক অণ্ডকোষ আকারে থাকলে তাকে পুরুষ বলা শ্রেয়। সাদাকো পুরুষ নাকি নারী, নিশ্চিত নয় আসাকাওয়া। যেহেতু তার বাবা-মা নাম রেখেছিল সাদাকো, এর মানে তাকে নারী হিসেবেই গড়ে তোলার ইচ্ছে ছিল তাদের। সকালবেলা, আতামির বোটে রুজি বলছিল, ‘তোমার মনে হয় না পুরুষ ও নারীর জননাঙ্গ-ই দুনিয়াতে ক্ষমতা ও সৌন্দর্য্যের উৎস?”

কথাটা ভেবে, একটা আর্টবুকের কথা মনে পড়ল আসাকাওয়ার। যেটা দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ও। ওখানাকর একটা চিত্রে দেখতে পেয়েছিল একজন নারীর দেহ শায়িত রয়েছে পাথরের স্ল্যাবের ওপর। কিন্তু তার উরুর মাঝে উঁকি দিচ্ছিল পুরুষ জননাঙ্গ।

“কিছু দেখতে পাচ্ছ?” জিজ্ঞেস করল রুজি।

ফ্লাশলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে কুয়োর তলায় জমে রয়েছে পানি। চার থেকে পাঁচ মিটার নিচে। কিন্তু কতটা গভীর জানা নেই ওদের।

“ফ্লাশলাইট নিচের দিকে কোনাকুনি ধরো। যেটাই করো না কেন, ভুলেও ফেলে দিও না ওটা ভাই।”

শালা ওখানে নামার কথা ভাবছে, এটা ভেবেই পা কেঁপে উঠল আসাকাওয়ার। আমাকে যদি নামতেই হয় ওখানে…লম্বা, সরু, অন্ধকার টানেল চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। ভয়ানক সব দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল ওর কল্পনায়।

আমি পারবো না। কালো পানিতে নেমে করবো টা কি? খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো হাল। কোনোভাবেই করতে পারব না কাজটা। পাগল হয়ে যাব। এসব চিন্তায় খেলতে লাগল ওর মনে।

কৃতজ্ঞতার সাথে চেয়ে দেখল নামতে আরম্ভ করেছে রুজি। প্রার্থনা করল, যেন না আসে ওর পালা।

অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে ওর। কুয়োর ভেতরের পৃষ্ঠে শ্যাওলা দেখতে পেল ও। পাথরের দেয়ালে ফ্লাশ লাইটের আলো পড়ায় মনে হলো সেখানে সৃষ্টি হয়েছে নাক, মুখ, চোখের গড়ন। যেন পাথুরে দেয়ালে ভেসে উঠেছে কোনো মৃতের অবয়ব, মৃত্যুর আগে আত্মচিৎকারের কারণে বিকৃত ঘটেছে ঐ অবয়বের। সেখান থেকে চোখ সরাতে পারল না ও। কোনো অশুভ সত্ত্বা যেন সাগরতলের আগাছার মতো ভেসে উঠতে চাচ্ছে ওপরে। কোনোভাবেই কল্পনা থেকে সরাতে পারছে না এই দৃশ্য। এক টুকরো পাথর পড়ল কুয়োর মধ্যে। জলের মধ্যে পাথরের শব্দ সৃষ্টি করল প্রতিধ্বনি। পাথরটা হারিয়ে গেল ঐ অশুভ সত্ত্বার খাদ্যনালীতে।

কোনোমতে কুয়োর ওপর ও ফ্লোর বোর্ডের মাঝামাঝি অবস্থায় নিজের দেহটা রেখেছে রুজি। হাতের সাথে দড়ি বেঁধে ধীরেসুস্থে নামতে লাগল সে। কুয়োর তলায় নেমে দেখল তার পা ডুবেছে হাঁটু পর্যন্ত। খুব বেশি গভীর নয় কুয়োটা।

“আসাকাওয়া, বালতি নিয়ে এসো। পাতলা দড়িটাও।”

বালতি ব্যালকনিতে ফেলে এসেছে ওরা। হামাগুড়ি দিয়ে কেবিনের ভূগর্ভস্থ থেকে বের হলো আসাকাওয়া। অন্ধকার নেমে এসেছে বাইরে। এরপরও বাইরে কেবিনের ভূগর্ভস্থের থেকে বেশি উজ্জ্বল। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে মুক্তির স্বাদ অনুভব করল ও। তাকাল কেবিনের চারপাশে। লাইট জ্বলছে শুধু রাস্তার ধারের এ-১ কেবিনে। ঘড়ির দিকে না তাকানোর সংকল্প করেছে ও। এ-১ কেবিন থেকে আসা কণ্ঠস্বরকে মনে হলো ভিন্ন কোনো দুনিয়ার আওয়াজ, ভেসে আসছে দূরত্ব পেরিয়ে। ডিনার করছে ওখানকার বাসিন্দা। কয়টা বাজে সেটা বুঝতে ঘড়ির দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই।

কুয়োর কাছে ফিরে এলো ও। বালতি ও বেলচা দড়ি দিয়ে বেঁধে নামিয়ে দিল রুজির কাছে। বেলচা দিয়ে কুয়োর তলার মাটি খুঁড়ে বালতিতে রাখছে রুজি। একটু পরপর কাঁদায় হাত ডুবিয়ে কিছু পাওয়ার খোঁজে রয়েছে সে। কিন্তু পাচ্ছে না কিছুই।

“বালতি টেনে ওঠাও!” চিৎকার করে বলল সে।

কুয়োর সাথে পেট ঠেকিয়ে বালতি ওপরে টেনে তুলল আসাকাওয়া। বালতির পাথর ও কাঁদাগুলো মাটির ওপর ঢেলে আবারও কুয়োয় ফেরত পাঠাল বালতি। মনে হচ্ছে কুয়োটা সিল করার আগে কিছু পরিমাণ কাঁদা ও পাথর ফেলা হয়েছিল সেখানে। তবে সেটা সাদাকোর সুন্দর দেহের অবশিষ্ট অংশ না উঠিয়েই।

“ঐ আসাকাওয়া!” কাজ থামিয়ে ওপরে তাকাল রুজি। জবাব দিল না আসাকাওয়া। “আসাকাওয়া! গড়বড় হয়েছে নাকি কোনো?”

জবাব দিতে চাইল আসাকাওয়া : সমস্যা নেই, ঠিক আছি আমি।

“একটা কথাও উচ্চারণ করোনি এই সময়ের মধ্যে। অন্তত কিছু বলে সাহস তো দিতে পারো নাকি। হালকা অবসাদে ভুগছি এখানে।”

কিছুই বলল না আসাকাওয়া।

“গান ধরলে কেমন হয়? হিবারি মিসৌরার কোনো গান ধরো নাহয়।”

এবারও কিছু বলল না আসাকাওয়া।

“হেই আসাকাওয়া! আছ ওখানে? আমি জানি জ্ঞান হারাওনি তুমি।”

“আমি….আমি ঠিকাছি।” কোনোমতে বিড়বিড় করে বলল আসাকাওয়া।

“তুমি শালা একটা গোদের ওপর বিষফোঁড়া, হারামজাদা।” কথাটা বলেই বেলচা চালাল কুয়োর পানির মধ্যে। কতবার করল এই কাজটা? কমছে কুয়োর পানির মাত্রা। কিন্তু যেটার খোঁজে রয়েছে সেটার দেখা নেই। ধীরগতিতে বালতি ওপরে উঠতে দেখল সে। থেমে গেল একপর্যায়ে গিয়ে। হাত ফসকে গিয়েছে আসাকাওয়ার। কুয়োর অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে আবারও নিচে নেমে আসল ওটা। কোনোমতে আঘাতের হাত থেকে নিজের সরিয়ে নিয়েছে রুজি। কিন্তু কাঁদা ছিটকে পড়েছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ক্রোধের পাশাপাশি বুঝতে পারল সে, শক্তির একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে আসাকাওয়া।

“বাল আমার! মেরে ফেলবে নাকি আমাকে?” দড়ি ধরে ওপরে উঠতে লাগল রুজি। “এবার তোমার পালা।”

