দুর্যোধন – ৭০

সত্তর 

প্রথম দিনেই তুমুল যুদ্ধ বেধে গেল। 

মহাবাহু ভীম গর্জন করে কৌরবসেনাদের দিকে এগিয়ে গেল। কুরুসেনারা তার ওপর চারদিক থেকে বাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করল। মেঘাচ্ছন্ন সূর্যের মতো ভীমও শত্রুর শরজালে আবৃত হয়ে গেল। 

কুরুপক্ষে দুর্যোধন, দুর্মুখ, দুঃশাসন, অতিরথ, বিকর্ণ, ভোজ, ভূরিশ্রবা ধনুকে বিষাক্ত বাণ যোজনা করে পাণ্ডবসৈন্যদের দিকে ছুড়ছিল। অপরপক্ষে অভিমন্যু, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র কুরুদের তিরের জবাব দিচ্ছিল। 

সমস্ত আবেগ-বিভোরতা ত্যাগ করে অর্জুন ভীষ্মের সম্মুখীন হলো। একে অপরের দিকে বাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করলেন। কিন্তু কেউ কাউকে টলাতে পারলেন না। 

সাত্যকি আর কৌরবপক্ষীয় কৃতবর্মার মধ্যে তুমুল সংগ্রাম শুরু হলো। মহাবীর অভিমন্যুর সঙ্গে কোশলরাজ বৃহদ্বলের যুদ্ধ বাধল। বৃহদ্বল অভিমন্যুর রথের ধ্বজা ভাঙল, তার সারথিকে হত্যা করল। ক্রুদ্ধ অভিমন্যুও হাতে ভল্ল তুলে নিল। প্রথমে বৃহদ্বলের রথ চুরমার করল, তারপর সারথিকে হত্যা করে নিজের সারথি হত্যার প্রতিশোধ নিল। সারথিকে হত্যা না-করার যে শর্ত ছিল, বৃহদ্বল বা অভিমন্যু কেউই মনে রাখল না সেই শর্ত। 

ভীমের প্রতিযোদ্ধা দুর্যোধন। দুজনেই গদাবিশারদ। কিন্তু আজ দুজনে গদা ছেড়ে ধনুর্বান নিয়ে পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। তাদের যুদ্ধ এত দুর্ধর্ষ হলো যে, আশপাশের সৈন্যরা যুদ্ধ ভুলে এই দুই মহাবীরের যুদ্ধ দেখে যেতে লাগল। 

ওদিকে নকুলের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে দুঃশাসন। নকুল পাঁচ বাণে দুঃশাসনের রথের ধ্বজা, তার ধনুক কেটে ফেলল। দুঃশাসনও নকুলকে ছাড় দিল না। তীক্ষ্ণ বাণে নকুলের রথের ঘোড়াগুলোকে হত্যা করল। 

এইভাবে দুর্যোধনভ্রাতা দুমুখের সঙ্গে সহদেবের, শল্যের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের, দ্রোণাচার্যের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্নের ঘোরতর সংগ্রাম চলতে লাগল। কৃপাচার্যের সঙ্গে কৈকেয়রাজ বৃহৎক্ষত্রের যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধটা প্রথমে তির-ধনুক দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত অসিযুদ্ধে গড়াল। 

যুদ্ধ চলতে লাগল। সঙ্গে শোনা যেতে লাগল বীরের সিংহনাদ এবং আহতের আর্তনাদ। শয়ে শয়ে সৈন্য মাটিতে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে শুয়ে পড়তে লাগল। 

এসব কিছুকে ছাপিয়ে ধনুকের টংকার, তলোয়ারে তলোয়ারে ঘর্ষণধ্বনি, গদার শব্দ শোনা যেতে লাগল। এসবের মধ্যেই সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের সঙ্গে মহারাজ দ্রুপদ, বিকর্ণের সঙ্গে ভীম, শকুনির সঙ্গে যুধিষ্ঠির, সুদক্ষিণের সঙ্গে সহদেব মরণপণ যুদ্ধ করে যেতে লাগল। 

অবন্তীরাজ অনুবিন্দ কুন্তীভোজকে গদাঘাত করে বসল। কুন্তীভোজ বাণাঘাতে অনুবিন্দকে জর্জরিত করে তুলল। 

এইভাবে অশ্বারোহীর সঙ্গে অশ্বারোহীর এবং গজারোহীর সঙ্গে গজারোহীর যুদ্ধ চলতে লাগল। পদাতিকদের কেউ প্রতিপক্ষের মস্তক বিচ্ছিন্ন করে তো প্রতিপক্ষের অন্যজন শত্রুর দু-হাত কেটে মাটিতে নামায়। কেউ পেটে ত্রিশূল চালিয়ে দেয় তো, অন্য কেউ ভল্ল দিয়ে মস্তক চূর্ণ করে। যুদ্ধ যতই সংকটময় আর ঘোরতর হতে লাগল, ততই যুদ্ধের শর্তগুলো অমান্য করতে শুরু করল সৈন্যরা। কোনো অশ্বারোহী অশ্ব থেকে লাফ দিয়ে নেমে প্রতিপক্ষের কারও রথে আরোহণ করে তার মাথা কেটে নামাচ্ছে। বিশালকায় রণহস্তী সামনের অশ্বগুলোকে পা দিয়ে থেঁতলে দিচ্ছে। 

এইভাবে উভয়পক্ষে সহস্র সহস্র যোদ্ধা নিহত হতে লাগল। চতুর্দিকে আর্তনাদ আর হাহাকার।

এইভাবে কেটে গেল দিনের প্রথমার্ধ। 

দিনের দ্বিতীয় ভাগে ভীষ্ম মহাক্রমে যুদ্ধ শুরু করলেন। ভীষ্মের তিনদিকে দুর্মুখ, কৃতবর্মা, কৃপ, শল্য অবস্থান নিল। এরা ভীষ্মকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে যেতে লাগল। ভীষ্মের সামনে এসে উপস্থিত হলো অর্জুনপুত্র অভিমন্যু। অভিমন্যু খরতর বাণ নিক্ষেপ করে ভীষ্মের রথের ধ্বজা, দুর্মুখের সারথির মাথা এবং কৃপাচার্যের ধনুক কেটে ফেলল। এ সকল কিছু উপেক্ষা করে কৌরবরা অভিমন্যুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। ভীষ্ম তার ওপর ক্রমাগত বাণ নিক্ষেপ করে যেতে লাগলেন। তা দূর থেকে লক্ষ করলেন মহারাজ বিরাট। নিজের পুত্র উত্তর, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীম, সাত্যকিকে নিয়ে অভিমন্যুর দিকে ছুটে এলো বিরাট। ভীষ্ম দ্রুপদতনয় ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে বাণবিদ্ধ করলেন এবং অমোঘ এক বাণে ভীমের রথের ধ্বজা বিচ্ছিন্ন করলেন। সতেজে বাণে বাণে তার প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করল ভীমসেন। 

এই সময় গজারোহী বিরাটনন্দন মদ্ররাজ শল্যের দিকে মহাক্রোধে এগিয়ে গেল। শল্য তার হস্তীকে লক্ষ করে তির ছুড়ল। আহত হস্তীর পদাঘাতে শল্যের রথ চুরমার হয়ে গেল। সেই ভাঙা রথে বসেই ভীষণ এক তির উত্তরকে লক্ষ করে ছুড়ে বসল শল্য। উত্তরের বর্ম ভেদ করে সেই তির তার বক্ষ বিদীর্ণ করল। নিহত হলো উত্তর। উত্তরই প্রথম বীরপুরুষ, যে জ্ঞাতিবিরোধের প্রথম বলি হলো। 

উত্তরকে হাতির পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়তে দেখে তার সহোদর শ্বেত ধনুর্বাণ নিয়ে এগিয়ে এলো। অনেক কুরুসৈন্যকে হতাহত করে ভ্রাতৃহন্তা শল্যের মুখোমুখি হলো শ্বেত। এবং প্রবলবেগে বাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করল। এতে শল্য অসহায় হয়ে পড়ল। তা দেখে কুরুসেনারা এগিয়ে এলো। কৌরবপক্ষের রথীরা শ্বেতকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। যুদ্ধ চলতে লাগল। 

যোদ্ধারা সঞ্চরমান। মুহূর্তে মুহূর্তে একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলে যাচ্ছে ওরা। প্রতিপক্ষের যাকেই সামনে পাচ্ছে, তার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। 

এইভাবে একটা সময়ে ভীষ্মের মুখোমুখি হলো বিরাটপুত্র শ্বেত। তার ক্রোধ প্রজ্বলিত হলো। কালবিলম্ব না করে ভীষ্মের দিকে সজোরে শক্তিশেল ছুড়ে মারল। সতর্ক ছিলেন ভীষ্ম। দ্রুত তির নিক্ষেপ করে সেই শক্তিশেলকে নয় টুকরো করে ফেললেন ভীষ্ম। শক্তিশেলকে ব্যর্থ হতে দেখে গদা নিয়ে ভীষ্মের দিকে ধেয়ে গেল শ্বেত। তার গদার আঘাতে ভীষ্মের রথ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। ভীষ্মের অশ্ব আর সারথি নিহত হলো। ভীষ্মের ধৈর্যের সীমা পার হয়ে গেল। শ্বেতকে অসি হাতে তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে ধনুকে এক কালান্তক তির যোজনা করলেন ভীষ্ম। সেই তির শ্বেতের বর্ম ভেদ করে বুকে গেঁথে গেল। ধুলায় লুটিয়ে পড়ল শ্বেতের দেহ। শ্বেতের মৃত্যুতে কৌরবপক্ষে আকাশবিদারী আনন্দধ্বনি উঠল। 

রাজা বিরাটই কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের প্রথম উদ্যোক্তা। তারই প্ররোচনায় রাজা দ্রুপদ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। কুরুক্ষেত্রের প্রথম দিনে সেই বিরাটের দু-দুটো পুত্র প্রাণ হারাল। এই দুই পুত্র ছিল রাজা বিরাটের নয়নের মণি। বিশেষ করে উত্তর ছিল দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা। সেই পুত্রকে হারিয়ে রাজা বিরাট দিশেহারা হয়ে পড়ল। 

মহাবীর শ্বেত যখন নিহত হলো, তখন সূর্য পশ্চিমে সামান্য ঢলেছে মাত্র। উত্তর ও শ্বেতের মৃত্যুতে পাণ্ডবপক্ষ হতোদ্যম হয়ে পড়ল। তবে তা সামান্য সময়ের জন্য। অল্পক্ষণের মধ্যে তারা আবার তুমুল যুদ্ধ শুরু করল। 

বিরাটের আরেক পুত্র শঙ্খ ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভীমবেগে শল্যের দিকে ধেয়ে এলো। শল্য গদা হাতে রথ থেকে নেমে শঙ্খের রথের চারটি ঘোড়াকে হত্যা করল। শঙ্খ অশ্বহীন রথ থেকে নেমে দ্রুত অর্জুনের রথে আশ্রয় নিল। সেদিনের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত ভীষ্ম বিষাক্ত শর নিক্ষেপ করে শত শত পাণ্ডবসৈন্যকে বধ করে গেলেন। 

প্রথম দিনের যুদ্ধ সমাপ্ত হলো। 

এইদিনের যুদ্ধে পাণ্ডবদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। যুধিষ্ঠির হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। 

আর আনন্দধ্বনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল কুরুশিবিরে। দুর্যোধনের স্ফুর্তির সীমা নেই। আজকের যুদ্ধে তারই জয় হয়েছে। 

রাতে পাণ্ডবশিবিরে মন্ত্রণাসভা বসেছে। যুধিষ্ঠিরকে বেশ হতাশ দেখাচ্ছে। 

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘এত অল্পতেই ভেঙে পড়লে দাদা? সবেমাত্র প্রথমদিন। কোনোদিন পাণ্ডবদের ক্ষতি হবে বেশি, আবার কোনোদিন কৌরবদের চুরমার করে ছাড়ব আমরা। হতাশ হওয়ার কারণ নেই। দেখে নিয়ো, শেষ পর্যন্ত আমরাই জিতব।’ 

যুধিষ্ঠির বিবর্ণ কণ্ঠে বলল, ‘আজকে দেখলে তো দুর্যোধনদের বীরত্ব? পিতামহ ভীষ্মের তেজ দেখে আমি ত্রস্ত হয়ে পড়েছি কৃষ্ণ।’

যুধিষ্ঠির বলল, ‘তুমি শুধু ভীষ্ম-দুর্যোধনকে দেখলে? আমাদের পক্ষের মহাবীর বিরাট, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, অর্জুন, ভীমকে দেখলে না? ওঁদের ওপর আস্থা রাখো দাদা। জয় তুমি পাবেই।’ 

কিছুটা আশ্বস্ত হলো যুধিষ্ঠির। পরের দিনের যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্নকে ক্রৌঞ্চারণ ব্যূহ রচনা করবার আদেশ দিল। 

একাত্তর 

এইভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম দিনের যুদ্ধও হয়ে গেল। কোনোদিন কৌরবরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরের দিন পাণ্ডবদের সৈন্যক্ষয় হলো অগণন। উভয়পক্ষের শতসহস্র সৈন্য নিধন হতে লাগল। কোনোদিন ভীষ্ম দ্রোণের তির ঝলসে উঠলে অন্যদিন অর্জুনের অগ্নিবাণের সামনে কুরুসেনারা দাঁড়াতেই পারল না। ভীম-দুর্যোধনের গদার ঘর্ষণে প্রতিদিন কুরুক্ষেত্রে বজ্রপাতের মতো শব্দ হতে থাকল। চতুর্থ দিনের যুদ্ধে দুর্যোধন তার আট ভাইকে হারিয়ে বসল। সামনে পেয়ে ভীম গদাঘাতে তাদের মাথা চূর্ণ করেছে। পঞ্চম দিনের যুদ্ধে কুরুপক্ষের ভূরিশ্রবার হাতে সাত্যকির দশ মহাবীর পুত্রের প্রাণ গেল। 

ষষ্ঠ দিনের যুদ্ধশেষে দুর্যোধন দেখল—কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এই ছয় দিনে একজন পাণ্ডবকেও বধ করা গেল না। মাঝখান থেকে ভীমের হাতে, অর্জুনের হাতে কুরুপক্ষ বেশ মার খাচ্ছে। তার কাছে গুপ্তচররা সংবাদ দিয়ে গেল—যুদ্ধের সময় পিতামহ ভীষ্ম পাণ্ডবদের প্রতি বেশ নমনীয় ভাব দেখাচ্ছেন। সামনে পেয়েও আঘাত করছেন না তাদের। উপরন্তু তাঁর সঙ্গে যুদ্ধরত অর্জুন বেশ কয়েকবার অসহায় হয়ে পড়লে ভীষ্ম নিজেই অস্ত্র সংবরণ করে সেখান থেকে সরে পড়ছেন। এই সংবাদ দুর্যোধনকে দিশেহারা করে ছাড়ল। বেশ কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল দুর্যোধন। তারপর দ্রুত পায়ে পিতামহের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। 

অস্থির কণ্ঠে বলল, ‘যুদ্ধের অনেকটা দিন পেরিয়ে গেল পিতামহ। যুদ্ধের সুফল তো পাচ্ছি না আমরা!’ 

ভীষ্ম নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, ‘তাতে আমার কী করার আছে দুর্যোধন?’ 

দুর্যোধন এই সময় ভীষ্মকে চেপে ধরতে পারত। যুদ্ধে তাঁর নিষ্ক্রিয়তা আর পাণ্ডব-আনুকূল্যের কথা তুলে জব্দ করতে পারত। কিন্তু দুর্যোধনের সৌজন্যবোধ তা করতে দিল না। কুরুকুলের এত বড় একজন মাননীয়কে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে অপমান করে কী করে সে? তিনি কুরুবংশের ধ্বজা। এই ধ্বজাকে মাটিতে নামিয়ে আনার ধৃষ্টতা দুর্যোধনের জানা নেই। তাই সব কিছু জেনেও কণ্ঠকে বিনয়ে ভরিয়ে তুলল দুর্যোধন, ‘পিতামহ আমি আপনার আনুকূল্য চাই। আপনার ভালোবাসাই আমার ভরসা। আপনি জানেন—আমার একমাত্র কাম্য- পাণ্ডবদের পরাজয়। ওরা নিহত হোক–এই-ই আমি চাই।’ 

‘তুমি কি জান না দুর্যোধন, পাণ্ডবরা কত শক্তিমান? অর্জুনের গাণ্ডীব সম্পর্কে তোমার জানা নেই? ওদের পেছনে কারা কারা দাঁড়িয়েছে খবর রাখো না তুমি? পাণ্ডবদের শক্তিমত্তা ও সহায়শক্তিকে পরাজিত করা কি এতই সোজা?’ 

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ভীষ্ম বললেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছি দুর্যোধন। আমি চাই তোমার জয় হোক। সুখ ও স্বস্তি পাও তুমি।’ 

দুর্যোধন বলল, ‘আমিও তো তা চাই পিতামহ! পাণ্ডবদের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে জয় আমার হাতে এসে ধরা দিক।’ 

ধুম করে সুর পাল্টালেন ভীষ্ম। কণ্ঠে শ্লেষ মিশিয়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা কি অতই সোজা দুর্যোধন? আমি তোমার জন্য মরতে পারি, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পাণ্ডবদের পরাজিত করতে পারি না।’ 

পিতামহের সুরপালটানো কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল দুর্যোধন। মাথা নিচু করে সে-স্থান ত্যাগ করে গেল সে। 

অষ্টম দিনের যুদ্ধশেষেও কৌরবদের জয় হলো। পাণ্ডবরা অনাহত থাকল। মাঝখানে কুরুপক্ষের বহু বহু সৈন্য হতাহত হলো। অষ্টম দিনের যুদ্ধে দুর্যোধন সতেরোজন ভাইকে হারাল। 

সূক্ষ্ম বিচারে কৌরবপক্ষ একটু একটু করে পরাজয়ের দিকে এগোতে লাগল। 

এই সময় যুদ্ধে কর্ণের অনুপস্থিতি বড় বেশি করে অনুভব করতে লাগল দুর্যোধন। সৈন্যাধ্যক্ষ নির্বাচনে প্রথমেই ভুল করে ফেলেছিল সে। মর্যাদার কথা চিন্তা করে সে পিতামহকে যুদ্ধপরিচালনার দায়িত্ব নিতে আহ্বান জানিয়েছিল। সৌজন্যবোধকে এড়িয়ে সে যদি প্রথমেই কর্ণকে যুদ্ধপরিচালনার ভার অর্পণ করত, তা হলে যুদ্ধপরিস্থিতি ভিন্ন হতো। কর্ণ ভীষ্মের মতো পাণ্ডবসৈন্য ক্ষয়ের জন্য ব্যস্ত না হয়ে পাণ্ডববধে মনোযোগী হতো। কর্ণের একাঘ্নীবাণ থেকে রক্ষা পাওয়া অর্জুনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। 

দুর্যোধন পিতামহের মর্যাদাকে দাম দিয়েছে এবং তার জন্য পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দুর্যোধনকে তার মূল্যও চুকাতে হয়েছে। 

অষ্টম দিনের যুদ্ধশেষে দুর্যোধন কর্ণের সঙ্গে পরামর্শে বসল। অল্পক্ষণের মধ্যে শকুনি আর দুঃশাসনও এসে উপস্থিত হলো সেখানে। সেই পরামর্শসভায় দুর্যোধন মর্মাহত কণ্ঠে পিতামহ ভীষ্মের কার্যকলাপের বর্ণনা দিল। পাণ্ডবদের সামনে তাঁর নিস্তেজ-নিষ্ক্রিয় হওয়ার ব্যাপারটা বিশদে বলল। 

কর্ণ বলল, ‘তোমাদের পিতামহ ভীষ্ম সর্বদাই পাণ্ডবদের পক্ষের লোক। তোমাদের প্রতি যে ভালোবাসা দেখান তিনি, তা মেকি। তাঁর যত টান, সবই পাণ্ডবদের জন্য। আর যতই তোমরা ভীষ্মকে মহাবীর মহাবীর বলো না কেন, পাণ্ডবদের মতো মহারথীদের পরাজিত করার ক্ষমতা নেই তাঁর।’ 

দুর্যোধন হতাশভঙ্গিতে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কর্ণ। আট আটটা দিন পার হয়ে গেল! বিপুল সৈন্যক্ষয় আর ভাইদের হারানো ছাড়া আমার আর কিছুই পাওয়া হলো না! এই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য—এঁরা তো কেউই পাণ্ডবদের আটকাতে পারলেন না!’ 

এই সময় শকুনি বলে উঠল, ‘ভীষ্ম আর দ্রোণের মধ্যে সেরকম তেজ দেখলে কোথায় যে তাঁরা পাণ্ডবদের বধ করবেন? যুদ্ধে তাঁদের সক্রিয়তা দেখে তো মনে হয় না, তোমার জয়ের জন্য যুদ্ধ করছেন তাঁরা!’ 

দুঃশাসন বলল, ‘আমারও একই কথা দাদা, পিতামহ আর অস্ত্রগুরুর মধ্যে আমি সেরকম উদ্যম দেখছি না।’ 

‘তার পরও তো তোমার দাদা সেই পিতামহ ভীষ্মকেই সেনাপ্রধান করলেন। ব্যঙ্গ ছলকে উঠল কর্ণের কণ্ঠে।

দুর্যোধন বলল, ‘আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে কর্ণ। এত বড় যোদ্ধা পিতামহ ভীষ্ম! তাঁর নাম শুনে বহু বিখ্যাত যোদ্ধাকে কাঁপতে দেখেছি আমি! কুরুশিবিরের প্রধান তাঁকেই তো করা উচিত ছিল! করেছিও তাই!’ 

কর্ণ দ্রুত বলে উঠল, ‘এখন তার ফল ভোগ করছ। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন কী? নাহ্, আমি যুদ্ধ করব না, যদি কর্ণ যুদ্ধ করে। আমার অপরাধটা কী? তাঁর পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদ করে গেছি আমি। তাতেই তিনি চটেছেন! কৌশলে আমাকে নিষ্ক্রিয় করে ছাড়লেন। ভেবে দেখো দুর্যোধন, এটাও ভীষ্মের একটা কূটকৌশল। এই কদিন আমি যদি যুদ্ধ করতাম, পাণ্ডবদের মাথা কেটে মাটিতে নামাতাম। তোমাদের পিতামহ জানেন সেটা। তাই তো কৌশলে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখলেন আমায়! তাতে পাণ্ডবদের লাভ তো হলোই পরোক্ষে বিপুল ক্ষতি করে বসলেন ভীষ্ম, তোমাদের।’ ক্রোধে অভিমানে কর্ণের চক্ষু দুটো জ্বল জ্বল করছে। 

দুর্যোধন ভেঙেপড়া কণ্ঠে বলল, ‘পাণ্ডবদের কেউ মরা তো দূরের কথা, বরং তাদের আক্রমণে আমাদের সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র সবই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কী করব—কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি।’ 

কর্ণ বলল, ‘তুমি এক কাজ করো দুর্যোধন। তুমি পিতামহ ভীষ্মকে বসিয়ে দাও। যুদ্ধের সমস্ত কিছু আমার হাতে ছেড়ে দাও। আমি পাঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবদের গুঁড়ো করে দেব। মনে রেখো, এই ভীষ্মের এমন কোনো ক্ষমতা নেই যে পাণ্ডবদের জিততে পারে।’ 

কর্ণের প্রস্তাব দুর্যোধনের মনে ধরল। দুঃশাসন এবং অন্য কয়েকজন ভাইকে নিয়ে দুর্যোধন ভীষ্মের শিবিরে গিয়ে উপস্থিত হলো। ভিতরে যতই ক্রোধ অভিমান থাকুক না কেন, দুর্যোধন কিন্তু সৌজন্য ভুলল না। 

হাত জোড় করে জলভরা চোখে দুর্যোধন বলল, ‘আমার প্রণিপাত গ্রহণ করুন পিতামহ। আমার প্রতি কৃপা করুন। পাণ্ডবদের বধ করুন। আর পাণ্ডবদের বধ করতে যদি আপনার বুক কাঁপে, তা হলে প্রধান সেনাপতির পদ ত্যাগ করুন আপনি। আমি মহাবীর কর্ণকে সেই দায়িত্ব দিই। যুদ্ধে কর্ণ নিশ্চিত পাণ্ডবদের সবান্ধবে হত্যা করবে।’ 

দুর্যোধন যতই কঠিন ভাষায় কথাগুলো বলুক না, সে সর্বদা পিতামহের মান-মর্যাদার কথা স্মরণে রেখেছে। ভীষ্ম যে অত্যন্ত শ্রদ্ধান্বিত ব্যক্তিত্ব, ক্ষণকালের জন্যও ভোলেনি দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের প্রস্তাব শুনে ভীষ্ম খুবই মর্মাহত হলেন। অনেকক্ষণের জন্য তাঁর মুখের কথা ফুরিয়ে গেল। দ্রুত নিজের ভেতরটা গুছিয়ে নিলেন তিনি। 

দুর্যোধন আবার বলল, ‘আমি আপনার ওপর ভরসা করে এই বিরাট যুদ্ধের আয়োজন করেছিলাম। ভেবেছিলাম…’ 

দুর্যোধনের কথা শেষ করতে দিলেন না পিতামহ। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘প্রধান সেনাপতিত্ব আমি ছাড়ছি না দুর্যোধন। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি- কাল থেকে আমি প্রাণপণ যুদ্ধ করব। শিখণ্ডী ছাড়া সকল সোমক ও পাঞ্চালকে আমি বধ করব।’ 

ভীষ্মের আশ্বাস পেয়ে দুর্যোধন ভাইদের নিয়ে নিজশিবিরে ফিরে এলো। 

বাহাত্তর 

পরদিন ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ংকর হয়ে দেখা দিলেন। 

দুর্যোধন বুঝতে পেরেছিল, নবম দিনের যুদ্ধ অত্যন্ত প্রলয়ঙ্করী হবে। প্রধান প্রধান রাজাদের ডেকে দুর্যোধন বলল, আজকের যুদ্ধে মহামতি ভীষ্ম হিংস্র রূপ ধারণ করবেন। সোমক আর পাঞ্চালদের ধ্বংস করে ছাড়বেন তিনি। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন আপনারা। তারপর ভীষ্মকে সর্বতোভাবে সুরক্ষিত রাখার জন্য দুঃশাসনকে নির্দেশ দিল। শিখণ্ডী যাতে ভীষ্মের কাছ ঘেঁষতে না পারে, সে ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকারও আদেশ দিল দুঃশাসনকে। 

শকুনি, শল্য, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য ভীষ্মের সুরক্ষায় নিযুক্ত হলেন। প্রথমেই যুধিষ্ঠিরের মুখোমুখি হলেন ভীষ্ম। উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। 

যুদ্ধের শুরুতেই মহারথী অভিমন্যু কুরুসেনাদের ছিন্নভিন্ন করতে শুরু করল। অশ্বত্থামা আর জয়দ্রথের মতো বীরেরাও তার গতিরোধ করতে পারল না। দুর্যোধনের নির্দেশে রাক্ষসবীর অলম্বুষ অভিমন্যুর দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে বহু পাণ্ডবসৈন্যকে নিধন করল অলম্বুষ। দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র বাধা দিলে ওদের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ লেগে গেল। ওদের পরাস্থ করে অলম্বুষ অভিমন্যুকে আক্রমণ করল। 

যুদ্ধে অভিমন্যুর হন্তারক মূর্তি দেখে ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললেন। বাণে বাণে রক্তাক্ত করতে লাগলেন অভিমন্যুকে। এই সময় পুত্রকে রক্ষা করার জন্য গাণ্ডিব বাগিয়ে অর্জুন এগিয়ে এলো। ভীষ্মের সামনাসামনি হলো অর্জুন। এই সময় কৃপাচার্য অর্জুনকে শরাঘাত করে বসলেন। সাত্যকি তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করে কৃপাচার্যকে জবাব দিল। ত্বরিত সেখানে অশ্বত্থামা এসে উপস্থিত হলো। সাত্যকি আর অশ্বত্থামাতে মরণপণ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পুত্রের সাহায্যার্থে দ্রোণাচার্য এগিয়ে এলে সাত্যকির পাশে এগিয়ে এলো অর্জুন। দুজন মিলে দ্রোণাচার্যকে বাণাঘাতে জরজর করে ছাড়ল। 

দিনের শেষভাগে ভীষ্ম সাক্ষাৎ যম হয়ে উঠলেন। করালগ্রাসী হয়ে সামনে যাকে পাচ্ছেন, তাকেই হত্যা করে চলেছেন। পদাতিক, গজারোহী, অশ্বারোহী, রথারোহী – কেউই রেহাই পাচ্ছে না তাঁর কালান্তক বাণ থেকে। এখন তিনি অজেয়, অপ্রতিরোধ্য। তাঁর সংহারমূর্তি দেখে শত শত পাণ্ডবসৈন্য পালিয়ে জীবন বাঁচাচ্ছে। পাণ্ডবপক্ষ আজ পুরোপুরি পর্যুদস্ত। এমন যে ভীম, সেও ভীষ্মের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। যুধিষ্ঠির-নকুল-সহদেব, সাত্যকি ভীষ্মের অগ্নিবাণে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানান্তরে গেল। 

কৃষ্ণ অর্জুনকে ভীষ্মের বিধ্বংসীমূর্তি দেখিয়ে বলল, ‘ওই—, ওই দেখ পিতামহের সংহারমূর্তি। পাণ্ডবপক্ষের সৈন্যদের তছনছ করে ছাড়ছেন তিনি। কেউ তাঁকে থামাতে পারছে না। একমাত্র তুমিই পার পার্থ, ভীষ্মকে পরাস্ত করতে। আমি রথটিকে তাঁর সামনে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ভীষ্মকে উচিত জবাব দাও।’ 

বলে অর্জুনের রথটিকে ভীষ্মের সামনে নিয়ে গেল কৃষ্ণ। ভীষ্ম আর অর্জুনের মধ্যে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ বেধে গেল। গাণ্ডিব দ্বারা অর্জুন বারবার ভীষ্মের ধনুক কেটে দিতে লাগল। অর্জুনের সমরনৈপুণ্যে ভীষ্ম কিছুতেই নিজধনুকে তির যোজনা করতে পারছেন না। যতবারই চেষ্টা করেন, অতি কুশলতায় অর্জুন, তা ব্যর্থ করে দেয়। 

এই সময় এক অদ্ভুত এবং অভূতপূর্ব কাজ করতে থাকলেন ভীষ্ম। উদাত্ত কণ্ঠে অর্জুনের যুদ্ধনৈপুণ্যের প্রশংসা করতে থাকলেন। পাশ দিয়ে রথ চালিয়ে যাওয়ার সময় দুঃশাসন তা শুনে ফেলল। 

রথ থামিয়ে ভীষ্মের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, ‘পিতামহ, আপনি কাদের হয়ে যুদ্ধ করছেন? কাদের জয় চান আপনি? যুদ্ধ ছেড়ে অর্জুনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন কেন? আপনাকে বুঝতে পারছি না কেন পিতামহ? দাদা, আপনাকে চিনতে ভুল করেনি তো?’ বলেই ত্বরিতবেগে সেস্থান ত্যাগ করে গেল দুঃশাসন। 

দুঃশাসনের কথা শুনে চমকে ফিরে তাকালেন ভীষ্ম। দুঃশাসনের রথ তখন অনেকটা পথ অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে। 

সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার উপক্রম। যুদ্ধ বন্ধের শঙ্খ বেজে উঠল। নিরস্ত্র হয়ে যে-যার শিবিরে ফিরে গেল। 

সেদিনের যুদ্ধে পাণ্ডবদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রধান হোতা পিতামহ ভীষ্ম। এ রকম বিধ্বংসীরূপ নিয়ে ভীষ্ম আর দু-একদিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে পাণ্ডবদের পরাজয় নিশ্চিত। 

পাণ্ডবরা অকূলে ভাসল। 

যে করেই হোক ভীষ্মকে থামিয়ে দিতে হবে, যেভাবেই হোক তাঁকে যুদ্ধবিমুখ করে তুলতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? 

পাণ্ডবশিবিরে সে রাতে পরামর্শসভা বসল। 

যুধিষ্ঠির বলল, ‘আজকে কুরুক্ষেত্রে পিতামহের যমমূর্তি দেখে আমি ভীত-সন্ত্রস্ত। কাল না-জানি, তিনি কী করেন! যুদ্ধে আমি কোনো উৎসাহ পাচ্ছি না কৃষ্ণ! 

কৃষ্ণ হতাশ গলায় বলে উঠল, ‘তোমার ওই এককথা দাদা—আমি ভীত, আমি অবসন্ন। এত নৈরাশ্যবোধ করলে চলে? তুমি নিজেকে এত দুর্বল ভাবছ কেন? ওই দেখ, তোমার পাশে ভীম বসে আছে। সে কুরুদের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যু ছাড়া আর কী? অর্জুনের কথা বলব? সে ইচ্ছে করলে কালকেই ভীষ্মকে বধ করার শক্তি রাখে। তোমাকে ঘিরে নকুল-সহদেব, এত এত খ্যাতিমান যোদ্ধা! তারপরও তুমি সবসময় মনমরা হয়ে থাক! হতাশা ছাড়ো দাদা। জেগে ওঠো। ভীষ্মকে কীভাবে সরানো যায়, সেই পরিকল্পনা করো।’ 

কৃষ্ণের কথায় যুধিষ্ঠিরের চোখমুখ উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ‘কোন পরিকল্পনার কথা বলতে চাইছ তুমি কৃষ্ণ?’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘এটা সবাই জানে যে, ভীষ্ম তোমাদের প্রতি দুর্বল। দুঃসময়ে সাহায্য চাইলে নিশ্চয়ই তিনি হাত গুটিয়ে রাখবেন না।’ 

‘সাহায্য! পিতামহের কাছে? কীভাবে! কোন সাহায্য চাইব আমি?’ হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল যুধিষ্ঠির। 

একেবারেই ঠাণ্ডা গলায় কৃষ্ণ বলল, ‘আজ রাতে আমরা ভীষ্মের সঙ্গে দেখা করব।’ 

ভীম আর অর্জুন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘পিতামহের সঙ্গে দেখা করব! কুরুশিবিরে! তুমি কি কুরুশিবিরের দুর্ভেদ্যতার কথা জান না?’ 

দুই ভাইয়ের কথা কানে তুলল না কৃষ্ণ। শুধু বলল, ‘এখন নয়! রাত আরও গভীর হোক। তিনজন যাব আমরা-আমি, যুধিষ্ঠির আর অর্জুন। এই কথা ঘূণাক্ষরেও যাতে অন্য কেউ জানতে না পারে।’ 

এর একটু পরে বড় একটা স্বর্ণমুদ্রার থলে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল কৃষ্ণ।

নির্দিষ্ট সময়ে ওরা তিনজন ভীষ্মের শিবিরে উপস্থিত হলো। 

কিন্তু কীভাবে? 

ভীষ্মশিবিরে কোনো প্রহরী ছিল না? 

গুপ্তচররা কি তাদের দায়িত্বে অবহেলা দেখিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল?

দুর্যোধনের গোয়েন্দাবাহিনী কি সুগঠিত ছিল না? 

ভীষ্মের শিবির ঘিরে থাকা রাতপ্রহরীরা কি বিশ্বাসঘাতক ছিল? 

ভীষ্মের তাঁবুর রাতপ্রহরীরা লোভী ছিল। কৃষ্ণের পাঠানো স্বর্ণমুদ্রার সামনে তারা হাঁটু গেড়ে বসেছিল। কৃষ্ণপ্রেরিত পাণ্ডবগুপ্তচর ওদের বুঝিয়েছিল, সামান্য সময়ের সাক্ষাৎ শুধু। এই সাক্ষাতে কোনো দুরভিসন্ধি নেই। শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ। সামান্য একটা সাক্ষাতের জন্য এত স্বর্ণমুদ্রার উৎকোচ! সহজেই রাজি হয়ে গিয়েছিল প্রহরীরা। আজ কুরুবাহিনীর জয় হয়েছে—এই তৃপ্তিতে গুপ্তচররা অলসতায় গা ভাসিয়েছিল, সে রাতে। 

পাণ্ডুপুত্র আর কৃষ্ণকে নিজশিবিরে দেখে যাঁর সব চাইতে বিস্মিত হওয়ার কথা, সেই ভীষ্ম তেমন করে বিস্মিত হলেন না। ভীষ্মের হাবভাব দেখে মনে হলো, যেন তিনি জানতেন ওরা আসবে। তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন ভীষ্ম 1 

‘কেন এসেছ?’ ভীষ্ম জিজ্ঞেস করলেন। 

কৃষ্ণ বলল, ‘আপনার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছে যুধিষ্ঠিররা।’ 

‘ভিক্ষা! কী ভিক্ষা!’ যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভীষ্ম। 

‘আপনাকে জয়ের ভিক্ষা।’ বলল যুধিষ্ঠির। 

মধুর একটু হাসলেন ভীষ্ম। বললেন, ‘আমাকে তো তোমরা কোনোভাবেই পরাজিত করতে পারবে না। যতক্ষণ না আমি অস্ত্র ত্যাগ করি, ততক্ষণ আমাকে বধ করা অসম্ভব।’ 

লজ্জা, সৌজন্য, মানবতা, সততা বলে কিছুই নেই কৃষ্ণের। হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘তা হলে কোন পরিস্থিতিতে আপনি অস্ত্রত্যাগ করবেন? 

‘আমার মৃত্যুসূত্র জানতে চাইছ কৃষ্ণ?’ বলে যুধিষ্ঠির-অর্জুনের মুখের ওপর দৃষ্টি ফেললেন ভীষ্ম। তারপর চোখ বুজলেন। দীর্ঘক্ষণ পর চোখ খুললেন। তখন তিনি ভিন্ন মানুষ। তাঁকে তখন চেনা যাচ্ছে না। যেন তিনি রক্তমাংসের মানুষ নন! যেন তিনি কুরুক্ষেত্রে অবস্থান করছেন না। অবাক করা দীপ্তিতে তাঁর চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। 

তারপর বহু বহু দূরাগত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘একমাত্র দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী আমার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অর্জুন যদি শিখণ্ডীকে সামনে রেখে আমার দিকে বাণ নিক্ষেপ করে, আমি অস্ত্ৰ তুলব না। কোনো নারীকে আমি অস্ত্রাঘাত করি না। শিখণ্ডী জন্মের সময় নারী ছিল।’ 

এই বলে ভীষ্ম মৌন হলেন। 

কৃষ্ণরা উৎফুল্লচিত্তে নিজেদের শিবিরে প্রত্যাবর্তন করল। 

তিয়াত্তর 

দশম দিন শিখণ্ডীরই দিন। 

সে-রাতে ফিরেই পরদিনের যুদ্ধপরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল পাণ্ডবরা। সেই মতে পরদিন সকালে যুদ্ধার্থে বের হলো পাণ্ডবপক্ষ। সবার আগে থাকল শিখণ্ডী। আজকের সংঘটিতব্য ঘটনার নায়ক যে সে! তার জাদুকরী ভূমিকার কথা কুরুরা না জানলেও পাণ্ডবরা জানে। 

এই দিনের ব্যূহ রচনার দায়িত্ব পড়েছে শিখণ্ডীর ওপর। ব্যূহ তৈরি করে শিখণ্ডী কৌরবপক্ষের দিকে এগোতে থাকল। তাকে রক্ষা ও সহায়তার দায়িত্ব নিল ভীম, অর্জুন, দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র এবং অভিমন্যু। 

ওদিকে কৌরবরাও ভীষ্মকে অগ্রবর্তী করে পাণ্ডবদের দিকে অগ্রসর হলো। তাঁর রক্ষায় থাকলেন দুর্যোধন, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, শকুনি প্রমুখ। ভীষ্ম প্রতিদিন একই রকম ব্যূহ রচনা করে যুদ্ধ করতেন না। কখনো আসুর, কখনো পৈশাচ, কখনো-বা রাক্ষসব্যূহ নির্মাণ করতেন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। 

অল্পক্ষণের মধ্যেই কৌরবে-পাণ্ডবে বিধ্বংসী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন ভীষ্মকে বাণ নিক্ষেপ শুরু করল। সঙ্গে আছে ভীম, নকুল-সহদেব, সাত্যকি। কুরুসেনারা এদের সামনে টিকতে না পেরে প্রাণের ভয়ে এদিক-সেদিক পালাতে শুরু করল। তা দেখে ভীষ্ম পাণ্ডবপক্ষের ওপর উপর্যুপরি শরবর্ষণ করে যেতে লাগলেন। ভীষ্ম দুর্যোধনের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, প্রতিদিনের যুদ্ধে তিনি দশ হাজার পাণ্ডবসেনা নিধন করবেন। আজ মধ্যাহ্নের আগেই তিনি দশ সহস্রের অধিক সেনা হত্যা করে ফেললেন। এতে পাণ্ডবরা প্রমাদ গুনল। ভীষ্মের এই রকম রুদ্রমূর্তি দেখে অর্জুন ভীষণ ঘাবড়ে গেল। 

পেছন থেকে কৃষ্ণ সাহস জোগাল, ‘ও কিছু না পার্থ। যুদ্ধে হতাহত তো হবেই! ঘাবড়ে যেয়ো না। আমাদের আজকের লক্ষ্যের কথা মনে আছে তো তোমার?’ বলে রথটা ভীষ্মের আরও নিকটে নিয়ে গেল। যথারীতি শিখণ্ডী ধনু বাগিয়ে অর্জুনের সামনে আছে। 

শিখণ্ডী তখন ভীষ্মকে লক্ষ করে অবিরত তির নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। কিন্তু পূর্বের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণে রেখে শিখণ্ডীর অস্ত্রাঘাতের কোনো জবাব দিলেন না ভীষ্ম। শিখণ্ডীর সামনে ভীষ্মের নাজুক অবস্থা দেখে সেখানে কৃতবর্মা, চিত্রসেন, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, অশ্বত্থামা ত্বরিত উপস্থিত হলেন। উভয়পক্ষে আবার ধুন্ধুমার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। 

এই সময় অর্জুন, যুধিষ্ঠির, অভিমন্যু, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ প্রমুখরা ভীষ্মকে ঘিরে মারমুখী রূপ ধারণ করল। আজ তাদের উদ্দেশ্য— ভীষ্মের নিধন। মন্ত্র তো তাদের জানা আছেই! গতরাতেই তো পিতামহ ভীষ্ম তাঁর মৃত্যুমন্ত্র পাণ্ডবদের জানিয়ে দিয়েছেন! ওভাবেই শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মের অতি নিকটে পৌঁছে গেল পাণ্ডবরা। শিখণ্ডীকে ঢাল হিসেবে রেখে উপর্যুপরি মারণবাণ নিক্ষেপ করে যাচ্ছে অর্জুন। 

অর্জুন ভীষ্মের ধনুক কেটে দিল। ভীষ্ম পাশ থেকে আরেকটা ধনু হাতে তুলে নিল। গাণ্ডিবের মাধ্যমে অর্জুন সেই ধনুকটিও কাটল। এরপর যতবার ভীষ্ম ধনু হাতে নেন, অর্জুন তির নিক্ষেপের মাধ্যমে তা দ্বিখণ্ডিত করে। ভীষ্ম ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন। অর্জুনকে লক্ষ করে পর্বত বিদীর্ণকারী এক শক্তিশেল নিক্ষেপ করে বসলেন ভীষ্ম। অর্জুন ত্বরিত তা পথিমধ্যে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলল। 

এই সময় বজ্রতুল্য বাণে ভীষ্মকে আক্রমণ করে বসল শিখণ্ডী। কিন্তু ভীষ্ম তাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না। শিখণ্ডী তাঁর সামনে আরও এগিয়ে এলে অস্ত্রসংবরণ করে রথেই বসে পড়লেন ভীষ্ম। এই সময় ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত তির নিক্ষেপ করতে শুরু করল অর্জুন। শিখণ্ডীকে সামনে রেখেই ভীষ্মকে শরাঘাত করে যাচ্ছিল অর্জুন। অর্জুননিক্ষিপ্ত শর এসে ভীষ্মের শরীরে গেঁথে যেতে লাগল। ভীষ্ম বুঝতে পারলেন, এ অর্জুননিক্ষিপ্ত শর, শিখণ্ডীনিক্ষিপ্ত নয়। বুঝতে পেরেও তিনি নিষ্ক্রিয় থাকলেন। এ যেন তাঁর ইচ্ছামৃত্যু! পাণ্ডবদের জয়ের জন্যই বুঝি ভীষ্ম এই মৃত্যুকে বুক পেতে নিচ্ছেন! অর্জুনের তিরগুলো ভীষ্মের শরীরকে এমনভাবে বিদ্ধ করল যে দুই তিরের মাঝখানে দুই আঙুল ফাঁকও থাকল না। 

বাণাঘাতে জর্জরিত ভীষ্ম সূর্যাস্তের সামান্য আগে রথ থেকে নিপতিত হলেন। কিন্তু তাঁর দেহ মাটি স্পর্শ করল না। তিরের ওপরই তাঁর বিশাল দেহটি ঝুলে রইল। 

ভীষ্মের পতনে চারদিকে হাহাকার ধ্বনি উঠল। কুরুকুলে শোকের ছায়া নামল। পাণ্ডবরা যুদ্ধজয়ের শঙ্খধ্বনি করতে গিয়ে থেমে গেল। 

যুদ্ধশেষে পাণ্ডব আর কৌরবরা ভীষ্মের শরশয্যার দুদিকে এসে দাঁড়ালেন। ভীষ্ম শরাঘাতে জর্জরিত হলেও তাঁর সংবিৎ পুরোপুরি বর্তমান তখন। তাঁর ডানদিকে পাণ্ডবরা – যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল-সহদেব। তাদের গা ঘেঁষে কৃষ্ণ। একটু দূরে দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম, সাত্যকি, বিরাট প্রমুখ যোদ্ধারা। বামপাশে দাঁড়িয়েছেন দুর্যোধন, দ্রোণাচার্য, শল্য, কৃপাচার্য, কৃতবর্মা, অশ্বত্থামা এবং দুর্যোধনের অবশিষ্ট ভাইয়েরা। শরশয্যায় ভীষ্মকে দেখতে কর্ণ আসেনি। তার কাছে মনে হয়েছে-এ ভীষ্মের বুজরুকি। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করবার অভিলাষেই এ রকম স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তিনি। এই মৃত্যু ঘটনা ভীষ্মের স্বকপোলকল্পিত বলে কর্ণের একান্ত বিশ্বাস। তাই প্রচণ্ড ঘৃণায় ভীষ্মকে মৃত্যুশয্যায় দেখতে আসেনি কর্ণ। 

তিরশয্যায় ভীষ্মের দেহটি ধৃত থাকলেও মাথাটি তাঁর ঝুলে পড়েছিল। কষ্ট হচ্ছিল ভীষ্মের। মস্তকটি তাঁর তুলে ধরা দরকার। ভীষ্মের হুঁশজ্ঞান স্বচ্ছ। হন্তা অর্জুনকে লক্ষ করেই ভীষ্ম তাঁর মাথাটি উঁচু করবার ইঙ্গিত করলেন। পাশে স্বপক্ষের দুর্যোধন দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও তার দিকে ফিরেও তাকালেন না পিতামহ। অর্জুন গাণ্ডিবে তিনটি বাণ যোজনা করে ভীষ্মের মস্তক বিদ্ধ করে মাথাটা উঁচু করে দিল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভীষ্ম তৃষ্ণা নিবারণের জলও চাইলেন ওই অর্জুনের কাছেই, যে অর্জুন কিছুক্ষণ আগে তিরে তিরে তাঁকে রক্তাক্ত করেছে, শরে শরে বিদ্ধ করে মৃত্যুশয্যায় শায়িত করেছে। 

জলপান করার পর ভীষ্মের মুখে কথা ফুটল। 

দুর্যোধনের স্তম্ভিত হওয়ার পালা এখন। দ্রোণাচার্য কী ভাবছেন বোঝা গেল না। তাঁর ভাবনাগুলো শ্মশ্রুর আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকল। কিন্তু ভীষ্মের আচরণে কৃপাচার্যের অক্ষিগোলক বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, ধৃতরাষ্ট্র— সবাই যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, এ যেমন সত্যি, আবার এটাও তো অস্বীকারের নয় যে কুরুপক্ষের হয়ে, তাদের সমর্থন করে যুদ্ধে নেমেছেন তাঁরা। কুরুপক্ষে যুদ্ধরত ভীষ্ম দ্রোণরা তো পাণ্ডবপক্ষের হতে পারেন না! যদি হন, তা হলে তাঁরা বিভীষণেরও অধম। বিশ্বাসঘাতক ছাড়া তাঁদের পরিচয় আর কিছুই নয়। এই ভীষ্মকে কী ভাবব? বিশ্বাসঘাতক? কৃতঘ্ন? ভেবে কূল পাচ্ছেন না কৃপাচার্য। রাগে-ঘৃণায় অশ্বত্থামা দুঃশাসনের গা জ্বলে যাচ্ছে। দুর্যোধন যেন চেতনারহিত! 

ঠিক এই সময় পিতামহের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল দুর্যোধন। 

বিমনা দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে ভীষ্ম তখন বললেন, ‘বৎস দুর্যোধন, আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই লোকক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হোক। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করো। ভাই ভাই মিলে কুরুরাজ্য ভোগ করো।’ 

যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে পাণ্ডবদের কিছু বললেন না ভীষ্ম 

ভীষ্মের এই উপদেশবাণী দুর্যোধনের কানে তখন বিষের মতো ঠেকছে। পিতামহকে তখন মস্তবড় এক অভিনেতা বলে মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে— পাণ্ডবদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শিখণ্ডীর ধুয়া তুলে স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করে শত্রুপক্ষের জয়কে সহজ করে দিয়ে গেলেন ভীষ্ম। অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করে সে-স্থান ত্যাগ করে গেল দুর্যোধন। 

ভীষ্মের পতনে কৌরবদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। দুর্যোধন জানে—যুদ্ধে হতাশ হতে নেই, ভেঙে পড়তে নেই। আগামীকাল কুরুপক্ষের নেতৃত্ব কে দেবে- সেটা সর্বাগ্রে ঠিক করতে হবে। সবাইকে নিয়ে রাতে পরামর্শ সভায় একত্রিত হলো তারা। 

খাঁকারি দিল কর্ণ। গলা পরিষ্কার করে মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘এখন বুঝলে তো বন্ধু, পিতামহ এই দশদিন কোন পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করেছেন?’ 

দুর্যোধনের বলার কিছুই নেই। কর্ণের সাবধান বাণীকে উপেক্ষা করে পিতামহকে বিশ্বাস করে এসেছে এতদিন। সেই বিশ্বাস ভেঙে আজ চুরমার হয়ে গেল। মাথা হেঁট করে থাকা ছাড়া আর কোনো পথ রইল না দুর্যোধনের। 

কর্ণ কিন্তু থেমে গেল না। তার মনের মধ্যে জমে থাকা এতদিনকার ক্ষোভ-ঘৃণা সে উগরে দিতে চাইল। 

ক্ষোভ মিশিয়ে সে বলল, ‘কৌরবদের আশ্রয়ে থেকে কৌরবদের পক্ষেই যুদ্ধ করলেন তোমাদের পিতামহ অথচ পাণ্ডবপক্ষের কোনো প্রধান বীরকে হত্যা করলেন না তিনি! তিনি কি অদক্ষ একজন যোদ্ধা ছিলেন? তা তো নয়! ভুবনবিখ্যাত একজন সমরবিদ ছিলেন ভীষ্ম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকলেন। উপরন্তু পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করবার জন্য বারবার তোমাকে চাপ দিয়ে গেলেন। যুদ্ধের সময় সন্ধির প্রস্তাব দেওয়া কি একজন যথার্থ সেনাপতির কাজ, যেখানে তোমরা পাণ্ডবদের পর্যুদস্ত করে ছাড়ছ? এটার নাম সেনাপতিত্ব নয় দুর্যোধন, একে বলে বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের পিতামহ তোমাদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তোমাদের খেয়েছেন, তোমাদের পরেছেন। আর তোমাদেরই বুকে বসে তোমাদের দাড়ি উপড়েছেন।’ বলতে বলতে হাউমাউ করে উঠল কর্ণ।

দুর্যোধন মর্মাহত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘পিতামহ আরও আগে দেহত্যাগ করলে কৌরবদের অনেক উপকার হতো।’ 

চুয়াত্তর 

একাদশ দিন থেকে কুরুপক্ষের প্রধান সমরনায়ক কে হবেন?

এ নিয়ে সে-রাতে পরামর্শসভা অব্যাহত থাকল। 

নানাজনে নানাজনের নাম প্রস্তাব করতে লাগল।

সবার শেষে সুহৃদ কর্ণের মতামত চাইল দুর্যোধন। 

কর্ণ দ্রোণাচার্যের নাম প্রস্তাব করল। দ্রোণাচার্য এবং দুর্যোধন চমকে কর্ণের দিকে তাকালেন। 

চিরন্তন দ্রোণবিরোধী এই কর্ণ। কিন্তু উপযুক্ত সেনাপ্রধান নির্বাচনের কথা যখন উঠল, দ্রোণাচার্যের কথা প্রথমেই মনে পড়ল কর্ণের। কর্ণ আর যা-ই হোক, গুণীর মর্যাদা দিতে জানে। বর্তমানে কুরুশিবিরে দ্রোণাচার্যের চেয়ে বেশি গুণবান, মর্যাদাবান, দক্ষ, ভয়ঙ্কর রণনিপুণ আর কে আছেন? তার সঙ্গে দ্রোণের যে সম্পর্কই থাকুক না কেন, সেনাপতি হিসেবে নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে তাই দ্রোণাচার্যের নামই উচ্চারণ করল কর্ণ। 

কর্ণের মুখে নিজের নাম শুনে ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। এই কর্ণ সেই কৰ্ণই তো, যে সবসময় কুরুদের অন্নভোজী বলে তাঁকে খোঁচা দিত! এই-ই তো সেই কর্ণ, যে পাণ্ডব-অনুরাগী বলে সর্বদা তাঁকে উপেক্ষা করে আসছে! এই কর্ণই তো তাঁকে চিরটাকাল কৃতঘ্নতার দায়ে অভিযুক্ত করে এসেছে! সেই কর্ণ এতগুলো মহাবীরের সামনে প্রধান সেনাপতি হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করল! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না দ্রোণ! ভুল শুনেছেন বলে নিজের কানকেই অবিশ্বাস করতে মন চাইল তাঁর! 

কর্ণের প্রস্তাব শুনে বড় আনন্দ লাগল দুর্যোধনের। দশ দিনের যুদ্ধের পর ভীষ্ম শরশয্যা গ্রহণ করলে খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল সে। পরবর্তী প্রধান সেনাপতি কাকে নির্বাচন করবে? তার পক্ষে মহা মহা বীররা যুদ্ধ করছেন— দ্রোণাচার্য, কর্ণ, কৃপাচার্য, কৃতবর্মা, মদ্ররাজ শল্য, অশ্বত্থামা আরও অনেকে। এবার কাকে সেনাপতি করলে কৌরবদের জয় নিশ্চিত হবে? অস্থিরতায় ভুগছিল দুর্যোধন। বন্ধু কর্ণ তাকে বাঁচিয়ে দিল। কত বড় বীর কর্ণ! এই অবস্থায় অন্য কেউ হলে নিজের নামই প্রস্তাব করে বসত! কিন্তু কর্ণ যে মহান! বীরকে মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করে না সে। তাই তো পরবর্তী সেনাপতির নাম প্রস্তাব করতে গিয়ে অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের নাম উচ্চারণ করল! 

দুর্যোধন আর দ্বিরুক্তি করেনি। দ্রোণকে প্রধান সেনাপতির পদ অলঙ্কৃত করার জন্য অনুরোধ করল। দ্রোণাচার্য সম্মতি দিলেন। 

সেনাপতিত্ব গ্রহণ করে দ্রোণ দুর্যোধনকে আশ্বস্ত করলেন, ‘আমার সেনাপতিত্বের কালটা পাণ্ডবদের জন্য সুখকর হবে না দুর্যোধন। পাণ্ডবসৈন্যদের ছারখার করে ছাড়ব আমি।’ 

হতাশা আর বিভ্রান্তির এই সময়টাতে দুর্যোধন খেয়াল করল না যে ভীষ্মের মতো দ্রোণাচার্যও পাণ্ডবসৈন্য নিধনের প্রতিশ্রুতি দিল, পাণ্ডবদের নিধনের নয়। 

দ্রোণ আবার বলে উঠলেন, ‘তবে আমার একটা শর্ত আছে।’ 

আবার শর্ত! পিতামহের শর্তের পর শর্ত পালন করতে গিয়ে কুরুদের আজ এই অবস্থা! তাঁর ওই শর্তের আড়ালে তো পাণ্ডবদের জয়ের বার্তা লেখা ছিল! বুঝতে পারেনি তখন দুর্যোধন। তাই আজকে আচার্যের মুখে ‘শর্ত’ শব্দটা শুনে বুক কেঁপে উঠল তার। 

বিব্রত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আবার শর্ত! কী সেই শর্ত?’ 

দ্রোণ বললেন, ‘আমি কোনোভাবেই দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করব না।’ 

‘ধৃষ্টদ্যুম্ন এমন কী মহাবীর হয়েছে যে আপনি তাকে বধ করতে পারবেন না?’ রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কর্ণ 

‘কথাটা বীর-মহাবীরের নয়। ব্যাপারটা অপরাধবোধের। আত্ম-অনুশোচনার।’ ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন দ্রোণ। 

দুর্যোধন বলল, ‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না গুরুদেব। একটু খোলসা করবেন?’ 

দ্রোণাচার্য করুণ গলায় বলল, ‘একদিন আমি আমার ছাত্রদের দিয়ে দ্রুপদকে বেঁধে এনেছিলাম। অর্ধেক রাজ্য ছিনিয়ে নিয়েছিলাম আমি তার। উত্তেজনা আর ক্রোধের বশে তখন এই কাজটি করেছিলাম আমি। পরবর্তীকালে গভীরভাবে ভেবে গেছি আমি, এ রকম হঠকারী কাজ আমার করা উচিত হয়নি। বিবেক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছি আমি দুর্যোধন।’ 

তারপর দীর্ঘ একটা শ্বাস ত্যাগ করে দ্রোণাচার্য আবার বললেন, ‘ক্ষত্রিয় দ্রুপদ। ক্ষত্রিয়ক্রোধ সে প্রশমিত করতে পারেনি। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেছে। সেই যজ্ঞেরই ফসল এই ধৃষ্টদ্যুম্ন। তার জন্ম হয়েছে আমাকে হত্যা করার জন্যই। ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে আমার মৃত্যু—হয়তো নিয়তির ইচ্ছা।’ বলে চুপ হয়ে গেলেন দ্রোণাচার্য। 

ব্যাপারটা খুব বেশি আমলে নিল না দুর্যোধনসহ অন্যরা। ভাবল—এ দ্রোণাচার্যের ভাববাদী কথা।

পরের দিন একাদশ দিনের যুদ্ধ শুরু হলো। 

কৌরবপক্ষে দুটো ব্যতিক্রম দেখা গেল। আজ থেকে যুদ্ধে নামল মহাধনুর্ধর কর্ণ। আর সেনাপতির পদে দেখা গেল অস্ত্রগুরু দ্রোণকে। দুটোই পাণ্ডবপক্ষের জন্য ভীতিকর। পাণ্ডবপক্ষ ভয়ে ভয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো সেদিন। 

সেদিন যুদ্ধ শুরুর আগে রথ ছুটিয়ে দ্রোণাচার্যের অগ্রভাবে গিয়ে দাঁড়াল দুর্যোধন। 

বলল, ‘আমার একটা অভিলাষ আছে গুরুদেব।’ 

‘কী অভিলাষ? দ্রোণাচার্য জিজ্ঞেস করলেন। 

‘আমি চাই, প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে জীবিত অবস্থায় আমার কাছে ধরে নিয়ে আসুন।’ বলল দুর্যোধন। 

মৃদু একটু হেসে দ্রোণ বললেন, ‘অর্জুন যদি যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা না করে, তা হলে তোমার বাসনা পূর্ণ করব আমি দুর্যোধন।’ 

দুর্যোধন খুশিতে আটখানা হলো। সে চাইছে, দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনলে তাকে আবার পাশাখেলায় বসাবে এবং নির্ঘাত জিতে সবাইকে পুনরায় বনবাসে পাঠাবে। কিন্তু দুর্যোধন একবারের জন্যও দ্রোণের কথার ইঙ্গিতটা বুঝবার চেষ্টা করল না। পরোক্ষভাবে দ্রোণ যে বললেন, আর যাকেই হোক অর্জুনকে পরাজিত করবেন না তিনি। 

দ্রোণের কথা শুনে দুর্যোধন তাঁর কথা সর্বাংশে বিশ্বাস করল। ভেবে নিল – যুধিষ্ঠির আজ দ্রোণের হাতে বন্দি হবেই। 

কিন্তু কথাটা ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকল না। গুপ্তচর মারফত যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার কথাটা পাণ্ডবশিবিরে চলে এলো। সেই মতে প্রস্তুত হয়ে যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুন যুদ্ধে এগিয়ে গেল। 

সেদিনের যুদ্ধে সত্যিই অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে আগলে আগলে রাখল। দ্রোণের ক্ষমতা হলো না যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার। 

উভয়পক্ষ ব্যূহ রচনা করে যুদ্ধটা শুরু করেছিল। পাণ্ডবসেনারা ক্রমাগত কুরুসৈন্যদের আক্রমণ করে গেল। কিন্তু দ্রোণের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় কৌরবসেনাদের কোনো ক্ষতি হলো না। 

শকুনির সঙ্গে সহদেবের প্রচণ্ড যুদ্ধ বেধে গেল। ভীমের সঙ্গে বিবিংশতির, নকুলের সঙ্গে মাতুল শৈল্যের, ধৃষ্টকেতুর সঙ্গে কৃপাচার্যের, সাত্যকির সঙ্গে কৃতবর্মার, বিরাটরাজার সঙ্গে কর্ণের এবং শিখণ্ডীর সঙ্গে ভূরিশ্রবার তুমুল যুদ্ধ চলতে লাগল। কর্ণ সর্বশক্তি নিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তার হাতে শত শত সৈন্য মারা পড়তে লাগল। হার্দিক্যের সঙ্গে অভিমন্যুর যুদ্ধ চলছিল দেখার মতো। বাণে বাণে পরস্পর পরস্পরকে ঢেকে ফেলল। জয়দ্রথ হার্দিক্যকে বাঁচাতে গেলে জয়দ্রথের সঙ্গে অভিমন্যুর ধুন্ধুমার যুদ্ধ লেগে গেল। এই সময় পাশ থেকে শল্য অগ্নিশিখার মতো এক শক্তিশেল ছুড়ে মারল অভিমন্যুর দিকে। অভিমন্যু সেই শেলটি নিজ হাতে ধরে ফেলে শল্যের দিকে নিক্ষেপ করল। আজ যেন অভিমন্যুর দিন। অভিমন্যুর হাতে কুরসৈন্য ছারখার হতে থাকল। 

দিনের শেষের দিকে দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে পেয়ে গেলেন। সারথিকে যুধিষ্ঠিরের সামনে তাঁর রথটিকে নিয়ে যেতে বসলেন। কিন্তু তার আগেই যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে লক্ষ করে উপর্যুপরি বাণ নিক্ষেপ করতে থাকল। যুধিষ্ঠিরের রক্ষায় নিযুক্ত শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, নকুল, দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, সাত্যকি অসংখ্য বাণ নিক্ষেপ করে যুধিষ্ঠিরকে আগলে রাখল। তারপরও দ্রোণ দমে গেলেন না। তাঁর রথ যুধিষ্ঠিরের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল। এই সময় অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে অর্জুনের রথ দ্রোণাচার্যের সামনে এসে দাঁড়াল। উভয়ের মধ্যে ভয়াবহ এক যুদ্ধ বেধে গেল। 

ইতোমধ্যে দিন শেষ হয়ে এলো। যুদ্ধ বন্ধের শঙ্খধ্বনি হলো। উভয়পক্ষ নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গেল। 

আজকের যুদ্ধে যুধিষ্ঠির কিন্তু দ্রোণাচার্যের নাগালের মধ্যে চলে এসেছিল। দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের রথ, সারথি, অশ্ব ধ্বংস করে দিলে দ্রুতগামী একটা অশ্বের পিঠে চড়ে পালিয়েছিল যুধিষ্ঠির। রথ ছেড়ে ঘোড়ায় চড়ার সময়টুকুতে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করা দ্রোণের পক্ষে কঠিন ছিল না। কিন্তু দ্রোণ তা করেননি। পালিয়ে যাওয়ার সময় দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। কেন যুধিষ্ঠিরকে ধরে ফেলেননি! পাণ্ডবদের প্রতি যে দ্রোণের প্রচণ্ড দুর্বলতা! পাণ্ডবদেরই যে জয় কামনা করেন তিনি! তাঁর আর ভীষ্মের মধ্যে যে কোনো তফাত নেই! 

দ্রোণাচার্যের মনোভাব ধরে ফেলতে দুর্যোধনকে বেগ পেতে হয়নি। 

পঁচাত্তর 

সেদিন দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে সহজে ছাড়েনি। শিবিরে ফিরেই তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল। 

দুর্যোধনের কণ্ঠে বিনয়ের লেশমাত্র ছিল না। উপহাস মিশানো গলায় বলে উঠেছিল, ‘আপনি যাদের বধ করবেন বলে ঠিক করেছেন আচার্য, আমরা সেই বধ্যদের দলেই তো পড়ি?’ 

চমকে দুর্যোধনের দিকে তাকালেন দ্রোণ। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি একথা কেন বললে দুর্যোধন!’ 

‘নইলে আপনি যুধিষ্ঠিরকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিলেন কেন? আপনি কি এখন আমাকে বোঝাতে লেগে যাবেন যে, আপনার অস্ত্রের ফাঁস ফসকে যুধিষ্ঠির বেরিয়ে গেল? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন আপনি?’ 

দ্রোণাচার্য আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে চাইলেন। কিন্তু দুর্যোধনের চোখের রং দেখে আপনাতেই থেমে গেলেন তিনি। 

দুর্যোধন বলল, ‘আপনি আমাকে আগে বর দান করে পরে নিজেই সেটা উলটে দিচ্ছেন। মানি—যুধিষ্ঠির-অর্জুনরা আপনার ছাত্র। আমরাও তো আপনার কাছ থেকে অস্ত্রশিক্ষা নিয়েছি! আমাদের আর ওদের মধ্যে পার্থক্য এইটুকু যে আমরা আপনার অনুগত, গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি আমরা আপনাকে। আর ওরা উদ্ধত। আপনাকে থোড়াই পাত্তা দেয় ওরা। শ্রদ্ধা তো দূরের কথা! উপরন্তু পাণ্ডবরা, বিশেষ করে আপনার প্রিয় ছাত্র অর্জুন আপনাকে হত্যা করতে উদ্যত। সেই পাণ্ডবদের পক্ষ নিচ্ছেন আপনি! কেমন মানুষ আপনি? আপনার একান্ত অনুগত কুরুদের আশাভঙ্গ করা কি আপনার মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপী একজন ব্রাহ্মণের শোভা পায়?’ 

দ্রোণ সাফাই গাইলেন, ‘আজ যা হয়েছে, হয়েছে। আজকের কথা বাদ দাও দুর্যোধন। আসলে হয়েছে কী, কৃষ্ণ আর অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে আগলে রেখেছিল খুব। ওদের ভেদ করতে পারিনি আমি।’ 

‘আপনার কথাটা ঠিক নয় গুরুদেব। এটা কারণ নয়, এটা অজুহাত। বলেন – আপনি ইচ্ছে করে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করেননি।’ 

দ্রোণ থতমত খেয়ে গেলেন। ইতস্তত কণ্ঠে বললেন, ‘আগামীর যুদ্ধগুলোতে আমি আমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করব দুর্যোধন।’ 

দুর্যোধন বেদনাহত কণ্ঠে বলল, ‘সেই-ই ভালো।’ 

দ্বাদশ দিনের যুদ্ধও উভয়পক্ষের বহু ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে কেটে গেল। 

ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধারম্ভের সকালে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘আজকে আমি পাণ্ডবপক্ষের এক মহারথ যোদ্ধাকে শেষ করে ছাড়ব। তোমরা শুধু কৌশলে অর্জুনকে যুদ্ধ ময়দানের একপ্রান্তে ব্যস্ত রেখো।’

উৎফুল্ল হয়ে উঠল দুর্যোধন। তার সংশপ্তকবাহিনীকে কুরুক্ষেত্রের দক্ষিণ প্রান্তে অর্জুনকে ব্যস্ত রাখবার নির্দেশ দিল। 

দ্রোণাচার্য আজ চক্রব্যূহ রচনা করলেন। এই ব্যূহের সামনে থাকলেন দুর্যোধন, দুঃশাসন, কৰ্ণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা প্রমুখ মহাবীররা। জয়দত্তের ওপর দায়িত্ব পড়ল চক্রব্যূহের প্রবেশদ্বার আগলে রাখা। প্রাণান্তক যুদ্ধ আরম্ভ করলেন তাঁরা। দ্রোণের শরঘাতে পাণ্ডব-পাঞ্চাল সৈন্যরা বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত হতে লাগল। ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি এমনকি ভীম পর্যন্ত চক্রব্যূহ ভেদ করতে ব্যর্থ হলো। দ্রোণের অস্ত্রাঘাতে এই সব বীরের প্রাণান্তকর অবস্থা হলো। 

চক্রব্যূহ এক কঠিন সৈন্যসজ্জা। দ্রোণেরই আয়ত্তাধীন এই কৌশলটি। অর্জুন, কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন এবং অর্জুনের ছেলে অভিমন্যুই শুধু যুদ্ধ করতে করতে এই ব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। অন্য দুজন বের হওয়ার উপায় জানলেও অভিমন্যু জানে না। অর্জুন কুরুক্ষেত্রের দক্ষিণ প্রান্তে সংশপ্তকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। প্রদ্যুম্ন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। বাকি রইল অভিমন্যু। অভিমন্যু ব্যূহমুখে যুদ্ধে রত। এই ব্যূহ ভেদ করতে না পারলে পাণ্ডবদের পরাজয় নিশ্চিত আজ। 

নিরুপায় যুধিষ্ঠির চক্রব্যূহে প্রবেশ করবার জন্য অভিমন্যুকে আদেশ দিল। 

অভিমন্যু চিৎকার করে বলল, ‘চক্রব্যূহ ভেদ করতে জানি আমি জ্যেষ্ঠতাত। আপনার আদেশে ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করছি। কুরুসৈন্য নিধন করতে করতেই ব্যূহে ঢুকে পড়ব আমি। কিন্তু জ্যেষ্ঠতাত, আমি যে চক্রব্যূহ থেকে বের হতে জানি না!’ 

অভিমন্যুর কথা শুনে যুধিষ্ঠির ও ভীম সমস্বরে বলল, ‘তুমি সেনাচক্র ভেঙে ব্যূহের দ্বার তৈরি কর। তোমার পেছন পেছন আমরা আসছি।’ 

জেঠাদের কথায় উৎসাহিত হয়ে অভিমন্যু কুরুসৈন্য ধ্বংস করতে করতে চক্রব্যূহে ঢুকে গেল। কৌরবপক্ষের সেনারা প্রস্তুত ছিল। সদলবলে অভিমন্যুকে আক্রমণ করে বসল। কিন্তু অভিমন্যু থামবার পাত্র নয়। তার তীক্ষ্ণ বাণের আঘাতে বহু যোদ্ধা ধরাশায়ী হতে লাগল। 

ওদিকে কুরুরা যুধিষ্ঠির-ভীম-ধৃষ্টদ্যুম্ন-সাত্যকিকে চক্রব্যূহে ঢোকা রুখে দিল। জয়দ্রথের রণনৈপুণ্যের সামনে সেদিন পাণ্ডববীররা কুঁকড়ে গেল। ব্যূহে ঢোকার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল তাদের। 

সপ্তরথীর জালে তখন আটকা পড়ে গেছে অভিমন্যু। এককভাবে যুদ্ধ করতে করতে তার বল ক্ষীণ হয়ে এলো। দ্রোণ-কৃপ-কর্ণ-অশ্বত্থামা দুর্যোধন উপর্যুপরি অভিমন্যুকে অস্ত্রাঘাত করে যেতে লাগলেন। একপর্যায়ে সপ্তরথীরা মিলে অভিমন্যুকে ঘিরে ধরলেন। এই অবস্থাতেই অভিমন্যু বাণাঘাতে দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণকে হত্যা করল। ক্রোধে গর্জন করে উঠল দুর্যোধন। যেভাবেই হোক অভিমন্যুকে হত্যার আদেশ দিল দুর্যোধন। সপ্তরথী মিলে অভিমন্যুর বর্ম, ধনুক, সারথি ও পার্শ্বরক্ষকদের কেটে ফেলল। যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত অসম হয়ে উঠল। তারপরও শরাঘাতে জর্জরিত অভিমন্যু একটা রথচক্র নিয়ে দ্রোণের দিকে ধেয়ে গেল। দুঃশাসনপুত্র গদা হাতে অভিমন্যুর পথ রোধ করে দাঁড়াল। উভয়ের মধ্যে মরণপণ যুদ্ধ বেধে গেল। পরস্পরের ধ্বস্তাধস্তিতে দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল। দুঃশাসনপুত্র আগে উঠে দাঁড়াল। মুহূর্তেই গদার আঘাতে অভিমন্যুর মস্তক চূর্ণ করে দিল সে। প্রচণ্ড ঝড়ে অরণ্যে মহীরুহ পতিত হলে যেমন সমস্ত অরণ্য থর থর করে কেঁপে ওঠে, অভিমন্যুর পতনেও তেমনি সমস্ত কুরুক্ষেত্র কেঁপে উঠল। রাহু চাঁদকে গ্রাস করলে যেমন চারদিকে আঁধার নেমে আসে, অভিমন্যুর মৃত্যু তেমনি পাণ্ডবশিবিরে বিষাদের গভীর অন্ধকার নেমে এলো। 

অভিমন্যু বধের পরই ওইদিনের যুদ্ধ শেষ হলো। কারণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। তাঁবুতে ফিরে অর্জুন জানল—অভিমন্যু নিহত হয়েছে। তাকে জানানো হলো—জয়দ্রথই অভিমন্যুর হত্যাকারী। কিন্তু অভিমন্যুকে তো জয়দ্রথ হত্যা করেনি! চক্রব্যূহের প্রবেশপথটা রক্ষা করে চলেছিল সে। সপ্তরথীর একজন ছিল বৃহদ্বল। অভিমন্যু নিজ হাতেই তাকে হত্যা করেছিল। শেষ পাঁচ মহারথী- কর্ণ, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা—অভিমন্যুহত্যায় সহযোগী ছিলেন। সপ্তরথীর কেউই অভিমন্যুকে বধ করেননি। বধ করেছে দুঃশাসনপুত্র। কিন্তু অর্জুনকে জানানো হলো— জয়দ্রথই অভিমন্যুকে হত্যা করেছে। মিথ্যে তথ্য দেওয়ার পেছনে যুধিষ্ঠির আর কৃষ্ণের একটা দুরভিসন্ধি ছিল। দুজনে শলা করে অর্জুনকে জানাল যে জয়দ্রথই তার প্রিয়তম পুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করেছে। 

জয়দ্রথ কুরুশিবিরে প্রায়-অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা হয়ে উঠেছিল। বিগত বারো দিনের যুদ্ধে কেউই তাকে কাবু করতে পারছিল না। কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির জানত, একমাত্র অর্জুনই পারে জয়দ্রথকে বধ করতে। তার জন্য চাই অর্জুনকে খেপিয়ে তোলা। মিথ্যে তথ্যটা কাজে লাগাল দুজনে। বলল, অভিমন্যুর হত্যাকারী জয়দ্রথই। 

অর্জুন প্রতিজ্ঞা করে বসল, আগামীদিনের যুদ্ধে জয়দ্রথকে হত্যা করবেই সে এবং সূর্যাস্তের আগেই হত্যা করবে। 

পরদিনের যুদ্ধে শকটব্যূহ তৈরি করে অর্জুনের গতিরোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন দ্রোণ। অর্জুন জানত, যুদ্ধে দ্ৰোণকে হারানো সম্ভব নয়। আর দ্রোণকে পরাজিত না করে জয়দ্রথ পর্যন্ত পৌঁছানোও সম্ভব নয়। 

দ্রোণকে লক্ষ করে অদ্ভুত এক মনভোলানো কথা বলল অর্জুন, ‘হে মহান গুরু, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। আপনিই আমাদের ভরসা। আমাকে পিতার মতো আশীর্বাদ করুন, যেমন করে অশ্বত্থামাকে আপনি আশীর্বাদ করেন। জয়দ্রথ আমার পরমপ্রিয় পুত্রকে হত্যা করেছে। পুত্রহত্যা যে কতটুকু হাহাকারের সে আপনি বুঝবেন। আমাকে জয়দ্রথের কাছে যেতে দিন। আপনার দুটি পায়ে পড়ি গুরুদেব।’ 

সম্মোহিত হয়ে গেলেন দ্রোণাচার্য, নাকি পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা চাগিয়ে উঠল-বোঝা গেল না। বিনা বাধায় দ্রোণকে অতিক্রম করে গেল অর্জুন। জয়দ্রথ পর্যন্ত পৌঁছে গেল এবং সূর্য ডোবার আগে নির্মমভাবে জয়দ্রথকে হত্যা করল অর্জুন। 

যুদ্ধশেষে দুর্যোধনের মুখোমুখি হতে হলো দ্রোণাচার্যকে। 

সক্রোধে দুর্যোধন বলল, ‘এ কী করলেন আপনি! বিনা বাধায় অর্জুনকে শকটব্যূহে ঢুকতে দিলেন!’ 

দ্রোণ আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি কী করব! অর্জুন যে ঢুকে গেল!’ 

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না দুর্যোধন। সগর্জনে বলল, ‘আপনি বেইমান। আমাদেরই খেয়ে-পরে আমাদেরই সর্বনাশ করেছেন আপনি! আমি ভাবতে পারিনি-আপনি মধুমাখা ক্ষুরের মতো। তলে তলে সেই ক্ষুর দিয়ে আমাদেরকেই হত্যা করে চলেছেন আপনি।’ 

ছিয়াত্তর 

দুর্যোধনের মনে শুভবুদ্ধি জেগে উঠল। আচার্য দ্রোণকে তার এভাবে আঘাত করা উচিত হয়নি। 

কণ্ঠকে একেবারে খাদে নামাল দুর্যোধন। বিনয় ও লজ্জা মিশিয়ে বলল, ‘আমি এই মুহূর্তে বিপন্ন বিধ্বস্ত গুরুদেব। ঘোরের মধ্যে কী বলতে কী বলে ফেলেছি আমি! আপনি ওসব ভুলে আমাকে ক্ষমা করে দিন আচার্য।’ 

দ্রোণাচার্য বুদ্ধিমান। মনের ব্যথা মনেই চেপে রাখলেন। বললেন, ‘তোমার কথায় আমি রাগ করিনি দুর্যোধন। তোমার একমাত্র বোনের স্বামী ওই জয়দ্রথ। তার মৃত্যুতে তোমার বোন দুঃশলার মনের অবস্থা কী হবে আমি বুঝতে পারছি।’ 

আর্তনাদ করে উঠল দুর্যোধন। শিশুর মতো বুক চাপড়ে হাউ মাউ করতে লাগল। 

দ্রোণ তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমি তোমাকে আমার ছেলে অশ্বত্থামার মতোই ভালোবাসি দুর্যোধন। তুমি আমার এই কথাটি বিশ্বাস করো বৎস। এখানে একটি কথা তোমাকে না বলে পারছি না। অর্জুনের সারথি হলো কৃষ্ণ। বিশাল কূটকুশলী সে। অর্জুন যখন আমাকে কথায় ব্যস্ত রেখেছিল, কৃষ্ণ তখন কোন ফাঁকে শকটব্যূহের মধ্যে ছোট্ট একটি প্রবেশপথ তৈরি করে ফেলতে পেরেছিল। চোখের পলকে কখন সে আমাকে টপকে গেল, বুঝতে পারিনি আমি দুর্যোধন। যখন বুঝতে পারলাম, তখন অর্জুন আমার নাগালের বাইরে।’ 

দুর্যোধন নিষ্পলক চোখে দ্রোণের দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর বলল, ‘আর কত মিথ্যে বলবেন আপনি? আর কতদিন মিথ্যে দিয়ে সত্যকে ঢাকবার চেষ্টা করে যাবেন আপনি?’ 

দ্রোণ উপায় না দেখে নিজের বার্ধক্যের কথা তুললেন। বললেন, ‘বয়স হয়েছে আমার দুর্যোধন। দ্রুতই আমাকে পাশ কাটিয়ে শকটব্যূহে ঢুকে গেল অর্জুন! পেছন থেকে তাড়া করে তার গতি রোধ করার মতো শারীরিক সামর্থ্য আমার নেই বৎস।’ 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন দ্রোণাচার্যের বয়স পঁচাশি। সেসময় মানুষ দীর্ঘজীবী হতো। পঁচাশি বছর বয়সটা একজন যোদ্ধার জন্য খুব কাহিলকরা বয়স নয় তখন। তাছাড়া দ্রোণাচার্য রণগুরু। দীর্ঘদিনের অনুশীলনের শরীর তাঁর। তাঁর দেহকাঠামো সুদৃঢ়। সবল পেশি। ত্বরিতগতি। তাই দ্রোণের কথা দুর্যোধনের কাছে বিশ্বাস্য মনে হলো না। তাই তাঁর কৈফিয়তে দুর্যোধনের ক্ষোভ কমল না। তার চোখমুখের অভিব্যক্তি আগের মতোই থেকে গেল। 

বুঝলেন দ্রোণাচার্য। এবার কৈফিয়তের আড়ালে নিজেকে ঢাকলেন না। স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘তুমি তো রাজা বটে। অস্ত্রশস্ত্রেও তোমার মতো কুশলী বীর কজন আছে বলো! পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতাটা আমি তৈরি করিনি। করেছ তুমি। তা একটা কাজ করো না তুমি দুর্যোধন। অর্জুনের সঙ্গে একবার যুদ্ধে নামো না। তখন বুঝবে অর্জুন কী ধাতু দিয়ে তৈরি। যদি তা না পার, অন্য একটা কাজ তো তুমি সহজেই করতে পার! আমার সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রের নাম যুধিষ্ঠির। তার অস্ত্রজ্ঞান অর্জুনের মতো তো নয়ই, এমনকি তোমার মতোও নয়। সেই যুধিষ্ঠিরকে দ্বৈতদ্বন্দ্বে পরাজিত করে বেঁধে নিয়ে আসো না। তাহলে বুঝব—কীরকম শক্তিধর তুমি!’ মনের ক্ষোভ-ক্রোধ একেবারে ঝেড়ে দিয়ে মৌন হলেন দ্রোণাচার্য। 

দ্রোণের কথায় একেবারে চুপসে গেল দুর্যোধন। মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি আপনার সেবক আচার্য। সেবকের যশ রক্ষা করা তো আপনারই কর্তব্য—কী বলেন গুরুদেব?’ 

এবার গম্ভীর কণ্ঠে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘আমাকে ভর্ৎসনা করো না। সামনে আমার পুত্র দাঁড়ানো। সে তোমার বশংবদ। তাই তোমার কথার প্রতিবাদ করে না। আমার অপমান সহ্য করে যায় সে। সে আমার একমাত্র পুত্র। সে আমার প্রাণাধিক। তোমার দলে আমার যোগদান করার প্রধান কারণ ওই অশ্বত্থামা। সে তোমার হয়ে যুদ্ধ করবে। বিরোধী দলে গেলে তার বুক লক্ষ করে আমাকে অস্ত্র তুলতে হতো। তাই আমি কুরুপক্ষে থেকে গেছি।’ 

দুর্যোধন আর একটি শব্দও করল না। সেখান থেকে সরে গেল। যেতে যেতে দ্রোণের কণ্ঠস্বর তাঁর কানে পৌঁছাল, ‘আমৃত্যু আমি তোমার হয়েই যুদ্ধ করব দুর্যোধন। তুমি তো জান না, ছাত্র আর পুত্রের বুকে অস্ত্রাঘাত করা কত মৰ্মান্তিক!’ 

দুর্যোধনের অপমান দ্রোণের বুকে খুব করে লেগেছিল। সেই বেদনা আর অপমানের জায়গা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন-রাত্রি যুদ্ধ শুরু করবেন তিনি। অর্থাৎ যুদ্ধ রাত্রি আর দিনব্যাপী অবিরত চলতে থাকবে। এ রকম যুদ্ধ আগে কখনো ভূ-ভারতে হয়নি। 

কিন্তু রাত্রি-যুদ্ধে কৌরবদের কাল হয়ে উঠল ভীমপুত্র ঘটোৎকচ। রাক্ষসীর গর্ভে জন্ম ঘটোৎকচের। রাক্ষসরা নিশাচর। ফলে রাত্রিকালীন যুদ্ধ ঘটোৎকচকে সুবিধা করে দিল। তার হাতে শতসহস্র কুরুসেনা মারা যেতে লাগল। 

নিরুপায় দুর্যোধন কর্ণের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘটোৎকচকে দমন করার জন্য কর্ণের সাহায্য চাইল। 

কর্ণ বলল, ‘ওই রাক্ষসটাকে হত্যা করার উপায় আছে। একাঘ্নী বাণ।’ 

‘মানে!’ বিস্মিত দুর্যোধন জানতে চাইল। 

‘আমার কাছে একাঘ্নী নামে একটা বাণ আছে। অমোঘ এটা। যাকে লক্ষ করে ছুড়ব, তার মৃত্যু অবধারিত।’ 

‘তাই করো বন্ধু। ওই একাঘ্নীর আঘাতে রাক্ষসটাকে হত্যা করো।’ 

 ‘তা হয় না দুর্যোধন। আমি বাণটি সযত্নে অর্জুনের জন্য তুলে রেখেছি। সুযোগে আর সময়ে আমি অর্জুনের বক্ষ বিদীর্ণ করব, তার ভবলীলা সাঙ্গ করব।’ 

অদূরদর্শী দুর্যোধন বলে উঠল, ‘অর্জুনবধের ব্যাপারে পরে ভাবা যাবে কর্ণ। এখন ঘটোৎকচের হাত থেকে কৌরবদের রক্ষা করো। একাঘ্নী দিয়ে রাক্ষসটার বক্ষ বিদীর্ণ করো।’ 

‘তোমার এ পরামর্শ ভুল দুর্যোধন। তোমার মধ্যে এই মুহূর্তে দূরদর্শিতার অভাব দেখছি। তোমাদের সবচাইতে বড় শত্রুটির নাম অর্জুন, ঘটোৎকচ নয়।’ 

হঠাৎ কর্ণের হাত ধরে ফেলল দুর্যোধন। কাতর কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ভুবনবিখ্যাত ধনুর্ধর কর্ণ। তোমার নামে ত্রিভুবন কাঁপে। একাঘ্নী ছাড়াও তোমার তৃণে কত ক-ত বাণ! সব কটা কালান্তক! ওদের একটা দিয়ে অর্জুনের ভবলীলা সাঙ্গ করার ক্ষমতা রাখ তুমি। আজ এই রাত্রিতে রাক্ষসটার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো বন্ধু। 

দুর্যোধনের অনুরোধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একাঘ্নীবাণের আঘাতে ঘটোৎকচকে হত্যা করল কৰ্ণ I এতে কুরুদের আপাত লাভ হলো। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদেরই ক্ষতি হয়ে গেল সবচাইতে বেশি। অর্জুনের মৃত্যুসম্ভাবনা একেবারেই থাকল না আর। 

রাত্রি-দিনের যুদ্ধে পাণ্ডবসৈন্যরা ভীষণভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ঘটোৎকচের হত্যা তাদের ক্লান্তি আর বিষণ্নতাকে আরও বাড়িয়ে তুলল। সমস্ত সেনাবাহিনী ঘুমের জন্য কাতর হয়ে পড়ল। দিশা হারাল তারা। নিদ্রাচ্ছন্ন সেনারা স্বপক্ষীয়দের গায়ে আঘাত করতে শুরু করল। এই অবস্থায় অর্জুন জোর করে যুদ্ধ বন্ধ করে দিল 

পাণ্ডবসেনারা চিৎকার করে কুরুসেনাদের জানিয়ে দিল যে তারা অস্ত্র ত্যাগ করছে। কৌরবসেনাদেরও একই অবস্থা। তারা ক্লান্ত ও তন্দ্রাচ্ছন্ন। যুদ্ধ বন্ধের জোর দাবি জানাল তারা। বাধ্য হয়ে দ্রোণাচার্য সৈন্যদের দাবি মেনে নিলেন।

এতে চটে গেল দুর্যোধন। দ্রোণকে রুক্ষস্বরে বলল, ‘শত্রুপক্ষকে এভাবে বিশ্রামের সুযোগ করে দেওয়া কি আপনার উচিত হয়েছে? এই যুদ্ধে আমাদের ক্ষতি হয়েছে বেশি। রাতের যুদ্ধে যা-ও জয় পাওয়ার একটু সুযোগ এলো, তাও বন্ধ করে দিলেন আপনি! আপনি কি জানেন না, বিশ্রামের সুযোগ পেলে পাণ্ডবপক্ষ আরও বলবান হয়ে উঠবে? আপনি অদ্বিতীয় ধনুর্ধর। আপনি বারবার পাণ্ডবপক্ষের সুযোগ করে দিচ্ছেন! কেন করছেন এমন? ওরা আপনার শিষ্য বলে করছেন, নাকি আমার ভাগ্য খারাপ বলে করছেন?’ 

দুর্যোধনের কথা শুনে ভীষণ বিরক্ত হলেন দ্রোণ। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘এই বুড়ো বয়সে যা করছি, আমার সাধ্যমতো করছি। তুমি কি বলো, যে-মানুষগুলো নিদ্রায় কাতর হয়ে অস্ত্রত্যাগ করেছে, তাদের বধ করি আমি? আমি কি অমানুষ? আমার কি মানবতা, স্নেহ, ভালোবাসা বলে কিছুই নেই? তুমি যা বলবে. মন্দ হলেও তাই করতে হবে আমাকে? 

দুর্যোধন বলল, ‘অর্জুনের প্ররোচনায় যুদ্ধ বন্ধ করেছেন আপনি।’ 

‘তুমি কি মনে কর—দিবারাত্রির যুদ্ধে অর্জুন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে? কিছুতেই নয়। আমি অর্জুনকে জানি—এ রকম যুদ্ধ বছর ধরে চললেও বিপন্ন হওয়ার পাত্র অর্জুন নয়। 

অর্জুনের প্রশংসা শুনে দুর্যোধনের গা জ্বলে উঠল। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘অর্জুনের ভাবনা আপনাকে ভাবতে হবে না। অর্জুনকে শেষ করার জন্য আমি আছি, দুঃশাসন আছে, কর্ণ আছে, শকুনি মামা আছে। আপনি শুধু মূল যুদ্ধটা পরিচালনা করে যান।’ 

বিদ্রূপ করে দ্রোণ তখন বলে উঠলেন, ‘তা-ই ভালো দুর্যোধন। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে তুমি যাও। তবে হ্যাঁ, একা যেয়ো না। সঙ্গে তোমার মামা পাশাড়ে শকুনিতে নিয়ে যেয়ো। ও হারিয়ে দিয়ে আসবে অর্জুনকে। তুমি বহুবার বলেছ দুর্যোধন—তুমি, কর্ণ আর দুঃশাসন মিলে পাণ্ডবদের হারানোর ক্ষমতা রাখো। আজ সুযোগ এসেছে। যাও অর্জুনকে হত্যা করে কুরুসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করো।’ বলে সেখানে আর দাঁড়ালেন না দ্রোণ। 

সাতাত্তর 

রাতের তিন ভাগ তখন কেটে গেছে। এক ভাগ বাকি। 

দুর্যোধনের কথায় দুর্দম্য রাগ হয়েছিল দ্রোণের। সেই রাগের মাথায় রাত্রির যুদ্ধকে পুনরায় উন্মুক্ত করে দিলেন। 

শেষ রজনীতে মশাল জ্বালিয়ে ধুন্ধুমার যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। দুর্যোধনের কাছে অপমানিত হয়ে দ্রোণাচার্য সেই রাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন। মূল লক্ষ্য পাঞ্চালসৈন্য। দ্রোণ যখনই ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন, তাঁর লক্ষ্য হয়েছে ওই পাঞ্চালরাই। পাণ্ডবরা নয়। যুধিষ্ঠিরকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ধরেননি। ভীম-নকুল-সহদেবকে তিনি কখনো মারণাস্ত্রের আওতায় আনেননি। অর্জুনকে তো নয়ই! উপরন্তু পাণ্ডবরা তাঁর কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে। সেনাপতি হিসেবে দ্রোণের উদ্দেশ্য ছিল- পাঞ্চালসৈন্য ধ্বংস করা। দুর্যোধনের সম্মুখে বারবার শপথও নিয়েছেন তিনি-আমি পাঞ্চালসৈন্যদের শেষ না করে দেহ থেকে বর্ম খুলব না। ভীষ্ম আর দ্রোণ— দুজনের কেউই পাণ্ডবনিধনের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেননি দুর্যোধনের কাছে। দুর্যোধন সেটা লক্ষ করলেও খুব বেশি আমলে নেয়নি। ভেবেছে—এই দুই মহারথী যদি পাণ্ডবসেনা এবং পাঞ্চালসেনাদের খতম করে, তা হলে পাণ্ডবদের হত্যা করা বা ধরা সহজ হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। 

সকাল হলো। পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধের সকাল। 

কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ ভীতিকর রূপ নিল। অর্জুন আর কর্ণের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ লেগে গেল। দুজনের যুদ্ধের ভয়ংকরতা দেখে উভয়পক্ষের সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করে দর্শকের ভূমিকা নিল। উভয়ের নিক্ষিপ্ত বাণবর্ষণে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। 

মৎস্য ও পাঞ্চালদেশীয় বীরদের সঙ্গে দ্রোণের ঘোরতর যুদ্ধ চলছিল। মৎস্যরাজ বিরাট এবং পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করে বসল। দ্রোণ তিন তীক্ষ্ণ বাণে দ্রুপদের তিন পৌত্রকে বধ করলেন। পৌত্রদের হারিয়ে রাজা দ্রুপদ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বিরাট ও দ্রুপদ একজোট হয়ে দ্রোণকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করে বসল। কিন্তু দ্রোণ ছিলেন পরাক্রমশালী। এই দুই রাজার চেয়ে বহুগুণে রণদক্ষ। তাঁর রণদক্ষতার সামনে শেষ পর্যন্ত বিরাট-দ্রুপদ টিকতে পারল না। এই দুইজনকে লক্ষ করে দ্রোণ পর পর দু-বার ভল্লক্ষেপণ করলেন। ভল্লাঘাতে পাণ্ডবদের দুই শুভানুধ্যায়ীর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটল। 

যুদ্ধ তখন এমন ভীষণ প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করেছিল যে, এই দুই মহাবীরের পতনে শোক প্রকাশ করারও অবকাশ পেল না পাণ্ডবপক্ষ। এমনকি পাঞ্চালরাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন ও প্রবলভাবে শোকগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ থামাল না। 

তখন দ্রোণ আর অর্জুন মুখোমুখি হলেন একবার। দ্রোণ অর্জুনকে এড়িয়ে শুধু পাঞ্চালসেনাদের হত্যা করে চললেন। নিধনযজ্ঞে দ্রোণ এমনই মেতে উঠেছিলেন যে পাণ্ডবপক্ষের কেউই তাঁকে প্রতিরোধ করতে পারছিল না। পাঞ্চালদের সংখ্যা দ্রুত কমতে শুরু করেছিল। 

এইভাবে পাঞ্চালনিধন চলতে থাকলে যুদ্ধজয় সুদূরপরাহত হয়ে যাবে—ভাবল পাণ্ডবরা। দ্রোণ যদি আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন, পাণ্ডবদের সর্বনাশ হয়ে যাবে আজ—ভাবল কৃষ্ণ। 

দ্রুত পাণ্ডবরা নিরাপদস্থানে একত্রিত হলো। কৃষ্ণের পরামর্শেই এই একত্রীকরণ। তাৎক্ষণিক পরামর্শের প্রয়োজন। দ্রোণাচার্যকে থামিয়ে দেওয়ার পরামর্শ। দ্রোণকে অস্ত্রত্যাগ করানোর কৌশল উদ্ভাবনের মন্ত্রণা এটি। 

যুদ্ধে দ্রোণের ভয়াবহ মূর্তি দেখে প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল কৃষ্ণের। চালাকি করে যুদ্ধারম্ভের আগে ভীষ্ম দ্রোণের কাছে যুধিষ্ঠিরকে পাঠিয়েছিল কৃষ্ণ। উদ্দেশ্য—এঁদের মনোরঞ্জন করা। ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপের মনোরঞ্জনে সক্ষমও হয়েছিল যুধিষ্ঠির। ফিরে কৃষ্ণকে বলেছিল যুধিষ্ঠির, দ্রোণের মৃত্যুকৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন- মিথ্যে কথা। আমাকে মিথ্যে কথায় ভোলাতে পারলে আমার মৃত্যু হবে। 

চট করে দ্রোণাচার্যের এই কথাটা স্মরণে এসেছিল কৃষ্ণের। তাই যুদ্ধরত পাণ্ডবদের জরুরিবার্তা পাঠিয়ে কুরুক্ষেত্রের এই নিরাপদ স্থানে একত্রিত করেছে। 

কৃষ্ণ ভেবে গিয়েছিল— কী সেই মিথ্যে কথা, যা শুনলে দ্রোণ অস্ত্রত্যাগ করবেন? কে বলবে মিথ্যে কথাটি? তার চেয়ে বড় কথা কোন কথাটি বললে তিনি মর্মাহত হবেন? আর সেটি মিথ্যে কথাই-বা হবে কেন? 

তবে কৃষ্ণ এটা বুঝে গেল যে যে-কথাটি শুনলে অস্ত্রগুরু হাহাকার করে উঠবেন, সেই সংবাদটি হবে কঠিন এবং মর্মবিদারী। সে কি কোনো মানুষের মৃত্যুসংবাদ? প্রিয় স্বজন? যার মৃত্যুসংবাদ শুনলে তাঁর 

বুকে শক্তিশেল আঘাত করবে? কে সে? অকস্মাৎ দ্রোণনন্দন অশ্বত্থামার কথা মনে পড়ে গেল কৃষ্ণের। ছলচাতুরির মধ্যেই কৃষ্ণের জীবনযাপন। কূটচাল, মিথ্যে, হটকারিতা, ওপরচালাকি, ধাপ্পাবাজি- এসব কৃষ্ণের চারিত্র্য। ওই চরিত্রবৈশিষ্ট্যের একটি তাকে পথ দেখাল। ধাপ্পাবাজি তার নাম। 

সবার সামনে কৃষ্ণ বলল, ‘দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বের আজ পঞ্চমদিন। পিতামহের দশদিনের সেনাপতিত্বে আমাদের যে সেনা ও অস্ত্র ক্ষয় হয়েছিল, বিগত পাঁচদিনে তার অধিক ধ্বংস আমাদের পক্ষে হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রদক্ষতার কারণে। এইভাবে আর দিনদুয়েক চললে কুরুক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হবে আমাদের।’ 

এই সময় ভীম বলে উঠল, ‘তাঁকে থামিয়ে দিতে হবে। যে করেই হোক গুরুদেবকে হত্যা করতে হবে।’ 

‘কিন্তু কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল কৃষ্ণ!

‘সে উপায় তো আমার জানা নেই!’ 

‘আমার জানা আছে।’ বলল কৃষ্ণ। 

যুধিষ্ঠির উৎফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার জানা আছে?’ 

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, ‘অর্জুনই পারত, দ্রোণকে থামিয়ে দিতে। কিন্তু অস্ত্রগুরু বলে, আমি জানি, অস্ত্রগুরু পিতার সমান বলে অর্জুন দ্রোণের বিরুদ্ধে কালান্তক অস্ত্র তুলবে না।’ 

ভীম বলল, ‘তা হলে?’ 

‘উপায় একটা আছে। যুধিষ্ঠির তা জানে।’ বলল কৃষ্ণ। 

‘উপায় আছে! আর সেই উপায় আমি জানি! কী আবোলতাবোল বকছ তুমি কৃষ্ণ?’ বিভ্রান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল যুধিষ্ঠির। 

এবার কৃষ্ণ কণ্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বলল, ‘তোমার কি মনে পড়ে দাদা, যুদ্ধ শুরুর দিনে তুমি কুরুবৃদ্ধদের কাছে আশীর্বাদ চাইতে গিয়েছিলে? সেদিন তোমাকে দ্রোণাচার্য কী বলেছিলেন মনে পড়ে?’ 

হঠাৎ সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল যুধিষ্ঠিরের। সেদিন আচার্য বলেছিলেন, কোনো মর্মান্তিক কঠিন কথা তাঁকে শোনালে তাঁর মৃত্যু হবে। 

যুধিষ্ঠির দ্রুত বলে উঠল, ‘মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথায় তাঁকে বিভ্রান্ত করার কথা বলেছিলেন আচার্য।’ 

কৃষ্ণ লাফিয়ে উঠে বলেছিল, ‘ঠিক তা-ই। কিন্তু কোন মিথ্যে কথাটা শুনলে তিনি মর্মাহত হবেন? কোন প্রিয়বস্তু সম্পর্কে কঠিন কথা শুনলে তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়বেন?’ 

পাঁচ ভাই-ই কৃষ্ণের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। কৃষ্ণের কথার ইঙ্গিতটুকু ধরতে পারল না তারা। 

বুঝতে পারল কৃষ্ণ। রহস্যময় গলায় বলল, ‘এই মুহূর্তে এই জগতে দ্রোণাচার্যের সবচাইতে প্রিয়জন কে?’ 

অর্জুন বুঝি এখন কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। তার বুকটা হঠাৎ করে কেঁপে উঠল কৃষ্ণ তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মৃদু কণ্ঠে অর্জুন বলল, ‘অশ্বত্থামা।’ 

কৃষ্ণ হিসানো গলায় বলল, ‘ঠিক ধরেছ অর্জুন। এখন দ্রোণকে গিয়ে বলতে হবে-আমরা অশ্বত্থামাকে হত্যা করেছি।’ 

‘কিন্তু অশ্বত্থামা তো এখনো দোর্দণ্ডপ্রতাপে পাণ্ডবসেনা বধ করে যাচ্ছে! তার অস্ত্রদক্ষতা এমন যে একমাত্র গুরুদেবই তাকে পরাজিত করতে পারবেন! অন্য কেউ নয়! বধ তো দূরের কথা! ‘ বলল অর্জুন। 

‘অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে-এই কথাটা বলবার জন্য অশ্বত্থামাকে হত্যা করতে হবে কেন?’ বলল কৃষ্ণ। 

ভীম বলল, ‘তা হলে!’ 

‘প্রতারণা করতে হবে দ্রোণের সঙ্গে। তাঁর সামনে গিয়ে মিথ্যে বলতে হবে। বলতে হবে—আপনার পুত্র অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে।’ একজন ধুরন্ধর চালবাজের কণ্ঠে বলে গেল কৃষ্ণ।

‘প্রতারণা করতে হবে? মিথ্যে বলতে হবে? গুরুর সঙ্গে? তাও বাঁচা-মরার প্রবঞ্চনা?’ মৰ্মাহত কণ্ঠে বলল অর্জুন। 

কৃষ্ণ চিকন চোখে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দ্রোণের সঙ্গে প্রবঞ্চনা না করলে তাঁকে পৃথিবী থেকে সরানো যাবে না। তিনি জীবিত থাকলে তোমাদের কখনো জয়লাভ হবে না।’ 

‘তাই বলে জঘন্য মিথ্যে বলে অস্ত্রগুরুকে প্রতারণা করতে হবে?’ জিজ্ঞেস করল যুধিষ্ঠির। 

‘হ্যাঁ, তাই করতে হবে। এবং তাঁর সামনে গিয়ে মিথ্যেটা বলতে হবে তোমাকেই।’ বীভৎস, অন্যায্য, অমানবিক কথাটা বলতে কৃষ্ণের কণ্ঠ কাঁপল না। 

আটাত্তর 

হাহাকার করে উঠল যুধিষ্ঠির, ‘এ কী বলছ তুমি কৃষ্ণ! শেষ পর্যন্ত গুরু হত্যার কারণ হতে বলছ তুমি আমায়!’ 

ভীম বলে উঠল, ‘তাতে কী হয়েছে? তুমি তো আর সরাসরি আচার্যকে হত্যা করছ না? সামান্য মিথ্যে বলছ শুধু!’ 

‘না না। তা আমাকে দিয়ে হবে না। গুরুবধের নিমিত্ত আমি হতে পারব না।’ করুণ কণ্ঠে বলল যুধিষ্ঠির। 

ভীম এবার গর্জে উঠল, ‘এই যুদ্ধটা তো বাধিয়েছ তুমিই দাদা। জুয়ার নেশায় পড়ে আমাদের সর্বস্বান্ত করেছ! নিজে রাজ্যহারা হয়েছ! এমনকি দ্রৌপদীকেও বাজি ধরেছ! তারপর কী করেছ? যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছ আমাদের! তোমার কারণে আজ ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ নারী স্বামী হারাচ্ছে, হারাচ্ছে পুত্র, বাবা, মামা, কাকা, প্রেমিক, জেঠাকে। আমাকে দিয়ে যে জতুগৃহে ছয় ছয়জন নিষাদকে হত্যা করিয়েছিলে, তখন কোথায় ছিল তোমার এই নীতিজ্ঞান? শুধু তো নিষাদদের নয়, পুরোচনকেও সপরিবারে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলে তুমি আমায়। তখন তোমার মানবিকতা কোথায় গিয়ে মুখ ঢেকেছিল? এই সেদিনই তো ধাপ্পাবাজি কাজটি করলে তুমি! প্ৰণাম জানাতে গেলে কুরুবৃদ্ধদের, আসার সময় কী করলে? দুর্যোধনভ্রাতা যুযুৎসুকে সসৈন্যে প্রতারণামূলক কথা বলে বাগিয়ে আনলে! কোথায় ছিল তখন তোমার ন্যায়বোধ? আর আজ কৃষ্ণ যখন বলছে, সামান্য মিথ্যে কথা বলতে, ধর্মপুত্র সাজছ তুমি! এমন ভাব করছ যেন কোনোদিন কাউকে মিথ্যে বলোনি, কারও সঙ্গে প্রতারণা করোনি। 

‘থাম তুমি ভীম, থাম এখন। এসব কী বলছ তুমি! এসব কথা কি এখন বলার সময়।’ বল কৃষ্ণ। 

কৃষ্ণের কথা কানে তুলল না ভীম 

গরগরে কণ্ঠে বলল, ‘আমি যাচ্ছি দ্রোণের সামনে। তাকে গিয়ে বলছি—অশ্বত্থামাকে আমি এই মুহূর্তে নিধন করে এসেছি। একবার নয়, প্রয়োজন হলে শতবার বলব এই মিথ্যে কথাটি, দ্রোণের সামনে গিয়ে।’

বলে দ্রুত রথে চড়ে বসল ভীম। যেদিকে দ্রোণ যুদ্ধ করছেন, সারথিকে সেদিকে রথ ছুটাবার জন্য নির্দেশ দিল। 

যেতে যেতে অদ্ভুত এক কাজ করে বসল ভীম 

অবন্তী দেশীয় রাজা ইন্দ্রবর্মা পাণ্ডবপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করছিল। ইন্দ্রবর্মা গজারোহী। তার হাতিটির নাম-অশ্বত্থামা। দ্রোণের দিকে যেতে যেতে ইন্দ্রবর্মার হাতি অশ্বত্থামার মাথা লক্ষ করে গদার প্রচণ্ড এক বাড়ি মারল ভীম। এক বাড়িতেই অশ্বত্থামা অক্কা পেল। মুহূর্তকাল সেখানে দাঁড়াল না ভীম। অশ্বত্থামা থেকে পতিত ইন্দ্ৰবৰ্মা ভ্যাবাচ্যাকা চোখে ভীমের গতিপথের দিকে তাকিয়ে থাকল। 

ভীম রথ ছুটিয়ে যুদ্ধরত দ্রোণাচার্যের সামনে উপস্থিত হলো। দ্রোণ যাতে শুনতে পান, এ রকম চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভীম বলতে থাকল, ‘অশ্বত্থামা মারা গেছে। অশ্বত্থামার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।’ 

ভীমের মুখে কথাটা শোনার পর দ্রোণাচার্যের মনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হলো। তাঁর হাত-পা সামান্য অবশ অবশ লাগল। কিন্তু ধৈর্য হারালেন না তিনি। দ্রোণ জানেন, তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা মহাধনুর্ধর। তার অস্ত্রক্ষমতা অর্জুনের সমকক্ষ। সেই অশ্বত্থামাকে সামান্য গদাযোদ্ধা ভীম হত্যা করেছে—বিশ্বাসযোগ্য নয় তাঁর কাছে। তিনি ধরে নিলেন— এ ভীমের মিথ্যাচার। অশ্বত্থামা বহালতবিয়তে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এই ভাবনা তাঁর মনে নতুন শক্তি জোগাল। ক্ষণিকের হারানো চেতনা ফিরে এলো দ্রোণাচার্যের। নতুন শক্তি আর উদ্দীপনায় পাণ্ডবসৈন্য নিধনে মনোনিবেশ করলেন তিনি। 

দুর্দম্য প্রতিশোধস্পৃহায় দ্রোণাচার্য আবার পাঞ্চালহত্যায় মগ্ন হলেন। দ্রোণের অস্ত্রাঘাতে শত শত সৈন্য ধরাশায়ী হতে লাগল। 

নিরুপায় কৃষ্ণ ভীমকে আবার দ্রোণাচার্যের কাছে পাঠাল। ভীম দ্রোণের সামনে রখোপরে দুই বাহু তুলে নাচতে নাচতে বলতে থাকল, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন আর না-করুন আচাৰ্য, সত্য এটা যে অশ্বত্থামা আমার হাতে নিহত হয়েছে।’ 

দ্রোণের হৃদয় আবার কেঁপে কেঁপে উঠল। অশ্বত্থামা বেঁচে আছে তো! এই ভীমটির কথা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে আসছেন- ভীমের বিবেচনাশক্তি কম। অবিমৃষ্যকারী। দেহশক্তিকে একমাত্র শক্তি বলে ভেবে এসেছে সে। তার মধ্যে ন্যায়বোধ খুব কম দেখেছেন তিনি। প্রয়োজনে হিংস্র হতেও দেখেছেন ভীমকে। ফটাফট মিথ্যে বলতে মুখে আটকাতো না তার। আজও সেরকম কোনো মিথ্যে বলছে না তো ভীম? তাঁকে দুর্বল করবার জন্য এ তার কোনোরকম চালাকি নয় তো? 

ভাবতে ভাবতে ভীমের দিকে আবার তাকালেন আচার্য। দেখলেন- যথাপূর্বং ভীম নেচে যাচ্ছে আর বলে যাচ্ছে—অশ্বত্থামা আমার হাতে…। অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। নিজেকে কঠোর হাতে দমন করলেন দ্রোণ। 

উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না বৃকোদর। এই কথাটা যদি যুধিষ্ঠির এসে আমাকে বলে, তা হলে বিশ্বাস করব। আমি যুধিষ্ঠিরকে জানি। সে মিথ্যে বলে না। তিন ভুবনের সমস্ত ঐশ্বর্যের প্রলোভন দেখালেও যুধিষ্ঠির মিথ্যে বলবে না।’ 

রথের ওপরে আরও জোরে নেচে উঠল ভীম। সারথিকে বলল, ‘রথ দ্রুত কৃষ্ণের কাছে নিয়ে যাও।’

কৃষ্ণসন্নিধানে এসে ভীম সব কথা খুলে বলল। 

কালবিলম্ব না করে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে বলল, ‘এখন পাণ্ডবদের জয়-পরাজয় তোমার হাতেই দাদা।’ 

‘বুঝলাম না। খুলে বলো।’ বলল যুধিষ্ঠির। 

ভীম আর দ্রোণের মধ্যে সংঘটিত ঘটনার বিবরণ দিল কৃষ্ণ। 

যুধিষ্ঠির না না করে উঠল। বলল, ‘এত বড় পাপ আমি করতে পারব না। এ রকম জঘন্য মিথ্যে কথা আমি বলতে পারব না কৃষ্ণ।’ 

এ যুদ্ধ যেন তারই যুদ্ধ, এই যুদ্ধে পরাজিত হওয়া যেন তারই সর্বনাশ হয়ে যাওয়া-এ রকম কণ্ঠে কৃষ্ণ বলে উঠল, ‘এ কী বলছ তুমি দাদা! সামান্যই তো কথা! এই একটু আগে ভীম ইন্দ্রবর্মার হস্তিকে হত্যা করেছে—অশ্বত্থামা তার নাম। তুমি সেই কথাটিই উঁচু গলায় বলো—অশ্বত্থামা হত হয়েছে। না না, হাতিটির কথাও উল্লেখ করবে। শুধু কণ্ঠকে একটু নিচে নামিয়ে।’ 

‘অনেক করেছ কৃষ্ণ। জয়ের জন্য বহু মিথ্যের জাল বিছিয়েছ তুমি আগে। এবার অন্তত থেমে যাও। বৃদ্ধটিকে হত্যার প্ররোচনা আমাকে দিয়ো না তুমি কৃষ্ণ।’ 

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে ভীম গরগর করতে লাগল। অর্জুন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল। 

কৃষ্ণ বলল, ‘দেখ দাদা, দ্রোণাচার্য যদি আর আধবেলা যুদ্ধ করেন, তা হলে আর কেউ বেঁচে থাকবে না। এখন শুধু তুমিই পার সকলের প্রাণ বাঁচাতে। তোমার একটা মিথ্যা উচ্চারণে যদি এতগুলো জীবন বাঁচে, সে মিথ্যা তো মিথ্যা নয় দাদা। সে মিথ্যা তো সত্যের চেয়েও উত্তম দাদা!’ 

ভীম বলে উঠল, ‘আমি বারবার চিৎকার করে বললাম, অশ্বত্থামা মারা গেছে, আপনি যুদ্ধ থেকে বিরত হোন। বিশ্বাস করলেন না আচার্য। বললেন, যুধিষ্ঠির বললে বিশ্বাস করব।’ 

হঠাৎ কোনোদিন যা করেনি, তা-ই করে বসল ভীম। যুধিষ্ঠিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। বলল, ‘তোমাকে সকলে সত্যবাদী বলে জানে। দ্রোণ বিশ্বাস করেন, তোমার প্রাণ যাবে, তবুও মিথ্যে বলবে না তুমি। এই সুযোগটা নাও তুমি দাদা। অশ্বত্থামার বধের সংবাদটি আচার্যের সামনে গিয়ে বলো।’ 

হঠাৎ রাজি হয়ে গেল যুধিষ্ঠির। কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলতে হবে আমায়, শিখিয়ে দাও।’ 

কৃষ্ণ বলল, ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি কুঞ্জর। অশ্বত্থামা নামটি জোরে বলবে, কুঞ্জর শব্দটি একদম আস্তে উচ্চারণ করবে।’ 

তাই করেছিল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। মিথ্যের বেসাতি নিয়ে দ্রোণের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিল। বলেছিলও কৃষ্ণের শিখিয়ে দেওয়া কথা। 

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে দ্রোণাচার্য সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করলেন, তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে। একেবারেই ভেঙে পড়লেন আচার্য। অস্ত্রত্যাগ করে হতমান হয়ে ধনুকে মাথা ঠেকিয়ে রথের ওপর বসে পড়লেন তিনি। তাঁর শরীরে যুদ্ধ করবার আর শক্তি রইল না। 

এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন। তরবারি হাতে দ্রোণের রথের দিকে ধেয়ে গেল। অর্জুন-যুধিষ্ঠিরের সামনেই এক কোপে দ্রোণাচার্যের মাথাটি কেটে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করল ধৃষ্টদ্যুম্ন। 

ভূ-ভারতে অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু পুত্রাধিক প্রিয়তম ছাত্রের প্ররোচনায় তাদেরই সামনে শুভাকাঙ্ক্ষী গুরুর নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে কি না কে জানে! তাও আবার সত্যবাদী বলে খ্যাত যুধিষ্ঠিরের মিথ্যে বলার ইন্ধনে! 

উনআশি 

আচার্য দ্রোণের হত্যায় শোক, বিষাদ, স্তব্ধতা, বিপন্নতা কুরুশিবিরে আছড়ে পড়ল। 

দুর্যোধন একেবারেই বোবা হয়ে গেল। কথা বলার স্পৃহা হারিয়ে ফেলল সে। চিন্তার সকল সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল যেন তার! কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। 

পাণ্ডবদের এত বড় মিথ্যাচার! এত নিচে নামতে পারে তারা? তাদের ন্যায়বোধ, ধর্মানুরাগ কোথায় গেল। যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র না? ধর্ম ধর্ম করেই তো প্রজাদের মনজয়ের চেষ্টা করে গেছে সে এতদিন! আজ কোথায় গেল তার ধর্মচিন্তা? স্বার্থের মুখোমুখি হয়ে তার ন্যায়বোধ আর মানবিকতা কোথায় মুখ লুকাল? শাস্ত্রে তো বারবারই উল্লিখিত হয়েছে—পিতা আর শিক্ষাগুরু সমান। যে কটি পাপের জন্য মানুষ রৌরব নরকে যায়, তাদের প্রধানটির নাম তো পিতৃহত্যা আর গুরু হত্যা! যুধিষ্ঠির তো মিথ্যে কথা বলে গুরুহত্যায় অংশগ্রহণ করল! এটা তো পরোক্ষ হত্যা নয়! এটা তো প্রত্যক্ষ হত্যা! তাদের সামনেই তো আচার্যের মাথা কেটে নামাল ধৃষ্টদ্যুম্ন! আর ওই অর্জুনটা, প্রিয়তম ছাত্রই তো ছিল সে আচার্য দ্রোণের! দ্রোণ সেই কথটি বলতে সংকোচও করতেন না! নিজের অধিত বিদ্যার সবটুকু অর্জুনকে উজাড় করে দিয়েছিলেন দ্রোণ। পুত্র অশ্বত্থামাকেও সেরকম করে শেখাননি। শুধু তো তা-ই নয়, অর্জুনের মনোরঞ্জনের জন্য সর্বদা সতর্ক থাকতেন তিনি! একলব্যের কথাটি মনে পড়ে যাচ্ছে এখন দুর্যোধনের। শুধু অর্জুনের সন্তুষ্টির জন্য গুরু না হয়েও গুরুদক্ষিণা নিয়েছিলেন আচার্য। কী নিষ্ঠুরভাবেই না একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি! কী তৃপ্তির আভাটাই না ছড়িয়ে পড়েছিল অর্জুনের চোখেমুখে তখন। আজ সেই প্রিয় শিষ্য অর্জুনের সামনে গুরুর মাথাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করল দ্রুপদপুত্র। একটু আফসোসের ধ্বনিও বের হয়ে এলো না দুই ভাইয়ের মুখ থেকে। কৃষ্ণের কথা না-হয় ছেড়ে দেওয়া যাক! সে না-হয় প্রতারক, মিথ্যেবাদী, ধাপ্পাবাজ! 

দুর্যোধন ভাবছে আর তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পিতৃশোকের কথা ভুলে বিমূঢ় দৃষ্টিতে দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে আছে অশ্বত্থামা। কর্ণ দুর্যোধনকে আশ্বস্ত করবার কথা ভুলে গেছে। কৌরবরা দুর্যোধনকে ঘিরে করুণ স্বরে বিলাপ করে যাচ্ছে। 

একটা সময়ে শোক লাঘব হয়ে এলো দুর্যোধনের। আগামী দিনের সেনাপতি নির্বাচন করা জরুরি। 

সেরাতে নিজশিবিরে পরামর্শসভা ডেকেছিল দুর্যোধন। অশ্বত্থামা, কর্ণ, কৃপাচার্য, দুঃশাসন, কৃতবর্মা, শকুনি এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বীরকে সেই ইতিকর্তব্য-নির্ধারণী সভায় আহ্বান জানিয়েছিল। 

অন্যরা ঠিক সময়ে উপস্থিত হলেও অশ্বত্থামা আর কৃপাচার্যের আসতে একটু দেরি হচ্ছিল। দুজনেই আজ শোকাচ্ছন্ন। অশ্বত্থামা হারিয়েছে জন্মদাতাকে আর কৃপাচার্য হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র বোন কৃপীর স্বামীকে। দ্রোণাচার্যের হত্যায় দুজনের বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। দুজনেই পরমাত্মীয়কে হারিয়ে গভীরভাবে শোকাচ্ছন্ন। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন? কী বলে সান্ত্বনা দেবেন? শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না বলে পরামর্শসভায় উপস্থিত হতে বিলম্ব হচ্ছে তাঁদের। 

ইত্যবসরে কর্ণ দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘দ্রোণ কতটা বীর আর কতটা স্বার্থপর – নিরূপণ করতে পারছি না আমি। তিনি তোমার খেয়েছেন-পরেছেন ঠিক, কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকত পাণ্ডবশিবিরে। পাণ্ডবদের ক্ষতি হোক—এ রকম কোনো কাজ তিনি করেছেন বলে তোমার মনে পড়ে দুর্যোধন? আসলে এই পাঁচদিন পাণ্ডবদের পক্ষেই যুদ্ধ করে গেছেন দ্রোণ, তোমার পক্ষে নয়।’ 

দ্রোণের সঙ্গে কর্ণের সম্পর্ক ভালো ছিল না। কেউ কাউকে যথার্থ বীর বলেও মনে করতেন না। কিন্তু ভীষ্মের পর সেনাপতি নির্বাচনের সময় যখন এলো, কর্ণ নির্দ্বিধায় দ্রোণাচার্যের নাম প্রস্তাব করেছিল। বাইরে যা-ই হোক, অন্তরে দ্রোণকে শ্রদ্ধা করত কর্ণ। তাছাড়া এতদিন যা সমালোচনা করেছে কর্ণ, দ্রোণের সামনে করেছে, পেছনে কোনোদিন দ্রোণাচার্যকে অবহেলা দেখায়নি। আজ কী হলো কর্ণের কে জানে, দ্রোণের অবর্তমানে তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠল! 

কর্ণ আরও বলল, ‘দ্রোণের অস্ত্রত্যাগ করার ব্যাপারটি আমি মোটেই বুঝে উঠতে পারছি না। শত্রুপক্ষের একজন এসে বলল, আপনার পুত্র নিহত হয়েছে, অমনি বিশ্বাস করে বসলেন তিনি! যুধিষ্ঠির ঠিক বলছে কিনা, যাচাই করলেন না! যুধিষ্ঠিরের মতো মিথ্যেবাদী, জুয়াড়ির কথা বিশ্বাস করে অস্ত্রত্যাগ করার মধ্যে আমি দূরদর্শিতার কিছুই দেখছি না দুর্যোধন। উপরন্তু তোমাদের সঙ্গে দ্রোণাচার্যের বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ পাচ্ছি।’ 

এই সময় তাঁবুতে প্রবেশ করলেন কৃপাচার্য আর অশ্বত্থামা। কর্ণের শেষ বাক্যটি দুজনেই শুনতে পেলেন। দ্রোণের মৃত্যুতে এমনিতেই দুজনে বিপর্যস্ত। অশ্বত্থামা প্রথমে শোকে স্তব্ধ হলেও পরবর্তীকালে ক্রোধে টগবগ করে উঠেছিল। সে এবার কুরুপক্ষের সেনাপ্রধান হতে চায়। সেনাপতি হয়ে প্রথমেই সে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করবে, তারপর পাণ্ডবদের গঙ্গাজলে ডোবাবে! এই বাসনায় মামা- ভাগনে দুজনে দুর্যোধনশিবিরে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁবুতে প্রবেশ করতে করতে পিতা সম্পর্কে কর্ণের সমালোচনা শুনে ফেলল অশ্বত্থামা। 

ক্রোধোন্মত্ত অশ্বত্থামা কিছু বলবার আগেই কৃপাচার্য বলে উঠলেন, ‘অশ্বত্থামাকে পরবর্তী সেনাপ্রধান করবার জন্য প্রস্তাব করছি আমি দুর্যোধন।’ 

দুর্যোধনকে একটু অস্থির দেখাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে বলল না। 

কৃপ ধৈর্য হারিয়ে বললেন, ‘কিছু বলছ না কেন দুর্যোধন?’ 

দুর্যোধন অস্থিরতা কাটিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমি তো কর্ণকেই পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে মনে মনে স্থির করে ফেলেছি।’ 

চকিতে দুর্যোধনের মুখের দিকে তাকাল কর্ণ। তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

কৃপাচার্য দুর্যোধনের কথা মেনে নিলেন না। বললেন, ‘কর্ণের জন্য, শুধু কর্ণকে তোয়াজ করার জন্য অশ্বত্থামাকে উপেক্ষা করা তোমার উচিত হবে না দুর্যোধন। শোকসন্তপ্ত অবস্থায় অশ্বত্থামাকে সেনাপতি করলে তার পিতৃশোকের ভার কিছুটা কমবে। অন্যদিকে পিতৃহত্যার ক্রোধকে ব্যবহার করে সে পাণ্ডবদের সমূহক্ষতি করতে পারবে।’ 

অশ্বত্থামা বলে উঠেছিল, ‘আগামী দিনের যুদ্ধশেষে আপনি দেখবেন মহারাজ, পৃথিবী অর্জুনশূন্য আর কৃষ্ণহীন হয়ে গেছে।’ 

অশ্বত্থামার বাগাড়ম্বর শুনে, অশ্বত্থামার কথাকে বাগাড়ম্বরই মনে হলো কর্ণের, কৰ্ণ বলল, ‘এ রকম কথা মুখে বলা সহজ, কাজে করা কঠিন। আগে আগে কৌরবশিবিরে এ রকম কথা অনেকে বলেছেন, কার্যক্ষেত্রে কী হয়েছে, দেখতে পাচ্ছি আমরা। শোকার্তের কাজ চোখের জল ফেলা আর বীরের কাজ যুদ্ধে যাওয়া।’ 

তারপর দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তুমি অশ্বত্থামাকে চোখের জল ফেলে হৃদয়ভার কমানোর জন্য কয়েকটা দিন সময় দাও দুর্যোধন।’ 

একে তো পিতৃশোক, দ্বিতীয়ত সেনাপতিত্ব হাতছাড়া। তার ওপর কর্ণের অযাচিত উপদেশ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না অশ্বত্থামা। 

গর্জন করে উঠল, ‘ওরে সারথির বেটা কর্ণ, আমার নাম অশ্বত্থামা। চোখের জল ফেলতে উপদেশ দিচ্ছিস আমায়? কেন, আমার অস্ত্রগুলো কি নির্বীর্য হয়ে গেছে? আমি কি তোর মতো রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছি? আমি কি তোর মতো সূতপুত্র?’ 

কর্ণও চুপ করে থাকল না। কণ্ঠে ব্যঙ্গ ছড়িয়ে বলল, ‘আমি সূতপুত্র হই, যা-ই হই না কেন, আমি তো মহাবীরই! আর সূতের ঘরে জন্মগ্রহণ করা কি অপরাধ? সূতরা কি মানুষ নয়? মানুষের জন্মের ওপর তো কারও হাত নেই! জাতকুল না দেখে আমাকে দেখো। আমি যোদ্ধা হিসেবে কেমন, তার বিচার করো। 

কর্ণ থামল না। আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘তোর বাপ বেটা জাতে বামুন। বামুন হয়ে ধর্ম লংঘন করেছেন। বামুন হয়ে হাতে পুথি না তুলে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। আবার সেই অস্ত্র শত্রুপক্ষকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ত্যাগও করে বসলেন চরম মুহূর্তে। তোর বাবা ধৃষ্টদ্যুম্নের ভয়ে হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিয়েছিলেন কেন বলতে পারিস?’ 

অশ্বত্থামাও ছেড়ে দেওয়ার লোক নয়। সেও চিৎকার করে বলল, ‘আমার বাবা ভীতু ছিল, নাকি বীর ছিল, দুনিয়ার লোকে জানে তা। সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের মিথ্যে বয়ান বিশ্বাস করে আমার বাবা যখন অস্ত্র ত্যাগ করল, তুই কোথায় ছিলি তখন? তুই তো একটা কাপুরুষ ছাড়া আর কিছুই নস।’ 

কাপুরুষতার অভিযোগ শোনামাত্র কর্ণ জ্বলে উঠল একেবারে। রূঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমি কাপুরুষ, তাই না? আর তুই মস্তবড় বীর? তোর বাপের মূর্খামির কথা মনে পড়লে আমার গা রি রি করে ওঠে। ধৃষ্টদ্যুম্ন এসে চুল টেনে ধরল, আর উনি গলাটা বাড়িয়ে দিলেন! ছি ছি! দ্রোণের এ লজ্জা রাখি কোথায়?’ 

এরপর উভয়ের মধ্যে ধাওয়া, পালটা-ধাওয়া শুরু হয়ে গেল। অশ্বত্থামা কৃপাণ হাতে কর্ণের দিকে ধেয়ে গেল। কর্ণ তরবারি উন্মোচিত করল। কৃপাচার্য খড়গ হাতে কর্ণের সামনে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *