চল্লিশ
কোনো কালে পৃথিবীর কোনো দেশে ক্ষমতাসীন রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করার চক্রান্ত হলে সেই রাজা চক্রান্তকারীদের বুকে জড়িয়ে আদর করে না।
ষড়যন্ত্রকারীদের সযত্ন-সম্ভাষণ জানানোর কোনো উদাহরণ ভূ-ভারতের কোথাও নেই। কোনো শাস্ত্রগ্রন্থ এটা সমর্থন করে না। উপরন্তু ধর্মগ্রন্থগুলোতে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—আত্মরক্ষার জন্য শত্রুনিধন শ্রেয়। পৃথিবীর নিয়মই এই——নিজে বাঁচো, শত্রুকে ধ্বংস করো। বেদ-বেদান্তে, রামায়ণে, তাবড় তাবড় অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে—শত্রু যত বড় আত্মীয়ই হোক না কেন, তাকে হত্যা করো।
এই যখন পৃথিবীর নিয়ম, শাস্ত্রগ্রন্থের বাণী, তখন পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে যারা, তাদের ধ্বংস চাইবে না কেন দুর্যোধন? তার চোখের সামনেই পিতার বিরোধিতা করছে একটা দল, সেই দলের বিনাশ না করে নিষ্ক্রিয় থাকবে সে? একজন পুত্রের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব? প্রতিবাদ না করা উচিত? শুধু তো পিতা ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষমতাচ্যুতি নয়, তাদের শত ভাই, মা গান্ধারী, অন্যান্য আত্মীয়স্বজন—সবারই তো ধ্বংস লুকিয়ে আছে বিদুর-পাণ্ডবদের এই চক্রান্তের মধ্যে!
তাই দুর্যোধন পিতাকে ক্ষমতাসীন রাখার জন্য, নিজেদের রক্ষা করার জন্য শঠের সঙ্গে শঠতা শুরু করেছে। ওই যে শাস্ত্রে আছে——শত্রুকে বিনাশ করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখ। শাস্ত্রবাক্য মেনেই দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। নাহ, এতে কোনো বিচলিতবোধ করছে না সে। কোনোরূপ লজ্জা বা অনুতাপে অস্থির হতে দেখা যাচ্ছে না তাকে। বরং শত্রুপক্ষকে করুণ একটা পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প করেছে দুর্যোধন।
জতুগৃহে পাণ্ডবদের গুপ্তভাবে হত্যা করার যে পরিকল্পনা দুর্যোধন পুরোচনকে নিয়ে করল, তার পেছনে রাজনৈতিক ঘটনাবর্ত ছিল। বিদুর-চক্রের ষড়যন্ত্রটা ছিল স্পষ্ট রাজদ্রোহ। একটা সময়ে চক্রান্তকারীদল প্রকাশ্য দিবালোকে এসে দাঁড়িয়েছে। ধৃতরাষ্ট্রবিরোধী প্রচারে মুখর হয়েছে। সেই সময়কার ব্রাহ্মণসমাজ এই অপপ্রচারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ধৃতরাষ্ট্র ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিল না। অন্যান্য সাধারণ প্রজাদের মতোই আচরণ করত পরান্নভোজী এই জনগোষ্ঠীটির সঙ্গে। বিশেষ কোনো সুবিধা ব্রাহ্মণরা ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে পেত না।
কিন্তু যুধিষ্ঠির যুবরাজ হয়ে ব্রাহ্মণদের দিকে বিশেষ নজর দিল। বিদুরের প্ররোচনাতেই দিল। এই ব্রাহ্মণসমাজকে একটা সময়ে প্রয়োজনে ব্যবহার করবে-এটাই ছিল বিদুরের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যুবরাজ হওয়ার পর নিজের ক্ষমতাবলে ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি এবং গোধন দান করা শুরু করেছিল যুধিষ্ঠির। রাজকোষ থেকে তাদের জন্য নিয়মিত মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিল। সাধারণ প্রজা থেকে সংগৃহীত কর ব্রাহ্মণ্যসেবায় অকৃপণ হস্তে খরচ করতে লাগল। ফলে ব্রাহ্মণরা যুধিষ্ঠিরের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। এই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হলো বিদুরের উসকানি। ব্রাহ্মণগোষ্ঠীকে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে এবং ধৃতরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রচারে ব্যবহার করল বিদুর-যুধিষ্ঠিররা। প্ররোচিত ব্রাহ্মণগোষ্ঠীটির মুখ দিয়ে হাটেবাজারে-গ্রামেগঞ্জে, রাজপথে, দেবালয়ে, তীর্থক্ষেত্রে, উৎসবে-মেলায় কৌরবদের বিপক্ষে প্রচারণা চালাতে আরম্ভ করল বিদুর-চক্র। বিদুর জানে—প্রচারণার মাধ্যমে জনমত সংগঠন করা অতি সহজ। ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হয়ে গেলে পাণ্ডবদের আর অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে না। জনগণই রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে পথের ধুলায় নামিয়ে আনবে।
ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধন এই চক্রান্তের কথা যখন বুঝতে পারল, তাৎক্ষণিকভাবে ওদের কিছুই করার থাকল না। না পারল বিদুরের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে, না পারল ব্রাহ্মণদের গায়ে আঁচড় কাটতে। বিদুরের ক্ষতি হোক, এমন সিদ্ধান্ত নিতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের পূর্বাপর অনীহা ছিল। হাজার হলেও একই পিতার সন্তান বিদুর-বলত মহারাজ। কিন্তু ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিল না কেন দুর্যোধন?
দুর্যোধন স্পষ্ট জানত, পরান্নভোজী পরগাছা শ্রেণির এই জনগোষ্ঠীটির প্রতি সাধারণ জনগণের গভীর শ্রদ্ধা আছে। কারণ তারা যে পুজো-অর্চনা করে! ওদের ছাড়া কোনো ধর্মানুষ্ঠান সম্পন্ন করা সম্ভব নয়! ওরা যে এই মর্ত্যে ঈশ্বরের দূত! তাই ওদের গায়ে সরাসরি হাত দিলে, ধর্মের অবমাননা ধরে নিয়ে প্রজাবিদ্রোহ ঘটে যাবে! সবকিছু জেনে-বুঝে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কোনো অশুভ পদক্ষেপ নেয়নি দুর্যোধন। তবে বিচক্ষণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
পাণ্ডবরা যখন বারণাবতে যাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত, বিদুর যখন তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় মগ্ন, ঠিক সেই সময় দুর্যোধন ব্রাহ্মণসমাজপতিদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হলো। এই সমাজপতিদের কিনে নিয়েছে বিদুর। এদের উসকানিতে সাধারণ বামুনরা কুরুবিরোধী প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। এই প্রচারণা ক্রমশ প্রকাশ্য বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করছিল। দুর্যোধন বুঝে গিয়েছিল, ব্রাহ্মণসমাজপতিদের মুখ বন্ধ করতে পারলেই ধৃতরাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণায় ভাটা পড়বে। কিন্তু কী প্রকারে ওদের বশে আনবে দুর্যোধন? দুর্যোধনের ভালো করেই জানা যে, গোটা ব্ৰাহ্মণ জাতটাই ধনাঢ্যদের কৃপার ওপর বেঁচে আছে। ওরা একধরনের ভিক্ষুক সম্প্রদায়। যার কাছ থেকে পাবে, তারই গুণগানে মুখরিত হবে। যেমন যুধিষ্ঠির-বিদুরের কাছ থেকে জমিজিরাত, ধনসম্পদ, গোধন পেয়েছে, তাদেরই গুণকীর্তনে মুখর হয়েছে। একের ওপরে যেমন দুই আছে, চন্দ্রের ওপরে যেমন সূর্য আছে, তেমনি বিদুর-যুধিষ্ঠিরের ওপরে দুর্যোধন আছে। বিদুর শত দিলে, সহস্র দেওয়ার ক্ষমতা রাখে দুর্যোধন। সে যে রাজার পুত্র! রাজকোষ যে তার সামনে উন্মুক্ত! সেই সমাজপতিদের অগাধ ধনসম্পত্তির লোভ দেখাল দুর্যোধন। জমি-গোধন বিতরণও শুরু করল সে। তার দানের হাত অবারিত থাকল। সাধারণ মানের বামুনরা পর্যন্ত দুর্যোধনের দানে ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠতে লাগল।
রাতারাতি সুর পালটে গেল ব্রাহ্মণসমাজের। যুধিষ্ঠিরের গুণগান ছেড়ে মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল ওরা। কুরুবিরোধী হাওয়া ঘুরে পাণ্ডববিরোধী হয়ে গেল। পরশ্রমভোগী সম্প্রদায় হওয়ায় রুজিরোজগারের জন্য রাজ্যের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত ব্রাহ্মণরা। অবাধ বিচরণশীল ব্রাহ্মণরা দেশের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের অনুকূলে প্রচারণা চালাতে লাগল।
উৎকোচপ্রবণ ব্রাহ্মণবাহিনী দুর্যোধনের কাজ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে এমনভাবে প্রচারণা শুরু করল যে, বিদুর-যুধিষ্ঠির সমর্থকদের সংখ্যা দ্রুত কমে এলো। ব্রাহ্মণ অনুগামী পুরবাসীরা সভামণ্ডপের চত্বরে, ধর্মীয় সভাসমিতিতে, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে পাণ্ডববিরোধী এমন প্রচারকার্য চালাল, যা অতি শিগগির বিদুরের কানে এসে পৌঁছল। বিদুর প্রমাদ গুনল। বুঝল, যেকোনো সময় দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরাট কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো মূল্যে পাণ্ডবদের বাঁচাতে হবে—ভাবল বিদুর। যে বারণাবতে যাওয়াটা বিদুরের কাছে কাল বলে মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে—যত তাড়াতাড়ি পাণ্ডবরা হস্তিনাপুর ত্যাগ করবে, ততই তাদের মঙ্গল হবে। পাণ্ডবদের বারণাবতে যাওয়ার এবং সেখানে নিরাপদে থাকার সমস্ত নকশা অতি দ্রুত তৈরি করে ফেলল বিদুর।
এক শুভসকালে চার ভাই এবং মা কুন্তীকে নিয়ে যুধিষ্ঠির রথে চড়ল। তাদের গন্তব্য বারণাবত। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অনুমতি নিতে গেলে যুধিষ্ঠিরকে বুকে জড়িয়ে ধরল মহারাজ। মস্তকের সুঘ্রাণ নিল। যুধিষ্ঠিরের দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মহারাজা বলল, ‘ভ্রমণশেষে ফিরে এসো বৎস। তোমার অপেক্ষায় থাকব আমি।’
বিদুর যুধিষ্ঠিরের রথ পর্যন্ত এসেছিল। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুপুত্রদের অনুগমন করে রথ পর্যন্ত আসতে চাইলে বিদুর বলেছিল, ‘মহারাজ আপনার হয়ে আমি যাচ্ছি রথ পর্যন্ত। আপনার আর কষ্ট করার দরকার নেই। আপনার স্নেহ আমি বৌঠান আর পাণ্ডবদের পৌঁছে দেব।’
ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলবার সময় লোকচক্ষুর আড়ালে যুধিষ্ঠিরের হাতে একটি দুমড়ানো কাগজ গুঁজে দিল বিদুর। সেই কাগজে ভবিষ্যতের মানচিত্র স্পষ্টভাবে অঙ্কিত ছিল।
রথ ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে অন্যের অবোধ্য মেচ্ছ ভাষায় বিদুর যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে বলল, ‘এ যাত্রা তোমাদের জন্য শুভ নয়। হয়তো মৃত্যু অনিবার্য। বুদ্ধি দিয়ে চলবে, হৃদয় দিয়ে নয়। তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব আমি। আমার নির্দেশনা অনুসরণ করো।’
একচল্লিশ
পাণ্ডুপুত্রদের সঙ্গে পুরোচনও রওনা দিয়েছিল বারণাবতের উদ্দেশে। সপরিবারে। কুন্তী এবং পাণ্ডবরা চড়েছিল বায়ুবেগগামী রথে আর পুরোচন আরোহণ করেছিল দ্রুতগামী অশ্বচালিত শকটে। সামান্য আগু-পিছু সময়ে সবাই বারণাবত নগরে উপস্থিত হয়েছিল।
পাণ্ডবরা বারণাবতে উপস্থিত হয়ে দেখল—এ প্রকৃতই একটি জনাকীর্ণ মনোরম নগরী। বৃক্ষবহুল, অরণ্যশোভিত। মাঝে মাঝে টিলাময়। টিলার চূড়ায় গায়ে নানা ফল-ফুলের গাছগাছালি। দেখে কুন্তীর মনটা আপনাতেই নেচে উঠল। আহা! কী মনোহারী দৃশ্য! ফেলে আসা অরণ্যজীবনের কথা মনে পড়ে গেল কুন্তীর। পাণ্ডুসঙ্গ, ঝিরঝির ঝরনা, নানা পাখির সুমধুর কলকাকলি, বিভিন্ন বনজকুসুম, দলবদ্ধ হরিণ-হরিণী—এসবের স্মৃতি ব্যাকুল করে তুলল কুন্তীকে।
রথ থেকে নেমে বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে ছুটে গেল কুন্তী। বৃক্ষতলটি ফুলে ফুলে ঢাকা। বর্তমানকে ভুলে বিছানো ছড়ানো সেই ফুলের গায়ে হাত বুলাতে লাগল কুন্তী। একদিন রাশিরাশি এই কৃষ্ণচূড়াই তো তার আঁচল ভরে দিয়েছিল মহারাজ পাণ্ডু! তৃপ্তির দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস কুন্তীর বুক চিরে বেরিয়ে এলো। এতদিন হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে থাকতে থাকতে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিল। এই বারণাবত, এই প্রকৃতিকন্যা বারণাবত তাকে দমবন্ধ জীবন থেকে মুক্তি দিল যেন!
পাণ্ডুপুত্ররা দেখল—হস্তিনাপুরের মতো জৌলুস নেই বটে বারণাবতে, কিন্তু হস্তিনা-অধিক প্রাণ আছে। বারণাবত নগরজুড়ে মানুষের এই যে কলগুঞ্জন, তাতে আবেগের উপস্থিতি, আনন্দের উচ্ছ্বাস। সবাই যেন সবার জন্য, আবার প্রত্যেকে যেন নিজের জন্য। প্রত্যেকে বিমোহন সজ্জায় সজ্জিত। নারীদের খোঁপায় বনপুষ্প, গলায় গুঞ্জমালা, মুখে কেয়ারেণু। দেহাতিপোশাকে অপরূপ দেখাচ্ছে তাদের। যেন স্বর্গচ্যুত অপ্সরা প্রত্যেকে। পুরুষেরাও নারীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের সাজিয়েছে। অরণ্য বালকবালিকারা হরিণশিশুর মতো লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে শৈশবজীবন উপভোগ করছে। টিলার গা বেয়ে বেয়ে রাজপথ ওই সুদূরে হারিয়ে গেছে। অদূরের ভাগীরথীর কলধ্বনি শোনা না গেলেও জলরেখা দৃশ্যমান। এসব দেখে বড় ভালো লেগে গেল পাণ্ডুপুত্রদের।
ভীম তো অস্ফুট কণ্ঠে বলেই ফেলল, ‘আহা, কী মনোলোভা নারীরা! তাদের চলনে কী গভীর আন্দোলন!’
মধ্যমাগ্রজের কথা শুনে অর্জুন মুচকি হাসল। সেই হাসিতে ঈষৎ কৌতুক।
নকুল-সহদেব বালকের মতো আবেগাপ্লুত চোখে সব কিছু দেখে যেতে লাগল।
যুধিষ্ঠির অর্জুনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘কেমন লাগছে তোমার, অর্জুন?’
‘আমার ভালো লাগছে দাদা। দুর্যোধনের কূটচালে আর দুঃশাসন ভূরিবল-জয়ৎসেন- দুর্বিমোচনদের প্রচণ্ড চাপে হস্তিনাপুরে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। বারণাবতে আসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে তুমি আমাদের বাঁচালে দাদা। যতদিন এই অরণ্যনগরে থাকব, নিজেদের মতো করে থাকতে পারব।’ দাদার দিকে তাকিয়ে বলল অর্জুন।
গম্ভীর কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘সেই-ই ভালো। তোমরা আনন্দে থাকলে আমার তৃপ্তি।’
তারপর হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘ওই দেখ, পুরবাসীরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে নানা মাঙ্গলিক দ্রব্য। মুখে সাদর সম্ভাষণের ধ্বনি না?’
‘হ্যাঁ দাদা। আমাদের অভিবাদন জানাবার জন্যই বোধহয় তারা এগিয়ে আসছে!’
‘আর ওই যে পুরনরনারীর অগ্রভাগে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তিনি মাননীয় পুরোচনই তো?’
‘তিনি মাননীয় মন্ত্রী পুরোচনই। আমাদের সঙ্গেই তো এসেছিলেন তিনি! হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলেন! আপনাকে বলিনি, কিন্তু আমার মন উসখুস করছিল বড়। এখন বুঝছি, আমাদের স্বাগত জানানোর আয়োজন করতেই ব্যস্ত ছিলেন পুরোচন।’ অপরাধীর কণ্ঠে বলে গেল অর্জুন।
‘ঠিক আছে। এখন আমাদের সবাইকে রথ থেকে নেমে দাঁড়াতে হবে। ওদের সম্ভাষণের জবাব দিতে হবে।’ তারপর চাপা কণ্ঠে নকুলকে উদ্দেশ করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘নকুল, মাকে গাছতলা থেকে দ্রুত এখানে নিয়ে এসো। পুরবাসীরা প্রথমে মাকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবে।’
কিছুক্ষণ পরে, সেই কৃষ্ণচূড়াতলায়, পথপার্শ্বের সেই ঘাসে ঢাকা চত্বরে, আনন্দবাদ্য বেজে উঠল। নানা পোশাকের নানা বয়সি প্রজারা তাদের ঘিরে নাচতে শুরু করল। তারা কুরুরাজ্যের অধিবাসী বটে, কিন্তু কোনোদিন রাজবাড়ির লোকদের দেখেনি। আজ তাদের জীবন সার্থক। আজ তারা শুধু একজন রাজপুরুষকে দেখছে না, হস্তিনাপুরের যুবরাজকেও দেখছে। ইনিই তো মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের পর কুরুসিংহাসনে বসবেন! শুধু যুবরাজ যুধিষ্ঠির তো নন, যুবরাজমাতা কুন্তী দেবীও উপস্থিত আছেন আজ। কী সৌভাগ্য আমাদের– সমস্বরে বলে উঠল পুরবাসীরা। আরেক দল বলল—এতদিন এই দূরবর্তী প্রদেশে মহারাজ পাণ্ডুর পাঁচ পুত্রের কথা শুনে আসছিলাম আমরা। সেই শোনা ছিল আবছা আবছা। সত্য আর মিথ্যেয় মিলানো নানারকম গল্পকথা সেসব। অরণ্যে জন্ম নেওয়া সেই পুত্রদের চেহারা কী রকম হবে, দেহগঠনই-বা কেমন? তাঁরা গৌরবর্ণের না কৃষ্ণবর্ণের–এসব নিয়ে কত জল্পনাকল্পনাই না হয়েছে! আজ চক্ষু আর কর্ণের বিরোধ মিটে গেল। আহা হা! কী দিব্য কান্তি ওঁদের! কী দীর্ঘদেহী সবাই! মধ্যমটা একটু মোটা বটে, কিন্তু দেখে অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, মধ্যমপাণ্ডবের মতো বলশালী ভূ-ভারতে আর একজন পাওয়া মুশকিল। আর ওই যে দেখছ নকুল-সহদেব নামের দুই ভাইকে, কী অসাধারণ রূপময় মুখাবয়ব, খেয়াল করেছ? যেন দুজন স্বর্গ-অপ্সরার মুখ খুঁদে দেওয়া হয়েছে ওঁদের মুখে। জয় হোক পাণ্ডবদের—বারণাবতের সেই নির্জন স্থানটি পাণ্ডুপুত্রদের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল। উল্লাস- কোলাহল-সুভাষণে বারণাবত হস্তিনাপুর হয়ে উঠল।
যুধিষ্ঠির ওদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করল। গণনীয় নাগরিকদের প্রীতি উপহার দিল। অর্থ বিতরণ করল সাধারণ জনমানুষের মধ্যে। সমবেত প্রজারা হর্ষোৎফুল্ল হয়ে উঠল।
পুরবাসীদের আপ্যায়ন সম্মান সাঙ্গ হলে বাদ্যবাজনা সহযোগে জননী কুন্তী এবং তার পাঁচ পুত্রকে একটি সুরম্য হর্মের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। জৌলুসময় ওই প্রাসাদটিই তাদের বর্তমান আবাসস্থল। প্রথম দেখাতেই বড় মুগ্ধ হলো কুন্তী।
সহদেবকে ডেকে বলল, ‘দেখেছিস বাছা, কী মনোরম অট্টালিকা! এ ধরনের হর্ম্য খোদ হস্তিনাপুরেই খুব কম চোখে পড়েছে আমার! জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের প্রশংসা না করলে পাপ হবে, কী বলিস?’
সহদেব মায়ের শেষ বাক্যটিকে এড়িয়ে বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ মা, প্রাসাদটি সত্যি দেখার মতো! গৃহায়নমন্ত্রী পুরোচনের রুচি আছে—বলতে হবে।’
সহদেব যতই জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের প্রশংসা করতে না চাক, স্বাগত-আপ্যায়ন থেকে এই রমণীয় অট্টালিকা পর্যন্ত—সবকিছু ধৃতরাষ্ট্রের আদেশেই পুরোচন সম্পন্ন করেছে। শুধু কী তাই, প্রাসাদাভ্যন্তরে অত্যুৎকৃষ্ট ভক্ষ্য, পেয়, আসবাবপত্র, শয্যা, সমস্ত রাজভোগ দ্রব্য মহারাজার নির্দেশেই থরে থরে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছে পুরোচন।
পাণ্ডবরা যেদিকেই তাকাল, সুব্যবস্থার কোনো ত্রুটি দেখতে পেল না। ভক্ষ্য দেখে ভীম মাতোয়ারা হলো, সৌন্দর্য দেখে কুন্তী মুগ্ধ হলো। এমন কি ওই যে কম কথার লোক যুধিষ্ঠির, অর্জুনকে লক্ষ করে বলল, ‘নাহ, জ্যেষ্ঠতাতের প্রশংসা করতেই হয়, কী বলো অর্জুন!’
দাদার কথা শুনে আনন্দের হাসি হাসল অর্জুন।
এই সময় মন্ত্রী পুরোচন যুধিষ্ঠিরের সামনে এসে দাঁড়াল।
যুধিষ্ঠির স্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবেন মাননীয় মন্ত্রী?’
পুরোচন করপুটে বলল, ‘মাননীয় যুবরাজ, আপনারা এই হর্মে আগামী দশদিন বাস করবেন।’
‘দশদিন! দশদিন কেন? দশদিন পর কোথায় থাকব আমরা?’ যুধিষ্ঠির কিছু বলার আগে অর্জুন বলে উঠল।
পুরোচন আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে বলল, ‘এই গৃহে পরম আনন্দে, পরম বিলাসিতায় আগামী দশ দিন কাটাবেন আপনারা। তারপর আপনাদের জন্য চমক অপেক্ষা করছে।’
চট করে খুল্লতাত বিদুরের কথা মনে পড়ে গেল যুধিষ্ঠিরের। রথযাত্রা শুরু করার আগে কাকা বলেছিল-এ যাত্রা তোমাদের জন্য শুভ নয়। হয়তো মৃত্য…। আর ভাবতে পারল না যুধিষ্ঠির।
প্রায় চিৎকার করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘চমক অপেক্ষা করছে! কী সেই চমক!’
বিয়াল্লিশ
‘অন্য একটা গৃহে গিয়ে বসবাস শুরু করতে হবে আপনাদের, যুবরাজ।’ সহজ কণ্ঠে বলল পুরোচন।
‘অন্য একটি বাড়িতে! কেন, এই বাড়িতে থাকতে অসুবিধা কোথায়?’ অধীর কণ্ঠে বলল যুধিষ্ঠির।
‘ওই বাড়িটি যে আরও সুন্দর, আরও আকর্ষণীয় যুবরাজ! মনকে উতলা করার মতো সেই বাড়ির গঠন কাঠামো। সেখানে স্বস্তির প্রাচুর্য। অঢেল খাবারদাবার। নয়নাভিরাম গৃহসজ্জাসমূহ। রাজপুত্র দুর্যোধনেরই নির্দেশে ওই বাড়িটি আপনাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।’
দুর্যোধনের কথা শুনে নিজের অজান্তে যুধিষ্ঠিরের বুকটি কেঁপে উঠল। এ নিশ্চয়ই অশুভ কোনো কিছুর ইঙ্গিত। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখল যুধিষ্ঠির।
মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। সে তো দশ দিন পরের ব্যাপার! এই দশ দিন আমরা এই বাড়ির স্বাদটুকু আস্বাদন করি!’
পুরোচন কুর্ণিশের ভঙ্গিতে বলল, ‘তা তো বটেই, তা তো বটেই। আপনাদের পরে জানালেও হতো, আগে জানালাম, আপনাদের মানসিক প্রস্তুতির জন্য।’
স্বগত কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘খুবই উত্তম কাজ করেছ পুরোচন। আমাদের আগাম সতর্ক করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তারপর স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে মাননীয় মন্ত্রী। আপনি এখন আসুন। আমাদের মতো আপনিও ক্লান্ত নিশ্চয়ই। আমাদের মতো আপনারও বিশ্রামের প্রয়োজন।’
‘যথার্থ বলেছেন যুবরাজ। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এবার ওদের দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার।
‘তা-ই করুন।’ বলল যুধিষ্ঠির।
দু-কদম সামনে এগিয়ে আবার পেছনে ফিরল পুরোচন। বলল, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছি যুবরাজ। দশ দিন পর যে-বাড়িতে যাবেন, তার নাম—শিবগৃহ। নগরের একটু ওইদিকে বাড়িটি। যেমন সুন্দর, তেমন বিলাসবহুল শিবগৃহটি। প্রণাম যুবরাজ।’ বলে পুরোচন বিদায় নিল।
গভীর রাতে খাওয়াপর্ব শেষ হলে সবাই যার যার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
লণ্ঠনের মৃদু আলোয় কাকা বিদুরের দেওয়া কাগজটি চোখের সামনে মেলে ধরল যুধিষ্ঠির।
চিঠি ধরনের একটা লেখা। বেশ বড়। অনার্য জাতির ভাষায় লিখিত। আর্যদের বোধগম্য নয় এই ভাষা। বিদুর শিখেছিল শৈশবের অনার্য-ভাষাপ্রিয়তার কারণে। অনার্য জাতি সম্পর্কে বিদুরের খুব ঔৎসুক্য ছিল। যুধিষ্ঠিরকেও শিখিয়ে নিয়েছিল বিদুর সেই ম্লেচ্ছ ভাষাটি। ভাষাপ্রিয়তার জন্য নয়, যুধিষ্ঠিরের ভবিষ্যজীবনের কোনো এক বাঁকে কাজে লাগবে বলে। সেই স্লেচ্ছ ভাষাকে এই সংকটকালে কাজে লাগিয়েছে বিদুর।
চিঠিটি যত পড়ছে যুধিষ্ঠির, শিহরিত হচ্ছে। বিকটাকার এক শঙ্কা তাকে ঘিরে ধরছে। বিদুর লিখেছে—বিপদে শঙ্কিত হলে চলবে না। স্থির থাকতে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। শোনো বাবা, বারণাবতে তোমাদের ভ্রমণের জন্য পাঠানো হয়নি, পাঠানো হয়েছে পুড়িয়ে মারার জন্য। না না, এই অংশটি পড়ে অস্থির হয়ে উঠো না। তোমাদের দগ্ধ করা অত সহজ নাকি? আমি নিশ্চিত, তোমাদের হত্যার পরিকল্পনাটি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতে করা হয়েছে। তিনি জানেন, শুধু ভ্রমণের জন্যই পাঠানো হয়েছে তোমাদের, বারণাবতে। হত্যার পরিকল্পনাটি দুর্যোধনের। পুরোচনকে অর্থ ও যশের লোভ দেখিয়ে এই কাজে রাজি করিয়েছে দুর্যোধন। যা হোক, ওই পাষণ্ড, দুর্বৃত্তটা তো জানে না—তার চেয়েও বুদ্ধিমান কুরুরাজপ্রাসাদে আছে। প্রাণবিসর্জন দেওয়ার মতো যে আমার একটা গুপ্তবাহিনী আছে, দুরাত্মা দুর্যোধন তা জানে না। ওই গুপ্তচররাই সকল সংবাদ আমাকে পৌঁছে দিয়েছে।
প্রথম গৃহের পর দ্বিতীয় আবাসস্থলে নিয়ে যেতে চাইলে আপত্তি করবে না। উপরন্তু অভিনয় করবে–তোমরা অত্যধিক আনন্দিত হচ্ছ। নতুন নতুন বাড়িতে থাকার খুশিটা বরং বেশি করে প্রকাশ করবে।
এর পরে আরও কী কী করণীয় অতি গোপনে আমি তোমাকে জানাব। তবে মনে রেখো, নতুন যে-বাড়িটিতে যাবে তোমরা, তা অতি দাহ্যপদার্থ দ্বারা তৈরি। লাক্ষাগৃহ সেটি। দুর্যোধন এর নাম দিয়েছে জতুগৃহ। জতুগৃহ মানে শণ ও সর্জরস দ্বারা নির্মিত ঘর। এটি বহ্নিযোগ্য। সাবধানে থেকো।
লেখাটির শেষে একটা মানচিত্র। একটা গৃহ, গৃহের তলদেশ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ। একটা জলরেখার ধারে গিয়ে শেষ হচ্ছে সুড়ঙ্গের প্রান্তটি। জলরেখার ওপর একটা তরণীর চিত্র, পালতোলা।
লেখাটি বেশ কয়েকবার পড়ল যুধিষ্ঠির। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মানচিত্রটি অবলোকন করল। প্রথম দিকে অত্যন্ত ত্রস্ত হয়ে উঠলেও পরে বেশ ধীরস্থির হয়ে গেল যুধিষ্ঠির। দুদিকে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। মুখ দিয়ে বড় করে ফুঁ দিয়ে বুকের শঙ্কিত-বাতাসসমূহ বের করে দিল। দুটি সিদ্ধান্ত নিল যুবরাজ যুধিষ্ঠির—এক. ব্যাপারটি কাউকেই জানাবে না, নিজের মধ্যে রাখবে; দুই. পুরোচনকে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে সব কিছু জেনে গেছে।
আগামীকাল থেকে তার অভিনয় জীবনের পর্ব শুরু হবে। দেখি পুরোচন, তুমি কত বড় অভিনেতা! ভেবে নিল যুধিষ্ঠির। অভিনয়ে তুমি বড়, না আমি পাকা— দেখিয়ে দেব তোমাকে।
দশ দিন পর পাণ্ডুপুত্ররা সমাতা শিবগৃহে প্রবেশ করল। আগের বাড়িটির চেয়ে এটি অনেক বেশি আড়ম্বরপূর্ণ। বাড়িটির জাঁকজমক-সমারোহ দেখে ওরা প্রথমে স্তব্ধ, তারপর বিহ্বল, এরপর আত্মহারা হলো। সত্যি মনোলোভা, সত্যি বিবশ করার মতো শিবগৃহের গঠন কৌশল!
সবাই বিভোর হলেও যুধিষ্ঠির হলো না। কীরকম অদ্ভুত এক চাহনিতে চারদিকটা খতিয়ে দেখতে লাগল।
জ্যেষ্ঠের এ রকম আচরণ দেখে ভীম অবাক হলো। কী ব্যাপার—দাদা এ রকম চোখে ঘরের আনাচেকানাচে কী দেখছে! এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখছ দাদা, এমন করে।’
খুঁটিয়ে দেখা অব্যাহত রেখে, ভীমের দিকে না তাকিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘দেখ ভীম, এই গৃহটি ঘি, লাক্ষা—এরকম আরও আরও দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ভালো করে অনুসন্ধান করো, কোথাও এসব দ্রব্যের সন্ধান পাও কি না।’ ভীমকে বলবার সময় যুধিষ্ঠির পূর্বের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেল। যে কথাটা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে বলে ঠিক করেছিল, ভীমের কাছে তা প্রকাশ করে দিল।
অবাক হলো ভীম—এসব কী বলছে দাদা!
‘কী বলছ দাদা এসব! এরকম সুরম্য বাড়িতে দাহ্যবস্তু আসবে কোত্থেকে! রাজারই তো বাড়ি এটি, রাজবাড়িতে লাক্ষা আসবে কেন?’ ভীমের চোখেমুখে বিস্ময়ের নানা আঁকাবুকি।
তীব্র কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘প্রশ্ন না করে যা বলছি, তা করো ভীম। প্রশ্ন করার সময় এখন নয়।’ দাদার তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর শুনে অন্য ভাইয়েরাও সেখানে উপস্থিত হলো। দাদাকে এমন অস্থির হতে আগে কখনো দেখেনি তারা।
অর্জুন মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে দাদা? বিপজ্জনক কিছু কি?’
‘শুধু বিপজ্জনক নয়, জীবনসংশয়জনকও। ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় নয় এখন। পরে বলছি সব। তার আগে বাড়ির আনাচেকানাচে খুঁজে দেখ, শুধু আনাচেকানাচে নয়, গৃহকাঠামোর ভেতরে, এমনকি ভূ-অভ্যন্তরেও অনুসন্ধান করে দেখ সবাই, কোনো দাহ্যদ্রব্য পাও কি না।’ ত্রস্ত কণ্ঠে বলে গেল যুধিষ্ঠির।
জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে চার ভাই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেল না তারা। ফিরে এসে বলল, ‘নাহ্ দাদা, কোথাও কোনো দাহ্য পদার্থ পাওয়া গেল না।’
যুধিষ্ঠির বিশ্বাস করল না ভাইদের কথা। খুল্লতাত বিদুরের তথ্য ভুল হতে পারে না। অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল যুধিষ্ঠির।
ভীম বলল, ‘যদি মনে করো দাদা এখানে অগ্নিভয় আছে, তা হলে আগের বাসস্থানেই ফিরে যাই আমরা।’
ভীমের কথা শেষ হতে না হতেই যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে উঠল, ‘না না ভীম। আমরা কোথাও যাব না। এখানেই থাকব।’
দাদার এ রকম অসংলগ্ন কথায় আর আচরণে অন্য পাণ্ডবরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
অত্যন্ত মন্থর কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘আগের বাড়িতে যেতে চাইলে সন্দেহ করে বসবেন পুরোচন।’
তেতাল্লিশ
‘সন্দেহ করবেন! পুরোচন! তোমার কথা যথাযথ বুঝতে পারছি না জ্যেষ্ঠ।’ ইতস্তত কণ্ঠে বলল ভীম
‘আহা! এত বিরক্ত করছ কেন ভীম? বললাম না, প্রশ্ন করো না। চুপ থাকো।’ অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল যুধিষ্ঠির। তারপর ধপ করে আসনে বসে পড়ল।
ওই সময় কুন্তীও এসে উপস্থিত হলো ওখানে। পুত্রের মলিন মুখ দেখে ঘাবড়ে গেল সে। যুধিষ্ঠিরের কাছ ঘেঁষে একটা আসন টেনে বসে পড়ল।
যুধিষ্ঠির অত্যন্ত ম্লান গলায় বলল, ‘নকুল, মূল দরজাটা বন্ধ করে এসো। আর বাহিরটাও দেখে এসো ভালো করে। কেউ কোথাও ঘাপটি মেরে আছে কিনা তালাশ করে এসো।’
কিছুক্ষণ পর নকুল ফিরে এসে বলল, ‘না দাদা, বাইরে কেউ নেই। দেখলাম—মাননীয় পুরোচনের গৃহে আলো জ্বলছে।’
জতুগৃহের অতি নিকটে আরেকটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। আকারে ছোট। একটা পরিবার স্বচ্ছন্দে থাকতে পারার মতো করে বানানো হয়েছে ওটি। মন্ত্রী পুরোচন সপরিবারে ওই গৃহে উঠেছে। পাণ্ডবদের জতুগৃহে পৌঁছে দিয়ে ওই গৃহে, পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে গেছে পুরোচন। এতদিন পর একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলবার সময় মিলেছে তার। স্ত্রী-সন্তানদের সান্নিধ্য দেওয়ার সুযোগ মিলেনি এতদিন। আজ মিলেছে। সবাইকে নিয়ে রাতের আহারে বসেছে পুরোচন। সেই আলো দেখে এসেছে নকুল।
যুধিষ্ঠির বলল, ‘দরজা বন্ধ করেছ তো?’
‘করেছি।’ সংক্ষেপে বলল নকুল।
দু-হাতের ইশারায় ভাইদের নিকটে ডাকল যুধিষ্ঠির। তারপর ধীর কণ্ঠে পূর্বাপর সকল কথা বলে গেল। ভীম ছাড়া অন্য সবার চোখমুখ শুকিয়ে গেল। কুন্তী আর্তনাদ করে উঠতে গেলে যুধিষ্ঠির মায়ের মুখে হাতচাপা দিল।
তারপর কণ্ঠকে একেবারে খাদে নামিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘দুম করে পুরোচন আগুন লাগাবে না এ বাড়িতে। আগামী বেশ কদিন আমাদের ওপর কড়া নজর রাখবে। আমরা কোনো সন্দেহ করছি কি না দেখে যাবে। তাছাড়া হস্তিনাপুর থেকে নির্দেশ আসতে হবে। তারপর পুরোচন আগুন লাগানোতে উদ্যোগী হবে। কাল থেকে আমরা এমন কোনো আচরণ করব না, যাতে পুরোচনের সন্দেহ জাগে। এক্কেবারে স্বাভাবিক থাকবে তোমরা। কাকা চিঠির সঙ্গে একটা মানচিত্রও এঁকে দিয়েছে। তাতে স্বস্তির ইঙ্গিত আছে। এখান থেকে মুক্তির পথও বাতলে দিয়েছে কাকা। শুধু একটু সময় দিতে হবে বিদুর কাকাকে।’ বলে ঢোক গিলল যুধিষ্ঠির। তারপর বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল, ‘কী সময় দিতে পারবে না ভাইয়েরা?’
ভাইয়েরা মুখে কিছু উচ্চারণ করল না, শুধু তাদের চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠল।
.
এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। হস্তিনাপুর থেকে কোনোরূপ নির্দেশনা এলো না পুরোচনের কাছে। বারবার দূত পাঠিয়েও কোনো সন্দেশ পেল না দুর্যোধনের কাছ থেকে। অস্থির হয়ে উঠল পুরোচন।
বারণাবতের দিকে তখন নজর দেওয়ার সময় নেই দুর্যোধনের। উৎকোচপ্রবণ রাজন্যরা, বিদুর-যুধিষ্ঠিরের আশীর্বাদপুষ্ট ব্রাহ্মণরা এবং কিছু সাহায্যলোভী প্রজা, যারা তখনো পাণ্ডবপক্ষের হয়ে কাজ করছিল, তাদের দমন-তোষণে ব্যস্ত সময় পার করছিল দুর্যোধন। সে জানে, যুধিষ্ঠির-অনুরাগীদের নিশ্চিহ্ন না করে জতুগৃহে আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিলে নির্ঘাত প্রজাবিদ্রোহ হবে হস্তিনাপুরে। সেই বিদ্রোহ দমন করা সহজ হবে না। তাই বারণাবত থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে বিদ্রোহীদের ওপর সেই মনোযোগ নিবিষ্ট করেছে দুর্যোধন। সে জানে, জতুগৃহ দাহ একটু পরে হলে অসুবিধা হবে না, যত সমস্যা হবে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীকে কব্জা করতে না পারলে। তাই পুরোচনের বারবার দূত পাঠানোর পরও কোনো নির্দেশনা দেয়নি দুর্যোধন।
এদিকে বিদুর বসে থাকেনি। এক সুদক্ষ খনককে বারণাবতে পাঠিয়েছে। হাতে তার চিরকুট। ওই ম্লেচ্ছ ভাষাতেই লেখা।
সেই খনক ভিক্ষা-আকাঙ্ক্ষী ব্রাহ্মণবেশে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করেছিল। না, চোখ এড়ায়নি পুরোচনের। কিন্তু জীর্ণ কাপড়ের কুঁজোমতন ব্রাহ্মণটি তার মনে কোনোরূপ সন্দেহের উদ্রেক করেনি। বরং দানের জন্য যেভাবে যুধিষ্ঠিরের সামনে কাকুতি-মিনতি করছিল ব্রাহ্মণটি, বড় মায়া জেগেছিল পুরোচনের মনে। ব্যাপারটা যুবরাজের, দান করা না-করা তাঁর ব্যাপার- ভেবে স্থানান্তরে গিয়েছিল পুরোচন।
এক ফাঁকে কাগজটা এগিয়ে ধরেছিল খনক, যুধিষ্ঠিরের দিকে। চটজলদি কাগজটা হাতে নিয়েছিল সে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি—এটা কাকার চিঠি।
চিরকুটে অতি সংক্ষিপ্ত দুটো পক্তি লেখা—লোকটি সাহায্যপ্রার্থী। সাহায্য করো।
চট করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল খনককে।
খনক গা-ঝাড়া দিয়ে বলেছিল, ‘মহামান্য বিদুর নির্দেশ দিয়েছেন—জতুগৃহ থেকে ভাগীরথীর তীর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দিতে। খোঁড়া সমাপ্ত হলে এই ঘরে আগুন দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে আপনাদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নদীর পাড়ে কী হবে, মানচিত্রে আঁকা আছে বলেছেন। আরেকটি কথা মাননীয় যুবরাজ, রাতের আঁধারে আমার আরও চারজন সহযোগী আসবে। এই নগরেই ছদ্মবেশে আছে তারা। অন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে জতুগৃহে ঢুকিয়ে নিতে হবে তাদের।’
ত্রস্ত কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলেছিল, ‘ঠিক আছে।’
পরদিন প্রত্যুষ থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়া শুরু করল খননকারীরা। জতুগৃহের নির্জন একটি কক্ষ থেকেই কাজটি শুরু হলো।
নিভৃতে নিঃশব্দে কাজ এগিয়ে চলল।
খনকের নাম ভাগুরী। ভাগুরী যেনতেন খনক নয়। অতিশয় কৃতবিদ্য খননবিশারদ সে। তার সহকারীরাও কম যায় না। ভাগুরীর পরিকল্পনায় খননক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলল। কেউ বুঝতে পারল না, কেউ জানতে পারল না। এমনকি যে পুরোচন, দেখভাল করার জন্য প্রায় প্রতিদিন জতুগৃহে আসছে, সেও বিন্দুমাত্র টের পেল না। সবার অলক্ষে ভাগুরী সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করে যেতে লাগল।
কেটে গেল বেশ কিছুদিন।
ঝিঁঝি ডাকা এক সন্ধ্যায় ভাগুরী চুপিসারে এসে বলল, ‘প্রণাম যুবরাজ। আমার কাজ সাঙ্গ হয়েছে। আপনারা স্বচ্ছন্দে সুড়ঙ্গপথ ব্যবহার করতে পারবেন। আজ রাতেই চলে যাব আমরা। এরপর আপনার কাজ। যা করার করবেন।’ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ভাগুরী বিদায় নিল।
যুধিষ্ঠির শিরদাঁড়া সোজা করে নিজ আসনে বসে থাকল। চোখ বোজা। শান্ত স্থির মুখমণ্ডল। অকম্পিত ভ্রূদ্বয়। পিঠজুড়ে কাঁধ ছাড়ানো কেশরাশি। যুধিষ্ঠিরের শ্বাস পড়ছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে—একজন ঋষি তাঁর তপস্যায় নিমগ্ন। জাগতিক সকল কিছু থেকে এই মুহূর্তে একেবারেই বিচ্ছিন্ন যেন!
কী ভাবছে যুধিষ্ঠির? ভাবছে — বাল্যকালের কথা, ভাবছে হস্তিনাপুরে প্রবেশের কথা, ভাবছে বিদুর-সংসর্গ, যুবরাজ হওয়া, বিদুরের রাজা করার প্ররোচনা, ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের অনুমান করতে পারা, কাকা বিদুরের উসকানিতে প্রজাদ্রোহ, শেষ পর্যন্ত বারণাবতে তাদের নির্বাসন, জতুগৃহে অবস্থান, সুড়ঙ্গখনন—এসব একের পর এক ভেবে চলেছে যুধিষ্ঠির। বিদুর কাকা বলেছিল, জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রকে না সরালে কোনোদিনই কুরুসিংহাসনে বসতে পারবে না তুমি যুধিষ্ঠির। সুঠামদেহী ধৃতরাষ্ট্র দীর্ঘজীবী হবে। তার পরে তার বড় ছেলে দুর্যোধনই হবে হস্তিনাপুরের রাজা। তুমি নও। তোমাদের নিয়ে প্রজা – রাজন্য-মন্ত্রীদের মনে সংশয় আছে—আদৌ তোমরা পাণ্ডুপুত্ৰ কিনা? এই অজুহাতেই কৌরবরা তোমাকে রাজা হতে দেবে না। রাজা যদি হতে চাও, ব্রাহ্মণদের নিয়ে প্রজাবিদ্রোহ ঘটাতে হবে। বিদ্রোহ যদি সফল হয়, তা হলে নির্বিঘ্নে কুরুরাজ্যের রাজা হবে তুমি।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রজাবিদ্রোহ সফল করা সম্ভব হয়নি। এই ষড়যন্ত্রের কথা দুর্যোধন জেনে গেছে। সরাসরি হত্যা করতে পারত সে আমাদের। বন্দি করতে পারত বিদুর কাকাকে। কিন্তু কোনোটাই করেনি দুর্যোধন। কৌশলে আমাদের বারণাবতে পাঠিয়ে কাকাকে নিঃসঙ্গ করে ছেড়েছে। আর জতুগৃহে আমাদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা ফেঁদেছে দুর্যোধন। না, দুর্যোধনকে এই সুযোগটা দেওয়া যাবে না। ও পুড়িয়ে মারার চেয়ে নিজেরা পুড়ে মরা ভালো—ভাবতে ভাবতে মুচকি একটু হাসল যুধিষ্ঠির।
চুয়াল্লিশ
মা আর ভাইদের ওই ঘরে আহ্বান জানাল যুধিষ্ঠির।
সবাই এলো। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ আসনে।
অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘এখন নিজেদের পুড়িয়ে মারার সময় হয়ে গেছে ভাইয়েরা।’
জননী কুন্তী ত্বরিত বলে উঠল, ‘পুড়িয়ে মারার! নিজেদের!
‘হ্যাঁ মা, নিজেদের পুড়িয়ে মারতে হবে এখন আমাদের।’
‘কী আবোলতাবোল বকছ বাছা!’
‘আবোলতাবোল নয় মা, ঠিক কথাই বলছি।’ ভাইদের দিকে মুখ ঘোরাল যুধিষ্ঠির। বলল, ‘আমাদের হাতে তিন দিন সময় আছে আর। এই তিন দিনের মধ্যে সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে।’
ভীম বলল, ‘গুছিয়ে নিতে হবে?
‘আগামী তৃতীয় দিনের পরের রাতে এই বাড়ি থেকে পালাব আমরা।’
‘কীভাবে?’ কুন্তী জিজ্ঞেস করল।
‘সুড়ঙ্গপথে মা। সুড়ঙ্গখনন সমাপ্ত হয়েছে। ভাগুরী জানিয়ে গেছে আমায়। ভাগীরথী তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে সুড়ঙ্গ পথটি।
‘সেখান থেকে কোথায় যাব আমরা?’ মা জানতে চাইল।
‘ও নিয়ে তুমি ভেব না মা। ওদিকের ব্যবস্থাটাও সুচারুভাবে করে রেখেছে বিদুর কাকা। ভাগীরথী তীরে পৌঁছালে বুঝতে পারবে বিদুর কাকার বিচক্ষণতা।’
বিদুরের নাম শুনে কীরকম অদ্ভুত এক শিহরন বোধ করল কুন্তী। সেই শিহরন নিজের মধ্যে চেপে রাখল। কিছুতেই পুত্রদের বুঝতে দিল না।
‘আমাদের কী করতে হবে, বলো দাদা।’ অর্জুন জানতে চাইল।
‘এই মুহূর্তে তোমাদের করার কিছু নেই তেমন। নিজেদের সজ্জিত করে রাখ শুধু। অস্ত্রশস্ত্র হাতের কাছে রাখ। এখন যা করতে হবে, মা-ই করবে।’
‘আমি করব!’ বিস্মিত কণ্ঠে শুধাল কুন্তী।
‘মা, কাল থেকে তুমি ব্রাহ্মণদের ভোজন করাতে শুরু করো। সঙ্গে দক্ষিণাও দেবে। প্রথমদিন যা হোক, দ্বিতীয় দিন ব্রাহ্মণের সংখ্যা বাড়বে। তৃতীয় দিন হয়তো আরও বেড়ে যাবে। হ্যাঁ মা, ব্রাহ্মণদের দেখে গরিব মানুষেরাও আসতে থাকবে। অরণ্যচারীরাই বেশি করে আসবে। বারণাবতে তাদের সংখ্যা অধিক। ওরা অভাবী। ব্রাহ্মণ থেকে ব্যাধ—কাউকে ফিরিয়ে দিয়ো না মা। ভক্ষ্য-চব্য-চোষ্য-পেয়–যে যা খেতে চায়, খেতে দিয়ো।’
ছেলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল জননী কুন্তী। যুধিষ্ঠিরের কথা শেষ হলে ডান দিকে মাথা কাত করল।
ভাইদের মনে অনেক জিজ্ঞাসা। দাদা একদিকে বলছে, তাদের মৃত্যুশঙ্কা; অন্যদিকে ব্রাহ্মণভোজনের আদেশ দিচ্ছে! দুটোই পরস্পরবিরোধী কাজ। এই বিপরীতার্থক কাজে উদ্যোগী হলো কেন দাদা? কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না অন্যান্য পাণ্ডব।
পরদিন থেকে মহাভোেজ লেগে গেল শিবগৃহে। সকালে পুরোচনকে ডেকে পাঠিয়েছিল যুধিষ্ঠির। ব্রাহ্মণভোজনের কথা বলেছিল তাকে। বলেছিল, ‘মায়ের বড় ইচ্ছা জেগেছে মন্ত্রীবর, ব্রাহ্মণ আর কাঙালিভোজন করাবেন। আনাজপাতি, চাল, ডাল—এসবের ব্যবস্থা করুন। আর হ্যাঁ, চোষ্য-পেয়ও যেন বাদ না যায়। প্রচুর মিষ্টান্নের ব্যবস্থা করবেন। তিনদিন চলবে এই ভোজনক্রিয়া। জানি, আপনার কষ্ট হবে। তার পরও কী করব বলুন, মায়ের বাসনাকে তো আর অবহেলা করা যায় না!’
পুরোচন হাসিমুখে বলল, ‘না না যুবরাজ, কষ্ট হবে কেন? মায়ের ইচ্ছা বলে কথা! এতদিন নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে থাকতে হাতেপায়ে খিল ধরে গিয়েছে। এখন কয়েকদিন কাজে ব্যস্ত থাকতে পারব। ভালোই লাগবে আমার।’
পুরোচনের অলক্ষে ক্রূর একটু হাসল যুধিষ্ঠির।
তিনদিন ধরে খুব খাওয়াদাওয়া হলো জতুগৃহে। গৃহের সামনের চত্বর জুড়ে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। নানা মানের ও ধরনের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণরা যথাযোগ্য মর্যাদায় আসন গ্রহণ করেছে। আকণ্ঠ খাদ্য গ্রহণ করে তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। ভীমাদি পাণ্ডবরা ব্রাহ্মণভোজনের তদারক করে গেছে আগাগোড়া। তিনদিন ধরে আচণ্ডালদ্বিজে মুক্তহস্তে দান করে গেছে যুধিষ্ঠির। সবাই খুব খুশি, সবারই মুখে ধন্য ধন্য ধ্বনি।
এই তিনদিনের কাজের চাপে পুরোচন একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তৃতীয় দিনের ভোজনক্রিয়া শেষে পুরোচন যুধিষ্ঠিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নেতিয়েপড়া গলায় বলল, ‘এবার আমায় ছুটি দিন যুবরাজ। শরীরটা আর কথা শুনছে না। পড়ো পড়ো অবস্থা আমার। বিশ্রামের বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যদি অনুমতি দেন সমস্ত রাত বিশ্রাম নিই।’
যুধিষ্ঠির তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘অবশ্যই অবশ্যই। বয়স তো আর কম হলো না আপনার! গেল তিনদিন ধরে তো রীতিমতো অত্যাচার করেছি আপনার ওপর! যান যান, বাড়ি যান। বিশ্রাম নিন। কিছু একটা খেয়ে শুয়ে পড়ুন। গোটা রাত ঘুমালে ক্লান্তি-অবসন্নতা কেটে যাবে।’
পুরোচন প্রণাম জানিয়ে পেছন ফিরলে যুধিষ্ঠির বলে উঠল, ‘বিদায় মাননীয় মন্ত্রী।’ তার মুখে সেই ক্রূর হাসিটি ছড়িয়ে পড়ল।
সন্ধে উতরে গেছে অনেকক্ষণ। পুরোচনকে বিদায় জানিয়ে ঘাড় ফেরাতেই কিছু মানুষের ওপর চোখ আটকে গেল যুধিষ্ঠিরের। জড়সড় হয়ে অনতিদূরে দাঁড়ানো। মশালের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে-ওরা ক্ষুধার্ত। দেখে যুধিষ্ঠিরের মনে হলো— ওরা নগরবাসী নয়। বড় মলিন পোশাক তাদের! ভয়ে ওরা কাঁপছে বলেও মনে হলো যুধিষ্ঠিরের। কয়েক কদম ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুঝল— ওরা অরণ্যচারী নিষাদ। হয়তো ভোজের কথা শুনে এসেছে। আসতে হয়তো দেরি করে ফেলেছে ওরা। খাবার পায়নি। হয়তো বহুদূর থেকে এসেছে। অরণ্য, এবড়োখেবড়ো পথ পেরিয়ে আসতে গিয়ে বিলম্ব হয়ে গেছে ওদের। খাবার সময়টাতে এসে পৌঁছাতে পারেনি।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কারা? এখানেই-বা কী করছ?’ যুধিষ্ঠির জানে রাজকীয় আর্য ভাষা ওদের অবোধ্য। তাই ম্লেচ্ছ ভাষাতেই জিজ্ঞেস করল যুধিষ্ঠির।
মা-টি কম্পিত স্বরে বলল, ওই দূরপাহাড়ের ওপারে থাকে ওরা। বহুদিন ধরে ওখানে খাদ্য মিলছে না তাদের। এখানকার খাওয়া-দাওয়ার কথা শুনে আসতে আসতে বেশ সময় লেগে গেল। ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারল না। দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে আসার কারণে বড় ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে তারা। যদি কিছু খাদ্য জোটে, প্রাণে বেঁচে যায় তারা।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা কারা? মানে তোমার সঙ্গে যারা আছে, তারা কারা?’
‘ও, এদের কথা বলছেন মহারাজা। এরা আমার সন্তান।
ছেলেদের সামনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে বলল নিষাদ রমণীটি। তারপর অনেকটা বিলাপের কণ্ঠে বলতে থাকল, ‘ওদের বাপকে বাঘে খেল। বনে গিয়েছিল, পশু শিকারে। ফিরে এলো না আর। পাঁচ ছাওয়াল নিয়ে বড় বিপদে পড়ে গেলাম আমি। কয় মাস ধার-উধার করে চালালাম। আর পারছিলাম না। সেই সময় খবর পেলাম-আপনি মহাভোজ দিয়েছেন। বামুন কাঙাল — সবাই অবাধে খেতে পারবে। পুত্রদের সঙ্গে শলা করে রওনা দিলাম। আসতে আসতে দেড় দিন লেগে গেল। পৌঁছালাম যখন, খাওয়ার পালা সাঙ্গ হয়ে গেছে। আমাদের কিছু খাবার দেন গো মহারাজ। ঈশ্বর আপনার অনেক মঙ্গল করবেন
নিষাদ রমণীটির সকল কথা যুধিষ্ঠিরের কান দিয়ে ঢুকেছে বলে মনে হলো না। কথা শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল যুধিষ্ঠির। তার মনে তখন অন্য এক খেলা চলছে। খাবার চাইছে দেহাতি নারীটি। বিধবা সে। সঙ্গের ছেলেরা তার পুত্র। সংখ্যায় ওরা পাঁচজন। কী অদ্ভুত মিল! তারাও পাঁচ ভাই। মা কুন্তীও বিধবা। নিষাদপুত্রদের একজনকে বেশ বলবান বলে মনে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে নেচে উঠতে ইচ্ছে করল যুধিষ্ঠিরের। আহা! কী প্রাপ্তি! কী দুর্দান্ত মাহেন্দ্ৰক্ষণ! গভীর দুর্ধর্ষ এক পরিকল্পনা যুধিষ্ঠিরের মস্তিষ্কে চাগিয়ে উঠল। নিজের ঊরুতে জোর একটা থাপড় মারল যুধিষ্ঠির।
মাথা উঁচু করে অদৃশ্য ঈশ্বরের উদ্দেশে বলল, ‘না চাইতেই মিলিয়ে দিলে প্রভু!’
পঁয়তাল্লিশ
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। সত্যবাদী। পরোপকারী। সজ্জন।
শুভক্ষণে জন্ম তার। শুভতা সর্বদা তাকে ঘিরে রাখে। হস্তিনাপুরের যুবরাজ যুধিষ্ঠির অপরের অনিষ্ট চিন্তা ভুলেও মনে স্থান দেয় না। প্রজাহিতৈষণায় যুবরাজের অধিকাংশ সময় কাটে।
এহেন যুবরাজ যুধিষ্ঠির, সেই সন্ধ্যায় নিষাদ রমণীটিকে সাদরে জতুগৃহের অভ্যন্তরে নিয়ে এলো। পুত্ররাও মাকে অনুসরণ করে কম্পিত পায়ে ঘরে ঢুকল। গৃহাভ্যন্তরের আড়ম্বর দেখে ক্ষুধার কথা ভুলে গেল তারা।
একটা গৃহকোণ দেখিয়ে যুধিষ্ঠির রমণীটিকে বলল, ‘তোমরা ওইখানে অপেক্ষা করো। আমি আসছি।’ বলে কক্ষান্তরে গেল যুধিষ্ঠির।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো যুধিষ্ঠির। পেছনে জননী কুন্তী। নিষাদরা আগের মতো থরোথরো। সামনে থেকে যুধিষ্ঠির সরে গেলে কুন্তীকে নিষাদ রমণীটি দেখতে পেল। ভেতরের ত্রস্ত ভাবটি কেটে গেল তার। হঠাৎ মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। মায়ের দেখাদেখি পুত্ররাও। সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম সেরে উঠে দাঁড়াল তারা। পিটপিটে চোখে উভয়কে দেখে যেতে লাগল নিষাদরা।
যুধিষ্ঠির জননী কুন্তীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘বহুদূর থেকে এসেছে মা এরা। প্রায় দেড় দিন হাঁটার পর এখানে এসে পৌঁছেছে। খাদ্যের খুব অভাব তাদের। এই মুহূর্তে বড় ক্ষুধার্ত তারা। ওই ছোটটিকে দেখ, কী রকম নেতিয়ে পড়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি এদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো। যা খেতে চায়, তা দাও। পর্যাপ্ত পরিমাণে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত।’
কুন্তী বলল, ‘আহা রে বাছারা! কী মলিন চোখমুখ তাদের! আহা, নারীটিও ক্ষুধায় কীরকম আনচান করছে! ঠিক আছে বাবা, রন্ধনশালায় নিয়ে যাচ্ছি আমি ওদের, ওখানেই…।’
কুন্তী তার কথা শেষ করতে পারল না। যুধিষ্ঠিরের আর্তচিৎকারে থেমে যেতে হলো তাকে।
যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে বলল, ‘না মা, ওরা রন্ধনশালায় খাবে না। এইখানেই খাবে। খাওয়া শেষে এখানেই ঘুমাবে তারা।’
চোখ কপালে তুলে কুন্তী বলল, ‘এখানে খাবে! এখানেই ঘুমাবে! আমাদের সঙ্গে একই গৃহে! এ কী কথা বলছ যুধিষ্ঠির!’
মায়ের সকল কথার কোনো উত্তর দিল না যুধিষ্ঠির। বরফশীতল কণ্ঠে যুধিষ্ঠির শুধু বলল, ‘মা যা বলছি, তাই করো। খাওয়া শেষে এখানেই ওদের শোবার ব্যবস্থা করবে মা।’
থতমত চোখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে থাকল জননী কুন্তী। ছেলের এ রকম রূঢ় ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বর আগে কখনো শোনেনি সে।
যুধিষ্ঠির নিজকক্ষে চলে গেলে কুন্তী নিষাদদের দেখভালের দিকে নজর দিল।
প্রচুর খেল নিষাদরা। আকণ্ঠ ভোজন যাকে বলে, ঠিক সেরকম। খাওয়াশেষে সুরা নিয়ে বসল ওরা। তারা এত সুরামগ্ন হয়ে পড়ল যে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাল। নিষাদ মাতাটি এবং তার পাঁচ ছেলেসহ মাত্রাতিরিক্ত পান-ভোজনে হতজ্ঞান ও মৃতকল্প হয়ে পড়ল। সেখানেই অচেতন হয়ে ঢলে পড়ল নিষাদরা। পান-ভোজনের আধিক্যের কারণে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে বসল তারা।
তারপর জননী আর ভাইদের নিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করল যুধিষ্ঠির। রাত তখন অনেক গভীর।
সবার উদ্দেশে ভীম বলল, ‘আমরা আজ রাতেই এই জতুগৃহ থেকে পালাব।
পালানোর কথা যুধিষ্ঠিরের মুখে আগেও একবার শুনেছে বলে অবশিষ্ট পাণ্ডবরা বিস্মিত হলো না। জননী কুন্তীও অবাক হয়েছে বলে মনে হলো না।
হতবাক হলো তখনই যখন যুধিষ্ঠির বলল, ‘ভীম, এবার এই বাড়িতে আগুন লাগাতে হবে এবং লাগাবে তুমিই। তার আগে পুরোচনের গৃহ ভস্ম করো।’
স্তব্ধ চোখে জ্যেষ্ঠের দিকে তাকিয়ে থাকল ভীষ্ম। এ কোন দাদা! কোন যুধিষ্ঠিরকে দেখছে সে! যে যুধিষ্ঠির পরোপকারী, প্রজাকল্যাণে মনোনিবেশী, যে যুধিষ্ঠির মানুষের মঙ্গলচিন্তায় বিভোর থাকে, যে যুধিষ্ঠির ধর্মভীরু মানবতাপরায়ণ, এ তো সেই যুধিষ্ঠির নয়! সে যুধিষ্ঠির তো একজন বৃদ্ধমন্ত্রীকে সপরিবারে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিতে পারে না!
এ কী শুনল সে! সত্যি শুনল! না শুনেনি কিছু? এ রকম নির্দয় অমানবিক আদেশ দিতে গিয়ে কণ্ঠস্বরটা একটুও কাঁপল না যে দাদার! জলজ্যান্ত মানুষটিকে সপরিবারে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিচ্ছে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির!
ছেলের মনোভাব বুঝতে পারল কুন্তী। অনেকটা ধমকেই বলল, ‘সাতপাঁচ ভাবার সময় এখন নয় বৃকোদর। ন্যায়-অন্যায় ভুলে যাও। নিজের প্রাণের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই এই পৃথিবীতে। আগুন লাগাও। ভস্মীভূত করো পুরোচনকে, সপরিবারে।’
‘পুরোচন দোষ করেছে মানি, আমাদের সকলকে মারার দায়িত্ব নিয়ে বারণাবতে এসেছে সে, তাও জানি। কিন্তু হত্যা তো সে আমাদের করেনি! তারপরও তার ওপর দাদার এই দণ্ড! পুরোচনের অপরাধের কথা মানলাম না হয়, কিন্তু তার স্ত্রী, তার সন্তানরা কী দোষ করেছে মা? ওদের কেন পুড়ে মরতে হবে?’ দিশেহারা কণ্ঠে বলল ভীম।
যুধিষ্ঠির কঠোর কণ্ঠে গর্জে উঠল, ‘তুমি থামবে ভীম? নীতির কথা রাখো। মানবতার আদর্শ বাণীগুলো ওই ভাগীরথীর জলে বিসর্জন দাও। আমাদের লক্ষ্য কুরুরাজসিংহাসন। রাজা হওয়ার জন্য যা কিছু করতে হয়, সেটা ন্যায় বা ঘোরতর অন্যায়, করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না আমি।’ একটু থামল যুধিষ্ঠির।
কণ্ঠকে আরও দৃঢ় করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘এখন তুমি পুরোচনগৃহে আগুন লাগাবে, না আমি লাগাব?’
যুধিষ্ঠিরের এরকম কদাকার মূর্তি দেখে নিথর হয়ে গেল বৃকোদর। তার মুখের রা ফুরিয়ে গেল। যুধিষ্ঠিরের কথার প্রতিবাদ করতে আর সাহস করল না ভীম। একপা দুপা করে জ্বলন্ত মশালের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ গৃহকোণে নিথর হয়ে পড়ে থাকা নিষাদজননী ও তার পুত্রদের ওপর নজর পড়ল ভীমের। থমকে গেল। পেছন ফিরে দাদার দিকে এগিয়ে এলো ভীম। তর্জনীটা ওই নিষাদদের দিকে প্রসারিত করল। তার চোখেমুখে ক্রোধ আর প্রশ্নের ঘনঘোর উপস্থিতি।
এবার অত্যন্ত সংহত গলায় যুধিষ্ঠির বলল, ‘ওরাও পুড়ে মরবে।
এতক্ষণ বাদে অর্জুন কথা বলল, ‘ওরাও! ওরা যে নিরীহ নিষাদ দাদা! ওরা যে নিষ্পাপ! পুরোচনের মতো কোনো অপরাধ করেনি ওরা! ‘
‘তারপরও ওদের পুড়ে মরতে হবে।’ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল যুধিষ্ঠির।
‘কেন দাদা, কেন? কেন ওই নির্দোষ অরণ্যচারীদের পুড়িয়ে মারব আমরা?’ ক্রোধে ফেটে পড়ে চিৎকার করে উঠল ভীম
জননী কুন্তী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘চুপ চুপ বৃকোদর। আস্তে। কেউ শুনতে পাবে। তোমার দাদা এমনি এমনি বলছে না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।’
‘তুমিও মা একথা বলছ! তুমি না জননী! তোমার না ওই নিষাদ রমণীটির মতো পাঁচটি পুত্র আছে! আজ দুর্যোধন আমাদের পুড়িয়ে মারবার জন্য পুরোচনকে লেলিয়ে দিয়েছে বলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছ, সেই ভুক্তভোগী তুমি ওই নিরীহ নিষাদদের হত্যা করাকে সমর্থন করছ! বাহ্, মা বাহ্! তোমার প্রশংসা না করে পারছি না!’ বলে ভীমবেগে গৃহ থেকে বেরিয়ে গেল ভীম।
ছেলের কথা শুনে কুন্তীর চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। নিস্পৃহ চোখে নিষাদদের একবার দেখে নিল। তারপর যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে বলল, ‘বৃকোদরের বয়স কম। যা ভাবে, তা কারও তোয়াক্কা না করে বলে ফেলে। তোমার কাজগুলো তার হয়তো ভালো লাগেনি। তাই মুখের ওপর ওরকম করে বলে গেল। তুমি কিছু মনে করো না বাছা। তোমার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত।’
যুধিষ্ঠির বলল, ‘ঝটপট সুড়ঙ্গপথে পালানোর জন্য তৈরি হয়ে নাও। ও মা, কিছু খাবারও সঙ্গে নিয়ো।
অল্পক্ষণের মধ্যে দেখা গেল- পুরোচনের আবাসগৃহটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।
ছেচল্লিশ
অনতিবিলম্বে জতুগৃহেও আগুন লাগল। প্রচণ্ড, দুর্বিনীত হুতাশন। বাড়িটি, বাড়ির আশপাশের বৃক্ষসকল, খাদ্যগুদাম, বাগানের প্রস্ফুটিত-অর্ধপ্রস্ফুটিত পুষ্পগুলো এবং নিষাদজননীসহ তার পাঁচ পুত্রকে অনলশিখা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ফেলল।
ওদিকে সুড়ঙ্গপথে পঞ্চপাণ্ডব জননী কুন্তীকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। তাদের পদক্ষেপ অত্যন্ত দ্রুত। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে। উষ্ণ বাতাস। দম আটকে যাওয়ার উপক্রম। তারপরও থামার উপায় নেই। পেছনে জতুগৃহের সর্বগ্রাসী আগুন। আগুনস্পর্শে বাতাস অসহনীয়। সেই অগ্নিস্পর্শিত সমীরণ পেছনে ধাওয়া করে আসছে। থামলেই মৃত্যু অনিবার্য। এ সুড়ঙ্গপথ ফুরাতেই হবে— বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে যুধিষ্ঠির।
হঠাৎ কুন্তী আর্তনাদ করে উঠল, ‘ও মারে!’
ভীম পেছন ফিরে দেখল, মা পড়ে গেছে। তার শরীর কাদামাটিতে মাখামাখি। দ্রুত মায়ের কাছে এগিয়ে এলো ভীম, ‘কী হয়েছে মা? এমন করে পড়ে গেলে কেন?’
ভীমের হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কুন্তী বলল, ‘আচমকা পা হড়কে পড়ে গেলাম বাছা। আর হাঁটতে পারছি না আমি।’
ঝট করে মাকে কাঁধে তুলে নিল বৃকোদর। নকুল-সহদেব দুই ভাইকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরল। তারপর বায়ুবেগে চলতে শুরু করল।
একটা সময়ে পাতালপথ শেষ হলো। সুড়ঙ্গ থেকে একে একে বেরিয়ে এলো ওরা। প্রথমে যুধিষ্ঠির, তার পিছু পিছু অর্জুন। যুধিষ্ঠির বাইরে থেকে নির্ভয়ের সঙ্কেত দিলে সুড়ঙ্গমুখ থেকে কুন্তীসহ ভীম-নকুল-সহদেব বেরিয়ে এলো। বহুক্ষণ পর নির্মল সমীরণে শ্বাস ফেলতে পেরে সবাই স্বস্তিবোধ করল।
রাত তখন গভীরতর। পরিষ্কার আকাশ। সেখানে তারার জটলা। নিকটেই নদী। কুলকুল শব্দধ্বনি সবার কানে ভেসে এলো। খোলা আকাশের তলায় এসে দাঁড়াল সবাই। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে নদীপাড় তোলপাড়। এ বুঝি বাতাসের আওয়াজ নয়, এ বুঝি পুরোচনের আর্তনাদ! পুরোচন যেন করুণ কণ্ঠে বলছে, যুবরাজ যুধিষ্ঠির, আমাকে পুড়িয়ে মারলেন, ঠিক আছে। আমি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। মা কুন্তীসহ আপনাদের পাঁচ ভাইকে জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা নিয়ে বারণাবতে এসেছি আমি। মানি, আমি অপরাধী। আমাকে হত্যা করবার অধিকার আপনার আছে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। কিন্তু আমার বৃদ্ধ স্ত্রীটি, আমার তরুণী কন্যাটি, আমার যুবক ছেলেটিকে কেন দগ্ধ করে হত্যা করলেন যুবরাজ? ওরা তো কোনো অন্যায় করেনি!
নদীর কলধ্বনি নিষাদ রমণীটির কণ্ঠস্বর হয়ে ভীমের কর্ণকুহরে বেজে উঠল, বড় ক্ষুধার্ত ছিলাম রে বাবা আমরা! অভাবী অঞ্চলের মানুষ। সেখানে চাল মিলল তো আনাজ মিলল না। শিকার করার মতো পশুপাখি কমে আসছিল অরণ্যে। স্বামীটিরও বনের মধ্যে অঘোরে প্রাণ গেল। অনেকটা দিন খেয়ে না-খেয়ে কেটেছে আমাদের। বড় কষ্ট হচ্ছিল। ওই সময় আপনাদের মহাভোজের কথা শুনতে পেয়েছিলাম আমরা। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে ছুটে এসেছিলাম বারণাবতে, আপনাদের এই শিবগৃহে। যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের দয়া দেখে আমি বড় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বড় ছেলেটি আমার কানে কানে তো বলেই ফেলেছিল—মা উনি যুবরাজ নন, সাক্ষাৎ ভগবান। সেই ভগবান এক রাতেই জানোয়ার হয়ে গেলেন! কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ঈশ্বর কী করে রাতারাতি শয়তানে পরিবর্তিত হয়ে গেলেন! নির্বিকারভাবে আমাদের পুড়িয়ে মারবার আদেশ দিলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির! যুধিষ্ঠিরের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু তোমাদের মা কুন্তীর কথা বাদ দিই কীভাবে? সে তো জননী! সন্তান হারানোর ব্যথা কত গভীর, তা তো তার বোঝার কথা! সেই জননী কুন্তী যুধিষ্ঠিরের পুড়িয়ে মারার প্রস্তাবে একটুও বিচলিত হলো না! বিচলিত হওয়া তো দূরের কথা, যুধিষ্ঠিরের হত্যাপ্রস্তাবকে বিনাদ্বিধায় সমর্থন করে গেল! নীরব থাকা মানে তো সমর্থনই বোঝায়! ধিক তোমাদেরকে! ধিক তোমাদের রাজ্যলোভকে! নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছয়জন নিরপরাধ অরণ্যবাসীকে জ্বালিয়ে মারলে তোমরা! থু দিই তোমাদের মুখে। তোরা নাকি ন্যায়বান, সত্যের পক্ষের!
নিষাদ জননীর আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার ভীমের কানে আছড়ে পড়তে লাগল। যে নারী ‘আপনি’ সম্বোধনের মাধ্যমে তার কথা শুরু করেছিল, সে তার কথা শেষ করল ‘তুই’ দিয়ে। কতটুকু ঘৃণা করলে একজন নিষাদ নারী এ রকম করতে পারে? অন্যরা না বুঝলেও মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে লাগল ভীম। প্রচণ্ড গ্লানি তাকে বিবশ করতে শুরু করল। মনে মনে বলতে লাগল, কেন দাদা, কেন তুমি ওই নিষাদদের এ রকম করে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিলে? কেন তুমি আমাকে আদেশ দিলে ওদের অগ্নিদগ্ধ করবার জন্য? তুমি তো জানো দাদা, তোমাকে পিতার চেয়েও অধিক সম্মান করি আমি। তুমি এ-ও জানো, তোমার আদেশ কোনো অবস্থাতেই অগ্রাহ্য করব না আমি। সেই সুযোগটা তুমি নিলে দাদা! নির্দেশ দিলে পুরোচনের বাসগৃহে এবং জতুগৃহে আগুন দিতে। তা-ই করেছি আমি। করতে বাধ্য হয়েছি। তোমার প্রতি আমার আনুগত্যই এই কাজ করতে বাধ্য করেছে আমায়! আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর পরও তোমার এই অপকর্মের জন্য মানবজাতি তোমাকে নিন্দা জানাবে। শুধু তুমি তো নও, মানুষের নিন্দা আর ঘৃণার ভাগিদার আমিও। কারণ কৌশলে আমাকে দিয়েই তো তুমি এই অন্যায্য কার্যটি করিয়েছ!
‘ভীম, ভীম, এই বৃকোদর!’ ডেকে যাচ্ছে যুধিষ্ঠির।
ভীমের কোনো সাড়া নেই। কোন এক অলৌকিক জগতে হারিয়ে গেছে ভীম। দাদার সম্বোধন তার কানে ঢুকছে না। অগত্যা ভীমের গায়ে জোর একটা ঠেলা দিল যুধিষ্ঠির।
বলল, ‘কী রে বৃকোদর! কোথায় হারিয়ে গেল তোমার মন?’
ভীম বাস্তবে ফিরল। লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘না না দাদা, একটু তন্দ্রা এসেছিল, এই যা।’
‘তাই বলো ভীম, আমি মনে করলাম- অন্য কিছু।’
তারপর কণ্ঠকে চিকন করে যুধিষ্ঠির বলল, ‘এই দেখ, এর নাম চরণ। ও আমাদের পথ দেখিয়ে নৌকা পর্যন্ত নিয়ে যাবে।’
ভীম চোখ বড় করে চরণের দিকে তাকাল।
যুধিষ্ঠির বলল, ‘চরণ আমাদের লোক। কাকা বিদুরের গুপ্তচর। ওর ওপর দায়িত্ব পড়েছে নিরাপদে জলযান পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দেওয়ার!’
চরণ বিনয়ে কুঁজো হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রাজপুত্র, মহামান্য বিদুর আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। নদীতীরে নৌকা বাঁধা আছে। নৌকায় দাঁড়ি-মাঝি প্রস্তুত। আপনারা পৌঁছলেই তরণী নদীতীর ছেড়ে যাবে। আমার দায়িত্ব নৌকা পর্যন্ত। নৌকায় আরোহণ করলে মাঝি আপনাদের গন্তব্য জানিয়ে দেবে—এ রকমই বলেছেন মহামান্য বিদুর আমাকে। আর বলেছেন, সতর্ক থাকতে। জতুগৃহ দগ্ধ হওয়ার পর দুর্যোধন আপনাদের হন্যে হয়ে খুঁজতে পারে।’ বলে সামনে এগোতে শুরু করল চরণ।
নদীতীরে পৌঁছে গেল তারা।
নিচ থেকে মাঝি অনুচ্চ কণ্ঠে সাবধান করল, ‘দেখে-শুনে নামবেন মাননীয় যুবরাজ। জননীকে ধরে ধরে নামাবেন। নদীপাড় ঢালু আর গর্ত গর্ত। হুমড়ি খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
নৌকায় সবাই আরোহণ করলে প্রণাম জানিয়ে চরণ বিদায় নিল।
মাঝি যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ করে বলল, ‘মহামান্য বিদুর আপনাদের আলিঙ্গন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আপনারা অবশ্যই কর্ণ-দুর্যোধন-শকুনিকে পরাজিত করবেন।’ তারপর একটু থামল মাঝি। আশ্বাসের কণ্ঠে বলল, ‘এই তরণী আপনাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে। এখানে আপনারা নিরাপদ। মহামান্য বিদুরের আশীর্বাদপুষ্ট আমরা। আপনাদের নির্বিঘ্ন রাখাই আমাদের কাজ।’
এরপর মাল্লারা নদীজলে দাঁড় ফেলল। পালে বাতাস লাগল। তরণী দ্রুত বেগে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল।
নানা আঁকবাঁক ঘুরে তরণীটি শেষপর্যন্ত নদীর অপর পাড়ের এক নির্জন স্থানে এসে ভিড়ল। মাঝিটি নেমে পাণ্ডবদের বেশ কিছুদূর সামনের দিকে এগিয়ে দিল। বড় একটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ডান হাত তুলে দূরের একটা স্থান নির্দেশ করে বলল, ‘ওই যে দূরে দেখছেন, ওটা একচক্রানগরী। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আপনারা ওখানে অবস্থান করবেন। আপনাদের ছদ্মবেশে থাকবারই নির্দেশ আছে। ওখানকার কেউ যাতে আপনাদের আসল পরিচয় জানতে না পারে।’
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে বিদায় নিল মাঝি।
সাতচল্লিশ
প্রথমে আকাশঢাকা ধূম্রকুণ্ডলী। পরে লেলিহান অগ্নিশিখা। যেন শত সহস্র ফণা বিস্তার করে বিকটাকার ক্ষুধার্ত এক ফণিনী নক্ষত্রলোকের সব কিছুকে গ্রাস করবার জন্য ঊর্ধ্বাকাশের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে।
পুড়ছে মন্ত্রী পুরোচনের বাসগৃহ। পুড়ছে পুরোচন। পুড়ছে তার স্ত্রী। পুড়ছে তাদের স্বপ্নসাধের সন্তানরা। বাতাসে লাশের গন্ধ।
আর পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছে জতুগৃহ। সঙ্গে অঙ্গার হচ্ছে নিষাদ জননীটি, তার অসহায় পাঁচটি পুত্রসহ। পেটের জ্বালা মেটাতে এসেছিল ওরা, শিবগৃহে। যুধিষ্ঠির ওদের দেহজ্বালাও মিটিয়ে দিল। গভীর নিস্তব্ধ এই রাত্রিতে ভয়ংকর ওই বহোৎসব দেখে নগরবাসীরা প্রথমে কিছুই অনুমান করতে পারল না। বুঝে উঠতে পারল না—এ কীসের আগুন, কোথাকার আগুন। অনুমান করতে না-পারার পেছনেও একটা কারণ আছে। শিবগৃহটি মূল নগরের বাইরে, অরণ্যঘেঁষে। ওদিকে তেমন কোনো লোকালয় নেই। রাজকীয় ওই বাড়িটি ছাড়া আশপাশে সাধারণের কোনো বসতবাড়ি নেই। ওই জায়গাটি রাজাধিকারে। ওদিকে সাধারণ নাগরিকেরও তেমন যাতায়াত নেই। তাই আগুন লাগার স্থানটি নির্ধারণ করতে একটু সময় লেগে গেল সবার। অতঃপর একটা সময়ে আন্দাজ করল—শিবগৃহ হতে পারে।
সবাই হাহাকার করে উঠল। বুক চাপড়াতে লাগল অনেকেই—হায় হায়! ওখানে তো আমাদের যুবরাজ থাকেন! তাঁর জননী, তাঁর ভাইয়েরাও তো একই বাড়িতে থাকেন! এ কী হলো! এ কী ঘটে গেল শিবগৃহে!
চাইলে এখনই রওনা দেওয়া যাবে না শিবগৃহের উদ্দেশে। আগুনশিখা দেখে যত কাছে মনে হচ্ছে, তত কাছে তো নয় বাড়িটি! তাছাড়া অরণ্যপথ, সাপের মতো আঁকাবাঁকা। সমতলও নয় রাস্তা, বন্ধুর। এত গভীর রাতে যানবাহন কোথায় যে যাব! রাত তো শেষ হয়ে এলো! একটু ধৈর্য ধরো। আলো ফুটলেই রওনা দেওয়া যাবে। হায় হায়! হস্তিনাপুর আজ যুবরাজ শূন্য হয়ে পড়ল! পাণ্ডববংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আজ!
সাধারণ নাগরিক যা-ই বলুক, বারণাবতের রাজকর্মচারীরা ঘোড়া আর রথ ছোটাল শিবগৃহের দিকে। কিন্তু পৌঁছতে অনেক বিলম্ব করে ফেলেছে তারা। তারা অকুস্থলে পৌঁছনোর আগেই সব কিছু জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে গেছে।
সকালে মানুষের ভিড় লেগে গেল জতুগৃহ ঘিরে। খুব যে কাছে ঘেঁষতে পারল নাগরিকরা, তা নয়। কারণ তখনো এখানে ওখানে আগুন জ্বলছিল। আগুন সুতীব্র নয়, তবে সহনীয়ও নয়। দূর থেকে নাগরিকরা দেখল—অনতিদূরের দুটি বাড়ি পুড়ে প্রায়-ভস্ম হয়ে গেছে। এধারে ওধারে শক্তমতন আধপোড়া দু-চারটা খুঁটি দাঁড়িয়ে, গুগুলোর গায়ে গায়ে তখনো আগুনের ফুলকি। উৎসুক মানুষেরা ভেতরের খবর জানতে চায়—যুবরাজের কী হলো? ভাইয়েরা বেঁচে আছেন তো! জননী কুন্তী? তাঁর সংবাদ কী? ওই যে ওদিকের বাড়িটিতে তো মন্ত্রীবর পুরোচন সপরিবারে থাকতেন! তাঁরা কুশলে আছেন তো? এ রকম শত সহস্র প্রশ্ন করে যাচ্ছে বারণাবতবাসীরা। কিন্তু উত্তর মিলছে না।
রাজকীয় অগ্নিনির্বাপক দল সেই শেষরাত থেকে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তেমন কিছু করতে পারেনি তারা। এই টিলা-অঞ্চলে জলের প্রাচুর্য নেই। আশেপাশে কোনো সরোবর নেই, অন্য কোনো জলাশয়ও নেই এখানে। যা কিছু সঞ্চিত জল ছিল, তা দিয়ে জতুগৃহের দাউ দাউটা কমানো গেছে। একটা সময়ে আপনাতে নিবতে শুরু করেছে আগুন। হুতাশনের খাদ্য তখন ফুরিয়ে গেছে যে!
অনেকক্ষণ পর অগ্নিনির্বাপক দলের প্রধান সামনে এগিয়ে এলো। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে মানুষের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়ে গেল।
দলপ্রধান করুণ কণ্ঠে বলল, ‘সব শেষ।’
সবাই চিৎকার করে উঠল, ‘সব শেষ মানে!’
‘আমাদের যুবরাজ যুধিষ্ঠির, তাঁর জননী এবং তাঁর অন্য চার ভাই আগুনে…।’ হু হু করে কেঁদে উঠল দলপ্রধান
‘আগুনে! আগুনে!’ চেঁচামেচি করে উঠল সকলে।
ব্যাকুলতা থামিয়ে দলনেতা বলল, ‘সবাই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছেন। ওই শিবগৃহে তাঁদের পোড়াদেহ খুঁজে পেয়েছি আমরা। একজন নারী, পাঁচজন পুরুষ। চেনার উপায় নেই। কোনটা কার দেহ।’
সমবেতদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল।
ওই অবস্থাতেই পেছন থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আর মন্ত্রীবর পুরোচন? তাঁর পরিবার- পরিজনের কী হলো?’
ম্রিয়মাণ কণ্ঠে দলপ্রধান বলল, ‘তাঁদেরও পাণ্ডবপুত্র আর জননী কুন্তীর মতো হাল হয়েছে।’
.
অনতিবিলম্বে হস্তিনাপুরে এই শোকসংবাদটি পৌঁছল—জতুগৃহের আগুনে দগ্ধ হয়ে জননী কুন্তী এবং পাণ্ডুপুত্ররা মারা গেছে। আধপোড়া কাঠ ও ছাইয়ের নিচে তাঁদের জ্বলে যাওয়া দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। আর মন্ত্রী পুরোচনও বেঁচে নেই। তিনিও সপরিবারে ভস্মীভূত হয়েছেন।
গভীর শোকের ছায়া নামল হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে। ধৃতরাষ্ট্র ভ্রাতুষ্পুত্রদের মৃত্যুসংবাদ শুনে প্রকৃত অর্থেই ভেঙে পড়লেন। নারীমহলে হাহাকার ধ্বনি উঠল। বিলাপ-ব্যাকুল হয়ে উঠল গান্ধারী। দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্য-ভীষ্ম অতলান্ত শোকগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
দুর্যোধনের চোখেমুখেও শোকচিহ্ন দেখা গেল। তবে গভীর চোখে তাকালে বোঝা যাবে— সেই শোকাচ্ছন্নতার অন্তরালে আনন্দ ঝিলিক তুলছে।
বিদুরের কৃত্রিম শোকের ব্যাপারটি একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। সে যেন সত্যি সত্যি প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন। তাকে অভিনিবেশী চোখে দেখেও বোঝার কোনো উপায় নেই যে এ লোকদেখানো শোক। মস্তবড় খেলুড়ে এই বিদুর। সব কিছু জেনেও সবার চাইতে অধিক কষ্ট পাচ্ছে যেন সে! চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল তো ঝরছেই, মাঝে মাঝে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
ধৃতরাষ্ট্র খুব ধুমধাম করে পাণ্ডবদের শ্রাদ্ধক্রিয়ার আয়োজন করল। কৌরববাড়ির সবার বিলাপের মধ্য দিয়ে শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন হলো। কৌরবপরিজনরা এমন ব্যাকুল হয়ে উঠল যে ওদের সংযত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে একজন লোককে খুব সংহত দেখা গেল, সে বিদুর। প্রচণ্ড ঝড়ের পর যেমন পৃথিবী একেবারে শান্ত হয়ে যায়, বিদুরকেও তদ্রূপ দেখা গেল। একেবারেই শীতল, একেবারেই নির্বিকার।
শ্রাদ্ধশান্তি চুকেবুকে গেলে দুর্যোধন নিজ ক্ষমতা সংহত করার দিকে মনোযোগ দিল। সে জতুগৃহের কথা একবারও ভাবল না। ভাবল না যে জতুগৃহ দগ্ধ করার নির্দেশ তো সে পুরোচনের কাছে পাঠায়নি! তা হলে পুরোচন তার নির্দেশের অপেক্ষা না করে জতুগৃহে আগুন লাগাল কেন? নিজের সিদ্ধান্তে লাগাল? যে লোক তার নির্দেশের জন্য বছরাধিককাল অপেক্ষা করে থেকেছে, সে কী করে তার নির্দেশ ছাড়া জতুগৃহে আগুন দিল? এও কী সম্ভব? দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত মন্ত্রী পুরোচন এ রকম আবাধ্যতা করতে পারে?
দুর্যোধন ভাবল না যে হঠাৎ এই আগুনলাগার পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না? প্রাপ্ত অঙ্গারময় দেহগুলোও শনাক্ত করার ব্যবস্থা নিল না দুর্যোধন। যদি নিত তা হলে কুরু-ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো।
দুর্যোধন প্রথমে নজর দিল রাজক্ষমতা সংহত করার দিকে। পিতাশ্রীর সমর্থনে নিজেকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা দিল। মন্ত্রী-রাজন্যদের মধ্যে যারা পাণ্ডবপক্ষীয় ছিল, তাদের একে একে বিদায় করল। দোর্দণ্ডপ্রতাপে কুরুরাজসভায় নিজের আসন পাকা করে ফেলল। পিতামহ ভীষ্ম আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়লেন। দ্রোণাচার্য নিস্পৃহ থাকলেন। সুযোগ বুঝে কৃপাচার্য দুর্যোধনের দলে ভিড়ে গেলেন।
দুর্যোধনের দল তখন অনেক ভারী। কর্ণ এখন তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সুহৃদ, মামা শকুনি প্রধান পরামর্শদাতা, গুরুপুত্র অশ্বত্থামা তার প্রধান সহচর। এদের পরামর্শ-সহযোগিতায় দুর্যোধন রাজপ্রাসাদ নিষ্কণ্টক করল।
কিন্তু সর্বাংশে নিষ্কণ্টক করতে পারল কি দুর্যোধন? পারল না। পারল না পিতা ধৃতরাষ্ট্রের জন্য। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পূর্বাপর বিদুরের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে আসছে। তাই ঘরের শত্রু বিভীষণ জেনেও বিদুরকে সহ্য করে যেতে লাগল দুর্যোধন।
ক্রমে ক্রমে হস্তিনাপুরের রাজসভার অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, কিন্তু রাজ্য চলে দুর্যোধনের নির্দেশনায়। ধৃতরাষ্ট্রের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত দুর্যোধনের মনমতো না হলে পিতাকে বুঝিয়ে, কখনো কখনো গায়ের জোরে নিজের সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেয় দুর্যোধন। স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের অন্যায় মেনে নেয়। এতে অন্যরা ক্ষুব্ধ হলেও ধৃতরাষ্ট্র তাদের ক্ষুব্ধতাকে উপেক্ষা করে।
একটা সময়ে দুর্যোধন হস্তিনাপুরের প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেল।
আটচল্লিশ
বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলো।
পাণ্ডবদের দেখে এখন চেনার উপায় নেই। তাদের বেশ-বোল একেবারে পালটে গেছে। তারা আজ দারিদ্র্যপীড়িত ব্রাহ্মণ। কুন্তী চালচুলাহীন পাঁচ ব্রাহ্মণপুত্রের অসহায় বিধবা জননী। সারাদিনের ভিক্ষালব্ধ কাঁড়া-আকাড়া চাল এনে দিলে ব্রাহ্মণজননী রেঁধে দেয়। পুত্ররা সারি হয়ে বসে বেলান্তে আহার করে। দীর্ঘ চুল, লম্বা শ্মশ্রু সবার, কাঁধজড়ানো বামুনপৈতে।
লোকালয়ের মানুষেরা কোনোক্রমেই চিনতে পারল না যে ওরা ছদ্মবেশী পাণ্ডব।
একদিন তারা শুনল — পাঞ্চালনগরীতে স্বয়ংবরসভা বসবে। পাঞ্চালরাজা দ্রুপদকন্যা দ্রৌপদী তার পছন্দমতো যুবকের গলায় মাল্য দেবে। যুধিষ্ঠির ভাবল—এই তো সুযোগ! কোনোভাবে যদি দ্রৌপদী পাঁচ ভাইয়ের কাউকে পছন্দ করে ফেলে, তা হলে কেল্লা ফতে! দ্রুপদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হবে। কে না জানে—বর্তমানের ভারতবর্ষে রাজা দ্রুপদ সামরিক শক্তিতে অনেক বেশি শক্তিশালী।
একচক্রানগরী থেকে পাঞ্চালনগরীর দিকে এগিয়ে গেল যুধিষ্ঠির, ভাইদের নিয়ে।
স্বয়ংবরসভা তখন শুরু হয়ে গেছে। বৃত্তাকারে বহু মূল্যবান আসন পাতা। সেখানে দেশ-বিদেশের দ্রৌপদী-প্রত্যাশী রাজারা, যুবরাজরা, রাজন্যপুত্ররা। দুর্যোধনও উপস্থিত সেখানে; সঙ্গে কর্ণ, শকুনী এবং ভাই দুঃশাসন। দ্রৌপদী-আশায় দুর্যোধনের আগমন, পাঞ্চালনগরীর স্বয়ংবরসভায়।
পাণ্ডবরা দানপ্রত্যাশী ব্রাহ্মণ দলে গিয়ে বসল। ব্রাহ্মণ ছাড়া তাদের তো অন্য কোনো পরিচয় নেই! তারা তো এখন দিন এনে দিন খাওয়া বামুন ছাড়া আর কিছু নয়!
স্বয়ংবরসভা যখন গমগম করছে, তখন দাদা বলরামসহ কৃষ্ণ ওখানে উপস্থিত হলো।
রাজা দ্রুপদ ঘোষণা করল, যে ব্যক্তি ওই আকাশযন্ত্রের ভেতর দিয়ে পঞ্চবাণ যোজনা করে লক্ষ্যবস্তু বিদ্ধ করবে, তাকেই দ্রৌপদী বর হিসেবে গ্রহণ করবে। আগেই কৃত্রিম আকাশযন্ত্র এবং দুর্জয় ধেনুটি নির্মাণ করে রেখেছিল রাজা দ্রুপদ।
অনেকে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। ব্যর্থদের একজন দুর্যোধনও। কর্ণ এগিয়ে এলো। দুর্ধর্ষ ধনুর্বিদ কর্ণকে চিনত দ্রৌপদী। কর্ণকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রৌপদী বলে উঠল, ‘হীনজাতির সূতপুত্রকে আমি কখনো বিয়ে করব না।’
অপমানিত কর্ণ সে স্থান ত্যাগ করে গেল। ক্ষত্রিয়কুলের সবাই ব্যর্থ হলে ফাঁপরে পড়ল রাজা দ্রুপদ।
বলল, ‘ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সবার জন্য প্রতিযোগিতার দ্বার খুলে দেওয়া হলো।’
উসখুস করে উঠল অর্জুন। যুধিষ্ঠিরের চোখ এড়াল না। আরেকজনেরও চোখ এড়াল না, সে কৃষ্ণ। দারিদ্র্যপীড়িত ব্রাহ্মণদের মধ্যে ছদ্মবেশে বসে থাকলেও পাণ্ডবদের চিনতে কৃষ্ণের ভুল হলো না।
দাদা বলরামকে আঙুল-ইশারায় দেখিয়ে কৃষ্ণ বলল, ‘ও যুধিষ্ঠির। আর তার পাশে যে বলবান মতন একজনকে দেখছেন, সে ভীম। আর দিব্যকান্তির যে শ্মশ্রুমণ্ডিত যুবকটিকে দেখতে পাচ্ছেন, ও অর্জুনই।’
ঘটনা এটা যে কৃষ্ণ কখনো এর আগে পিসতুতো এই ভাইদের দেখেনি। শুধু নানা সময়ে তাদের বর্ণনা শুনেছে। জ্ঞাতিশত্রুতার কথাও কৃষ্ণের অজানা থাকেনি। কিন্তু কথায় বলে না, যে চেনার সে ঠিকই চিনে নেয়। কৃষ্ণও বামুন দলের মাঝখানে বসে থাকা ছন্নছাড়া পরিচ্ছদের পাণ্ডবদের চিনতে ভুল করেনি।
ইত্যবসরে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে ইঙ্গিত করেছে আকাশযন্ত্র আর দুর্জয় ধনুটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। অর্জুন ইতস্তত না করে এগিয়ে গেল এবং অতি সহজেই ধনুতে তির যোজনা করে লক্ষ্যবস্তু বিদ্ধ করল।
দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় মালা দিল।
উপস্থিত রাজা-রাজপুত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ একটু হলো বটে, ভীম-অর্জুন সহজেই তাদের পরাস্ত করে ছাড়ল।
পাণ্ডবদের পরিচয় সর্বজনে বিদিত হলো।
পাণ্ডবদের প্রকৃত পরিচয় জেনে খুবই সন্তুষ্ট হলো রাজা দ্রুপদ এবং তার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন। উভয়ে ভাবল—বড় একটা সামরিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে পারল তারা এবং বহুদিন পরে হলেও দ্রোণাচার্যের লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতে পারবে আর প্রতিশোধ নিতে পারবে দ্রোণাচার্যের সেই প্রিয় ছাত্রদের দিয়েই।
কৃষ্ণ এগিয়ে গিয়েছিল পাণ্ডবদের কাছে। বলেছিল, ‘তোমরা আমার নিকটাত্মীয়। তোমাদের মা কুন্তী আমার পিসি। আমার বাবা বসুদেবের দিদি তিনি।’
অর্জুনরা প্রণামের জন্য উপুড় হতে চাইলে পঞ্চপাণ্ডবকে বুকে টেনে নিল কৃষ্ণ।
শ্যামাঙ্গী দ্রৌপদী তখন অর্জুনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ মৃদু হাসল। বলল, ‘জানি, তোমার নাম দ্রৌপদী হলেও অনেকে তোমাকে কৃষ্ণা নামে ডাকে। তুমি কৃষ্ণা, আমি কৃষ্ণ। আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে। ও হ্যাঁ, যাদববংশে জন্ম আমার। তোমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে আমরা আসিনি। আমি আর দাদা বলরাম এসেছি, তোমাদের সাক্ষাতের আশায়।’ শেষ কথাটি যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে বলল কৃষ্ণ।
এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রৌপদীর সমভিব্যহারে জননী কুন্তীর কাছে গেল পাণ্ডবরা।
কুন্তী তখন গৃহাভ্যন্তরে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত।
বাহির থেকে আনন্দে-উদ্ভাসিত কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বলল, ‘মা, আজ আমরা এক রমণীয় পদার্থ ভিক্ষা করে পেয়েছি।’
মা ভেতর থেকে বলল, ‘সকল ভাই সমানভাবে ভোগ করো।’
দ্রুত বেরিয়ে এসে দ্রৌপদীকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল কুন্তী। ওই অবস্থাতেই বলে উঠল, ‘এ আমি কী বললাম! যুধিষ্ঠির, তুমিই বা কী বললে আমায়! জ্বলজ্যান্ত এক তরুণীকে পদার্থ বললে!’
কুন্তীর পরবর্তী কাজগুলো কৃত্রিমতায় ভরা। চোখেমুখে বিপন্নতার ভাব ফুটিয়ে তুলল। ধর্মভয়ে ভীষণ ব্যাকুল দেখাল কুন্তীকে। কুন্তী স্নেহভরে অর্জুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দ্রৌপদীর হাত ধরল। টানতে টানতে যুধিষ্ঠিরের অতি নিকটে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘বুঝতে পারছি, এই কন্যাকে তোমরা স্বয়ংবরসভা থেকে জয় করে এনেছ। একজনের প্রতিই তো আসক্ত হয়েছে মেয়েটি! তার গলায় মালাও পরিয়েছে নিশ্চয়ই সে। কিন্তু যুধিষ্ঠির, তুমি কেন রক্ত মাংসের এই সুন্দরী তরুণীকে পদার্থ বললে?’
যুধিষ্ঠির আর কী বলবে, চুপ করে থাকল। আসল কথা তো এই— স্বয়ংবরসভায় দ্রৌপদীকে দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল যুধিষ্ঠিরের। হৃদয় চুরমার করে দেওয়া রূপ দ্রৌপদীর। এমন রূপময়ী নারীকে কে না শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে চায়? যুধিষ্ঠিরও মনে মনে দ্রৌপদীকে কামনা করছিল ভীষণ। কিন্তু ঘটনাচক্রে দ্রৌপদী অর্জুনকেই স্বামী হিসেবে বরণ করল। প্রথম দিকে হতোদ্যম হয়ে পড়লেও একেবারে আশা ছাড়েনি যুধিষ্ঠির। ফন্দি একটা আঁটল সে, তবে মনে মনে। ভালো মানুষের মুখ করে আবাসগৃহের উঠান পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল। তারপর ওই ফন্দিমূলক বাক্যটি, যে বাক্যে দ্রৌপদী নারী না হয়ে পদার্থ হয়ে গেছে।
বাক্যের করণকৌশল ঘরের ভেতর থেকে বুঝতে পারেনি কুন্তী। বলেছে—তোমরা সব ভাই মিলে ভাগ করে খাও।
বাইরে এসে পরিস্থিতি বুঝে কুন্তী নিজের কথাটি তুলে নিতে পারত। বলতে পারত, অর্জুন জয় করেছে, দ্রৌপদী অর্জুনেরই। কিন্তু কুন্তী তা করল না। যুধিষ্ঠিরের চোখমুখের দিকে তাকিয়েই কুন্তী তার নির্দেশ ফিরিয়ে নিল না। যুধিষ্ঠিরের চোখেমুখে যে তখন দ্রৌপদীকে পাওয়ার লালসা জান্তব হয়ে উঠেছে! বড় ছেলেটিকে বড় ভালোবাসে কুন্তী। তার মনে কষ্ট দিতে চাইল না সে। তাই তো পাকা অভিনেত্রীর মতো দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের কাছে টেনে নিয়ে যাওয়া! মৃদু ভর্ৎসনা করতেও ছাড়ল না কুন্তী।
তার পর কণ্ঠে গভীর আবেগ ঢেলে বলল, ‘দেখো বাছা, তোমার ওই এক মিথ্যের জন্য কত বড় সমস্যা তৈরি হয়ে গেল দেখো! কিন্তু মায়ের কথারও তো একটা মূল্য আছে! এখন তুমি দেখো, আমার বাক্য যেন মিথ্যা হয়ে না যায়।’ এক নারী দিয়ে পাঁচপুত্রকে একসুতায় বেঁধে রাখার সুযোগটা হারাতে চায় না কুন্তী।
মায়ের কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের চোখ চকচক করে উঠল। অপূর্ব উত্তেজনায় নেচে উঠতে ইচ্ছে করল তার। কঠোর হাতে নিজেকে দমন করল। নিজেকে লুকাবার জন্য মাথা নিচু করল যুধিষ্ঠির।
ওই সময় অর্জুন কিছু একটা বলতে চাইল। যুধিষ্ঠিরের আবেগাপ্লুত বাক্যের তলায় অর্জুনের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। যুধিষ্ঠির বলল, ‘তোমার কথার ব্যত্যয় ঘটতে দেব না মা আমি।’
‘তাই কর বাছা। এমন বিধান বের করো যাতে অধর্ম দ্রুপদনন্দিনীকে স্পর্শ না করে আর আমার বাক্য যাতে অনৃতকথা না হয়ে যায়।’ বলল কুন্তী।
ঠিক হলো- দ্রৌপদী পাঁচ ভাইয়েরই স্ত্রী হবে। প্রত্যেকের সঙ্গে এক বছর করে, সহবাস করবে। অন্য চার ভাই তখন দ্রৌপদীর সঙ্গে ভাশুরের মতো আচরণ করবে।
বড় ভাইয়েরই অগ্রাধিকার। সেই হিসেবে যুধিষ্ঠিরই দ্রৌপদীকে প্রথমে ভোগ করার অধিকার পেল।
যে অর্জুনকে পছন্দ করে দ্রৌপদী স্বামী হিসেবে বরণমাল্য পরিয়েছিল, সে পড়ে রইল ভীমের ও পশ্চাতে।
মধ্যমাগ্রজ হওয়ার কারণে দ্রৌপদী নামের শয্যাসঙ্গিনীটিতে যুধিষ্ঠিরের পর ভাগ বসাবে ভীম।
উনপঞ্চাশ
পাণ্ডবদের দ্রৌপদীজয়ের কথাটি গোপন থাকেনি।
চারদিকে রাষ্ট্র হয়েছে। কথাটি অচিরেই বিদুরের কানে এসে পৌঁছেছে। গুপ্তচরের মাধ্যমে বিদুর এ-ও জেনে গেছে যে দুর্যোধন আর কর্ণ দ্রুপদরাজের স্বয়ংবরসভা থেকে হতদর্প হয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছে।
এতদিন খোলসে থাকা বিদুর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এখনই তো তার ছদ্ম আবরণ ত্যাগ করার সময়! প্রথমেই তার মনে পড়ে গেল ধৃতরাষ্ট্রের কথা। প্রথম ঘা-টা যে ওখানেই দিতে হবে! ধৃতরাষ্ট্রকে দুঃখ আর হতাশায় জর্জরিত করতে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ছুটে গেল।
ধৃতরাষ্ট্র জানে না—পাণ্ডুপুত্ররা আবিষ্কৃত হয়েছে। দুর্যোধনও জানে, জতুগৃহের আগুনে পাণ্ডবরা মারা গেছে। স্বয়ংবরসভাতেও বুঝতে পারেনি দুর্যোধনরা। ভেবে নিয়েছে-ছন্নছাড়া ওই তরুণটি, যে দ্রৌপদীকে জিতে নিল, সে সাধারণ একজন বামুন ছাড়া আর কিছুই নয়। ফিরতে ফিরতে অবশ্য দুর্যোধন-কর্ণাদির মধ্যে এই কথা হলো যে, নাহ্, বামুনটার অস্ত্রদক্ষতা আছে বটে। ব্যস ওইটুকুই। এর বেশি কিছু কৌরবরা জানে না, যা জানে বিদুর। ওই জানাটুকু নিয়েই বিদুর ছুটে গেল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। ধৃতরাষ্ট্র তখন সিংহাসনে আসীন। তার দুদিকে ভীষ্ম, দ্রোণ কৃপ এবং অন্য রাজন্যরা।
বিদুর ভালোমানুষের মতো মুখ করে ধৃতরাষ্ট্রকে বলল, ‘মহারাজ, কুরুদের এবার বেশ বাড়-বাড়ন্ত হলো।’ বিদুরের এই কথায় গভীর এক শ্লেষ ছিল। পাণ্ডবদের বোঝাতে গিয়ে বিদুর ইচ্ছে করে ‘কুরু’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। যদিও পাণ্ডবরা নিজেদের কুরু বলে পরিচয় দেয় না, বলে -ওরা পাণ্ডব। কিন্তু বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বক্রোক্তি করতে গিয়ে ‘কুরু’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। কুরুবংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে পাণ্ডবরাও তো কুরু! বিদুর সেই অর্থে পাণ্ডবদের এই আখ্যা দিয়েছে।
কিন্তু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বুঝে নিয়েছে অন্য। সবার মতো মহারাজও জানে, হস্তিনাপুরে কৌরব বলতে দুর্যোধন আর তার ভাইদের বোঝানো হয়। তাই ‘কুরুদের বাড়-বাড়ন্ত’–এই কথা শুনে অন্ধরাজা খুবই খুশি হয়ে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ তো! হ্যাঁ তো! এ তো আমাদের বিরাট সৌভাগ্য!’
পাঞ্চালনগরীতে ঘটে যাওয়ার ঘটনার কিছুই জানে না রাজা। ধরে নিয়েছে- বড় ছেলে দুর্যোধনের সঙ্গেই বিদগ্ধা দ্রৌপদীর বিয়ে হয়েছে।
আবেগে আপ্লুত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীর জন্য বহুতর গহনা আনার নির্দেশ দিল আর পুত্র দুর্যোধনকে অতি শিগগির রাজসভায় ডেকে আনতে বলল।
মুহূর্তেই ধৃতরাষ্ট্রের ভুল ভেঙে দিল বিদুর। তার কণ্ঠস্বরে তখন শ্লেষ নেই, আছে প্রচ্ছন্ন এক কৌতুক। বলল, ‘আপনার ভুল হচ্ছে মহারাজ। দ্রৌপদী দুর্যোধনকে বরণ করেনি, বরণ করেছে পাণ্ডবদের।’
‘পাণ্ডবদের!’ বলে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল ধৃতরাষ্ট্র।
পাঞ্চালের স্বয়ংবরসভায় পাণ্ডবরা এলো কোত্থেকে? ওরা না জতুগৃহে ভস্মীভূত হয়েছে? তা হলে! পাণ্ডুপুত্ররা শেষ পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়নি! বেঁচে আছে ওরা! বেঁচে তো আছে নিশ্চয়ই! নইলে বিদুর এ কথা বলে কী করে!
এখন, এই মুহূর্তে, এই পরিস্থিতিতে তার কী করা উচিত! এক লহমায় ধৃতরাষ্ট্র তার করণীয় ঠিক করে ফেলল।
ধৃতরাষ্ট্র বলে উঠল, ‘এ জগতে কে আছে যে দ্রুপদকে বন্ধু হিসেবে না চায়! দ্রুপদ এখন পাণ্ডবদের শ্বশুর হলো, আমাদের পরমাত্মীয় হয়ে গেল সে। রাজশক্তি হিসেবে দ্রুপদ তো মোটেই ফেলনা নয়!’
মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে দ্রোণাচার্যের চোখমুখ আঁধার হয়ে গেল। দ্রুপদকে হাড়ে হাড়ে চেনেন তিনি। এবার সে অপমানের প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে উঠবে। প্রিয় ছাত্রটিকেই হয়তো তাঁর পেছনে লাগাবে!
পিতার কথা শুনে দুর্যোধন ফুঁসে উঠল। একটু আগেই সে কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে দরবারে উপস্থিত হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্রকে সে সোজা কণ্ঠে বলল, ‘এ কী ধরনের কথা পিতাশ্রী আপনার? শেষ পর্যন্ত শত্রুর প্রশংসাই শুরু করলেন আপনি? কোথায় আপনি দেখবেন, যাতে পাণ্ডবরা আমাদের গ্রাস করতে না পারে, সেখানে আপনি পরোক্ষে পাণ্ডুপুত্রদের প্রশংসা শুরু করলেন?’
ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে বলল, আহা রে বালক দুর্যোধন, তোমার অর্বাচীনতা এখনো কাটল না! রাজনীতির গভীর চালগুলো এখনো তুমি বুঝে উঠতে পারলে না দুর্যোধন! আরে বেটা, একে বলে অভিনয়! আমার অভিনয়টা বুঝে উঠতে পারছিস না তুই! তোর মনে যা আছে, আমার মনেও তাই রে বাছা! আমি বিদুরসহ অন্যদের দেখাচ্ছিলাম মাত্র!
সেদিনের মতো সভাভঙ্গের আদেশ দিল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র।
.
রাতের একান্ত সভায় ধৃতরাষ্ট্রই প্রথমে বলল, ‘আজ দিনের রাজসভার সবটাই ছিল আমার অভিনয়। তা দুর্যোধন, তুমি বলো—কী ভাবছ? তোমার বন্ধু কর্ণই-বা কী ভাবছে?’
দুর্যোধন কিছু ঠিক করতে পারছে না। তার মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে বারবার? মৃত মানুষ জীবিত হয়-এও কি সম্ভব? যে পাণ্ডবরা তাদের মা-সহ বারণাবতের জতুগৃহে ভস্মীভূত হলো, তারা কী করে আবার পাঞ্চালরাজ্যে উপস্থিত হয়? হয়েছে তো। নইলে বিদুর কাকা বলে কী করে? গুপ্তচররা এসে জানায় কী করে-বিদুর কাকার কথা ঠিক! এখন কী করবে দুর্যোধন? তার বড় অস্থির অস্থির লাগছে। এতদিন নিজেকে শত্রুমুক্ত ভাবত, আজ দেখছে— সে তো শত্রুমুক্ত নয়ই, উপরন্তু আগের তুলনায় শত্রুরা অনেক বেশি শক্তিমান হয়ে উঠেছে।
এই অস্থিরতার মধ্যেই পিতাকে লক্ষ করে দুর্যোধন বলল, ‘আজই কিছু ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ দ্রুপদ রাজ্যে পাঠাব। ওদের দিয়ে কুন্তী আর মাদ্রীর ছেলেদের মধ্যে এমন বিভেদ সৃষ্টি করাব, যাতে ওরা পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয়। অথবা এমনও করা যায় বাবা, পাঞ্চালমন্ত্রীদের প্রচুর উৎকোচ খাইয়ে পাণ্ডুপুত্রদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। আর একটা কাজও করা যায়, দ্রৌপদীর মনকে বিষিয়ে তোলা। একজনকে বিয়ে করে পাঁচজনের ভোগ্য হওয়াতে এমনিতে দ্রৌপদীর মনটা তিক্ত হয়ে আছে। এই সুযোগে দ্রৌপদীর মনে পাণ্ডুপুত্রদের সম্পর্কে অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে আমাদের।’
দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে দুর্যোধনের কথা শুনে গেল ধৃতরাষ্ট্র। শেষে বলল, ‘তোমার এখন বিহ্বলতায় সময় কাটছে পুত্র। তুমি নিজেকে বড় বিপন্ন বোধ করছ এখন। তাই তুমি বুঝতে পারছ না, তোমার প্রস্তাবগুলো অত্যন্ত খেলো। একটা প্রস্তাবও বুদ্ধিপ্রসূত নয়। তুমি অন্য কিছু ভাব পুত্র।’
দুর্যোধন ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আগে ভীমটাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নিন। ওই ভীমটাই পাণ্ডবদের যত শক্তির উৎস। আপনারা যতই অর্জুন অর্জুন করেন না কেন, আমি মনে করি অর্জুনটা ওই বৃকোদরের বলে বলিয়ান। ও বেটা অর্জুন তো বন্ধু কর্ণের নখের যোগ্যি নয়। আপনি বরং পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে আনার জন্য কর্ণকে পাঠিয়ে দিন, পথিমধ্যে আমাদের লোক গিয়ে খুন করে আসবে পাণ্ডুপুত্রদের।’
দুর্যোধনের সকল প্রস্তাব একঝটকায় উড়িয়ে দিল বন্ধুবর কর্ণ। বলল, ‘তোমার বুদ্ধি কাজ করছে না দুর্যোধন।’ ততদিনে উভয়ের ঘনিষ্ঠতা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরস্পরকে তারা নাম ধরে সম্বোধন করে।
কর্ণ বলে গেল, ‘তুমি কিছু মনে করো না দুর্যোধন। তুমি যেসব প্রস্তাব দিলে তাদের কোনোটা দিয়েই ওদের কুপোকাত করা যাবে না। পাণ্ডবরা যখন অসহায় বাচ্চা ছিল, একটুও পাখা গজায়নি তখন তাদের, তখনই তাদের কোনো ক্ষতি করা যায়নি। আর এখন তো বিদেশের মাটিতে ওদের পুরো পাখা গজিয়ে গেছে। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ওদের সহায় হয়েছে। এখন তোমার ওসব কায়দায় ওদের কিছুই করতে পারবে না।’
দুর্যোধন থতমত খেয়ে গেল। দুর্যোধন কর্ণকে খুব মূল্যায়ন করে। ওই থতমত অবস্থাতেই দুর্যোধন জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে কী করতে বলো তুমি?’
কর্ণ বলল, ‘পাণ্ডবদের সহায় শুধু দ্রুপদ নয়, আর একজন আছে, সে কৃষ্ণ। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের নিকটআত্মীয়। যেকোনো সময় নিজের যাদববাহিনী নিয়ে দ্রুপদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে সে। তার আগে পাঞ্চালরাজ্য আক্রমণ করো। ধুলোয় মিশিয়ে দাও পাঞ্চালরাজ্য। দ্রুপদকে পরাস্ত করে পাণ্ডবদের বেঁধে এই হস্তিনাপুরে নিয়ে আসব।’
আচমকা চিৎকার করে উঠল ধৃতরাষ্ট্র, ‘না না। আমি যুদ্ধ চাই না। এমনিতে জতুগৃহে পাণ্ডুপুত্রদের পুড়িয়ে মারার দায় আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে সবাই। এই সময়ে পাঞ্চাল আক্রমণ করলে ওই দায় সম্পূর্ণতই আমার ওপর বর্তাবে।’
কী রকম যেন চুপষে গেল দুর্যোধন।
ধৃতরাষ্ট্র এবার ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘পাণ্ডুপুত্রদের পুড়িয়ে মারার অপবাদ থেকে তুমিও মুক্ত নও পুত্র। এই অবস্থায় কী করব, কী করলে ঠিক হবে, কী করলে আমার রাজত্ব থাকবে, তোমার প্রতাপ থাকবে, বুঝে উঠতে পারছি না।’
অমীমাংসিত অবস্থায় সেদিনের পরামর্শসভা শেষ হলো।