আমার পালা, ভেবেই চমকে উঠল আসাকাওয়া। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ফ্লোর বোর্ডের সাথে আঘাত লাগল ওর মাথায়। “দাঁড়াও রুজি, আমি ঠিক আছি। এখনও কিছু শক্তি বাকি আছে আমার।”

তোতলাল আসাকাওয়া। কুয়োর মুখ দিয়ে উঁকি দিল রুজি।

“নাহ নেই। একফোঁটাও নয়। যাও, তোমার পালা এখন।”

“দাঁড়াও, দাঁড়াও। আরেকবার খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে দাও।”

“তাহলে ভোর পর্যন্ত থাকা লাগবে।”

আসাকাওয়ার চেহারায় লাইট ধরল রুজি। অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওর চোখজোড়া। মৃত্যুভয় যেন হারিয়ে গেছে সেখান থেকে। চোখ দেখেই বুঝল রুজি, এই মুহূর্তে যৌক্তিক বিচারবুদ্ধি হারিয়েছে আসাকাওয়া। বেলচা দিয়ে কর্দমাক্ত মাটি বালতিতে ওঠানো আর চার-পাঁচ মিটার উচ্চতায় সেটা টেনে তোলার মধ্যে কঠিন কাজ কোনটা সেটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

“নিচে নামো গিয়ে,” আসাকাওয়াকে ঠেলে বলল রুজি।

“নাহ…দাঁড়াও..এটাতে..”

“কি?”

“আমি কুস্ট্রফোবিক।”

“আবালের মতো আচরণ করিস না ভাই।”

একবিন্দুও না নড়ে কুঁকড়ে গেল আসাকাওয়া। কুয়োর তলার পানি কেঁপে উঠল সামান্য।

“পারবো না আমি। যেতে পারব না ওখানে।”

কলার ধরে দুইবার আসাকাওয়াকে চড় মারল রুজি। “নাকে কান্দা বন্ধ কর, ‘যেতে পারব না’ বললে চলবে না হারামজাদা। মৃত্যু চোখ রাঙাচ্ছে তোমাকে। হয়তো কিছু করার সক্ষমতাও রয়েছে তোমার। আর তুমি বলছ পারবে না? ভীতুর ডিম হয়ো না। ভালোমতই, শুধু তোমার জীবন-ই এটার ‘ওপর নির্ভর করছে না। একটু আগে তোমার করা ফোনকলের কথা মনে করো। ছোট্ট, নিষ্পাপ শিশুটিকে নিয়ে মরতে চাও নাকি।”

স্ত্রী ও বাচ্চার কথা ভাবল ও। নির্বোধের মতো আচরণ করলে চলবে না। এখন ওর হাতেই ওদের জীবন। কিন্তু সায় দিচ্ছে না শরীর।

“এটা সত্যি কাজে আসবে তো?” অকারণেই প্রশ্নটা করল ও। এই মুহূর্তে এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা অবান্তর। কলারে হাতের চাপ হালকা করল রুজি।

“প্রফেসর মিউরার থিওরি আরেকটু বলব তোমাকে? মৃত্যুর পরেও অতৃপ্ত আত্মার পৃথিবীতে থেকে যাওয়ার তিনটে কন্ডিশন রয়েছে। বদ্ধ জায়গা, পানি ও ধীরগতির মৃত্যু। এক, দুই, তিন। অন্যভাবে বলতে গেলে, বদ্ধ কোনো জায়গায়, পানির উপস্থিতিতে, ধীর গতির মৃত্যু। এভাবে মৃত্যু ঘটলে ঐ ব্যক্তির অতৃপ্ত আত্মা ওখানেই আটকা পড়ে। এখন কুয়োটা দেখ। এটা ছোট্ট, বদ্ধ জায়গা, আর পানিও রয়েছে। মনে আছে, কি বলেছিল ভিডিওর বৃদ্ধা?”

…ঐ ঘটনার পর কেমন আছে তোমার শরীর? সবসময় পানির মধ্যে খেলতে থাকলে ঘিরে ধরবে তোমাকে দানবরা।

পানির মধ্যে খেলা। হ্যাঁ, এটাই। সাদাকোর দেহ এখনো আটকা রয়েছে কালো কাদাপানিতে। সেখানে খেলছে সে, অসীম ধাঁধার এক খেলা।

“দেখ কুয়োয় ফেলার পরেও বেঁচে ছিল সাদাকো। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় থাকার সময়, ক্রোধ ও ঘৃণার প্রলেপ ঘষে দিচ্ছিল বদ্ধ কুয়োর দেয়ালে। এই কেসে তিনটি শর্ত-ই পূরণ হয়েছে।”

“তো?”

“তো প্রফেসর মিউরার মতে, এই ধরনের অভিশাপ মুক্ত করা সম্ভব। দেহটাকে মুক্ত করে দিলেই হবে। আমরা এই জঘন্য কুয়ো থেকে তার দেহাবশেষ নিয়ে গিয়ে যথাযথ মর্যাদার সাথে তার নিজের শহরে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করবো। প্রশস্ত, উজ্জ্বল দুনিয়ায় নিয়ে যাব তাকে আমরা।

কিছুক্ষণ আগে বাইরে বালতি আনতে গিয়ে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল আসাকাওয়া। সাদাকোকেও কি একই স্বাদ দিতে পারবে ওরা? এমনটাই কি চায় সাদাকো?

“তাহলে এটাই সমাধান?”

“হয়তো, হয়তো না।”

আবারও আসাকাওয়ার কলার টেনে ধরল রুজি।

“ভাবো! নিশ্চিত ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই আমাদের জীবনে! আমরা শুধু জীবনে ধারাবাহিকতার আশাই করতে পারি। কিন্তু এর মাঝেই বেঁচে থাকা লাগে আমাদের। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে হাল তো ছেড়ে দেয়া যায় না। প্রশ্নটা এখানে সম্ভাব্যতার। সমাধান…হয়তো সাদাকো আরও অনেক কিছুই চাইতে পারে। কিন্তু তার দেহাবশেষ এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলে ভিডিওর অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার ভালো একটা সম্ভাবনা রয়েছে বলা যায়।”

মুখ বাঁকিয়ে নীরবেই চিৎকার করে উঠল আসাকাওয়া।

বদ্ধ জায়গা, পানি ও ধীরগতির মৃত্যু, বলেছেন তিনি। এই তিনটি কারণেই টিকে থাকে শক্তিশালী অশুভ আত্মা। প্রফেসর মিউরার থিওরি সত্যি, এর প্রমাণ কী? ভাবল আসাকাওয়া।

“আমার কথা মাথায় ঢুকলে, যাও কুয়োয় নামো।”

কিন্তু আমার মাথায় ঢোকেনি। কীভাবে মাথায় ঢুকবে এরকম কিছু?

“ইতস্তত করার মতো সময় তোমার নেই। তোমার ডেডলাইন একদম কড়া নাড়ছে।” নরম হয়ে এসেছে রুজির কণ্ঠস্বর। “ভেবো না, লড়াই না করেই মৃত্যুকে হারাতে পারবে।”

হারামজাদা, তোমার জীবনদর্শন শুনতে চাই না এখন, মনে মনে বলল রুজি।

কিন্তু অবশেষে দড়ি ধরে কুয়োয় নামা আরম্ভ করল রুজি।

“সাবাস। বুঝতে পেরেছ তাহলে করতে পারবে কাজটা?”

দড়ি ধরে কুয়োর ভেতরে নেমে গেল আসাকাওয়া। চোখের সামনে রুজির চেহারা।

“চিন্তা কোরো না। বিপজ্জনক কিছু নেই ওখানে। তোমার সবথেকে বড় শত্রু হলো তোমার অতিকল্পনা।”

ওপরে তাকানোর সাথে সাথে ফ্লাশলাইটের আলো মুখে লাগল ওর। ঝাপসা লাগল দৃষ্টি। পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে দেয়ালের সাথে। ধীরেধীরে হালকা করল মুঠির মধ্যে থাকা দড়ি। পাথরের কারণে পা পিছলে গেল ওর। হঠাৎ করেই নেমে গেল মিটার খানেক। ঘর্ষণের কারণে ছিলে গেছে ওর হাত।

পানির পৃষ্ঠের একেবারে কাছাকাছি ঝুলে রয়েছে ও। ভাবছে নামবে কিনা। আরও একফুট নেমে পানিতে পা রাখল আসাকাওয়া। দেখে মনে হলো, গোসলের আগে পানির তাপমাত্রা মাপছে ও। ঠান্ডা পানির স্পর্শে শরীরে বয়ে গেল অদ্ভুত এক শিহরণ। সাথে সাথে সরিয়ে নিল পা। কিন্তু দড়িতে ঝুলে থাকতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে ওর বাহু। দেহের ভরের কারণে ধীরে নেমে গেল আসাকাওয়া। বাঁধাও দিতে পারল না আর। ফলে নামিয়ে দিল দুটো পা-ই। দ্রুতই নরম কাঁদায় ডুবে গেল ওর পা। এখনও দড়ি ধরেই রয়েছে আসাকাওয়া। আতঙ্কিত হতে শুরু করেছে ও। ওর মনে হলো দৈত্যাকার কোনো হাত ওপর থেকে ধরতে আসছে ওকে। চেপে আসছে উভয় প্রান্তের দেয়াল। পালানোর কোনো পথ নেই।

রুজি! চিৎকার করতে চাইল আসাকাওয়া। কিন্তু একটা শব্দও বের হলো না মুখ দিয়ে। নিশ্বাস নিতে পারছে না ও। মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা আওয়াজ বের হলো শুধু। অবুঝ বাচ্চাদের মতো ওপরের দিকে চাইল ও। ঊরুর ভেতরে উষ্ণ কিছু অনুভব করল আসাকাওয়া।

“আসাকাওয়া! নিশ্বাস নাও!”

অসীম চাপে নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছে আসাকাওয়া।

“সবকিছু ঠিক আছে। আমি আছি এখানে।”

রুজির কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শুনতে পেল ও। কোনোমতে বুক ভরে শ্বাস টানল আসাকাওয়া।

কোনোমতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। এখানে যেটা করা উচিত করতে পারছে না সেটাও। ব্যগ্র হয়ে ভাবতে চেষ্টা করছে অন্য কিছু। সুখের কোনো স্মৃতি। যদি এই কুয়োটা বাইরে আকাশ ভর্তি তারার নিচে হতো তাহলে হয়তো এত ভয়াবহ বোধ হতো না। এরকম অনুভূতি হচ্ছে কেননা কুয়োটা বি-৪ কেবিনের নিচে। এটা মানা কষ্টকর। ফলে বাতিল হয়ে গেছে পালানোর সুযোগও। কংক্রিটের ঢাকনা সরিয়ে নেয়ার পরেও ওপরে রয়ে গেছে ফ্লোরবোর্ড আর মাকড়সার জাল।

গত পঁচিশ বছর ধরে এর ভেতরেই বসবাস করছে সাদাকো ইয়ামামুরা। হ্যাঁ, ঠিক এখানেই। আমার পায়ের তলায়। এটা একটা কবর। হ্যাঁ, অবশ্যই এটা একটা কবর। এর বেশি কিছু ভাবতে পারল না ও। শুধুমাত্র এই চিন্তাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়, কোনোভাবেই সরাতে পারছে না মাথা থেকে। মর্মান্তিকভাবে এই বদ্ধ জায়গায় মরতে হয়েছে সাদাকোকে। আর মৃত্যুর সময় তার মাথায় চলা চিন্তাভাবনা, দুঃস্বপ্ন আটকে রয়েছে এখানেই, বেশ জোরালোভাবে, তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার মাধ্যমে। আর এই বদ্ধ গর্তে অজানা কোনো চক্রাকারে জোয়ার ভাটার হ্রাস বৃদ্ধির মতই নিশ্বাস ফেলছে ওগুলো। নির্দিষ্ট একটা সময়ে টেলিভিশন তরঙ্গে রূপ নিয়ে আবারও ফিরে গিয়েছে দুনিয়ায়। এখনও নিশ্বাস ফেলছে সাদাকো। অজানা কোনো স্থান থেকে সেই নিশ্বাস ক্রমাগত তাড়া করছে ওকে। সাদাকো ইয়ামামুরা, সাদাকো ইয়ামামুরা, এই একটা নাম-ই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওর মস্তিষ্কে। আর কল্পনায় বারবার ভেসে উঠছে সাদাকোর সৌন্দর্যে মোড়ানো চেহারা। চেহারাটা ভেসে উঠতেই বারবার কেঁপে উঠছে আসাকাওয়া। এখানেই রয়েছে সাদাকো ইয়ামামুরা। পাগলের মতো মাটি খুঁড়তে লাগল আসাকাওয়া। তার খোঁজে। সাদাকোর সুন্দর চেহারা ও দেহের কথা ভাবল ও, স্থির রাখতে চাইল নিজের কল্পনায়।

ঐ সুন্দর মেয়েটার দেহাবশেষ আমার পায়ের তলায়, ভাবল ও। কাঁদায় বেলচা চালাতে থাকল ও। সময় কোনো ব্যাপার নয় আর। ঘড়ি খুলে রেখে এসেছে এখানে নামার আগে। অতিরিক্ত অবসাদ ও ধকলের ফলে কেটে গেছে ওর আতঙ্ক। ফলে ডেডলাইন ও কাজের মাত্রার ব্যাপারেও ভুলে গেছে ও। নিজেকেই মনে হচ্ছে মাতাল। হারিয়ে ফেলেছে বাস্তব সময়জ্ঞান। হৃদক্রিয়া আর বালতি ওঠা নামা দেখে কোনোভাবে সময় পরিমাপের উপায় আছে কী? অবশেষে দুই হাতে দিয়ে বড়সড় একটা পাথর আঁকড়ে ধরল আসাকাওয়া। মসৃণ একটা পাথর। স্পর্শ করেও শান্তি। দুটো এবড়ো থেবড়ো গর্ত রয়েছে পাথরের দুই প্রান্তে। পানি থেকে পাথরটা ওঠাল ও। ময়লা পরিষ্কার করল পাথর থেকে। বুঝতে পারল পাথরের গর্তদুটো আসলে কানের ফুটো, আর পাথরটা মানব কঙ্কালের মাথা। কল্পনায় চামড়া চড়াল কঙ্কালের মাথাতে, বড়, সুন্দর চোখ গিয়ে বসল অক্ষি কোটরে আর মধ্যেখানের ছোট্ট দুটো ছিদ্রে সৃষ্টি হলো মাংসল নাকের। লম্বা চুলগুলো ভেজা, পানি ঝরছে দুটো কান দিয়ে। সাদাকো ইয়ামামুরা দুই-তিনবার পলক ফেলে পানি ঝেড়ে ফেলল চোখের পাতা থেকে। আসাকাওয়ার হাতে ধরা অবস্থাতেই ব্যথায় বিকৃত দেখাল তার চেহারা। তবুও তার সৌন্দর্য স্পষ্ট। আসাকাওয়ার দিকে চেয়ে হাসল সে, এরপর চোখ সরু করে স্থির করল দৃষ্টি।

আমি দেখা করতে চাচ্ছিলাম তোমার সাথেই, এটা ভাবার সাথে সাথেই ধপাস করে পড়ে গেল আসাকাওয়া। ওপর থেকে ভেসে আসছে রুজির কণ্ঠ।

“আসাকাওয়া, তোমার ডেডলাইন ১০:০৪ মিনিট না? ইয়ে! এখন ১০:১০ বাজে।

“আসাকাওয়া শুনতে পাচ্ছ? এখনও বেঁচে আছ তো, তাই না? অভিশাপ কেটে গেছে। আমরা নিরাপদ। হেই, আসাকাওয়া! ওখানেই মরলে তোমারও তার মতোই অবস্থা হবে। শালা, মরলে আবার আমাকে অভিশাপ দিয়ে যেয়ো না। মরলে ভালোভাবেই মরো ভাই। ঐ আসাকাওয়া, বেঁচে থাকলে জবাব দে ভাই আমার। বাল!”

রুজির কণ্ঠ শুনল ও। তবে নিরাপদ বোধ করছে না এখনও। সাদাকো ইয়ামামুরার কঙ্কাল বুকের সাথে চেপে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল আসাকাওয়া। যেন এই মুহূর্তে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *