চতুর্থ পর্ব : তরঙ্গ

চতুর্থ পর্ব : তরঙ্গ

অধ্যায় এক

১৯ অক্টোবর, শুক্রবার

ম্যানেজার অফিস থেকে আসা ফোনকলে তন্দ্রাবস্থা থেকে জেগে উঠল আসাকাওয়া। চেক আউটের সময় সকাল এগারোটা, ওদেরকে মনে করিয়ে দিল ম্যানেজার। জানতে চাইল ওরা আরেক রাত থাকতে চায় কিনা। হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে ঘড়িটা উঠিয়ে সময় দেখল আসাকাওয়া। ক্লান্ত হয়ে আছে ওর হাতদুটো। সামান্য হাত উঁচু করাই কষ্টকর এখন। এখনও কোনো ক্ষতি হয়নি ওদের। তবে পরিশ্রমের ফলে শরীরে অমানুষিক ব্যথা। চোখে চশমা নেই। ফলে চোখের কাছাকাছি ঘড়িটা না এনে দেখতে পেল না কয়টা বাজে। এগারোটা বেজে পার হয়েছে কয়েক মিনিট। বুঝতে পারল না কি বলবে ম্যানেজারকে। এমনকি বুঝতেও পারছে না কোথায় আছে এই মুহূর্তে।

“আপনারা কি আরেক রাত থাকবেন?” কণ্ঠের বিরক্তি লুকিয়ে জিজ্ঞেস করল ম্যানেজার। ঘুমের ঘরে আসাকাওয়ার পাশে গোঙাল রুজি। ওদের রুম নয় এইটা। এটুকু নিশ্চিত। মনে হচ্ছে ওর অজান্তেই নতুন রঙে রাঙানো হয়েছে পুরো দুনিয়াকে। মোটা একটা লাইন সংযুক্ত করছে অতীতের সাথে বর্তমান ও বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতকে। সময়কালকে দুটো ভাগে ভাগ করলে হয়: ওর ঘুমের আগের সময় আর ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরের সময়।

“হ্যালো?”

উদ্বিগ্ন শোনাল ম্যানেজারের কণ্ঠ। ফোনের অপর প্রান্তে কেউ নেই ভেবেছে সে। অজানা কারণেই বুকের মধ্যে একধরনের আনন্দ অনুভব করছে আসাকাওয়া। ঘুরে শুয়ে সামান্য চোখ খুলল রুজি। হা করে শুয়ে আছে সে। ঝাপসা হয়ে গিয়েছে আসাকাওয়ার স্মৃতি। অন্ধকার ছাড়া কিছুই মনে পড়ছে না আর। শুধুমাত্র ডক্টর নাগাওয়ের ওখানে যাওয়া আর ওখান থেকে ভিলা লগ কেবিনের আসার স্মৃতি মনে আছে ওর। বাকি সবকিছুই অস্পষ্ট। ভেসে আসছে একের পর এক অন্ধকার স্মৃতি। ভাবতে গেলেই আটকে যাচ্ছে নিশ্বাস। মনে হচ্ছে জেগে উঠেছে ভয়ঙ্কর স্পষ্ট কোনো

দুঃস্বপ্ন দেখে। যেসব স্বপ্ন ঘুম ভাঙার পরেও প্রভাব ফেলে মনের মধ্যে। কিন্তু কোনো কারণে আত্মবিশ্বাসী বোধ করছে ও।

“হ্যালো? শুনতে পাচ্ছেন কি?”

“উহ, হ্যাঁ।” কোনোমতে ফোনের রিসিভার ধরে অবশেষে উত্তর দিল আসাকাওয়া।

“আপনাদের চেক আউটের সময় সকাল এগারোটা।”

“বুঝতে পেরেছি। জিনিসপত্র গুছিয়েই বের হচ্ছি।” সহযোগিতাপূর্ণ ভঙ্গিতে জবাব দিল আসাকাওয়া। কিচেন থেকে পানি পড়ার আওয়াজ পেল ও। মনে হচ্ছে ঘুমুতে যাওয়ার আগে কেউ টাইট করে লাগায়নি পানির ট্যাপ। ফোন রেখে দিল ও।

আবারও চোখ বন্ধ করেছে রুজি। তাকে ধাক্কা দিল আসাকাওয়া। “হেই রুজি! ওঠ, এখনই।”

ধারণা নেই কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ওরা। সাধারণত রাতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার বেশি ঘুমায় না আসাকাওয়া। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সময়ের থেকেও অনেক বেশি ঘুমিয়েছে ও। বহুদিন পর কোনো ঝামেলা, দুশ্চিন্তা ছাড়াই লম্বা সময় ঘুমাতে পারল ও।

“রুজি, এখনই উঠে না বেরোলে শালারা আরেক রাতের ভাড়া নিয়ে নেবে।” জোরে ধাক্কা দিলে রুজিকে। কিন্তু উঠল না সে। আশপাশে তাকিয়ে টেবিলের ওপর সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখতে পেল আসাকাওয়া। হঠাৎ করেই গতরাতের কিছু অংশ মনে পড়ল ওর। টের পেল কী আছে ওতে।

সাদাকোর নাম ধরে ডাকা, শীতল মাটির তলা থেকে টেনে বের করা, ব্যাগে ঢোকানো, মনে পড়ল ওর। পানি গড়ানোর শব্দ…গতরাতে সিঙ্কে সাদাকোর দেহাবশেষ ধুয়ে পরিষ্কার করেছে রুজি। ফলে এখনও সিঙ্কের ট্যাপ থেকে পড়ছে পানি। এরইমধ্যে পার হয়ে গেছে বেঁধে দেয়া সময়। আর এখনও বেঁচে আছে আসাকাওয়া। আনন্দে আত্মহারা ও। ওর কাঁধে নিশ্বাস ফেলছিল মৃত্যু, সেটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা গেছে, জীবনটাকে মনে হচ্ছে অনন্য। সাদাকোর মাথার খুলি অসাধারণ। যেন মার্বেল পাথরের তৈরি কোনো ভাস্কর্য।

“রুজি! হারামজাদা ওঠ!”

হঠাৎ করেই বিশ্রী একটা অনুভূতি ভর করল ওর মনে। মনের গহীনে দেখা দিয়েছে আশঙ্কা। রুজির বুকে কান পাতল ও। শার্টের ওপর দিয়ে রুজির হৃৎস্পন্দন শুনতে চাচ্ছে আসাকাওয়া। জানতে চাচ্ছে এখনও জীবিত কিনা সে। কিন্তু বুকে কান পাতার সাথে সাথেই ওর মাথা দুই হাত দিয়ে আকড়ে ধরল রুজি। হাত পা নাড়িয়ে রীতিমত সংগ্রাম করতে লাগল ও, ছাড়া পাওয়ার জন্য।

“হেহে! কী মনে করেছিলে? মরে গেছি আমি?” আসাকাওয়ার মাথা ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসতে লাগল রুজি। বাচ্চাদের মতো হাসি। যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ওরা এরপরও সে কীভাবে এরকম ফাইজলামি করতে পারে? ঘটতে পারত যেকোনো কিছুই। যদি টেবিলের পাশে সাদাকো ইয়ামামুরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুজি নিজের চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে মারা যেত, সেটাও বিশ্বাস করত আসাকাওয়া। রাগ নিয়ন্ত্রণ করল ও। রুজির কাছে কৃতজ্ঞ।

“ইয়ার্কি বন্ধ কর।”

“এখন শোধ নিচ্ছি। গতরাতে এভাবেই আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তুমি।” আবারও হাসতে আরম্ভ করল রুজি।

“কী করেছিলাম আমি?”

“কুয়োর তলায় ফিট খেয়ে পড়ে ছিলে। সত্যি ভেবেছিলাম পটল তুলেছ তুমি। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। সময় পার হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম তোমার খেল খতম।”

কিছুই বলল না আসাকাওয়া। কয়েকবার পলক ফেলল শুধুমাত্র।

“হাহ, তোমার সম্ভবত কিছুই মনে নেই। শালা অকৃতজ্ঞ বন্ধু।”

কিছুক্ষণ ভাবল ও। নিজ থেকেই কুয়োর ওপরে উঠে আসার কথা মনে নেই ওর। অবশেষে মনে পড়ল দড়িতে ঝুলে থাকার কথা। নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল সব শক্তি। ষাট কেজি ওজনের দেহ চার অথবা পাঁচ মিটার ওপরে টেনে তোলা মুখের কথা নয়। এমনকি রুজির মতো শক্তিশালী কারও পক্ষেও। ঝুলে থাকার স্মৃতি হারিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। কল্পনায় ভেসে উঠল এন নো ওজোনো’র পাথরের মূর্তি সমুদ্র থেকে টেনে তোলার দৃশ্য। রহস্যজনক ভাবে অলৌকিক শক্তি ভর করেছিল শিযুকুর মধ্যে, মূর্তিটা টেনে তোলার সময়। কিন্তু ওকে টেনে তুলতে ব্যথা ও ঝামেলা পোহাতে হয়েছে রুজিকে।

“রুজি?” অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে তাকে ডাকল আসাকাওয়া।

“কি?”

“যা যা করেছ, সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। আমি সত্যি কৃতজ্ঞ।”

“নাটক শুরু কইরো না তো।”

“তুমি যদি না থাকতে তাহলে… বুঝতেই পারছ। যাইহোক, ধন্যবাদ বন্ধু।”

“বাল আমার! আবেগে কান্দাইয়ে দিবা তো আমাকে। কৃতজ্ঞতার এক পয়সাও দাম নাই বাড়া।”

“আচ্ছা, লাঞ্চ করলে কেমন হয়? আমি খাওয়াচ্ছি।”

“আহ, এই তো লাইনে এসেছো। ভালোই হয় তাহলে।” সামান্য হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়াল রুজি।

আশিকাগায় স্ত্রীকে ফোন করল রুজি। প্রতিজ্ঞামত রবিবারে গাড়ি ভাড়া করে উঠিয়ে নেবে ওদেরকে, জানাল ও।

তাহলে সবকিছু সামলে নিয়েছ, জিজ্ঞেস করেছিল ওর স্ত্রী।

“সম্ভবত।” শুধু এটুকুই বলতে পারল আসাকাওয়া। ব্যাপারটা হলো এখনও বেঁচে আছে ও, এখানে দাঁড়িয়ে আছে রীতিমত, ধরেই নেয়া যায় আর সমস্যা নেই। কিন্তু ফোন রাখার সময় কিছু একটা গভীরভাবে বিব্রত করল ওকে। কোনোভাবেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না ব্যাপারটা। যেহেতু ও বেঁচে আছে, সেহেতু বিশ্বাস করতে চাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু… ভাবল রুজিরও একই সংশয় কাজ করছে কিনা। টেবিলে ফেরত এসে জিজ্ঞেস করল তাকে, “সত্যি ফাঁড়া কেটে গেছে, তাই না?”

আসাকাওয়ার ফোনে কথা বলার সময় গোগ্রাসে খাবার গিলছিল রুজি। “তোমার পরিবার ঠিক আছে তো?” আসাকাওয়ার প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দিল না রুজি।

“হ্যাঁ। রুজি, তোমার কি এমন কিছু মনে হচ্ছে, যে এখনও ব্যাপারটা শেষ হয়নি?”

“দুশ্চিন্তা হচ্ছে?”

“তোমার হচ্ছে?”

“হয়তো।”

“কী নিয়ে? কী বিব্রত করছে তোমাকে?”

“ভিডিওর বৃদ্ধা যা বলেছিল, পরের বছর একটা সন্তান জন্ম দেবে তুমি। তার এই ভবিষ্যৎবাণী।”

এখন ও বুঝতে পারল, ওর মতো রুজির সংশয়ও একই। সংশয়গুলো দূর করতে চাইল আসাকাওয়া।

“হয়তো এই ‘তুমি’ বলতে সাদাকোকে নয়, শিযুকুকে বুঝিয়েছে বৃদ্ধা।”

সরাসরি এই সম্ভাবনা বাতিল করল রুজি। “এটা সম্ভব নয়। ভিডিওর দৃশ্যগুলো এসেছে সাদাকোর নিজের অন্তরের ভেতর থেকে তাকে উদ্দেশ্য করেই বলছিল বৃদ্ধা। এই ‘তুমি’ সাদাকো ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।”

“হয়তো তার ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে।”

“সাদাকোর ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা একেবারে শতভাগ অব্যর্থ।”

“কিন্তু সাদাকো তো শারীরিকভাবে সন্তান গ্রহণে অক্ষম ছিল।”

“এজন্যেই অদ্ভুত লাগছে। বায়োলজিক্যালি, সাদাকো একজন পুরুষ, নারী নয়। ফলে গর্ভধারণের কোনো উপায় ছিল না তার। এর ওপর আবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কুমারী ছিল সে। আর…”

“আর?”

“তার প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা হলো নাগাও। জাপানের সর্বশেষ গুঁটি বসন্তের রোগী। কাকতালীয়ভাবে।”

সুদূর অতীতে বলা হতো, ঈশ্বর ও শয়তান, কোষ ও জীবাণু, পুরুষ ও নারী এমনকি আলো ও অন্ধকার, সবই একে অপরের অনুরূপ। এদের মধ্যে নেই কোনো অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ। অস্বস্তিবোধ হচ্ছে আসাকাওয়ার। প্রশ্নটা যখন জিনগত বৈশিষ্ট্য বা পৃথিবীর আদি অবস্থার দিকে চলে যায়, সেসময় জবাবটা আর একজনের জন্য নিবদ্ধ থাকে না।

এই মুহূর্তে সংশয়গুলো দূরে সরিয়ে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, নিজেকে এমনটা বোঝানো ছাড়া আর কিছুই করার নেই আসাকাওয়ার।

“কিন্তু জীবিত আছি আমি। ভিডিওর ধাঁধার সমাধান করা গেছে। কেস খতম।”

ঠিক তখনই কিছু একটা মনে পড়ল আসাকাওয়ার। এন নো ওজোনোর মূর্তিকে কি এটার নিজের ইচ্ছাতেই ওঠানো হয়নি সাগরতল থেকে? এই ইচ্ছাশক্তি ভর করেছিল শিযুকুর ওপর, পথ দেখিয়েছিল তাকে, ফলাফলস্বরূপ সে পেয়েছিল অলৌকিক শক্তি। হঠাৎ করেই এই প্যাটার্ন পরিচিত ঠেকছে আসাকাওয়ার। কুয়োর তলা থেকে সাদাকোর দেহাবশেষ উঠিয়ে আনা আর সাগরতল থেকে ওঠানো এন নো ওজোনোর মূর্তি। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস-ই বিব্রত করছে ওকে। এই অলৌকিক ক্ষমতা শুধু দুর্ভোগ- ই বয়ে এনেছিল শিযুকুর। কিন্তু এভাবে দেখলে আবার সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন ধারণার। সম্ভবত আসাকাওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি আর শিযুকুর অলৌকিক ক্ষমতা গ্রহণ, দুটো ঘটনার গুরুত্ব পরস্পর সমান। এমনটাই ধরে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল আসাকাওয়া।

আসাকাওয়ার দিকে তাকাল রুজি। ভাবল লোকটা এখনও লোকটা বসে রয়েছে তার সামনে, জীবিত অবস্থায়, দুইবার মাথা নেড়ে সায় জানাল সে।

“আমার মনে হয় যুক্তি আছে তোমার কথায়।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিল রুজি। “আর এখনও ভাবছি…

“কী?”

উঠে দাঁড়িয়েছে রুজি। যেন জিজ্ঞেস করল নিজেকেই, “কী জন্ম দিয়েছিল সাদাকো?”

অধ্যায় দুই

আতামি স্টেশনে এসে ভিন্ন পথ ধরল দুজনে। দেহাবশেষ নিয়ে সাসিকিজিতে সাদাকোর আত্মীয়ের ওখানে যাওয়ার কথা আসাকাওয়ার। দেহাবশেষ মর্যাদার সাথে সমাহিত করতে বলবে ওদেরকে। সম্ভবত ওদের বুঝতে পারার কথা নয়, কী করতে হবে ওগুলো নিয়ে। একে তো দুঃসম্পর্কের আত্মীয়, এরমধ্যে আবার কোনো যোগাযোগ ছিল না গত ত্ৰিশ বছর। কিন্তু ব্যাপারটা হলো, কোনোমতে দায়সারাভাবে তাকে পরিত্যক্ত করতে পারবে না আসাকাওয়া। সে আসলে কে, এটা না জানা থাকলে হয়তো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবেই সমাহিত করত। কিন্তু ভালোমত জানে ও। যেকারণে সম্মানে ওদের হাতে সমর্পণ করবে ঐ দেহাবশেষ। বহু আগেই কেটে গেছে এই মৃত্যুর আইনগত বিধি। নতুন করে খুনের মামলা করাও এখন মহা ঝামেলা। এই কারণে তার মৃত্যুকে সম্ভাব্য আত্মহত্যা বলার সিদ্ধান্ত নিল আসাকাওয়া। আত্মীয়দের কাছে এটা বুঝিয়ে দিয়ে যতদ্রুত সম্ভব টোকিওতে ফিরতে চায় ও। কিন্তু ওখান থেকে সবসময় চলাচল করে না বোট। হয়তো রাতটা কাটাতে হবে ওশিমাতেই। যেহেতু রেন্টাল কারটা আতামিতে ছেড়ে দিতে হবে, সেহেতু টোকিওতে ফিরে যাওয়া বেশ সমস্যা হবে ওর জন্য।

“তুমি নিজেই গিয়ে দেহাবশেষ বুঝিয়ে দিতে পারবে ওদেরকে। আমাকে প্রয়োজন হবে না এই কাজে।” আতামি স্টেশনে গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হেসে কথাটা বলেছিল রুজি। সাদাকোর দেহাবশেষ আর প্লাস্টিক ব্যাগে নেই। কালো একটা কাপড়ে সুন্দরভাবে মুড়িয়ে গাড়ির সিটের নিচে রাখা ওটা। সত্যি বলতে, এতই ছোট একটা পুটলি ওটা, যেকোনো বাচ্চাও পারবে সাসিকিজিতে বসবাস করা আত্মীয়দেরকে হস্তান্তর করতে। কিন্তু যদি ওরা নিতে সম্মতি না জানায়, তখন বিপদে পড়বে আসাকাওয়া। ওগুলো নিয়ে যাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকবে না। আসাকাওয়ার মনে হচ্ছে আত্মীয় বা কাছের মানুষরা মর্যাদার সাথে দেহাবশেষ সমাহিত করার পরেই পূর্ণতা পাবে পুরো ব্যাপারটা। কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে, হাড়গোড় নিয়ে ওদের দরজায় গিয়ে দাঁড়ানোর পর কেন ওরা বিশ্বাস করবে ওর কথা? বিশেষ করে যেখানে সাদাকোর খোঁজ নেই পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে। কী প্রমাণ আছে ওর হাতে? এখনও কিছুটা দুশ্চিন্তাবোধ করছে আসাকাওয়া।

“আচ্ছা, হ্যাপি জার্নি। টোকিওতে দেখা হবে।”

হাত নেড়ে টিকেট কাউন্টারের কাছে চলে গিয়েছিল রুজি। “হাতে প্রচুর কাজ। নাহলে তোমার সাথে যেতে কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু তুমি তো জানোই, কীভাবে করতে হবে কাজটা।”

আসলেই পাহাড়সম কাজ জমা পড়েছে রুজির। লেকচার প্রস্তুত করা, আর্টিকেল লেখা। জরুরি ভিত্তিতে সারতে হবে এসব।

“তোমাকে আবারও ধন্যবাদ।”

“ভুলে যাও এসব। আমিও মজা পেয়েছি এই কাজে।”

রুজি প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর, চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তার দিকে তাকিয়ে ছিল আসাকাওয়া। দৃষ্টিসীমা থেকে নাই হওয়ার ঠিক আগে, তাড়াহুড়োয় সিঁড়ির ওপর পা হড়কে পড়তে লেগেছিল রুজি। দূর থেকে আসকাওয়ার কাছে একমুহূর্তের জন্য দ্বিগুণ দেখাচ্ছিল রুজির অবয়ব। নিজের ক্লান্তি ধরতে পেরেছিল আসাকাওয়া। হাত দিয়ে চোখ ডলছিল ও। চোখ থেকে হাত সরিয়েই দেখতে পেয়েছিল দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে গেছে রুজি। একধরনের কৌতূহল অনুভূত হয়েছিল ওর ভেতরে। হঠাৎ করেই পেয়েছিল হালকা সুগন্ধ …

কোনোরকম নাটকীয়তা ছাড়াই বিকেলের মধ্যে সাদাকোর দেহাবশেষ তাকাশি ইয়ামামুরাকে হস্তান্তর করল আসাকাওয়া। মাছ ধরে কেবল ফিরেছিল সে। আসাকাওয়ার হাতে কালো ব্যাগ দেখেই বুঝে নিয়েছিল কী রয়েছে ওতে। দুই হাতে সেটা ধরে বলেছিল আসাকাওয়া, “এটা সাদাকোর দেহাবশেষ।”

কিছুক্ষণ জিনিসটার দিকে চেয়ে চোখ সরু করে তাকিয়েছিল তাকাশি। আসাকাওয়ার দিকে সামান্য এগিয়ে, বো করে ওটা গ্রহণ করে নিয়েছে সে। বলেছিল, “ধন্যবাদ আপনাকে। এতদূর বয়ে নিয়ে আসার জন্য।”

একটু আশ্চর্য হয়েছিল আসাকাওয়া। এত সহজেই লোকটা গ্রহণ করবে ভাবতেই পারেনি ও। সম্ভবত তাকাশি ধরতে পেরেছিল কী ভাবছে আসাকাওয়া। একারণেই দৃঢ় বিশ্বাসে বলল সে, “এটা অবশ্যই সাদাকোর দেহাবশেষ।”

শুরুতে তিন বছর বয়স, এরপর নয় থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত এখানে থেকেছে সাদাকো। এই ইয়ামামুরা এস্টেটে। তাকাশির বয়স এখন একষট্টি। তার চোখে কেমন ছিল সাদাকো? দেহাবশেষ গ্রহণের সময় তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো খুবই ভালোবাসত সে সাদাকোকে। এইটা যে সাদাকো, এই ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা চায়নি সে। সম্ভবত সেটার দরকারও নেই তার। হয়তো সে মনের গহীন কোণ থেকে নিশ্চিতভাবে জানে কালো কাপড়ে মোড়ানো দেহাবশেষ সাদাকোর-ই। প্রথমবার জিনিসটা দেখার পরেই জ্বলজ্বল করে উঠেছিল তার চোখ। নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক কিছু কাজ করেছে এক্ষেত্রেও

কাজ শেষ করে যতদ্রুত সম্ভব সাদাকোর থেকে দূরে সরে যেতে চাইল আসাকাওয়া। ফলে চলে আসার জন্য মিথ্যে বলল ও, “তাড়াতাড়ি যেতে হবে। নাহলে আবার ফ্লাইট মিস করব।”

এরইমধ্যে যদি হঠাৎ করেই এই পরিবারের মন পরিবর্তন হয়ে গিয়ে প্রমাণ ছাড়া সাদাকোর দেহাবশেষ গ্রহণ করতে না চায়, তবে মহা বিপদে পড়বে ও। যদি বিস্তারিত জানতে চায় ওরা, তবে ওর জানা নেই কী বলবে। দীর্ঘদিন পেরিয়ে না গেলে হয়তো কাউকেই বলতে পারবে না পুরো কাহিনিটা। বিশেষ করে সাদাকোর পরিবারের কাছে তো নয়-ই।

সাহায্যের জন্য হায়াৎসুকে ধন্যবাদ জানাতে তার ওখানে গেল আসাকাওয়া। এরপর এগিয়ে গেল ওশিমা হট স্প্রিং হোটেলের দিকে। গরম পানি দিয়ে গোসল করে ক্লান্তি কাটাতে চাচ্ছে ও। ক্রমানুসারে লিখে ফেলতে হবে ঘটনাগুলোও।

অধ্যায় তিন

হট স্প্রিং হোটেলে উঠেছে আসাকাওয়া। ঠিক একই সময়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের ডেস্কে বসে ঝিমুচ্ছে রুজি। অর্ধেক লেখা প্রতিবেদনের ওপর মাথা দিয়ে আছে ও। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া লালায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে নীল কালিতে লেখা অক্ষর। এতই ক্লান্ত হাত থেকে পছন্দের মন্টেব্ল্যাঙ্ক কলমটা নামিয়ে রাখতেও ভুলে গেছে সে। এখনও ওয়ার্ড প্রসেসরে অভ্যস্ত হতে পারেনি রুজি।

হঠাৎ করেই কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে উঠল তার, অস্বস্তিতে বিকৃত হয়ে গেল মুখ। উঠে বসল রুজি। একেবারে সোজা হয়ে গেছে তার মেরুদণ্ড। চোখ বড় বড় করে তাকাল সে। যেমনটা ঘুম থেকে ওঠার পর করে। সাধারণত তির্যক রুজির চোখ, কিন্তু যখন ওভাবে তাকায় সেসময় একেবারে ভিন্ন দেখায় তাকে। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু সুন্দর। এখন লাল হয়ে আছে তার চোখ। স্বপ্ন দেখছিল রুজি। সাধারণত কোনো কিছুতেই ভয় পায় না সে। কিন্তু এই মুহূর্তে কাঁপতেই আছে ঘনঘন। কী স্বপ্ন দেখছিল ঠিক মনে নেই। কিন্তু শরীরের কাঁপুনি, ক্লান্তি সাক্ষ্য দিচ্ছে কতটা আতঙ্কের ছিল স্বপ্নটা। নিশ্বাস নিতে পারছে না রুজি। ঘড়ির দিকে তাকাল। ৯:৪০ বাজে। তৎক্ষণাৎ সময়ের তাৎপর্য ধরতে পারল না সে। মাথার ওপর ফ্লুরাসেন্ট বাল্ব, টেবিলে ডেস্ক ল্যাম্প, আলোর অভাব নেই চারদিকে। তবুও অন্ধকার বোধ হলো রুজির। প্রবৃত্তিগত ভয় অনুভব করল অন্ধকারের। অন্ধকারের-ই রাজত্ব ছিল তার দেখা স্বপ্নে।

চেয়ার ঘুরিয়ে ভিডিও ডেকের দিকে তাকাল রুজি। অভিশপ্ত টেপটা এখনও ওখানে। কোনো কারণে ওদিক থেকে চোখ সরাতে পারল না। চেয়েই রইল ওদিকে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তার। অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে চেহারায়। কল্পনায় ভেসে উঠছে বিভিন্ন দৃশ্য। যৌক্তিক চিন্তাভাবনার কোনো সুযোগ-ই পাচ্ছে না সে।

“বাল। তুমি তাহলে…“

ডেস্কে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করল কী দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পেছনে। তার অ্যাপার্টমেন্ট বেশ নিরিবিলি। মেইন রাস্তা থেকে একটু দূরে। যা আওয়াজ আসার ঐ রাস্তা থেকেই আসে। মাঝেমধ্যে শোনা যায় ইঞ্জিনের উচ্চ শব্দ অথবা ভারী যানবাহনের টায়ারের শব্দ। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই শোনা যায় না কোলাহল। ভারী ভরের কিছু একটা ডান বামে নড়াচড়া করছে তার পিছনে। কান খাড়া করে টের পেল কয়েকটা শব্দ। এর মধ্যে রয়েছে কিছু পোকামাকড়ের আওয়াজ। এই মিশ্র আওয়াজগুলো শুনে মনে হলো উড়ে বেড়াচ্ছে কোনো ভূত। ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে বাস্তবিক আবহ, এমনটাই মনে হলো রুজির। আর বাস্তবতা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে সৃষ্টি করছে শূন্যস্থান, যেখানে বিচরণ করছে অলৌকিক কিছু। রাতের শীতল বাতাস ও আর্দ্রতা জেঁকে বসেছে তার দেহে। সৃষ্টি হয়েছে ছায়ার। যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে ছায়াটা। ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে রুজির। চাপ বাড়ছে বুকের মধ্যে। ঘড়ির দিকে তাকাল রুজি রাত ৯:৪৪ বাজে। যতবার-ই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, ঢোক গিলছে ততবার-ই।

এক সপ্তাহ আগে আসাকাওয়ার বাড়িতে বসে যখন ভিডিওটা দেখছিলাম, কয়টা বাজছিল সেসময়? আসাকাওয়া বলেছিল ওর বউ সবসময় নয়টা নাগাদ ঘুমাতে যায়… সম্ভবত ঐ সময়ের পরেই প্লে বাটন চেপেছিলাম আমরা। তাহলে দেখা শেষ হয়েছে।

আর ভাবতে পারল না সে। বের করতে পারল না ওদের ভিডিও দেখে শেষ করার সময়টা। কিন্তু বুঝতে পারল খুবই দ্রুত কেটে যাচ্ছে সময়। যেসব লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে ওগুলো ভ্রম নয়, এই ব্যাপারে অবগত রুজি। কল্পনায় সৃষ্ট আতঙ্কের চেয়ে এই পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ আলাদা। গর্ভধারণের অভিজ্ঞতা কেমন, সেটা যেমন বাস্তবে না জানলে কল্পনা করা সম্ভব নয়, ঠিক ওরকম-ই। ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে জিনিসটা। কিন্তু রুজি জানেনা কী?

আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন ওটা? আমিই কেন? আসাকাওয়া নয় কেন? এগুলা অবিচার।

সংশয়ের ঝড় চলছে রুজির মনে।

কী হচ্ছে এসব? আমরা তো ভিডিওর ধাঁধার সমাধান করেছি। তাহলে কেন? কেন? কেন?

যেন অ্যালার্ম বাজছে তার বুকের মধ্যে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে কিছু একটা প্রবেশ করে চেপে ধরেছে ওর হৃদপিণ্ড। ব্যথার স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে। ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করল গলায়। কাঁপতে আরম্ভ করেছে রুজি। ওঠার চেষ্টা করল চেয়ার থেকে। কিন্তু ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল পিঠ ও কোমরে। পড়ে গেল মেঝের ওপর।

ভাবো! কী করা উচিত তোমার।

কোনো না কোনোভাবে তার অবশিষ্ট চেতনা নির্দেশ দিল পুরো শরীরকে। দাঁড়াও! উঠে দাঁড়াও! মাথা খাটাও। নিজেকেই বলল সে। মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে ভিডিও ডেকের ওখানে পৌঁছাল রুজি। ইজেক্ট বাটন চেপে বের করে আনল টেপটা

এটা কেন করছি আমি? নিজেকেই প্রশ্ন করল সে। কিছুই করার নেই তার। দীর্ঘমুহূর্ত তাকিয়ে থাকল টেপের দিকে। এই টেপটা যত নষ্টের গোড়া। টেপটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে আবারও ভিডিও দেখে ঢোকাতে গিয়েও থেমে গেল সে। টেপের স্পাইনে ছোট্ট করে লেখা রয়েছে কিছু। হাতের লেখাটা আসাকাওয়ার। লিযা মিনেলি, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, স্যামি ডেভিস, জুনিয়র/১৯৮৯। ভিডিওটা আসাকাওয়া কপি করার আগে নিশ্চয়ই মিউজিক প্রোগ্রাম রেকর্ড করা ছিল এতে। বিদ্যুৎ খেলে গেল রুজির মেরুদণ্ডে। একটা মাত্র চিন্তায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে তার আপাত শূন্য মস্তিষ্কে। নির্বোধ, মস্তিষ্কে চিন্তাটা খেলে যাওয়ার পর নিজেকেই বলল সে। কিন্তু টেপটা চালু করার পর মুহূর্তের সংশয় দূর করে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেল রুজি। এবার সে বুঝতে পারল অনেক কিছু। ধাঁধার সমাধান, বৃদ্ধার ভবিষ্যৎবাণী, টেপের দৃশ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতা… কেন ঐ চারজন ছেলেমেয়ে সমাধানের চেষ্টা না করেই মরেছে? কেন রুজিকে মরতে হচ্ছে যেখানে মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পেরেছে আসাকাওয়া। কিসের জন্ম দিয়েছিল সাদাকো? হিন্ট’টা একেবারে সঠিক, হাতের কাছেই ছিল একেবারে। সাদাকোর ক্ষমতা অন্য একটা ক্ষমতার কাছে ম্লান হয়ে যাবে, বুঝতে পারেনি সে। বাচ্চা নিতে চাইত সাদাকো, কিন্তু বাচ্চা নেয়ার সক্ষমতা ছিল না তার শরীরের। ফলে অনেকগুলো সন্তানের জন্য শয়তানের সাথে চুক্তি করেছিল সে। ভিডিওতে বলা হয়েছে, ‘কী প্রভাব পড়তে চলেছে এর কারণে?’ ভাবল রুজি। অবর্ণনীয় ব্যথার মধ্যেও হেসে উঠল সে, নিজের অদৃষ্ট্যের পরিহাসের কথা ভেবেই হাসি পেল তার।

দারুণ কাব্যিক রসিকতা! আমি মানবজাতির ধ্বংসের দেখতে চাইতাম। এখন আমি-ই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি!

হামাগুড়ি দিয়ে টেলিফোনের কাছে গিয়ে আসাকাওয়ার বাড়ির নম্বরে ডায়াল করতে লাগল সে। তখনই মনে পড়ল: আসাকাওয়া ওশিমায়।

নিশ্চিত হারামজাদা চমকে যাবে, যখন শুনবে মারা গেছি আমি, ভাবল রুজি। প্রচণ্ড চাপ পড়ছে বুকের মধ্যে, মনে হচ্ছে যেন ভেঙে যাবে পাঁজর। মেই তাকানোর নম্বরে ডায়াল করল রুজি। জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া নাকি শেষবারের মতো মেই’য়ের কণ্ঠ শুনে মৃত্যুর আগে নিজেকে সামান্য উবুদ্ধ করা, ফোন করার কারণ কোনটা, জানা নেই রুজির। দুইয়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারল না সে। তবে নিজের মস্তিষ্কের ভেতরে শুনতে পেল একটা কণ্ঠস্বর

বাদ দাও! তাকে এসব ঝামেলায় জড়ানোর কোনো মানে নেই।

কিন্তু অপরদিকে সে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে রয়েছে আশা। এখনও হয়তো সময় রয়েছে নিজেকে বাঁচানোর।

ডেস্কের ওপর রাখা ঘড়িতে চোখ আটকাল তার, ৯:৪৮ বাজে। কানে ফোনের রিসিভার ধরে মেইয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকল সে। হঠাৎ করেই অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। মাথায় হাত রেখে ভয়াবহভাবে ঝাঁকাতে লাগল সে। খেয়াল করল চুল উঠে এসেছে কয়েক গোছা। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সময় চেহারা বিকৃত করে ফেলল রুজি। লম্বা একটা আয়না রয়েছে তার সামনে। নিজের চেহারার প্রতিফলন দেখতে পেল সেখানে। কানে ফোন ধরা আছে সেটা ভুলেই আয়নার কাছাকাছি মুখ নিয়ে গেল সে। পড়ে গেছে রিসিভারটা। কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার। আয়নায় নিজের চেহারার দিকেই তাকিয়ে রইল শুধু। অন্য কারো চেহারার প্রতিফলন ফুটে উঠেছে সেখানে। গালদুটো হলুদাভ, শুকনো, ভেঙে যাওয়া। আয়নার অবয়বের চুল পড়ে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে মাথার ক্ষতস্থান।

দৃষ্টিভ্রম? দৃষ্টিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়, নিজেকেই বলল সে। এরপরও নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না নিজেকে। মেঝেতে পড়ে থাকা রিসিভার থেকে ভেসে আসছে নারী কণ্ঠ: “হ্যালো! হ্যালো!”

টেরই পেল না রুজি। চিৎকার করে উঠল সে। তার চিৎকার ছাপিয়ে গেল মেইয়ের কণ্ঠকে। সবশেষে, আর শোনা হলো না তার প্রিয় কণ্ঠস্বর। আয়নার অবয়ব রুজির ছাড়া আর কারোর না, তবে সেটা সুদূর ভবিষ্যতের, তার একশো বছরের বেশি বয়সের অবয়ব। এমনকি রুজিও কখনো ভাবতে পারেনি, তারই ভবিষ্যতের চেহারা দেখে এত ভয় পাবে সে।

চতুর্থবার রিং হওয়ার পর ফোন উঠিয়েছে মেই তাকানো: “হ্যালো!”

চিৎকার ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেল না সে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে রুজির অ্যাপার্টমেন্টের কাঁপুনি, আতঙ্ক ভেসে এল মেইয়ের কাছে। অবাক হয়ে কান থেকে রিসিভার দূরে সরাল মেই। চিৎকার চলছেই। প্রথম চিৎকারটা ছিল আচমকা, ধীরেধীরে সেটা রূপ নিচ্ছে গোঙানিতে। পূর্বে বেশ কয়েকবার হয়রানি মূলক ফোনকল পেয়েছে সে। কিন্তু টের পেল, এবারেরটা ভিন্ন। আবারও কানে ধরল ফোন। থেমে গেছে কণ্ঠস্বর। এখন শুধুই নীরবতা।

রাত ৯:৪৯ বাজে। খুন হয়েছে যে মানুষটাকে ভালোবাসে, তার কণ্ঠস্বর শোনার শেষ ইচ্ছেটা। পরিবর্তে তাকে শুনতে হলো মৃত্যু চিৎকার। এখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগের ধারপ্রান্তে সে। শূন্যতা ভর করেছে তার চেতনায়। হাতের কাছে পড়ে থাকা রিসিভারে ভেসে আসছে মেইয়ের কণ্ঠস্বর। রুজির দুই পা ছড়িয়ে আছে মেঝেতে, পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে বিছানার সাথে। তার বাম হাত ম্যাট্রেসের ওপর, আর ডান হাত হাতড়ে বেড়াচ্ছে ফোনের রিসিভার। রিসিভার থেকে এখনও ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর: “হ্যালো?”

মাথা উঁচু করে বাঁকিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঢলে পড়ার আগে বুঝতে পারল রুজি বাঁচার আর কোনো আশা নেই। মারা যাওয়ার আগে ইচ্ছা হলো, নির্বোধ আসাকাওয়াকে ধাঁধা সমাধানের রহস্যটা শিখিয়ে যেতে।

“হ্যালো, হ্যালো,” ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বারবার বলতে লাগল মেই। কোনো জবাব নেই। পরিচিত লাগছে গোঙানির শব্দ। বুকের মধ্যে অজানা ভয় অনুভব করল মেই। ক্র্যাডলে রিসিভার নামিয়ে, প্রফেসরের নম্বরে ডায়াল করল সে। ব্যস্ত পেল সংযোগ। হুকে চাপ দিয়ে ডায়াল করল আবারও। এখনও ব্যস্ত। কলটা করেছিল রুজি-ই সেটা জানে মেই। আর তার সাথে ঘটেছে ভয়াবহ কিছু।

অধ্যায় চার

২০ অক্টোবর, শনিবার।

অবশেষে বাড়ি ফিরে স্বস্তিবোধ করছে আসাকাওয়া। কিন্তু স্ত্রী ও সন্তানকে ছাড়া ফাঁকা ফাঁকা লাগছে পুরো বাড়ি। কতদিন পর বাড়ি ফিরে এল? আঙুল গুনে বের করার চেষ্টা করল ও। এক রাত কাটিয়েছে কামকুরায়, দুই রাত আটকা পড়েছিল ওশিমায়, আর গতরাতে ভিলা লগ কেবিনে। পাঁচ রাত বাড়ির বাইরে ছিল ও। কিন্তু মনে হচ্ছে মাঝখানে পেরিয়ে গেছে কত যুগ। মাঝেমধ্যেই প্রতিবেদনের রিসার্চের কাজে চার পাঁচদিনের বাইরে যেতে হয় ওকে। তবে তখন সময় কেটে যায় চোখের পলকে।

স্টাডির ডেস্কে বসে ওয়ার্ড প্রসেসর চালু করল আসাকাওয়া। এখনও দেহের এখানে ওখানে ব্যথা। দাঁড়াতে গেলে ব্যথা করছে পিঠে। দশ ঘণ্টা টানা ঘুমিয়েও কাটেনি সারা সপ্তাহের ক্লান্তি। কিন্তু এখন থেমে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নেই। সপ্তাহজুড়ে জমে থাকা কাজগুলো শেষ না করতে পারলে, পরিবারকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা সম্ভব হবে না।

ওয়ার্ড প্রসেসরের সামনে বসে রয়েছে ও। ফ্লপি ডিস্কে এরইমধ্যে সেভ করে রাখা হয়েছে রিপোর্টের প্রথম অংশ। এখন বাকিটুকু লিখতে হবে। সোমবার মানে সাদাকো ইয়ামামুরার নাম জানার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব। যত দ্রুত সম্ভব ডকুমেন্টটা লেখা শেষ করতে চাচ্ছে ও। ডিনারের আগ পর্যন্ত লেখা শেষ হলো পাঁচ পৃষ্ঠা। ভালো গতিতেই লিখছে বলা চলে। সাধারণত রাতের বেলা লেখার গতি বৃদ্ধি পায় আসাকাওয়ার। এভাবে লিখতে থাকলে আরামসে কালকে দেখা হবে স্ত্রী ও কন্যার সাথে। এরপর সোমবারে, ফিরে যেতে পারবে স্বাভাবিক জীবনে। যা লিখছে সেটা দেখার পর এডিটরের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, কোনো ধারণাই নেই ওর। কিন্তু লেখা শেষ করার আগে কিছুই ধারণা করা সম্ভব নয়। ফলপ্রসূ নাও হতে পারে জেনেও গত সপ্তাহের দ্বিতীয় ভাগের ঘটনা ক্রমানুসারে লিখতে থাকল আসাকাওয়া। পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ করার পরেই হয়তো মনে হবে, অবসান ঘটেছে এই দুঃস্বপ্নের

মাঝেমধ্যে কি-বোর্ডে আটকে যাচ্ছে ওর আঙুল। ডেস্কের ওপর রাখা সাদাকোর ছবির প্রিন্টআউট। মনে হলো সৌন্দর্যের অধিকারিণী ভয়ানক মেয়েটি তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। মনযোগে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে এটা। এই সুন্দর চোখ যা দেখেছে, সেই একই জিনিস পরখ করেছে আসাকাওয়াও।

এখনও মনে হয় সাদাকোর একটা অংশ ঢুকে গেছে ওর দেহে। চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখল ছবিটা। এটা সামনে রেখে সম্ভব নয় কাজ করা।

স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকে ডিনার করল ও। এরপর ভাবল কী করছে রুজি এখন। দুশ্চিন্তায় নয়, তবে কোনো কারণে রুজির চেহারা ভেসে উঠল ওর কল্পনায়। আর ঘরে ফিরে কাজ শুরুর পর ওর অবচেতন মনে ভেসেই থাকল রুজির চেহারা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সেটা।

ভাবছি, কী করছে এখন শালায়?

ওর কল্পনা থেকে সরে গেল রুজির চেহারা। হঠাৎ করে উদ্বিগ্ন বোধ করে ফোনের কাছে গেল ও। সাতবার রিং হওয়ার পর পেল রিসিভার ওঠানোর শব্দ। স্বস্তিবোধ করল আসাকাওয়া। কিন্তু শুনতে পেল নারী কণ্ঠস্বর।

“…হ্যালো?” ম্লান ও পাতলা কণ্ঠ। এই কণ্ঠের সাথে পরিচিত আসাকাওয়া।

“হ্যালো। আসাকাওয়া বলছি।”

“হ্যাঁ?” দুর্বলস্বরে ভেসে এল জবাব।

“আপনি মেই তাকানো, রাইট? সেদিনকার আপনার বানানো লাঞ্চের জন্য ধন্যবাদ।”

“ব্যাপার না কোনো,” উত্তর দিয়ে থেমে থাকল সে।

“রুজি আছে?” এখনও ফোনটা রুজিকে দিচ্ছে না কেন, ভাবল আসাকাওয়া।

“রুজি কি….”

“মারা গেছেন প্রফেসর।”

“…কিহ?” কতক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল ও? শুধুমাত্র নির্বোধের মতো উচ্চারণ করতে পারল ‘কিহ?’ শব্দটা। সিলিংয়ের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ও। ফোন হাত থেকে ফস্কে যাওয়ার মুহূর্তে কোনোমতে বলল, “কখন?”

“গতরাতে, দশটা নাগাদ।”

আসাকাওয়ার বাড়িতে গত সপ্তাহে রুজি ভিডিও দেখা শেষ করেছিল রাত ৯:৪৯ মিনিট এ। বেঁধে দেয়া শিডিউলে মারা গেছে সে।

“মৃত্যুর কারণ কী?” জিজ্ঞেস না করলেও চলত।

“হঠাৎ হার্ট ফেইলর…কিন্তু ডাক্তাররা মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি।”

নিজ পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না আসাকাওয়া। খেলাটা শেষ হয়নি এখনও। কেবল প্রবেশ করেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে।

“মেই, কিছুক্ষণ কি আপনি থাকবেন ওখানে?”

“হ্যাঁ, প্রফেসরের কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে আমাকে।”

“আমি আসছি এখুনি। অপেক্ষা করুন আমার জন্য।”

ফোন রেখে মেঝেতে বসে পড়ল আসাকাওয়া। ওর স্ত্রী আর কন্যার ডেডলাইন আগামীকাল সকাল এগারোটায়। আরেকটা সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই। আর এবার, একাই লড়তে হবে ওকে। ওকে ছেড়ে চলে গেছে রুজি। এভাবে মেঝেতে বসে থাকলে চলবে না। কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্রুত, এইমুহূর্তেই।

রাস্তায় নেমে ট্রাফিকের অবস্থা দেখে নিল ও। মনে হচ্ছে ট্রেনে যাওয়ার চেয়ে ড্রাইভ করে যাওয়ায় ভালো। ক্রসিংয়ে গিয়ে রেন্টাল কারে চড়ে বসল ও। লটে-ই পার্ক করা ছিল কারটা। পরিবারের সাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রেন্টাল কারের মেয়াদ একদিন বর্ধিত করেছে ভেবে নিশ্চিন্ত হলো ও।

এসবের মানে কী? স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে চিন্তাগুলোকে একসূত্রে গাঁথতে চাইল ও। দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল কল্পনায়। কিন্তু কোনোটাই বুঝতে পারল না ও। যতই ভাবল ততই কম মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। আর ঘটনাগুলোকে একসূত্রে গাঁথতে গিয়ে প্যাঁচ খেয়ে গেল পুরোটাই।

মাথা ঠান্ডা রাখো! মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করো! নিজেকে নিজেই বোঝাল আসাকাওয়া। অবশেষে ধরতে পারল কোন জায়গায় দৃষ্টিপাত করতে হবে।

প্রথমত, আমরা বের করতে পারিনি ধাঁধার সমাধান- মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়ার উপায়। দেহাবশেষ উদ্ধার করে মর্যাদার সাথে সহিত করা হোক, এমনটা চায়নি সাদাকো। সম্পূর্ণ আলাদা কিছু একটা চেয়েছে সে। কী? কী সেটা? আর সমাধান যদি না-ই বের হয়ে থাকে তাহলে আমি বেঁচে গেলাম কীভাবে? এর মানে কী? কেউ বলো আমাকে। কেন বেঁচে গেলাম আমি?

সকাল এগারোটায় শিজু আর ইয়োকো মুখোমুখি হবে ওদের ডেডলাইনের। রাত নটা বেজে গেছে এরইমধ্যে। এখনই কিছু না করলে ওদেরকে চিরতরে হারাতে হবে।

সাদাকোর উচ্চারণ করা অভিশাপের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল ও। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল সাদাকোকে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটার ওপরেই এখন সন্দেহ জাগতে আরম্ভ করেছে আসাকাওয়ার। এটা অসীম কোনো অশুভ চক্র, যেটার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে শিকার করা। এমন শঙ্কা-ই জাগল ওর মনে।

জাপানি স্টাইলে রুমের মেঝেতে বসে আছে মেই। তার কোলে রুজির কাগজপত্র। পাতা উল্টাচ্ছে সে।

ভালোমত চোখ বুলাচ্ছে প্রত্যেকটা পাতায়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত জটিল। কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। ঘরটাকে মনে হচ্ছে পাহাড়ের কোনো গুহা। রুজির পিতামাতা সকালবেলা এসে কাওয়াসাকিতে নিয়ে গেছে তার মৃতদেহ। দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় জানিয়েছে রুজি।

“গতরাতের ব্যাপারে খুলে বলুন সবকিছু।”

বন্ধু মারা গেছে ওর। শুধু বন্ধু নয়, রুজি ছিল ওর ভাইয়ের মতো। আসাকাওয়া শোকাহত। কিন্তু শোকে ডুবে যাওয়ার মতো সময় ওর নেই। মেইয়ের পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে আসাকাওয়া।

“রাত সাড়ে নটার পরপর প্রফেসরের কাছে থেকে কল পেয়েছিলাম…” ওকে সবকিছু বিস্তারিত জানাল সে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা চিৎকার, এরপরের নীরবতা, সবকিছু। এরপর ছুটে রুজির অ্যাপার্টমেন্টে এসে দেখে, বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে রুজি। মেঝেতে দুই পা ছড়ানো। রুজির মৃতদেহ যেখানে ছিল সেদিকে তাকাল সে, কথা বলতে গিয়ে অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়াল তার।

“বারবার কল করছিলাম, কোনো জবাব পাইনি প্রফেসরের থেকে।“

তাকে কাঁদার সময় দিল না আসাকাওয়া।

“ঘরের মধ্যে ভিন্ন কিছু নজরে পড়েছিল আপনার?”

“নাহ।” মাথা নেড়ে বলল সে। “শুধু টেলিফোনটা নিচে পড়ে ছিল। আওয়াজ আসছিল ওখান থেকেই।

মৃত্যুর আগমুহূর্তে মেইকে কল করেছিল রুজি।

কেন? আবারও তাকে জিজ্ঞেস করল আসাকাওয়া। “শেষে আপনাকে কিছু বলেনি ও? কোনো শেষ কথা? ভিডিও টেপের ব্যাপারে কোনো কিছু?”

“ভিডিওটেপ?” মেইয়ের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে রুজির মৃত্যু আর ভিডিওটেপের ব্যাপারে কোনো সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না সে। মৃত্যুর আগে ধাঁধার সমাধান বের করতে পেরেছিল কিনা রুজি, সেটা জানার আর কোনো উপায় নেই আসাকাওয়ার।

তাহলে মেইকে কেন কল করেছিল রুজি? নিশ্চিতভাবেই টের পেয়েছিল নিজের মৃত্যুর কথা। শুধুই কি প্রিয় মানুষের কণ্ঠস্বর শেষবার শোনার আকুতি? এমন না তো, সমাধানের আসল উপায় বের করতে পেরেছিল সে, আর মেইকে ফোন করেছিল সেটা পূরণের উদ্দেশ্যে? এই কারণেই কি তাকে কল করেছিল রুজি? এরকম কিছু হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, ধাঁধার সমাধান করতে লাগবে আরেকজনের সাহায্য।

চলে যেতে ধরল আসাকাওয়া। ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল মেই।

“মেই, আজ রাতে আপনি কি এখানেই থাকবেন?”

“জ্বি। তার কাগজপত্রগুলো একটু দেখেশুনে গুছিয়ে রাখতে হবে।”

“দুঃখিত, আপনার ব্যস্ততার সময়ে বিরক্ত করার জন্য।” বের হয়ে যেতে লাগল ও।

“উমম”

“জ্বি?”

“মিস্টার আসাকাওয়া, প্রফেসর আর আমার ব্যাপারে আপনার সম্ভবত ভুল ধারণা আছে।”

“কী বলতে চাচ্ছেন?”

“আপনি হয়তো মনে করেন, আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল…একজন পুরুষ ও নারীর যেমন থাকে।”

“না, মানে…আমি।”

ওদেরকে প্রেমিক প্রেমিকা ভেবেছিল, আসাকাওয়াকে দেখেই সেটা বুঝতে পারল মেই। এই নজরেই ওদেরকে দেখত আসাকাওয়া। এটা বিব্ৰত করল মেইকে।

“প্রথম যেদিন দেখা হয় আপনার সাথে, প্রফেসর আপনাকে উনার বেস্টফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অবাক হয়েছিলাম আমি। প্রফেসর আগে কাউকে নিয়ে এভাবে বলেননি। আমার মনে হয় আপনি খুব বিশেষ কেউ ছিলেন তার জন্য। তো…” বলার আগে ইতস্তত করল সে। “তো আশা করি, প্রফেসরের বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে তাকে একটু ভালোমত বুঝতে পারবেন…যতদূর জানি, তার পরিচিত কোনো মহিলা ছিল না।” চোখ নিচু করল সে।

এর মানে ভার্জিন অবস্থায় মরেছে রুজি, এমনটাই বলতে চাচ্ছে সে?

কিছুই বলার নেই আসাকাওয়ার। চুপ করে থাকল ও। মেইয়ের কাছে রুজির কথা শুনে রুজিকে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তি মনে হচ্ছে ওর। সেই একই ব্যক্তির ব্যাপারেই কি আলাপ করছে ওরা এখন?

“কিন্তু…”

কিন্তু আপনার জানা নেই জুনিয়র হাইস্কুলে পড়ার সময় কী করেছিল রুজি। এই কথাটা বলতে চাইল ও কিন্তু বলল না। মৃত কোনো ব্যক্তির অপরাধের ফিরিস্তি তুলে ধরার কোনো ইচ্ছা নেই ওর। আর রুজির প্রতি মেইয়ের মনোভাবও নষ্ট করতে চাইল না।

শুধু তাই নয়, নতুনভাবে সংশয়ে পড়ে গেল আসাকাওয়া। নারীর অনুমান ক্ষমতায় বিশ্বাস আছে আসাকাওয়ার। রুজিকে খুব কাছ থেকে দেখেছে মেই। সে যখন বলছে ভার্জিন অবস্থায় মরেছে রুজি, তখন অবশ্যই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে কথাটার। অপরপক্ষে, এমনও হতে পারে কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনা রুজির মনগড়া কাহিনির বেশি কিছুই নয়।

“আমার সাথে থাকার সময় একেবারে বাচ্চাদের মতো আচরণ করতেন প্রফেসর। আমাকে সবকিছু বলতেন তিনি। কিচ্ছু লুকাতেন না আমার থেকে। তারা ছেলেবেলার ব্যাপারে জানার মতো যা যা ছিল সবই জানি আমি। তার ব্যথা, যন্ত্রণা সব।”

“তাই?” এটুকুই উচ্চারণ করতে পারল আসাকাওয়া।

“আমি পাশে থাকলে দশ বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশুর মতো আচরণ করত সে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে অবশ্য নিপাট ভদ্রলোক হয়ে যেতেন। আর আমার মনে হয়, আপনার সাথে বেশ দুষ্টুমির সম্পর্ক ছিল তার। তাই না? যদি না সে… “ হ্যান্ডব্যাগ থেকে সাদা রুমাল বের করে চোখ মুছল মেই। “যদি সে এরকম আচরণ না করত, তবে দুনিয়াতে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেত তার জন্য। আমার কথা ধরতে পেরেছেন? বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?”

চমকে গেছে আসাকাওয়া। অন্য যেকোনো ঘটনার থেকে বেশি। কিন্তু হঠাৎ করে খটকা লাগল ওর। পড়াশোনা ও খেলাধুলায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও নিঃসঙ্গ ছিল রুজি। একজনও কাছের বন্ধু ছিল না তার।

“নিষ্পাপ একজন মানুষ ছিল ও… আমার স্কুলের বাকি বন্ধুদের মতো ভণ্ড না। বাকিদের সাথে তুলনাই চলে না তার।”

দরজায় দাঁড়িয়ে আসাকাওয়া বুঝতে পারল যাওয়ার আগে মেইকে  সান্ত্বনামূলক কিছু বলার জন্য অনেক ভাবতে হবে ওকে। রুজিকে ও যেভাবে চিনত সেটা মেইয়ের চেনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। রুজিকে এখন অচেনা অপরিচিত একজন বলে মনে হচ্ছে ওর। গভীর অন্ধকারের মতো বিষণ্ণতা লুকিয়ে ছিল রুজির মধ্যে। যতই চেষ্টা করুক না কেন, তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কখনোই পুরোপুরি জানা সম্ভব ছিল না আসাকাওয়ার। সত্যি স্কুলে পড়ার সময় মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছিল রুজি? জানার কোনো উপায় নেই আসাকাওয়ার। আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই নেই ওর। কেননা আগামীকাল ওর পরিবারের ডেডলাইন। নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে ভাবার দরকারও নেই।

“রুজি আমারও বেস্টফ্রেন্ড ছিল,” শুধু এটুকুই বলতে পারল আসাকাওয়া।

কথাটা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট করেছে মেইকে। তার কোমল চাহনি দেখে বোঝা সম্ভব নয় সে কথাটা শুনে হাসবে নাকি আরও কান্নায় ভেঙে পড়বে। সামান্য ঝুঁকে বো করল মেই। দরজা লাগিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল আসাকাওয়া। রুজির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে, রাস্তায় আসার পর কতটা ভালো বন্ধু ছিল রুজি, মনে হলো ওর। যে কিনা ওর বিপদে নিজেকে জড়িয়েছে এই বিপজ্জনক খেলায়। এমনকি খুইয়ে বসেছে নিজের জীবনও। নিজের চোখের পানি মোছার কথা একদমই ভাবল না আসাকাওয়া।

অধ্যায় পাঁচ

২১ অক্টোবর, রবিবার

পার হয়েছে মাঝরাত। অবশেষে হাজির হলো রবিবার। একটা কাগজে নোট নিচ্ছে আসাকাওয়া। একসূত্রে গাঁথতে চাচ্ছে ওর সকল চিন্তা।

মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ধাঁধার সমাধান বের করতে পেরেছিল রুজি। সম্ভবত ডেকে আনার জন্যই ফোন করেছিল মেইকে। এর মানে দাঁড়ায় সমাধান প্রয়োগে সাহায্য লাগত মেইয়ের। আচ্ছা, এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হলো আমি এখনও বেঁচে আছি কেন? এর একটাই সম্ভাব্য উত্তর রয়েছে। গত সপ্তাহের কোনো এক সময়ে, নিজের অজান্তেই ধাঁধার সমাধানটা করে ফেলেছিলাম আমি! এছাড়া আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? সমাধানটা সম্ভবত এমন কিছু, যা সহজেই কারো সাহায্য নিয়ে করে ফেলা যায়।

কিন্তু এক্ষেত্রে হাজির হচ্ছে আরেকটা সমস্যা। তাহলে ঐ চারজন ছেলেমেয়ে ধাঁধার সমাধান না করতে পেরে মরে গেল কেন? এত সহজ হলে ওদের মধ্যে অন্তত একজন হলেও তো গোপনে গিয়ে ধাঁধার সমাধানের চেষ্টা করত, তাই না? ভাবতে হবে! কী করেছি এই সপ্তাহে? কী এমন যেটা আমি করেছি কিন্তু রুজি করেনি?

মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে আসাকাওয়ার। ক্লান্তিতে হাই তুলল ও, “কীভাবে বুঝবো বাল, বিশেষ কী করেছি আমি? এই সপ্তাহে এমন হাজারো জিনিস আমি করেছি যেগুলা করেনি রুজি! ফাইজলামি নাকি।”

সাদাকোর ছবিতে ঘুষি মারল ও। “বাল যত্তসব! আর কত যন্ত্রণা দেবে আমাকে?” ছবিটাতে ঘুষি মারতেই থাকল আসাকাওয়া। কিন্তু কোনো পরিবর্তন ঘটল না সাদাকোর অভিব্যক্তির: পরিবর্তন ঘটল না তার সৌন্দর্যের।

রান্নাঘরে গিয়ে গ্লাসে হুইস্কি ঢালল ও। শরীরের সব রক্ত যেন এসে জমা হয়েছে মাথায়। স্বাভাবিক হতে হবে আবারও। এক ঢোকেই পুরোটা গিলতে চলেছিল, কিন্ত থেমে গেল ও। হয়তোবা আজকের মধ্যেই উত্তর পেয়ে যাবে, তখন ড্রাইভ করে আশিকাগায় যেতে হবে। ফলে ড্রিঙ্ক না করাই উত্তম। নিজেকে ব্যতীত বাইরের কিছুর ওপর ভরসা করতে গেলেই মাথা আউলিয়ে যায় ওর। গর্তে নেমে সাদাকোর দেহাবশেষ খুঁড়ে বের করার সময় মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় হয়েছিল ভয় আর আতঙ্কে। এরপরও কাজটা সম্পন্ন হয়েছে কারণ ওর সাথে ছিল রুজি। আর যা যা পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেসব করার সামর্থ্য সবসময় ছিল তার।

“রুজি! কোথায় তুমি ভাই! পায়ে পড়ছি ফিরে এসে সাহায্য করো আমাকে।”

স্ত্রী ও কন্যাকে ছাড়া ওর পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয় কখনোই। ভালোভাবেই সেটা জানে আসাকাওয়া।

“রুজি! তোমার ক্ষমতা ধার দাও আমাকে! জানাও, কেন বেঁচে আছি আমি? আমি-ই প্রথমে উদ্ধার করেছিলাম সাদাকোর দেহাবশেষ, এটাই কি একমাত্র কারণ? এটাই হলে আমার পরিবারকে বাঁচানোর উপায় কী? এসব অবিচার, তাই না রুজি?”

মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে আসাকাওয়া। আহাজারি করার মতো সময় নয় এখন, তবুও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে ও। কিছুক্ষণ রুজিকে নিয়ে গোঙানোর পর মাথা ঠান্ডা হলো ওর। মন দিল কাগজে করা নোটগুলোয়।

বৃদ্ধার ভবিষ্যৎবাণী, সত্যি কি বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল সাদাকো? মৃত্যুর আগে জাপানের সর্বশেষ গুঁটি বসন্তের রোগীর সাথে সঙ্গম ঘটে তার। কোনোভাবে কি এই ব্যাপারটা সম্পৃক্ত?

ওর নোটের সবকিছুর পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। নিশ্চিত নয় কিছুই। এভাবে কি সমাধান পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে? ব্যর্থতা কোনোভাবেই মানতে পারবে না ও।

কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা। আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে বাইরে। মেঝেতে শুয়ে নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল আসাকাওয়া। পাখি ডাকছে বাইরে। জেগে রয়েছে নাকি স্বপ্ন দেখছে বুঝতে পারল না ও। মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল অবচেতন মনেই। চোখ মিটমিট করে তাকাল সকালের আলোর দিকে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে কারো অবয়ব। ভয় পেল না আসাকাওয়া। উঠে বসে একমনে তাকিয়ে রইল ঐ অবয়বের দিকে।

“রুজি? তুমি নাকি?”

কোনো জবাব দিল না অবয়ব। কিন্তু হঠাৎ করেই আসাকাওয়ার কল্পনায় স্পষ্টভাবে ভেসে উঠল একটা বইয়ের টাইটেল। মনে হলো যেন এটা গেঁথে ছিল ওর মস্তিষ্কেই।

“এপিডেমিকস অ্যান্ড ম্যান।

চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই নামটা ভেসে উঠেছিল, হারিয়ে গেছে এরপর পরই। কিন্তু এখনও নামটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওর মস্তিষ্কে। বইটা থাকার কথা আসাকাওয়ার স্টাডিতে। কেসটা নিয়ে কাজ শুরুর পর ভেবেছিল আসাকাওয়া, অজানা কোনো ভাইরাসের কারণে মৃত্যু হয়েছে ঐ চারজনের। সেসময়-ই কিনেছিল বইটা। কিন্তু খুলে দেখা হয়নি। তবে বুকসেলফে বইটা তুলে রাখার কথা মনে আছে ওর।

পূর্বের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে ওর ওপর। চেষ্টা করল উঠে দাঁড়ানোর। দপদপ করছে মাথাটা।

স্বপ্ন ছিল নাকি এইটা?

স্টাডির দরজা খুলল আসাকাওয়া। নামাল এপিডেমিকস অ্যান্ড ম্যান নামক বইটা। বইটার কথা কে এসে বলে গেল তাকে, এই ব্যাপারে অবশ্যই ধারণা আছে আসাকাওয়ার। রুজি। কিছুক্ষণের জন্য ফিরে এসেছিল সে। ওকে গোপন রহস্যের ব্যাপারে জানাতে।

তো তিনশো পৃষ্ঠার এই মোটা বইয়ের কোথায় লুকিয়ে রয়েছে জবাবটা?

আরও একবার খেল দেখাল ওর অনুমান শক্তি। পৃষ্ঠা ১৯১! এই সংখ্যাটার ইঙ্গিতও পেল নিজের মস্তিষ্ক থেকেই। যদিও আগেরবারের মতো জোরাল ভাবে নয়। পৃষ্ঠাটা খুলল ও। একটা শব্দ-ই নজরে পড়ল ওর। বড় হয়ে ভাসতে থাকল চোখের সামনে।

বংশবিস্তার। বংশবিস্তার
বংশবিস্তার। বংশবিস্তার।

ভাইরাসের প্রবৃত্তি-ই হলো বংশবিস্তার ঘটানো। ভাইরাস পোষক দেহ খুঁজে নেয় বংশবিস্তার করার জন্যই।

“উউউউউউউহ!” গোঙিয়ে উঠল আসাকাওয়া। অবশেষে ভিডিওর ধাঁধার সমাধানের বৈশিষ্ট্য ধরতে পেরেছে ও।

এবার বুঝতে পেরেছি, গতসপ্তাহে আমি কী এমন করেছিলাম যেটা করেনি রুজি। আমি টেপটা বাড়িতে এনে, কপি করে, দেখিয়েছিলাম রুজিকে। ধাঁধার সমাধানটা সহজ। যে কেউই পারবে করতে। কপি করে দেখাতে হবে কাউকে। এমন কাউকে দেখাতে হবে, যে দেখেনি এটা। এভাবেই ঘটাতে হবে টেপের বংশবিস্তার। ঐ চার নির্বোধ পোলাপাইন প্র্যাংক মনে করে কেবিনেই ফেলে এসেছিল টেপটা। কেউই আর এটার কথা ভাবেনি, ফলে ওদের ক্ষেত্রে সমাধানও হয়নি ধাঁধার।

যেভাবেই ভাবুক না কেন, এটাই একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা মনে হলো আসাকাওয়ার। ফোন উঠিয়ে আশিকাগায় কল করল ও। কল ধরল শিজু।

“শোনো, আমি যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। একটা জিনিস তোমার মা ও বাবাকে দেখানো প্রয়োজন। দ্রুত। আমি আসছি এখনই। আমি আসার আগে যেন কোথাও না যান উনারা। বুঝতে পেরেছ? ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

আহ হা, স্ত্রী ও সন্তানকে বাঁচানোর স্বার্থে আমি কি শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বেঁচে দিলাম? এমনকি আমি আমার স্ত্রীর পিতামাতার জীবনও ফেলে দিচ্ছি ঝুঁকির মুখে, যদিও সাময়িকভাবে। তবে উনারা যদি জানেন, এটা তাদের মেয়ে ও নাতনির জীবন বাঁচাবে, তাহলে সহযোগিতা করবেন নিঃসন্দেহে। উনাদের শুধু ভিডিওর আরেকটা কপি করে দেখাতে হবে অন্য কাউকে। এরপরই বিপদমুক্ত। কিন্তু এরপর… এরপর কী?

“কিসের কথা বলছো? বুঝতে পারছি না কিছুই।“

“যা বলছি সেটাই করো। আমি বেরুচ্ছি এখনই। ওখানে ভিডিও ডেক আছে তো, নাকি?”

“হ্যাঁ।”

“বেটা নাকি ভিএইচএস?”

“ভিএইচএস।”

“ভালো। আমি আসছি। আবারও বলছি, কোথাও যেন না যায়। “এক মিনিট দাঁড়াও। আমার বাবা-মাকে তুমি ঐ ভিডিওটা দেখাতে চাও, তাই না?”

বুঝতে পারল না কী বলবে, চুপ করে থাকল ও।

“ঠিক বলেছি?”

“… হ্যাঁ ঠিক।”

“ওটা বিপদজনক না?”

শুধুই বিপজ্জনক? এটার কারণে পাঁচ ঘণ্টা পর মরতে চলেছ তুমি আর তোমার মেয়ে। এত প্রশ্ন না করে যা করছি করতে দাও, বাল। সবকিছু শুরু থেকে ব্যাখ্যা করার সময় নেই।

স্ত্রীর ওপর চিৎকার করতে ইচ্ছা করল আসাকাওয়ার। তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে।

“যা বলছি সেটা করো।”

সকাল সাতটা বাজতে কিছুক্ষণ বাকি। ফ্রিওয়ে দিয়ে গেলে, ট্রাফিক এড়িয়ে যাওয়া যাবে। সকাল সাড়ে নটা নাগাদ শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে যেতে পারবে ও। সময়ের হিসাব করলে, এরমধ্যে স্ত্রী ও মেয়ের জন্য দুটো ভিডিও কপি করে এগারোটার ডেডলাইন এড়াতে পারবে ওরা। ফোন রেখে ভিডিও ডেকের কাছে গিয়ে প্লাগ খুলল আসাকাওয়া। দুটো ভিডিও ডেক লাগবে কপি করতে। এজন্য ওর ডেকটাও নিয়ে যাবে সাথে।

বের হওয়ার আগে আরেকবার দেখে নিল সাদাকোর ছবিটা।

নিশ্চিতভাবেই নোংরা কিছু একটার জন্ম দিয়ে গেছে সাদাকো।

ওইয়ি ফ্রি ওয়ে ধরে এগোতে থাকল ও। টোকিও বে থেকে তোহকু হাইওয়ে দিয়ে শহরের বাইরে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসাকাওয়া। তোহকু হাইওয়েতে বেশি ট্রাফিক থাকার কথা নয়। সমস্যা হলো এর আগের জ্যাম সামলাতে হবে। ওয়্যিতে টোল দেয়ার পর ট্রাফিক বোর্ডের দিকে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো খেয়াল করল আজকে রবিবার। এর মানে বে’র নিচের টানেলে বেশি গাড়ি থাকার সম্ভাবনা কম। যেখানে সাধারণত গিজগিজ করে গাড়িতে। বড় বড় এলাকাগুলোতেও এরকম জ্যাম হয় না। এই গতিতে চলতে থাকলে সময়মত পৌঁছে যাওয়া যাবে আশিকাগায়। ভিডিও কপি করার জন্যেও পাওয়া যাবে যথেষ্ট সময়।

এক্সেলেটরে চাপ কমাল আসাকাওয়া। এখন দ্রুত গাড়ি চালিয়ে এক্সিডেন্ট করার ভয় পাচ্ছে ও।

উত্তরের সুমিদা নদীর দিকে এগিয়ে গেল ও। বাইরে তাকিয়ে দেখল, রবিবার সকালে জেগে উঠেছে আশপাশের মানুষ। অন্যান্য দিনের তুলনায় অন্যরকম সকালের বাতাস গ্রহণ করছে ওরা। শান্তিপূর্ণ রবিবার সকাল।

কী প্রভাব পড়তে চলেছে, না ভেবে পারল না ও। আমার স্ত্রীর কপি আর কন্যার কপির মাধ্যমে এই ভাইরাসটা ছড়িয়ে পড়বে দুই দিকে। ওখান থেকে আবার কীভাবে ছড়াবে?

মানুষকে ভিডিও কপি করে আরেকজনকে দিচ্ছে, যে কিনা আগেই দেখে ফেলেছে, একটা সার্কেলের মধ্যেই রাখার চেষ্টা ভাইরাসকে। যাতে ছড়িয়ে না পড়ে। চিন্তাটা কল্পনায় ভেসে উঠল আসাকাওয়ার। কিন্তু এমনটা ঘটলে তো ভাইরাসের বংশবিস্তার ঘটানোর ইচ্ছার বিরুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কীভাবে এই ফাংশনটা ভিডিওর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেটা জানার কোনো উপায়-ই নেই। এর জন্য দরকার কিছু এক্সেপরিমেন্ট চালানোর। আর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির আগে, নিজের জীবন বিপদে ফেলে এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হয়ে রহস্য উদঘাটন করতে চাইবে, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। ভিডিও কপি করে আরেকজনকে দেখানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। আর লোকজন এটাই করবে। গোপন কথা মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়, সেহেতু প্রচার হতে থাকবে : “এটা এমন কাউকে দেখাতে হবে, যে পূর্বে দেখেনি।” সময়ের সাথে বংশবিস্তার করবে টেপটা। হয়তো ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকবে ডেডলাইনের দৈর্ঘ্য। একসপ্তাহের বদলে আরও কম হয়ে যাবে ডেডলাইন। যাদেরকে দেখানো হবে, ওরা স্বাভাবিকভাবেই অন্য কাউকে দেখাতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করবে না। কতদূর পর্যন্ত বর্ধিত হবে এই ‘রিং’ বা চক্র? প্রবৃত্তিগতভাবেই রোগ ছড়ানো ভয় কাজ করে মানুষের মনে, আর এই ধ্বংসাত্মক ভিডিও তো নিঃসন্দেহে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে চোখের পলকেই। আর আতঙ্কের বশে মানুষজন ছড়ানো শুরু করবে বিভিন্ন গুজব। যেমন: একবার দেখার পর দুটো কপি করতে হবে ভিডিওটা আর দেখাতে হবে দুজন ভিন্ন মানুষকে। চক্রবৃদ্ধির হারে বাড়তে থাকবে এই গুজব। একটা টেপে যা ক্ষতি হতো, তার থেকেও বহুগুণে ক্ষতি হবে তখন। অর্ধেক বছরের মধ্যে জাপানের সবাই হয়ে উঠবে এটার বহনকারী। এরপর জাপানের বাইরেও ছড়াতে থাকবে এই ভয়াবহ জিনিসটা। এই প্রক্রিয়ায় নিশ্চিতভাবেই বহু মানুষ মরবে, বাকিরা বুঝবে টেপের হুমকি আসলেই বাস্তব। তখন আরও মরিয়া হয়ে সবাই কপি করতে থাকবে এই টেপ ছড়িয়ে পড়বে আতঙ্ক। এর শেষ কোথায়? কতজন শিকার হবে এটার? দুই বছর আগে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার স্যাপারে জনগণের আগ্রহের বিস্ফোরণ ঘটায় নিউজরুমে জমা পড়েছিল দশ মিলিয়ন চিঠিপত্র। সৃষ্টি হয়েছিল বিশৃঙ্খলা। আবারও এমনটাই ঘটবে। প্রচণ্ডভাবে ছড়িয়ে পড়বে নতুন ভাইরাস।

জনগণের প্রতি ক্রোধ, যারা তার বাবা-মাকে ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুর মুখে, আর বিলুপ্তির ধারপ্রান্তে থাকা গুঁটি বসন্তের ভাইরাস, এই দুই-ই সমন্বিত অবস্থায় রয়েছে সাদাকো ইয়ামামুরার মধ্যে। আর সম্পূর্ণ ভিন্ন, অপ্রত্যাশিত এক রূপে আবারও পৃথিবীতে ফিরে এসেছে সে, প্রতিশোধ নিতে।

আসাকাওয়া, ওর পরিবার ও বাকিরা, যাঁরা এই ভিডিওটা দেখেছে, সবাই-ই মনের অজান্তেই আক্রান্ত হয়েছে এই ভাইরাসে। ওরা এই ভাইরাসের বহনকারী। আর ভাইরাসের বাস সরাসরি বহনকারীর জিনে। এর ফলাফল, কীভাবে মানবজাতির ওপর প্রভাব ফেলবে এটা, এসব সম্পর্কে এখনই কোনো ধারণা করা সম্ভব নয়।

আমার পরিবারকে বাঁচাতে হলে দুনিয়ার মাঝে উন্মুক্ত করে দিতে হবে এক ভয়ানক ভাইরাস, যা ধ্বংস ডেকে আনবে মানবজাতির, ভাবল আসাকাওয়া।

কী করতে চলেছে ওটা ভেবেই কেঁপে উঠল ও। ফিসফিস করে উঠল মাথার মধ্যে একটা কণ্ঠ।

যদি আমি আমার স্ত্রী ও কন্যাকে মরতে দেই তবে ব্যাপারটা এখানেই শেষ। ভাইরাসের পোষক মারা গেলে ভাইরাসও মরে যায়। এভাবেই মানবজাতিকে রক্ষা করা সম্ভব।

কিন্তু খুবই ম্লান ওর মস্তিষ্কের ভেতরকার ঐ কণ্ঠস্বর।

তোহকু হাইওয়েতে প্রবেশ করল ও। কোনো ভিড় নেই। যথেষ্ট সময় হাতে রেখেই পৌঁছানো যাবে। দুইহাত দিয়েই গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল আঁকড়ে ধরল আসাকাওয়া। “আফসোস করবো না আমি। নিজেদের উৎসর্গ করে দুনিয়াকে রক্ষা করা আমার পরিবারের দায়িত্ব নয়। কিছু জিনিস হুমকি হয়ে দাঁড়ালে নিশ্চিতভাবেই সেসবের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে তোমাকে।”

ইঞ্জিনের শব্দের মধ্যেই চিৎকার করে কথাগুলো বলল ও। নিজেকে উদ্দীপ্ত করার জন্য। ওর জায়গায় রুজি থাকলে কী করত? নিশ্চিতভাবেই ও জানে, কী করত রুজি। ওকে ভিডিওর রহস্য উন্মোচনের সূত্র শিখিয়ে গেছে রুজির আত্মা। বিশেষত ওর পরিবারকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই। এটাই সাহস যোগাচ্ছে ওকে। এই পরিস্থিতিতে রুজি সম্ভবত কী বলত, জানা আছে ওর।

‘নিজের তাৎক্ষণিক অনুভূতির প্রতি সৎ থাকবে! আমাদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ব্যতীত কিছুই নেই! ভবিষ্যৎ নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। কোনো কিছু উদ্ভাবনে মানবিকতার প্রয়োগ ঘটালে, কে জানে, হয়তো সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব। এটা মানবজাতির জন্য আরেকটা পরীক্ষা। যুগ যুগ ধরে শয়তান পৃথিবীতে ফিরে এসেছে বিভিন্ন রূপে। যতবারই একে বিতাড়িত কর না কেন, সে বারবার ফিরে আসবেই।’

এক্সেলেটরে পা রেখে আশিকাগার দিকে এগিয়ে গেল আসাকাওয়া। অদ্ভুতভাবে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে আকাশে। অনেকটা সাপের মতো এগিয়ে আসছে মেঘগুলো, যেন ইশারা করছে নরখের কোনো অশুভ সত্ত্বার মুক্তির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *