দুর্যোধন – ৮০

আশি 

এই অবস্থায় দুর্যোধন হতভম্ব হয়ে পড়ল। হুঁশে ফিরে অনেক অনুনয়ে-বিনয়ে উভয়পক্ষকে শান্ত করল। 

এবং সুদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল, ‘কাল থেকে কৌরবসেনাদলের সেনাপতিত্ব করবে কর্ণ। কর্ণ সর্বগুণান্বিত, অস্ত্রবিশারদ ও যুদ্ধদুর্মদ।’ 

দুর্যোধনের পক্ষে অনেক বীর এখনো বেঁচে আছেন—দুঃশাসন, শল্য, শকুনি, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য প্রমুখ। কিন্তু দুর্যোধনের সেই মুহূর্তে মনে হলো—কর্ণই পাণ্ডবদের নিশ্চিত পরাজিত করতে পারবে। 

দুর্যোধন কর্ণের দিকে ফিরে সেনাপতির পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করল। কর্ণ দুর্যোধনের প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হলো। 

সে-রাতে নিজের বিছানায় একান্তে শুয়ে কর্ণের একটু পেছনে ফিরতে ইচ্ছে করল। 

হারতে হারতেই তো জীবনটা এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে এলো তার! অথচ জয়ী হওয়ার সমস্ত গুণ তার মধ্যে ছিল। কিন্তু একবারও জিততে পারেনি। ব্যর্থতা যেন তার নিয়তি! জলেভাসা জীবন তার। ভাসতে ভাসতে এই হস্তিনাপুরের কূলে ভেড়া। অর্জুন পেয়েছিল দ্রোণাচার্যের আশীর্বাদ। আর সে পেয়েছিল অভিশাপ। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় বীরত্ব প্রকাশ করার আগেই দ্রৌপদী তাকে প্রত্যাখ্যান করে বসল! কেন? সূতপুত্র বলে। সেদিন বড় হাসি পেয়েছিল কর্ণের! অপমানিত মানুষের মর্মান্তিক এ রকম হাসি পৃথিবীতে আর কেউ কোনোদিন হেসেছিল কিনা কে জানে! 

অভিমন্যুকে সে নিজ হাতে খুন করেনি। নিরস্ত্রকে আঘাত করার মতো অবিবেচক সে নয়। এটা ঠিক, সপ্তরথীদের একজন ছিল সে। অভিমন্যু হত্যার পুরো দায় তো যুধিষ্ঠিরের! সব জেনেও কেন সে মূঢ়ের মতো অভিমন্যুকে চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে নির্দেশ দিল? চক্রব্যূহের প্রবেশপথ রক্ষা করবার দায়িত্ব পড়েছিল জয়দ্রথের ওপর। সেদিন জয়দ্রথ একাই সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীম, দ্রুপদ প্রভৃতিকে হটিয়ে রেখেছিল। চক্রব্যূহের মাঝখানে গদাযুদ্ধে অভিমন্যুকে হত্যা করে দুঃশাসনপুত্র। কিন্তু অর্জুন অভিমন্যুর হত্যাকারী নির্বাচন করল জয়দ্রথকে। অথচ হত্যাকাণ্ড থেকে জয়দ্রথ অনেক দূরে ছিল। পরদিন হত্যাও করেছিল জয়দ্রথকে অর্জুন! আসলে জয়দ্রথের বহুদিন আগের এক অপরাধের শোধ নিয়েছিল অর্জুন। জয়দ্রথ একবার দ্রৌপদীকে হরণ করেছিল। এসবের পরও কর্ণকেই অভিমন্যুর প্রকৃত হত্যাকারী বলে মনে করে সবাই। নিয়তির অবিচার একেই বলে! 

সে ধার্মিক। কিন্তু ধর্মভীরু নয়। দান করা তার অভ্যাস। তাই ছদ্মবেশী ইন্দ্রকে চিনতে পেরেও তার কবচকুণ্ডল ইন্দ্রকে দান করতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি কর্ণ। 

সে কুৎসিত প্রকৃতির নয়। কাপুরুষও নয়। সে অতিশয় উদার এবং মহাবীর। কিন্তু কী নিদারুণভাবেই-না ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুর তার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন! প্রচার করেছেন—সে কুৎসিত ভাষী, সে নীচ। কেন তাঁরা এ রকম মিথ্যে প্রচার করে গেছেন বারবার? সে সূতপুত্র ছিল বলে? তথাকথিত নীচবংশের হয়েও উঁচুবর্ণের সকল গুণ তার মধ্যে দেখেই কি কুরুবৃদ্ধরা খেপে গিয়েছিলেন? 

সূতপুত্র হিসেবে সে কখনো নিজকে হীন মনে করেনি। সূতপুত্র হয়েও সে রাজা হয়েছিল। দিগবিজয়ী বীরের সম্মান আদায় করে নিয়েছিল। সগর্বে সে নিজের পালিত পিতা-মাতার পরিচয় দিয়েছে। প্রকৃত পিতা-মাতার পরিচয় পাওয়ার পরও নিজ সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়েনি সে। 

যুদ্ধ বন্ধের জন্য কৌরবরাজসভায় পাণ্ডবদূত হয়ে এসেছিল কৃষ্ণ। সেই দৌত্য ব্যর্থ হয়েছিল। ফেরার পথে কর্ণকে নিজ রখে তুলে নিয়েছিল কৃষ্ণ। নিভৃত স্থানে নিয়ে গিয়েছিল কর্ণকে। সেখানে কৃষ্ণ 

কর্ণকে তার জন্মবৃত্তান্ত শোনাল। বলল, কুন্তীই তোমার আসল মা। তার কুমারীকালের সন্তান তুমি। সম্মান রক্ষার জন্যে কুন্তী তোমাকে জন্মমাত্র জলে বিসর্জন দিয়েছিল। কর্ণ একটুও চমকায়নি কৃষ্ণের কথায়। কৃষ্ণ বলেছিল, পাণ্ডবদের মধ্যে তুমি জ্যেষ্ঠ। তুমি পাণ্ডব দলে এসো। রাজা হবে। মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে কর্ণ বলেছিল, দুর্যোধন আমার বন্ধু। বিশ্বাসঘাতকতা আমার ধাতে নেই। এরপর দ্রৌপদীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার লোভও দেখিয়েছিল কৃষ্ণ, কর্ণকে। অবহেলার হাসি দিয়ে কৃষ্ণের সেই প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিয়েছিল কৰ্ণ। 

এর পরের কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে কর্ণের। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধারম্ভের ঠিক আগের দিন। সায়াহ্নের প্রায়ান্ধকারে মাতা-পুত্র মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল — কুন্তী আর কর্ণ। কুন্তীর আতিশয্যেই কর্ণ সাক্ষাতে রাজি হয়েছিল। মাতা আকুল হয়ে পুত্রকে তার জন্মকাহিনি বলে গেল। কর্ণ নির্বিকার থাকল। এ তো তার জানা কথা। কুন্তী আকুল হয়ে বলল, তোমার ওপর অবিচার করেছি পুত্র। আমার অন্য কোনো উপায় ছিল না বলে এ রকম করেছি পুত্র। তুমি আমায় ক্ষমা করো। তুমি ফিরে এসো। ভাইদের সঙ্গে মিলে কুরুবংশ ধ্বংস করো। চমকে তখন মায়ের দিকে তাকিয়েছিল সে। মনে পড়ে সে দৃশ্য। মাকে তখন বড় বেশি ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল তার। মা তা হলে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে আসেনি তার কাছে! স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এসেছে! তাকে বাগিয়ে নিয়ে গিয়ে পুত্রদের শক্তির পাল্লা ভারী করতে এসেছে! প্রত্যাখ্যান করেছিল মাকে। না না, কোনো রকম খারাপ আচরণ করেনি সে, মায়ের সঙ্গে। মায়ের শেষ-চাওয়া পূরণ করতে মোটেই দ্বিধা করেনি সে। মায়ের চাওয়া অনুসারে প্রতিজ্ঞা করেছিল- পাণ্ডবদের কোনোদিন আঘাত করবে না সে। অর্জুনকে হত্যা করবে না। 

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রথম দশ দিন তাকে যুদ্ধ করতে দেননি ভীষ্ম। সেই দশ দিন সমরাঙ্গনের পাশে দাঁড়িয়ে ছটফট করে গেছে সে। ভীষ্ম মোটেই পছন্দ করতেন না তাকে। কেন, সূতপুত্র বলে? না, মোটেই তা নয়। নারদের কাছ থেকে বহু আগেই ভীষ্ম কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত জেনে গেছিলেন — কৰ্ণ কুন্তীপুত্র। কিন্তু ভীষ্ম সেই কথাটি গোপন রেখে দিয়েছিলেন। কী এক অজানা কারণে ভীষ্ম কর্ণের প্রতি খুব কঠোর ছিলেন। 

যুদ্ধ শুরুর আগে কৌরবশিবিরে উভয়পক্ষের শীর্ষস্থানীয় যোদ্ধাদের মধ্যে কে কত বড় বীর নির্ণয় করছিলেন পিতামহ। এক একজনকে রথী বা মহারথী অথবা অধিরথ বলে ঘোষণা করছিলেন তিনি। তাঁর বিবেচনায় কৃপাচার্য, শল্য, কৃতবর্মা, জয়দ্রথ এমনকি স্বল্প পরিচিত যোদ্ধা সুদক্ষিণ, নীল, বিন্দু, অনুবিন্দু—এঁরাও সবাই রথী-মহারথী। এমন যে কর্ণপুত্র বৃষসেন, সেও ভীষ্মের বিবেচনায় রথী। কিন্তু ভীষ্ম কর্ণকে বললেন, তুমি অর্ধরথ ছাড়া কিছুই নও। ভীষ্ম জানতেন, কোথায় আঘাত করলে কর্ণ দুমড়ে যাবে। সেই জায়গাটিতে আঘাত করেছিলেন পিতামহ। না না, সেও ছাড়েনি ভীষ্মকে। তার স্পষ্ট মনে পড়ছে আজ, সেদিনের বীর নির্ধারণী সভায় ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ভীষ্মকে ভীষণ গালি দিয়ে উঠেছিল সে। তারও প্রতিশোধ নিয়েছিলেন তিনি। চক্রান্ত করে যুদ্ধের প্রথম দশ দিন বসিয়ে রেখেছিলেন তাকে। আসলে এই চক্রান্তের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল পিতামহ ভীষ্মের। তিনি তো মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, এই যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় হোক! 

তিনি জানতেন, এই যুদ্ধে সে প্রথম থেকে অংশ নিলে পাণ্ডবদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাই তো কৌশল করে পাণ্ডবপক্ষের প্রধান শিরঃপীড়া, কৌরবপক্ষের প্রধান যোদ্ধাকে রণক্ষেত্র থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। 

হ্যাঁ, জীবনে মস্তবড় এক অন্যায় করে ফেলেছিল সে। এই অন্যায়ের জন্য ভীষণ লজ্জিত সে। আজ এই বিছানায় শুয়ে সেদিনের অভব্য আচরণের জন্য দ্রৌপদীর কাছে সে জোড়হাতে ক্ষমা চাইছে। সেদিন কুরুরাজসভায় বস্ত্রহরণের সময় দ্রৌপদীকে লক্ষ করে অমন অভদ্র ভাষায় কথা বলা মোটেই উচিত হয়নি তার। কোথায় দুঃশাসনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, তা না, দুর্যোধনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘দাসী’

‘বেশ্যা’—এসব কুরুচিপূর্ণ শব্দ দ্রৌপদীর দিকে ছুড়ে দিয়েছিল! এই কুরুচিপূর্ণ আচরণ কেন করেছিল সে, সেদিন? তার কি মতিভ্রম হয়েছিল? নাকি সেদিনের স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদীর অপমান-অবহেলার প্রতিশোধস্পৃহা চাগিয়ে উঠেছিল তার? এটা তার জীবনের সবচাইতে বড় হঠকারিতা। 

আর একটি কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কর্ণের। সেটা কৃষ্ণের ধোঁকাবাজির কথা। শেষ মুহূর্তে এসেও কৃষ্ণ প্রতারণা করতে চেয়েছিল তার সঙ্গে। তাকে বাদ দিয়ে যুদ্ধ শুরু হবে। তরঙ্গময় সমুদ্রের কল্লোল নিয়ে উভয়পক্ষ মুখোমুখি। 

যুধিষ্ঠির গেছে ভীষ্ম দ্রোণ-কূপের কাছে, আশীর্বাদের অছিলায়। এই অবসরে কৃষ্ণও পৌঁছে গিয়েছিল তার কাছে। কৃষ্ণ বলেছিল, শুনেছি–ভীষ্ম তোমাকে যুদ্ধ করতে দিচ্ছেন না। তা হলে যতদিন ভীষ্ম নিহত না হন, ততদিন তুমি পাণ্ডবপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করো। ভীষ্মের মৃত্যুর পর না হয় তুমি কৌরবপক্ষে ফিরে যেয়ো। 

কর্ণ সেদিন কৃষ্ণের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারত। নীচ, দুরাত্মা, কুচক্রী, ধান্ধাবাজ বলে গালিও দিত পারত। কিন্তু সে তো তা করেনি! শুধু অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে কৃষ্ণের কুপ্রস্তাবটি। 

পাণ্ডবপক্ষের চেয়ে কুরুপক্ষের লোকেরাই তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে বেশি। ভীষ্মের বিরাগ ছিল সবচাইতে তীব্র। দ্রোণও ভীষ্মানুসারী। কেন জানি, কৃপেরও দুচক্ষের বিষ ছিল সে। সে চেয়েছিল অর্জুনেরই সমকক্ষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এই দুই কুরুবৃদ্ধ তা হতে দেননি! 

আজ সেই কর্ণ কুরুপক্ষের সেনাপতি নির্বাচিত হয়েছে। এই বিছানায় শুয়ে আজ কর্ণের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে— দেখে যান পিতামহ ভীষ্ম, দেখে যান অস্ত্রগুরু দ্রোণ, যাকে সারাজীবন আপনারা দাবিয়ে রাখতে চেয়েছেন, সে আজ কুরুদের প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত হয়েছে। 

একাশি 

সেই গভীর রাতে হঠাৎ শয্যা ছেড়ে উঠে পড়েছিল কর্ণ। কাল যুদ্ধ শুরুর আগে একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বিশেষ প্রয়োজন। 

কে তিনি? 

তিনি পিতামহ ভীষ্ম। 

ভীষ্ম তখনো জীবিত। শরশয্যায় শায়িত। শরশয্যা গ্রহণের আটান্ন দিন পর তাঁর মৃত্যু হবে। ইচ্ছামৃত্যু। এখনো তিনি শরশয্যায় যন্ত্রণা ভোগ করে যাচ্ছেন। 

কর্ণের কী খেয়াল হলো—মৃত্যুপথযাত্রী পিতামহের সঙ্গে দেখা করবে। এই মুহূর্তে তাঁর আশীর্বাদের প্রয়োজন। শিবির থেকে বের হয়ে ভীষ্মের শরশয্যার দিকে রওনা দিল কৰ্ণ। পার্শ্বরক্ষকরা অতি সন্তর্পণে তাকে অনুসরণ করে চলল। 

শরশয্যা ঘিরে দাউ দাউ মশাল। চারদিক আলোকিত। কর্ণ ভীষ্মের মাথার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চোখ বুজে ছিলেন তিনি 

খসখস শুনে পিতামহ অনুমান করলেন—কেউ এসেছে। ওই অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’ কর্ণ বলল, ‘আমি সূতপুত্ৰ কৰ্ণ পিতামহ।’

কর্ণের খোঁচাটা বুঝতে অসুবিধা হলো না ভীষ্মের। আগে যতবার তিনি কর্ণের নাম উচ্চারণ করেছেন, নামের আগে ‘সূতপুত্র’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আজ এই শরশয্যায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন যখন, তখন নিজের নামের আগে ‘সূতপুত্র’ শব্দটি ব্যবহার করে কর্ণ যে তাঁর ওপর শোধ নিল, তা কি তাঁর না বোঝার কথা? 

বুঝলেনও। 

তিনি কিছু বলে উঠার আগে কর্ণ আবার বলে উঠল, ‘আমার প্রণাম গ্রহণ করুন পিতামহ। আপনার চরণে মাথা ঠেকিয়েই প্রণাম করতাম, কিন্তু শাস্ত্রে যে আছে শুয়ে থাকা ব্যক্তির পাদস্পর্শ করে প্রণাম করতে নেই!’ 

অতি কষ্টে চোখ মেলে কর্ণকে দেখলেন ভীষ্ম। 

বললেন, ‘তোমাকে আশীর্বাদ করি বৎস। আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি—কেন তোমার হঠাৎ প্রণাম করতে আসা? তাও এত গভীর রাতে?’ 

‘রাতেই আসতে হলো পিতামহ। অস্ত্রগুরু মারা গেছেন আজ। আলো ফুটলেই যুদ্ধে নামতে হবে আমাকে। সাধারণ সৈনিক হিসেবে নয়। কুরুশিবিরের প্রধান সেনাপতি হিসেবে।’ 

‘প্রধান সেনাপতি হিসেবে?’ চমকে জিজ্ঞেস করলেন ভীষ্ম। 

‘হ্যাঁ পিতামহ। মহারাজ দুর্যোধন আমাকে কৌরবপক্ষের প্রধান সেনাপতি নির্বাচন করেছেন। আগামীকাল যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হবে। কিন্তু আপনার আশীর্বাদ ছাড়া আমি সেনাপতিত্ব শুরু করি কী করে?’ 

‘আশীর্বাদ! আশীর্বাদ চাইতে এসেছ তুমি! আমার কাছে! যে সারাজীবন তোমার বিরোধিতা করে গেছে, তার কাছে আশীর্বাদ চাইতে এসেছ কর্ণ!’ এক নিদারুণ বেদনায় ভীষ্মের কণ্ঠ চুরমার হয়ে গেল। 

কর্ণ বলল, ‘আপনি তো একজন মহান পুরুষ। জাগতিকতার তাড়নায় ওই সময় আমাকে অবহেলা দেখিয়েছেন। পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে আপনি আমাকে বারবার দাবিয়ে রেখেছেন। দুর্যোধনের বন্ধু বলেই আমার প্রতি আপনার এ রকম আচরণ। এখন আপনি ওসবের ঊর্ধ্বে। এখন আপনি একজন দিব্যপুরুষ। এখন প্রাণখুলে আমাকে আশীর্বাদ করুন, যাতে আমি পাণ্ডবদের জয় করতে পারি।’ 

কর্ণের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। অন্যদের দূরে সরে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন। তারপর গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘কর্ণ, বৎস আমার, এর মধ্যে তুমি জেনে গেছ তুমি কে? সহোদরের বিরুদ্ধে আর অস্ত্র তুলে নিয়ো না হাতে। কুন্তীকে মাফ করে দাও তুমি। আমি তোমাকে শেষবারের মতো অনুরোধ করছি কর্ণ, তুমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দাও। দুরাচারী দুর্যোধনকে ত্যাগ করো তুমি।’ 

এবার কটকট করে হেসে উঠল কর্ণ। শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি যাকে দুরাচারী বলছেন, সে আমার বন্ধু। নিঃস্ব অবস্থায় সে আমাকে ধনাঢ্য করেছে। রাজা বানিয়েছে সে আমায়। আমার দুঃসহ দিনের সুহৃদ দুর্যোধন। সেই বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বলছেন আমায় আপনি? যে জননী শুধু সামাজিক সম্মানের ভয়ে আত্মজকে জলে বিসর্জন দিয়েছিল, সেই মাকে মাফ করে দিতে বলছেন আপনি? আপনি কেমন মানুষ পিতামহ?’ বলতে বলতে কর্ণের কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে উঠে গিয়েছিল। চট করে নিজেকে সংযত করল সে। 

অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করুন পিতামহ, আমি স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়েছিলাম।’ 

ভীষ্ম স্নেহে বললেন, ‘তুমি কোনো দোষ করোনি কর্ণ। কথাগুলো বলার অধিকার তোমার আছে। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি বৎস। তুমি যদি আমার প্রস্তাব মেনে নিয়ে পাণ্ডবদলে যোগ দিতে, তোমাকে অশ্রদ্ধা করতাম আমি।’ 

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন ভীষ্ম। উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি নানা সময় তোমার নিন্দা করেছি পুত্র, তোমার বীরত্বকে অকিঞ্চিৎকর প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি জানি, তুমি কত বড় বীর। পাণ্ডবপক্ষের যেকোনো যোদ্ধাকে হারানোর ক্ষমতা রাখ তুমি। আমি তোমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করছি কর্ণ।’ বলে মৌন হলেন ভীষ্ম। 

.

প্রথম দিনের যুদ্ধে অর্জুন কর্ণের সঙ্গে চরম যুদ্ধে গেল না। কৃষ্ণ অর্জুনের রথকে কর্ণ থেকে দূরে দূরে রাখল। 

সেনাপতি হিসেবে নিজের বীরত্ব প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগল কর্ণ। নকুল, ভীম, যুধিষ্ঠির, সাত্যকি প্রভৃতি মহারথীদের পরাজিত করে ছেড়ে দিল। বলদর্পী ভীমের কাঁধে ধনুক পরিয়ে টেনে এনে কর্ণ বলল, ‘ওহে ভোজনবিলাসী, তোমাকে কে বলেছে যুদ্ধ করতে আসতে? তোমার কাজ তো খাওয়া আর খাওয়া। তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি আমি। শিবিরে গিয়ে খাওয়া শুরু করো।’ 

মাথা নিচু করে ভীম সেস্থান ত্যাগ করে গিয়েছিল। 

যুধিষ্ঠিরকে অত সহজে ছাড়েনি কর্ণ। প্রথমে বাণাঘাতে জর্জরিত করে তুলেছিল। তারপর অশ্ব-সারথিকে হত্যা করে, ধনু-গদা ভেঙে যুধিষ্ঠিরকে কবন্ধ করে ছেড়েছিল। 

আহত যুধিষ্ঠিরের কাঁধে নিজের ধনুটা ছুঁইয়ে সহাস্যে বলেছিল, ‘যুধিষ্ঠির ভায়া, বেদপাঠ, ধর্মযজ্ঞ ছেড়ে তোমাকে কে বলেছে যুদ্ধ করতে আসতে? তুমি নাকি ভীষণ ধার্মিক! তা শাস্ত্র ছেড়ে অস্ত্র তুলে নিলে কেন হাতে? অস্ত্র তুলে নিয়েছ, ঠিক আছে। কিন্তু অস্ত্রবিদ্যা ভালো করে না শিখে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছ তুমি! দু-চারটা তীরের আঘাতেই কাবু হয়ে গেলে! আসল তির তো এখনো হাতেই নিইনি আমি! যাও যাও, শিগগির দ্রৌপদীর কাছে ফিরে যাও। আহা, দরদর করে রক্ত ঝরছে তোমার গা থেকে। ফিরে গেলে দ্রৌপদী আঁচল দিয়ে তা মুছে নেবে।’ বলে অন্যদিকে রথ ঘুরিয়েছিল কর্ণ। 

আহত অপমানিত যুধিষ্ঠির শিবিরে ফিরে এসেছিল। 

যুধিষ্ঠিরের আহত হওয়ার কথা কৃষ্ণ-অর্জুনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। দাদাকে দেখবার জন্য শিবিরে চলে এসেছিল তারা। 

অর্জুনকে দেখে বড় আনন্দিত হয়ে উঠেছিল যুধিষ্ঠির। মনে করেছিল, কর্ণকে হত্যা করে সুসংবাদটা দাদাকে দিতে এসেছে। 

জিজ্ঞেসও করে বসল যুধিষ্ঠির, ‘কীভাবে বধ করলে তুমি কর্ণকে? শেষযুদ্ধ কীরকম হয়েছিল? কর্ণের মাথাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করেছ তো?’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘কই না তো! কর্ণ তো নিহত হয়নি! অর্জুনের সঙ্গে আজ কর্ণের দেখাই হয়নি! আমরা তো তোমার আহত হওয়ার খবর পেয়ে দেখতে এসেছি।’ 

যুধিষ্ঠিরের অপমান ছিল মৃত্যুসম। ও মনে করেছিল, দাদার অপমান-লাঞ্ছনার কথা শুনে অর্জুন কর্ণকে হত্যা করবে। তা না, দেখতে এসেছে! 

শান্ত সুশীল যুধিষ্ঠির আচমকা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। অর্জুনকে লক্ষ করে অশালীন বাক্যস্রোত বইয়ে দিল, ‘দুরাত্মা তুমি অর্জুন, কুন্তীর গর্ভের কলঙ্ক। কর্ণকে বধ করার ক্ষমতা নেই তোমার। কর্ণের ভয়ে ভীমকে অসহায় অবস্থায় রেখে কুরুক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছ? তুমি কুন্তীর গর্ভে জন্মালে কেন? পঞ্চম মাসের গর্ভস্রাবে বিনষ্ট হলে না কেন? তোমার গাণ্ডিবকে ধিক। তোমার বলবীর্যে ধিক।’ 

ধৈর্য হারাল অর্জুন। যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ করে সক্রোধে খড়গ উত্তোলন করে বসল। যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করেই ছাড়বে সে। 

কৃষ্ণ প্রমাদ গুনল। জয়ের কাছাকাছি এসে সব কিছু ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। এই ভ্রাতৃবিরোধ না থামালে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে! 

কৃষ্ণ নরমে-গরমে বলল, ‘সব কিছু না জেনে-বুঝে এ রকম কটুক্তি করা তোমার উচিত হয়নি দাদা। তুমি তো চলে এলে রণক্ষেত্র থেকে! ওদিকে কী হয়েছে তা তুমি জান না! না জেনেই এ রকম অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিলে তুমি! আর অর্জুন, তোমাকে বলছি দাদা তোমার গুরুজন, পিতৃতুল্য। সেই দাদার মাথার ওপর খড়গ তুললে তুমি! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। যুদ্ধই আমাদের লক্ষ্য। জয়ই আমাদের অভীপ্সা। এসো, দাদাকে প্রণাম করে আলিঙ্গন করো অর্জুন।’ 

কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় সেদিনের বিরোধ মিটে গিয়েছিল। 

বিরাশি 

শুরু হলো সপ্তদশ দিবসের যুদ্ধ। 

সেদিনই প্রথম, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, কর্ণ আর অর্জুন সামনাসামনি হলো। 

তার আগে ভীম দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করেছে। 

উভয়পক্ষের বহু বহু রথী-মহারথী এদিনের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। নিহত হয়েছে ভানুদেব, চিত্রসেন, সেনাবিন্দু, শূরসেনের মতো যোদ্ধারা। কর্ণপুত্র ভানুসেন ভীমের হাতে নিহত হয়েছে। সহদেবের হাতে প্রাণ গেছে শকুনির পুত্র উলূকের। ভীম নির্বিচারে হত্যা করেছে দুর্যোধনের বহু ভ্রাতাকে। ব্যাঘ্রকেতু, সুশর্মা, চিত্র, উগ্রায়ুধ, জয়, শুক্ল, রোচমান, সিংহসেন, জিষ্ণু, ভদ্র, দণ্ড, চিত্র, চিত্রায়ুধ সিংহকেতু, শলভ—এ রকম আরও অগণন বীর শত্রুপক্ষের হাতে প্রাণ হারাল। 

আজকের যুদ্ধ মারাত্মক। প্রাণসংহারী। ভয়জাগানিয়া। চারদিকে হাহাকার আর আর্তনাদ। হাতি-ঘোড়ার মৃতদেহ, রথের ধ্বংসাবশেষ, মানুষের হাত-পা-মস্তক; নানা অস্ত্রশস্ত্র নানা স্থানে স্তূপাকারে পড়ে আছে। এগুলো ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। প্রত্যেকের একটাই লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে যমালয়ে পাঠানো। 

আজকের যুদ্ধে কেউ অন্যজনকে হত্যা করে হুঙ্কার দিচ্ছে, কেউ অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত হতে হতে পালাচ্ছে। কেউ জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ছে, কেউ আহত হয়ে মাটিতে পড়ে কোঁকাচ্ছে। দুর্যোধন, দুঃশাসন, যুধিষ্ঠির, সহদেব, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন কখনো শত্রুসৈন্য নিধন করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার কখনো শরাঘাতে আর গদাঘাতে অতিষ্ঠ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছে। 

ঘোরতর জীবননাশী এই সমরে একসময় ভীমের সামনে পড়ে গেল দুঃশাসন। তখন সূর্য মাথার ওপরে। 

ভীম দুঃশাসনকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। মধ্যাহ্ন সূর্যের তীব্র তেজ তার চোখেমুখে সঞ্চারিত হলো। সারথিকে বলল, ‘শিগগির দুঃশাসনের রথের সামনে নিয়ে যাও।’ 

দুঃশাসনও মহাপরাক্রমশালী। সেও পিছপা হবে কেন? তার রথও দ্রুতবেগে ভীমের সামনে এসে দাঁড়াল। উভয়ের মধ্যে অতি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। 

দুঃশাসন কিছু বুঝে উঠার আগেই ভীম বাণবর্ষণ শুরু করল। ভীমের বাণ ছিল তীক্ষ্ণ এবং ক্ষিপ্র গতির। চোখের পলকে দুঃশাসনের ধনুক ও রথধ্বজা কাটা পড়ল। তার সারথি মারাত্মকভাবে আহত হলো। দুঃশাসন ধৈর্য হারাল না। 

অন্য একটা ধনু হাতে নিয়ে এক ভয়ঙ্কর তির যোজনা করল দুঃশাসন। ভীমের বক্ষ লক্ষ করেই সেই তির নিক্ষেপ করল। সেই তির ভীমের বর্ম ভেদ করতে পারল না, কিন্তু এমন প্রচণ্ড গতিতে বর্মে আঘাত করল যে ভীম প্রাণহীনের মতো হাত ছড়িয়ে রথমধ্যে পড়ে গেল। অবিলম্বে চেতনা ফিরে পেয়ে যুদ্ধপ্রস্তুতি নেওয়ার আগেই ভীমের ধনুক কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলল দুঃশাসন। যুদ্ধটা দুই বীরের মধ্যে হলেও দুঃশাসনের পরাক্রম দেখবার মতো ছিল। 

ভীম এবার শক্তি সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়াল। হাতের কাছে ভীষণাকার এক শক্তিশেল খুঁজে পেল ভীম। সেটাই সুতীব্র বেগে দুঃশাসনের দিকে ছুড়ে মারল। কিন্তু দুঃশাসন আগে থেকেই সতর্ক ছিল। সেই শক্তিশেলকে পথের মধ্যে বাণাঘাতে খণ্ড খণ্ড করে ছাড়ল। এরপর দুঃশাসন ভীমের দিকে ছুড়ে মারল প্রচণ্ড গতির এক শক্তিশেল। গদা হাতে নিল ভীম। গদার আঘাতে দুঃশাসনের শক্তিশেল ছত্রখান হয়ে গেল। 

এরপর গদা হাতে মাটিতে নেমে পড়ল ভীম। বাতাসে প্রবল বেগে গদা ঘোরাতে লাগল। বাতাসে ঘূর্ণি উঠে শোঁ শোঁ শব্দ হতে লাগল। সেই ঝড় ক্রোধ হয়ে তার মনে ছড়িয়ে পড়ল। দ্রুত পায়ে সামনের দিকে বেশ কিছু পথ এগিয়ে গেল ভীম। সেখানে দাঁড়িয়েই প্রবল শক্তিতে দুঃশাসনকে লক্ষ করে তার ভারী ভয়ঙ্কর মৃত্যুসম গদাটি ছুড়ে মারল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না গদাটি। দুঃশাসনের মাথায় গিয়ে আছড়ে পড়ল। গদার আঘাতে রথ থেকে ছিটকে পড়ল দুঃশাসন। তার সারথি ও রথও চূর্ণ হয়ে গেল। 

দুঃশাসনের বর্ম টুকরো টুকরো হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেছে। তার বসন ছিন্নভিন্ন। ধূলিধুসরিত দুঃশাসন ব্যথায় কাঁতরাচ্ছে। আশপাশে কোনো কুরুযোদ্ধা নেই যে তাকে মাটি থেকে টেনে তুলবে, এমন কোনো কুরুরথী নেই যে এগিয়ে এসে তাকে রথে তুলে নিয়ে তার প্রাণ বাঁচাবে। তার চারদিকে তখন পাণ্ডব-পাঞ্চাল সৈন্যরা। বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আনন্দধ্বনি দিয়ে যাচ্ছে তারা। 

দুঃশাসন ছটফট করতে করতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। সিংহগর্জনে ভীম তার দিকে এগিয়ে গেল। 

এক লাফে দুঃশাসনের বুকের ওপর চড়ে বসল ভীম। পূর্বস্মৃতিতে জর্জরিত ভীম তখন ক্রোধে কাঁপছে। বাম পা দিয়ে দুঃশাসনের গলা চেপে ধরল ভীম। তারপর দুঃশাসনের ডান হাতটাকে মোচড় দিয়ে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ওই ছিন্ন হাত দিয়েই দুঃশাসনকে আঘাত করতে করতে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে বেজন্মা, এই হাত দিয়েই তো দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরেছিলি? এই হাত দিয়েই তো তুই দ্রৌপদীর বস্ত্র খুলে ফেলতে চেয়েছিলি? আর এই জিহ্বা…।’ 

বলতে বলতে দুঃশাসনের ছিন্ন হাতটি দূরে ছুড়ে মারল ভীম এবং দুঃশাসনের মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে তার জিহ্বা টানতে টানতে বলতে লাগল, ‘এই জিহ্বা দিয়েই তো দ্রৌপদীকে কুৎসিত কথা বলেছিলি! আজ তোর সেই জিহ্বা টেনে বের করে নেবই।’ 

তারপর ভীম দুই হাতের প্রচণ্ড শক্তিতে দুঃশাসনের বুক চিরে ফেলল। উন্মাদের মতো বলে যেতে লাগল, ‘মনে পড়ে তোর দুঃশাসন, পাশাখেলার সময় বলেছিলাম— একদিন সময় আমার হাতে আসবে। সেদিন তোর বুকের রক্ত পান করব আমি। আজ করছি, এই দেখ তোর বুক ফেঁড়ে রক্ত খাচ্ছি আমি।’ 

বলতে বলতে আঁজলা আঁজলা রক্ত মুখে পুরতে লাগল ভীম। 

তার কাণ্ড দেখে যোদ্ধারা নিথর নিস্তব্ধ। নিষ্পলক চোখে ভীমের পাশবিকতা দেখে যেতে লাগল তারা। 

এরপর ত্বরিত উঠে দাঁড়াল ভীম। কোষ থেকে তরবারি বের করে আনল। গলা বরাবর সেই তরবারি প্রচণ্ড গতিতে নামিয়ে আনল। দুঃশাসনের মস্তকটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে ছিটকে পড়ল। এরপরও শান্ত হলো না ভীম 

কর্কশ কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘ওহে তোমরা শোনো আমার কথা, শত্রুর রক্ত যে অমৃতের চেয়েও মিষ্ট, জানতাম না আগে। কুলাঙ্গার দুঃশাসনের রক্ত পান করেই বুঝলাম- ওই দুরাত্মার রক্ত মধুর চেয়েও মধুর। 

ক্রোধ, হিংসা, প্রতিহিংসায় উন্মত্ত ভীমের এ রকম চেহারা আগে কেউ কোনোদিন দেখেনি। তার সামনেই তো দুর্যোধন-শকুনি-কর্ণের প্ররোচনায় দুঃশাসন অন্তঃপুর থেকে চুল ধরে টানতে টানতে রজঃস্বলা একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে প্রকাশ্য রাজসভায় নিয়ে এসেছিল! ভীষ্ম, কৃপ, দ্রোণ, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্রের সামনে তার বস্ত্র খুলে ফেলে তাকে নগ্ন করতে চেয়েছিল। 

হত্যা এবং রক্ত পান করার পরও দুঃশাসনের ওপর থেকে ভীমের ক্রোধ তবুও কমে না। দুহাতে গদা ধরে মাথার চারদিকে ঘুরিয়ে যেতে লাগল। শক্তিক্ষয়েও রাগ যদি কিছুটা কমে ভীমের 

দুর্যোধন যখন তার ভাইদের নিয়ে ওখানে পৌঁছাল, দুঃশাসনকে চেনার উপায় নেই তখন। বুক চাপড়ে হাহাকার করে উঠল দুর্যোধন। দুঃশাসন যে প্রাণের ধন ছিল তার! এই ভাইটিকে সে যে সবচাইতে বেশি ভালোবাসত! 

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার হাহাকার দেখে দুর্যোধনের অন্য ভাইয়েরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নিষঙ্গী, কবচী, পাশী, দণ্ডধর, ধনুর্গ্রহ, অলোলুপ, সহযণ্ড, বাতবেগ এবং সুবর্চা নামের দশজন দুর্যোধনভ্রাতা চারদিক থেকে ভীমকে ঘিরে ধরল। ভীমকে লক্ষ করে দশভাই-ই মারাত্মক শরবর্ষণ শুরু করল। তারা আজ ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে। 

ভীমের আজ কালান্তক যমের মূর্তি। দুঃশাসনহত্যার ক্রোধ তার মনে এখনো প্রজ্জ্বলিত। দুর্যোধন ভাইদের আক্রমণ সেই ক্রোধের আগুনে ঘি ঢালল। গদা ছেড়ে ভল্ল হাতে তুলে নিল ভীম। এক ভাইকে লক্ষ করে সেই ভল্ল ছুড়ে মারল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। বাতাবেগ ধূলিতে লুটিয়ে পড়ল। এইভাবে একের পর এক ভল্ল নিক্ষেপ করে দুর্যোধনের অন্য ভাইদেরও যমালয়ে পাঠাল সে। 

ভীমের বিধ্বংসী মূর্তি দেখে পাণ্ডবসেনারা পর্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এই সময় পাঞ্চালসেনারা দুর্যোধনকে ব্যস্ত রেখেছিল। ভাইদের হত্যাকাণ্ড দুর্যোধন নিজ চোখে দেখল না। 

ওই সময় কর্ণপুত্র বৃষসেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নকুল সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। বৃষসেন যথার্থ বীর। তার সঙ্গে নকুলের এঁটে উঠা সম্ভব হচ্ছিল না। বারবার পেছনে হটতে হচ্ছিল নকুলকে। সুযোগ হাতছাড়া করল না বৃষসেন। বাণাঘাতে নকুলকে ব্যাকুল করে তুলল। ভীম কাছেই ছিল। আহত নকুল এক লাফে ভীমের রথে চড়ে বসল। ভীম ভাইকে নিয়ে দূরে পালিয়ে আত্মরক্ষা করল। 

পেছনে বৃষসেনের অট্টহাস্য শুনতে পেল তারা। 

তিরাশি 

আজ সকালে যুদ্ধযাত্রার আগে কর্ণের হঠাৎ মনে হলো— মদ্ররাজ শল্য যদি তার সারথি হয়, তা হলে অর্জুনহত্যা সহজতর হবে। 

যুদ্ধজয়ে সারথির ভূমিকা অনেক। তার বিচক্ষণতায় রথী-মহারথীরা শত্রুর অস্ত্রাঘাত এড়াতে পারে। যুদ্ধরত অবস্থায় একজন সারথির মন্ত্রণা খুবই জরুরি। তাছাড়া শত্রুকে আক্রমণের সময় সারথি নানা প্রশংসাবাক্যে রথারোহীযোদ্ধাকে উদ্দীপিত করে তোলে। 

আজ কর্ণের মনে হলো শল্যের মতো একজন সারথিকে পেলে তার যুদ্ধজয় নিশ্চিত। আজ যে অর্জুনের সঙ্গে তার মরণপণ যুদ্ধ! 

দুর্যোধনের মাধ্যমে কর্ণের সারথ্য-প্রস্তাব শল্যের কাছে গেলে ভীষণ রেগে উঠল সে। এটা ঠিক, তার অশ্বজ্ঞান তুলনাহীন। ঘোড়ার গতি-প্রকৃতি, হ্রেষার মমার্থ, ঘাড়-মাথা ঘোরানোয় ইঙ্গিত, নানা ভঙ্গিতে লেজ নাড়ার তাৎপর্য তার চেয়ে বেশি এই কুরুক্ষেত্রের যোদ্ধারা তো নয়ই, ভূ-ভারতের অন্য কেউই বোঝে না। হ্যাঁ, কৃষ্ণকে তার সঙ্গে তুলনা চলে, কিন্তু কৃষ্ণের সারথ্যজ্ঞান তার চেয়ে বেশি নয় কখনো। তাছাড়া সে মদ্র নামের বিখ্যাত এক দেশের রাজা। মদ্ররাজ্য করদরাজ্য নয়। শস্ত্রবিদ হিসেবে তার ভুবনব্যাপী খ্যাতি আছে। পিতামহ ভীষ্মের বিবেচনায় সে মহারথী। আর কর্ণ হলো অর্ধরথ। সেই মহারথীকে একজন অর্ধরথ কামনা করছে সারথি হিসেবে! ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠবে, না অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে, বুঝে উঠতে পারছে না মদ্ররাজ শল্য। 

নিজেকে সংযত করে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে শল্য বলল, ‘কী বললেন, মহারাজ দুর্যোধন? কার সারথি হওয়ার জন্য বলছেন?’ 

‘আপনি রাগ করবেন না মদ্ররাজ। প্রস্তাবটা আমার নয়, বন্ধু কর্ণের। বর্তমানে সে কৌরবদের সেনাপতি। সৈন্যপরিচালনার সকল সিদ্ধান্ত এখন তার হাতে। সেই সেনাপ্রধান কর্ণ ইচ্ছে করছে, আপনি তার সারথ্য গ্রহণ করুন।’ ধীরে ধীরে বলল দুর্যোধন। 

ক্রোধটাকে কোনোক্রমেই দমিয়ে রাখতে পারছে না শল্য। গলা ছাপিয়ে ক্রোধ বারবার মস্তিষ্কে উঠে আসতে চাইছে। কঠোর হাতে ক্রোধকে দমন করল শল্য। বলল, ‘আমার বংশমর্যাদা, ঐশ্বর্য, বিদ্যা আর শক্তির কথা আপনার অজানা নয়। এসব নিয়ে আমি গর্বও করি। বীরত্বের বিবেচনায়ও কর্ণ আমার সমান নয় বলে আমি মনে করি। তাছাড়া…।’ বলে চুপ মেরে গেল শল্য। 

দুর্যোধন সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, ‘তাছাড়া?’ 

শল্য গর্বের সঙ্গে বলল, ‘আমি ক্ষত্রিয়, কর্ণ শূদ্র। সূতপুত্র সে। আপনি নিজে ক্ষত্রিয় হয়ে আর একজন ক্ষত্রিয়কে শূদ্রের রথের সারথি হতে কী করে বলেন মহারাজ?’ 

ফাঁপরে পড়ে গেল দুর্যোধন। কী করবে—ঠিক করতে পারছে না সে। শল্যের প্রশ্নের জবাবে কী বলবে, তাও মুখে আসছে না তার। ভ্যাবাচেকা চোখে শল্যের দিকে তাকিয়ে থাকল দুর্যোধন। এবার কণ্ঠে বেশ গর্ব মিশিয়ে মদ্ররাজ শল্য বলল, ‘রাজর্ষিবংশে আমার জন্ম। লোকে আমাকে মহারথী বলে জানে। সেই আমার পক্ষে একজন শূদ্রের সারথ্য করা কিছুতেই সম্ভব নয়।’ বলে আসন ছেড়ে উঠে পড়ল শল্য। চলে যেতে উদ্যত হলো। 

দুর্যোধন মহাবিপদে পড়ে গেল। কর্ণ এমনি এমনি শল্যের সারথ্য কামনা করেনি। পেছনে নিশ্চয়ই নিগূঢ় কোনো কারণ আছে। তাছাড়া কর্ণ বলছে, আজকের যুদ্ধে সে অর্জুনকে বধ করবে। যুধিষ্ঠিরকে তার সামনে বন্দি করে আনবে। এই অবস্থায় কর্ণকে সহযোগিতা করা উচিত তার। তাতে যুদ্ধজয় সহজতর হবে। শল্যের কথাও মিথ্যে নয় মোটেই। সে কখনো কর্ণের সারথি হতে পারে না। তার পরও কেন যে কর্ণ শল্যকে সারথি হিসেবে পেতে চাইল, ভেবে দিশা পেল না দুর্যোধন। 

চট করে উঠে দাঁড়াল দুর্যোধন। শল্যের পথ আগলে দাঁড়াল। হঠাৎ দু-হাত জড়িয়ে ধরল শল্যের। বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘আমি বা কর্ণ—দুজনের কেউই আপনার চেয়ে বলশালী নই মহারাজ। কিন্তু এটা তো মানবেন—কর্ণ অর্জুনের চেয়ে উৎকৃষ্ট যোদ্ধা? কর্ণ জানে, আপনি কৃষ্ণের দ্বিগুণ অশ্ববিদ্যাভিজ্ঞ। তাই বিপদে আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছে কর্ণ। কর্ণের প্রার্থনা ফেরাবেন না মহারাজ। 

দুর্যোধনের কথা শুনে শল্যের মন হঠাৎ খুশিতে ভরে উঠল। কিন্তু বাইরে তা দেখাল না।

এই সময় দুর্যোধন বলে উঠল, ‘আজ অর্জুনবধের দিন মহারাজ। যুধিষ্ঠিরকে ধ্বংস করার দিন। আপনি দয়া করে কর্ণের সারথ্য গ্রহণ করুন।’ 

যুধিষ্ঠিরের নাম নেওয়া মাত্রই শল্যরাজ মদ্রের সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে গেল। ভাগনে যুধিষ্ঠির হাতজোড় করে প্রার্থনা করেছিল তার কাছে—কর্ণের সঙ্গে যখন আমাদের যুদ্ধ হবে, তখন আপনি তার সারথি হবেন এবং যুদ্ধকালে নানা কথা বলে তার মনের জোরটা নষ্ট করে দেবেন। তার নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথাও মনে পড়ে গেল শল্যের। সে যুধিষ্ঠিরের কাছে অঙ্গীকার করেছিল- সময় এলে সে সাহায্যটা অতি অবশ্যই পাণ্ডবদের করবে সে। 

আহা! কী চমৎকারভাবেই না সুযোগটা এসে গেল হাতে! একে বলে না-চাইতেই জল। ধেই ধেই করে নেচে উঠতে ইচ্ছে করল শল্যের। 

উল্লাসকে নিজের মধ্যে গোপন রেখে শল্য বলল, ‘আপনার অনুরোধ ফেলে দেওয়ার শক্তি আমার নেই। আপনি আমার অত্যন্ত প্রিয়জন। আপনাকে আমি ভালোবাসি বলেই ভাগনেদের ত্যাগ করে আপনার দলে যোগদান করেছি। আপনাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি বলে কর্ণের সারথ্য আমি গ্রহণ করলাম। তবে আমার একটা শর্ত আছে মহারাজ।’ 

শল্যের কথা শুনে আবার বুক কেঁপে উঠল দুর্যোধনের। যুদ্ধ শুরুর আগে পিতামহ ভীষ্ম শর্ত দিয়েছিলেন। প্রাপ্তি কিছু হয়নি। কিছু পাঞ্চাল ও দ্রুপদসৈন্য নিহত হয়েছে শুধু। তাঁর শর্তের ফাঁদে আটকে কর্ণকে যুদ্ধবিযুক্ত থাকতে হয়েছে। দ্রোণাচার্যও শর্ত দিয়ে বসেছিলেন। তাতেও লাভ হয়নি কিছু কৌরবপক্ষের। উপরন্তু, নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন তিনি। আজ আবার এই মদ্ররাজ শর্তের কথা বলল! কী আছে সেই শর্তে! তার সর্বনাশের বার্তা নেই তো শল্যের শর্তে? 

‘শর্তটা হলো আমি কর্ণের রথ চালাবার সময় যা ইচ্ছে বলতে পারব। কর্ণ কোনো বাধা দিতে পারবে না।’ আবার বলল শল্য। 

নিয়তির হাতের পুতুল যেন এই দুর্যোধন! নিয়তি তার বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে কি তার সমস্ত শৌর্য-বীর্য, শক্তি-সামর্থ্য, পুরুষকার, সামরিক শক্তি পাণ্ডবদের দাপটে ম্লান হয়ে যায়? নিয়তি তার বিরোধিতা না করলে কেন এতগুলো বিশ্বাসঘাতক তার শিবিরে জমায়েত হয়? ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, ভাই যুযুৎসু আর আজকের এই শল্য। হ্যাঁ, শল্যকে বিশ্বাসঘাতক বলেই তো মনে হচ্ছে তার? নইলে এতদিন তার পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করার পর এই সংকটকালে শর্ত দিয়ে বসবে কেন শল্য? এই শর্তকে আপাত চোখে কিছুই নয় বলে মনে হলেও, যেকোনো রথারোহী বীর জানে—যুদ্ধকালে একজন সারথির ভূমিকা কত জরুরি! তার উৎসাহ, পেছন থেকে শত্রুপক্ষের অস্ত্রের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সতর্কীকরণ এবং শত্রু সম্পর্কে নিন্দা করে যোদ্ধাকে মনোবল জোগানো—এসব সারথিই করে থাকে। তখন যদি কোনো সারথি যোদ্ধাকে কুমন্ত্রণা দেয় বা অপ্রশংসার মাধ্যমে রথারোহী যোদ্ধার মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অথবা মনোবল ভেঙে দেয়, তা হলে সেই যোদ্ধার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। শল্য কোন ভূমিকা পালন করবে? ভেবে কিনারা পায় না দুর্যোধন। কর্ণই- বা আজ হঠাৎ করে শল্যকে চেয়ে বসল কেন, তাও বুঝতে পারছে না সে। কর্ণ চাইতেই পারে শল্যকে। শল্যের মতো অশ্ববিশারদ ভারতবর্ষে আর দ্বিতীয়জন নেই—না জানার কথা নয় কর্ণের। তাই হয়তো অর্জুনবধের দিন চৌকশ শল্যকে নিজের রথের সারথি হিসেবে নির্বাচন করেছে। প্রধান সেনাপতি হিসেবে তা করার অধিকার আছে কর্ণের। 

কিন্তু এই শল্যটা ভীষ্ম হয়ে যাবে না তো? দ্রোণাচার্য নয় তো সে? যুযুৎসুর মতো তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না তো শল্য? শেষ পর্যন্ত ভাগনে নকুল-সহদেবের হয়ে কাজ করবে না তো সে? 

‘কী মহারাজ, আমার শর্তের কোনো উত্তর দিচ্ছেন না যে আপনি?’ ভেজাবেড়ালের কণ্ঠে বলে উঠল মদ্ররাজ শল্য। 

‘অ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ!’ সংবিতে ফিরল দুর্যোধন। অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘আপনার শর্ত মেনে নিলাম রাজা। কর্ণকে ব্যাপারটা খুলে বলব আমি। কিন্তু ব্যাপারটা হলো আপনার ভূমিকা যাতে কর্ণের মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে, তার বীরত্বে যাতে কোনোরূপ ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে।’ 

‘তা অবশ্য আমি চেষ্টা করব। তবে যুদ্ধকালের উত্তেজনা সম্পর্কে তো আপনি জানেন! কী পরিস্থিতিতে কোন কথাটি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে, তা তো এখন হলফ করে বলতে পারব না মহারাজ! তবে আপনার কথা নিশ্চয়ই মনে রাখব আমি।’ 

শল্যের চোখেমুখে যে আবছা একটু ক্রূর হাসি ছলকে উঠল, বুঝতে পারল না দুর্যোধন।

দুর্যোধন বলল, ‘ঠিক আছে। কর্ণের রথের দিকে এগিয়ে যান আপনি।’ 

চুরাশি 

কর্ণ আর অর্জুন তাদের রথ মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। 

অর্জুনের সারথি কৃষ্ণ। কৃষ্ণ যেমন কুচক্রি, তেমনি কুটিল। মায়া-মমতা-মানবতা বলে কিছুই নেই তার। শঠতা, প্রতারণা, মিথ্যা, কুমন্ত্রণার মাধ্যমে যুদ্ধ জয়ই তার লক্ষ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে সারথিদের যে নিয়মধর্ম পালন করতে হয়, তার ধারেকাছেও নেই কৃষ্ণ। তবে তার একটা অতুলনীয় গুণ আছে। সারথি হিসেবে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কৃষ্ণ অর্জুনের সারথি বলেই অর্জুন এখনো বেঁচে আছে। শুধু তা-ই নয়, কৌশলে অপকৌশলে কুরুপক্ষের বহু বীরকে অর্জুন হত্যা করতে পেরেছে। পাণ্ডবদের মূলধন কৃষ্ণ। আর কৃষ্ণের মূলধন প্রতারণা। 

আর কর্ণের সারথি মদ্ররাজ শল্য। শল্য অর্জনদের মামা। নকুল সহদেবের মা মাদ্রী। এই মাদ্রীর সহোদর শল্য। ঘটনাক্রমে সে আজ ভাগনেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সেদিনের সেই ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তার লোভ ও সৌজন্যপ্রীতি। দুর্যোধন ওভাবে অর্ধপথ এগিয়ে এসে তার প্রতি এ রকম প্রীতি-সৌজন্য না দেখালে সে আজ পাণ্ডবদের পক্ষেই যুদ্ধ করত। যা হোক, বিধি বাম ছিল বলেই এ রকম হয়েছিল। আজ সেই ভুল সংশোধনের দিন এসে গেছে। কর্ণের সারথ্য গ্রহণ করে শল্য আজ সেই ভুলের মাশুল পাণ্ডবদের ফেরত দিতে চায়। 

আদর্শ সারথির বৈশিষ্ট্য—দেশ, কাল, রথীর লক্ষণ, ইঙ্গিত, দৈন্য, হর্ষ, খেদ, বল ও দুর্বলতা, স্থানের সমতলতা, বন্ধুরতা, যুদ্ধের অবসর ও শত্রুর দুর্বলতা দেখা। তা সবই শল্যের ছিল। বাড়তি যা ছিল, তার নাম-বিশ্বাসঘাতকতা। কার্যকালে কর্ণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বিন্দুমাত্র বিচলিতবোধ করেনি শল্য। 

আজ যুদ্ধ শুরুর আগে সেনাপতি কর্ণ পক্ষপ্রপক্ষযুক্ত মহাব্যূহ রচনা করল। নিজে সেই ব্যূহের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দিল। ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। যুদ্ধে কখনো পাণ্ডবসেনা পিছিয়ে যেতে লাগল, আবার কখনো কৌরবসেনা। সংশপ্তকসৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দিনের প্রথম দিকের বেশিরভাগ সময় কেটে গেল অর্জুনের। সেই সময়টা কর্ণেরও কেটে গেল পাঞ্চাল, চেদি, সৃঞ্জয় ইত্যাদি দেশের বীরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে। ভীমের হাতে গন্ডায় গন্ডায় কৌরবযোদ্ধা মারা পড়তে লাগল। দুর্যোধন বহু পাণ্ডবসৈন্যের ভবলীলা সাঙ্গ করল। 

শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের মহাসমরে কর্ণ আর অর্জন সামনাসামনি হলো। 

উভয়ের চোখেমুখে জিঘাংসা। উভয়ে যেন দীর্ঘদিনের মহাবুভুক্ষু। দুজনের চোখে খাণ্ডবদাহের অগ্নি। পৃথিবীকে রসাতলে নেওয়ার প্রতিজ্ঞায় উভয়ে যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে আজ। দুজনকেই যমসদৃশ্য মনে হচ্ছে। উভয়ে যেন আজ মৃত্যুর দোসর। দুজনের তূণভর্তি তিরে তিরে শমনের সঘন উপস্থিতি। 

কর্ণ আর অর্জুনের সংহারমূর্তি দেখে অশ্বত্থামা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এত বড় বীর যে-অশ্বত্থামা, সেই মহাধনুর্ধরের বুকটা কেন জানি কেঁপে উঠল। তার তখনই মনে হলো এই যুদ্ধ থামনো দরকার। নইলে সব কিছু, সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। 

দুর্যোধনের দিকে রথ ছোটাল অশ্বত্থামা। দুর্যোধনের সামনে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ল। 

‘আপনি এ যুদ্ধ বন্ধ করুন মহারাজ। যুদ্ধ থামান। অনুনয়ের কণ্ঠে বারবার বলতে লাগল অশ্বত্থামা। 

দুর্যোধন চমকে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে! কী বলতে চাইছ অশ্বত্থামা তুমি?’ 

‘আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করুন। সন্ধির প্রস্তাব করুন। নইলে…।’

‘নইলে! নইলে কী হবে অশ্বত্থামা?’ 

‘কুরু-পাণ্ডব কোনো পক্ষেই কেউ বেঁচে থাকবে না।’ 

‘কেন?’ 

‘আমি কর্ণ আর অর্জুনের সংহারমূর্তি দেখে এসেছি। তাদের রোষানলে পড়ে কোনো পক্ষের কেউ বেঁচে থাকবে না মহারাজ। 

এবার দৃঢ় কণ্ঠে দুর্যোধন বলল, ‘আমার প্রায় সকল ভাই নিহত হয়েছে। প্রাণের ভাই দুঃশাসনের রক্ত পান করেছে ভীম। লক্ষ লক্ষ সৈন্য নিহত হয়েছে। আঠারো অক্ষৌহিণীর মধ্যে আর সামান্য সংখ্যক যোদ্ধা বেঁচে আছে। আজকের যুদ্ধে তারাও মারা গেলে কিছু আসবে যাবে না অশ্বত্থামা। কর্ণ আজকে আমাকে জয় এনে দেবে বলেছে। তুমি যুদ্ধে ফিরে যাও অশ্বত্থামা। সন্ধির কথা মন থেকে মুছে ফেল।’ 

হতাশ হয়ে অশ্বত্থামা ফিরে গেল। 

অর্জুন গাণ্ডিবে টংকার দিল। কর্ণ মৃত্যুসম তার ধনুকটি হাতে তুলে নিল। 

অর্জুনকে লক্ষ করে কর্ণই প্রথমে বাণ ছুড়ল। সেই বাণে অর্জুন রক্তাক্ত হলো। অর্জুনও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। মহাবীর সে। দ্রোণাচার্যের শিষ্য সে। সেও গাণ্ডিবে তির যোজনা করে কর্ণের দিকে ছুড়তে লাগল। কর্ণও আঘাতপ্রাপ্ত হলো। কিন্তু সেও তো জগদ্বিখ্যাত পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছে! অর্জুনের অস্ত্রাঘাতে কর্ণ হতোদ্যম হলো না। একটুও বিচলিত না হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে অটল থাকল কর্ণ। রাম আর রাবণে যুদ্ধ হয়েছিল সাতদিন সাতরাত। এ দুজনের যুদ্ধ কতদিন চলে—বুঝে উঠতে পারল না উভয়পক্ষের সেনারা। 

বীরত্বে, অস্ত্র সঞ্চালনে এবং পৌরুষে কখনো কর্ণ আবার কখনো অর্জুন এগিয়ে যাচ্ছিল। উভয়পক্ষের যোদ্ধারা যুদ্ধ ফেলে কর্ণ-অর্জুনের প্রাণঘাতী সমর দেখে যেতে লাগল। 

অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পরও কর্ণ যখন অর্জুনকে কাবু করতে পারছিল না, হঠাৎ করে তার সর্পমুখ বাণের কথা মনে পড়ে গেল। এই বাণ সুবর্ণ তৃণীরে চন্দনচূর্ণের মধ্যে রক্ষিত। কর্ণ তৃণ থেকে সেই বাণ হাতে তুলে নিল। এই বাণ ভয়ালদর্শন। এর আঘাতে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। অর্জুনের মৃত্যু আজ নিশ্চিত। সর্পমুখ বাণটি অর্জুনকে নিশানা করে ধনুতে যোজনা করে ফেলেছে কর্ণ—চকিতে পেছন ফিরে দেখে নিল শল্য। শল্য বুঝল -মহাপ্ৰমাদ! 

শল্য হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলল, ‘মহাবীর কর্ণ, এই বাণ অর্জুনের গ্রীবা লক্ষ করে নিক্ষেপ করবেন না। এই সর্পমুখ তির মস্তক ছেদনের জন্য নির্মিত। এই তিরে অর্জুনের মৃত্যু নিশ্চিত। আপনি অর্জুনের মস্তক লক্ষ করে তিরটি ছুড়ুন।’ এমন জোরে শল্য কথাগুলো বলল যে কৃষ্ণের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেল তা। 

ইতিমধ্যে সর্পমুখ বাণটি বাতাসে ভেসে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না এটি। অর্জুনের মৃত্যু অবধারিত। 

কৃষ্ণ সামনের গর্তটি লক্ষ করে রথ ছোটাল। রথের চাকা গর্তে পড়ে গেল। মাটিতে দেবে গেল অর্জুনের রথটি। ঘোড়াগুলোও হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিল। অর্জুনের মাথাটি বেঁচে গেল। মুকুটে আঘাত করল সর্পমুখ তিরটি। অর্জুনের কিরীটটি খণ্ডিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। 

বিপদ কেটে গেলে কৃষ্ণ দ্রুত রথ থেকে নেমে দু-হাতে টেনে তুলল রথটিকে। রথের চাকা তুলতে গিয়ে কর্ণ যা সময় পেয়েছিল, ওই সময়ের মধ্যে অর্জুনকে বধ করতে পারত কৰ্ণ। কিন্তু কৰ্ণ তা করেনি। যুদ্ধের নিয়ম নয় বিপদেপড়া কোনো শত্রুকে আঘাত করা। সেই নিয়ম মেনেছিল কৰ্ণ। 

রথের চাকা সমতলে উঠে এলে অর্জুন বাণাঘাতে কর্ণের সুবর্ণ মুকুট কেটে মাটিতে নামাল। কর্ণের বর্ম খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল। তার দেহে অনেক ক্ষতের সৃষ্টি হলো। তার হাত থেকে ধনুক খসে পড়ল। রথের মধ্যেই মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল কর্ণ। তা দেখে বাণাঘাত করা থেকে বিরত থাকল অৰ্জুন। 

কৃষ্ণের তা পছন্দ হলো না। হিংস্র কণ্ঠে বলল, ‘তুমি এ কী করছ অর্জুন! যুদ্ধ থেকে বিরত হলে কেন?’ 

‘তুমি দেখছ না দাদা, কর্ণ মূর্ছিত হয়ে গেছে! নিরস্ত্র সে! নিরস্ত্রকে আঘাত করা আমার ধর্ম নয়।’ বেশ জোরের গলায় বলল অর্জুন। 

কৃষ্ণ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তুমি কী বলতে চাইছ বুঝতে পারছি না অর্জুন! তুমি কি আমাকে সমরনীতি শেখাতে চাইছ? যুদ্ধনীতি তো এটাই বলে অর্জুন, সংকটগ্রস্ত শত্রুকে বধ করা অধর্ম নয়। বিপদগ্রস্ত শত্রুকে সময় দিলে সে আবার আগের শক্তি ফিরে পাবে। কর্ণকে যদি এই মুহূর্তে তুমি সময় দাও, তা হলে জ্ঞান ফিরে আবার মারণাস্ত্র হাতে তুলে নেবে। গাণ্ডিবে তির যোজনা করো অর্জুন। কর্ণের বক্ষ লক্ষ করে তির ছোড়ো।’ 

কৃষ্ণ ন্যায়নীতি এবং বীরধর্মের তোয়াক্কা করল না। তার প্রকৃতিই হলো নীতিকে যখন যেভাবে প্রয়োজন নিজের অনুকূলে ব্যবহার করা। কৃষ্ণ জানে, কর্ণ অর্জুনের সহোদর। সেই সহোদরকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে বধ করার প্ররোচনা দিতে তার গলা কাঁপল না। তার নীতিধর্মের কাছে মানবধর্ম অবহেলিত। 

অর্জুন কিন্তু শুনল না কৃষ্ণের কুমন্ত্রণা। 

স্পষ্ট গলায় বলল, ‘তোমার কথা আমি মানতে রাজি নই। মূর্ছিত কর্ণকে আমি কিছুতেই আঘাত করব না।’ 

পঁচাশি 

হিসিয়ে উঠল কৃষ্ণ, ‘তুমি ভুল করছ অর্জুন। আমার কথা ধরো। বাণাঘাতে কর্ণকে ভূলুণ্ঠিত করো।’ 

অর্জুন কৃষ্ণের খুব অনুগত। যখন যা বলেছে কৃষ্ণ, মেনে নিয়েছে। আজ কৃষ্ণকথা মানতে রাজি হলো না। বলল, ‘এ প্রকৃত বীরের কাজ নয়। তুমি বলো যে আমি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। একজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার কাজ কি অসহায় শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়ে হত্যা করা? তা যদি করি আজ, ত্রিজগতে আমি নিন্দিত হব।’ 

কৃষ্ণ এবার উগ্র কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তুমি কি আজ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লে? তুমি যদি আজ কর্ণকে বধ না কর, তা হলে আমি সুদর্শনচক্র দিয়ে কর্ণের মুণ্ডচ্ছেদ করব।’ কৃষ্ণ বুঝে গিয়েছিল, কর্ণকে কাবু করতে চাইলে নিরস্ত্র অবস্থায় আক্রমণ চালাতে হবে। 

অর্জুন মৃদু হেসে বলল, ‘তা হলে তোমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে না দাদা? তুমিই তো বলেছিলে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেবে না তুমি!’ 

অর্জুনের কথায় চুপসে গেল কৃষ্ণ। তার মুখের কথা ফুরিয়ে গেল। ভ্যাবাচ্যাকা চোখে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে থাকল। 

অর্জুন মনে মনে বুঝে নিল কৃষ্ণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। তার আচরণ কৃষ্ণের অভিমানে আঘাত লেগেছে। কিন্তু কৃষ্ণকে যে আঘাত দেওয়া যাবে না! তাদের সকল প্রেরণার উৎস এই কৃষ্ণ। মূলত কৃষ্ণের চাতুর্যময় মন্ত্রণার কারণেই তারা আজ কুরুসেনাবাহিনীকে ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এই কৰ্ণই এখন যত বাধা। এই বাধাকে সমূলে সরিয়ে ফেলতে পারলে তাদের জয় আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। কৃষ্ণের প্ররোচনায় সে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়েছে। এত এত আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করেছে। অন্যায়, অনীতি যা করার, তা তো আগেই করে ফেলেছে সে! অসহায় কর্ণকে আক্রমণ সেই অন্যায়ের মুকুটে না হয় আরেকটা অন্যায়ের পালক যুক্ত হবে। ভাবতে ভাবতে গাণ্ডিব হাতে তুলে নিল অর্জুন। 

ততক্ষণে কর্ণ চেতনা ফিরে পেয়েছে। ধনুতে তির যোজনার আগেই অর্জুন তাকে আক্রমণ করতে শুরু করল। 

ধৈর্য হারাল না কর্ণ। অর্জুনের বাণাক্রমণের জবাব দিতে শুরু করল। 

অর্জুনের রথের চারদিকে ঘুরে ঘুরে বাণাঘাত করে যেতে লাগল কর্ণ। তার হিংস্র, মারাত্মক, বিধ্বংসী শরাঘাতে অর্জুন আর কৃষ্ণ জর্জরিত হতে থাকল। কর্ণের সম্মুখে অর্জুন এখন নিষ্প্রভ। কৃষ্ণ দিশেহারা। রথ কোন দিকে ঘোরালে কর্ণের বাণাঘাত থেকে অর্জুন রক্ষা পাবে, তাও ভুলে গেছে যেন কৃষ্ণ! 

শল্য দেখল, এই দিশেহারা অবস্থায় অর্জুনের পরাজয় নিশ্চিত। কর্ণের নিক্ষেপিত তিরের তেমন জবাব দিতে পারছে না অর্জুন। অর্জুনের মনোবল ভেঙে চুরমার। কৃষ্ণ হতভম্ব। কর্ণের মনের জোর এখন তুঙ্গে। এখনই তার কাজ শুরু করার সময় এসে গেছে। ভাগনেঋণের শোধ দেওয়ার সুযোগ এসে গেছে তার হাতে। যা করার এখনই করতে হবে। না হলে ভাগনে অর্জুনকে বাঁচানো যাবে না। 

জোর খাঁকারি দিল একটা। তারপর উচ্চৈঃস্বরে কর্ণকে শুনিয়ে শুনিয়ে শল্য বলতে শুরু করল, ‘মহাবীর কর্ণ, আপনি যে অর্জুনকে খেলো ভাবছেন, সে আসলে তা নয়। মহাধনুর্ধর সে। গাণ্ডিব যখন তার হাতে থাকে, তখন এই পৃথিবীর কেউই তাকে হটাতে সাহস করে না। তার অস্ত্রজ্ঞান, নৈপুণ্য, কৌশলের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না। আপনি সাবধান হোন। ভেবেচিন্তে অস্ত্র নির্বাচন করুন।’ 

বিশ্বাসঘাতক সারথি শল্যের কথা শুনে মনে মনে বিচলিত বোধ করতে লাগল কর্ণ। তির নিক্ষেপের সময় তার হাত কি নড়ে নড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছে না কর্ণ! তবে তার মনঃসংযোগ যে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, এটা বুঝতে পারল সে। তারপরও দৃঢ় মনোবলে কৃষ্ণার্জুনকে লক্ষ করে চোখা চোখা বাণ নিক্ষেপ করে যেতে লাগল কর্ণ। 

শল্য দেখল, তার কথায় তেমন কাজ হলো না। কর্ণের মনোবল অক্ষুণ্নই আছে। এ রকম হলে তো অর্জুনকে জয়ী করা যাবে না! আত্মীয়ঋণ তো শোধ করা যাবে না! হঠাৎ চলন্ত রথের সামনে একটা গর্ত শল্যের নজরে এলো। অন্য সময় হলে কৌশলে সেই গর্তকে পাশ কাটিয়ে যেত। যে কোনো সারথি তাই-ই করে। সারথি শল্য তা করল না। সরাসরি গর্তটিকে লক্ষ করে কর্ণের রথটি চালিয়ে দিল। রথের বামদিকের চাকাটি গর্তে পড়ে গেল। আটকে গেল কর্ণের রথ। বেকায়দায় পড়ে ঘোড়াগুলো চিঁ হি শুরু করল। এক লাফে মাটিতে নেমে পড়ল কর্ণ। নিরস্ত্র সে তখন। তার তির ধনুক-তূণ তখন রথমধ্যে। কর্ণ নামলেও রথ থেকে শল্য নামল না। ‘হৈ হৈ হট’ বলে ঘোড়াগুলোকে সামাল দেওয়ার অভিনয় করে যেতে লাগল। 

কর্ণ দ্রুত রথের চাকায় হাত লাগাল। ঠেলে সমতল জায়গায় তোলার চেষ্টা করতে করতে উঁচু গলায় বলল, ‘মহারাজ শল্য, আপনি তাড়াতাড়ি রথ থেকে নেমে আসুন। আমার সঙ্গে হাত লাগান। দুজনে একসঙ্গে ঠেললে চাকাটি সমতলে উঠে আসবে।’ 

শল্যের চোখেমুখে তখন ক্রুর হাসির প্রগাঢ় প্রলেপ। সেই হাসি লুকানোর কোনো চেষ্টা করল না শল্য। রথোপরি থেকে বলল, ‘আমি কী করে নামব সেনাপতি! ঘোড়ার রশি ছেড়ে দিয়ে এলে ওরা লাফালাফি শুরু করে দেবে। তাতে রথ মাটিতে আরও দেবে যাবে। আপনি চেষ্টা করতে থাকুন। আমি ঘোড়াগুলোকে সামাল দিই।’ বলে নিজের আসনে গা এলিয়ে বসে পড়ল অর্জুনমাতুল শল্য। 

ওদিকে দমফাটা শক্তি প্রয়োগ করে যেতে লাগল কর্ণ। কিন্তু রথের চাকা একটুও নড়ল না। মহাপরাক্রমশালী বীর হয়েও কোনোমতেই রথের চাকাটি টেনে তুলতে পারছে না কর্ণ। 

ওই সময় কৃষ্ণ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘এই-ই সুযোগ অর্জুন, কর্ণকে হত্যা করার এই-ই সুবর্ণ সুযোগ। যদি দুর্যোধনকে পায়ের তলায় আনতে চাও, তা হলে নিরস্ত্র কর্ণের ওপর এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ো পার্থ।’ 

কৃষ্ণের কথাগুলো কর্ণের কানে গেল। অর্জুনকে লক্ষ করে কর্ণ বলল, অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের এই-ই প্রথম কথা বলা, ‘হে পার্থ, তুমি একটুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি রথের চাকাটা টেনে তুলি। এখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ো না। তুমি রণপণ্ডিত অর্জুন। তুমি জান, অসহায় ও নিরস্ত্র শত্রুকে আক্রমণ করতে নেই। আমার রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে। চাকাটি টেনে তুলতে যা সময় লাগে, ওইটুকু সময় তুমি অপেক্ষা করো অর্জুন। ক্ষণকাল যুদ্ধে নিবৃত্ত হও।’ চাকা ঠেলতে ঠেলতে দৃঢ় কণ্ঠে বলে গেল কৰ্ণ। 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশর্তই ছিল—প্রতিপক্ষ সময় চাইলে সময় দিতে হবে। এমনকি বিপদগ্রস্ত শত্রুকে সাহায্যও করতে হবে। 

অর্জুন তার কিছুই করল না। উপরন্তু কৃষ্ণের প্ররোচনায় গাণ্ডিব হাতে তুলে নিল। কৃষ্ণ-কুমন্ত্রণায় অভিভূত অর্জুন অতি ভীষণ ব্ৰহ্মাস্ত্র মন্ত্রপূত করে ধনুতে যোজনা করল। অসহায় সাহায্যপ্রার্থী নিরস্ত্র কর্ণের বুকে গিয়ে সেই তির আঘাত করল। কর্ণ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। বুকের তিরটি মাটিতে ঠেস হয়ে থাকল। সেই অবস্থাতেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল কর্ণের। 

সেখানেই থেমে থাকল না অর্জুন। অসি হাতে কর্ণের দিকে ছুটে গেল। মাটির দিকে ঝুঁকে থাকা কর্ণের মাথাটি অসির এক কোপে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল অর্জুন। ধড়বিচ্ছিন্ন মাথাটি ধরাতলে গড়িয়ে পড়ল। 

যুদ্ধশেষের অপরাহ্ণে কর্ণের ছিন্ন মস্তকটি মাটিতে পড়ে রইল। তার ওপরে সন্ধ্যাসূর্যের শেষ অস্তরাগের ছোঁয়া এসে লাগল। সহস্রদল পদ্মের মতো কর্ণের মস্তকটি দিনশেষের আলোতে সহস্ররশ্মি হয়ে চারদিকটা রাঙিয়ে তুলল। 

অর্জুনের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলো কর্ণ, কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়বরণ করেনি সে। দুর্যোধনের বন্ধুত্বের ঋণ নিজের জীবন দিয়ে মিটিয়ে গেছে কর্ণ। জীবন তাকে বারবার বঞ্চনা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে স্বয়ং কর্ণ। 

কর্ণ নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৌরবদের যশ, দর্প এবং জয়াশা একসঙ্গে উবে গেল। 

দুর্যোধন ঝড়েপড়া শাখা-পল্লবহীন মৃতপ্রায় এক বৃক্ষ যেন এখন! তাকে দেখে এখন চেনার উপায় নেই যে সে শৌর্যবীর্যময় এক কৌরবপুরুষ। যার বলদর্পে সসাগরা ভারতবর্ষ কেঁপে কেঁপে উঠত। 

দুর্যোধন কর্ণের মৃত্যুর সংবাদ জানল। কিন্তু দুর্যোধনের অগোচরে থেকে গেল শল্যের বিতর্কিত ভূমিকার কথা। তার কাছে মদ্ররাজ শল্য মহাবীরই থেকে গেল। 

ছিয়াশি 

বলরাম বলেছিলেন, ‘এ যুদ্ধ দ্বৈপায়নপাড়ের এই এবড়ো-খেবড়ো ভূমিতে হতে পারে না। গদাযুদ্ধের জন্য চাই সমতল ভূমি। মহাবীর দুর্যোধনকে সসম্মানে সেই কুরুক্ষেত্রে নিয়ে চলো। সেখানেই দুর্যোধনে আর ভীমে গদাযুদ্ধ হবে।’ 

বলে বলরাম রথে উঠেছিলেন। কুরুক্ষেত্রের দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। 

সবাই সবার বাহনে চড়ে বসেছিল। শুধু দুর্যোধনকে কোনো বাহনে চড়তে দেয়নি ভীম। নিৰ্দেশ দিয়েছিল—দুর্যোধন পায়ে হেঁটেই যাবে কুরুক্ষেত্রে। কেউ ভীমের বিরোধিতা করার সাহস করেনি। কারণ ভীমই আসন্ন যুদ্ধের পাণ্ডবপক্ষের একমাত্র ব্ৰহ্মাস্ত্র। 

হাঁটছে দুর্যোধন। 

উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে সমতলভূমিতে নেমে এসেছে দুর্যোধন। কম পথ হাঁটল না সে! সেই ভোর হতে হাঁটা শুরু। এখন প্রায় দ্বিপ্রহর। সময় ফুরাচ্ছে। পথ ফুরাচ্ছে না। হাঁটায় বিরতি নেই, বিশ্রাম নেই। একাক্রমে হেঁটে যাওয়া কুরুক্ষেত্রের দিকে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু অথবা জীবন। যুদ্ধে জয়ী হলে জীবন। পরাজিত হলে মৃত্যু। পাণ্ডুপুত্ররা কি তাকে জয়ী হতে দেবে? কৃষ্ণ কি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে? আঠারো দিনের যুদ্ধটাই তো ছলচাতুরি করে জিতিয়েছে কৃষ্ণ! আজকের যুদ্ধটা কি তার ব্যতিক্রম হবে? 

দুর্যোধনের দেহ অবসন্ন। মন ক্লান্তিহীন। ক্লান্তিহীন মন দুর্যোধনের আহত অবসন্ন দেহটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই হাঁটাতে অবসাদ নেই দুর্যোধনের। কোনো এক গ্রামের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে এখন সে। দুধার শস্যশ্যামল। দূরে গিরিশৃঙ্গের উষ্ণীষ। গ্রামের মানুষ পথের দুপাশে জমায়েত হয়েছে। তারা তাদের রাজাকে দেখবে। এতদিন তারা রাজার নাম শুনেছে, আজ দুচোখে দেখে জীবন ধন্য করবে। কিন্তু রক্তাক্ত আহত বিপর্যস্ত দুর্যোধনকে দেখে তাদের আতঙ্কের অবধি থাকল না। কেউ কেউ আর্তনাদ করে উঠল। পাশের জন দ্রুত তার মুখ চেপে ধরল। 

সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই রাজা দুর্যোধনের। মাথা উঁচু করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। তার দুপাশের তৃণভূমি, শস্যময় খেত, আকাশ, গ্রামের তরুসকল পিছিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। 

আজ যুদ্ধের কোনো কথা মনে পড়ছে না দুর্যোধনের। আজ কেবল আত্মীয়দের মুখ ঘুরেফিরে তার চোখে ভেসে উঠছে I 

লক্ষ্মণার কথা এই মুহূর্তে বড় মনে পড়ছে দুর্যোধনের। লক্ষ্মণা তার আদুরে কন্যা। রাজনীতির ডামাডোলে ব্যস্ত থাকার কারণে মেয়েটিকে আদর করার সময় পায়নি সে। ছোট্ট বালিকা লক্ষ্মণা কখন যুবতী হয়ে উঠেছে, টের পায়নি। ভানুমতী সেদিন কন্যাকে টেনে এনে তার সামনে দাঁড় না করালে চিনতেই পারত না লক্ষ্মণাকে। ভানুমতীর সামনে মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিল—বড় ভুল হয়ে গেছে ভানু আমার। মেয়ের দিকে খেয়াল রাখিনি আমি। তুই আমাকে মাফ করে দে মা, মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল সে। 

লক্ষ্মণার কথা ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে উঠল দুর্যোধন। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকল দুর্যোধন। 

ভানুমতী, তোমাকেও আমি সুখী করতে পারিনি, সুখ দিতে পারিনি। স্ত্রী হিসেবে কিন্তু তুমি সব দিয়েছ আমায়। উজাড় করে দিয়েছ। অনেকের স্ত্রীকে তো দেখলাম! তোমার মতো কাউকে দেখলাম না। কোনো অভিযোগ নেই, কোনো মতান্তর নেই। শুধু ভালোবেসে যাওয়া। রাজনীতিকে তুমি ঘরে টেনে আননি। বলেছ—এই গৃহকোণটা শুধু তোমার আর আমার। আর আমার সন্তানদের। স্বামী সন্তানদের নিয়ে সুখের একটা নীড় রচনা করতে চেয়েছিলে তুমি ভানুমতী। কিন্তু আমি সেই নীড়টাকে নষ্ট করে দিয়েছি। তোমার আঁচলের তলা থেকে আমি তোমার প্রাণের টুকরা লক্ষ্মণকে টেনে বের করে নিয়েছি। তোমার প্রিয়তম পুত্রটিকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছি ভানুমতী। লক্ষ্মণের মৃত্যুসংবাদ তোমার কাছে যখন পৌঁছেছিল, তুমি যে তখন মাটিতে আছড়ে পড়েছিলে, নিজ চক্ষে না দেখেও দেখেছি আমি। তুমি আমায় ক্ষমা করো ভানু, ক্ষমা করো। 

চোখবাঁধা গান্ধারীর চেহারাটা দুর্যোধনের চোখের সামনে ভেসে উঠল। তেজি মুখ। ক্রোধের আলতো আভা। দীর্ঘদেহী। গম্ভীর। হাঁটায় দৃঢ়তা। বড় ব্যক্তিত্বশালী মা তুমি গান্ধারী। তুমি আমার মা, জননী কি না জানি না। এ নিয়ে বিস্তর কানাঘুষা রাজপ্রাসাদে। ছোটবেলার অবুঝ কানে কত কিছুই না শুনতে পেতাম তখন! তারপরও জেনে এসেছি—তুমি আমার মা, আমাদের মা। একশ এক সন্তানের মা তুমি — বালক – বেলা থেকে এই কথাটি শুনে এসেছি আমরা। 

কিন্তু মা, তোমার মধ্যে আমরা জননীকে খুঁজে পাইনি কখনো। কীরকম কঠিন কঠিন মুখ! বাৎসল্যহীন। পাণ্ডবমাতা কুন্তীর চেয়ে অনেক দূরের বলে মনে হতো তোমাকে। কী নিবিড় বাৎসল্যে কুন্তী তার পুত্রদের বুকের কাছে টেনে নিতেন। আঁচল দিয়ে সন্তানদের চোখমুখ মুছিয়ে দিতেন। পরম মমতায় ওদের ঘন চুলে হাত বোলাতেন পাণ্ডবজননী। আমি দূর থেকে তা দেখে যেতাম মা। নিজের অজান্তে আমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত। আমাকে, আমার ভাইদের কাউকে ভালোবেসে কাছে টেনে মাথায়-গায়ে হাত বুলিয়েছ কখনো মা তুমি? সেই পরম পবিত্র দৃশ্যের স্মৃতি আমাদের ভাইদের কারোরই নেই মা। তোমার মধ্যে আমাদের প্রতি একধরনের অবহেলা লক্ষ করেছি। তখন মনে হতো— তুমি কাছে টানতে শেখনি মা, দূরে ঠেলে দিতেই জান তুমি। আসলে আমাদের প্রতি তোমার কোনো ভালোবাসাই ছিল না মা। এই সেদিনের কথাই ধরো। যুদ্ধযাত্রার দিন। শতভাই মিলে তোমার কাছে আশীর্বাদ চাইতে গেলাম। তুমি নির্মোহ কণ্ঠে বলে উঠলে—যথায় ধর্ম, তথায় জয়। তুমি আমাদের আশীর্বাদ করলে না মা, আশীর্বাদ করলে যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠিরকে তো অনেকে ধর্মরাজ বলেও ডাকে! বড় বেদনা নিয়ে আমরা যুদ্ধে যাত্রা করেছিলাম। আমাদের অর্ধেক পরাজয় সেদিন তুমি নির্ধারণ করে দিয়েছিলে মা। 

দুর্যোধন ভাবছে আর হাঁটছে, হাঁটছে আর ভাবছে। গ্রাম ছাড়িয়ে এখন সে বনভূমির পথ ধরেছে। কী সুন্দর! কী মনোময়! এই দিনদুপুরেও হাজার পাখির কলরব। পথরেখা ছায়াছায়া। কোথাও কোথাও সূর্যের রশ্মি তির্যক ভঙ্গিতে পথে এসে পড়েছে। পত্রপল্লবে গাঢ় সবুজের মেলা বসেছে যেন! এসব দেখার, পাতার মর্মর শোনার কোনোদিন সময় হয়নি দুর্যোধনের। আজ নিয়তি সেই অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা পাইয়ে দিচ্ছে তাকে। 

হঠাৎ করেই বনপথ শেষ হয়ে গেল। ঝুপ করে চোখের সামনে ভেসে উঠল নদী। গঙ্গা নদী তার আশৈশবের বন্ধু এই গঙ্গা। এর জলে কত কত বার ঝাঁপিয়েছে দুর্যোধন! শুধু দুর্যোধন কেন, দুঃশাসন, বিকর্ণ, যুযুৎসু এবং আরও ভাইয়েরাও। একটা সময়ে এই গঙ্গা কুরুভাইদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। গঙ্গার পুণ্যতোয়াতে অবগাহন করে তার দেহমন শীতল হতো। এই গঙ্গাজল একসময় অসহনীয় হয়ে উঠেছিল দুর্যোধনের কাছে। যখন পাণ্ডবরা হস্তিনাপ্রাসাদে এলো, ভীমই তাদের জলক্রীড়াকে দুর্বিষহ করে তুলল। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জলক্রীড়া একসময় বন্ধ করে দিতে হয়েছিল তাদের। 

ভীমের নাম মনে পড়ায় মনটা তিক্ততায় ভরে উঠল দুর্যোধনের। 

জোর করে মনটাকে অন্যদিকে ঘোরাতে চাইল দুর্যোধন। আচমকা পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কথা মনে পড়ে গেল দুর্যোধনের। দুচোখ ভাসিয়ে জলধারা নেমে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে গেল সে। হায়রে পিতাশ্রী ধৃতরাষ্ট্র! তোমার মতো দুর্ভাগা পিতা এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়জন নেই! আজ বাবা তোমাকে আপনি বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই তুমি করে বলছি। পিতা সন্তান জন্ম দেয় আনন্দচ্ছলে। সেই আনন্দের ফসল একসময় পিতার জীবনের মহামূল্যবান মানিক হয়ে ওঠে। পিতা পুত্রের দেহমনে নিজেকে প্রোথিত করে। আশা করে, পুত্রের মাধ্যমে সে বহু বহু শতাব্দীর ওপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তুমি আমাকে নিয়ে তা-ই আশা করেছিলে বাবা। আমি তোমার প্রিয়পুত্র হতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি। আমাদের জীবনটা বড় সুখে শুরু হয়েছিল বাবা। সুখ আর স্বস্তি কেড়ে নিল ওই বহিরাগত পাণ্ডবরা। 

পাণ্ডবরা সত্যি সত্যিই পাণ্ডুপুত্র ছিল বাবা? ওরা কি অরণ্যপুত্র ছিল না? তাদের কি কোনো অধিকার আছে-হস্তিনারাজ্য চেয়ে বসার? কিন্তু তোমার ভাই বিদুর তাদের ইন্ধন দিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী কৃষ্ণ ওদের দলে যোগ দিল। তোমার রাজ্যে প্রজাবিদ্রোহ ঘটাতে চাইল বাবা। আমি শক্ত হাতে না সামলালে এই হস্তিনাপুর বহু আগেই বহিরাগতদের হাতে চলে যেত। আমি তোমাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম—এসব ধান্ধাবাজ পাণ্ডবদের নির্মূল করব আমি। কিন্তু পারলাম না বাবা আমি। উলটো আমিই তাদের হাতে বন্দি হয়ে গেলাম, যুদ্ধে পরাজিত হলাম। যেপক্ষে শুভানুধ্যায়ীর মুখোশপরা এতগুলো বিশ্বাসঘাতক থাকে, সেপক্ষ কী করে জয় পায় বাবা! ভীষ্ম, দ্রোণ, শল্য- আর কতজনের নাম বলব বাবা! আমি জানি, আমার বন্দি হওয়ার কথা তোমার কাছে পৌঁছে গেছে। প্রতি মুহূর্তের লাঞ্ছনার সংবাদও সঞ্জয়ের মাধ্যমে তোমার কাছে পৌঁছে যাবেই। জানি বাবা, এসব শুনে তুমি কান্নায় বুক ভাসাচ্ছ। তুমি কেঁদ না বাবা। তুমি দেখে নিয়ো, আজ বিকেলের গদাযুদ্ধে আমি ভীমের ভবলীলা সাঙ্গ করব। শর্তের কথা তো তুমি জেনে গেছ বাবা—ভীমকে জয় করতে পারলে হস্তিনাপুর আবার আমাদের হবে। পাণ্ডুপুত্ররা রাজ্য ছেড়ে যাবে। 

এখন আমার কাছে তোমার আশীর্বাদ বড় প্রয়োজন বাবা। তুমি আমাকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করো পিতা—আমি যাতে তোমার হৃতগৌরব তোমাকে আবার ফিরিয়ে দিতে পারি। প্রণাম পিতাশ্রী। 

সাতাশি 

কুরুক্ষেত্র। সরস্বতী নদীর দক্ষিণপাড়ের এক প্রশস্ত ভূমি। সমতল। 

এখন এর মাটি পশু-মানুষের রক্তে ভেজা ভেজা। স্থানে স্থানে মৃতদেহ। এখানে ওখানে দেহাংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সেখানে শত শত কুকুরের কামড়াকামড়ি। রথচূর্ণ, খণ্ডিত অস্ত্র কুরুক্ষেত্র জুড়ে। বাতাসে দুর্গন্ধ। মৃতদেহগুলো পচতে শুরু করেছে। পচাগন্ধ বাতাসকে ধীরে ধীরে ভারী করে তুলছে। 

তারই মধ্যে নদীঘেঁষা একটা সমতলভূমি বেছে নেওয়া হলো। 

ভূমিটি ঘিরে বৃত্তাকারে সবাই বসেছে। দূরে-অদূরে শত শত যোদ্ধা দাঁড়িয়ে। তাদের চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। উৎসুকও সবাই। এই যুদ্ধশেষে নির্ধারিত হয়ে যাবে হস্তিনাপুর কার? পাণ্ডবদের, না কুরুদের? 

সেই উদ্বেগের গভীর ছায়া পাণ্ডবদের চেহারায়। কুটিলতা দিয়ে চেহারাটাকে কৃষ্ণ এমনভাবে ঢেকে রেখেছে, বোঝা যাচ্ছে না সে উদ্বিগ্ন, না নিরুদ্বিগ্ন। বলরামের চোখমুখ শক্ত। 

সুন্দর শুভ্রকান্তির বলরাম শিরদাঁড়া সোজা করে আসনে বসেছেন। 

দুর্যোধন আর ভীম পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বাম কাঁধে গদাটি বাম হাতে ধরে আছে ভীম। দুর্যোধনের গদা মাটিতে দাঁড়ানো। ডান হাতের মুঠি দিয়ে এর হাতলটি শক্ত করে ধরেছে দুর্যোধন। দুর্যোধনের মনে ভয়ের লেশমাত্র নেই। গ্লানি বা ব্যথার কোনো চিহ্ন নেই তার চেহারায়। সে নির্ভীক। সিংহের মতো বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে মনে প্ৰচণ্ড ঘৃণা। 

ভীমই প্রথমে বাক্যযুদ্ধটা শুরু করল। ভীমের মুখ থেকে অবিরাম, স্রোতের মতো গালাগালি বেরিয়ে আসতে লাগল। গালাগালের মাঝখানে মাঝখানে দোষারোপ। দুর্যোধনের অকীর্তি, তার অপরাধের কথাগুলো বহুক্ষণ ধরে বলে গেল ভীম। 

অদ্ভুত অজানা এক কারণে দুর্যোধন আজ নিরুত্তর। সেও গালাগাল দিতে জানে, দূষিত ভাষায় পাণ্ডবদের অন্যায়-শঠতা-প্রতারণার কথা বলতে জানে। কিন্তু আজ সেদিকে গেল না সে। স্থির দৃষ্টিতে ভীমের দিকে তাকিয়ে থাকল। হয়তো মনে মনে এই সময়টাতে যুদ্ধকৌশল ঠিক করে নিল দুর্যোধন। 

গালি-ভর্ৎসনা শেষ করে দু-কদম এগিয়ে এলো ভীম। দুর্যোধন ভীমের চোখে চোখ রেখে তিন পা এগোল। দর্শকদের মনে হলো- পরস্পরকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য রাম এবং রাবণ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। দু-জনেই মত্ত হস্তীর মতো। দুজনেরই রক্তবর্ণ চোখ। মনে প্রবলপ্রতাপী ঘৃণা। 

তড়িদ্বেগে দুজনেই গদা হাতে তুলে নিল। দুজনেই একই সঙ্গে গদা ঘুরিয়ে বাতাসে ঘূর্ণি তুলল। দুজনেরই চেহারা পর্বতপ্রায়। ওদের চেহারা থেকে মানুষী আভা উবে গেছে। সেখানে এখন পাশবিকতা। 

মহাবিক্রমে উভয়ে গদাযুদ্ধে লিপ্ত হলো। 

বজ্রপাতের মতো গদাঘর্ষণের ভয়ংকর শব্দ হতে লাগল। গদাঘাতে দুজনেই রক্তাপ্লুত হতে থাকল। দুর্যোধনকে দেখে মনে হচ্ছে না, সে গত দুদিন ধরে অভুক্ত; বোঝা যাচ্ছে না, দীর্ঘ দীর্ঘ বন্ধুর পথ সে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করে এসেছে; বোঝা যাচ্ছে না, বিগত আঠারো দিনের যুদ্ধে সে নিরানব্বইজন ভাইকে হারিয়েছে; বোঝা যাচ্ছে না, গতকাল গোটাদিন কুরুক্ষেত্রে মরণপণ যুদ্ধ করতে করতে রক্তাক্ত হয়েছে। এ যেন এক মহাতেজা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা! বিপুল বিক্রমে সে ভীমকে গদাঘাত করে যেতে লাগল। 

ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে ভীম নেতিয়ে পড়ছে। অমনিতে দর্শক সারি থেকে উৎসাহ ধ্বনি উঠছে। ভীম সতেজে আবার যুদ্ধমগ্ন হচ্ছে। 

উভয়ে একে অপরকে হত্যা করবার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগল। দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বীর আঘাত থেকে বাঁচবার জন্য কৌশল খুঁজে ফিরতে লাগল। দুই প্রতিস্পর্ধীর গদাযুদ্ধ তুমুল আকার ধারণ করল। গদাযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকল। দুর্যোধনের গদাঘাতে ভীম মূর্ছিত হয়ে পড়ল তো ভীমের গদাঘাতে দুর্যোধন মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। যুদ্ধ এমন দাঁড়াল যে কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান। 

দর্শকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। এই দ্বৈরথ শেষ হবে কবে? আদৌ শেষ হবে কি? দুজনেই রক্তাক্ত। দুজনেই আহত। কিন্তু যুদ্ধে হতোদ্যম নয় একজনও। তবে ভীম যুদ্ধ করছে বটে, আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে সে-ই বেশি। গদায় ভীম থেকে দুর্যোধন এগিয়ে। 

অর্জুন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। পাশে বসা কৃষ্ণকে ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ভীম ও দুর্যোধনের মধ্যে কার ক্ষমতা বেশি? গদায় কে অধিক দক্ষ?’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘দুজনেই দাদা বলরামের শিষ্য। গুরুর কাছ থেকে দুজনেই একরকম উপদেশ পেয়েছে। দুজনে দুভাবে সেই উপদেশ নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ করেছে। গদাযুদ্ধে ভীম শারীরিক শক্তিকে প্রাধান্য দেয় আর দুর্যোধন দেয় গদাপ্রয়োগ কুশলতাকে। যুদ্ধজয়ে শারীরিক শক্তির চেয়ে অস্ত্রকুশলতার মূল্য বেশি। কুশলী যোদ্ধা প্রতিপক্ষের চরম প্রহার এড়াতে জানে।’ অত্যন্ত চাপা কণ্ঠে, দাদা বলরাম শুনতে না-পায় মতো করে বলে গেল কৃষ্ণ। 

‘তা হলে!’ শঙ্কিত কণ্ঠে বলল অর্জুন। 

এবার গলা একেবারে খাদে নামাল কৃষ্ণ, ‘দুর্যোধন ভীমের চেয়ে পরাক্রমশালী। ন্যায়যুদ্ধে ভীম কখনো দুর্যোধনকে পরাস্ত করতে পারবে না।’ 

‘তা হলে উপায়!’ কর্ণ নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। 

কৃষ্ণ বলল, ‘ভীম কোনোদিন দুর্যোধনের সঙ্গে পেরে উঠবে না। পেরে উঠতে চাইলে অন্যায় করতে হবে।’ 

‘তুমি আর আমার উৎকণ্ঠা বাড়িয়ো না দাদা। কার্যসিদ্ধির পথ দেখাও। পাণ্ডবদের রক্ষা করো।’ অর্জুনের কণ্ঠস্বর বলরাম পর্যন্ত পৌঁছে গেল। 

বলরাম চকিতে অর্জুনের দিকে ফিরে তাকালেন। তাকানোর ভাষায় বোঝা গেল, অর্জুনের কথাগুলো স্পষ্ট করে শুনতে পাননি তিনি। উদ্বেগাকুল কণ্ঠস্বরই শুনেছেন। বলরাম আবার যুদ্ধে মগ্ন হলেন। 

কৃষ্ণ এবার স্পষ্ট অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘ভীমকে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে দুর্যোধনকে হত্যা করতে হবে। দুর্যোধনকে আজ যেভাবেই হোক, বধ করতেই হবে। ও বেঁচে থাকলে তোমাদের মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে। পরাজিত শত্রু ফিরে এলে তাকে জয় করা সম্ভব নয়। তার হারাবার কিছু থাকে না তখন। মৃত্যু নিশ্চিত ধরে নিয়ে যুদ্ধে নামে সে। দুর্যোধন আহত সিংহ। এই যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সে। গত তেরো বছর ধরে ভীমকে মারার জন্য গদানুশীলন চালিয়ে গেছে দুর্যোধন। আবার বলছি, অন্যায় যুদ্ধ না করলে দুর্যোধনকে মারতে পারবে না ভীম।’ 

তারপর কৃষ্ণ আর অর্জুনের মাথা খুব কাছাকাছি এলো। দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ ফিসফিসানি হলো। অর্জুন সোজা হয়ে বসল। 

দুর্যোধন আর ভীম তখন পাগলের মতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। গত আঠারো দিনে কুরুক্ষেত্রে ভীমের সঙ্গে দুর্যোধনের প্রায়ই গদা যুদ্ধ হয়েছে। বরাবরই দুর্যোধন হেরেছে। কিন্তু আজকের যুদ্ধে দুর্যোধনের কাছে ভীম পরাভূতপ্রায়। গদাঘাতে দিশেহারা সে। এই বুঝি পরাজিত হলো! করুণ চোখে সে একবার অর্জুনের দিকে তাকাল। 

এই সময় অর্জুন নিজের বাম ঊরুতে বাম হাত দিয়ে আঘাত করতে শুরু করল। যুদ্ধ করতে করতে আরেকবার অর্জুনের দিকে ফিরল ভীম। তখনো একই দৃশ্য দেখল। ত্বরিত অর্জুনের সংকেত বুঝে গেল ভীম। 

পরের ঘটনা মর্মান্তিক। অন্যায্য। দুষ্কর্মে পূর্ণ। কলুষযুক্ত। এবং পশুসুলভ। 

অর্জুনের ইঙ্গিতটা দুর্যোধনও বুঝে ফেলেছিল। তাই আচমকা সে ভীমের গদাবৃত্ত থেকে দূরে সরে গেল। কিন্তু ক্রোধ তাকে দূরে থাকতে দিল না। 

দুর্যোধনকে দূরে সরে যেতে দেখে ভীষণ গালাগাল দিয়ে উঠল ভীম। ক্রোধান্বিত দুর্যোধন আগুপিছু না ভেবে ওপর দিকে লাফ দিয়ে গদাহাতে ভীমের মাথার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। এই সুযোগটার জন্য অপেক্ষা করে ছিল ভীম। দুর্যোধনের দুই ঊরু লক্ষ করে ভীম সবেগে গদার বাড়ি হাঁকাল। দুর্যোধন হুড়মুড় করে ভূমিতে ভেঙে পড়ল। 

সবাই নিষ্পলক স্তব্ধ চোখে দেখল— সসাগরা ভারতবর্ষের নায়ক দুর্যোধন আর কোমর তুলতে পারছে না। পা তার নিথর, নির্জীব। স্থাণুর মতো মাটিতে পড়ে আছে দুর্যোধন। সর্বাঙ্গ ধুলায় ধূসর যন্ত্রণায় কাতর। কিন্তু কাতরতার কোনো চিহ্ন তার চোখেমুখে দেখা গেল না। তার চোখে তখন অপার বিস্ময়। তার মুখে তখন প্রবল ঘৃণা। এই ঘৃণা কৃষ্ণের জন্য, অর্জুনের জন্য। সর্বোপরি ভীমের জন্য। দুর্নীতি দিয়ে যে-যুদ্ধ শুরু করেছিল যুধিষ্ঠির, অন্যায় দিয়ে সেই যুদ্ধ শেষ করল ভীম। 

হঠাৎ বলরামের বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল, ‘এটা চরম অন্যায়! মস্তবড় অপরাধ এটি! এ রকম জঘন্য জুলুম করল ভীম, দুর্যোধনের ওপর! নাভির নিচে আঘাত করা তো গদাযুদ্ধের নিয়ম নয়! ভীম নিয়ম না মেনে প্রিয়বৎস দুর্যোধনকে আহত করল! এ বড় অন্যায়, মস্তবড় অন্যায়!’ বলতে বলতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন বলরাম। 

দ্রুত দাদার নিকটে এগিয়ে এলো কৃষ্ণ। 

কৃষ্ণকে দেখে তেড়ে উঠলেন বলরাম, ‘তুমিই করিয়েছ এটা। অর্জুনকে ঊরু থাপড়াতে দেখেছি আমি। এটা তোমার শিখিয়ে-দেওয়া কৌশল কৃষ্ণ। তুমি ছাড়া এ অধর্মের উদ্‌গাতা আর কেউ হতে পারে না।’ বলতে বলতে ভীমের দিকে সরোষে এগিয়ে গেলেন হলধর বলরাম। 

আটাশি 

বলরাম এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন যে, নিজের অমোঘ প্রাণঘাতী যুদ্ধাস্ত্র লাঙ্গল নিয়ে ভীমের দিকে ছুটে গেলেন। 

কৃষ্ণ অগ্রজ বলরামকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। সে বুঝে গিয়েছিল, দাদাকে না আটকালে ভীমের আজ শেষদিন। একবার হাতে, একবার পায়ে ধরে কৃষ্ণ বলরামকে শান্ত করবার চেষ্টা করে যেতে লাগল। 

বলরামকে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। হৃদয়বিদারী হাহাকার তাঁর কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসছে। তাঁর শরীর ঘামে ভিজে গেছে। ক্রোধে চোখে আঁধার আঁধার ঠেকছে তাঁর। একধরনের কাতরধ্বনি বেরিয়ে আসছে বলরামের কণ্ঠ থেকে। যেন নিজেরই ঊরুতে লেগেছে ভীমের গদার বাড়ি। ওখানে দাঁড়িয়েই বলরাম বজ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ছিঃ ভীম! ছিঃ ছিঃ! শত ধিক্কার তোমাকে! তোমার গদাবিদ্যা অর্থহীন। তোমার শিক্ষা অর্থহীন। তুমি দায়িত্বহীন। তুমি দুর্নীতিগ্রস্ত। তোমাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি…।’ 

চট করে দাদার মুখ চেপে ধরল কৃষ্ণ। কাতর কণ্ঠে বলল, ‘দাদা! দাদা!’ 

বাঁ হাত দিয়ে নিজের মুখ থেকে সজোরে কৃষ্ণের হাতখানা সরিয়ে দিলেন বলরাম। ক্রোধোম্মত্ত গলায় বললেন, ‘অভিশাপ দিচ্ছি—যতদিন এই পৃথিবীতে মানুষ থাকবে, ততদিন আজকের এই অন্যায় যুদ্ধের জন্য তোমাকে ধিক্কার দিয়ে যাবে।’ 

তারপর তিনি উপস্থিত সবার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। পীড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘ভীম যেভাবে দুর্যোধনের নাভির নিচে ঊরুতে গদাপ্রহার করল, যুদ্ধের নীতিতে এটা চরম অন্যায়। কোনো যোদ্ধা কোনোদিন এ রকম অন্যায় করেনি। এই মূর্খ নিয়মের কোনো ধার ধারে না। যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে সে মহাবীর দুর্যোধনকে আঘাত করেছে, ধূলিতে নামিয়েছে! আর আপনারা, দেশবিদেশের মহা মহা যোদ্ধারা ওই দর্শকসারিতে বসে আছেন, কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেন না? আপনাদের মনুষ্যত্বকে নিন্দা জানাচ্ছি আমি।’ 

একঝটকায় কৃষ্ণের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন বলরাম। মাথা নিচু করে নিজের রথের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রিয়শিষ্য দুর্যোধনের কাছে গেলেন না তিনি। গেলে হয়তো কান্নাকে ধরে রাখতে পারবেন না। 

বলরামের ছিঃ ছিঃ ধিক্কারে ভীমের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো বলে মনে হলো না। সে নির্বিকার। 

বলরামের রথ চোখের আড়ালে চলে গেলে সেদিকে তাকিয়ে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করল ভীম। তারপর রাগী পায়ে দুর্যোধনের দিকে এগিয়ে গেল। উপস্থিতদের মধ্যে কেউই বুঝতে পারছে না, কেন ভীম আবার দুর্যোধনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? দুর্যোধনের পতন তো হয়ে গেছে! অন্যায় সমরে তাকে তো ধুলোয় টেনে নামানো হয়েছে! এখন দুর্যোধন তো চলৎশক্তিহীন! মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তার তো অন্য কোনো উপায় নেই এখন! মৃত্যু তো দুর্যোধনের অবশ্যম্ভাবী! তা হলে? এসব কিছু জেনেও কেন ভীম দুর্যোধনের দিকে পুনরায় এগিয়ে যাচ্ছে? অবাক বিস্ময়ে বিমূঢ় চোখে উপস্থিতরা ভীমের দিকে তাকিয়ে থাকল। কী ঘটবে? কী ঘটতে যাচ্ছে তার পর? 

ভীম দুর্যোধনের নিকটে গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘বর্বর ছোটলোক তুই। গান্ধারীর দূষিত গর্ভে জন্ম তোর। তুই কুরুবংশের কলঙ্ক। ক্ষত্রিয়ের মুখে কালি দিয়েছিস তুই।’ 

জোরে একটা শ্বাস টেনে কদর্য কণ্ঠে ভীম আবার বলতে শুরু করল, ‘তুই সেদিন একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে রাজসভায় টেনে আনিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার হাসি হেসেছিলি আর আমাদের লক্ষ করে উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠেছিলি —গরু গরু। সেই গরু বলার ফল, দ্রৌপদীকে লাঞ্ছিত করার ফল তোকে দিতে এসেছি আমি।’ 

অকস্মাৎ ভীম তার বাম পা-টি দুর্যোধনের প্রশস্ত কপালের ওপর তুলে দিল। দুর্যোধন তখনো জীবিত। পায়ের ভারে দুর্যোধনের মাথাটি কেঁপে কেঁপে উঠল। চারদিক থেকে মর্মযাতনার ধ্বনি উঠল। সবারই চোখে জিজ্ঞাসা- এ কী? এ তো এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড! হায় হায়! গদাধর ভীম কি জানোয়ার হয়ে গেল? সে কি উন্মাদ? কাণ্ডজ্ঞানহীন? বর্বর? তার মনুষ্যত্ব কোথায় মুখ লুকাল? 

যারা পাণ্ডবদের হয়ে বিগত আঠারো দিন প্রাণবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে, পাণ্ডবদের জয়ই যাদের একান্ত কাম্য ছিল, গদাযুদ্ধে সমবেত পাণ্ডবপক্ষের সেই বীর-মহাবীর এবং সাধারণ পদাতিকদের মুখ দিয়ে এসব কথা বেরিয়ে আসতে লাগল। 

ভীম বৃত্তমধ্যে দাঁড়িয়ে সব শুনতে পেল। কিন্তু তার মধ্যে কোনো বিকার দেখা গেল না। বাম পায়ের চাপে দুর্যোধনের মাথাটি মাটিতে দেবে দিল। তারপর পাষণ্ড নির্মমতায় দুর্যোধনের মস্তকটি সেই বাম পা দিয়ে ঘষে পিষে দিতে লাগল ভীম। রাজসিংহ দুর্যোধনের মস্তকটি ভীমের বর্বর পায়ের তলায় লাঞ্ছিত হতে থাকল। 

পায়ের তলায় দুর্যোধনের মাথাটি দলিত মথিত করতে করতে ভীম চিৎকার করে বলতে থাকল, ‘যারা এখানে আছ তারা দেখ, যারা নেই তারা শোনো— ধৃতরাষ্ট্রের এই পাপিষ্ঠপুত্র দুর্যোধন একদিন আমাদের হিজড়ে বলে ডেকেছিল, আজ দেখ তোমরা তার কী হাল করছি আমি।’ বলে পা দিয়ে আরও জোরে জোরে দুর্যোধনের মাথাটি ঘষতে লাগল। 

ভীমের এই জঘন্য আচরণ ধৃষ্টদ্যুম্নের ভালো লাগল না। লজ্জায় ঘৃণায় সে কেঁপে উঠল। দাঁড়িয়ে সে হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘থামান বৃকোদর, আপনার এ বর্বরতা থামান। বহু হয়েছে। মানুষের কাছে পাণ্ডবদের আর ছোট করবেন না। দুনিয়ার লোক দুর্যোধনকে মহারাজার মতো সম্মান করেছে। সকলে তার প্রতাপ দেখেছে। হস্তিনাপুরের সকল প্রজা মহারাজ দুর্যোধনকে ভালোবাসত। সেই সম্মানিত দুর্যোধনকে আপনি আর বর্বরের মতো পীড়ন করবেন না।’ 

ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা শুনে লজ্জায় যুধিষ্ঠিরের মাথা নুইয়ে এলো। জলদমন্ত্র কণ্ঠে যুধিষ্ঠির ধিক্কার দিল, ‘থামো তুমি ভীম। অপকর্ম থেকে বিরত হও। দুর্যোধনের ওপর আমাদের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে। সে জীবিত। কিন্তু চলার শক্তি হারিয়েছে সে। দুর্যোধন এখন সহায়হীন, নির্বান্ধব। একজন অসহায় মানুষকে এভাবে নির্যাতন করো না। জয়ের পর দুর্যোধনের সঙ্গে এখন তুমি যা করছ, সেটা বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়।’ 

যুধিষ্ঠিরের তীব্র তীক্ষ্ণ তির্যক কথা শুনে দুর্যোধনের মাথা থেকে ভীম পা সরিয়ে নিল। 

যুধিষ্ঠির তখনো বলে যাচ্ছে, ‘দুর্যোধন তুমি রাগ করো না, তুমি কষ্ট পেয়ো না।’ 

এই সময় কৃষ্ণ উচ্চৈঃস্বরে ভীমের উদ্দেশে বলল, ‘ভীম, আমি তোমার প্রশংসা না করে পারছি না। তোমার বীরত্বে আজ ওই কুলাঙ্গার দুর্যোধনের ভাইয়েরা যমালয়ে গেছে। যে দুর্যোধন নিজেকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বলে মনে করত, যে নিজেকে মনে করত সমস্ত পৃথিবীর সবচাইতে মর্যাদাবান রাজা, আজ তুমি ভীম সেই উন্নত মর্যাদাবান মাথাটি নিজের পাদুকা দিয়ে মাড়িয়ে দিলে! এ যে কতবড় কীর্তি, তা বলে শেষ করা যাবে না বৃকোদর।’ 

কৃষ্ণের কথাগুলো দুর্যোধন পর্যন্ত এসে পৌঁছাল। দুর্যোধন মারা যায়নি। ভীমের পায়ের পেষণে যন্ত্রণায় অপমানে কাতরাচ্ছিল। কৃষ্ণের কথায় মাথাটা একটু আলগা করল দুর্যোধন। দু-হাতে মাটি আঁকড়ে শরীরটাকে খানিকটা উঁচুতে তুলল। 

তারপর নির্ভীক বীরের কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কুরুদের এই যে পতন, আমার এই যে অপমান, সব তো তোমার কারণেই কৃষ্ণ! তুমিই তো যুদ্ধটা বাধালে! বহিরাগত পিতৃপরিচয়হীন পাণ্ডবদের নিয়ে এদেশ থেকে তুমি ক্ষত্রিয়শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছ। তোমার কূটচালে আজ হস্তিনাপুরে বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যশাসন প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে।’ 

এবার কণ্ঠকে ঘৃণায় চুবিয়ে দুর্যোধন আবার বলল, ‘তুই ওই অর্জুনকে শিখিয়ে দিলি, অর্জুন বাম ঊরুতে চাপড় মেরে ইঙ্গিত করল। ইঙ্গিত পেয়ে ওই মূর্খটা অন্যায়ভাবে আমার দুই ঊরু ভেঙে দিল। তোর কুটবুদ্ধিতে আমার পক্ষের মহাবীররা মারা গেছেন। শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুনকে দিয়ে পিতামহকে হত্যা করালি। অশ্বত্থামা নামে একটা হাতি মেরে যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করালি। ঘটোৎকচকে লেলিয়ে দিয়ে কর্ণের একাঘ্নী বাণটি খরচ করানোয় তো তোরই বুদ্ধি ছিল কৃষ্ণ। আর কর্ণ, কর্ণকে তো হত্যা করালি তুই-ই। মাটিতে আটকে গেল তার রথটি। ওই অবস্থায় অর্জুন নামের ওই বশংবদটাকে দিয়ে কর্ণকে হত্যা করালি তুই। তুই নিজেকে দেবতা বলে প্রচার করা শুরু করেছিস। তুই কি দেবতা? তুই কি মানুষ? যদি দেবতা হতিস, নিদেনপক্ষে মানুষও হতিস যদি, তা হলে এ রকম অন্যায় কাজগুলো কিছুতেই করতিস না তুই। আজ পাণ্ডব এবং পাণ্ডবদের পদলেহীদের কাছে তুই দেবতা হিসেবে গণ্য হচ্ছিস। কিন্তু শুনে রাখ কৃষ্ণ, এমন একদিন আসবে, কুরুক্ষেত্রের তুই কৃষ্ণের কথা মনে এলে পৃথিবীর মানুষরা তোকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই করবে না।’ 

কৃষ্ণ কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমার দোষেই তুমি আজ লাঞ্ছিত হলে দুর্যোধন। তুমি রাজ্যলোভী বলে তোমার আত্মীয়স্বজন, ভাই, বন্ধু সবাই নিহত হলো।’ 

দুর্যোধনের এখনকার কথায় কোনো ক্রোধ নেই, নেই কোনো ঘৃণা-তাচ্ছিল্য। আত্মতৃপ্তিতে ভরা অদ্ভুত এক মায়াময় কণ্ঠস্বর দুর্যোধনের গলা থেকে বেরিয়ে এলো, ‘বিধিমতো বেদ এবং অন্যান্য শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি আমি। দানধ্যানও করেছি প্রচুর। শত্রুকে দমন করে সসাগরা পৃথিবী শাসন করেছি। প্রজারা আমার প্রশংসা করত। আমি চুটিয়ে রাজৈশ্বর্য ভোগ করেছি। আমার মতো ভাগ্যবান এই পৃথিবীতে কে আছে বলো কৃষ্ণ। আর হ্যাঁ কৃষ্ণ, আমার আত্মীয়স্বজনের মারা যাওয়ার কথা বললে না তুমি? সেই আত্মীয়দের নিয়ে আমি ক্ষত্রিয়দের প্রাপ্য জায়গায় যাচ্ছি। আর তোমরা সারাজীবন ধরে পোড়ামাটির শূন্য পৃথিবী ভোগ করো।’ বলে চুপ করে গেল দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের কথা শুনে কৃষ্ণের মুখের কথা ফুরিয়ে গেল। 

দুর্যোধনের কথায় অন্য কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সবাই নিজ নিজ বাহনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। শিগগির হস্তিনাপুর পৌঁছাতে হবে তাদের। সেখানে বিজয়োৎসব অপেক্ষা করে আছে। 

.

সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলো। 

আজ অমাবস্যা। 

অন্ধকারের মধ্যে রুধিরাক্ত মহাবীর দুর্যোধন আলোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। 

দুর্যোধন জানে না– আগামীকালের প্রভাতসূর্য তার দেহে আলোকণা ছড়িয়ে দেবে, নাকি রাতের নিবিড় তমসায় মৃত্যু তার নিষ্ঠুর দুটি হাত দুর্যোধনের দিকে বাড়িয়ে দেবে। 

পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে দুর্যোধনের যুদ্ধ আজ শেষ হলো।

কিন্তু দেশমাতৃকার জন্য মানুষের যুদ্ধ চলতে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *